সতেরো
বিকেলবেলা সানী সাহেব সহিসকে ডেকে বললেন : গাড়ি বের কর।
তারপর অন্দরে এসে খদিজা বিবিকে জিগ্যেস করলেন : ছেলেরা কোথায়?
—ঘরেই আছে কোথাও।
রান্নাঘর থেকেই খদিজা বিবি জবাব দেন।
রান্নাঘরের দরজার সামনে সানী সাহেব একটু দাঁড়ালেন। অল্পকাল পর একটু হেসে বললেন : তুমি কি দিন-রাত রান্না নিয়েই থাকবে? আর কি কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই?
—বাঁদীকে পায়ে ঠাঁই দিয়েছেন, তাতেই সব সাধ পুরা হয়ে গেছে।
—আলমারি ভরা কাপড়-চোপড়, কখনো পরতেও দেখি নি।
কড়াইয়ের গোস্ত চাটু দিয়ে নাড়তে নাড়তে খদিজা বিবিও হেসেই জবাব দিলেন : কেন? এমনি বুঝি পছন্দ হয় না?
যে ঐভাবে এক পাশে ঘাড় কাত করে চোখের কোণ দিয়ে একটুখানি হেসে কথা বলতে পারে, তারই মুখে এই প্রশ্ন শোভা পায়—যে প্রশ্নের উত্তর সম্বন্ধে কোনো সংশয়ই থাকতে পারে না।
মেঘের মতো কালো চুল ঘাড়ের দু’পাশ দিয়ে কোলের ওপর নেবে এসেছে। উনুনের দগদগে আগুনের আভায় ফর্সা মুখখানি নববধূর মতোই রঙিন। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুক্তোর মতো ঝলমল করছে।
সানী সাহেব কিছুকাল নীরবে স্ত্রীর মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকেন।
স্বামীর মনোযোগ যে তিনি সর্বশরীর দিয়ে উপভোগ করছেন, খদিজা বিবির সর্বাঙ্গের ঈষৎ কম্পনই তার সাক্ষ্য দেয়।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয় ক্বচিৎ, আলাপ-আলোচনা আরো কম।
তাই একটু অবাক হয়েই খদিজা বিবি এবার জিগ্যেস করলেন : আজ আপনার হয়েছে কি? সানী সাহেব প্রশ্নটির সোজা জবাব দিলেন না। বললেন : তোমার ওপর কতদিন রাগ করেছি, সারাদিন ঘরে শিকল দিয়ে বন্ধ করে রেখেছি। মারধোরও যে করি নি, তা নয়। তবু তোমাকে তো কোনোদিন নালিশ করতে শুনি নি।
খদিজা বিবি হেসে ফেললেন। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বললেন : যে স্ত্রী স্বামীর হাতের মার খায় নি সে বড় হতভাগী। তাছাড়া কেবল মারটাই কি মনে আছে, আর কি কিছুই মনে পড়ে না? এই যে আলমারি ভরা এত গহনা-কাপড়, এসব এলো কোথা থেকে? মার না খেলে কি ওসব পেতাম?
—বাস্ গহনা-কাপড় পেয়েই সব জ্বালা ভুলে গেলে?
এবার কৌতুকভরা দুটি চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি এসে পড়ল সানী সাহেবের চোখের ওপর। মৃদু হেসে খদিজা বিবি বললেন : কেবল কি গহনা-কাপড়? আর কি কিছুই নয়? মনে নেই, রাগ করে দু’দিনের জন্য বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে কে বসেছিল? এদিকে দেখতে তো ইয়া পহলওয়ান!
সানী সাহেবও হেসে ফেললেন।
—আমার দিন তো ফুরিয়েই এলো। তাই ভাবছি।
—কি ভাবছেন?
সানী সাহেব হাসতে হাসতেই বললেন : ভাবছি, আমি মরে গেলে তুমি আবার নিকে করবে কি না। আর—
হঠাৎ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে সানী সাহেব নীরব হয়ে গেলেন।
শ্বেত পাথরের মতোই সাদা আর নিষ্প্রাণ সে মুখ।
—সত্যি! আজ আপনার হয়েছে কি?
এমন সময় কোথা থেকে দুই ছেলে নাসের আর আজিজ ছুটতে ছুটতে উপস্থিত। দুই দিক দিয়ে দুইজন মাকে দখল করল।
—আম্মা আম্মা নাস্তা!
সানী সাহেব সেখান থেকে চলে এলেন।
—বাইরে আমাদের জন্যও নাস্তা পাঠিয়ে দাও। জজ সাহেবও আসবেন।
খজিদা বিবি আর একবার স্বামীর দিকে তাকালেন। সানী সাহেব সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝলেন।
এই মেহমানদের জন্যই খদিজা বিবিকে সারাদিন রান্নাঘরে থাকতে হয়। তাঁর হাতের রান্না তামাম কলকাতায় মশহুর। আসেও লোকে কলকাতার চারদিক থেকে, খান বাহাদুরের বন্ধু- বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন।
জজ সাহেব চলে যাবার পর সানী সাহেবও উঠলেন।
দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি অপেক্ষমাণ ব্রুহামে গিয়ে উঠলেন। জুতা মোজা প্যান্ট শার্ট আর গ্যালিস পরা দুই ছেলে এক পাশে, খান বাহাদুর এক পাশে। মাঝখানে পায়ের কাছে বসে আছে বাড়ির এলসেশিয়ানটি।
হাওয়া খেতে চলেছেন। কোমেদান বাগান লেনের পথে যত লোক একবার করে সালাম দিতে লাগল।
গড়ের মাঠে পৌঁছে সানী সাহেব ছেলেদের ছেড়ে দিলেন। তিনি নিজেও ধীরে ধীরে পায়চারি করতে লাগলেন।
নাসের কখনো কুকুরটির পিছনে পিছনে দৌড়তে থাকে, কখনো কুকুর নাসেরের পিছনে দৌড়য়।
আজিজ ছোট। সে সবসময়ই অগ্রজ নাসেরের পিছনে ছুটতে থাকে—তার কেবলই ভয় হতে থাকে এই বুঝি কুকুরটি নাসেরকে কামড়ালো।
হ্যালো, খান বাহাদুর।
—হ্যালো!
–নমস্কার স্যার। ভালো আছেন?
—এই যে যতীন বাবু, আপনি কেমন?
কেউ বলে : হুজুর সালাম!
—সালাম সালাম!
দুই ছেলে নিয়ে খান বাহাদুর সাহেব কেল্লার ময়দানে বেড়াচ্ছেন। কিছুটা অন্যমনস্ক মাঝে মাঝে পরিচিত লোকজনদের সঙ্গে এক-আধটা বাক্য বিনিময়ও হচ্ছে। ধীরে ধীরে মাঠের ওপর অন্ধকার নেবে আসছে। ক্রীড়ারত বালক-বালিকার মুখরিত কণ্ঠ নিস্তেজ নিস্তব্ধ হয়ে আসছে।
এমন সময় অনতিদূরেই হাবিবকে দেখতে পেলেন। তিনিও বেড়াতে এসেছেন। হাবিবকে দেখে নাসের আর আজিজ বাপের কাছে ফিরে এলো। দুইজন বাপের দুই হাত ধরে হাবিবকে দেখতে থাকে। এই লোকটিকে তারা জ্ঞান হওয়া অবধি দেখে আসছে। একটা ঘরে চুপচাপ বসে পড়ছেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। কখনো কখনো নাসের আর আজিজকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন, তখনো একটি কথাও বলেন নি। তারাও তাঁকে এড়িয়েই চলেছে।
তারপর হঠাৎ কি ঘটল, সে সম্বন্ধে নাসের আর আজিজের পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু এক রকম করে তারাও বুঝে নিয়েছে এই লোকটির প্রতি তাদের পিতা বিরূপ।
খান বাহাদুর সাহেবকে দেখে হাবিব অন্যদিকে চলে গেলেন। খান বাহাদুর সাহেব ছেলেদের হাত ধরে আবার গাড়িতে এসে উঠলেন। একবার ‘হোয়াইটওয়ে লেডল’ যেতে হবে। ক’দিন ধরে মুনিরের জ্বর, তার জন্য একটা কম্বল কিনতে হবে। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর কাছে মানুষ। হালে বিয়েও দিয়ে দিয়েছেন। হাইকোর্টে চাপরাশির কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। ব্ৰুহাম চলছে। খান বাহাদুর সাহেবের মাথায় কতরকম চিন্তা। এই মুনিরেরই তিনি মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন।
নতুন বিয়ে দিয়েছেন। বৌ পছন্দ নয়, দুর্ব্যবহার করে।
খান বাহাদুর সাহেব সব লক্ষ্য করেন? কিন্তু কিছু বলেন না।
একদিন রাত্রে মুনিরের কামরা থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। তখন অনেক রাত। খান বাহাদুর দোতলা থেকে নেবে এলেন। মুনিরের বৌকে বললেন : তুমি একটু সরো তো মা।
তারপর আর কোনো কথা নেই। পায়ের খড়ম খুলে মুনিরের মাথায় এক বাড়ি। মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। মুনিরও কাটা ছাগলের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অল্পক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল মুনিরের গায়ে একশ’ চার ডিগ্রি জ্বর। কলকাতার সবচাইতে নাম করা ডাক্তার এলেন। ফ্র্যাঙ্ক রসের দোকান থেকে ওষুধ এলো। দিনের পর দিন যায়, জ্বর ছাড়ে না।
খান বাহাদুর পনের দিনের ছুটি নিলেন। দিন নেই রাত নেই মুনিরের মাথার কাছে বসে কেবল শুশ্রূষা। কখনো মাথায় বরফ দিচ্ছেন, কখনো বেডপ্যান সাফ করে দিচ্ছেন।—চোখে এক পলক ঘুম নেই।
বাড়িভরা চাকর, লোকজন, কারো সাহস নেই সাহেবকে বিরত করে।
মুনিরের যখন জ্বর ছাড়ল, তার মাথা তখন খান বাহাদুরের কোলে। মুনিরের মাথা সযত্নে বালিশের ওপর নাবিয়ে রেখে তিনি তার গালে একটা চুমু দিলেন।
—ছিঃ বাবা। বৌয়ের সাথে অমন ব্যবহার করতে নেই।
এইবার সানী সাহেব উঠলেন।
সেই মুনিরের আবার জ্বর এসেছে।
ম্যালেরিয়াই হবে, সানী সাহেব ভাবেন।
কম্বল কিনবার পর সানী সাহেব সহিসকে ভীম নাগের দোকানে যেতে আদেশ দিলেন।
তবক দেওয়া হলদে সন্দেশ : দিলখোশ!
দোকানে মালিক বেরিয়ে এলেন।
—কমিশনার সাহেব, সন্দেশ আজ দুপুরেই তৈরি। বেশি করে নিয়ে যান।
—ঠিক বলছ তো নরেন?
—আজ্ঞে মিথ্যে? তাও আপনাকে?
সন্দেশ নিয়ে খান বাহাদুর সাহেব বিদায় নিলেন।
দোকানের ভিতর থেকে কে একজন বলেন : লোকটা কে? একেবারে বাদশার মতো দেখতে।
ঘোড়ার ক্ষুরের ক্লিপ-ক্লপ ক্লিপ-ক্লপ তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেয়।