ষোলো
মামাবাড়ির সাথে এই উপন্যাসের নায়কের পরিবারের সম্পর্ক সঠিকমতো বুঝতে হলে এইখানে একবার পিছনের দিকে ফিরে দেখা আবশ্যক। এইখানে যে আখ্যায়িকার অবতারণা করতে চলেছি তা-ও লোকমুখেই শোনা। তবে ঘটনাগুলোকে এই উপন্যাসের প্রয়োজন অনুসারে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে হয়েছে।
আজ থেকে দুই পুরুষ আগেকার জামানায় আমাদের ফিরে আসতে হবে।
তেত্রিশ নম্বর কোমেদান বাগান লেনে তখন খান বাহাদুর আবদুস সানী সাহেবের বাস। তিনি কলকাতা পুলিশের এ্যাসিসটেন্ট কমিশনার। সেই বৃটিশ আমলের এ্যাসিসটেন্ট কমিশনার, বাঙালিদের মধ্যে প্রথম। যেমন তাঁর দাপট তেমনি প্রতাপ, তেমনি নামডাক।
সেই জামানায় কলকাতার রেড রোড ছিল শ্বেতাঙ্গদের খাস এলাকা। ‘আউট অফ্ বাউন্ডস টু ইন্ডিয়ান্স!’ শ্বেতাঙ্গ ছাড়া প্রবেশ নিষেধ, বিশেষ করে সন্ধ্যার পর
একদিন সন্ধ্যায় ফোর্ট উইলিয়ম থেকে সাড়ে ছ’ফিট লম্বা আর বিয়াল্লিশ ইঞ্চি চওড়া একটি লোক ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেরিয়ে এলো—সে সাহেব নয়।
অথচ কে বলবে সাহেব নয়।
ঘোড়সওয়ার আস্তে আস্তে রেড রোডের দিকে এগিয়ে এলো।
পাশের ময়দানে তখন বহু বাঙালি হাওয়া খাচ্ছিলেন। ঘোড়সওয়ার তাঁদের অনেকেরই পরিচিত। কিন্তু রেড রোডের দিকে যায় যে! পাশের লোকেরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এখুনি না জানি কি ঘটবে। রেড রোডে পা দেয়ার অপরাধে বহু বাঙালিকে পিঠের ছাল রেখে আসতে হয়েছে।
ঘোড়সওয়ার অকম্পিত, বেপরোয়া—সন্ধ্যার হাওয়ায় তার বুকটা আরো ফুলে ফুলে উঠেছে।
ঠিক সেই সময় এক বাঙালি সন্তানের কাতর চিৎকারে সন্ধ্যার বাতাস কেঁপে উঠল শ্বেতাঙ্গদের নির্যাতন।
ঘোড়সওয়ার রাশ টেনে ধরল!
আর্তনাদ অনুসরণ করে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল, লুঙ্গি পরা এক যুবকের ওপর। ভাবলেশহীন
মুখে ঘোড়সওয়ার নাবল।
—হ্যান্ডস অফ দি ম্যান।
—হোয়াই? উই থট ইউ ওয়ার এন ইংলিশম্যান!
—মাই নেম ইজ সানী। সন অফ আবদুল গফফার। ডাজ দ্যাট কনভে এনিথিং টু ইউ?
—সন অফ এ বিচ। দ্যাট কনভেজ দিজ।
এই বলে একজন হান্টার তুলল। হান্টার তার হাতেই থাকল, আবদুস সানী সাহেবটিকে ছোট ছেলের মতো দুই হাতে তুলে আছাড় দিলেন। রেড রোড সেই প্রথম শ্বেতাঙ্গের রক্তে লাল হলো।
সানী জিগ্যেস করলেন : আর ইউ হার্ট? নিড় এনি হেপ্?
সাহেব নিরুত্তর।
সানী লুঙ্গি-পরা ছেলেটিকে ঘোড়ায় তুলে নিলেন।
ততক্ষণে আশেপাশে লোক জড়ো হয়েছে। অবশ্য রেড রোডের সরহদ্দের বাইরেই সতর্ক সমাবেশ!
একজন বললেন : এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি। কেন বাবু, এত রাস্তা থাকতে রেড রোড দিয়েই চলতে হবে, এটা কেমন গোঁ!
আর একজন : তা বটে। সাহেবরা একটা নিয়ম করেছে, তো মানলে ক্ষতি কি। কথায় কথায় নিয়মভঙ্গ করলে শাসনকার্য চলে না।
তৃতীয় জন : খান বাহাদুর ধরে পিটেছে, বেশ করেছে। নিয়ম একটা করলেই হলো! হাইকোর্ট আছে না!
সানী কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র করলেন না। আবার ঘোড়ার পিঠে উঠে তেমনি অবিচলিতভাবে এগিয়ে গেলেন।
জনতাও এই বলে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল :
—চলো হে চলো। সাহেবটা লাশের মতো পড়ে আছে। আবার কোন ফ্যাসাদে পড়ব।
প্রহৃত ছেলেটির নাম হাবিব। দেশ বর্ধমান। কলকাতায় এসেছিল ভাগ্যান্বেষণে। তার পরই এই বিপত্তি।
হাবিবের জন্য সানী একটি কামরা ছেড়ে দিলেন। হগস্ মার্কেটে গিয়ে তার জন্য কাপড় কিনে আনলেন। অন্দরে বিশেষ করে বলে দিলেন হাবিবের খাওয়া-পরার কোনো কষ্ট যেন না হয়। তারপর হাবিবকে ক্যালকাটা মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন।
হাবিব অল্পকালের মধ্যেই ক্যালকাটা মাদ্রাসা থেকে ম্যাট্রিক এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই.এ, বি.এ পাস করলেন। তাঁর কপাল ভালো, নমিনেশনে ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে গেলেন।
তখন আব্বার বয়স দশ-এগারো। ব্রুহামে চড়ে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়তে যান। সাহেবদের বাচ্চার মতোই সাজ-পোশাক, টানা টানা চোখ-মুখ।
তারপর হাবিব বিয়ে করলেন, বর্ধমানের এক জমিদার-কন্যাকে। বিয়ের পরই সস্ত্রীক চলে যান নওগাঁ কর্মস্থলে।
সানী সাহেবের তখন বয়স হয়েছে, দুই ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় শরীরও ভেঙে পড়েছে। হাবিব লেখাপড়া করেন, কলেজ যাতায়াত করেন, এসব খবরই সানী সাহেব রাখেন। কিন্তু এর বেশি কোনো সম্পর্ক হাবিবের সঙ্গে থাকে না। তিনি নামাজ-রোজা আর মেহমানদের আপ্যায়ন নিয়েই থাকেন।
হাবিব ডিপুটি হয়ে বিয়ে করলেন; কিন্তু কনে নির্বাচনের ব্যাপারে সানী সাহেবের সঙ্গে কোনো পরামর্শই করলেন না। সানী সাহেবও কোনো কৌতূহল প্রকাশ করলেন না। বিয়ের উদ্যোগ চলতে থাকে; কিন্তু এক পাশের একটি কামরা থেকে হুঁকো টানার শব্দ ছাড়া সানী সাহেবের কাছ থেকে আর কোনো সাড়া আসে না।
বৌয়ের জন্য গহনা গড়িয়ে দিলেন, বরের বিয়ের পোশাকও কিছু কিছু তৈরি করে দিলেন—এমনকি দেনমোহর কত হওয়া উচিত তা-ও ঠিক করে দিলেন; কিন্তু তার বেশি না।
বরযাত্রী হয়ে নওশার সঙ্গে বর্ধমানও গেলেন না।
কোনো কোনো বন্ধু-বান্ধব হয়তো কখনো-সখনো হাবিবের আচরণের নিন্দা করে কিছু বলেন। সানী সাহেব একটা লম্বা ইজি চেয়ারে তাঁর বিরাট শরীর এলিয়ে দিয়ে একটু উদাস হয়ে বসে থাকেন। সে সম্বন্ধে কোনোই মন্তব্য করেন।
বছরখানেক বাদেই খবর পাওয়া গেল হাবিবের একটি মেয়ে হয়েছে। হাবিব একটি পোস্ট-কার্ডে দু’ছত্র লিখে সানী সাহেবকে খবর পাঠালেন। বহুদিন পর সানী সাহেবের মুখে হাসি দেখা গেল।
তিনি স্ত্রীকে বললেন : মেয়েটি খুশনসিব। এই শুনে রাখো আমার কথা।
সানী সাহেব ও খদিজা বিবি হাবিব-কন্যার জন্য গহনা, কাপড় আর খেলনা পাঠিয়ে দিলেন।
কিছুদিনের মধ্যেই হাবিব আলিপুরের সদর এসডিও হয়ে বদলি হয়ে এলেন।
হাবিব স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে আসবে, সানী সাহেব রোজ সেই আশায় বসে থাকেন।
কিন্তু হাবিব এলেন না।
মাস চারেক বাদে একটা ঘোড়ার গাড়ি তেত্রিশ নম্বর কোমেদান বাগান লেনের ফটকে এসে থামল!
গাড়ি থেকে নাবলেন আলিপুরের এসডিও সাহেব। পরনে কোট-প্যান্ট, এক হাতে একটা ছোট সুটকেস, ঠোঁটের ফাঁকে একটা সিগারেট। সোজা ওপরে উঠে গেলেন। তার আগে সিগারেটটা ফেলে দিলেন।
খান বাহাদুর সাহেব ইজি চেয়ারে শুয়ে একটা বই পড়ছিলেন। মুখে হুঁকোর নল।
হাবিব কদমবুসি করে এক পাশে দাঁড়ালেন।
তাঁর দাঁড়াবার ভঙ্গিটুকুর মধ্যে এক অব্যক্ত কাঠিন্য, এক অনুচ্চারিত ঔদ্ধত্য।
ঘরের ভিতরে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। বিকেলের সূর্যের আলো বইয়ের আলমারির পিছনেই লুটিয়ে পড়েছে। কামরার ভিতর হুঁকোর তামাক, জীর্ণ বই আর জবাকুসুম তেলের মিশ্র গন্ধ।
সানী সাহেব পাশের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বোসো।
এই বিরাট বিপুল বলিষ্ঠ লোকটির নিকট-সংস্পর্শে হাবিব কতদিন কতবার এসেছেন। কোনোদিন বেশি কথা বলেন নি! বলবার প্রয়োজন হয় নি। বলতে সাহসও করেন নি।
জানালার কাছে সূর্যাস্তের আলোয় আজ তাঁকে ইজি-চেয়ারে শায়িত দেখে, হাবিবের মনে হলো, অতীতের ভয়-ভীতি কতই না অর্থহীন। এই প্রৌঢ়ের কাছে তাঁর ঋণবাধের কল্পনা বাস্তবকে কত দূর ছাড়িয়ে গেছে! তিনি বরাবর স্কলারশিপ পেয়েছেন, কলেজে মাইনে লাগে নি। হ্যাঁ দুটি খেয়েছেন, পরেছেন, বই-পত্তরের জন্য যখন যা দরকার হয়েছে, পেয়েছেন।
পর্দার পিছনে খদিজা বিবির ছায়া পড়ল।
নেপথ্য থেকেই তিনি বললেন : হাবিবকে নাস্তা করে যেতে বলবেন।
সানী সাহেব হেসে বললেন : শুনলে তো। খেয়ে যেও। হাবিব সানী সাহেবকে কোনো দিন এভাবে হাসতে দেখেন নি।
সানী সাহেব আবার চোখ বন্ধ করে ইজি-চেয়ারে তেমনি শুয়ে থাকলেন!
একবার জিগ্যেস করলেন না, হাবিব এতদিন আসেন নি কেন: আর আজ এলেনই যদি স্ত্রী-কন্যাকে একবার আনলেন না কেন!
ঘরের ভিতর সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলো।
—জি না। খেয়ে যেতে পারব না। একটু কাজে এসেছিলাম।
সানী সাহেব দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলেন না। সন্ধ্যার অন্ধকারে তাঁর মুখভাব গোপন থাকল।
ক্লান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন : কি কাজ?
—এই ক’টা জিনিস রেখে দিন।
এই বলে হাবিব সুটকেসটা এগিয়ে দিলেন।
সেদিকে ভ্রূক্ষেপ-মাত্র না করে সানী সাহেব পুনশ্চ জিগ্যেস করলেন : কি জিনিস!
তাঁর গলার আওয়াজ একটু চড়ল।
—এই সুটকেসে কিছু গহনা আর দু’হাজার টাকা আছে। আপনার কাছে আমি ঋণী, তাই-
—তাই দেনা শোধ দিতে এসেছ?
ততক্ষণে সানী সাহেব চেয়ারে উঠে বসেছেন, তাঁর পেশিগুলো দড়ির মতো শক্ত হয়ে উঠেছে।
হাবিব কোনো জবাব দিলেন না।
—তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ মনে আছে?
আশ্চর্য শান্ত কণ্ঠে সানী সাহেব আবার জিগ্যেস করলেন।
হঠাৎ বহুদিন আগেকার একটি দৃশ্য হাবিবের চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেই যেদিন রেড রোডে এক ঘোড়সওয়ার তাঁকে সাহেবদের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছিল।
কিন্তু আলিপুরের এসডিও সাহেব এবারো কোনো জবাব দিলেন না। খান বাহাদুর সাহেব সামনের দরজা দেখিয়ে দিয়ে বললেন : যাও!
একটু নত হয়ে সুটকেসটা হাতে নিয়ে হাবিব বেরিয়ে গেলেন। সিঁড়ির দু’ধারে কনস্টেবল আরদালি আর চাকর স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
একমাত্র ইশারার অপেক্ষা—বেয়াদবের হাড় গুঁড়ো হয়ে যেত।
খাঞ্চায় নাস্তা সাজিয়ে খদিজা বিবি আবার পর্দার পাশে এসে দাঁড়ালেন। পরক্ষণেই পর্দা তুলে ভিতরে প্রবেশ করে জিগ্যেস করলেন : হাবিব কোথায়?
—চলে গেছে।
—চলে গেছে!
— হুঁ।
—তার জন্য নাস্তা নিয়ে এলাম।
–কোনো কুত্তাকে দিয়ে দাও।
তখন অন্ধকারে ঘর ভরে গেছে।