উত্তম পুরুষ – ১৫

পনেরো

দেখতে দেখতে কটি বছর কেটে গেল। ক্লাস সিক্স শুরু করে ক্লাস নাইন। আজ আবার এনুয়াল পরীক্ষার ফল বের হবে। ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠব

ক্লাস ওয়ান থেকে নাইন পর্যন্ত সব ক্লাসের ছেলেরাই বহু আগে থেকে তাদের নির্দিষ্ট ক্লাসে এসে বসে আছে।

অন্যদিন এই সময় স্কুল কেমন সরগরম থাকে। আজ একেবারে চুপ। সকলের চোখমুখই উদ্বিগ্ন প্রত্যাশার ছায়ায় মলিন। সকাল দশটার সময় স্কুল টিচার হরেন বাবুকে সঙ্গে নিয়ে হেডমাস্টার আমাদের ক্লাসে ঢুকলেন। পিছনে হেড পণ্ডিত আর হেড মৌলবী। এতক্ষণ যা-ও- বা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল এখন একেবারে স্তব্ধ।

ছেলেরা সবাই উঠে দাঁড়ালো।

হেডমাস্টার বললেন : বসো।

অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠ।

তাঁর হাতে সবগুলো ক্লাসের প্রগ্রেস রিপোর্ট। হেড পণ্ডিত আর হেড মৌলবীর হাতে সিলেবাস।

হেডমাস্টার বলতে শুরু কররেন : শেখর, তুমি ফার্স্ট হয়েছ।

ক্লাসসুদ্ধ সবাই অবাক। সকলের চেয়ে অবাক শেখর স্বয়ং! গোটা ক্লাসই হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকল! কারো মুখে কোনো কথা নেই।

এমন সময় এক অপ্রত্যাশিত কাণ্ড হলো। বলা নেই কাওয়া নেই সলিল চিৎকার করে উঠল : থ্রি চিয়ার্স ফর শেখর।

আমরা স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকলাম। সলিল সাহসী ছেলে জানতাম; কিন্তু সে যে হেডমাস্টারের উপস্থিতিতেও এ-ধরনের নাটক শুরু করে দিতে পারে তা কোনোদিনই কেউ ভাবে নি।

হেডমাস্টার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দেখে মনে হলো তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর হেডমাস্টারের মুখে অল্প একটু হাসি দেখা গেল। তিনি সহাস্যে বললেন : কি হলো তোমাদের? চুপ থাকলে যে।

এর পরের ঘটনা আরো অবিশ্বাস্য।

স্বয়ং হেডমাস্টার সুউচ্চ কণ্ঠে হেঁকে উঠলেন : থ্রি চিয়ার্স ফর শেখর

এবার আর কেউ কোনো শাসন মানল না।

ক্লাসের শতাধিক ছেলে গগনবিদারি কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল : হিপ হিপ হুর-রে।

যাকে নিয়ে এত উত্তেজনা সে এক কোণে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসেছিল। এইবার সে ডুকরে কেঁদে উঠল।

এক নিমেষে ক্লাসসুদ্ধ সবাই চুপ।

হেডমাস্টার এগিয়ে এসে শেখরের মাথায় হাত রেখে বললেন : বি কোয়ায়েট মাই বয়। রাইজ টু দি অকেশন।

শেখর যখন আবার শান্ত হলো তখন হেডমাস্টার বললেন : তুমি রেকর্ড নম্বর পেয়েছ। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তুমি স্কুলের নাম উজ্জ্বল করবে আমরা তাই আশা করি।

শেখর মাথা নিচু করে হেডমাস্টারের পদধূলি নিয়ে ধীরে ধীরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।

—আবদুস শাকের সেকেন্ড। ইংরজিতে ফার্স্ট হয়েছে।

—কাঞ্জিলাল রায় থার্ড।

হেডমাস্টার আর কোনো মন্তব্য করলেন না।

—বদ্রিনারায়ণ প্রসাদ ফোর্থ।

শিশির ফিফ্‌থ মফিজ টেনথ্ সলিল নট-প্রমোটেড।

দীর্ঘ তিন বছর পর সলিল আবার ফেল করল।

সলিলকে সম্বোধন করে হেডমাস্টার বললেন : সলিল এবার তোমাকে প্রমোশন দেয়া সম্ভব হলো না।

—কুছ পরোয়া নেই স্যার। দু’চারবার ফেল করা—সে আমার অভ্যাস আছে।

—আরো একটা কথা বলতে হচ্ছে। তুমি কোনোদিন ম্যাট্রিক পাস করতে পারবে না। তোমাকে এ-স্কুল ছেড়ে চলে যেতে হবে।

সলিল এতটার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

সে আর একটি কথাও বললো না! ক্লাস ছেড়ে চলে গেল। তার কিছু আগে শেখরও বেরিয়ে গেল। তাদের অবস্থায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কিন্তু উভয়ের ভঙ্গির মধ্যে কোথায় যেন একটা মিলও ছিল।

সলিলের জন্য আমাদের সকলেরই দুঃখ হলো। ছাত্র সে যেমনই হোক, এতদিনের অভ্যাসের ফলে মনে হয়, সে ক্লাসে না থাকলে ক্লাসই যেন পূর্ণ হলো না। তাছাড়া সে ছিল আমাদের কাছে বহির্বিশ্বের প্রতীক।

পরীক্ষার ফলাফল সম্বন্ধে অনেকক্ষণ ধরে পোস্ট-মর্টেম চলল। জানা গেল, ক্লাস নাইন আর টেনের বাংলা ও সংস্কৃতের খাতা স্বয়ং পণ্ডিত মশাই দেখেন। তাই এবারের পরীক্ষায় যার যা প্রাপ্য সে তত নম্বরই পেয়েছে। মফিজ আমাকে আর একটি সংবাদ দিল। মৌলবী সাহেব না কি এবারে আমাকে বেশি নম্বর দিয়েছেন। স্কুলের মুসলমান ছেলেরা কোনোদিন পরীক্ষায় ভালো করতে পারে না, পজিশন পায় না, এ তাঁর বহুদিনের দুঃখ। এবারে তাঁর সেই দুঃখ ঘুচল।

এইবার বুঝলাম। আমাকে যখন সেকেন্ড ঘোষণা করা হলো, তখন মৌলবী সাহেবের চোখ দুটি আনন্দে হাসছিল।

মফিজ এবার ঠাট্টা করে বললো : মাত্র আট আনা খরচ করেই তুই বাজিমাত করলি।

মফিজের তামাসা আমার ভালো লাগল না।

ক্লাস টেনের ছেলে আমরা। বেশ বড় হয়ে উঠেছি। শরীরও ধীরে ধীরে প্রায় আমাদের অগোচরেই বেড়ে উঠেছে। গলার আওয়াজ ভারি হয়ে গেছে। পদযুগলে আগের সেই ক্ষিপ্রতা নেই, গতিও কেমন মন্থর হয়ে আসছে। দৃষ্টি থেকে চঞ্চলতা দূর হয়ে যাচ্ছে।

সরস্বতী পূজার জন্য একদিন ছুটি। ছুটির পরদিন স্কুলে গিয়ে সবাই শুনলাম : পণ্ডিত মশাই মারা গেছেন। পণ্ডিত মশাই মারা গেছেন? হ্যাঁ, গতরাত্রে ওলাওঠায় তিন ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন।

সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

তবু কথাটি যেন কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। মারা গেছেন? পণ্ডিত মশাই? মাত্ৰ পরশুদিনই না তিনি আমাদের কাজী নজরুলের কবিতা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।

হেডমাস্টার মশাই তাঁর কামরাতে বসে আছেন। সেই যে সকালে এসে নিজের ঘরে ঢুকেছেন, তারপর তাঁকে আর কেউ বেরুতে দেখে নি। তিনি প্রত্যেক ক্লাসে তাঁর একটা ছোট্ট লেখা পাঠিয়ে দিয়েছেন। ক্লাসটিচার সে লেখা প্রত্যেককে পড়ে শোনালেন। পণ্ডিত মশাইয়ের কাছে এ স্কুল কিভাবে কতদিন ধরে কতটা ঋণী, হেডমাস্টারের বাণীতে সেই কথা। শেষের দিকে হেডমাস্টার বলেছেন :

—পণ্ডিত মশাই ছিলেন সত্যকার আচার্য। নির্লোভ নিঃস্বার্থ। স্কুলের ছেলেরা ছিল তাঁর প্রাণ। এই স্কুল ছিল তাঁর সাধনার মন্দির। বহু প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর ডাক এসেছে—উচ্চ পারিশ্রমিকের প্রলোভন। কিন্তু যে স্কুলের সঙ্গে বিশ বছরের সম্পর্ক সেই স্কুলের মায়া তিনি কোনোদিন ছাড়তে পারেন নি।

দেড় হাজার টাকা তাঁর আজীবন সঞ্চয়। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর শেষ ইচ্ছা এই ছিল যে, এই টাকা দিয়ে তাঁর স্কুলের ছেলেদের যেন মিষ্টি খাওয়ানো হয়। তাঁর বিধবা স্ত্রী স্কুলের এক হাজার ছেলের জন্য মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

এইখানেই হেডমাস্টারের বাণী শেষ।

আমরা সকলেই হাতে মিষ্টির মোড়ক নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসি।

স্কুল আজ ছুটি।

কত কথাই মনে হচ্ছিল। ক্লাস টেনে উঠেছি। সলিল বিদায় নিয়েছে। পণ্ডিত মশাই মারা গেছেন। আস্তে আস্তে স্কুলের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে। পিছনে ফেলে আসছি এক বৈচিত্র্যময় জীবন।

এদিকে মিষ্টি খেয়ে গলা গেছে শুকিয়ে। পথের ধারে পানের দোকানে লেমনেড দেখে তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। পকেটে সাড়ে তিন আনা পয়সাও আছে। কিন্তু লেমনেড খেলে চলবে কেন? পার্ক-শো-হাউসে ‘অচ্ছুৎ কন্যা’ হচ্ছে। আজই ছবিটা দেখতে হবে। একেবারে পর্দার কাছের বেঞ্চির আসনগুলোর দাম দশ পয়সা। একটা দশ পয়সার টিকিট কাটতে হবে। তবু এক আনা পয়সা হাতে থাকে। অন্তত এক খিলি সাঁচি পান কিনে গলাটা ভিজিয়ে নিলে হয়; কিন্তু থাক। জমিয়ে জমিয়ে আর একটা সিনেমা দেখা যাবে।

তন্ময় হয়ে ছবি দেখছি। হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন আমার মাথাটা এক পাশে সরিয়ে দিল। ফিরে দেখি, একটি স্ত্রীলোক। মুখভরা পান। কপোল বেয়ে ফুলেল তেল গড়িয়ে পড়ছে— সেই অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছিল। আর মুখশ্রী? সে কথা না বলাই ভালো। কি আর করি। এক পাশে ঘাড় কাত করে ছবি দেখতে লাগলাম। পুরাতন প্রিন্ট। স্থানে স্থানে ঝরঝরে হয়ে গেছে; কিন্তু এত ভালো লাগছে যে ছবিটা দেখবার জন্য যেন এক জোড়া চোখই যথেষ্ট নয়।

আবার বাধা পড়ল।

এবার বিপরীত পার্শ্ব দিয়ে দ্বিতীয় আর একজন মাথাটিকে তার মূল অবস্থানেই ফিরিয়ে দিল।

দেখলাম, তিনিও স্ত্রীলোক, এবং প্রথমোক্তার সখি ও সঙ্গিনী। এ পাশে মাথা রাখলে এঁর এবং ওপাশে মাথা রাখলে ওঁর ছবি দেখতে অসুবিধা হচ্ছে।

যাই হোক, ছবি তবু আমি দেখবই।

একটু পরই এক তৃতীয় ব্যক্তি—স্পর্শ থেকেই অনুমান করলাম ইনি পুরুষ—তাঁর হাত দিয়ে আমার মাথাটি আমারই বুকের ওপর নাবিয়ে দিলেন। বুঝলাম এবার তাঁর দৃষ্টিপথের বিঘ্ন দূর হলো।

এবার আর পশ্চাতে ফিরে দেখলাম না। উঠে পড়লাম। আমার এই সাময়িক প্রতিবেশীত্রয়ের সম্মিলিত হাসি পালের বাতাসের মতোই ধাক্কা দিয়ে আমাকে দরজার বাইরে নিয়ে এলো।

হলের বাইরে যখন বেরিয়ে আসি, রোদ তখন ঝাঁ-ঝাঁ করছে। আমিও বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। পা আর কিছুতেই উঠতে চায় না। পকেটে এক আনা পয়সাও আছে, ট্রামে উঠে পড়লেই হয়; কিন্তু কতটুকুই আর পথ। এরই জন্য ট্রামে উঠব? ফজুল পয়সা খরচ করতে মন ওঠে না।

ঠিক এই সময়টিতেই একটা ট্রাম এলো। আর কিছু না ভেবে ট্রামে উঠে পড়লাম।

সামনের সিটেই মামা বসে আছেন—আপন মামা, একমাত্র মামা; কিন্তু আমাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা নেই। তিনি ডিপুটি সাহেব।

কন্ডাক্টর এসে বললো, টিকিট!

আমি আমার বহু কষ্টের আনিটা বের করে দিলাম।

—আর একটা আনি দিন। এটা অচল!

অচল! আর একটা আনি! আর একটি আনি পাব কোথায়?

ট্রামের মধ্যে একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল। আজকালকার ছেলেরা কী দ্রুত অধঃপাতে যাচ্ছে, ঠকাবার কত কৌশল আবিষ্কার করেছে, সকলের মুখে সেই আলোচনা।

আমার মন-প্রাণ তখন একটিই মোনাজাত করছিল : হে খোদা আমাকে কোনোমতে অশরীরী করে দাও। তুমি সব পার। আমি আর কোনোদিন তোমার কাছে কিছু চাইব না।

কিন্তু খোদা গোনাহ্গারের কথা শুনবেন কেন?

অশরীরী হবার কোনো লক্ষণই যখন দেখলাম না, তখন বড়ই আশা হতে লাগল, মামু নিশ্চয়ই পয়সাটা দিয়ে দেবেন।

মামু কিন্তু ফিরেও তাকালেন না। সোজা নাক বরাবর তাঁর দৃষ্টি—জানালার বাইরে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত।

কন্ডাক্টর ঘাড় ধরে আমাকে নাবিয়ে দিল।

পথের ওপর নেবে এলাম। ট্রাম চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল; কিন্তু এতক্ষণ যা দেখি নি, এইবার তাই চোখে পড়ল।

একদম সামনের আসনে বসে আছে সেলিনা!

.

সেইদিনই সন্ধ্যাবেলা মামু টহল দিতে দিতে আমাদের বাড়ি উপস্থিত হলেন।

সোজা আম্মার কাছে এসে একটা মোড়া টেনে বসলেন।

কোনোরকম ভূমিকা না করেই বলে গেলেন : তোমার ছেলেদের চালচলনের জন্য আমরা যে রাস্তায় মুখ দেখাতে পারি না।

–কেন? কি হলো।

মামু যে কি বলে গেলেন তার সবটা আমার কানেও গেল না। টোস্ট, অমলেট আর দু’কাপ চা খেয়ে মামু বিদায় নিলেন।

মামু চলে যাওয়ার পর আম্মা আমার কাছ থেকে ব্যাপারটা সবিস্তারে জানতে চাইলেন। আমি বললাম।

আম্মা আর কিছু বললেন না।

কেবল একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *