চৌদ্দ
একদিনে সাতটা পিরিয়ড। আজকাল ফোর্থ পিরিয়ডের পর আর পড়ায় মন বসে না। মাথা ঘুরতে থাকে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তার ওপর যা গরম। মাস্টাররাও ভালো করে পড়ান না। তাঁরাও কেমন ঝিমিয়ে পড়েন। হয়তো আমাদের একটা কিছু লিখতে দিয়েই তাঁরা তন্দ্ৰায় ঝিমুতে থাকেন—মাথাটা বুকের ওপর ঝুলে আসে। ছাত্ররা লিখছে কি না, আর লিখলেও কি লিখছে সে সম্বন্ধে কোনোদিন কোনো কৌতূহলই তাঁরা দেখাতেন না।
এনুয়াল পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই। এইবার ক্লাস নাইন থেকে ক্লাস টেনে উঠব।
ফিফ্থ পিরিয়ডে ফার্সি ক্লাস।
মৌলবী সাহেব সেদিন মাথা থেকে টুপিটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর চেয়ারে বসে পড়ে মাথার ওপর একবার হাত বুলিয়ে নিলেন। নোংরা কালো শেরওয়ানির জীর্ণ পকেটের ভিতর শীর্ণ হাতটি গলিয়ে দিয়ে একটি বিকট দুর্গন্ধময় রুমাল বের করলেন। সেই রুমালটি দিয়েই গলার ঘাম মুছলেন। চশমার কাচ দুটি পরিষ্কার করে নিয়ে চশমাটি প্রায় একটি কামানের মতো করে নাকের ওপর বসালেন। তারপর কামানটি আমার প্রতি নিশান করে একটি প্রশ্নবাণ ছুঁড়লেন :
—কি মিঞা পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
আমি নিরুত্তর।
মৌলবী সাহেবও জবাবের জন্য পীড়াপীড়ি করলেন না। আমার দিকে আর একটিবারও ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত করলেন না।
বিকেলবেলা। রোদ তখন পড়ন্ত। ক্লাসরুমের ভিতর লম্বা লম্বা ছায়া পড়তে শুরু করেছে। জানালার ভিতর দিয়ে রাস্তায় করপোরেশনের কল দেখা যাচ্ছে। লাইন বেঁধে মেয়েরা কলসি নিয়ে অপেক্ষা করছে। মনে হয় কারো কোনো তাড়া নেই। তারা জানে তার পালা আসতে দেরি আছে, অযথা চঞ্চল হয়ে লাভ নেই। স্থির হয়ে বসে থাকাই ভালো।
তারা দিব্যি বসে পান চিবোচ্ছে, ঘামাচি টিপছে, চুল বাঁধছে—অনেকে কেবল গল্পই করছে। স্কুলের বটগাছটিতে দুটি একটি পাখি যেন ক্লান্ত অবসন্ন উদ্দেশ্যহীন হয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে অলসভাবে ডানা নাড়ছে, ক্বচিৎ-কদাচিৎ এক মুহূর্তের জন্য মুখর হয়ে তাদের অস্তিত্ব প্রকাশ করছে। একটি দাঁড়কাকও অন্যমনস্ক হয়ে ডালের ওপর বসে আছে।
কোথাও কারো কোনো তাড়া নেই, ব্যস্ততা নেই—কারো কিছু করণীয় নেই। সবকিছুরই গতি ঢিমে হয়ে গেছে।
একটা ফেরিঅলা কাটা শশা বিক্রি করছে। কেবল তাকে কেন্দ্র করেই কিছু প্রাণ-চাঞ্চল্য তখনো অবশিষ্ট আছে।
–তোমরা ফেরিঅলাদের কাছ থেকে কাটা খিরা পাপিতা কিনে খাও—পেটের অসুখ করে না?
—জি না স্যার।
লম্বা কালো দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে মৌলবী সাহেব বলেন : বেশ বেশ।
হঠাৎ মৌলবী সাহেবের কি খেয়াল হলো, তিনি পড়া নিতে শুরু করলেন। মফিজ, রাজ্জাক, আবুল পাল-তোলা-নৌকার মতো তরতর করে পড়া বলে গেল, কোথাও এতটুকু বাধল না। চড়ায় ঠেকে গেলাম কেবল আমি।
—কি মিঞা, পড়া বলতে পার না কেন? হিন্দুয়ানি পড়ায় তো শুনি এক নম্বর।
ব্যাপারটা বুঝতে পারি। পণ্ডিত মশাই আমাদের “রামায়ণী কথা” পড়ান। কৈকেয়ীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে একটা রচনা লিখে আনতে তিনি গোটা ক্লাসকে বলে দিয়েছিলেন। আমার রচনা সবার চাইতে ভালো হয়েছিল। পণ্ডিত মশাই সেটা ক্লাসে পড়ে শুনিয়েছিলেন।
এবারো চুপ করে থাকি। কোনো জবাব দিই না। কিন্তু মনে মনে অত্যন্ত অপ্রসন্ন হয়ে উঠি। স্কুলের পাঠ্য-তালিকায় যদি ‘রামায়ণী কথা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, আর মুসলমানি কোনো কথা অন্তর্ভুক্ত করা না হয়, সে দোষ কি আমার? আর নম্বর বেশি পেয়েছি, সেই কথা? তা নম্বর বেশি কে না পেতে চায়? পরীক্ষায় সকলের সঙ্গে টক্কর তো দিতে হবে।
–আমাকে নিরুত্তর দেখেও মৌলবী সাহেব নিরস্ত হলেন না।
এদিকে এসো তো।
–আমি উঠে এগিয়ে যাই।
—তুমি না কি পানিকে জল, আব্বা-আম্মাকে বাবা-মা, বড় ভাইজানকে বড়দা বলে ডাক? বস্তুত অভিযোগ অস্বীকার করবার উপায় ছিল না। স্কুলের শতকরা পঁচানব্বই জন ছেলে হিন্দু। আমাদের মুখে আব্বা আম্মা ভাইজান এসব সম্বোধন শুনলে তারা সকলেই এমন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যে মনে হয় তারা যেন কস্মিনকালেও এমনধারা অসংস্কৃত উক্তি শ্রবণ করে নি। তারা যে নিজেরাই কেবল হতবুদ্ধি হয়ে যায় তাই নয়, তাদের সেই বোবা দৃষ্টি হতবুদ্ধি করেও দেয়। তবে এ-অপরাধে আমি একাই অপরাধী নই। স্কুলের সব কটি মুসলমান ছেলেই সমান দোষী। একশ’ জোড়া চোখের বিদ্রূপের মোকাবিলা মাত্র পাঁচজোড়া চোখ কি করে করবে? তাই দেখেছি, মৌলবী সাহেব পর্যন্ত পণ্ডিত মশাইয়ের সঙ্গে যখন বাক্যালাপ করেন তখন তাঁর জবানও বদলে যায়। তাঁকেই-বা দোষ দেবে কে? স্কুল-গভর্নিং বডির সব কটি সদস্যই হিন্দু। মৌলবী সাহেবের চাকরির মায়া তো আছে।
সুতরাং ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য মৌলবী সাহেব যখন আমাকে একাই বেছে নিলেন তখন তর্ক করতে পারতাম, প্রতিবাদও করতে পারতাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, সেই অল্প বয়সেই এই জ্ঞানটুকু হয়ে গিয়েছিল।
ঠিক এই সময়টিতেই সামনের বারান্দা থেকে পণ্ডিত মশাইয়ের চটির শব্দ ভেসে এলো। পণ্ডিত মশাই সারাটি স্কুল চক্কর দিয়ে বেড়ান, কোথায় কি অঘটন ঘটছে, তাই তদারক করে বেড়ানো তাঁর কাজ। যেখানেই তাঁর ছায়া পড়ে সেখানেই সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
মৌলবী সাহেবও সেই শব্দ শুনে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
—যাও যাও নিজের জায়গায় যাও।
তারপর সুর করে ফার্সি পড়তে লাগলেন।
আরো একদিনের কথা মনে পড়ে।
মৌলবী সাহেব ক্লাসে ঢুকলেন, মুখটি কেমন মলিন। সোজা চেয়ারের দিকে এসে বসে পড়লেন। তারপর হাঁপাতে লাগলেন। একটু বিশ্রাম নেয়ার পর তাঁর চোখ-মুখে কিছুটা রঙ ফিরে এলো। বুঝতে পারছিলাম ভিতরে ভিতরে তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন! তাঁর উত্তেজনার কারণ কোনোদিনই জানতে পারি নি
—তোমার কাছে আট আনা পয়সা হবে?
আমার কাছে আট আনা পয়সা থাকবার কথা নয়। কিন্তু সেদিন ছিল। স্কুলের মাইনে দেয়ার পর খুচরা একটি টাকা তখনো আমার কাছে ছিল।
আমি তাড়াতাড়ি আট আনা পয়সা হাতে করে এগিয়ে গিয়ে বলি : জি আছে।
—কাল মনে করে চেয়ে নিও।
তারপর মৌলবী সাহেব হাসানকে ডেকে বললেন : যাও তো মৌলালির মোড় থেকে কাবাব- পরোটা কিনে আন। আজ সকালে খাওয়া-দাওয়া না করেই বেরিয়ে পড়েছি। বড্ড ভুখ লেগেছে।
—স্যার কাবাব-পরোটা আনলে পণ্ডিত মশাই রাগ করবেন। কাবাব আনতে পারব না।
মৌলবী সাহেব খানিকক্ষণ চুপ থাকলেন। তাঁর চোখ-মুখ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করল; কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্যই।
আশ্চর্য, সেই মুহূর্তেই দরজার কাছে পণ্ডিত মশাইয়ের ছায়া পড়ল। চেয়ার থেকে উঠে পড়ে মৌলবী সাহেব সহাস্য বদনে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন : আসুন, আসুন।
পণ্ডিত মশাই সে-কথার কোনো জবাব দিলেন না। তেমনি নীরবেই চলে গেছেন।
মৌলবী সাহেব চেয়ারের ওপর বসে পড়ে আবার হাঁপাতে লাগলেন। একটু পরে বললেন : যাও, হালুয়া-পুরী নিয়ে এসো।
অন্য সব মাস্টারের মতো, মৌলবী সাহেবও ছাত্রদের এইসব ফুটফরমাশ করতেন। সব ছেলেই তাঁকে অল্পবিস্তর ভয়ও করত।
এক মফিজকে তিনি কখনো কিছু বলতেন না। মফিজ বেশ গম্ভীর চালে বসে বসে গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করত—চিত্রতারকাদের জীবন-কাহিনী।
পরদিন অবশ্য মৌলবী সাহেবের কাছ থেকে আমি পয়সা চেয়ে নিই নি। আমার লজ্জা করছিল। মৌলবী সাহেবও ব্যস্ত মানুষ, ভুলে গিয়েছিলেন।