উত্তম পুরুষ – ১১

এগারো

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি বাড়ি ফিরে আসি। গেট তখনো বন্ধ। আমি জানি অনেকক্ষণ কড়া নাড়তে হবে। অত সকালে সেই শব্দ যদি কারো কানে পৌঁছয়ও, তবু উষ্ণ শয্যা আর আলস্য ত্যাগ করে কেউ উঠে আসবে না। নিদ্রার ভান করে পড়েই থাকবে। এক আম্মা ছাড়া। সারারাত আম্মার ঘুম হয় না আমি জানি। শেষ রাত্রের দিকে একটু চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তাই এই সময়টা তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত না করে আমি বেরিয়ে পড়ি।

কলকাতার রাস্তায় বৈদ্যুতিক আলোগুলো তখনো নেভে নি। কিন্তু প্রথম অরুণ-কিরণের পটভূমিকায় অনেক নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। সেই সাত-সকালেই হোস-পাইপ দিয়ে রাস্তায় পানি দেয়া হচ্ছে। ফুটপাতের ওপর এখানে-সেখানে কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে। পথের পাশের কোনো কোনো দোকান সবেমাত্র দিনের পাট খুলছে—হাতে মগ আর পায়ে খড়ম দোকানদার ছাউনির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে।

রাস্তার মোড়ে ছোট্ট চায়ের দোকান। বালতিতে করে উনুন ধরানো হয়েছে।

একটু পরই ডালপুরী ভাজা হবে। একটি বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি বালীগঞ্জ ময়দানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে—সেই ঘোড়ার খুরের শব্দ ছাড়া কলকাতার রাজপথ তখনো নিস্তব্ধ।

আমি চায়ের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চির ওপর বসে পড়ি।

—দুটি ডালপুরী আর এক ভাঁড় চা। জলদি।

–হাঁ বাবু। জলদিই দেব। গরম ডালপুরী আর গরম চা।

ডালপুরী আর মাটির ভাঁড়ে করে গুড়ের চা যদি পাই তো আমি আর কিছুই চাই না; যদিও আমি ভালো করেই জানি, এদের এই দোকানে ডালপুরী তৈরি করবার প্রণালি, পরীক্ষার আগে মুখস্থ করা স্বাস্থ্য-রক্ষার প্রণালির সঙ্গে ঠিক মেলে না। কিন্তু সে কথা মনে করে আমার একটা সাময়িক দ্বিধা আসে মাত্র, তার বেশি নয়। চোখের সামনে ডালপুরী দেখলে সে দ্বিধা একেবারেই থাকে না। বড় দিনের পরবে আব্বা ভালো কেক কিনে আনেন; কিন্তু কিসে আর কিসে। কোথায় লাগে কেক।

কাচের পেয়ালার চাইতে মাটির ভাঁড়েই চা খেতে আমার বেশি ভালো লাগে। তা আবার চিনির চা নয়, গুড়ের। ভাঁড়ের, গুড়ের আর চায়ের মিশ্র গন্ধটুকুর মতো আর কিছুই নয়। শুধু দুধটুকু একটু ঘন হওয়া দরকার। আর একটু পোড়া!

বালীগঞ্জ ময়দানে তখন বেশ লোক হয়েছে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাবু আছেন, প্যান্ট-শার্ট পরা সাহেব আছেন; কিন্তু এঁদের মধ্যে একটা মিলও আছে—সবাই বেশ বয়স্ক।

কি একটা অজ্ঞাত কারণে একটি দৃশ্য আজও আমার মানস-পটে আঁকা আছে। একটি শিমুল গাছের গুঁড়িতে বসে এক তন্বী শ্বেতাঙ্গিনী ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে চা খাচ্ছেন। তাঁর পরনে ব্রিচেস। একটু আগেই রাইড করছিলেন। এখন হয়তো একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন।

একটু একটু করে সূর্য উঠছে। সূর্যের কিরণ শিশির সিক্ত ঘাসের ডগায় বসে ফড়িংয়ের মতো কাঁপছে। আমি সোজা সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। এসব কিছুই পিছনে ফেলে। এত বড় বালীগঞ্জ মাঠটির এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যাই। হাঁটতে আমার ভালো লাগে; কিন্তু একটি মাঠের চারপাশে বারবার ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে না। একই দৃশ্য বারবার দেখলে চোখ দুটির সঙ্গে পা দুটিও ক্লান্ত হয়ে আসে। ভালো লাগে প্রতি মুহূর্তে নতুন দৃশ্য নতুন মুখ।

বালীগঞ্জ ময়দানের বিপুল বটগাছটির ছায়ায় এসে বসে পড়লাম। এই বটগাছটি আমার বড় প্রিয়। বটগাছটির গোড়াটা ইয়া চওড়া। এই গাছটির ভিতরই সুন্দর ঝকঝকে একটি ঘর। সেখানে থাকেন এক দরবেশ। কখনো থাকেন আবার কখনো নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কিন্তু তাঁর ঘরটি সবসময়ই ঝকঝকে তকতকে থাকে। কে যে পরিষ্কার করে কেউ জানে না। সবাই বলে, ঐ অরক্ষিত ঘরটির মধ্যেই দরবেশ সাহেবের অনেক ধন-দৌলত পরম অবহেলায় পড়ে থাকে। কিন্তু বাটপাড়ি করতে কেউ সাহস করে না। দরবেশ সাহেবের ধনে লোভ করতে গিয়ে কত লোকের হাত খসে গেছে। কত লোক বজ্রাহত, কত লোক নির্বংশ হয়েছে।

জনশ্রুতি : দরবেশ সাহেবের এই আস্তানা পাহারা দেয় দশ হাত লম্বা এক অজগর সাপ।

সাপের কথা মনে হতেই আমার পৃষ্ঠদেশ কেমন শিরশির করে উঠল। ঠিক তখনি পাশের জৈন মন্দিরে ঘণ্টা পড়তে শুরু করল।

সেখান থেকে উঠে পড়ি। কিন্তু আমার মনে হতে থাকে, থাকবার জন্য এমন একটা আস্তানা মন্দ নয়। সারাদিন কেমন ঝিরঝির করে বাতাস বইতে থাকে।

বালীগঞ্জ সার্কুলার রোড ধরে হাঁটতে থাকি। প্রমথেশ বড়ুয়ার বাড়ির কাছে। একবার যেন কিসের আশায় দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু ভগ্নপ্রায় গৃহটি নেহায়েতই পাষাণ। সেখানে কোনো প্রাণী থাকে বলেও মনে হয় না।

তারপর আবার চলতে শুরু করি। মসজিদের পিছনে আর একটি ভগ্নপ্রায় বাড়ি, তাও পিছনে ফেলে চক্ৰবেড়ে রোডের দিকে এগিয়ে যাই। ল্যান্সডাউন রোড, এলগিন রোড সব পিছনে ফেলে কেবল এগুতে থাকি—রূপালি সিনেমার দিকে।

এই এক নতুন অভ্যাস হয়েছে আমার—ম্যাটিনী শোতে সিনেমা দেখা। অবশ্য পয়সার অভাবে সবসময় সাধ পুরো করা সম্ভব হয় না। যখনি কোনো নতুন বাংলা ছবি রিলিজ হয়, প্রথম দিনই সেই ছবি দেখা চাই। বিশেষ করে প্রমথেম বড়ুয়া, দুর্গাদাস, উমাশশী আর যমুনা যদি সেই ছবির পাত্র-পাত্রী হয়। তার ওপর যদি থাকে পঙ্কজ মল্লিক আর সায়গলের গান, তাহলে তো কথাই নেই। ক্লাসের বেশির ভাগ ছেলেই অবশ্য সায়গলের ভক্ত। কিন্তু সায়গলের গান আমার অত ভালো লাগে না—গলাটা বড়ই মিহি। তবে হ্যাঁ, পঙ্কজ মল্লিকের গলা আর গান! শুনলে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।

একদিনের কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। সেদিন ছিল রবিবার, সকাল ন’টা বাজে। গলির মোড়ের চায়ের দোকানে রেডিও বাজছিল। রোজই বাজে, সবসময়েই বাজে। কিন্তু রবিবার সকাল ন’টার কথাই আলাদা—পঞ্চজ মল্লিকের সঙ্গীত শিক্ষার আসর। রেডিওর সামনে কত যে লোকের ভিড়, চায়ের দোকানে একটিও চেয়ার খালি নেই। আমার ভারি ইচ্ছে হতে লাগল, চায়ের দোকানের একটি চেয়ারে বসে আরাম করে গান শুনি; কিন্তু তা আর কি করে হয়। অন্তত এক কাপ চা না কিনলে তো আর বসবার জায়গা পাওয়া যাবে না। এদিকে পকেট তো যথারীতি গড়ের মাঠ।

আমি পথে দাঁড়িয়েই গান শুনছিলাম। একেবারে তন্ময় হয়ে, লুপ্ত-চেতন হয়ে। আমি যেন এ দুনিয়াতেই নেই—চলে গেছি এমন এক দুনিয়ায় যেখানে কেবল সুর আর সুর। হঠাৎ একটা মোটর গাড়ি আমার কানের পাশ দিয়ে ঝাঁ করে বেরিয়ে গেল! একটা হৈ-হৈ শব্দ উঠল। কিন্তু না : সবাই বললো, এ-যাত্রা খুব বেঁচে গেছে।

রেস্টুরেন্টের মালিক অমিয় বাবু বেরিয়ে এসে বললেন :

—এসো খোকা। ভিতরে এসে বোসো। ভগবান খুব বাঁচিয়েছেন। আমার ভারি লজ্জা করছিল। তবু অনেকটা যেন যন্ত্রচালিতের মতোই ভিতরে গিয়ে বসলাম।

অমিয় বাবু আমার জন্য জায়গা করে দিলেন। তারপর চেঁচিয়ে বললেন :

—পল্টু। আরে ও পল্টু শুনছিস! এদিকে দুটো টোস্ট, একটা মামলেট, আর এক পেয়ালা চা নিয়ে আয়।

এ যে প্রায় রাজভোগ। আমার সারাটা গা ঘেমে উঠল। আমি দরিদ্র ছাত্র মাত্র। পয়সা পাব কোথায়? আর পয়সা যে নেই সে কথা এই এতগুলো লোকের সামনে স্বীকারই-বা করি কেমন করে। অথচ স্বীকার না করেও তো উপায় নেই। এক্ষুণি যে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর চোরের মতো চারদিক দেখতে দেখতে অমিয় বাবুর টেবিলের কাছে এগিয়ে এলাম।

—আমার পয়সা নেই।

—পয়সা নেই তো কি হয়েছে।

অমিয় বাবু এত জোরে কথাগুলো বললেন যে সবাই আমাদের দিকে ফিরে দেখল।

অমিয় বাবু বলেই গেলেন, তেমনি জোরে :

—পয়সা নেই তো কি হয়েছে। তুমি পাড়ার ছেলে। পালিয়ে তো যাবে না। তাছাড়া তোমার মেজ ভাই আমার রেগুলার কাস্টোমার। যখন হবে দেবে।

আমার লজ্জা বরং বেড়েই যায়। এতগুলো লোক, সবাই কি ভাবছেন। আমার এই এক ভয়। আমার সবসময়ই কেবল মনে হতে থাকে, সকলেই যেন আমাকে দেখছেন! বিশেষ করে কোনো হাস্যকর বা লজ্জাকর পরিস্থিতিতে আমি যখন জড়িয়ে পড়ি, তখন আরো বেশি করে এই ভয় পেয়ে বসে। আমি কি বলি, কি করি, কিভাবে হাঁটি দুনিয়াসুদ্ধ লোক সব কাজ ফেলে যেন তাই দেখছেন, তাই শুনছেন। এই ভাবনার দরুন পায়ে পা যায় জড়িয়ে, কথায় কথা যায় জড়িয়ে, দৃষ্টি অপরাধীর মতো সঙ্কুচিত হয়ে আসে।

রূপালি সিনেমার সাড়ে চার আনার কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আমি এতসব কথা ভাবছিলাম। আমি ‘কিউর’ একেবারে পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। কখন যে একেবারে সামনে পৌঁছে গেছি খেয়ালও করি নি। টিকিট করে বেরিয়ে আসছি এমন সময় পাশ থেকে কে ডাকল :

—শাকের!

সলিল!

—চল্। টালীগঞ্জ যাবি। আজ এগারোটার সময় শুটিং আছে, দেখে আসি!

সলিল এক বিখ্যাত চিত্রাভিনেতার কি রকম যেন আত্মীয় হয়। এই কারণে ক্লাসসুদ্ধ সবাই তাকে খাতিরও করে খুব। সলিলকে দেখলে আমারো চোখ কেমন যেন স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে আসে। মোহভরা চোখে সলিলকে দেখতে থাকি। সলিলকে তো নয়, সলিলকে উপলক্ষ করে কল্পনা চিত্রলোকের স্টুডিওর চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।

একটু ইতস্তত করে আমি সলিলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। সেদিন বাড়ি ফিরে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। টালীগঞ্জ থেকে ফিরবার পথে যখন ট্রামে উঠলাম তখন দুটো বেজে গেছে। সলিল থাকে কালিঘাটে। সেদিন বাড়ি ফিরে না এসে দুপুরের খাওয়াটা সলিলদের বাড়িতেই সেরে নিই। এই উপলক্ষে একটা মজার অভিজ্ঞতা হয়।

সলিলই প্রস্তাব করে :

—শাকের, তুই আজ দুপুরে আমাদের বাসাতেই খেয়ে নে। নইলে তিনটায় আবার সিনেমায় পৌঁছতে পারবি না।

সেদিন তো অনেক রকম অসম সাহসিকতাই করেছি, আর একটা করতে রাজি হয়ে যাই। সলিল একটু লজ্জিত হয়ে, একটু যেন ইতস্তত করে, একটু গলা পরিষ্কার করে নিয়ে পুনশ্চ বললো :

—এই শোন্! মাকে বলব তুই আমার ক্লাস-ফ্রেন্ড।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। ক্লাস-ফ্রেন্ড তাতে কি আর সলিলের সন্দেহ আছে না কি! বস্তুত আমি ক্লাস সিক্সে ভর্তি হবার পর থেকে এই ক্লাস নাইন পর্যন্ত সলিল একবারও ফেল করে নি। সলিল নিজেই বলে, আমার না কি খুব পয় আছে। অতএব তার এই ভূমিকায় আমি স্বভাবতই আশ্চর্য হই।

এইবার সলিল আসল কথাটি পাড়ল।

—আর শোন্। বলব তুই হিন্দু। তোর নাম অম্বিকা। মা খুব গোঁড়া কিনা। নইলে এক সঙ্গে খেতে দেবে না। কোনোই অসুবিধা হবে না। তুই তো দেখতেও হিন্দুর মতো। কে বলবে বাঙালি নোস।

—আমি বাঙালি নই কি রে!

—বাঃ! তুই তো মুসলমান!

সলিল ছাত্র মোটেই ভালো নয়। তবু ক্লাসের সবাই তার বন্ধু হতে চায়। সলিলই এড়িয়ে চলে। অথচ সেই সলিলই উপযাচক হয়ে আমার সাথে ভাব করতে চায়। এতে কে না গর্ববোধ করবে।

কিন্তু আমার নাম অম্বিকা? এ তো ভারি মজা!

সেদিনকার খাওয়াটা কিন্তু হয় দিব্যি। লুচি, আলুর দম, পায়েস, আরো কত কি!

নির্বিঘ্নে খাওয়া শেষ হলে আমরা বেরিয়ে আসি। পানের দোকান থেকে দু’খিলি পান আর একটা পাসিং শো সিগারেট কিনে নিয়ে সলিল হো-হো করে হেসে উঠল।

—মা যদি কোনোদিন জানতে পারে তো বেচারীকে গোবর খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সলিলের হাসি আর থামে না। এক সময় সলিল গম্ভীর হয়ে বলে :

—তুই কাপড় পরিস না কেন রে?

কাপড় পরি না! আমি আবার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।

—দূর গাধা কোথাকার। কাপড় কাকে বলে তাও জানিস না। আমি কি পরে আছি?

-–কেন, ধুতি!

—হ্যাঁ, হ্যাঁ ধুতি। ধুতিকেই কাপড় বলে। তুইও পরবি। বেশ মানাবে।

আমার হাফ প্যান্ট তাহলে কাপড় নয়। মফিজের পাজামাও কাপড় নয়।

সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে সলিল আরো একবার হো-হো করে হেসে উঠল।

সলিলের হাসি আমার একটুও ভালো লাগল না। মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *