উত্তম পুরুষ – ১০

দশ

কোনো কোনোদিন স্কুলে যাবার বা স্কুল থেকে ফিরবার পথে দেখি মুশতাকদের বাসার সামনে তাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অমনি একটা সুস্থ সুন্দর হাসিখুশিভরা জীবনের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বড় ইচ্ছে হয়, একবার ভিতরে যাই; পরক্ষণেই দ্বিগুণ নিরুৎসাহে মন ভরে যায়।

একদিন গড়ের মাঠে ফুটবল খেলতে গেছি। অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে- রাস্তায় এক হাঁটু পানি জমে গেছে। ‘বোম্বে ক্রাউন’ রেস্টুরেন্টের ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে আছি—কবে বৃষ্টি ধরবে, বাড়ি যাব।

এমন সময় চোখের সামনে বিদ্যুৎ চমকাবার মতো করে মুশতাকদের হলদে রঙের শেভ্ গাড়িটা আমারই চোখের সামনে এসে দাঁড়াল।

সেলিনা, আর একটি মেয়ে এবং মুশতাক একের পর এক গাড়ি থেকে নাবল। সন্তর্পণে পানির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে, বর্ষণের বিরুদ্ধে অশেষ নালিশ প্রকাশ করতে করতে কলহাস্যে মুখরিত আর সিক্ত-সাজ সম্পর্কে বিচলিত হয়ে তারা তিনজন ফুটপাতের ওপর নেবে এলো। মুশতাক এলো সবার পিছনে, তার চোখেমুখে সেই পরিচিত দুষ্টুমিভরা হাসি। ফুটপাতের এক কোণে বর্ষার পানি জমে এক ক্ষুদ্র জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। মুশতাক সজোরে সেই স্থানটুকুর ওপর পদাঘাত করতেই সেলিনার শাড়ি আরো ভিজে গেল। সেলিনা সাপের মতো ফণা তুলেই যেন ওঝা দেখে দৃষ্টি নত করে নিল—এক কোণে দণ্ডায়মান আমাকে দেখে একেবারে স্থির হয়ে গেল।

শত চেষ্টা সত্ত্বেও সেলিনার শাড়ি-ব্লাউজ প্রায় সবটুকুই ভিজে গেছে। মাথার চুলে আর চোখের পল্লবে বর্ষার পানি শিশিরের মতো টলমল করছে। সেলিনাকে দেখলেই এখন আমার ভয় হয়। তাই আমিও অনেকটা বজ্রাহতের মতোই দাঁড়িয়ে থাকলাম। সেলিনার পা দু’খানাও যেন কিছুক্ষণ নড়ল না। এমন সময় মুশতাকও আমাকে আবিষ্কার করল।

—কি রে শাকের তুই যে! এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?

মুশতাকের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে যাব এমন সময় শুনতে পেলাম সেলিনা দ্বিতীয় মেয়েটিকে বলছে :

—মুশতাক’স বি-এফ—বেস্ট ফ্রেন্ড।

তার ঠোঁটের বাঁকা হাসিটুকুও দৃষ্টি এড়াল না।

সুতরাং জবাবে কিছুই বলতে পারলাম না, বলবার প্রবৃত্তি হলো না।

এবার মুশতাক ঘাড় ধরে সজোরে আমাকে নাড়া দিয়ে বললো :

–দাঁড়িয়ে ভাবছিস কি। চল ভিতরে চল—ব্রেন কাটলেট খাওয়া যাবে।

আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পকেটে একটি পয়সাও নেই—ব্রেন কাটলেট খাব কি। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, একটু আগেই ব্রেন কাটলেটের ভেসে আসা গন্ধ মনটিকে আনচান করে দিচ্ছিল। বর্ষণ মুখরিত সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা হাওয়া সেই ইচ্ছেটিকে শাসন-না-মানা ঝড়ের মতোই দুর্দমনীয় করে তুলছিল। অথচ এই মুহূর্তে ব্রেন কাটলেট খাবার প্রস্তাবে আমি ক্ষেপে উঠলাম। বিচিত্র মানব মনের গতি। বিচিত্রতর দরিদ্র-সন্তানের মনস্তত্ত্ব। বহির্বিশ্বে বেড়ে উঠবার সব পথ রুদ্ধপ্রায় দেখে অন্তর্লোকে তার পরিণতিটা কত দ্রুতই না আসে। মুশতাক বয়সে আমার চাইতে কতটুকুই আর ছোট, তবু সে আমার কাছে শিশু মাত্র।

যাই হোক এবার আমি যে জবাব দিলাম তা যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি রূঢ়।

—আমি ভাই তোমাদের মতো বড়লোক নই। কাটলেট খাবার পয়সা আমার নেই।

—আহা, তোকে পয়সা খরচ করতে বলছে কে?

—তাহলে কি তোর কাছ থেকে ভিক্ষে নেব?

এবার মুশতাকও রেগে উঠল।

—তুই তো আচ্ছা কথা বলিস! বন্ধুর কাছ থেকে কেউ ভিক্ষে নেয়? তাছাড়া তোকে যদি আমি একদিন খাওয়াই, তাতেই কি তোর মান যাবে?

—না ভাই তুই যা।

—তা কিছুতেই হয় না।

এই বলে মুশতাক জোর করে একটা পাঁচ টাকার নোট আমার পকেটে গুঁজে দিল।

একটা কেবিনে সেলিনা আর তার বান্ধবী মুখোমুখি বসে ছিল। মুশতাক কোনো কথা না বলে সেই মেয়েটির পাশে গিয়ে বসে পড়ল। আমিও মুহূর্তকাল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সেলিনা একবার দুটি চোখ তুলে—চোখ তো নয় যেন করাত—মুশতাকের দিকে তাকালো। মুশতাকের দুটি চোখ তখন টেবিলক্লথটির সূচিকার্যের নৈপুণ্য পর্যবেক্ষণে নিযুক্ত। সেলিনা নীরবে একটু সরে বসে জায়গা করে দিল। আমি সেলিনার পাশে গিয়ে বসলাম—যেন ফাঁসির মঞ্চের ওপর এগিয়ে এলাম।

এবার মুশতাক আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল :

—বুবুর বন্ধু অনিমা। আমার বন্ধু শাকের।

অনিমা হাত তুলে নমস্কার করল। আমি আরো একটু আড়ষ্ট হয়ে বসলাম। সেলিনা আর অনিমা দৃষ্টি বিনিময় করল।

বাইরে তখনো তেমনি বৃষ্টি পড়ছে, এ বৃষ্টি যে কোনোদিনই থামবে তা মনে হয় না। টিনের ছাতে জানালার শার্ষিতে, নালার পানিতে, ফিটন গাড়ির চামড়ায়, পথে-মাঠে দালানের দেয়ালে বৃষ্টির আছাড় খাওয়ার অবিরাম শব্দ ছাড়া আর কোনো দিকে কোনো শব্দ নেই। কালো পিচের রাস্তার ওপর এমন তীক্ষ্ণ ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল যেন কড়াইয়ের ওপর খই ফুটছে।

কেবিনের ভিতরে আমরা চারিটি প্রাণী চুপচাপ বসে কাটলেটের জন্য অপেক্ষা করছি। কারো মুখে কথা নেই।

এক সময় কাটলেট এলো, মনে হলো এক যুগ পরে।

নীরবে আহার চলল। ছুরিকাঁটার শব্দ, তাছাড়া কারো মুখে কোনো রা নেই। খাবার সময় কেবল আমার মুখ দিয়েই এক রকম বিশ্রী আওয়াজ বেরুতে লাগল। অন্য তিনজন কেমন নিঃশব্দে খেয়ে চলেছে। শুধু কি তাই। কেমন ধীর মন্থর গতি; খাওয়াটা যেন এক বেদনাদায়ক কর্তব্য।

কেবিনের ভিতর এক অস্বাভাবিক নীরবতা বিরাজ করতে লাগল। সবাই কাটলেটের সদ্ব্যবহার করতে ব্যস্ত, নিশ্চয়ই এইটেই নীরবতার কারণ। অথচ এই নীরবতা কেন যেন আমাকে পীড়ন করতে লাগল। আমরা চারজনই এক সঙ্গে বসে খাচ্ছি; যা কিছু ঘটছে চারজনেরই চোখের সামনে ঘটছে। অথচ অপর তিনজনের ভাবভঙ্গি দেখে আমার কেবলই মনে হতে লাগল, এমন কিছু ঘটেছে, বা ঘটছে, যা শুধু ওরা তিনজনই জানে। সে এমনই এক রহস্য যা চতুর্থজনকে জানানো যায় না। আমার এই অস্বস্তিকর আশঙ্কার হেতু কি তখনো বুঝি নি। তবে একটা কথা আমার মনে হচ্ছিল। আমি যেভাবে ছুরি আর কাঁটা চালনা করছিলাম, সেটাকে ঠিক স্বচ্ছন্দ বলা যায় না।

এমন সময় যেন ভূত দেখেছি সেইভাবে চমকে উঠলাম।

হঠাৎ চোখে পড়ল আমার সঙ্গী িতিনজন ডান হাতে ছুরি আর বাম হাতে কাঁটা ধরে আহার করছে।

আর আমি?

সে মর্মান্তিক কথা মনে হলে আজও আমার শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।

আমার বাম হাতে ছুরি আর ডান হাতে কাঁটা।

সময়ের গতি যেন থেমে গেছে।

আমি মুহূর্তকাল নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকলাম।

তারপর মাথা নত করে ছুরি আর কাঁটাকে হস্তান্তরিত করলাম। আমার সঙ্গী তিনজনের তিন জোড়া পা অসোয়াস্তিতে শান্ত নীরে বুদ্বুদের মতো একবার নড়ে উঠল। তারা তিনজন অলক্ষ্যে দৃষ্টি বিনিময়ের চেষ্টা করল; কিন্তু তখন আমার চোখ-কান অস্বাভাবিক রকম সজাগ। কিছুই দৃষ্টি এড়ালো না।

কথাটা মনে হলে আজও আমার কান গরম হয়ে ওঠে। অথচ, আশ্চর্য—এই এতদিন পরও ডান হাতে কাঁটা আর বাম হাতে ছুরি ধরে আহার করতে পারলেই আমি অপেক্ষাকৃত সহজে আহার করি।

ওয়েটার বিল নিয়ে এলো। আমি দ্রুতবেগে পকেট থেকে পাঁচ টাকার নোট বের করে তশতরির ওপর রাখলাম। দ্রুততর বেগে নেবে এলো অনিমার হাত, তশতরির ওপর রাখা আমার হাতের ওপর!

—না, না তুমি নয়। আমি দেব।

সেলিনা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বললো :

—চলো চলো বিল দেয়া হয়ে গেছে।

—এ তোমার ভারি অন্যায় কিন্তু।

অনিমা তিরস্কার করে উঠল

অনিমা আর সেলিনার মধ্যে বাক্য-বিনিময় হচ্ছে, তারই এক ফাঁকে মুশতাক আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা চোখ টিপল! তার অর্থ এই : ওরাই পয়সা দিক না। তুই অত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন।

আমি কিছু বললাম না। কি-ই-বা বলব! সেলিনা, অনিমা আর মুশতাক বিল দেয়া-নেয়া নিয়ে বচসা করতে পারে; কিন্তু বিল তারা তিনজনের মধ্যে আর যেই দিক, আমার যে দেবার প্রশ্নই উঠতে পারে না, এটা তারা ধরেই নিয়েছে। তার কারণ কি এই যে, আমি তাদের স্বল্প- পরিচিত? না কি, তার চাইতেও সূক্ষ্ম কোনো কারণ ছিল? তার কারণ কি এই নয় যে, যে বৃষ্টি ধরবার অপেক্ষায় আমাকে বাড়ি থেকে বহু দূরে একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, সেই বর্ষণের শুভক্ষণেই ওরা তিনজন হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, গৃহের উষ্ণ কোণ ত্যাগ করেছে, মোটর গাড়ি বের করতে বলেছে, তারপর সোজা ‘বোম্বে-ক্রাউনে’ উপস্থিত হয়েছে?

আমার তখন যে বয়স সেই বয়সে এমন তলিয়ে চিন্তা করবার মতো বুদ্ধির পরিণতি থাকার কথা নয়। কিন্তু কতগুলো সামাজিক অভ্যাস, রীতি-নীতি, আদব-কায়দার পিছনে এমন-ধারা অনুচ্চারিত কতগুলো কারণই কাজ করতে থাকে। এতো ভালোই যে রীতি-নীতিগুলো এই কার্য-কারণের সূত্র ধরেই অগ্রসর হয়। তবু সেদিন বড্ড কষ্ট পেয়েছিলাম। না হয় আমার পকেটের পাঁচটি টাকাও আমার নিজের নয়, তবু আমাকে বিল শোধ করতে দিলে কি আর এমন ক্ষতি হতো। ওদের তিনজনের সঙ্গে কোনো একখানে তো তাহলে সমতুল্যতা দাবি করতে পারতাম।

আমি যখন এই চিন্তারই সূত্র ধরে সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হয়ে গেছি সেই সময় সেলিনা বললো :

—অনিমা চলো আজ রাত্রে তুমি আমাদের বাড়ি থাকবে।

—আমার কোনোই আপত্তি নেই। কিন্তু মাকে রাজি করবার দায়িত্ব তোমার।

—আচ্ছা আমারই।

—শাকের, তুইও চল।

মুশতাক এবার আমাকে নিমন্ত্রণ করল। সেলিনা তার বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করলে মুশতাকই-বা তার বন্ধুকে ডাকবে না কেন? মুশতাকের বহু কার্যকলাপের পিছনে এমনই এক সাম্য-নীতি কাজ করত।

যাই হোক, মুশতাকের প্রস্তাব সম্পর্কে হাঁ না কিছু বলবার আগেই অনিমাও অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে যোগ করল :

–বেশ হবে। তুমিও চলো না।

কেবল সেলিনা কোনো কথাই বললো না।

আমরা সবাই গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সবার আগে আমি ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলাম।

গাড়ি চলল ভবানীপুর, অনিমাদের বাড়ি। তারপর যাবে বালীগঞ্জ, আমাদের বাড়ি। তারপর বেনিয়া পুকুর, মুশতাকদের বাড়ি।

বৃষ্টি তখন থেমেছে; কিন্তু আকাশে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ তখনো গর্জন করছে। মোটর গাড়ির আর্শির ওপর কখনো কখনো বিদ্যুতের আলো টর্চের মতো এসে পড়ে। তখনই আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া বড় বড় মেঘ এদিক থেকে ওদিকে সরে যাচ্ছে দেখা যায়। ঠাণ্ডা হাওয়া দিতে থাকে।

গাড়ি চলল এ-পথ সে-পথ পেরিয়ে। কারো মুখে কথা নেই। একবার কেবল ড্রাইভার আমাকে উদ্দেশ করে বললো :–বাবু। আপনার পা-টা একটু সরিয়ে নিন। গাড়িতে কাদা লাগছে।

আমি আজ্ঞা পালন করলাম। গাড়ি আগের মতোই ছুটতে লাগল।

একটা বাগানঅলা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গাড়ি বারান্দার নিচে এসেই থেমে পড়ল।

অনিমা গাড়ি থেকে নাবতে নাবতে বললো :

—তোমরা সবাই নাবো।

সেলিনা তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে বললো :

—না চলো, আমি একাই যাই। সবাই নাবলে আবার দেরি হয়ে যাবে।

একটু পরই তারা ফিরে এলো।

আবার গাড়ি ছুটল। একটু পরই আমাদের বাড়ির দরজা।

অনিমা দরজা খুলে নাবতে যাচ্ছিল।

—চলো শাকের, তোমার মায়ের সাথে আলাপ করে আসি।

—আলাপ করবি আর একদিন পোড়ারমুখী, এখন থাম।

কি কারণে জানি না সেলিনা অনিমাকে বিরত করল। আমিও এই প্রথম সেলিনার প্রতি এক প্রকার কৃতজ্ঞতা বোধ করতে লাগলাম।

কেবল মুশতাক আমার সঙ্গে নেবে এলো।

আম্মা একটি অন্ধকার কোণে চুপচাপ বসেছিলেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন

—কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

কণ্ঠ অপ্ৰসন্ন।

জবাব দিল মুশতাক।

—আমাদের সঙ্গে ছিল। চাচি, শাকের আজ রাতে আমাদের বাড়ি থাকবে। আম্মা মুশতাকের কথার কোনো জবাব দিলেন না। একবার শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন মাত্র। তারপর আমার হাত ধরে পাশের ঘরে নিয়ে এলেন। জিগ্যেস করলেন :

—আলমারি থেকে দুটো টাকা নিয়েছিস?

আমার গলা কেঁপে উঠল, তবু বললাম :

—কৈ, না তো!

—আচ্ছা যা!

আম্মার গা গরম। নিশ্চয়ই তাঁর গায়ে জ্বর আছে।

আমি তবু নড়ি না।

আম্মা আবার বলেন :

—ওষুধের জন্য টাকা দুটো রেখেছিলাম।

আমি আর দাঁড়াই না। তাড়াতাড়ি মুশতাকের সঙ্গে বেরিয়ে আসি। সেলিনার প্রতি ডবল কৃতজ্ঞতা বোধ করি। ভাগ্যিস, অনিমাকে নাবতে দেয় নি।

বেশ রাত হয়েছে। করপোরেশনের বৈদ্যুতিক আলোক-স্তম্ভটির ঠিক নিচেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। শুধু আকাশের বুকে বড় বড় মেঘ তখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সেলিনা আর অনিমা গাড়ির মধ্যে বসে আছে। আলো-অন্ধকারে তাদের ইহলোকের প্রাণী বলেই মনে হচ্ছে না। চারদিকের পরিবেশ কেমন যেন অশরীরী অলৌকিক।

এবার আমরা মুশতাকদের বাড়ি পৌঁছলাম।

মুশতাকের আম্মা বললেন :

—অনেক দিন আস নি। অসুখ-বিসুখ করে নি তো বাবা।

আমি কোনো জবাব দিই না।

বাথরুমের দরজায় ঠেস দিয়ে সেলিনা দাঁড়িয়েছিল। তার চুল বৃষ্টির পানিতে ভেজা—কাঁধে তোয়ালে। এখুনি গা ধুতে যাবে।

মুশতাকের আম্মা আবার বললেন :

—আজ এখানেই খেয়ে যাবে।

মুশতাক তাড়াতাড়ি জবাব দিল :

–খেয়ে যাবে কি আম্মা! শাকের যে আজ রাত্রে এখানেই থাকবে।

অনিমাও যোগ দিল :

—আমিও যে থাকব বলেই এসেছি, মাসিমা।

—ওমা। তাই না কি। তা তোমরা দুষ্টু ছেলেমেয়েরা বাইরে থেকে কি ষড়যন্ত্র করে এসেছ, না বললে আমি কি করে জানব বলো মা।

এবার আমার দিকে ফিরে বললেন :

—আমি চললাম রান্নার ব্যবস্থা করতে। দুষ্টু ছেলে তুমি চলে যেও না সেদিনের মতো। এবার আমিও বললাম :

—না চাচি। আমি যাব না।

সেলিনা তখনো দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল। কখন এক সময়

খোঁপা খুলে দিয়েছে। চুলগুলো হাঁটু পর্যন্ত নেবে এসে যেন পা ধরে কিসের জন্য সাধাসাধি করছে।

অনিমা বললো :

—সেলিনা, আমার হাতে ক্যামেরা থাকলে এখনি তোর ছবি তুলে নিতাম।

—কেন রে?

—কেন রে! তা কি আর আপনি জানেন!

এবার সেলিনা একটুখানি হেসে গোসলখানার দরজা বন্ধ করল।

আমরা সবাই বৈঠকখানায় এসে বসলাম।

সেলিনাও একটু পরেই গোসল করে বেরিয়ে এলো।

মুশতাকের পরনে জিপ-লাগানো লাল রঙের স্পোর্টস্ শার্ট আর সাদা হাফ প্যান্ট। ভারি স্মার্ট লাগছিল। আমি পরে আছি সাদা রঙের বিবর্ণ নোংরা হ্যাফ প্যান্ট আর একটা ময়লা হাফ শার্ট। আমার ঢ্যাঙা পায়ের লোমগুলো সজারুর গায়ের লোমের মতোই বিসদৃশ ঠেকছিল। আমি আবার মনের মধ্যে সেই পুরাতন অসোয়াস্তি বোধ করতে লাগলাম।

সেলিনা মুশতাকের দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসল। সে হাসির অর্থ আমি বুঝলাম না।

কথা বলছি, এমন সময় সেলিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার দৃষ্টি আমারই দুটি পায়ের ওপর এসে স্থির হলো। হাফ প্যান্টের নিচে হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত সবটাই খোলা; আমার পায়ের সজারুর মতো লোমগুলো যেন সকলের গায়ে বিঁধছিল। সবচাইতে বেশি আমার নিজের গায়ে। সেলিনা একবার সেইদিকে দেখল, একবার মুশতাকের দিকে। মুশতাকের পরনেও হাফ প্যান্ট; কিন্তু কেমন করে যেন হাফ প্যান্ট তাকে দিব্যি মানিয়ে যেত।

সেলিনার চোখের দৃষ্টি দেখে মুশতাক পর্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সেও একবার আমার লোমশ পা দুটির দিকে চকিতে তাকিয়ে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে থাকল।

আর আমি?

আমার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল আমারই হতভাগ্য পদযুগলের ওপর। এই দুটি পা-কে নিয়ে কি করি, কোথায় লুকাই, সেই অসহায় চিন্তায় আমার মাথা ভার হয়ে থাকল। মনে হতে লাগল, এমন একজোড়া বিসদৃশ পদার্থ সৃষ্টি না করলে খোদার লোকসানটা কি হতো। আর সৃষ্টি যদি করাই হলো একটু সুন্দর সুডৌল আর সুশ্রী করে তৈরি করলেই-বা কার কি ক্ষতি হতো। সেই এক নিমেষের লজ্জা থেকে বাঁচবার জন্য জীবনের অবশিষ্ট সময়টা পদবিহীন হয়ে থাকতেও আমি সানন্দে রাজি হয়ে যেতাম। কিন্তু দুটি জলজ্যান্ত পা-কে—তা সে যতোই লোমশ আর বিসদৃশ হোক তো আর ইচ্ছে করলেই পকেটে পুরে ফেলতে পারি না এবং সত্যি সত্যিই আর লোপাটও করে দেয়া যায় না। কারণ, আমার পদমর্যাদা না হয় নাই থাক কিন্তু পদ-চালনার প্রয়োজন তো আর দশজনের চাইতে কিছু কম ছিল না। বরং কিছু বেশিই ছিল।

ঝকঝকে পরিষ্কার মেঝে, দেয়ালে কত রকমের ছবি, সৌখিন আসবাবপত্র, কোথাও এতটুকু বালুকণা পর্যন্ত চোখে পড়বার উপায় নেই। সেইখানেই আমি হাফ প্যান্ট পরে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছি। হাঁটুর ভাঁজের কাছে কাদা-মাখা পানি টলটল করছে, গোড়ালির কাছে এক চাকলা কাদা। খোদার দুনিয়ায় এতদিকে এত সুন্দর জিনিস থাকতে সেলিনার চোখ বারবার সেই কাদাটুকুর ওপর এসে পড়ছে। অথবা এসে পড়ছে বলেই আমার মনে হচ্ছে।

মুশতাক আমার হাত ধরে টেনে তুলল।

—তুই গোসলখানায় ঢুকে পড়। আমি কাপড় এনে দিচ্ছি।

আমি প্রতিবাদ না করে দুটি অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম অবাঞ্ছিতটাই বেছে নিলাম। চিড়িয়াখানার জানোয়ারের মতো কৌতূহল আর কৌতুকের বস্তু না হয়ে, পরের পোশাক পরে বাবু হওয়াও ভালো। অন্তত আমি তাই ঠিক করলাম।

এক সময় চাচি এসে বললেন :

—তোমরা সব করছ কি। খাবার হতে কিন্তু দেরি আছে। বরং তোমরা এখন এক পেয়ালা করে চা খাও।

অনিমা সোৎসাহে সায় দিল।

আমি ইতিমধ্যে গোসল করে মুশতাকের দেয়া সাজে সজ্জিত হয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছি।

কথার অভাব ঘটলেই অনিমা একটা কিছু বলে, বা একটা কোনো প্রস্তাব করে কামরার নীরবতা দূর করছিল; কিন্তু এভাবে কাঁহাতক আলাপ চলতে পারে? তাই এক সময় সে-ই প্রস্তাব করল :

—এসো, ক্যারাম খেলা যাক।

মুশতাক চট করে রাজি হয়ে গেল; কিন্তু সেলিনা কোনো কথাই বললো না। অনিমা জবরদস্তি করে তাকে টেনে চাটাইয়ের ওপর বসিয়ে দিল।

প্রথমবার আমি আর অনিমা পার্টনার হলাম; কিন্তু হেরে গেলাম।

অনিমা খেলে ভালোই। এমনকি ‘টাচ্’ আর ‘রিবাউন্ডের’ মারগুলো জবরদস্ত মারে। কিন্তু তার এক দোষ শেষের দিকে যারপরনাই নার্ভাস হয়ে যায়। হয়তো এক কঠিন অবস্থা থেকে নিজেকে উদ্ধার করে ধীরে ধীরে ময়দান সাফ করে আনল, তারপর যে মুহূর্তে বোর্ড অবধারিত আমাদের মনে হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ই তার হাত দুটি ফাঁসির আসামির মতো কাঁপতে থাকে। এইভাবে জেতা খেলা আমরা হেরে যাই।

খেলা শেষ হলে অনিমা দুঃখ করে বললো :

—কিছু মনে করো না ভাই, আমার দোষেই হেরে গেলে।

সত্যিই তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তার পরিতাপের সীমা-পরিসীমা নেই। ক্যারাম খেলায় তো হারে নি, তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, জীবনের শেষ খেলাতেই বুঝি তার বাজিমাত হয়ে গেছে! সে অনবরত খুনখুন করছিল।

বস্তুত এমনটিই হয়। বিশেষ করে প্রথম যৌবনের সেই সন্ধিক্ষণে তো নিশ্চয় এমনটিই হয়। খেলাই বল, পড়াই বল, যা কিছুতেই প্রতিযোগিতার একটা ভাব আছে, সেখানে একাগ্র চেষ্টার পর আশাহত হলে বুকটাই ভেঙে যায়। সেদিন অনিমার নৈরাশ্য মাত্রাতিরিক্ত মনে হচ্ছিল। আজ কেবল তা স্বাভাবিক নয়, সমীচীন মনে হচ্ছে। জীবনটা গোড়া থেকেই তার কাছে এক দুর্লভ বস্তু। সে সর্বতোভাবেই জীবনটার সদ্ব্যবহার করতে চায়। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সে পরাজিত হতে চায় না। তার নিষ্ঠা আছে, সে তার নিষ্ঠার পুরস্কার চায়। কেনই-বা চাইবে না?

যাই হোক, দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা এ আখ্যায়িকার উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং যেখান থেকে সরে এসেছি সেখানেই ফিরে যাই।

দ্বিতীয়বার খেলতে বসলাম। এবার পার্টনার হলাম আমি আর মুশতাক। অনিমা আর সেলিনা। বলা বাহুল্য, আমাদেরই জিতবার কথা।

কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম, মুশতাক ফাজলামি করছে বেশি, খেলছে কম! আমি একার চেষ্টায় কতদূর এগিয়ে নিয়ে যাব? একক চেষ্টায় আর যে খেলাতেই জেতা যাক না কেন, কোনো ‘ডাবস্‌’ খেলায়, বিশেষ করে ক্যারামের ডাবল্স্ খেলায় বিশেষ সুবিধা করা যায় না।

‘বেসের’ একটা সহজ মার যখন মুশতাক গুবলেট করে দিলো, আমি তখন রীতিমতো রেগে উঠলাম।

মুশতাক হাসতে হাসতে জবাব দিলো :

—তুই ভাবছিস কি। ওরা যখন বিশ করবে, তখন আমরা খেলা শুরু করব। মেয়েদের একটু গ্রেস দিতে হয়।

হলোও তাই। অনিমা-সেলিনার নম্বর যখন বিশ, আমাদের তখনো শূন্য।

এইবার মুশতাক খেলা শুরু করল। সে কি খেলা! ক্যারাম খেলা যে এত দর্শনীয় হতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। কত সব অকল্পনীয়, অদৃশ্যপূর্ব, অনবদ্য মার। মুশতাকের সরু সরু আঙুলগুলো যেন খেলছে না, সেতারের তার নাড়ছে। দুটি গুটির মাঝ দিয়ে, তিনটির মাথার ওপর দিয়ে, চারটির পাশ দিয়ে, যতসব সম্ভব-অসম্ভব কোণ থেকে, সে কি এক একটা মার। মুশতাকের মতো খেলোয়াড়ের হাতে ক্যরাম খেলা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে।

কিন্তু মেয়েরাও অত সহজে হাল ছাড়বার পাত্রী নয়। যে সুবিধা তারা একবার পেয়ে গেছে সে সুবিধা তারা হেলায় হারাবে না।

হারল না। তারাই জিতল। আমরা চব্বিশ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলাম।

তৃতীয় খেলায় আমি আর সেলিনা পার্টনার।

এতক্ষণের ফলাফল; আমি দুটোই হেরেছি, সেলিনা দুটোই জিতেছে, অনিমা আর মুশতাক একটি জিতেছে।

এইবার তৃতীয় আর শেষ খেলা।

মুশতাক অনিমাকে ভরসা দিয়ে বললো :

—তুমি ভেব না। এবার আমরাই জিতব।

কিন্তু উত্তর এলো অনিমার কাছ থেকে নয়, সেলিনার কাছ থেকে। সে বললো :

—তাতে আমারও সন্দেহ নেই। ‘ডাবলস্ খেলার’ তো এই বিপদ।

সেলিনা কখনোই তার ভাইয়ের সঙ্গে একমত হয় না, বিশেষ করে যেখানে তাদের পরস্পরের শ্রেষ্ঠত্বটাই প্রতিপাদ্য সেখানে তো কিছুতেই নয়। কিন্তু আজ সে অপ্রত্যাশিতভাবে একমত হলো।

আচ্ছা। তাহলে সেলিনার আশঙ্কা এই যে আমারই খেলার দোষে হেরে যাবে।

আমিও রুমাল মুখে পুরলাম।

মুশতাক আমার এই অভ্যাসের কথা জানে। কিন্তু সে এই সঙ্কেত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো :

—শাকের, তোর রুমাল পকেটেই রাখ। এ খেলা তোকে জিততে দেব না।

আমি সে-কথার কোনো জবাব দিলাম না। কিন্তু রুমাল মুখ থেকে সরিয়েও নিলাম না। ক্যারাম খেলায় মুশতাক অনন্য তা একশ’বার মানি। তবু মনে মনে বললাম : দেখাই যাক না। অধ্যবসায়ের যদি কোনো মূল্য থাকে, তো আজ আমাকে সেই মূল্য পেতে হবে।

এমন অবস্থায় খেলতে বসা আর কিছু নয়, নিজের স্নায়ুর ওপর জুলুম করা। সেলিনা প্রথম দুটি খেলাতেই জিতেছে, তৃতীয় ও শেষ খেলাতেও সে জিততেই চায়। অথচ আমাকে পার্টনার দেখে সে আগে থেকেই হার মেনে বসে আছে! মুশতাকও আগে থেকেই ঘোষণা করেছে, সে আমাকে জিততে দেবে না। অবস্থা যখন এই, তখন খেলতে বসা স্নায়ুর ওপর জুলুম ছাড়া আর কি।

এমন একাগ্র নিষ্ঠা আর মনোযোগের সঙ্গে জীবনে অন্য কোনোদিন অন্য কোনো কাজ আমি করেছি কি না সন্দেহ, সেদিন ক্যারাম যেভাবে খেলেছিলাম। কেবল মারগুলো পরিপাটি হলেই ক্যারাম খেলায় জেতা যায় না। বিশেষ করে প্রথম শ্রেণীর খেলায় হাতের চাইতে বুদ্ধির খেলাই বেশি। নিজের দুটি গুটি সহজেই ফেলতে পারি; কিন্তু তাহলে প্রতিপক্ষের তিনটি গুটির পথ সাফ হয়ে যায়। তাই নিজের একটি গুটি স্থানান্তরিত করে বিপক্ষ দলের অনেকগুলো গুটির পথ রোধ করে দিই। ধীরে ধীরে যেন পা টিপে টিপে শত্রুর শিবিরের দিকে এগুতে থাকি। শত্রুও সেইভাবে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তার জাল বিস্তার করতে থাকে।

এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের খেলা চলতে থাকল। খেলার গতি ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো কখনো এদিক, কখনো ওদিক।

শেষ ‘বোর্ডে’ তখন ফলাফল : মুশতাকদের নম্বর আঠাশ, আমাদের তেইশ, কিন্তু ‘রেড’ আমরাই ‘পট’ করেছি। অর্থাৎ যে-দল এই ‘বোর্ড” জিতবে, খেলাও তারাই জিতবে।

আমার ডান দিকের পকেটের ঠিক মুখের সামনে দুটি কালো গুটি। মুশতাকদের গুটি। কালো গুটি দুটির মাঝখানের আধ ইঞ্চিরও কম ব্যবধান আর সেই ফাঁকটুকুর কাছ ঘেঁষে আছে, আমাদের একটি সাদা গুটি, আমাদের শেষ গুটি। ‘বোর্ডে’ তখন মোট তিনটি গুটি, দুটি মুশতাকদের, একটি আমাদের।

পকেটের মুখের সামনে বটে, কিন্তু এত কাছে নয় যে ‘বেস’ থেকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করতে পারি। একমাত্র উপায় যদি রিবাউন্ডে’ ফেলতে পারি। সে বলতে গেলে এক অসাধ্য ব্যাপার। ‘রিবাউন্ড’ মারলে আমাদের সাদা গুটি না পড়ে মুশতাকদের দুটি কালো গুটির একটি পড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। অথচ সেই চেষ্টাই আমাকে করতে হবে।

মারটি অতিশয় দুরূহ সন্দেহ নেই। কিন্তু গুটিটি ‘পট’ করতে পারলে আমরা ‘গেম’ জিতে যাব। কারণ ইতিপূর্বেই আমরা তেইশ করেছি এবং এবারো আমরাই ‘রেড’ পট করেছি। কিন্তু সাদা গুটিটা ফেলতে না পারলে খেলায় জিতে যাবে মুশতাক-অনিমা। কেবল যে মুশতাকের দম্ভই সত্য হবে তাই নয়, সেলিনার আশঙ্কাও যথার্থ প্রমাণিত হবে।

আমি যদি আমার গুটি ফেলতে না পারি তাহলে আমার ডান পাশে মুশতাক সহজেই তাদের কালো গুটি দুটি ফেলে দেবে। তাদের কালো গুটি দুটি মুশতাকের বেসের কাছে পাকা ফলের মতো টপ করে ঝুড়ির মধ্যে পড়বারই অপেক্ষা করছে।

সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে দেখছে, অপেক্ষা করছে, আমি কি করি। অনিমার চোখ-মুখ পাথরে খোদাই করা মূর্তির মতোই নিথর ভাবলেশহীন। সেলিনার মুখে ঝড়ের পূর্ব-মুহূর্তের সঙ্কেত— কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। বুঝতে পারছিলাম, অসহ্য প্রতীক্ষায় তার শরীর কাঁপছে।

এমনকি মুশতাকও উৎসুক।

আর বলা বাহুল্য, আমার মনের অবস্থাটাও তখন ঈর্ষা করবার মতো নয়।

আমার সমস্যা এই : কালো গুটি দুটির মাঝখানে ফাঁক বড় কম। প্রথমত মারতে হবে রিবাউন্ড। রিবাউন্ড মারে কালো গুটি দুটিকে দু’দিকে সরিয়ে দিয়ে তারই মাঝ দিয়ে সাদা গুটিটিকে গলিয়ে দিতে হবে। বড় সহজ কাজ নয়।

সহজই হোক আর কঠিনই হোক, পারি আর না পারি, চেষ্টা তো করতে হবে।

দাঁত দিয়ে রুমালটি ভালো করে চেপে ধরলাম। ‘স্ট্রাইকারটাকে’ একেবারে বামদিকে সরিয়ে আনলাম। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে লাগালাম এক ‘রিবাউন্ড’ মার। স্ট্রাইকারটি আমাদের সাদা গুটিটির ঠিক মাথার ওপর বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। কালো গুটি দুটি তারই ধাক্কায় সসম্মানে দু’দিকে সরে গেল, আমাদের সাদা গুটিটি রাজার মতো সমারোহ আর মর্যাদায় গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল।

মুশতাকের গলার ভিতর থেকে ঝাঁপ দিয়ে বেরিয়ে এলো দুটি কথা :

—ওয়ান্ডারফুল শট্।

এইবার আমি রুমাল পকেটে পুরলাম।

এক ঢিলে দুই পাখি মারলাম। মুশতাকের দম্ভ আর সেলিনার আশঙ্কা দুই-ই মিথ্যা প্রমাণিত হলো।

এতক্ষণে সেলিনা হাত-পা ছেড়ে আরাম করে বসল।

এই সময় চাচি এসে বললেন :

—চলো চলো শিগগির। খাবার তৈরি।

যেতে যেতে অনিমা মুশতাককে উদ্দেশ করে বললো :

–তোমার ওভার-কনফিডেন্সের জন্য তুমি হার।

কথাটি ঠিক। মুশতাক আর অনিমা পর্দা তুলে বেরিয়ে গেল।

তাদের পিছনে সেলিনা। সবার শেষে আমি।

সেলিনা পর্দার কাছে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বললো :

–থ্যাঙ্কস্।

তারপর পর্দা তুলে চলে গেল।

তার হাতের চুড়ি আর পর্দার রিঙ এক সঙ্গে বেজে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *