উতলা দখিন বাতাসে
গোটাদুয়েক ঋতু বড় লাজুক হয়ে পড়েছে। দর্শক-সচেতন অভিনেতার মতো। মঞ্চের প্রবেশ-দ্বারে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারে। অবশেষে প্রয়োগকর্তার ধাক্কা খেয়ে মঞ্চে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অস্পষ্ট কয়েকটি সংলাপ বলে ছুটে পালায়। কোথায় হেমন্ত! কোথায় বসন্ত! দখিন দুয়ার সমান্য উন্মোচিত হয়। মন-কেমন-করা বাতাস ছুটে আসে। সতর্ক প্রকৃতি তৎক্ষণাৎ দুয়ার টেনে দেন। বড় সাবধানী। বসন্ত আমাদের জীবন ছুঁয়ে যাক, এ যেন তাঁর ইচ্ছা নয়। আমরা গ্রীষ্মে দগ্ধ হব। বর্ষায় তালগোল পাকাব। সুখ আমাদের সহ্য হবে না।
এক সময় বসন্ত ছিল। ছিল আমাদের ছাত্রজীবনে। মনে ছিল, না বাইরে ছিল, ভেবে দেখতে হয়। মনেই না-কি মথুরা! বয়েসেই শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত! মনে যদি ফুল না ফোটে, উদ্যানভরা ফুলে কী করবে! মনে যদি কোকিল না ডাকে, গাছের কোকিলে কী হবে! মাইন্ড ইন ইটস ওন প্লেস ক্যান মেক এ হেল অফ হেভেন অ্যান্ড হেভন অফ হেল।
সেদিন এক নিউট্রিসানিস্টের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এখন না-কি, দু-ধরনের ম্যাল-নিউট্রিসান দেখা যাচ্ছে। গরিবের অপুষ্টি আর ধনীর অপুষ্টি। কারুর জুটছে না, আর কারুর এত জুটছে যে, জীবনে অরুচি ধরে যাচ্ছে। ইয়া বড় এক তালশাঁস সন্দেশ নিয়ে মা ছুটছেন আদুরে ছেলের পেছন-পেছন। খেয়ে যা বাবা, খেয়ে যা বাবা। ছেলে নাকে কেঁদে বলছে আমার আর ভালো লাগে না। ফেলে দাও নর্দমায়। ছেলের ইস্কুলে গিয়ে মা দেখলেন, একটি ছেলে ভারী হৃষ্টপুষ্ট, তেলচুকচুকে। অমনি শুরু হল নিজের ছেলেকে তিরস্কার। কেন তুই অমন হতে পারিস না। ডিম, ছানা, দুধ, মাংস, ভিটামিনের আক্রমণ শুরু হল। ছেলে ভাবছে, এর চেয়ে উপবাস ভালো ছিল। মার্ক টোয়েনের প্রিন্স অ্যান্ড পপারের মতো।
বাড়ি একেবারে ফেটে যাচ্ছে। কী ব্যাপার! রোজ মুরগির ঠ্যাং চিবিয়ে চিবিয়ে পরিবারস্থ সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ছানা নিয়ে দক্ষযজ্ঞ। মেয়ে বলছে, যম এত লোককে নেয়, আমায় নেয় না কেন! ছেলে খাটের তলায় সেঁদিয়ে বসে আছে। ধরতে গেলেই থাবা মারছে। মা চিৎকার করে কর্তাকে বলছেন, পুলিশে খবর দাও, টিয়ারগ্যাস চার্জ করে বের করে আনুক শয়তানটাকে।
কর্তা বলছেন, আগে মশামারা ধূপ দিয়ে ট্রাই করো। ফেল করলে লঙ্কাপোড়া ধোঁয়া দাও! ওদিকে বাইরের ফুটপাথে? কর্পোরেশনের রেলিঙে বাবুদের বাড়ি থেকে চেয়ে-আনা রুটি শুকোচ্ছে। আজ চলবে, কাল চলবে। বাজারের পাশ থেকে কুড়িয়ে-আনা পচা শাকসবজি ফুটপাথের নর্দমার ধারে ফেলে মরচে ধরা একখন্ড লোহা দিয়ে তরিবাদি করে কোটাকাটা হচ্ছে, যেন চিনে রেস্তোরাঁয় এখুনি ভেজিটেবল চৌচৌ বসবে। ভাঙা হাঁড়িতে জল ফুটছে। পাশে বসে আগুনে ভাঙা প্যাকিং বাক্সের টুকরো ঠেলছে বাংলার বধু, বুকে তার মধু, নয়নে নীরব ভাষা।
বসন্ত আর লজ্জায় আসে না। কী হবে এসে। কোথায় উদ্যান! কোয়েলা কোথায়! কোথায় সূক্ষ্ম উত্তরীয়ধারী, দীর্ঘকেশ কবি! কোথায় যৌবন-মদালসা নায়িকা! বসন্ত আসবে কোথায়? মনুমেন্টের তলায়, যার তলদেশ থেকে উৎসারিত সমস্ত রাজনৈতিক বাণী এখন সম্পূর্ণ একটি পরিকল্পনা। এই পঙ্ক থেকেই রাজনীতির পদ্মসমূহ প্রস্ফুটিত হয়ে দিকে দিকে শোভিত। চামচা-ভ্রমরের দল ভনভন করছে। আর বিরহীর দল বলছে; কোয়েলিয়া গান থামা এবার/ তোর ওই কুহুতান/ভালো লাগে না আর।
বৃদ্ধরা যেমন বলেন, সে একটা সময় ছিল, যখন ঘিয়ে ঘি ছিল, তেলে তেল ছিল, মানুষে মানুষ ছিল। ঋতুতে ঋতু ছিল। আমিও বলি, আমাদের যৌবনে বসন্ত ছিল। সন্ধের দিকে রাস্তাঘাট বসন্তের বাতাসে কেমন যেন ভিজে-ভিজে হয়ে উঠত। মাতাল বাতাস দুলে উঠত বারান্দা থেকে ঝোলানো চিত্রবিচিত্র শাড়িতে। লোডশেডিংয়ের কোনও আতঙ্ক ছিল না। ঘরে-ঘরে আলো, হাসির ফোয়ারা। কুলফি মালাই হেঁকে যেত পাড়ায় পাড়ায়। প্যাঁঠার ঘুঘনি আসত আর একটু বেশি রাতে। রকে রকে জমাট আড্ডা। এরই মাঝে প্রজাপতি উড়িয়ে, গোড়ের মালা গলায়, বর চলে যেত চোখের সামনে দিয়ে হুস করে। দূর থেকে ভেসে আসত সানাইয়ের প্যাঁচানো সুর। গহনার দোকানের দেয়ালজোড়া আয়নায় আয়নায় লাখ লাখ চোখে লোভ ঝলসাত। ফাগুন এসেছে, ফাগুন। আগুন আসছে পিছু-পিছু। ফিনফিনে পাঞ্জাবি উড়িয়ে বিক্রেতা ক্রেতাকে জড়োয়ার সেট দেখাচ্ছেন। ওদিকে বহুদূরে তাজমহলের মাথার ওপর চাঁদ উঠছে। আগ্রা ফোর্টে বসে আছে সাজাহানের প্রেতাত্মা। সেনেট হলের থামের মাথায় মাথায় বিনিদ্র পায়রার দল বুকের কষ্টে কেতি পাড়ছে। গোটাতিনেক ভালো সরবতের দোকান ছিল। চটে বরফ পুরে কাঠের মুগুরের ঠ্যাঙানি। ভেতরে জমাট জলের কুঁচি কুঁচি হওয়ার কান্না। গোলাসে গেলাসে সাদাঘোলে গোলাপি সিরাপের নেশা। আরকের গন্ধ ছুটছে, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি, গ্রিন ম্যাঙ্গো, পাইনঅ্যাপল। প্রেমসমুদ্রে বরফ যেন হাবুডুবু। বিয়েবাড়ির গুরুভোজনে বরযাত্রী হাঁসফাঁস। পানবিড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। চুনোট-করা ধুতি পেছনে পেখম মেলে আছে। মিহি পাঞ্জাবির তলায় গেঞ্জির আভাস। সোডা লেমনেড চেয়েছেন। বোতলের মুখে যন্ত্র রেখে দোকানদার ঘা মারছেন। গলার গুলি সশব্দে তলিয়ে যাওয়ার আগে বোতলের মুখে বায়বীয় জলের গ্যাঁজালা। হাত বাড়িয়ে সিক্ত বোতল নিতে নিতে ক্রেতা আয়নায় নিজের মুখ দেখছেন। বন্ধুর শ্যালিকাটি মনে বড় দোলা দিয়েছে। পানের খিলি নেওয়ার সময় হাতে হাত ঠেকেছে।
ওস্তাদ আসর ফেলেছেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুটের হলে। পরজ বসন্তে আলাপ চলেছে। সমঝদার বলছেন, একেবারে স্পেলবাউন্ড করে দিলে হে। কী সুর! তিন সপ্তকে সহজ আনাগোনা। দুদিকে দুই বিশাল তানপুরা ম্যাওম্যাও করে সুর ছাড়ছে। ওস্তাদজি মাঝে মাঝে সুরমণ্ডলে আঙুল টানছেন। সপ্তসুর ঝিলিক মেরে উঠছে। কর্মকর্তারা বুকে ব্যাজ এঁটে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ঘুরছেন। কারুর কারুর কাঁধে এখনও শাল। বড় সাবধানী। দখিনা বাতাস মৌজের সঙ্গে বসন্তও ছড়ায়। সাবধানের মার নেই, মারের সাবধান নেই। গাড়ি এসে দাঁড়াল যন্ত্রপাতি নিয়ে, নামছেন বেগম আখতার। রাত দুটোয় বসবেন বড়ে গেলাম আলি। লম্বালিস্ট। সারা রাত চলবে মাইফেল। শ্রোতারা ভাঁড়ের চা খেয়ে ঘুম তাড়াচ্ছেন। সারেঙ্গি ওদিকে সুরের মোচড় মারছে। মাঝেমাঝেই রহিশ আদমিদের গাড়ি আসছে। সরব অভ্যর্থনা, আসুন আসুন। বোতলে গেলাসে ঢালছে রঙিন মদিরা। রক্তস্রোতের মতো মৃদু কুলুকুলু শব্দ। ওস্তাদজি ঠুংরির মুখ ধরছেন, মুসে তো কুচ বোল।
মির্জাপুরের তেলেভাজার দোকানে হামানদিস্তায় মশলা গুঁড়ো হচ্ছে, ঢাউস, ঢাউস, ঢনঢন। ফাঁকা স্টান্ড রোডে একটি মাত্র ছ্যাকরাগাড়ি, ছিড়িক ছিড়িক শব্দে চলেছে। চিৎপুরে কাবাবের দোকানে বিশাল হাঁড়ি কাত হয়ে আছে। তলায় ধিকিধিকি করছে কাঠকয়লার আগুন। তাওয়ায় রোগনজুস চর্বির মধ্যে পিটির পিটির করছে। কেওড়া, জায়ফল, জাফরানের গন্ধ উড়ছে বসন্তের বাতাসে। দোকানে ঠাসা খদ্দের। নাখোদার তলায় সারসার দোকানে আতরের পলকাটা শিশি আলোয় চিকচিক করছে। কাঠির আগায় জড়ানো তুলোর কুঁড়ি সারসার ফুটে আছে।
নিস্তব্ধ অফিসপাড়া। বিশাল বিশাল বাড়ির তলায় নিস্পন্দ রাস্তা পড়ে আছে চওড়া ফিতের মতো। বাতাস লেগেছে ছেঁড়া শালপাতার ঠোঙায়। বিহারীর ঢোল পেটাচ্ছে আর তারস্বরে হোলির গান গাইছে, রামা হো শ্যামা হো। বসন্তের রাত যত বাড়ছে, মানুষের ফুর্তি তত বাড়ছে। দেশে তখন এত ঘাতক ছিল না। রাত ছিল শান্তির। পাড়ায় পাড়ায় বোমবাজি ছিল না। বোমারুরা হয়তো ছিল ভ্রুণের আকারে ভবিষ্যতের গর্ভে। দশভরি সোনার গহনা পরে সুন্দরী মাঝরাতে পান চিবোতে চিবোতে ঘরে ফিরছেন নি:শঙ্ক। বসন্তের মতো আইন-শৃঙ্খলাও তখন অদৃশ্য হয়ে যায়নি। শীতের ধোঁয়াশা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বাতাস। ঝনঝনে রাত। তারার খই ফুটছে আকাশে। বাংলার ছড়ানো প্রান্তর পড়ে আছে নীচে। অযোধ্যা পাহাড়ের দিক থেকে রাস্তা বাঁক নিয়েছে, যেদিকে বাঘমুন্ডি সেদিকে। রাস্তা নামতে নামতে শুয়ে পড়েছে মজানদীর বুকে। ভিজে বালিতে পা দেবে যাচ্ছে। চারপাশের বনস্থলিতে বসন্তের বাহার লেগেছে। আসছে পলাশ লাল ডানা মেলে। সুপ্ত পৃথিবী। পাহাড় ধ্যানমগ্ন। মানুষ কিন্তু জেগে। বিশাল শিমুলের কোটরে প্রদীপ জ্বলছে। ছায়ায় কাঁপছেন দেবতা বোঙ্গা। বসন্তের মধ্যরাতে সাঁওতালিদের পরব শুরু হয়েছে। পাথরে কোঁদা সচল নারীমূর্তি প্রদীপ হাতে চলেছে দেবস্থানে। কচি ছাগশিশু থেমে থেমে কাঁদছে। ধুপ আর ধুনোর ধোঁয়া সরু চুলের গুচ্ছের মতো আকাশের দিকে উঠছে। মাদলের শব্দ ফিরে ফিরে আসছে। বসন্তের বড় আনন্দ। মানুষ এখনও তাকে চেনে। শুধু সে-ই জেগে নেই, মানুষও জেগে আছে। পাহাড়ঘেরা ছোট্ট প্রান্তর, পৃথিবীর বিরাটমঞ্চের পাদপ্রদীপের আলো যেখানে পড়ে না, সেখানেও প্রচারের টানে নয়, প্রাণের টানে মানুষ ছুটে এসেছে উৎসবের সাজে। পক্ষী-শাবক মায়ের কোলের কাছে জেগে উঠেছে মাদলের শব্দে। ভাবছে এই আমার সুন্দর পৃথিবী। এরই আকাশে একদিন আমাকে ডানা মেলতে হবে। বাজ আছে। থাকুক। তার ক্ষুদ্র ডানার চেয়ে আকাশ অনেক বড়। পথ চলে গেছে দূরে, বাংলার সীমান্ত পেরিয়ে বিহারের দিকে। শালের ডালে নতুন পাতার পদশব্দ। সারা বনভূমিতে প্রাণের আগমনের বিনবিন শব্দ। শীতের ঘুম ভেঙে সরীসৃপ এসেছে গর্তের বাইরে। মাছের মা ডিম পাড়ছে শীতল জলের কিনারায়। হরিণশাবক জল খাচ্ছে চকচক শব্দে। সারা পৃথিবী যখন সুপ্ত তখন পাথরের গা বেয়ে কুলকুল করে জলধারা নেমে আসছে ক্ষুদ্র একটি জলাধারে। প্রকৃতির প্রতি কোণে কোণে যে খেলা চলেছে, মানুষ হয়তো তার সাক্ষী নয়, সাক্ষী কীটপতঙ্গ, অরণ্যজীবন, বৃক্ষশাখা, ক্ষুদ্র বনলতা। মানুষের নিদ্রা আছে। সৃষ্টির চোখে ঘুম নেই। তার মণিবন্ধে বাঁধা নেই সময়ের ঘড়ি। বসন্তে পৃথিবী বড় মোলায়েম। স্তনদায়িনী মাতার ভিজে বুকের মতো।
মধ্যরাতে মালকোষে গান ধরেছিলেন শিল্পী। ভূত-জাগানো রাগ। গান শেষ হবার পরও সুর ভাসছে, মধ্যগগনে দ্বিপ্রহরের চিলের মত। পুব আকাশে আলোর চিড় ধরেছে। শেষরাতের বাতাসে শীতের কঙ্কাল-আঙুলের ছোঁয়া। কে যেন দেখেছিল নদীর চরে পড়ে আছে একটি কঙ্কাল, তার হাতের আঙুলে তখনও ধরা আছে একটি শাঁখার আংটি। ঊর্ধ্বোত্থিত পায়ের ওপর স্থির হয়ে বসে আছে নীল একটি মাছরাঙা। স্বচ্ছ জল বাতাসের স্পর্শে বৃত্তাকারে ভেঙে ভেঙে একদা জীবনের সাক্ষী কঙ্কালটিকে জীবনের কোন গান শোনাতে চাইছে! সেই ঊষার আকাশ লক্ষ করে শিল্পী ধরেছেন শেষ গান, যোগিয়া রাগে। ধর্মে ইসলাম, আবাহনে মানব। সৃষ্টিকর্তাকে সুরে সুরে বলতে চাইছেন—দাতা তু হ্যায় করতার। অশ্রুসিক্ত সুর ধূপের ধোঁয়ার মতো ঘুরে ঘুরে আকাশপানে উঠছে। ফুলশয্যায় নায়কের কোলের কাছে নায়িকার খোঁপাভাঙা মাথা। রাতের রজনীগন্ধার স্তবক থেকে টুপ করে খসে পড়ল একটি ফুল। রঙ্গমঞ্চে ভেলভেটের পরদা নামছে। প্রাচীন আয়নার সামনে যৌবনের অঙ্গরাগ তুলছেন প্রবীণ অভিনেতা। দেবদারুর শাখায় সুর তুলছে উতলা কোকিল। কোথায় সেই বসন্ত! মানুষ মেরে ফেলেছে। সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে কংক্রিটের দেওয়াল তুলে।