উড়ুক্কু লাটিম ও কাটরুবুড়ো – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

উড়ুক্কু লাটিম ও কাটরুবুড়ো – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সবুজ পাহাড়ের ঢালে খাঁজকাটা কয়েক টুকরো ভুঁই। পাশ দিয়ে ঝরঝর করে নেমে যাচ্ছে একটা ঝরনা। সেই জলে ভুঁইগুলির চাষ করে লোকটা। উঁচু দিকটায় একটা কাঠ-বাঁশ-খড়ের টং। সেটাই তার ঘর।

সকালে কাঁধে বন্দুক আর ব্যাগে ডজনখানেক ছররা গুলি নিয়ে বেরিয়েছিলুম তিতির মারতে। সঙ্গে আমার প্রিয় কুকুর জিম। নীচের উপত্যকায় ঘাসের জঙ্গলে নাকি অনেক তিতিরের ডেরা।

ঝরনার ধারে যেতেই লোকটার সঙ্গে দেখা। মাথায়-সাধুবাবাদের মতো চুড়োবাঁধা প্রচণ্ড সাদা চুল আর তেমনি দাড়ি। খালি গা, খালি পা, পরনে একফালি ন্যাতার মতো কাপড় জড়ানো। হাতে খুরপি। ঝুপসি জামুনগাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাকে একটা সিগারেট দিলুম। নিজে একটা ধরিয়ে নিলুম। তারপর তিতিরের খবর জানতে চাইলুম। তখন সে ভাঙা-ভাঙা হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে একটা অদ্ভুত গপ্প শোনাল।

নীচের সমতল উপত্যকায় দিব্যি চাষ করা যেত। কিন্তু এই যে সে পাহাড়ের গায়ে উঠে এসে ভুঁই করেছে কেন, সেটা আমার জানা উচিত, বিশেষ করে আমি যখন নীচের ঘাসের জঙ্গলে তিতির মারতে যাচ্ছি। বছর কয়েক আগে ওই ঘাসজমি ছিল তার চাষের ভুঁই। ফসল ফলত অঢেল। ঝরনাটা ওখানে নদী হয়েছে। সেই নদীর চড়ায় এক রাত্তিরে স্পষ্ট দেখল কী, একটা পেল্লায় লাটিমের মতো আজগুবি জিনিস আকাশ থেকে নেমে এল। বনবন করে সেটা ঘুরছিল। ঘুলঘুলির মতো ফোকর ছিল লাটিমটার চারদিকে। আর সেখান দিয়ে ঠিকরে পড়ছিল রং-বেরঙের আল। কিছুক্ষণ তুলকালাম ঝড় বইছিল। অথচ আকাশ ফাঁকা। ঝলমলে তারা জ্বলছে। ঝড়টা থামলে লাটিমটার ঘুরপাক থামল, অথবা লাটিমটার ঘুরপাক থামলে ঝড়টা থামল। তখন সাহস করে লোকটা টং থেকে নেমে নদীর ধারে গেল ব্যাপারটা জানতে। সেইসময় লাটিমের ফোকর থেকে দুটো বেঁটে, পেটমোটা, কালো দু’ঠেঙে প্রাণী বেরোল। তারপর সটান তার কাছে চলে এল। নদীতে তখন জল ছিল না। তারা তার কাছ-বরাবর এল। তারপর যা বলল, তা হচ্ছে, কে-ক্কে-ক্কে-ক্কে…কি-ক্কি-ক্কি-ক্কি…ডা-ড্ডা-ড্ডা-ড্ডা…ডি-ড্ডি-ড্ডি-ড্ডি…

‘বল কী! তা, তুমি কী বললে?’

‘আমি কী বলব?’ লোকটা একটু হাসল, ‘আমি তো ভয়ে কাঠ। মুখে কথাটি নেই। ওরা একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। লাটিমটার ফোকর গলিয়ে ঢুকে পড়ল। তখন আবার সেটা বনবন করে ঘুরতে লাগল। ফোকর দিয়ে তেমনি রং-বেরঙের আল ঠিকরে পড়তে থাকল, তারপর ফের শনশন করে দারুণ ঝড়। লাটিমটা মাটিছাড়া হয়ে চোখের পলকে উড়ে আকাশের তারার সঙ্গে মিশে গেল। ঝড়টাও থেমে গেল।’

লোকটা একা এই পাহাড়-জঙ্গলে থাকে। সে যে গপ্পটা বলল, তা নিশ্চয় ‘ইউফো’ বলতে যা বোঝায়, তা-ই। এরকম একটা নিরক্ষর লোক, যে জীবনে কখনো শহরে গেছে কী না সন্দেহ, তার মুখে ইউফো-বৃত্তান্ত শুনে আমি তো তাজ্জব। লোকটা আমাকে পইপই করে নীচের উপত্যকায় যেতে বারণ করে চলে গেল। জিম ঝরনার ধারে একটা পাথরে বসে নিশ্চয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিল, এমন তার ভঙ্গি। ডাকলুম, ‘জিম, চলে আয়।’

জিম যেন একটু বিরক্ত হয়েই আমার সঙ্গ ধরল। সেই লোকটা তার চাষের ভুঁইয়ে বসে লক্ষ করছিল, আমি কী করি। না, তাকে খুশি করার জন্য নয়, কিংবা ভয় পেয়েও নয়। আমি বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তের কাছে ফিরে যাচ্ছিলুম। ওপাশে নীচু টিলার গায়ে তাঁর বাড়ি। সে বড়ো অদ্ভুত বাড়ি। যেন কিউবিক চিত্রকলা। টিলাটা ঘন সবুজ। তার গায়ে ওই বাড়িটায় রং-বেরঙের ত্রিভুজের জটিলতা। বাইরের লোকের পক্ষে দরজা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া আরও ব্যাপার আছে। দরজা জানা থাকলেই হল না, সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে হবে। তা হল, ‘হিং টিং ছট!’ অমনি দরজা খুলবে।

সেই আলিবাবা ও চল্লিশ চোর গপ্পের ‘চিচিং ফাঁকে’র মতো আর কী। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত রসিক মানুষ। সেটা কোনো কথা নয়। ওঁর কিছু গোপন কাজকর্মের ব্যাপার আছে। বহু বছর ধরে এই নির্জন জঙ্গলে এলাকার বহু আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্যালাক্সিতে কোথাও সভ্য প্রাণী আছে কি না ঢুঁড়ে-ঢুঁড়ে হন্যে হচ্ছেন। কাজেই তাঁকে এই লাটিম-ইউফোর ঘটনাটি বলা দরকার।

জটিল জ্যামিতিক আঁকিবুকির মতো বাড়িটার দরজার সামনে গিয়ে বললুম, ‘হিং টিং ছট! ‘অমনি দরজা খুলে গেল। আমরা ঢুকলে বন্ধ হয়েও গেল। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তকে খুঁজে পেলুম ওঁর ল্যাবরেটরিতে। আমাদের দেখে একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘এত শিগগির ফিরে এলেন যে! পেলেন তিতির?’

বললুম, ‘একটা খবর আছে। ঝরনার ধারে একটা লোক ইউফো দেখার গপ্প বলল। তাই শুনে….’

কথা কেড়ে বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত বললেন, ‘কাটরু তো? ও একটা ধড়িবাজ। উড়ুক্কু লাটিমের গপ্প ও এ-পর্যন্ত অসংখ্য শিকারিকে বলেছে। আসলে ও চায় না, উপত্যকায় কেউ পাখি মারুক। পাখি মারা ওর পছন্দ নয়। আপনি লক্ষ করেননি, পাখিগুলি ওকে ভয় পায় না। ওর কাঁধে বা মাথায় বসে থাকে।’

‘কিন্তু ইউফো ব্যাপারটা ওর মতো লোকের কল্পনা করা তো অসম্ভব। ও যে বর্ণনা দিল, তার সঙ্গে অনেক বিলিতি সায়েন্স-ফিকশনে পড়া মহাকাশযানের আশ্চর্য মিল।’

কথাটা বলে আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালুম।

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত একটা কম্পিউটারের সামনে বসে কয়েকটা বোতাম টেপাটিপি করতে করতে বললেন, ‘আপনি নিশ্চিন্তে তিতির মারতে যান। শুধু একটা বিষয়ে সাবধান। সেবারকার মতো মহাজাগতিক কাল-ঘুড়ির পাল্লায় পড়বেন না। আর জিমকে সঙ্গ-ছাড়া করবেন না। ওকে সেবার অনেক কষ্টে উদ্ধার করেছিলুম, মনে আছে তো?’

মনে পড়ে গেল। সে অবশ্য আলাদা গপ্প। একই মফৎসল শহরের বাসিন্দা ছিলুম আমি ও বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত। খেলার মাঠে অবেলায় পড়ে-থাকা একটা কাল-ঘুড়ির ভেতর জিম অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। ঘুড়িটা নাকি এক ধরনের খুদে ‘ব্ল্যাক হোল’। কোনো দূরের গ্যালাক্সি থেকে উড়ে এসেছিল। শব্দ যেমন রেকর্ড করা যায়, তেমনি জীবজন্তু ওর পাল্লায় পড়লে রেকর্ড হয়ে যায়। কী জটিল সমস্যা! রেকর্ড থেকে শব্দ উদ্ধারের মতো। তখন তাদের উদ্ধার করতে হয়। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত না থাকলে জিমকে আমি ফিরেই পেতুম না।

সেই ঝরনার ধার দিয়ে ফের যেতে যেতে কাটরুবুড়োকে খুঁজলুম। দেখতে পেলুম না। হয়তো টঙে উঠে ছাতুটাতু খাচ্ছে।

জিম খুব উৎসাহী। একটু এগোলেই ধমক দিচ্ছিলুম। বলছিলুম, ‘সাবধান জিম! ব্ল্যাক হোল কী সাংঘাতিক জিনিস ভুলে যেও না। একটা বিশাল গ্যালাক্সি কোটি-কোটি বছর বিকিরণ ঘটাতে ঘটাতে যখন ফতুর হয়ে যায়, তখন তার ঘনত্ব বাড়তে বাড়তে আর গুটিয়ে যেতে যেতে এতটুকুনটি হয়ে পড়ে। তখন কী হয় জান? তার নাগালে যা কিছু গিয়ে পড়ে, সে একঝিলিক আল। হোক কী উপ-পারমাণবিক কণিকাই হোক, শুয়ে নেয়। যেন রাক্ষুসে হাঁ। টুপ করে ধরে গিলে খায়। সাবধান!’

সমতলে ঘাসের বনে পৌঁছনো অবধি জিমকে ব্ল্যাকহোল ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলুম। সে আমার পায়ের কাছ থেকে যেভাবে মুখ তুলে তাকাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল পুরোটাই বুঝেছে। মাঝে-মাঝে সে আমার দু’পায়ের ফাঁকে ঢুকে পড়ছিল। হুঁ, ওর মনে পড়েছে সেবারকার সাংঘাতিক ঘটনাটা।

ঘাসের বনের শিশির সবে শুকিয়েছে। ঘাসফড়িংরা বেরিয়ে এসে ঘাসের পাতায় বসে রোদ নিতে নিতে কিরকির করে গান গাইছে। প্রজাপতিরা চনমন করে উড়ে বেড়াচ্ছে। এখানে-ওখানে উঁচু গাছপালার জটলা। সেখানে পাখি ডাকছে। অন্য পাখি মারব না। কেনই বা মারব? তিতিরের মাংস সুস্বাদু। তাই তিতির পেলেই মারব। তিতির থাকে ঘাসের বনে। কখনো আকাশে উড়ে ডাকতে থাকে ট্টি ট্টি ট্টি…ট্টি ট্টি…ট্টি…

কিন্তু কোথায় তিতির? পায়ের শব্দ পেলেই গুড়ি মেরে দৌড়নো অভ্যাস আছে ওদের। তাই খুব নজর রেখে এগোচ্ছি। ঘাসের ভেতর কালো-কালো পাথর ছড়ানো। তারপর সামনে পড়ল নদী। সেই ঝরনাটা এখানে ছোট্ট নদীটি হয়ে পাথর আর বালির চড়ার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। জিমকে কাঁধে তুলে পাথরে পা রেখে-রেখে নদী ডিঙিয়ে গেলুম। তারপর ওপারে ঘাসের বনে পৌঁছতেই কাটরুবুড়োর মুখোমুখি।

সে নিষ্পলক চোখে আমাকে দেখছিল। বলল, ‘তো আপ মেরা মানা না শুনা?’

বললুম, ‘কাটরু, তুমি যাই বল, অন্তত একটা তিতির আমি মারবই।’

‘ঠিক হ্যায়। মারিয়ে।’ বলে সে হাততালি দিয়ে মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করতে থাকল। তারপর যা দেখলুম, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম না।

একটা দুটো করে তিতিরের একটা ঝাঁক বেরিয়ে এল ঘাসের বন থেকে। ওর মাথায়, কাঁধে, কোমরে, পায়ের নীচে তিতির আর তিতির। জিম অনবরত মুখ ভেঙাতে থাকল ওদের। তারপর একসঙ্গে অতগুলি তিতিরের ডাক ট্টি ট্টি ট্টি…ট্টি ট্টি ট্টি…আমার কান ঝালাপালা একেবারে।

কাটরু বাঁকা হেসে বলল, ‘কী হল? বন্দুক ছুঁড়ুন!’

শরৎকালের উজ্জ্বল রোদে এই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটছে আমার সামনে বড়োজোর মিটার দশ-বারো দূরে। কাটরুকে দেখাচ্ছে এই জঙ্গলেরই একটা গাছ, নাকি খুব পুরনো, আদিম আর রহস্যেভরা পৃথিবীর কোনো আজব দুঠেঙে প্রাণী! তারপর যেন চাক মুখেও তিতিরের ডাক শুনতে পেলুম ট্টি ট্টি ট্টি…ট্টি ট্টি ট্টি…ট্টি ট্টি ট্টি…ট্টি ট্টি ট্টি…

সাহস উবে গেল। জিমকে কাঁধে তুলে নিয়েই অ্যাবাউট টার্ন করে নদী পেরিয়ে দৌঁড় দৌঁড় দৌঁড়।

ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তকে দেখলুম বিড়বিড় করে কী আওয়াচ্ছেন, আর চুল খামচে ধরে চোখ বুজে নাক কুঁচকে ফেলছেন। আমার ও জিমের দিকে লক্ষই নেই। কান করে শুনি, কী অবাক! বিজ্ঞানীপ্রবর আওড়াচ্ছেন, ‘কে-ক্কে-ক্কে-ক্কে… কি-ক্কি-ক্কি-ক্কি-ক্কি-ক্কি-ক্কি… ডা-ড্ডা-ড্ডা-ড্ডা-ড্ডা… ডি-ড্ডি-ড্ডি- ড্ডি-ড্ডি…’

ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়লুম। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘ওঃ!’

চন্দ্রকান্ত ঘুরলেন। বললেন, ‘ট্টি-ট্টি-ট্টি-ট্টি-ট্টি?’

‘হ্যাঁঃ!’

‘কাটরু?’

‘হুঁঃ!’

চন্দ্রকান্ত উঠে এলেন আমার কাছে। ওঁকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। চাপা স্বরে বললেন, ‘কাটরু সম্পর্কে আমার ধারণা বদলাতে বাধ্য হয়েছি। একবছর এখানে এসেছি। অথচ ওর সম্পর্কে কিছু তলিয়ে ভাবিনি। লাটিমের গল্পটা ও আমাকেও বলেছিল। তো কিছুক্ষণ আগে আপনি ফের ওর গল্পটা বলে যাওয়ার পর ফোনেটিক ডি-কোডিং যন্ত্রটার সামনে বসলুম। আমাদের এই গ্যালাক্সিতে যতরকমের শব্দ হওয়া সম্ভব, তার মানে শব্দতরঙ্গের হ্রস্বতম থেকে দীর্ঘতম স্তর অব্দি, ওই এফ-ডিতে ফিড করিয়ে সংশ্লেষণের মাধ্যমে উৎস নির্ণয় করা যায়।’

মাথা আরও ঝিমঝিম করতে লাগল কথাটা শুনে। বন্দুকটা পাশে দাঁড় করানো, জিম আমার উরুর ওপর। বেচারা তখনও কাঁপছে। বললুম, ‘কাটরু আমার ঘিলু উপড়ে নিয়েছে চন্দ্রকান্তবাবু। মুণ্ডুটি শুকনো লাউ-এর খোল। ট্টিং ট্টিং ট্টিং বাজনা ছাড়া আর কিছু নেই। আস্ত একতারা বানিয়ে দিয়েছে আমাকে।’

বিজ্ঞানী বললেন, ‘ট্টি-ট্টি-ট্টিতে যাচ্ছি। কে-ক্কে-ক্কে থেকে শুরু করা যাক। এফ-ডি থেকে কী বেরোল জানেন? দেখাচ্ছি।’ বলে একটা কম্পিউটার থেকে জিভের মতো বেরিয়ে থাকা লম্বাটে কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে এলেন। গ্রাফের ছক কাটা কাগজটাতে লাল একটা আঁকাবাঁকা রেখা। ‘কিছু বুঝলেন?’ চন্দ্রকান্ত মিটিমিটি হেসে প্রশ্ন, করলেন।

মাথা নেড়ে বললুম, ‘নাঃ, জ্যামিতি আমার মাথায় ঢোকে না।’

‘জ্যামিতি নয়, অঙ্ক।’

‘অঙ্কে স্কুলে বরাবর গোল্লা পেতুম।’

চন্দ্রকান্ত হতাশ মুখে বললেন, ‘তা হলে তো মুশকিল। যাই হোক, উড়ুক্কু লাটিমটা যে আমাদের গ্যালাক্সির, তাতে আমি নিঃসন্দেহ। আর ওই কাটরু সম্পর্কে আমার ধারণাও বদলানো দরকার। কাটরু…. ক-আ-ট-র-উ… কে-এ-টি-আর-ইউ…কা-ক্কা-ক্কা…ট-ট্ট-ট্ট… রু-রু-রু…’

বিড়বিড় করতে করতে বিজ্ঞানী উঠে দাঁড়ালেন। আবার গিয়ে বসলেন সেই এফ-ডি যন্ত্রটার সামনে। খটাখট বোতাম টিপতে থাকলেন। টিভির মতো ছোট্ট চৌকো কাচের পর্দায় লাল-নীল-সবুজ রঙের ফুটকি আর তরঙ্গরেখা ফুটে উঠল। মিলিয়ে গেল। আবার ফুটে উঠল, আবার মিলিয়ে গেল। তারপর আচমকা উঠে বেরিয়ে গেলেন চন্দ্রকান্ত। আমি তো থ।

কিন্তু জিমের সবটাতেই নাকগলানো চাই। সে আমার উরুর ওপর থেকে তুড়ুক করে লাফ দিয়ে চন্দ্রকান্তের পিছনে দৌড়ল। ‘জিম, জিম, ব্ল্যাক হোল!’ ওকে ভয় দেখাতে দেখাতে আমিও পা বাড়ালুম। কিন্তু দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই জিম বন্ধ দরজায় আঁচড় কাটছে। হাসতে হাসতে বললুম, ‘কী? বেরো এবারে। বুদ্ধু কোথাকার! বল দরজা খোলার মন্তর! পারবি বলতে হিং চিং, ছট?’

এই রে! কেলেঙ্কারি করে ফেললুম তো। সঙ্গে-সঙ্গে দরজা খুলে গেল। আর জিমও একলাফে বাইরে।

বাইরে গিয়ে জিমকে দেখতে পেলুম না। ডাকতে থাকলুম, ‘জিম, জিম, জিম!’ সাড়া না পেয়ে ভয় হল। জিমটা যে বরাবর বড্ড বোকা! চারদিকে ছোটো ও বড়ো সবুজ পাহাড়, মধ্যিখানে উপত্যকা। কাটরুবুড়োর টংটা দেখা যাচ্ছিল। একটু পরে দেখি, সেখান থেকে কাঠের মই বেয়ে নেমে আসছেন বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত। ওঁকে দেখে ঢাল বেয়ে ঝোঁপ-জঙ্গল ভেঙে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলুম। কাটরুর চাষের জমিতে পৌঁছলে চন্দ্রকান্ত আমাকে দেখে একটু হাসলেন। হন্তদন্ত বললুম, ‘জিমকে দেখেছেন?’

চন্দ্রকান্ত এ-কথায় কানই দিলেন না। বললেন, ‘ঠিকই ধরেছি। কাটরুর জমিতে এই সবুজ উদ্ভিদগুলি লক্ষ করুন। আমরা ফসল বলতে যা বুঝি, এগুলি মোটেও তা নয়। ধান নয়, গম নয়, বাজরা নয়, ভুট্টা নয়, অড়হর নয়—তার মনে পাহাড়ি মাটিতে যা ফলে, তার কোনোটাই নয়। অথচ এগুল ফসলই।’ বলে উনি ঘাসের মতো দেখতে একটা গুছি থেকে শিষ ছিঁড়ে নিলেন। তারপর আপনমনে খিকখিক করে হেসে উঠলেন।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে জিমকে খুঁজতে খুঁজতে আনমনে বললুম, ‘হাসছেন কেন?’

‘ভুল হয়ে গেছে। আসলে এগুলিকে বলে কাংনিদানা। পাখিকে খাওয়ানো হয়। এ আপনি শহরের পশুপাখির খাদ্যভাণ্ডার পেয়ে যাবেন।’ চন্দ্রকান্ত শিষটা ফেলে পা বাড়ালেন। ‘চলুম ফেরা যাক। কাটরু আমাকে ভয় পায়। তাই গা-ঢাকা দিয়েছে। কী হল? আসুন।’

‘জিম আপনার পেছন-পেছন এসেছে। তাকে দেখতে পাচ্ছি না।’

চন্দ্রকান্ত গলায় ঝোলানো বাইনোকুলারে চোখ রেখে জিমকে খুঁজতে শুরু করলেন। তারপর বললেন, ‘মাই গুডনেস! কী অবাক, কী অবাক! আসুন তো দেখি।’

ওঁকে অনুসরণ করে সেই ঝরনার ধারে গেলুম। সত্যি অবাক হওয়ার মতো দৃশ্য। জামুনগাছটার তলায় কাটরুবুড়ো বসে আছে। তার কাঁধে হতচ্ছাড়া জিম, যেন নিঃশব্দে হেসে অস্থির হচ্ছে একপাল ধেড়ে ও বাচ্চা হরিণ সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর পাখি। রং-বেরঙের সবরকম পাখি এসে জড়ো হয়েছে জামুনগাছে, তলার ন্যাড়া মাটিতে, কাটরুর চারপাশেও এমনকী জিমের কাঁধেও একটা কাঠঠোকরা!

কিন্তু সব্বাই চুপ, সব্বাই। চুপ আর নিথর। যেন ছবি। একটু দূরে আমরা থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলুম। চন্দ্রকান্ত আমার কাঁধ ধরে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসলেন। ঝোপের আড়াল থেকে দেখতে থাকলুম সেই আশ্চর্য দৃশ্য। একটু পরে হঠাৎ দেখি, কাটরু যেন কাটরু নয়, প্রাচীন যুগের এক মুনিঋষি—না, তাও নয়। আমারই চোখের ভুল। ও এই জঙ্গলেরই একরকম গাছ। ওর গায়ের খসখসে রুক্ষ চামড়া আস্ত বাকল, ওর পা দুটো শেকড়, হাত দুটো ডাল, আর আঙুলগুলি চিরোল পাতা। ওর চুড়োবাঁধা চুল একরাশ সাদা ফুল। আর…

চন্দ্রকান্তের চিমটি খেয়ে চমকে উঠলুম। ঝরনার পাথর ডিঙিয়ে একটা চিতাবাঘ আসছে। সর্বনাশ! কুকুর চিতার প্রিয় খাদ্য। জিম, বুদ্ধু গবেট হাঁদারাম! যেন চিতাটাকে ‘ওয়েলকাম’ বলার মতো হাঁ করেছে। চিতাটা এসে হরিণের পালের একটু তফাতে পেছনের দু’ঠ্যাঙ মুড়ে বসে একটা প্রকাণ্ড হাই তুলল। কী সাংঘাতিক দাঁত!

তারপর দেখতে দেখতে এসে জুটল একদঙ্গল কাঠবেড়ালি, খরগোশ, গন্ধগোকুল, বেজি। এমনকী ঝরনার জল থেকে উঠে এল কয়েকটা কোলাব্যাং, একজোড়া ভোঁদড়।

তারপর যা দেখলুম, ভয়ে কাঠ। একটা শঙ্খচূড় সাপ এসে একমিটার উঁচু হয়ে চক্কর তুলল।

আর মাথা ঠিক রাখা গেল না। বন্দুকে ছররা গুলি পোরা ছিল। চন্দ্রকান্ত বাধা দেবার আগেই বন্দুক তুলে হ্যামার টেনে ট্রিগারে চাপ দিলুম। লক্ষ ছিল সাপটার চক্কর। চন্দ্রকান্তের ধাক্কায় নলটা গেল উঠে। কিন্তু সামান্য ছররা গুলির যা আওয়াজ হল, আরও অবিশ্বাস্য। চারদিকের পাহাড়ে তুমুল প্রতিধবনি উঠল। সেকেন্ডে তুলকালাম অবস্থা। চিতাটা লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল। হরিণ, খরগোশ, গন্ধগোকুল, ভোঁদড় নিমেষে উধাও। কোলাব্যাংগুলি ঝরনায় ঝাঁপ দিল। আর পাখপাখালি চ্যাঁচামেচি করতে করতে ঝাঁক বেঁধে উড়ে পালাল। শুধু শঙ্খচূড় সাপটা পালিয়ে গেল না। তেড়ে এল আমাদের ঝোপের দিকে। সেই সময় একপলকের জন্য কাটরুকে দেখলুম উঠে দাঁড়িয়েছে। দুটো চোখে নীল আগুন। ও চোখ মানুষের নয়, আমাদের ঝোপটার দিকে দৃষ্টি। তার কাঁধ আঁকড়ে বিশ্বাসঘাতক জিম! সে ঘেউ-ঘেউ করে আমাকেই ধমক দিচ্ছে।

চন্দ্রকান্ত আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চললেন। রোগাটে গড়ন হলে কী হবে, অসম্ভব জোর তো ওঁর শরীরে! খাপ্পা হয়ে বললুম, ‘সাপটাকে মারতে দিন। তাড়া করে আসছে যে!’

চন্দ্রকান্ত হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘ছেড়ে দিন! সব বুঝতে পেরেছি। এভরিথিং ক্লিয়ার! বলে আমাকে হিড়হিড় করে টেনে ঢাল বেয়ে দৌড়ে চললেন।

জিমের জন্য মনখারাপ। ল্যাবরেটরির পাশে বেডরুমে শুয়ে আছি। ভীষণ ক্লান্তও বটে। ঝরনার ধারে জামুনতলার দৃশ্যটা চোখে ভেসে আসছে। অবাক হতে গিয়ে জিমের জন্য রেগে যাচ্ছি। শুধু একটাই আশা, ওই সবতাতে-নাক-গলানো স্বভাবের খুদে বুদ্ধুটাকে সেবারকার মতো এবারও বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত উদ্ধার করতে পারবেন।

ল্যাবরেটরি থেকে এসে গেলেন বিজ্ঞানীপ্রবর। মুখে মিটিমিটি হাসি। ‘ভাববেন না। বাড়ির চারধারে লেসার-রশ্মির বেড়াজাল ঘিরে দিয়ে এলুম। সাপ কেন, পোকামাকড়ও দেওয়াল ছুঁলে ছাই হয়ে যাবে।’ বলে ইজিচেয়ারে বসে পড়লেন।

চমকে উঠে বললুম, ‘সর্বনাশ! জিম ফিরে এলে যে….’

কথা কেড়ে দুলতে-দুলতে চন্দ্রকান্ত বললেন, ‘টি-ডি, অর্থাৎ টেলি-ডিটেক্টরে দেখে এলুম আপনার জিম কাটরুর টঙে বসে কাংনিদানা খাচ্ছে।’

‘সে কী! কাংনিদানা তো ঘাসের বীজ। জিম ঘাসের বীজ খাচ্ছে?’

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত চোখ বুজে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘খাক না। ভালো লাগছে বলেই খাচ্ছে। নইলে কি খেত? তবে ব্যাপারটা, হল, কাটরুর পরিচয় আমি অনেক ক্যালকুলেশন করে জানতে পেরেছি। ও একজন নির্বাসিত প্রাণী। আমাদের সৌর-জগতেরই একটা উপগ্রহে ছিল ওর বাড়ি। তাই ওর চেহারা মানুষের মতো। একই সোলার সিস্টেমে একই ধরনের প্রাণী জন্মাবে, একই ধারায় বিবর্তন ঘটবে, এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। প্লুটো নামে একটা গ্রহের কথা তো জানেন?’

আনমনে বললুম, ‘হুঁ।’

‘প্লুটোর একটামাত্র উপগ্রহ আছে। তার নাম রাখা হয়েছে ‘কারন’। CHARON ইংরেজি বানান। শব্দটা এসেছে গ্রিক পুরাণ থেকে। হিন্দু পুরাণে যেমন বৈতরণী নদী, গ্রিকে তেমনি স্টিক্স নদী, মরার পর মানুষকে ওই নদী পার করে পাতালে পৌঁছে দেয় কারন। আক্ষরিক অর্থে খেয়া-মাঝি। বিজ্ঞানীদের মতে, প্লুটোর ওই উপগ্রহ আসলে একটা গ্রহ। প্লুটোর খপ্পরে পড়ে আমাদের চাঁদের দশা হয়েছে। চাঁদকেও তো ইদানীং কেউ-কেউ সেইরকম বন্দি-গ্রহ বলছেন। তবে কারণ যে বন্দি-গ্রহ, তার প্রমাণ তার ভর প্লুটোর মাত্র এক দশমাংশ। এদিকে চাঁদের…’

বিরক্ত হয়ে বাধা দিলুম, ‘জিমকে কীভাবে উদ্ধার করা যাবে, তাই বলুন।’

চন্দ্রকান্ত হাসলেন। ‘চলে যান না। কাটরু সম্ভবত অহিংস প্রাণী। গিয়ে বুঝিয়ে বলুন। ক্ষমাটমা চান।’

‘কিন্তু শঙ্খচূড় সাপটা হয়তো ওত পেতে আছে।’

বিজ্ঞানীপ্রবর চোখ বুজে কী ভেবে বললেন, ‘এক মিনিট। আপনাকে আমার লেসার-প্তিলটা দিচ্ছি। সাবধান, ওটা অটোমেটিক। হ্যামার টানতে হয় না। সাপটা দেখলে ট্রিগারে চাপ দেবেন। পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তা ছাড়া দরকার হলে কাটরুকেও থ্রেটন করবেন। কিন্তু সাবধান। ওকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।’

উঠে দাঁড়ালেন চন্দ্রকান্ত। ফের বললেন, ‘কিছুক্ষণের জন্য বাড়ির লেসার-রশ্মির বেড়াজাল অফ করে রাখছি, আপনি ফিরে না-আসা অব্দি।’

দুঃখের মধ্যে হাসি আসছিল। কাটরু নাকি প্লুটোর উপগ্রহের নির্বাসিত প্রাণী। দিব্যি ভাঙা হিন্দি-বাংলা বুলি বলতে পারে লোকটা। পশু-পাখি ওকে ভালোবাসে, ওর কাছে আসে, এতে আর এমনকী অস্বাভাবিকতা আছে? নির্জন প্রকৃতির মানুষ। পশু-পাখির ক্ষতি করে না। বহু বছর ধরে দেখে দেখে পশু-পাখিরা ওর কাছঘেঁষা হয়েছে। আসলে আমরা নতুন কোনো ঘটনা বা দৃশ্যের সামনে পড়লে মনের চোখ দিয়েই দেখি। যা দেখছি না, তাও দেখি, রং চড়িয়ে দেখতে ভালোবাসি বলেই।

কাটরু সম্পর্কে এই ব্যাখ্যাটা দাঁড় করালুম মনে-মনে। কিন্তু নজর তীক্ষ্ণ। লেসার-পিস্তল-বাগানো হাত। ফোঁস করলেই ট্রিগারে চাপ দেব। কিন্তু কোথায় বদমাশ শঙ্খচূড়টা? কাটরুর ভুঁই অব্দি দিব্যি আসা গেল। টং নিঝুম খাঁখাঁ। ডাকলুম, ‘কাটরু, কাটরুখুড়ো!’ খুড়ো বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। নাকি হিন্দিতে ‘কাটরুমৌসা’—কাটরুমেসো বলে ডাকব? ঠিক আছে। গলা ঝেড়ে ডাকলুম, ‘কাটরুমৌসা, তুম কিধার হো? সাড়া না পেয়ে ডাকলুম, ‘জিম, জিম।’ তাও সাড়া নেই।

কাঠের মই বেয়ে চঙে উঠে উঁকি মেরে দেখি, ঘাসের তৈরি কুঁড়েঘরটার ভেতর কেউ নেই। ঘাসের বিছানা পাতা। ঘাসের বালিশ। একখানা পাথরের থালা আর ডেকচি গড়নের পাত্র। থালায় কাংনিদানা পড়ে আছে খানিকটা। ডেকচিতে জল।

এদিকে-ওদিকে খুঁজতে থাকলুম উঁচু টঙের ওপর থেকে না কাটরু না জিম। উপত্যকা, চারপাশের ছোটোবড়ো সবুজ পাহাড়, সবখানে নির্জনতা ছমছম করছে। হাওয়া-বাতাস বন্ধ। কিন্তু কী সুন্দর প্রকৃতির এই সাজানো বাগান। দাগড়া-দাগড়া সবুজ রঙের ওপর সাদা হলুদ-লাল ছোপ। ওগুল ফুল। নদীর দিকটাতে কাশফুল থরেবিথরে সাজানো। তারপর ক্রমশ পোকামাকড়ের ডাক আর পাখির ডাক কানে আসতে লাগল। শিউরে উঠলুম। এ এক আশ্চর্য অনুভুতি। প্রকৃতির একটা গোপন কেন্দ্রে এসে পড়েছি, যেখানে লক্ষকোটি প্রাণ সাড়া তুলেছে। এত প্রাণ, এত রং এত সুর।

নেমে আসছি টং থেকে, তখন আমি যেন অন্য মানুষ। ভাবের ঘোরে উদাসীন। এখন যদি শঙ্খচূড়টা ফোঁস করে তেড়ে আসে, বলব, ‘লক্ষ্মী ভাইটি আমার। আয়, দুজনে মিতে পাতাই’।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, আর আমি তিতির মারব না। কোনো পাখিকেই মারব না। জানোয়ার দেখলে বলব, ‘হ্যাল্লো, ব্রাদার অর সিস্টার! হাউ ডু য়ু ডু?’

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত বাড়ির ছুঁচল ছাদ থেকে বাইনোকুলারে আমাকে লক্ষ করছিলেন। এবার খুব হাত নেড়ে ডাকতে লাগলেন। ঢাল বেয়ে উঠে বাড়িটার কাছে যেতেই শুনলুম, ‘আপনার কুকুরটা খুঁজে পেলেন না তো? পাবেন না। এই মাত্র ক্যালকুলেশন করে দেখলুম, কাটরুর কাঁধে চেপে পশ্মিপাহাড়ের ওধারে চলে গেছে।’

‘জিম যা খুশি করুক। হিং টিং ছট!’

দরজা খুললে ভেতরে গেলুম। একটু পরে ছাদ থেকে চন্দ্রকান্ত নেমে এলেন। মুখটা গম্ভীর বললেন, ‘গুরুতর ব্যাপার। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আপনি যাওয়ার পর প্লুটোর ওই উপগ্রহের সঙ্গে ট্যাকিওনের সাহায্য যোগাযোগ করেছিলুম। ‘ট্যাকিওন’ বোঝেন? বোঝেন না। একরকম কণিকা, যার গতিবেগ আলোর সমান। সেকেন্ডে ২৯৯৭৯২.৫ কিলোমিটার। কোনো Mass বা ভর নেই। তো কারন উপগ্রহ থেকে পালটা সংকেত ধরা পড়ল। কারন পৃথিবীর মতো ফুল অভ লাইফ। হ্যাঁ, মানুষের মতো দ্বিপদ বুদ্ধিমান প্রাণীও আছে। সংকেত ডি-কোড করে বুঝলুম, ওরা শিগগির রওনা দিচ্ছে। যদি কোনো অঘটন না ঘটে, আজ রাত্তিরেই ওরা এসে পড়বে।’

‘আপনি কী ডাকলেন ওদের?’

‘হ্যাঁ।’ চাপা স্বরে বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত বললেন। ‘কাটরুকে ওরা ফেরত নিয়ে যাক। বড্ড ঝামেলা করে ও মাঝে-মাঝে। তার চেয়ে বড়ো কথা, আমি নিরিবিলিতে অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্সের যেসব গোপন পরীক্ষা করছি, অন্য গ্রহ বা উপগ্রহের বাসিন্দা তা টের পাক, এটা আমি চাই না। কে বলতে পারে, ওরা ঈর্ষাকাতর হয়ে আমার এই ল্যাবরেটরি জ্বালিয়ে দেবে না?’ চন্দ্রকান্ত অনর্গল বলতে থাকলেন এইসব কথা।

আমার মনে রীতিমতো বৈরাগ্যভাব এখন ইচ্ছে করছে আমিও কাটরু হয়ে যাই। গাছপালার ভেতর ঘাসের মাঠে ঝরনার ধারে কাটরুর মতো খালি-গা খালি-পা হয়ে কোমরে একফালি মাত্র কৌপীন জড়িয়ে ঘুরে বেড়াই। জঙ্গল একটুখানি সাফ করে তার মতো কাংনিদানার চাষ করি। পাখিদের জন্য, স্রেফ পাখিদের জন্যই। কারণ, মুঠো মুঠো কাংনিদানা ছড়ালেই ওরা এসে যাবে আমার কাছে। আপন হয়ে যাবে। আমাকে ঘিরে কিচিরমিচির করবে। আমিও কিচিরমিচির করব। তিতির হয়ে ডাকব, ট্টি ট্টি ট্টি। ট্টি ট্টি ট্টি! আমার গায়ে-মাথায় তিতিরের ঝাঁক। আর আমি তখন এক ‘পাখিবাবা’! কী মজাই না হবে।

চন্দ্রকান্তের ডাকে ঝিমুনি কেটে গেল। ‘আসুন, লাঞ্চ সেরে নিই। নিরিমিষ কিন্তু! বলেছিলেন তিতিরের মাংস খাওয়াবেন। আপনিই ফেল করেছেন!’ বিজ্ঞানীপ্রভারের সঙ্গে ডাইনিং-রুমে ঢুকলুম। প্রচুর খিদে পেয়েছে বটে।

চন্দ্রকান্তের হিসেবে কারন উপগ্রহের স্পেসশিপ পৌঁছুবে কাঁটায়-কাঁটায় দশটা বত্রিশ মিনিট একুশ সেকেন্ডে। আঁধার রাত। হাওয়াবাতাস নেই। উপত্যকার আকাশে জ্বলজ্বল করছে লক্ষ কোটি তারা। নদীর ধারে পাথরের আড়ালে দুজনে ওত পেতে বসে আছি। শঙ্খচূড়টার ভয়ে আমাদের পরনে স্পেসস্যূটের মতো পোশাক। ছোবল দিলে বৈদ্যুতিক শক খাবে নিজেই। চন্দ্রকান্ত হাতে একটা টর্চের সাইজ যন্ত্র নিয়ে বসে আছেন। আমাকে নজর রাখতে বলেছেন আকাশে। হাতঘড়িতে দশটা বত্রিশের ঘরে রেডিয়াম-কাঁটা। সেই সময় একবার ঘুরে কাটরুর টঙের দিকটা দেখে নিলুম। টঙের সামনে খুঁটিতে লণ্ঠন জ্বলছে। কারন থেকে যারা আসছে তারা কাটরুকে ধরে নিয়ে যাবে। তখন জিমকে উদ্ধার করা সহজ হবে তো? জিমকে সুদ্ধু ধরে নিয়ে গেলে কেলেঙ্কারি!

আবার আকাশের দিকে তাকালুম। হঠাৎ দেখি একটা তারা ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠছে। বড়ো হতে হতে সেটা নেমে আসছে। এইসময় শনশন করে বাতাস উঠল। বাতাসটা বাড়তে লাগল। বাড়তে বাড়তে তুলকালাম ঝড়। এমন ঝড় যে উড়িয়ে নিয়ে যাবে সবকিছু। আমরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম দুজনে। সেই প্রকাণ্ড তারাটা এবার লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-বেগুনি রং বদলাতে বদলাতে ঠিক আমাদের মাথার ওপর এসে স্থির হল এক সেকেন্ডের জন্য। তারপর সামনের বালির চড়ায় বালি উড়িয়ে নামল। বনবন করে ঘুরতে থাকল। কাটরু যা বলেছিল, ঠিক তেমনটি। প্রকাণ্ড লাটিম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, ওটা বাইরের কিছুকে আলোকিত করছে না। অথচ প্লেনের জানালার মতো টুকরো-টুকরো ফোকর দিয়ে রং-বেরঙের আলো বেরোচ্ছে। চক্কর থামার পর একটা ফোকর দিয়ে দুটো কাল নাদুসনুদুস বেঁটে পুতুল গড়নের প্রাণী বেরোল। কাটরুর বর্ণনায় একটুও গণ্ডগোল নেই দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তকে উঠতে দেখে আমিও উঠে দাঁড়ালুম। আর দুঠেঙে প্রাণী দুটো এসে ধাতব কণ্ঠস্বরে বলে উঠল, ‘কে-ক্কে-ক্কে-ক্কে… কি-ক্কি-ক্কি- ক্কি-ক্কি… ডা-ড্ডা-ড্ডা-ড্ডা… ডি-ড্ডি-ড্ডি-ড্ডি!’

চন্দ্রকান্ত বললেন, ‘কা-ক্কা-ক্কা-ক্কা… ট-ট্ট-ট্ট-ট্ট… রু-রু-রু-রু-রু!’

প্রাণী দুটো আঁধারে রং-বেরঙের আলোর পুতুলের মতো কাটরুর টং লক্ষ করে উড়ে গে। চন্দ্রকান্ত বললেন, ‘ওদের স্পেসশিপটা একটু দেখে আসা যাক।’

চন্দ্রকান্ত যখন উড়ুক্কু লাটিমটার কাছে, তখন টঙের দিক থেকে জিমের গলা শুনতে পেলুম। প্রচণ্ড ধমক দিচ্ছে। হাঁদারামকে ধরে নিয়ে যাবে ভেবে অস্বস্তি হচ্ছিল। হঠাৎ সেইসময় সেই প্রাণী দুটো সুড়ুত করে ভেসে নদীর ওপর দিয়ে উড়ুক্কু লাটিমের কাছে ফিরে এল। চন্দ্রকান্ত ‘কি-ক্কি-ক্কি’ করে উঠলেন। ওরা কোনো জবাব না দিয়ে ফোকর গলিয়ে লাটিমে ঢুকল। অমনি বনবন করে সেটা ঘুরতে লাগল। আবার সেই ঝড়। আবার শুয়ে পড়লুম। উড়ুক্কু লাটিমটা বোঁও করে আকাশে উঠে ছোটো হতে হতে নিমেষে তারার সঙ্গে মিশে গেল। ঝড় থামলে চন্দ্রকান্তের কাতর ডাক শুনলুম, ‘হেল্প মি। জলে পড়ে গেছি।’

জলে স্পেসস্যুট-পরা বিজ্ঞানীপ্রবরের অবস্থা করুণ। টেনেটুনে ওঠালুম। বললেন, ‘ওরা অমন করে পালিয়ে গেল কেন বলুন তো?’

টঙের দিক থেকে জিমের গলা ভেসে আসছে। সমানে ধমক দিচ্ছে এখনও। হুঁ, উদ্ভুট্টে প্রাণী দুটোর পড়ি-কি-মরি করে পালানোর রহস্য বোঝা গেল। পা বাড়িয়ে বললুম, ‘আমার ধারণা, কারন-উপগ্রহে কুকুর নেই।’

চন্দ্রকান্ত ব্যস্তভাবে বললেন, ‘ক্যালকুলেশন করতে হবে। চলুন শিগগির!’

কী ভেবে টঙের কাছাকাছি গিয়ে ডাকলুম, ‘কাটরুমৌসা, কাটরুমৌসা!’

চন্দ্রকান্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আঃ। করছেন কী? ও সব টের পেয়ে গেছে। এখন আমাদের নাম্বার ওয়া এনিমি!’

ওঁকে গ্রাহ্য না করে টঙের দিকে চললুম। বিজ্ঞানী খাপ্পা হয়ে চলে গেলেন। টঙের নীচে দাঁড়িয়ে আবার ডাকলুম, ‘কাটরুমৌসা, ঘাট মানছি। আর কখনো বন্দুক ছুঁড়ব না। জিমকে ফেরত দাও।’

কাটরুর সাড়া পেলুম না। কিন্তু জিমকে সে ফেরতই দিল বলতে হবে। জিম টঙের মই বেয়ে নেমে এসে আমার পায়ের ফাঁকে ঢুকে কুঁইকুঁই শব্দ করতে থাকল। হুঁ, সেও বলছে, ঘাট মানছি। আর কক্ষনো এমনটি হবে না। ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে চন্দ্রকান্তের বাড়ি পৌঁছলুম।

বিজ্ঞানীপ্রবর ল্যাবরেটরিতে ছিলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘আপনি ঠিক বলছিলেন। কারনে এ-জাতীয় চতুষ্পদ প্রাণী নেই। তাই ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। যাই হোক, আপনি জিমকে নিয়ে দেশে ফিরলে তখন ফের ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। কাটরুকে আমার মোটেও পছন্দ হয় না।’

আর-একটু আছে। সেটাই আসল গপ্প। তা বলার জন্যই এতখানি লম্বাচওড়া পরিপ্রেক্ষিত।

পরদিন সকালে কাটরুর সঙ্গে কথা বলার জন্য ওর টঙের দিকে যাচ্ছি। সঙ্গে জিম। হাতে বন্দুক নেই। সাপের ভয়ও নেই কারণ কাটরু আমার ওপর খুশি হয়েছে। নইলে জিমকে ফেরত দিত না।

কিন্তু কী অবাক, কোথায় টং? ভেঙেচুরে পড়ে আছে মাকড়সার জালে ঢাকা চালছপ্পর, কাঠের মই, সবকিছুই। আর সেখানেই রাতারাতি গজিয়ে গেছে একটা গাছ। একমাথা সাদা ফুল। ধূসর বাকলে রাতের শিশির। শিশির তার পাতায়, ফুলে। গাছটার গায়ে হাত রাখতেই মনে হল দারুণ জ্যান্ত, কোনো প্রাণীর শরীরে হাত রাখলে যেমন লাগে। চমকে উঠে পিছিযে এলুম। বললুম, ‘কাটরুমৌসা, কেন তুমি গাছ হয়ে গেলে বল তো? বেশ তো ছিলে মানুষের মতো।’ জিমও গাছটার দিকে তাকিয়ে লেজ নেড়ে কুঁইকুঁই করতে থাকল।

গাছের পাতায় একঝাঁক পাখি এসে বসল। অমনি ঝরঝর করে ঝরে পড়ল রাতের শিশির। দুঃখিত মনে বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তের বাড়ির দিকে পা বাড়ালুম। ওঁকে জানানো দরকার কারন উপগ্রহের নির্বাসিত মানুষ কাটুরু পৃথিবীর এক গাছ হয়ে গেছে। কাজেই এ-নিয়ে আর মাথা ঘামানো নিষ্ফল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *