উঠে বোসো শালগ্রাম
‘একটা ভীষণ সুন্দর, স্বর্গের মতো দেশ তৈরি করার প্রবল ইচ্ছে হয়েছে।’
‘স্বর্গ কেন বললেন স্যার! আমরা স্বর্গ মানি না, নরকও মানি না।’
‘তাহলে আমেরিকার মতো।’
‘ছি ছি ছি, আমেরিকার একটা সাম্রাজ্যবাদী দেশ। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের চিরসংগ্রাম। সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক।’
‘আচ্ছা মুশকিল তো! তাহলে আমরা কীসের মতো দেশ করব?’
‘আমরা আমাদের মতো করব।’
‘বেশ! কিন্তু ভীষণ, ভীষণ সুন্দর। সুন্দর সুন্দর রাস্তা, বাড়ি, পার্ক। জলপথ, স্থলপথ। ঝকঝকে হাসপাতাল, তকতকে স্কুল, পরিচ্ছন্ন বাজার। কোটরচোখো, গাল তোবড়ানো কোনও লোক থাকবে না, থাকা চলবে না। চারিদিকে সুন্দরী-সুন্দরী মেয়ে, গাবলুগুবলু শিশু। ফিটফাট, ঝকঝকে, চকচকে যুবক। ভোঁ-ভোঁ কলের বাঁশি। কারখানার গেট দিয়ে গলগল করে শ্রমিকরা বেরিয়ে আসছে। বাহুতে বল, মুখে হাসি, চোখে স্বপ্ন, বুকভরা ভালোবাসা। মাছ কিনছে, মাংস কিনছে, মুলো কিনছে, গাজর কিনছে, গাজরের হালুয়া কিনছে, লাল লাল আপেল, মোটা মোটা কলা, বউয়ের জন্যে রাঙা শাড়ি। খেতে খেতে চাষিরা গান গাইছে—’কাটি ধান আয়রে’। আকাশে থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। দাওয়ায়-দাওয়ায় বৃদ্ধ আর বৃদ্ধারা মলিদার চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে। সুখী সুখী মুখ। প্রত্যেকটা বাড়িতে বিদ্যুতের আলো। ছেলেমেয়েরা দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করছে। যত মশা, মাছি সব মেরে ফেলেছি। মশারি জালের কাজ করছে। ভোরবেলা সূর্য সবে উঠেছে। ছোট্ট নদীর কুলকুল জলে বিশ্বনাথ মশারি ফেলেছে। এক ঝাঁক রুলি মাছ, খলবল, খলবল। মৌরলা, পুঁটি, চাঁদা। কৃষকের কুটিরে আর দারিদ্র্য নেই। সামন্তর ছেলেটি এক গেলাস খাঁটি দুধ খেয়েছে। কচিকচি ঠোঁটের ওপর সরের গোঁফ। নিবারণ ফলের রস খাচ্ছে। সনাতন খটাস খটাস করে তাঁত চালাচ্ছিল। খবর এল তার ছেলে আই এ. এস হয়েছে। মসৃণ একটা পিচের রাস্তা লম্বা হয়ে চলে গেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মাঠে মাঠে হৃষ্টপুষ্ট ধবলী গাই। মশমশ করে নেপিয়ার ঘাস খাচ্ছে। সবক’টার স্তন দুধে টসটস করছে।
নতুন নতুন পাকা প্রাইমারি স্কুল। ঠংঠং ঘণ্টা। হৃষ্টপুষ্ট শিশুরা মাছের ঝোল, ভাত খেয়ে বই বগলে ছুটছে। ঘণ্টা পড়ে গেছে ঘণ্টা। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে ছাগল ছানারাও ছুটছে। কোথাও একটা ঘেয়ো লেড়ি কুত্তা নেই। কান্ট্রিলিকার শপে ডাবের জল আর শরবত বিক্রি হচ্ছে। ডাকাতরা ছোরা, ছুরি, লাঠি, বল্লম সব বিসর্জন দিয়েছে কাজলা দিঘির জলে। যত বদমাশ আর ফেরেববাজ চাকরি বাকরি করছে। সংসারী হয়েছে। একটাও বেকার নেই দেশে।
লরিচালক আর খালাসিরা মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বোতলে কলের জল। তেষ্টা পেলেই গলায় ঢালছে। হাইওয়েতে আর দুর্ঘটনা ঘটছে না। মদ নেই মাতালও নেই। অথবা মাতাল নেই তাই মদও নেই। বউ পেটানোও বন্ধ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সর্বত্র দোতারার মতো। কোর্ট কাছারিতে আর একটাও ডিভোর্স মামলা নেই। জল না পেলে গাছ যেমন শুকিয়ে যায়, ডিভোর্স আদালতও শুকিয়ে গেছে। পারিবারিক অশান্তি, দাম্পত্য কলহ সব টিভিতে ঢুকে গেছে। দর্শকরা দেখে আর হাসে।
ঘুষ আর ঘুষি দুটোই উঠে গেছে। দেশে অপরাধ নেই। পুলিশদের ভি. আর. এসে ফেলা হচ্ছে। দু-চারজন যারা আছেন তাঁরা সিনেমায় অভিনয় করছে। প্রাচীন বড়বাবুরা আত্মজীবনী লিখছেন। জেল হাজতে নতুন আর কেউ আসছে না। খাঁচায় মুরগির চাষ হচ্ছে। সুপাররা কবিতা লিখছেন।
দুম।
‘কী হল?’
‘টায়ার ফেটে গেল স্যার। রাস্তায় যা অবস্থা।’
‘পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দেওয়া হল। এই কি তার নমুনা।’
‘হাফ তো পকেটে গেছে।’
‘কেন গেছে?’
‘আপনি দ্যাখেননি স্যার? কাজের বাড়িতে হালুইকররা সবার আগে উনুনে ঘি ঢালে। অগ্নিকে সন্তুষ্ট করার জন্যে। রাস্তা তৈরি কঠিন কাজ। পঁচিশ লাখ ভূতায় স্বাহা।’
‘দশ গজের মধ্যে ক’টা গর্ত?’
‘পুরোটাই স্যার।’
‘ঠিক আছে। উলটো রাস্তা করো। যেখনে গর্ত নেই সেখানেও গর্ত করে দাও। পৃথিবীর সব দেশে রাস্তা ওপর দিকে ওঠে, হাইওয়ে, আমাদের এখানে হবে লো ওয়ে। ক্রমশ নামো, নীচে আর নীচে। বিনীত পথ।’