উট বনাম ট্রেন
তোমাদের মধ্যে যারা সোনার কেল্লা ফিল্ম দেখেছ, তারা জান যে সেখানে উটকে নিয়ে বেশ একটা মজাদার ঘটনা আছে। রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু মরুভূমিতে উটের পিঠে চড়ার স্বপ্ন দেখেন। এ স্বপ্ন গল্পের শেষের দিকে আশ্চর্যভাবে ফলে যাচ্ছে। জয়সলমির যাবার পথে মন্দার বোসের চক্রান্তে ফেলুর গাড়ির টায়ার পাংচার হয়, তার ফলে ফেলু তোপ্সে লালমোহন পথে বসে। এমন সময় দূরে দেখা যায় উটের দল। আট মাইল দূরে রামদেওরা স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারলে মাঝরাত্তিরের ট্রেনটা ধরা যাবে। ফেলু স্থির করে এই পথটুকু তারা উটেই যাবে। ফেলু তোপসের তো কোনও চিন্তা নেই—দু’জনেই স্মার্ট, দু’জনেরই খেলাধুলো ব্যায়াম করা ছিমছাম শরীর—কিন্তু জটায়ু তো নামেই জটায়ু। উটের সামনে পড়ে অ্যাদ্দিনের স্বপ্ন যে বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী জানোয়ার রে বাবা। নেশাখোরের মতো আধবোজা ঘোলাটে চোখ, এবড়ো খেবড়ো কোদালের মতো দাঁত, ঝোলা ঠোঁট উলটিয়ে অষ্টপ্রহর কী জানি চিবোচ্ছে—আর হাঁটলে পরে সর্বাঙ্গে যা দোলানি, দেখলে মনে হয় সওয়ারের হাড়গোড় সব আলগা হয়ে যাবে। না জানি এ জানোয়ারের পিঠে চড়লে কী ভোগান্তি আছে|
কিন্তু উপায় নেই। ফেলু তোপ্সে তড়াক তড়াক করে উঠে পড়ে, লালমোহন উঠতে গিয়ে প্রায় বেসামাল হয়ে কোনও রকমে ম্যানেজ করে। ফেলু উটওয়ালাদের হুকুম দেয়—‘চলো রামদেওরা’।
উটের দল চলেছে সার বেঁধে, লালমোহন প্রমাদ গুনছে, মাঝপথে হঠাৎ তোপসের চোখ গেল—ওই দূরে ট্রেন আসছে। ওটাকে থামাতে পারলে আর রামদেওরা গিয়ে দশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না। ছুট ছুট ছুট| উটের দল লাইনের ধারে পৌঁছে যায়, ফেলু পকেট থেকে রুমাল বার করে প্রাণপণে নাড়তে থাকে, ট্রেন সে সংকেত অগ্রাহ্য করে মরুপ্রান্তর কাঁপিয়ে চোখের সামনে দিয়ে তারস্বরে সিটি মারতে মারতে বেরিয়ে যায়। ফেলু দাঁতে দাঁত চেপে বলে ‘শাবাশ’। জটায়ু আধমরা। স্বপ্ন ভেঙে খান খান। এ শিক্ষা ভোলবার নয়। অগত্যা সবাই উটের পিঠেই চলতে শুরু করে রামদেওরা উদ্দেশে।
এই তো গেল উটের পর্ব। ছবিতে শুধু এই দৃশ্যটি তুলতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল সেটা বললে ফিল্ম তৈরির এলাহি কারবারটা তোমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারবে।
এটা সবাই জানে যে উট জিনিসটার অভাব নেই রাজস্থানে। গুপী গাইন ছবিতে হাল্লার সেনা দেখানোর জন্য উটের মালিক সমেত এক হাজার উট জোগাড় হয়েছিল মাত্র দু’-তিন দিনের চেষ্টায়। এ ব্যাপারে অবিশ্যি জয়সলমিরের মহারাজা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিলেন। সোনার কেল্লায় আমাদের চাহিদা ছিল এর তুলনায় সামান্যই। কিন্তু মুশকিল এই যে, যে জায়গাটা শুটিং-এর জন্য বাছা হয়েছিল, তার ত্রিসীমানায় কোনও লোকালয় নেই। চারিদিকে ধূ ধূ করছে বালি, মাঝে মাঝে শুকনো ঘাস আর ছোট ছোট কাঁটা ঝোপ। এরই মধ্যে দিয়ে চলে গেছে মিটার গেজের লাইন; দেখলে মনে হয় যার শুরুও নেই শেষও নেই। এই রেললাইনের পাশ দিয়েই আবার চলে গেছে জয়সলমির যাবার মোটরের রাস্তা। লাইন যদি রাস্তা থেকে বেশি দূর হত তা হলে শুটিং সম্ভব হত না, কারণ জয়সলমিরে আমাদের ডেরা—সেখান থেকে মালপত্তর লোকজন নিয়ে আসতে হবে শুটিং-এর জায়গায়। উট যখন ট্রেনের দিকে ছুটে যাবে, তখন ক্যামেরাকেও ছুটতে হবে তার সঙ্গে সঙ্গে। তার মানে ক্যামেরাকে চাপতে হবে হুড খোলা জিপের উপর, আর তার মানেই রেললাইনের কাছাকাছি পিচ বাঁধানো রাস্তা চাই।
যোধপুর থেকে জয়সলমির পর্যন্ত দেড়শো মাইল রাস্তা চষে বেড়িয়ে একটিমাত্র জায়গা পাওয়া গেল যেখানে আমরা যা যা চাইছি তার সব কিছুই আছে। জায়গাটা জয়সলমিরের প্রায় সত্তর মাইল পূবে, যোধপুরের দিকে। উটের দলকে আসতে হবে সেখান থেকে আরও সাত মাইল পূবে খাচি নামে একটা গ্রাম থেকে। উটওয়ালাদের বলে দেওয়া হল তারা যেন উটগুলোকে সাজপোশাক পরিয়ে আনে। আমরা উটকে যে চোখে দেখি, রাজস্থানের মরুদেশের লোকেরা মোটেই সে চোখে দেখে না। উট দেখে আমাদের হাসি পায়, কিন্তু তাদের পায় না। কারণ উট হল তাদের পরম বন্ধু, মরুভূমিতে একমাত্র সহায়। এই বন্ধুটিকে সাজানোর জন্য রাজস্থানীরা আদ্যিকাল থেকে যে কত রকমের কত বাহারে জাজিম ঝালর গয়নাগাটি তৈরি করে এসেছে তার হিসেব নেই। এই সব পরে উটের দল যখন বালির উপর দিয়ে সার বেঁধে চলে, তখন তারা এই রুক্ষ প্রাকৃতিক পরিবেশে আশ্চর্য সুন্দরভাবে খাপ খেয়ে যায়। দেখলে মনে হয় ঘোড়া বা হাতি বা অন্য কোনও জানোয়ার হলে নিশ্চয়ই এতটা মানানসই হত না। যাই হোক, উটওয়ালারা কথা দিল যে তারা দুপুরেই এসে পৌঁছে যাবে। আমাদের লোক শুটিং-এর জায়গায় অপেক্ষা করবে, নইলে উটওয়ালাদের পক্ষে জায়গা চিনে বার করার কোনও উপায় থাকবে না।
উট তো হল, এবার ট্রেনের ব্যাপার। যোধপুর থেকে একটা সকালের ট্রেন সত্তর মাইল দূরে পোকরান অবধি যায়। আমরা সেই ট্রেনটাকেই ব্যবহার করব বলে ঠিক করেছিলাম। পোকরান হল যোধপুর আর জয়সলমিরের মাঝামাঝি। আমাদের বাছাই করা জায়গাটা অবিশ্যি পোকরান ছাড়িয়ে আরও ২০ মাইল পশ্চিমে, তাও আমাদের ভরসা ছিল যে রেলের কর্তাদের বলে সেই ট্রেনটাকেই আমরা আমাদের কাজের জায়গা অবধি এগিয়ে নেব।
আমরা শুটিং-এর জোগাড় করে তৈরি হয়েছি, এমন সময় একটা ভয়াবহ ঘটনা আমাদের রক্ত জল করে দিল। কয়লার দাম বেড়ে যাওয়াতে রেলের কর্তৃপক্ষ দিনের ট্রেনটিকে এক দিনের নোটিসে দিলেন বাতিল করে| সর্বনাশ| ফেলুর দল উটের পিঠে করে ছুটে গিয়ে ট্রেন থামানোর চেষ্টা করছে-আমার এই সাধের দৃশ্য কি ছবিতে স্থান পাবে না? এ হতেই পারে না।
সেই দিনই রেলের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁদের সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম, এই দৃশ্যটা তুলতে না পারলে আমাদের এত খরচ করে রাজস্থানে আসাটাই মাটি হয়ে যাবে। আমাদের কপাল ভাল যে কর্তাদের মধ্যে রসিক লোকের অভাব ছিল না। তাঁরা ব্যাপারটা বুঝলেন এবং বুঝে যে ব্যবস্থা করলেন তা হল এই—তাঁরা আমাদের ব্যবহারের জন্য একটি আস্ত ট্রেন দেবেন যাতে থাকবে থার্ড ক্লাস, ফাস্ট ক্লাস মেশানো ছ’টি বগি, গার্ডের গাড়ি, কয়লার গাড়ি ও ইঞ্জিন; ট্রেন চালু করতে যা কয়লা লাগবে তার খরচ দেব আমরা। ব্যাস, সমস্যা মিটে গেল। সত্যি বলতে কি, আমার মতে এটা হল শাপে বর, কারণ এ ট্রেনটা থাকবে আমাদের হাতের মুঠোয়। নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে আমরা সেটাকে নিয়ে এগোনো পিছনো থামানো চালানো যা ইচ্ছে তাই করতে পারব।
ঠিক হল পোকরান স্টেশনে এসে ট্রেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। আমরা জয়সলমির থেকে একশো মাইল রাস্তা মোটরে গিয়ে ট্রেনে চাপব। ট্রেন রওনা হবে আমাদের উটের দৃশ্যের জন্য বাছাই করা জায়গার দিকে। ফেলু তোপসে জটায়ু অপেক্ষা করবে সেখানে। যাবার পথে আমরা ট্রেনের কামরায় শুটিং করব মুকুল আর বর্মনকে নিয়ে। বর্মন মুকুলকে নিয়ে জয়সলমির যাবার পথে ঝিমিয়ে পড়েছে, আর মুকুল তন্ময় হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে।
এ ছাড়া যাবার পথে আরও একটা জিনিস তোলার ইচ্ছে আছে। ক্যামেরা নিয়ে কয়লার গাড়িতে গিয়ে চাপব, সেখান থেকে ইঞ্জিনের ছবি তুলব—সামনেই চোঙা দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আর তার মধ্যে দিয়ে সমান্তরাল রেললাইন একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত চলে গেছে।
প্রথম গণ্ডগোলটা হল পোকরানে। ট্রেন আসার কথা এগারোটার সময়, এল আড়াইটার পর। কাজের সময় যেখানে আগে থেকে হিসেব করে ভাগ করা থাকে, সেখানে দশ-পনেরো মিনিট এদিক ওদিক হলেই হিমসিম খেতে হয়, আর এ তো তিন ঘণ্টার ব্যাপার। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি করলে আরও মূল্যবান সময় নষ্ট হবে, তাই আমরা চটপট মালপত্র নিয়ে কামরায় উঠে গাড়ি চালু করে দিলাম।
মুকুল আর বর্মনকে নিয়ে কামরার ভিতরের কাজটা নির্ঝঞ্ঝাটে হয়ে গেল। তারপর গাড়ি থামিয়ে আমরা জনা তিনেক গিয়ে উঠলাম কয়লার গাড়িতে। সেখানে কয়লার স্তুপ ছাড়া কিছুই নেই, তাই সেই স্তুপের ওপরেই দাঁড়িয়ে ক্যামেরা হাতে নিয়ে রেডি হয়ে আবার ট্রেন চালু করে দেওয়া হল। ক্রমে গাড়ির স্পিড বাড়লে পর ক্যামেরাও চলতে শুরু করল। ইঞ্জিনে ড্রাইভার ছাড়াও আর একজন লোক থাকে, সে হল স্টোকার। তার কাজ হল একটি অতিকায় খোন্তায় কয়লা তুলে বয়লারে ঢালা। ঢাললেই বয়লারের আগুন গন গন করে জ্বলে ওঠে, আর সেই সঙ্গে চোঙা দিয়ে ভস ভস করে কালো ধোঁয়া বেরোয়।
আমার হাতে ক্যামেরা, কয়লার উপর পা দিয়ে কনুই দুটোকে ইঞ্জিনের ছাতে ভর করে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। তারই মধ্যে কেন যে মাঝে মাঝে পা হড়কে টাল হারিয়ে ফেলছি সেটা বুঝতে পারছি না। শট্ নেওয়ার পরে বুঝলাম, আমি কয়লার স্তুপের সামনের দিকে দাঁড়ানোর ফলে স্টোকারবাবু বাধ্য হয়ে আমার ঠিক পায়ের তলা থেকেই কয়লা তুলে নিচ্ছিলেন। বুঝলাম একেই বলে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া|
এই কয়লার গাড়িতে করেই আমরা উটের শুটিং-এর জায়গায় পৌঁছে গেলাম। উট সমেত বাকি দল সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কেবল যে জিনিসটি না হলে ছবি তোলা যায় না, সেটিকে আর ধরে রাখা যায়নি। সেটি হল সূর্যের আলো। পশ্চিম দিগন্তে মামার আধখানা উঁকি মারছে, নতুন জায়গায় ক্যামেরা বসাতে বসাতে তিনি যে একেবারেই ডুব দেবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
উট, ট্রেন, সব যে যার ঘরে ফিরে গেল, তবে যাবার আগে ঠিক হয়ে গেল পরদিন আমরা আবার এই একই জায়গায় জমায়েত হচ্ছি দুপুর আড়াইটার সময়। ট্রেনও পোকরানে না থেকে সোজা চলে আসবে এইখানে।
আগেই বলেছি যে আমাদের ডেরা ছিল জয়সলমিরে। মুকুলের সোনার কেল্লা থেকে আধ মাইল দূরে একটি ছোটখাটো প্রাসাদের মতো গেস্টহাউসে আমাদের ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জনের থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। পরদিন ভোরে উঠে আমরা প্রথমে গেলাম কেল্লার ভিতরে শুটিং করতে। ঘণ্টা তিনেক ধরে সেখানে ছবির শেষ দৃশ্যের কিছু শট্ নেওয়া হল। তারপর তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা আড়াইটার মধ্যে গিয়ে হাজির হলাম উটের শুটিং-এর জায়গায়।
গিয়ে দেখি উটের দল আগেই হাজির। এবার শুধু ট্রেন আসার অপেক্ষা। গতকালের গণ্ডগোলটাও যে শাপে বর হয়েছে সেটা বুঝলাম আকাশের চেহারা দেখে। সাদা আর ছাই রঙের টুকরো টুকরো মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে, আর তারই ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে সোনালি রোদ এসে পড়েছে মরুভূমির উপর। নাটকীয় দৃশ্যের পক্ষে এমন মানানসই নাটকীয় আলো গতকাল ছিল না।
আজ ট্রেনও এসে হাজির হল ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়। আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সকলেরই বুক ধুকপুক করছিল, কারণ কাল সকালেই জয়সলমির ছেড়ে চলে যেতে হবে যোধপুর, আর কালই সন্ধ্যায় আমরা তলপি-তলপা গুটিয়ে রাজস্থান ছেড়ে ঘরমুখো রওনা হব। হঠাৎ যখন কানে এল ঝুক্ ঝুক্ শব্দ, তখন সবাই একসঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
ট্রেন এসে থামবার পর ড্রাইভারকে সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়া হল। তাকে পিছিয়ে যেতে হবে সিকি মাইল। সেখান থেকে আবার রওনা হয়ে ট্রেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে, সময় বুঝে আমরা সওয়ার সমেত উটের দলকে রওনা করিয়ে দেব। ক্যামেরা থাকবে হুড খোলা জিপের উপর, পিচের রাস্তা দিয়ে জিপ ঠেলে ক্যামেরাকেও উটের সঙ্গে সঙ্গে দৌড় করানো হবে ট্রেনের দিকে।
ড্রাইভারকে সবই বোঝানো হয়েছিল, কেবল একটি জিনিস বাদে—যার ফলে আমাদের প্রথম বাজি ভেস্তে গেল। ট্রেন আসছে, উট ছুটছে, ক্যামেরাও ছুটছে; ট্রেন উটের কাছাকাছি এসে গেলে পর ফেলু যেই পকেট থেকে রুমাল বার করে হাত নেড়েছে, অমনি ঘ্যাঁ-চ করে ব্রেক কষে ট্রেন থেমে গেল। ড্রাইভারকে জিগ্যেস করতে বলল, ‘বাবু যে আমায় থামবার জন্য ইশারা করল, তাইতো থামলাম’। ড্রাইভার বেচারা তো আর জানে না যে ও জিনিসটা করলে গল্পের ঘটনা একেবারে উলটিয়ে যায। পিছোও, পিছোও— ট্রেন পিছোও, আবার সেই সিকি মাইল দূরে। উট পিছোও, ফেলু তোপসে লালমোহন পিছোও, জিপ ক্যামেরা সব পিছোও, আবার সব শুরু থেকে নতুন করে হবে। এবারে নিশ্চয়ই আর কোনও গণ্ডগোল হবে না।
ট্রেন আবার রওনা হল। ওই যে শব্দ শোনা যাচ্ছে, ওই এসে পড়ল বলে। উটের দলকে ইশারা করে দেওয়া হল। জিপকে ঠেলার জন্য সার বেঁধে লোক তৈরি। এক ঠেলায় একদফা ঘাম ছুটে গেছে তাদের; এবার দ্বিতীয় দফা।
ক্যামেরা চালু করার জন্য ‘স্টার্ট’ কথাটা বলতে গিয়ে জিভে আটকে গেল। ট্রেন তো আসছে, কিন্তু ধোঁয়া কই? মরুপ্রান্তরের বিশাল ঝলমলে আকাশ ট্রেনের মিশকালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে—এ না হলে দৃশ্যটা জমবে কী করে? থামাও থামাও, ট্রেন থামাও, উট থামাও, জিপ থামাও।
দলের যত লোক যে যার কাজ ফেলে দুহাত তুলে ট্রেনের দিকে ছুটে গেল। রোক্কে, রোক্কে।
ঘ্যাঁ-চ করে ট্রেন আবার ব্রেক কষল।
স্টোকারবাবু নিজে শুটিং দেখার জন্য এত উদ্গ্রীব যে বয়লারের কয়লা দিতে ভুলেই গেছেন—ধোঁয়া আর হবে কোত্থেকে? এবার কিন্তু কয়লা দেওয়া চাইই চাই। তৃতীয়বার ভুল হলে আমরা পথে বসব, কারণ চারবারের বার আর আলো থাকবে না। স্টোকারের খেয়াল খুশির উপর নির্ভর না করে এবার ইঞ্জিনে আমাদের নিজেদের একজন লোক রেখে দিলাম।
ফেলু, তোপসে আর জটায়ু উটের পিঠে চড়ে জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। বার বার তিনবার শট্ নেওয়াতে একটা লাভ হবে জানি—সওয়ারদের আর দম বেরোনোর অভিনয় করতে হবে না। জটায়ুর অবস্থা তো দেখছি এর মধ্যেই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। কিন্তু দৃশ্যটা যাতে ভালভাবে তোলা হয় তা জন্য সবাই সমান ব্যগ্র, তাই পরিশ্রম হলেও কেউ সেটা গায়ে মাখছে না।
তিনবারের পর আর কোনও দিক দিয়ে কোনও গণ্ডগোল না হওয়াতে দৃশ্যটা নিখুঁতভাবে তোলা হয়ে গেল।
কিন্তু তার মানেই যে সেদিনের কাজ শেষ হয়ে গেল তা নয়। এই একই ট্রেন আমাদের আবার প্রয়োজন হবে আজই রাত্রে দশটার সময়। রামদেওরা স্টেশনের দৃশ্য| মাঝরাত্তিরে জয়সলমিরের ট্রেন এল, ফেলু তোপসে লালমোহন ট্রেনে চাপল, আর ট্রেন ছাড়া মাত্র রাজস্থানির ছদ্মবেশে মন্দার বোস দৌড়ে গিয়ে ফেলুদের কামরার দরজার হাতল ধরে ঝুলে পড়ল।
সে হল আরেক পর্ব।