উট
ঈশা একদিন সকালে পথে বেরিয়েছেন বেড়াতে। কিছু দূর গিয়ে দেখলেন একটা পাঁচিলের ওপর কিছু লোক বসে আছে পা ঝুলিয়ে। তাদের চোখ মুখের ভাব দেখে ঈশার মনে হল, লোকগুলো ভীষণ অসুস্থ। তাদের সাংঘাতিক একটা কিছু হয়েছে। তিনি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে জিগ্যেস করলেন, ‘তোমাদের কি হয়েছে ভাই?’ তারা বিষণ্ণ মুখে ভয়ে-ভয়ে বললে, ‘আজ্ঞে, আমরা মৃত্যুর পর নরকে যাবার ভয়ে এইরকম হয়ে গেছি।’
ঈশা কিছু না বলে তাদের ছেড়ে এগিয়ে চললেন নিজের পথে। কিছুদূর যাবার পর দেখলেন একদল লোক পথের পাশে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। জিগ্যেস করলেন, ‘তোমাদের আবার কি হল ভাই?’
তারা বললে, ‘স্বর্গে যাবার প্রবল বাসনায় আমরা এই রকম ত্রিভুঙ্গ মুরারি হয়ে গেছি।
ঈশা অবাক হলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। তিনি এগিয়ে চললেন আপন মনে। অনেকটা দূর যাবার পর তাঁর সঙ্গে দেখা হল তৃতীয় আর একটি দলের। তাদের চোখমুখ দেখে মনে হল তারা জীবনের অনেক ঝড় ঝাপটা সহ্য করেছে, কিন্তু সকলেরই মুখ বেশ উজ্জ্বল, যেন একটা জ্যোতি বেরোচ্ছে?
ঈশা কৌতূহল চাপতে না পেরে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কি করে এমন হলে?’ তারা হেসে বললে, ‘জীবনের সত্যটা আমরা ধরে ফেলেছি। বাস্তবকে আমরা নানাভাবে দেখেছি। জীবনের তুচ্ছ ব্যাপার আর আমাদের বিচলিত করতে পারে না।’
ঈশা বললেন, ‘তোমরাই সেই মানুষ যারা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। শেষ হিসাব নিকাশ যখন হবে তখন দেখবে ঈশ্বর তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হাসি মুখে।’
ইংরেজিতে একটি কথা আছে,—’লিভ অ্যান্ড লার্ন লাইফ।’ বেঁচে থেকে বাঁচা শেখো। তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামিও না। বাস্তব জগৎটা কেমন? খুবই কঠিন। কঙ্করাস্তীর্ণ। জীবনের পথে ছড়ানো থাকে না গোলাপের পাপড়ি। দু:খ আর সুখ জীবনের দুটো পা। এই হাসি, এই কান্না! চাকার মতো ঘুরছে দু:খ, সুখ। কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। আজ যে আমির কাল সে ফকির। নদী রে! একুল ভেঙে ওকুল তুমি গড়ো। কেউ কারোকে মনে রাখবে না। যেই শেষ সেই শেষ। এরপর আর তারপর নেই। স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, পরিজন স্বার্থের সুতোয় বাঁধা। গরু যতদিন দুধ দেয় ততদিনই তার খাতির। মানুষ যতদিন পারবে ততদিনই সংসার তার হাঁকডাক শুনবে। আবার এমন হতে পারে, সংসার নিঙড়ে নিলে, দিলে না কিছুই। অবহেলাটাই হল কপালের লিখন। অবিশ্বাসী মুখরা স্ত্রী, অবাধ্য স্বার্থপর ছেলে, উড়ুক্কু মেয়ে। তাতেও ঘাবড়ালে চলবে না। এই তো জীবন। সেই সুন্দর একটি গল্প আছে। বন্ধু বন্ধুকে দেখাচ্ছে, ‘ওই দ্যাখো আমার হলুদ রঙের তিনতলা বাড়ি। চলো, এই হল সিঁড়ি। ঘুরে-ঘুরে উঠে গেছে চারতলার ছাদে। এই দ্যাখো দোতালায় আমার বিশাল শোবার ঘর। সাজানো গোছানো। নরম কার্পেট। দেওয়াল চোয়ানো আলো। এই দ্যাখো আমার খাট। খাটে শুয়ে আছে আমার সুন্দরী স্ত্রী। আর তাকে আদর করছি আমি।’
বন্ধু বললে, সে কি, তুমি আদর করছ কি? তুমি তো আমার পাশে!
বলল, ‘ওই হল। পৃথিবীতে বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করবে। যার উপকার করা হল, সে হবে পরম শত্রু। কুৎসা রটনা করবে। আত্মীয়-স্বজনরা স্বার্থ ফুরোলেই কেটে পড়বে। ছেলে বুড়ো বয়সে বাপকে ঘাড়ধাক্কা দেবে। যতক্ষণ হাতে টাকা পয়সা ক্ষমতা ততক্ষণই চারপাশে মোসায়েবের ভিড়। সুন্দরী রমণী শরীর দেখিয়ে কাজ বাগাবে। প্রলোভনে ব্যাঙ্কের তহবিল তসরুফ করে ক্ষমতাশালী জেলে যাবে। সুন্দরী তখন আর এক পাঁঠাকে জবাই করতে ছুটবে। ধার দেবে ধার পাবে না। অন্যের প্রয়োজনে প্রাণ দাও, তোমার প্রয়োজনে কেউ আসবে না। বাস্তবটা এইরকমই।
এসেছি একা যেতে হবে একা। ‘যাহা চাই তাহা পাই না, যাহা পাই তাহা চাই না।’
একজন উটকে জিগ্যেস করলে, ‘তুমি চড়াই পছন্দ করো, না উৎরাই?
উট বললে, ‘ধুস, চড়াই উৎরাই নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, আমার মাথা ঘামাবার বিষয় হল আমার পিঠের ওজন।’
জীবনের আদর্শ হল ওই উট। কাঁটা গাছ যার আহার। পিঠে যার বোঝা। গলা এগিয়ে চলেছে পথ, পথ উঁচু, কি পথ নিচু সে খেয়ালের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শক্তির। সহ্য শক্তি।