উচ্চারণ
০১.
প্রবাদ আছে, বঙ্গদেশে সংস্কৃত উচ্চারণ এককালে এমনই বিকৃত হইয়া পড়িয়াছিল যে, মহারাজা আদিশূর কানাকুজ হইতে শ্রীহর্ষ, ভট্টনারায়ণ (কেহ কেহ বলেন ক্ষিতীশ, মেধাতিথি) ইত্যাদি পাঁচজন ব্রাহ্মণকে এদেশে নিমন্ত্রণ করিয়া আনয়ন করেন। তাহারা এদেশের লোককে শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ কতটা শিখাইতে সমর্থ হইয়াছিলেন জানিবার উপায় নাই। ইহার পর আমাদের জানামতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এদেশে আবার সেই চেষ্টা করেন। কিন্তু তাহার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
ইতোমধ্যে শত শত বছর ধরিয়া বহু বাঙালি বিদ্যার্থী কাশীতে সংস্কৃত শিখিয়া আসিয়াছেন, কিন্তু তাহাদের উচ্চারণও এদেশে প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই। এমনকি কাশী-প্রত্যাবৃত্ত কোনও কোনও বাঙালি পণ্ডিতকে আমরা খাঁটি বাংলা উচ্চারণে সংস্কৃত পড়িতে শুনিয়াছি। সন্দেহ হইতেছে খাস কাশীতেও বাঙালি চালিত টোলে বাংলা কায়দায় সংস্কৃত উচ্চারণ শিখানো হয়।
বাংলা কায়দায় সংস্কৃত উচ্চারণ ব্যাপারটা যে কতদূর মারাত্মক তাহা একটি সামান্য উদাহরণ হইতেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন। প্রায় পঁচিশ বছর পূর্বে ইতালির খ্যাতনামা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত অধ্যাপক তুচ্চি কলকাতার তকালীন এক বিখ্যাত পণ্ডিতের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনা করিতেছিলেন। কথায় কথায় পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ ঋষি যাজ্ঞবন্ধ্যের নাম উচ্চারণ করেন। বাঙালি যে কায়দায় করে, সেই কায়দায়ই করিলেন, অনেকটা জাগেগাঁবোল্কোর ন্যায়। তুচ্চি তো কিছুতেই বুঝিতে পারেন না। কাহার কথা হইতেছে। পণ্ডিতের চক্ষুস্থির যে তুচ্চির মতো লোক যাজ্ঞবন্ধ্যের নাম শোনেন নাই। তুষ্টি প্রত্যাশা করিতেছেন যাজ্ঞবন্ধ্যের শুদ্ধ উচ্চারণ অনেকটা Yajnyavalkya-র ন্যায়, শুনিতেছেন Jaggonbolkol. বুঝিবেন কী প্রকারে যে একই ব্যক্তি!
বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ এতই কর্ণপীড়াদায়ক যে, আমাদের পরিচিত দুইটি পশ্চিম ভারতীয় ছাত্রকে বাধ্য হইয়া কলকাতা কলেজে সংস্কৃত অধ্যয়ন ত্যাগ করিতে হইল। পরশুরামের গল্পেীজী মেঘনাদবধকাব্য উচ্চারণ করিলে আমাদের কর্ণে যে পীড়ার সঞ্চার হইবে, আমাদের সংস্কৃত উচ্চারণ পশ্চিম ও উত্তর ভারতীয়দের সেই রকমই পীড়া দেয়।
বাঙালি সংস্কৃত ব্যঞ্জনের ঞ, ণ, য, অন্তস্থ ব, ষ, স উচ্চারণ করিতে পারে না ও যুক্তাক্ষরের (আত্মা, যক্ষ ইত্যাদি) উচ্চারণে অনেকগুলি ভুল করে। স্বরবর্ণের অ, ঐ, ঔ ভুল উচ্চারণ করে ও সর্বাপেক্ষা মারাত্মক এই যে স্বরের উচ্চারণে দীর্ঘশ্বরের প্রতি ক্ষেপমাত্র করে না। তাহাতে বিশেষ করিয়া মন্দাক্রান্তা পড়িলে মনে হয় ভগবানের অপার করুণা যে, কালিদাস জীবিত নাই।
বাঙালি যখন আরবি উচ্চারণ করে, তখন এই মারাত্মক অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়। বাঙালি (কি হিন্দু কি মুসলমান) আরবি বর্ণমালার সে, হে, জাল, স্বাদ, দ্বাদ, তৃয়, জয়, আইন, গাইন, কাফ, হামজা, অর্থাৎ বর্ণমালার ৪, ৬, ৯, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২১ ও ২৯ ভুল উচ্চারণ করে ও সংস্কৃতে হ্রস্ব-দীর্ঘ যেমন অবহেলা করিত, সেইরকমই আরবিতেও স্বরের হ্রস্ব-দীর্ঘের কোনও পার্থক্য করে না। কিন্তু শুধু কোরান পাঠের জন্য এক শ্রেণির বিশেষজ্ঞ আছেন। তাহাদিগকে কারী বলে; দ্রাবিড়ে যেমন সামবেদ গাহিবার জন্য এক শ্রেণির বিশেষ আইয়ার– আয়ঙ্গার ব্রাহ্মণ আছেন। বাঙালি কারীরা দীর্ঘ-হ্রস্ব মানেন ও ব্যঞ্জনে শুধু ৪, ৯, ১৫-তে ভুল করেন।
আমরা সংস্কৃত উচ্চারণে ভুল করি তাহার প্রধান কারণ, আমরা আর্য-সভ্যতার শেষ সীমা প্রান্তে বাস করি। (আর্য-সভ্যতা বাঙলা ছাড়াইয়া বর্মায় যাইতে পারে নাই ও বালি-জাভায় বিকশিত হইল বটে, কিন্তু প্রাণধারণ করিতে পারিল না)। আমাদের ধমনিতে আর্য-রক্ত অতি কম বলিয়াই আর্য উচ্চারণ করিতে অক্ষম হই। আমরা যে আরবি উচ্চারণ করিতে পারি না, তাহাও ঠিক সেই কারণেই। আরবি সেমিতি ভাষা, তাহার যেসব কঠিন উচ্চারণ মুখের নানা গোপন কোণ হইতে বহির্গত হয়, তাহা বাল্যকাল হইতে না শুনিলে আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব।
গত শুক্রবারে রেডিয়োতে কোরান পাঠ ও শনিবারে সংস্কৃত শাস্ত্র পাঠ ও উভয়ের বাঙলা অনুবাদ ও টিপ্পনী শুনিয়া উপরোল্লিখিত চিন্তাধারা মনের ভিতর তরঙ্গ খেলিয়া গেল। রেডিয়োর কোরান পাঠ মুসলমানদের কাছে আদর পাইয়াছে কি না জানি না, কিন্তু তাহারা যে কান দিয়া শুনেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এক বৃহৎ মুসলমান পরিবারে লক্ষ করিয়াছি, বুড়া কর্তারা রেডিয়োটা দুই চক্ষে দেখিতে পারেন না, দুই কানে শুনিতে পারেন না। তাহাদের বিশ্বাস ইসলামে সঙ্গীত অসিদ্ধ ও ওই যন্ত্রটি সেইসব শয়তানি জিনিস লইয়া কারবার করে, ছোকরাদের বিগড়াইয়া দেয়। অথচ শুক্রবার সকালবেলা দেখি গুঁড়িগুড়ি রেডিওঘরের দিকে চলিয়াছেন তাবৎ বুড়াবুড়িরা। আধ ঘণ্টা পূর্ব হইতে কলকাতা ছাড়া অন্য কোনও বেতারকেন্দ্রে রেডিয়ো জুড়িবার উপায় নাই। তার পর মুদ্রিত চক্ষে ভক্তিরসে পরিপূর্ণ হৃদয়ে অতি নীরবে কোরান পাঠ শ্রবণ করেন। অনুবাদ ও টিপ্পনী কেহ শোনেন, কেহ শোনেন না।
এই সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রতি কলকাতা কেন্দ্রের কর্তব্য আছে।
যে কারী সাহেব কোরান পাঠ করিলেন, তাহার উচ্চারণ সাধারণ বাঙালি কারী অপেক্ষা ভালো সন্দেহ নাই। তাঁহার দীর্ঘ-হ্রস্ব দুরস্ত, তাঁহার আইন কাফ হে ঠিক, কিন্তু তাঁর সে জাল ও দ্বাদ (4, ৯, ১৫) বারে বারে দুঃখ দেয়, বিশেষ করিয়া সে ও জাল, কারণ ইজা (যখন) ও সুম্মা (তৎপর) দুইটি কথা আরবিতে এবং সর্বভাষাতেই ঘন ঘন আসে।
কারী সাহেবের বাঙলা উচ্চারণে আরবির গন্ধ পাওয়া যায়– পাদ্রি সাহেবের বাঙলাতে যেরকম ইংরেজি গন্ধ আমাদিগকে পীড়িত করে আমরা বাঙলায় বলি যখন (যখোন), কারী সাহেব বলেন, য্যখ্যন যেন য ও খ-র ভিতরে আরবি আকার বা জবর রহিয়াছে।
শাস্ত্র যিনি পাঠ করিলেন তাহার উচ্চারণ সাধারণ বাঙালি অপেক্ষা শতগুণে ভালো সন্দেহ নাই কিন্তু কোনও মারাঠি বা যুক্তপ্রদেশীয় পণ্ডিত সে উচ্চারণের প্রশংসা করিবেন না। তাহার প্রধান কারণ যে শাস্ত্ৰ-পাঠকের হ্রস্ব-দীর্ঘ যথেষ্ট পরিমাণে হ্রস্ব ও যথেষ্ট পরিমাণে দীর্ঘ নহে। হ্রস্ব-দীর্ঘে তিনি এত সামান্য পৃথক করেন যে, বানান জানা সত্ত্বেও কানে ঠিক ঠিক বাজে না। তাঁহার বাঙলা উচ্চারণও পণ্ডিতি অনেকটা কথক-ঠাকুরদের মতো।
দুইজনেরই অনুবাদ ও টীকা নৈরাশ্যজনক। প্রভু ইসা (খ্রিস্ট) ও হাওয়ারিগণের বর্ণনা বাঙলার মুসলমান কী প্রকারে বুঝিবে, তাহাতে যদি বেশ কিছুদিন ধরিয়া প্যালেস্টাইনের ইতিহাস ও ভূগোল না শোনানো হয়। সকলেই তো শূন্যে ঝুলিতে থাকিবেন ও শাস্ত্র শোনা হইবে বটে, কিন্তু বোঝা বা আলোচনা তো হইবে না।
শাস্ত্ৰ-পাঠক যে ঊর্ধ্বশ্বাসে অনুবাদ ও টীকা করিয়া গেলেন তাহাতে আমার মতো মূর্খ কিছুই বুঝিতে পারিল না। টোলে কৃতবিদ্য ছাত্রকে যে ধরনে দ্রুতগতিতে টীকা শোনানো হয়, ইহার অনেকটা তাই। সাধারণ বাঙালি ধৰ্মতৃষিতকে আরও সরল, আরও সহজ করিয়া না বুঝাইলে টীকাদান পণ্ডশ্রম হইবে।
কারী সাহেব ও শাস্ত্রী মহাশয়ের নিন্দা করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে; আমরা জানি তাহারা যে কোনও মসজিদ-মাদ্রাসা, যে কোনও টোল-চতুম্পাঠীতে সম্মান ও আদর পাইবেন– আমরাও দিব। কিন্তু অল ইন্ডিয়া রেডিওর উচিত আরও ভালো আরও উত্তম, এক কথায় সর্বোত্তম কারী সর্বোত্তম শাস্ত্ৰপাঠক আনয়ন করা। ইংরেজিতে বলে, সর্বোত্তম উত্তমের শত্রু।
তাবৎ বাঙলা ও কিছু কিছু বিহার উড়িষ্যা আসামকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ যে উচ্চারণ পরিবেশন করা হয় তাহার জন্য রেডিওকর্তার দায়িত্বজ্ঞান ও বিবেকবুদ্ধি অনেক বেশি হওয়া উচিত ও তাহাদিগকে অনেক পরিশ্রম করিয়া সর্বোত্তম কারী-শাস্ত্রী সন্ধান করা উচিত। অথবা অর্থব্যয় করিয়া উপযুক্ত লোক প্রস্তুত করা উচিত।
শুনিয়াছি মিশরের কারী রেফাৎ রমজান মাসে কোরান পাঠের জন্য ১৩০০ টাকা পারিশ্রমিক পান; কাইরো কলকাতা অপেক্ষা ধর্মপ্রাণ একথা কে বলিবে?
সর্বশেষে বক্তব্য, পাঠক যেন না ভাবেন, মন্দ উচ্চারণে আমরাই একা। আর্যসভ্যতার অন্য প্রান্ত অর্থাৎ ইংলন্ডের অবস্থাও তাই। সেখানে বড় বড় পণ্ডিতদের লাতিন উচ্চারণ শুনিলে কানে আঙুল দিতে হয়। তবে ইংলন্ডে উচ্চারণ শুদ্ধ করিবার জন্য জোর আন্দোলন চলিতেছে, এদেশে–থাক সে কথা।
.
০২.
উচ্চারণ সম্বন্ধে আলোচনায় যোগ দিয়াছেন শ্ৰীযুত মুখোপাধ্যায়, কাব্য ব্যাকরণস্মৃতিতীর্থ, সাহিত্যশাস্ত্রী, ভূতপূর্ব অধ্যাপক, সংস্কৃত কলেজ। পাঠক বুঝিতে পারিতেছেন, এহেন পণ্ডিতের সঙ্গে উচ্চারণ সম্বন্ধে আমি আলোচনা করিতে পারি, কিন্তু তর্ক করিবার মতো যুগ্ম মস্তক স্কন্ধে নাই। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে শাস্ত্রী মহাশয়ের শেষ বাক্য আমাদের মতের সঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে বলিয়া তর্কাতর্কির বিশেষ প্রয়োজন হইবে না। তাঁহার শেষ বাক্য সকল কথার পর তবুও স্বীকার্য যে, বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু তাহার পূর্বে সকল কথার মাঝখানে শাস্ত্রী মহাশয় এমন কথাও তুলিয়াছেন যেখানে অধম কিঞ্চিৎ প্রগলভতা প্রকাশ করিবে। শাস্ত্রী মহাশয় এবং অন্যান্য সহৃদয় পত্রপ্রেরকও দর্শাইয়াছেন যে, অবাঙালি সংস্কৃত পণ্ডিত ষ ও খতে পার্থক্য রাখেন না। কিন্তু তাহা হইতে কী সপ্রমাণ হয় ঠিক পরিষ্কারভাবে বুঝাইয়া বলেন নাই। ব্যঞ্জনায় বুঝিতেছি শাস্ত্রী মহাশয়ের বলার উদ্দেশ্য যে, যেহেতুক অবাঙালি পণ্ডিতও ঠিক ঠিক উচ্চারণ করিতে পারেন না, তবে বাঙালিরই-বা দোষ কী?
ইহার উত্তরে বক্তব্য এই যে, মারাঠি, দ্রাবিড় ও কাশীর পণ্ডিত যখন সংস্কৃত উচ্চারণ করেন, তখন প্রাদেশিক বৈশিষ্ট্যবশত কিছু কিছু পার্থক্য তাহাদের উচ্চারণের মধ্যে থাকে। ওইসব পণ্ডিতের একে অন্যের উচ্চারণে যে পার্থক্য তাহা যেন একইরঙের পৃথক পৃথক ফিকা ভাব অথবা গাঢ়। বাঙালির উচ্চারণ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন রঙ। দক্ষিণের আইয়ার হয়তো যতটা দীর্ঘ করিলেন, উত্তরে কাশীবাসী হয়তো ততটা করিলেন না। এবং শেষ পর্যন্ত বাঙালি যে অত্যন্ত পৃথক কিছু উচ্চারণ করে তাহা এই তথ্য হইতে সপ্রমাণ হয় যে, আইয়ার, নষুদ্ৰী, চিতপাবন, দেশ, করাঢ় (এমনকি মহারাষ্ট্রের দেশস্থ ও ঔপনিবেশিক দ্রাবিড়স্থ), উদীচী, ভার্গব, নাগর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়গণ ও তাঁহাদের শিষ্য ব্রাহ্মণগণও একে অন্যের উচ্চারণের পার্থক্য লইয়া ঈষৎ আলোচনা করিয়া একটি সাধারণ রূপ বা নর্ম (norm) স্বীকার করেন, কিন্তু বাঙালির উচ্চারণ যে সম্পূর্ণ পৃথক এবং পরস্পর-বিরোধিতায় কণ্টকাকীর্ণ সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করেন না।
(ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে উচ্চারণের পার্থক্য হয় প্রধানত দীর্ঘস্বরের দৈর্ঘ্য, হ্রস্বস্বরের হ্রস্বতা, ঝ, ৯, ও ষ লইয়া। সব কয়টির আলোচনা এক কলমে ধরাইবার মতো কলমের জোর অধমের নাই। উপস্থিত য লইয়া আলোচনা করিব, পরে প্রয়োজন হইলে অন্যান্যগুলির হইবে। ষ যে খ নয় সে বিষয়ে তর্ক করিবার কোনও প্রয়োজন নাই। কিন্তু ষ-এর উচ্চারণ কেন খ হইল তাহার আলোচনা করিলে মূল ষ-এর কিঞ্চিৎ নির্দেশ পাওয়া যায়। প্রথম দ্রষ্টব্য ষ স্থলে বিদেশি পণ্ডিত যখন খ বলেন, তখন তাহারা দুই দলে বিভক্ত; কেহ কেহ উচ্চারণ করেন পরিষ্কার খ অর্থাৎ ক বর্গের মহাপ্রাণ খ এবং কেহ কেহ উচ্চারণ করেন ঘর্ষণজাত আরবির খ— কাবুলিরা যেরকম খবর বলে, স্কচরা যেরকম লখ LOCH বলে, জর্মনরা যেরকম BACH বলে। এই দ্বিতীয় খ উচ্চারিত হয় পণ্ডিত যখন ষ-কে শ হইতে পৃথক করিবার জন্য অত্যধিক উল্কণ্ঠিত হইয়া জিহ্বা মূর্ধা হইতে সরাইয়া আরও পশ্চাৎ দিকে ঠেলেন। এই কারণেই আর্যভাষা পশতুতেও তাহা দেখা যায়– কেহ বলে পশুতু, কেহ বলে পখতু, কেহ বলে পেশাওয়ার, কেহ বলে পেখাওয়ার। এই কারণে জর্মনে Becher-এর ch ষ-এর মতো, অথচ Bach-এর ch আরবি খ-এর ন্যায়। ষ-কে এইজাতীয় খ করা অবশ্য ভুল, আমি মাত্র কারণটি ও নজিরগুলো দেখাইলাম। কিন্তু ষ-এর আসল শুদ্ধ উচ্চারণ সম্বন্ধে মতানৈক্য হওয়া অনুচিত। অত্যধিক উল্কণ্ঠিত (উভয়ার্থে) না হইয়া মুখগহ্বরের যে স্থল অর্থাৎ মূর্ধা হইতে ট, ঠ, ড, ঢ ও পরে ওই স্থলে য বলিলে মূর্ধণ্য য বাহির হইবে।)
বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণের কৈফিয়ৎ দিয়াছেন হিন্দুস্থান পার্ক হইতে শ্রীআচার্য। তাহার বক্তব্য কোনও ভাষা আয়ত্ত করিতে হইলে তার সাহিত্য, ব্যাকরণ এবং ধ্বনিতত্ত্বে পারদর্শী হওয়া বাঞ্ছনীয় সন্দেহ নাই। আমাদের মতের সঙ্গে আচার্য মহাশয়ের মতে মিলিল কিন্তু তিনি বলিতেছেন—
কিন্তু জাতীয় অভ্যাসের প্রতিকুলতা নিবন্ধন যদি সেই ভাষার উচ্চারণে অসম্পূর্ণতা থাকিয়া যায়, তাহাতে কোনও পণ্ডিত ব্যক্তির লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণ আছে বলিয়া মনে করি না।
আচার্য মহাশয় তাহার চিঠিতে নিজের কোনও উপাধির উল্লেখ করেন নাই, অথচ পত্রখানি গভীর, পাণ্ডিত্যে পূর্ণ। তাই প্রতিবাদ করিতে সাহস পাইতেছি না, অথচ উপরের নীতিটি এতই বিপজ্জনক যে, নিতান্ত অনিচ্ছায় করিতেছি। কারণ যদি এই নীতিই অনুসরণ করিতে হয়, তবে বলিতে হইবে যেহেতু আমরা বাঙালি, আমাদের জাতীয় অভ্যাসের প্রতিকূল হয় তাই আমরা F ও ফয়ের তফাৎ করিব না, th-এর শুদ্ধ উচ্চারণ শিখিব না, কুরান বঙ্গীয় ইসলামি কায়দায় পড়িব, মন্দাক্রান্তার দীর্ঘ না মানিয়া উদয়াস্ত কালিদাসকে জবাই করিব। এই নীতি আরও অনুসরণ করিয়া বলিব, আমরা বাঙালি, বাঙলা ভাষার লিঙ্গ নাই, সংস্কৃত লিখিবার সময় লিঙ্গভেদ করিব না। দ্বিবচন মানিব না; হিন্দি বলিবার সময় একঠো, দুইঠো করিব, গাড়ি আতা হৈ বলিব– এক কথায় জাতীয় অভ্যাসের দোহাই দিয়া বিজাতীয় কোনও ভাষাই তাহার স্বরূপে গ্রহণ করিব না; সুকুমার রায়ের হ য ব র ল-য়ের দর্জির ৩২ ইঞ্চি ফিতা দিয়া মাপিলে যেমন সবকিছু ৩২ ইঞ্চি হইয়া যাইত। আমাদের জাতীয় অভ্যাসের বকযন্ত্রে চোলাই করা সর্ব উচ্চারণ শুদ্ধ একহল হইয়া বাহির হইবে তাহার বর্ণগন্ধ থাকিবে না।
লজ্জা বা শ্লাঘার কথা হইতেছে না; অভ্যাসটি বাঞ্ছনীয়। বেদমন্ত্র ঠিক কী প্রকারে উচ্চারিত হইত জানি না, কিন্তু চেষ্টা তো করিতে হইবে জানিবার জন্য। সেই চেষ্টাতেই তো
পণ্ডিতে ও আমাদের মতো সাধারণ লোকের তফাৎ। যুক্তপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মদ্র, গুর্জর পার্থক্য সত্ত্বেও একটি (norm) মানিয়া লইয়াছেন, নিরপেক্ষ ইউরোপীয় পণ্ডিতগণও সেটি স্বীকার করিয়া লইয়াছেন– তবে আমাদের কর্তব্য কী?
আচার্য মহাশয় ভুল উচ্চারণ চাহেন না, কিন্তু তাঁহার মতো পণ্ডিত যদি সে উচ্চারণের সপক্ষে এককাড়ি অজুহাত দেন, তবে আমাদের মতো সরল লোক জাতীয় অভ্যাসের তাকিয়ায় ঠেসান দিয়া আরামে নিদ্রা যাইব– এই আমার ভয়।
এস্থলে বলিয়া রাখা ভালো যে, যদিচ জাভার মুসলমান ও মক্কার মুসলমান এক রকম উচ্চারণে কোরান পড়েন না, তবু জাভার মুসলমান হামেহাল চেষ্টা করেন নর্মের (norm) দিকে অগ্রসর হইবার। পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের আরবি উচ্চারণ খারাপ, কিন্তু জাতীয় অভ্যাসের বিরুদ্ধে জেহাদ হামেসা চালু রাখেন বলিয়া তাহাদের আরবি উচ্চারণ বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ অপেক্ষা নর্মের (norm-এর) অনেক কাছে।
আচার্য মহাশয় দূরদৃষ্টি ও অভিজ্ঞতাজাত অন্যান্য মনোরম তথ্যও বলিয়াছেন। সেগুলি পণ্ডিত-অপণ্ডিত সকলেরই জানা উচিত। সুবিধামতো সেগুলি পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত করিব।
অন্যান্য চিঠিও পাইয়াছি, লেখকদের ধন্যবাদ। এ মূর্খকে জ্ঞানদান করিবার জন্য তাহাদের প্রচেষ্টা কৃতজ্ঞ হৃদয়ে বার বার স্বীকার করি।