মেঘ-মল্লার
মৌরীফুল
যাত্রাবদল
জন্ম ও মৃত্যু
কিন্নর দল
বেনীগীর ফুলবাড়ি
নবাগত
তালনবমী
উপলখন্ড
বিধুমাস্টার
ক্ষণভঙ্গুর
অসাধারণ
মুখোশ ও মুখশ্রী
নীলগঞ্জের ফালমন্ সাহেব
1 of 2

উইলের খেয়াল

উইলের খেয়াল

দেশ থেকে রবিবারে ফিরছিলাম কলকাতায়। সন্ধ্যার আর বেশি দেরি নেই, একটু আগে থেকেই প্ল্যাটফর্মে আলো জ্বেলেছে, শীতও খুব বেশি। এদিকে এমন একটা কামরায় উঠে বসেছি, যেখানে দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই যার সঙ্গে একটু গল্পগুজব করি। আবার যার-তার সঙ্গে গল্প করেও আনন্দ হয় না। আমার দরের কোনো লোকের সঙ্গে গল্পে করে কোনো সুখ পাইনে, কারণ তারা যে-কথা বলবে সে আমার জানা। তারা আমারই জগতের লোক, আমার মতোই লেখাপড়া তাদেরও, আমারই মতো কেরানিগিরি কী ইস্কুল-মাস্টারি করে, আমারই মতো শনিবারে বাড়ি এসে আবার রবিবারে কলকাতায় ফেরে। তারা নতুন খবর আমায় কিছুই দিতে পারবে না, সেই একঘেয়ে কলকাতার মাছের দর, এম. সি. সি-র খেলা, ইস্টবেঙ্গল সোসাইটির দোকানে শীতবস্ত্রের দাম, চণ্ডীদাস কী সাবিত্রী ফিলমের সমালোচনা—এসব শুনলে গা বমিবমি করে। বরং বেগুনের ব্যাপারী, কী কন্যাদায়গ্রস্ত পাড়াগেঁয়ে ভদ্রলোক, কী দোকানদার—এদের ঠিকমতো বেছে নিতে পারলে, কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। কিন্তু বেছে নেওয়া বড়ো কঠিন–কন্যাদায়গ্রস্ত ভদ্রলোক ভেবে যাঁর কাছে গিয়েচি, অনেক সময় দেখেছি তিনি ইনসিওরেন্সের দালাল।

একা বসে বিড়ি খেতে খেতে প্লাটফর্মের দিকে চেয়ে আছি, এমন সময় দেখি আমার বাল্যবন্ধু শান্তিরাম হাতে একটা ভারী বোঁচকা ঝুলিয়ে কোন গাড়িতে উঠবে ব্যস্তভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি ডাকতেই ‘এই যে!’ বলে একগাল হেসে আমার কামরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললে—বোঁচকাটা একটুখানি ধরো না ভাই কাইন্ডলি—

আমি তার বোঁচকাটা হাত বাড়িয়ে গাড়িতে তুলে নিলাম—পেছনে পেছনে শান্তিরামও হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে আমার সামনের বেঞ্চিতে মুখোমুখি হয়ে বসল। খানিকটা ঠান্ডা হয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললে—বিড়ি আছে? কিনতে ভুলে গেলাম তাড়াতাড়িতে। আর ক-মিনিট আছে? পৌঁনে ছ-টা না রেলওয়ের? আমি ছুটচি সেই বাজার থেকে—আর ওই ভারি বোঁচকা! প্রাণ একেবারে বেরিয়ে গিয়েছে। কলকাতায় বাসা করা গিয়েচে ভাই, শনিবারে শনিবারে বাড়ি আসি। বাগানের কলাটা, মুলোটা যা পাই নিয়ে যাই এসে—সেখানে তো সবই—-— বুঝলে না? দাঁতন-কাঠিটা ইস্তক তাও নগদ পয়সা। প্রায় তিন-চার দিনের বাজার খরচ বেঁচে যায়। এই দ্যাখো ওল, পুঁইশাক, কাঁচা লঙ্কা, পাটালি…দেখি দেশলাইটা—

শান্তিরামকে পেয়ে খুশি হলাম। শান্তিরামের স্বভাবই হচ্চে একটু বেশি বকা। কিন্তু তার বকুনি আমার শুনতে ভালো লাগে। সে বকুনির ফাঁকে ফাঁকে এমন সব পাড়াগাঁয়ের ঘটনার টুকরো ঢুকিয়ে দেয়, যা গল্প লেখার চমৎকার—অতিচমৎকার উপাদান। ওর কাছে শোনা ঘটনা নিয়ে দু-একটা গল্পও লিখেচি এর আগে। মনে ভাবলাম শান্তিরাম এসেচে, ভালোই হয়েছে। একা চার ঘণ্টার রাস্তা যাব, তাতে এই শীত। তা ছাড়া এই শীতে ওর মুখের গল্প জমবেও ভালো।

হঠাৎ শান্তিরাম প্ল্যাটফর্মের দিকে মুখ বাড়িয়ে ডাকতে লাগল—অবনী ও অবনী, এই যে, এই গাড়িতে এসো, কোথায় যাবে?

গুটি তিন-চার ছেলে-মেয়ে, এক পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের স্বাস্থ্যবতী ও সুশ্রী একটি পাড়াগাঁয়ের বউ আগে আগে, পিছনে একটি ফর্সা একহারা চেহারার লোক, সবার পিছনে বাক্স পেটরা মাথায় জন দুই কুলি। লোকটি আমাদের কামরার কাছে এসে দাঁড়িয়ে হেসে বললে—এই যে দাদা, কলকাতা ফিরছেন আজই! আমি? আমি একবার এদের নিয়ে যাচ্চি পাঁচঘরার ঠাকুরের থানে। মসলন্দপুর স্টেশনে নেমে যেতে হবে; বাস পাওয়া যায়। দলটি আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে এগিয়ে খালি একটা ইন্টার ক্লাস কামরায় উঠল।

শান্তিরাম চেয়ে চেয়ে দেখে বললে—তাই অবনী এখানে এল না, ইন্টার ক্লাসের টিকিট কিনা? আঙুল ফুলে কলাগাছ একেই বলে! ওই অবনীদের খাওয়া জুটত না, আজ দল বেঁধে ইন্টার ক্লাসে চেপে বেড়াতে যাচ্ছে…ভগবান যখন যাকে দেন,—আমাদের বোঁচকা বওয়াই সার।

গাড়ি ছাড়ল। সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকারে পাম্পিং এঞ্জিনের শেড, কেবিনঘর, ধূমাকীর্ণ কুলিলাইন সট সট করে দু-পাশ কেটে বেরিয়ে চলেছে, সামনে সিগন্যালের সবুজ বাতি, তারপর দু-পাশে আখের খেত, মাঠ, বাবলা বন। শান্তিরামের গলার সুর শুনে বুঝলাম, সে গল্প বলার মেজাজে আছে, ভালো করে আলোয়ান গায়ে দিয়ে বসলাম, উৎসুক মুখে ওর দিকে চেয়েঃরইলাম।

শান্তিরাম বললে—অবনীকে এর আগে কখনো দেখোনি? নিশ্চয় দেখেছ ছেলেবেলায়, ও আমাদের নীচের ক্লাসে পড়ত আর বেশ ভালো ফুটবল খেলত— মনে নেই? ওর বাবা কোর্টে নকলনবিশি করতেন, সংসারের অভাব-অনটন টানাটানি বেড়েই চলেছিল। সেই অবস্থায় অবনীর বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে আললেন। বললেন—কবে মরে যাব, ছেলের বউয়ের মুখ দেখে যাই। বাঁচলেনও না বেশিদিন, একপাল পুষ্যি আর একরাশ দেনা ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সংসার থেকে বিদায় নিলেন।

তারপর কী কষ্টটাই গিয়েচে ওদের। অবনী পাস করতে পারলে না, চাকরিও কিছু জুটল না, হরিণখালির বিলের এক অংশ ওদের ছিল অনেককাল আগে থেকে—শোলা হত সেখানে, সেই বিলের শোলা ইজারা দিয়ে যে কটা টাকা পেত, তাই ছিল ভরসা।

ওদের গাঁয়ে চৌধুরীপাড়ায় নিধিরাম চৌধুরী বলে একজন লোক ছিল। গাঁয়ে তাকে সবাই ডাকত নিসু চৌধুরী। নিসু চৌধুরীর কোনো কুলে কেউ ছিল না, বিয়ে করেছিল দু-দু-বার, ছেলেপুলেও হয়েছিল কিন্তু টেকেনি। ওর বাবা সেকালে নিমকির দারোগা ছিল, বেশ দু-পয়সা কামিয়ে বিষয়সম্পত্তি করে গিয়েছিল। তা শালিয়ানা প্রায় হাজার বারোশো টাকা আয়ের জমা, আম-কাঁঠালের বাগান, বাড়িতে তিনটে গোলা, এক-একটা গোলায় দেড়পাট দু-পাট করে ধান ধরে, দুটো পুকুর, তেজারতি কারবার। নিসু চৌধুরী ইদানীং তেজারতি কারবার গুটিয়ে ফেলে জেলার লোন অফিসে নগদ টাকাটা রেখে দিত। সেই নিসু চৌধুরীর বয়স হল, ক্রমে শরীর অপটু হয়ে পড়তে লাগল, সংসারে মুখে জলটি দেবার একজন লোক নেই। আবার পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার জানো তো? পয়সা নিয়ে বাড়িতে কাউকে খেতে দেওয়া—এ রেওয়াজ নেই। তাতে সমাজে নিন্দে হয়, সে কেউ করবে না। নিসু চৌধুরী এমন একবার অসুখে পড়ে দিনকতক বড়ো কষ্ট পেলে—এসব দিকের পাড়াগাঁয়ের জানো তো ভায়া, না-পাওয়া যায় রাঁধুনি বামুন, না-পাওয়া যায় চাকর, পয়সা দিলেও মেলানো যায় না। দিন দশ-বারো ভুগবার পর উঠে একটু সুস্থ হয়ে একদিন নিসু চৌধুরী অবনীকে বাড়িতে ডাকলে। বললে—বাবা অবনী, আমার কেউ নেই, এখন তোমরা পাঁচজন ভরসা। তা তোমার বাবা আমায় ছোটো ভাইয়ের মতো দেখতেন, তোমাদের পাড়ায় তখন যাতায়াতও ছিল খুব। তারপর এখন শরীরও হয়ে পড়েছে অপটু, তোমাদের যে গিয়ে খোঁজখবর করব, তাও আর। পারিনে। তা আমি বলছি কী, আমার যা আছে সব লেখাপড়া করে দিচ্চি তোমাদের, নাও—নিয়ে আমাকে তোমাদের সংসারে জায়গা দাও। তুমি আমার দীনুদার ছেলে, আমার নিজের ছেলেরই মতো। তোমাকে আর বেশি কী বলব বাবা?

অবনী আশ্চর্য হয়ে গেল। নিসু চৌধুরীর নগদ টাকা কত আছে কেউ অবিশ্যি জানে না, কিন্তু বিষয়সম্পত্তির আয়, ধান—এসব যা আছে, এ গাঁয়ে এক রায়েদের ছাড়া আর কারু নেই। সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিতে চায় নিসু চৌধুরী তার নামে! অবনীর মুখ দিয়ে তো কথা বেরুল না খানিকক্ষণ। তারপর বললে—আচ্ছা কাকা, বাড়িতে একবার পরামর্শ করে এসে কাল বলব।

নিসু চৌধুরী বললে—বেশ বাবা, কিন্তু এসব কথা এখন যেন গোপন থাকে। পরদিন গিয়ে অবনী জানালে এ প্রস্তাবে তাদের কোনো আপত্তি নেই। নিসু চৌধুরী বললে-বউমা তাহলে রাজি হয়েছেন? দ্যাখো তাহলে আমার একটা সাধ আছে, সেটা বলি। আমার এত বড়ো বাড়িখানা পড়ে আছে, অনেক দিন এতে মালক্ষ্মীদের চরণ পড়েনি, ঠিকমতো সন্ধে-পড়ে না। তোমাদের ও-বাড়িটাও তো ছোটো, ঘরদোরে কুলোয় না, তা ছাড়া পুরোনোও বটে। তোমরা আমার এখানে কেন এসো না সবসুদ্ধ? তোমারই তো বাড়িঘর হবে, তোমাকেই সব দিয়ে যখন যাব, তখন এখন থেকে তোমার নিজের বাড়ি তোমরা না-দেখলে নষ্ট হয়ে যাবেঃযে!

এ প্রস্তাবেও অবনী রাজি হল, একটা ভালো দিন দেখে সবাই এ বাড়িতে চলে এল। অবনীর বউ নিসু চৌধুরীর বাড়ি কখনো দেখেনি, কারণ সে ওপাড়ার বউ, এ-পাড়ায় আসবার দরকার তেমন হয়নি কখনো। ঘরবাড়ি দেখে বউ যেমন অবাক হয়ে গেল, তেমনি খুশি হল। নিসু চৌধুরীর বাবা রোজগারের প্রথম অবস্থায় শখ করে বাড়ি উঠিয়েছিলেন—তখনকার দিনে সস্তাগণ্ডার বাজার ছিল, দেখে অবাক হবার মতো বাড়িই করেছিলেন বটে, পাড়াগাঁয়ের পক্ষে অবিশ্যি। কলকাতার কথা ছেড়ে দাও। মস্ত দোতলা বাড়ি ওদের, নীচে বড়ো বড়ো সাত-আটখানা ঘর, বারান্দা, প্রকাণ্ড ছাদ, সান-বাঁধানো উঠোন, ভেতর বাড়িতে পাকা রান্নাঘর, দারা, বাইরে প্রকাণ্ড বৈঠকখানা। বাড়ির পেছনে বাগান, ছোটো একটা পুকুর, বাঁধানো ঘাটপাড়াগাঁয়ে সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ি যেমন হয়ে থাকে।

ওরা বাড়িতে উঠে এসে জাঁকিয়ে সত্যনারায়ণের পুজো দিলে, লোকজন খাওয়ালে, লক্ষ্মীপুজো করলে। সবাই বললে অবনীর বউ-এর পয় আছে, নইলে অমন বিষয়সম্পত্তি পাওয়া কী সোজা কথা আজকালকার বাজারে। আবার অনেকেরই চোখ টাটালো।

এসব হল গিয়ে ওবছর ফাল্গুন মাসের কথা! গত বছর বৈশাখ মাসে নিসু চৌধুরী মারা গেল। জ্বর হয়েছিল, অবনী ভালো ভালো ডাক্তার দেখালে, খুলনা থেকে নৃপেন ডাক্তারকে নিয়ে এল—বিস্তর পয়সা খরচ করলে, অবনীর বউ মেয়ের মতো সেবা করলে—কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। অবনী বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ করলে খুব ঘটা করে, সমাজ খাওয়ালে—তা সবাই বললে দেখেশুনে যে নিজের ছেলে থাকলে নিসু চৌধুরীর—সেও এর বেশি আর কিছু করতে পারত না। তারপর এখন ওরাই সম্পত্তির মালিক, অবনী নিজেই খাটিয়ে ছেলে, কোনো নেশা-ভাঙ করে না, অতি সৎ। কাজেই বিষয় উড়িয়ে দেবে সে ভয় নেই, দেখেশুনে খাবার ক্ষমতা আছে।

তাই বলছিলাম, ভগবান যাকে দেন, তাকে এমনি করেই দেন। ওই অবনীর বউ আঁচল পেতে চাল ধার করে নিয়ে গিয়েছে আমার মাসিমাদের বাড়ি থেকে, তবে হাঁড়ি চড়েচে—এমন দিনও গিয়েচে ওদের। আমার মাসিমার বাড়ি ওদের একই পাড়ায় কিনা? তাঁরই মুখে সব শুনতে পাই। আর তারাই এখন দেখো ইন্টার ক্লাসে—ভগবান যখন যাকে—

অবনীর বউটি খুব ভালো, অত্যন্ত গরিব ঘরের মেয়ে ছিল, পড়েছিলও তেমনি গরিবের ঘরে। সে নাকি মাসিমার কাছে বলেচে, যা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি দিদি তাই যখন হল, এখন ভাবি, ভগবান সব বাঁচিয়ে বর্তে রাখতে হয়। গরিব লোকের কপাল, ভরসা করতে ভয় পাই দিদি। প্রথম যেদিন বাড়িতে ঢুকলাম, দেখি এ যেন রাজবাড়ি, অত ঘরদোর অত বড়ো জানলা-দরজা, এতে আমার ছেলে-মেয়েরা বাস করতে পারবে, জানো তো কী অবস্থায় ছিলাম—তোমার কাছে আর কি লুকোব? এ যেন সবই স্বপ্ন বলে মনে হয়েছিল। এখন ব্ৰতটা নামটা করে, দু-দশ জন ব্রাহ্মণের পাতে দু-মুঠো ভাত দিয়ে যদি ভালোয় ভালোয় দিনগুলো কাটাতে পারি, তবে তো মুখ থাকে লোকের কাছে। সেই আশীর্বাদ করো তোমরা সকলে।

সন্ধ্যার অন্ধকার চারিধারে খুব গাঢ় হয়েছে। ট্রেন হু-হু করে অন্ধকার মাঠ, বাঁশবন, বিল, জলা, আখের খেত, মাঝে মাঝে ঘন অন্ধকারের মধ্যে জোনাকি জ্বলা ঝোপ পার হয়ে উড়ে চলেচে, মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম, খড়ে-ছাওয়া বিশ-ত্রিশটা চালাঘর একজায়গায় জড়াজড়ি করে আছে, দু-চার-দশটা মিটমিটে আলো জ্বলে অন্ধকারে ঢাকা গাছপালায় ঢাকা গ্রামগুলোকে কেমন একটা রহস্যময় রূপ দিয়েছে।

একটা বড়ো গ্রামের স্টেশনে অবনী তার বউ ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে নেমে গেল। স্টেশনের বাইরে একখানা ছইওয়ালা গোরুরগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, বোধ হয় ওদেরই জন্যে। অবনীর বউকে এবার প্লাটফর্মের তেলের লণ্ঠনের অস্পষ্ট আলোয় দেখে আরও বেশি করে মনে হল যে মেয়েটি সত্যিই সুশ্রী। বেশ ফর্সা রং, সুঠাম বাহু দুটির গড়ন, চলনভঙ্গি ও গলার সুরের সবটাই মেয়েলি। এমনি নিখুঁত মেয়েলি ধরনের মেয়ে দেখবার একটা আনন্দ আছে, কারণ সেটা দুষ্প্রাপ্য। ট্রেনখানা প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইল; একজন লোক হারিকেন লণ্ঠন নিয়ে ওদের এগিয়ে নিতে এসেছিল, ওরা তার সঙ্গে স্টেশনের বাইরে যেতে গিয়ে ফটক খোলা না-পেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কারণ যিনি স্টেশনমাস্টার তিনিই বোধ হয় টিকিট নেবেন যাত্রীদের কাছ থেকে—ফটকে চাবি দিয়ে তিনি গার্ডকে দিয়ে প্লাটফর্মের মধ্যে আঁধারে লণ্ঠনের আলোয় কী কাগজপত্র সই করাচ্ছিলেন।

তারপর ট্রেন আবার চলতে লাগল—আবার সেইরকম ঝোপ-ঝাপ, অন্ধকারে ঢাকা ছোটোখাটো গ্রাম, বড়ো বড়ো বিল, বিলের ধারে বাগদিদের কুঁড়ে। আমার ভারি ভালো লাগছিল—এইসব অজানা ক্ষুদ্র গ্রামে ঘরে ঘরে অবনীর বউ-এর মতো কত গৃহস্থবধূ ভারবাহী পশুর মতো উদয়াস্ত খাটচে, হয়তো পেটপুরে দু বেলা খেতেও পায় না, ফর্সা কাপড় বছরে পরে হয়তো দু-দিন কী তিনদিন, হয়তো সেই পুজোর সময় একবার, কোনো সাধ-আহ্লাদ পুরে না মনের, কিছু দেখে না, জানে না, বোঝে না, মনে বড়ো কিছু আশা করতে শেখেনি, বাইরের দুনিয়ার কিছু খবর রাখে না—পাড়াগাঁয়ের ডোবার ধারের বাঁশবাগানের ছায়ায় জীবন তাদের আরম্ভ, তাদের সকল সুখ-দুঃখ, আনন্দ, আশা-নিরাশার পরিসমাপ্তিও ওইখানে।

অবনীর বউ গৃহস্থবধূদেরই একজন। অন্তত ওদের একজনও তার সাধের স্বর্গকে হাতে পেয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে আমি বসে বসে এই কথাই ভাবছিলাম। আমি কল্পনা করবার চেষ্টা করলাম অবনীর বউকে, যখন সে প্রথম নিসু চৌধুরীর বাড়িতে এল—কী ভাবলে অত বড়ো বাড়িটা দেখে,…অত ঘরদোর!…যখন প্রথম জানলে যে সংসারের দুঃখ দূর হয়েছে, প্রথম যখন সে তার ছেলে-মেয়েদের ফর্সা কাপড় পরতে দিতে পারলে, আমি কল্পনা করলাম দশঘরার হাট থেকে অবনী বড়ো মাছ, সন্দেশ, ছানা কিনে বাড়িতে এসেচে…অবনীর বউ এই প্রথম সচ্ছলতার মুখ দেখলে। তার সে খুশি-ভরা চোখমুখ অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।…

ট্রেন আর একটা স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। শান্তিরাম আলোয়ান মুড়ি দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে, মাঝে মাঝে ঢুলচে। স্টেশনে পানের বোঝা উঠছে। শান্তিরামকে বললাম—শান্তিরাম, ঘুমুচ্চ নাকি? আমি একটা গল্প জানি এইরকমই, তোমার গল্পটা শুনে আমার মনে পড়েছে সেটা, শুনবে?…

কিন্তু শান্তিরাম এখন গল্প শোনবার মেজাজে নেই। সে আরামে ঠেস দিয়ে আরও ভালো করে মুড়িসুড়ি দিয়ে বসল। সে একটু ঘুমুবে।

পূর্ণবাবুর কথা আমার মনে পড়েছে, শান্তিরামের গল্পটা শোনবার পরে এখন। পূর্ণবাবু আমিন ছিল, পাটনায় আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। পূর্ণবাবুর বয়স তখন ছিল পঞ্চাশ কী বাহান্ন বছর। লম্বা রোগা চেহারা, বেজায় আফিম খেত—দাঁত প্রায় সব পড়ে গিয়েছিল, মাথার চুল সাদা,নাক বেশ টিকোলো, অমন সুন্দর নাক কিন্তু আমি কম দেখেছি, রং না-ফর্সা না-কালো। পূর্ণবাবু কম মাইনে পেত, এখানে কোনোরকমে চালিয়ে বাড়িতে তার কিছু টাকা না পাঠালেই চলবে না— কাজেই তার পরনে ভালো জামাকাপড় একদিনও দেখিনি। পূর্ণবাবু নিজে বেঁধে খেত। একদিন তার খাবার সময় হঠাৎ গিয়ে পড়েছি—দেখি পূর্ণবাবু খাচ্চে শুধু ভাত—কোনো তরকারি, কী শাক, কী আলুভাতে—কিছু না, কেবল একতাল সবুজ পাতালতা-বাটা ওষুধের মতো দেখতে—কী একটা দ্রব্য ভাতের সঙ্গে মেখে খাচ্চে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সবুজ রঙের দ্রব্যটা কাঁচা নিমপাতাবাটা। পূর্ণবাবু একটু অপ্রতিভের সুরে বললেন, নিমপাতা-বাটা এত উপকারী, বিশেষ করে লিভারের পক্ষে। ভাত দিয়ে মেখে যদি খাওয়া যায়—আমি আজ দু-বছর ধরে আজ্ঞে দেখবেন খেয়ে, শরীর বড়ো ঠান্ডা—তা ছাড়া কী জানেন, লোভ যত বাড়াবেন ততই বাড়বে—

উপকারী দ্রব্য তো অনেকই আছে, ডাল-ঝোলের বদলে কুইনাইন মিক্সচার ভাতের সঙ্গে মেখে দু-বেলা খাওয়ার অভ্যেস করতে পারলে দেশের ম্যালেরিয়া সমস্যার একটা সুসমাধান হয়, তাও স্বীকার করি। কিন্তু জীবনে বড়ো বড়ো উপদেশগুলো চিরকাল লঙঘন করে চলে এসে এসে আজ নীতি ও স্বাস্থ্য পালন সম্বন্ধে এত বড়ো একটা সজীব আদর্শ চোখের সামনে পেয়ে খানিকক্ষণের জন্যে নির্বাক হয়ে গেলাম। আর একদিন-দু-দিন নয়, দু-বছর ধরে চলছে এ ব্যাপার।

একদিন পূর্ণবাবু নিজের জীবনের অনেক কথা বললেন। কলকাতায় তাঁদের বাড়ি, ভবানীপুরে। তাঁর একজন পিসিমা আছেন, একটু দূর সম্পর্কের। সেই পিসিমার মৃত্যুর পরে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন পূর্ণবাবু। কিন্তু পিসিমা মরি-মরি করচেন আজ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর।

পূর্ণবাবুর বিবাহ হয় বাগবাজারের সম্রান্ত বংশের মেয়ের সঙ্গে—তবে তখন তাদের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। পূর্ণবাবুদের পৈতৃক বাড়িও নেই কলকাতায়, ভবানীপুরে খুব আগে নাকি প্রকাণ্ড বাড়ি পুকুর ছিল, এখন তাদের দু-পুরুষ ভাড়াটে বাড়িতে থাকে। পূর্ণবাবুর আঠারো-উনিশ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ হয়, তিনি ছেলের জন্য শুধু যে কিছু রেখে যাননি তা নয়, ছেলেটিকে লেখাপড়াও শেখাননি। কারণ তিনিও জানতেন এবং সবাই জানত যে তার দরকার নেই, অতবড়ো সম্পত্তির যে মালিক হবে দু-দিন পরে—তার কী হবে লেখাপড়ায়?

 

ছেলেটিও জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত তাই জানত বলে লেখাপড়া শেখবার কোনো চেষ্টাও ছিল না। পূর্ণবাবুর শ্বশুরও তাই ভেবে মেয়েকে ওই গরিব ঘরে দিয়েছিলেন।

পূর্ণবাবুর বাবা তো মারা গেলেন, পূর্ণবাবুর ঘাড়ে রেখে গেলেন সংসার, নব বিবাহিতা পুত্রবধূ, অল্প কিছু দেনা। কিন্তু পূর্ণবাবুর ক্রেডিট তখন পুরোমাত্রায়—কী বাজারে কী বন্ধুবান্ধব মহলে। টাকা হাত পাতলেই পাওয়া যায়—ধারে দোকানে জিনিস পাওয়া যায়, নিত্যনতুন বন্ধু জোটে। পূর্ণবাবু খুশি, পূর্ণবাবুর তরুণী বউ খুশি, আত্মীয়-স্বজন খুশি, বন্ধুবান্ধব খুশি। কারণ সবাই জানে, বুড়ি আর ক-দিন? না–হয় মেরেকেটে আর পাঁচটা বছর!

অবশ্য পূর্ণবাবুর তখন বয়স অনেক কম, সংসারের কিছুই বোঝেন না, জানেন না—মনে উৎসাহ, আশা অদম্য, আনন্দের উৎস—চোখের সামনে দীপ্ত রঙিন ভবিষ্যৎ—যে ভবিষ্যতের সম্বন্ধে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, আশঙ্কা নেই, যা একদিন হাতের মুঠোয় ধরা দেবেই—এ অবস্থায় যে যা বুঝিয়েচে পূর্ণবাবু তাই-ই বুঝেছেন, টাকাকড়ি ধার করে দু-হাতে উড়িয়েছেন, বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যও করেচেন, ধারে যতদিন এবং যতটা নবাবি করা চলে, বাকি রাখেননি।

কিন্তু ক্রমে বছর যেতে লাগল, দু-তিন বছর পরে আর ধার মেলে না— সকলেই হাত গুটিয়ে ফেললে। পাওনাদারের যাতায়াত শুরু হল এইজন্যে আরও বিশেষ করে পূর্ণবাবু বাজারে ক্রেডিট হারিয়ে ফেললেন যে, সবাই দেখলে পূর্ণবাবুর পিসিমা ওঁদের আদৌ বাড়িতে ডাকেন না, পূর্ণবাবুকেও না, পূর্ণবাবুর বউ ছেলে-মেয়ে কাউকে না।

পিসিমার কাছে খাতির পেলে বাজারেও পূর্ণবাবুর খাতির থাকত—অনেকে বলতে লাগল পূর্ণবাবুর পিসিমা ওদের দেখতে পারে না, সমস্ত সম্পত্তি হয়তো দেবোত্তর করে দিয়ে যাবে—একটি পয়সাও দেবে না ওদের।

পূর্ণবাবুর পিসিমার বিশ্বাস যে এরা তাঁকে বিষ খাইয়ে মারবে—যত বয়স হচ্ছে এ বিশ্বাস আরও দিন দিন বাড়ছে—এতে করে হয়েছে এই যে পূর্ণবাবুর, কী পূর্ণবাবুর স্ত্রীর, কী পূর্ণবাবুর ছেলে-মেয়ের পিসিমার বাড়ির ত্রি-সীমানায় ঘেঁষবার জো নেই। কাজেই অতবড়ো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েও পূর্ণবাবু আজ ত্রিশ টাকা মাইনের আমিনগিরি করচেন।

আমি পূর্ণবাবুর এ গল্প বিশ্বাস করিনি। কিন্তু সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে আমরা একসঙ্গে দেড় বছরের উপর ছিলাম—এই দেড় বছরের প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় কী রাত্রে একসঙ্গে বসবার সুযোগ হলেই পূর্ণবাবু আমায় তাঁর পিসিমার সম্পত্তির গল্প করতেন। কখন কোনটা হয়তো বলে ফেলেচেন ছ-মাস আগে তাঁর মনে থাকবার কথা নয়, আবার আজ যখন নতুন কথা বলচেন ভেবে বললেন তখন খুঁটিনাটি ঘটনাগুলোও ছ-মাস আগের কাহিনির সঙ্গে মিলে যেত—নানা টুকরো কথার জোড়াতালি মিলিয়ে এই দেড় বছরে পূর্ণবাবুর সমস্ত গল্পটা আমি জেনেছিলুম—একদিন তিনি বসে আগাগোড়া গল্প আমায় করেননি, সে ধরনের গল্প করার ক্ষমতাও ছিল না পূর্ণবাবুর।

সেই থেকে পূর্ণবাবুর দুর্দশার সূত্রপাত হল। বন্ধুবান্ধব ছেড়ে গেল, শ্বশুরবাড়িতে খাতির কমে গেল, সংসারে দারিদ্রের ছায়া পড়ল। দু-এক জন হিতৈষী বন্ধুর পরামর্শে পূর্ণবাবু আমিনের কাজ শিখতে গেলেন—বউ-ছেলেকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।

এসব আজ ত্রিশ বছর আগেকার কথা।

এই ত্রিশ বছরে পূর্ণবাবু আমোদপ্রিয়, শৌখিনচিত্ত, অপরিণামদর্শী যুবক থেকে কন্যাদায়গ্রস্ত, রোগজীর্ণ, অকালবৃদ্ধ, দারিদ্রভারে কুজদেহ ত্রিশটাকা মাইনের আমিনে পরিণত হয়েছেন—এখন আর মনে তেজ নেই, শরীরে বল নেই, খেলে হজম করতে পারেন না, চুল অধিকাংশই পেকে গিয়েছে, কষের অনেকগুলো দাঁত পড়ে গেলেও পয়সার অভাবে বাঁধাতে পারেন না বলে গালে টোল খেয়ে যাওয়ায় বয়সের চেয়েও বুড়ো দেখায়।

বাড়ির অবস্থাও ততোধিক খারাপ। পনেরো টাকা ভাড়ার এঁদো ঘরে বাসকরার দরুণ স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সকলেই নানারকম অসুখে ভোগে—অথচ উপযুক্ত চিকিৎসা হয় না। তিনটি মেয়ের বিয়েতে পূর্ণবাবু একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছেন, অথচ মেয়ে তিনটির প্রথম দুটি ঘোর অপাত্রে পড়েছে। বড়ো জামাই বউবাজারে দরজির দোকান করে, ঘোর মাতাল, কুচরিত্র—বাড়িতে স্ত্রীকে মারপিট করে প্রায়ই, তবুও সেখানে মেয়েকে মুখগুজে পড়ে থাকতে হয়—বাপেরবাড়ি এলে শোবার জায়গাই দেওয়া যায় না। মেজো জামাই মাতাল নয় বটে, কিন্তু তার একপয়সা রোজগারের ক্ষমতা নেই—রেলে সামান্য কী চাকুরি করে, সে-সংসারে সবাই একবেলা খেয়ে থাকে, তাই নাকি অনেক দিন থেকে নিয়ম। আর একবেলা সকলে মুড়ি খায়। মেজো মেয়ের দুঃখ পূর্ণবাবু দেখতে পারেন না বলে মাঝে মাঝে তাকে বাড়িতে আনিয়ে রাখেন; সেখানে এলে তবু মেয়েটা খেতে পায় পেট পুরে দু-বেলা। আজকাল প্রায়ই জ্বরে ভোগে, শরীরও খারাপ হয়ে গিয়েছে, ডাক্তারে আশঙ্কা করচে থাইসিস। বুড়ি পিসিমা কিন্তু এখনো বেঁচে। এখনও বুড়ি গঙ্গাস্নানে যায়, নিজের হাতে বেঁধে খায়। বয়স নব্বই-এর কাছাকাছি, কিন্তু এখনও চোখের তেজ বেশ, দাঁত পড়েনি। বুড়ি একেবারে অশ্বামার পরমায়ু নিয়ে জন্মেছে, এদিকে যারা তার মরণের পানে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, তাদের জীবন ভাঁটিয়ে শেষ হতে চলল।

সেটেলমেন্টের কাজ ছেড়ে পাটনা থেকে চলে এলাম। পূর্ণবাবু তখনও সেখানে আমিন। বছরতিনেক পরে একদিন গয়া স্টেশনে পূর্ণবাবুর সঙ্গে দেখা। দুপুরের পর এক্সপ্রেস আসবার সময় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করচি, একটু পরেই ট্রেনটা এসে দাঁড়াল। পূর্ণবাবু নামলেন একটা সেকেন্ড ক্লাস কামরা থেকে, অন্য কামরা থেকে দুজন দারোয়ান নেমে এসে জিনিসপত্রের তদারকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। পূর্ণবাবুর পরনে দামি কাঁচি ধুতি, গায়ে সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি, তার ওপরে জমকালো পাড় ও কল্কাদার শাল, পায়ে প্যারিস গার্টার আটা সিল্কের মোজা ও পাম্পশু, চোখে সোনার চশমা, হাতে সোনার ব্যান্ডওয়ালা হাতঘড়ি।

আমি গিয়ে আলাপ করলাম। পূর্ণবাবু আমায় চিনতে পেরে বললেন—এই যে রামরতনবাবু, ভালো আছেন? তারপর, এখন কোথায়?

আমি বললাম—আমি এখানে চেঞ্জে এসেচি মাসতিনেক, আপনি এদিকে— ইয়ে—

তাঁর অদ্ভুত বেশভূষার দিকে চেয়ে আমি কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। পূর্ণবাবুকে এ বেশে দেখতে আমি অভ্যস্ত নই, আমার কাছে সুতির ময়লা-চিট সোয়েটার ও সবুজ আলোয়ান গায়ে পূর্ণবাবু বেশি বাস্তব, তা ছাড়া চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন বছরের বৃদ্ধের এ কী বেশ!

কী ব্যাপারটা ঘটেছে তা অবশ্য পূর্ণবাবু বলবার আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

জিনিসপত্র গুছিয়ে পূর্ণবাবু ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন; তিনি সাউথ বিহার লাইনের গাড়িতে যাবেন। গাড়ির এখনও ঘণ্টা-দুই দেরি। একজন দারোয়ানকে ডেকে বললেন—ভূপাল সিং, এখানে ভালো সিগারেট পাওয়া যায় কিনা দেখে এসো— নইলে কাঁচি নিয়ে এসো এক বাক্স

আমায় বললেন—ওঃ, অনেক দিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা। আর বলেন কেন, বিষয় থাকলেই হাঙ্গামা আছে। সামনে আসচে জানুয়ারি কিস্তি—তহশিলদার বেটা এখনও একপয়সা পাঠায়নি, লিখেচে এবার নাকি কলাই ফসল সুবিধে হয়নি। তাই নিজে যাচ্ছি মহালে, মাসখানেক থাকব। গাড়িটা এখানে আসে ক-টায়? ভালো কথা, এখানে টাইমটেবল কিনতে পাওয়া যাবে? কিনতে ভুল হয়ে গেল হাওড়ায়—

আমি জিজ্ঞেস করলাম—আপনার পিসিমা?

দারোয়ান সিগারেট নিয়ে এল। পূর্ণবাবু একটা সরু ও সুদীর্ঘ হোল্ডার বার করলেন, আমার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, আসুন।

তারপর সিগারেট ধরিয়ে আরামে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন—পিসিমা মারা গিয়েচেন আর-বছর কার্তিক মাসে। তারপর থেকেই বিষয়-আশয়ের ঝাটে পড়েচি—নিজে না-দেখলে কি জমিদারি টেকে? আর এই বয়সে ছুটোছুটি করে পারিনে, একটা ভালো কাজ-জানা লোকের সন্ধান দিতে পারেন রামরতনবাবু? টাকা-চল্লিশ মাইনে দেব, খাবে থাকবে—

ওয়েটিং রুমে বসে পূর্ণবাবু দু-বোতল লেমনেড খেলেন এই শীতকালে। একবার দারোয়ানকে দিয়ে গরম জিলিপি আনালেন দোকান থেকে, একবার নিমকি বিস্কুট আনালেন। আর একবার নিজে স্টেশনের বাইরের দোকান থেকে এক ডজন কমলালেবু কিনে আনলেন। আমায় প্রতিবারেই খাওয়ানোর জন্য পীড়াপীড়ি করলেন, কিন্তু আমার শরীর খারাপ, খেতে একেবারেই পারিনে, সে-কথা জানিয়ে ক্ষমা চাইলাম। একটু পরেই পূর্ণবাবুর ট্রেন এসে পড়ল।

দিন পনেরো-কুড়ি পরে আবার বেড়াতে গিয়েচি স্টেশনে। সেদিন খুব শীত পড়েছে, বেশ জ্যোৎস্না, রাত আটটার কম নয়। স্টেশনের রাস্তা যেখানে ঠেকেছে সেখানে চপকাটলেট চায়ের দোকান থেকে কে আমার নাম ধরে ডাকলেও রামরতনবাবু—এই যে—এদিকে—ফিরে চেয়ে দেখি পূর্ণবাবু একটা কোণে টেবিলে বসে। পূর্ণবাবুর মাথায় একটা পশমের কানঢাকাঃটুপি, শালের কম্ভার গলায় জড়ানো, হাতে দস্তানা। আমায় বললেন—আসুন, বসুন—কিছু খাওয়া যাক। আজ ফিরে এলাম মহাল থেকে—এই রাতের গাড়িতে ফিরব কলকাতায়— কিছু খাবেন না?…না, না, খেতেই হবে কিন্তু, সেদিন তো কিছু খেলেন না—এই বয়, ইধার আও—

আমাকে জোর করে পূর্ণবাবু চেয়ারে বসালেন। তারপর তাঁর নিজের জন্যে যা খাবার নিলে, তা দেখে আমার তো হৃৎকম্প উপস্থিত হল। এত খাবেন কী করে পূর্ণবাবু এই বয়সে? আর একটা অতিবাজে দোকানে খানআষ্টেক চপ, খানচারেক কাটলেট, এক প্লেট মাংস, পাঁউরুটি, ডিমের মামলেট, পুডিং, কেক, চা—তিনি কিছু বাদ দিলেন না। আমাকে দেখিয়ে বললেন—এই, বাবুকো ওয়াস্তে এক প্লেট মাটন আউর তিন পিস—

আমি সবিনয়ে বললাম—আমার শরীর তো জানেন পূর্ণবাবু, ওসব কিছু আমি–

–আরে, তা হোক, শরীর শরীর করলে কী চলে! খান খান—মাংসটা বেশ করেছে—কলকাতায় মাংস রাঁধতে জানে না মশাই রেস্টোরেন্ট—আমি ঝাল পছন্দ করি, কলকাতায় শুধু মিষ্টি খেয়ে দেখুন মাংসটা–কাটলেটেও এরা কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়েচে-ভারি চমৎকার খেতে—এই বয়…আউর দুটো কাটলেট–

কথাটা শেষ হবার আগেই তাঁর বেজায় কাশির বেগ হল—কাশতে কাশতে দম আটকে যায় আর কী!

একটু সামলে বললেন—বড্ড ঠান্ডা লেগেছে মহালে—সেইজন্যে বেশ একটু গরম চা–চপ খেয়ে দেখবেন? ভারি চমৎকার চপ করেছে! এই বয়,–

আমি কথাটা মুখ ফুটে বললাম—পূর্ণবাবু, আপনার শরীরে এসব খাওয়া উচিত নয়—আর এ ধরনের দোকান তো খুব ভালো নয়! চা বরং এক কাপ খান, কিন্তু এত—এগুলো খেলে—

পূর্ণবাবু হেসে উড়িয়ে দিলেন—খাব না বলেন কী রামরতনবাবু, খাবার জন্যেই সব। শরীরকে ভয় করলেই ভয়, ওসব ভাবলে কী আর—আপনিও যেমন।

রেস্টোরেন্ট থেকে বার হয়ে এসে আমায় নীচু স্বরে বললেন—কিছু মনে করবেন না রামরতনবাবু, একসঙ্গে অনেকদিন কাজ করেছি এক জায়গায়, এখানে কোনো ভালো বাইজির বাড়ি-টাড়ি জানা আছে? থাকে তো চলুন না, আজ রাতটা —শুনেছি পশ্চিমে নাকি ভালো ভালো—কলকাতায় না-হয় আজ না-ই গেলাম–

আমি বুঝিয়ে বললাম, পশ্চিমের যেসব জায়গায় ভালো বাইজি থাকে, গয়া সে তালিকায় পড়ে না। বিহারের কোথাও নয়। কাশি, লক্ষৌ, দিল্লি ওদিকেই সত্যিকার বাইজি বলতে যা বোঝায় তা আছে।

পূর্ণবাবু বললেন—পাটনাতে নেই?

—আমার তাই মনে হয়।

—এদিকে আর কোথাও নেই? না-হয় এমনি আর কোথাও—

কোথাও কিছু নেই। আমি ঠিক জানি।

পূর্ণবাবু ওয়েটিংরুমে ঢুকে আমায় বসতে বললেন। পূর্ণবাবুকে আরও বেশি বৃদ্ধ দেখাচ্ছিল। আমি তাঁর বাড়িতে কে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলাম। থাইসিসের রোগী সেই মেয়েটিকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করাচ্ছেন, বড়ো ছেলেটি বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েচে আজ বছর দুই—সম্পত্তি পাবার আগেই। কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তার খোঁজ করেছেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত এসব গল্প শুনলাম বসে বসে। পূর্ণবাবু গল্পের মধ্যে আরও দু-বার চা আনিয়ে খেলেন, ব্যাগ খুলে ওষুধ খেলেন তিন-চার রকম, কোনোটা কবিরাজি, কোনোটা বিলেতি পেটের ওষুধ। দু-প্যাকেট সিগারেট শেষ করলেন।

দেখলাম পূর্ণবাবু চিরবঞ্চিত জীবনের সর্বগ্রাসী তৃষ্ণার ভোগলালসা মেটাতে উদ্যত হয়েচেন বিকারের রোগীর মতো। চারিধারে ঘনায়মান মৃত্যুর ছায়ার মধ্যে স্বল্পতৈল জীবনদীপের আলো যত সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর জ্যোতি :বৃত্তের সৃষ্টি করেচে, উনি ততই উন্মাদ আগ্রহে যেখানে যা পাবার আছে পেতে চান—যা নেবার আছে নিতে চান। জীবনে ওঁর যখন সুবৃষ্টি এল, জল না-পেয়ে তখন তা আধ-মরা। সেই এল—কিন্তু এত দেরি করে ফেললে!

* * * *

আমায় বললেন—একটু কিছু বাড়াবাড়ি খেলেই, ওষুধ খেয়ে রাখি। আর হজম করতে পারি-নে এখন। আমাদের পাড়ায় আছে গদাধর কবরেজ…খুব ভালো চিকিচ্ছে করে, একহপ্তার ওষুধ নেয় দু-টাকা—তারই কাছে ভাবছি এবার। পূর্ণবাবুর সেই নিমপাতাবাটা মেখে ভাত খাওয়ার কথা আমার মনে পড়ল, আরও মনে পড়ল পূর্ণবাবুর প্রথম জীবনের শৌখিনতার কথা। এখন তিনি বুঝেছেন আর বেশি দিন বাঁচবেন না, চিরবঞ্চিত জীবনের সর্বগ্রাসী তৃষ্ণার ভোগলালসা তাঁর বিকারের রোগীর মতো অসংযত, অবুঝ।

শান্তিরামকে গল্পটা বলব ভেবেছিলাম, কিন্তু সে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্চে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *