রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

উইলিয়াম জোন্স (১৭৪৬–১৭৯৪) – এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা

উইলিয়াম জোন্স (১৭৪৬–১৭৯৪) – এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা

এশিয়াটিক সোসাইটর প্রতিষ্ঠাতা এবং অষ্টাদশ শতকের সবচাইতে বিদ্বান ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ স্যার উইলিয়াম জোন্স। তিনি প্রায় ৩০টির মতো ভাষা জানতেন। এর মধ্যে ইংরেজি, ল্যাটিন, গ্রিক, ইতালীয়, হিব্রু, ফারসি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, আরবি, তুর্কি, রুশ, সিরিয়াক, এথিওপিক, কপাটিক, ওয়েলস, সুইডিশ, ডাচ, সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি, তিব্বতি, পালি, পহলবি, জাপানি ও চীনা প্রভৃতি ভাষায় তিনি লিখতে-পড়তে, এমনকি সাহিত্যও রচনা করতে পারতেন। উইলিয়াম জোন্সের ভাষাজ্ঞান ছিল কিংবদন্তির মতো।

এই মহান কিংবদন্তি-পুরুষের জীবনকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। মাত্র আটচল্লিশ বছরের জীবন ছিল তাঁর। জন্ম ১৭৪৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে এবং মৃত্যু ১৭৯৪ সালের ২৭ এপ্রিল কলকাতায়।

কিন্তু এই স্বল্প জীবনকালেই তিনি অর্জন করেছিলেন বিরাট সাফল্য। বিশ্বের চোখে তিনি ছিলেন প্রতিভার এক মূর্তিমান বিস্ময়। বাল্যকাল থেকেই তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটতে থাকে। ক্লাসে প্রায় সব বিষয়ে তিনি তাঁর সহপাঠীদের চাইতে বরাবর এগিয়ে থাকতেন। ছোটবেলায় মা বলেছিলেন, পড়ো, তা হলেই সব জানতে পারবে। আর সেই থেকেই জোন্সের শুরু হয় পড়া আর জানার আগ্রহ। তাঁর প্রতিভা কেমন বিস্ময়কর ছিল, তার একটা উদাহরণ দিই। মাত্র তের বছর বয়সে একটি আস্ত বই একবার পড়েই তিনি তা লিখে ফেলতে পারতেন। একবার তাঁর স্কুলের ছেলেরা শেপিয়ারের ‘টেম্পেস্ট’ নাটক অভিনয় করবে বলে ঠিক করল। কিন্তু নাটকটি পাওয়া যাচ্ছিল না। তা হলে উপায়?

উপায় বের করলেন জোন্স নিজেই। তিনি বেশ কয়েকদিন আগে নাটকটি একবার পড়েছিলেন। পড়াশোনার সেই স্মৃতির ওপর নির্ভর করেই তিনি আস্ত নাটকটি আবার লিখে দিলেন। তারপর সে-নাটক মঞ্চস্থও হলো। এমনই অসাধারণ ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি।

১৭৬৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করে অক্সফোর্ডে ভর্তি হন জোন্স। কয়েকদিনের মধ্যেই এখানকার শিক্ষকরাও বুঝলেন, এ এক অসাধারণ প্রতিভাধর ছেলে। তার ফলে জোন্সের দৈনিক হাজিরা মাফ হয়ে গেল। তাঁর আর প্রতিদিন ক্লাসে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা রইল না। পড়া শেখার জন্য তাঁকে দৈনিক ক্লাসে না এলেও চলবে।

অক্সফোর্ডে থাকতেই তিনি শিখলেন আরবি ভাষা। ১৭৬৮ সালে কাউন্ট চার্লস রেভিস্কির সংস্পর্শে এসে ভালোভাবে শিখলেন ফরাসি। এই সময়ই তিনি ডেনমার্কের রাজা সপ্তম ক্রিশ্চিয়ান-এর অনুরোধে মির্জা মেহেদির নাদির শাহের ইতিহাস ‘তারিখ-ই-

নাদিরি’ অনুবাদ করে দিলেন ভাষায়। এই অনুবাদ পড়ে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই সবিস্ময়ে বলেছিলেন, এ ছেলে তো ফরাসি ভাষা আমার চেয়েও ভালো জানে দেখছি!

১৭৬৮ সালে গ্র্যাজুয়েট হলেন জোন্স। তারপর শুরু তাঁর হলো ব্যারিস্টারি পড়া। ১৭৭১ থেকে ১৭৭৪ সালের মধ্যে ছাপা হলো তাঁর ফরাসি ব্যাকরণ এবং কবিতাগুচ্ছ। নানা ভাষার কবিতার অনুবাদ। তারপর বেরুল কবি হাফিজের কবিতার অনুবাদ—‘এ পার্সিয়ান সং অব হাফিজ’। জোন্সের ফরাসি ব্যাকরণ বইটি খুব আলোড়ন সৃষ্টি করল। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বরাতে জুটে গেল তিন তিনটি পদবি—ফরাসি জোন্স, ভাষাবিদ জোন্স এবং ওরিয়েন্টাল জোন্স। ১৭৭২ সালের ৩০ এপ্রিল মাত্র ২৬ বৎসর বয়সে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো (এফ. আর. এস.) মনোনীত হন। ১৭৭৩ সালে মনোনীত হন ড. জনসন ক্লাবের সদস্য এবং সেই বছরই তিনি জুন মাসে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৭৭৪ সালে তিনি যোগদান করেন বারে।

১৭৭৬ সালে তিনি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর গ্রিক আইনজীবী ইসেউস-এর দশটি ভাষণ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এই ভাষণগুলি থেকে তিনি গ্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখান।

১৭৮৩ সালে জোন্স আসেন ভারতবর্ষের তখনকার রাজধানী কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের জজ হয়ে। এখানে পাঠানোর আগে তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। ১৭৮৩ সালে স্ত্রী অ্যানা মারিয়াকে নিয়ে তিনি চলে আসেন তাঁর নতুন কর্মস্থল কলকাতায়।

এবার তাঁর প্রতিভা মোড় নিতে শুরু করে অন্যদিকে। তিনি ঝুঁকে পড়ে প্রাচ্যের সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি। তিনি ভারতে এসে সন্ধান পেলেন সংস্কৃত সাহিত্যের রত্নখনির। এই অমূল্য সম্পদ নিয়ে গভীর গবেষণা চালাবার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন কিন্তু এ কাজ তো তাঁর একার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়!

আর তখনই তাঁর মাথায় এলো এক নতুন চিন্তা। আচ্ছা, লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির মতো এখানেও এমন একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করলে কেমন হয়? ভাবনা মতো শুরু হলো কাজ। ১৭৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে ডাকা হলো তাঁর চেনাজানা সহকর্মীদের। পৃষ্ঠপোষক হলেন গভর্নর নিজে। আর সর্বসম্মতিক্রমে সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হলেন উইলিয়াম জোন্স। আর এইভাবে গঠিত হলো ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’ ( Asitic Society of Bengal)।

এবার তিনি সংস্কৃত ভাষা শেখার দিকে মন দিলেন। কারণ সংস্কৃত ভাষা না শিখলে এই ভাষার রত্নভাণ্ডারের সন্ধান করবেন কেমন করে?

তিনি বেনারসে এসে খোঁজ পেলেন বৈদিক ঋষি মনুর মানব ধর্মশাস্ত্রের। শুরু করলেন অধ্যয়ন। নিরিবিলিতে গবেষণার কাজ চালানোর জন্য তিনি কৃষ্ণনগরে একটি বাড়িও নিলেন। তারপর সংস্কৃত সাহিত্যের ওপর গবেষণাকাজে তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য নবদ্বীপের কয়েকজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নিয়োগ করলেন তিনি এবং প্রতিজ্ঞা করলেন, সারা জীবন রুগ্‌ণ হয়ে থাকতে হয় থাকব, তবু সংস্কৃত সাহিত্যের খনি আমি খুঁড়বই। তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এখানে ভাষার এমন ব্যাখা বিশ্লেষণ, নিয়ম-নির্দেশ করা হয়েছে, যা গ্রিক, ল্যাটিন, আরবি, ফারসি কোনো ভাষারই এ ধরনের ব্যাকরণে নেই। সংস্কৃতের সাথে তিনি মিল খুঁজে পেলেন গ্রিক, ল্যাটিন, কেলটিক, জার্মান ও ফারসির সাথে। শুধু মূল শব্দ আর ধাতুতে নয়, ব্যাকরণেও এই মিল খুঁজে পেলেন। আর এমনি করেই তিনি আবিষ্কার করলেন ভাষার এক মূল্যবান তথ্য। ভারতের সংস্কৃত ও ইউরোপের অনেক ভাষাই মূলত এক ভাষা থেকে এসেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা।

এশিয়াটিক সোসাইটির তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ১৭৮৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর গবেষণার ফলাফল। আর এইভাবে জন্ম হলো তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিজ্ঞানের।

উইলিয়াম জোন্স সারাক্ষণ মেতে রইলেন সংস্কৃত সাহিত্যের গবেষণা নিয়ে। এদেশের প্রাচীন সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান পাঠ করে তাঁর বারবার মনে হতে লাগল, হোমার, সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের সাথে প্রাচ্যজগতের অবশ্যই পরিচয় ঘটাতে হবে। তেমনি এদেশের প্রাচীন মনীষী, তথা বাল্মিকী, মনু, ব্যসদেব, পানিনি, পতঞ্জলি, কালিদাস, জয়দেব গোস্বামী, আর্যভট্ট এঁদেরকেও তুলে ধরতে হবে ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর কাছে। তিনি দেখলেন, ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ভাবধারা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ইংরেজি কবিতার একটি ধারা, যার ধারক-বাহক হলেন মুর এবং কিপলিং- এর মতো কবিরা। তিনি মহাকবি কালিদাসের নাম দিলেন ভারতের শেকসপিয়ার। সংস্কৃত সাহিত্যের অমর চরিত্র শকুন্তলার কাহিনী ম্লান করে দিল ফরাসি বিপ্লবের গল্পকে।

১৭৯৩ সালে স্ত্রী অ্যানা মারিয়া কলকাতা ছেড়ে ফিরে গেলেন বিলেতে। পরের বছর ১৭৯৪ সালে জোন্সের ‘মনুসংহিতা’র অনুবাদ প্রকাশিত হলো। তিনি দীর্ঘ আট বছর পরিশ্রম করে কুল্লুক ভট্টের ভাষ্য অবলম্বনে এই ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন।

উইলিয়াম জোন্স পরিশ্রম করতেন অবিশ্বাস্য রকমের। ফলে তাঁর শরীর ভেঙে পড়তে থাকে। ডাক্তারি পরীক্ষায় তাঁর পেটে প্রথমে টিউমার ধরা পড়ল। চিকিৎসার অবশ্য ত্রুটি হলো না। কিন্তু শেষরক্ষা করা গেল না। ১৭৯৪ সালে তিনি কলকাতাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। কিন্তু আজও তিনি বেঁচে আছেন বিশ্বের বিদ্যানুরাগীদের মনে কিংবদন্তির পুরুষ হয়ে। বেঁচে আছেন তিনি তাঁর সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক সোসাইটির কাজের মধ্য দিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *