উইন্ডচাইম

উইন্ডচাইম

সারাদিন সাইট সিয়িং-এর পর বাড়ি ফিরে ক্লান্তিতে দু-জনেরই চোখ আর খোলা থাকতে চাইছিল না৷ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ রাত দুটো নাগাদ অলকার খোঁচাখুঁচিতে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম৷ হলটা কী মেয়েটার? এইমাত্র তো ঘুমোল৷

—‘কী ব্যাপার? ঘুম আসছে না?’

—‘আমি ঘুমোইনি৷’

অলকার গলায় ক্লান্তির ছাপ৷ যেন চেষ্টা করেও ঘুম আসেনি তার৷ আমি পরের প্রশ্ন করার আগে সে নিজে থেকেই উত্তর দিল, ‘কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে, ওই উইন্ডচাইমটা…’

কটেজে এসে থেকেই উইন্ডচাইমটার শব্দ কানে আসছে আমার৷ সকালের দিকে একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম৷ তখন চোখেও পড়েছিল জিনিসটা৷ টুং টুং করে হাওয়ার দোলায় বেজে চলেছে৷ শুনতে মন্দ লাগে না৷ রাতে শুতে যাওয়ার সময়ও বারান্দা থেকে টুং টুং ভেসে আসছিল৷ ঘুমের ঘোরেও বোধহয় কানে ভাসছিল আওয়াজটা৷ খেয়াল করতে এখনও শুনতে পেলাম৷

—‘ওটা আবার কী করল? বেশ তো বাজছে৷’

—‘শুধু বাজছে না… একটু খেয়াল করো…’

অলকার বয়স ছাব্বিশ পেরিয়েছে৷ তবে এই বয়সে পৌঁছেও ছেলেমানুষির ভূত তার ঘাড় থেকে নামেনি৷ আমি শুনলাম না, তবে শোনার ভান করে বললাম, ‘কই, আলাদা কিছু তো বুঝছি না৷’

কান খাড়া করে আওয়াজটা শুনতে শুনতে আঙুল দিয়ে কিছু হিসেব করার চেষ্টা করল অলকা, ‘এলোমেলো আওয়াজ নয়, মনে হচ্ছে, একটা সুরে বাজছে৷’

—‘সুর! উইন্ডচাইম হাওয়ার ঠেলায় বাজে৷ সুর-টুর থাকে না তাতে৷’

—‘তুমি সত্যি বুঝতে পারছ না?’

অলকার মুখের দিকে দেখে একটু মায়া লাগল আমার৷ বাইরে জঙ্গলের ভিতর থেকে ঝিঁঝি আর পোকামাকড়ের ডাক ভেসে আসছে একটানা৷ থেকে থেকে একটা প্যাঁচা আর তাকে সঙ্গ দিয়ে একটা রাতচরা পাখি ডেকে উঠছে৷ তার সঙ্গে মিহি পিয়ানোর মতো বেজে চলেছে উইন্ডচাইম- টুং-টাং-টুং…

ভালো করে শুনতে একটু ধাঁধায় পড়লাম আমি৷ যে আওয়াজটা আসছে, সেটাকে সুর বলে ভেবেই নেওয়া যায়, কিন্তু তাতে মনের ভুল হওয়ার একটা বড়সড় সম্ভাবনা থেকে যায়৷ একবার সুরটা বাজার পর সেটা রিপিট হওয়ার এক বিট আগে এসেই হারিয়ে যাচ্ছে ছন্দ৷

এমনিতেই ঘুমটা জাঁকিয়ে বসেছে, অত মাথা ঘামাতে আর মন চাইল না, অলকার মাথায় একটা হাত রেখে বললাম, ‘তো সুরই যদি বাজে তো বাজুক না, সাইরেন যখন নয় তো ঘুমিয়ে পড়ো৷’

—‘কিন্তু সুর কী করে বাজবে?’ তার মুখ থেকে অসন্তাোষ যায় না৷

—‘আমার কিন্তু ভারী ঘুম পাচ্ছে৷’ আমি হাই তুললাম৷

—‘একবার গিয়ে দেখে আসবে?’ দ্বিধা কাটিয়ে বলল অলকা৷

প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু বুঝলাম, যতক্ষণ না ব্যাপারটা মিটছে, ততক্ষণ আমাকে ঘুমোতে দেবে না সে৷ বিছানা থেকে নামতে নামতে তা-ও বিরক্তিটা হিসেব করে খরচ করলাম, ‘উফ… ভীমরতি বটে!’

বেডরুমটা পেরিয়ে ছোট বসার ঘর৷ সেটার সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা৷ বারান্দায় একটা ছোট হলদে শেডের ল্যাম্প জ্বলে৷ রাতে নিবিয়ে ঘুমোতে হয়৷ বসার ঘরে সুইচবোর্ডটা খুঁজে নিয়ে আলোটা জ্বাললাম৷ তারপর বেরিয়ে এলাম বারান্দায়৷

আমাদের কটেজটা দোতলা৷ কটেজটাকে ঘিরে একটা মিটার দশেক লম্বা টেরেস করা আছে৷ সেটা যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখান থেকেই শুরু জঙ্গলের সীমানা৷ ঘন গাছের জঙ্গল৷ রাতবিরেতে সে জঙ্গলের অন্ধকারের ভিতরে চোখ পড়লেই গা-টা ছমছম করে ওঠে৷ এখন অবশ্য গোটা জঙ্গলটাই অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়েছে৷ তার ভিতর থেকে জঙ্গুলে হাওয়া ভেসে এসে বসার ঘরের পর্দা উড়িয়ে দিচ্ছে বারবার৷

আমি বারান্দার ভিতরে মন দিলাম৷ লোহার কোমরসমান উঁচু রেলিং থেকে ফুট দুয়েক উপরে দুলছে উইন্ডচাইমটা৷ একদিকের দেওয়াল থেকে বের হয়ে থাকা একটা কাঠের কঞ্চি থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া আছে৷ একই সুরে বেজে চলেছে৷ টুং-টাং-টুং…

মোট চারটে পাইপ৷ তার মাঝে একটা বড় গোল রিং৷ ভালো করে একবার দেখালাম জিনিসটাকে৷ আমাদের কলকাতার বাড়িতেও একসময় উইন্ডচাইম ছিল৷ এটা কিন্তু বেশ অন্যরকম দেখতে৷ পাইপগুলোর কয়েকটা জায়গা তোবড়ানো৷ সুতোগুলোও পলকা৷ মাঝের রিংটাও কেমন নোংরাটে৷ এমন সুন্দর কটেজে কি শেষে কারও ফেলে-দেওয়া জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে?

কঞ্চি থেকে খুলে নিলাম চাইমটা৷ বারান্দার এককোণে একটা জঞ্জাল ফেলার বাক্স রাখা ছিল৷ আমরা এসে থেকে ব্যবহার করিনি৷ তার ভিতরে সেটা ফেলে রেখে ভিতরদিকে পা বাড়ালাম৷

ফিরে আসতেই যাচ্ছিলাম৷ এমন সময় জঙ্গলের দিক থেকে একটা শব্দ শুনে ঘুরে তাকালাম৷ ঠিক কী যে দেখলাম, নিজেই বুঝতে পারলাম না৷ একটা ছায়া কি? মনে হল, আকাশছোঁয়া গাছগুলোর ফাঁক থেকে একটা দানবিক ছায়া যেন জঙ্গলের ভিতরের দিকে সরে গেল৷ খেয়াল করলাম, আমার অজান্তেই পোকামাকড়ের ডাক কখন যেন থেমে গেছে৷ তার বদলে হালকা বাঁশির সুর ভেসে আসছে দূর থেকে৷ গ্রামের দিক থেকে নয়, জঙ্গলের প্রান্ত থেকে৷ কিন্তু তা কী করে হবে?

নাঃ, হয়তো হাওয়ার শব্দ, কিংবা কোনও জঙ্গুলে প্রাণীর ডাক৷ যা-ই হোক-না কেন, তাতে অলকার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না৷ ফলে আমারও আরামের ঘুম হবে৷ আলোটা নিবিয়ে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম৷

কিন্তু ঘুম ঠিকঠাক হল না৷ সারাক্ষণ মনে হতে লাগল, বারান্দার দিক থেকে কে যেন ডেকে চলেছে আমাকে৷ সেই বাঁশির সুরটা বেড়ে উঠছে৷ বাঁশি বাজাতে বাজাতে জঙ্গলের ভিতর থেকে এগিয়ে আসছে সেই বাঁশিওয়ালা…

(দুই)

—‘এই জঙ্গলের ধারের কটেজে রাত কাটানো কিন্তু একটা এক্সপিরিয়েন্স৷’ অলকা টোস্টে কামড় বসাতে বসাতে বলল৷

আমাদের উলটোদিকেই গীতেশবাবু বসে ছিলেন৷ ভদ্রলোকের বেশ বড়সড় চেহারা, বাজখাঁই গলার আওয়াজ৷ এই কটেজটা নাকি তাঁর নিজেরই তৈরি৷ জঙ্গলের ধারে প্রকৃতির কোলে এমন আরামে থাকার একটা জায়গা তৈরি করে বেশ পয়সা কামাচ্ছেন তা এসে থেকেই বুঝছি৷ জঙ্গলের লাগোয়া গ্রামেই নাকি নিজের বাড়ি আছে তাঁর৷ মাঝে মাঝে এখানে এসে খবর নিয়ে যান৷ আমরা বাঙালি বলে কটেজের ভাড়ায় নাকি বড়সড় ডিসকাউন্ট রেখেছেন, তবে সেটা ধাপ্পাবাজি৷ তিন দিনে সাড়ে পনেরো হাজার টাকা গছিয়ে নিয়েছেন৷

লক্ষ করেছি, কথা বলতে বলতে কেবলই হাতের তালু দিয়ে টেবিলের উপরে তাল ঠোকেন ভদ্রলোক৷ অলকার কথা শুনে একগাল হেসে বললেন, ‘প্রথম রাত যখন, ঘুম-টুম ঠিক করে হয়নি, তা-ই তো?’

—‘আপনি কেমন করে জানলেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷

—‘সবারই তাই হয়৷ আসলে আপনারা কলকাতায় থাকেন, রাতে জন্তু-জানোয়ারের ডাক শুনে ঘুমোতে যাওয়ার অভ্যাস নেই তো…’

—‘এখানে কোনও ভয়ানক জানোয়ার টানোয়ার আছে?’ আমি জলের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড় জাতের?’

—‘বড় বলতে? হাতি-টাতি নেই, শিয়াল আছে বটে তবে তারা তেমন ভয়ংকর নয়৷ মানুষ দেখলে এড়িয়েই চলে৷’

আমার কাল রাতে জঙ্গলের মধ্যে দেখা সেই ছায়াটার কথা মনে পড়ে গেল৷ সেটা মন থেকে সরাতে মুখ তুলে প্রশ্ন করলাম, ‘ঘুম না-হওয়াটা বড় কথা নয়, কিন্তু এই কটেজ নিয়ে অন্য একটা অভিযোগ আছে আমার৷’

—‘সে কী! কী বলুন তো?’

—‘এত সুন্দর করে সাজিয়েছেন কটেজটা কিন্তু কুড়িয়ে-পাওয়া একটা উইন্ডচাইম ঝুলিয়েছেন বারান্দায়?’

গীতেশবাবুর ভুরু দুটো একবারের জন্য কুঁচকে গেল, পরমুহূর্তেই সশব্দে হেসে উঠলেন তিনি—‘ওঃ ওটা৷ আরে না মশাই, ওটা কুড়িয়ে পাওয়া নয়, বলতে পারেন ওটাই এখানকার আদি বাসিন্দা, বাকি কটেজের সব কিছুই পরে এসেছে৷ তাছাড়া ওটা না-ফেলার অন্য একটা কারণ আছে৷’

—‘কীরকম কারণ?’ অলকার মুখ একটা চাপা কৌতূহল লক্ষ করলাম৷ গীতেশবাবু একবার হাতঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘এই কটেজগুলো তৈরি হয়েছে ধরুন বছর পাঁচেক আগে, তার আগে এখানে একটা ছোট কুটির ছিল, তাতে কাসিমা নামে এক কিম্ভূত মহিলা থাকত৷ তিনি দেহ রাখতে কটেজটা বানানো হয়৷’

—‘কাসিমা! সেটা কে আবার?’

—‘ওই যে বললাম কিম্ভূত মহিলা৷ স্থানীয় গুজব, সে নাকি কুটিরের ভিতর নিজেকে বন্দি করে উইচক্র্যাফট-তন্ত্রমন্ত্র এইসব করত৷’

—‘আরে বাঃ! গথিক ব্যাপার-স্যাপার৷ এইটারই অভাব ছিল এসে থেকে৷’ আমি হাসতে হাসতে বললাম৷

গীতেশবাবু দেখলাম আমার হাসিতে খুব একটা বিচলিত হলেন না, আগের মতোই বলতে থাকলেন, ‘জঙ্গলের এই ধারটায় স্থানীয় লোকজন খুব একটা আসতে চায় না৷ এলাকাটা খুব একটা উন্নত হয়নি বলে ট্যুরিস্টও খুব একটা আসত না৷ শোনা যায়, কাসিমা যখন ছোট ছিল তখন ডাইনি অপবাদ দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে৷ তারপর থেকে সে এই জঙ্গলের ধারে বাসা বাঁধে৷ কারও সাতে-পাঁচে থাকত না, ছেলেপুলে দেখলে তাড়া করত না৷ জঙ্গল আলাদা কোনও গ্রামের আওতায়ও পড়ে না৷ ফলে তাকে তাড়ানোরও ইচ্ছা ছিল না কারও৷ মনের সুখে তন্ত্রমন্ত্র করত সে৷’

‘উইন্ডচাইমটা তাহলে তারই, তা-ই না?’ অলকা জিজ্ঞেস করল৷

‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ পাঁচ বছর আগে শীতের এক সন্ধ্যায় গ্রামের কিছু বাচ্চা ছেলে সাহস করে জঙ্গলের ভিতরে উকিঝুঁকি দিতে এসে কাসিমার কুঁড়ে ঘরটা দেখতে পায়৷ সেই সঙ্গে বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে আসে৷ তারাই ছুটে গ্রামে এসে খবর দেয়, ডাইনি তার ঘরের একেবারে মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে মরে পড়ে আছে৷ আমরাই এসে তার সৎকারের বন্দোবস্ত করি৷ কুটিরটাও ভেঙে ফেলা হয়৷ সেখান থেকেই কেউ তুলে নিয়ে যায় উইন্ডচাইমটা৷’ একটু থেমে দম নিয়ে গীতেশবাবু বলেন, ‘আপনারা চাইলে ওটা সরিয়ে নেব আমরা৷ আসলে জঙ্গলের ধারের এই জায়গাটা কাসিমার, এতগুলো বছর এখানে সে ছাড়া আর কেউ থাকত না৷ ফলে শেষ একটা চিহ্ন ঝুলিয়ে রাখা আর কী… বাকি সবই তো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে৷ তা ছাড়া লোকে বলে, উইন্ডচাইম নাকি খারাপ শক্তিকে দূরে রাখে… তাই আর কী…’

—‘আচ্ছা, এই কাসিমা কি সত্যিই ডাইনি ছিলেন?’

গীতেশবাবু কিছু বলার আগেই আমি বলে উঠলাম, ‘হ্যাঁ, একেবারে৷ ঝাঁটায় করে হাওয়া খেতে বের হত আর কেউ দুষ্টুমি করলেই ধুলো ছিটিয়ে কালো বিড়াল বানিয়ে দিত৷ তোমারও চিন্তাভাবনা বলিহারি৷’

—‘ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন মহিলা৷’

—‘বাঁশি!’ আমার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল৷ চমকে উঠলাম৷ ‘হ্যাঁ, মাঝে মাঝে গভীর রাতের দিকে গ্রামের কেউ কেউ শুনতে পেত সে বাঁশির আওয়াজ৷ আমিও শুনেছিলাম একবার৷’

একবার ভাবলাম কাল রাতের ঘটনাটা খুলে বলি, পরক্ষণেই মনে হল এমনিতেই এখানে এসে থেকে অলকার মাথার পোকাগুলো নড়ে উঠেছে৷ এসব কানে গেলে আর রক্ষা থাকবে না৷

—‘ভাবছি, বেলা করে একবার জঙ্গলটা দেখে আসব৷’

—‘হ্যাঁ আসুন-না, এ জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই৷ চারদিকেই রাস্তা আছে৷ উলটোমুখে সোজা হাঁটতে থাকলেই বেরিয়ে আসবেন৷’

—‘আপনিও চলুন-না৷’ অলকা টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল৷

গীতেশবাবু ঘাড় নাড়লেন, ‘আমার আবার গ্রামের দিকে কিছু কাজ আছে, বরঞ্চ মুকুন্দকে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ শিক্ষিত ছেলে, জঙ্গলটাও ভালো চেনে, আপনাদের সমস্ত দেখিয়ে ফিরিয়ে আনবে৷’

গীতেশবাবু বিদায় নিতে আমরা কটেজের ভিতরে ঢুকে জামাকাপড় পালটে নিলাম৷ সকালে উঠে থেকেই মেজাজটা বেশ ফুরফুরে আছে আমার৷ এখানে বাতাসে গাড়ির ধোঁয়া নেই৷ মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক নেই৷ আছে শুধু নাম-না-জানা পাখির ডাক আর আদিম বৃক্ষের পাতা ছুঁয়ে ভেসে-আসা এলোমেলো হাওয়ার শব্দ৷ বাইরেটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে একবার তাকালেই চোখ ভরে যায়৷ আজ থেকে লক্ষ বছর আগে যখন মানুষের খবরদারি শুরু হয়নি তখন হয়তো গোটা পৃথিবী জুড়ে এমনই বৃক্ষের সার আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকত শতাব্দীর পর শতাব্দী৷ পাতার নড়াচড়া ছাড়া আর কোনও প্রাণীর আসা যাওয়া ছিল না তখন, কিংবা ছিল হয়তো, আমরাই জানি না৷

মুকুন্দ বলে ছেলেটা আমরা কটেজ থেকে বেরোনোর আগেই এসে হাজির হয়েছে৷ দু-একটা কথাবার্তা বলে বুঝলাম, গীতেশবাবু তাকে আগে থেকে তালিম দিয়েই পাঠিয়েছেন৷ তালিমে সবার আগে বুঝিয়েছেন যে আমাদের থেকে কোনওভাবেই যেন বকশিশ না চেয়ে বসে৷ অলকা দেখলাম, খুশিই হয়েছে তাকে পেয়ে৷

কটেজের সামনের দিকে আধ কিলোমিটার হাঁটলে গ্রাম৷ পিছনদিকে কিছুটা গেলেই জঙ্গলের সীমারেখা৷ আমরা যখন সেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছাড়িয়েছে৷ গীতেশবাবু আগে থেকেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন দিনের আলো থাকতে জঙ্গল যতটা নিরাপদ, রাত নামলে ততটাই ভয়ংকর৷ এখন শীতকাল নয়, ফলে সাপের উপদ্রবের আশঙ্কা প্রবল৷ অন্ধকারে সাপের গায়ে পা পড়ে গেলে একটা কাণ্ড ঘটবে৷

জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে মুকুন্দ আমাদের থেকে হাত পাঁচেক এগিয়ে হাঁটতে লাগল৷ তার হাতে একটা ফুট দুয়েকের শক্ত লাঠি৷ পথের উপরে এসে পড়া লতানে গাছপালা সরিয়ে দিচ্ছে৷ গুনগুন করে একটা গানও গাইছে বুঝি৷

—‘হ্যাঁ রে, কাসিমাকে তুই দেখেছিলি?’ অলকা ডাইনির ব্যাপারটা মাথা থেকে সরাতে পারছে না৷

থেমে পিছন ফিরে একবার আমাদের দিকে তাকায় মুকুন্দ, তারপর আবার হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘বেঁচে থাকতে দেখিনি৷ মরে গিয়েছিল যখন তখন দেখেছি৷’

—‘মানে ডেডবডিটা দেখেছে৷’ আমি বিড়বিড় করলাম৷

—‘ডেডবডিটা তোরাই দেখেছিলি আগে?’

মুকুন্দ কী উত্তর দিল বোঝা গেল না, গাছের উপরে লাঠির আছড়ে পড়ার শব্দে হারিয়ে গেল৷

—‘উইন্ডচাইমটা দেখেছিলি তখন?’

—‘কী?’ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল সে৷

এবার আমি বললাম, ‘উইন্ডচাইম, ওই যে বারান্দায় ঝোলানো আছে যেটা, টুং টুং করে আওয়াজ হয় হাওয়া দিলে?’

—‘হ্যাঁ, ওটা ওর ঘরের বাইরে ঝুলছিল৷ ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার আগে মানিক একটা গাছে ঝুলিয়ে দেয় ওটা৷’

—‘মানিক কে? তোর বন্ধু?’

আবার লাঠি পেটার শব্দে কথা হারিয়ে যায়৷ আমরা আর প্রশ্ন না করে সামনে হাঁটতে থাকি৷

জঙ্গলটা খুব একটা ঘন নয়৷ বেশির ভাগই শাল গাছ, তাদের ফাঁকে ফাঁকে বুনো ফার্ন আর শ্যাওলার ঝোপ জমাট বেঁধেছে৷ সেই ঝোপের উপর কোথাও গাছের শুকনো পাতা পড়ে আছে৷ মিহি ধুলোর মতো কিছু একটা উড়ছে বাতাসে৷ আমাদের তিনজনের পায়ের আওয়াজ যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গোটা জঙ্গল জুড়ে৷

বেশ কিছুক্ষণ হল লক্ষ করেছি, থেকে থেকে পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে অলকা৷ যেন দেখার চেষ্টা করছে কাউকে৷ এবার সামনে ফিরতে গিয়ে আমার চোখে চোখ পড়ে গেল তার৷ আমি ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে বলো তো? পিছনে কাকে দেখছ?’

—‘কী জানি…’ একটু উদ্বিগ্ন দেখাল তাকে, ‘মনে হচ্ছে কিছু একটা সরে যাচ্ছে বারবার৷’

—‘কী সরে যাচ্ছে?’

—‘একটা ছায়া৷’

—‘ছায়া! কেমন ছায়া?’

—‘ঠিক…’ বাকি কথাটা গিলে নেয় অলকা, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না৷’

সামনে তাকিয়ে দেখলাম, জঙ্গলের একটা বিশেষ জায়গায় এসে পড়েছি আমরা৷ এখানে জঙ্গলের রং কিছুটা খয়েরি৷ যেন বেছে বেছে এই জায়গার কয়েকটা গাছে মড়ক লেগেছে৷ কোনও কারণে পাতা শুকিয়ে গেছে তাদের৷ গাছের ফাঁকে একটা বেশ বড় জায়গার মাটি ধসে গিয়ে খাদের মতো হয়ে আছে৷ তবে ফুট দশেকের বেশি গভীর নয়৷

—‘এখানে আগুন লেগেছিল নাকি?’ আমি মুকুন্দর মাথার পিছনে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম৷

মুকুন্দ কাঁধ ঝাঁকাল, বুঝলাম, আগুন লেগেছিল কি না সে তথ্য তার কাছেও নেই৷ এগোতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার পা আটকে গেল৷ পাশ ফিরতেই খেয়াল করেছি অলকা আমার পাশে নেই৷ এতক্ষণে সামনের জায়গাটা দেখতে গিয়ে তার কথা মনেই ছিল না৷ চকিতে পিছন ফিরলাম, আমাদের ফেলে-আসা রাস্তাটা খাঁ খাঁ করছে৷ অলকা নেই৷

একটা ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে৷ অনেকটা যেন মিহি বাঁশির আওয়াজ৷ কাল রাতের সেই বাঁশিটা এখন কাছেই কোথাও বাজছে৷ আমি একঝলক দেখে নিলাম মুকুন্দের মুখটা, হ্যাঁ সে-ও শুনতে পেয়েছে৷ সতর্ক চোখে জঙ্গলের চারপাশটা লক্ষ করছে সে৷

‘অলকা…’ আমি গলা তুলে ডেকে উঠলাম, ‘কোথায় তুমি?’ কোনও উত্তর এল না৷ জঙ্গলের অন্য শব্দ যেন ম্যাজিকের মতো থেমে গেছে, শুধু অচেনা একটা হাওয়া ভেসে আসছে গাছের ফাঁক থেকে৷ অলকার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আমি পিছন দিকে দৌড়োতে লাগলাম৷ চোখ রাখলাম দু-পাশে যত দূর দেখা যায়৷ ভেসে আসা হাওয়াটা বাঁশির সুরের সঙ্গেই কম্পিত হচ্ছে৷

—‘অলকা…’ আমার মাথার শিরাগুলো দপদপ করে উঠল৷ মনে হল, জঙ্গলের মাটিতে পড়ে থাকা গুল্মলতা আমার পা চেপে ধরতে চাইছে৷

এলোপাথাড়ি ছুটতে যাচ্ছিলাম বাঁশির আওয়াজ লক্ষ্য করে, কিন্তু তার আগেই পিঠে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছন ফিরে দেখলাম মুকুন্দ এসে দাঁড়িয়েছে আমার পিছনে, চাপা কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল, ‘ওদিকে পাবেন না, আমার সঙ্গে আসুন৷’

—‘কোথায়?’

—‘আসুন৷’

আমার কথার উত্তর দিল না সে৷ হাতের উপর চাপটা একটু বাড়িয়ে জঙ্গলের গাছের ফাঁক দিয়ে একটা দিকে আমাকে টেনে নিয়ে চলল৷ খানিক হেঁটে কিছুটা দৌড়োনোর পরে অলকার নেভি ব্লু রঙের শার্ট চোখে পড়ল আমার৷ ছুটে গেলাম তার শরীর লক্ষ্য করে৷ সামনে গিয়েই কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ জঙ্গলের ফাঁকা একটা জায়গার দিকে একমনে তাকিয়ে কী যেন দেখছে সে, হাত, পা চোখের মণি আশ্চর্যরকম স্থির৷ ঠিক যেন একটা জীবন্ত পুতুলে পরিণত হয়েছে সে৷

—‘এই অলকা…’

তার কাঁধের কাছে ঠেলা দিলাম আমি, ‘এখানে কী করে এলে৷’

পরপর দু-বার ধাক্কা দিতে তার দেহে প্রাণের সঞ্চার হল, সে থতমত খেয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, ‘অ্যাঁ? এখানে…’

—‘কী করে এলে এখানে? আমার সঙ্গে চলছিলে তো…’ আমি তার কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দিলাম৷

—‘তুমি ডাকলে…’

—‘আমি!’

—‘আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম… তুমি বললে কী একটা দেখাবে… একহাত দিয়ে তার মুখের উপরে এসে পড়া-চুলগুলো আমি সরিয়ে দিলাম, সে অবাক চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, ‘তারপর কোথায় গেলে বলতো?’

—‘ধুর… কী সব বলছ… আমি তো মুকুন্দর সঙ্গে এগোচ্ছিলাম, ও-ই তো আমাকে পথ দেখিয়ে… কী বলো না…’

মুকুন্দর দিকে চেয়ে শেষ-কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম আমি, থেমে গেলাম৷ আমার হাতটা একটু আগেই ছেড়ে দিয়েছে মুকুন্দ৷ এখন আমার পাশে আর অস্তিত্ব নেই তার৷ ঝোপের উপরে পায়ের চিহ্ন পর্যন্ত নেই৷ যেন আমি একাই এসেছি এখানে৷ গেল কোথায় ছেলেটা? এখানেই তো ছিল…

অলকা যেদিকে তাকিয়ে ছিল, সেখানে লক্ষ করলাম আমি৷ জঙ্গলের গাছগুলো যেন একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সেখানে৷ ভিতরটা ঘন অন্ধকার৷ এ জঙ্গলটা এমনিতে পাতলা, বেশির ভাগ জায়গাতেই সূর্যের রোদ আলোছায়া বিছিয়ে রেখেছে৷ কিন্তু আমাদের থেকে বিশ হাত দূরে ওই বিশেষ জায়গাটা যেন একবুক রহস্য আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে৷ মনে হল গাছ না কেটে ওখানে মানুষের ঢোকার কোনও উপায় নেই৷

—‘কী আছে বল তো ওখানে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷ অলকা উত্তর দিতে যাচ্ছিল কিন্তু থেমে গেল৷ আমাদের পিছনদিক থেকে মাটির উপরে পায়ের আওয়াজ ভেসে এসেছে, সতর্ক হয়ে তাকাতে একটা মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল সেখানে— মুকুন্দ৷ আমাদেরকে অবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বলল,

—‘আপনারা এখানে! আর আমি খুঁজে মরছি৷’

অলকাকে ছেড়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘ইয়ারকি হচ্ছে? আমাকে তো তুমিই এখানে নিয়ে এলে৷’

—‘আমি!’

সে হাতের লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে আমাদের আপাদমস্তক দেখল৷ মুখের উপরে একবার বুলিয়ে নিল হাতটা৷ তারপর আর কিছু না বলে আমাদের পাশ দিয়ে সামনে হাঁটতে লাগল৷

কয়েক সেকেন্ড সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম আমি আর অলকা৷ তারপর মুকুন্দর পিছু নিলাম দু-জনেই৷

—‘জঙ্গলে আর সেরকম কিছু নেই দেখার মতো৷ আপনারা ছবি তুলে নিন৷’

ছবি তোলার ইচ্ছা আর ছিল না আমাদের৷ ক্যামেরাটা বেরই করা হয়নি ব্যাগ থেকে৷ কপাল ঘষতে ঘষতে বললাম, ‘তুমি সত্যি বলছ আমাকে ওখানে নিয়ে যাওনি?’

—‘না, আমি চিৎকার করছিলাম৷ আপনারা সাড়া দিচ্ছিলেন না৷’

অলকা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সাড়া যদি না-ই দিয়ে থাকি তাহলে তুই বুঝলি কী করে, আমরা ওখানে আছি?’

এইবার একটু অস্বস্তিতে পড়ল মুকুন্দ৷ মুখ দেখে মনে হল কিছু একটা কথা লুকোতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে সে৷ ঢোক গিলে বলল, —‘আমি জানতাম, আপনারা ওখানে থাকবেন৷’

—‘কী করে?’ আমরা দু-জনে প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম৷

চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নেয় মুকুন্দ, তার মুখে ছায়া ঘনিয়ে আসে,

—‘আগে আমরা এই জঙ্গলের ভিতরে খেলতে আসতাম৷ তো একবার খুব ঝড় হচ্ছিল, আমরা সবাই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে দেখি মানিক আমাদের সঙ্গে বেরোয়নি৷ অনেক খোঁজাখুঁজি করে আবিষ্কার করি, সে ওই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে৷ সেবার আমরা অত কিছু ভাবিনি৷ কিন্তু ঘটনাটা আরও বার তিনেক ঘটে৷ প্রতিবার কেউ না কেউ হারিয়ে যায়৷ তারপর ওইরকম জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে ওই ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ তারপর থেকে ভয়ে আর আসি না৷

যতবারই ঝড় ওঠে, ওই বাঁশিটা বাজতে থাকে, স্যার…’ থেমে থেমে পরের কথাগুলো উচ্চারণ করে সে, ‘বাঁশিটা ভালো নয়, স্যার৷ কাসিমা ডাইনি ছিল, তার অভিশাপ এখনও এই জায়গাটা ছেড়ে যায়নি৷’

—‘কীসের অভিশাপ?’

বুঝলাম, ইচ্ছা করেই উত্তর এড়িয়ে গেল মুকুন্দ৷ আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,—‘আজ আর জঙ্গল ঘুরে কাজ নেই৷ তুমি আমাদের বেরোনোর ব্যবস্থা করো৷’

কিছুটা এদিক-ওদিক ঘুরে জঙ্গলের সীমানা পেরিয়ে বেরোলাম যখন তখন দুপুর অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে৷ বেরোনোর আগে পিছন ফিরে জঙ্গলটার দিকে আর-একবার তাকালাম৷ কেমন একটা বিষণ্ণ ভাব সর্বক্ষণ ঘিরে রয়েছে গাছগুলোকে৷ যেন একসময় অনেক মানুষ বাস করত এই জঙ্গলের ভিতরে, তারপর কিছু একটা ঘটায় রাতারাতি পরিত্যক্ত হয়েছে জঙ্গলটা৷ গোটা জঙ্গলটা ঠিক একটা হানাবাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে৷

বাইরে বেরিয়ে মুকুন্দ গ্রামের দিকে চলে গেল৷ আমরা কটেজের দিকে এগোলাম৷ লক্ষ করলাম অলকা একটু বেশি আমার দিকে ঘেঁষে হাঁটছে৷

চোখমুখ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তার৷ আমার নিজেরও শরীর ভালো লাগছিল না৷ অলকা বলল, ‘বাঁশিটা কে বাজাচ্ছিল বলো তো? জঙ্গলে অন্য কেউ তো ছিল না৷’

—‘থাকতে পারে, আমরা জানব কী করে, তবে…’

—‘তবে কী?’ সে থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকাল৷

—‘কাল রাতেও বাঁশিটা শুনেছিলাম আমি৷’

—‘কাল রাতে৷ কখন?’

—‘উইন্ডচাইমটা নামিয়ে রাখতে গিয়েছিলাম যখন, মনে হল, একটা ছায়া যেন সরে যাচ্ছে জঙ্গলের ভিতরে৷ আর ওই বাঁশিটা…’

গার্ডেন গেটটার সামনে এসে পড়েছিলাম আমরা, অলকা পিছন ফিরে একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘জায়গাটা আমার একদম ভালো লাগছে না৷ আচ্ছা, ডাইনিদের বিশেষ কিছু ক্ষমতা থাকে বলে শুনেছি, যদি সত্যি কোনও অভিশাপ থাকে জায়গাটাকে ঘিরে?’

—‘ধুর, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না৷ আর অভিশাপ যদি থাকেই, সেটার তো একটা কারণ থাকবে৷ কাসিমাকে তো গ্রামবাসীরা মারেনি৷ খামোখা সে অভিশাপ দিতে যাবে কেন?’

—‘তুমি কী করে জানলে, মারেনি? গীতেশবাবু বললেন, তার ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখেছিল ছেলেরা৷ সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু না-ও হতে পারে৷ পোস্টমর্টেম কিছু হয়েছিল বলে তো মনে হয় না৷’

—‘হুম… ব্যাপারটা আমার কাছেও স্পষ্ট নয়৷ কোথাও কিছু গোলমাল তো নিশ্চয়ই আছে৷’

দু-জনে কটেজের ভিতরে ঢুকে আসি৷ জানি না কেন, কয়েক মুহূর্তের জন্যে মনে হল কোথা থেকে একটা গন্ধ আসছে৷ ঠিক যেন কটেজের কোনও ঘরে কেরোসিন ছড়িয়েছে কেউ৷ ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে গন্ধটা৷

—‘কী হল? দাঁড়িয়ে গেলে যে৷’

অলকার কথায় চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, সে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে৷

হাওয়ায় আর-একবার শুঁকলাম গন্ধটা৷ নাঃ, আর আসছে না৷ কিন্তু গন্ধ তো এত তাড়াতাড়ি মিলিয়ে যাবার নয়, তাহলে? মনের ভুলই হবে৷

(তিন)

কটেজের ভিতরে একটা ছোট রান্নাঘর আছে৷ সেখানেই আজকের মতো রান্নার ব্যবস্থা করে নিলাম আমরা৷ দু-জনে মিলে রান্নাবান্না শেষ করতে করতে কিছুটা দেরি হল৷ কিছুতেই মন বসছে না৷ থেকে থেকে দুপুরের ঘটনাটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ সব কিছু কেমন গোলমেলে হয়ে গিয়েছিল৷ বিশেষ করে অলকার হারিয়ে যাওয়াটা৷

সন্ধে পেরোতেই খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানা নিলাম দু-জনে৷ আজ আর উইন্ডচাইমের শব্দ আসছে না৷ বাইরে জঙ্গলে কাল রাতের প্যাঁচাটা ডাকছে বটে কিন্তু রাতচরা পাখিটা নেই আজ৷

বারান্দার আলোটা আজ জ্বেলেই শুয়েছি৷ সেটা এখন বসার ঘর পেরিয়ে আমাদের উলটোদিকের দেওয়ালে এসে পড়েছে৷ বারান্দার গাছের এগিয়ে-আসা ডালপালা আঙুলের মতো ছায়া তৈরি করেছে৷ ছায়াগুলো দুলছে৷

—‘ধরো যদি সত্যি কোনও অভিশাপ থাকে, সেটা আমাদের উপরে লাগবে কি?’ অলকা উলটো হয়ে শুয়ে জিজ্ঞেস করল৷

—‘তুমি ওসব সরাও এখন মাথা থেকে৷ কাল সকাল হলেই এখান থেকে চলে যাব৷ রাতটা একবার কাটাতে পারলে অভিশাপ নিয়ে আর না ভাবলেও চলবে৷’

আমার শেষ কথাটায় একটু ধমকের সুর ছিল৷ তাতে কাজ দিল৷ লেপে মাথা জড়িয়ে শুয়ে পড়ল অলকা৷ আমিও পাশ ফিরে শুলাম৷ কিন্তু মন উসখুস করতে লাগল৷ কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না মনটা৷ এই জঙ্গুলে জায়গাটার ভিতরে কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে৷ ঠিক যেন একটা জীবন্ত কুয়াশা আড়াল থেকে নজর রাখছে আমাদের উপর৷

তবে কি সত্যি কাসিমার আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায় এই কটেজকে ঘিরে? এখানে থাকতে আসা মানুষকে বিভ্রান্ত করে? কিন্তু কেন? একটা সম্ভাবনা মাথায় এল আমার৷ হয়তো তার ঘরের ভিতরে এমন কিছু ছিল, যা পুড়ে যায়নি৷ এমন কিছু, যাকে অবলম্বন করে এখনও এখানে টিকে আছে সে৷ কী হতে পারে?

বিদ্যুৎ ঝলকের মতো মনে পড়ে গেল, উইন্ডচাইম৷ তার শেষ স্মৃতিচিহ্ন, সেটা বারান্দা থেকে সরিয়ে নিতেই সেই ছায়াটাকে লক্ষ করেছিলাম জঙ্গলের ভিতরে৷

অলকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ পায়ে চটিটা গলালাম না৷ আবার একটা মিহি শব্দ শুনতে পাচ্ছি, হ্যাঁ… তবে বাঁশির নয়, খুব হালকা চাপা স্বরে যেন শিস দিচ্ছে কেউ৷ ছোট ফাটলের ভিতর থেকে সজোরে হাওয়া দিলে যেমন শব্দ হয়—সেইরকম৷

বেশ বুঝতে পারলাম আওয়াজটা প্রাকৃতিক না, কারও মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে সেটা৷ সেই আওয়াজেই সম্মোহিতের মতো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ মনে হল মাথার উপরে জ্বলতে-থাকা হলদে আলোটা একেবারে ক্ষীণ হয়ে এসেছে৷ বারান্দার আউটলাইন ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না৷ দূরে জঙ্গলের গাছের মাথার দিকগুলো দেখা যাচ্ছে৷ ঝোড়ো হাওয়ায় দুলে উঠছে তারা৷ এলোপাথাড়ি নয়, কোনও নির্দিষ্ট ছন্দে৷

খেয়াল করলাম, বারান্দার কাঠের রেলিং-এর গায়ে একটা হাত রেখে আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে একটা নারীমূর্তি৷ তার সমস্ত শরীর কালো আলখাল্লার মতো কাপড়ে ঢাকা৷ মাথার চুল কোমর ছাড়িয়ে নেমেছে নীচে৷

—‘অলকা…’ কাঁপা-কাঁপা স্বরে উচ্চারণ করলাম আমি৷ যদিও মন বলছে, আমার ঠিক সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে অলকা নয়৷ অন্য কেউ৷

শিসের শব্দ থেমে গেল৷ নারীমূর্তির রেলিং-এর উপরে রাখা হাতদুটো নেমে এল কোমরের দু’পাশে৷ আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম তার দিকে৷ একটা হাত রাখলাম তার পিঠে, ঠিক যেন ঠান্ডা গাছের কাণ্ডে হাত রেখেছি৷ প্রাণ আছে, কিন্তু স্যাঁতসেঁতে উদ্ভিদের মতো প্রাণ৷ সে আস্তে আস্তে ফিরে তাকাতে লাগল আমার দিকে৷ এইবার… তার মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমার চোখের সামনে…

কিন্তু মুখ কোথায়? আমি অবাক হয়ে দেখলাম, নারীমূর্তির মুখমণ্ডল যেন ছুরি দিয়ে ধার থেকে কেটে সরিয়ে নিয়েছে কেউ৷ গোটা মুখ জুড়ে একটা গাছের অন্ধকার কোটর৷

এতক্ষণ আমার চারপাশের সমস্ত শব্দ থেমে গিয়েছিল, এবার আমাকে কাঁপিয়ে দিয়ে কোটর থেকে আবার বেরিয়ে এল সেই ভয়াবহ শিসের শব্দ৷ আমি ধাক্কা মেরে তাকে সরিয়ে দিতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার হাত খালি, কিচ্ছু নেই সেখানে৷

—‘কী চাও তুমি?’ চিৎকার করে উঠলাম৷

পিছন ফিরে দৌড়ে ঘরের ভিতর আসতে গিয়ে আমি মাটির উপরেই বসে পড়লাম৷ আমার মুখের ঠিক সামনে এখন অলকার মুখ৷ তবে সোজা নয়, উলটো৷ ঘরের উপরের দেওয়াল থেকে তার পা বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে দিয়েছে কেউ৷ তার সাদা চোখের মণি দুটো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ সে হাসছে৷ সশব্দে হাসছে৷

দু-হাতে চোখ ঢেকে ফেললাম৷ পরক্ষণে চোখ খুলতেই হাসির আওয়াজ মিলিয়ে গেল৷ দেখলাম, অলকা দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে৷ আমার দিকে প্রায় দৌড়ে এগিয়ে এল সে, ‘এ কী! তুমি এখানে বসে আছ কেন?’

সে একটা হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে৷ আমি জামার হাতায় মুখটা মুছে পিছন দিকটা দেখে নিলাম৷ বারান্দাটা এখনও আগের মতোই পড়ে আছে৷ একটুও হাওয়া দিচ্ছে না বাইরে৷

—‘একটা কথা মনে আছে তোমার?’

—‘কী কথা?’ সে ঘুম-জড়ানো চোখে চাইল আমার দিকে৷

—‘কাল আমরা জঙ্গলের ঢুকেছিলাম যখন তখন জোরে হাওয়া দিচ্ছিল?’

ভাবতে মিনিট দুয়েক সময় নেয় অলকা, বলে, ‘না তো, বরঞ্চ বেশ গুমোট হয়ে ছিল৷’

—‘অথচ মুকুন্দ বলল, একমাত্র ঝড় উঠলেই জঙ্গলের মধ্যে গন্ডগোলটা ঘটে থাকে৷’

—‘আমারও সেটা মনে হচ্ছিল… কিন্তু…’

—‘আমরা একটা বড় ভুল করে ফেলেছি, উইন্ড চাইমটা সরিয়ে নেওয়া উচিত হয়নি আমাদের৷’

—‘কিন্তু কেন?’

আমি দ্রুত বারান্দার দিকে সরে আসি, ‘ওটা কোনও সাধারণ উইন্ডচাইম না, এই জঙ্গলের ভিতরে এমন একটা কিছু আছে যে বাঁশির মতো শব্দ করে বাতাসে কোনও হ্যালুসিনোজেন ছড়াতে পারে৷ সে বাঁশির শব্দ যে শুনতে পাবে—সে-ই ভয়ংকর কিছু একটা দেখতে পাবে৷ তাকে নিস্তেজ করে রাখার একটাই উপায় আছে৷ ওই উইন্ডচাইমের সুরটা৷ ওটা শুনিয়েই এত বছর তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল কাসিমা৷ কাল আমি ওটা খুলে নেওয়ার পর সে আবার জেগে উঠেছে৷’

অলকাকে বিভ্রান্ত দেখাল৷ আমার কথাগুলো মাথায় ঢোকেনি তার৷ কিছুটা এগিয়ে এসে বলল, ‘এসব তুমি কী করে জানলে?’

—‘ভেবে দেখো, একমাত্র ঝড় হলেই বাঁশির শব্দ শোনা যায়, অর্থাৎ হাওয়ার ঝাপটায় যখন উইন্ডচাইমের শব্দ পালটে যায় তখনই জেগে ওঠে সে৷’

—‘কিন্তু কালকে তো আমি ভয় পাইনি৷’

আমি জঞ্জালের বাক্সের ভিতরে পড়ে থাকা উইন্ডচাইমটা হাতে তুলে নিলাম৷ সেটা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে-থাকা কঞ্চিতে ঝোলাতে ঝোলাতে বললাম, ‘কাল আমাদের ভয় দেখানো উদ্দেশ্য ছিল না তার৷ সে মানুষকে জানতে চায়, মানুষ কীসে ভয় পায়, সেটা বুঝতে চায়৷ কাল তুমি হতবাক হয়ে জঙ্গলের ভিতরে অন্ধকার একটা জায়গায় তাকিয়ে ছিলে৷ আমার মনে হয়, সেই অন্ধকারের ভিতরেই সে থাকে৷’

টুং টুং শব্দে আবার বাজতে শুরু করেছে উইন্ডচাইমটা৷ হাওয়ার দোলা নয়, বিশেষ একটা সুর তুলে বেজে চলেছে সে৷ মৃদু ধাতব আওয়াজটা যেন ভেসে এসে প্রবেশ করছে আমাদের শরীরের ভিতরে৷

—‘কাসিমা ডাইনি ছিল কি না আমি জানি না, কিন্তু কোনওভাবে জঙ্গলের প্রাণীটিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার শব্দটা সে নিজেই তৈরি করেছিল৷ তা না করলে এই জায়গাটায় সে টিকতে পারত না৷’

—‘কিন্তু সে এল কোথা থেকে?’

আমি একহাতে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে বললাম, ‘বলা যায় না৷ হয়তো পৃথিবীতেই ছিল৷ এখনও আদিম বন-বনানী কিংবা সমুদ্রের গভীরে এমন অনেক প্রাণী আছে যাদের হদিস মানুষ এখনও পায়নি৷ এ-ও হয়তো তেমন কিছুই৷’

ক্রমশ পিয়ানোর মতো সুরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সম্মোহিনী বাঁশির সুর৷ মনে হল, আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে আমাদের চারপাশে, বুঝতে পারলাম, অলকার একটা হাত আমার জামার হাতা খামচে ধরেছে৷ একদৃষ্টে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, এই প্রাণীটা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না?’

—‘পারে হয়তো৷ তবে এখনও আসেনি যখন তার মানে আপাতত আর আসার সম্ভাবনা নেই৷’

ঘুরে দাঁড়িয়ে তার মাথায় একটা হাত রাখলাম আমি—‘অত চিন্তার কিছু নেই৷ চলো, ঘুমিয়ে পড়ি৷ এবার আর গন্ডগোল হবে না৷’

(চার)

সকালে ব্যাগপত্র নিয়ে বাগানের গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ গীতেশবাবু একটু আগেই এসে পৌঁছেছেন৷ আমাদেরকে গাড়িতে করে স্টেশন অবধি দিয়ে আসবেন তিনি৷ সকালের দিকে মুকুন্দও এসে ঘুরে গেছে একবার৷ কালকের কথা যে আমি গীতেশবাবুকে বলিনি, সেটার জন্য বাড়তি ধন্যবাদ দিয়ে গেল আমাকে৷

চারপাশটা এখন রোদে ঝলমল করছে৷ জঙ্গলের সবুজ গাছের উপরে সেই রোদ এসে পড়ে ঠিক রূপকথার জঙ্গলের মতো দেখাচ্ছে৷ যেন এইমাত্র ভিতর থেকে একটা সোনালি হরিণ বেরিয়ে আসবে৷

সেদিক থেকে চোখ নামিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম আমরা৷ গীতেশবাবু পিছনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন৷ পিছন ফিরে বললাম, ‘কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে?’

গীতেশবাবু উত্তর দিলেন না৷ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছেন তিনি৷ নীচের দিকে মুখ নামিয়ে মাটিতে কী যেন দেখছেন৷ অথচ কিছুই পড়ে নেই মাটিতে৷

—‘কী হল? গীতেশবাবু… শুনছেন?’

আমি তার দিকে এগিয়েই যাচ্ছিলাম৷ তার আগেই তিনি মাথা তুললেন৷ সেই মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভিতরটা এক পলকের জন্যে ছ্যাঁত করে উঠল৷ গীতেশবাবুর ঠোঁট দুটো মুখের দু-দিকে অস্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে৷ ক্রমশ সে মুখে ফুটে উঠছে একটা অমানুষিক, নারকীয় হাসি৷ যেন কিছু একটা কারণে আমাকে ব্যঙ্গ করতে চাইছেন তিনি৷

একটু একটু করে সেই হাসি মিলিয়ে গেল তার মুখ থেকে৷ সেই সঙ্গে চোখ, নাক, কপাল, গাল মুছে গিয়ে তৈরি হল একটা অন্ধকার শূন্য, কাল রাতের নারীমূর্তির মতো ধীরে ধীরে উলটো হয়ে শূন্যে ভাসতে লাগলেন তিনি৷

—‘কী হচ্ছে এসব… আমি… আমি…’

দিনের আলো নিভে এল একনিমেষে৷ আমার চারপাশের সবকিছু পালটে গিয়ে মুহূর্তে অনুভব করলাম, আবার এসে দাঁড়িয়েছি কাল রাতের সেই ভৌতিক মুহূর্তে৷ কানে এল অলকার অসহায় গলার স্বর, ‘কী হল, খুঁজে পাচ্ছ না? কোথায় ওটা?’

বুঝলাম, জঞ্জালের বাক্সে উইন্ডচাইমটা খুঁজে চলেছি আমি৷ এতক্ষণ কি তবে হ্যালুসিনেট করছিলাম? কালকের সকাল আসেনি এখনও? তাহলে…. না হোক, উইন্ডচাইমটা একবার ঝুলিয়ে দিতে পারলেই… ঠান্ডা পাইপের ছোঁয়া হাতে লাগতেই আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘পেয়েছি… পেয়েছি…’

—‘ওঃ গড…’ অলকার গলায় খুশি ঝরে পড়ল, ‘দাও আমাকে….. কুইক৷’

পাইপটা ধরে একটা টান দিয়ে উইন্ডচাইমটা অলকার হাতে ধরিয়ে দিলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে একটা শব্দ করে খসে পড়ল সেটা৷ আমি হতবাক চোখে তাকিয়ে দেখলাম পাইপের সুতোগুলো গোড়া থেকে ছিঁড়ে রেখেছে কেউ৷

কিন্তু কে ছিঁড়বে? আমি তো প্রথমদিন রাতে… স্পষ্ট হয়ে গেল উত্তরটা৷ সেদিন উইন্ডচাইমটা খুলে নেওয়ার পরেই বাঁশি বাজতে শুরু করেছিল৷ সম্মোহিত অবস্থায় আমি নিজেই হয়তো… এবার আর কাজ করবে না ওটা…

—‘কী করেছ তুমি এটা!’ সে গলা চিরে চিৎকার করে উঠল৷

—‘আমি! কে আমাকে বলেছিল উইন্ডচাইমটা…’

একটা আতঙ্কিত চিৎকার করে আমার গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিল অলকা, কিন্তু তার চিৎকার ছাপিয়ে আর একটা শব্দ এসে পড়েছে আমাদের কানে৷ না, আর জঙ্গলের দিক থেকে না, ভিতরের ঘর থেকে… তীব্র বাঁশির শব্দ ভেসে আসছে আমাদের শোবার ঘর থেকে… সেখান থেকে বারান্দার দিকে এগিয়ে আসছে কেউ…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *