উইকাণ্ড
আরণ্যক এখানকার এক অহংকার, চারপাশে শুধু বনস্পতি আর বনস্পতি। অন্তত সবুজের মাথায় জড়িয়ে থাকে যতদূর চোখ যাওয়া সম্ভব। সবুজের নীচেও আরও এক সবুজ, তারা কেউ চারাগাছ, কেউ গুল্মলতা, কেউ তৃণ— তার মধ্য দিয়ে পায়ে চলার সরু পথ। এমতো অখণ্ড নির্জনতার প্রেক্ষাপটে স্বর্ণলতা তার পেলব বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে কাঞ্চনের শরীর, কাঞ্চনের সাধ্য কি তার আহবান এড়িয়ে থাকতে পারে!
অপরাজিতাও কি কম যায়! কাঞ্চন কি স্বর্ণলতার একার! অপরাজিতাও কাঞ্চনকে জড়িয়ে ধরে বলতে চায়, আমি কি নিতান্তই ফেলনা! আমার দিকে একবার তাকাও!
কাকে সামলাবে কাঞ্চন! স্বর্ণলতার জটিল বাহুবন্ধন, না অপরাজিতার শরীরী প্রেম!
কাঞ্চন দেখেনি, স্বর্ণলতাও না, তাদের অদূরে বলিষ্ঠ চেহারার অর্জুনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে মহুয়া, তারাও একে অপরের শরীর থেকে শুষে নিতে চাইছে পরম উষ্ণতা। মহুয়ার শরীর থেকে উৎসারিত হচ্ছে এক মোহময় সুগন্ধ। সেই আকর্ষণে ওতপ্রোত অর্জুন মাতাল হয়ে ঢলে পড়তে চাইছে মহুয়ার শরীরের উপর। মদমত্ত হাওয়ার ঝাপটে দুই শরীরের উষ্ণতা এক-একবার এক হতে চাইছে, আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পরের মুহূর্তে।
কিন্তু কেন অমন বিষণ্ণনয়না শ্রেয়সী! তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না শাল্মল। শাল্মলের বিশাল চেহারা আলাদা করে চোখে পড়ে এখানে। হয়তো তাই তার শরীরে এত অহংকার। শ্রেয়সী তার দু বাহু তুলে ডাক দেয়, তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? কেন আমাকে এত উপেক্ষা! ওই দ্যাখো স্বর্ণলতা কী বেহায়ার মতো জাপটে ধরে আছে কাঞ্চনকে। চারপাশে কত সহস্র চোখ, তা সত্ত্বেও—
শাল্মল একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে দেখে শ্রেয়সীর দিকে, তার ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি।
বাতাস তখন মৃদুমন্থর, শাল্মল চুপিচুপি শ্রেয়সীর উদ্দেশে ছড়িয়ে দেয় তার না-ছুঁতে পারা ভালোবাসা।
আর দ্যাখো, ওই যে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মল্লিকা, জুঁই, কলাবতী, কৃষ্ণকলি, শিউলি, অতসী— ওরা এখন কী করবে! একটু পরেই পরে নেবে নাচের পোশাক, মাথায় টাঙিয়ে নেবে রকমারি ফুলে টোপর— শুরু করে দেবে আঙুল ঘুরিয়ে, কোমর বাঁকিয়ে—
মৌরি আর এলাচি কেন শামিল হয়নি নাচের দলে! কেন দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক! ওরা কি নাচের সঙ্গে মহড়া দেবে গানের!
২.
আরণ্যকের সীমারেখা যেখানে শেষ, সেখানেই প্রধান রাস্তা। তার ধারে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে এক মস্ত বটবৃক্ষ, বিশাল একটা জায়গা জুড়ে তার ব্যাপ্তি। কী স্পর্ধিত তার উপস্থিতি! তার মূল কাণ্ডটি বিশালাকায়, কাণ্ডের উপর থেকে কাতারে কাতারে নেমে এসেছে সহস্র ঝুরি, সেই ঝুরিও কালক্রমে সমৃদ্ধ হয়ে রূপান্তরিত হয়েছে এক-একটি কাণ্ডে। এক কাণ্ড থেকে বহু কাণ্ড। কাণ্ডগুলি এমন ঘনসংবদ্ধ যে, তার মধ্যে পথচারী কেউ প্রবেশ করলে গোলকধাঁধার মতো ঘুরতেই থাকবে অজস্র কাণ্ডের ভিতর।
সেই বহুকাণ্ড বট ছায়া দেয় তার লক্ষকোটি পাতার ছাতায়। পথ-চলতি মানুষ তার নাম দিয়েছে রাজবাড়ি। রাজবাড়ির একটা বিশেষত্ব হল তার অজস্র কাণ্ডের মধ্যে কোনও একটা ফোকরে বাস করে এক আশ্চর্য তক্ষক। রাজবাড়িতে কোনও বেচাল কাণ্ড ঘটলে তৎক্ষণাৎ তক্ষকটি অদ্ভুত শব্দ করে ডেকে ওঠে। ট-র্র্র্র্ ট-র্র্র্র্—
সেই শব্দ হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে যায় চারদিকে। দৈববাণীর মতো।
৩.
শহরের মেয়ে বিতর্কিতা কবে একদিন এসেছিল সাবলীল সহাস্য আরণ্যকের এক বৃহৎ অধিবাসীকে আবিষ্কার করতে। তাকে কেউ বলেছিল এখানেও এক আশ্চর্য প্রাণের মেলা। বনস্পতি মানেই ঊধর্বমুখী এক পাতাডালপালা কাণ্ডই নয়, গুল্মলতা মানে পথের ধারে অবহেলায় শোভা পাওয়া ভীরু লতানে ঝোপঝাড় নয়, তৃণ মানেই পা দিয়ে মাড়িয়ে যাওয়ার ঘাসঘাসালি নয়।
তবু তার প্রথমবারের অভিযানে খুব যে আহামরি কিছু মনে হয়েছিল তা নয়, যেন আর পাঁচটা গহীন জঙ্গলের মতো বনরাজির একত্র সমাবেশ। তারপর যত দিন গেছে, কী এক আকর্ষণে জড়িয়ে পড়েছে আরণ্যকের মায়ায়। বারবার ছুটে এসেছে এখানে, তন্নতন্ন দেখেছে প্রতিটি বাসিন্দার আচার-আচরণ, রোমাঞ্চ-শিহরন, হাওয়ায় আন্দোলিত হওয়া।
ক্রমে অরণ্যের সঙ্গে ভাব-ভালবাসা হয়েছে বিতর্কিতার, তাদের কাণ্ড ছুঁয়ে অনুভব করে এক অন্য আত্মীয়তা, তাদের পাতার স্পর্শে শিহরিত হয়, তাদের ফুলের শোভায় সম্মোহিত হয়, কখনও তাদের সঙ্গে কথাও বলে।
অরণ্যের এই মোহময় আকর্ষণ, পারস্পরিক টান-ভালোবাসা যেদিন থেকে বিতর্কিতা আবিষ্কার করেছে, তার অরণ্যপ্রীতি নিবিড় হয়েছে আরও।
দু-চোখে বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে চলার পথের দুপাশে কখনও গামার, কখনও সেগুন, কখনও শমী, কখনও মহানিম, কখনও গাব। মাঝেমধ্যে দু-একটা হিজল আর শেওড়া। কখনও পায়ের পাতা ছুঁয়ে যায় দূর্বাদল, মুজঘাস, উলপ, চোরকাঁচকি, আৎছট্টি। কখনও শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় বেতস, নলখাগড়া, করঞ্জা, কণ্টিকারী, প্রিয়ঙ্গুলতা।
আরণ্যক থেকে বেরিয়ে প্রতিবার হাঁটতে হাঁটতে বিতর্কিতা পৌঁছোয় বটবৃক্ষের কাছে। রিকশাগুলো যাতায়াত করে এই প্রধান রাস্তা দিয়ে। রাস্তায় চলমান রিকশা ডেকে নিয়ে তাতে উঠে চলে যায় শহরের দিকে। সেদিন রিকশার তালাশে দাঁড়িয়ে আছে বটবৃক্ষের সামনে, দেখতে থাকে কত পথ-চলতি মানুষ বহু দূর পথ পাড়ি দিয়ে এসে দু-দণ্ড বিশ্রাম নেয় বটবৃক্ষের নীচে। কেউ বা ঘুমিয়ে পড়ে চরম ক্লান্তিতে। ঘুম ভেঙে উঠে আবার চলে যায় যেখানে যাওয়ার।
বিতর্কিতার কখনও মনে হয়, আচ্ছা যদি এমন হয় লোকটির যখন ঘুম ভাঙল, রাত্রি দুপুর। তখন কী করবে সে! সামনে অসাড় জঙ্গল, বনের মধ্যে হিংস্র জন্তুজানোয়ার থাকা সম্ভব। লোকটি কি ভয় পেয়ে গাছের কাণ্ড বেয়ে উঠে পড়বে বটবৃক্ষের ডালে! বাকি রাত জেগে কাটিয়ে ভোরবেলা পাড়ি দেবে গন্তব্যে! কিংবা যদি এরকমটাই কোনও দিন ঘটল বিতর্কিতার বরাতে! মধ্যরাতে হঠাৎ এই অরণ্য মাঝারে নিজেকে অবিষ্কার করত বটবৃক্ষের কোনও ডালে! কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড! তখন কী করত সে!
এমন আজগুবি ধারণা মগজে ভর করতে সে হাসতে থাকে নিজের মনে। পাগলের মতো পরক্ষণে ভাবল এটা তো রাজবাড়ি। নিশ্চয় মাথার উপর ছাতা ধরবে বটবৃক্ষ!
কিন্তু সত্যিই সেদিন এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটল বিতর্কিতার জীবনে। আরণ্যক থেকে বেরিয়ে পৌঁছেছে রাজবাড়ির সামনে, হঠাৎ শুনছে তক্ষকের ডাক! কোন অন্তরিক্ষ থেকে জোরে জোরে ডাকছে তক্ষকটা! তক্ষকের স্বর এমনই অদ্ভুত আর তীবর যে, শরীরের ভিতরটা শিরশির করে ওঠে আচমকা। বিতর্কিতার বুকের ভিতর বাজ ডাকায়। বুঝে উঠতে পারছে না কী প্রলয় ঘটেছে অকস্মাৎ! ইতিউতি তাকাচ্ছে কী কারণে ডাক, হঠাৎ দেখল তার আগেই এসে দাঁড়িয়েছে এক অচেনা পথিক।
পথিকের মাথায় পাগড়ির মতো করে বাঁধা একটা গামছা, তার নাকের নীচে কাঁচাপাকা পুরুষ্ট গোঁফ, গায়ে হাফ হাতা শার্ট আর হাঁটুসোর আধময়লা ধুতি। নিতান্তই গ্রামের লোক। কিন্তু তার চোখদুটো কেন আকাশমুখো তার উৎস খুঁজতে গিয়ে বিতর্কিতা স্তম্ভিত। দেখল বিশাল বটবৃক্ষের একটা নিচুমতো ডাল থেকে ঝুলছে একটি মেয়েলোকের শরীর। তার পরনের শাড়ি দিয়েই সে ফাঁস দিয়েছে এমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক।
বিতর্কিতার পা-দুটো কেঁপে গেল ভয়ঙ্করভাবে। বটগাছের অত মোটা কাণ্ড বেয়ে ওঠা কোনও পুরুষের পক্ষেই অতি কঠিন, একজন মেয়েমানুষের পক্ষে তো আরও।
গাঁয়ের লোকটি এতক্ষণ হাঁ করে দেখছিল দৃশ্যটা, হঠাৎ এক তরুণীর আবির্ভাবে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার কাজে। যে-কাজে মন করে বেরিয়েছিল, সেদিকে যাওয়ার উদ্যোগ করতে বিতর্কিতা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, গলায় দড়ি দিয়েছে?
লোকটি আমতা আমতা গলায় বলল, দেখে তাই তো মনে হয়?
অত উঁচু ডালে একটা মেয়েলোক গলায় দড়ি দেবে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?
লোকটি তরুণীকে ভালো করে দেখে বলল, তা তোমার কী মনে হয়?
নিজে গলায় দড়ি দেওয়া যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আর যা হওয়া সম্ভব তাই মনে হয়!
লোকটি ভয় পেয়ে গেল বিতর্কিতার কথায়, বলল, তা হবে।
লোকটি চলে যাওয়ার উদ্যোগ করতে বিতর্কিতা বলল, আপনি কতক্ষণ এসেছেন এখানে?
আমি? আমি তো এক্ষুনি। লোকটি আরও ভয় পেয়ে বলল, তুমি, মানে আপনি কে?
আমি একজন সাংবাদিক। বিতর্কিতা তার কাঁধের ব্যাগ থেকে বার করল একটা ছোটো ক্যামেরা, সামনের দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করার অবকাশে বলল, আপনি প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী। আপনার স্টেটমেন্ট খুব জরুরি।
বলে ক্যামেরা ব্যাগে রেখে বার করল একটা ছোটো ডায়েরি, বলুন তো ঠিক কতক্ষণ আগে এসে পৌঁছেছেন আপনি?
না, না, আমি কিছু দেখিনি। ও বাবা খবরের কাগজে আমার নাম উঠে গেলে আমাকেও ওইভাবে মেরে ঝুলিয়ে দেবে।
বলে লোকটি কাঁধের ব্যাগ সামলে প্রায় ঊধর্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল বিতর্কিতার নাগাল এড়িয়ে বহু দূরে চলে যেতে।
ডায়েরিটা ব্যাগের মধ্যে রেখে বিতর্কিতা নিজের মনে হাসল কিছুক্ষণ। অনেকক্ষণ পথে রিকশা নেই, হঠাৎ একজন কাঁচাপাকা চুলের লোক হনহন করে আসছিল উল্টোদিক থেকে, বিতর্কিতার চোখ অনুসরণ করে তার চোখ আছড়ে পড়ল বটগাছের ডালে। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠল কাঁচাপাকা চুল, কিন্তু পালাল না, দাঁড়িয়ে দেখল দু-দণ্ড। তারপর আর্তনাদের গলায় বলে উঠল, এ বাবা, এটা কী করল মেয়েছেলেটা?
তার হাঁ-মুখের সামনে গিয়ে বিতর্কিতা জিজ্ঞাসা করল, আপনার চোখ দেখে মনে হয় চেনেন মেয়েলোকটাকে!
চিনি? লোকটি বিহ্বল হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য, তারপর বলল, হ্যাঁ, মানে, না—
‘হ্যাঁ, মানে না’-এর অর্থ কী! আপনার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে চেনেন ওকে!
হ্যাঁ, মানে ও তো বাজারপট্টির বেশ্যা একটা।
বেশ্যা? কী নাম ওর?
ও তো বিন্দু। লোকটা তখনও ঘোরের মধ্যে।
হুঁ, তা কী করে এরকম হল ওর? বিতর্কিতা বেশ ঝোঁক দিয়ে কথাটা বলল।
কী করে হল? তা বেবুশ্যে মেয়েলোকদের কখন কী মতি হয় তা কী করে বলব?
বিতর্কিতা আরও চেপে ধরার চেষ্টা করে, আপনি বাজারপট্টির বেশ্যাকে চিনলেন কী করে?
কাঁচাপাকার সংবিৎ ফেরে, বলল, না, মানে আমি কী করে চিনব? লোকে বলে ওর নামে।
লোকে বলে! লোকে যাই বলুক, বেশ্যারা মুখ তো সবাই দেখে না! যারা ওর ঘরে নিয়মিত যায় তারাই চিনবে। বিন্দুর এরকম হল কেন, কোনও আইডিয়া আছে?
না, আমার আইডিয়া হবে কী করে? আমি তো নেহাত ছাপোষা লোক।
বিতর্কিতা আরও চাপ দিতে বলল, ছাপোষা লোকরাই তো বাজারপট্টিতে যায়। যায় কি না?
একটা ছোট্ট ধমক খেতে লোকটি বলে ফেলল, আমি আর কতটা চিনি! চেনে ওই গজাবাবু।
কোথাকার গজাবাবু?
আপনি গজাবাবুকে চিনেন না? আপনি লদণপুরে বাস করেন?
বিতর্কিতা লদণপুরে বাস করে না, থাকে নিকটবর্তী শহর রামনগরে। কিন্তু আত্মহননকারী মহিলার একটা পরিচয় জোগাড় করে ফেলল কাঁচাপাকার কাছ থেকে।
গজাবাবু মানে?
গজপতি শর্মা।
একটা ক্লু পেতে বিতর্কিতা হাতে কলম খুঁজে পায়। মুহূর্তে চনমন করে ওঠে তার মগজ। আপাতত এই বটবৃক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আর কালক্ষেপ করার কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। সে অতএব হাঁটা শুরু করে লক্ষ্মণপুরের উদ্দেশে। কাজের অবসরে আরণ্যকে এসে গাছগাছালি দেখা তার একটা নেশা, যাতায়াতের পথে চোখে পড়ে বিশাল রাজবাড়ির ঝাঁপিয়ে পড়া রাজত্ব।
বিন্দু বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ ধারণা ছিল না তার। তাকে নিয়ে মগজে পাক খাওয়ানোর অবসরে একটা রিকশা পেতে তাতে উঠে বসে দ্রুতগামী হল লদণপুরের পথে। রিকশাওয়ালা খুবই বয়স্ক মানুষ, আগে থেকে খেয়াল করলে এত বৃদ্ধ মানুষের রিকশায় উঠত না, অবশ্য না উঠে উপায়ও ছিল না, আরণ্যকের দিকে চট করে কোনও রিকশা আসে না, তার দ্রুত ফেরার খুব দরকারও ছিল এই মুহূর্তে।
রিকশাওয়ালা বার দশেক প্যাডেল ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি যাবেন কোথায়, মামণি?
একজন রিকশাওয়ালার মুখে মামণি ডাকটা বেশ উপভোগ করল বিতর্কিতা। হেসে বলল, লদণপুর।
লদণপুরে কার বাড়ি?
গজপতি শর্মার কাছে।
গজপতি শর্মার নাম শুনে রিকশাওয়ালার হাতটা কেঁপে গেল এক মুহূর্ত, পরক্ষণে জিজ্ঞাসা করল, সেখেনে কেন?
রিকশাওয়ালা কেন যাত্রীকে ‘সেখেনে কেন?’ জিজ্ঞাসা করবে তা মগজে সেঁধাল না বিতর্কিতার। সে উল্টে জিজ্ঞাসা করল, চেনেন নাকি লোকটাকে?
গজপতি শর্মাকে এ দিগরে কে না চিনে? তবে না চিনাই ভালো।
তাই নাকি? কেন? বিতর্কিতার মনে হল রিকশাওয়ালারা এলাকার অনেক কিছুই জানে, তার কাছ থেকে গজপতি শর্মার জীবনকাহিনি সম্পর্কে কিছু জানা যেতে পারে।
আসলে কী জানেন, একটা ধূপ বিক্রি করা লোকের যদি হঠাৎ আঙুল ফুলে বটগাছ হয়ে যায় তো আপনি কী বলবেন তাকে?
বিতর্কিতা কিছুটা আন্দাজ করে ফেলল লোকটা সম্পর্কে। কিন্তু রিকশাওয়ালার পরের কথাটা আরও মারাত্মক, বলল, ওনার ছেলেকে নিয়ে একটা রেপ কেসে ফেঁসে আছেন ক-দিন হল।
বিতর্কিতা বেশ ঝাঁকুনি খেল প্রসঙ্গটা আকস্মিকভাবে বাঁক নেওয়ায়। তার স্তম্ভিত ভাবটা কেটে যাওয়ার আগেই পৌঁছে গেল একটা বিশাল অট্টালিকার সামনে। একেবারে নতুন তৈরি বাড়ি। তার গেটের দুপাশে দুটো প্রমাণ আকারের হাতি শূঁড় উঁচু করে জল ছেটাচ্ছে আকাশের উদ্দেশে। সেই জল ছিটকে পড়ছে তার আশেপাশে থাকা দর্শকদের গায়েও।
বিতর্কিতা চেষ্টা করল গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে। কিন্তু গেটের কাছে ভিড়, ভিতরে কেউই ঢুকতে পারছে না। শুধু ভিজছে সবাই আর হাঁ করে দেখছে গেটের কাছে একটা কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা, ‘বেশ্যার আবার রেপ হয় নাকি!’
৪.
রাজবাড়িতে ভোরের বেলা জোরে জোরে তক্ষক ডেকেছে সেই খবর মোবাইলে ভাইরাল হয়ে পৌঁছে গেছে শহরে। বিতর্কিতা খবরটা পাওয়ার আগেই সেদিন আরণ্যকে গিয়েছিল বাসিন্দাদের খবরাখবর নিতে। তখন হাওয়ারা এলোমেলো হয়ে ছটফটানি ধরিয়ে দিয়েছে সবার মধ্যে। গাছগাছালি, লতাপাতার মধ্যে বিতর্কিতা হাঁটছে আর দেখছে বাসিন্দাদের রকমসকম!
খুব গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পলাশ আর করবী। একে অপরের শরীর থেকে শুষে নিতে চাইছে উষ্ণতা যতটা সম্ভব। হাওয়ার ঝাপট এলে জড়িয়ে ধরছে নিবিড়ভাবে। আরও কিছুটা দূরে পরস্পরকে ছুঁতে চাইছে চম্পা আর পিয়াল। হাওয়া একটু জোরে বইলেই দুজনে কাছাকাছি হচ্ছে, হেসে গড়িয়ে পড়ছে একে অপরের গায়ে। পাশে একটি শিশু অপলক সেদিকে তাকিয়ে থাকলেও গ্রাহ্যের মধ্যে আনছে না।
মৌরি আর এলাচি দাঁড়িয়ে আছে মুখ ভার করে, তাদের কোনও দোসর জোটেনি।
রোজই এই সব দৃশ্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, তবু আজ আবার দেখল বিতর্কিতা। তবে আজ সে এই দৃশ্য দেখতে আসেনি, এখন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখল বটবৃক্ষের ডাল থেকে আজ আবার ঝুলছে এক মেয়েলোকের শরীর। আগের দিন ঠিক যেভাবে ঝুলছিল, সেভাবেই। আগের দিনের সঙ্গে আজকের পার্থক্য এই যে, খবরটা সাতসকালে ভাইরাল হওয়ায় কাগজের সাংবাদিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই এর মধ্যে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে।
বিতর্কিতা সেই ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে প্রথমে কয়েকটা ছবি তুলে নিল, নাহলে হয়তো গাছ থেকে নামিয়ে ফেলবে লাশটা। তারপর কান পাতল ভিড়ের কথোপকথনের মধ্যে।
ভিড়ের কথাবার্তার মধ্যে টুকরো টুকরো ছবি পাওয়া যায় তা তার কাজের পক্ষে খুব উপকারী।
কাদের বাড়ির মেয়েলোক জানো?
কী জানি, কোনও বেপাড়ার হবে।
আহা রে! একদম কচি বয়স!
হ্যাঁ কে যেন বলছিল কলেজে পড়ে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। সন্ধেবেলা কলেজ থেকে ফিরছিল। রাস্তাটা ছিল সুনসান। অমনি কয়েকজন লোফার মিলে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে।
সে কী! গণধর্ষণ!
তাই তো শুনছি সগ্গলের মুখে।
তারপর ওখানে ঝুলল কী করে?
লোকে বলছে লজ্জায় ঝুলেছে।
তাই নাকি? কিন্তু একটা কচি মেয়ে অত উপরের ডালে উঠবে কী করে?
তা কী করে জানব? লোকে বলছে গলায় দড়ি।
পোস্টমর্টেম করলে তো জানা যাবে সব।
পোস্টমর্টেম করলে কি জানা যায় সব? মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
আগে তো পোস্টমর্টেম হোক। পুলিশ আসুক।
পুলিশ এখনও আসেনি?
না, পুলিশ আসে সবার শেষে। সব লোকের দেখা শেষ হলে তবে। যখন কেউ থাকবে না, তখন লাশ পেড়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো পোস্টমর্টেম করবে। তারপর একটা মামলা দেবে। নইলে মামলার ধারা হালকা করতে পারবে না!
ও।
গজপতি শর্মার কেস তো। যাদের বাড়ির মেয়ে, তারা থানায় গিয়েছিল, পুলিশ তাদের হাঁকিয়ে দিয়ে বলেছে বয়স্কা মেয়ে কেন একা-একা ফিরছিল নির্জন রাস্তা দিয়ে!
কেন, এই যে বললে ওটা ছিল তার বাড়ি ফেরার রাস্তা।
হ্যাঁ। তাই তো। কলেজ থেকে বাসে উঠে নেমেছিল লদণপুরের বাসস্টপে। তারপর দু কিলোমিটার হেঁটে গেলে তবে বাড়ি। রোজ রোজ দোকা পাবে কোথায়? তাই একা ফিরছিল।
সেটা পুলিশকে বুঝিয়ে বলতে পারেনি!
বলেছিল। কিন্তু পুলিশের একটা কান। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, কানটা সেদিকে পাতা।
সে কী? কেন?
পুলিশের উপর ইনস্ট্রাকশন থাকে সেরকম। প্রথমে ধর্ষকদের লুকিয়ে থাকতে বলে যাতে ‘অ্যাকিউজড পার্সনস আর অ্যাবস্কন্ডিং’ বলতে পারে ওপরওয়ালাকে। তারপর বেশি চাপাচাপি করলে ধরে আনবে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মামলা এমন হালকা করে দেবে যাতে থানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জামিন।
ও, বাবা। কেন? এমন জামাই আদর কেন?
কেন আবার! গজপতি শর্মার হাত মাথায় থাকলে সাত খুন মাপ।
এতসব কথোপকথনের মধ্যে ভিড় হালকা হতে শুরু করে। সবারই তো কাজকাম আছে। পুলিশ কখন আসবে তার কোনও ঠিক নেই। বিতর্কিতার কানে গজপতি শর্মার নামটা গেঁথে আছে, সে ঠিক আগের দিনের মতোই একটা ফিরতি রিকশা ধরে চলল বাজারপট্টিতে গজপতি শর্মার বাড়ির দিকে।
রিকশাওয়ালা ছেলেটি অতি তরুণ, বোধহয় নতুন এসেছে লাইনে, পায়ে বেশ জোর, দ্রুত প্যাডেল করে পেরোতে পারছে আরণ্যক থেকে বাজারপট্টির পথ। বিতর্কিতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি রাজবাড়ির ওখানে গিয়েছিলে?
ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, একজনকে নিয়ে এসেছিলাম। লোকটা বুদ্ধিজীবী না কী বলল, দেখতে এসেছে গলায় দড়ি, না খুন!
বিতর্কিতার মনে হল বুদ্ধিজীবীদের দেখতে কেমন লাগে তা দেখার জন্য আবার ফিরে যাবে রাজবাড়ির কাছে। কিন্তু কী ভেবে চলল গজপতি শর্মার বাড়ির দিকে।
রিকশাওয়ালা ছেলেটি বলল, আপনিও গলায় দড়ি দেখতে এসেছিলেন?
বিতর্কিতা বিব্রত না হয়ে বলল, না আরণ্যকে। হঠাৎ বেরিয়ে দেখি এই কাণ্ড।
রিকশাওয়ালা বলে চলল, গরিব ঘরের মেয়ে, তাই হেঁটে আসছিল। রিকশায় গেলে বোধহয় মরত না মেয়েটা! লেখাপড়ায় ভালো ছিল।
তুমি চিনতে নাকি ওকে।
না, চিনব কী করে? কোনোদিন আমার রিকশায় ওঠেনি তো! তবে রিকশা নিয়ে ওর পাশ দিয়ে কতবার গেছি। কারও দিকে তাকাত না, মুখ নিচু করে সকালে কলেজে যেত, আবার বিকেলে বাড়ি ফেরার সময়ও একরকম। বেশিরভাগ দিনই কলেজের কোনও না কোনও মেয়ে সঙ্গে থাকত। সেদিন কেউ ছিল না। বুঝলেন, মরবে বলেই কেউ ছিল না!
বিতর্কিতা শুনতে চাইছিল ছেলেটির প্রতিক্রিয়া, বলল, একা পথ চললেই মরতে হবে?
ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কী জানি! যা পড়েছে দিনকাল! একটু রাতে রিকশা নিয়ে একা একা ফিরতে গিয়ে আমারও গা ছমছম করে।
তোমার গা ছমছম করে কেন? মেয়েদের না হয় ভয় পাওয়ার কারণ থাকে।
কী জানি, একা ফেরার সময় দু-তিনটে ছেলেকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করতে দেখলেই মনে হয় হয়তো আমাকে থামাতে বলবে।
তোমার কাছে কী আছে যে তোমাকে থামাতে বলবে?
যারা ওরকম করে তারা কি কোনও বাছবিচার করে! আমাকে বলবে সারাদিন কী কামিয়েছ বার করো। মদের টাকা কম পড়েছে। দিলে ভালো, না দিলে হয়তো পেটে ভোজালি ঢুকিয়ে দেবে।
বিতর্কিতার শরীর শিরশির করছিল। কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না, তার আগেই অবশ্য পৌঁছে গেল গজপতি শর্মার বাড়ির সামনে।
গিয়ে দেখল, ঠিক আগের দিনের মতোই বাড়ির সামনে বেশ ভিড়। বাড়ির গেটে তালা ঝুলছে, আর গেটে লতপত করে উড়ছে একটা কাগজ, তাতে লেখা, ‘সব অভিযোগ ফল্স।’
৫.
কিন্তু ঘটনা ঘটতেই থাকে, ঘটনার পিছু পিছু হাঁটে অভিযোগ। রাজবাড়িতে যে কোনও ঘটনা ঘটলেই তা ভাইরাল হয়ে যায় শহরের অলিতে গলিতে। একসময় তা পৌঁছে যায় বিতর্কিতার কাছেও। রাজবাড়িতে কখন কী হয়, কোন ডাল থেকে পাতা খসে পড়ল, কোন ডালটাই বা পড়ো-পড়ো, কোন ডালটা শুকিয়ে আসছে, কোন ডালে কী পাখি বসে, কোন ডালে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠছে কোনও বিষধর সাপ, তক্ষক কতবার ডাকল!
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে, হঠাৎ তক্ষকের ডাক বেড়ে গেছে ভয়ঙ্করভাবে। সেই ডাক অনুসরণ করে ভিড় জমছে রাজবাড়ির সামনে। সবাই দেখছে বড়ো বড়ো ডাল থেকে ঝুলছে নিত্যনতুন লাশ। তার মধ্যে মেয়েমানুষের লাশই বেশি। লোকে যথারীতি ভিড় করে দেখতে যাচ্ছে লাশগুলি। কেউ অবাক চোখে, কেউ ভয়ের চোখে, কেউ রাগের চোখে দেখতে লাগল লাশগুলো। একটু পরেই জানাজানি হয়ে যায় কাদের বাড়ির লাশ, কেনই বা বেঘোরে ঝুলতে হচ্ছে প্রধান রাস্তার পাশে। আবার অনেক লাশের পরিচয় জানাও যাচ্ছে না। তারা পরিচিত হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ নামে।
ঘটনাটা এমন ঘন ঘন ঘটতে লাগল, এত এত লাশ ঝুলতে লাগল বটবৃক্ষের ডালে যে রাজবাড়ি ক্রমে উচ্চারিত হতে লাগল লাশবাড়ি নামে।
ঘটনা পরম্পরায় আলোচিত হচ্ছে প্রতিবারই লাশগুলির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে গজপতি শর্মার নাম। ভিড় জমছে গজপতি শর্মার বাড়ির সামনে। গজপতি শর্মার ঘন ঘন ছবি বেরোচ্ছে সংবাদপত্রে। কখনও তার হাসি-হাসি মুখ, কখনও গম্ভীর, কখনও রাগত অভিব্যক্তি। যত ছবি বেরোচ্ছে, তার নাম তত আলোচিত হচ্ছে জনসাধারণের মধ্যে। কেন ছবি বেরোচ্ছে তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ছবি বেরোলেই এখন মানুষ বিখ্যাত হয়।
গজপতি শর্মার বাড়ির সামনে এখন জবরদস্ত ভিড়। সবাই গজপতি শর্মাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। কিন্তু গজপতি শর্মা ভিতরে অন্তরীণ। শুধু একই নিয়মে গেটের বাইরে লটকে দিচ্ছেন ‘সব ঘটনাই ফল্স’।
৬.
ভিড় এড়াতে বিতর্কিতা ঘন ঘন ছুটে যায় আরণ্যকে, সবুজের মধ্যে খুঁজে পেতে চায় একটু মনের আরাম। আরণ্যকের বাসিন্দাদের খোঁজখবর নেয়, দেখে আরণ্যকের ভিতর পৌঁছোয় না রাজবাড়ির লাশের গন্ধ। বরং দেখতে পায় পুষ্করিণীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কলাবতী লাল টুকটুকে ফিতে মাথায় বেঁধে বাড়িয়ে দিচ্ছে তার সবুজ হাত, আর এক বুক জলে দাঁড়িয়ে সরসিজ হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইছে কলাবতীকে।
ওদিকে মন্দার তার বিশাল শরীর নিয়ে তাকিয়ে দেখছে আকাশে মেঘের আনাগোনা, তার কোমরের কাছে শিউলি দাঁড়িয়ে দু-হাত বাড়িয়ে বলছে, আমাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না! একটু তাকাও। তোমাকে কতক্ষণ ধরে ডাকছি!
এক চোখ বিস্ময় নিয়ে বিতর্কিতা দেখতে থাকে আরণ্যকের গহনে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে কত ভাব-ভালোবাসার লীলা। কতজনের কত রকম উচ্ছবাস, আনন্দ। তাকে উজ্জীবিত করে রাখে এইটুকু সুখানুভূতি।
কিন্তু আরণ্যক থেকে বেরিয়ে রাজবাড়ির সামনে এলেই অদ্ভুত মন খারাপ। শরীরের ভিতর বিজিবিজ করতে থাকে হাহাকার আর হাহাকার। রোজই কিছু না কিছু ঘটতে থাকে, রোজই এক অনন্ত মন খারাপ।
কিন্তু সেদিন যা ঘটল তা খুবই অদ্ভুত। দেখলে রাজবাড়ির সামনে খুব ভিড়। না, কাউকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যায়নি সেদিন। বরং মস্ত কাণ্ডটার পাশে একজন প্রৌঢ় পড়ে আছে মুখ থুবড়ে। পরনে ধবধবে ধুতি ও নীলচে পাঞ্জাবি। তার গায়ে-পায়ে-মাথায় লেগে আছে রক্ত। একজন দুজন করে পথচারী মানুষ পথে যেতে যেতে দাঁড়াচ্ছে দু-দণ্ড, দেখছে, আহা উহু করছে, আবার চলে যাচ্ছে যেখানে যাওয়ার। কেউ বলছে, আহা, লোকটাকে খুন করল এভাবে!
বিতর্কিতা চলে যেতে পারল না, সে এগিয়ে গেল লোকটির কাছে, দেখল লোকটিকে নৃশংসভাবে মারা হয়েছে সারা শরীরে। একেবারে মরেনি, এখনও শ্বাস পড়ছে একটু একটু।
বিতর্কিতা চেষ্টা করল লোকটির পরিচয় জানতে। কিছু লোক চলে যাচ্ছে, আবার আশেপাশে কিছু লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। তাদের অবিরল কথোপকথন থেকে অনায়াসে জানা যায় কোথাকার লোক, কী বৃত্তান্ত। ভিড়ের মানুষ কত কিছু জানে।
ইস, কী মার মেরেছে লোকটাকে!
মেরেছে মানে! একেবারে মেরে ফেলতেই চেয়েছিল, কিন্তু কেন যেন মরেনি।
এমন মার মেরেছে ভেবেছে মরেই গেছে নিশ্চয়। তাই এখানে ফেলে রেখে চলে গেছে।
কে লোকটা চিনিস?
একজন ব্যবসায়ী চেহারার লোক বলল, কলেজের মাস্টারমশাই। রোজ দশটার সময় বাস ধরে যান দেখেছি।
হাই পাওয়ারের চশমা পরা একজন বলল, হ্যাঁ। শুনেছি খুব প্রতিবাদ করেন।
বিতর্কিতা তাকিয়ে দেখল লোকটিকে।
কিন্তু লোকটা বেঁচে আছে তো! হাসপাতালে না নিয়ে গেলে নির্ঘাত মরে যাবে!
ও বাবা, কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। গজপতি শর্মার হাত আছে এর পিছনে।
বিতর্কিতা তাদের কথার মধ্যে এগিয়ে বলল, যার হাতই থাকুক, তাই বলে একজন লোকের প্রাণ বাঁচাবেন না! দেখুন দেখি একটা গাড়ি পাওয়া যায় কি না।
প্রধান রাস্তার উপর কোনও না কোনও গাড়ি চলছে অষ্টক্ষণ। একজন গিয়ে নিয়ে এল গাড়িটা।
অন্যদের সঙ্গে ধরাধরি করে বিতর্কিতা সংজ্ঞাহীন লোকটাকে তুলল গাড়িতে, বলল, আপনারা দু-তিনজন চলুন। আমিও সঙ্গে যাব।
যাব-না যাব-না করেও বিতর্কিতার তাড়ায় দুজন লোক উঠে পড়ল গাড়িটাতে। তিনজনে মিলে লোকটাকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিল হাসপাতালে।
বিতর্কিতার কাজ ওখানেই শেষ হল না, বিষয়টা নিয়ে খোঁজখবর নিতে চলল গজপতি শর্মার বাড়ি। গিয়ে দেখল, গেটের উপর লতপত করে উড়ছে একখণ্ড কাগজ, তাতে লেখা, ‘গিলি গিলি গিলি ভেলকি’।
৭.
বহু বছরের প্রাচীন বটবৃক্ষ ক্রমে চিহ্নিত হতে থাকে নানা অসদাচারের কেন্দ্র হিসাবে। দিনের বেলা সরগরম থাকে রাস্তার চলমান যানবাহনের শব্দে। কিন্তু যত রাত হয়, নানা অন্ধকারের মানুষ এসে গা ঢাকা দেয় রকমারি ঝুরির আড়ালে। অজস্র কাণ্ডের মধ্যে বিচরণ করে রকমারকম উদ্দেশ্য নিয়ে।
কখনও টাকা লেনদেন হয়, কখনও পাচার হয় নারী ও শিশু, কখনও ধর্ষণ। সারাক্ষণ ফিসফাস শব্দে ছমছম করতে থাকে রাজবাড়ির চত্বর।
এরকমই একদিন রাতের বেলা কিছু অন্ধকার মানুষ এসে হাজির হল বটবৃক্ষের নীচে। তাদের ঝোলায় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সেই টাকা লেনদেন হল রাতের অন্ধকারে। বহু টাকা ভাগ ভাগ করে চলে গেল অন্যদের ঝোলায় ঝোলায়। টাকার পরিমাণ ঢের। কেউ কেউ এত টাকা কোথায় রাখবে ভাবতে গিয়ে আবিষ্কার করল এক অভিনব পন্থা। বটবৃক্ষের গুঁড়িতে থাকে অনেক ফোকর, তারই একটায় টাকার বাণ্ডিল রেখে হাওয়া হয়ে গেল নিরাপদ জায়গায়। পরে সুবিধামতো সময়ে এসে নিয়ে যাবে নিজের হেপাজতে।
তাদের মধ্যে একজন দামি শার্ট-ট্রাউজার্স পরা যুবক কোনও ফোকরে রেখে ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারল না! তার তো অনেক টাকা, ভাবল আরও অনেকেই টাকা রাখতে আসে এখানে, তাদের কারও চোখে পড়লে নিশ্চিত খোয়া যাবে টাকাটা। তার চেয়ে এত-এত কাণ্ড, তাদের কোনও একটি কাণ্ডের গোড়ায় যদি পুঁতে রেখে যাওয়া যায়, তবে একশোভাগ নিশ্চিন্দি।
যুবকটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল একটা খুপরি কোদাল, রাতের অন্ধকারে কোনও একটা কাণ্ড বেছে নিয়ে তার গোড়ায় গর্ত করে টাকাটা রেখে মাটি চাপা দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। নাহ্, কারও ক্ষমতা নেই এই টাকা খুঁজে পায়।
রাজবাড়ির কোণে-খোঁচড়ে এভাবে টাকা রাখারাখি চলতে থাকে কেননা এখানে রাখলে কারও মনের গোপন কোণের বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হবে না।
দামি শার্ট-ট্রাউজার্স পরা যুবকটি তখন এত টাকা রোজগারে ব্যস্ত যে, বটবৃক্ষের কাছে আসার সময় পাচ্ছিল না! বেশ কিছুকাল পরে সময় পেতে এক গভীর রাতে গাড়িতে চড়ে এসে হাজির হল সেই কাণ্ডটির গোড়ায় যেখানে রেখে গিয়েছিল টাকাটা। কী আশ্চর্য, কিছুতেই মনে করতে পারছিল না ঠিক কোন কাণ্ডটার গোড়ায় পুঁতেছিল টাকাটা! তার হাতের ব্যাগ থেকে খুপরি কোদাল বার করে ঘুরতে লাগল এক কাণ্ড থেকে আর এক কাণ্ডে। কিন্তু কোথায় সেই কাণ্ড যার গোড়ায় খুঁড়ে রেখেছিল! যুবকটি খুঁজে চলেছে, খুঁজেই চলেছে।
ইতিমধ্যে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় কাণ্ডের গোড়াগুলো ভিজে, স্যাঁতসেতে। চারপাশে সোঁদা গন্ধ ঠোনা দিচ্ছে নাকের লতিতে, তার মধ্যে খুপরি নিয়ে এক অবসন্ন যুবক ঘুরছে ফিরছে এক কাণ্ড থেকে আর এক কাণ্ডে।
প্রায় শেষরাতের দিকে, যুবকটির আশা যখন শেষ, অবসন্ন শরীরে ধুঁকছে রুগ্ণ কুকুরের মতো, সেসময় হঠাৎ একটা চিহ্ন চোখে পড়তে লাফিয়ে উঠে বলল, পেয়েছি।
তাড়াতাড়ি কাণ্ডের গোড়ায় বসে, খুপরি পর খুপরি চালিয়ে, জায়গাটা খুঁড়ে বার করে ফেলল সেই বাণ্ডিলগুলো। বহুদিন মাটির তলায় বাস করে, বৃষ্টির জলে ভিজে কীরকম স্যাঁতসেতে হয়ে গেছে টাকার বাণ্ডিল, তবু রাতশেষের আঁধারের মধ্যে কাঁধের ব্যাগটা ভরে ফেলল বাণ্ডিলে বাণ্ডিলে। তারপর গোড়াটা আবার বুজিয়ে দিয়ে উঠে বসল গাড়িতে।
তার গন্তব্য আরণ্যক পেরিয়ে আরও দূরের একটা শহরে, যেখানে তার টাকার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় আছে। কিন্তু আরণ্যকও পেরোতে পারেনি হঠাৎ কাঁধের কাছে কী যেন বিড়বিড় করছে দেখে গাড়ি থামিয়ে দেখল কাঁধের ঝোলাটা। আঁতকে উঠে দেখল তার ঝোলা থেকে বেরিয়ে কাঁধে, কাঁধ থেকে মাথায়, বুকের উপর, সারা শাট জুড়ে, শার্ট থেকে নেমে প্যান্টের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে উঁইপোকা।
যুবকটি লাফিয়ে নামল গাড়ি থেকে, দেখল অন্ধকারের মধ্যে ঠিক বুঝতে পারেনি, বর্ষার ধারানি পেয়ে উঁই ধরেছে সমস্ত বাণ্ডিলগুলোয়। একটি বাণ্ডিলও আর আস্ত নেই।
সঙ্গে সঙ্গে আরণ্যকের ধারে গিয়ে দ্রুত হাতে একটা একটা করে বাণ্ডিল ছুড়ে দিতে লাগল আরণ্যকের সর্বত্র।
তারপর নিজের পোশাকটাও উঁইমুক্ত করে ফিরে চলল যেখান থেকে এসেছিল গত রাতে।
তার শরীর তখন ঘর্মাক্ত, মন চূড়ান্ত বিপর্যস্ত, একটা অদ্ভুত কাঁপ ধরেছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। গাড়িতে উঠে কোনও ক্রমে ফিরে চলল তার বাড়ির পথে।
৮.
আরণ্যকের কাছে বিতর্কিতা এবার এল বেশ কিছুদিন পর! পেরিয়ে গেছে একটা বা দুটো ঋতু। আরণ্যক তার ফুসফুসে প্রতিদিনই ভরে দেয় অক্সিজেন। ভিতরে ঢুকে আচমকা কী যেন দেখে বিতর্কিতা বিস্মিত, মর্মাহত। বিশাল অর্জুন কীরকম মুষড়ে পড়েছে হঠাৎ। কী কারণে যেন ভীষণভাবে শুকিয়ে গিয়েছে তার শরীর। অকারণে ঝরে যাচ্ছে পাতারা। বিতর্কিতা তার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার?
অর্জুন কিছু বলল না, মাথা নাড়ল অসহায়ভাবে। তার পাশে মহুয়াও তো কীরকম শীর্ণ, মনমরা! ঝিমোচ্ছে একা-একা। মহুয়াকে দু-তিনবার ডেকেও তার সাড়া পেল না!
একবুক মন খারাপ নিয়ে বিতর্কিতা আর একটু এগোতেই দেখল কাঞ্চনের পাতাগুলি কুঁকড়ে আসছে! স্বর্ণলতার সেই উপচে পড়া যৌবন আর নেই। শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে স্বর্ণলতা। অপরাজিতার দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না! একেবারে নেতিয়ে পড়ে আছে মাটিতে।
বিতর্কিতার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল! খাঁ খাঁ করছে শরীরের ভিতরটা। আরও একটু এগিয়ে দেখল অমন বিশাল শাল্মল আর আগের মতো ভূজপ্রাংশু নয়, খসে খসে পড়ছে তার পাতাগুলি। শুকনো পাতার রাশ ছড়িয়ে রয়েছে তার নীচে। পাশে দাঁড়ানো শ্রেয়সীর মুখ শীর্ণ, ফ্যাকাসে।
বিতর্কিতা এতসব দৃশ্য দেখছে আর দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করছে আরণ্যকের কাছে উত্তরের খোঁজে। আরণ্যক, কী হল তোমার? কে এমন হতশ্রী দশা করল তোমার?
আরণ্যক নিজেই আজ শোকার্ত, হতচকিত। তার ভিতরের সত্তাটা আজ কেউ নাড়িয়ে দিয়েছে প্রবলভাবে। উত্তর দেওয়ার শক্তিই নেই তার।
বিতর্কিতা তাকায় আরণ্যকের মধ্যে এক বুক টলটলে জল নিয়ে সারাক্ষণ জেগে থাকা পুষ্করিণীর দিকে। একমাত্র সরসিজ শরীর টানটান করে একই ভঙ্গিতে কোমর ডুবিয়ে পুষ্করিণীর জলে। কিন্তু ডাঙায় দাঁড়ানো কলাবতীর এ কী হাল! তার পরনের সবুজ আজ হলুদ। ঠোঁটে রং নেই। বিবর্ণ কলাবতী চুপসে ঢলে পড়েছে সামনের মুথাঘাসের উপর।
বিতর্কিতার বুকের ভিতর নিঃশব্দ আর্তনাদ। কোথায় গেল জবা, মল্লিকারা? কোথায় গেল মিষ্টি হাসি মুখের জুঁই? ছোট্ট ছোট্ট প্রাণগুলি বাতাসের সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে শরীরে নাচন তুলবে বলে অপেক্ষায় ছিল, তাদের তো কোনও চিহ্নমাত্র নেই!
বিতর্কিতা ছুটে গেল শিশুকে দেখতে। এ কী দেখল সে! শিশুর চাউনিতে শূন্যতা আর শূন্যতা।
আর ও মন্দার, তুমি কেন আজ এমন নিরুত্তর! তোমার শরীরে কেন নেই সেই জৌলুষ! তোমার ঠোঁটে নেই কেন সেই ভুবন-ভোলানো হাসি!
বিতর্কিতা বুঝে উঠতে পারে না তার সাধের আরণ্যকের কেন এই জীর্ণ, দীর্ণ, বিশীর্ণ দশা!
বিতর্কিতা খুঁজতে থাকে আঁতিপাতি করে কেন সবুজ, ঝলমলে পত্রপুষ্পশোভিত আরণ্যক আজ ধুঁকছে এমন ভয়ঙ্করভাবে!
৯.
বিতর্কিতার রাতে ঘুম আসে না চোখে। তার একটা পৃথিবী ছিল সবুজ, সুন্দর, সাবলীল। সেখানে কোনও অসুন্দরের বসতি ছিল না! কে সেই দৈত্য যে মাত্র কিছুকালের মধ্যে তছনছ করে দিয়েছে এক রূপবানের গোটা অস্তিত্ব।
কয়েকদিন শহরের মধ্যে ছটফট করে ঘুরে বেড়াল বিতর্কিতা। তার গলার কাছে আটকে থাকে একটা দলার মতো। সারাক্ষণ খচখচ। বুকের গোড়ায় চিনচিন। কাকেই বা বলবে তার এই ব্যথাবেদনার কথা।
কিন্তু দিনের পর দিন নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতে পারল না, আবার একদিন সকালে উঠে পৌঁছে গেল আরণ্যকের কাছে। যাওয়ার পথে কী জানি কেন, তার খুব মন খারাপ। গিয়ে কী দেখবে কী জানি!
আরণ্যকের কাছে গিয়ে দেখল, উফ, এ কী দৃশ্য! তার বুক ভেঙে একদম চুরমার। আরণ্যকের বহু বাসিন্দাই মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটির উপর। যারা তখনও দাঁড়িয়ে, কীরকম কুঁকড়ে, দোমড় হয়ে ধুঁকছে। যেন যে কোনও মুহূর্তেই হুড়মুড় করে আছড়ে পড়বে সমূলে।
বিতর্কিতা দিশেহারা। বিতর্কিতা থরথর করে কাঁপছে আরণ্যকের সামনে দাঁড়িয়ে। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হতে চাইছিল আর্তনাদ, কিন্তু কোনও স্বরই বেরোতে পারল না। শুধু দেখল গোটা আরণ্যক জুড়ে শুধু উঁই আর উঁই। লক্ষ লক্ষ, না কি কোটি কোটি উঁইপোকা থিকথিক করছে আরণ্যকের সারা শরীরে। একজন বাসিন্দাও জীবিত নেই আর।
যা ছিল সবুজ, সুন্দর, সদাহাস্যময় তা আজ মরুভূমি।
কিন্তু যার কারণে আরণ্যকের এই অবস্থা, সেই বটবৃক্ষের কী অবস্থা!
বিতর্কিতা পায়ে পায়ে এগোয় আরণ্যকের অদূরে বটবৃক্ষের বিশাল, রাজকীয় উপস্থিতির সামনে। স্তম্ভিত হয়ে দেখল তারও রাশি রাশি পাতা কুঁকড়ে এসেছে, শুকিয়ে আসছে তার স্পর্ধিত ডালগুলি। অজস্র ঝুরি শীর্ণকায়। রাশি রাশি কাণ্ড বেষ্টন করে আছে উঁইঢিবিতে। এখন দেখলে আর কাণ্ড মনে হচ্ছে না, বলা যায় উঁইকাণ্ড।
আর স্বয়ং বটবৃক্ষের গোড়ায় বিজবিজ করছে লক্ষ কোটি উঁইপোকা, প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলেছে তাদের সংখ্যা, সেই বৃদ্ধি চক্রবৃদ্ধি হারে, এত দ্রুত সেই বাড়বাড়ন্ত যে, নিশ্চিত হওয়া যায় যে কোনও মুহূর্তে ধসে পড়বে তার আকাশস্পর্শী অহংকার।