আজকে যাঁর স্মৃতি উপলক্ষে আমরা সমবেত হয়েছি, তাঁর পরিচয় অনেকের কাছেই আজ উজ্জ্বল নয়। তাঁর সম্বন্ধে কিছু ব্যাখ্যা করা আবশ্যক। এই প্রসঙ্গে আমাদের প্রথম বয়সের কথা বলি। তখন ভারতের শিল্পকলার নিদর্শনগুলি দেশের মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছিল কিন্তু আমাদের লক্ষ্যের মধ্যে ছিল না। কেননা তাদের ইতিহাস ছিল পূর্বাপরের সূত্রচ্ছিন্ন, অস্পষ্ট, এবং সে-ইতিহাস আমাদের শিক্ষা-বিষয়ের বহির্ভূত। ভারতবর্ষে মোগল রাজত্বকালে, নবাবী আমলে বেগবান ছিল চিত্রকলার ধারা। সে খুব বেশি দিনের কথা নয়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের কালে তার প্রভাব হল লুপ্ত। তার একটা কারণ এই যে, ভারতের চিত্রকলা তখনকার কালের ইংরেজের অবজ্ঞাভাজন ছিল। আমরা ছিলুম সেই ইস্কুলমাস্টারের ছাত্র, তাঁদের দৃষ্টি ছিল আমাদের দৃষ্টির নেতা, তার যা ফল তাই ফলেছিল। সেদিন ভারতীয় শিল্পবিদ্যা ছিল ভারতেরই উপেক্ষার দ্বারা তিরস্কৃত। তখন বনেদী রাজাদের ভাণ্ডারে পূর্বকাল থেকে যে-সব ছবি সঞ্চিত হয়ে এসেছে তার ক্ষতি ঘটলেও সেটা কারো নজরে পড়ত না। তখন বিদেশের যত সব নিকৃষ্ট ছবি বিনা বাধায় ধনীদের ধনগৌরবের সাক্ষী হয়ে তাঁদের প্রাসাদে অভ্যর্থনা পেত।
শিক্ষিতদের কাছে নিজের দেশের শিল্পকলার পরিচয় যখন একেবারেই অন্ধকারে, তখন বিদেশী গুণীদের কীর্তি আমাদের কাছে জনশ্রুতির বিষয় ছিল মাত্র। আমরা সেখানকার নামজাদাদের নাম কীর্তন করতে শিখেছি, তার বেশি এগোই নি। সেই নামাবলী জমা ছিল আমাদের মুখস্থ বিদ্যার ভাণ্ডারে। আমরা বিদেশী ছাপার বইয়ে দেখেছি ছাপার কালিতে সেখানকার শিল্পের প্রতিকৃতি, আর ছাপার অক্ষরে তাদের যাচাই দর। সে-সমস্ত পড়া বুলি ঠিকমতো আওড়ানোই ছিল আমাদের শিক্ষিতত্বের প্রমাণ। বিদেশী বইয়ে বিদেশী ছবির আবছায়া সঙ্গে নিয়ে ভেসে এসেছিল সমুদ্রপারের হাওয়ায় যে গুণগান, বিনা বিচারে বিনা তুলনায় তা আমরা মেনে নিয়েছি; কেননা তুলনা করবার কোনো উপাদান আমাদের কাছে ছিল না। অর্থাৎ রেলোয়ে টাইমটেবিলে চোখ বুলিয়ে যাওয়াতেই ছিল আমাদের ভ্রমণ।
তখন ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে সাহিত্যের অভ্যুদয়। সে কথাও নিজের জীবনের ইতিহাস থেকে বলতে পারি। কাব্যে বাংলা দেশের সাহিত্য থেকে যে প্রেরণা পাব তার পথ ভালো জানা ছিল না।
এমন সময় অক্ষয় সরকার মহাশয় যখন বৈষ্ণব পদাবলী প্রথম প্রকাশ করলেন লুকিয়ে পড়লাম। পড়ে জানলাম যে কাব্যকলা বলে একটি জিনিস বাংলা প্রাচীন কাব্যে আছে। সেদিন সাহিত্যরসের উদ্দীপনা সহজে প্রাণে পৌঁছল। তারি প্রথম প্রবর্তনায় অন্তত আমার সাহিত্য-অধ্যাবসায়কে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে|।
চিত্রকলায় মাতৃকক্ষ থেকে পূজোপকরণ নিয়ে রূপসাধনার পরিচয় আমাদের বাড়িতেই পাই। অবন যখন প্রথম তুলি ধরলেন তিনিও বিদেশী পথেই শিক্ষাযাত্রা আরম্ভ করেছিলেন, ইস্কুলমাস্টারের স্বাক্ষরের মক্সো ক’রে ক’রে।
তখনকার দিনের মডেল-নকল-করা শিল্পবিদ্যাভ্যাস মনে করলে আজ হাসি পায় কিন্তু তখন গাম্ভীর্য ছিল অক্ষুণ্ন। সেই চির-ছাত্রগিরির দুর্দিন আজও হয়তো চলত যদি হ্যাভেল এসে দৃষ্টি না ফিরিয়ে দিতেন। তিনি ফিরিয়ে দিলেন সেই দিকে ভারতীয় রূপকলার যেখানে প্রাণপুরুষের আসন।
সেদিন অবন ও তাঁর ছাত্রেরা শিল্পকলায় আত্মপ্রকাশের আনন্দ-বেদনার প্রথম উদ্বোধন যখন পেয়েছিলেন, দেশে তখনো প্রভাতের বিলম্ব ছিল, তখনো আকাশ ছিল আলো-অন্ধকারে আবিল। তার পূর্বে সীসের ফলকে খোদাই করা ছবি দেখেছি পঞ্জিকায়, আর শিশুপাঠ বইয়ে নৃসিংহ-মূর্তি, আর ষণ্ডামার্কের চিত্র, এমন সময় দেখা দিল রবিবর্মার চিত্রাবলী। মন বিচলিত হয়েছিল সে কথা স্বীকার করি। তারা যে কত কৃত্রিম, তারা যে যাত্রার দলের পাত্রপাত্রীর একশ্রেণীভুক্ত, সে কথা বোঝবার মন তখনো হয় নি। সেই লজ্জাকর অবস্থা থেকে এক দিন যে জাগতে পেরেছি সেজন্যে হ্যাভেলের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি। সেই নৃসিংহ-মূর্তির মধ্যেও সত্য ছিল কিন্তু রবিবর্মার ছবির মধ্যে ছিল না এ কথা বোঝবার পথ তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি।
য়ুরোপের শিল্পকলা গৌরবময় আমি জানি, কিন্তু সে-গৌরব আসল জিনিসে, তার প্রেতচ্ছায়ায় নেই। যে আনন্দলোকে তাদের উদ্ভব তারই আবহাওয়ায় যাদের প্রত্যক্ষ বাস, আনন্দের তারাই পূর্ণ অধিকারী। আমরা জহুরির দোকানে মোটা কাচের আড়ালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছাপানো মূল্যতালিকা হাতে নিয়ে ঢাকাঢুকির ভিতর থেকে যা আন্দাজ করে নিই তাকে কিছু পেলুম বলে কল্পনা করা শোচনীয়। অশ্বত্থামা পিটুলিগোলা জল খেয়ে দুধ খেয়েছি মনে করে নৃত্য করেছিলেন এ বিবরণ পড়লে চোখে জল আসে।
অবন ফিরলেন নকল স্বর্গসাধনা থেকে স্বদেশের বাস্তব ক্ষেত্রে শিল্পের স্বরাজ্য স্থাপন করতে। এ একটা শুভ দিন। তাঁর প্রতিভা দেশ থেকে আহ্বান পেল আর তাঁর আহ্বানে দেশ দিল সাড়া। তিনি জাগলেন বলেই জাগালেন। কিন্তু জাগাতে কত দেরি হয়েছিল সে কথা সকলেরই জানা আছে। শিল্পের সেই নব প্রভাতে চার দিক থেকে ভারতীয় কলাভারতীকে কত অবজ্ঞা কত বিদ্রূপ। অযোগ্য জনতার পরিহাসের খরশর বর্ষণের মধ্যে যাঁরা আপন সার্থকতা আবিষ্কার করলেন তাঁদের ধন্য বলি আর সেইসঙ্গে সমস্ত দেশের হয়ে তাঁকে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করি যিনি তীর্থযাত্রীর সামনে বহুকালের বিলুপ্ত পথকে কাঁটার জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে দিলেন।
সেদিন তাঁরও ছিল না শান্তি। কেননা তাঁর স্বজাতীয়দের মধ্যে অল্প দুই-এক জন মাত্র ছিলেন যাঁরা তাঁর নির্দেশ-পথকে শ্রদ্ধা করতে পারতেন। আর আমাদের দেশের যে-সব ছাত্র শিল্পবিদ্যালয়ে মাথা নিচু করে অনুকৃতির কৃতিত্ব অর্জন করত তারা হায় হায় করে উঠেছিল। ভেবেছিল শিল্পের উচ্চ আদর্শে সম্মানভাজন হবার জন্যে তারা যে অধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত, ইংরেজ গুরুর তা সহ্য হল না, তিনি বুঝি দিশি পোটোর দলেই চিরদিনের জন্যে তাদের লাঞ্ছিত করে রেখে দিতে চান। তাদের দোষ ছিল না, কেননা সেদিন ভারতীয় চিত্র-ভারতীর আসন ছিল আবর্জনাস্তূপে। ঘরে পরে তীব্র বিরুদ্ধতার দিনে হ্যাভেল যে সেদিন অবনের মতো ছাত্র পেয়েছিলেন এরকম শুভযোগ দৈবাৎ ঘটে। যোগ্য ছাত্র আবিষ্কার করতে ও তাঁকে যথাপথে প্রবর্তন করতে যে ক্ষমতার আবশ্যক সেও কম দুর্লভ নয়।
অন্ধকারের ভিতর থেকে যুগ-পরিবর্তন যে হল আজ তার প্রমাণ পাই যখন দেখি শিল্পকলায় নব জীবনের বীজ স্বদেশের ভূমিতেই অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে। এক দিন আমাদের ঘরে আসত পাঠানের দেশ থেকে কাঠের বাক্সে তুলোয় ঢাকা আঙুর– খেতে হত সাবধানে নিজের পকেটের দিকে দৃষ্টি রেখে। দ্রাক্ষালতা যে স্বদেশের জমিতেও সফল হতে পারে সে কথা সেদিন জানাই ছিল না। সেদিনকার আঙুর-ব্যবসায়ীদের অনেক দাম দিয়েছি, আজ যারা এই মাটিতে আঙুর ফলিয়ে তুললেন তাঁরা চিরদিনের জন্য মূল্য দিলেন স্বদেশকে এ কথা যেন মনে রাখি। সব ফলই যে সমান উৎকর্ষ লাভ করবে এ সম্ভব নয় কিন্তু এখন থেকে আপন মাটির উপরে বিশ্বাস রাখতে পারব এইটেই সবচেয়ে বড়ো কথা। সে কথাটিকে প্রথম সম্ভাবনা দিয়েছেন যিনি তাঁকে আজ নমস্কার করি। ভূমিকার প্রতি পরিশিষ্টের অশিষ্টতার প্রমাণ পদে পদে পেয়ে থাকি সেই অকৃতজ্ঞতার দুর্যোগকে যথাসাধ্য দূরে ঠেকিয়ে রাখবার অভিপ্রায়ে আজ আমাদের আশ্রমে হ্যাভেলের স্মৃতিমন্দির প্রতিষ্ঠা করলুম। যাঁরা আজ এই অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধার সঙ্গে যোগদান করলেন সেই সহৃদয় বন্ধুদের আমার অভিবাদন জানাই।
প্রবাসী, মাঘ, ১৩৪৫