ঈশ্বর যখন বন্দি – ৪

কেলি যখন বাড়ি ফিরল তখন দুপর তিনটে বেজে গেছে। সেই ব্রেকফাস্টের পরে কেলির পেটে আর কিছুই পড়েনি, অন্যদিন হলে ওর মাথা গরম হয়ে যেত, কিন্তু আজকের কথা আলাদা। অন্তত বাবাকে আজ ও এটা বোঝাতে পেরেছে যে দাদু বা বাবার মতো না হলেও সে কিছু কম যায় না। এই তৃপ্তিতেই আনন্দে ওর গলায় গান চলে আসছিল।

হালকা শিস দিতে দিতে যখন বাড়ি ঢুকল, প্যাট্রিক তখন অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে চেয়ারে হেলান দিয়ে। কেলি ওকে জাগাল না। আগে পেটটাকে ভরতি করা জরুরি, তারপর কাজ। এমনিতে ও স্যান্ডউইচ আর স্যালাড দিয়েই লাঞ্চ সারে, কিন্তু আজকের কথা আলাদা।

কেলি রেফ্রিজারেটর থেকে মস্ত বড়ো একটা চিকেন রোস্ট আর একটা পুডিং—এর বাটি বের করল। ইয়র্কশায়ার পুডিং কেলির সবথেকে প্রিয়। কিন্তু পুডিং—এর বাটিটায় এরকম খাবলা করে গর্ত হল কী করে! ও নিজে তো একটুও খায়নি? খুঁতখুঁতে মনে ডাইনিং—এ গিয়ে সকালের বেঁচে যাওয়া টোস্টগুলোকে গরম করল কেলি। তারপর সেদ্ধ সবজির ডিশটা নিয়ে আনন্দে খেতে বসল। রোস্টটায় সবে একটা কামড় বসিয়েছে, এমন সময় প্যাট্রিক চোখ কচলাতে কচলাতে ডাইনিং—এ এল, ‘কখন এসেছি, তোমার তো কোনো পাত্তাই নেই!’

কেলির মুখটা বিরক্তিতে বেঁকে গেল। আরেকটু ঘুমোতে পারল না! যেই কামড়টা বসাল, অমনি হাজির হয়ে গেল।

মুখে বলল, ‘বোসো। সিঙ্ক থেকে একটা ডিশ ধুয়ে নিয়ে লাঞ্চ করো আমার সঙ্গে।’

প্যাট্রিক বলল, ‘না না, আমার লাঞ্চ হয়ে গেছে। রাস্তায় স্যান্ডউইচ খেয়েছিলাম, এখানে এসে তোমার ফ্রিজ থেকে জুস আর একটু পুডিং খেলাম। বলো, হঠাৎ জরুরি তলব কেন?’

কেলি সরু চোখে তাকাল। অন্য সময় হলে দু—চার কথা শুনিয়ে দিত, আজ আর কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘আগে তোমার আপডেট দাও।’

প্যাট্রিক বলল, ‘আপডেট আবার কীসের! পুলিশ লেগেছে পেছনে। ক—দিন সেন্ট্রাল লন্ডনের একটা জায়গায় লুকিয়ে ছিলাম। আজ ডাকলে, তাই আসতে হল।’

কেলি এক টুকরো পুডিং মুখে পুরে বলল, ‘হুম। আর কিছুদিন থাকো। আমি জাল গুটিয়ে এনেছি প্রায়।’

প্যাট্রিক বলল, ‘ড্যামফ্রেসশায়ারের বইটা ক—নম্বর?’

কেলি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বই আবার কী? এই ক—দিন আগে এত বিশদে বোঝালাম তোমায়, এরপরও বই বল কী করে? তেঞ্জ্যুর ওটা।’

প্যাট্রিক বলল, ‘ও হ্যাঁ, তেঞ্জ্যুর। ক—নম্বর এটা?’

কেলি বলল, ‘এটা তিন নম্বর। আর এটাই শেষ।’

প্যাট্রিক বলল, ‘বুঝলাম। এবার বলো আমায় কী করতে হবে।’

কেলি অরেঞ্জ জুসের জাগটা নিয়ে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলল, ‘বিশেষ কিছু নয়। আমার সঙ্গে ক—দিনের জন্য একটা জায়গায় যেতে হবে তোমায়।’

‘কোথায়?’

‘মার্কের কাছে।’

প্যাট্রিক ভ্রূ তুলে বলল, ‘মার্কের কাছে? মানে সেই ভুটান? ওখানে গিয়ে আমি কী করব?’

কেলি গ্লাসে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে হেলান দিল চেয়ারে, ‘জাল প্রায় গুটিয়ে এনেছি। শেষ সময়ে তোমাকে কাজে লাগতে পারে। তোমার পাসপোর্টটা আমাকে দিয়ে যেয়ো, ভিসা বা অন্যান্য সমস্ত ব্যবস্থা করতে হবে। সামনের সপ্তাহেই স্টার্ট করব আমরা।’

প্যাট্রিক বলল, ‘সামনের সপ্তাহে? কিন্তু এ মাসের শেষেই তো অ্যালফ্রেড আঙ্কল ছাড়া পাচ্ছে। তুমি থাকবে না?’

কেলি মিটিমিটি হাসল, ‘ওইজন্যই তো এত তাড়াহুড়ো। বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। তার আগে ফিরে আসব, আর হ্যাঁ একটা কথা মনে রাখবে আমি কিন্তু তোমার বস। অন্য কারুর কথা তুমি ওখানে গিয়ে কখনোই শুনবে না, সে যে—ই হোক না কেন!’

সকাল ন—টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে রুদ্ররা লুংদোপেদরির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে নরবু আর জিগমে ছাড়া রয়েছে নরবুর বন্ধু ওয়াংচুকের বোন চিমি, ওদের বাড়িতেই রুদ্ররা রয়েছে। চিমি মেয়েটি খুব হাসিখুশি, এসে ইস্তক ওদের খাতির যত্নে কোনো ত্রুটি রাখছিল না। ওরা লুংদোপেদরি যাবে শুনে নিজে থেকেই সকালে জিজ্ঞেস করেছিল ও যেতে পারে কি না। নরবু বলেছিল, ‘ম্যাডাম, চিমির সঙ্গে ওখানকার প্রধান লামার খুব ভালো পরিচয় আছে। ও আগে প্রায়ই ওখানে যেত। ওকে নিয়ে গেলে স্যারের কাজের আরও সুবিধা হবে। লুংদোপেদরি খুব জাগ্রত মনাস্টারি, লামাজিরা বাইরের কাউকেই ঢুকতে দেন না ওখানে, আমরা নিজেরা গেলে বাইরে থেকে দেখেই চলে আসতে হবে। ও গেলে ভেতরে যাবার সুযোগ হলেও হতে পারে, ম্যাডাম।’

রুদ্র জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না কেন?’

নরবু চাপা গলায় বলেছিল, ‘লুংদোপেদরি মনাস্টারির লামারা খুব গোপনে থাকতে পছন্দ করেন, ম্যাডাম। আর এমনিতেই এতটা রিমোট জায়গায়। ওখানকার লামারা তো শুনেছি তন্ত্রের সাধনা করেন, কোনো সাধারণ মানুষ ওখানে যাবার অনুমতি পায় না। তবে মাঝে মাঝে কাছাকাছি গ্রামে কোনো মহামারি বা কঠিন রোগ ছড়িয়ে পড়লে ওঁরা মন্ত্রবলে সারিয়ে দিতে পারেন, এরকমই শুনেছি। বহুদিন অবধি তো সাধারণ মানুষ ওদিকে যেতেই ভয় পেত। মাঝে তবু একটু যাওয়া আসা হত চিমি বলছিল, এখন তো একদমই বন্ধ।’ একটু থেমে যোগ করল, ‘এই চিমির ছোটোবেলায় একটা খুব বড়ো অসুখ হয়েছিল, তখন ওই লুংদোপেদরি মনাস্টারির এক লামা ওকে সারিয়ে দিয়েছিলেন, সেই থেকে উনি ওকে মেয়ের মতো দেখেন। তাই বলছি, ও গেলে আপনাদের হয়তো সুবিধা হবে।’

রুদ্র বলেছিল, ‘ভালোই তো। চিমি চলুক না।’

সুন্দর রোদ উঠেছে, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো কিউমুলাস মেঘ পায়চারি করছে। ঠান্ডা খুবই, পাঁচের নীচে হবে তাপমাত্রা, তবু এই রোদের আমেজটা থাকার জন্য ওদের বেশ ভালোই লাগছিল। হোটেলের ঘর থেকে লুংদোপেদরি দূরে দেখা গেলেও গাড়িতে যেতে লাগবে প্রায় আধ ঘণ্টা। রুদ্র সামনে জিগমের পাশের সিটে বসেছিল, কোলে বাইনোকুলারটা। কাল রাতের ঘটনাটা ও কাউকেই বলেনি, এমনকী প্রিয়মকেও নয়। নিবিষ্ট মনে মোবাইলে খুটখাট করছিল। নরবু ওকে এখানকার একটা সিম ক—দিনের জন্য জোগাড় করে দিয়েছিল, সেটা দিয়েই ইন্টারনেটে মগ্ন হয়ে কীসব দেখছিল।

পেছনের সিটের একপাশে চিমি বসে ছিল, মাঝে নরবু, তার পাশে প্রিয়ম। চিমি মেয়েটিকে দেখতে ভারি মিষ্টি। কুড়ির নীচেই হবে বয়স, রোগাটে গড়ন, পাটের মতো সোজা লম্বা সিল্কি গাঢ় খয়েরি রঙের চুল, ছোটো ছোটো সুন্দর করে কাজল—পরা চোখ, পরনে এখানকার পোশাক কিরা। এখানকার মেয়েরা ভীষণ কর্মঠ আবার একইসঙ্গে সাজগোজে সচেতন। হোটেলের দায়িত্ব থেকে শুরু করে অধিকাংশ দোকানেরই দায়িত্বে মেয়েরা কিন্তু প্রত্যেকেই সুন্দর করে সেজে রয়েছে, এমন কাউকেই রুদ্র দেখেনি যে আলুথালু বা বিস্রস্তভাবে রয়েছে। প্রত্যেকের চোখ সুন্দর করে আঁকা, চুল থেকে শুরু করে প্রতিটি অঙ্গই সযত্নে লালিত।

প্রিয়ম বলল, ‘নরবু, এখানে তো মানুষজনই দেখতে পাচ্ছি না। তুমি যে বললে কী—একটা ফেস্টিভ্যাল হয় মে মাসে, কারা করে সেটা? লোকই তো খুব কম।’

নরবু হাসল, ‘ওই যে বললাম স্যার, বজ্রপাণি ঠাকুরের পুজো হয়।’

প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘বজ্রপাণি কীসের ঠাকুর?’

নরবু মাথাটা একটু চুলকে বলল, ‘অত জানি না, স্যার। তবে একটা গল্প শুনেছিলাম ওয়াংচুকের কাছে। অনেককাল আগে এইখানে এক মহিলা তাঁর বাড়ির উঠোনে বসে ছিলেন। এক লামা এসে তাঁর কাছে জল খেতে চান। ওই মহিলা ভেতরে গিয়ে জল তুলে নিয়ে আসার পর দেখে, লামাজি নেই, একটা থলে রেখে গেছেন, তার মধ্যেই ছিল এই বজ্রপাণি ঠাকুরের মূর্তি। ওই মহিলার উত্তরসূরিরাই ওই উৎসবের মূল দায়িত্বে থাকেন।’ বলে ও চিমির দিকে ফিরল, ‘কি ঠিক বলছি তো চিমি?’

চিমি মৃদু হেসে সায় দিল, ‘হুম! তবে আমরা আরেকটা দিকও মানি। ”ইয়াক” মানে চমরী গাইদের থেকে ইয়াকচো উৎসবটার শুরু, ওদের ওইসময় পুজোও করা হয়।’

কথায় কথায় পাকা রাস্তা ছেড়ে ওদের জিপ ভ্যালির দিকে টার্ন নিয়েছে। দু—একটা ছোটোখাটো পাহাড় পেরোনোর পর একটা তিব্বতি গ্রাম পড়ল। সাকুল্যে মনে হয় দশটা পরিবারের বাস সেখানে।

কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে জিপের শব্দ শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এল।

গ্রামটা শেষ হতে একটা জঙ্গল পড়ল, খুব ঘন নয়, তবে মানুষের পায়ে—চলা পথের দাগ রয়েছে। জঙ্গলটাকে বাঁ—পাশে রেখে ওদের জিপ ছুটে চলছিল। আরও মিনিট দশেক চলার পর রাস্তা আরও সরু হয়ে এল।

জঙ্গল শেষ হতে একটা সমতল জায়গা এল। চিমি স্থানীয় ভাষায় কিছু একটা নির্দেশ দিতে জিগমে জিপটা দাঁড় করাল। রুদ্র জিজ্ঞাসু চোখে চিমির দিকে তাকাতে চিমি মিষ্টি হেসে বলল, ‘লুংদোপেদরি অনেকটা ভেতরে। অতটা তো গাড়ি যায় না। আপনাদের ভ্যালির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হবে।’

জিগমে গাড়ির মধ্যেই বসে ছিল, রুদ্র গিয়ে ওদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলতে রাজি হয়ে গেল। নির্জন জায়গাটা গাড়িটাকে রেখে ওরা পাঁচজন হাঁটতে শুরু করল। ওদের মধ্যে একমাত্র চিমি—ই রাস্তা চেনে, ও—ই আগে আগে চলল। রুদ্র চুপচাপ প্রিয়মের পাশাপাশি হাঁটছিল। কাল রাতে ভ্যালিটা যে এতটা সুন্দর সেটা ও বুঝতে পারেনি। পা দিয়ে হাঁটতেও যেন সংকোচ হচ্ছে নোংরা হয়ে যাওয়ার ভয়ে। সুদূরবিস্তৃত মসৃণ সবুজ জনহীন উপত্যকা, মাঝেমধ্যে কিছু বুনো ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে। উপত্যকা থেকে ঢালু হয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়ের কচি ঘাস খাচ্ছে তারা।

কিছুটা দূর গিয়ে মাটি ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে। দু—পাশে নাম—না—জানা বুনো রঙিন ফুল ফুটে রয়েছে, কিন্তু বুনো ফলের গাছও চোখে পড়ল।

প্রিয়ম বিস্ময়ে পুরো বাকরুদ্ধ। ক্যামেরার শাটার বাটনটাই না খারাপ হয়ে যায় ওর ছবি তোলার চাপে। একবার ফুলের ছবি তুলছে তো পরমুহূর্তেই রুদ্রর দিকে ফোকাস করছে। রুদ্র বেশ সুন্দর করে দাঁড়িয়ে একটা পোজ দিতে প্রিয়ম দারুণ খুশি। রুদ্র হেসে চিমির দিকে ফিরল, ‘চিমি, লুংদোপেদরি এত ভেতরে কেন? এত রিমোটে তো অন্য মনাস্টারিগুলো নয়?’

চিমি বলল, ‘এই গুম্ফা বহু, বহু পুরোনো, ম্যাডাম। গুরু রিনপোচে নিজে এটা তৈরি করেছিলেন।’

রুদ্র বলল, ‘গুরু রিনপোচে মানে পদ্মসম্ভব? উনি নিজে তৈরি করেছিলেন।’

চিমি একটু অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি ওঁর নাম জানেন? হ্যাঁ ম্যাডাম, আমরা ভুটানিরা ওঁকেই বুদ্ধ বলে মানি। প্রায় তেরোশো বছরের পুরোনো এই গুম্ফা। এত প্রাচীন গুম্ফা আর নেই বললেই চলে ভুটানে। কিন্তু এটার খোঁজ পাওয়া গেছে মাত্র পাঁচশো বছর আগে এক পুথিতে। গুরু রিনপোচে এখানে প্রচুর গোপন সম্পদ এবং পুথি নাকি লুকিয়ে রেখেছিলেন। একজন মহালামা এটি পুনরাবিষ্কার করেন।’ চিমি একটু থামল, ‘কিন্তু, তারপর থেকেও এটা প্রায় বহির্জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই রয়েছে। এখানকার লামারা বাইরের কাউকে ঢুকতে দেন না। নিজেরাও কারুর সঙ্গে তেমন মেশেন না।’

চলতে চলতে দূরে পাহাড়ের নীচের এক সমতল জায়গা চোখে পড়ল। সুন্দরভাবে ধাপ কেটে কেটে চাষ করা হচ্ছে। এখানে প্রচুর কমলালেবুর গাছ, একদম ঝোপ হয়ে রয়েছে। আরও মিনিট সাতেক চলার পর লুংদোপেদরির চূড়াটা চোখে পড়ল। কালচে খয়েরি আর সাদা রং দিয়ে তৈরি চৌকো আকারের একটা বাড়ি, বাড়িটার ওপরের অংশটায় সরু সরু আয়তাকার খয়েরি রঙের পাত একটার পর একটা বসিয়ে গম্বুজের আকার দেওয়া হয়েছে। একদম ওপরে সোনালি রঙের একটা শলাকা, রোদে ঝলমল করছে।

চিমি জানাল, লুংদোপেদরি এখান থেকে দেখা গেলেও পৌঁছোনোর জন্য সামনের জঙ্গলের মাঝে একটা ছোট্ট পাহাড়ি নদী আছে, তার ওপরের হাতে তৈরি করা একটা সেতু পার হতে হবে। এই জঙ্গলটাও বেশ ঘন তবে মানুষের আনাগোনা রয়েছে বোঝা যায় পায়ে—চলা সরু পথ দেখে। উঁচুনীচু ছোটো বড়ো খাদ, টিলা পেরিয়ে ওরা সেতুটার কাছে পৌঁছোল।

রুদ্রর তো দেখেই মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়! প্রায় ত্রিশ ফুট লম্বা ব্রিজটা। কয়েকটা কাঠের পাটাতনকে কোনোরকমে জুড়ে জুড়ে ফুট দুয়েক চওড়া করা হয়েছে, দু—এক জায়গায় চিড় খেয়েছে। দু—পাশে দড়ি দিয়ে বানানো রেলিং। সেটা দেখলে অবশ্য রেলিং—এর থেকে খাটিয়ার দড়ির প্যাটার্নের কথাই মনে পড়ে বেশি। প্রায় পাঁচশো ফুট নীচ দিয়ে যে নদীটি বয়ে চলেছে, সেটা ছোটো হলেও তার জলে যে সাংঘাতিক কারেন্ট সেটা এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে। নীচে পড়ে গেলে তা হাড়গোড়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না মনে হয়। ও ঢোঁক গিলে প্রিয়মের দিকে তাকাল।

প্রিয়মের কোনো সমস্যা হবে না, মাউন্টেনিয়ারিং ওর এমনিতেই প্রিয়, তার ওপর ছোটোখাটো ট্রেকিং ও মাঝেমধ্যেই করে। কিন্তু রুদ্রর এমনিতেই খুব উঁচু জায়গায় গিয়ে নীচের দিকে তাকালে কীরকম একটা অস্বস্তি হয়, আর এখানে তো ও একটু এগোলেই মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে!

এতদূর অবধি এসে শেষে এইখান থেকে ফিরে যেতে হবে?

রুদ্রর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়ম বলল, ‘আরে, ভয়ের কী আছে? দেখছ না ওই চিমি কী সুন্দর যাচ্ছে?’

সত্যিই তাই। রুদ্র মুখ ফিরিয়ে দেখল, চিমি তার লম্বা গাউনটাকে কী সুন্দর করে একটু উঁচু করে বেঁধে নিয়ে সাবলীলভাবে তরতরিয়ে চলেছে ব্রিজের ওপর দিয়ে। দেখেই রুদ্রর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। চিমি একা যাচ্ছে, তাতেই সাঁকোটা বিপজ্জনকভাবে দুলছে, মনে হচ্ছে আর একটু জোরে হাওয়া দিলেই তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। রুদ্র চট করে চোখ সরিয়ে নিল।

একটা পাথরের ঢিবির ওপর বসে পড়ে জলের বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে বলল, ‘ওরা পাহাড়ি মেয়ে, ছোটো থেকেই এইরকম ব্যাপারে অভ্যস্ত। তা ছাড়া ও এখানে অনেকবার এসেছে এটা নিশ্চয়ই জানো তুমি।’

প্রিয়ম বলল, ‘সে না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু তুমিও তো ছোটো থেকে অনেক ঘুরেছ পাহাড়ে পাহাড়ে! তুমি বলেছিলে না, সেভেন না এইটে পড়ার সময় বাবা আর তুমি গঙ্গোত্রী থেকে গাড়োয়ালেরর অডেন কলে ট্রেক করে গিয়েছিলে? ওটা তো ভীষণ দুর্গম জায়গা শুনেছি! আর সেই তুমি এরকম একটা ব্রিজ, যেটা কিনা বুড়ো লামারা দিনে তিনবার করে পেরোয়, সেটা পার হতে পারবে না?’

রুদ্র মৃদু বাধা দিয়ে বলল, ‘অডেন কল মোটেই আমি যাইনি, তুমি গুলিয়ে ফেলছ। অডেন কল তো বাবা ওঁর ট্রেকিং ক্লাব থেকে গিয়েছিলেন। আমি আর বাবা গিয়েছিলাম পিন্ডারি গ্লেসিয়ার ট্রেকে, নন্দাদেবী পিক থেকে নান্দাকোট পিক যাওয়ার পথে। ওটা মোটেই অত টাফ নয়। আর তা ছাড়া…’ রুদ্র চুপ করে গেল, ‘তখন বাবা ছিল সঙ্গে। আমি বরফের মধ্যে ওঠার সময় একবার স্লিপ করে পড়ে যাচ্ছিলাম গড়িয়ে, বাবা পেছন থেকে আমাকে প্রায় লুফে নিয়েছিল কোলে! না হলে আমার মাথা—টাথা ফেটে যেত।’ রুদ্র একটা নিশ্বাস ফেলল, ‘বাবার ট্রেকিং ছিল নেশার মতো। বছরে অন্তত তিনবার সব কাজ ফেলে ছুটতই। মা এ নিয়ে কত রাগারাগি করত!’

প্রিয়ম এসে রুদ্রর কাঁধে হাত রাখল, ‘কুছ পরোয়া নেহি! বাবা নেই তো কী হয়েছে, তোমার পতিদেবতা তো আছে!’ বলেই এক ঝটকায় রুদ্রকে কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল ব্রিজের দিকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় রুদ্র এতটাই অবাক হয়ে গেল যে প্রথমে কী বলবে ভেবে পেল না। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে হাত পা ছুঁড়ে চেঁচাতে লাগল, ‘না প্রিয়ম! প্লিজ, এরকম কোরো না! আমাকে এক্ষুনি নামিয়ে দাও! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, এক্ষুনি হার্ট ফেল করে যাবে!’

নরবু আর চিমি ততক্ষণে ওপারে পৌঁছে গেছিল। ওরা দেখতে পেয়ে হাততালি দিয়ে কিছু একটা বলতে লাগল, কিন্তু নদীর প্রবল জলোচ্ছ্বাসে কিছু শোনা যাচ্ছিল না।

জিগমে এতক্ষণ চুপচাপ ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল, সে—ও বেশ মজা পেয়ে বলল, ‘ডরিয়ে মাত, ম্যাডামজি। কুছ নেহি হোগা। সাব আপকো ঠিকসে লে যায়েগা।’

প্রিয়ম টলোমলো সাঁকোটায় ওঠার ঠিক আগে একটু থামল।/ধীর গলায় বলল, ‘দ্যাখো রুদ্র, নরবু, চিমি বা জিগমে, এরা কিন্তু কেউই জানে না আমাদের আসল উদ্দেশ্যটা কী। শুধু তুমি আর আমি জানি, কত আশা, কত মানসিক চাপ নিয়ে তুমি এখানে এসেছ। এতদিন ধরে বয়ে নিয়ে চলা তোমার দুঃখগুলোর কথা চিন্তা করো। যদি আমাদের দু—জনের ডিডাকশন ঠিক হয়, আমাদের এখানে আসাটা ব্যর্থ হবে না। সেখানে…একটা সামান্য রিপু…ভয়ের কাছে তুমি হেরে যাবে?’

রুদ্র চিৎকার থামিয়ে বলল, ‘আমি তো তা একবারও বলিনি!’

‘তবে? গোলোক বিহারীর ওই অঙ্কের ফর্মুলা ঠিক হলে এখানেই আমরা বাবার খোঁজ পাব। তুমি কি তা চাও না?’

রুদ্র এবার একটু কঠিন গলায় বলল, ‘অবশ্যই চাই।’

‘তাহলে নো চিৎকার, নো ভয় পাওয়া। তুমি শুধু একটা কাজ করো, চোখটা পুরোপুরি বুজে থাকে, আর আমাকে এতটা শক্ত করে না ধরে রিল্যাক্সডভাবে ধরো। চোখ কিন্তু খুলবে না আমি না বললে।’

রুদ্র শরীরের স্টিফ ভাবটা কমিয়ে লম্বা শ্বাস নিল, চোখ বুজে বলল, ‘ঠিক আছে চলো, আমি রেডি। আর ওঁর নাম গোলোক বিহারী নয়, এই নিয়ে বোধ হয় একশোবার বললাম, বিনোদ বিহারী।’

প্রিয়ম একবার গা ঝাড়া দিয়ে বলল, ‘ওই হল! এত ভারী জিনিস কাঁধে নিয়ে চোখে সব কিছু গোল গোল হয়ে যাচ্ছে তো, তাই ওটাই প্রথমে মাথায় এল।’

রুদ্র ছোট্ট একটা কিল বসাল প্রিয়মের পিঠে।

প্রিয়ম সাঁকোটায় উঠে চলতে শুরু করল। দূর থেকে দেখে যতটা পলকা মনে হচ্ছিল ততটা মোটেই নয়। শক্তপোক্ত দড়ি দিয়ে একটা বিশেষ প্যাটার্নে কাঠের পাটাতনগুলোকে জোড়া হয়েছে। হাওয়ায় দুললেও শক্ত করে ধরে এগোলে ভয়ের তেমন কিছু নেই, যদি না হঠাৎ ভীষণ ঝড় ওঠে। প্রিয়মও সেটাই করছিল। রুদ্র চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ করে ঘাড় গুঁজে ছিল। পেছনে জিগমে চলল।

প্রায় মিনিট দশেক এইভাবে কাটার পর প্রিয়ম যখন ব্রিজের ওপারে পৌঁছোল তখন ঘামে ওর ভেতরের জামা ভিজে উঠেছে। কিছুটা রুদ্রর ভারে, কিছুটা টেনশনে হাঁপিয়ে গেছে ও। রুদ্রকে নামিয়ে মোটা/জ্যাকেটটা খুলে ফেলল ও। জলের বোতল খুলে গলায় ঢেলে রুদ্রর দিকে চেয়ে ও মিটিমিটি হাসল। ভাবখানা এমন, দেখলে। বললাম না কুছ পরোয়া নেহি!

রুদ্র কিছু না বলে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। ওর ছলছল করা চোখটা প্রিয়মকে ও দেখাতে চাইছিল না। ভগবান ওর কাছ থেকে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে কেড়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তে এমন একজনকে দিয়েছেন যে একইসঙ্গে সবথেকে বড়ো বন্ধু, অভিভাবক, হিতৈষী, ওর সুখ দুঃখের সাথি। এই প্রথম ভগবানকে অভিযোগ না জানিয়ে ধন্যবাদ দিল ও।

ওরা পাঁচজন আবার চলতে শুরু করল। এবার আর রাস্তা বলে কিছু নেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলা, কোনো পায়ে—হাঁটা পথও নেই, ঝোপঝাড় পেরিয়ে এগিয়ে চলা। রুদ্র চিমিকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখান দিয়ে কি কেউ যায় না?’

চিমি জবাব দিল, ‘না ম্যাডাম। বাইরের লোকেরা তো তেমন যায় না, আর লামাজিরা গুম্ফার অন্যদিক দিয়ে বেরোন, সেদিকে আরেকটা ঝরনা আছে, সেটা একটু বড়ো।’

চিমি আর নরবু আগে আগে হাঁটছিল। চিমির গাউনটা হঠাৎ একটা গাছের ডালে আটকে যেতে ও হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। নরবু গিয়ে সঙ্গেসঙ্গে ধরে তুলল চিমিকে। ওদের ভাষায় কিছু একটা বলল।

রুদ্র প্রিয়মের দিকে চেয়ে চাপা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসল। নরবুর চিমির প্রতি দুর্বলতা কাল থেকে রুদ্রর চোখ এড়ায়নি। মুচকি হেসে ও বলল, ‘চিমি, তোমার লাগেনি তো?’

চিমি দু—পাশে মাথা নাড়ল, যদিও ওর ডান পায়ের গোড়ালির কাছটা একটু ছড়ে গেছে। রুদ্র গম্ভীর হয়ে বলল, ‘নরবু, তুমি চিমির পাশে পাশে হাঁটো, ওকে সাবধানে নিয়ে চলো।’

নরবু সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল, ‘ওকে, ম্যাডাম।’

আরও কিছুটা চলার পর রুদ্র হঠাৎ লক্ষ করল সামনের বেশ কিছুটা অংশের ঘাস একটা খুব ভারী জিনিস ঘষটে ঘষটে নিয়ে গেলে যেমন পিষে যায়, সেইরকম হয়ে রয়েছে। ওর ভ্রূ কুঁচকে গেল। উবু হয়ে বসে ভালো করে ঘাসগুলাকে পরীক্ষা করে ও বুঝল, মাটির ওপর এই ঘষটানো আঘাতটা একদমই টাটকা। ও পিছনে ফিরল। অদ্ভুত তো! পেছনে বা দু—তিন মিটার সামনের ঘাসগুলো কিন্তু এইরকম নয়। শুধু এই চত্বরটারই ঘাসগুলো এইরকম। তার মানে এই জায়গা দিয়ে কোনো ভারী জিনিস টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই!

প্রিয়ম কিছুটা গিয়ে খেয়াল করল রুদ্র নেই, পেছনে ফিরে দেখতে পেয়ে হাঁক দিল, ‘ওখানে কী করছ?’

রুদ্র কিছু না বলে মাথা নাড়ল, তারপর হাঁটতে লাগল। নরবু আর প্রিয়ম সমানে বকবক করতে করতে চলেছে। চিমি কিছুটা পেছনে একটা সরু গাছের ডাল হাতে নিয়ে চুপচাপ হাঁটছিল। রুদ্র ইচ্ছে করেই প্রিয়মদের সঙ্গে দূরত্ব কিছুটা বাড়িয়ে দিল, তারপর চিমির দিকে চেয়ে অল্প হাসল। চিমিও মিষ্টি হেসে হাসিটা ফিরিয়ে দিল ওকে। কিছুটা যাবার পর ও চিমিকে ডাকল, ‘আচ্ছা চিমি, তুমি তো বহুবার লুংদোপেদরি গেছ। ওখানে ক—জন লামা থাকেন?’

চিমি রিনরিনে গলায় বলল, ‘একজন প্রধান লামা আছেন, কিন্তু তিনি অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন। এখন অন্য একজন লামা—ই সব দায়িত্ব সামলান। ওঁর নাম দাওয়া লামা, দাওয়া কথার অর্থ চাঁদ। সবাই ওঁকে সংক্ষেপে দামাজি বলে ডাকে। এ ছাড়া কিছু ভৃত্য থাকে। সব মিলিয়ে পনেরোজন মতো আছে। অন্যান্য মনাস্টারিতে যেমন ছাত্রাবাস থাকে এখানে তেমন কিছু নেই।’

রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘ছাত্রাবাস নেই, বাইরের জগতের সঙ্গে এঁরা মেশেন না, তাহলে কী করেন এঁরা?’

চিমি কী—একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গিয়ে বলল, ‘আমি ঠিক জানি না ম্যাডাম, আমি বলতে পারব না।’

রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, পেমা লিংপা বলে কোনো লামাকে চেনো তুমি?’

চিমির চোখ দুটো এবার বিস্ময়ে গোল হয়ে উঠল, ‘আপনি পেমাজিকে কীভাবে চিনলেন!’

রুদ্র ঠিক করে নিয়েছিল আর ও কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেবে না, যতটুকু বললে কোনো ক্ষতি নেই, সেটুকু বলবে ও। চিমি লুংদোপেদরির ব্যাপারে অনেক কিছু জানে, সেগুলো ওকে জানতে হবে। সহজভাবে ও বলল ‘আমার এক দাদু লুংদোপেদরিতে এসেছিলেন অনেক বছর আগে, তখন ওঁর সঙ্গে আমার দাদুর পরিচয় হয়।’ একটু থেমে ও আবার বলল, ‘তুমি চেনো পেমাজিকে?’

চিমির মুখটা আরও সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল, ‘আপনার দাদু মানে তো ইন্ডিয়ান বাঙালি! লুংদোপেদরিতে এসেছিলেন! কীরকম দেখতে বলুন তো?’

রুদ্র গলার কম্পন একরকম তারে বেঁধে রেখে চাপা গলায় বলল, ‘চিমি, তোমার কাছে আমার একটা সাহায্য চাই।/একমাত্র তুমি—ই পারবে আমায় হেল্প করতে।/আমি জানি নরবু নেপালি, তোমার বাড়িতে তাই বিয়ের ব্যাপারে আপত্তি তুলছে। কিন্তু তোমরা দু—জনেই দু—জনকে চাও। নরবু ওর প্রোজেক্ট শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তোমার জন্যই এখানে পড়ে আছে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার পরিবারকে রাজি করাব। তুমি শুধু আমাকে একটু সাহায্য করো।’

চিমি ফর্সা গাল দুটোয় অল্প গোলাপি রং ধরেছিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও বলল ‘ম্যাডাম, আমার যখন ছয় বছর বয়স; আমার একটা খুব কঠিন রোগ হয়। কী রোগ জানি না, তবে এখন বড়ো হয়ে উপসর্গ শুনে মনে হয় কোনো পাহাড়ি মশার কামড় থেকে হয়েছিল। দশদিন ধরে আমি বেহুঁশ ছিলাম, সারা গায়ে লাল লাল গুটি বেরিয়ে করমচার মতো হয়ে গিয়েছিল। আমাদের গ্রামের ডাক্তারের ওষুধে কিছু হচ্ছিল না। সবাই ধরেই নিয়েছিল আমাকে বাঁচানো অসম্ভব। আমাদের গ্রামে মেয়ের সংখ্যা খুব কম বরাবরই। কাজেই আমার এরকম অবস্থাতে সারা গ্রাম আমার বাবা মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল। পাশের গ্রাম থেকেও ডাক্তার আনা হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তখন আমাদের গ্রামে পাগল গোছের একটা ছেলে থাকত, নাম কর্মা। ও এই লুংদোপেদরির লামাদের ফাইফরমাশ খাটত সারাদিন, রাতের বেলা গ্রামে ফিরত। তখন এই গুম্ফা সম্পর্কে আমাদের গ্রামের সবার প্রচণ্ড ভয় ছিল। বছরের একটা দিন একটা বিশেষ উৎসব ছাড়া এদিকে কেউ আসত না। আসলে পেমাজির আগের যিনি প্রধান লামা ছিলেন তিনি খুব রাগী ছিলেন তাই মানুষের মনে একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু পেমাজি আসার পর উনি নিজেই গ্রামের লোকদের সঙ্গে মিশতে চাইতেন।

‘কর্মা এই গুম্ফায় কাজ করত বলে আমাদের গ্রামের লোকজনও ওকে সাধারণত এড়িয়েই চলত। তো সে বোধ হয় আমার এরকম অবস্থার কথা এখানে এসে বলেছিল। তখন এই গুম্ফার প্রধান লামা পেমা লিংপাজি। তিনি ওর মুখে ঘটনাটা জেনে আমাকে এখানে নিয়ে আসতে বলেন।

‘কর্মা গিয়ে সেকথা আমার বাবাকে জানালে আমাদের পুরো গ্রাম আমাকে নিয়ে যেতে বারণ করে। এখন তো তবু শিক্ষার আলো কিছুটা হলেও আমাদের গ্রামে এসে পৌঁছেছে, তখন ছিল নানারকম আচার আর কুসংস্কার। সবাই বলেছিল আমি মরে গেলে আমার মৃতদেহ থেকে আত্মা বার করে ওঁরা নাকি তন্ত্রসাধনা করবেন। আমার বাবা মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। শেষে আগাই আমার বাবা মা—কে রাজি করান। আগাইয়ের সঙ্গে পেমাজির ভালো আলাপ ছিল। আর আগাইয়ের কথা আমাদের সারা গ্রাম মেনে চলত। তখন আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়। তখন আমি পুরো নেতিয়ে পড়েছি। পেমাজি প্রায় দশদিন ধরে শুশ্রূষা করে আমাকে সুস্থ করে তোলেন। আমার আবছা মনে আছে, লালচে ধরনের গরম এক পানীয় খাওয়াতেন বার বার, সঙ্গে কিছু গাছের শিকড়। প্রায় পনেরো দিন বাদে আমি সুস্থ হয়ে উঠি। সেই থেকে উনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। চলে আসার সময় বলেছিলেন আমি যেন প্রতি সপ্তাহে একবার করে ওঁর সঙ্গে দেখা করে আসি।’ চিমি থাকল।

রুদ্র মন দিয়ে শুনছিল। চিমি থামতে ও বলল, ‘এই আগাই যাকে বলছ ইনি কি তোমাদের গ্রামের প্রধান গোছের কেউ?’

চিমি মাথা নাড়ল, ‘না, আগাই আমাদের গ্রামে এসেছিলেন অনেক আগে। ছোটো থেকেই দেখেছি ওঁকে। সবাই বলত উনি ইন্ডিয়া থেকে বহু বছর আগে এখানে চলে আসেন, কিন্তু কেন কেউ জানে না। সবার বিপদে—আপদে পাশে দাঁড়াতেন আর সারাদিন পড়াশুনো নিয়েই থাকতেন। এ চত্বরের সমস্ত গুম্ফায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। লুংদোপেদরিতে ওঁর নিয়মিত যাওয়া আসা ছিল। আমাদের গ্রামের বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন।’

রুদ্র ওর নিজের বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিল। এত সহজে বিনোদ বিহারীর খোঁজ পাওয়া যাবে ও ভাবতেও পারেনি। কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে ও বলল, ‘আগাই কি মারা গেছেন?’

চিমি উদাস হয়ে গিয়েছিল। আনমনে বলল, ‘না, উনি বেশ কয়েক বছর আগে এখান থেকে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে যান।’

রুদ্র বলল, ‘আচ্ছা চিমি, যাওয়ার আগে কি কেউ আগাইয়ের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করছিল? মানে ওঁর ওপর কোনো হামলা হয়েছিল কি না তুমি জানো?’

চিমি এবার ঝট করে ওর মুখের দিকে তাকাল, ফর্সা মুখটা কেমন পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে, চোখে ভয়াতুর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি, ‘আপনারা ঠিক কী জন্য এখানে এসেছেন বলুন তো?’

রুদ্র বলল, ‘বলব। তার আগে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাও।’

চিমি বলল, ‘আমি যা জানি আপনাকে সব বললাম, এর বেশি কিছু আমি আর জানি না। আমাকে মাফ করবেন, ম্যাডাম।’ বলেই রুদ্রকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও একটু জোরে পা চালিয়ে প্রিয়ম আর নরবুর দিকে এগিয়ে গেল।

রুদ্র ওকে ডাকল না। চিমি এগিয়ে গিয়ে নরবুর সঙ্গে হাঁটতে লাগল। প্রিয়ম এতক্ষণ বাদে পেছন দিকে তাকিয়েছে। পিছু হেঁটে এসে বলল, ‘কী বকছিলে এতক্ষণ?’

রুদ্র মাথা নাড়ল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুপুর একটা বাজে প্রায়। চুপচাপ হাঁটতে লাগল ও। ও এখন বেশি কথা বলতে চায় না। মাথার ভেতর পাকিয়ে থাকা জটটা আস্তে আস্তে আলগা হতে শুরু করেছে। উলটোপালটা সুতো ধরে টান দিলেই আবার গিঁট পাকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

আরও খানিকটা যাবার পর একটা ছোট্ট ঝরনা পেরোলে লুংদোপেদরি গুম্ফা স্পষ্টভাবে দেখা গেল। প্রিয়ম আর রুদ্র দু—জনেই অবাক হয়ে গেল। ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পু হয়ে উরা, এতটা রাস্তা গাড়িতে আসার সময় ছোটো বড়ো অনেকগুলো মনাস্টারি চোখে পড়েছে, কিন্তু এতটা জরাজীর্ণ অবস্থা কোনোটারই ছিল না। সত্যি বলতে কী, এখানকার সমস্ত মনাস্টারিই খুব যত্নের সঙ্গে রাখা হয়, এটাই ব্যতিক্রম। দূর থেকে বোঝা যায়নি, এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাড়িটার ওপরদিকের পাতগুলো প্রায় খসে পড়েছে, নীচের সাদা অংশের অধিকাংশ স্থানেই হাড় পাঁজরা বেরিয়ে পড়েছে।

সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার পুরো গুম্ফাটার চারপাশ এমনভাবে জঙ্গল দিয়ে আবৃত, পথ চেনা না থাকলে চট করে কেউ খুঁজে পাবে না। শুধু ওপরের চূড়াটায় সূর্যের একফালি আলো এসে পড়েছে, যেখানটা রুদ্ররা পাহাড়ের ওপর থেকে দেখতে পেয়েছিল। বাকি অংশটা আলো—আঁধারিতে থমথম করছে। পাশের ঝরনার জলের কুলকুল শব্দ ছাড়া চারদিকে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। জঙ্গলের ভেজা গন্ধ মাখা পুরো জায়গাটায়।

সামনে একটা বড়ো চাতাল, তাতে কিছু ফল শুকোতে দেওয়া আছে একটা চাদরের ওপর। মনাস্টারির বিশাল দরজার গায়ে নানারকম কাজ করা, মাঝখানে একজন মানুষের গলে যাওয়ার মতো ছোটো একটা দরজা। দরজার দু—পাশের ওপর দিকটায় মশাল রাখার গর্ত। পাথরের পাঁচিলের গায়ে বসে আছে এক প্রহরী। বিশাল চেহারার পুরুষ, পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখ, হাতে একটা বল্লম জাতীয় জিনিস। রুদ্রদের আসতে দেখে সে উঠে দাঁড়াল।

চিমি—ই প্রথমে এগিয়ে গিয়ে একটু হাসল, তারপর ওদের ভাষায় কিছু বলল। প্রহরীটি একইরকম অভিব্যক্তিহীন মুখে দু—পাশে মাথা নাড়ল, অর্থাৎ ‘না’। এরপর চিমি আবার কিছু বলতে লাগল।

প্রিয়ম ফিসফিস করে নরবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কথা বলছে ভাই ওরা?’

নরবু মাথা নেড়ে বলল, ‘জানি না স্যার। আমি তো শুধু জংখা ভাষাটাই জানি। ওটাই ভুটানের প্রধান ভাষা। এগুলো সব লোকাল ভাষা।’

এতক্ষণ পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা জিগমে হঠাৎ হিন্দিতে বলল, ‘ওই মেয়েটা বলছে এঁরা মহালামার সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু দারোয়ানটা বলছে হবে না। মেয়েটা অনুরোধ করছে একবার দেখা করার জন্য, খুব দরকার। কিন্তু দারোয়ান কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। বলছে দামাজির নিষেধ আছে।’

প্রায় মিনিট দশেক কথোপকথনের পর প্রহরীটা দরজাটার মাঝখানের দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। চিমি ফিরে এসে বলল, ‘বলেছিলাম না, দামাজি বাইরের কাউকে ঢুকতে দেন না। অনেক করে বললাম যে ইন্ডিয়া থেকে দু—জন এসেছেন পেমাজির সঙ্গে দেখা করতে। দেখি কী হয়।’

রুদ্র বলল, ‘পেমাজি কি আর কোনো দায়িত্বই সামলান না?’

চিমি একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘উনি মনে হয় খুব বড়ো হয়ে গেছেন। বহুদিন দেখিনি ওঁকে। এখন দামাজিই সব সামলান।’

প্রহরীটা ফিরে এল প্রায় পনেরো মিনিট বাদে। বড়ো দরজাটা খোলার উপক্রম দেখে প্রিয়ম ফিসফিস করল, ‘হুররে! গ্রিন সিগনাল দিয়েছেন দামাবাবু।’

প্রহরীটা আবার দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলতে চিমি ওদের দিকে ফিরে বলল, ‘সবাই মিলে যাওয়া যাবে না। আমার সঙ্গে আপনাদের মধ্যে যেকোনো দু—জনকে যাওয়ার আদেশ দিয়েছেন দামাজি। আর ক্যামেরা, মোবাইল বাইরে রেখে আসবেন।’

নরবু আর জিগমে জিনিসগুলো নিয়ে বাইরে রয়ে গেল, চিমির সঙ্গে ওরা দু—জন ভেতরে ঢুকল।

বড়ো দরজাটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে সামনে একটা খোলা পাথর দিয়ে বাঁধানো চাতাল। একপাশে বিরাট একটা গাছ, সেটা এতটাই বড়ো যে, তার পাতায় পুরো মনাস্টারিটার ওপরের আকাশটা ছেয়ে গেছে, ফলে ভেতরে আলো তেমন নেই বললেই চলে।

রুদ্রর বেশ শীত শীত করতে লাগল। চাতালটার মাঝখানে সাদা রঙের একটা বেদি। তার ওপরে গুরু রিনপোচে অর্থাৎ পদ্মসম্ভবের প্রায় পনেরো ফুট লম্বা একটা মূর্তি। এই প্রথম পদ্মসম্ভবের কোনো মূর্তি দেখল রুদ্র। বিনোদ বিহারীর ঘরে পড়ে থাঙ্কাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল ওর। থাঙ্কার ছবি আর এই মূর্তিটা যে হুবহু এক সে ব্যাপারে ওর কোনো সন্দেহ নেই।

ভঙ্গিমাটুকু পর্যন্ত এক। তবে কি ওই থাঙ্কাগুলো এই মূর্তিটা দেখেই বানানো হয়েছিল? এই ব্যাপারে ও ঠিক নিশ্চিত হতে পারল না কারণ আর কোনো ভঙ্গিমায় বা পদ্মসম্ভবের আর কোনো ধরনের ছবি হয় কি না সেটা ওর ঠিক জানা নেই।

ওদের দাঁড়াতে বলে প্রহরীটা ভেতরে চলে গেল। দূরের দালান দিয়ে একটা লোক হেঁটে চলে গেল। আরেকটা লোক কিছু জিনিস নিয়ে এদিকে আসছিল, রুদ্র চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

কাল রাতের বোবা লোকটা।

বাঁ—দিকে একটা মাঝারি মাপের মণ্ডপ, তার মধ্যে একটা বিশাল চোঙাকৃতি পিতলের জিনিস। দেখেই চিনতে পারল রুদ্র। এটাকে বলে ‘প্রেয়ার হুইল’। প্রতিটা মনাস্টারিতেই থাকে এই পবিত্র চাকা। হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে ঘোরাতে হয়। এঁদের মতে তাতে মনের ইচ্ছাপূরণ হয়।

প্রিয়ম বলল, ‘চাকাটার সারা গায়ে কী লেখা?’

চিমি জবাব দিল, ‘বেশিরভাগ মনাস্টারির প্রেয়ার হুইলের গায়েই সংস্কৃতে একটা মন্ত্র লেখা থাকে, ওম মনি পদ্মে হুম। কিন্তু এটা ডাকিনী হরফে লেখা। লেখাটাও অন্য কোনো মন্ত্র।’

রুদ্র চমকে উঠল। ওর মনে পড়ে গেল বাবা ওকে ডাকিনী স্ক্রিপ্ট বা কিন কোডের কথা বলেছিলেন। প্রাচীন এক তিব্বতি সাংকেতিক ভাষা এই ডাকিনী স্ক্রিপ্ট। বজ্রযান ধর্মের বহু গুপ্ত পুথি পদ্মসম্ভব এই ভাষাতেই লিখে গিয়েছিলেন। বিনোদ বিহারীর পাওয়া তেঞ্জ্যুরটা ডাকিনী স্ক্রিপ্টেই লেখা ছিল।

প্রিয়ম গিয়ে বার দুয়েক চাকাটা ঘোরাল। বড়ো চাকাটার চারপাশে ছোটো ছোটো রংবেরঙের অনেক চাকা দিয়ে ঘেরা। সেগুলো অল্প হাওয়াতে দুলে উঠছে।

দূরে একটা শব্দ হতে ওরা ঘুরে দাঁড়াল। একজন লামা আসছেন, সঙ্গে সেই প্রহরী। ছ—ফুটের ওপর লম্বা ঋজু চেহারা, মাথা ও মুখ পরিষ্কারভাবে কামানো, সারা গায়ে চাদর জড়ানো। এই লামার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হলেও এঁর গায়ে অসীম শক্তি তা বুঝতে অসুবিধা হল না। গায়ের রং খুব ফর্সা, তবে রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। হাঁটার ধরন দেখলেই বোঝা যায় ইনি প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। চিমি ইশারায় জানাল ইনি—ই বর্তমান প্রধান দাওয়া—লামা, অর্থাৎ দামাজি।

দামাজির পায়ে পায়ে আসছে এক ভয়ংকর চেহারার কুকুর। তিব্বতিরা কুকুর পোষে জানা ছিল কিন্তু তাই বলে এইরকম করালদর্শন কুকুর! মেহগনি কাঠের মতো মসৃণ কালো শরীরের ওপর হালকা হলুদ ছোপ, ঝোলা কান দুটো নেতিয়ে পড়েছে মাথার দু—পাশে। মস্ত বড়ো ত্রিকোণাকৃতি জিভটা মুখ থেকে অনেকটা বেরিয়ে রয়েছে। সাক্ষাৎ যমদূত!

কাছাকাছি আসতেই চিমি এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল নিঃশব্দে। দামাজি চিমির মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদের মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। তারপর রুদ্রদের দিকে এগিয়ে এসে পরিষ্কার ইংরেজিতে বিনীতভাবে বললেন, ‘কী চাই আপনাদের বলুন?’

রুদ্র হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে নম্রভাবে বলল, ‘আমার নাম রুদ্রাণী। ইনি আমার হাজব্যান্ড প্রিয়ম। আমার ইন্ডিয়া থেকে একটা বিশেষ কারণে আসছি। পেমা লিংপা লামাজির সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’

দামাজি প্রতি নমস্কারের ভঙ্গিতে মাথাটা অল্প ঝোঁকালেন, তারপর অল্প মাথা নেড়ে সংক্ষেপে জানালেন, ‘সম্ভব নয়। উনি খুব অসুস্থ। বয়সজনিত কারণে বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না। বাইরের কারুর সঙ্গে উনি দেখা করেন না।’

রুদ্র অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি যদি ওঁকে একটু বলেন যে আমরা বিনোদ বিহারী চৌধুরীর কাছ থেকে আসছি, উনি ঠিক দেখা করবেন। আমরা বেশি সময় নেব না। আমার দরকারটা খুব—ই আর্জেন্ট।’

দামাজি আবার গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, ‘না। একেবারেই সম্ভব নয় সেটা। ওঁর নব্বইয়ের ওপর বয়স।/উনি এখন কোনো ধকল নিতে পারবেন না। আমরাও ঝুঁকি নিতে পারি না।’

রুদ্র হতাশ হয়ে গেল। এতদূর এসে পেমা লিংপার সঙ্গে দেখা না করতে পারলে ও এগোবে কী করে! ইনি তো কথা বাড়াতেই দিচ্ছেন না!’

দামাজি আবার বললেন, ‘আমাদের এখানে বাইরের কাউকে ঢুকতেই দেওয়া হয় না। গুরু রিনপোচের নিজের হাতে তৈরি যে ক—টি দুর্লভ মনাস্টারি সারা বিশ্বে গোপনে সংরক্ষিত রয়েছে, তার মধ্যে লংদোপেদরি একটা। অত্যন্ত পবিত্র এই মনাস্টারি। তবু আপনাদের আমরা স্বাগত জানিয়েছি চিমির অনুরোধে। আপনারা ভুটানে এসেছেন, অন্যান্য মনাস্টারি দেখুন, ভালো লাগবে।’

রুদ্র বুঝল কথা বাড়িয়ে আর কোনো লাভ নেই। এই জাঁদরেল লামা কোনো কথাই শুনবেন না। ও একবার শেষ চেষ্টা করল, ‘ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ। তবু ঢুকতে যখন দিয়েইছেন, আমরা কি চলে যাবার আগে এই মনাস্টারিটা একটু ওপর ওপর ঘুরে দেখতে পারি? দশ—পনেরো মিনিটের বেশি নেব না, কথা দিচ্ছি।’

দামাজি কিছু মুহূর্ত তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রুদ্রর দিকে, তারপরই পিছন ফিরে হাঁক দিয়ে কাউকে ডাকলেন। এক ভৃত্য শ্রেণির লোক ছুটে এল। দামাজি দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বললেন লোকটিকে, তারপর রুদ্রর দিকে ফিরলেন, ‘আপনারা এর সঙ্গে যান। এর নাম থুম্পডেন। ও আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাবে।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘লুংদোপেদরি জনসাধারণের ঘোরার জায়গা নয়। তবু আপনি বার বার অনুরোধ করছেন বলে অনুমতি দিলাম। আশা রাখব আপনাকে দেখানো সম্মানের অমর্যাদা করবেন না। পনেরো মিনিট বাদে থুম্পডেন আপনাদের বাইরে এগিয়ে দিয়ে আসবে। নমস্কার। গুরু রিনপোচে আপনাদের সহায় হোন।’

দামাজি ডান হাতটাকে বিদায় জানাবার ভঙ্গিতে ওপরে তুললেন, তারপর চলে গেলেন। পেছন পেছন কুকুরটাও। প্রিয়ম বলল, ‘বাপ রে! কী পারসোনালিটি দেখেছ? একেই বলে সত্যিকারের সাধক!’

রুদ্র একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, ‘উঁ?’

প্রিয়ম আবার বলল, ‘বলছি, একেই বলে প্রকৃত তন্ত্রসাধক! চোখটা দেখলেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে।’

রুদ্র বলল, ‘হুম। প্রকৃত তন্ত্রসাধন কিন্তু প্রকৃত টেকি—ও বটে।’

প্রিয়ম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘মানে? টেকি আবার কী?’

রুদ্র বলল, ‘টেকি মানে টেকনোলজি—স্যাভি। ওঁর ডান—হাতের কবজির পিছনদিকটা খেয়াল করেছ? কালো হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে কেউ নিয়মিত কম্পিউটারে কাজ করলে মাউসটা ধরে থাকার জন্য ওই দাগটা হয়।’

চিমি ওদের বাংলা কথা কিছুই বুঝছিল না। ও বলল, ‘আপনারা কি যাবেন?’

থুম্পডেনের সঙ্গে ওরা ওই চাতালটারই নানা দিকে ঘুরছিল। থুম্পডেন ছেলেটা বড়ো চুপচাপ। ইশারায় প্রার্থনা কক্ষ, লামাদের থাকার জায়গা সব বাইরে থেকে দেখিয়ে দিচ্ছিল ওদের। রুদ্র চিমিকে বলল, ‘তুমি তো সবই চেনো এই গুম্ফার। পেমাজি কোন ঘরে থাকেন?’

চিমি বলল, ‘না, আমি এবার অনেকদিন বাদে এলাম। পেমাজি যখন প্রধান ছিলেন তখন অন্যরকম ছিল। দামাজি আসার পর পুরো গুম্ফাটাই নতুন করে সাজিয়েছেন উনি। তারপর আর মাত্র একবারই এসেছিলাম, আর ঢুকতেও পারিনি। তারপর আবার আজ এসেছি।’

রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘শেষ কবে পেমাজিকে দেখেছ তুমি?’

চিমি বলল, ‘সে প্রায় আট—ন—বছর আগে। তখনও দামাজি আসেননি।’

রুদ্র অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী! এতদিন পেমাজিকে তুমি দেখোইনি?’

চিমি দু—দিকে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল।

কিছুটা এগিয়ে পাশের ঘরটার দিকে আঙুল তুলল চিমি। সেই ঘরটার ভেতরটার আবছা অন্ধকার হলেও সেটা যে লাইব্রেরি বুঝতে অসুবিধা হয় না। একধরনের অদ্ভুত টেবিলের ওপর সার সার বই সাজানো। রুদ্র তীক্ষ্ন চোখে দেখছিল। চিমি বলে চলল, ‘পরে একবার যখন এসেছিলাম, ওঁর শরীর খুব খারাপ ছিল বলে দেখা করতে পারিনি।’

গুম্ফার পেছনদিকটায় কোনো পাঁচিল নেই, ঘন জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। একটা লোক পেছন দিক থেকে এক বালতি জল বয়ে নিয়ে সামনে চাতালের দিকে আসছিল, রুদ্রদের দেখেই আড়ালে চলে গেল। একঝলক দেখলেও সে যে কাল রাতের সেই বোবা লোকটা সেটা বুঝতে এতটুকুও অসুবিধা হল না রুদ্রর।

রুদ্র কিছুক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে রইল তারপর মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা চিমি, তুমি আসার সময় বলেছিলে লামারা গুম্ফার পেছন দিকের কোনো পথ ব্যবহার করেন ঝরনার জলের জন্য। সেটা কোনটা থুম্পডেনকে জিজ্ঞেস করো তো!’

চিমি চুপ করে গেল, বলল, ‘থুম্পডেন বলতে পারবে না!’

রুদ্র আশ্চর্য হয়ে গেল বলল, ‘কেন? ও এখানে থাকে, জল নিশ্চয়ই ও—ই নিয়ে আসে। বলতে পারবে না কেন।’

চিমি বলল, ‘থুম্পডেন কথা বলতে পারে না। ও বোবা। আগে ছিল না। শেষবার এসে শুনেছিলাম কী—একটা জটিল রোগে ওর কথা বলার শক্তি চলে গেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *