৩
কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস যখন হাসিমারা স্টেশনে ঢুকল, তখন বেলা প্রায় বারোটা। এর আগে উত্তরবঙ্গে রুদ্র যতবার এসেছে, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে দার্জিলিং, সিকিম, রিশপ, লাভা বা লোলেগাঁও গেছে, এদিকে কিন্তু আসা এই প্রথম।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন ছেড়ে ট্রেন এগোলেই উত্তরবঙ্গের তরাইয়ের যে বন্য সুন্দর রূপ তা ওদের মুগ্ধ করে দিল। দু—পাশে সবুজ অরণ্য, মনে হচ্ছে কেউ কোনোদিনও স্পর্শ করে এদের পবিত্রতা নষ্ট করেনি। মাঝখান দিয়ে সরু রেললাইনের উপর দিয়ে ট্রেন চলেছে ধীরে ধীরে। ওদের কামরা নিউ জলপাইগুড়ির পর প্রায় ফাঁকা।
প্রিয়ম সাইড বার্থে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে একটা বই পড়ছিল। বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তি ম্যাথমেটিশিয়ান পল এরডসের জীবনী দ্য ম্যান হু লাভড ওনলি নাম্বারস। একটা অঙ্কপাগল মানুষ সারাজীবন অঙ্ককে ভালোবেসে কতরকম অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটিয়ে গেছে।
ওদিকে রুদ্র বন্ধ জানলার কাচ দিয়ে ওপারটা দেখতে দেখতে ভাবছিল, স্টেশনের নামগুলোও কী সুন্দর! গুলমা, উদলাবাড়ি, ডামডিম।
ডামডিম স্টেশনটায় ট্রেনটা হঠাৎ থেমে যেতে ও নামল।
ছোট্ট পরিষ্কার স্টেশনটার দু—দিকে সবুজ চা বাগানের ধার দিয়ে পাহাড় উঠে গেছে। জানুয়ারি মাসের আকাশ, তাই একদম ঝকঝকে পরিষ্কার নীল, মাঝে মাঝে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে গেছে। রুদ্রর খুব একটা ঠান্ডা লাগছিল না। হালকা একটা শিরশিরে আমেজ বেশ ভালোই লাগছিল। হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে ওর খুব গর্ব হল। হতে পারে এর থেকে অনেক বড়ো বড়ো রাজ্য আছে দেশে, কিন্তু এমন বৈচিত্র্য ক—টা রাজ্যে আছে? ওপারে শিবালিক হিমালয় রেঞ্জ, নীচে বঙ্গোপসাগর, সুন্দরবনের মতো অরণ্য, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, আবার কলকাতার মতো প্রাণের শহর। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, হেরিটেজ, আভিজাত্য সব রয়েছে ওর রাজ্যে। নিজের অজান্তেই গর্বে ওর বুকটা ফুলে উঠেছিল, এমন সময় জানলা দিয়ে প্রিয়ম ডাকাতে ও পেছন ফিরল, ‘আরে নেমে পড়লে কেন? এখানে স্টপেজ নয়, সিগনাল পায়নি, তাই দাঁড়িয়ে পড়েছে। দুম করে ছেড়ে দেবে, শিগগির উঠে এসো।’
হাসিমারা স্টেশনটা ছবির মতো সুন্দর, সবুজে ভরা আর ঝকঝকে। স্টেশনের পাশেই ছোটো ছোটো রেল কোয়ার্টার, লাল সুরকি বিছানো রাস্তা। সরু রেললাইন দুটো এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর। প্রিয়ম ঘড়ির দিকে তাকাল, ‘বারোটা পনেরো। এখান থেকে যেন কোথায় যেতে হবে?’
রুদ্র ওর রুকস্যাকটা পিঠে চাপিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘আপাতত কোনো শেয়ারড অটো বা বাসে করে যাব বর্ডার টাউন জয়গাঁও। সেখান থেকে বর্ডার পেরিয়ে ফুণ্টশোলিং ঢুকব। আমাদের পারমিট তো করানোই আছে, তাই ওখানে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, সোজা গাড়ি নিয়ে চলে যাব থিম্পু।’
জয়গাঁও আর ফুন্টশোলিং একটা বড়ো তোরণ দিয়ে আলাদা করা। জয়গাঁও—এর দিকটা বেশ ঘিঞ্জি। তোরণটা পুরোপুরি ভুটানের মনাস্টারি প্যাটার্নে তৈরি। এদিক থেকে অজস্র লোক প্রতিদিন ওপারে যাচ্ছে, আবার ওপার থেকে মানুষ আসছে এপারে জীবিকার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় টানে। একটাই রাস্তা এদেশ থেকে ওদেশে চলে গেছে অথচ, ওরা ওপারে পৌঁছে দেখল, দু—দিকের কী ভীষণ তফাত! ভুটানের দিকটা এলেই সবথেকে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল, অসম্ভব পরিষ্কার, ছবির মতো রাস্তাঘাট। কোথাও এক কণা আবর্জনা পড়ে নেই।
প্রিয়ম বলেই ফেলল, ‘কী কাণ্ড দ্যাখো! আমাদের নখের থেকেও ছোটো দেশ, এরা এমন ঝকঝকে তকতকে করে রাখতে পারে, আর আমরা পারি না। এদিকটা এমন সুন্দর আর ওদিকটা দেখলে ঠিক হাওড়া স্টেশনের বাইরেটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।’
রুদ্র বলল, ‘সবসময় ক্রিটিকের মতো নিজের দেশকে খারাপ বলে আঁতলামি কোরো না। ভুটানের পপ্যুলেশন কত জানো? আট লাখেরও কম। আর সেখানে পুরো ভারত বা পশ্চিমবঙ্গের কথা তো বাদ—ই দাও, আমাদের হাওড়া জেলারই হল পঞ্চাশ লাখেরও বেশি। এত কম লোকজন হলে আমাদের দেশ এর থেকেও ঝকঝকে হত। আর তা ছাড়া ভুটানে না আছে কোনো রেললাইন না কোনো নদী বা সমুদ্রের সঙ্গে কানেকশন। এখানকার অর্থনীতিও ভারতের ওপর বিশালভাবে নির্ভরশীল।’ একটু থেমে ও যোগ করল, ‘তবে কিনা এখানকার মানুষজন খুব শান্তিপ্রিয়। এমনি পাহাড়ি লোকজন শান্তই হয়, সমতলের মানুষদের কুটিলতা এদের মধ্যে অনেকই কম, তার ওপর ভুটানে এখনও রাজতন্ত্র। নেটে পড়েছিলাম এরা এদের রাজাকে ভীষণ সম্মান করে, ভালোবাসে। তাই আইনকানুনও খুব কড়া।’
ওরা বর্ডার পার হবার আগেই জয়গাঁওতে একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়াটা সেরে ফেলেছিল। বাঙালি ছিমছাম হোটেল, ভাত আর কাতলা মাছের ঝোল দিয়ে লাঞ্চটা ভালোই হয়েছিল। তার সঙ্গে টাটকা মাছভাজা। রুদ্র এমনিতে মাছ খুব একটা পছন্দ করে না, কিন্তু এখানে বিশাল সাইজের গরম গরম মাছভাজা দারুণ লেগেছিল ওর। তাই এদিকে আর দেরি না করে একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিল থিম্পুর উদ্দেশে।
ভুটানিজ ড্রাইভারটার নাম জিগমে দোরজি। এমনি বেশ ভালোই, তবে কথা একটু কম বলে, প্রশ্ন করলে এককথায় উত্তর দিয়ে মিটিমিটি হাসে। দরাদরি হয়ে যেতে ওদেরকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে মিনিট পাঁচেকের জন্য উধাও হয়ে গেল জিগমে, ফিরে এল যখন, তখন পরনে অন্য পোশাক। ওপরে ঢলঢলে ফতুয়ার মতো একটা জামা, বুকের কাছটা কোনাকুনি বাঁধা আর নীচে হাঁটু অবধি একটা লুঙ্গির মতো, কিন্তু কোনো ঘের নেই। প্রিয়ম বলল, ‘ও বাবা, এ আবার কী ধড়াচুড়ো পরে এল!’
রুদ্র বলল, ‘এটাই ভুটানিজ ছেলেদের জাতীয় পোশাক। এটাকে বলে ঘো। আর মেয়েদের পোশাকটার নাম কিরা। কয়েকদিন আগে ভুটানের রাজা আর রানি ভারতে এসেছিলেন, ছবি দেখনি? এদেশে সবাই এই পোশাকই পরে। ফুন্টশোলিংটা নেহাত একদম ইন্ডিয়া বর্ডার বলে লোকজন অত মানে না, কিন্তু থিম্পু, পারো এইসব জায়গায় এই ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক, এ ছাড়াও এদের নিজেদের সংস্কৃতি এরা খুব যত্নের সঙ্গে ধরে রেখেছে।’ কথাটা বলে ও জিগমে দোরজিকে হিন্দিতে নানা বিষয়ে টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। ওর কাছ থেকে রুদ্র খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানল, থিম্পু পৌঁছোতে প্রায় রাত ন—টা বেজে যাবে। দূরত্ব দেড়শো কিলোমিটারেরও বেশি।
এত রাতে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোটা নিরাপদ কি না জিজ্ঞাসা করতে জিগমে মাথা দুলিয়ে বলল এখানে সারারাত আলো জ্বলে আর গাড়ি আসা যাওয়া করে, তাই কোনো চিন্তা নেই।
প্রিয়ম কানে হেডফোন গুঁজে গানের তালে তালে পা নাচাচ্ছিল, হঠাৎ হেডফোনটা খুলে বলল, ‘আচ্ছা, আমরা থিম্পু যাচ্ছি কেন? একেবারেই ডিরেক্ট তো উরা চলে যেতে পারি!’
‘থিম্পু ভুটানের রাজধানী। থিম্পু আর পারো ছাড়া যেকোনো জায়গা যেতে হলে আগে থিম্পু থেকে পারমিট করাতে হবে, আমাদের এই পারমিটে চলবে না। তা ছাড়া তোমার দেখানো রাস্তাটাই ১০০% ঠিক তার তো কোনো মানে নেই। সব দিকের অপশনই খোলা রাখতে হবে। আর উরা উপত্যকা এখান থেকে অনেক দূর। আমাদের স্টে করতেই হবে কোথাও।’
‘বুঝলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে আমি আর তোমার ওই কাতলা মাছের ঝোল খেতে পারছি না। নেটে দেখে এসেছি, ভুটানে এসে এদের খাবার কেওয়া দাতশি আর জাশা মারু না খেয়ে যাওয়াটা হল সাংঘাতিক পাপ।’
রুদ্র হেসে ফেলল, ‘ওই কেওয়া দাতশি যেটা বললে, সাংঘাতিক ঝাল। আলু, চিজ আর এখানকার একধরনের স্থানীয় লঙ্কা দিয়ে তৈরি করে। খেলে নাকি ব্রহ্মতালু অবধি জ্বলবে। আর শুনলে না জয়গাঁও—এর ওই গোদাবরী হোটেলের মালিকটা মাছটা দেওয়ার সময় কী বলছিল? কাতলা নয়, ওটা কাতোল মাছ!’ খুশিতে রুদ্রর মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল, ‘কী ভালো খেতে না মাছটা? তুমি এই কাতোল মাছ তো কখনো আনো না?’ গলায় ঈষৎ অভিমান ঝরে পড়ল রুদ্রর।
‘উফ, সেই এক কথা তখন থেকে বলে যাচ্ছে। আরে বাবা বলছি তো, ওটা কাতলা মাছ—ই, কাতোল বলে কোনো মাছ হয় না, ওরা এখাকার উচ্চারণে হয়তো কাতোল বলে।’
রুদ্র গলায় নৈরাশ্য, ‘যাহ তুমি শিয়োর? কই, তুমি যে কাতলা মাছ আনো সেগুলো এত সুন্দর খেতে হয় না তো? না, না, আমার মনে হয় তুমি ভুল করছ, এটা কাতোল মাছই।’
প্রিয়ম রুদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিকই বলেছ! আমাকে যা বললে বললে, আর কাউকে বোলো না। লোকে শুনলে হাসবে। কাতোল মাছ! পৃথিবীতে একমাত্র জয়গাঁওতে একটা স্পেশাল পুকুর আছে সেখানে পাওয়া যায় কিনা! হুঁ!’
কথায় কথায় সন্ধে নেমে আসে পথ চলতে চলতেই। প্রারম্ভিক উত্তেজনা এখন ক্লান্তিতে পর্যবসিত হয়েছে। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। পাহাড়ের গা বেয়ে মসৃণ রাস্তা বেয়ে হু হু করে ছুটে চলছিল ওদের গাড়ি। প্রিয়ম কিছুক্ষণ গান শুনে, তারপর কিছুক্ষণ বই উলটোল, তারপর চলন্ত গাড়িতে পড়া অসম্ভব বুঝে এখন মাথা হেলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। রুদ্র ফোনে টাওয়ার নেই দেখে চোখ বুজে ভাবছিল। ড্যামফ্রেইসশায়ারের মঠের সেই চুরির কোনো কিনারা হল কি না কোনো আপডেট পাওয়া যাবে না, ফুন্টশোলিং ছাড়ার পর থেকে ফোনে কোনো নেটওয়ার্ক নেই।
রুদ্র মুখ দিয়ে একটা আফশোসের শব্দ করল। একটা ধারণা নিয়ে এগোচ্ছে, কিন্তু যদি পুরোটাই ভুল প্রমাণিত হয়? সব বেকার হবে তাহলে। আর যদি প্রিয়মের এই ধারণাটা ঠিক হয়, তবে উরায় গিয়ে ও কোথায় যাবে? ওখানে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করবে স্থানীয় লোকেদের সাহায্যে? নাকি বুমথাং—এর ওই প্রাচীন যে মনাস্টারি, যাতে পেমা লিংপা নামে লামা আছেন, তাঁর খোঁজ করবে?
হঠাৎ সজোরে ঝাঁকুনিতে ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। ওদের ড্রাইভার জিগমে খুব জোরে ব্রেক কষেছে। টাল সামলে উঠে বসতে বসতে রুদ্র দেখল জিগমে মাথার টুপি খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়েছে। কী হল ব্যাপারটা? রুদ্র গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল। পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে একটা গাড়ির কনভয় ছুটে চলেছে। প্রিয়মও ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে।
প্রায় ছ—সাতটা গাড়িসমেত কনভয়টা ঝড়ের বেগে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে জিগমে মাথা তুলে গাড়ি স্টার্ট করল। রুদ্র গাড়িতে উঠে বসল। প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার ভাইসাব?’
‘রাজপরিবারের গাড়ি সাব। রাস্তা দিয়ে গেলেই আমরা গাড়ি থামিয়ে টুপি খুলে মাথা নীচু করে আমাদের রাজাকে সম্মান দেখাই।’
প্রিয়ম অবাক হয়ে বলল, ‘এরকম নিয়ম? কেউ যদি না মানে?’
জিগমে স্বল্প কথায় বোঝাল, ‘মানা—না—মানার তো কোনো ব্যাপার নেই। আমরা আমাদের রাজা—রানিকে ভালোবাসি তাই সম্মান দিই।’
রুদ্র বলল, ‘কিন্তু তুমি কী করে বুঝলে ওটা রাজপরিবারের কনভয়?’
‘এখানে তিন ধরনের নাম্বার হয়। একটা রয়্যাল ফ্যামিলির, একটা সরকারি গাড়ি আর একটা সাধারণ মানুষের জন্য। প্রথম দুটো নম্বর দেখেই সবাই বুঝে যায় কোনটা কী গাড়ি।’ জিগমে তার ঝপধপে সাদা দাঁত বের করে সরল সমাধান বাতলাল।
দূরে পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মতো অজস্র আলো কোনো ছোটো শহরের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। পাহাড়ি রাস্তায় অনেকক্ষণ চলার মজা এই, কখন কোন পাহাড় ছেড়ে কোন পাহাড়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে সেটার আর খেয়াল থাকে না, রুদ্র ভাবল। একবার এই পাহাড় কেটে তৈরি রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে খাদ বাঁ—দিকে পড়ে, পরক্ষণেই দ্যাখে ডান দিকে খাদ রেখে গাড়ি ছুটছে। সরু সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া মসৃণ রাস্তা পাহাড়গুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। কত হাজার বছরের ইতিহাসের মূক সাক্ষী এরা! কত উত্থান পতনের প্রত্যক্ষদর্শী! থিম্পু পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় দশটা বেজে যাবে। এই ঠান্ডায় হোটেল খোঁজাটা বেশ চাপ হবে, ভাবল রুদ্র।
পরের দিন সকালে প্রিয়ম যখন ঘুম থেকে উঠল, আশেপাশে রুদ্রকে দেখতে পেল না। কাল রাতে হাড়—কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে ভীষণ ক্লান্ত অবস্থায় হোটেলে এসেছিল ওরা, কোনোমতে ডিনারটা সেরে নিয়েই তলিয়ে গিয়েছিল ঘুমের রাজ্যে। বাইরে কনকনে ঠান্ডা হলেও রুম হিটার আর আরামদায়ক গোটা তিনেক ব্ল্যাঙ্কেটের দৌলতে ঘুমটা জব্বর হয়েছে। জানলার ফাঁক দিয়ে মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে ঘরের মাঝে। প্রিয়ম আড়মোড়া ভেঙে উঠে টেবিলে রাখা কফি—মেকারে এক মাগ কফি বানাল। রুদ্র কোথায় গেছে কে জানে, ফোনটাও তো ফেলে গেছে হোটেলেই। নতুন জায়গায় এসে সবসময় ওর ছটফটানি! বিছানার পাশের বড়ো জানলাটা প্রিয়ম খুলে দিল। কফির মাগটা নিয়ে আয়েশ করে দাঁড়াল লাগোয়া ছোট্ট ব্যালকনিটায়।
কাল রাতে তো বুঝতে পারেনি, এই হোটেলটা একদম রাস্তার ওপরে। রাস্তাটা বেশ চওড়া, দু—পাশ দিয়ে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে সাঁ সাঁ করে, মাঝখানের ডিভাইডারে সুন্দর বিন্যাসে ল্যাম্প—পোস্ট আর গাছ লাগানো। দূরে ঝকঝকে নীল আকাশের মাঝে পাহাড়গুলোকে পুরো ক্যালেন্ডার—থেকে—উঠে—আসা মনে হচ্ছে। পুরো ছবির মতো ঝকঝকে, নোংরা আবর্জনা তো দূর, কোথাও একফোঁটা মালিন্য নেই। লোকজন সুশৃঙ্খলভাবে ফুটপাথ ধরে হাঁটছে। রুদ্র ঠিকই বলেছে, জনসংখ্যা খুবই কম, তাই এত সুন্দর লাগছে সব কিছু।
এই জায়গাটা মোটামুটি এই রাজধানী শহরের কেন্দ্রবিন্দু বলেই মনে হচ্ছে। বেশ বড়ো বড়ো হোটেল আর রেস্টুরেন্ট রয়েছে। একটা ব্যাপার লক্ষ করল প্রিয়ম, সমস্ত বাড়ির প্যাটার্ন এক। কিছু বাড়ি ফ্ল্যাট প্যাটার্নের আর কিছু বসতবাড়ি ধরনের, কিন্তু সবগুলোরই জানলাগুলো এক ধরনের। প্রতিটা জানলাই লম্বা আয়তাকার, ওপর দিকটা মন্দিরের চুড়োর মতো, প্রতি দুটো তলার মধ্যবর্তী জায়গাটা সুন্দর রঙিন নকশা দিয়ে ভাগটা বোঝানো রয়েছে। যেসব বাড়িগুলোর একতলাটায় দোকান রয়েছে, সেগুলোর সামনেটা সুন্দর নকশা করে থাম দিয়ে সাজানো। এ ছাড়াও বাড়িগুলোর দেওয়ালগুলো বড়ো বড়ো সব ছবি আঁকা, দেখে মনে হচ্ছে পৌরাণিক সমস্ত আঁকা। পুরো রাস্তাটার দু—ধারেই সার দিয়ে গাড়ি দাঁড় করানো।
প্রিয়ম হঠাৎ দেখল, ডান দিকের ফুটপাথ দিয়ে একটা স্থানীয় লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হনহন করে রুদ্র হেঁটে আসছে এদিকে। আরিব্বাস! সাতসকালেই তো মহারানি একদম ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। গাঢ় নীল রঙের একটা জিনস পরেছে, হাঁটু অবধি চামড়ার বুট, ওপরে হলদে রঙের মোটা উইন্ডচিটার, চুলগুলোকে চুড়ো করে পেছন দিকে বাঁধা, হাতে একটা লেদারের হ্যান্ডব্যাগ আর চোখে একটা ঢাউস সানগ্লাস।
প্রিয়ম চুপচাপ ওপর থেকে ওর বউকে দেখছিল। এই জামা, জুতো চশমা কোনোটাই আগে দেখেনি ও। আসার আগে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পুরো ফাঁকা করে দিয়েছে মনে হচ্ছে।
হোটেলের নীচে এসে লোকটা কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল, তারপর রুদ্র হাত নেড়ে কী বলাতে হেঁটে বাঁ—দিকে চলে গেল।
রুদ্র ঘরে ঢুকে বলল, ‘গুড মর্নিং। আমি কি একটু আমার স্বামীর হাতের অসাধারণ কফির স্বাদ পেতে পারি?’
প্রিয়ম বলল, ‘অবশ্যই পারেন। তার আগে বলুন যে সাতসকালে উঠে আমাকে না ডেকে কোথায় গিয়েছিলেন?’
রুদ্র হ্যান্ডব্যাগটা থেকে কিছু কাগজপত্র বের করতে করতে বলল, ‘সাতসকালে না বেরোলে পারমিট করতে দেরি হত স্যার, আর আমাদের বেরোতেও দেরি হয়ে যেত। পারমিট হয়ে গেল, এবার ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়ব। চলো, লাগেজগুলো গুছিয়ে নিয়ে ঝটপট বেরিয়ে পড়ি। ও হ্যাঁ, আমাদের হোটেলটার তিন চারটে বাড়ি পরেই ডান দিকে থিম্পু ক্লক টাওয়ার, ওটা দেখে নিতে ভুলো না। বেশ সুন্দর জায়গাটা, অনেকটা আমাদের সিমলার মতো।’
প্রিয়ম রুম হিটাবটার সামনে হাত দুটো জড়ো করে ঘষছিল, ‘ধুর, এইখানে তো সব বাড়িই দেখছি একরকম! কী কী দেখার আছে এখানে?’
‘দেখার জিনিস অনেকই আছে, সেগুলো সব তো আমাদের দেখা হবে না, তবে এখানকার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং জিনিস হল এদের রাজা রানি।’
‘মানে?’
‘ভুটান তো রাজতান্ত্রিক দেশ, এখানে রাজার দাপট তো থাকবেই। কিন্তু আমাদের ওখানে যেমন রাস্তাঘাট ছেয়ে থাকে ফিলমের হিরো হিরোইন আর ক্রিকেট ফুটবলের তারকাদের ছবিতে, এখানে আসল তারকা হল এদের রাজা আর রানি। প্রতিটা হোটেলের রিসেপশনের লবিতে, গাড়ির সামনের কাপ বোর্ডে, শপিং মলে, সরকারি অফিসে, যেখানে যাও না কেন, দেখবে এখানকার অল্পবয়সি রাজা এবং রানির ছবি। সাধারণ মানুষ সত্যিকারের ভালোবাসে তাদের রাজাকে।’
পরের আধ ঘণ্টার মধ্যে ঝটপট রেডি হয়ে নিয়ে হোটেলের ডাইনিং—এ গিয়ে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিল ওরা। বেশি কিছু নয়, খানকতক ব্রেড অমলেট আর কিছু ফল। এখানকার প্রায় সব কিছুই আমদানি হয় ভারত থেকে, তাই প্রায় আকাশছোঁয়া দাম। প্রিয়ম একটা আপেলের টুকরো চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আচ্ছা আমরা এখন কি ওই উরাতেই যাব তাহলে?’
রুদ্রর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, সানগ্লাসের কাচ মুছতে মুছতে ভাবলেশহীনভাবে চাপা স্বরে বলল, ‘তার আগে বলো, বাঁ—দিকের কোণের দিকের লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছ?’
প্রিয়ম একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আড়ে আড়ে চাইল। বাঁ—দিকে একটা লোক বসে আছে বটে, দেখে তো ভুটানিজ মনে হচ্ছে না, লম্বাটে ধরনের মুখ, হালকা চাপ দাড়ি। বয়স আন্দাজ চল্লিশের এপারেই হবে, মাথায় একটা দেব আনন্দ স্টাইলের কালো রঙের টুপি আর গায়ে ধূসর রঙের সোয়েটার। গায়ের রং ময়লা—ই বলা চলে, সঙ্গে একটা ছোটো ব্যাগ রয়েছে। চুপচাপ নুডলস জাতীয় কিছু একটা খাচ্ছে। প্রিয়ম মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘বাপের জন্মে দেখিনি। ইনি আবার কিনি?’
‘বাপের জন্ম অবধি যেতে হবে না, নিজের জন্মে শুধু যে দেখেছ তা—ই নয়, তোমার সঙ্গে বাথরুম যাওয়ার সময় হালকা একটা ঠোক্করও লেগেছিল ট্রেনে। আমাদের কামরাতেই ছিল লোকটা। কিন্তু যতদূর মনে পড়ছে এন জে পি—র পর লোকটা আর ছিল না।’
‘তাই নাকি! কী জানি হবে হয়তো! তা, ভুটানেই যদি আসবে তাহলে এন জে পি নামবে কেন? ওখান থেকে তো আসা অনেক ঝক্কি।’
রুদ্র কাকে একটা ডায়াল করে কানে ফোনটা লাগিয়ে বিড়বিড় করল, ‘সেইটাই তো খটকা!’
পরক্ষণেই ফোনে বলে উঠল, ‘হাঁ ভাইসাব, হামলোগ তৈয়ার হ্যায়। আপ আ যাইয়ে।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চলো, জিগমে দাঁড়িয়ে হোটেলের সামনে।’
ভুটানের টাকার নাম নুল্ট্রাম যেটা কিনা প্রায় ভারতের এক টাকার সমান। এখানকার মানুষজন ভুটানিজ টাকার পাশাপাশি ভারতের টাকাও নেয়, তবে চেঞ্জ দেওয়ার সময় সাধারণত ভুটানিজ টাকাই ফেরত দেয়। হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে ওরা গাড়িতে উঠে বসল। গাড়িটা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে একটা খোলা জায়গায় দাঁড়াল। আশপাশে বাড়ি, মাঝখানে অনেকটা চওড়া বাঁধানো চাতাল, মাঝখানে একটা লম্বা ক্লক টাওয়ার, তার গায়ে সুন্দর নকশা করা আর ছবি আঁকা। চারপাশের চাতালটা ছোটো ছোটো গাছ দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো। রুদ্র বলল, ‘এটাই থিম্পুর ক্লক টাওয়ার স্কোয়ার। এখানে বিভিন্ন প্রোগ্রাম হয়, অনেকটা দার্জিলিং—এর ম্যালের মতো আর কি!’
রুদ্র নেমে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। প্রিয়ম নেমে রুকস্যাক থেকে ক্যামেরাটা বের করে ক্লক টাওয়ারের ছবি তুলতে তুলতে রুদ্রকে বলল, ‘বেশ সুন্দর জায়গাটা কিন্তু।’
টাওয়ারটার তিন দিকে ভুটানিজ প্যাটার্নের মেরুন রঙের বাড়ি, পেছন দিকে সবুজ ভেলভেটের মতো নরম ঘাসে মোড়া পাহাড় উঠে গেছে। পাহাড়ের কোলে কোথাও কোথাও একটুকরো মেঘ জমে রয়েছে। প্রিয়ম টাওয়ারটাকে ফোকাসে রেখে পাহাড়ের জমে থাকা মেঘগুলোর কয়েকটা ছবি তুলে বলল, ‘চলো, যাওয়া যাক তাহলে?’
রুদ্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে একটু দাঁড়াতে হবে। একটা ছোটো কাজ আছে। তুমি ফটো তোলো ততক্ষণ।’
কয়েকটা বাচ্চা স্কুল থেকে ফেরার পথে ছুটোছুটি করছিল। প্রিয়ম তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ছবি তুলেতে লাগল, বাচ্চাগুলো ক্লক টাওয়ারের চারদিকে দৌড়ে দৌড়ে খেলছিল। অপরিচিত দাদাটার ক্যামেরায় পোজ দিতে সবার খুব আগ্রহ। রুদ্র একটু অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিল। এত দেরি তো হওয়ার কথা নয়! ঠিক সাড়ে ন—টায় টাইম দেওয়া আছে।
ওকে বার বার পা নাচাতে দেখে প্রিয়ম এগিয়ে এল, ‘কী ব্যাপার, এখানে কীসের জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছ?’
রুদ্র উত্তর দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় উলটোদিক থেকে হনহন করে একটা ছেলেকে হেঁটে আসতে দেখে ও চুপচাপ ইশারা করে গাড়িতে উঠে বসল। ছেলেটাও এসে গাড়িতে উঠল। জিগমে পাথরের মতো স্টিয়ারিঙে হাত রেখেই বসে ছিল। সবাই ওঠার পর স্টার্ট করল। প্রিয়ম আড়চোখে তাকাল। এই ছেলেটাই সকাল বেলা রুদ্রর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হোটেলের সামনে অবধি এসেছিল। চোখমুখ দেখে তো মনে হচ্ছে এদিককারই লোক। বয়স বেশি না, একুশ বাইশ হবে। কিন্তু ভুটানের পোশাক ওই ‘ঘো’ না কী বলে, সেটা পরেনি। সাধারণ উলিকটের খয়েরি রঙের সোয়েটার আর জিনস গায়ে, গলায় মাফলার, মাথায় টুপি। রুদ্র সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে ইংরেজিতে বলল, ‘প্রিয়ম, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, এ হল নরবু। আমি আগে যখন ডালহৌসি ব্রাঞ্চে ছিলাম, ওখানে সেবাস্টিয়ান প্রধান বলে এক অফিসারের কথা বলতাম তোমায়, মনে আছে? সিকিম থেকে বছর তিনেকের জন্য ট্রান্সফার হয়ে এসেছিল? সেবাস্টিয়ানই নরবুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে।’ একটু থেমে রুদ্র যোগ করল, ‘নরবু কিন্তু আসলে ভুটানিজ নয়, সিকিমের আরিটারে বাড়ি ওর, সেবাস্টিয়ানের বাড়ির পাশেই। এখানে ও বেশ কয়েক বছর ধরে আছে, গাইডের কাজ করে। ও আমাদের সঙ্গে যাবে। সবথেকে সুবিধার ব্যাপার, ও উরায় আগেও গেছে, জায়গাটা ভালোই চেনে।’
নরবু ওর বড়ো বড়ো দাঁতগুলো বের করে হাসল। প্রিয়মের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘গুড মর্নিং, স্যার। আমার আসল নাম কিন্তু নরবু নয়, আমার নাম হল নরেন্দ্র বাহাদুর সুব্বা। আপনারা আমাকে নরবু বলেও ডাকতে পারেন, আবার নরেন্দ্রও বলতে পারেন। এখানে এসেছি চার বছর আগে, এখানে সবাই নরবু বলেই ডাকে। এসেছিলাম বুমথাং—এর একটা কনস্ট্রাকশন প্রোজেক্টের হয়ে কাজ করতে, সেই প্রোজেক্টটা কয়েক মাস আগে শেষ হয়ে গেছে, তাই এখন এখানেই টুকটাক গাইডের কাজ করছি। যদিও মন আমার ইন্ডিয়াতেই পড়ে থাকে। হে হে।’
গাড়ি হু হু করে ছুটে চলেছে, আর পাশ দিয়ে পাহাড়ি এক নাম—না—জানা নদী ওদের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে চলেছে। প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘নরবু, এই নদীটার নাম কী?’
নরবু ইংরেজি থেকে হিন্দিতে এসে দুরন্ত গতিতে রিলে করতে শুরু করল, ‘স্যার, আমরা এখন থিম্পুর প্রধান রাজপথ নরজিং লামের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে চলেছে, তার এখানকার নাম ওয়াং চু, ভুটানিজ ভাষায় নদীকে বলে চু। এই ওয়াং চু কিন্তু আমাদের ব্রহ্মপুত্রেরই একটা উপনদী। এর আরেকটা নাম আছে, রায়ডাক। এই নদী থিম্পুর পূর্বদিক ধরে বয়ে গেছে। উত্তরদিক দিয়ে বয়েছে চুবা চু নদী।’
কিছুক্ষণ বাদেই বোঝা গেল, নরবু চোখেমুখে কথা বলে এবং এক মিনিট চুপ করে থাকতে হলেই হাঁপিয়ে ওঠে। রুদ্র সংক্ষেপে বোঝাল, ‘নরবু, তুমি আগে শুনে নাও আমরা কোথায় যেতে চাই। আমরা প্রথমে যাব উরা ভ্যালিতে…’
নরবু মাঝপথে বলে উঠল, ‘জানি, মেমসাব। আজ সকালেই তো বললেন। কিন্তু এখন তো উরা গিয়ে সেরকম কিছু দেখতেই পাবেন না, সবই প্রায় বরফে ঢেকে থাকবে। উরা যাবার আসল সময় হল মে মাসে, একটা ফেস্টিভ্যাল হয়, উরা ইয়াকচো বলে, তাতে দেশ—বিদেশ থেকে সব টুরিস্ট আসে কিন্তু এই ফেস্টিভ্যালটার মজা কী জানেন, কবে হবে কোনো ঠিক নেই, ধরুন আগে থেকে বলে রাখল মে মাসের অমুক তিনদিন হবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে পালটে গেল।’
প্রিয়ম এই ছেলেটার হাবভাব বেশ মজা পাচ্ছিল, বলল, ‘এটা কীসের ফেস্টিভ্যাল নরবু?’
‘বজ্রপানি নামে এক ঠাকুরের স্যার। তিনদিন ধরে মুখোশ নাচ চলে। এখানে মন্দিরকে বলে লাখাং। একটা ছোটো লাখাং থেকে বড়ো প্রধান লাখাং—এ ওই বজ্রপানি ঠাকুরের ছবি নিয়ে আসা হয় ওই মুখোশ নাচ করতে করতে। আমি আগের বারই দেখতে গিয়েছিলাম, স্যার।’
রুদ্র বলল, ‘আমাদের উরা পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে?’
নরবু গাড়ির জানলা দিয়ে এদিক—ওদিক চেয়ে বলল, ‘সবে তো বাবেসা থিম্পু এক্সপ্রেসওয়ে ধরেছি, মেমসাব। এরপর থিম্পু পুনাখা হাইওয়ে হয়ে ওয়াংদুফোদরং পৌঁছোব, তারপর বুমথাং ঢুকব…’ নিজের মনে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে বলল, ‘তাও ন—ঘণ্টা মতো তো লাগবেই। রাত প্রায় আটটা বেজে যাবে উরা পৌঁছোতে পৌঁছোতে।’ পরক্ষণেই চুপচাপ গাড়ি চালানো জিগমের কাঁধে হালকা চাপড় মেরে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চলো দোরজি ভাই, দিনের আলো থাকতে থাকতে যতটা যাওয়া যায়।’
রুদ্র বলল, ‘অত রাত হলে গিয়ে থাকার জায়গা পাব তো?’
নরবু বলল, ‘ওসব ব্যাপার আমার ওপর ছেড়ে দিন, মেমসাব। আমার এক বন্ধুর বাড়ি আছে ওখানে। তোফা ঘর, খাওয়াদাওয়া সব আছে, কোনো অসুবিধাই হবে না।’
রুদ্র সায় দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ওখানে কোনো মনাস্টারি আছে?’
নরবু বলল, ‘হ্যাঁ আছে তো। ওই যে বললাম একটা বড়ো মনাস্টারি আরেকটা ছোটো মনাস্টারি।’
রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘এই দুটোই কি খুব পুরোনো?’
নরবু মাথা নাড়ল, ‘না না, খুব পুরোনো নয়, ওই সত্তর আশি বছরের হবে। উরা জায়গাটিতে তো লোকজনই খুব কম।’
রুদ্র বলল, ‘উরাতে একটা খুব প্রাচীন মনাস্টারি আছে পড়েছিলাম…’
নরবু কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, ‘ওহ, লুংদোপেদরি মনাস্টারির কথা বলেছে তাহলে বইতে। সে তো কয়েকশো বছরের পুরোনো। কিন্তু সেখানে তো কেউ যায় না, ম্যাডাম।’
রুদ্র বলল, ‘ওখানকার সবথেকে পুরোনো মঠ তাহলে ওটাই, তাই তো? তাহলে ওখানেই আমরা কাল সকালে প্রথমে যাব।’
নরবু এইবার একটু অবাক হয়ে বলল, ‘লুংদোপেদরি মনাস্টারি গিয়ে কী করবেন মেমসাব? ওর নামই তো অর্ধেক লোক জানে না। ওখানে তো তেমন কিছু দেখবারও নেই, আর বাইরের লোকদের ঢুকতেও দেওয়া হয় না। তেমন কেউ জানেও না ওটার কথা, নেহাত আমার ওই বন্ধুর বাড়ি থেকে দেখা যায় বলে জেনেছিলাম।’
রুদ্র অম্লানবদনে প্রিয়মকে দেখিয়ে বলল, ‘আমার হাজব্যান্ড বৌদ্ধ মনাস্টারি নিয়ে রিসার্চ করছেন নরবু। সেইজন্যই আসা।’
প্রিয়ম ফোনে পি ডি এফ ভার্সানে একটা বই পড়ছিল, আকস্মিক এই পরিচয়ে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাল। রুদ্র বিনা নোটিশে মাঝে মাঝে এমন বিপদে ফেলে দেয়! এবার দুমদাম কিছু জিজ্ঞেস করলে প্রিয়ম মুশকিলে পড়ে যাবে।
নরবু হেসে বলল, ‘ও তাই বলুন, আমি তাই ভাবছিলাম পারো পুনাখা ছেড়ে হঠাৎ উরা কেন! কুছ পরোয়া নেহি। নরবু আছে, সব জায়গায় নিয়ে যাবে আপনাদের।’
.
ইংল্যান্ডের পূর্বদিকে বেডফোর্ডশায়ার অঞ্চলে লুটন বলে যে ছোট্ট টাউনটি রয়েছে, বর্তমানে সেটি স্থানীয় একধরনের টুপি তৈরির জন্য বিখ্যাত হলেও এর ইতিহাস সহস্রাব্দ প্রাচীন। আদি প্রস্তর অর্থাৎ প্যালিয়োলিথিক যুগ থেকে শুরু করে নব্য প্রস্তর নিয়োলিথিক যুগ, সবেরই নিদর্শন এখানে এখনও স্বল্প হলেও বিদ্যমান। আধুনিককালে এই ছোটো ছিমছাম শহরটিতে বসবাস শুরু হয় আনুমানিক ষষ্ঠ শতক থেকে। এখন এই শহরে আধুনিক জীবনযাত্রার জন্য যা যা উপকরণ প্রয়োজন সবই অবশ্য মজুত। বড়ো বড়ো চওড়া রাস্তা, অনেকটা করে জায়গা নিয়ে একেকটি গাছপালা পরিবেষ্টিত বাড়ি, মাঝে মাঝে মধ্যযুগীয় গথিক প্যাটার্নের অট্টালিকা, আবার একই ছাদের তলায় সমস্ত সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুপারমার্কেট শহরটি একইসঙ্গে আভিজাত্য, সাবেকিয়ানা ও আধুনিকতার মেলবন্ধন করে তুলেছে।
এমনই এক রোদ ঝলমলে সকালে শহরেরই পূর্ব কোণের এক ছোটো কিন্তু ছিমছাম গলিতে এক যুবককে ঢুকতে দেখা গেল। শহরের প্রায় কিনারায় এই গলিটির পাশ দিয়েই বিস্তীর্ণ জলাভূমি, তাই বাড়ির সংখ্যা খুবই কম।
যুবকটি আস্তে আস্তে ঈষৎ পা টেনে টেনে হাঁটছে, তাকে দেখেই বোঝা যায় সে বড়ো ক্লান্ত, বিশেষত কাঁধের ভারী ব্যাগটা সে আর বইতে পারছে না। অনেকক্ষণের পরিশ্রমে তার ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে গেছে, গায়ের সাদা গেঞ্জিটাতেও ময়লা লেগেছে। গলিটার একদম শেষ প্রান্তে যে ছোটো বাগানবাড়িটা রয়েছে তার সামনে এসে সে দাঁড়াল। বাড়িটার চারপাশে বেশ কিছু আগাছা গজিয়ে উঠেছে আর সামনে তালা ঝুলছে। কিছুক্ষণ সতর্কভাবে এদিক—ওদিক তাকিয়ে সে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বাড়িটার বাইরে থেকে দেখে পরিত্যক্ত মনে হলেও ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায়, মানুষের বাস রয়েছে এ—বাড়িতে। যুবকটি দু—তিনটি ঘর পেরিয়ে ডান দিকের কোণের ঘরে প্রবেশ করে দেখল, মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি পেটের ওপর ল্যাপটপ দিয়ে খাটে বসে আছে। অন্যান্য ঘর প্রায় আসবাবহীন হলেও এই ঘরে আধুনিক ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের সবই প্রায় মজুত রয়েছে। তাকে দেখে ল্যাপটপ সরিয়ে খাটে—বসে—থাকা লোকটা সোজা হয়ে বসল, ‘এসো এসো প্যাট্রিক, তোমার কথাই ভাবছিলাম। জিনিসটা এনেছ?’
প্যাট্রিক উত্তর না দিয়ে তার পিঠের ভারী ব্যাগটা টেনেহিঁচড়ে নামাল মাটিতে। উবু হয়ে বসে ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়া একটা মাঝারি সাইজের প্যাকিং বাক্স বের করে খাটের ওপর রাখল। তারপর প্যাকিংটা সাবধানে খুলল। ভেতরের জিনিসটা বের করে লোকটার হাতে দিল।
লোকটা বেশ উত্তেজিত হয়ে জিনিসটা হাতে নিল। একটা বহু পুরোনো বই। বই না বলে কাগজের গোছা বলাই ভালো। সরু লম্বাটে ধরনের আয়তাকার একধরনের কাগজ একসঙ্গে করে রাখা, হলদে হয়ে অর্ধেক পাতা অস্পষ্ট হয়ে গেছে, সামান্য অসাবধানে পাতার কোনাগুলো ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছে। লোকটা খুব সাবধানে পুথিটাকে সামনে রেখে বাঁ—দিকে রাখা স্ক্যানার মেশিনটা অন করল। স্ক্যানারের সঙ্গে ল্যাপটপটা কানেক্ট করে অন্য হাতে মোবাইলের সুইচ টিপে কানে লাগাল, ‘মার্ক, জিনিসটা পেয়েছি। আধ ঘণ্টার মধ্যে স্ক্যান করে তোমাকে ইমেল করছি, পেলে ফোন করবে।’
ওপাশ থেকে উত্তর শুনে লোকটা আবার বলল, ‘ওকে। তুমি পাঠাও আমি দেখছি কী করা যায়। আর ওদিকের কী খবর?’
আরও মিনিট পাঁচেক কথা বলে সন্তুষ্ট হয়ে লোকটা ফোন রেখে দিয়ে প্যাট্রিকের দকে ঘুরল, ‘তোমার পেমেন্টের বাকিটা আমি দু—দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেব। আর কোনো ঝামেলা হয়নি তো?’
প্যাট্রিক পাশের টুলটায় বসে পা নাচাচ্ছিল, তাচ্ছিল্যভাবে বলল, ‘না! ঝামেলা আর কী হবে। ক—দিন একটু গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে আর কি!’ বলে উঠে দাঁড়াল, ‘ঠিক আছে মি কেলি, আমি চলি। পেমেন্টটা পাঠিয়ে দেবেন।’
প্যাট্রিক চলে যেতে কেলি আবার ল্যাপটপটা খুলে বসল। মনটা বেশ খুশি খুশি। এতদিনের প্রচেষ্টা আজ সফল হল, বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল আজ। হালকা শিস দিতে দিতে স্ক্যান করতে লাগল কেলি। আর মাত্র কয়েক মাস। তারপরই সারা বিশ্বের কাছে ও হয়ে উঠবে বিখ্যাত।
খুব সাবধানে একটার পর একটা কাগজ স্ক্যান করতে করতে ও ভাবতে লাগল, টাকার অভাব ওর এখন আর নেই। কিন্তু মানুষের অর্থের চাহিদা যখন মিটে যায়, তখন সে চায় খ্যাতি আর ক্ষমতা। ছাত্রজীবনে কিছুকাল ম্যানেজমেন্টের ক্লাস করেছিল, ম্যাসলো—র সেই থিয়োরির কথা মনে পড়ল ওর। সবচেয়ে প্রথমে মানুষের চাহিদা থাকে শারীরিক, অর্থাৎ খাবার, যাতে শরীরের কোনো কষ্ট না হয়। সেটা মিটে গেলে মানুষ চায় নিরাপত্তা অর্থাৎ মাথার ওপর ছাদ। এই দুই মিটে গেলে মানুষ ভালোবাসা পেতে চায়, চায় সবাই তাকে ভালোবাসুক, সেটাও মিটে গেলে সে চায় সম্মান আর খ্যাতি। কেলির এখন শেষটাই দরকার। প্রথম তিনটে চাহিদা মেটানোর জন্য তাকে বিশেষ কিছু করতে হয়নি, বাবা—ই যা করার করেছে। আর সবাই বাবাকে যে চোখেই দেখুক না কেন, কেলির কাছে ওর বাবা আজও হিরো।
মা—কে ওর ঠিকমতো মনেও পড়ে না, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবাকে ও বাবা—মা দুটো ভূমিকাই পালন করতে দেখে এসেছে। ছোটোবেলায়, যখন ওরা খুব গরিব ছিল, তখন এমন দিনও গেছে যেদিন শুধু একটুকরো পাঁউরুটি ছাড়া কিছুই হয়তো জোটেনি, সেদিনও বাবা নিজে না খেয়ে ওকেই খাইয়েছে।
তারপর যখন ওদের প্রচুর টাকা হল আর তার জন্য বাবাকে খাটতে হত দিনরাত, তখনও হাসিমুখে ওর সব আবদার মিটিয়েছে বাবা, তবু ওকে বলেনি রোজগার করতে। ছোটো থেকে ফিজিক্স নিয়ে পড়ার খুব শখ ছিল ওর, বাবা কোনো আপত্তি করেনি। পর পর দু—বার ফেল করার পরেও কিচ্ছু বলেনি বাবা। কেলির তখন উঠতি বয়স, মনের আনন্দে ফুর্তি করেছে। কাজকর্মে ওর মতি ছিল না একটুও। দেদার টাকা উড়িয়েছে আর ঘুরে বেড়িয়েছে। বাবা তখনও কিছু বলেনি মুখে, কিন্তু বাবা আস্তে আস্তে এটা বুঝতে পারছিল যে ওর দ্বারা কিছু হবে না।
কিন্তু এখন যে ও কতটা পালটে গেছে সেটা বাবা ধারণাই করতে পারবে না।
স্ক্যান করা ইমেজগুলো সব ইমেলে অ্যাটাচ করে পাঠিয়ে দিল কেলি। নিজের মোটা শরীরটাও খাটে হেলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগল, এবার দেখা যাক কদ্দূর কী হয়।
বুমথাং উপত্যকায় ঢোকবার ঘণ্টা দুয়েক আগে একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল ওরা। সূর্য তখনও পশ্চিম আকাশে লালচে কমলা হয়ে রয়েছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। যেকোনো পাহাড়ি জায়গার মতো এখানেও চা অত্যন্ত সুস্বাদু। ঘন দুধের তৈরি ধোঁয়া—ওঠা চায়ের কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি গোরুর দুধের চা?’
নরবু বলল, ‘না স্যার, এই এলাকায় সব ভেড়ার দুধ। কি ঘন দেখেছেন?’
একপাশে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে, অন্যপাশে বিশাল খাদ। নীচে চোখ জুড়োনো ভ্যালি। পাহাড়ের ধাপ কেটে কেটে চাষ চলছে সেখানে। জনশূন্য রাস্তায় ওদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। রুদ্র ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ গাড়িতে বসে থাকলে পাগুলো কেমন অবশ হয়ে যায়, হাঁটাচলা করে জড়তাটা কাটাচ্ছিল ও। এই নির্জন প্রান্তরে চায়ের দোকান কী করে চলে কে জানে! ক—টাই—বা খদ্দের হয় দিনে। যে ক—টা গাড়ি চলার পথে থেমে চা খায়, সেই ক—টাই যা। এতে এদের দিন চলে যায়?
ও দোকানটার সামনে এগিয়ে এল। দোকানদারটা মাঝবয়সি স্থানীয় লোক, ভাঙা হিন্দিতে কথা চালাচ্ছিল। এই ঠান্ডায় এরা কী করে হাঁটু অবধি পোশাক ‘ঘো’ পরে থাকে কে জানে, রুদ্র ভাবল। দোকানটা একেবারেই সাদামাটা কিন্তু সুন্দর সাজানো। ছোটো ছোটো পাহাড়ি ফুলের টব দিয়ে ঘেরা, দেওয়ালেও সুন্দর নকশা করা, আর প্রতিটা দেওয়ালে ঝুলছে রাজা—রানির ছবি।
প্রিয়ম আর নরবু ততক্ষণে দোকানদারের সঙ্গে জোর গল্প শুরু করে দিয়েছে। দোকানদারের গ্রাম এখান থেকে কতদূর, কীভাবে যায়, এখান থেকে কতক্ষণ লাগবে এইসব। রুদ্র চা—টা শেষ করে প্রিয়মকে মৃদু তাড়া দিল। এখানে বেশি সময় নষ্ট করলে একেবারেই হবে না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উরা পৌঁছোতে হবে। নরবুকে একবার হাঁক দিয়ে রুদ্র গাড়িতে উঠে বসল। জিগমে যথারীতি গাড়ির স্টিয়ারিঙে হাত রেখে চুপচাপ বসে আছে, মাথার টুপিটা হেলে পড়েছে একদিকে। একটু অদ্ভুত আছে বই কী! কিছু খেতে বললে খায় না, নরবু ডাকাডাকি করল চা খাবার জন্য, তাও গেল না। ছোটো দুটো চোখ আধখোলা রেখে প্রস্তরমূর্তির মতো একনাগাড়ে বসে থাকে কী করে কে জানে।
রুদ্র ওর হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা চুইং গাম বের করে মুখে পুরল। জিগমেকে অফার করতে যাবে এমন সময় আরেকটা গাড়ি এসে থামল দোকানটার সামনে। জিগমে ওদের গাড়িটা দোকান থেকে একটু দূরেই রেখেছে, তবু রুদ্র স্পষ্ট দেখতে পেল, থিম্পুর হোটেলের সেই লোকটা, যে ওদের সঙ্গে ট্রেনেও ছিল গাড়ি থেকে নামল। নেমে দোকানের দিকে গেল। সঙ্গে আরও দুটো লোক রয়েছে। একজন আবার সাদা চামড়ার। মুখের আদল, উচ্চতা, চুলের টেক্সচার, চোখের আকৃতি দেখে রুদ্র মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে কে কোন দেশের, কিন্তু এতদূর থেকে ও ঠিক বুঝতে পারল না। আরেকজন একেবারে স্থানীয়, পরনে ভুটানিজ পোশাক। রুদ্র ইচ্ছে করেই গাড়ি থেকে নামল না। ট্রেনের লোকটা কিছু একটা অর্ডার দিল। বাকি লোক দুটো এদিক—ওদিক ঘুরছে। বিদেশি লোকটার হাতে একটা ক্যামেরা, তাতে মস্ত একটা লেন্স লাগানো, সম্ভবত টেলি—লেন্স যা দিয়ে বহু দূর অবধি জুম করা যায়। এদিকে ট্রেনের লোকটা প্রিয়ম আর নরবুর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে। নরবু হাত মুখ নেড়ে কী সব বলছে।
রুদ্র একটু অধৈর্য হয়ে পড়ল। সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। ঠান্ডাও লাগছে খুব, হাড়—হিম—করা হাওয়া বইছে। নরবু কী বলতে কী বলছে কে জানে! রুদ্র প্রিয়মকে ফোন করতে যাবে এমন সময় দেখল প্রিয়ম এদিকে আসছে।
প্রিয়ম এসে গাড়িতে উঠে বসল। নরবু তখনও বকে যাচ্ছে। রুদ্র একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল, ‘কী কথা বলছিলে এতক্ষণ?’
প্রিয়ম ক্যামেরায় দূরের ভিলার ছবি ফোকাস করতে করতে বলল, ‘ওই ভদ্রলোকও উরা যাচ্ছেন, জানো। সঙ্গে একটা ফরেনার ছিল দেখলে, ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন ভূটান দেখতে, তাকেই ঘোরাতে নিয়ে যাচ্ছে।’
রুদ্র একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি কি বললে আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি?’
প্রিয়ম এক গাল হেসে বলল, ‘আমাকে অত বোকা পাওনি, ম্যাডাম! পাশে নরবু রয়েছে, ওকে যা বলেছ সেটাই বললাম।’
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘তাহলে এই ব্রিটিশ লোকটাকে থিম্পুর হোটেলে দেখলাম না কেন? তখন তো একাই বসে খাচ্ছিল। আর এই নরবু কী এত বকছে ওর সঙ্গে?’
বলতে বলতেই নরবু চলে এসেছে। গাড়ি স্টার্ট হতে নরবু বলল, ‘উরা যাওয়ার টুরিস্ট হঠাৎ বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। ওই সায়েবও উরা—ই যাচ্ছেন।’
রুদ্র বলল, ‘কী নাম ভদ্রলোকের? কোথা থেকে আসছেন?’
‘নাম বলেননি ম্যাডাম, তবে ওই লালমুখো সাহেব মি চৌধুরী বলে ডাকছিলেন। বললেন শিলিগুড়িতে বাড়ি। ট্রাভেল এজেন্সির ব্যাবসা। মালদার পার্টি বা ফরেন থেকে টুরিস্ট এলে নিজেই ঘুরিয়ে দেন। এটাও তেমনই। আর সঙ্গের ভুটানি লোকটা ওই চৌধুরীরই এজেন্সির ভুটানের এজেন্ট।’
রুদ্র চুপচাপ শুনছিল। জিগমে গাড়ির স্পিড বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে, সাপের মতো এঁকেবেঁকে একেবারে এ পাহাড়ের গা দিয়ে আর একবার ও পাহাড়ের গা বেয়ে ছুটে চলেছে ওদের গাড়ি। ও হাতদুটোকে মাথার পেছনে রেখে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগল, এই চৌধুরী কি সত্যিই ওদের পিছু নিচ্ছে? চৌধুরী পদবিটা এমন যে কিছু বোঝা যায় না। বাঙালি হিন্দু হতে পারে, পাঞ্জাবি হতে পারে, মুসলমান বা খ্রিস্টানও হতে পারে। ও কোন একটা বইয়ে পড়েছিল, মুঘল সম্রাটরাও তাদের স্থানীয় প্রধানদের চৌধুরী উপাধি দিতেন। কাজেই লোকটা কোথাকার বোঝা যাচ্ছে না। শিলিগুড়ির ব্যাবসাদার হলে ওদের সঙ্গে ট্রেনে কলকাতা থেকে এল কেন? ব্যাবসার কাজে কলকাতা যেতেই পারে, কিন্তু তখন তো সঙ্গে ওই ব্রিটিশ লোকটা ছিল না। পরক্ষণেই ও ভাবল, এরকম হতেই পারে যে, এই চৌধুরী ব্যাবসার কাজে হয়তো কলকাতা গিয়েছিল আর এই বিদেশি লোকটা বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নেমেছে। তারপর এখানে দু—জনে মিলে এসেছে। কিন্তু, ভুটান ঘুরতে এলে ওদের মতো উরাই—বা যাচ্ছে কেন?
রুদ্র একটা ছোটো নিশ্বাস ফেলে চোখ বুজল। খটকা আর খটকা। এতে তো কোনো সন্দেহ নেই যে, বাবার কিডন্যাপাররা খুব ভালোভাবেই জানতে পেরেছে যে রুদ্র ভুটানে এসেছে বাবাকে খুঁজতে এবং সেটা আটকাবার নানা চেষ্টাও করেছে।
এই চৌধুরী কি তাদেরই একজন? কত বড়ো মাথা আছে এর পেছনে যে ধনেখালির মতো গণ্ডগ্রামে চর রাখা থেকে শুরু করে এখানেও রুদ্রর পেছনে ফেউ লাগিয়েছে? এই চক্রটা অনেক দূর অবধি বিস্তৃত, ভাবল রুদ্র। বাবার কাছে শোনা ফরেস্টিয়ারের দলের কথা মনে পড়ল ওর। সঙ্গের বিদেশিটা কি তাদেরই কেউ?
এখনকার আবহাওয়ার কোনো ছিরিছাঁদ নেই। শীতকালে এরকম কালবৈশাখীর মতো অঝোরে বৃষ্টি হবে কেউ ভাবতে পেরেছে! পূরবী কলেজ চত্বরে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজ কিছু কেনাকাটা করার ছিল, ভেবেছিলেন গড়িয়াহাটের দিকে যাবেন, এই অসময়ের বৃষ্টি সব বানচাল করে দিল। সঙ্গে ছাতাও নেই, যদিও ছাতা এই বৃষ্টিতে কিছুই আটকাতে পারত না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বৃষ্টিটা একটু ধরে যেতে পূরবী সাবধানে রাস্তায় নামলেন। কলকাতায় যতই ঝাঁ চকচকে শপিং মল আর ফ্লাইওভার হোক না কেন, পনেরো মিনিট বৃষ্টি হলেই অর্ধেক জায়গা জলের তলায় চলে যাবে।
শাড়িটাকে সাবধানে একটু তুলে অন্য হাতে ব্যাগ নিয়ে পূরবী জল বাঁচিয়ে হাঁটছিলেন। রুদ্ররা পৌঁছে একবার ফোন করেছিল, তারপর তিনদিন হয়ে গেল কোনো খবর নেই। ফোন করলে ‘নট রিচেবল’ বলছে। এখন ওইদিকটাতে প্রায়—ই ছোটোখাটো ভূমিকম্প হচ্ছে, যতক্ষণ না দু—জনে ফিরছে, ততক্ষণ মনের মধ্যে চিন্তা ঘুরপাক খাবে।
বাসস্ট্যান্ডে যখন এসে দাঁড়ালেন, তখন অনেকক্ষণ বৃষ্টির পর ক্লান্ত হয়ে আকাশ থম মেরে রয়েছে। কেমন যেন একটা ফ্যাকাশে ভাব, অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, চারদিকে ঝড়ের তাণ্ডবলীলার চিহ্ন। কোথাও ছেঁড়া তার পড়ে রয়েছে, আবার কোথাও ভাঙা ডাল। কলকাতা শহর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। কাকভেজা রাস্তায় একটা দুটো করে গাড়ির দেখা মিলছে। কিন্তু বাসের দেখা নেই। পূরবীর বিচ্ছিরি লাগছিল। একে তো কলকাতার এই দিকটা অপেক্ষাকৃত নির্জন, উচ্চবিত্তদের বিশাল বিশাল বাগানবাড়ি আর বড়ো বড়ো গাছপালায় ভরতি, তার ওপর এখন তো একদমই জনশূন্য প্রায়। পূরবী বার বার অধৈর্য হয়ে ঘড়ি দেখছিলেন।
হঠাৎ একটা নীল রঙের সেডান গাড়ি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ব্রেক কষে দাঁড়াল পূরবীর পাশে।
ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে মুখ বাড়িয়ে একটা লোক বলে উঠল, ‘আরে বউদি! কেমন আছেন?’
পূরবী একটু অবাক হলেন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর রিমলেস চশমা পরা এই মুখ এ জীবনে কখনো দেখেছেন বলে মনে পড়ছে না। একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন লোকটার দিকে।
লোকটা গাড়ি থেকে নেমে আবার বলল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন না বউদি? অবশ্য মনে না থাকবারই কথা। আমি সুরঞ্জনের কলেজের বন্ধু প্রদীপ। সুরঞ্জনের সঙ্গে কতবার গেছি আপনাদের বাড়ি! রুদ্র তখন অ্যাত্তটুকুন,’ হাত দিয়ে শিশু রুদ্রর আকার বোঝাল, লোকটা, ‘কত কোলে নিয়ে খেলেছি ওকে।’
পূরবী এবার নিঃসংশয় হলেন। এ লোকটা আগাগোড়া মিথ্যে কথা বলছে। সুরঞ্জনের বন্ধু সার্কল একেবারেই বিশাল ছিল না। খুবই মুষ্টিমেয় ক—জন বন্ধু ছিলেন যাঁদের সঙ্গে পূরবীর এখনও অবধি যোগাযোগ রয়েছে। তাঁরাই আসতেন বাড়িতে। আর তা ছাড়া এই প্রদীপ নামের লোকটা বোধ হয় জানে না যে পূরবীও সুরঞ্জনেরই সহপাঠিনী ছিলেন, কাজেই সুরঞ্জনের সমস্ত বন্ধুকেই তিনি চিনবেন। অন্তত দেখে চিনতে পারবেন না এমনটা হতেই পারে না।
পূরবী গাড়িটার দিকে দেখলেন। কালো কাচ থাকায় ভেতরে কেউ রয়েছে কি না ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পাশ দিয়ে হুসহাস করে বাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি আবার মুখ ফিরিয়ে ঠান্ডা চোখে লোকটার দিকে ফিরলেন।
লোকটা মুখ দিয়ে একটা চুকচুক শব্দ করল, ‘কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল! মাঝখান থেকে আপনার জীবনটা শেষ হয়ে গেল।’
পূরবী এবার হাঁটতে উদ্যত হলেন, ‘প্রদীপবাবু, আপনাকে আমি সত্যিই চিনতে পারছি না। অন্য আরেকদিন কথা হবে বরং। আজ আমার একটু তাড়া আছে।’
লোকটি বলল, ‘কীসের এত তাড়া বউদি? কী করবেন তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে? মেয়ে জামাই তো নেই। যে ভয়ে সুরঞ্জনের উধাও হওয়ার ঠিকঠাক তদন্তই করতে দিলেন না পুলিশকে, মেয়ে তো যেচে সেই বিপদের মুখে গেছে। কী দরকার ছিল বলুন তো এতদিন বাদে মাটি খুঁড়ে সাপ বের করতে যাওয়ার? আপনার কথা একবারও ভাবল না রুদ্র?’
পূরবী হাঁটতে শুরু করেছিলেন, লোকটার কথাগুলো শুনে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঠান্ডা বরফের মতো জমে গিয়ে বললেন, ‘মানে! আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! রুদ্র কোথায় গেছে সেটা আপনি কী করে জানলেন?’
লোকটা এবার খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, ‘সেটাই তো বলছি বউদি! অত তাড়া থাকলে চলে নাকি? রুদ্র বাবাকে খুঁজতে গেছে ভালো কথা, কিন্তু মায়ের কথা ভাববে তো একবার। স্বামীর পর একমাত্র মেয়েটাকেও ওরা যদি ভালোমন্দ কিছু করে ফেলে, আপনার কী অবস্থা হবে সেটা একবারও ভাবল না!’
পূরবী স্থান কাল ভুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কোথায় গেছে রুদ্র?’
লোকটা মিচকে হেসে গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়িটা বেরিয়ে যাবার আগে মুখ বাড়িয়ে চাপা গলায় বলল, ‘এখনও সময় আছে বউদি। মেয়ে জামাইকে জ্যান্ত দেখতে চাইলে ফোন করে বা যে করেই হোক ফিরিয়ে আনুন। এখন না ফিরতে পারলে কিন্তু কোনোদিনই আর ফিরতে পারবে না!’ একটু হেসে আবার যোগ করল, ‘ঠিক ওর বাবার মতো। হে হে। চলি। ভালো থাকবেন।
গাড়িটা বেরিয়ে যাবার পরে বেশ কিছুক্ষণ অবধি পূরবী স্বাভাবিক হতে পারলেন না। প্রায় দশ মিনিট বাদে সম্বিত ফিরে পেয়ে পাশের একটা বৃষ্টির জলে ভরতি বেঞ্চে ধপ করে বসে পড়লেন। তাড়াহুড়োয় মনে পড়ল গাড়ির নম্বরটা দেখার কথা মাথাতেই আসেনি। ব্যাগ থেকে পাগলের মতো ফোনটা বের করে রুদ্রর নম্বর ডায়াল করলেন। ‘নট রিচেবল’। এবার প্রিয়মের নম্বরে ফোন করলেন। একই যন্ত্রচালিত কণ্ঠস্বর, ‘নট রিচেবল’।
দশ—পনেরো বার চেষ্টা করেও যখন কোনো লাভ হল না, তখন হতাশ হয়ে পূরবী ফোনটা বন্ধ করলেন।
ভেজা বেঞ্চিতে পুরো ভিজে যাওয়া শাড়িতে বসে দূরের লাইটপোস্টটায় ঝুলতে থাকা পাখিটার দিকে চেয়ে হু হু করে চোখে জল এসে গেল পূরবীর। যে ভয়টা এতদিন ধরে পাচ্ছিলেন সেটাই সত্যি হল? রুদ্র কোথায় গেছে? প্রিয়মও সত্যিটা তাঁকে বলেনি। কী করবেন তিনি এখন? রুদ্রর স্বভাব তিনি ভালো করেই জানেন। কিন্তু এতদিন বাদে হঠাৎ কেন গেল ও? এই প্রদীপ লোকটা তো পরোক্ষভাবে হুমকি দিয়ে গেল, এটা পরিষ্কার। স্বামীকে হারিয়েছেন, এখন মেয়েকেও হারাতে হবে? আতঙ্কে পূরবীর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।
সারারাত জেগে কাজ করতে করতে কেলি ভোর রাতের দিকটায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল যখন তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আজ বাবার সঙ্গে দেখা করার শেষ দিন। এর পরের ডেটেই বাবাকে আনতে যেতে হবে ফাইনালি।
দেখা করার জন্য অনলাইনে অ্যাপ্লাই করতে হয়, কনফার্মেশন ইমেল এলে সেটার প্রিন্ট আউট নিয়ে দেখা করতে যেতে হয়। এক ঘণ্টার বাঁধা সময় দেওয়া থাকে তাতে, তার মধ্যেই সব কথাবার্তা সারতে হয়। আজকে অবশ্য আরও কিছু ফরম্যালিটিস থাকবে শেষবার বলে। কেলি কোনোরকমে ব্রেকফাস্ট সেরে পড়িমরি করে ছুটল।
বেডফোর্ডের সেন্ট লয়েস স্ট্রিটের প্রায় দু—শো বছরেরও বেশি পুরোনো সুবিশাল কারাগারটা ব্রিটিশ ইতিহাসের উত্থান পতন ও বিভিন্ন কালো অধ্যায়ের সাক্ষী। অতীতে বহু রাজনৈতিক বিপ্লবী এখানে বন্দি থাকলেও এখন প্রধানত স্থানীয় লুটন কোর্টের মামুলি আসামিরাই এখানে থাকে। তবে কিছু দেশ কাঁপানো দাগি আসামীও রয়েছে এখানে। সেই হাতে—গোনা বন্দিদের জন্য নিরাপত্তাও বেশ কড়া। অ্যালফ্রেড তেমনই এক হাই প্রোফাইল বন্দি। কেলি তার ছেলে।
কেলি গত দশ বছর ধরে নিয়মিত আসায় সিকিউরিটি গার্ডরা তাকে চিনে গেছে। প্রতিবারের মতো কেলির পরিচয়পত্র পরীক্ষা করার পর তাকে ভালো করে সার্চ করা হল। নিয়মমাফিক এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হল। রবার্ট নামে একটি ছোকরাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মাস দুয়েক হল কাজে যোগ দিয়েছে সে। কেলি ভেতরে চলে যেতে সে বয়স্ক আরেক গার্ড মাইকেলকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই লোকটা এলেই সুপারিনটেন্ডেন্ট থেকে শুরু করে সবাই চলে আসে কেন বল তো? আগের মাসেও একই জিনিস দেখলাম!’
বুড়ো মাইকেল বলল, ‘সে তো আসবেই। এখন এই জেলে সবই তো রদ্দি মার্কা চোরদের আড্ডা। হয় পিকপকেট নয়তো মোবাইল চুরি, না হলে বড়োজোর ইভটিজিং বা লাগেজ ছিনতাই। বড়ো মাপের কয়েদি বলতে তো শুধু ওই অ্যালফ্রেড! তাও তো সামনের মাসেই মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ওর।’ বুড়ো মাইকেলের গলায় আফশোস ঝরে পড়ল, ‘তোরা দু—দিনের ছেলেছোকরা সব, তোরা আর কী জানবি! আমি যখন প্রথম ঢুকি তখন বড়ো বড়ো আসামিদের লাইন লেগে থাকত। সেসব কয়েদিদের ব্যাপার—স্যাপার আলাদা। হোমরাচোমরা সব লোকজন রোজই আসছে, প্রেস, সাংবাদিকদের ভিড়, এই কোনো মেয়র আসছেন আবার এই কোনো মন্ত্রী বা গভর্নর, আরও কত কী!’
রবার্ট বুঝল বুড়ো ঠিক স্বভাবমতো এক কথা বলতে গিয়ে আরেকদিকে ইউ টার্ন নিয়েছে। ও একটু আড়ালে গিয়ে একটা চুরুট ধরিয়ে আরেকটা মাইকেলের দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, বুঝলাম। এখন বলো এই অ্যালফ্রেড কি খুব বড়ো মাপের আসামি নাকি?’
মাইকেল চোখ বড়ো বড়ো করে ওর দিকে তাকাল, ‘কে রে তুই! বেডফোর্ডশায়ার জেলের গার্ড হয়ে ঢুকেছিস আর অ্যালফ্রেডকে এখনও চিনিস না! জেলার জানতে পারলে তোর চাকরি তো এক্ষুনি যাবে রে!’
রবার্ট এইবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দুর বাবা, ধানাইপানাই না করে বলবে কি, এই অ্যালফ্রেড মশাই এত বিখ্যাত কেন?’
মাইকেল এবার হেসে ফেলল, ‘আহাহা চটছিস কেন!’ তারপর চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, ‘বেডফোর্ডশায়ার তো দূর, সারা ইংল্যান্ড অ্যালফ্রেডের কীর্তির কথা জানে। প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অ্যালফ্রেডরা বিভিন্ন মিউজিয়াম ও প্রদর্শনী থেকে কয়েকশো মিলিয়নেরও বেশি মূল্যের দুষ্প্রাপ্য আর্ট আর অ্যান্টিক জিনিসপত্র চুরি করে সারা ইংল্যান্ডে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সত্তরের দশক থেকে শুরু করে ২০০০ সালের প্রথমদিক অবধি এদের বিভিন্ন কার্যকলাপে পুলিশের ঘুম ছুটে গিয়েছিল। এমন সব সাংঘাতিক চুরি এরা করেছিল যে হলিউডি থ্রিলারকেও হার মানিয়ে দেবে। প্রথম চুরিটা যখন হয় তখন আমি স্কুলে পড়ি। মনে আছে, প্যারিসের এক মিউজিয়াম থেকে পাবলো পিকাসোর এক বিখ্যাত ছবি চুরি করে হইহই ফেলে দিয়েছিল এরা। চুরিটা হয়েছিল এমনই অদ্ভুতভাবে যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড হতবাক হয়ে গিয়েছিল।’
রবার্ট মাঝপথে বলল, ‘অ্যালফ্রেডের দলে আর ক—জন ছিল?’
মাইকেল মাথা নেড়ে বলল, ‘অ্যালফ্রেডের দল ঠিক নয়। তখন অ্যালফ্রেড দলের পাণ্ডা নয়। ওদের দলের চাঁই ছিল ক্রমওয়েল বলে একটা লোক। তার পুরো নাম আজও কেউ জানে না। সম্পর্কে সে ছিল অ্যালফ্রেডের শ্বশুর। শ্বশুর জামাই মিলে এই গ্যাংটা তৈরি করেছিল। মোটামুটি কুড়ি বাইশ জনের দল ছিল। দ্বিতীয় চুরিটা করে স্পেনের এক চার্চ থেকে, একটা বারোশো শতকের দুষ্প্রাপ্য বাদ্যযন্ত্র।’
রবার্ট অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু এগুলো চুরি করে ওরা বিক্রি করত কোথায়! মানে, কিনত কে?’
মাইকেল একটা লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘ওরে, কেনবার লোক অনেক আছে। অনেক ধনকুবের আছে যারা ব্যক্তিগত সংগ্রহে এইসব দুষ্প্রাপ্য জিনিস রাখবার জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করে। এ ছাড়া চোরাবাজার তো আছেই। তবে শেষের দিকে ক্রমওয়েল—এর এটা নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মনে হয়। তারপর শোনা যায় দু—নম্বর চুরিটার পর পুরো ইউরোপ জুড়েই তল্লাশি শুরু হয়ে গেল। কিন্তু কিছুতেই পুলিশ থেকে শুরু করে ডিটেকটিভ স্কোয়াড, কেউ কোনো ক্লু পেল না। এইরকম সময় বাকিংহ্যামশায়ারের অ্যালিসবেরির এক ম্যানসনে মধ্যযুগীয় কিছু অ্যান্টিক জিনিস ছিল। ক্রমওয়েল বেনামে কাগজে বিজ্ঞাপন দিল, পরবর্তী চুরিটা সে ওই অ্যালিসবেরির ম্যানসন থেকেই করবে। পুলিশ পারলে আটকাক। একদম ওপন চ্যালেঞ্জ। একেবারে যাকে বলে ”ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান”! আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠলে যা হয় আর কি! পুলিশ পুরো ঘিরে ফেলল অ্যালিসবেরির সেই প্রাচীন দুর্গটা। ডিটেকটিভ স্কোয়াডের খোদ কর্তা গিয়ে তদারক করতে লাগলেন। কিছুই লাভ হল না। ক্রমওয়েলের দল ঠিক মাল নিয়ে কেটে পড়ল। কীভাবে সেটা আজও রহস্য।’
রবার্ট মাইকেল থামতেই বলে উঠল, ‘তারপর? পরের চুরিটা কোথায় করল?’
মাইকেল চুরুটের শেষাংশটা ছুড়ে দূরের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলল, ‘ধুর, অত মনে আছে নাকি! তবে আটানব্বই সালের শেষাশেষি যখন ক্রমওয়েল ধরা পড়ে তখন ওর চুরি করা জিনিসের মূল্য সত্তর মিলিয়ন ইউরোরও বেশি। ধরাটা পড়েছিল একটা মূর্তি পাচারের সময় একেবারে বামাল আর ওদের গাড়িসমেত। ক্রমওয়েল আর তার সাত—আটজন সহকারী। বিচারে ক্রমওয়েলের কুড়ি বছরের জেল হয়। ততদিনে বেচারা বুড়ো হয়ে গেছিল। জেলে থাকতে থাকতেই তিন—চার বছর বাদে মারা যায়। অ্যালফ্রেড তখনও বাকি চ্যালাচামুণ্ডাদের নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। সেও কিছু কম যায় না। সেভেনহ্যাম্পটনের একটি আর্ট/এগজিবিশন থেকে বহু পুরোনো একটা মিশরীয় পুথি হাতিয়েছিল। তারপর সেও ধরা পড়ে। এখন দশ বছরের জন্য জেল খাটছে। তা হয়েই এল প্রায়, আর বোধ হয় মাসখানেকও নেই।’
রবার্ট বড়ো বড়ো চোখে শুনছিল, বলল, ‘বাপ রে! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! বেরিয়েই তো আবার শুরু করবে তাহলে! আর এই কেলি তো অ্যালফ্রেডের ছেলে? এ—ও কি তলে তলে এখনও চালিয়ে যাচ্ছে নাকি?’
মাইকেল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘না না! কেলি বাপ দাদু কারুর প্রতিভার এক কণাও পায়নি! প্রথম প্রথম পুলিশ ওর গতিবিধির দিকে কড়া নজর রেখেছিল। এখন দেখা গেছে খালি খায়দায় আর ঘুমোয়। ওর দ্বারা কিছু হবে না। আর অ্যালফ্রেডেরও বয়স হয়েছে। ওর দলটাই পুরো ভেঙে গেছে।’
রবার্ট কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ থমকে গিয়ে দেখল, কেলি বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। মোটা শরীরটাকে নিয়ে ডান পা—টা অল্প টেনে টেনে আসছে। মুখটা লাল হয়ে আছে। একঘণ্টার বাঁধা সময় শেষ। ওদের কাছে এসে মাইকেলের দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হাসল, তারপর কাউন্টারে আরেক দফা চেকিং আর সইসাবুদের পর বেরিয়ে গেল।
গলায় সাঁড়াশির মতো যে জিনিসটা আস্তে আস্তে চেপে বসেছিল সেটা আর যাই হোক কোনো মানুষের আঙুল নয়, বুঝতে পারছিল রুদ্র। দমবন্ধ হয়ে আসছিল ওর। ছটফট করতে করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল বাঁচার। দৃষ্টি আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছিল, তবু নাছোড় দৃষ্টি দিয়ে প্রিয়মকে খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল ও। কিন্তু প্রিয়মকে দেখতে পাচ্ছিল না।
ওই অবস্থাতেই প্রিয়মের নাম ধরে একবার চিৎকার করার চেষ্টা করল ও, কিন্তু জান্তব এক আর্তনাদ ছাড়া কিছুই বেরোল না গলা দিয়ে। প্রিয়মকে দেখার মরিয়া চেষ্টা চালাতে চালাতে ও অনুভব করল ওর ঠিক দু—পাশে কোনো একধরনের প্রাণী চেপে রয়েছে ওকে। তাদের গায়ের সঙ্গে ওর গায়ের সংস্পর্শে ওটা যে মানুষের চামড়া নয়, সে—ব্যাপারে নিঃসংশয় হল ও।
খসখসে দুর্গন্ধময় ভেজা ভেজা গায়ের ঘিনঘিনে প্রাণীগুলো আস্তে আস্তে ওর বুকের উপর উঠে আসছিল। দম নেবার চেষ্টা করতেও গা গুলিয়ে উঠছিল। হঠাৎ এক আগুনের ঝলকায় সারা শরীরটা জ্বলতে লাগল ওর। অসহ্য যন্ত্রণায় ও বাঁচার শেষ চেষ্টা করছিল…
অস্ফুট একটা চিৎকার করে ধড়মড় করে উঠে বসল রুদ্র। আতঙ্কে ওর মুখটা লাল হয়ে গেছে, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে বাইরে, এই ঠান্ডাতেও কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাতটা কাঁপছিল ওর। ও যে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সেটাই বুঝে উঠতে পারছিল না। পাশে তাকিয়ে দেখল বিশাল লেপের তলায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে প্রিয়ম। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে আস্তে আস্তে নেমে বাথরুমে গেল ও। মিনিট দশেক বাদে ক্রমাগত জলের ঝাপটাতে একটু ধাতস্থ হল রুদ্র।
এতক্ষণে ওর মনে পড়ল ওরা উরার একটা হোটেলে কাল রাতে এসেছে। নরবু—ই নিয়ে এসেছে। হোটেল ঠিক নয়। রাস্তার পাশেই দোতলা একটা বাড়ি, স্থানীয় একটা পরিবার থাকে একতলায়, নরবু—র পরিচিত। তারাই মালিক, দোতলাটা টুরিস্টদের জন্য হোম স্টে ধরনের করেছে। থাকা খাওয়া নিয়ে পুরো রেট ঠিক করা।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ওর বেশ শীত শীত করতে লাগল। এতক্ষণ উত্তেজনার বশে কিছু মনে হচ্ছিল না। চেয়ারে রাখা প্রিয়মের পুলওভারটা আলগা করে গায়ে জড়াল ও। রুম হিটারের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ হাতগুলো সেঁকল। বাইরে তাপমাত্রা এখন শূন্যের বেশ নীচেই হবে। রাস্তা থেকে লাইটপোস্টের উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে বিছানায়। সেই হালকা হলুদ মায়াবী আলোয় প্রিয়মকে কেমন যেন অপার্থিব লাগছিল।
রুদ্র সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর এগিয়ে গিয়ে পর্দাটা অল্প সরাল, যাতে প্রিয়মের মুখে আলোটা না পড়ে। কাচের জানলায় দাঁড়িয়ে উরা উপত্যকাটা দেখতে লাগল ও। পূর্ণিমার ঝকঝকে আলো ভরা রাত। রাস্তার দু—পাশে খানকয়েক বাড়ি। বাকি সব ফাঁকা বিস্তীর্ণ জায়গা। রাস্তার ওপাশে চোখ জুড়োনো একটা বিশাল ভ্যালি, সবুজ ভেলভেটের মতো ঘাসে বিছানো জায়গাটা দেখে বিলিয়ার্ড টেবিলের কথা মনে পড়ে যায়, ভাবল রুদ্র। দূরে ঘন ব্লু পাইন গাছের সারি যেন চাঁদ ছুঁয়েছে। চাঁদের আলোয় গাছগুলোকে যেন জীবন্ত লাগছিল।
মানুষ নশ্বর, কিন্তু প্রকৃতি চিরন্তন। ও যে এই বাড়িটার জানলায় দাঁড়িয়ে দূরের চোখ জুড়োনো ভ্যালিটা দেখছে, আজ থেকে হাজার বছর আগে হয়তো কোনো এক রাজকুমার ঠিক এই জায়গাতে দাঁড়িয়েই সামনের উপত্যকার অসাধারণ সৌন্দর্যের তারিফ করেছিল। তারও কয়েক লক্ষ বছর আগে হয়তো কোনো এক বিশালকায় ডাইনোসর দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই জায়গাটায়।
টেবল থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে এসে চোখে লাগাল। এই ছোটো কিন্তু দারুণ শক্তিশালী বাইনোকুলারটা বাবা ওকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। হাতে ধরে চোখের কাছে নিয়ে আসতেই যেন বাবার পরশ পেল। মুহূর্তে দূরের ব্লু পাইনের সারিগুলো ওর একদম কাছে চলে এল। দূরে লুংদোপেদরি মনাস্টারিটা দেখবার জন্য বাইনোকুলারটা বাঁ—দিকে ঘোরাল ও। নরবু প্রথমেই এসে এই জানলা দিয়ে ওকে মনাস্টারিটা দেখিয়েছিল। বাইনোকুলার দিয়ে বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একইরকম প্যাটার্নের মনাস্টারি, তবে ভগ্নপ্রায় দশা। দেওয়ালের কাজগুলো ক্ষয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় পুরোটা বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে। ভেতরে ক্ষীণ একটা আলো জ্বলছে। লামারা কি রাতে ঘুমোন না? নরবু একটা উৎসবের কথা বলছিল গাড়িতে আসতে আসতে, সেটা কি এই লাখাং—এই হয়? হঠাৎ রুদ্রর চোখে পড়ল ভ্যালির ডান পাশ অর্থাৎ যেদিকে মনাস্টারিটা রয়েছে, তার অন্যদিক থেকে একটা মৃদু আলো ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছে। ঘন সবুজ বনের ওপর চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় রহস্যময়ী মায়াবী হয়ে উঠেছে পুরো জায়গাটা। আলোটা ধীর লয়ে কাছে এগিয়ে আসছিল। আরেকটু কাছে আসতে ও বুঝতে পারল আলোটা একটা পেট্রোম্যাক্সের। কেউ সেটাকে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে হেঁটে আসছে। কিন্তু এই সাংঘাতিক ঠান্ডায় রাতের বেলায় পাহাড় থেকে নেমে আসা তো আত্মহত্যার সমান।
পেট্রোম্যাক্সটা ভ্যালি পেরিয়ে রাস্তার দিকে আসছে দুলতে দুলতে, রুদ্র যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে বাইনোকুলারটা নামিয়ে রেখে দেখতে লাগল। খালি চোখেই পরিষ্কার লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিল ও। রাস্তাটার ওদিকে এসে একটু থেমে দাঁড়াল লোকটা, তারপর সতর্ক বিড়ালের মতো নিঃশব্দে এপারে চলে এল। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রুদ্র দেখল, লোকটার গায়ে মোটা ফারের জ্যাকেট, নীচে এখানকার পোশাক ঘো। ল্যাম্পপোস্টের পেছনদিকটায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাই আলো—আঁধারিতে মুখটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল না ও। তবে লোকটা যে বার বার ওদের জানলার দিকেই চাইছে সেটা বুঝতে ওর একটুও অসুবিধে হল না। নিজেকে দেওয়ালের সঙ্গে প্রায় লেপটে ফেলে সাপের মতো বেঁকেচুরে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল রুদ্র। হঠাৎ লোকটা ওর হাঁটুর কাছে ঝুলতে থাকা পেট্রোম্যাক্সটা উঁচু করে তুলে ধরল আর ওর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল রুদ্র। ফর্সা রং, চেপটা নাক, চোখগুলো ছোটো ছোটো, মাঝবয়সি স্থানীয় ভুটানি। পেট্রোম্যাক্সটা উঁচু করে ধরে রুদ্রদের জানলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
লোকটা প্রায় মিনিট পাঁচেক একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর রাস্তাটা পুরোটা পেরিয়ে এসে ওদের হোটেলের সামনেটা আসতে লাগল। রুদ্র কিছুটা ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করল যে এদিকে এসে কোথায় গেল, কিন্তু আর দেখতে পেল না। রুদ্র মুহূর্তের মধ্যে গায়ে আলগোছে চাপিয়ে রাখা পুলওভারটা ঠিকঠাক করে নিয়ে মাথায় পশমের টুপিটা চড়াল। টর্চটা হাতে নিয়ে ঘুমন্ত প্রিয়মের দিকে একঝলক তাকিয়ে দরজার লকটা নিঃশব্দে খুলে বেরিয়ে পড়ল।
এই বাড়িটার সামনেটা খোলা ধরনের। ওদের ঘরের দরজা খুলে ছোটো একটা ডাইনিং, তার এককোণ দিয়ে একটা সিঁড়ি রয়েছে বাইরের দিক দিয়ে নীচে নামার। রুদ্র সন্তর্পণে কিন্তু দ্রুতগতিতে কাঠের সিঁড়িটা দিয়ে নামছিল। কিন্তু বাইরে এতটা ঠান্ডা হবে বুঝতে পারেনি। সিঁড়ির শেষ ধাপ ছেড়ে মাটিতে পা দিতেই কান দিয়ে হিমেল হাওয়া ঢুকে সারা শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। গায়ে পুলওভার থাকলে কী হবে, পায়ে তো রাতে পরার পাতলা ট্রাউজার্স। দাঁতের ঠকঠকানি প্রাণপণে সামলাতে সামলাতে ও সামনের রাস্তাটায় এল।
ওই তো, লোকটা ওদের হোটেল পেরিয়ে রাস্তার বাঁ—পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে। দ্রুতগতিতে হাঁটার ফলে হাতের পেট্রোম্যাক্সটা বিপজ্জনকভাবে এদিক—ওদিক দুলছে। রুদ্র একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, সাড়ে তিনটে বাজে, ভুটানের সময় ভারতের থেকে আধঘণ্টা এগিয়ে, মানে এখানকার সময় হল চারটে। যদিও এখনও ঘুটঘুট্টি অন্ধকার, কিন্তু ভোররাত। বেশি সময় নেই হাতে। রুদ্র এতক্ষণ আড়াল রেখে হাঁটছিল, এবার ছুটতে শুরু করল।
লোকটা হঠাৎ পেছন ফিরে ওকে দেখতে পেয়েই প্রথমে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল, তারপর দৌড়োতে শুরু করল। রুদ্রও পেছন পেছন তিরবেগে দৌড়েচ্ছিল।
হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রায় জনশূন্য উরা উপত্যকার রাস্তায় এই চোর—পুলিশ ধরার খেলায় উৎসাহ দেবার জন্য একটা কাকপক্ষীও উপস্থিত ছিল না, শুধু নির্দিষ্ট ব্যবধানে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো লাইটপোস্টগুলো নীরব প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
প্রায় মিনিট পাঁচেক ছোটার পর পেট্রোম্যাক্সটা হঠাৎ লোকটার হাত থেকে ছিটকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা রাস্তা টপকে ওপারে গিয়ে আড়াতাড়ি ভ্যালির দিকে ছুটতে শুরু করল। রুদ্রর সঙ্গে তখন ওর ব্যবধান পঞ্চাশ মিটারও হবে না। রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে কোনাকুনি বেঁকে রাস্তা টপকে ভ্যালিতে পৌঁছোল। প্রথমে ছুটতে ছুটতে বেশ আরাম লাগছিল, ঠান্ডাটা কেটে যাচ্ছিল বলে, কিন্তু এখন এতদিন অনভ্যাসের ফলে অল্প হাঁপ ধরছিল আর পায়ের শিরাগুলোয় হালকা টান ধরছিল। তবুও ও ছোটার গতি কমাল না।
বিস্তীর্ণ ফাঁকা সবুজ গালিচার মতো ঘাস বিছানো ভ্যালিতে পূর্ণিমা চাঁদের আলোর নীচে লোকটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ও খুব বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে লোকটাকে ছুঁয়ে ফেলল। হাতের টর্চটা দিয়ে ঘাড়ে জোরে একটা রদ্দা মেরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল লোকটাকে। লোকটা চিত হয়ে পড়ল ঘাসের ওপর। রুদ্র ওর হাত দুটোকে মাটিতে চেপে রেখে চাপা স্বরে ইংরেজিতে বলল, ‘ফলো করছিস কেন বল? কী চাই তোর?’
লোকটা কিছু না বলে রুদ্রর মুখের দিকে চেয়ে রইল। নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টাও করছিল না। মুখে পরিষ্কার ভয় পাওয়ার চিহ্ন। দু—চোখে আকুতি। এই ঠান্ডাতেও ঘামে ভিজে উঠেছে কপাল। চাঁদের আলো এসে পড়েছে মুখে। রুদ্র আবার কথাটা রিপিট করল, এবার হিন্দিতে। তাতেও কোনো উত্তর না পেয়ে সজোরে দুটো থাপ্পড় কষাল লোকটার গালে। রাগে রুদ্রর মুখটা গনগন করছিল। পিছু নেবে, রাতদুপুরে এসে নজর রাখবে আর কথার জবাব দেবে না। রাগে হাতটাকে পেছন দিয়ে গিয়ে মোচড়াতেই লোকটা তীব্র যন্ত্রণায় মুখ দিয়ে একটা বিকট চিৎকার করতে শুরু করল। রুদ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাতটা ছেড়ে দিতে লোকটা মুখ দিয়ে জান্তব একটা আওয়াজ বের করতে লাগল, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল দু—পাশে।
রুদ্র ছিটকে উঠে দাঁড়াল। লোকটা বোবা!