ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা – ৫১

৫১.

পরদিন সকালে চোখ মেলতেই কানে এল আমার–প্রথম প্রশ্নেই রিনির কুশল জিজ্ঞাসা, কেমন আছো গো? ভালো তো? সর্দিটা কমলো?

কমবে কি রে? আরো জমলো বরং। বুকটা কেমন ভার ভার ঠেকছে। আমি বলি-তার ওপর কাশি হয়েছে আবার। ভারী কেশেছি কাল সারা রাত। জানিস?

তাই নাকি?

এত কাঁসি বাজালাম তোর কানে গেল না? আচ্ছা ঘুম তো তোর! এরপর যখন সানাই শুনবি টের পাবি তখন।

কিসের সানাই? বিয়ের?

বিয়ের নয়, হাঁপানির। বুকে সর্দি জমলে, কাশি হলে, ব্রঙ্কাইটিস হয়ে গোড়ার সেই সর্দি হাঁপানি হয়ে দাঁড়ায় শেষটায়। জানিসনে?

না তো!

জানবি কি করে, তোর মা তো হাঁপায় না আর। হাঁপানি আছে আমার মার। আমি জানি। যখন তা হয় না, এমন সাই সাঁই আওয়াজ বেরোয়–ঠিক যেন সানাইয়ের মই। আমি জানাই : সারা বাড়ি গমগম করে আওয়াজে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তিন চারদিন এমন ভোগায় যে, সে দৃশ্য চোখে দেখা যায় না রে! যার হয় তার যে কী করে কে জানে!

সারায় না কেন তোমার মা? ওষুধ নেই হাঁপানির?

এখন অব্দি বার হয়নি। ওষুধ খেয়ে একটু কমানো যায় কেবল। একবার হলে তিন চারদিন ভোগাবেই। ডাক্তার নলিনী সেনগুপ্তর একটা মিকশ্চার খেয়ে মা খুব উপকার পান। আর ডাক্তার বিধান রায় একবার আমার চিঠির জবাবে প্যালল বলে একটা ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন, হাঁপানি থেকে সেরে ওঠার পর সেটা খেলে, নিয়মিত খেয়ে গেলে অনেকদিন ধরে তিনি ভালো থাকেন বেশ।

খেলেই হয় তাহলে।

তা তো হয়। খায়ও তো মা। কিন্তু হাঁপানি যখন হবার ঠিক হবেই। কিছুতেই আটকানো যাবে না। দিন কয়েক হমু ভোগাবেই তোমাকে। আর তাতে যে ভোগ তারই শুধু কষ্ট না, যাদের সেই ভোগান্তি দেখতে হয়, তাদের কষ্টও কিছু কম নয়। অন্য ব্যারামের সঙ্গে হাঁপানির কী পার্থক্য তা জানিস?

কী?

আর সব রোগ হলে একেবারে শুইয়ে ফেলে, শুয়ে থাকা যায় মজা করে বেশ, কিন্তু হাঁপানির বেলায় সেটি হবার নয়। হাঁপানি এসেই তোকে বষিয়েদৈবে।

বসিয়ে দেবে?

হ্যাঁ, শোবার নামটি নেই। বসে বসে হাঁপাও দিন রাত। কী কষ্ট, কী কষ্ট! একটুও শুতে দেয় না রে–আগাগোড়া ঠায় বসিয়ে রাখে।

ভারী খারাপ হতো!

 খারাপ বলে! শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে যা কষ্ট হয় না–যেন প্রতি মুহূর্তে দম আটকে আসে দমকে দমকে আসে হাঁপটা-হাঁপানির ধমকটা।

কখন আসবে হাঁপানির ঐ ধকম আগের থেকে কি তা টের পাওয়া যায় না একদম?

যায় বইকি। প্রথম একটু সর্দি হয়, সবারই যেমন হয়ে থাকে। হয়ে থাকে, ফের সেরে যায়–কিন্তু হাঁপানি রুগীর বেলায় সেটি হয় না। সেই সর্দি শুকিয়ে গিয়ে বুকে বসে হাঁপানির সুখটান হয়ে দাঁড়ায় শেষটায়।

সর্দি না হতে দিলেই তো হয় বাপু!

তা তো হয়। ডাক্তার রায়ের প্যাললটা বোধহয় সেইজন্যই দেওয়া। লাংস-এর প্রতিরোধ শক্তি বাড়িয়ে সর্দিটাকে আটকায় গোড়াতেই

তুমি বাপু সাবধান হও তো! বাবার মুখে শুনেছি, কতগুলো ব্যারাম আছে যা বাপ মার থেকে ছেলেমেয়েতে এসে বর্তায়–ঐ হাঁপানি তার ভেতর একটা-উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির মতই।

জানি তো। মা-ই বলেছে আমায় যে, আমারও হতে পারে। হবে হয়ত বা। তবে একটা সান্ত্বনার দিকও আছে জানিস? হেঁপোরুগীরা অনেকদিন বাঁচে, দীর্ঘজীবী হয় নাকি!

কাজ নেই ছাই অমন দীর্ঘজীবী হয়ে-কষ্ট পেয়ে কষ্ট দিয়ে ওরকম বেঁচে সুখ?

 মার ধারণায় ওটা একটা আধ্যাত্মিক অসুখ। যাদের কিনা আত্মার আকূতি থাকে …আকূতি মানে জানিস?

উঁহু। …আকূতি আবার কী? তুমি জানো?

জানি না ঠিক। আঁকুপাঁকু গোছের একটা হবে বোধ হয়। ইঁদুর কলে পড়লে যেমনটা হয়, কিংবা তোর জন্যে মাঝে মাঝে যেমনটা আমার হয় না?…

আত্মারই বলে কোনো পাত্তা নেই। তার আবার আঁকুপাঁকু।

মানুষ যা মনের থেকে চায় না? যখন পায় না, যারা নাকি তা পায় না–অনেকে না পেলে কিছু মনে করে না, ভূলে যায় এক সময়, কিন্তু যাদের নাকি মনের ভেতরে তা চাপা থাকে–যারা কিনা সেই না-পাওয়াটা অন্তরে অন্তরে ফীল করে, তাদেরই নাকি ঐ হাঁপানিতে ধরে ভাই! প্রতিভাবান আর সাধক মানুষদেরই বেশি হয় এই ব্যারামটা।

চাইনে আমার প্রতিভাবান হয়ে। প্রতিভা আর হাঁপানিকে সে এক তুড়িতে উড়িয়ে দিতে চায়।

আমি কিন্তু চাই যে, আমার হোক। মাঝেসাঝে এক-আধটু হক আমার…প্রতিভাবান না হতে পারি, ওই হাঁপানিবান তো হতে পারব। বিবেকানন্দর ছিল নাকি ওই হাঁপানি, আর রবি ঠাকুরেরও নাকি…

হোক গে, থাকুক গে, তোমার হয়ে কাজ নেইকো…

আমিও সেটা ভাবি একেক সময়। কাল রাত্তিরে যখন কাশির ধমকটা আসছিল না, ভাবলাম, ধরল বুঝি হাঁপানিতে আমাকেও, মার মতন আমিও গেলাম বুঝি! সম্ভাবনাটায় একটুখানি সুখ হলেও ঘাবড়ে গেছলাম বেজায়। কাশির ধমকের ওপর আবার যদি আমায় হাঁপানির ধমকানি খেতে হয়, তাহলেই আমার হয়েছে। আর দেখতে হবে না। বারোটা বেজে যাবে আমার।

সর্দিটা সারাও দেখি বাপু দয়া করে…

সর্দি কোথায়? সেরে গেছে তো। তার বদলে কাশিই আমার এখন…

মোটেই সারেনি তোমার সর্দি। বসে গেছে বুকে। কাশি হচ্ছে সেই জমাট সর্দিকে তোলবার জন্যে শরীরের স্বাভাবিক প্রয়াস। বুঝেছ? বাবার মুখে শোনা আমার। জানো?

ডাক্তারের মেয়ে হয়ে শোনা কথার বিদ্যে ফলাচ্ছিস যে ভারী! আমি ঠাট্টা করি– লেডি ডাক্তার হবার আগেই তোর এই ডাক্তারি!

ঐ হাঁ করে থাকাটা বন্ধ করে দেখি। হাঁ করে ঘুমোনোটা বন্ধ করো তত তোমার…জেলের দাদাটি কী বলে গেলেন কালকে? শুনলে না? কানে তুলছ সে কথাটা?

কানেই তোলা রয়েছে, নাকে নামানো যায়নি। নাক বোজা থাকলে, বোঝাই থাকলে, আমি তার কী করব? নাক কি আমার বাধ্য নাকি? মুখও অবাধ্য! নিতান্তই অবুজ আমার মুখ, কিন্তু নাক আমার বেশ বুজদার। বুঝেছিস?

সারারাতই কাল বুঝতে হয়েছে আমাকে। বুজুতে হয়েছে। যতবারই হাত দিয়ে তোমার মুখ বুজিয়ে দিয়েছি না, পরমুহূর্তের দেখি তুমি ফের হাঁ করে বসে রয়েছে।

কি বললি? আমার মুখে হাত চাপা দিচ্ছিলিস তুই? আমি ফোঁস করে উঠি।

একবার নাকি? যখনই আমার ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখেছি যে, তুমি বদন ব্যাদান করে শুয়ে, তখনই আমি…কেন, টের পাওনি তুমি?

টের পেলে কি রক্ষে রাখতুম তোর? তোকে এই অযথা হস্তক্ষেপ করতে দিতুম নাকি?

অযথা?

অযথা নয়? দস্তুর মতন অনধিকার চর্চা, আমি বলব। হাত হচ্ছে হস্তগত করার জন্য–পরের কিংবা পরীর পাণিগ্রহণের হেতু। কারো মুখ হাতাবার জন্য হয়নিকো। আর ঐ মুখের সঙ্গে সব সময়ই মুখোমুখি হতে হয়।

হলেই বা কী! তুমি তো তখন ঘুমোচ্ছিলে গো! টের পেতে কী করে? বাজে বরবাদ যেত কেবল।

যেত যেত আমার যেত-তোর কী! সে আমি বুঝতুম। আমি বলি- তুই তো ভারী কেপ্লন রে! আমি যে কতো ঘুম ভেঙে উঠে, তুই অঘোরে ঘুমুচ্ছিস দেখে, অকাতরে, অপব্যয়ের কথা বিন্দুমাত্র বিবেচনা না করে না, মেয়েরা ভারী হিসেবী হয় বলে যে, তা মিথ্যে নয়।

এখন বুঝলে তো! এখন দয়া করে তোমার ওই মুখটিকেও বোঝাও। বোঝাও এবং বোজাও।

বুঝেছি। এখন আমার খেসারত চাই। আমার ওপর তোর এই অনধিকার হস্তক্ষেপের…

তুমি যে শেষমেস এদিকেই ঠেলে আনছো তোমার কথার ধরনে আগেই তা টের পেয়েছি। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে! তুমি হাঁ করলেই আমি তার আঁচ পাই, তা জানো? তা খেসারত তুমি পাবে কিন্তু তার আগে তোমাকে মুখ বুজে থাকতে হবে, নাক দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে হবে পাঁচ ঘন্টা!

আবার ঘন্টা! পাঁচন খাওয়ার মত মুখখানা করে জানাই-প্রাণায়াম আমার ধাতে পোষায় না–অঙ্কের মতই অবিকল। বাবা আমায় ছোটবেলায় অনেক শিখিয়েছিল জানিস? অষ্টাঙ্গ যোগের নাম শুনেছিস কখনো?

যাদব চক্কোত্তির পাটিগণিত? পাটিগণিতের যোগ আর জানিনে!

শিব্রাম চকরবরতির খাঁটি অ-গণিত। যোগফোগ সব অঙ্কের ব্যাপার, আতঙ্কের ব্যাপার আমার আছে। পাটিগণিতের যোগের মতই বাবার ওই প্রাণায়ামযোগ করা সহজ নয়, দারুণ কষ্টসাধ্য কৃচ্ছসাধন। আমার দ্বারা হবার নয়। আমি অমনি পেলাম তো পেলাম, ঐ উসিতরসে…যা বলেছিলাম। উসিতরসে পেলাম–তর হয়ে গেলাম। নইলে অত কষ্ট করে যোগের অঙ্ক কষে আমার অঙ্কশায়িনীকে যদি পেতে হয় তো আমার তা চাইনে।

তোমার ভালোর জন্যেই বলেছিলাম। হাঁ-করা ছেলেদের কোনো মেয়েরা পছন্দ করে না তা জানো?

কোনো মেয়েদের চাইছে কে? আমি সেই মেয়েটির অপেক্ষায় থাকব, যে নাকি বেশ সমঝদার, যা বোজাবার-যা যা বোঝাবার-মুখে মুখে বোঝাতে পারবে আমায়। তোর মতই যে কিনা আমি-হাঁ করলেই তার আঁচ পাবে, আর আঁচ পেলেই আঁচাতে দেবে আমাকেও। খাবার পরেই না আচাবার কথা!

আঁচিয়ে কাজ নেই তাহলে। তুমি ওই ই-করাটাই প্র্যাকটিস করে যাও। ওর একটা ভালো দিকও আছে ভেবে দেখলে। নাকডাকা বরকে নিয়ে ঘর করা যায় না। হাঁ করে থাকলে তোমার নাক ডাকবে না। সেটা মন্দের ভালো। কানের পাশে সারা রাত নাক ডাকলে, ঘুমোনোর দয়া রফা!

হ্যাঁ, কথাটা তোর খাঁটি। কানের গোড়ায় নাকের ডাকাতি হলে ঘুমটাই মাটি। কান পাতাই দায় হবে, চোখের পাতা বুজবি কি, তবে সে ভাবনা তোর কিসের! তুই তো আমায় বিয়ে করতে যাচ্ছিসনে…।

আহা, নিজের কথাই ভাবছি নাকি আমি। যে তোমার বউ হবে গো তার কথাটাই ভাবছিলাম…তোমার নাক ডাকলে তাকে নাকাল হতে হবে না?

তার ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না। সে কোনোদিন হবার নয়… এসব আলতু-ফালতু কথার আগড়ম-বাগড়ম আউড়ে আসল কথা তুই ভুলিয়ে দিতে পারবিনে। খেয়াল আছে। আমার–খেসারত চাই। চাই-ই। নইলে ছাড়ছি না।

আচ্ছা নাছোড়বান্দা তুমি! সে তার গালটা এনে আমার হা-এর ওপর রাখে। একটুক্ষণ।–হোলো তো? এখন যাই, তোমার ওষুধটা নিয়ে আসি গে চট করে। পাঁচ দাগ তো ফাঁক করেছে, দুদিনের ওষুধ একদিনেই খেয়ে বসে আছো দেখছি…

দু দিনের ওষুধ ছিল বুঝি? বলিসনি তো আমায়?

প্রত্যহ তিন দাগ-তিন ঘন্টা বাদ বাদ। লিখে দেয়নি শিশির গায়ে?

শিশির দিকে নজর দিলাম কখন? শিশির-সম্পাতে কি নজর দেওয়া যায়–চোখের সামনে সমুদ্র উথলালে?

যাক, খেয়ে ভালোই করেছ বোধ হচ্ছে। জ্বরটা ছেড়ে গেছে তোমার ওই জন্যেই মনে হয়।

জ্বর নেই যে কি করে টের পেলি? তুই কি থার্মোমিটার?

বাঃ, এক্ষুনি আঁচ পেলাম না? গা তোমার গরম নয় গাল ঠেকিয়ে দেখলাম যে!

দেখলি তো! না আঁচালে বিশ্বাস হয় না। আঁচ নিলি বলেই না…কিন্তু বাপু যাই বল, কাজটা তোর ঠিক হহলো না। উচিত হয়নি। কাল রাত্তিরে আমার অজান্তে আমার প্রতি বিমুখতা করেছিস, আর আজ সকালে এমনি করে আমাকে তোর গাল দেওয়াটা…এই অপমান? যাক, এখনকার মত সয়ে গেলাম। দাবী আমার রয়েই গেল। পাওনা আমার মিটলো না কিন্তু।

যেতে দাও তো আমায়। ছাড়ো এখন লক্ষীটি! ওষুধটা নিয়ে আসি গে। দেরি করলে ভারী ভিড় জমে যাবে ডিসপেনসারিতে। ফিরবার পথে ফের তোমার খাবারটা–খিচুড়িভোগ–নিয়ে আসতে হবে না আবার? কী বলবো ডাক্তারবাবুকে? জ্বরটা সেরেছে কিন্তু কাশি হয়েছে। বেজায়? এই তো!

আমিও যাব তোর সঙ্গে আজ। আজ তো আমার জ্বর নেই আর। তবে যাবার বাধা কোথায়?

এসো তাহলে চটপট।

ডক–জেলখানাটার এক টেরে ডিসপেনসারি। ডাক্তারের হাবভাব মোটে নেই এমন এক কম্পাউন্ডার মার্কা ডাক্তার বসে ঘরটার একধারে। তাঁর সামনে জনাদশেক রুগী দাঁড়িয়ে

আর পাশের টেবিলে প্রকাণ্ড এক কাঁচের জার-ভর্তি রঙচঙে কী এক মিকশ্চার।

তিনি ব্যাজার মুখে রোগবৃত্তান্ত শুনছেন, আর জার থেকে ওষুধ ঢেলে দিচ্ছেন সবাইকে।–আর বলছেন-দুদিনের জন্য দেওয়া হল। প্রত্যহ নি দাগ খাবে। তিন ঘন্টা অন্তর। আসতে হবে দুদিন বাদে।

কারো সর্দি, কানো সর্দিকাশি, কারো জ্বর, কারো আমাশা, কারো সেটা রক্তঘটিত, কারো বা পেটের অসুখ–কিন্তু সবার জন্যে সেই এক দাবাই। কারো নাড়ি দেখা কি বুকে নল ঠেকানোর কোনো বালাই নেই।

কিন্তু আশ্চর্য, সেই ওষুধ খেয়েই জ্বর ছেড়েছে আমার। কাশিটাও আমার কমল। কিন্তু তার পরেই এসে হাজির হোলো গলা ব্যাথা আর পেটের অসুখ।

একি ওষুধ রে বাবা! একটা সারায় তো আরেকটা এসে পাকড়ায়। আমি তাজ্জব হই-বুক সারলো তো এদিকে পেট ছাড়লো!

ওষুধ খেয়ে হয়নি। অসুখের উচিত পথ্য তুমি পাচ্ছো কী?–খিচুড়ি কি রুগীর পথ্যি নাকি? তাই খেয়েই তোমার এই পেটের অসুখটা। আমি বলি কি, এসব যা তা না খেয়ে এর চেয়ে বরং উপোস করে থাকো আজ দিনটা। শুধু উপোস করলেও অনেক বোগ সেরে যায়, বাবা বলেন।

বারে! বলছিস মন্দ না! পেটেও কিছু পড়বে না, মুখেও কিছু পড়বে নানা খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে মরি আর কি!

সত্যি বলতে, উপোস দিয়ে রোগকে পোষ মানানোর পক্ষে আমি নই। আমার মতে না খেয়ে বাঁচার চেয়ে গান্ডেপিন্ডে গিলে মরাটা ঢের ঢের ভাল–গন্ডের খাদ্য আর খাদ্যপিড যদি এক সঙ্গে মিলে যায়।

তাহলে অমন পেট ঠেসে না খেয়ে কম কম করে খাও বরং।

পরদিন আমার আমাশা দেখা দিল–তারপর সেটা দাঁড়াল রক্তামাশায়। তারপর দিন জ্বরটা ঘুরে এলো তার ওপর। আবার এলো কাশিবাসের ধকল।

রোজ ডিসপেনসারিতে যাই। সেই ডাক্তার-কাম-কম্পাউন্ডারকে সবিস্তার রোগ বৃত্তান্ত জানাই। সেই একই জারের একমাত্র দাবাই কয়েক মাত্রা করে পাই। তাই খাই তিন ঘন্টা বাদ বাদ। খেয়ে যাই ঘন্টায় ঘন্টায়। দুদিনের দাবাই একদিনে সাবাড় করি। আবার যাই পরদিন।

ওষুধ খেতেও তুমি কম ওস্তাদ নও বাপু! দশদিনের দিন ডিসপেনসারি থেকে দশম শিশিটি এনে রিনি বললে–ডাক্তারেরও তাক লেগে গেছে দাদা! বলছিলেন যে, কোন রোগই সারছে না, এত ওষুধ যাচ্ছে কোথায়?

সেদিন আমি ডিসপেনসারিতে যেতে পারিনি-কাহিল হয়ে শুয়ে ছিলাম নিজের বিছানায়। দশকমের রোগ এসে আমায় শুইয়ে দিয়েছিল।

এই দশ দিনেই এই দশা আমার! এত রোগ! কোনটাই সারছে না, সবগুলোই বাড়ছে। আর বিশদিন বাদে যখন তুই থাকবিনে, আরো কী দুর্দশা হবে আমার কে জানে!

কেন, থাকবো না কেন আমি?

তুই তো এক মাসেই খালাস! আমার যে দু মাস রে! ছাড়া পেয়ে তুই চলে যাবি আমার চোখের ওপর দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে…আমি এখানে একলাটি পড়ে থাকব বেঘোরে।

তুমিও কেন সেই সময়ে চলে এসো না আমার সঙ্গে? শুনেছি আপিসে গিয়ে আন্ডারটেকিং দিলেই ছেড়ে দেয়…ছেড়ে দিচ্ছেও…ছাড়াও পেয়েছে নাকি কেউ কেউ।

আমার আন্ডারটেকার কে হবে? কে আছে এখানে আমার? আমার কথায় সে হাসল-বালাই ষাট! আন্ডারটেকার কী গো! আভারটেকার কাকে বলে তুমি জানো? ক্রীশ্চান ইস্কুলে পড়ো নি তো, জানবে কি করে? আমি সেন্ট মেরিতে পড়ি, আমি জানি…

তুই সেন্ট মেরিতে পড়িস, বলিসনি তো আমায়? এদিকে আমি দিনের পর দিন বেথুন ইস্কুলের সামনে মাথা খুঁড়ে মরছি…আর ওদিকে তুই কি…হায় হায়, আমার এত খাটাখাটনি সব বৃথায় গেল!

আমিই তোমার হয়ে আন্ডারটেকিং দেব না হয়। তুমি অসুস্থ তো, আমিই তোমার গার্জেন এখন। তোমার ভাই না আমি? খাতায় লিখে দিয়েছি তাই।

আচ্ছা, তাই হবে। তাই হবে না হয়। কিন্তু এই একটা মাসই কাটাই কি করে? এই মাসটাই কি কাটবে আর আমার? কাটলে হয়।

কিন্তু আশ্চর্য, সারা মাসটা আমার এক রাত্তিরেই কেটে গেল সেদিন…কি করে যে! অত! সেই রাত্তিরেই আমার তামাম রাত কাবার হলো!

ঘুম আসছিল না কিছুতেই। শুয়ে শুয়ে ছটপট করছিলাম। জ্বরটা বেড়েছে। পেটের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রনা। বুকের ভেতরেও কেমন যেন করছিল। হার্টফেল করবো নাকি আমি?

রিনি প্রায় মার মতই সেবা করছিল আমার। জলপটি লাগিয়েছিল কপালে। রুমাল নেড়ে হাওয়া করছিল সে। হাত বুলাচ্ছিল গায়ে। আর মাঝে মাঝে অযাচিতই সারা মুখে মুখ বুলিয়ে দিচ্ছিল–বলছিল উঃ! কী গরমই না হয়েছে গাটা তোমার। আজ রাতটা কাটলে হয়। কাল সকালেই আভারটেকিং দিয়ে চলে যাব আমরা এখান থেকে। এখানে থাকে কেউ? এই নরকে.এমন নরকযন্ত্রনায়? এখানে থাকলে মারা পড়বে তুমি। কী ড্যাম্পো জায়গাটা বাবা! ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, পথ্যি নেই, কিচ্ছু নেই এখানে। আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফেললে আমার বাবা দুদিনে সারিয়ে দেবেন তোমায়–দেখো না।

এমনি সব আবোল-তাবোল কতো কী যে বলছিল–যেমন করে ছেলে ভোলায়, তেমনি করে আদর দিয়ে, সান্ত্বনা দিচ্ছিল সে আমাকে।

আমার তো নেই-ই, তার দুচোখেও ঘুম ছিল না। মাঝরাতে হঠাৎ সে উঠে বসলো চুপটি করে শুয়ে থাকো, আমি একটু বাইরে থেকে আসি। এক্ষুনি আসব।

এত রাত্তিরে বাইরে কেন রে?

একটু বাইরে যেতে হবে যে। এক্ষুনি আসব।

জলবিয়োগে বুঝি? বুঝেছি। শীতের রাত্তিরে এত বেশী করে জল খায় নাকি কেউ?–খেলেই এই ঝঞ্ঝাট। যা তবে।

গিয়েই তক্ষুনি সে ফিরে এল-না, গেলাম না আর।

তার মানে?

দেবেনদা বাইরে দাঁড়িয়ে। দেখেই চলে এলাম।

 আর কেউ নেই এখন বাইরে?

না, সে একলাটি দাঁড়িয়ে…কেন কে জানে!

 কী করছে সে ওখানে? চল দেখি তো। আমি তোর সঙ্গে যাচ্ছি, চ।

বাইরে গিয়ে দেখি তাই বটে। চুপ করে একলাটি দাঁড়িয়ে রয়েছে দেবেন। কেন, কে মানে। দেবেন, তুমি? এত রাত্রিরে একলা দাঁড়িয়ে কী করছে এখানে?

পাহারা দিচ্ছি ভাই!

 কিসের পাহারা? শুনে আমার তাক লাগে। কাকে পাহারা দিচ্ছো আবার?

পাছে কেউ জেল থেকে না পালায়। আমাদেরকেই আগলাচ্ছি। পাহারা দিচ্ছি তোমাদের সবাইকেই।

কেন, জেলের পাহারা নেই? তারা সব গেল কোথায়?

কে জানে কোথায়! জেলের গেট খোলা, দেখছো না? সদর গেট খুলে রেখে পাহারাওলারা ঘুমুতে চলে গেছে সবাই। কেউ কোথাও নেই, দেখছ না?

দেখছি তো, কিন্তু কেন বল তো? জেলে তো পাহারার ভারী কড়াকড়ি থাকে শুনেছি– এখানে এমনটা কেন?

এখানকার সবই অদ্ভুত! ডিসপেনসারিতে ডাক্তার নেই, সদর দরজায় পাহারা নেই! রিনির টিপ্পনি।

কর্তারা ইচ্ছে করেই খুলে রেখেছেন। জেল থেকে পালিয়ে যাবার জন্যে সুবিধে করে দিচ্ছেন সবাইকে। পালাতে ওসকাচ্ছেন জেলের ছেলেদের। এত ছেলের ধাক্কা সামলাতে পারছেন না তাঁরা-জেলের এত খোরাক যোগাতেও হিমসিম খেতে হচ্ছে বোধ হয়। ফতুর হয়ে গেল সরকার। তাই এই ব্যবস্থা নিয়েছেন মনে হচ্ছে। যার খুশি সে না জানিয়ে চলে যাক না! কোথাও কোনো বাধা নেই।

দিনের বেলায় আন্ডারটেকিং দিয়েও তো চলে যাওয়া যায় শুনেছি। যেতে পারে না ছেলেরা?

যায় বইকি কেউ কেউ। কিন্তু কারো কারো চক্ষুলজ্জায় বাধে না কেমন? তাই রাত্তিরে পালায় তারা, তাদের জন্যেই আমি…আমরা…জেলের দাদারা পালা করে পাহারা দেবার ব্যবস্থা করেছেন। ওরা গেট খুলে রাখলে কী হবে, আমরা কাউকে ওই গেট পেরুতে দিচ্ছি না, পালাতে দেব না কারুকেই। এখন আমার পাহারা দেবার পালা কিনা।

তাই বুঝি! তা রিনির–মানে–রিন্টুর যে একটু বাইরে যাবার দরকার পড়েছিল। দিনভোর ঢক ঢক করে জল গিলেছে তো তার জলাঞ্জলি না দিলেই নয় এখন।

যাক্ না! গেট তো খোলাই আছে…সেরেই আসুক গে চটপট। আমরা তো এখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভয়টা কিসের।

না না, ভয় কিসের দেবেনদা। কোনো ভয় করছে না আমার।

গেট পেরিয়ে সে বেরিয়ে যায়-বাইরের আলো-আঁধারি দিকটায়।

খানিক বাদেই তার আর্তনাদ আসে-শিব্রামদা-শিব্রামদা…শিব্রামদা…চট করে এসো তো একবারটি।

দাঁড়াও, দেখে আসি তো কী হোলো আবার। সাপে কামড়ালো নাকি ছোঁড়াটাকে।

আশ্চর্য নয়! গঙ্গার এ-ধারটায় গর্তে গর্তে খানাখন্দে ভরতি-সাপ-খোপ বেজায়। কিন্তু আমি তো ভাই এখান থেকে নড়তে পারবো না এখন। সে বলে : দাদাদের কড়া হুকুম। তুমি গিয়ে দেখে এসো গে। যদি ধরে নিয়ে আসতে হয়, একলা না পারো, তখন আমায় ডেকো। আমি যাবো।

আমি বাইরে বেরুতেই রিনি আমার হাত চেপে ধরে-চলো, এখুনি পালাই এখান থেকে। কেউ কোথাও নেই। রাস্তায় একটা ছ্যাকরা গাড়িটাড়ি পাকড়ে বাড়ি চলে যাই সটান! :

সাপে কামড়ায়নি তো তোকে?

না গো! তোমাকে বের করে আনার জন্যেই ওই ফিকিরটা বার করলাম… আর দেরি করো না, এক মুহূর্ত নয়। দেবেনদার সন্দেহ হতে পারে।

জেল ভেঙে নয়, পাঁচিল টপকে নয়, কোনো বীরোচিত ভাবের ধারকাছ দিয়েও নয়কো, নিতান্তই কাপুরুষের ন্যায় সেই রাত্তিরেই জেলের থেকে পালালাম আমরা। বুক টান করে গিয়ে সেই আমাদের পিঠটান দেওয়া।

.

৫২.

 ডক্ এরিয়া ছেড়ে খানিকটা এগুতেই একটা গলির টেরে খানকয়েক ছ্যাকরা গাড়িকে খাড়া দেখলাম। তারই একশো এগারো নম্বরের একখানাকে ভাড়া করে রিনি গিয়ে চেপে বসল আমায় নিয়ে।

ভাড়া তো করলি, কিন্তু মেটাবি কি করে? আমি বললাম পকেট ফাঁকা, গড়ের মাঠ। একটাও টাকা নেই আমার।

তোমার তো খালি টাকাই নেই, আমার যে একটা পয়সাও নেই গো!

তা হলে?

বাড়ি তো গিয়ে পৌঁছুই আগে। বাবার কাছে চাইবো। তিনিই মিটিয়ে দেবেন তখন।

মার কাছে চাইলেও পারিস।

মা? বাব্বা! মার সামনে এখন আমি এগুচ্ছি না সহজে। আমাকে দেখলে আর রক্ষে রাখবে না মা–কী যে আমার অদৃষ্টে, ভগবানই জানেন!

রক্ষে রাখবে না? জেলে যাওয়ার জন্যে বকবে বুঝি খুব?

শুধু জেল! কতো কী! সে তুমি কি বুঝবে তার! সে গুমরায়।

 মাকে এড়িয়ে কতক্ষণ থাকবি? বাড়িতে মার সামনে না পড়ে থাকা যায় নাকি?

ঢাল দিয়ে যেমন তরোয়াল আটকায় না? তেমনি আমি বাবার আড়ালে আড়ালে থেকে মাকে ঠেকাবো।

আমার বরাতে ঠিক উলটোটাই। আমায় মার আড়াল দিয়ে বাবাকে ঠেকাতে হয়। বাবার মার এড়াতে মার আবডাল লাগে আমার।

বাবা খুব মারে বুঝি তোমায়?

বাঃ! মারে না? না মারলে তো বাবা কিসের! মারবার জন্যেই তো বাবারা জন্মেছে রে! বাবার এক এক চাপড়ে পাঁচ পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে যায় আমার গায়ে। মা তখন কতো আহা আহা করে হাত বুলিয়ে রুজে দেয় জায়গাটা-তখন ডবোল আরাম। তাইতেই পুষিয়ে যায় আমার। মার খাবার ইচ্ছে করে আবার!

আমরা যখন বেরুলাম জেল থেকে, জেল-ফটকের ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটা দেখেছি। এতক্ষণে চারটে বেজেছে মনে হয়। এখান থেকে আহিরিটোলা তো কমখানি পথ নয়, বেতো ঘোড়ারা যেমন ঢিমে চলছে না, এমনি টিকিয়ে টিকিয়ে যেতে যেতে বাড়ি পৌঁছতে সাতটা বেজে যাবে নির্ঘাত। বাবা নীচে নেমে এসেছেন ততক্ষণে। তার চেম্বারে রুগীপত্তর আসতে শুরু করেছে। বসে বসে তিনি রুগী দেখছেন তখন, দেখব গিয়ে আমরা।

বৈঠকখানার ঘরে বসে রুগী দেখেন? মা সেখানে আসেন না কখনো?

নেহাত দরকার পড়লে আসেন, নচেৎ নয়। রিনি কয়ঃ বাবা ঘুম থেকে ওঠেন কাঁটায় কাঁটায় চারটেয়-শীত কি গ্রীষ্ম কী! চানটান সেরে চা-টা খেয়ে তৈরি হতে পাঁচটা বাজে তাঁর। সাড়ে পাঁচটায় তিনি নীচের চেম্বারে নেমে আসেন। হকার সেই ভোরেই স্টেটসম্যান দিয়ে যায়, পড়েন বসে বসে। তারপর রুগীরা সব আসতে থাকে একে একে। আশপাশেরই তো রুগী যত, পাড়ারই বেশির ভাগ। তাদের দেখেন। যে যা দেয় তাই নেন।

আর দুপুর বেলায় করেন কী? পড়ে পড়ে ঘুমোন বুঝি আমার বাবার মতন?

 ঘুমুবেন বাবা? তবেই হয়েছে। ওঁর খালি কাজ আর কাজ। কাজ ছাড়া কথাটি নেই। এগারোটা না বাজতেই খেয়েদেয়ে ফের তিনি বেরিয়ে পড়েন-শহরতলীর কোথায় কোন এক জুটমিলে চলে যান। সেখানকার বাধা ডাক্তার তিনি। মাস গেলে সেখান থেকেও হাজার আড়াই আসে তাঁর। সেই জুটমিলের থেকেই।

তার ওপর এখানে সেখানে উপরি কল তো রয়েছেই। নেই কি রে? ঘরে বসে রুগী দেখে তার থেকেও তা পান আবার? মোটামুটি জোটে তাঁর বেশ, কী বলিস? আমার অনুযোগ।

তা তো জোটেই। তবে বাবার বেশির ভাগ আয় ঐ জুটের থেকেই।

আর ওই এধারে-ওপারে যা জুটে যায়। তাই বা কম কী রে?

ডাক্তারদের উপায় কি কম নাকি গো? সেইজন্যেই তো ডাক্তার হতে এত সাধছিলাম তোমায়!…এবার তুমি সেরে উঠে পড়াশুনায় মন দেবে তো, কেমন? দেশোদ্ধার তো হয়ে গেল! দেখলে তো সব। এবারটি নিজেকে উদ্ধার করতে লাগো এখন।

বাঃ, এ কী হোলো! দেশের জন্যে প্রাণ দিতে হয় না? দিয়েছি কী?

 দিতে বসেছিলে প্রায়। বুদ্ধি করে তোমায় বাঁচিয়ে আনলাম-তাই না? দেশের জন্য একবার করলেই হোলো, ছেলেমেয়ে তো কম নেই এদেশে। তারা করুক এবার। দেশোদ্ধারে– কাজ তো ভাই একজনের নয়–সবাই মিলে করবার-তাই না? তাদের সবাইকে চা দাও এবার। দেশের কাজ করার সবাই সুযোগ পাক। নিজেই একলা দেশটাকে টেনে তুলবে, এমন স্বার্থপর হয়ো না গো!

আহিরোটোলা পৌঁছুতে সাতটা বাজলো প্রায়। রিনির বাবা চেম্বারে এসে বসেছেন তখন। একজন রোগীকে দেখছিলেন খুব যত্ন করে। রিনি গিয়ে বলল, বাবা, গোটা কয়েক টাকা দাও তো, গাড়িভাড়া মেটাবো।

রুগী দেখার ফাঁকে চোখ তুলে তাকালেন একবার, একটি কথাও না বলে টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিতে বললেন ইশারায়।

রুগীদের ফীসের টাকা টেবিলের ওপরে ছড়ানো পড়েছিল, তার থেকে নিয়ে রিনি বেরিয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম চুপটি করে।

রিনি ফিরে আসার আগেই সে রুগীটিও ফী দিয়ে চলে গেছে। আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে আসছিল কেমন। সামনের সোফাটায় গিয়ে বসে পড়েছি।

রিনিও এলো, আমিও এলিয়ে পড়েছি সোফায়।

বাবা, রামদাকে একটু দেখবে? কী হয়েছে ওর! রিনি বলল, কদিন ধরেই ও ভুগছে বেজায়?

শোনা মাত্রই ওর বাবা উঠে এসে আমাকে দেখতে বসলেন। রিনি তাঁর চেয়ারটা সোফার কাছে টেনে এনে রাখলো।

প্রথমে আমার হাত নিয়ে নাড়িটা দেখলেন তিনি। তারপর বুকে স্টেথোসকোপ বসালেন, তারপর পিঠের দিকে…ওরই ভেত্র এক ফাঁকে রিনিকে বলেছেন-ছোট সিরিঞ্জটা ধো তো বেশ করে। টেবিলের থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে আয়।

বেহুঁশের মত হলেও আমি হুঁশ হারায়নি তখনো। প্রায় আচ্ছন্নের ন্যায় হয়েও, টের পাচ্ছিলাম সব। শুনতে পাচ্ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম বেশ।

উনি আমায় একটা ইনজেকসন দিলেন আর বললেন–তোর মাকে ডাক তো একবারটি। দুধ গরম করে আনতে বল চট করে।

মাকে এখন বিরক্ত করার দরকার কী বাবা? মোড়ে মেঠাইওলার দোকানে তো পাওয়া যায় গরম দুধ। আনব?

তাই আন না হয়। ভাঁড়ে করে আনবি তো? ভাঁড়টা গরম জলে ভালো করে ধুয়ে দিতে বলিস গোড়ায়।

গরম জল যদি না থাকে? ওদের তো চায়ের দোকান না!

বেশ ফুটন্ত দুধ তো? তাহলে ওই গরম দুধ দিয়েই ভাঁড়টা গরম জলে ভালো করে ধুয়ে নিবি একটুখানি, বুঝেছিস?

আমি কি বেহুঁশ হয়ে পড়ছি নাকি? এক্ষুণি কি অজ্ঞান হয়ে পড়ত্ব? মারা যাব এবার? কী হয়েছে আমার যে!……

গলার থেকে বোল সরছে না আমার মাথার ভেতর যতো আবোল-তাবোল ভাবনা।

বাবার মতই হোলো নাকি আমার? বাবার যেমন মাঝে মাঝে হয়? দিন কয়েক অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন বিছানায়। তারপর একদিন আপনার থেকেই সেরে ওঠেন–জ্ঞান ফিরে পান আবার।

কী হোত যে বাবার কে জানে! তখনকার কালে ওসব রোগের নামধাম, চিকিৎসা কিছুই বেরয়নি নাকি।

চাঁচল রাজ হাসপাতালের ডাক্তার বিপ্রদাসবাবু আসতেন–দেখতেন। অজ্ঞানাচ্ছন্ন বাবাকে তাঁর যথাসাধ্য পরীক্ষা করতেন। দেখেশুনে শেষমেস বলতেন-কোমা হয়েছে তোমার বাবার। আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে এর কোনো দাবাই নেই। আমার জানা নেই অন্তত।

সারবেন না বাবা? কাচুমাচু হয়ে শুতাম। মারা যাবেন নাকি? সে কথা জিগ্যেস করার সাহস হত না, মন যে কেমনটা করত তখন!

সারলে আপনার থেকেই সারবেন! এখন কদিন এভাবে থাকেন কিছুই বলা যায় না। জল খাওয়াতে হবে খুব। আর ফলের রস-টস। এই লুক।

হাঁ করছেন না তো! খাবেন কি করে?

হাঁ করিয়ে খাওয়াতে হবে। ঐ জল আর ফলের রস। খুব একটু একটু করে। মাঝে মাঝেই।

ওষুধ দেবেন না?

এর কোনো ওষুধ নেই, বেরয়নি এখনো। কবরেজি শাস্ত্রে এই ব্যায়োকে সন্ন্যাস রোগ বলে থাকে। আমরা বলি কোমা!

কোমাটি কী?

কোমা হচ্ছে কোমা–আবার কী? মরবার আগে হয়ে থাকে অনেকের, আচ্ছন্নের মতন এই পড়ে থাকা। আবার মরবেই যে তারও কোনো মানে নেই। ভালোও হয়ে উঠতে পারে ভগবানের ইচ্ছায়। সবই তাঁর হাত।

কিন্তু মা যে বলেন, উনি এখন সমাধিতে রয়েছেন?

সেই কথাই বলেন। ঐ কোমাই। সংস্কৃত ভাষায় সমাধি। একেবারে খতম হবার আগে, মানে সমাধার আগে হয়ে থাকে।

না না, তা নয়। ঠাকুর পরমহংসদেব বলেন না…?

সেই সমাধি তো? জানি। যে-সমাধি হলে, উনি বলেন, লোকে আর ফেরে না, কদাচ দু-এক জনা ফিরে আসেন লোকশিক্ষা দেবার জন্যই? সেই তো? সেই কথাই তো কইছি আমি।

মার কিন্তু ভিন্ন মত ছিল। মা বলতেন, ছাই জানে ওই ডাক্তার। উনি এখন ব্রহ্ম সাক্ষাৎকারে রয়েছেন। দেবদেবীদের সঙ্গে মুলাকাত করছেন এখন।

একেবারে মূল ধরে টানতেন মা। সিরিয়াসলি বলতেন, কি ঠাট্টাতামাশায়-তা মা-ই জানেন!

মুলাকাতের কাতর দশা কাটিয়ে ফেরার পর বাবাকে আমি শুধিয়েছি, বাবা, তুমি নাকি ইন্দ্রলোকে চন্দ্রলোকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে? দেখা হয়েছিল মহাদেবের সঙ্গে? মা দুর্গাকে দেখেছ? দশ হাত নিয়ে লটর-পটর করছে মা? দশ-দশটা হাত নিয়ে কিছু অসুবিধা হচ্ছে না ওঁর! ঘুমোত পারছেন? পাশ ফিরে শোন কি করে?

মা হাসতেন আমার কথায়।-বোকা ছেলে কোথাকার। মার কি চোখ ঝুঁজবার ফুরসত আছে একদণ্ড? বিশ্বজোড়া এত ছেলেমেয়ের দায়ভাবনা ঘাড়ে নিয়ে…? এক মুহূর্তের জন্যে তিনি চোখ বুজলেই আমাদের চক্ষুস্থির! মায় মহাদেব সমেত সবার!

বলো না বাবা, কী হয়েছিল তোমার ওই? সমাধি না কী?

আমার কী হুঁশ ছিল রে! আমি বাঁচতে বসেছিলাম।

তার মানে, তিনি মরতে বসেছিলেন তখন। বাবা বলতেন, মন্দ কথা কখনো মুখে আনতে নেই। মুখের কথা ফুলে যায় অনেক সময়। তাই মরতে বসে না বলে ঘুরিয়ে অমনি করে বলা ঐ কথাটা!

বাবার জবাবে ডাক্তারের জবানির সায় ছিল যেন… .

অর্ধাচ্ছন্ন অবস্থায় আমার মনে হতে লাগল, বাবার সেই রোগটাই ধরেছে বুঝি আজ আমায়। উত্তরাধিকার সূত্রে মার হাঁপানি যেমন নাকি আমার পাওনা হয়ে রয়েছে, মা বলেছেন, তেমনি সেই জন্মসূত্রেই বাবার সন্ন্যাসের এই দায় আমার ঘাড়ে এসে চাপল এখন। বাবা সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে গিয়ে যে-পাহাড়ে ব্যাধিটা তাঁর জটাজুটে বেঁধে নিয়ে এসেছিলেন, হিমালয়ে না গিয়েই, ঘরে বসেই সেটা অমনি আমার জুটে গেল বোধহয়–নিখরচার এই আমদানি।

সেই কোমাই ধরেছে, ধরতে যাচ্ছে বুঝি আমায়?

কোমা? কোমাটা কী? আধা বেহুঁশ অবস্থায় নিজেকেই আমি শুধাই।

কোমা মানে কোমা-আবার কী? আপনার থেকেই জবাব পাই। বাক্যরচনার গোড়ায়, প্রথম পদক্ষেপেই যিনি দেখা দেন–সেই কমা-ই একরকম আর কি? ডাক্তারি ব্যাকরণে ঐ কোমা। অর্থাৎ বাক্য সম্পূর্ণ হয়ে সমাপ্তির দাড়ি টানার আগে, স্থানে অস্থানে মাঝে মাঝেই যিনি দেখা দিয়ে থাকেন। লাইফ সেটেনসের মাঝ-মধ্যের হলটিং স্টেশন–যার শেষে কিনা সেই ডেথ। অনিবার্য ডেথ সেনটেন্স?

আমি কি তাহলে দাড়ি টানার আগে সেই কমাতেই এখন দাঁড়িয়ে আছি?

রিনি গরম দুধের ভাঁড়টা রুমালে জড়িয়ে ধরে আনল, চোখের কোণে দেখতে পেলাম।

দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি যখন, তাহলে এখনো আমি হতজ্ঞান হইনি একেবারে।

কমার লক্ষণ নেই এখনো–এখনো আমি বাড়ার দিকেই রয়েছি। তবে? তাহলে?

হাঁ করিয়ে চামচেটা দিয়ে একটু একটু করে খাইয়ে দে তো ওকে। বললেন উনি, কিন্তু বসবি কোথায়? বসে খাওয়াতে হবে যে। সোফায় তোকে ধরবে না তো? কী করে খাওয়াবি তবে? তাহলে এই চেয়ারটায় বস না হয়। বসে বসে খাওয়া।

চেয়ারে বসে অ্যাদূর থেকে হাত বাড়িয়ে কি খাওয়ানো যায় বাবা? বলে রিনি চেয়ারটাকে হটিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

তাই তো বলছিলাম রে! তাহলে? তিনি কন : সেইজন্যেই তো তোর মাকে ডাকতে বলছিলাম।

বাবার জবাবে সে সোফায় বসে আমার মাথাটাকে নিজের কোলের ওপর টেনে নিল। নিজেই মা হয়ে বসল যেন। তারপর কোলের ছেলেকে মা যেমন ঝিনুকে করে দুধ খাওয়ায় না, তেমনি করে আগে ফুঁ দিয়ে গরম দুধটাকে একটু জুড়িয়ে নিয়ে খাওয়াতে লাগল আমায়। চামচের পর চামচ।

হাঁ করাতে হোলো না আমাকে। চিরকালের হাঁ-করা ছেলে হাঁ করেই ছিলাম, ঢক ঢক করে গিলতে লাগলাম বেশ।

এমন সময় রিনির মা দরজা ঠেলে ঘরে এলেন। একী? এ কে? চাঁচলের রাম না? এখানে অমন করে শুয়ে কেন গো? কী হয়েছে ওর?

ভারী শক্ত ব্যারাম গিন্নি। বুকে জল জমেছে। বললেন রিনির বাবা : প্লুরিসি হয়েছে ছোঁড়াটার।

.

৫৩.

 না, কোমা না। কমা নয়, সেমিকোলনেই ছিলাম এতক্ষণ। এমন কি, কোলনেও ছিলাম বলা যায়। রিনির কোলে মাথা রেখে দুধ খেয়েছি মনে পড়তে থাকে আমার। আচ্ছন্ন ভাবটা কাটার পর চোখ মেলে দেখি আমি বিছানাতে শুয়ে। এ কোথায়? এ তো সেই সোফা নয়, এমন কি ডাক্তারবাবুর রুগী দেখার ঘরও নয় এ।

রিনি আমার বিছানার পাশে বসে।–কোথায় রে আমি?

আমাদের তিনতলার ছাদে। চিলকোঠায়। রিনি বলল, বাড়িতে তো ঘর খালি নেই। ছাদের এই ঘরটাই ফাঁকা। এখানেই তুমি থাকবে।

চিলেকোঠায়? এই এক চিলতে ঘরে?

তোমার একলার থাকার পক্ষে তো যথেষ্টই–তাই নয়?

একলা থাকতে হবে আমায়? না বাবা, একলাটি থাকতে পারব না। দারুণ ভয় করবে আমার।

ভয় কিসের গো?

ভূতের ভয়, আবার কী? আমি বলি : ছোটবেলায় ভূতে ধরেছিল না আমায়? সেই থেকে ভূতের ভয় আমার ভারী।

ভূত কোথায় এখানে? কলকাতায় কি ভূত থাকে নাকি? থাকতে পায়? তিষ্ঠোতে পারে কখনো? ভূত যতো সব পাড়াগাঁয়।

সেই ভূতটা আমায় ছাড়েনি এখনো। জানিস? মনের মধ্যে রয়ে গেছে আমার। অন্ধকার ঘরে একলাটি পেলেই চেপে ধরে, ভয় দেখায় আমায়, বুকের মধ্যে এমন গুড় গুড় করে। একলা থাকতে হলে…আমি…আমি হয়ত হার্টফেল করেই মারা যাবো।

বেশ। আমিও থাকব না হয় তোমার কাছে। তুমি রুগী মানুষ, রাত-বিরেতে কখন কী দরকার পড়ে, ওষুধ-টষুধ খাওয়াতে হয় যদি, এই সব বলে-কয়ে মাকে রাজী করানো যাবে–থেকে যাব না হয় তোমার কাছে, কী হয়েছে

তাই বল্। এতক্ষণে ধড়ে প্রাণ এলো আমার। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলি-একতলায় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম না? একটু আগে…যখন তুই দুধ খাইয়ে দিচ্ছিলিস আমায়? তিনতলায় এলুম কি করে? কিছুই তো মনে পড়ছে না আমার।

আমি তুলে আনলাম যে তোমাকে!

তুই! তুই আনলি? কি করে আনলি রে তুই। কিছুই তো টের পাইনি।

কোলে করে আনলুম তো! একলাই আনতে পেরেছি…

বলিস কি রে! অবাক্ করলি আমায়!

অবাকটা কিসের? এমন কিছু ভারী কাজ নয়। কেন, চাঁচলে থাকতে তুমি যে আমায় কোলে করে মহানন্দা পার করেছিলে একবার–মনে পড়ে না তোমার?

তুই তো হাল্কা পলকা ছিলিস তখন। এখন আর পারব কি? আর তোকে কোলে নিয়ে মহানন্দা পেরুননা…সে তো মহানন্দের কাজ। তাছাড়া তোকে কোলে করতে পাওয়া তো এক বিলাস! আর আমি-আমি যে একটা দস্তুর মতন লাশ রে, প্রাণ নিয়ে টানাটানি ব্যাপার…

তুমিও এমন কিছু ভারী নও। কদিন ধরে ভুগে ঠিক যেন ফড়িংটি হয়ে গেছ। তোমাকে তুলতে এমন কিছু বেগ পেতে হয়নি।

এখনো তুই ঐ ছেলের পোশাক বদলাসনি? সেই হাফপ্যান্ট পরে রয়েছিস? মা কিছু বলছে না?

বলবে না আবার? তবে এখনো বলার ফুরসত পায়নি বোধহয়। তুমি অজ্ঞান হয়ে গেছ বিসি নাকি যেন হয়েছে তোমার-তাই নিয়ে বাড়ি সুদ্ধ ব্যস্ত সবাই। তাই এখনো আf আস্ত রয়েছি এতক্ষণ। দেখো না কী হয়…আমার অদৃষ্টে কী আছে দ্যাখো না! আমারে নিয়ে কী হয় এরপর দেখতেই পাবে।

তা নাহয় দেখবখন। কিন্তু তুই যে চামচেয় করে আমায় দুধ খাইয়েছিস তাতে…তার যা দুঃখ পেয়েছি কী বলব! সে আমার দুধ খাওয়া নয় বিষ খাওয়া হয়েছে। আর্ট সখেদে কই : তোকে এত করে সেদিন বোঝালাম যে, মুখ থাকতে হাতের কোনো কাত নেই-হাত কিসের জন্যে? আর তুই কি না! …কোনো উন্মুখ লোকের কাছে, এমন কি : যদি মরণোন্মুখও হয় না…মুখের কাছে দুধের পাত্র তুলতে হলে মুখটাকেই পাত্র করতে হয় নিজেই মুখপাত্র হবি। তা না হয়ে…?

মুখপাত্র হব? কি করে মুখপাত্র হবো? সে বুঝতে পারে না বুঝি।

কি করে আবার? মুখটাকেই পাত্র করবি তোর। মুখের মধ্যে দুধ নিয়ে না…চুমুকে চুমুতে খাওয়াবি আমায়। তাই তো নিয়ম।

তাই নিয়ম? কোথাকার সৃষ্টিছাড়া নিয়ম।–শুনি একবার?

মোটেই সৃষ্টিছাড়া নয়। এই সৃষ্টির মধ্যেই। তোর সৃষ্টির মধ্যেই তো? তুই-ই আমারে অমনি করে খাইয়েছিলিস একবার…একটা মিষ্টি জিনিস…তাতে ঐ মিষ্টি আরেকটা মিষ্টি সঙ্গে মিশিয়ে ডবোল মিষ্টি করে আমি পেয়েছিলাম.তোর কাছেই খেয়েছিলাম সব প্রথম আর…আর বোধ হয় সেই শেষ। মনে নেই তোর?

কক্ষনো না! কবে আমি খাওয়ালুম গো তোমায়?

ওর কথায় আমি আঘাত পাই সত্যিই! যে মুহূর্তক্ষণটি আমার প্রতিমুহূর্ত-আমা: সারাজীবন তাই ওর কাছে বিস্মরণ হয়ে রয়েছে। ওর যে ক্ষণিক আত্মবিস্মৃতি থেকে আমার আত্মবিস্মৃতি–কোনোখানেই তার বিন্দুমাত্র স্থিতি নেই আর একটু ও?

মেয়েরা বুঝি এমনিই! এমনি করেই মুহূরে লীলাবিলাসে কাউকে রাজা করে দিতে তার পরেই অবহেলায় তাকে ফকির করে ছেড়ে দেয়। ঈশপের ব্যাঙের গল্পটা মনে পরে যে, ব্যাঙ নাকি ঢিলছোঁড়া একটা ছেলেকে বলেছিল নাকি মেয়েকেই?), তোমার কাছে যা নেহাত হাসিখেলা, আমার বেলায় তা ভাই মরণদশাই নির্ঘাত!

আমার সেই ব্যাঙের জিম্মায়, মনের ব্যাঙ্কে সযত্নে এতদিন ধরে যে আধুলিটি জমিতে রেখেছিলাম তা আজ এই অর্ধচন্দ্র হয়ে দেখা দিল আমায়।

তাহলে তুই নোস, আর কেউ হবে বোধ হয়। ভুল করে গুলিয়ে ফেলেছি।

আমি ছাড়া আবার কে খাওয়ায় তোমায়? তির্যক চাউনি তারকার খাও আর?

তাও তো বটে! কার খাবো আর? তুই ছাড়া আমায় খাওয়াবার কে আছে আবার? আমি ভাবিত হই-তুই-ই খাইয়েছিলিস-তবে সেটা স্বপ্নই হবে বোধহয়। স্বপ্নেই দেখে থাকল হয়ত।

তাই বলো! সে হাঁপ ছাড়ে : হ্যাঁ, স্বপ্নে ওরকমটা দেখা যায় বটে। কততদিন আমিং স্বপ্ন দেখেছি অমন–যে তুমি আমায় খাচ্ছ, আমিও তোমায় …হ্যাঁ, সেটা হতে পারে।

সে কথা যাক, ই যে অসহায় অসতর্ক পেয়ে আমায় সঙ্গে ঈদৃশ আচরণ করবি তা আমি কখনো ভাবতে পারিনি…

কী ঈদৃশ আচরণ?

পথ্য দেবার ছলনায় আমার প্রতি অপত্যস্নেহ দেখাবি–এই রকম বাৎসল্য করবি? এটা করা কি তোর উচিত হয়েছে?

তোমার কথার মাথামুণ্ডু যদি বুঝতে পারি?

অজ্ঞান অবস্থায় ঝিনুকে করে দুধ খাইয়েছিস আমায়? ও তো ােকারা খায় রে। আমি কি খোকা নাকি এখনো? বড় হইনি আমি?

সন্দেহ হয়।

ঝিনুকে খাবার বয়েস আমার গেছে। আমি এখন চুমুক দিয়ে খেতে পারি। তাই খাব। চুমুকে চুমুকে খাওয়াবি তো তুই আমায়?

হয়েছে! থামো তো। চুপ করো এখন। এখানে ওসব উচ্চবাচ্য একদম না। কেউ শুনলে কি দেখতে পেলে আর রক্ষে থাকবে না। এ তোমার জেলখানা নয়। জেলের স্বাধীনতা এখানে নেই। এটা বাড়ি। বুঝেচ?

ভারী শেখাচ্ছিস আমায়। বাড়ি যে জেল তা আমি অনেককাল আগেই জানি–তুই বাড়িয়ে কী বলবি আর! সেই জন্যেই বাড়ি থেকে পালিয়েছি কবে। চিরদিনের জন্যই-ঘর ছেড়ে আমি এই হাঘরে!

তোমাদের বাড়ি জেলখানা? বোলো না, বোলো না–অমন কথাটি বোলো না। তোমার বাড়ির পরিবেশ আমি জানিনে নাকি? ওরকম স্বাধীনতা কটা বাড়িতে আছে? আর কী ভালো যে খাও-দাও তোমরা! কতো আম, কলো রসগোল্লা, কতো ক্ষীর সর পায়েস। আঃ! আয়েসে ওর চোখ বুজে আসে। ওই বাপ-মা, অমন ভাই-কজন পায় গো? আমি পেলে বর্তে যেতাম।

হাজার এ-ক্লাসের হলেও জেল সেই জেলই! বুঝেছিস?

অমন সুখের বাড়ি হয় নাকি! সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় তোমায়। সেই ভূত, যাকে তুমি নাকি দেখেছিলে ছোটবেলায়, এখনো তোমায় ছাড়েনি তুমি বলেছিলে না? সেই ভূতটাই। সে-ই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। সে-ভূত আর কোথাও নেই বাপু, তোমার ওই মনের মধ্যেই বাসা বেঁধে রয়েছে। তোমায় শান্তিতে থাকতে দেয় না।

তোরা মেয়েরা তো সেকথা বলবিই রে! তোদের দুঃখ কদিনের আর! কদিনের কারাবাস। বিয়ে হোলো কি বাড়ির জেলখানা ছাড়লি, রাতারাতি আরেক রাজ্য জয় করে বসলি। তোর সেই নিজের রাজধানীতে তুই-ই রাণী-রাজা নেই কেউ সেখানে। নামমাত্র একজন থাকে বটে, সে গোলাম। ভূতের ব্যাগার খাটবার, কি পেত্নীর ব্যাপার যাই বলো!

আর তোমাদের?

বিয়ের পরই বনবাস-সেই রামচন্দ্রের মতই। জন্মের থেকে বাপ-মার অধীনতার মায়াপাশ আর বিয়ের পর স্ত্রীপূত্রের তাঁবেদারি–সেই নাগপাশ–আমাদের মুক্তি কোথায়? আজন্ম কারাবাস আমাদের…আমরণ!

আহা! কপট সহানুভুতিতে সে নিশ্বাস ফেলে।

কন্যারাশির রাশি রাশি সুখ, আর কন্যালগ্নের…মানে ওই হতভাগ্যদের দুঃখের সীমা নেই আর। একযাত্রায় পৃথক ফল যদি কোথাও থাকে তো সে এই গোধূলি-যাত্রাতেই।

বোলো না, বোলো না!

বলব না? খুনের আসামীরও হয় ফাঁসি হয়, নয়তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড–একটাই হয়, দুটো কখনোই নয়। কিন্তু বিয়ের স্বামীদের গোড়াতেই ওই ফাঁসি, তার পরে যাবজ্জীবন কারাবাস!

আমার কপট দীর্ঘনিশ্বাস।

তোমার ভাবনা কিসের? সে-ফাড়া তো তোমার কেটেই গেছে। নতুন করে আর তো কোনো ফাঁদে তুমি পড়তে যাচ্ছে না আবার!

তাতে কী, যাবজ্জীবনটাই এড়ানো গেছে, ফাঁসির দণ্ড তো মুকুব হয়নি আমার। ফাঁস তো লেগেই রইলো এই গলায়! তুই তো দুদিনেই ভুলে যাবি, আমার কিন্তু তোর জন্যে হাঁসফাঁস করে কাটাতে হবে সারা জীবন!

আর আমি বুঝি খুব সুখে থাকবো!

সেই জন্যেই বলছিলাম কি, ওর দুঃখের কথায় কান না দিয়ে নিজের বিনীত নিবেদন রাখি–ফাঁসির আসামীও যা চায় জেলে বসেই পায়, যা খেতে চায় তাই দেওয়া হয় তাকে-জানিস তো? কিন্তু আমার কী বরাত দ্যাখ। এত করে চাইছি কিন্তু আমার সেই ফাঁসির খাওয়াটা পাচ্ছিনে আর।

পাবে পাবে–কিন্তু এখন না। আমার ফাঁসির আগে, ফাঁসি হবার আগের দিনটায় কোনো এক ফাঁকে খাইয়ে যাব তোমায়-অনেকক্ষণ ধরে একখানা। কথা দিচ্ছি। কিন্তু এখন না লক্ষ্মীটি! দোহাই তোমার। এখন নয়। এক্ষুনি কোত্থেকে কে এসে পড়বে, দেখে ফেলবে–সর্বনাশ হয়ে যাবে। বলেছি না যে জেলখানায় রয়েছি? জেলার সাহেব এখানে না থাকলেও-জেল ঠিকই আছে।

বলতে বলতে জেলার মেম এসে হাজির।

আমার প্রতি বিরূপ দৃষ্টি হেনে এমন এক ঝঙ্কার তুললেন যে, দুজনেই আমরা চমকে গেলাম।

বলি, এই ধড়াচূড়োগুলো কি ছাড়া হবে রাজকন্যের? নাওয়া-খাওয়া নেই বুঝি আজ?

যাচ্ছি মা এক্ষুনি। বাবাকে বাথরুমে ঢুকতে দেখলুম না! এই দশ দিন চান করতে পাইনি জানো মা? কীরকম করছে যে গা-টা!

ছিলি কোথায় এই দশ দিন–শুনি? পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখে পছন্দ করে গেল, এসে আশীর্বাদ করবে, দিনক্ষণ সব ঠিকঠাক, মেয়ে ইদিকে উধাও! বলা নেই কওয়া নেই, বেপাত্তা? কোথায় নেচে নেচে বেড়ানো হচ্ছিল ধিঙ্গি মেয়ের?

কোথাও না!–পুলিসে ধরেছিল যে, আমি কী করব!

পুলিসে ধরেছিল? শুনেই মা আঁতকে ওঠেন–অ্যাঁ! …পুলিসে ধরেছিল তোকে?

ইস্কুল থেকে ফিরছিলাম তো! এক জায়গায় ছেলেরা সব পিকেটিং করছিল। পুলিসে ওদের ঘেরাও করে জায়গাটা ঘিরে রেখেছে, আমি কী করে জানব! সেই ফুট দিয়েই আসছিলাম, যেমন আসি না রোজ? ধরা পড়ে গেলাম। ছেলেদের সঙ্গে আমাকেও ধরে নিয়ে গেল থানায়। আমি কী করব?

পুলিসের হাতে পড়েছিলিস, বলিস কি? থানায় নিয়ে গেল পাকড়ে? তোর অমন সুন্দর চুল–কোথায় খোয়ালি?

পুলিসে ছেঁটে দিয়েছে যে! আমার কোনো হাত ছিল?

পুলিস ছেঁটে দিয়েছে? মেয়েদের গায়ে হাত দেয় পুলিস?

পুলিসের যে কী অত্যাচার তুমি জানো না মাসিমা?

মাঝখান থেকে বলতে হয় তখন আমায়-প্রাণে মারা যাচ্ছে কত জনা। আমার পাশেই একটা ছেলেকে এমন রুলের গুতো লাগালো না, সে কোঁক করে উঠেই ঢলে পড়ল, চোখ মেলল না আর। রিনি তো তবু রক্ষে পেয়েছে খুব। চুলের ওপর দিয়েই গেছে ওর–অল্পের জন্য রেহাই। এক চুলের জন্যেই বেঁচে গেছে বেচারা।

.

৫৪.

পুলিসে ধরে নিয়ে গেছল তোকে?-শুনে তো রিনির মার গালে হাত।

হ্যাঁ মা, ইস্কুল থেকে ফিরছিলাম, পথে এক জায়গায় ছেলেরা বিলিতি কাপড়ের দোকানে পিকেটিং করছে দেখবার জন্যে একটুখানি দাঁড়িয়েছি কেবল, ওদের সঙ্গে পাকড়ে প্রিজন ভ্যানে পুরে আমাকেও ধরে নিয়ে গেল থানায়। সেখানে ছোরাগোছের এক বাঙালী পুলিস, পুলিস হলেও লোকটা ভালো, সে আমায় বলল কি–দিদি, মেয়েদের এখানে ভারী অসুবিধে, নানান বিপদ-আপদ, তুমি বরং ছেলেদের পোশাক পরে নাও, নিরাপদে থাকবে। তারপরে সেই আমায় এই হাফপ্যান্ট আর হাফ শার্ট এনে দিয়েছে, বিনুনি হেঁটে ব চুল বানিয়ে দিয়েছে সেই তো?

আমি হাঁ করে রিনির কাহিনী শুনছিলাম। সত্যি, মুখে মুখে এমন বানাতেও পারে বটে মেয়েরা।

গালগল্পে তাদের জোড়া মেলে না। কাহিনীবিন্যাসে তো অতুলনা। গল্প গাঁথনিতে তাদের জুড়ি নেই। উপমাহীন-তারা প্রত্যেকেই।

এই নিরুপমার কথাই ধরুন না! প্রায় সেই সময়েই নিজের দিদি নিয়ে প্রবাসীর আসরে এসে সারা ভারতবর্ষে কী শোরগোলই না তুলেছিলেন তিনি। লোকে প্রায় ধরেই নিয়েছিল যে, এই নিরুপমা দেবী আর কেউ নন, সেই শরৎচন্দ্রই–যিনি এর আগে আরেকবার অনিন্দিতা দেবীর ওরফে হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস তিনি যথাকালে ষোলোকলায় বিকশিত হয়ে দেখা দিয়েছিলেন তাই রক্ষে, নইলে আমাদের বাংলা সাহিত্যের একছত্ৰতলে তৃতীয় সম্রাটের হলে তাঁর বদলে আমরা একজন সাহিত্য-সম্রাজ্ঞীকেই পেতাম! ঐ নিরুপমা দেবীকেই।

সব মেয়েই গল্প রচনায় নিরুপমা। মালা গাঁথার মতই গল্পগাথায় ওস্তাদ।

জানো মা, সেই পুলিসটা কী বলেছিল আমায়? বলল যে, তোমার সঙ্গে এই যে বোনের মত ব্যবহার করলুম না,এর জন্য আসছে ভাইফোঁটায় তুমি আমায় নেমন্তন্ন করবে, বুঝলে? করবে তো?

মরে যাই আর কি! সুখের আর সীমা নেই আমার। বললেন রিনির মা-কনস্টেবলকে ভাইফোঁটা দেবো না তো দেবো কাকে! শুনেই আমি মূৰ্ছা যাচ্ছি।

মূৰ্ছা যাবার কথাই বটে! চুল ছাঁটাইয়ের পরই যে ভাই পাতিয়ে বসে, ভাতৃদ্বিতীয়ায় আসতে চায়, সেই অদ্বিতীয় ধুরন্ধর ফের ভাইফোঁটায় এলে উলটে জামাই হতে চাইবে কিনা তাই কে জানে!…পেয়াদাদের শ্বশুরবাড়ি হয় না, হতে নেই, সেই রক্ষে।

রিনির নিপুণ বর্ণনায় ওর মা আর আমি দুজনেই হাঁ।

তখনই আমার মনে হয়েছিল, অনুপমা আমার এই রিনিই একদিন হয়ত আমাদের নিরুপমা হয়ে উঠবে। নিরুপমার মতই সুলেখিকা।

সেটা হলে আমাদের সাহিত্যের এই বারো ভুইঞা রাজ্যে প্রথম সম্রাজ্ঞী হয়ে সে-ই বিরাজ বরত বুঝি আজ।

তবে সে আকাশ-কল্পনা না ফললেও দুঃখ নেই, উক্ত অভাবমোচনে, চতুর্থ সম্রাট তারাশঙ্করের পর অদ্বিতীয়া সম্রাজ্ঞীরূপে একজন এসে আমাদের সেই আশা পূর্ণ করছেন এখন। আশাপূর্ণাই।

তা, সেই শাড়ি ফাড়ি গুলো সব গেল কোথায় শুনি? মা শুধান।

আমি কি জানি! পুলিসটাই রেখে দিয়েছে হয়ত। জেলে গিয়ে শাড়ি যখন পরতেই পাব না তখন আর তার খোঁজ নিয়ে কী করব মা?

আমার আন্তরিক সায় তার কথায়। শুকসারির সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য হলেও জেলের মধ্যে যেখানে কোনোই নাকি সুখ নেই, সেখানে ফের শাড়ির প্রয়োজনটা কিসের!

চুলোয় যাক শাড়ি, তার জন্য ভাবছিনে, কিন্তু তোর সেই চুল! তাও তো তুই খুইয়ে এসেছিস! তাঁর খেদোক্তি : আহা, সেই চুল!

আগুলফচুম্বিত! মানে না জানলেও বঙ্কিমরচনায় পঠিত কথাটা এই সুযোগে আমি যুগিয়ে দিই।

আমার প্রতি রোষকটাক্ষ হানেন মাসিমা। কিছু বলেন না।

হতভাগী! তোর সেই চুল দেখেই যে তারা পছন্দ করে গেছল রে! বেয়ানঠাকুরণ সেই চুল যদি না দেখতে পান মেয়ের…কী যে হবে তাহলে!

কী যে হবে ভেবে না পেয়ে তিনি মুহ্যমান, আর আমি ভাবি, এই চুলের ব্যত্যয়ে যদি বিয়েটা না হয় তাহলে তার চেয়ে ভালো বুঝি আর কিছুই হয় না!

লক্ষ কথায় যে বিয়ে নাকি ঘটে থাকে, লক্ষ্যে পৌঁছবার আগে এক কথায় তা ভেঙে যাওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত আমি দেখেছি। এমন কি বিয়ের পরও তো কতই না ভাঙচুর হয়ে থাকে…হায়, দাম্পত্য জীবনের ন্যায় ক্ষণভঙ্গুর আর কিছুই নয় বুঝি!

এক চুলের হেরফেরে রিনির বিয়ে বাতিল হওয়ার তিলমাত্র সম্ভাবনায় ভর দিয়ে আমি দাঁড়াতে যাই। ভরসা পেতে চাই।

বেয়ান তো দেখে গেছেন, এখন শুনছি ছেলের মাসিপিসীরা নাকি দেখতে আসবেন আবার। এসে যদি মেয়ের চুল না দেখতে পান…

ভাবতে গিয়ে আবার উনি দিশাহারা।

যারা আমায় দ্যাখে না মা, আমার চুল দ্যাখে খালি, একচুল মাত্র দাম দেয় আমায়, ফোঁস করে ওঠে রিনি, তাদের বাড়ি আমি নাই বা গেলাম মা!

সত্যি, যেখানে মেয়ের কোনো দর নেই, তার চুলেরই শুধু কদর… আমি ওর সানাই হতে যাই।

তুমি থামো তো রাছা! এক ঝটকায় আমায় উনি চুপ করিয়ে দেন–এ সবের কী বোঝো তুমি?

আমায় তোমরা পড়তে দাও না? বিয়ে পাশ করতে দাও না আগে? বিয়ের কী হয়েছে এখন? আমি আরো পড়ব… বাবার মতন ডাক্তার হই যদি? বি. এস-সি. পাশ করার পর আমি ডাক্তারি পড়তে চাই।।

তুই থাম। ঝাঁঝিয়ে ওঠেন উনি-বিয়ের বয়েস পার হয়ে যাচ্ছে, সে হুঁশ আছে তোর? বারো বছরে বিয়ে হয়েছিল আমার, সেই বারো কবে পেরিয়ে ষোলোয় পড়তে চলেছিস! বিয়ের সব ঠিক, এদিকে মেয়ে উধাও! কুটুমমহলে কান পাতা যাচ্ছে না–যে কেলেঙ্কারিটাই না হোলো!

কেলেঙ্কারি কিসের মা? দেশের জন্যে কি মেয়েরা আজ যাচ্ছে না জেলে? বাসন্তীদেবী, ঊর্মিলাদেবী, আরো কতো সব বড় বড় বাড়ির মেয়েরা যায়নি কি? তুমি তো জানো মা?

কুটুমদের কী আর, তারা তো সব মুখিয়েই রয়েছে কি করে এমন সম্বন্ধটা ভাঙচি দিয়ে ভাঙতে পারে, কোমর বেঁধে তৈরি সবাই! কতো বড়ো ঘর, বংশ মর্যাদা, বাড়ি গাড়ি, আরো কত কী! কেমন পাত্তর! মরবে না হিংসেয়? বিয়ের সব পাকা, ইদিকে এনার পাত্তা নেই। আত্মকুটুম মহলে মুখ দেখাবার যো নেই! কোথায় যে কার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে মুখ পুড়িয়েছে ছুঁড়িটা! কানাঘুষা করছে সবাই।

কিন্তু মেয়ে তো আপনার কুলত্যাগ করেনি মাসিমা, চুলত্যাগ করেই ফিরেই এসেছে তো। মুখটুখ কিছু পোড়েনি, চেয়ে দেখুন এক চুল কম হলেও নিখুঁত সেই রকমটিই।

আমি রিনির সাফাই গাইতে যাই, উনি এমন ধমক লাগান আমায়! এক চুলের ফারাকে এমনটা কী যায় আসে, আমি তো তা ভেবে পাই না।

তুমি থামো তো বাপু! মেয়েটাকে আমার তুমিই বখিয়ে দিলে। ওর মাথাটা খেয়েছো তুমিই।

আমার মা কিন্তু বলে যে… বলার মুখেই বাধা পাই। অদূরে দাঁড়িয়ে নিজের ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে আমার কথার মুখে সে হাত চাপা দেয়। সেদিনকার কয়েদ গাড়িতে তার সেই তর্জনী সঙ্কেত দেখি।

আমি চেপে গেলেও উনি নিজের ক্ষোভ চাপতে পারেন না : আমার এমন সোনার টুকরো তোমার পাল্লায় পড়ে বিগড়ে গেল। এত ভালো মেয়ে, যার কেউ নাকি কখনো এতটুকু বেচাল পায়নি, সেই বিন্ন জেল খেটে এলো আবার। ওর মাথায় দেশোদ্ধারের এইসব পোকা কে ঢোকালো? চাঁচলে থাকতে পিস্তল নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে মারতে গিয়েছিলে তুমি, আমি জানিনে কি? ওর কচি মাথার দেশের ধান্দা কে ঢুকিয়েছে? কী মতলবে যে তুমি ওকে এমনি করে ফুসলে নিয়ে গেছলে তুমিই জানো!

তুমি কী বলছো মা? রিনি চেঁচিয়ে ওঠে–রামদা কোথায়! আমি তো সেই জেলে গিয়েই না ওর দেখা পেলাম। ও যে কলকাতায় এসেছে তা-ই আমি জানতুম নাকি? রামদা এখানে এসে আমাকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে কি ও তো আমাদের বাড়ির ঠিকানাই জানত না। মিথ্যে দোষে দোষী করছ ওকে। অমন করে বলছ কেন রামদাকে? শক্ত রোগ হয়েছে না ওর? মনে লাগল অসুখ ওর আরো বেড়ে যাবে না? তুমি যে কী মা?

ওর মা কিছু বলেন না আর। চুপ করে শোনেন।

 সত্যি বলতে গেলে, রামদার জন্যেই ছাড়া পেলাম তো! চার মাসের জেল হয়েছিল না আমার? এত তাড়াতাড়ি ছাড়ত নাকি? কিন্তু শক্ত অসুখের জন্য দশদিনের মধ্যেই ছেড়ে দিলো ওকে, আর আমি ওর ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিলাম তাই ওর তদারকের জন্যে আমাকেও ছাড়তে হোলো তাদের। ও না হলে–ওর অসুখ না হলে এত শীগগির আমি ছাড়া পেতুম নাকি? অসুখটা বাঁধিয়েই তো রামদা বাঁচিয়ে দিয়েছে আমায়! তা জানো?

কর্তা এতক্ষণে বাথরুম থেকে বেরিয়েছেন। যা এবার তুই নেয়েটেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হ। সেজেগুজে তৈরি হয়ে থাকা রোজই ওরা ফোন করে খবর নিচ্ছে, কবে আসবে মেয়ে দেখতে। কখন এসে পড়বে ঠিক নেই। হয়ত আজ বিকেলেই তোকে দেখতে আসতে পারে। এই যা চুল আছে শাপু-টাপু করে একেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাতে হবে। এই কদিনে যা ছিরি হয়েছে না মেয়ের!

এতক্ষণ যেন বিষদৃষ্টি হানছিলেন, এবার মনে হল, আমার দিকে একটু উনিশ নজরে তাকিয়ে রিনিকে নিয়ে উনি চলে গেলেন। আমার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর এই ইতর-বিশেষে, আমার মনে হল, আমাকে আর বিশেষ ইতর বলে বোধ করছেন না বোধহয়। হাঁফ ছেড়ে আমি বাঁচলাম।

খানিক বাদেই তিনি ফিরে এলেন আবার–আমার খাবার নিয়ে। দুধ আর পাঁউরুটি।

খেয়েদেয়ে বেশ করে ঘুমোও। রেস্ট নাও এখন। উনি বলেছেন, গোড়াতেই ধরা পড়েছে রোগটা, এমন কিছু শক্ত হয়ে দাঁড়ায়নি। তেমন ভয়ের কিছু নেইকো। দশ বারো দিনেই তুমি সেরে উঠবে। সেরে উঠলেই উনি তোমার টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবেন-সোজা বাড়ি চলে যেয়ো। কোনো হুজ্জত হাঙ্গামায় মাথা গলিয়ো না। এখানে থেকো না আর, বুজলে? উঠতি বয়েসের ছেলেদের পক্ষে এই হইচই-এর সময় কলকাতায় থাকাটা ঠিক নয়। বুঝেছ?

আমি চুপ করে শুনি। কী জবাব দেব ওঁর কথার?

রিনির বিয়েটা তুমি দেখেই যেয়ো বরং। দশ বারো দিনের মধ্যেই চুকে যাবে আশা করছি। হ্যাঁ, তোমার নাকি পদ্যটদ্য লেখা আসে, বলছিলেন দিদি। তুমি তাহলে ওর বিয়ের প্রীতি উপহার লিখে দিয়োয়া, কেমন? পাড়ায় ছাপাখানা আছে, কর্তার পেশেন্ট তারা–সেখান থেকে ছাপিয়ে নিয়ে বিয়ের রাতে বিলি করা যাবে। কন্যাত্রী-বরযাত্রীদের তুমিই বিলি কোরো না হয়।

বিলক্ষণ! রিনিকে যে অকাতরে বিলিয়ে দিতে পারে, সে কি আর তার বিয়ের পদ্য বিলি করতে পারবে না?

লিখব বই কি মাসিমা। এমন একখানা কবিতা লিখব না!…

বিকেলের পড়ন্ত রোদ জানালা গলে মুখের ওপর এসে পড়তেই ঘুম ভাঙলো আমার। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি রিনি বসে বিছানার পাশটিতে। এমন সেজেগুজে এসেছে যে!

কি রকম আছো এখন?

ভালোই তো। কেবল গা-হাত-পা একটুখানি কামড়াচ্ছে যেন কেমন।

টিপে দেব একটু?

না।

 টিপতে পারি বেশ। বাবার পা টিপে দিই তো আমি। দিই না কেন?

না। তোকে আমার পায়ে হাত ঠেকাতে দেব না, কক্ষনো না।

তুমি যে একদিন আমার পায়ে…..আর আমি তোমার পা ছুঁতে পর্যন্ত পারব না?

আমার পা কামড়াচ্ছে না আর। ইস, দারুণ সেজেছিস যে! সত্যিই ইন্দ্রাণীর মতই দেখাচ্ছে যেন তোকে।

ইন্দ্রচন্দ্ররা দেখতে আসছে না আমায় আজ? আরেকটু বাদেই এসে পড়বে।

তবে যে শুনলাম জটিলা কুটিলা? পূতনা সূর্পনখারা? ছেলের মাসিপিসীরা আসবেন বললেন না তোর মা?

পুতনা আসেন কি তাঁর পুত্ররা আসেন ঠিক নেই এখনো। ছেলে তার বন্ধুদের নিয়েও আসতে পারে শুনছি।

পুত্র মিত্ররা? মানে, পাত্র মিত্ররা? বুঝলি রিনি, তার মধ্যেই তোর বরও থাকবে রে, ছেলের বন্ধুর ছদ্মবেশে।

সে জানি। তা আর বলতে হয় না। কোটি যে, তাও টের পাবো এক নজরে। রিনি হেসে কয়, এই প্রথম বিয়ে পাশের পরীক্ষায় বসছি না মশাই! চাঁচল থেকে এসে অবধি এই পালাই চলছে আমার। ছেলেরা হলে সহজেই পার পাওয়া যায়, একটু মুচকি হাসি, একখানা গান গাইলেই মিটে যায়, কিন্তু মেয়েদের কাছে পরীক্ষায় পাশ করা দারুণ শক্ত-মহামারী ব্যাপার।

কিসে কিসের পরীক্ষা দিতে হয় রে? ইংরেজি অঙ্ক ইতিহাস ভূগোল গ্রামার সমসকৃত সব? এই বৈতরণী পেরুবার কোনো বই-টই নেই-নোট-ফোট?

বই নেই, কোন তরণীও নেই–তবে হ্যাঁ, নোটর গোছা পণ দিতে পারলে হয়!

রিনি কয়–আগাপাশতলা পরীক্ষা দিতে লাগে-মাসিপিসীরা কিছু বাকী রাখে না পরখ করার… চুলটুল টেনে টেনে দ্যাখে সব; জানা গেল রিনির কথায়, ঝুটো কিনা ঝুঁটি নেড়ে ভালো করে দেখে নেয়, দাঁতে টোকা মারে তার ওপর, বাঁধানো কিনা দেখতেই। দাঁতের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কথা কয় তারপর–হাঁ করো তত বাছা! হাঁটা কিসের জন্যে? না, মেয়ের হাঁ কতো বড়ো, তার সঙ্গে নাকি সুলক্ষণের কোন সম্পর্ক আছে। উই, আমি বলি, তা নয়। বাড়ির ডাল-ভাত কতো ধ্বসাবে, কেমন খাইয়ে মেয়েটা, তাই দেখবার জন্যেই ঐ হাঁ-কানোটা। কিন্তু ওভাবে কারো দাঁতে ঘা দিয়ে কথা কওয়াটা ঠিক কি? কিন্তু ছাড়ান নেই তার পরেও–পরীক্ষা আছে আরো। ঐ অতটুকুন ঘরের মধ্যেই ঘোড়দৌড় করিয়ে ছাড়ে। ঘোড়দৌড়টা কিসের জন্যে? মেয়ে খোঁড়া কিনা বাজিয়ে দেখতে হবে না? পদে পদে পরীক্ষা-হাতে হাতে বাজিয়ে নেওয়া।

সেই ভগবানের মতই কুমারী ভগবতীদেরও।

এমন করে আপাদমস্তক পরখ করার পর শেষ পর্যন্ত সেই এক কথা-বাড়ি ফিরে খবর দেব ভাই। জানাবো আপনাদের। সে-খবর কিন্তু আর কোনো দিনই আসে না।

বাঁচা যায়! আমি হাঁফ ছাড়ি।

বাড়ি গিয়ে জটলা করে মেয়েরা একটা না একটা খুঁত তারা বার করেই। বেরুবেই খুঁত। অমন চাঁদের খুঁত আছে আর মেয়ের খুঁত থাকবে না? নিখুঁত কেউ হয় নাকি কোথাও?

আর ছেলেদের কাছে পরীক্ষা দিলে?

সঙ্গে সঙ্গে পাশ। একটুখানি আড়চোখে তাকালেই হোলো। বাড়ি গিয়ে মরে থাকবে সব কটাই। সবারই বাসনা হবে ওই মেয়েটিকেই।

ভাগ্যিস, একালে সুন্দ উপসুন্দর লড়াই হয় না–সুন্দরের জন্য! কিন্তু হলে কী হবে, মেয়ে আর পাত্রস্থ হয় না। ছেলের পছন্দ হলেও ছেলের বাবা-কাকারা আসেন তারপর-রে দামে পটে না। বাপের পণের কাছে ছেলের প্রাণপণ ভেসে যায় কোথায়।

তাই যাক না। আমি সায় দিই। সেই তত ভালো।…আচ্ছা, আড়চোখে তাকানোটা আবার কী রকমের রে? কাকাতুয়ার মন ঘাড় বেঁকিয়ে নাকি?

না না। এই রকমটা। তারাটাকে সে চোখের কোণে ঠেলে আনে-এই যে! আর এইটে হোলো গিয়ে চোরা চাউনি। আর একেই বলে কটাক্ষপাত।

তিনটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আমার মনের পিঠে যেন কশাঘাত। তিনখানা সপাৎ! –ও বাবা! তাই নাকি? বইয়ে পড়েছি বটে, কিন্তু চোখে পড়ল এই! আমার জীবনে এই প্রথম বটে! এমনি মারাত্মক একেকখানা? আমার জানা ছিল না।

কি করে জানবে! মেয়েরা জানে। জন্ম থেকে–আপনার থেকেই। তুমি তো কোনো মেয়ের সঙ্গে মেশনি কখনো? আমার আগে কোনো মেয়ে তো মেশেনি তোমার সঙ্গে জানবে কি করে?

আচ্ছা, যদি ছেলেরাই আসে আজ? আর তোকে গান গাইতে বলে, কোন গানটা গাইবি তুই? আমি শুধাই?

মনে করো-শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর/অন্য সবে কথা কবে/তুমি রবে নিরুত্তর বিয়ের ভাঙচি দেবার পক্ষে মোক্ষম হবে–কী বলে?

রাস্তা থেকে মোটরহর্নের আওয়াজ এলো। মা ডাকতেই রিনি নেমে গেল। কারা এলো কে জানে! সূর্পনখারা? না, সুলক্ষণরা?

একটু বাদেই রিনির গলা পেলাম ওপরে শুয়েই। সুরলহরী ভেসে এলো তলার থেকে। গাইছে রিনি….. কিন্তু এ তো সেই রম গানখানা না, গানের যা নাকি চরম!…আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো! তোমা ছাড়া এ ভুবনে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো।

আড়চোখের ওই চাউনির ওপর এই যদি গানের বউনি হয় ওর, তাহলে আর দেখতে হবে না! বউয়ের জন্যে ছেলে হন্যে হয়ে উঠেছে এতক্ষণে-বউ না নিয়ে বাড়ি ফিরছে না আর। তাই কি এখুনি হয়ত ঘাড়ে করে ঘোড়দৌড় লাগাবে সে-সেকালের পৃথ্বিরাজের মতই সংযুক্ত হয়ে।

এ কী গান গাইছে রিনি? আমার মনের কথাগুলোই আমার কানের গোড়ায় উজাড় করে দিচ্ছে যেন…আমি তোমারই বিরহে রহিব বিলীন/আর তোমাতে করিব বাস/দীর্ঘদিবস, দীর্ঘরজনী, দীর্ঘ বরষমাস।…

অনেকক্ষণ পর পকেটভর্তি সন্দেশ নিয়ে এলো রিনিতোমার জন্যে আগের থেকে সরিয়ে রেখে ছিলাম…।

আমার খিদে নেই। তাকালাম না সন্দেশের দিকেও। জীবনে এই প্রথম। মিত্রদের সঙ্গে পাত্রও ছিল, জানা গেল, আর ছিল নাকি ওর মামা। বরের অভিভাবকদের ভেতর হলেও আবার তার বন্ধুও বটে সে। মেয়ে দেখে তাঁদের পছন্দ হয়েছে, এই তীদের পাকা কথা, পাকাপাকি তিনি বলে গেছেন নাকি। বরের কোনো পণের দাবিদাওয়া নেই জানা গেল তাঁর কাছেই।

এই সপ্তাহেই আমার আশীর্বাদ, পরের হপ্তায় বিয়ে।…নাও, এবার খেয়ে নাও তো লক্ষ্মীটি।

না! আমি দুধ-বার্লি খাবো। রুগীর পথ্য নাকি এ?

ওদের বাড়ির বাচ্চাটা একটা ক্যাম্পখাট এনে খাড়া করলে আমার চৌকির পাশে।

এটা কি জন্যে রে?

বা, আমি থাকব না এখানে রাত্তিরে?

ঐখেনে শুবি? আলাদা? কেন, সেই জেলের মতন…।

এটা জেল নয়…..ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে সারা রাত, মা বলেছে। সিঁড়ির আলোটাও জ্বলবে। বুঝেছ? মাঝে মাঝে এসে মা দেখে যাবে আমাদের।

কেন রে?

কেন যে তা কী বোঝাবো তোমায়! ঘরে সোমত্ত মেয়ে থাকলে মার যে কী অশান্তি কতো ভাবনা-তা সে মারাই জানে।

তুইও জানিস! তুই মা হয়েছিস কিনা!

 আমরা মেয়েরা জন্ম থেকেই মা হই তা জানো? এইটুকুন-টুকুন খুকীদের পুতুল নিয়ে ঘরসংসার পাততে দ্যাখোনি? ছেলেমেয়েকে খাওয়ায় শোয়ায় নাওয়ায়, মাই খাওয়ায় আবার!…..তা, কী করেই বা দেখবে। তোমার তো কোনো বোন নেই, দ্যাখনি তুমি, জান না তাই।

মাই খাওয়ায়? ওই বাচ্চা খুকীরা? কিন্তু তাদের কি…তবে মা-ই খাওয়ায় বটে, সারা জীবন ধরে…..তার পরেও…জন্ম-জন্মান্তরে।

তবেই বোঝ।

আমার মাকে এমনি ধারার একটা কথা বলতে শুনেছি বটে। মেয়েরা জন্ম থেকেই মা। মা হয়েই জন্মায়-মা হবার জন্যেই। বলতেন বটে মা! কিন্তু তার মানেটা ঠিক ঠিক বুঝিনি তখন।

এখন তো বুঝলে? সব সময় মায়ের ভাবনা ভাবতে হয় আমাদের…একটা কথা বলব?

বল।

এবার তুমি বাড়ি ফিরে গিয়ে পড়াশুনায় মন দাও–কেমন? তারপর মনের মতন কাউকে বে-থা করে সংসারী হয়ে সুখে থাকো সারা জীবন।

ও কথা বলিসনে।…সংসার করা আমার ধাতে সইবে না।

বৈরাগযোগ কঠিন উধো, হাম না করব হো।–কোন্ বইয়ে যেন পড়েছিলাম কবে! সেই কথাটাই একটু পালটে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিই-সংসার ভারী কঠিন ঠাই ভাই! সংসারযোগ কঠিন উধো, হাম না করব হো! সে আমি পারব না উদ্ধব!

আমার এই উদো মার্কা জবাবে একটু চুপ করে থেকে সে বলে-সে কথা থাক তাহলে। যখন করবার করবে ঠিকই। সে রকম মেয়ের পাল্লায় পড়োনি তো! ঘাড় ধরে করিয়ে নেবে। আচ্ছা, বিয়ে না হয় নাই করলে এখন, রাস্তাঘাটে ওরকম হাঘরের মতন পড়ে থেকো না আর। একটা মেসবাড়ি খুঁজে নিয়ো। কলকাতার অলিতে গলিতে বাসা বেঁধে থাকে কেরাণী-ছাত্ররা, চাকরি করে পড়াশোনা চালায়, জানো না? খুব সস্তা খরচে থাকা যায় সেখানে, জানো?

জানব না কেন? চরিত্রহীন পড়েছি আর মেসবাড়ির খবর রাখিনে? সেখানে যে সাবিত্রীরা থাকে তাও বেশ জানি।

সাবিত্রীদের খপ্পরে পড়তে যেয়ো না যেন, সাবধান। শক্ত রোগে ধরবে। বাবার ডেস্ক থেকে একটা বই এনে পড়তে দেব তোমায় পড়ে দেখো, তাহলে বুঝবে।

জানি আমি। পাঁজির বিজ্ঞাপন পড়েই কবে আমার জানা! নেহাত যারা পাঁজির পাঝাড়া, তারাই সাধ করে ওই সব ফ্যাসাদ ডেকে আনে-ওই সব নোংরা অসুখ বাধায়। সে বিষয়ে আমি ওকে আশ্বস্ত করি- তাছাড়া সতী-সাবিত্রি বলে না? সাবিত্রিদের সতীশদের ওপর নজর। আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না কেউ, তুই নিশ্চিন্ত থাক।

আহা, তারা নজর না দিলেও তোমার নজর পড়তে তো কোনো বাধা নেই?

যে কারণে আমি স্ত্রৈণ হতে পারব না, ঠিক সেই কারণেই আমার ঐ পথে যেতে বাধবে, বুঝেছিস? আর, যে চেহারা নিয়ে জন্মেছি না, কারো পাতে পড়ার কোনো কথাই নেই…আমাদের জেলার সতীশ কি তোদের জেলার ঐ দেবেনের মতও যদি শরীরটা পেতাম না, তা হলেও কথা ছিল একটা, কিন্তু এ যা একখানা…..মরে গিয়ে ভাগাড়ে আমায় ফেলে দিলেও শেয়াল-কুকুরেও মুখে তুলবে না। সে কথা থাক, তোর কথাটা বল্। তোর এই চুল নিয়ে কোনো কথা উঠল না? একচুলও নয়? জানার কৌতূহল হয়।

এই বব চুলের জন্যেই আরো বেশি পছন্দ হয়েছে ছেলের, তা জানো? বলেছে যে, এমন মর্ডান মেয়ে, এমনটাই নাকি সে চাইছিল। চুলের জন্যেই কোনো পণ লাগছে আমার বিয়ের। এক কাঁড়ি চুল নিয়ে এক কাঁড়ি টাকা বেঁচে নিয়েছে বাবার। মা বেজায় খুশি তাই আমার ওপর এখন। এমন কি, তোমার ওপরও।

হিতে বিপরীত না হয়ে বিপরীতে হিত হয়ে গেল তো!

আমার পার্বণের পালা ফুরোলো এবার, শেষ পর্বে এসে পড়লাম শেষটায়। উৎসবের দিন কাটলো অবশেষ।…..

সেদিন বিকেলে অপরূপ সাজসজ্জায় রিনি এলো আমার ঘরে আবার।

আজ সন্ধ্যায় আমার আশীর্বাদ। কালকেই আমার বিয়ে।…তুমি কিছু বলছ না যে?

আমি কী বলব আবার? আমার কী বলার আছে? বিয়ে তো ভালোই রে! বে-থা করে সুখে ঘর বেঁধে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারী হ, সুখি হ।

এই তোমার কথা? আমার কথাগুলোই শোনাচ্ছ তুমি ঘুরিয়ে আমায়? আর কিছু বলার নেই তোমার?…এতো কথা ছিল যে তোমার গো!

কই, কিছু তো মনে পড়ছে না এখন?

মনে পড়ছে না? আমার মনে আছে। বলেছিলাম না, বিয়ের আগে তোমার কথাটা আমি রাখব। বলেছিলাম না যে খাইয়েটাইয়ে যাব তোমায় শেষবারের মতো-যতো চাও।

ও! সেই কথা। আমার মনে পড়ে। আমার সেই ফাঁসির আগের সাধ-তার এই আশীর্বাদের দিনটাতেই।

না। আমার কিছু চাইনে আর। অনেক পেয়েছি তোর কাছে। এমন কেউ বুঝি পায় না কখনো। তবে তুই কী আর দিয়েছিস? আমার মা দিয়েছেন বলেই পেয়েছি। মা-ই তো দেয়।…তা ছাড়া তুই পরের হতে যাচ্ছিস এখন, পরদ্রব্যে লোভ করা কি ভালো?

এমন কি তুমি যদি চাও…চাও তো…

সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে– এখন তো আর ভয় নেই-ভাবনারও কোনো কারণ নেই আমার! বিয়ে তো হচ্ছেই।

না না…কক্ষনো না। আমি চেঁচিয়ে উঠি-ও সব নয়। আমি তোর বন্ধু নই? দাদা না? তোকে আমি নষ্ট করতে পারি?

তখনকার সেই কথায় এখন আমার হাসি পায়। কিন্তু সে সময়ে এমনটাই ছিল বুঝি। শরৎবাবুর বই পড়ে সব ছেলেমেয়েই অদ্ভাবিত হয়ে গেছল তখন। তাঁর ভাবধারায় মোহাচ্ছন্ন হবে সবাই তাঁর উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা– সব ছেলেই সতীশ, সব মেয়েই সতী।

সেই মোহনার মুখে তখন একটিই দ্বীপ কেবল। সন্দীপের চর। রক্ত-মাংসের মানুষ বলতে ঘরে-বাইরের সেই সন্দীপ। একটি মাত্রই ব্যতিক্রম সেই।

তখনো গৃহদাহের পর্ব আসেনি। ঘরপোড়া হনুমানদের সাক্ষাৎ মেলেনি তখনো।

আমার কথায় সে হাসল। বলল, বেশ, তাহলে দাদার মতই তুমি আশীর্বাদ কোরো আমায় আজ। সন্ধ্যেয় যখন সবাই আশীর্বাদ করতে আসবে, আমাদের দোতলার ঘরে এসো, আসবে তো?

যাবো। কিন্তু কি করে আশীর্বাদ করে জানিনে যে। করিনি কখনো।

 মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে করতে হয়–আবার কী? সবাই যেমনটা করবে…

 তাই করব না হয়…আচ্ছা, মনে মনে করলে হয় না?

সত্যি বলতে, ওকে নিয়ে সবই তো আমার মনে মনে করা। গড়া, ভাঙা, আবার নতুন করে গড়া।

আশীর্বাদের ক্ষণটিতে ওর দিদি এসে ডেকে নিয়ে গেল আমায়। খবর পেয়ে শ্বশুর বাড়ির থেকে একটুকু আগেই এসেছিল সে।

কার্পেটমোড়া ওদের দোতলার ঘরটায় আর সবার পাশে গিয়ে বসলাম। ঘরের আসবাবপত্তর দেখে আমার চক্ষুস্থির! ঝকঝকে কতো কি-নামও জানিনে। সবকিছুই রিনির শ্বশুরবাড়ি যাবে–বিয়ের তত্ত্বে ওর।

বরের বাবা মা মামা আশীর্বাদ করলেন রিনিকে। ব্রেসলেট নেকলেস গিনি মোহর আংটি ইত্যাদি দিয়ে। রিনির গায়েও ছিল অনেক কিছু-ঐসবই–অন্য প্যাটার্নের।

আমার দিকে তাকালো সে। একটুখানি হাসলো বুঝি।

কিন্তু শুকনো ধান দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করতে আমার হাত উঠলো না। হায়, কাউকে কিছু প্রেজেন্ট দেবার মতন বরাত দিয়েও যে পাঠায়নি আমায় বিধাতা। কোনো রকমে আমাকেই প্রেজেন্ট করে দিয়েছে কেবল।

কিন্তু এ প্রেজেন্ট কারো পাতে দেবার নয়। হাতে দেবার নয়।

আশীর্বাদের পালা চুকলে কর্তারা সব পাশের ঘরে চলে গেলেন। মেয়েরাই রইলো শুধু সেই ঘরে–রিনির মা মাসি পিসি দিদি এরাই। বসে বসে গুলজার করতে লাগল।

রিনিও রয়ে গেল এক পাশটিতে চুপটি করে বসে, সেজেগুজে তেমনটিই।

আর, আমিও রয়ে গেলাম সেখানে স্থাণুর মতই। ওদের কেউ কিছু বলল না আমায়, ধর্তব্যের মধ্যেই ধরল না। গালগল্প চলতে লাগল তাদের।

চোখ জড়িয়ে আসছিল রিনির। সারাদিনের ঝাড়পোঁছ সাজগোজ–কম ধকলটা যায়নি তার ওপর। ঘুমের আবেশে কার্পেটের ওপর গড়িয়ে পড়েছিল সে।

নিজেদের গল্পেই গিন্নীরা সব মশগুল। কেউ লক্ষ্য করছিল না তাকে–আমিই একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। আমিই কেবল চেয়েছিলাম হাঁ করে…ফাঁসির আগেকার এই খাওয়া আমার-গিলছিলাম আমার দু চোখ দিয়ে।

ঘুমের ঘোরে গড়াতে গড়াতে কখন সে আমার চেয়ারের গোড়ায় চলে এসেছে–আমার পায়ের কাছটিতেই।–

পা গুটিয়ে নিয়েছি আমি–পাছে ওর মাথায় পা ঠেকে যায় আমার।

ঘুমের ঘোরেই যেন সে হাত তুলেছে, আলতো করে পা ছুঁয়েছে আমার, তার পরে সেই হাত নিয়ে যেন ঘুমের আবেশেই মাথায় ঠোঁটে ঠেকিয়েছে নিজের।

এটা কি ওর বিদায় নেওয়া নাকি? চিরবিদায় তার? এমনি করেই?

 আমার মনটা কেমন করে উঠল। আমি আর বসতে পারলাম না। উঠে পড়লাম তক্ষুনি।

সিঁড়ির মুখে রিনির দিদির সঙ্গে দেখা-কোথায় বেরুচ্ছ এখন? এখনই সবাই খেতে বসবে, তুমিও আমাদের সঙ্গে খাবে আজ। তোমার তো অসুখ নেই আর। বাবা বলল।

মাথাটা বডডো ধরেছে দিদি। ঘুরে ফিরে একটু বাইরের হাওয়া লাগিয়ে আসি। দেরি কোরো না যেন। জানো, এই আশীর্বাদের খাওয়াটাই হচ্ছে আসল। বিয়ের ভোজটা কিছু না–চয়েস করার মতো খাবার না। এটাতেই পরিপাটি থাকে। বুঝেছ?

ঘাড় নেড়ে সিঁড়ি টপকে উতরে আসি রাজপথে, আমার স্বরাজ পথে। সোজা রাস্তায় আমার–চিরদিনের আস্তানায়।

আর কেন?

এবার চলে যাই আমার মায়ের উঠোনেই সটান। সেই ঠনঠনেয়। সেখানে গিয়ে লম্বা হইগে এখন।

কাল ভোর হতেই ফের লাইন লাগাতে হবে শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেসে। আর, একটা মেসের খোঁজ করতে হবে তারপরই।

আচ্ছা, এটা কি করলো রিনি? যেতে যেতে ভাবি। ভাবতে ভাবতে যাই।

ঘুমের ঘোরে আড়মোড়া ভাঙার ছলনায় সবার অলক্ষ্যে সে আমার পায়ে হাত ঠেকিয়ে এই যে নিজের মাথায় মুখে ঠেকানো-মানেটা কী এর? এ কী রকমের তার বিদায় নেওয়া? কী ধরণের বিদায় দেওয়া?

অনেকদিন ক্ষণে ক্ষণে সেই কথাটা মনে মনে ভেবেছি, ভাবি আমি আজও। কিন্তু মানে খুঁজে পাই না। মনে হয়, বিদ্যায় বুদ্ধিতে বয়সে অভিজ্ঞতায় মেয়েরা যতই পরিণত হোক না, সারা জীবন ধরে আসলে তারা সেই একরকমটাই থেকে যায়–সেই পরিণীতাই। এক আঁচড়েই সেটা ধরা পড়ে।

বাংলার মেয়েদের চিনেছিলেন শরৎচন্দ্রই। সব মেয়েই আচরণে এক। সবারই এক আচরণ।

দেবদাসরা নেই আর। অরক্ষণীয়ারাও নেই। কিন্তু পরিণীতারা সবাই রয়েছে। তারা আর পরিণত হয়নি। হবার নয়।

.

৫৫.

বহুদিন বাদ সেদিন হঠাৎ জনাব সাহেবের সঙ্গে মোলাকাত আবার। ঠনঠনের মাথাতেই ঠোকাঠুকি!

মার মন্দিরের সামনেটায়।

এখানে কী করছেন মশাই? মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিগ্যেস করি।

কিছুই না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার ভক্তি নিবেদন দেখছিলাম আর কি! এতক্ষণ ধরে তাই দেখছি।

এতক্ষণ! এক মিনিটও তো হয়নি আমার। আর ভক্তির কথা কী বলছেন, ভক্তি ফক্তির ধার আমি ধারিনে। আমার হচ্ছে অতি ভক্তি-নিতান্তই চোরের লক্ষণ। আদায়ের ফন্দি ফিকির।.আমার মা বলেছেন তাই দিনান্তে একবার অন্তত যাওয়া-আসার পথে এই প্রিমিয়ামটা দিয়ে যাই আমার।

প্রিমিয়াম না প্রণাম-কী বললেন?

 প্রিমিয়াম। লাইফ ইনস্যুরেন্সের। মা বলে দিয়েছেন যে, কলকাতায় পথে পথে অপঘাত পদে পদে বিপদ-তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিরাময় ভাবে নিরাপদে নির্বিঘ্নে টেকসই হয়ে থাকতে হলে এই টেক্স দিতে যেন কখনো না গাফিলতি করি।

বাঁচা যায়।

বেঁচেই তো আছি মশাই। এবং একরকম নিরাপদ নির্বিঘ্নেই। তেমন কোনো শক্ত অসুখ-বিসুখও করেনি কখনও, এবং এক-আধবার যাও বা হয়েছে তাও খুব সহজেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি–প্রায় মিরাকলের মতই। একলাই থাকি, দেখাশোনার কেউ নেই, তবু চার যুগ তো পার হয়ে এলাম নির্ভাবনায়। আপনার জন কেউ কোথাও নেই–আত্মীয় বন্ধুহীন নিরূপদ্রব নিশ্চিন্তিতে এমনি করেই-খাসা আছি মশাই! আবার কী চাই!

 কিন্তু এই কালী মন্দিরে এসে মাথা ঠোকা, এটা তো নিছক পৌত্তলিকতাই।

হ্যাঁ, পৌত্তলিকতা তো বটেই। ভাবতে গেলে তাই বইকি। কিন্তু, কতো দূর আমরা ভাবতে পারি বলুন? এই জড় জগতের নিছক জড়তার উৎস থেকেই তো প্রাণ আর চৈতন্যের উৎসার। এই শ্ৰী-সমৃদ্ধি–এত শিল্পকলা–সব কিছুর আমদানি। কিন্তু কোথায় যে সেই জড়তার শেষ আর এই চৈতন্যের সঞ্চার, তার কিছু কি ছাই জানি আমরা? আধুনিক বিজ্ঞান কি মনোবিজ্ঞানীরা কি সেই রহস্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পেরেছেন? একটুও কিনারা করতে পেরেছেন কোনো কিছুর? কিনারেই যেতে পারেননি বলতে কী!

চেতনাই সর্বশক্তির মূলে আর তার ভিত্তি নাকি অবচেতনাতেই–আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ একথা বলেছেন বটে।তিনি কন–কেউ কেউ আবার নির্জানের কথাও বলেছেন।

একই কথা। আরো এগিয়ে যান–একেবারে অজ্ঞানে, অচেতনে,-জড়তায়–জড়পিণ্ডতায়৷ …মানে, আমাদের সম্মুখীন ঐ পুতুলে–প্রতিমায়-প্রতাঁকে।

সেটা কি নিতান্তই জড়োপাসনা হবে না মশাই? জড়ত্বেই আত্মনিবেদন হবে তো?

নিশ্চয়ই জড়োপাসনাই তো! মনকে জড় করা। সর্ষের মতন যে মন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডর নানান বিষয়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাকে পাকড়ে এক জায়গায় জড়ো করে আনা-পরমহংসদেবের। কথায়। এই জড় পুত্তলিকায় মন দিয়েই সহজে সেটা হয়ত সম্ভব হয়। আর তখনই হয়ত, সেই পুতুলই প্রতিমা হয়ে ওঠে একদিন–জড়ের আড়ালেই অনন্ত শক্তি বিশ্বচৈতন্যের সাক্ষাৎ মিলে যায় কারো কারো।

মনকে জড়ো করা কি রকম মশাই?

মা বলতেন, সব কিছুর থেকে মনকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে এই দুই ভুরুর মাঝখানে নিয়ে এসে একেবারে নির্ভাবনা হয়ে যাওয়া। সেটা মুহূর্তের জন্য হলেও হয়। যে মুহূর্তেই তোর সব ভাবনা থেকে মুক্ত হবি, বলতেন মা, সেই মুহূর্তেই অভাবিত কতো কীর যে উন্মুক্তি ঘটবে!-মা খুব সহজ করে বলতেন কথাগুলো, কিন্তু কী ভাষায় যে বলতেন, সঠিক মনে পড়ছে না–তবে মোদ্দা কথাটা হচ্ছে তার এই। আমার নিজের ভাষণে ব্যক্ত করলাম।

ধারণা করতে পারছি না।

আমিও পারিনি। এখনও পারি না। কেউ পারে কিনা সন্দেহ! তবে তার কোনো দরকারও নেই নাকি, মা বলতেন। যেহেতু, বস্তুটা ধারণা করার নয়, প্রত্যক্ষ করার। গাছের ধারণা করে কী হবে, ফলের আস্বাদ নিয়ে কথা-বলতেন না ঠাকুর? ফলেই পরিচয়।

ফলে?

ফলে বই কি। করে দেখুন না। একটুক্ষণের জন্যেও মনকে জড়ীভূত করে সব ভাবনা দূর করতে পারলেই অফুরন্ত নতুনের উদ্ভাবনা–দেহে মনে জীবনে-গোচরে অগোচরে। সব কিছুর নবনবোন্মেষ ঘটে। যততা আধিব্যাধি সারার পথ ধরে তক্ষুনি কত সুযোগ সন্ধানের পথ খুলে যায়। এমন কি, আমার গল্পের যত না নতুন নতুন আইডিয়া-সে তো আমি এই করেই পাই মশাই। রামের পাদুকা মাথায় জড়ভরত হতে পারলেই আরামের রামরাজ্য লাভ।।

 তাই বুঝি এখানে এসে প্রার্থনা করছিলেন? প্রার্থনা করেন সেই জন্যেই!

প্রার্থনা কিসের! কিছু চাইবার দরকার করে না। আসল কথা, দেহে নিস্পন্দ আর মনে নিঃশব্দ হওয়া–অন্তত ক্ষণেকের জন্যেও। বাস, তাহলেই হোলো। হয়ে গেল তক্ষুনি। সেই অচিন্তন থেকেই অচিন্তনীয় লাভ। নিশ্চিভির থেকেই নিঃশেষে প্রাপ্তি। কম ভাবনার থেকেই যতো সম্ভাবনা। অবশ্যি ঘরে বসেও যে নির্ভাবনায় জড়িয়ে যাওয়া যায় না তা নয়, কিন্তু এখানে এই সাক্ষাৎ জড়তার সামনে দাঁড়িয়ে জর্জর হওয়াটা একটুখানি সহজতর নয় কি? বিশেষ পরম শিব যেখানে স্বয়ং জড়ীভূত হয়ে দেশকালাতীত নিজের বুকের মহাকাশ বিস্তারে মহাকালীর অনন্ত লীলায় তন্ময় হয়ে রয়েছেন? জীবশিবের খণ্ডকালের নব নবদ্বীপে নিত্য চৈতন্যলীলা?

আপনি পুতুল, প্রতিমা, প্রতীক-তত্ত্ব, রহস্য, ইঙ্গিত-সব গুলিয়ে একাকার করছেন।

একাকারই তো। এক বস্তুরই নানা আকার। মূলত সেই জড় কিংবা চৈতন্য-যাই বলুন–এক বস্তুরই এপিঠ ওপিঠ-আসলে যা উৎস, যার থেকে সব কিছুর উৎসার-তাবৎ উৎসাহ! জড়ের থেকেই অজর অমরত্ব! সেই আদিম জড়াবের থেকেই যত কিছুর উদ্ভব–যত না উদ্ভাবনা–জীবনের সব উৎসব! কিন্তু সে কথা যা আপনি এই অসময়ে অকুস্থলে এমন হঠাৎ এই বেপাড়ায় যে…?

বেপাড়া?

 বেপাড়া না? নেহাত বে-র বরযাত্রী না হলে কেউ কি এ পাড়ায় পা বাড়ায়? কলাবাগান আর চোরবাগানের এই চত্বরে সাধ করে নিজের পকেট খোয়াতে আসে?

খোয়ানোর কথা বলছেন? খোয়ার কথা? তা, আপনার খোঁজে এসে এই কদিনেই আমার যথেষ্ট খোয়র হয়েছে!

আমার খোঁজে?

হ্যাঁ, কিন্তু কিছুতেই আপনার সেই বাসার খোঁজ পাচ্ছিনে আর।

সে কি! আপনি কয়েকবার আমার বাসায় এসেছেন তো এর মধ্যে।

তা তো এসেছি। দেখেও গেছি ভালো করে। কিন্তু এখন এসে কিছুতেই তা আর খুঁজে পাচ্ছি না। এখানেই ছিল, অথচ কোথায় গেল যে এখন!

কদিন ধরেই টহল মারছেন এই রাস্তায়?…কেন, আমার বাসার নম্বরটা আপনার মনে নেই নাকি? যাতে ক্ষণে ক্ষণেই মনে পড়ে সেই হেতু খনার বচনের মন করে ছড়া বানিয়ে দিয়েছিলুম না? এক দুই তিন চারগুনে যান বার বার/বাদ দিন দ্বিতীয়কেই পেয়ে যাবেন তা হলেই/অ-দ্বিতীয় আমার ন্যায়/আমার বাসাও যে মশায়। মনে নেই আপনার? ভুলে মেরেছেন বুঝি?

ভুলব কেন? একশ চৌত্রিশ নম্বর তো আপানার? কিন্তু রাস্তায় তার হদিশ কোথায়? ১৩০ অব্দি পাচ্ছি, কিন্তু তার পরেই একেবারেই গিয়ে ১২০-মাঝখানের দশটা বাড়ির পাত্তাই নেই। বিলকুল লোপাট।

এই জন্যেই তো মশাই, গোড়াতেই আমি বলেছিলাম না আপনাকে? প্রথম যেদিন কোন্ এক অভিনয় আসরে না সাহিত্য বাসরে আলাপ হতেই আপনি আমার ঠিকানা চেয়ে বসলেন, আমি দিতে চাইনি কিছুতেই। বলেছিলাম না, সে আপনি খুঁজে পাবেন না সহজে, হয়রান হবেন নাহক। বলিনি কি? জানি তো, আমার পাত্তা পাওয়া কী সুকঠিন? ঠিকানা পেয়েও কলকাতায় কোনো বাড়ির ঠিক পাওয়া যায় না, আমি তো পাইনে অন্তত, আর তা খুঁজে বার করা যে কী দায় মশাই! আর কী যে ঝকমারি, তার ওপর আমার বাসার খোঁজ পাওয়া তো এক ফ্যাসাদ! সেই বাসায় গিয়ে ওঠার পরও কতদিন যে আমি নিজেই তার কোনো ঠাওর পাইনি তা জানেন? পার্কে শুয়ে কতো রাত যে কাটাতে হয়েছে আমাকে…

খোঁজ পান না তো, কী করে বাড়িটা খুঁজে পেয়েছিলেন গোড়াতে?

আমি ঠিক খুঁজে পাইনি, খুঁজতেও যাইনি। সত্যি বলতে, বাড়িটাই যেন কী করে খুঁজে পেয়েছিল আমায়…চিনে নিয়েছিল কেমন করে।

আগের জন্মের আপনজনকে যেমন চেনা-চেনা মনে হয়, সেই রকমটা? পূর্বজন্মের পরিচিত বুঝি বাড়িটা?

তাই বা বলি কি করে? আমার চোখের সামনে জন্মাতে দেখলাম বাড়িকে। আগের জন্মে কোনো বাড়িই ছিল না, একটা দীঘি ছিল নাকি ও-জায়গায়। বসাকদের দীঘি। বসাকদীঘি নাম নাকি তাই রাস্তাটার, জানতে পারলুম। আর আমার চোখের ওপরই বড় হলো বাড়িটা। বাড়লো, হৃষ্টপুষ্ট হলো। আমি যখন ওটায় সেঁধিয়েছিলাম তখন সবে ওর তৈরি শুরু। সম্পূর্ণও হয়নি তখন। আমি এলাম, দেখলাম, সেঁধুলাম–মৌরসী পাট্টা গাড়লাম আপনার। একালের উদ্বাস্তুরা যেমনটা করে না? ভিনি-ভিডি-ভিসি! সেই রকম বাতুঘুঘু হয়ে বসে গেলাম।

ভারী মজার লাগছে তো ব্যাপারটা, বলুন শুনি।

আগের রাত্তিরে আমার এক বোন–হ্যাঁ, বোনই বটে, তবে বন্ধু বলতেও বাধা নেই বলেছিল আমায় যে, রাস্তায় ঘাটে অমন করে পড়ে না থেকে একটা বাসাটা খুঁজে নিয়ে আসতানা গাড়ো নিজের। তাই সকাল বেলার খবর কাগজ বেচার কাজটা সেরেই রাবড়ির ভাঁড় মুখে চুমুকে চুমুকে চাখতে চাখতে বাড়ির খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি। অলিগলির ভেতর দিয়ে একটু গলাগলি করতেই মার্কাস স্কোয়ার মাঠটার সামনে এসে পড়লাম–এক নির্মীয়মান বাড়ির সামনে সৌম্যমূর্তি বর্ষীয়ান এক ভদ্রলোকের সম্মুখে। এধারে একটা মেসবাড়ির সন্ধান দিতে পারেন আমায়? শুধিয়েছি তাঁকেই। চোরবাগানে আবার মেসের অভাব? তিনি বললেন, চারধারেই তো মেস। এই রাস্তাটার কখানা বাড়ি ছাড়িয়ে করিম সাহেবের দোতলার পাশে বাঁহাতি গলির ভেতরে পর পর তিনখানা বাড়িই তো মেস। ল কলেজ মেস। ল কলেজের ছাত্ররা থাকে সেখানে। তুমি কি ল-র ছাত্র?

ছাত্র? হ্যাঁ, ছাত্র তো বটেই। তবে ল-র নয়, হ-য-ব-র-লর। আমি বলেছি।

তবে তো ওখানে থাকতে দেবে না তোমায়। তাহলে দিনকতক অপেক্ষা করো, আমার এই বাড়িটা মেস-পারপাসেই করা হচ্ছে, মেস হলে পর এখানে এসেই উঠতে পারবে তখন।

এখন ওঠা যায় না?

এখন তো সবে দুটো তালা হয়েছে মাত্তর। তিনতলাটা উঠবে এরপর। তারপর ছাদ হবে, ছাদের ঢালাই পেটাই হবে, চুনবালির পলস্তরা পড়বে, দরজা জানালা বসবে, ইলেকট্রিক ফটিংস আছে–বিস্তর কাজ বাকী এখনো।

থাক না। হতে থাক। দোতলার সিঁড়িটা হয়ে থাকলে এখনই তো ওঠা যায়। যায় না?

তা যায়, দোতালায় গিয়ে ওঠা যায় বটে। কিন্তু মেসবাড়ি কাকে বলে তার কোন আইডিয়া তোমার নেই বোধহয়? বিশ-ত্রিশজনায় মিলে একখানা বাড়ি ভাড়া নিয়ে ভাগ করে থাকে, ঠাকুর চাকর রেখে মেস গলায়-বখরায় খাওয়া-থাকা চালায় বলে খরচা কম পড়ে–একজনায় তো একটা মেসবাড়ি হয় না।

এখন একজন মেম্বারই আগাম চলে এল না-হয়। তারপর বাকীরা যখন এসে জুটবে তাদের একজন হয়ে থাকব আমি তখন। কিন্তু…কিন্তু…একটু কিন্তু কিন্তু করে কথাটা পাড়ি : কিন্তু ততদিন গোটাবাড়ির ভাড়াটা কি একলাই আমায় গুণতে হবে নাকি?

না, তা কেন। এমনি তুমি থাকতে পারো। আমার বাড়ির এক কেয়ারটেকার হিসেবে। তুমি থাকলে বাড়ির দরজা জানালাগুলো ঠিক থাকবে, সিমেন্ট বালি বেহাত হবে না–চোর ছাচোরের উপদ্রব থেকে বাঁচব। সেজন্য তোমাকে যেমন কোনো বেন দেব না, তোমারও কোনো ভাড়া দিতে লাগবে না। তা না হয় হল, কিন্তু তুমি খাবে কোথায়?

খাওয়ার জন্যে চিন্তা করিনে। এই পাড়ারই এক জায়গায় আমার খাবার ব্যবস্থা আছে…তাছাড়া এইরকম কয়েক ভাঁড় রাবড়ি হলেই আমার সারাদিন চলে যায়। হান্দ্রে দৃষ্টান্ত দেখিয়ে কথাটা সারি।

কিন্তু সিঁড়ির রেলিং এখনো হয়নি, বাড়িতে আলো নেইকো। রাত-বিরেতে ওঠা-নামায় অন্ধকারে পড়ে যাও যদি?

পড়লেই উঠে পড়ব তক্ষুনি–তার কী হয়েছে।

বেশ, তাহলে দোতলার যে-কোনো ঘর বেছে নাও গে। তোমার শোবার জন্যে একটা চৌকি পাঠিয়ে দিচ্ছি বরং, একটা হেরিকেন লণ্ঠনও। হেরিকেন দেব, নাকি টর্চ?

হেরিকেনের দরকার নেই, টর্চ একটা আমি কিনে নেব না-হয়। তাঁকে বললাম আপনার বাড়িটার চৌকিদারির জন্যে একটা চৌকিই যথেষ্ট। তার বেশি আর টর্চার করতে চাইনে আপনাকে।

আস্তানা গাড়লে কী হবে–রাস্তা মুখস্থ হয়নি তখনো। যে ধরনের পাঠ মুখস্থ করায় আমি অভ্যস্ত এ-পড়া তার থেকে আলাদা। কেবল মুখে মুখে সুখে আয়ত্ত হবার নয়, বার বার চোখস্ত করার পরই মুখস্থ হয়। রাস্তার নামধামেও ফারাক বিস্তর। নম্বরটা মুক্তারামের, বাড়িখানা এদিকে বসাকদীঘির লেনে। পাড়াটাও যেন কী রকমের। কারো কাছে কোনো সাহায্য পাওয়া যায় না। পরদিনই আর পথঘাটের কোনো হদিশ পাইনে। সকালের কাগজ ফিরি করে ফেরার পর দেখি আমার বাড়িও ফেরার। বাসার কোনো পাত্তাই নেই। কোথায় গেল সেটা? এই তো সকালেই দেখে গেছি–এখানেই ছিল কোথায়–এর মধ্যে উধাও? সারা চোরবাগান চষেও তার টিকির নাগাল পাই না। আপনি তো তবু দু-চারবার ঘোরাফেরা করার পরই ঐ ১২০ নম্বর কুড়িয়ে পেয়েছেন, আমি তো মশাই একশ কুড়িবার চক্কর মারবার পর তবে তার কিনারা পাই…।

একশ কুড়িবার?

কী বলছি তবে? কিন্তু সেটা আমরা চক্করবরতী বলেই হয়ত হবে। ১২০ কিংবা ১১৮ নম্বর যাই হোক, কিন্তু তারপরেই ওই ১৩০ আসে কী করে-সেটা হচ্ছে আবার চোরবাগানের বিখ্যাত চাটুজ্যেবাড়ি–যাই হোক, মাঝখানের দশ-দশটা বাড়ি লোপাট হয়ে যায় কী করে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা ঘামাচ্ছি, এমন সময় সামনের বাড়ি থেকে একটা ছেলে, প্রায় আমার সমবয়সী কি কিছু ছোর্টই হয়ত, বেরিয়ে এসে শুধোলে, আমাদের বাড়ির সামনে আপনি এত ঘোরাফেরা করছেন যে? কিছু চাই আপনার? বাবা জানতে পাঠালেন।–জিজ্ঞাসাবাদে জানলাম, আমি যেখানে ডেরা নিয়েছি, সেই বাড়ির মালিক আনন্দ সাহা মশায়ের বড় ছেলে সে। প্রভাতকুমার সাহা-বলল নাম। আমি বললাম–চাই বই কি ভাই! তোমাদের সেই বাড়িটাকেই চাই। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিনে সকাল থেকে।

আসুন আমার সঙ্গে  বলে সে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া একটা শুড়ি পথ ধরে (সাহাদের সঙ্গে কলকাতার শুঁড়িপথ একদা অবিচ্ছেদ্য ছিল ) ছোটখাট একটা বস্তি ভেদ করে আমার বাসার পশ্চাদ্দেশে এসে, তারপর তার পাশ কাটিয়ে বাড়িটার সামনের রাস্তায়-বসাকদীঘি লেনে (এখন নাকি যেটা কেদার বাঁড়ুজ্যে লেনে নামান্তরিত) এনে ফেলল। বলল যে, এ গোলমালটা হয় কেন জানেন? মুক্তারামবাবু স্ট্রীট থেকে এই বসাকদীঘি গলি অব্দি পুরো এলাকাটাই আমাদের-বাঁ দিকের সব বাঙ্গিলিই আমাদের…সরু গলিটার সব বাড়ির নম্বরই মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের, এমন কি, এ বাড়িটা বসাকদীঘিতে হলেও ইচ্ছে করেই আমরা এটার নম্বরও ওই মুক্তারামের নামেই রেখেছি, স্ট্রীটের বাড়ির ভ্যালুয়েশন গলির বাড়ির চাইতে বেশি হয় কিনা, তাই! বিক্রি করার কালে ভালো দাম মেলে।

আরে মশাই, আমিও যে ওই বস্তিতেই গিয়ে ঠেকেছিলাম। এর ভেতর দিয়ে এগুতেই দিল না আমাকে। আপনাদের তিন তলাটা আমায় দেখিয়ে দিল অবশ্যি; বলল, ঐ বাড়িটাই! কিন্তু এধার দিয়ে রাস্তা নয় তার, আপনাকে যেতে হবে ওধার দিয়ে…সে ধার দিয়ে, অন্য ধার দিয়ে-পূর্ব দিকের গলি দিয়েও যেতে পারেন, আবার পশ্চিম দিক দিয়েও যেতে কোনো বাধা নেই, কিন্তু এখান দিয়ে না, এটা পাবলিক রাস্তা নয়; এসব ভদ্রলোকের বাড়ি, এখানে এসে অমন ঘুরঘুর করলে গায়ে গরম জল ঢেলে দেব আপনার…এই বলে শাসালো আবার আমায়।…সেই ভদ্রজনরা!

দেবেই তো গরম জল, শাসাবেই তো! প্রাইভেট রাস্তা ওটা–জনাভিকের নেপথ্য যাত্রার। ও পথ দিয়ে আসতে হলে বাড়িওলার ছেলের পাসপোর্ট লাগে…

তাই বলে গায়ে গরম জল ঢেলে দেবে নাকি? বস্তির বাসিন্দাদের এতখানি গুমোর?

সুন্দর সুন্দর মেয়েরা নেই কি সেই বস্তিতে? আপনি ইতিউতি চাইছিলেন বোধ হয়? আশা করেছিলেন, আপনার কপালেও হয়ত কুন্ডলা ফলবে, এসে বলবে, পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ? অনেকে ইচ্ছে করে পথ হারাতে ওখানে যায় যে। গিয়ে পথ হারায় কি না! তাই ঐ গরম জলের ঢালাও ব্যবস্থা। ওরা ঘন্টায় ঘন্টায় চা খায়, গরম জল সর্বদাই রেডি। বডডো বেঁচে গেছেন মশাই!

কিন্তু তথাপি তাঁর ক্ষোভ যায় না–কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি–বস্তির লোকের এত গুমোর… তিনি গুমরোন তবুও।

বস্তি বলছেন কেন? শ্রাবস্তি বলুন। সুন্দর মেয়েরা যেখানে-স্বর্গ সেখানেই! স্বর্গের অলকনন্দা সেখান দিয়ে প্রবাহিত। সেই অলখ ঝোরার সন্ধানে বেরিয়ে হাজার হাজার বছর পর্যটনের পর ক্লান্ত পথিকরা অবশেষে শ্রাবস্তির কারুকার্যের কিনারায় এসে পৌঁছায়, জীবনের আনন্দ (কিংবা কবি জীবনানন্দকেই) নিজের অন্তরে খুঁজে পায় বুঝি। কত কাভ করে পেতে হয়–তা কি অত সোজাসুজি পাবার? তবে হ্যাঁ, আপনার একথা আমি মানব, এই কদিন বাসাটার খোঁজাখুজিতে যে পরিশ্রমটা করেছেন, পরীর মত কেউ নজরে পড়লে, তেমন কাউকে একটু নজরানা দিতে পারলে শ্রমটা আপনার সার্থক হতো বই কি!

যাই হোক, বাসাটা আপনার পালটান মশাই! আপনার সন্ধানী ভদ্রসন্তানদের আর এমন নাহক হয়রান করবেন না। তাঁর উপরোধ শুনতে হয়।

হ্যাঁ, আপনার কথায় বাসা পালটাই আর ধরা পড়ে যাই শেষটায়! ও-কথা আমি আমলই দিই না।

তার মানে?

তার মানে, কলকাতায় থেকেও ঢাকায় থাকার মত, গা-ঢাকা দিয়ে থাকার মত এমন আরেক খানা বাড়ি নেই শহরে। আছে আর কি? যেখানে কিনা আপনিও ফেরার, আপনার বাসাও ফেরার–যুগপৎ! কারো পাত্তা পাবার যো নেই। ঠিকানা পেলেও যার ঠিকঠিকানা মিলবে না কোনোদিন।

পুলিসের ভয় আছে বুঝি আপনার?

কার নেই? পুলিসের ভয় সবাই করে–সর্বত্র–সব সময়। জানেন, বিনয় বাদল দীনেশের একজন, কোন আমি ঠিক জানি না, একরাত্তির ঐ বাসায় কাটিয়ে গেছেন? তারকদার খোঁজে এসেছিলেন তিনি। তারকাও এক বিপ্লবী, আমাদের দেশের গাঁয়ে ইনটারনী হয়ে ছিলেন দিনকতক। মাঝে মাঝে কার্যগতিকে আমাদের বাসায় উঠতেন, থাকতেন আমার ঘরেই। তাঁর আসবার কথা ছিল যে আজ। আজকালের মধ্যে এসে যাবেন নিশ্চয়, বলল ছেলেটি, আমি তাঁর জন্যে অপেক্ষা করব এখানে। করুন, আপত্তি কিসের! কিন্তু আমার গেস্ট হয়ে ছিলেন তিনি শুধু ঐ এক রাত্তিরই। পরদিন সকালে উঠে আর তাঁর দেখা পাইনি। আমার ঘুম ভাঙার আগেই কোনো কথা না কয়েই কখন যে তিনি চলে গেছেন টেরও পাইনি আমি। টের পেলুম তার পরদিন-তখন তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া গেল। রাত না পোয়াতেই দমাদম ঘা পড়তে লাগল আমাদের সদর দরজায়। উঠে দেখি, গোটা পাড়াটা ছেয়ে গেছে পুলিসে। যেদিকে তাকাই খালি পুলিস আর পুলিস! বাসাড়েরা ভয়ে কাঁপছে সবাই–আমরা ঘেরাও! আর সশস্ত্র পুলিস আর গোরা সার্জেন্টদের নিয়ে এসেছেন অপর কেউ নয়–স্বয়ং টেগার্ট সাহেব!

.

৫৬.

 সদর দরজা ভেঙে ফেলার যোগাড়, কিন্তু ভয়ে কেউ উঁকিটি মারছে না পর্যন্ত। সবাই নিঃসাড়।

কিন্তু আমি তো জানি পুলিসের ডাকে সাড়া না দিয়ে যাবার জো নেই, শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের সেই কারাবরণের সময় থেকেই জানা আমার।

পুলিসের সঙ্গে পারা যায় না। দে ক্যান শুট। আর, সব সময় যে বন্দুক দিয়েই–তা নয়। শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের গুলতানিতে ঘোড়ামুখো এক গোরা সার্জেন্ট কেমন শুট করে আমায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল কয়েদগাড়ির ভেতরে-তার এক লং শটেই না।…বলপ্রয়োগ, মানুষকে বলের মত

অপপ্রয়োগে তাদের দ্বিধা বাধা নেই আমি জানি।

এর মধ্যেই অগ্রপশ্চাত খতিয়ে দেখা হয়েছে। যম যে সব সময় পিছে থাকেন, পিছিয়ে থাকেন তা নয়, এখানে সামনে বাঁয়ে ডাইনে পিছনে সর্বত্র। পিছনের খিড়কি ধরে বস্তির দিকে সরে পড়া যাবে, সেপথও বন্ধ–সেধারেও পুলিস। বাঁ দিকের দেয়াল টপকে পালাবো যে, সেদিকেও পাহারা। দরজা যদি না খুলে দি, আর কবিগুরুর সেই গানের মত তারা দ্বার ভেঙে এসে পড়ে যদি, তাহলে প্রাণের আর কিছু বাকী থাকবে না। আস্ত রাখবে না।

নামতে হল আমাকে, বাধ্য হয়েই।

দরজা খুলে বেরুতেই এক পুলিস অফিসার-তিনিই টেগার্ট সাহেব জানা গেল–এগিয়ে এলেন–নাম কী তোমার?

বললাম নাম।

কদ্দিন আছো এখানে? কতজন থাকে এ বাসায়? কী করে তারা সব?

 যথাযথ উত্তর দেবার পর তাঁর প্রশ্ন হল আবার-বাইরের ফালতু লোকের যাতাযাত আছে এখানে?

মাঝে মাঝে। কারো আত্মীয়স্বজন কখনো-সখনো এলে কয়েকদিনের জন্যে থাকেন তার গেস্ট হয়ে। তারপরে চলে যান।

এর ভেতর কেউ এসেছিল কি? তোমাদের এখানে?

না তো। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে-হ্যাঁ, এসেছিল। পরশু রাত্তিরে একজন এসেছিল বটে, এক যুবক, তাকে আমি চিনি না। ভালো করে আলাপ হবার আগেই কাল সকালে সে চলে গেছে–কোথায় জানি না। আমাকে কিছু না বলেই চলে গেছে সে।

কীরকম দেখতে যুবকটি?

বর্ণে বর্ণে তার পরিচয় দিতে না পারলেও একটা বর্ণনা দিলাম সাধ্যমতন। শুনে টেগার্ট পাশের সহযোগী বাঙালী অফিসারের দিকে ইঙ্গিত করলে–দ্যাটস্ দা ম্যান। এসেছিল কেন সে তোমার কাছে?

আমার কাছে আসেনি ঠিক। তারকা বলে একজনের খোঁজে সে এসেছিল এখানে।

হু ইজ দিস তারক? এখানে থাকে সে? এ মেম্বর অফ দিস মেস?

না। মাঝে মাঝে এখানে আসে। এসে দুয়েক দিন থাকে, থেকে চলে যায় আবার। কোথায় যায় জানি না।

এনি রিলেটিভ অফ ইয়োরস?

নো সার। আমাদের মালদায় ইনটার্নী হয়ে ছিল সে কিছুদিন। সেখানেই তার সঙ্গে আমার আলাপ।

সিওরলি এ টেররিস্ট। কামস্ টু ইউ হিয়ার ফর সাম টেররিস্টিক অ্যাকটিভিটি আনডাউটেডুলি?

সে টেররিস্ট কিনা আমি জনি না। তেমন কোনো কাজে আমার কাছে আসে না। সেরকম কোনো কথাও বলে না সে। হি রাইটস্ নভেলস্। আমাকে শোনাতে চায়-তাই। নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা ইত্যাদি করার জন্যেই আসে।

নাউ হি ইজ এ রাইটার? নট এ টেররিস্ট, ইউ মীন?

বাট টু লিসন টু হিজ রাইটিংস নো লেস এ টেরর সার! আই ডোন্ট লাইক ইট, বাট–কী করতে পারি বলুন! সে নাছোড়বান্দা। শুনতেই হবে আমায় বাধ্য হয়ে। না শুনিয়ে ছাড়বে না।

তুমি কী করো? আর ইউ এ রাইটার টু? এ নভেলিস্ট?

নো, নো। আই অ্যাম এ জার্নালিস্ট। আই হক দা পেপারস্ ইন দা মর্নিং।

ওঃ! দ্যাট জার্নালিস্ট দ্যাট ইউ হক দা জার্নালস?

নো সার। নাহক নয়। আই অলসো রাইট ইন দেম। স্টোরি অ্যান্ড পোয়েম। ইন সাম অফ দেম।

চলো, তোমাদের বাসাটা আমি সার্চ করব। হ্যাঁজ দ্যাট ম্যান লেফট এনিথিং হিয়ার ইন, ইওর রুম?

পারহ্যাপস্ নট। আসুন! ইউ আর ওয়েলকাম। অলওয়েজ ওয়েলকাম।

পুলিস আর প্রেমিককে অভ্যর্থনা না করে উপায় নেই–মিথ্যে বললেও দোষ নেই কোন যদি তাঁদের সন্তোষ হয়। যতই আনওয়েলকাম হোক না, তাদের কাম্য আচরণ করাটাই দস্তুর।

বাসার সব ঘর ঘরগুলোই তাঁরা ঘুরেফিরে দেখলেন। অন্য ঘরগুলো ওপর ওপর, আমারটা তন্ন তন্ন করে। ছাদটাও বাদ গেল না।

কোথাও আপত্তিকর কোনো কিছু না পেয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোকেরা।

যাবার আগে টেগার্ট সাহেবকে আমি জানিয়েছিলাম, আমার কিছু ধন্যবাদ তাঁর পাওনা আছে। দিনকতক আগে আমার ফাউন্টেনপেনটা খোয়া গিয়েছিল, অ্যান্ড বিকজ আয্যাম এ রাইটার, আমার কলম গেলেই খোয়র। আমি হাতে খোঁড়া। কিন্তু হারাবার দু-একদিন পরেই একজন–এই পাড়ারই কোনো পিকপকেট হবে, আমি চিনি না, খুব বিরক্তিভরে অযাচিত কলমটা ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন আমায়। থানায় ডায়েরি করেছি নাকি, সে শুধিয়েছিল আমাকে। পাগল! থানায় খবর দিলে কী হয় আমার জানা আছে ভাই! যে জানাতে যায় তাকেই তারা নাজেহাল করে ছাড়ে। অমন কথা বোলো নাকো–থানার ত্রিসীমানায় আমারা নেই। আমার জবাবে খুশি হয়ে সে বলেছে–উয়োবাত তো ঠিক হ্যায়। শালা টেগার্টের জ্বালায় না খেয়ে মরতে হবে আমাদের, কারো পকেট মারবার যো নেই দেখুন না। রাস্তায় এক টাকার নোট পড়ে থাকলেও কেউ তা কুড়োতে পারবে নাক বলেছে নাকি শালাটা। তাহলে সে তাকে দেখে নেবে। দেখুন তো! কী মুশকিল। কী রকম হারামি!

শুনে টেগার্ট হাসতে লাগলেন–তুমি দেখেছ এরকম পড়ে থাকতে?

নোট? এক টাকার নোট রাস্তায় পড়ে থাকতে? না সার, কক্ষনো দেখিনি। দেখলে তো আমি নিজেই তা কুড়িয়ে নিতাম তৎক্ষণাৎ। না, টাকা পয়সা আমি কখনো পড়ে থাকতে দেখি না। তেমনটা এ পোড়া চোখেই পড়ে না আমার। আমার বরাত! শুনে না টেগার্ট সাহেব আমার করমর্দন করে হাসতে হাসতে চলে গেলেন।

কী হোলো তার পরে? জনাব সাহেব জিগ্যেস করলেন।

 কী আর হবে। পাড়ায় আমার বেশ পজিশন হয়ে গেল তারপর। বড়রা সবাই ভাবতে লাগল আমায় পুলিসের স্পাই বলে, আর ছোটরা মনে করল, আমি বুঝি বিপ্লবী। দুই মহলেই আমার মর্যাদা বেড়ে গেল বেজায়। আর সবাই বেশ সমীহ করে আমার স্পর্শদোষ বাঁচিয়ে চলতে লাগল। ছায়া মাড়াত না কেউ। নির্বাাট ছিলাম পাড়ায় তারপর। সাধনবাবুর সন্দেশের দোকানে ধারেও রাবড়ি পেতাম আমি তখন থেকে–চাইলেই না!

বাঃ বাঃ! আপনার বরাতে মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়ে গেল ব্যাপারটা। বেশ বেশ! তিনি বললেন-পুলিসে ছুঁলে আঠারো ঘা হয়ে থাকে, সেই বিপাকে আপনার হলো মিষ্টান্ন লাভ! এই অসাধ্যসাধন!

ইতরজন বলেই বোধহয়! সাধনা না করতেই এই সিদ্ধিলাভ। সাধুনবাবুর মেঠাই-মন্ডা পাওয়া! সেদিনকার প্রাতঃকালীন দৃশ্য দেখতে পাড়ায় বেশ ভিড় জমে গেছল তোদূরে অদূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল সবাই, সম্ভবত সাধনবাবুও সেই উপরিদর্শকদের দলে থাকবেন। খোদ পুলিস কমিশনারের সঙ্গে আমার খাতির দেখে তিনি আমায় হাত করতে চেয়েছিলেন হয়ত, সেইটে খতিয়ে আমিও তাঁর রাবড়ি হাতাতে লাগলাম।

সেই সুমধুর হাতাহাতিটা কদ্দিন গড়িয়েছিল? কবছর পর্যন্ত?

এখন অব্দি। এখন অবশ্যি সাধনবাবু জীবিত নেই আর, বহুদিন স্বর্গত, এখন তাঁর ছেলে শৈলেনের দোকান। তাহলেও সেখান থেকে ধারে কিছু নিলে তারা পরে চেয়ে নিতে ভুলে যায় দেখছি, সেটা ইচ্ছে করেই মনে হয়।

সব পেয়েছি-র দলে না হলেও সব পাওয়ার মেসে আপনি এসে পড়েছেন দেখছি। কিন্তু যাই বলুন, ঠিক গা ঢাকাটি দিয়ে থাকা যায় না ওখানে। পুলিসে ঠিক খবরটিও পায়, আর ঠিকানারও পাত্তা পায় ঠিকই। কেমন খুঁজে পেল দেখলেন তো?

তা ঠিক। পুলিসের সঙ্গে আড়ি করে ফেরারী হওয়া যায় না সত্যি। পুলিস ঠিক পিঁপড়ের মতই। কোথায় ওদের খাদ্য আছে, টের পেয়ে যায় যে কেমন করে-খুঁজে বের করে হানা দেয় শেষ পর্যন্ত। ঐ পুলিস আর পিঁপড়েরা।

পিঁপড়েরাও!

হ্যাঁ। দেশের থেকে একবার শখানেকের ওপর আম পাঠিয়েছিল যেন কে! এককালে আমাদের দেশ ছিল সেই মালদায় জানেন তো? ওখানে গিয়ে একবার ঘুরে ফিরে এসেছিলেন না আপনি? তাহলে সেখানকার আম খাওয়ার বিধি-ব্যবস্থা কী রকম তাও জানেন নিশ্চয়। আমের নামেই সেটা মালুম হবে। গোপালভোগ, বাদশাভোেগ, ক্ষীরসাপাতি এইসব আম। আমের নাম! বুঝতেই পারছেন, এহে আম গোপালকে নিবেদন করে পাতক্ষীরের গামলায় ডুবিয়ে বাদশার মত আয়েস করে খেতে হয়। কিন্তু এই একশ আম, আমি একাই একশ হলেও একা একা খাই কি করে–খেয়ে ফুরোবার আগেই বেশির ভাগ এর তো পচে গলে একশা হয়ে যাবে…

পাড়ার আমজনতাকে ডেকে এনে খাওয়াতে পারতেন।

আসবে কেন তারা? বলেছি না, টেগার্ট সাহেবের সৌজন্যে আমি কিঞ্চিৎ নামজাদা হলেও তারা আমাকে এড়িয়ে চলত–তখন না হয় একটু আমজাদাই হয়েছি, তাই বলে তারা আমায় আমল দেবে নাকি? সাধনবাবুর দোকান থেকে সের দুয়েক রাবড়ি নিয়ে এসে আমার বোনেদের-জবা পুতুল কাবেরী ইতুদের ডেকে আনতে চলে গেলুম। আমার অনেক বইয়ে ওদের গল্প পড়ে থাকবেন, ওরা আপনার অজানা নয় বোধ হয়? ভালোবাসার অনেক নাম-বইটার গোড়ার গল্পটাই তো জবাকে নিয়ে। আবার নিখরচায় জলযোগ বইয়ের শেষের গল্পটাও তাই-আমার সেই জবাই! সত্যি বললে, এক সম্পর্কে ওরা আমার কাজিন হয়। সে সময় ওরা সবাই কূপার স্ট্রীটে থাকত, বিয়েও হয়নি কারু–সেই কূপার থেকে পাকড়ে আমার অন্ধকূপে টেনে আনলাম সবাইকে–আম খাওয়ার আমন্ত্রণে। আনলাম তো, কিন্তু এসে দেখি, ওমা! আম যথাযথই আছে বটে, কিন্তু রাবড়ির গামলাটা পিঁপড়েয় ভর্তি, রাবড়ির সরের ওপর রঙচঙে এক স্তর পিপিড়ের পুরু পলস্তারা।

সে কী মশাই!

বলছি কি তবে? আমার সেই ঘরের জঞ্জাল তো দেখেছেন? তার ওপরে সেদিনের খবর কাগজটা পেতে তার ওপরেই গামলাটা বসিয়ে ঢেকে রেখে গিয়েছি।

পিঁপড়েরা গন্ধ পায় মশাই! এদিকে পুলিসের সঙ্গে বেশ মিলে আছে তাদের।

ভাবলাম গন্ধ পেলেও সন্ধান পাবে না। রাজ্যের ওই নোংরা মাড়িয়ে, খালি পায়ে আবর্জনার সেই উচ্চাবচ পর্বতশৃঙ্গদের ডিঙিয়ে, দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার হয়ে এত কষ্ট করে তারা সেই অমৃতকুম্ভের নাগাল পেতে আসবে, ধারণাও করিনি–কিন্তু পাত্তা পেয়েছে ঠিকই। যাই হোক, ওপর ওপর চেঁছে ফেলে রাবড়ির তলানিটাই সদ্ব্যবহার করা গেল আম দিয়ে–কতো কী ভালো-মন্দ তো তারা খেয়েছে জীবনে। তাদের বাড়ি আমিই কি কম কিছু খেয়েছি নাকি, তবু আমার মনে হয়, সেই খাওয়ার সোয়াদ এখনো বুঝি তাদের–আমার সেই বোনদের মুখে লেগে রয়েছে।

সত্যি! জনাব সুরুৎ করে জিভের জল টানলেন। ঝালের মত মিষ্টিটাও পরের মুখেই খেতে হয় বুঝি।

ইতু বলল, দূর, বাড়ি বসে কি এসব জমে নাকি? চলো আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ময়দানে গিয়ে পিকনিক করিগে। তাই গেলাম সবাই। গ্রেট ইস্টার্ন থেকে কেক প্যাট্রজ কাটলেট স্যানডউইচ ইত্যাদি নিয়ে খবরের কাগজ বিছিয়ে সেখানে গিয়ে বসলাম আমরা। খানিক বাদেই চেঁচিয়ে উঠেছে ইতু-ওমা? কাভটা দেখেচ! তোমার সেই পিঁপড়েরা আবার এখানেও এসে হানা দিয়েছে দ্যাখো! এখানে আসব আমরা, কী করে টের পেয়েছে কে জানে! আমি যখন ভিক্টোরিয়ার কথা বলছিলুম না, তখনই শুনেছিল বোধ হয়। আর সটান চলে এসেছে সঙ্গে সঙ্গে। পুতুল তো ওর কথায় অবাক। এগুলো সেই মেসের পিঁপড়ে বলছিস তুই? না তো কী! দ্যাখ না, একেকটা ঘাড় তুলে তাকাচ্ছে কেমন আবার! সেই পিঁপড়েরাই! তোর দিকেই তাকাচ্ছে বোধ হয়–এর মধ্যে আহামরি তো তুই-ই কেবল। ইতুকে আমি সান্ত্বনা দিই।

সেই থেকেই আমার ধারণা মশাই, পুলিসের মতন পিপত্রে হাত থেকেও পার পাওয়া যায় না। যে করেই হোক, টের তারা পাবেই–এড়ানো যাবে না তাদের। তবে একটা কথা আমি বলব, পিঁপড়ে প্রমুখদের ফেরানো না গেলেও পাওনাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে থাকা যায় বেশ ঐ বাসাতে…

মানে, আপনাকে আর পালাতে হয় না, বাড়িটাই পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় বলছেন অই? জনাব কন–নাকি সদরে পাওনাদারদের দর্শন পেলেই আপনি খিড়কির শুড়িপথ ধরে সরে পরতে পারেন? সেই কথাই?

না, না মশাই। এদিকে পাওনাদারের টিকি দেখলেই ওদিক দিয়ে টিকিট কাটব সে বরাত করিনি-আমার আবার পানাদার কে হবে? কে ধার দিতে যাবে তখন আমায়? তেমন ধারালো বন্ধু-তেমন কেউই ছিল না যে। তখন আমার স্ট্রাগলিং পিরিয়ড চলছিল না? সেই দারুণ দুঃসময়ে কেউ কারো মিত্র হয়? সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়, পড়েননি পদ্যপাঠে?

কেন, দেশবন্ধু তো ছিলেন আপনার? পাননি–পেতেন না তাঁর কাছে?

পাব না কেন? পেয়েছি তো, অনেক অনেক-অনেকবার! কাছে গেলেই কেমন করে যেন তিনি টের পেতেন, তখন যা তাঁর পকেটে থাকত, সব উজাড় করে বের করে দিতেন, কিন্তু তাঁকে পেলে তো?

পাবার বাধাটা কী ছিল?

আমি নিজেই বাধা। মুহুর্মুহু গিয়ে চাওয়া যায় খালি খালি? চক্ষুলজ্জা করে না? বুড়ো ধাড়ি হয়ে বার বার তাঁর বাড়ি গিয়ে…তা ছাড়া, আমার প্রতি তাঁর বদান্যতার কথা তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরাও টের পেয়ে গেছল যে…সেই বদ অন্যরাই তাঁকে দুইত বোধ হয়–তারাই তাঁকে ঘিরে থাক সব সময়। ধারে-কাছে ঘেষতেই দিত না আমাকে। বাড়ি থাকলেও বলে দিত বাইরে চলে গেছেন। এমনি নানা ফন্দি ফিকিরে বাধা দিত তারা আমায়…

চিঠি লিখে জানাতে পারতেন…মাইকেল যেমন বিদ্যাসাগরকে পত্রাঘাত করতেন…কেবল আপনাকেই নয়, অনেক লেখককেই তিনি সাহায্য করতেন জানা গেছে, আর তিনি বিদ্যাসাগররের মতই তাদের প্রতি মুক্তহস্ত ছিলেন।

তা বটে, নিজেকে তিনি উঠতি প্রতিভাদের প্রতিভূ বলে জ্ঞান কানে বোধ হয়। তা বলে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর তুলনা হয় না–সে তুলনা করবেন না। এদিক দিয়ে বিদ্যাসাগরের চেয়ে তিনি বড়ো ছিলেন এমন কথা আমি বলতে চাইনে, তিনি ছিলেন তাঁর থেকে আলাদা। একেবারে স্বতন্ত্র। বিদ্যাসাগর যোগ্য লোককে দিতেন আর দেশবন্ধু অযোগ্য ছাড়া দিতেই না। বিদ্যাসাগরের বিচারপূর্বক দান আর তাঁর ছিল নির্বিচার। বর্ষার মেঘপুঞ্জ যেমন কোন বাছবিচার না করে স্থানে-অস্থানে সমানে অকাতরে ঝড়ে পড়ে নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হয়ে বাঁচে ঠিক–তেমনটাই। বিদ্যাসাগরের করুণা; আর দেশবন্ধুর স্নেহ। দুজনের তুলনা হয় না।

আপনি দেশবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন, জানি আমরা।

তেমন অনেকেই ছিল। আমি এমন বিশেষ কিছু নয়। তবে নজরুল আর সুভাষকেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন মনে হয়। তবে বললাম না? তাঁর স্নেহলাভের বাধা ছিল বিস্তর।

আমার মতন অনেক স্নেহভাজন, তারা আবার নিকটজনও, তাঁকে ঘিরে রাখত–আমার মত অভাজনদের এগুতেই দিত না তাঁর কাছে–সেই দুস্তর বাধা পেরিয়ে পৌঁছনো যায় কি করে? তা ছাড়া তিনিও মাঝে মাঝে সুদূরপরাহত হয়ে যেতেন। অল ইন্ডিয়া লীডার ছিলেন তো তিনি–প্রায়ই হিল্লি-দিল্লি, বোম্বে, মাদ্রাজ, এলাহাবাদ, নাগপুর ঘুরতে হত তাঁকে–তখন? সেই দুঃসময়ে কী করি বলুন?

কী করতেন?

অসহায়ের পাশে কে দাঁড়াবে আবার? কে সহায় হয় তার? সে সময় শুধু দুজনই আছে কেবল–মা-কালী আর বাবা কাবুলি। সামনের মন্দিরের ওই প্রতীকাকার আর সেই প্রতিকার।

কাবুলির কাছে ধার করতে হতো আপনাকে?

হত বইকি। হয়েছিল একবার–সেই একবারই মাত্র। আমাদের দেশের একজন–শরৎ ঝা-চাঁচলের ইস্কুলে এক বছরের সিনিয়র ছিল আমার–সেই শরৎদাই আমায় নিয়ে গেছল তাঁর চেনা কাবুলিটির কাছে। দেখে-শুনে সে ধার দিতে রাজী হয়ে গেল এক কথাতেই। অদ্ভুত এই কাবুলিরা, সত্যিই! দিয়েছিল সে শদেড়েক টাকা ধার।

কী দেখেশুনে দিল শুনি?

আমার কথা শুনে। আর আমার ঠিকানায় এসে বাসাটা দেখে–তারপরে। কেয়া কাম বতে হো? শুধিয়েছিল সে শুধু। সকালে খবর কাগজ বেচার কথাটা আমি বলেছি। সে শুনে বলল–আচ্ছা কাম হ্যায়। বহুৎ আচ্ছা কাম। লেকিন উওতো ফজিরকা কাম। আর সমুচা দিন… বিলকুল বেকার? কুছভি নেহি আউর?

কাহে নেহি? হা এক মোকামকা কেয়াটেকার ন্যায় না? কেয়ারটেকারকা কেয়া বোলতা? দারোয়ান। যাঁহা হাম রহতা হ্যায়, ওই কোঠিকা দারোয়ানি ভি করতা হ্যায়।

বহুৎ আচ্ছা! বহুৎ আচ্ছা! ইয়ে আউর ভি বড়িয়া কাম। এহি দারোয়ানিসে জবর কাম আউর কুছভি নেহি। সে বলেছে।

জী হাঁ! আমি সায় দিয়েছি তার কথায়–ইসে জেয়াদা কাম আউর কেয়া হ্যায়? এই পেয়াদা কাম?

জরুর, জরুর! সে ঘাড় নাড়ে-হাকিমসে ভি জবর ইয়ে কাম। হরবখৎ মোকামকা দরওয়াজা পর খাড়া।.হাকিমকা সাথ দোস্তি-রহনে সেকতা, লেকিন পেয়াদাসে দোস্তি বেগর হাকিমসে মিলনা ভি মুশকিল! পেয়াদা দরোয়াজামে যোক দেনেসে তোম উপর জায়গা কিন্তরে?

ওহি তো বাৎ! পেয়াদা নেহি কাৎ হোনেসে হাকিমসে ভি মোলাকাৎ নেহি।

কাবুলি আমার বুলিতে খুশি হয়েছিল বোধ হয়। সে তার ঝুলির থেকে কিসমিস বাদাম বার করে খেতে দিয়েছিল আমায়। আমার হকারির চাইতেও আমার দারোয়ানিকে বেশি মর্যাদা দেওয়ায় আমিও মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাকে সঙ্গে করে মহাসমাদরে নিয়ে এসে বাসাটা দেখিয়ে দিলাম আমার।

সে জানালো, মাসের একটা নির্দিষ্ট তারিখে বাড়িটার এক ফার্লং দূরে এই ল্যাম্পপোস্টের সামনে এসে সে খাড়া হবে, তাকে দাঁড়াতে দেখলেই আমি যেন সুড় সুড় করে সুদের টাকাটা গিয়ে তার হাতে গুঁজে দিয়ে আসি। তা হলে সে বাসায় এসে হানা দেবে না, ঐখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে চুপচাপ- কিন্তু তাকে দেখার পরেও আমি নেহাত যদি না যাই, তখন সে বাধ্য হয়ে এখানে এসে চড়াও হবে কিন্তু। আর যদি তাকে দেখেই আমি দিয়ে দিয়ে আসি গিয়ে, তা হলে সে আমাকে পেস্তা, বাদাম, কিসমিস, মনাক্কা, আখরোট, আঙুর ইত্যাদি মেওয়া খাওয়াবে আবার। কিন্তু দিতে দেরি করলে–সবুরে সে মেওয়া ফলবে না।

যাবার আগে সে বেশ করে দেখে গিয়েছিল বাড়িটাকে। কিন্তু সেই তার প্রথম দেখা আর সেই-ই শেষ।

সেই শেষ কেন? কী হলো তারপর?

তারপর তার সৌজন্যে আমার স্ট্রাগলটা শেষ হলো বটে, অন্তত তখনকার মতন। কিন্তু তার স্ট্রাগলটা শুরু হয়ে গেল তারপরই। আমার বাড়িটা খুঁজে বার করতে লাগল সে। তারপর–কিন্তু পাত্তা পেল না কিছুতেই। আমিও তার দেখা পাইনি আর! সেই বাসাটার দৌলতেই না? সেই বাসা আমায় আপনি বদলাতে বলছেন মশাই?

.

৫৭.

চলুন, আজ ভালো করে দেখব। জনাব সাহেব কথা পাড়েন মাঝখানে : আপনার মেসটা চিনে আসব বেশ করে।

কী হবে চিনে? আমি কোনো উৎসাহ দেখাইনে-আমি তো আপনার কাছে কোনো ধার চাইতে যাচ্ছিনে। আপনার ধার ধারবারও কোনো মতলব নেই আমার। না, সেজন্যে নয়। এত ঘুরেফিরে, এতবার ঘোরাঘুরির পরেও যা চিনতে পারেননি, তা না হয় নিশ্চিহ্ন হয়েই থাক। তাতে আপনারও শাভি এবং হয়ত আমার-আমারও…

তার বেশি বলতে পারি না। নিজের শান্তিপ্রিয়তা ব্যক্ত করতে সঙ্কোচ হয় স্বভাবতই।

বাসায় তো ফিরছেন এখন? চলুন না!

না, বাসায় কেন আবার? বেরুলাম তত এই। নানান বিষয়কর্মে বেরিয়েছি। হাতে ওষুধের শিশি দেখছেন না? বোস কম্পানিতে মিকশ্চারটা বানাতে দিতে হবে। সেখান থেকে আরেকটু এগিয়ে, বিবেকানন্দ রোড পেরিয়ে চাচার দোকানের পাশে সাঙ্গভেলির কেবিনে…সেখানে চা-টা খেয়ে ফেরার পথে ওষধটা নিয়ে আসব বোস কোম্পানির থেকে… এর ভেতরে তাঁরা বানিয়ে রাখবেন মিকশ্চারটা।

কিসের মিকশ্চার?

অ্যাজমার। মার ছিল না ঐ ব্যামো? আমারও হয়েছিল একবার। আমারও হবে, বলেছিল মা। অ্যাজমা মার, ঐ অ্যাজমা আমারও। সেই রকমটাই হয়েছিল একবার ভারী জোর হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর হতে দিইনি। এখন মাঝে মাঝে এক-আধবার একটু-আধটু না হয় যে তা নয়–এর কয়েক দাগ খেলেই সেরে যায়।…ডাক্তার নানী সেনগুপ্তর প্রেস্কৃঞ্জন এটা মশাই, সেই কোন সেকালে। আমরা যখন যদুনাথ সেন লেনে থাকতাম–বাড়িটার এগরো নম্বর বোধ হয়, আর ডাঃ সেনগুপ্ত তখন সবে প্র্যাকটিশ জমিয়েছেন, চার টাকা মাত্র ফি ছিল তাঁর তখনকার–থাকতেন মানিকতলা স্ট্রীটের কোথায় যেন–এসে মাকে ভালো করে দেখেশুনে ঐ মিকশ্চারের ব্যবস্থা করে গেছলেন।

দেখে তো মনে হয় না আপনার অ্যাজমা-ট্যাজমা আছে? হেঁপো রুগীকে দেখলেই তো চেনা যায়। কোনো অসুখই আপনার রয়েছে বলে বোধ হয় না। আপনি বোধ হয় কলকাতার সুস্থতম ব্যক্তি।

অসুস্থতম। হেন আধিব্যাধি নেই, যা নাকি হয়নি আমার–আর নেইকো এখন। যে রোগটা একবার আমায় ধরেছে সে আর আমায় কখনো ছাড়েনি, ছাড়তে চায়নি বুঝি। এবং আমিও যে ওষুধটা একবার ধরেছি তার ছাড়ান দিইনি আর। শরীর ব্যাধি মন্দিরম-বলেছে না? বাঁচতে হলে, বুঝলেন মশাই, হয় অসুখে ভুগুন, নয়তো ওই ওষুধেই–ভুগতেই হবে। অসুখে ভুগলে অশান্তি, নিজের এবং আশপাশের সবাইকার, কিন্তু ওষুধে ভুগলে সেটা নেই। কপেয়ারিটিভলি অনেকটা শান্তি–তাই না কি? তবে যতই ওষুধ খান না, মৃত্যু এড়ানো যাবে না সত্যি, তবু যতটা স্বচ্ছন্দে থাকা যায়–আর শান্তিতে মরা যায়। আমার ভোগসুখে যেমন অনীহ্যাঁ, অসুখ ভোগেও সেই রকমটাই। সুখ ভোগ নাগালের বাইরে বলে সাধ করে অসুখ ভোগ বাগাতে যাব, এমন ভোগলালসা নেই আমার। তাই যতটা সম্ভব যথাসাধ্য তাদের প্রকোপ এড়িয়ে যেতে চাই।

সবাই তো তাই চায় মশাই!

আর আজকাল এমন এমন ওষুধ বেরিয়েছে না! মন্ত্রের মতন রোগ সারায়, রোগ আটাকাতেও তাদের জোড়া নেই।

তা, এখন বোস কোম্পানিতে যাচ্ছেন যে! হাঁপানি হয়েছে নাকি?

না, হয়নি। সে একবারই যা হয়েছিল, বললাম না! সেই একবার ভুগেই আমার ভোগস্পৃহা মিটে গেছে…হইে দিই না এখন আর, হবার আগেই সারিয়ে রাখি। যে দাবাইয়ে সারায়, তাই দিয়ে দাবিয়ে রাখি আগের থেকে। নিয়মিত এক-আধ দাগ খাই রোজ, খেয়ে যাই–তাতেই আর ওটা পাত্তা পায় না। আমলই দিই না অসুখটাকে। ভালো আছি বেশ।

আশ্চর্য! রোগ না হলেও ওষুধ খায় লোকে?

আশ্চর্য বটে। এ তো মিরাকল-এর ন্যায়। ওষুধ সব থাকতেও লোকে যে এত অসুখে ভোগে তা দেখে আমি কিছু কম অবাক হই কি মশাই? আমার কী মনে হয় জানেন? ভোগবাসনা মানুষের অন্তর্গত, কিছুতেই তা যায় না, যেতে চায় না। যেমন সুখের জন্য তেমনই আবার যেন অসুখের জন্যেও মন তার কেমন করে যেন। সেটি না হলে কেমন যেন ভালো লাগে না, মনে মনে, চায় যে, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন সবাই মিলে তার জন্য আহা-উৎ করুক, সেবা করুক ঠেলে, অসুখে না পড়লে তো পারিবারিক প্রীতি প্রকাশ পায় না। তার পরিচয় পাবার তরেই হয়ত সে ওই লালায়িত। সেই হেতু সাধ করে রোগ ডেকে আনে-মারা পড়ে অনেক সময় সেইজন্যই। চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। ওষুধটা করতে গিয়ে সাঙ্গুভেলিতে বসি গিয়ে–সেখানে বসেই গল্প করা যাবেখন। চা টোস্ট কফি যা চান, অমলেট পোচ কাটলেট যা চাই, স্ট কারি কোর্মা সব পাওয়া যায় সেখানে। চমৎকার সস্তায়।

বোস কম্পানিতে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে সাঙ্গুভেলিতে গিয়ে বসলাম আমরা। দুপ্রস্থ খাবারের অর্ডার দেওয়া গেল।

এখানেও ধারে খাওয়ায় নাকি? টেবিলের ওধার থেকে তাঁর জিজ্ঞাসা।

আরে না না। কাবুলিওয়ালার দক্ষিণা কি সবারই থাকে নাকি? সেকালে যখন খবর কাগজ বেচতাম সকালে, আমাদের দেশের শরৎদার সঙ্গে একদিন রাস্তায় দেখা হঠাৎ। তাঁকে আমি বললাম, শরৎদা, গোটা কুড়ি পঁচিশ টাকা ধার দাও না আমাকে? এই কারবার তাহলে জমিয়ে করা যায়। তোর এই কাগজ বেচার ব্যবসা? হ্যাঁ, আনন্দবাজার, বসুমতী আমি অবশ্য ধারেই পাই, কিন্তু সব কাগজ তো তাই নয়। হ্যাঁ, আরো কতো কাগজ আছে, অমৃতবাজার, ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ, স্টেটসম্যান, নামক সব রকম কাগজই চায় খদ্দের। কিন্তু সেসব তত এই টার্মে মেলে না। কমিশন বাদে কাগজের দাম আগাম মিটিয়ে দিয়ে আনতে হয়। সেটা করতে পারলে আরো কতো উপায় হত আমার। তাই তো ধার চাইছিলাম। তা তো চাইছিস। কিন্তু তুই কি আর এ ধার শুধতে পারবি কখনো? পারব না? কেন বলো তো? পারব না কেন? আরে, যে ধার করে সে কি আর তা ওখতে পারে? পারলে তো তাকে আর ধারই করতে হত না রে। ধার করার দরকারই পড়ত না তার-পড়ার আগেই সে রোজগার করে রাখত। ও বাবা এ যে আমার সেই রোগ হবার আগেই সারাও-থিয়োরির মতই আরেকখানা! তা, টাকাটা দিয়ে তুমি আর ফেরত নাই-বা নিলে শরৎদা? তোমার ঋণ কি শুধবার? তোমার কাছে না-হয় চিরঋণী হয়েই থাকতাম। তিনি বললেন, না ভাই তা হয় না। আমি কারুর কাছে চির পাওনাদার হয়ে থাকতে চাই না। সেটা আমার ভাল্লাগে না। তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই, কিন্তু তারা আবার দশ বিশ টাকা ধার দিতে চায় না যে, দুশো পাঁচশো হলে দেয়। নিবি দুশো পাঁচশো? নেব না কেন, নিতে বাধা কিসের। পেলে তো ভালোই হয় আরো–কিন্তু অতত টাকা শুধব আমি কি করে? শুধতে হবে না, জানালেন শরৎদা, তাদের টাকা কখনো শুধতে হয় না, শুধতে পারে না কেউ, শুধু সুদ দিয়ে গেলেই হয়। শুধতে গেলেই আমার মনে হয়, তারা হয়ত কেঁদেই ফেলবে ভ্যাক করে। তাই নাকি? হ্যাঁ, ওই টাকায় তারা কি ফেলল না তোকে? জন্মের মতন তুই তাদের জমিদারি হয়ে গেলি, তোর থেকে নিয়মিত ভাড়া আদায় করাটাই কাজ দাঁড়ালো তাদের। সে কাজ গেলেই তারা বেকার। তাই সুদ পেলেই তারা খুশী, আর কিছুই চায় না। সেই কাবুলিওলারা। এই বলে সে নিয়ে গেল আমায় সেই কাবুলিওলাদের এক ডেরায়, বউবাজারের কোথায় যেন তাদের আস্তানাটা। তাদের খাতায় সই দিয়ে দেড়শ টাকা ধার করলাম, টেন পারসেন্ট হিসেবে সুদ তার পনের টাকা, সেটা বছরের নয়, মাসে মাসে। প্রথম মাসের সুদের পনেরটাকা প্রথমেই সে উসুল করে নিল–সেটা কেটে নিয়ে বাকীটা দিলো। আর বলে দিল যে, পরের মাসের ঠিক এই তারিখেই ফের এই পনের টাকা যেন তাকে দিয়ে আসি গিয়ে–এমনি মাসের পর মাস পরম্পরায়–তার যেন অন্যথা না হয়। এসব তো বলেইছি আপনাকে গোড়ায়। বলিনি?

হ্যাঁ, তাহলে যে বছরে প্রায় একশো আশী পার্সেন্ট সুদ দাঁড়ায় মশাই।

 দাঁড়াক না। আমিও দাঁড়ালাম তো তার দৌলতেই। বছরে সেটা যত পার্সেন্টের ধাক্কাই হোক না, সে সময় যেন আমার কাছে সেটা বিধাতার আশীর্বাদের মতই এসেছিল। আমি বলি–তুলনাটা একটু অশোভন হলেও, রবীন্দ্রনাথ যেমন কাবুলিওয়ালার সাহায্যেই সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন…

অ্যাঁ? শুনেই চমকে উঠেছেন জনাব : তাকেও কি ওই কাবুলির কাছে ধার করতে হতো নাকি?

না না। সে ধার দিয়ে বলছিনে। কাবুলিওয়ালা গল্পটা লিখেই কথাসাহিত্যে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে না? এবং পরে-বহুকাল পরেই যদিও-সেই কাবুলিওয়ালার থেকেই সিনেমা জগতেও তাঁর প্রতিষ্টা-সেটা রবি আর তপনের যুগপৎ সমুদয়ে যদিও-তেমনি আমারও যা-কিছু জারিজুরি তা সেই কাবুলিওয়ালার প্রেরণাতেই।

তার মানে? পরিষ্কার করে বলুন।

প্রেরণ করো ভৈরব তব দুর্জয় আহবান হে! সে আহ্বান আর কার হতে পারে? কাবুলিওয়ালা ছাড়া আবার কে? তারই প্রেরণায় আমি পড়ি কি মরি করে গল্প লিখতে বসলাম। মাসের অমুক তারিখে অত টাকার সুদ গুণতেই হবে আমাকে, ছাড়ান ছোড়ন নেই, কী করা যায় তখন বলুন? না লিখে উপায় আছে? তিন টাকা কি পাঁচ সিকে, কিংবা সাড়ে চার বা দশ টাকাই গল্পের দর তখন আমার। রোজ লিখি সকালে দুপুরে রাত্তিরে, রাত জেগেও লিখতে হয়–একেক দিন এমনকি তিনটে করেও ওতরাতে হয়। লেখাগুলো ওতরায় কিনা জানিনে, কিন্তু আমার লেখনীকে ওগরাতে হয়ই। নামকরা কোনো কাগজে লিখি না তখন, নেয়ও না, চায়ও না তারা আমার লেখা। লিখি ছোট ছোট কাগজে-ছোটদের পত্রিকায়–বেঁটেখাটো দক্ষিণায়। তিল কুড়িয়ে তিল পাকাই, কিন্তু পনের টাকার মত লিখতে গেলেই যে সেই আন্দাজে লেখা যাবে তা হয় না, লেখার ঠেলায় লেখা বেড়ে চলে বাধ্য হয়ে কোনো কোনো মাসে পনেরর জায়গায় পঁচাত্তর উপায় করে বসি। আবার সেই গল্পগুলির জোট পাকিয়ে ছোটখাট বই হয়ে যায় একেকটা। যে কোনো প্রকাশককে যে কোনো দামে দিয়ে দিই–আমার খাসী তখন দ্বিতীয়বার জবাই হয়–মোটমাট অনেকগুলি বই এ করেই বেরিয়ে যায় আমার তখন। আর এমনি করেই, যৎসামান্য যা আমার প্রতিষ্ঠা–সব সেই কাবুলিওয়ালার প্রেরণাতেই। তার কাছে আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ। আর চিরঋণী তো বটেই। সুদ আসল কিছুই তার শোধ করতে পারিনি।

বেশ করেছেন।

মোটেই বেশ করিনি। অনিচ্ছা সত্ত্বে হলেও আমার সেই অবিশ্বস্ততায় প্রাণে সে কতত ব্যথা পেয়েছে কে জানে! কাবুলিওয়ালাও প্রাণে ব্যথা পেতে পারে, তারও প্রাণ আছে, আমার মত প্রাণীই সে। কতো মেয়ের স্নেহের কথা আমি বেমালুম ভুলেছি, কিন্তু কবে কে পাঁচ টাকা ধার নিয়ে দেয়নি, তার শোক এখনো আমার যায়নি–এখনও মনে পড়ে ক্ষণে-ক্ষণে। অন্য শোক ডালেপালে, অর্থশোক বক্ষস্থলে-বলে না? ঠিক তাই। না, অনিচ্ছাকৃত হলেও, কাজটা আমার খুবই গর্হিত হয়েছে। কিন্তু এমনই এই সংসারটা, গহিত কিছু না করলে গড়পড়তায় কারও হিত হয় না বোধ হয়।

যাই হোক, যে করেই হোক, অসাধ্যসাধন করেছেন বটে। আমি এটাকে আপনার জীবনের যুগান্তর বলব। কাগজের হকার থেকে কাগজের লেখক হওয়া যুগান্তকারী নয় কি?

হ্যাঁ, তাই। যুগান্তকারীই। কাবুলিওয়ালার সেই দেড়শ টাকা পুঁজি সম্বলে লেখক থেকে আবার সম্পাদক হয়ে যাওয়া-যুগান্তকারী ঘটনাই বটে। আমার জীবনের সেই যুগান্তর সাধন।

সম্পাদক হলেন আবার কী রকম?

তারপরই আমি সম্পাদক হয়ে নব পর্যায়ে যুগান্তর বার করলাম না?

যুগান্তর! সে তো বারীনদাদের কাগজ ছিল বলে জানি।

হ্যাঁ, তাঁদেরই ছিল বটে। অগ্নিযুগের গোড়ায় বারীনদা উপেনদারা মিলে সেটা বেব করেছিলেন। তারপর তাঁরা নির্বাসিত হয়ে আন্দামানে চলে গেলেন না? কাগজখানা বাজেয়াপ্ত করে নিলেন সরকার। পরে যথাসময়ে আন্দামান থেকে ফিরে এসে তাঁরা বের করলেন সাপ্তাহিক বিজলী-নলিনীকান্ত সরকারের সম্পাদনায়। আর উপেনদা বার করলেন তাঁর নিজস্ব আত্মশক্তি-রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। আর কবি নজরুল ইসলামের ছিল ধূমকেতু-কবিগুরুর আশীর্বাদধন্য। ধূমকেতুর মাথায় সেই আশীর্বাদ-লিপি লেখা থাকত, দেখেননি? আয় রে আয় ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/দুর্দিনে এই দুর্গ শিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। অল্পক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভুলে হোক না লেখা/জাগিয়ে দে রে/চমক মেরে আছে যারা অর্ধচেতন।

তারই সমসাময়িক ভুঁইফোড় সাপ্তাহিক আমার এই যুগান্তর-সরকারী বাজেয়াপ্ত হওয়া বারীনদাদের কাগজ জবরদখল করে নেওয়া আমার।

জবরদখল করে পাওয়া?

তাছাড়া কী? উদ্বাস্তুদের মতই প্রায়–এমনিতেই যার সব হারায় সে। সর্বহারারা যা পায় অমনিই পায়, নয় তো জোর করে আদায় করে। ভুইফোড় আমি জন্ম-উদ্বাস্তুই তো। আমার জীবনের সব কিছুই জবর দখল করা। কী শিশুসাহিত্যে, কী নাট্য জগতে, কী বড়দের লেখাটেখায়, কিছুই আমার পরিশ্রম নৈপুণ্যে নিজগুণে পাওয়া নয়,সাধনোচিত লাভ নয় কোনটাই, সত্যি বলতে যা পেয়েছি তার কোনটাই আমার পাওনা ছিল না। আমার জীবনের যা-কিছু পেলাম, সবই ওই পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতই? যেমন কিনা, এই কাবুলিওয়ালাকে পেয়ে যাওয়া সেই চৌদ্দ আনাই তো? সে আমায় তার দেয় টাকার থেকে সুদের দুআনা কেটে চোদ্দ আনা দিলেও, তার থেকে আমি ষোলো আনার ওপরে আঠারো আনা লাভ পিটেছি। কার অযাচিত পৃষ্ঠপোষকতায় কে জানে!

কে আবার? আপনার ঐ মা কালী ছাড়া আর কে? ফোড়ন কাটেন জনাব সাহেব উনিই তো আপনার পৃষ্ঠপোষক।

মাখতে না চাইলেও উনি যেন জোর করে গায়ে মাখিয়ে দেন। কথাটার ঝাল কানে না তুললেও ঝাঁজটা নাকে লাগেই। হ্যাঁ, নিশ্চয়। সামনে না থাকলেও সবার পিছনেই উনি রয়েছেন–ঐ ভগবান। সবার পিঠোপিঠি।

পিঠোপিঠি?

হ্যাঁ, শুধু পার্থের ন্যায় যুগন্ধরদেরই উনি সারথ্য করেন, সামনে থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান। আমাদের মত লোকদের পিছন থেকে ঠেলা মারেন–ঠেলা দেন ঠিক পথটিতে। আমাদের তো রথ নেই, রথী নই আমরা–তাই আমাদের ঘাড়েই চেপে রয়েছেন। এই পিঠেই তাঁর পীঠস্থান-সেখান থেকেই তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা।

তাই পিঠোপিঠি বলতে চাইছেন?–তিনি কন : মানে, আপনার স্কন্ধপুরাণের পৃষ্ঠায় তিনি রয়েছেন? মাপ করবেন, কথাটা আপনার কায়দায় বলা হয়ে গেল।

তাই বইকি! মাকে তো কোনো দিনই হৃদয়ে ঠাঁই দিতে পারিনি, না নিজের মাকে না ঐ পরমাকে- কিন্তু মা তো কখনই ছাবার পাত্রী নন, নাছোড়বান্দাই। সিন্ধবাদ নাবিকের সেই বৃদ্ধের মতই মাথার ওপর চেপে রয়েছেন-সেখানে বসেই আমার মুণ্ডু ঘোরাচ্ছেন-ফেরাচ্ছেন তাঁর অলক্ষ্য নির্দেশে। খালি আমার নন, সবাইকার।

মুন্ডুপাত করছেন সকলের? বলতে চাইছেন?

তাছাড়া কী? মার বাঁ হাতে যে মুন্ডু-ধরা সে কার? আমারই তো। আমাদেরই। তাঁর গলা জড়িয়ে যে মালা করে পরানো সে তো আমরাই–তাঁর ছেলেমেয়েরাই–কণ্ঠলগ্ন গলগ্রহরা যত! বাঁ হাতে তিনি আমাদের মাথা উদ্ধার করছেন, যদিও দক্ষিণ হস্তে তাঁর চতুর্কগই। বরমাল্যই। তাঁর সে-বর আগ বাড়িয়ে যে বরণ করে নিতে পারে তারই, কিন্তু কজন তা পারে? আর সবাইকে তাই হাতে তুলে তাঁকে দিতে হয়। তাদের ঘাড়ে ধরে তাঁর প্রসাদের পায়েস-পিঠে তিনি হাঁ করিয়ে গিলিয়ে দেন। তা নইলে সেই অক্ষমদের অভুক্ত থাকতে হোত। এই পিঠে দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া–এটা তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া আর কী?

আপনাকে তাই ওই কাবুলি দাওয়াই দিয়ে গিলোতে হোলো? পথে আনতে হলো বুঝি?

না তো কী? মা আমায় কবে বলেছিলেন, বৃত্তিতে যাবি–তাই তোর স্বধর্ম, যা ই মন থেকে চাস, যেদিকে তোর প্রবৃত্তি-সত্যিকারের ঝোঁক সেই হোলো তোর আসল বৃত্তি-স্ববৃত্তে তুই প্রবৃত্ত হবি-বৃত্তিলাভেই সিদ্ধিলাভ-স্ববৃত্তেই স্বয়ংসিদ্ধি। কিন্তু মার কথাটা শুনেছিলাম কী! কী যে আমি চাই! তার খোঁজ করেছি কি কখনো? যার-তার যা-কিছুর পিছনে ছুটে মরেছি–আর পরে টের পেয়েছি যে সেটা আমি চাইনি। কিন্তু তখন সেই কালে মার কথা দূরে থাক, মাইে আমার মনে পড়ত না কখনো। না নিজ মাকে, না পরমাকে। একটু আগেই বললাম না আপনাকে? মার সব কথাই মন থেকে ভেসে গিয়েছিল কোনকালে! মারই ঠাই ছিল না আমার মনে-বলতে কি! যত আজেবাজে মেয়েরাই মনের সবখানি জুড়ে বসেছিল, সুন্দর সুন্দর মুখরাই ফুলের মত ফুটফুট করত সব সময়–আলপিনের মতও ফুটত আবার! মার দিকটায় ছিল ঘুটঘুঁটে অমাবস্যাই–কিন্তু অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো! সেই তো তোমার আলো! বলে না? সেই অন্ধকারের পৃষ্টপট থেকেই আমার উৎসবের দিন এগিয়ে এল। যুগান্তর ঘটে গেল আমার জীবনে।

হকার থেকে রচনাকার-যুগান্তর বইকি!

কিন্তু হোতী কি, মা অমন করে ঘাড় ধরে না গিলিয়ে দিলে? কাবুলিওয়ালার ঠেলায় না পড়লে বৃত্তির পথে যেতুম নাকি কোনোদিন? সে-পথ খুঁজেই পেতাম না হয়তো। কাগজ বিক্রির কমিশনে দিলশোসের মটন চপ আর সাধনবাবুর রাবড়ি সাবাড় করেই আত্মসুখী আমার স্বচ্ছন্দে দিন কাটত-কখন-সখনো এক-আধটু এখানে সেখানে লিখে-টিকে। তারই আত্মসতভাষে কোনরকমে টিকে থাকতাম। লেখাটাকে বৃত্তি করার প্রবৃত্তিই হত না, তার থেকে জীবিকার্জনের ধারণাই করতে পারতাম না-কাবুলিওলার সুদ মেটানোর দায় ঘাড়ে না চাপলে সম্পাদকের কাছে লেখার জন্য টাকা আদায় করার ভাবনাই হত না আমার। আর যাদুশী ভাবনাৰ্যস্য-ভাবনার থেকে তো সাফল্যের অদ্ভাবনা? মাথায় ভাবনা জাগল বলেই না এটা হোলো

কাবুলি পর্বর আগে আপনি লিখে কোথাও টাকা পাননি? চাননি বুঝি?

 লেখার জন্যে টাকা দেওয়া নেওয়ার রেওয়াজই ছিল না তখন। এমনকি প্রমথ চৌধুরীও অমনি প্রবন্ধ লিখতেন সেকালে, রবীন্দ্রনাথ কবিতা দিতে চাইলেই। লেখার জন্য দক্ষিণা আদানপ্রদানের পত্তন হয়েছিল নজরুলের থেকেই করেছিলেন পবিত্র গাঙ্গুলি।

স্বনামধন্য পবিত্র গাঙ্গুলি?

পত্রিকাওলাদের বদ্ধমুষ্টি থেকে তার কবিতার দক্ষিণা উদ্ধার করে আনতেন ওই পবিত্র বাবুই–সেই টাকা জেলখানার দরজায় গিয়েও কাজীকে পৌঁছে দিয়েও আসতেন আবার। তার বেলায় পবিত্রর আদায়, আমার বেলা সেই কাবুলিওলার দায়। শৈলজার মতই পবিত্র ছিল কাজীর অন্তরঙ্গ বন্ধু, তার সব কাজ, সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্য আর সাহিত্যসেবীদেরও কাজ সে এগিয়ে দিয়েছিল। আমার বন্ধু বলতে সেই কাবুলিওলাই, আর তো কাউকে দেখতে পাই না। সে-ই আমার কাজ গুছিয়ে দিয়েছে তার খেই ধরানোর থেকেই আমার খেয়া শুরু।

কাবুলিওলার প্রেরণাতেই আপনার কলম ধরা তাহলে? প্রেরণা বা ঠেলাতে–যাই বলুন! ঠেলার নাম বাবাজী বলে যে, তা মিছে নয়।

আমার বেলায় মাইজী। আমার বেলায় মায়ের ঠেলাই-একটু পরয়ৈপদীভাবে যদিও। দক্ষিণ হস্তের বরাভয় তো নয়, বাঁ হাতের দাক্ষিণ্যই–মাথার টিকি ধরে খড়গহস্তর টান। যাই হোক, মার স্নেহ তো! দু দিকেই সমান। আমার মা বলেছিলেন নিজের বৃত্তিপথে পা বাড়ালেই সিদ্ধি পাবি তৎক্ষণাৎ। আর সিদ্ধি মানেই তাঁর সাক্ষাৎ। পদে পদে তাঁর পরিচয়, হাতে হাতে তার প্রমাণ। নিজের মুঠোর মধ্যে নগদ নারায়ণ লাভ করতেই টের পেলাম, কথাটা তো মার মিথ্যে নয়। এই লেখাই আমার পথ–এই পথই আমার তো! আস্ত নোটখানা হাতে আসতেই রাস্তা আমার পরিষ্কার হল।

প্রথম কোথা থেকে টাকা পান আপনি লেখার জন্য?

মৌচাক। মৌচাক ছোটদের মাসিক, সুধীর সরকার সম্পাদক। আমাদের আধুনিক কিশোর সাহিত্যের পথিকৃৎ তিনিই। নিজে যে খুব বেশি কিছু লিখেছেন তা নয়, যদিও তাঁর লেখার বেশ হাত ছিল–আমার দেশ, আমার কাল-বইয়েই তার প্রমাণ আছে, তবে সাহিত্যকৃতির চেয়েও তাঁর বড় কৃতিত্ব সাহিত্যিক সৃষ্টিতে-যে-কীর্তির অংশীদার বঙ্গদর্শনের বঙ্কিম,সাধনার রবীন্দ্রনাথ, সবুজ পত্রের প্রমথ চৌধুরী, প্রবাসীর রামানন্দ, বিচিত্রার উপেন গাঙ্গুলি, কল্লোলের দীনেশ দাশ থেকে শুরু করে সসাগরা ভারতবর্ষের আরো অনেকে। সম্পাদকরূপে সুধীরবাবুও তাঁর স্বক্ষেত্রে সেই রকম এক অগ্রগণ্যই। স্বয়ং সারথি হয় সেকালের অনেক সাহিত্যরথীকে শিশু সাহিত্যের কর্মক্ষেত্রে টেনে এনেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত, মণিলাল, হেমেন্দ্রকুমার, রাজশেখর, কেদার চাটুজ্যে, বিভূতি বাঁড়ুজ্যে, শরৎচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে কল্লোল গোষ্ঠীর বড় বড় লিখিয়েদেরও ছোটদের জন্য কলম ধরিয়েছিলেন, প্রায় কেউই বাদ ছিল না। বড়রা লিখতে ধরেছিলেন বলেই আমাদের শিশুসাহিত্য বড় হল। বড়দের লেখা, বড় দরের লেখা পেলে তবেই না দেশের ছেলেমেয়েরা বড় হবে। তাঁর প্রেরণালব্ধ লেকখদের সাহিত্য সৃজনেই সেই সুধীরবাবুরই জয় হয়েছে, আমি মনে করি।

সুধীরবাবুর কাছ থেকেই আপনার প্রথম লেখার দক্ষিণালাভ?।

হ্যাঁ, তাঁর দাক্ষিণ্যই সব প্রথম। তবে সেটাই আমার প্রথম লেখা নয়। তার আগে বিস্তর লিখেছিলাম–বড় বড় কবিতা, মেজ মেজ গল্প, আর মাজাঘষা প্ৰরন্ধ কম লিখিনি–একাঙ্কিকা নাটক-ফাটক কী না! সে সব লেখা বড় পত্রিকার পৃষ্টায় বয়স্কদের পাতে পরিবেষিত। বেরিয়েছিল ভারতী, ভারতবর্ষ, উত্তরা, কল্লোল, বিজলী আর ধূমকেতুতে। সিরিয়াস যত লেখা। কিন্তু তার কোনটার জন্যেই কিছু পাইনি। চাইওনি কোথাও হাত বাড়িয়ে। চাইবার সাহসই হয়নি বলতে কি! লেখা ছাপানোর জন্যই, নিজেকে ধন্য জ্ঞান করেছি, সাধুবাদ দিয়েছি সম্পাদককে। তখন মনের আনন্দে লিখতেন লেখকরা, আর লেখা ছাপা হলেই কৃতার্থ! তার থেকে কৃত অর্থের কোনো কথাই ছিল না, অর্থমূল্যে রচনা বিক্রীত (কিংবা বিকৃত) করার গরজ ছিল না তাঁদের। সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে লিখে যেতেই এনতার, তারপর বয়স্য কন্যা পাই করার ন্যায় সেই সব রচনা পত্রস্থ করার একটা দায় ছিল যেন তাদের। বুঝতে পারছেন অবস্থাটা? কাগজে লিখে কিছু উপায় করার কথাটা তখন গজাই না আমার মগজে…

তাহলে?

যদি না কাবুলিওলার আসন্ন তাগাদার কথাটা গজালের মত লেগে থাকত মাথায় গজগজ করত সব সময়। সেই কথা ভেবেই-তারই গঞ্জনায় আমায় আদায়ের পথে এগুতে হলো। সুধীরবাবু যখন আমায় মৌচাকে লেখার জন্য বললেন, আমি মুখফোঁড় হয়ে চেয়ে বসলুম-টাকা দেবেন তো?

নিশ্চয়। টাকা দেব বইকি? কত দাবি বলুন? সুদের ধান্দা ছিল আমার মাত্র পনের টাকার–তা-ই আমি চেয়েছিলাম। এই নিন আগাম বলে তক্ষুনি টাকাটা আমার হাতে তিনি তুলে দিয়েছেন। দিতেই, টাকাটা পেতেই না, আমার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন হেসে উঠল তক্ষুনি। সেই হাসিই ক্রমে বন্যার আকার ধরে আমার আগেকার সব লেখাপত্তর ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে হাসির গল্প হয়ে দেখা দিয়েছে তার পরে…বাংলা সাহিত্যে তো নয়ই, শিশু সাহিত্যেও প্রথম নয় নিশ্চয়, কিন্তু আমার হাতে প্রথম হাসির গল্প সেইটাই।

কী ছিল গল্পটা?

 একটা ঘোড়ার গল্প। গরীব গঞ্চাননের একটা বেতো ঘোড়া ছিল, খেতে পেত না বেচারা। পেট ভরে খেতে দিতে পারত না, তার ওপর বেদম খাটাত পঞ্চানন। খিদের জ্বালায় ঘোড়াটা ছটফট করত সর্বক্ষণ। বেগুনীর থেকে শুরু করে টর্চ বাতি, লেপ মশারি যাহা পাইত তাহাই খাইত-পঞ্চানন করল কি দাঁও বুঝে একদিন গাঁয়ের এক মোড়লকে ধরে গছিয়ে দিল ঘোড়াটা। হয়েছিল কি, জেলার হাকিম সেখানকার ডাকবাংলোয় এসেছিলেন সেদিন, আর মাতব্বর লোকটি তাঁর সাক্ষাৎকারে যাচ্ছিলেন। পঞ্চানন তাকে বুঝিয়েছিল, পায়ে হেঁটে হাকিমদর্শনে গেলে কি আর কদর হবে, ঘোড়ায় চেপে গেলে আদর মিলতে পারে। নামমাত্র দামে ঘোড়াটা পেয়ে তাতেই চেপে ডাকবাংলোয় হাজির হলেন ভদ্রলোক। তার ঘোড়াটাকে নিয়ে যাওয়া হলো বাংলোর আস্তাবলে-হাকিম সাহেবের ঘোড়া বাঁধা ছিল যেখানে। সেখানে হাকিমের ঘোড়ার মতই তাকেও বালতি ভরে দানাপানি দেওয়া হল। সেই সব বাদাম ছোলা, আরো কতো কী, খাওয়া দূরে থাক, জীবনে কখনো চোখেও দেখেনি বেচারা। তাই না দেখেই, বালতিতে মুখ ডোবাবে কি, আকাশের দিকে মুখ তুলে হাসতে শুরু করে দিয়েছে সে-চ্যাঁ হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ হ্যাঁ! ভূরি ভোজে মুখ না ছুঁইয়ে ভূরি ভূরি তার সেই অভ্রভেদী অট্টহাসি! খাবে কি, খাবার দেখেই তার চক্ষুস্থির! সে আত্মহারা। মর্মভেদী হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসতে হাসতেই মারা গেল বেচারা শেষ পর্যন্ত? এই গল্প।

গল্পটার নাম পঞ্চাননের অশ্বমেধ, তাই না? বইটা পড়েছিলাম যেন কোনকালে। এখন আর পাওয়া যায় না বোধ হয়?

আসলে সেই ঘোড়াটা আর কেউ না, এই আমিই। এই যে ঘোড়েল–আপনার সামনেই। সেই ঘোড়ার হাসি, লিখে প্রথম টাকা পাওয়া আমার সেই গোড়ার হাসিই তারপর আমার সব গল্পে আমদানি-আমার সব লেখাতেই ছড়িয়ে যাওয়া এখন অবধি। আগাগোড়া একই হাসাহাসির ব্যাপার।

মা-কালী বা বাবা কাবুলিওলা–যার প্রেরণাতেই হোক না, প্রেরণা বা ঠেলা যাই বলুন এই মেলাই গল্প–এত গল্পের মেলা–এ কীর্তিও কিছু কম নয় মশাই! কালী কমলিওলার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু কালী কাবুলিওলার দৌলতে যা কাভটা আপনি বাধালেন না?

এমন কিছু মহৎ সৃষ্টি নয়, আমি মানব। তেমন কিছু করতে পারিনি জানি আমি। সেটা মার দিকের কোনো গলদ নয়, আমার দিকেই বলহীনতা। নয়মাত্মা বলহীনেন লভ্য, জানেন তো? মহাকালের বৃত্তে, স্বয়ং শিবকে বৃত্ত করে যিনি মুহূর্তে মুহূর্তে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করছেন আমার ন্যায় অক্ষমের সামান্য বৃত্তে এসে যৎকিঞ্চিৎ বৃত্তির পরিধিতে তিনি আর এর বেশি কী করবেন। বৃত্তই তো আধার–যেমন আধার তেমনটি হবার, বলতেন না ঠাকুর? কল্পতরুর কান্ডে যাঁর অসামান্য ফলসম্ভার, সামান্য ঘেঁটুগাছের ডগায় এসে তাঁর তেমনি ধারাই সাফল্য হবে তো। গুল্মকে তো আর বনস্পতি বানানো যায় না। কাঁটা গাছের বাদাড়ে ফুল নয়, কাঁটাই ফুটবার। আমার ভাগ্যে যা জুটেছে তাতেই আমি প্রফুল্ল। মহাকালের বক্ষে যিনি মহাকালী, আমার মতন মাকালদের পক্ষে তিনিই মাকালী।

.

৫৮.

 আমি ভগবান-ফগমান মানি না…

আমিও না…

ভগবান কিছু করতে পারে আমার বিশ্বাস হয় না। যা কিছু করার মানুষই করছে, মানুষই করবে।…

আমারও তাই মত। আমি প্ৰকাশ করি-ভগবান যে মানুষ করে ছেড়ে দিয়েছে সেই ঢের। এখন আমাদের চরে খাওয়া উচিত।

মানুষের ব্যাপারে ভগবানের কিছু করণীয় আছে আমার মনে হয় না। মানুষই নিজের ভালোমন্দ সব করছে, আর সে-ই করতে পারে। এ বিষয়ে ভগবানের কোনো হাত নেই।

ভগবানও সেই কথাই বলতে চান, আমি মনে করি।

 ভগবানের মনের কথা টের পান আপনি? তাঁর উক্তিতে বক্তৃতার কটাক্ষ।

তা কি করে পাব? কেউ পায় নাকি? পেয়েছে কেউ কখনো? তবে এই আমার মনে হয়। ভগবান নিজেই কি একথা বলে দেননি?

কোথায়? গীতায়? জনাব সাহেবের জিজ্ঞাসা।

গীতায় কেন? গীতার ভাষ্য ছাড়া তাঁর বক্তব্য কি আর কোথাও প্রকাশ্য হয়নি? সর্বজনবোধ্য ভাষাতেই তিনি কত রকমেই তো সেকথা প্রকাশ করেছেন…

কী রকমের ভাষাটা? শুনি তো!

কবিসুলভ ভাষায়। ভগবান আসলে কবিই তো। কবি ছাড়া আর কী? আদি কবি আমাদের।

এই বিশ্বসৃষ্টি তাঁর কবিতা, এই কথা বলছেন?

না না, সে কথা নয়। এটা তাঁর লীলা কি কবিতা তার তত্ত্ব কে জানে! না, সে কথা বলছিনে। কবির একটা অর্থ হচ্ছে স্রষ্টা, অতএব স্বয়ং স্রষ্টাও কবিই। কবি হতে বাধ্য। অভিধান মতে কবিই। অর্থাৎ তাই দাঁড়ায়। কিন্তু কথা হচ্ছে এই যে, সেই আদি কবিও আমাদের আধুনিক কবিদের মতই প্রতীকী ভাষায় কথা কন।

যেমন?…তিনি দৃষ্টান্তর মুখাপেক্ষী।

যেমন আপনি বললেন না, ভগবানের কোন ব্যাপারেই কিছু হাত নেই–বললেন না? সাক্ষাৎ জগন্নাথরূপে ঠিক সেই কথাটিই কি তিনি বাতলাননি ঐ প্রতীকী ভাষায়? কিংবা অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টে–যাই বলুন।

ঐ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে?

হাতের দিকে তিনি শূন্য। যেমন হাতে শূন্য তেমনি তিনি শূন্যহস্তই। তাঁর হাতেও কাউকে দেবার কিছু নেই। যা পাবার তা আমাদের অর্জন করে নিতে হবে, উপার্জন করে পেতে হবে। তার কোনো ভুল নেই মশাই! তবে কিনা…

তবে কিনা?

তবে কিনা সেই শূন্যতার থেকেই সমস্ত আসে, সব কিছু মেলে যে! সেই শূন্য হাতই আমাদের দু-হাত পূর্ণ করে দিতে পারে…দেয়, বুঝি বারে বারে…স্বতোৎসারে। সেই শূন্যের থেকেই আসে পূর্ণতা, শূন্যতা হেঁকেই সব পাই। তার কাছে কিছু চাইতে হয় না, না চাইতেই পাওয়া যায়। কেন্দ্রবিন্দুর সেই পরম শূন্যের দিকে, মানে কেন্দ্রমূলে মন নিয়ে সেই শূন্যের দিকে উন্মুখ থেকে নিজের পথে এগুলেই পদে পদে পেয়ে যাই, হাতে হাতে মিলে যায় সব।

শূন্যের দিকে মন দেয়া যায় কি করে শুনি? জনাবের জিজ্ঞাসা।

মনকে শূন্য করেই। শূন্যমনা হয়ে যদি মনোবৃত্তির সাধনায় লাগি, প্রবৃত্তির পথ ধরি, সেই শূন্যচিত্তের থেকেই নিত্য নব অমৃতায়ন। তাঁর সঙ্গে সংযোগই হচ্ছে অমৃত, আর তাঁর হাত ধরে যাওয়াটাই সার্থক যাত্রা।

তা না হয় হোলো, কিন্তু তাঁর এইসব প্রতীকী রূপ?…

তাঁর প্রকৃতির পরিচয় ছাড়া কিছু নয়। তাঁর প্রকৃতিরই প্রতিকৃতি। জীবনের দশ দশার বৃত্তে আমাদের সঙ্গে তিনি নিত্য বিদ্যমান। সেই সব বৃত্তিপথে তাঁর যে চেহারা, তাঁর থেকে যা প্রাপ্তিযোগ, সেই কথাই তো দশমহাবিদ্যার রূপে প্রকাশিত। আসলে মার এই প্রতীক-কৃতিই প্রতাঁকের সাহায্যে বলার ধরনটা আমাদের চলার সাহায্যে তাঁর পথনির্দেশ মাত্র।

কী পথ? কিসের নির্দেশ?

বৃত্তপথ। আমাদের বৃত্তির পথ। তাঁর ঐ প্রতীকী মহাবিদ্যার রূপগুলিকে সেই পথের ম্যাপ বলে ধরতে পারেন। ওগুলি যেমন তাঁর হওয়া তেমনি তাঁর সঙ্গে আমাদেরও হওয়া তো-পরস্পরের সহাবস্থান-কোএকজিসটেস্। কোএকজিস্টেনসিয়ালিজমও বলা যায়। পরস্পরের আবহাওয়ায় পরস্পরের সব হওয়া। পরস্পরের প্রতিক্রিয়ার প্রতীক-কৃতিই মার ওই প্রতিকৃতিগুলিতে বিচিত্র বিদ্যমানতার বিভিন্ন বিকাশে প্রকাশিত।

 তার সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক?

বৃন্তের সঙ্গে ফলের যেমনটা। বৃত্তের সঙ্গে বৃত্তির যেমন কিনা অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। আমরা যেমন বৃত্তে যাব, যা বৃত্তি বেছে নেব, তার ফল কী রকমটি হবার, তাঁর বিদ্যারূপের ঐ প্রতীকী আবৃত্তির দ্বারাই বিশদ করা রয়েছে। সত্যি বলতে, তিনিই তো সব হয়েছেন, সব কিছু করছেন–কিন্তু আমাদের বাদ দিয়ে নয়। আমরাও যা কিছু করছি, তাঁকে বাদ দিয়ে নয়। দেবার উপায় নেই। পরস্পরের মুখাপেক্ষী আমরা। তাঁর হওয়াতেই আমাদের হয়ে যাওয়া, তাঁর হওয়ায় আমাদের বয়ে যাওয়া। তাঁরই বৃত্তপথে আমাদের বৃত্তিরথ চালিয়ে–তাঁর হাত ধরে অবাধে অবলীলায় আমাদের উতরে যাওয়া। সেই উত্তরণ যেমন তাঁর তেমনি আমাদেরও।

আপনার বা আপনার মার–যাই হোক না, আপনাদের মোদ্দা কথাটা মোটামুটি বুঝলাম। কিন্তু সেকথা নয়, কাগজের হকারির থেকে কি করে সম্পাদকারিতে উতরে এলেন, আপনার কাগজই বা ওরালো কেমন–সেই কথাটা কম।

আমি আর ওতরালাম কোথায়! আমি জীবনের কোনো পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পারিনি, পাশ না করে সব কটারই পাশ কাটিয়েছি। তবে হ্যাঁ, কাগজটা উতরেছিল বেশ। সেটা আমার কোনো বাহাদুরি নয়, তার নাম-মাহাত্ম-ঐ যুগান্তর নামটাই।

নামটা মাথায় এল কী করে শুধোচ্ছেন? হঠাতের মাথায়। কাগজ ফিরি করতে করতেই মাথার পোকারা নড়ল একদিন–আমার মনে হলো, এই চিনির বলদ হয়ে কী লাভ? চিনির আসল সোয়াদ তো পাচ্ছিনে। পরের ভূতের বোঝা না বয়ে নিজেই যদি কাগজ একখানা বার করি তো কেমন হয়? চিনির মোট বওয়ার চেয়ে চিনি পয়দা করার ফয়দা আরো বেশি হবে নিশ্চয়? আর তার মোট নিজে না হেঁকে ফিরে অন্য ফিরিওলা হকারদের দিয়ে বেচলে মোটামুটি দু-পয়সা উপায় হতে পারে হয়ত।

কাবুলির সেই একশো পঁয়ত্রিশ টাকার পুঁজি সম্বল করে একশো চৌত্রিশ নম্বর থেকে যুগান্তর বেরুল–আমার ঘরের বিছানাটাই তার কার্যালয়। পরে এই কাগজকে দেশবন্ধুর থেকে বিধান রায় পর্যন্ত অনেকেই অর্থ সাহায্য করেছেন, তবে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছি ঐ নামটার কাছেই।

হ্যাঁ, তারই কুদরতে প্রথম সংখ্যার পাঁচ হাজার কপি বাজারে পড়তে না পড়তেই উড়ে গেছল। যুগান্তর-নামখানাই অর্ধেক কাজ এগিয়ে রেখেছিল, আর সময়টা ছিল তো অগ্নিগর্ভ। বেরুতে না বেরুতেই আমি বিখ্যাত হয়েছিলাম। রাতারাতি।

কাগজের কাজে কৈশোর কালের বন্ধু গিরিজাকে আমার সহযোগী পেয়েছিলাম। জিলা স্কুলের থেকে চাঁচলের ইস্কুলে পড়তে আসার সময় থেকেই ওর সঙ্গে ভাব আমার। এন্ট্রেন্স দিয়ে আমাদের মেসেই এসে উঠেছিল সে, কলেজে ভর্তি হবার আগেটায়। এখন একখানা কাগজ বেরুতে দেখে আপনার থেকেই সে এগিয়ে এল। আর সে-ই নিয়ে এল বীরেন্দ্রকুমার সেনকে যুগান্তরের যুগ্ম-সম্পাদক করে। নামমাত্র সম্পাদক। গিরিজা আমাকে বুঝিয়েছিল যে, বীরেনদা লিখিয়ে বলে বেশ নাম আছে বাজারে, আর খাতির আছে লেখক মহলে; সম্পাদকের স্থলে তাঁর নামটা আমার সঙ্গে থাকলে কাগজের মর্যাদা হবে। তাই হোলো। গিরিজা হোলো কাগজের প্রিন্টার পাবলিশার। চুটকি লেখারাই আমার সব রচনার চেয়ে (পাঠকের চোখে অন্তত ) চটকদার হয়ে বৈতরণী-উত্তরণের আগে পর্যন্ত তরিয়ে দেবে আমায়। ওই চড়াই পাখির পাখায় ভর দিয়েই জীবনের যত চড়াই উত্নাই সব উতরে যাব অবহেলায়, তা আমি ধারণাও করতে পারিনি।

কী থাকত কাগজে? যা যা দস্তুর। প্রথম পাতাতেই একটা কবিতা–একটু গরম গরম। তারপরে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় ও সম্পাদকের মন্তব্য, তারপর গল্প-টল্প এক আধটু, অনেকটা রূপকগর্ভ কথিকা জাতীয়, বিজলীতে উপেনদার উনপঞ্চাশীর মত একটু পলিটিক্যাল রসরচনা (উপেনদার লেখা সেকালে আমায় প্রভাবিত করেছে গোড়াতেই বলেছি) আর টুকরো খবরের ওপর টিপ্পনির চুটকি-কলম দুয়েক। এখনকার অল্পবিস্তরের প্রথম ক্রুশ সেটাই। যখন ধ্ৰুণাক্ষরে ঐগুলি লিখেছিলাম তখন কি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছি, যে, শেষ পর্যন্ত ঐ চুটকি লেখারাই আমার সব রচনার চেয়ে (পাঠকের চোখে অন্তত), চটকদার হয়ে বৈতরণী-উত্তরণের আগে পর্যন্ত তরিয়ে দেবে আমায়। ওই চড়াই পাখির পাখায় ভর দিয়েই জীবনের যত চড়াই উৎরাই সব উৎরে যাব অবহেলায়!

কে লিখতেন আমাদের যুগান্তরে? যুগান্তকারী কোনো লেখক নয়। কে যাবে তাঁদের কাছে? গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে ভাব জমানোর স্বভাব ছিল না আদৌ, একটু মুখচোরা, সেইহেতুই অমিশুক ছিলাম বোধহয়। তখন লেখার জন্য কোনো স্বনামধন্য লেখককেও টাকা দিতে হত না, একটু সাধাসাধি করলেই হত–কিন্তু সাধ্যসাধনার ধাত ছিল না যে। প্রমথ চৌধুরি সাপ্তাহিক বিজলীতে নিয়মিত বীরবলের চিঠি লিখতেন, তাঁর কাছে গিয়ে চাইলেই হত। লেখক হিসেবে তত দিনে আমি তাঁর কাছেও পরিচিত হয়েছিলাম মনে হয়। একবার বিজলীতে, তাঁর পৃষ্ঠায়, যুগান্তরের আমার চুটকিগুলির তারিফ করে তিনি লিখেছিলেন। তবু, এমনকি, ধন্যবাদ জানাবার হলেও তাঁর কাছে যাবার আমার সাহস হয়নি, উৎসাহও বোধ করিনি, কেন জানি না।

বড় লেখক বলতে আলাপ হয়েছিল শুধু শরৎ চাটুজ্যের সঙ্গে। আর উপেন বাঁড়ুজ্যে আমাদের উপেনদা তো ছিলেনই। এই দুজনাই কেবল–তখন পর্যন্ত।

শরৎচন্দ্রের কাছে নিয়ে গেছলেন আমায় তারকা। তাঁর লেখা একটা উপন্যাসের প্রকাশক পাবার দরবারে। ভূমিকার মত দু-ছত্র লিখে দিলে প্রকাশক মহলে যদি লেখাটার দর বাড়ে। পড়ে দেখবেন, তারপরে লিখবেন বলে পাণ্ডুলিপিটা তিনি রেখে দিলেন। বিপ্লবীদের প্রতি শরৎচন্দ্রের শুধু স্নেহ নয়, অন্তরের টানও ছিল মনে হয়।

শরৎচন্দ্রের সম্মুখীন হতে আমি ভয় খাইনি, স্বাভাবিক আকর্ষণেই গেছি। শরৎচন্দ্রের লেখা পড়লেই তাঁকে কেমন দরদী আপনজন বলে মনে হয় না? যেমন তার রচনার পাত্রপাত্রীদের সঙ্গে তেমনি যেন তাঁর পাঠকদের সঙ্গেও তিনি একাত্ম হয়ে যেতেন–তাঁর ঐকান্তিকতা সংক্রামকই ছিল। তাঁর লেখার আয়নায় পাত্রপাত্রীদের মনস্বত্বমোচনের প্রত্যক্ষ প্রতিফলনে তাঁর নিজের মনটিও ধরে দিতেন যেন, সেই লেখার সংস্পর্শে এলে, তাঁর মনের স্পর্শ পেলে পাঠকপাঠিকারা তাঁর আপনার হয়ে যেত নিজের অগোচরেই কেমন করে যেন। তাঁকে নিজের একান্ত বলেই মনে করত তখন। সহজভাবে তাঁর সঙ্গে মেশার কোনো বাধা থাকত না আর।

আর তিনিও মিশতে পারতেন সহজভাবেই। সাহিত্যিক-সুলভ কোনো ব্যবধান না রেখেই। বড় কঠিন সাধনা যার বড় সহজ সুর। খুব কঠিন জীবনসাধনার জন্যই শরৎচন্দ্র তাঁর জীবনে অত সহজ হতে পেরেছিলেন আমার মনে হয়। কেবল অভ্রভেদী লেখক বলেই নয়, সাধারণ স্তরের মানুষদের সঙ্গে অত সাধারণের মতই মিশতে পারতেন বলেই তিনি অসাধারণ।

আর, তেমনি আশ্চর্য মানুষ ছিলেন উপেনদা। কলমের আঁচড়ে যেমনটি, ব্যবহারে আচরণেও ঠিক তেমনিই–যত সহজ ততই যেন গভীর। তাঁর লেখার মতই তিনিও অবিকল মিলিয়ে দেখা যেত। বিজলীর পাতায় তাঁর উনপঞ্চাশীর যে হাওয়া তিনি বইয়ে দিয়েছেন, সেই আবহাওয়াতেই সত্যি বলতে শুধু আমি কেন, অনেকেই তখন বয়ে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের ব্যঙ্গ রচনায় হালকা চালে গভীর কথা বলার যে ধারাটি তিনি সূত্রপাত করেছিলেন, সেখানে শুধু তিনি অগ্রগণ্যই নন, অনন্য আজও।

গিরিজা কিন্তু এর মধ্যেই অনেকের সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল বেশ। দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র, বিন রায়, শরৎ বোস–এহেন উচ্চস্তরের মানুষদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারলেও মাঝামাঝি এলাকায় আমি যেন বেখাপ্লাই ছিলাম-সেখানে আমার কোনো পাত্তা ছিল না। উচ্চলোকের পরেই মিশবার পাত্ররা আমার তুচ্ছলোকে–পাড়ার যত ছোট লোক (তারা তা না হলেও তাই বলে আমরা ভাবি যাদের ) আর ছোট ছোট বালকরা। তাদের সঙ্গই আমার মিষ্টি লাগত–আর তাদের সঙ্গেই মিশ খেতাম সহজে।

মধ্যবর্তী স্তরের স্কলারলি উন্নাসিক পণ্ডিতম্মন্যদের কাছে খাতির ছিল গিরিজার। তাঁদের সঙ্গে উচ্চমার্গের আলোচনা বিতর্কে উৎসাহিত ছিল সে, যেটা আমি সতর্কভাবে সবসময়ই এড়িয়ে চলতাম। হয়ত, তাবচ্চ শোভতে…হিসেব করেই নিজের শোভা বজায় রাখতে চাইতাম ঐভাবে।

কিংবা উত্তম পুরুষ হিসেবে (নিজের ধারণায় নয়, ব্যাকরণ মতে ) শুধু পুরুষোত্তমদের সঙ্গে যা একটু খাপ খেত আমার–মধ্যপদস্থরা মধ্যপদী সমাসের মতই একেবারে লু ছিল আমার কাছে। আর, তাঁদের কাছে আমি যেন ছিলামই না। উচ্চরা আমাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেননি, হয়ত তাঁদের সমুচ্চ মহানুভবতায়, কিন্তু মধ্যবর্তীরা সর্বদাই আমায় এড়িয়ে চলেছেন। কারণ বোধ হয়, উত্তম নির্ভয়ে চলে অধমের সাথে। তিনিই মধ্যম যিনি থাকেন তফাতে। মাঝারিদের বাজারে এই অধমের কোনো কলকে ছিন না।

.

৫৯.

 তখনকার দিনে কাগজ বের করা এমন কিছু শক্ত ছিল না। চাইলেই ডিক্লেয়ারেশন মিলত, হিল্লি-দিল্লি দৌড়-ঝাঁপের মুশকিল ছিল না এখনকার মত। কাগজ ছিল সস্তা, কম পাউন্ডেজের ডবোল ডিমাইয়ের রীম বোধকরি দশ টাকাতেই পাওয়া যেত, ছাপাই খরচাও ছিল প্রায় তেমনই।

 দশ টাকায় ফর্মা। ডবোল ডিমাই আট পাতার কাগজ পাঁচ হাজার ছাপতে পঞ্চাশ ষাট টাকার বেশি পড়ত না। কাগজের দামও প্রায় তাই।

কাগজটা কিনতে হত নগদ। প্রিন্টিং বাবদ যা দেবার কাগজ বেচে দিলেই চলত। যেখানে বিজলী, আত্মশক্তি প্রভৃতি ছাপা হত, বউবাজারে সেই চেরী প্রেসেই আমরা ছাপাতাম।

ছাপাখানাটা ছিল পাইকপাড়ার কুমার অরুণ সিংহের। এমনিই পড়েছিল নাকি, বারীনদারা আন্দামানের থেকে ফিরে এসে কাগজ বার করতে চাইলে অরুণবাবুরা অনিই সেটা তাঁদের ছেড়ে দেন-ব্যবহারের জন্য।

ছাপাখানাটা চালাতেন ঋষিদা-ঋষিকেশ কাঞ্জিলাল-আন্দামান-ফেরত তিনিও। যেমন নামে, তেমনি চেহারায়, তেমনি কিনা আচারে আচরণে প্রায় ঋষিতুল্য, তিনি অনেক সুযোগ সুবিধে দিতেন আমাদের।

আর সুবিধে পেয়েছি শ্ৰীপাতিরামের কাছে। বিখ্যাত পত্রিকাদের সুবিখ্যাত এজেন্ট-বেচবার আগেই সাতষট্টি পারসেন্ট দাম দিয়ে দিত নগদ আর কাগজও বেচে দিত অবলীলায়। শিবরামের কাগজ পাতিরাম কাটাতেন। পোকারা কাটবার ফুরসত পেত না।

এক আনা করে দাম ছিল একখানার। শতকরা তেত্রিশের কমিশন বাদেও প্রায় দুশ টাকার মতন উপায় হত হপ্তায়। তার একশ টাকাই নেট লাভ।

কী করতেন টাকাটায়? জনাব সাহেবের জিজ্ঞাসা।

পরের হপ্তায় ছাপা কাগজের দামটাম মজুদ রাখতাম।…

আর বাকী টাকার কী গতি করতেন? কী হতো?

আমার গর্ভে যেত। খেয়েদেয়ে ফুঁকে দিতাম সব। গিরিজা কিছু নিত বোধ হয়। আর কাউকে বিশেষ কিছু দিতে হত না।

রাজেন মল্লিকের লঙ্গরখানা ছেড়ে দিয়েছিলেন নাকি?

বাসাতেই খানা পাকত যে তখন। তদ্দিনে মোস আমাদের জমজমাট। তারকা তাঁর চেনাজানাদের নিয়ে এসে বাসাটা চালু করে দিয়েছিলেন–তিনি নিজেও মাঝে মাঝে এসে থাকলে তো। যদ্দিন ইচ্ছে খুশি মতন। সেকালে বাসা-খরচাও বিশেষ কিছু পড়ত না। সস্তার বাজার ছিল তো তখন।

তেমন নামকরা কেউ ছিল আপনাদের বাসায়?

তখন বিনামা, পরে তাঁদের কেউ কেউ বেশ নাম করেছেন বইকি। তখনই খুব নামকরা দুজনা ছিলেন অবশ্যি

একজন বিখ্যাত ধ্রুপদ-গাইয়ে ভূতনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (এখন স্বত), অপরজন নামজাদা খেলোয়াড় সূর্য চক্রবর্তী-ইস্টবেঙ্গলে খেললে সেকালে–তাঁরা দুজন আমার দুপাশের ঘরে থাকতেন আর থাকতেন সতীশন্দ্র সরকার, বগুড়ার কংগ্রেসী নেতা, কর্পোরেশন না কোথায় কাজ করতেন যেন। আর ছিলেন প্রসিদ্ধ গবেষক প্রাবন্ধিক বাংলার বাউলের লেখক উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য-তখন তিনি বিদ্যাসাগরের ছাত্র। আর থাকতেন স্বৰ্গত তারানাথ রায়। প্রাক্তন বিপ্লবী। পরে ইনি নবশক্তি পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। তার পরে আমৃত্যু জড়িত ছিলেন দৈনিক বসুমতীর সঙ্গে। উপন্যাস ইত্যাদি লিখেছেন।

বীরেন্দ্রকুমার সেন থাকতেন, আগেই বলেছি। তার মা বিরজাসুন্দরী দেবীও মাঝে মাঝে এসে থেকেছেন ছেলের কাছে–সেই সূত্রে নজরুলেরও যাতাযাত ছিল। বীরেনদার বোনের সঙ্গেই পরে নজরুলের বিয়ে হয়েছিল। সে তো এখন ইতিহাস–সবার জানার কথা। ছান্দসিক প্রবোধ সেনও একবার এসেছিলেন মনে হয়, দুএকদিন থেকেছিলেন আমাদের বাসায়। রবীন্দ্রনাথের ছন্দের উপরে প্রবন্ধ লিখে তখনই উনি বেশ নাম করেছেন। গিরিজা ছিল তাঁর বন্ধু, তার আমন্ত্রণেই তিনি এসেছিলেন। দুজনের ভেতর লম্বা লম্বা চিঠিপত্রের আদান-প্রদান চলত। সেগুলি চিঠি কি গল্প কি বিতর্কমূলক গবেষণা আমি জানি না। প্রবোধবাবু যুগান্তরে লিখেছিলেন কিনা মনে পড়ে না। তখনই তাঁর লেখার বেশ কদর হয়েছিল, প্রবাসীতে লিখে টাকা পেতেন তখনই। তাই আমাদের কাগজে বেগার লিখতে যাবেন বলে মনে হয় না।

নজরুলের ধূমকেতু কি তখনকার কাগজ না? কেমন চলত ধূমকেতু?

দারুণ। বিশ পঁচিশ হাজার কপি বিকিয়ে যেত বাজারে পড়তে না পড়তেই। সময়ের মতন কাগজটাও ছিল গরম। সে সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ঐ ধূমকেতু-সবার চেয়ে বেশি চাহিদা ছিল তার। তাছাড়া, বারীনদা নলিনীদাদের বিজলী, উপেনদার আত্মশক্তি, আর শঙ্খ বলেও একটা যেন কাগজ বেরুত তখন, কাদের জানি না। সমসাময়িক সাপ্তাহিক সব। সাপ্তাহিক পত্রের যেন জোয়ার এসেছিল সে-সময়টায়।

সেই জোয়ারেই আপনারা গা ভাসিয়েছিলেন সবাই?

আমার বেলায় অনেকটা তাই, আপনি বলতে পারেন। নজরুলের বেলা তা নয়, ওর একটা মিশন ছিল না? বিপ্লবার্তা ঘোষণার? সে যেমন কবি তেমনি এক যুগন্ধর নেতাও যে আবার। আর, বিজলী ছিল এক অভিজাত পত্রিকা। বীরবল, পন্ডিচেরির নলিনী গুপ্ত, সুরেশ চক্রবর্তী প্রমুখ জাতলিখিয়েরা লিখতেন তাতে। নলিনীদার দারশ খাতির ছিল সাহিত্য সমাজে–এমন চমৎকার হাসির গান গাইতেন তিনি, আবার বানাতেও পারতেন তিনি। দাঠাকুরের (শরৎ পন্ডিতমশাই কলকাতার ভুলে ভরা গানখানা তাঁর গলার থেকে তো চালু হয়ে যায়। রবীন্দ্রজয়ভীর কালে অমল হোমকে নিয়ে তার রচিত গানটাও বাজার মাত করেছিল। চমৎকার গানখানা, কিন্তু তার এক লাইনও আমার মনে নেই-যা আমার বিস্মৃতিশক্তি না।

ধূমকেতুর সঙ্গে আপনার যুগান্তরের তফাতটা ছিল কোথায়?

নজরুলের লেখায় খোলাখুলি রাজদ্রোহের কথা থাকত। বিপ্লবের প্রেরণায় ভরা। তবে কবি তো সে, উপমা-ইঙ্গিতের আড়ালে তার বক্তব্যটা প্রকাশ পেত স্বভাবতই। আইনের প্যাঁচে তার নাগাল পাওয়া সহজ ছিল না। যেমন ধরুন না–ধূমকেতুতে বেরুনো দুঃশাসনের রক্ত চাই বলে বিখ্যাত কবিতাটা। বন্দুরে বন্য হিংস্র বীরদুঃশাসনের চাই রুধির/চাই রুধির রক্ত চাইঘোষো দিকে দিকে এই কথাইদুঃশাসনের রক্ত চাই/দুঃশাসনের রক্ত চাই/ওরে, এ যে সেই দুঃশাসন/দিলো শত বীরে নির্বাসন/কচি শিশু বেঁধে বেত্রাঘাত/করেছে রে এই ক্রুর স্যাঙা/মা বোনেদের হরেছে লাজদিনের আলোকে এই পিশাচ/বুক ফেটে চোখে জল আসে/তারে ক্ষমা করা ভীরুতা সেহিংসাশী মোরা মাংসাশী/ভন্ডামি ভালো বাসাবাসি। এমনি পড়লে মনে হবে যে মহাভারতের উল্লেখ-কাহিনী, কিন্তু আসল অর্থটা কী, পাঠকের তা বোঝার কিছু বাকী থাকবে না। বাংলার উদ্ধত যৌবন তখন কাজীর কবিতায় উন্মত্ত হয়েছিল। কিন্তু এহেন অর্থের দ্বিত্ব থাকা সত্ত্বেও সরকারের দ্বিধা বেশিদিন থাকেনি। আইনের পাকে অচিরেই পড়তে হয়েছিল নজরুলকে। জেল হয়েছিল দুবছরের জন্য। কারাবরণের আগে আদালতে তার আত্মসমর্থনে যে কবুলতি সে দেয়, সেই রাজবন্দীর জবানবন্দী অবিস্মরণীয় এক দলিল।

আপনার যুগান্তরের প্রেরণাটা কী ছিল?

রাজদ্রোহ নয় ঠিক। সমাজদ্রোহ বলা হয়ত যায়। আমাদের কালের সমাজ-ব্যবস্থায় যে সব অবিচার অনাচার অত্যাচার মনে প্রচন্ড নাড়া দিত, তার বিরুদ্ধেই আমি কলম ধরেছিলাম। ইংরাজের শাসন আমায় তেমন পীড়িত করেনি, যাকে বলে Social injustice সেই সব–যেমন অবাহ্মণদের ওপরে বামুনদের অত্যাচার, প্রজাদের ওপরে জমিদারের শোষণপেষণ–এই সবেই আমি বেশি অভিভূত হয়েছিলাম। সমাজবাদের ধুমধাড়াক্কা তখনো তেমনটা পড়েনি, সোভিয়েট মুল্লুকে সমাজতন্ত্র পত্তনের নামগন্ধ বাতাসে ভাসছিল, ঘুনাক্ষরের বার্তায় আসছিল–শুধু তারই সুদূর হাতছানি কাউকে কাউকে যেন কেমন উন্মনা করছে সে সময়। যার আবহে মনে হয়, প্রেমেন লিখেছিল, আমি কবি যত কামারের/কুমোরের/যত ছুতোরের আর ইতরের/ইতাদি (মিস-কোটেশন হয়ে গেল হয়ত বা! যে মেমারি!) প্রত্যাসন্ন যুগের সেই সম্ভাবনার আবছায়াতেই আমার সে সময়ের লেখা যত না। পরে সেই সব ভাব-ভাবনাই ফলাও করে প্রবন্ধাকারে আমি ফলিয়েছি তারানাথ রায় সম্পাদিত নবশক্তির পাতায়–যা পরে আমার মস্কো বনাম পন্ডিচেরি আর ফানুসফাটাই–এই দুই নিবন্ধ বইয়ে প্রকাশ পেয়েছে। কাজীকেও এই পথে আসতে হয়েছিল শেষপর্যন্ত–তার সাম্যের গান কবিতায় যার পরাকাষ্ঠা দেখা যায়। তবে কাজী ছিল আসলে জন্মবিদ্রোহী-তার সেই সর্বপ্রথম কবিতার মতই কায়মনোবাক্যে সর্বদাই বিদ্রোহী সে। এমন কি তার ফাউন্টেন পেনের কালিও ছিল লাল। রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা/ তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা/তার কোন কবিতার কোথায় যেন আছে না?

তা যুগান্তর পত্রিকাটির থেকে বেশ উপায় হয়েছিল আপনার? তাই না?

তা হয়েছিল। কাগজ বিক্রির ফলে তলার থেকেও যেমন কুড়িয়েছি, মেনি ওপর থেকে পাড়বারও কোনো কসুর ছিল না আমার। দেশবন্ধু, বিধানচন্দ্র, শরৎবোস, লিবারেল পার্টির নায়ক যতীন্দ্রনাথ বসু–সবাই লিব্যারলি সাহায্য করেছেন আমায়। এমন কি, কাগজখানা, উঠে যাবার অনেকদিন বাদেও বেশ দুপয়সা দিয়ে গেছে আমাকে।

কেমনতর?

কাগজখানার নাম বেচেই মোটা টাকা উপায় করেছি একবার। তুষারকান্তি ঘোষ, অমৃতবাজার বাদেও তাঁদের সংসার থেকে একখানা বাংলা দৈনিক বার করার ইচ্ছে করেছিলেন- আমি বিবৃত করিঃ

সেই সূত্রেই আমার এই সংস্থানটা হোলো। তিনি পত্রিকাটার যুতসই একটা নাম খুঁজছিলেন। যুগান্তর নামটা সেদিক থেকে বেশ মজবুতসই মনে হোলো তাঁর। কিন্তু বাধা এল আদালতের। আগেকার প্রিন্টার পাবলিশার ছাড়ান না দিলে নয়া ডিক্লেয়ারেশন পাবার উপায় ছিল না। আর, কাগজটার শেষ প্রিন্টার, পাবলিশার, এমন কি সম্পাদকও আমিই ছিলাম একমাত্র। আমার বন্ধু ভবানী মুখোপাধ্যায়ের কাছে খবর পেয়ে, (পরে জেনেছি) তুষারবাবুর দূত আমার বাসায় আবির্ভূত হলেন একদিননগদ পাঁচশো টাকা হাতে নিয়ে। আমার ঐ নামমাত্র বিনিময়ের বাবদেই ঐ টাকাটা আগাম। পরে যেদিন আদালতে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে যুগান্তরের নামগন্ধ ছাড়লাম (তার পরে দিগ্বিদিকে ছড়ালামও বলা যায় দৈনন্দিন! পরমৈপদী ভাবেই যদিও) সেদিনও আরো পাঁচশ এসে গেল নগদ!

বলেন কী?

এই সূত্রে তুষারবাবুর দর্শনও পেয়েছিলাম সেই কালে। তিনিও একদিন এসেছিলেন আমার বাসায় সেই উপলক্ষেই। আমি তখন বিছানায় বসে–না, প্রাতরাশ নয়, মধ্যাহ্নের আশ মেটাচ্ছি। চামচেয় করে রাবড়িচূর্ণ খাচ্ছি তখন। চার চামচ নেসপ্রে-র গুঁড়ো দুধের সঙ্গে এক চামচ চিনি মিশিয়ে যা একখান হয় না। ভীম নাগের সন্দেশকেও ছড়িয়ে যায়। জিভের থেকে টা পর্যন্ত–সেই মিষ্টির অণুপরমাণু ওতপ্রোত হয়ে ছড়িয়ে থাকে–সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। বানিয়ে একদিন খেয়ে দেখবেন না?

তুষারবাবু পা দিলেন আপনার আস্তানায়?

আস্তাকুড়ও বলা যায়। দেখেছেন তো সেই ঘরজোড়া জঞ্জাল? সেই আস্তাকুড়ে আস্ত এই কুড়ের সামনাসামনি বসলেন আমার বিছানায়। বিছানা ছাড়া বসার কোনো জায়গা তো নেই ঘরে, দেখেননি কি? বসেই তাঁর জিজ্ঞাসা–কী খাচ্ছেন? আজ্ঞে রাবড়িচূর্ণ। গুঁড়ো দুধ চিনি একাধারে মিশিয়ে-খাবেন একটু? তিনি মাথা নাড়লেন। রাজী হলেন না চাখতে। প্রায় হিমালয়তুল্য ব্যক্তিত্ব বলেই হয়ত তাঁর তুষার গলাতে পারিনি। তুষারবাবুর গলা দিয়ে তলাতে পারিনি ঐ জিনিস। খাননি তিনি।

কী বলে তাঁকে ওই অখাদ্য অফার করলেন বলুন তো? আমিও তাই ভাবি এখন। ভেবে অবাক হই। অবশ্যি, ইতুদের কাছে রাবড়িচূর্ণের যে ব্যাখ্যা দিয়েছি, তার কাছে সে ব্যাখ্যান দিতে সাহসী হইনি।–বুঝলি না ইতু? সের পাঁচেক রাবড়ি কিনে আনি, পাঁচখানা থালায় ছড়িয়ে বরাদে শুকোতে দিই–ঠিক আমসত্ত্বর মতই। তারপর সেই রাবড়ি শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেলে হামানদিস্তায় তাই গুঁড়ো করে না, বোতলে ভরে রেখেছি। ইচ্ছে হলেই খাই, খাওয়াই। তারা অবিশ্বাস ভরে শুনলেও খেয়ে কিন্তু হতবাক! সত্যি শিব্রামদা, রাবড়ির মতই টেস্ট তো বটে! এমন কি তার চেয়েও খাসা। আমার ভাগনে-ভাগনি, পাড়ার ছেলেমেয়েদের যেই না খেয়েছে তারই দৃঢ় প্রত্যয়, ওই পদ্ধতিতে প্রস্তুত ওটা আসল রাবড়িচূর্ণই।

কিন্তু ঐ রাবড়িচূর্ণ তুষারবাবুকে…তাঁকে ছেলেমানুষের মতই বিবেচনা করে. আপনার স্পর্ধা তো কম নয় মশাই!

কী জানি, ওঁকে দেখে কেমন যেন আমার ছেলেমানুষ বলেই বোধ হয়েছিল–শিশুর মত সহজ সরল মনে হয় না তাঁকে?, শিশুসুলভ একটা আমেজ যেন তাঁর মেজাজের সঙ্গে মাখানো। প্রথম দর্শনের সেই ধারণা তার পরেও তেমনটা টলেনি আমার। সুধীরবাবু বেঁচে থাকতে মৌচাকের আসরে মাঝে মাঝেই তিনি আসতেন তো, অচিন্ত্য, ভবানী, প্রবোধ, প্রেমেন, অনেকেই যেত যেমন, আর তাঁর মুখে কত গল্পও সেখানে বসে শোনা। এমন রসিয়ে গল্প করতে পারেন উনি। তাঁর তুল্য মজলিসী আরেকজনকেই সেই আড্ডায় দেখেছি, প্রবাসীর সম্পাদক কেদার চাটুজ্যেকে। তুষারবাবুর সেই সব বিচিত্র কাহিনীই পরে আরও বিচিত্র কাহিনী হয়ে বই আকারে বেরিয়েছে এখন। আসলে তুষারবাবুর সে-সব বই কিশোরপাঠ্যই। তাছাড়া, তাছাড়া

তাছাড়া?

তাছাড়া, সেই প্রথম দর্শনের দিনই আমাকে জানিয়েছিলেন যে, আমার ছেলেদের লেখার তিনি নিয়মিত পাঠক। আমার ওই সব লেখাই ভালো লাগে তার। আমার অনেক ছোটদের বই তিনি কিনেছেনও নাকি। এমন কি, মৌচাকের পৃষ্টায় আমার সব প্রথমের-ঘোভার বেগুনি খাওয়ার গল্পটাও–তিনি হুবহু শুনিয়ে দিলেন আমাকে। আরো জানালেন যে তিনি ওই ছোটদের বই পড়তেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। স্বাভাবিক কৈশোরের একটা সৌরভ তাঁর দেহমনে যেন উচ্ছ্বসিত, তাই তাঁকে বালক জ্ঞান করে দ্রুপ আচরণ করা স্বভাবতই সহজ হয়েছিল আমার পক্ষে। তাহলেও, আপনি যা বললেন না, এখন সেটা ভাবতে গেলে বিস্ময় লাগে বইকি। মাহাত্ম শিশিরকুমারের বংশধর, তুষারবাবুর নিজের মহাত্মও কিছু কম নয়, তাঁকে ওই রাবড়িচূর্ণের আতিথ্যে আপ্যায়িত করতে যাওয়া স্পর্ধার চূড়ান্তই বটে। কিন্তু আমার স্বভাবসিদ্ধ যে হঠকারিতায় অগ্নিযুগের যুগান্তরকে আমার ভগ্নিযুগে আমদানি করেছিলাম, ওটাও সেই যুগান্তকারী হঠকারিতারই আর এক নিদর্শন। হঠতর যত কারুকার্য আমার জীবনে প্রতি পদেই–প্রতি পদেই।

.

৬০.

 আমার বিষয়কর্মের খবরটা বিস্তারিত হবার পরে সুরেশদার সঙ্গে দেখা একদিন দৈবাৎ। দর্শনমাত্রই তিনি বলেছেন-তুই আমাদের কেন বললি না? আমাদের কাছে এলি না কেন তুই? আমরা তোকে দুহাজার টাকা দিতাম ঐ যুগান্তরের জন্যে।

আমি জানব কি করে যে, আপনারাও চান। শুনে তো আমি অবাক; ঘুণাক্ষরেও কেউ জানায়নি আমায়। কিন্তু আপনাদের তো আনন্দবাজারই রয়েছে, এমন একখানা কাগজের ওপর আরেকখানা দৈনিক বার করতেন নাকি আপনারা?

না। তা করতুম না। নামটা চেপে রাখতুম কেবল। ওই নামের কাগজ অন্য কাউকেও বার করতে দিতুম না।

তাতে কার কী লাভ হতো যে, তার রহস্য আমার অবিদিত থেকে যায়। অবশ্যি, আমার লাভটা ছিল সেন্ট পারসেন্ট-উপরি আরো হাজার টাকার উপায় হত। কিন্তু সেই ক্ষতির হেতু কোনো ক্ষোভ ছিল না আমার-নগদ যা পেয়েছি সেই আমার ঢের-যে-দাওটা মারতে পারতাম, কিন্তু পারিনি, ফসকে গেছে, তার প্রতি কোনো লোভ ছিল না আমার।

বরং আমার মনে হয়েছে অপরের পরিচালনায় চালু হলেও ঐতিহাসিক ওই নামটা তো বেঁচে রইল, সেইটেই যেন বড় কথা। এই সূত্রে অনেক সাংবাদিক আর অসাংবাদিক কর্মী করে খাবেন (কিংবা আমার বন্ধু স্বৰ্গত জ্যোতির্ময় রায়ের ভাষায় না খেয়ে করবেন-যাই হোক না!) তখনকার সাংবাদিকদের জীবন এখনকার মত এমন স্বচ্ছল ছিল না, ছিল সংগ্রামী : বিদেশী শাসকদের সঙ্গে অনবরত সংঘর্ষের, অনিবার্য রাজদন্ডের, ত্যাগব্রতী জীবনাদর্শের : স্বাধীনতার জন্যে যোদ্ধৃবাহিনীর প্রথম সারিতে তারা।

অগ্নিযুগের যুগান্তর অনেক ফাড়াকাটিয়ে লগ্নিযুগে এসে খাড়া হল শেষটায়–রূপান্তর লাভ করে আলাদা চেহারায়। ভেসটে ইন্টারেস্টের চক্রে পড়ে একটা ইনভেস্টমেন্ট হয়ে দাঁড়াল। এই দাস ক্যাপিটালের যুগে ক্যাপিটালের দাস না হয়ে কোন আদর্শই নিছক নিজের জোরে কখনো টেকসই হতে পারে না। সেবা ও শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, ধর্ম ও সংস্কৃতির সংস্থা সব, এমন কি নামজাদা সঘ আর আশ্রমগুলিও যত না! কায়েমী স্বার্থের সঙ্গে জড়িত হয়েই কায়েম হয় শেষ পর্যন্ত। এষাস্য পরমাগতি-অর্থের আগতিটাই পরম। অর্থ না থাকলে কোন কিছুরই যেন কোন অর্থ হয় না।

যুগান্তর তো গেল, কী করবি এবার? শুধালেন সুরেশদা।

এখানে বলা দরকার, আমার যুগান্তরে একটা লেখার জন্য রাজদ্রোহের দায়ে জেল খেটে বেরিয়ে আসার পর, ঠিক পরম্পরায় না হলেও মাঝে মাঝে আমার কাগজখানা বেরুতই। হাতে কিছু পুঁজি এলে এবং নিজের কিছু লেখা পুঞ্জীভূত হলে তার দায় থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে কাগজটা বার করে বসতাম–হুঁজুগের মুখেই অনেকটা। যুগান্তর তখন প্রায় হুজুগান্তর উঠেছিল।

যা হয় করা যাবে। আমি জানাই।–কিছু না করলে কী হয় সুরেশদা?

সত্যি, কিছু যে করতেই হবে তার কী মানে আছে? কোনো কিছু না করেও অনেক কিছু হয়ে যায় আমি দেখেছি। আমার জন্যে পরের যতই দুশ্চিন্তা থাক না, আমার নিজের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কোনোদিনই নয়। অনিশ্চয়তার মধ্যেই চিরদিনের নিশ্চিত আশ্রয় ছিল যেন আমার।

তুই আমাদের আনন্দবাজারে চলে আয় না? আমরা একটা সাপ্তাহিকও বার করব ভেবেছি। তোর তো কলমের জোর আছে বেশ। সুরেশদা বলেন।

অনুবাদের হাতও মন্দ নয়। প্রফুল্লদা সায় দেন তাঁর কথায় : সংবাদ-অনুবাদও কানন যায় ওঁকে দিয়ে।…

যুগান্তকর বাণিজ্যের কালে তুষারবাবুর কাছ থেকেও অনুরূপ আহ্বান এসেছিল। দৈনিক পত্রটার সম্পাদকরূপে আমরা বিবেকানন্দবাবুকে ঠিক করেছি। আনন্দবাজার ছেড়ে দিয়ে তিনি আসছেন। আপনিও আসুন না কেন তার সহকারী হয়ে?… বলেছিলেন তিনি।

কিন্তু দুজায়গাতেই আমি ঘাড় নেড়েছিলাম। স্থায়িত্বের পথে দায়িত্বের পথে এগুবার কোথায় যেন বাধা ছিল আমার। অন্তরগত অনীহায় কোনো ভার বহনের ধার ঘেঁষে যেতে চাইনি কোনোদিনই।

আহা, যদি যেনে, কতো সুখে থাকতেন না আজ। স্ত্রী-পুত্র পরিবার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর, বাড়ি গাড়ি মোটর সোফা-সেট নিয়ে সুখের সংসারে বিরাজ করতেন কেমন!

সুখের সংসার! আমি সেটা মনে করি না। আসলে সুখ হচ্ছে মনের। বিষপানে নীলকণ্ঠের সুখ। বিষয় বিশষে জর্জরিত হয়ে সংসারীর। বিবিধ আধিব্যাধি পীড়িত হয়ে পরের সহানুভূতি লাভে কেউ সুখী, নিরবচ্ছিন্ন শান্তির নির্ঞ্ঝাট স্ব-ভাবে সুখ কারো। নিজের লাভ খতিয়ে হিসেবী মানুষ সুখ পায়, পরের ক্ষতি করে আনন্দ হয় কারো আবার!

সুখের নানান রকম ফের। কিছু হওয়ার, হয়ে ওঠার মধ্যে যেমন সুখ, অনেক কিছু না হওয়ার, না হতে পাওয়ার ভেতরেও আরাম আছে তেমনি। যেমন বেচে থাকার প্রশস্তি, তেমনি বেঁচে যাওয়ার স্বস্তি। মোটের উপর স্বচ্ছন্দ থাকাটাই আমার মতে সুখের।

কারো দুঃখ-সুখের ভাগী না হয়ে শুধু নিজের সামান্য সুখ-দুঃখ নিয়ে একলা থাকার আপনার এই একেলবেঁড়েমির জন্যে দোষ না দিয়ে পারিনে-তবুও জনাব সাহেবের আপসোস–তা হলেও আমি বলব, সিকিউরিটি-বোধের যে একটা স্বস্তি তা আপনি জীবনে পাননি, জানেননি কখনো। মাসকাবারে নির্দিষ্ট একটা তারিখে বাঁধা মাইনেটা পাবার যা আরাম…।

হ্যাঁ, তাও পেয়েছি। তাও জানি। তবে কমাসের বেশি সে-সোয়াস্তি এ-বরাতে জোটেনি। উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তরীণ যাবার কালে তাঁর সাপ্তাহিক আত্মশক্তির দায় সুভাষচন্দ্রের ঘাড়ে চাপিয়ে যান। সুভাষ তখন কর্পোরেশনের চীফ একজিকিউটিভ অফিসার। (আমার ক্রনিক বিস্মৃতিশক্তির জন্য ঘটনার পারম্পর্যে আমার কাহিনী হয়ত ক্রনলজিক্যালি সঠিক হচ্ছে না, যখন যেটা মনে পড়ছে লিখছি, যেভাবে আসছে প্রকাশ পাচ্ছে…তা হলেও যদূর আমার মনে পড়ে, তিনিই তখন এই পৌর সংস্থার কর্ণধার ) দেশবন্ধুর কথায় সুভাষন্দ্র আমাকেই আত্মশক্তির সম্পাদক নিয়োগ করেন–মাসিক একশ টাকায়।

নির্ঝঞ্ঝাট নির্ভাবনায় সে কমাস কেটেছিল আমার সত্যি। বরাদ্দ মাইনের বাঁধা চাকরি আমার জীবনে সেই প্রথম আর সেই শেষ।

চন্দননগর গোঁদলপাড়ার প্রাক্তন বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অফিসের দেখা-শোনা করতেন–কর্মকর্তার যা কিছু করণীয় তা তাঁর। প্রুফ দেখা থেকে কাগজ ছাপিয়ে বার করার তাবৎ দায় তাঁর ওপর।

সেদিকে আমার দেখার কিছু ছিল না, আমার দায়িত্ব ছিল লেখার। ডবল ক্রাউন সাইজের আট পাতা (কি ষোল পাতার, ঠিক স্মরণে নেই আমার ) প্রায় সবটাই লিখে ভরতে হতো আমাকেই। বাইরের থেকে যা দু-চারটে লেখা আসত, দেখেশুনে দেওয়া হত, কিন্তু বাকিটা সবই, স্বনামে, বেনামে, ছক্ষনামে বিবিধ ফীচারে লিখে ভরাট করতাম আমি।

এখনকার কালে যেমন, সর্বোপরি একজন সম্পাদকের তাঁবে থাকলেও পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগ স্বতন্ত্র লেখকের তদারকে তখনকার দিনে ঠিক এমনটি ছিল না। সব পত্রিকার বেলায় অন্তত নয়।

কোনো কোনো সাপ্তাহিকের পিছনে একটা লেখকগোষ্ঠী থাকলেও, যেমন বিজলীর ছিল, আমার সম্পাদিত কাগজ সর্বদাই তার ব্যতিক্রম। লেখকদের কাছে যাতায়াত, নড়াচড়ার নিরুৎসাহ আমার চিরদিন, তাই আমার কাগজে বাধ্য হয়ে আমিই সর্বময়–আমারই একচ্ছত্র বিধাতার ন্যায় সর্বভূতে বিরাজ করতে গিয়ে সব ভূতের বোঝা-একা আমাকেই বইতে হয়েছে–সব লেখকের লেখার দায় নিজের কাছ থেকেই আদায় করতাম।

এখন, স্বভাবত আমার মজ্জাগত হলেও লেখারা আমার একটু যেন লজ্জাবতী লতার মতই-স্পর্শকাতরতায় সঙ্কুচিত। অপরের সামনে বেরুতে চায় না কিছুতেই। কেউ আমার কাছে থাকলে লেখা হয় না, ত্রিসীমানার আনাচে-কানাচে ঘুরলে-ফিরলে দেখা দেয় না লেখারা। গোলমালের মধ্যে তো নয়ই।

এদিকে চেরি প্রেসের ওপর তলায় বসে তলার আওয়াজে কলমের কাজে মন দেওয়া মুশকিল। মনের অনুবর্তী না হলে কাগজ ভর্তির মালমসলা পাব কোথাথেকে?

নিজের ঘরটিতে বিছানার আরামে শুয়ে বসে গড়িয়ে শিব্রামের যততা লেখা। লেখবার মত মন কোনদিনই আমার হয় না–কোনদিনই নেই তা–যদি না তা মনের মত লেখা হয়। কিন্তু আমার এই অক্ষমতার কথা কি কেউ বুঝবে? বিশেষ করে যাঁরা সর্বক্ষম, সর্বদাম, সব অবস্থাম লিখিয়ে? সর্বপরিবেশক্ষম তাঁদের মতন বেশ লিখিয়ে আমি নই তো-বেশি লিখিয়ে হয়ত হলেও।

 যাই হোক, আমার অক্ষমতাজনিত এই ত্রুটি, অফিসবিধিবিরুদ্ধ এই গাফিলতির কথা কেউ হয়ত সুভাষবাবুর কাছে লাগিয়ে থাকবেন। আমি নিয়মিত অফিসে যাই না, দশটা-পাঁচটা কাঠের চেয়ারে ঠায় বসে থাকিনে, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনটিতে প্রেসে দেবার পূর্বক্ষণে আমার সব লেখা গছিয়ে দিয়ে আসি, তারপর সে হপ্তায় আর আমার পাত্তা মেলে না, সেই মাসকাবারে ঠিক তারিখটিতে মাইনে নিতে হাজির হই।

বিধিবদ্ধ কোনো আপিসের আইনে এমনধারা চলে না, একথা আমি মানব। কিন্তু লেখারাও কোনো আইন মেনে চলে না–সে কথাও তো সত্যি? বিশেষ করে আমার লেখারা কোনো ধারারই ধার ধারে না যারা!

অতএব এমন অবস্থায় যা হবার তাই হলো। একদা আত্মশক্তি কার্যালয়ে উপস্থিত হতেই নরেনবাবু সীল-করা কর্পোরেশনের মার্কা মারা একটা লেফাফা আমার হাতে তুলে দিলেন। তার মধ্যে ছিল তিনখানা একশ টাকার নোট আর ছোট্ট একটা চিরকূট; তাতে লেখা-আপনাকে আমাদের আর দরকার নেই। সুভাষ।

বাস্! হয়ে গেল। এক কথায় খতম।

 সঠিক বলতে, সে সময়ে আমার মনে একটু ক্ষোভ হয়েছিল সত্যিই। সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে হয়ত একটু অভিমানও হয়ে থাকবে বা (তার পরে আর কখনো তাঁর সমীপস্থ হইনি। কিন্তু আজ সমস্তটা খতিয়ে দেখে মনে হয় না–আমার প্রতি কোনো অবিচার হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র দারুল ডিসিপ্লিনবাদী, চিরদিনই তাঁর এই শৃঙ্খলাবোধ যেমন নিজের বেলায় তেমনি সবার ব্যাপারেই। স্বভাবতই আপিস বিধিবিরুদ্ধ আমার এই ব্যবহার তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না।

তবুও আমার দিকের কথাটা না শুনে পরের কথায় কান দিয়ে তাঁর এই একতরফা ডিক্রি-ডিসমিস আমার একটু যেন কেমনতর ঠেকেছিল সে সময়। তাঁর কাছে ডেকে আমার গাফিলতির কৈফিয়ত তো তিনি চাইতে পারতেন। নিজের সাফাইয়ে আমারও কিছু বলবার থাকতে পারে তো। আপিসে গরহাজির থেকেও তাঁর আত্মশক্তির কাজ তো আমি বাজিয়ে গিয়েছি ঠিকই। আপিসে বসেই লিখি আর ঘরে শুয়েই লিখি-সম্পাদনা কি লেখার কাজে তো কোনো কসুর ছিল না আমার।

তবে চাকরিটা গিয়ে প্রথমটায় একটু মুষড়ে পড়লেও, কহেন কবি কালিদাস-এর কথায় খানিক সান্ত্বনা পাই শেষ পর্যন্ত। সেই যে–নেই তাই খাচ্ছ নইলে কোথায় পেতে। কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে! চাকরিটা এমন করে গেল বলেই না এই বড়ো বড়ো তিনখানা জলছবি হাতের মুঠোয় এলো! জলের মতন উড়িয়ে এখন ফুর্তি করা যাবে দিনকতক!…

সুভাষবাবু একটু কানপাতলা ছিলেন লোকে বলে। জনাব সাহেবের জবান : পরের মুখে ঝাল খাওয়ার অভ্যেস ছিল নাকি তাঁর।

সে কথা আমি বলি না। তবে রাজারা কর্ণেন পশ্যতি বলে একটা আপ্তবাক্য আছে, সেই রাজোচিত মর্যাদা ছিল তাঁর নিশ্চয়।

সে কথা থাক্। আপনি যুগান্তরের গোড়ার কথাটা বললেন, কিন্তু কি করে খতম হল বলেননি তো?

এমন কিছু ঘটা করে নয়। ফুললো আর মরলো-র মন একেবারে হঠাৎ। বেশ চলছিল কাগজ, আমদানিও হচ্ছিল মন্দ না, কিন্তু সেই প্রফুল্লতার মুখেই আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল অকস্মাৎ। একদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি ঘরের ভেতর আমার সুটকেসটা নেই। জামাকাপড় খাতাপত্তর টুকিটাকি এটা-ওটা রাখতে মাঝারি সাইজের একটা সুটকেস কিনেছিলাম। কিন্তু বিষয়সম্পত্তি সবার সয় না। যুগান্তরের পুঁজিপাটা টাকাকড়ি অল্পবিস্তর তার ভেতরেই থাকত সব। একেবারে লোপাট।

দরজা জানালা সব খোলা রেখেই শুই আমি–এখনও অব্দি। বাইরে গেলেও লাগাই না কখনো, তালা-চাবির বালাই ছিল না আমার। সুটকেসটাতেও কোনো চাবি দেওয়া ছিল না। সুট করে এসে কে নিয়ে গেছে কখন!

ছাপাখানার দায় মেটানোর কাগজ কেনার টাকা ছিল তার ভেতরেই–কোথায় যাই এখন? কাগজ বার করি কি করে?

এরকম অবস্থায় গন্তব্যস্থল ছিল একটাই। দেশবন্ধুর কাছে।

গেলাম তাঁর বাড়ি। গিয়ে শুনলাম তিনি কলকাতার বাইরে। কী করা যায় তা হলে?

শার্টের পকেটে ট্রাম ভাড়ার কয়েক আনার সম্বল মাত্র। কী করে এত সমস্যার সমাধান করি ভাবতে ভাবতে ফিরছিলাম। ট্রামটা যখন ওয়েলিংটন স্ট্রীটে, বৌবাজারের কাছ বরাবর আচমকা আমার মনে হল…..

মরীচিকামায়ার মত একটা ছায়াভাস দেখা দিল যেন।

অনেকের প্রকোপে একটার পর একটা করে গেরো পড়লেও সব গেরোই এক কোপে কেটে যায়, আমি দেখেছি। সপক্ষেই থাক আর বিপক্ষেই যাক, বজ্র আঁটুনির একটা ফা গেরো থাকেই, কোন ফাঁকে তা-ই তাবৎ গ্রন্থিমোচন করে দেয়।

এদিনও যেন প্রায় সেই রকমটাই হলো।

যে-আভাসটা আন্দাজে পেয়েছিলাম, ফলে গেছল সেদিন।

ট্রামে আসতে আচমকা আমার মনে হলো, সেই সেদিনকার মতন, আজও বোধ হয় আমাদের বাসা ঘেরাও হয়েছে। পুলিসে পাহারালায় ছেয়ে গেছে পাড়া-আমাদের পাকড়াতে এসেছে পুলিস।

এখন কী কর্তব্য? আমি ভাবি।

 প্রথমেই পেট ভরে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। কারণ থানার হাজতে কী জুটবে বরাতে, জানা নেই। খিদেও পেয়েছিল দারুণ।

কোথায় খাই?

ততক্ষণে আমার নামার জায়গা ঠনঠনের মোড় পার হয়ে ট্রামটা পরের স্টপ-এ-আদর্শ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মুখোমুখি।

তারপর আর আমায় প্রেরণা দিতে হয় না। আমি নেমে পড়ি। মিষ্টান্ন ভান্ডারের টেবিলে বসি গিয়ে।

এনতার রাজভোগের অর্ডার দিই। না, কচুরি সিঙাড়া আজেবাজে জিনিস নয় আজ। বিনিপয়সার ভোজ যেকালে, তখন আর কিছু কিনি না। শুধু রাজভোগই চাই-রাজভোগই খাই। রাজভোগেই পেট ভরাতে হবে আজ-তারপর যা থাকে বরাতে।

পেট ঠেসে খেয়ে তার পরে পকেটে হাত দিয়ে হঠাৎ-ও মা! মনিব্যাগটা গেল কোথায় আমার? ট্রামে কেউ পকেট মেরেছে নিশ্চয়।

কথাটা কেবল ডাহা মিথ্যা নয়, ডবোল মিথ্যা। মনিব্যাগ আমার একদম নেই, কখনো থাকে না, ছিল না কোনো কালেই।

পাড়ার পকেটমার বন্ধু বলেছিল আমায় একবার, টাকা না রেখে যেন পকেটে মনিব্যাগ নিয়ে না বেরোই। ওতে নাহক ওদের হয়রান করা হয়-বহুৎ মেহনতি বেফয়দায় যায়।

তবে, আমার দোস্ত বেরাদারদের হয়রানি বাঁচাতে নয়, আমার মনিব্যাগ না থাকার কারণ অন্য। কখন টাকায় থাকি না, তাই মনিব্যাগ রাখি না।

কোথায় থাকেন আপনি? ঠিকানাটা দিন। সুবিধে মন এক সময় এসে দিয়ে যাবেন এখন। তার কী হয়েছে?

আদর্শের এক ভদ্রলোক বললেন। জ্বলোকের আদর্শ বলতে হয়।

কাছেই থাকি তো। ঠনঠনের কাছাকাছি। আপনারা একজনকে দিন না আমার সঙ্গে তার হাতে দিয়ে দেব দামটা।

একজন আমার সঙ্গে সঙ্গে এল।

বাড়ির কাছাকাছি আসতে, যা ভেবেছি, সারা গলিটা লালে লাল-পাহারাওলাদের লাল পাগরি জেলায়।

রাস্তায় আসতেই যার আঁচ পেয়েছিলাম, ভালো করে না আচাতেই তার ছোঁয়া লাগল। কিন্তু পুলিসের মতন এমন ওয়েলকাম সেদিন আমার কাছে আর কিছু ছিল না। পুলিস কোন সময়ই সমস্যা নয়, সমস্যার সমাধানও কখনো আবার!

দোরগোড়ায় পৌঁছতেই এক ইনপেকটার এসে আমার নাম শুধালেন। শোনা মাত্রই বললেন-আপনি অ্যারেষ্টেড।

তবুও, তার পরেও যেটা বক্তব্য থাকে, বলতে কসুর করি না-ওয়ারেন্ট কই?

এই যে। দেখুন না।

আদালতের ওয়ারেন্ট। সাদা কথায়, এর পর আর কথা চলে না। সামনে খাড়া করা কয়েদ-গাড়িতে গিয়ে উঠতে হয়।

উঠে দেখি, আমি ধৃত হবার আগেই গিরিজা আর বীরেনদা সেখানে উদ্ধৃত হয়েছেন।

ফিরে তাকাই, আদর্শের লোকটি ত্রিসীমানায় নেই।

পুলিসের কান্ড দেখেই না সে উধাও হয়ে গেছে কখন।

আমার মত আসামীকে খাওয়াবার দায়ে পাছে পুলিসে তাকেও পাকড়ায়, সেই ভয়েই হয়ত সে উড়ে দৌড়?

আদর্শের এমন খদ্দের, এহেন আদর্শ খদ্দের হয়ত এর আগে সে আর দ্যাখেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *