৪১.
ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে হাঁফ ছেড়েছি! বড়ো বাঁচন বাঁচা গেছে আজ। ঘোড়র ক্ষুরে মাথা মুড়োতে হয়নি আমায়।
মাথা বাঁচলে তো দেশের জন্য মাথা ঘামাব। মাথা খাটাবো আমার। দেশের জন্য নিজের মাথা দিতে পারব না কোনোদিন।
ঘোড়ার পায়ে মাথা দেবার কোনো মানে হয় না।
দেশোদ্ধার আমার মাথায় থাক, মাথাটা আগে বাঁচানো যাক! দেশের কাজ পড়েই আছে জীবনভোর। করলেই হবে এক সময়, দেশ কিছু কোথাও পালাচ্ছে না।
মুক্ত বায়ুর জন্য ভোলা জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।…চিত্তরঞ্জন আমার মাথায় থাকুন বাবা!
স্বগতোক্তিটি অস্ফুট স্বরে ব্যক্ত হয়েছিল বুঝি, যে কিশোরটি জানালাটার কিনারায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল, উঠে বসেছে আমার কথায়।
কিছু বলছ নাকি আমাকে? শুধিয়েছে সে।
তোমায়? না তো। জায়গা খালি পেয়ে তার পাশটায় আমি বসলাম। তোমায় তো আমি চিনি না ভাই! কে তুমি?
বাঃ, এই মাত্তর আমার নাম করলে! আমার নামই তো চিত্তরঞ্জন।
ও মা! তুমিও চিত্তরঞ্জন? তাই নাকি? চিত্তরঞ্জন এখন ঘরে ঘরেই নাকি? আমি হাসলাম-ঘরে ঘরেই প্রবাহিত গঙ্গা! এক চিত্তরঞ্জনের জন্য একটু আগে প্রাণটা খোয়া চ্ছিল আমার। সেই কথাই বলছিলাম। তোমায় কিছু বলিনি।…….অচেনা একটা লোক সোজা তোমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে দেখে খুব অবাক হয়েছ বুঝি?
আমাদের বাড়ি কেন হবে? পাবলিক লাইব্রেরি তো এটা। বলল ছেলেটি, এখানে বই নিতে আসে সবাই।
তাকিয়ে দেখি, তাই তো। লাইব্রেরিই তো বটে। অদূরে কাউন্টার ঘিরে লোকরা দাঁড়িয়ে লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে বইয়ের আদান-প্রদানে তটস্থ। চারিধারে পাশাপাশি সাজানো যত আলমারি হাজারো কই ঠাসা।
বাঃ! এখানেও একটা লাইব্রেরি। আরেকটা লাইব্রেরি এত কাছাকাছি রয়েছে জানতাম না তো?
সে কি! এমন নামজাদা রামমোহন লাইব্রেরির নাম তুমি শোনো নি? সে অবাক হয়।
আমি শুধু হিরণ লাইব্রেরি আর চৈতন্য লাইব্রেরি জানি কেবল। ওদের একটার আমি মেম্বর। তুমি এই রামমোহনের মেম্বর বুঝি?
না, ইস্কুল ছুটির পর আমি চলে আসি এখানে সটান। পছন্দমত বই নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক পড়ি, তারপরে বাড়ি ফিরে যাই। পড়ার বই নিয়ে বসি তারপর। এখানে বসে পড়লে এ এমনি বই দেয় পড়তে। কোনো কিছু দিতে হয় না, কি মেম্বর হতে হয় না। আমি এই জানালাটার আলসেয় শুয়ে শুয়ে পড়ি রোজ।
কিন্তু এটা কি এই আলসেমির সময় ভাই? দেশ আমাদের ডাকছে না এখন?
কথাটায় একজনের টনক নড়ে বুঝি।–কী বললে খোকা? ভদ্রলোক লাইব্রেরিয়ানদেরই কেউ হবেন হয়ত, পাশের আলমারির বই হাঁটকাচ্ছিলেন, তিনিই পাড়লেন কথাটা ফস্ করে–কোন ইস্কুলে পড় তুমি?
আমি পড়িটড়ি না, তীব্র প্রতিবাদ করি-তাছাড়া, আমি কোনো খোকা নই।
কী করো তুমি তাহলে?
যা আমাদের করবার এখন। সবাই যা করছে। দেশের কাজ করি।
দেশের কাজ? ভদ্রলোকের মুখে বক্র হাসি দেখা যায়-মুখ হয়ে থেকে দেশের কাজ? তা করা যায় নাকি? আগে নিজেকে গড়া-তারপরই না দেশের মানুষের সকলের কাজ করা।
পড়াশুনা তো পড়েই আছে, দেশের কাজ কিছু পড়ে থাকতে পারে না। আমি কই : কী বলেছেন মহাত্মাজী জানেন না? এডুকেশন মে ওয়েট বাট স্বরাজ ক্যানট। সব নেতাই তো সেই কথা বলছেন–বিপিন পাল, সুভাষ বোস, সি আর দাশ…
থামো থামো! ওই নেতারা কি মুখ নাকি! সবাই ওঁরা পণ্ডিত, রীতিমত পড়াশোনা করেছেন, তারপরেই কিনা দেশের কাজে নেমেছেন তাঁরা। তাঁদের মত হবার চেষ্টা করো আগে, তার পরে দেশের কাজ কোরো। এই বয়সে পড়াশুনা করাটাই তোমাদের কাজ এখন। কাজ করার উপযুক্ত হও, তারপর না কাজ করবে। যাও, এক্ষুনি ইস্কুলে ফিরে যাও, মন দিয়ে পড়োগে। যা-ও!
তিনি যেন মাছি তাড়ানোর মতই তাড়িয়ে দিতে চান আমায়।
আমার রাগ হয়ে যায়-যান, পড়ব না আমি। আপনি কী করবেন আমার? কী করতে পারেন আপনি?
আমি আর কী করতে পারি। মুখ্য হয়ে থাকবে, কষ্ট পাবে জীবনে, এই মাত্র বলতে পারি। জীবনে চারটি মাত্র বন্ধু, বুঝেছ ভাই? বিদ্যে, স্বাস্থ্য, টাকা আর ভগবান, হ্যাঁ, ঐ তোমার ভগবানও! এছাড়া আর কেউ কোথাও নেই কারো, সময়ে অসময়ে কেউ দেখার নেই ওরা ছাড়া। তাছাড়া এই কথাও আমি বলতে চাই, মুখ হয়ে থেকে দেশের স্বাধীনতা আনা যায় না। গড় গড় করে গড়িয়ে যান তিনি এক নিশ্বাসে–আর এত খারাপ লাগতে থাকে আমার যে! তাই যদি হতো ভাই, তাহলে তো আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জনই তো ওই নিরক্ষর। তাহলে দেশ স্বাধীন হয়ে যেত কোন কালে! হচ্ছে না কেন? এত গাধা থাকতে, বুঝেছ, এ দেশ কোনোদিন তা হবেও না।
গাধা থাকতে যদি না হয়, তাহলে আপনার ঐ ঘোড়া থাকতেও দেশ স্বাধীন হবার নয়। যা সব ঘোড়া বাবা! ভাবতেই আমার হৃৎকম্প হয়।
মাউন্টেড পুলিসদের কথা বলছ বুঝি? তাদের তাড়া খেয়েই পালিয়ে এসেছে এখানে? শুনে তিনি হাসেন-ও, তাই বলো? ই অশ্বদের টেক্কা দেবার মতলবেই অশ্বতর হতে চাইছ তাই?
অশ্বতর?
ঘোড়ার চাট তো ওই ঘোড়াতেই সইতে পারে। ঘোড়াকে তাদের ঘোড়াই কেয়ার। অশ্বতর হলে তুমিও পারবে। চাই কি দেশের নেতাও হয়ে যেতে পারো কোনোদিন বা! পলিটিশিয়ানরা তাই তো-গাধাদের চালিয়ে চরিয়ে তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। এক নম্বরের অশ্বতর না হলে কি তা পারা যায় নাকি? রানো যায় তোমার মতন গাধাদের কখনো?
বইখানা বার করে নিয়ে ভদ্রলোক কাউন্টারের দিকে চলে গেলেন।
ভদ্রলোক তোমায় গাল দিয়ে গেল। চিত্তরঞ্জন বলল-ওই অশ্বতত্র বলল তোমাকে। শুদ্ধ বাংলায় বলল তাই, সাদা বাংলায় কথাটা ভাই মুখে আনা যায় না। আমি অন্তত আওড়াতে পারব না।
তোমায় বলতে হবে না। জানি আমি কথাটার মানে। খচ্চর বলেছেন ভদ্রলোক। উনি বললেই হবে? উনি বললেন আর আমি হয়ে গেলাম? গান্ধী চিত্তরঞ্জন সুভাষ বোস কি সবাই বুঝি তাই?।
তাঁদের বলেননি তো? বলেছেন ঐ পলিটিসিয়ানদের। তাঁদের সঙ্গে এমন সব মতলববাজ ধড়িবাজ লোক আছে না? বাবাও তো বলেন এই কথাই। তাদের সম্বন্ধেই বলেছেন উনি মনে হয়।
বলুন গে, আমার বয়ে গেল! উনি খচ্চর বললেই আমি খচ্চর হবো নাকি? আমি তো আর পলিটিসিয়ান হতে যাচ্ছিনে, চাচ্ছিও না তাই হতে?
ছেড়ে দাও ওঁর কথা। আমাদের বাড়ি একদিন বেড়াতে এসো, কেমন? সাকুলার রোডের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সে বলল–আমার নাম চিত্তবঞ্জন দে। চিত্ত চিত্ত বলে ডাক দেবে নীচের থেকে, মেমে আসব তক্ষুনি।
চিত্তরঞ্জন দে? তুমি কি দেবেন দের কেউ হও নাকি? এই-ভাইটাই?
কে দেবেন দে? চিনিওনে আমি তাকে।
না চিনলেও তার অনেক চিহ্ন রয়েছে কিনা তোমার চেহারায়–অনেক মিল পাচ্ছি তোমাদের। তোমার হাসিটা ঠিক তার মতই আর তেমনি জ্বলজ্বলে বড় বড় চোখ। দেবেনের মতই তুমি দেদীপ্যমান, দেখছি কিনা!
তাই নাকি? শুনে সে হাসে-তাহলে আসছে তো রোববার?
আসবো একদিন পরে হয়ত কখনো। এই রবিবার কি করে হবে? এখন তো আমার জেলে যাবার পালা, ঐ দেবেন দের সঙ্গেই। আরেক চিত্তরঞ্জনকে দেখতেই, বুঝেছ? আমি জানাই-দেশবন্ধু এখন যে জেলে রয়েছেন জানো না?
ভদ্রলোকটি ফিরে এলেন সেই আলমারির কাছে। আবার কোনো বইয়ের তাগিদেই বোধ হয়। আমাকে দেখেই চমকে উঠলেন যেন-সে কী! এখনো তুমি এখানে? যাওনিকো? এখনো এখানে বসে রয়েছে? না না, ইস্কুলে যেতে বলছিনে তোমায়। মীর্জাপুর পার্কেই যেতে বলছি গো। দেশ তোমায় ডাকছে না এখন? দেরি হয়ে যাচ্ছে যে-যাও। ঘোড়ার ভয়ে পিছিয়ে থাকলে কি চলে ভাই? ঘোড়া দেখে খোঁড়া হলে চলবে কেন?
.
বক্রদৃষ্টির সঙ্গে তাঁর বাঁকা বাঁকা বুলি শুনতে হয়।
যাবই তো, যাচ্ছি তো? বলতে বলতে উঠে পড়ি-চললাম তো? ঘোড়ার ভয় আমি করি নাকি মশাই? তাদের আমার ঘোড়াই কেয়ার!
আসতে হবে কিন্তু! যাবার বেলায় পিছু ডাকে ছেলেটা-মনে রেখো আমায়!
ঘোরানো সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসি নীচেয়। ঘোড়াটা দোর গোড়ায় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই আর। না থাক, আমি আর বড় রাস্তা ধরছি না, ঘোড়াসঙ্কুল পথ ছেড়ে ঘোরালো পথে অলি গলি দিয়ে কেটে পড় গিয়ে সেই মীর্জাপুর স্কোয়ারে।
যেতে যেতে মনের মধ্যে ছেলেটির সাড়া পাই, তার ওই পিছু ডাকা–মনে রেখো আমাকে।
মনে তো রেখেছি অনেককেই। মনের মধ্যেই রয়েছে তারা। মনেই রাখা যায় কেবল ফিরে আর চোখের দেখা হয় না তো তার সঙ্গে আর! সেই যে বাড়ির থেকে চুটকি কবিতাটা পাঠিয়েছিলাম না বিজলীতে-জানি জানি সবাই সবে ছাড়বে/চলার পথে কে আর কবেকার বা চুমু কাড়বে!
আমার সারা জীবন যে ওই চুটকিই। তার মতই ছুটকো হয়ে ওঠা–সেই কবিতার টুকরোটার মতই টুকরো টুকরো টুটা ফুটা হয়ে ভেঙেচুরে যাওয়া!…কারে বেঁধে রাখা নয়/কোথাও বন্দী থাকাও নয়/লেনা দেনা/যাক চুকে না/হোক ক্ষণিকের জয়!
ভবিষ্যদ্বাণীর মতই এক বালকের কলমে যা একদা বেরিয়েছিল তাই বুঝি জীবনভোর সত্যি হয়ে দাঁড়ালো। তার কৈশোর জীবনে আজ তাই যথার্থ হয়ে উঠেছে।
মীর্জাপুর পার্কের অতো ভিড়ের ভেতর দেবেনের দেখা পেলে হয় এখন। ছেলেটি কিন্তু দেবেনের মতই দেখতে–একটু ছোট সাইজের এই যা! দীপশিখার মতই দ দপ্ করে জ্বলছে তেমনি।
ওর বয়সের, বারো-চোদ্দর সব ছেলেই আলোর মতন অমনি ঝলকায়, আমি দেখেছি। অমনই ধারালো-অতই সপ্রতিভ। তারপরে যতই তারা বয়সে বাড়তে থাকে, পড়াশোনার চাপে কি সংসারের তাপে–কী জন্য যে কে জানে, কেমন করে কীরকমটা হয়ে যায় তারা দিনকের দিন! কালো হয়ে যায়, ভোঁতা হয়ে আসে, অকালে বুড়িয়ে যায় কেমন!
কেন এমনটা হয়? দেশ আমাদের পরাধীন বলেই নাকি?
দেশ স্বাধীন হলেই আমাদের সব দুঃখ দূর হবে। ছেলেদের দুঃখ, বড়দের দুঃখ, চাষী মজুরের–সবার। জ্বলজ্বল করবে সারা জীবন।
সেদিন ধূমকেতুর পাতায় নজরুল ইসলামের কবিতাটা পড়ছিলাম না? কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/রক্ত জমাট শিকলপূজার পাষাণ বেদী/ওরে ও পাগলা ঈশান/বাজা তোর প্রলয়বিষাণ/ধ্বংসনিশান/উড়ুক প্রাচী-র প্রাচীর ভেদি।…পড়লে রক্ত গরম হয়ে ওঠে। ওঠে না?
ঐ জেলে গিয়েই জেলের শেকল ভাঙতে হবে আমাদের-বলছিল দেবেন।
সেও নজরুলের একটা কবিতার পদ আউড়েছিল তখন–এই শিকল পরা ছল আমাদের/শিকল পরা ছল।/ঐ শিকল পরেই শিকল তোদের করব যে বিকল!
কিন্তু জেলে যাওয়াও খুব সহজ নয়, বলছিল সে। জেলে একবার ঢুকলে যেমন তার থেকে বেরুনো বেজায় কঠিন, তেমনিই শক্ত নাকি ঐ জেলের মধ্যে ঢোকাটাও।
আমি শুধিয়েছিলাম, কেন, শক্তটা কিসের? গেলেই তো হয় জেলে।
অত সোজা নয় ভাই! বলেছিল সে। মাঝপথে ঘোড়ার এই বাধার কথাটা ভেবেই বলেছে নাকি?–আমি তিন তিনবার চেষ্টার পর তবে সাকসেসফুল হয়েছিলাম, জানো?
কী রকম, শুনি তো?
ধরে নিয়ে গেলেও তোমায় জেলে যেতে দেবে না। থানার থেকেই পত্রপাঠ ভাগিয়ে দেবে তোমাকে।
থানার থেকেই? কেন হে? সরকারের আইন ভেঙে গেছি। যেতে দেবে না? আবদার নাকি? আমার প্রশ্ন : ল ইজ ল? তা কি কখনো হ য ব র ল হয়।
হয়ই তো ভাই! প্রথমেই ওরা তোমার নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করবে, কেয়ার অফ-এর কথা জানাতে হবে তোমাকে।
কেয়ার অফ-এর কথা? কেয়ার অব আবার কি?
সেই যে খামের ওপর ঠিকানায় লেখা থাকে না কে.। অ, অমুক? বাবা কি কাকা কি কারো নাম গো? বলল দেবেন : তা আমায় যখন শুধালো তোমার নাম কি? তুমি কার কেয়ার অফ। আমার নামটা ঠিক বলেছিলাম, কিন্তু বাবার নাম, কি বাড়ির ঠিকানা দিইনি। টের পেয়ে বাবা যদি আমায় ঠেঙায় তখন? তাই মামার নাম-ঠিকানা দিয়েছিলাম আমি।
কী হলো তারপর?
থানার থেকে পাহারাওলা পাঠিয়ে খবর দিয়েছিল মামাকে। মামা তক্ষুনি ছুটে এসে আমার হয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল থানার থেকে আমায়।
মুচলেকাটা কী জিনিস ভাই?
কী তা কে জানে! হিন্দী কোনো কথা হয়তো।
ও বুঝেচি। মোচ লেখা! মোচ মানে হচ্ছে গোঁফ। একজন বলেছিল আমাকে। তোমার ওই গোঁফটোফের মতই কিছু হবে হয়তো।
তাই হবে বোধ হয়। ছেড়ে দিল তো সেবার আমায়। তার পরদিনই আমি আবার ধরা দিলাম-সেবারও আমায় ভাগিয়ে দিল থানার থেকে। আমার দাড়ি গোঁফ কিছু বেরয়নি বলে–আমি নাকি নাবালক এই ছুতোয়। নাবালকদের জেলে নেয় না কিনা।
তোমার নাবালকত্ব তুমি জাহির করতে গেলে কেন?
জাহির করতে হয় না। দারোগা গালে হাত বুলিয়ে দেখে নেয়…এমনি করে ভাই বলে সে গালে হাত দেয়। নিজের নয়, আমার গালেই।
এটা কী হলো তোমার?
একটু আদর করলাম আর কি। কেন, তুমি কি আদর করবার মত নও?
হেদোর দীঘির দীঘল আয়নায় ওর মুখের হাসি ভেসে ওঠে উছলে-দেখতে পাই। দেখে আমার চিত্তির জ্বলে যায়।
বেশ, আমিও তোমায় একটু করি তা হলে। তুমিও তো আদর করার মতই।
উঃ! আদরের ঠেলায় ককিয়ে ওঠে সে-এই কি আদর করা নাকি? এই তোমার আদর করার নমুনা? আমি কোথায় আলতো করে একটুখানি ছুঁয়েছি মাত্র আর তুমি কিনা, উঃ!
যার যেমন টিপ ভাই! আমার টিপ্পনি রাখি : আমার টিপসই ওই রকম! আনাড়ির মার তো!
আনাড়ি আমি সত্যিই–এ বিষয়ে। এর আগে আর কোনো ছেলেকে এভাবে আমি আদর-করিনি রিনির বাইরে আর কাউকে না–এ পর্যন্ত। মিথ্যে বলিনি সত্যিই।
ইস্। এমন লেগেছে না আমার! তুমি যদি ভীমভবানী হতে না, তা হলে তোমার এই আদরের চোটে দাঁতগুলো আমার চুরমার হয়ে যেত। ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ত এতক্ষণ।
ভালোই হোতো তাহলে। ঝুরিভাজা আর খেতে হোতো না জীবনে তোমায়। দারোগা এর প্রতিশোধ দেবে তোমাকে থানায়; আমি শাপ দিচ্ছি। কড়াপড়া হাতে কষে এমন তোমায় টিপবে না… শাপান্ত করে শান্তি পেয়ে সে শুধায় তারপরে থানায় তোমার নাম-ঠিকানা শুধালে কী জানাবে তুমি তখন, বলবেটা কী?
ঠিক ঠিকই বলব, আবার কী? বলব যে আমার কোনো ঠিকঠিকানা নেই মশাই?
বললে তাই শুনবে নাকি? পাগল আর বাউণ্ডুলে ছাড়া সেরকম কারো হয় না। তোমার নিজের না থাক, তোমার কেয়ার অফ-এর তত রয়েছে। কে তোমার কেয়ার অফ?
কেয়ার অফ ফুটপাথ। তার নামও যা ঠিকানাও তাই ঐ এক কথায় আমি প্রকাশ করি-ফুটপাতেই আমার বাড়ি আপাতত।
বেঁচে গেছ তাহলে। তোমার হয়ে মুচলেকা দেবার কেউ নেইকো আর। তার স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে।
মুচলেকা দিতে হবে কেন আমাকে? আমার মুচলেকা তো বেরিয়েই রয়েছে। দেখতে পাচ্ছ না!
মুচলেকা বেরিয়ে আছে! সে আবার কী? সে অবাক।
কেন, এই যে আমার মোচ! আমার প্রদর্শনী দেখাই : আমার গোঁফের রেখা বেরিয়েছে। যে দেখছ না? চোখে পড়ছে না তোমার? রোজ আমি আয়নায় দেখি যে। দাড়িটা বেরোয়নি এখনো এই আমার দুঃখু।
এই তোমার মুচলেকা?
হ্যাঁ, এই তো! এ দেখলেই তারা আমার গালে হস্তক্ষেপ করবে না। ভাববে যে দাদা রয়েছে যে কালে, তার ভাইও আছে, গোঁফের ভাই ঐ দাড়িও রয়েছে কাছাকাছি। তোমার শাপ লাগবে না আর আমাকে। আমি হেসে জানাই : দাড়ি বার করা ভারী শক্ত ভাই। গোঁফ নিজ গুণে দেখা দেয়, কিন্তু দাড়িকে অনেক তোয়াজ করে অর্জন করতে হয়। নিত্য কামাতে হয় তাকে ঐ টাকার মতই। রোজ কামালেই দাড়ি বেরোয় আর টাকা বাড়ে, বুঝেছ? তা, না থাকগে দাড়ি, গোঁফ তো আছে, সেই ঢের। এই গোঁফ জোড়াতে দিলে চাড়া তোমার মতন অনেক পাবো! ওঁর মুখের ওপর দ্বিজেন্দ্রলাল ছুঁড়ে হতবাক করে দি।
গোঁফ না ডিম! সে ভ্যাঙচায়।
ডিমের মত হলেও তো বাঁচতুম! একটু একটু তা দিতে পারতুম তাহলে। সান্ত্বনা থাকত। মোচের ডিম ফেটে চিকেন গোঁফ বেরুতে একদিন! তারপর তাই হয়ে উঠত HEN গোঁফ-এহেন গোঁফ?…..
বলে আমার যে গোঁফ নাকি নেই তাই আমি চুমড়ে দেখাই।
দেবেনকে ভিড়ের ভেতর পেলে হয় এখন! ভাবতে ভাবতে আঁকা-বাঁকা অলিগলি পেরিয়ে যথাস্থানে গিয়ে পৌঁছেছি।
ভিড় তখন আরো গভীর, জনতা আবোরা উত্তাল।
ঘোড়াদের দুর্জনতা আরো বেজায়। কিন্তু তাদের লম্ফঝম্প সেই আমহার্স্ট স্ট্রীটের বড় রাস্তা ধরেই। ওদের ত্রিসীমায় কে যায়? সে পথ না মাড়িয়ে আমি পার্কটার অন্য ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম।
সে ধারেও ভিড় আছে। অনেকেই খাড়া, তবে সে ধারে একটু কম। কিন্তু ভেতরে সেঁধুবার জো নেই কোনো ধারেই, ঘোড়া না থাকলেও পাহারাওলারা চারধার ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে হাত ধরাধরি করে।
ছেলেরা সব পার্কের রেলিং টপকে টপকে ঢুকছে–কেউ আটকাচ্ছে না। পাহারাওলারা কোনো বাধা দিচ্ছে না। তাদের বাহুবেষ্টনী ভেদ করে চলে যাচ্ছে মাঝখানের সভায়। ভলান্টীয়ারদের ওপর তাদের কেমন যেন সহানুভূতি রয়েছে মনে হোলো। ঘোড়ার সোয়ারী গোরা সার্জেন্টদের মত নয়।
মহাত্মা গান্ধীজী কি জয়! জয়ধ্বনি দিয়ে তারা পার্কের ভেতরে টপকে পড়ছে গিয়ে।
পশ্চিমা পাহারাওলারা বাধা দিচ্ছে না তাদের কাউকে। মনে হোলো সেই জয়ধ্বনির স্তরে তাদেরও ঠোঁট যেন নড়ে উঠছে একটু করে নিঃশব্দেই। নিঃশব্দে তারাও যেন আওড়াচ্ছে সেই কথাই। তারাও মনে মনে চাইছে ভারতের স্বাধীনতাই।
আমিও রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে দাঁড়াই। যা খাড়া রেলিং! পারব টপকাতে?
ওদিকের রেলিং টপকে কে একটা মেয়ে ভেতরে গেল না? ফ্ৰকপরা মেয়ে একটা? এই চোদ্দ-পনেরর মতন?
একটা বাচ্চা মেয়ে টপকাতে পারে আর আমি পারব না? সে জেলে যাবে আর আমি পিছিয়ে পড়ে থাকব পেছনে?
আমিও টপকালাম। হেঁচড়ে-মেচড়ে ঢুকলাম কোনো গতিকে।
ইস্ এক কড়ারও বাহুবল বিধাতা দেননি আমায়! ভেতরে গিয়েই এক ছুটে সেই মেয়েটির মুখোমুখি গিয়ে পড়েছি।
দেখি ওমা! এ কে? রিনি নাকি? কাছাকাছি হয়ে চিনি, হ্যাঁ, রিনিই তো। রিনি, তুমি এখানে? তুই এখানে কী করছিস রিনি? কী করতে এসেছিস তুই?
ওমা, তুমি এসেছো এদ্দিনে? পৌঁছে তাহলে? যথাসময়ে যথাস্থানে? কথা-কাহিনীর সেই উপগুপ্তর মত সেই যে-সন্ন্যাসী উপগুপ্ত। মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে একদা ছিলেন সুপ্ত…?
এ নহে কাহিনী এ নহে স্বপন, আসিবে সেদিন আসিবে! আমিও রবীন্দ্রনাথ আউড়ে ওর কথার উতোর গাই। তা, তুই এখেনে যে! কী জন্যে এসেছেস শুনি?
তুমিও যেজন্যে আমিও ঠিক সেইজন্যেই। জেলে যেতে হবে না আমাদের এখন? এই দেশ স্বাধীন করবার যুদ্ধে মেয়েরা পিছিয়ে থাকবে নাকি? কী লিখেছিলাম তোমায়? অ্যাদ্দিন বাদে তুমি এলে!…একবার তোরা মা বলিয়া ডাক/জগতজনের শ্রবণ জুড়াকহিমাদ্রি পাষাণ কেঁদে গলে যাক /… সঙ্গে সঙ্গে রিনি একবারে সুরধুনী।
.
৪২.
কবে তোমায় লিখেছি চিঠি! সে কি আজকে? বলছিল রিনি-এত করে লিখলাম তোমায় যে চটপট চলে এসো কলকাতায়। দুজনে মিলে দেশের কাজে লাগব–তোমার সঙ্গে একসাথে জেলে যাব, লিখিনি? তা, না তুমি এলে, না-দিলে চিঠির একখানা জবাব!
রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে কথা কইছিলাম দুজনায়।জবাব দেবো কি করে? তোর ঠিকানা জানলে তো? আমার সাফ জবাব। কোনো ঠিকানা-মিকানা ছিলো নাকি তোর চিঠিতে?
জানতে না তুমি? চাঁচল ছাবার দিন তোমায় বলে আসিনি ঠিকানা? আহিরিটোলায় আমাদের বাড়ির ঠিকানা বলে আসিনি তোমাকে?
বলেছিলিস বটে, কিন্তু আমার মনে থাকলে তো?
এতো যদি তোমার ভুলো মন হয়, কি করে পরীক্ষা পাশ করবে গো?
করিনি তো পাশ। করব না তো। সব পরীক্ষার পাশ কাটিয়ে এসেছি আমি। দ্যাখ রিনি, তোদের মেয়েদের এই একটা বড়ো দোষ। তোদের ধারণা তোদের মতন তোদের বাড়ির নম্বর-টম্বরও ছেলেদের মনে গাঁথা হয়ে থাকবে। আমি আরো অনেক মেয়ের দেখেছি এই রকম।
কটা মেয়ের দেখেছ এ রকম শুনি? কজনার সঙ্গে পত্রালাপ হয়েছে গো?
এ পর্যন্ত একজনার সঙ্গেও না। আর ওইজন্যেই তো। আমার ভাগনি, সুশীলাদির মেয়ে প্রিসিলা, অন্নপ্রাশনের সময় তার নামকরণটা আমিই করেছিলাম। এইটুকুন মেয়ে। কিন্তু এই বয়সেই মেয়েদের সব দুর্লক্ষণ তার মধ্যে বর্তমান! তাদের কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে চিঠি দিয়েছিল আমাকে। ঐ প্রথম চিঠিটাতেই যা ঠিকানা দেয়া ছিল–তারপর আর যত চিঠি লিখল তার কোনটাতেই কোনো ঠিকানা নেই। প্রথম চিঠিটা কি করে যে হারিয়ে গেল–তার কোনো চিঠিরই আর উত্তর দেওয়া হলো না তাই। কি করে হবে? সে বোধহয় ভেবেছিল প্রথমখানায় ঠিকানা দিয়েছি সেই ঢের–তারপর নিশ্চয় আমি তার মতন তার ঠিকানাটাও মুখস্থ করে ফেলেছি… আমার স্মৃতিপটে তার মতই আঁকা হয়ে রয়েছে।
তাকেও মুখস্থ করা হয়েছে বুঝি তোমার? কেমনধারা চোখ করে সে তাকায়।
বা রে! ভাগনি না আমার? ভাগনি কি আদরের জিনিস নয়? এইটুকুন তো।.সত্যি, তুই ভারী সন্দেহবাদী, দারুণ সন্দিগ্ধচেত্রী।
ঠিকানা মনে না রাখতে পারো তো তোমার ইতিহাসের পরীক্ষার বেলায় করতেটা কি? রাজা-বাদশা লাট-বেলাটের জন্ম-কর্মের সাল তারিখ লেখবার বেলাতে?
যারা মেমারি রাখে তাদেরই ওসব মুখস্থ থাকে। তারিখ-টারিখের কোনো উল্লেখ না করে আমি মন থেকে সব বানিয়ে দিতাম। সব রাজাগজা লাট-বেলাটের স্বভাবচরিত্র কার্যাবলী প্রায় এক ধারার–সবাই হিতকর পরোপকারী প্রজারঞ্জক ইত্যাদি ইত্যাদি কোনো ইতরবিশেষ নেই কারো। সাল তারিখ না দেওয়ার জন্য কিছুটা নম্বর কাটা যেত অবশ্যই কী আর করা? আরে, ইতিহাস পাশ করা তো সবচেয়ে সোজা রে!
বানিয়ে বানিয়ে লিখতে ইতিহাস! সে হাসে-সে একটা নতুন ইতিহাস হতো নিশ্চয়।
ইতিহাস তো সব মনগড়া ব্যাপার রে! যে কালে ওসব কাণ্ড ঘটেছিল সে সময় কি এখনকার কেউ থেকেছিল, দেখেছিল? সব ইতিহাসই তাই।
তোমায় বলেছে! বলতে বলতে সভার মাঝখানে শোরগোল উঠল খুব। নেতা-টেতা এলেন বোধ হয়, বলল সে।
গান্ধীটুপি মাথায় বয়স্ক কয়েকজনকে আসতে দেখা গেল সভাস্থলে–তাঁদের ঘিরে জয়ধ্বনি হতে লাগল।
কে জানে কে! আমি তো চিনি না সবাইকে। আমি বলি-এবার বোধ হচ্ছে শুরু হবে সভাটা। চল সবার মাঝখানে বসি গে।
দাঁড়াও না। এখন কী। এখনই কী। পুলিস পাকড়াবার সময় এলে তখন। ততক্ষণ গল্প করা যাক না!…বক্তৃতা শুনতে আসিনি, বক্তৃতা করতেও না। জেলে যাবার জন্যেই
সেছি তো! জেলে যাওয়া অতো সোজা নয় মশাই! জেলের থেকে বার হওয়া যেমন শক্ত ব্যাপার, জেলের মধ্যে ঢোকাটাও তেমনই! একটা ছেলে বলছিল না আমায়…সে তো আজ…
বলতে হবে না কাউকে, আমার জানা। রিনি জানায় কদিন ধরেই তো চেষ্টা করছি আমি। কিছুতেই যেতে পারছি না। নিচ্ছেই না আমাকে। ধরবামাত্র ছাড়ছে, নয়ত থানায় নিয়ে গিয়ে
কেন, ছেড়ে দিচ্ছে কেন তোকে?
মেয়েছেলে বলে, তাই। কেন, মেয়েরা কি মানুষ নয়? তাদের কি দেশ না? তারা। কিছু করতে পারে না দেশের জন্যে? বলতে বলতে সে উকে ওঠে-ছেলেরা জেলে যাবে আর আমরা যেতে পাব না? আজও যদি না নেয় আমায় তো কাল আমি আসব আবার একেবারে ভোল পালটে–একটা ছেলে হয়ে, তুমি দেখো।
কি করে ছেলে হবি? শুনে তো আমি হতবাক্তা হওয়া যায় নাকি কখনো?
ফ্রক খুলে হাফ প্যান্ট পরব, চুল কেটে ফেলব ছোট করে–এই লম্বা বিনুনি আমার ছেটে ফেলব দেখো না!
না না! আমি চেঁচিয়ে উঠি-খবর্দার না, দেশের জন্য আর যা করিস কর, কিন্তু তোর নিজের কোনো অঙ্গহানি করতে দেবো না।
ওর এক চুল এদিক-ওদিক হওয়াটা যেন আমি সইতে পারি না। ওর বেণীসংহারে আমার আপত্তি।
দেশের জন্য এক চুল স্বার্থ ত্যাগ করতে পারো না এই তোমার দেশকে ভালোবাসা? তার দু চোখ যেন জ্বলে ওঠে।
আমার চুল হলে করতাম। আমি ন্যাড়া হয়ে যেতে পারি দেশের জন্যে। কিন্তু তোর চুলের স্বার্থ ত্যাগ করা আমার পক্ষে ভারী শক্ত। না, তুই ও কাজ করতে পাবিনে।
এখনো এ চুল তোমার হয়নি মশাই। আমার যা ইচ্ছে করব। তুমি কে বলবার?
কথাটায় আমি একটু চোট খাই। মনে কেমন লাগে। ওর একচুলের তফাত আমার অসহ্য, আর ও কিমা এক কথায় আমায় সাত হাত সরিয়ে দিল। নস্যাৎ হয়ে গেলাম!
তাহলেও তুই ধরা পড়ে যাবি হাজার চুল ছোট করে ছাঁটলেও। তুই যে মেয়ে তা একটুতেই টের পেয়ে যাবে সবাই। আমি সেই একটুখানির প্রতি কটাক্ষ করে কই-হাজার তুই চেষ্টা কর না, লুকোতে পারবি না কিছুতেই।
তাও আমি ভেবে রেখেছি। আমার অপাঙ্গদৃষ্টি লক্ষ্য করে সে বলে-বাবার কাছে ব্যাণ্ডেজ আছে না? তাই দিয়ে বেশ টাইট করে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে নেব, একাকার করে ফেলব দেখো না তুমি।
তাহলে আর দেখবার কী থাকবে। আমার মতে সেটাও ভালো হবে না। তবে তেমনটা হলে কেউ টের পাবে না হয়ত বা, কিন্তু সেটা কেবল ওই তোর পক্ষেই সম্ভব। তুই আর সব মেয়ের মত নয়তো ঠিক…তুই বোধ হয় তত বড় হোসনি এখনো, নইলে আর সব মেয়েদের যেমন…যেমনটা কিনা… তোর এটা একটা খুঁতই হবে বোধ হয়। একটুখানি আমার খুঁতখুঁতুনিই থেকে যায়।
রিনির ওই ইতরবিশেষ লক্ষ্য করেই আমার বলা। কিন্তু সেহেতু তার বিশেষ দুঃখ দেখা যায় না-এই তো ভালো বেশ। তেমনটা হলে আমি ফ্রক পরতে পেতুম না আর দিদির মতন আমাকেও শাড়ি পরতে বাধ্য করত মা-অ্যাদ্দিনে আমার বিয়ে হয়ে যেতো তাহলে।
শাড়ি হলেই শ্বশুরবাড়ির সুখ থাকে কপালে? তাই বুঝি? আমি বলি-সুখের সঙ্গে শাড়ি জড়ানো? তবে হ্যাঁ, জানি, শুকসারী বলে থাকে কথায়।
তবে তবে? এবার আমার দোসরা শ্বশুরবাড়ি আটকায় কে? আমার সবিস্ময় দৃষ্টি দেখে সে কয়-জেলখানাকে দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়ি বলে জানো না বুঝি?
তাহলেও এই বিয়ের যেমন বর নেই-আমি প্রকাশ না করে পারি না–তেমনি সেই শ্বশুরবাড়ির সুখও নেই তোর বরাতে। থানায় নিয়ে গিয়েই তোকে ছেড়ে দেবে আবার দেখিস।
কেন, ছাড়বে কেন? আমি তো আর মেয়ে নই, ছেলেই তো তখন।
ছেলে হলে কী হয়? ছেলেদের গালেও এমনি করে তারা হাত বুলিয়ে দ্যাখে… আমি দৃষ্টান্ত দ্বারা বিশদ করি–এই ভাবে।
পুনশ্চ বলি, দাড়ি বেরিয়েছে কিনা দেখে নেয়। আর না বেরুলেই তারা ছেলের সঙ্গেও ঐ মেয়ের মতই ব্যবহার করে থাকে। থানার বার করে দেয় ধরে।
দিলেই হোলো। আমার গায়ে…মানে, আমার গালে হাত দিতে দেব কেন তাদের?
তোর বাধা তারা মানছে কি না! পুলিশ কারো কথা শোনে! তবে কারো গালে হাত দেওয়াটা উচিত নয় তা বটে… বিশেষ করে গালের মতন গাল হলে। আমিই যে এখন একটু হাত বুলিয়ে নিলাম, সেটাই কি ঠিক হোলো নাকি? গাল হস্তক্ষেপের জায়গা নয় জানি, হাত হচ্ছে হাতাহাতির জন্য আর গাল হচ্ছে…গাল হচ্ছে গিয়ে…কিন্তু এখন এখানে তোর সঙ্গে গালাগালি করলে সেটা কি ভালো দেখাবে? বলবে কি লোকে!
রাখো!…ঐ দ্যাখো, একজন আইন ভঙ্গ করছে…বেআইনি সভায় বক্তৃতা করতে উঠেছে দ্যাখো!
গান্ধী টুপি-পরা লোকটা দুএকটা কথা বলতে না বলতেই একজন ইনস্পেক্টর এনে তাকে অ্যারেস্ট করেছে…তক্ষুনি উঠেছে আরেকজন…তাকেও তৎক্ষণাৎ! তৃতীয় ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বন্ধুগণ পর্যন্ত সম্ভাষণ করতেই না, ধরা পড়ে গিয়েছে সেও। এরপর পরের পর একজন করে উঠে দাঁড়ায় আর ধরা পড়ে ধরা দিয়ে যায় পরম্পরায়।
ডজনখানেক ধরে ইনস্পেক্টর তাদের সভার বাইরে নিয়ে যায়, সেখানে পাহারাওলাদের জিম্মা করে দেয়। পুলিসরা একটা গভীর ভেতর তাদের ঘিরে রাখে। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা বন্দেমাতরম, গান্ধী মহারাজ কী জয়! দেশবন্ধু কি জয়! ইত্যাদি হাঁকতে থাকে।
এমনি করে মাথা মাথা জনাপঞ্চাশেককে পাকড়ে পার্কের বাইরে নেয়। সেখানে সারি সারি প্রিজনভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল, তার ভেতরে ভরতে থাকে। তারপরও সভায় বালখিল্য যারা বাকী ছিল তারাও মহাজন পদাঙ্ক অনুসরণে একে একে খাড়া হতে থাকে–ভারতের স্বাধীনতা চাই। মহাত্মা গান্ধীজী কী জয়! ইত্যাদি বহুৎ বাগবিস্তার করলেও পুলিস তাদের প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ করে না। পালের গোদাদের পাকড়ে নিয়ে চলে যায়। সেদিনকার সভাটা সেখানেই সমাপ্ত।
দূর। এ কী হলো। ধরলই না তো আমাদের… রিনি বললে-আইন ভাঙবার সুযোগই পেলাম না আমরা।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলাম কেবল…ধরা পড়লাম কোথায়? আমিও আক্ষেপ করলাম।
দাঁড়াও, চেষ্টাচরিত্র করে দেখা যাক-না। প্রিজনভ্যানে গিয়ে উঠে পড়ি না কেন? ফাঁক পেলেই উঠে পড়ব, কেমন? রিনি পথপ্রদর্শন করে–আমরা প্রিজনভ্যানগুলোর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াই-আমি আগে উঠব, বুঝলে? তুমি তার পরেই এসো। আমি আগে, আমাকে যদি না নেয়, তুমি ধরা পড়তে যেয়ো না যেন। কেমন?
তুই না গেলে কিসের জন্যে যাবো শুনি? কোন্ সুখটা আছে আমার সেখানে? তোর বিহনে জেল তো আমার কাছে অন্ধকার! কে আছে সেখানে আমার?
ওর পিছু পিছু আমিও প্রিজনভ্যানের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াই। তটস্থ হয়ে থাকি দুজনাই। বিনি একটুখানি ফাঁক পেতেই না এগিয়ে প্রিজনভ্যানের হাতল ধরে টুক করে লাফিয়ে উঠে পড়ে কেউ বাধা দেবার আগেই।
এইবার দেবেনকে এগিয়ে আসতে দেখি।
এতক্ষণ তাকে দেখতেই পাইনি। রিনির আলোয় চারধার যেন অন্ধকার হয়ে ছিল, নজরে পড়েনি তাই আমার। এবার সে এগিয়ে এল।
এগিয়ে এসে একটু তাকে পিছিয়ে যেতে দেখলাম। একটু পিছিয়েই না, দৌড়ে এসে হাইজাম্প দিয়ে সে ভ্যানের ভেতরে গিয়ে পড়ে। বাঘরা শুনেছি এমনি করে নাকি লাফ মারার আগে একটুখানি পেছোয়।
আমিও তার পিছু পিছু গিয়ে হাতলটা পাকড়াই–কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সামান্য বাহুবলে আমার কিছুতেই আর নিজেকে টেনে তুলতে পারি না। হাতল ধরে ভ্যানের দরজায় ঝুলতে থাকি। বৃথাই আমার জেলে যাওয়ার এই ভ্যানিটি–কেবলই আমার মনে হয়।
কাছেই একটা গোরা সার্জেন্ট দাঁড়িয়েছিল, সে না আমার পেছন থেকে এইসা এক শট মারলে না…!
তার সেই ধাক্কাতেই দরজা গলে ভ্যানের ভেতরে গিয়ে ছিটকে পড়েছি অবলীলায়। এই অযাচিত সাহায্যের জন্য সার্জেন্টকে থ্যাংকিউ বলে যে ফিরে ধন্যবাদ জানাবো তার ফুরসত পাই না।
.
৪৩.
সার্জেন্ট যা কিকখানা ঝাড়ল না, আমি একবারে কর্নার। তার সেই এক শটেই আমার কর্নার হয়ে গেছে। দরজার গোল দিয়ে গলে ভ্যানটার কোণ ঘেঁষে গিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়লাম। নড়নচড়ন নেই, জবুথবুর মত পড়েই রইলাম তেমনি।
না, বেহুঁশ হইনি, তবুও কেমন আচ্ছন্নের মতন পড়ে রয়েছি অনেকক্ষণ।
মনে হচ্ছিল অনেকক্ষণ, কিন্তু তা হয়ত নয়, একটু বাদেই একজনের সবল বাহু আমাকে টেনে তুলে তার পাশে বসিয়ে দিয়েছে বোঝা গেল।
চেয়ে দেখি দেবেন।
লেগেছে? লেগেছে খুব?
আমি ঘাড় নেড়ে জানাই-না। তেমনটা নয়।
হাড়গোড় ভেঙে যায়নি তো?
কে জানে!
কে জানে–তার মানে? ভেঙে গেলে তো টের পাবে–ব্যথা করবে বেজায়। হাত-পায়ের কোথাও কোনো টনটন করছে না তোমার?
মুখে বললাম বটে যে, না, কিন্তু যেহেতু হতজ্ঞান হইনি, মনের মধ্যে জ্ঞান টনটন করছিল বেশ।
ঘোড়ার চাট তো খেতে হয়নি আর, এই ভেবে সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করছিলাম। সামান্য এক জনবুলের চোটেই যদি এই হয় তা হলে ঐ সব অসামান্য অশ্বতমর পায়ের তলায় পড়লে কী দশাটাই না হত আজ আমার!
খুব বাঁচটা বাঁচা গেছে আজকে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি তাই ভেবেই।
আমি দেখেছি, এইভাবেই জীবনের দুঃখকষ্ট লাঘব করতে হয়, খেদ-বেদনা ভুলতে হয়। সব। পায়ে কাঁটা ফুটলে ভাবতে হয় পা-টা কাটা পড়তেও তো পারত ট্রেনে কিংবা মোটরে। তাহলে কী হতো? একটু কাঁটার ওপর দিয়েই ফাঁড়াটা কাটানো গেছে।
এ ছাড়া আর দুঃখ ভোলার কোনো সূক্ষ্ম উপায় নেই।
স্কুল পথ আছে অবশ্যি। রাবড়ি।
এক ভাঁড় তাই নিয়ে চাখতে চাখতে চললে জীবনের যত জুলুম, যত না দাবড়ি পলকে ভোলা যায়। এমন কি, পথ-চলতি যে-শ্রীময়ীরা আশপাশ কাটিয়ে চকিতের দেখা দিয়ে অবলীলায় চলে যাচ্ছেন চিরদিনের মত, অচেনা থেকে শুধু স্মৃতিটুকু রেখে হারিয়ে গেলেন চিরকালের মত–একেবারেই, সে কষ্টও আর মনে তেমনটা লাগে না।
মিষ্টি জিনিসের কোনোটা অধর পথে সেঁধিয়ে হৃদয়ে গিয়ে জমে, কোনোটা আবার হৃদয় ভেদ করে উদরদেশে গিয়ে পৌঁছয়। তাই এক মিষ্ট বস্তু হারানোর মর্মভেদী দুঃখ ভুলতে হলে আরেক মিষ্টি দিয়ে তার মর্মান্তিকতায় গিয়ে শরণ নেওয়া, এক প্রিয়জনের বিরহে যেমন আরেকজনার প্রয়োজন। অন্য মিষ্টের দ্বারা অভাব মোচন না হলে তখন বিকল্প ওই মিষ্টান্নই!
জীবনের যত দুঃখ ভোলার মুখ্য উপায় সেই রাবড়ির ভাঁড়েই রয়েছে–অভাবনীয় ভাবে গতি স্ত্বং গতি স্ত্বং তমেকা–সেই ভবানী।
পাশে বসিয়ে দেবেন আমার হাত পা ঘাড় পিঠ কোমর সব টিপে টিপে দ্যাখে-লাগছে?
খুউব। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
তা হলে তো ভেঙেছে হাড়।
না না, ভাঙেনি কিছু, তবে এইবার যদি ভাঙে! আমি বলি, যা জোর টিপছ–না! ঘোড়ার চাটে কেমন লাগে কে জানে। তবে তোমার টেপার চোটে তো আমি গেলাম! তুমি আমার এই পদসেবা না করলে বাঁচি ভাই!
আমার দেখাদেখি তুমিও হাইজাম্প দিয়ে উঠতে গিয়েছিলে বুঝি?
হাইজাম্প? হ্যাঁ,তাই বটে। তবে ঐ জাম্পটাই শুধু আমার, হাই তোলাটা অন্যজনের। তবে হ্যাঁ, তুমি যা হাইজাম্পটা দিলে না, দেখবার মতই! বাঘরা যেমন-না পিছিয়ে গিয়ে লাফ মারে সামনে–দেখিনি কখনো, কানেই শোনা, তোমার ঐ লাফানিটা প্রায় সেই রকমই হয়েছিল ভাই! তবে আমি-আমি কিন্তু তোমার লাফাবার বাঘে ছিলাম না, ছিলাম পালাবার বাগে! কিন্তু পালাতে পারলাম কোথায়!
পালাতে যাচ্ছিলে বুঝি?
পারলুম কই। সামনে চুম্বকের টান ছিল না? সেটা আর কাটানো গেল না।
বুঝেছি! ঐ গঙ্গা! গঙ্গাই! দেশবন্ধুর আকর্ষণ! সমঝদারের মত সে মাথা নাড়ে।
না, তোমার সে-গঙ্গা নয় ভাই! আমার সুরধুনি! কিন্তু…।
কোথায় গেলেন উনি? এতক্ষণের পর আমি রিনির দিকে নজর দিই। কয়েদী গাড়ির সামনের বেঞ্চিতে আর সব ছেলের মধ্যে ঠাসাঠাসি হয়ে বসে রিনি ভয়ে যেন শিটিয়ে কি রকম চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমার কখানা হাড়ের শরীর নিয়ে সত্যিই আমার সর্বাঙ্গীণ সঠিক টিকে আছি কি না সেই সংশয়েই সে মুহ্যমান ছিল বুঝি।
তার দিকে তাকিয়ে আমায় এখন একটু হাসতে দেখে এতক্ষণে বুঝি স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল তার।
তুমি রেলিং ডিঙিয়ে ঢোকার মুখেই তোমাকে আমি দেখেছিলাম, নীচু গলায় বলছিল দেবেন, কিন্তু তোমার বোনের সঙ্গে গল্পে মশগুল হয়ে আছে বলে আমি আর তোমায় ডিস্টার্ব করিনি।…
বোন? শুনে আমার চমক লাগে।
ওই তো সামনেই বসে। সে ইঙ্গিতে দেখায়-বোন না?
হ্যাঁ, বোনই বটে। আমি বলি–যখন ভাইফোঁটা দিয়েছে তখন বোনই তো।
মা-র পেটের বোন নয় বুঝি?
না। সহোদরা নয়, তবে সহৃদয়া বোন বলা যায় নিশ্চয়।
বোনকে কনটেশনের ব্যাপার করে তুলে কথা আর না বাড়িয়ে ঐ একবাক্যেই আমার সেরে নেওয়া।
সে আবার কী ভাই?…সে আবার কী রকম বোন?
কি রকমটা বলব? ঠিক তোমার ঐ গঙ্গার মতই। তুমি তো খালি দেশবন্ধুর মধ্যেই গঙ্গা দেখেছ কেবল? উনি হচ্ছেন মোহানা মুখের গঙ্গা-যেখানে মহাসাগরের সঙ্গে মিশে গিয়ে উনি উন্মুখর, উদার, উচ্ছল–তাঁর মহাসঙ্গীত শোনাচ্ছেন সবাইকে। তেমনি আবার গোমুখীর গঙ্গাও রয়েছে না? হরিপাদপদ্ম থেকে বিগলিত হয়ে যে গঙ্গা শিবের কেশস্পর্শ করে…অম্বর হইতে সমশতধারা জ্যোতিপ্রপাত তিমিরে–দ্বিজেন্দ্রলালের সে-ই যে, মনে পড়ছে? সেও এক গঙ্গা আবার। গো অর্থে অনেক কিছু বলেন বাবা-গো বলতে এই পৃথিবীকেও বোঝায়। ধরিত্রী মায়ের অন্তর থেকে উৎসারিত সেই করুণা-সেও তো ভাই ঐ গঙ্গাই– তোমার আমার মায়ের স্নেহধারার মতই নয় কি…।
এ আবার কী কপচাচ্ছ এসব?
আমার মার কথাই। গঙ্গা শুধু দেশবন্ধুর মধ্যেই না, তোমার আমার সবার ভেতর দিয়েই সমানে বয়ে যাচ্ছে। উনি মোহানায় আছেন, মানে ঐ দেশবন্ধু আর আমরা আছি গঙ্গার ভিন্ন ভিন্ন ঘাটে। কেউ গঙ্গোত্রীতে, যেমন আমার সন্ন্যাসী বাবা ছিলেন এক সময়, কেউ হরিদ্বারে, যেমন আমার মামা, কেউ কাশীর মনিকর্ণিকায় আমার অন্নপূর্ণার মত মা যেমনটা, কেউ বা আবার এই কালীঘাটে। যেমন ধরো এই আমরা।
হয়েছে। হয়েছে! তত্ত্বকথায় আমার মস্ত হওয়া তার পছন্দ হয় না। তার বিরক্তি প্রকাশ পায়।
তেমনি সেই এক গঙ্গারই ফের অনেক নাম। আমিও সহজে ছাড়বার পাত্র নই; সুযোগ এলেই সুবিধা পেলেই মাকে আমার না জাহির করে যেন নিস্তার নেই। অলকানন্দা, জাহ্নবী, পদ্মা, ভাগীরথী-কত কী! আবার যার টানে রসাতলে যেতে হয়, ভূতলের সেই ভোগবতীও বলতে গেলে প্রকৃতরূপে গঙ্গাই। গঙ্গা, মানে হচ্ছে ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসাই আসলে গঙ্গা।
জানি জানি। তোমাকে আর অত ব্যাখ্যান করতে হবে না। সে অধৈর্য হয়।
কিচ্ছু জানো না। কী করে জানবে? এ সব মার কাছ থেকেই তো জানা যায়। কোনো বইয়ে মেলে না। তোমার মা কি বলেছেন তোমায়? তিনি না জানিয়ে থাকলে জানবে কোথা থেকে শুনি? গঙ্গার আবার কতো না ধারা-তা জানো? কত যে সঙ্গম। ধারণা করতে পারো?
গঙ্গাসাগর সঙ্গম কে না জানে বাবা!
গঙ্গা মানে তো ভালোবাসাই? কিন্তু ভালোবাসা আবার কত রকমের হয় যে। মনের ভালোবাসা, প্রাণের ভালোবাসা, দেহের ভালোবাসা–ভাগীরথী, যমুনা, সরস্বতী–এই ত্রিধারায় মিলেই না সেই ত্রিবেণীসঙ্গম। তার খবর রাখো?
সবাই রাখে। হাওড়া লাইনের হুগলি জেলায় বাঁশবেড়ে পেরিয়ে খানিকটা গেলেই সেই ত্রিবেণী। আমরা একবার চড়ুইভাতিও করে এসেছি সেখেন থেকে। আবার গয়া প্রয়াগ পার হয়ে এলাহাবাদের কাছেও বোধ হয় আরেক ত্রিবেণী আছে।
আরো আছে, আরো আছে। আরো ওপরে, আরো ওপরে–গঙ্গোত্রীর পথে। জলধর সেনের হিমালয় পড়ে দেখো। আবার আমাদের সবার মধ্যেও রয়েছে সেই ত্রিবেণী পরস্পরের সম্পর্কে এসে দেহমনপ্রাণের ভালোবাসা মিলেমিশে সেও এক ত্রিবেণী। পরস্পরের জীবনধারার সঙ্গমে ত্রিবেণী হয়ে ওঠা।
আর তোমার ওই সাগরসঙ্গম?
সেও ঐ ভালোবাসাই–আরো বিপুল, আরো বিরাট। ভগবানের প্রতি ভালোবাসা হলে সেটাই হলো সাগরসঙ্গম–সে কি সবার হয় নাকি? সে শুধু তোমার ঐ চিত্তরঞ্জন, রবীন্দ্রনাথ আর পরমহংসদেবেরই হয়েছে। আমার তো কালীঘাটের গঙ্গা–আমাদের জল কাদাগোলা ঘোলাটে। খালকাটা কালীগঙ্গার সেই ঘোলা জলেই স্নান সারতে গিয়ে খালি নাকানিচুবানি খাওয়া আমাদের।
ঘোল খাওয়া আর কি! সে হাসে-ঘোল খাওয়ানোও বলা যায়। আমাদের ভালোবাসাটাই হচ্ছে তাই। ঘোল খাও আর খাওয়াও।
তবে কারো কারো বরাতে কি আর ত্রিবেণীসঙ্গম ঘটে না?
ঘটে বোধ হয়। চাপা গলায় কথাটা সে কয় রিনির দিকে আড়াআড়ি কটাক্ষে চেয়ে কিন্তু দুটো বেণীই তো দেখছি মেয়েটার। বুকের দু-দিকে এসে পড়েছে।… আরেকটা মানে তোমার ত্রিবেণীর তৃতীয় বেণীটা বোধ হয় ওধারে ঝুলছে। তোমার বোন যখন, ত্রিবেণী না বলে ত্রিবোনী বলাই ভালো।
বোন আর কোথায় ও? গঙ্গার ঢেউ খেয়ে খেয়ে বোনটোন সব ধুয়েমুছে গিয়ে বন্ধুই বলা যায় এখন। মনে মনে বলি–ওর কাছে যতই ঋণী হই না, তিনি আমার বন্ধুই। বোনও আবার সে আমার।
পাশাপাশি সার বেঁধে দাঁড়ানো সব কটা কয়েদী-গাড়িই ভর্তি হয়ে উঠল একে একে লোহার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখে যাচ্ছি আমরা।
বোঝাই হবার পর গালিলা ছাড়তে লাগল একটার পর একটা। কোমরের বেল্টে রিভলবার বাঁধা, বেটন হাতে একজন করে সার্জেন ঢুকছিল গাড়ির ভেতরে আর একটা করে খাড়া থাকছিল বাইরের পা-দানিটায়।
আমাদের গাড়িটাও ভরে গিয়েছিল, সবগুলো ছেড়ে যাবার পর এটাও ছাড়ল শেষটায়।
বেটন হাতে সার্জেনটা ভেতরে এসে সেঁধুতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ছেড়ে দিল প্রিজন ভ্যান। ছুটল ভোঁক ভোঁক করে।
গাড়িটা ছাড়তেই আমার এ-পাশের ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠেছে–মহাত্মা গান্ধী কি জয়!
অমনি সেই সার্জেনটা বলের এক গুঁতো বসিয়ে দিয়েছে তার পেটে–আর সে কোঁক করে উঠে কুঁকড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নিজের হাঁটুর ওপরে। তারপরই দেবেন ওপাশ থেকে চেঁচাতে গেছে-ব…
অমনি তার হাঁটুর ওপর এমন এক চিমটি কেটেছি না আমি–যার নাম রামচিমটি! চীৎকারটা তার বন্ করে উঠে গিয়েছে মাথায়! বন্দে মাতরম্-এর ছন্দপত হয়ে গেছে তার। সূত্রপাতেই বন্ধ!
সেও একটা শিব্রাম চিমটি বসায়-ভীতুর ডিম কোথাকার! চাপা গলায় সে আওড়ায়।
এখানে আর টুঁ শব্দটিও না! হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে সেই গলাতেই আমার জবাব জানো না? পড়েছ মোগলের হাতে-খানা খেতে হবে সাথে।…এখানে কোনো গোল পাকিয়ে না আর।
রিনির দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা আঙুল নিজের ঠোঁটে চেপে রয়েছে। নীরবে একই অনুপ্রেরণাই দিচ্ছিল সে আমায়।
পাশের ছেলেটা তেমনি কুঁকড়ে পড়ে আছে-নড়ছে চড়ছে না একদম। যতক্ষণ গাড়িটা চলল সেই রকমই পড়ে রইল সে। মাথা তুলতে পারল না আর।
থানায় গিয়ে গাড়িটা খাড়া হতেই গাড়ির দরজা খুলে গেল। প্রথম ছেলেটা লাফ দিয়ে নীচে নেমেই হাঁকল-বন্দে মাতরম।
সেই সার্জেনটা তক্ষুনি তার মাথায় মেরেছে বেটনের বাড়ি।
মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে ছেলেটা। শুয়ে শুয়েই চেঁচাচ্ছে আবার-বন্দেমাতরম। বনদে…
এগোতে পারেনি আর সে। আওয়াজের সঙ্গেই সার্জেনটা তার পেটে মেরেছে বুটের এক ঠোক্কর।
কোঁক করে উঠেছে ছেলেটা! আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই তার–অজ্ঞান হয়ে গেছে বোধ হয়। মাথার ফাটল দিয়ে রক্তের ফিনকি বেরিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে তার জামাকাপড়। রক্তে ভেসে গিয়েছে জায়গাটা।
মারা গেল নাকি ও? রিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে সভয়ে শুধোয়।
বুটের চোটে তো পিলে ফেটে মারা যায় শুনেছি-কোলোক ওদের বুটের ঘায়ে মারা গেছে ওরকম।
কী হয়েছে ওর কে জানে! রিনি কাঁদো কাঁদো হয়ে কয়ঃ ভাগ্যিস, তুমি আমার কথাটা রেখেছিলে, চেঁচাতে যাওনি। তা হলে তোমায়রা ঠিক ওই দশাটাই হতো। বলে সকৃতজ্ঞ নেত্রে সে আমার দিকে তাকায়।
তার কথা রেখে আমি যেন তাকে কত কৃতার্থ না করেছি।
প্রায় ওই দশাই হয়েছিল আমারও…গাড়িতে ওঠবার মুখটাতেই। সে কথাটা ওর কাছে আর প্রকাশ করি না।
ভাগ্যিস, আমার পিঠের দিকে পিলে ছিল না, (কারোরই থাকে না বোধকরি )। তা হলে গোরার ওই সবুট পদাঘাতের পর এতক্ষণ আর আমায় এমন অটুট থাকতে হত না। সেই ঠোকুরেই টক্ করে বৈতরণী পার হয়ে যেতাম।
রিনির সশঙ্ক নেত্রের মিনতি রেখে সেদিন ওকে যত না কৃতার্থ করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি চরিতার্থ হয়েছি আমি–টের পাচ্ছি আজ। সেদিনকার সেই রুলের গুঁতো উদরসাৎ করলে আজ আর এই চরিত-কাহিনী লিখতে হত না আমায়–এ বাবদে দক্ষিণার অর্থটাও মাঠে-মারা যেত, আমার মতই প্রায়। সবদিক খতিয়ে দেখলে সেদিন আমি খরচ হয়ে গেলে কোনোভাবেই তার কিছুমাত্র ক্ষতিপূরণ ছিল না।
সবাই আমরা নেমে এসেছি ভ্যানটা থেকে। আমার পাশের সেই ছেলেটি কিন্তু তেমনি কুঁকড়ে পড়ে রয়েছে। নড়ছে-চড়ছে না।
দেবেন এবং আরো দুজন ছেলে উঠে গিয়ে ধরাধরি করে তাকে নামিয়ে আনল ভ্যানের থেকে। রাখল এনে থানার চত্বরে।
সে বেচারীও চৈতন্য হারিয়েছে। কোনো হুঁশ নেই তারও।
থানার ওসি বেরিয়ে এলেন থানার ভেতর থেকে তক্ষুনি। আমাদের সবার দিকে তাকালেন একবার। বেহুঁশ ছেলে দুটির দিকেও দৃষ্টি গেল তাঁর। এক পাহারাঅলাকে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করতে বললেন।
একটু বাদেই একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে তাদের দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
.
৪৪.
থানার একটা ঘরে গিয়ে আমরা জমা হলাম সবাই। বাড়িটার সামনে একটা পার্ক আছে নজরে পড়ল। ছোটখাট পার্কটা। সেন্ট জে স্কোয়ার, বলতে শুনলাম একজনকে।
মুচিপাড়া থানায় নিয়ে এসেছে আমাদের, সে জানালো।
ঘরজুড়ে আমরা গুলতানি পাকাচ্ছি সবাই মিলে।
রিনি আর আমি একধারটিতে বসে গল্প করছিলাম। দেবেনও ছিল কাছাকাছি।
একেকজনকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছিল পাশের ঘরে, ও-সির কাছে। যে যাচ্ছিল সে আর ফিরে আসছিল না।
তারপর ডাক পড়ছিল আরেকজনের।
ফিরছে না কেন ওরা? গালে হাত বুলিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে নাকি? না, কী করছে কে জানে! আমার আশঙ্কা প্রকাশ পায়।
না-না- নামধাম জিজ্ঞেস করে লক-আ-এ নিয়ে পুরছে। সেখানে আমাদের সবাইকেই পুরবে, দ্যাখো না।
লক্-আপটা কী ব্যাপার ভাই?
থানার হাজত বলে না? তাই। দেবেন বলে, সারা রাত আজ হাজতবাস আমাদের। কাল সকালে দশটার সময় সবাইকে প্রিজন ভ্যানে করে ব্যাংশাল কোর্টে হাজির করবে। সেখান থেকে একেবারে সটান জেলখানায়।
আমি ফ্রক না পরে শাড়ি পরে এলে বোধ হয় ভালো করতাম। রিনি বলল মাঝখান থেকে।
কেন, এ কথা বলছিস কেন?
বড় দেখাত আমায়। শাড়ি পরলে মেয়েদের বড়সড় দেখায় না? তা হলে আর ওরা বয়েস টের পেত না আমার…ছাড়া পেতুম না…ছেড়ে দিতে পারত না আমাকে।
তা বটে! এমনিতেই তো মেয়েদের বয়েস টের পাওয়া যায় না! শাড়ি পরলে তো, আরও। তার কথায় আমি সায় দিই।
ফ্রক পরলে কেমন বাচ্চা বাচ্চা দেখায় না? খুকী ভেবে আমায় ছেড়ে দেয় যদি শাড়ি পরলে আমি নিজেকে চব্বিশ বলে চালিয়ে দিতে পারি অনায়াসেই।
মেয়ে বলেই তোমায় ছেড়ে দেবে ওরা, খুকী বলে নয়। দেবেন তাকে কয়।
তা হলে আমি দেখে নেব…কালকেই দেখে নেব ওদের… বলতে বলতে তারও ডাক এসে গেল।
সেও পাশের ঘরে চলে গেল। সেও ফিরল না তারপর আর।
লক-আপেই পুরেছে। ছেড়ে দিলে সে নিশ্চয় তোমার সঙ্গে দেখা করে যেত। যেত না? এ ঘরে তার আসার তো বাধা ছিল না কোনো।
দেবেন আমায় ভরসা দেয় বটে, কিন্তু তার কথায় আমি কোনই সান্ত্বনা পাই না। এবারও রিনি তার ঠিক ঠিকানাটা দিয়ে যায়নি। কে জানে সে আবার আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল কি না! এবারে একেবারে চিরদিনের মতই হয়ত বা।
মুচিপাড়া থানার থেকে আমরা সেই রাত্রেই লালবাজারের হেডকোয়ার্টারে রপ্তানি হয়ে গেলাম।
প্রিজন ভ্যানে উঠে আমি দেবেনকে বলি, রিনি কোথায়? সে তো কই নেই আমাদের সঙ্গে এই ভ্যানে?
একটাই ভ্যান ছিল নাকি? পাঁচ পাঁচটা ভ্যানে করে এলাম না আমরা? সেই পার্কের থেকে? আর কোনো ভ্যানে তাকে তুলে দিয়েছে। ঠিকই রয়েছে সে।
আহা, তাই যেন হয় গো। মনে মনে বলি। তাই ভেবে ভরসা পেতে চাই নিজের মনে।
কিন্তু না, লালবাজার লক-আপ-এ গিয়ে যখন আমরা নামলাম, সেখানেও দেখা গেল না রিনিকে।
তুমি যে বললে, সে আমাদের সঙ্গে এসেছে? কোথায় সে? শুধাই আমি দেবেনকে।
আলাদা ঘরে তাকে রেখেছে। জবাব পাই দেবেনের–মেয়েদের ছেলেদের সঙ্গে রাখে নাকি কখনো? বিশেষ করে এই রাত্তির বেলায়!
রাখে না? কেন রাখে না? কী হয় রাখলে?
কী হয় কে জানে! কেন রাখে না তা কে বলবে! তবে রাখতে নেই নাকি। রাখে না যে তাই জানি।
রিনিকৈ এখানে রাখলে, আমাদের সঙ্গে থাকলে কী যে ওর ক্ষতি হত আমি তো তা ভেবে পাই না। এমন বিচ্ছিরি লাগে আমার যে!…জেলে যাওয়াটাই যেন কেমন ব্যর্থ বলে মনে হতে থাকে।
যে জেলখানা স্বর্গোদ্যানের ন্যায় চোখের সামনে উদ্ভাসিত ছিল, তা যেন পলকের মধ্যে অশোকনের মত নির্বাসিত হয়ে যায়। সব আলো যেন নিবে যায় এক লহমায়।
লালবাজারের হাজতঘরে পৌনোর পরে আমরা চা আর টোস্ট পেলাম। দেবেন বলল, রাত্রের মত এই যা খেলে। এর পর হরিমটর! এসো এখন শুয়ে পড়া যাক আরাম করে–কী বলে?
সকালে উঠে আবার আমরা সেই এক কাপ চা আর খান দুই টোস্ট পেলাম।
কিন্তু রাতউপোসী খিদে কি তাতে বাগ মানে? পেট চুই চুই করতে লাগল আমার।
আর কিছু খেতে দেবে না এরা? একদম না? আমি কুঁই কুঁই করি–আবার কখন খেতে দেবে তাহলে?
এখানে বোধ হয় আর নয়। দেবেন কয়, দুপুরে টিফিনের সময় সেই আদালতের লক আপ- এই যা চা টোস্ট দেবে হয়ত-এই রকম আবার। সেখান থেকে জেলে নিয়ে যাবার পর সেইখানেই মিলবে ভরপেট খাবার। ডাল রুটি তরকারি-বেশ মোটা মোটা রুটি, পালা পাতলা ডাল আর জংলী যত তরকারি। সন্ধ্যের আগেই খেতে দেবে সবাইকে। খাইয়েই ঢুকিয়ে দেবে যার যার সেলে।
সেই সন্ধ্যের সময়? শুনেই আমি মুষড়ে যাই। তার কথাটা কেমন যেন খট্ করে কানে লাগে–খটকাটা লেগেই থাকে।
জংলী তরকারিটা কী ভাই? উসকে উঠি আমি তার পরেই। জানতে চাই।
বনজঙ্গল কেটে বানানো। পাড়াগাঁর ঝোঁপঝাড়ে যে সব কাঁটা গাছফাছ আর আগাছা গজায় না? তাই সব কেটে হেঁটে নিয়ে আসে কোত্থেকে। তারই জগাখিচুড়ি করে দারুণ এক ঘ্যাট বানায়। যত খুশী খাও–যত চাও। এন্তার দেবে।
কি রকম খেতে?
ওই একরকম। সে বলে-রোজই ওই একরকম। রোজ বিকেলেই ওই রুটি তরকারি। সকালে ঘুম থেকে উঠে অবশ্যি কিন্তু অন্য রকম–গাদাখানেক লসি দেবে তোমায়–মুখ ফেরাতে পারবে তখন। খাও না কষে যত খুশি। পেটভর্তি পাবে তোমার।
লপসিটা কী জাতীয়? কি রকম আবার?
ডালে চালে মেশানো ঘন্টের মতন।
ও! খিচুড়ি! তাই বলো না সে তো খেতে ভালোই হে! খাসা! উপাদেয়।
খাসা? হ্যাঁ, খাসাই বটে। দেবেনের দ্বিমত দেখি না–সকালে খিদে পেটে খেতে মন্দ লাগে না বলতে কি!
রোজ দেয়? ঐ লপসি-রোজ রোজ?
রোজ রোজ। সে বলে–কিন্তু সে ওই সকাল বেলাতেই কেবল।
তবে তো ভালো। খুবই ভালো তা হলে। এতক্ষণে আমি উৎসাহ পাই, লালায়িত হয়ে উঠি–সকালবেলাতেই আমি অনেকখানি করে নিয়ে রাখব। আর সারাদিন ধরে খাব–একটু একটু করে–যখনই আমার খিদে লাগবে। ওই লসিই তো আমি মল্লিকবাড়ির সদাব্রতে খাই হে। সেখানকার ভাড়ারায় তাই তো দেয়?
লপসির কথায় মল্লিকবাড়ির স্মরণে খিদেটা যেন চাগাড় দিয়ে উঠল আরো। পেটের ভেতর ছুরি মারতে লাগল কেমন!…এমন সময় অভাবনীয় এক আবির্ভাব!…।
জনকতক মাড়োয়ারি ভদ্রলোক চাঙ্গারি চাঙ্গারি পুরি কচুরি লাড়ু চাপাটি প্যাড়া বরফি হালুয়া বালুসাই নিয়ে হাজির, আমাদের সবাইকে খাওয়াবার জন্যই। অযাচিত অভাবিত আমন্ত্রণ!
আরে! এ লোকগুলো যে আমাদের চেনা রে। দেবেন চেঁচিয়ে উঠেছে আচমকা।
চেনা কি রকম? আমি জানতে চাই–আমি তো কস্মিনকালেও দেখিনি কাউকে এদের।
আমি দেখেছি। অনেক অনেক দিন দেখেছি। এরা সব বড়বাজারের মাড়োয়ারি পট্টির মারাঠী গুজরাটি ব্যাপারী যত। বিলিতি কাপড় বিক্রি করে এরা সবাই। বড়বাজারে দিনের পর দিন এদের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পিকেটিং করেছি আমরা। কোনো খদ্দেরকে কিনতে দিইনি কিছু, ঢুকতেই দিইনি দোকানে–এদের চিনব না?
বলো কী হে?
এরাও চিনে রেখেছে আমাদের। ভালো করেই চিনে রেখেছে। কত দিন আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছি–এরা সব চিনে রাখছে আমাদের লক্ষ্য করছিস? এদের যা ক্ষতি করছি না আমরা? কোনদিন গুন্ডা লেলিয়ে দেবে আমাদের পেছনে। গুমখুন করবে আমাদের। মওকা পেলেই হয়ত বা খতম করে দেবে আমাদের দেখিস্। আড়ালে আবডালে অলিগলিতে সেই সব গুন্ডারা বেটপকা পেলে বেমক্কা মার লাগাবে আমাদের।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, তাই আমাদের ধারণা হয়েছিল। যাদের আমরা লাখ লাখ টাকার লোকসান করেছি তারাই আজ খাবার নিয়ে এসে খাওয়াচ্ছে আমাদের! আশ্চর্য!
মহাত্মা গান্ধীর মাহাত্ম্য! এই বলে অম্লানবদনে তাদের পুরি কচুরি মুখের মধ্যে পুরতে থাকি আমরা।
খেয়েদেয়ে হাঁক ছাড়ি মহাত্মা গান্ধীজী কি জয়।
খাইয়ে দাইয়ে খুশী হয়ে হাসি মুখে চলে যায় তারা সবাই।
লক্-আপের পাহারাওলারাও মৃদু স্বরে আমাদের জয়ধ্বনিতে যোগ দিয়েছে। আমাদের পুরি কচুরির ভাগ তারাও পেয়েছিল কিছু কিঞ্চিৎ। সেখানকার ঝাড়ুদাররাও বঞ্চিত হয়নি।
ভাগ্য কারো একার নয়, একজনের জন্য প্রসন্ন হয় না–বলতেন মা। সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয় বলেই তার নাম ভাগ্য। ভাগের যোগ্য বলেই ভাগ্য–আমার মার ব্যাখ্যায়। একজনের বরাত যে খোলে হঠাৎ, তার কারণ তার সঙ্গে অনেকের বরাত দেওয়া থাকে তাই। কারো মানসসরোবরের ভান্ডারে আকাশ থেকে বর্ষণ নামে, জল জমে ওঠে, গোমুখী বেয়ে নেমে আসে তাইছড়িয়ে যায় সারা ভূভারতে। কেবল গঙ্গাধরের জন্যই নয় গঙ্গা, জাহ্নমুনির জন্যও না, যে ভগীরথ টেনে আনলো তারও একলার নয়কো–সবার জন্যেই সেই ভাগীরথী।
সবাইকে খয়রাতির এই দায়ভাগ যে মানে না, রাতারাতি ক্ষয় পায় তার ভাগ্য। ভাগ্যের সঙ্গে এহেন ফেরেববাজি যে করে, তার বরাতেই ফের আর দেখা দেয় না সেই সৌভাগ্য। নেহাত মন্দ ভাগ্য হয়ত না হলেও তার আদায়ভাগে মন্দা পড়ে যায়। তার নিজের বরাতই বাড়ন্ত হয়।
লালবাজার থেকে যথাসময়ে আমরা চালান হয়ে গেলাম ব্যাংশাল কোর্টে। সেখানে দু মিনিটের মামলা। খানিকক্ষণেই পালা খতম।
কলকাতার বিভিন্ন এলাকার থেকে পিকেটিং আর আইন লঙ্ঘন করে যারা যারা ধরা পড়েছিল, গোছায় গোছায় জজ সাহেবের সামনে কাঠগড়ায় এনে খাড়া করা হচ্ছিল তাদের।
তারা বন্দে মাতরম্ হেঁকে গান্ধিজীর জয়ধ্বনি দিয়ে হাজির হচ্ছিল দলের পর দল।
তারপর মামুলি বাঁধা গৎ।
আদালতের থেকে প্রশ্নবাণ বর্ষিত হতে থাকে পরম্পরায়।
তোমরা দোষী না নির্দোষ?
কিচ্ছু আমরা কবুল করি না।
আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাও তোমরা? নিজেদের উকীল-টুকীল দেবে?
না, একদম না। এ আদালতকে মানিনে আমরা। করব না নিজের পক্ষ সমর্থন। যা। করেছি, বেশ করেছি। ছাড়া পেলে আবার করব। ইংরেজের আদালতকে আমাদের ঘোড়াই কেয়ার! আপনাদের আইনকানুনের ধার ধারি না।
ইত্যাকার নানা জনের নানান জবাব।
ব্যস্। ঐ পর্যন্তই। ঐখানেই আমাদের খেলা খতম। পরব শেষ। তারপর দুমাস, চার মাস, ছ মাস করে জেল হয়ে যায় জজসাহেবের মর্জি মাফিক।
তারপরেই আমরা প্রিজন ভ্যানে চড়ে চলে যাই সটান কলকাতার যত কয়েদখানায়।
গান্ধিজীর জয়ধ্বনি দিয়ে আমাদের পিজরেয় গিয়ে ভর্তি হই আমরাও। নামি এসে একেবারে জেলখানার সেই চত্বরে।
কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা অনেকখানি জায়গা জুড়ে জেলের সেই চত্বরটা, তার চৌহদ্দির ভেতর অনেক ছেলে, নানা বয়সের, বয়স্ক যুবকরাও ছিল তার মধ্যে, ঘুরছিলো ফিরছিলো ইতস্ততঃ। আমরা নামতেই বন্দেমাতরম্-এর হুঙ্কার দিয়ে সমাদরে তারা সবাই অভ্যর্থনা করে নিল আমাদের।
এগিয়ে গেলাম আমরা।
জেল আমার এই প্রথম দর্শন জীবনে। অবাক হয়ে তাকাচ্ছিলাম চারদিকে। সবার দিকেই।
এমন কি, যদিও তার আগেকার দেখা, তবু দেবেনেরও তাক লেগে গেছে মনে হল। সেও বেশ তাকিয়ে তাকিয়ে জেলটাকে দেখছে লক্ষ্য করলাম।
এ আবার কোন জেলে নিয়ে এলো হে আমাদের! চারধার দেখে সে বললে অবশেষে।
এখানে তো এসেছো তুমি আগে, তবুও চিনতে পারছ না?
না, এ জেল সে জেল নয়। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে বলে, কোন জেল যে কে জানে? রতে পারছিনে ঠিক।
তোমার সেই নিমগাছটা কই? দেখতে পাচ্ছ না তাকে? গোড়াগুড়ি সবটাই দাঁতন কয়ে ফেলল নাকি আমার সন্দেহ হয়।
নাঃ, কোথায় নিমগাছ! কোথথাও নেই।
দেশবন্ধুও নেই তাহলে এখানে?
নাঃ! তার দীর্ঘনিশ্বাসের দ্বিতীয় প্রস্থ।
হায়, কোথায় এলে? তোমার গঙ্গাও হারিয়ে গেল শেষটায়। হাহুতাশে আমার সহানুভূতি জানাই।
গঙ্গা হারাবে কেন? ওই সামনেই তো গঙ্গা। অচেনা একজন মাঝখান থেকে কথা পাড়ল, যোগ দিল আমাদের আলোচনায়–গঙ্গার ধারেই তো আমাদের এই জেলটা হে। এসো না দেখবে, দেখবে এসো গলা পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আমাদের।
গেলাম গঙ্গার সামনে।
গঙ্গার বুকে দূরে অদূরে অতিকায় যতো মানোয়ারী জাহাজ নোঙর করা।
খিদিরপুর ডক ছিল এটা। আর সব জেলে কয়েদী আঁটছে না কি না, হাজার হাজার ছেলে আসছে তো ঠেলে, রোজই আসছে। তাই খিদিরপুরের এ ডকটাকে ঘিরে নিয়ে আনকোরা এই জেলখানাটা বানিয়েছে। এর মধ্যেই হাজার চারেক এসে গেছে এখানেও। ছেলে জানাল।
না ভাই। এ গঙ্গা সে গঙ্গা নয়। গঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁফ ছাড়ল দেবেন।–গঙ্গা আমাদের হারিয়ে গেল ভাই। গঙ্গা বোধহয় আর পেলাম না আমরা—পাব না আর এ জীবনে।
আমার সুরধুনীও বুঝি হারিয়ে গেল সেই সঙ্গে। নিজের মনে মনেই আমি আওড়াই। জীবনের মতই বুঝি এবার! অন্তরের মধ্যেই আমার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে!
.
৪৫.
গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে মার কথাগুলোই মনে পড়ছিল কেবল…..সকলের দায় মিটিয়ে সবার ভাগ বিলিয়েই ভাগীরথী।
দুনিয়ায় কেউ একলার ভাগ্য নিয়ে আসে না রে, বলেছিলেন মা, সবার সঙ্গে সবার ভাগাভাগি। নিজের ভাগ্যে খায় না কেউ, সবাইকে ভাগ দিয়ে সবার ভাগ থেকে নিয়েই খেতে হয়, পেতে হয় সবাইকে। দিলে পরে তবেই পায়। সবাই সবার ভাগ্যের ভাগীদার।
একই দেহের অংশ প্ৰত্যংশের ন্যায় সবাই সবার অংশীদার। সবার সুস্থতায় সর্বাঙ্গীণ কুশল।
দাঁড়াতে হয় অবশ্যি নিজের পায়েই, পরের ওপর ভর দিয়ে নয়–সেভাবে দাঁড়ানোই যায় না আদৌ, এমনকি খাড়া থাকাটাই দায়, কিন্তু তাছাড়া আর সব বিষয়ে স্বভাবতই আমরা পরমুখাপেক্ষী। দিয়েই পেতে হয়, পেয়েই দিতে হয়–সব কিছুই–সব কিছুতেই। না দিয়ে পাওয়ার উপায় নেই–ঠিক যেন ওই চুমুর মতই।
এমন সময় একটা ছেলে ছুটতে ছুটতে এল-তোমাদের নাম কি শিবরাম আর দেবেন?
হ্যাঁ, কেন? কী হয়েছে?
ডাক পড়েছে আপিসঘরে।জেলের আপিসে। নাম রেজেস্ট্রি করতে হবে না? কম্বল-টম্বল ঘালা গেলাস দেবে যে তোমাদের।
গেলাম আমরা। দুখানা করে কম্বল দিল দুজনকে–একটা গায়ে দিতে আর এটা পাতবার জন্যে। এনামেলের থালা গেলাসও পেলাম সেই সঙ্গে।
এসো আমার সঙ্গে তোমরা। কোথায় থাকবে ঠিক করে নাও, এসো। দেখে শুনে নাও সব।
গেলাম তার সঙ্গে।
বিপুল পরিধি নিয়ে বিরাট গুদামঘর। থাকে থাকে খাড়া করা যত স্টীলফ্রেমের শেল পরের পর সাজানোচলে গেছে সারি সারি এধার থেকে ওধার অব্দি। শেলফ-গুলি তাকিয়ে দেখার মতই-পাঁচ ছটা করে তাক প্রত্যেক শেফে–তাকগুলো লম্বা চওড়ায় পাঁচ-ছ হাত করে।
বেশির ভাগ তাকেই কম্বল বিছানো। কম্বলের নিশানায় জানা গেল কারো না কারো দখলে। বুঝলাম এই তাকগুলিই আমাদের থাকবার জায়গা।
এবার পছন্দ করে বেছে নাও, কে কোনটা চাও। বলল ছেলেটা।
নিলেই হোলো একটা। নিতেই হবে যখন–পছন্দটা কিসের! আমি বলি- আচ্ছা ভাই, এইসব তাকগুলোয় থাকত কী আগে? ইয়া ইয়া এই সব তাকে?
ডক ছিল না আগে এটা? ডকের গুদাম ছিল তোডকের যত আসবাব-মালপত্তর থাকত কিনা এখানে। লোহা-লক্কর যন্তর-টন্তর–এই সব মনে হয়।
ছেলেটি ব্যক্ত করেনাও, পছন্দমত যে কোনটায় তোমরা কম্বল বিছিয়ে ফেলল। এই দুটো তাক নাও, কেমন?
তাকিয়ে দেখি– দুজনে এক তাকে থাকলে হয় না? আমরা বন্ধু তো, একসঙ্গে কি যদি? শুয়ে শুয়ে বেশ গল্প করা যায় তাহলে।
কোনো বাধা নেই। দুজন করে একটা তাকে থাকলে ভালোই তো। এর মধ্যেই অনেক ছেলে এসে গেছে, আরো কত আসবে। জায়গার টানাটানি পড়বে তখন। কাউকেই তখন একটা তাক একলার জন্য দেওয়া যাবে না।
সব জেলেই তো ওয়ার্ডাররা থাকে। থাকে না? কিন্তু এখানে তেমন দেখছি না কে হে? জানতে চায় দেবেন। –এ এক সৃষ্টিছাড়া জেল। সত্যি।
হঠাৎ বানিয়ে নেওয়া হয়েছে কিনা! আছে জনকতক জেলের ওয়ার্ডার। খাবার দেবার সময় তাদের দেখতে পাবে। পুলিস পাহারাওলারাও আছে কয়েকজনা-ঐ সদরেই থাকে। গেটের কাছে আপিস না? সেখানেই গেট আগলে রাখে, পাহারা দেয়।…নাও, থালা বাটি সব রেডি করো, রেডি হও, রুটি তরকারি-রাতের খোরাক সব এসে পড়বে এক্ষুনি।
আহারপর্ব সমাধার পর শয়নপর্ব। এমন ঘুম পাচ্ছিল আমার যে…
সবে শীতের মৌসুম। কলকাতার মধ্যে হলে তেমন কিছু শীত নয়। কিন্তু এই গঙ্গার ধারে ডক-এরিয়ায় শীত যেন ডাকাতের মতই পড়ল। এমন হঠাৎ পড়ল যে হাড়ে হাড়ে কাপুনি ধরিয়ে দিল আমাদের-রাত খানিকটা এগুতেই না! শেষ রাতে যা দাঁড়ালো তা আর বলবার নয়।
কম্পান্বিত কলেবরে গুটিসুটি মেরে যে করেই হোক কাটালাম তো রাতটা। সকালে উঠেই বেরিয়ে পড়েছি বাইরে। ঠাণ্ডায় হাত-পায়ে খিল লেগে যাচ্ছিল, সূর্য উঠতেই বেরিয়ে পড়েছি চত্বরে–রোদ লাগিয়ে একটুখানি গা গরম করতে। ঠাণ্ডামারা অবশ দেহটা বাশিয়ে নিতে হবে। সব ছেলেই রোদ পোহাতে বেরিয়েছে। কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা বিরাট সেই প্রাঙ্গণটা এখন ছেলেয় ছেলেয় ভর্তি-গুলতানিতে গুলজার! বাঙালী আছে, বিহারী আছে, পাঞ্জাবীরা আছে সেই দঙ্গলে-কত হবে সংখ্যায়? এক হাজার? দু হাজার? আড়াই হাজার? কে জানে কতো!
খাতার পরে হিসেব কষতেই আমি পোক্ত নই, এমনি মাথাগুনতিতে পাত্তা পাবো?
দেবেনও এসে জুটেছে একটু পরে।
খানিকবাদে ঘণ্টা বাজল সদরে। সদর ফটকের কাছটায়।
কিসের ঘন্টা ভাই? শুধালাম একজনায়।
খাবার ঘণ্টা। সে বললে–খিদে পায়নি তোমাদের? ব্রেকফাস্টের ঘন্টা পড়ল। লসি দেবে এবার। তোমাদের থালা বাটি নিয়ে গিয়ে দাঁড়াও গে! লাইন দিতে হবে–জানো?
তাই নাকি? আমি আর দেবেন আমাদের থালাবাটি আনতে দৌড়ই। ঘুম ভাঙার পর থেকেই খিদের ঘণ্টা বাজছিল পেটে। সকালের খিচুড়িভোগের ভিড়ে গিয়ে ভিড়তে মোটেই দেরি করি না।
গাদাখানেক লপসি গেলার পর শীতটা যেন কাটলো সত্যিই। শীত শীত ভাবটা গেল। একটু গরম হোলো হাত-পা।
এতক্ষণে যেন বাঁচলাম–উঃ! হাঁফ ছাড়লাম আমি।–ঠাণ্ডাটা কাটলো ভাই।
ইস, কী ঠাণ্ডাই যে, গেছে কাল রাত্তিরে। কী বলব ভাই, সারা রাত্তির আমি ঘুমোতে পারিনি…।
নাক ডাকিয়েছ সমানে। আমি বাধা দিয়েছি তার কথায়।
সে ওই তন্দ্রার ঘোরে। মাঝে মাঝে তন্দ্রা লাগে না? না ঘুমোলও? লাগে না? সেটা তাই।
তোমার তন্দ্রায় আমারো ঘা লেগেছে ভাই…বলতে যাই।
সে বলে-ঐ দারুণ শীতে কি ঘুমোনো যায় নাকি? একটা কম্বলে শানায় কখনো? ওরকম চারখানা কম্বল হলে তবে যদি গিয়ে এই বাঘা শীত কাটে।
তা বটে। আমার কোনো দ্বিমত ছিল না এ বিষয়ে।
দুপুরের খাওয়ার পর স্টীলের তাকে গিয়ে গড়িয়েছি খানিক। তারপর ঘুরে বেড়িয়েছি সারা ঘরে। বিরাট গুদাম ঘরে যেন তার চেয়েও বিরাট এক মেলা বসেছিল–মেলাই ছেলে মিলে জমজমাট চারধার।
কোথাও তাস পিটছে কয়েকজনায়। দাবা নিয়ে বসেছে ফের কোথাও কোথাও আবার স্বদেশী গান গাইছে কেউ কেউ।
মাঝে মাঝে কয়েকটা ছেলে দেখি টেক্সট বই নিয়ে বসে গেছে–পড়াশোনায় মন দিয়েছে ওর মধ্যেই।
আলাপ হোলো ওদের সঙ্গে।
টেস্ট পরীক্ষায় পাস করে এসেছে তারা সব। তাদের অভিভাবকরা বইপত্তর জমা দিয়ে গেছল আদালতে। জজ সাহেব এখানে বই আনতে কোনো বাধা দেননি। ফাইন্যালের জন্যে তৈরি হচ্ছিল তারা। দু-এক মাস করে জেল তো সবার। বেরিয়ে গিয়েই তারা পরীক্ষা দিতে বসবে। তারপরে ফের জেলে আসবে। ফের আবার-ডাক পড়ে যদি।
ভালো ছেলে তারা সবাই। আমার মতন বাউণ্ডুলে ভবঘুরে নয়।
বিকেল একটু গড়াতেই গুদামের ভেতরে ঠাণ্ডা ছড়াতে শুরু করেছে।
বাইরের চত্বরে চলে এলাম। বিকেলের পড়ন্ত বোদ এমন মিষ্টি লাগে যে
দেবেন একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখা গেল।
তোমার অপেক্ষায় ছিলাম হে! কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম জেলখানাটা।…আগাপাশতলা দেখলাম।
খানা আবার কোথায়? একখানাই তো ঘর মোটে।–যদিও একটু বড়োসড়ো। জেল বলতে হয় তো হ্যাঁ, আমাদের প্রেসিডেন্সিকে। কত সেল, কতো ঘর–কখানা তাক। কতোরকমের কয়েদী যে। ফাঁসীর আসামীও রয়েছে তার ভেতর-কনডেন্ড সেলে–একেবারে পৃথক। ফাঁসিকাঠ দেখতে পাবে তুমি, যেখানে ক্ষুদিরাম, কানাইলাল হাসতে হাসতে ফাঁস পরেছিল গলায়। সেই হচ্ছে জেল-যার ভেতর দিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে এখন। জাগ্রত গঙ্গা-সেই দেশবন্ধু! এটা কি জেল নাকি? এটা তো স্রেফ ডক ইয়ার্ড। জেলের নামে ইয়ার্কি একটা।
তা হোক, তোমার সে জেল তো আমি দেখিনি ভাই! এখানে একখানা ঘর তা ঠিক–কিন্তু কতো বড়ো একখানা! কী বিরাট ঘর বাবা! একটা গোটা ফুটবল মাঠ এঁটে যায়। একখানাই অনেক। কলোজনের সঙ্গে আলাপ হলো যে এতক্ষণে…
খুব সাবধান! যার তার সঙ্গে ভাব জমাতে যেয়ো না, বেঘোরে মারা পড়বে শেষটায় বলে দিলাম।
কেন, মারামারিটা কিসের আবার?
এর মধ্যেই বিপ্লবী দাদারা রয়েছেন তা জানো? টের পেয়েছি কালকেই। গান্ধীমার্কা টুপি মাথায় দিয়ে নিজেদের দলে ছেলে রিক্রুট করার তালে ঢুকেছেন তাঁরা। তার পেছনে আবার সি আই ডি-র স্পাইরাও সেঁধিয়েছে নিজেদের তালে। এই দুই চাকার চাপে পড়ে চিঁড়ে-চ্যাপটা হয়ে না যাও।
ল্যাপটাতে গেলে তো! ও ব্যাপারে হাতেখড়ি হয়ে গেছে আমার। ঢের ঢের আগেই। মা আর দারোগা–দুজনের কাছে নাকে খত দিয়ে ছাড়ান পেয়েছিলাম। ছেড়ে দিয়েছি সে পথ। ও-পথ আমার নয়, জেনে গেছি আমি।
নাকে খত দিয়ে পথ ছেড়েছে–কিরকমটা?
পিস্তল সমেত ধরা পড়েছিলাম না? অমনি ছাড়ান মেলে নাকি? রীতিমতন মন্তর আওড়াতে হয়েছে তার জন্য…।
মুচলেকা দিতে হয়েছিল বুঝি? জামিন দাঁড়িয়েছিলেন বাবা?
না না। বললাম না মন্তর?
শুনি মন্তরটা।
এই দিই নাকে খত/এই করি দণ্ডবৎ/আর প্রভু/আমি কভু/মাড়াবো না ওই পথ …এই মন্তর!
বাজে! দারোগার সামনে আর ছড়া কাটতে হয় না কাউকে। ইয়ার্কি করবার জায়গা পাওনি আর? পীরের কাছে মামদোবাজি? আমি বুঝিনে বুঝি?
বেশ। ইয়ার্কি তো ইয়ার্কি।
রাত হলেই আবার সেই শীতের ধাক্কা। এমন ভয় করছে আমার না!…সুর পালটায় তার–তাই ভেবে এখন থেকেই কাঁপুনি দিতে লেগেছে।
কাঁপছি আমিও। তবে শীতের ভয়ে ততটা নয়, যতোটা কিনা তোমার ভয়ে ভাই!
আমার ভয়? তার মানে? আমাকে আবার কিসের ভয়? সে হতবা হয়।
অধঃপতনের একটা আশংকা থাকে না মানুষের? পদে পদে ভয় থাকে না তার?
কিসের অধঃপতন শুনি? খুলে বলবে তো!
তুমি যে এমন তুখোড় খেলোয়াড় তা কি আমি জানি! কাল রাত্তিরে সেটা টের পেলা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখছো খালি! বল নিয়ে চষে বেড়িয়েছে সারা মাঠ এই পাস করছো, এই শুট করছে, এই কর্নার করলে! এই মধ্যেই আবার গোল বাঁধি বসেছো একেবারে। গো-ও-ও-ও-ওল!
গো-ও-ল গো-ও-ল বলে চেঁচাচ্ছিলাম নাকি? সে হাসে।
চেঁচালে তো রক্ষে ছিল। শুধু কি চেঁচানি! তোমার পাসের ধাক্কায় আমার প্রাণ যা যায়! এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল। এমন শট ঝাড়ছিলে মাঝে মাঝে যে তেতালার থে পড়ি মরি আর কি! শেষটায় যখন গোল বাঁধালে না, তখন কোনো-রকমে অধঃপতনে হাত থেকে সামলেছি। সেই তেলার তাক থেকে বেতালায় পড়লে হাড়গোড় ভাঙা + হয়ে যেতাম।
জাগিয়ে দিলে না কেন আমায়?
হ্যাঁ, জাগিয়ে দিই আর তুমি ঘুম ভেঙে উঠে মার লাগাও আমায়।
কেন, মারবো কেন? মারতে যাবো কিসের জন্যে?
ঠিক শট করার মুখটাতেই গোলটা তোমার আটকে দিলুম বলে? অমনটা হলে রাগ হল না তখন? আমি কি জানিনে! গোলে শুট করতে যাচ্ছে এমন সময় রেকারি অ সাই হাঁকলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে প্লেয়ারদের? তখন ওই রেফারিকেই মেরে বসে–আমি কী ছার
আচ্ছা আমি কথা দিচ্ছি তোমায়–আজ অমনটা হবে না আর। তুমি আমায় জাগি দিয়ো।
না ভাই, আজ আর আমি তোমার সঙ্গে এক তাকে শুচ্ছিনে! ঐ তেতলায় যে কিছুতেই নয়। আমি আজ একতলার কে শোবো। একলাই। তার থেকে ঘুমের ঘোর পড়ে গেলেও ততটা আর লাগবে না গায়।
আরো বেশি শীত শীত করবে তখন। দেখো তুমি। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞা হয়ে যাবে। জায়গাটা ভয়ঙ্কর ড্যাম্পো না? যত না ওপর থেকে ছপ্পর ফেড়ে পড়ে তার চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা নীচের থেকে মাটি খুঁড়ে ওঠে। গঙ্গার ধারের গুদোমঘর–মানু বসবাসের জন্যে তো বানানো হয়নি। স্যাঁতসেঁতে মেজেটা দ্যাখোনি কি! সে দম নি কয় : আকাশের চেয়ে মাটির ঠাণ্ডার জোর বেশি তা জানো? তাতেই মানুষ বেশি ঘায়ে হয়। তাতেই রিসি, নিউমোনিয়া ধরে-বুঝেছ?
না ভাই! অবুঝের মত বলি–সেই ভুইফোড় ঠাণ্ডাও সইবে আমার, কিন্তু তোমা শ্রীচরণের মার…মানে, ঐ ঠ্যাংএর ঠ্যাঙানি খেলে আর বাঁচবো না।
তোমার যা খুশি।…কিন্তু একজনাকে একটা তাক নিয়ে থাকতে দেয় না যে–বলল : সেই ছেলেটা কালকে? সে অন্য কথা পাড়ে। ঢের ঢের ছেলেরা আসছে না আরো ধরবে কোথায় জেলে, শুনি?
না যদি থাকতে দেয়, তুমি তোমার মতই আরেকজন খেলোয়াড়কে জুটিয়ে নিয়ে শোগে! এত ছেলের ভেতর কি তোমার মতন প্লেয়ার আরেকটা পাবে না?
আর তুমি? তোমাকেও তো একটা তাকে একলাটি থাকতে দেবে না। তুমি কী করবে?
দেখি নেহাৎ ঠাণ্ডা গোছের কাকে পাওয়া যায় আমার তাকে। কে থাকে দেখা যাক। তার তাকে থাকতে হবে।
থাকো গে! বলে রাগ করে বিরাগভরে সে চলে যায় আমায় ত্যাগ করে। আমি একা একা ঘুরতে থাকি গঙ্গার ধারটায়। ঘুরেফিরে মার কথাগুলোই মনে পড়তে থাকে আমার। গঙ্গার কলধ্বনির সঙ্গে মিশিয়ে।
এমন সময় প্রিজন্ ভ্যানে করে আদালতের থেকে আমদানি একদল ছেলে এসে পড়ল জেলের সদরে। দেখতে পেলাম দূর থেকেই।
গেট খুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। গাড়িটা ঢুকল এসে চত্বরের মধ্যে। বন্দেমাতরম্ হেঁকে নামল নতুন ছেলের দল।
এর থেকেও সমধ্বনি উঠল তাদের সংবর্ধনায়–তাদের অভ্যর্থনায়। এ ধারের যে ছেলেগুলো এখানে সেখানে ঘুরছিল, ভ্যানের সামনে ছুটে গেল সবাই। একটু বাদেই দেবেন। এসেছে আমার কাছে ছুটতে ছুটতে।
তোমাকে আর তাকে তাকে থাকতে হবে না। পেয়ে গেছে তাকে। না চাইতেই পেয়ে গেছ! তোমার বরাত।
বলছো কী? কথাটার ঠিক ঠাওর পাই না।
সেই মেয়েটার ভাই…তাই হবে বোধ হয়। সে আজ এসেছে-আজকের আমদানিতে। তার ভাই নিশ্চয়তার মতই দেখতে হুবহু।
কার মতন দেখতে?
তোমার সেই মেয়ে বন্ধুটির মতন গো! তোমার তাকের পার্টনার। যার তাকে তুমি ছিলে গো? সে জানায় আর তোমাকে কে পায় এবার!
শোনামাত্রই আমি দৌড় লাগাই। একটু এগিয়েই দেখতে পাই…
সেও দেখতে পেয়েছিল আমাকে। ছুটে এল আমার দিকে। এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। জড়িয়ে ধরল আমাকে…
ইস্! তোমাকে এখানে পাব আমি আশা করিনি… বলল সে।
তার দিকে চেয়ে আমি কথা কইতে পারি না।
ইস্ কী করেছিস রে রিনি! তোর এমন সুন্দর বেণী-চুলটুল সব ছেলেদের মতন হেঁটে ফেলেছিস!
ঠিক ছেলেদের মত না। বরং বেবিদের মতন বব করা–বলতে পারো।
কিন্তু সেই চুল? আহা! ওর কথায় আমার খেদ চলমাত্র কমে না।
আবার হবে। দেখতে দেখতে হয়ে যাবে, দেখো না!…এখন বলল তো হাফপ্যান্টে আমায় কেমন মানিয়েছে বলো না?
এবার ওকে আপাদমস্তক দর্শন করি-মাথার থেকে পা পর্যন্ত।
কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে তোকে না, কী বলব! তুই ছেলে হয়ে জন্মালেই ভালো করতিস বোধহয়। তাহলে, এই হাফপ্যান্ট পরে থাকতে পারতিস চিরকাল। তাহলে আর কোনোদিন তোকে শাড়ি-ফাড়ি পরতে হোতো না। এখন দুদিন বাদেই তো শাড়ি ধরতে হবে তোকে–পরতে হবে দিনরাত।
ওরা কিন্তু ধরতে পারেনি একদম। কেমন ধোঁকা দিয়েছি ওদের দেখছো তো। বলেছিলাম না যে আমি আসবই? এলাম না ঠিক? আটকাতে পারলো আমাকে? আমার সঙ্গে কেউ পারে? শুধু কেবল এই ভয় করছিল আমার… বলতে বলতে সে থেমে যায়।
কী ভয় করছিল?
কোন্ জেলে পাঠায় আমাকে কে জানে! জেলে ঢুকে যদি হতামার দেখা না পাই, তখন?…এ কি, তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছো না যে? খালি খালি আমার পা দেখছো কেবল…কেন, আমার পা কি তুমি দ্যাখোনি নাকি আগে?
দেখব না কেন? ফ্রক পরেই তো থাকতিস দিনরাত-কতো দেখেছি।
তবে এখন ওদিকে নজর দিচ্ছ যে খালি খালি। কেন, আমি কি আর দ্রষ্টব্য নই?
তোর মুখ্য অংশ তো দেখছিই, দেখবই, সম্মুখেই পাব চিরদিন, কিন্তু-আমি বলি কিন্তু তোর অ্যাততখানি খালি পা তো দেখিনি কখনো। ফ্রকে যে অনেকটা ঢাকা পড়ে থাকে। হাফপ্যান্টে আরো অনেকখানি বেশি দেখা যাচ্ছে না? চেয়ে দেখছিলাম তাই। হ্যাঁণ্ডসাম মেয়ে তো অনেক আছে, তোর মতন আছে কি না জানি না… :
আহা! কী আমি এমন হ্যাঁণ্ডসাম। কী রূপের ছিরি আমার। আমার চেয়ে ঢের ঢের সুন্দর মেয়ে দুনিয়ায় আছে, আমারই চোখে পড়েছে। বুঝলে? অনেক দেখেছি আমি।
আমি দেখিনি। একটাও দেখিনি এখনো। আমার নজরে পড়েনি অন্তত। থাকে থাকুক গে। আমার বয়ে গেল। আমি তা দেখতে চাইনে। তবে একথা আমি বলবই, হ্যাঁণ্ডসাম মেয়ে আরো থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু তোর মতন এমন লেগসাম মেয়ে আর দুটি নেই।
যাও। তোমার যততা ফক্কুড়ি কথা…
একটা কথা বলবো, রাখবি? তুই কখনো ভুলেও শাড়ি পরিসনি, ফ্রক পরে থাকিস চিরটাকাল… বুঝেছিস?
কেন, শাড়ি পরলে কী হয়? ভালোই তো দেখায় গো। আরো ভালো দেখায় মেয়েদের।
তা হলে তোর এই সুন্দর পদপল্লব তো আমি আর দেখতে পাব না।…
তাতে কি। মুখপদ্ম তো দেখতে পাবে। বলেই সে কী মিষ্টি না হাসে যে।–তাতেই তোমার লোকসান পুষিয়ে যাবে মশাই।
.
৪৬.
কাঁটাতারের বেড়ায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রিনি, দুজনেই আমরা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে।
সেই গানটা একটু গা না রিনি, গাইবি? পরশু মীর্জাপুর পার্কের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গাইছিলিস যেটা? গুন গুন করে ধরেছিলি যে সেই
তার দিকে তাকাই। তার রূপ গুণ দুই-ই বুঝি একাধারে পেতে চাই।
সেখানে আবার কী গান গাইলুম গো? সেই পার্কে? সেটা কি গান করবার জায়গা ছিল নাকি?
আহা! চাপা গলায় গাইলি না একটুখানি? আপন মনেই গেয়েছিস, মনের ভুলেই হয়ত বা। টের পাসনি তুই-কিন্তু বেশ লেগেছিল আমার। সেই যে…বহুদিন পরে/বঁধুয়া এলে/দেখা না হইতো/জীবন গৈলে। পদাবলী কীর্তনের এই কলিটা ধরেছিলি না তুই। ঐ একটা কলিই.তারপর সভায় কে একজন হোমরাচোমরা লোক এসে গেল, আর তোর কলিটা ভালো করে ফুটতে না ফুটতেই ঝরে পড়ল। সে আসতেই যা চেঁচামেচি পড়ে গেল না! তুইও থেমে গেলি তখন।
সে কলি তো সেদিনের গো, আজ আবার কেন? আজ তো সে কলি ফুল হয়ে ফুটেছে। এসে গেছি তো আমরা।…সে গান ফের এখন কিসের জন্যে?
সেই সুরটা কানে লেগে রয়েছে কিনা আমার এখনো, শুনছি সব সময়। তাই বলছিলাম। কী মিষ্টি যে গাইছিলি না।
সেদিনের আত্মবিস্মৃতক্ষণের তার স্বগতোক্ত সম্ভাষণের সেই অস্ফুট কলিতার সুমৃদু সুরভি এখনো যেন আমার কানে লেগে। কোনদিন প্রস্ফুটিত না হয়েই অকালে যদি ঝরেও যায়, তবু বুঝি তা চিরকালের মতই আমার প্রাণে লেগে থাকবে।
জেলখানায় কি কেউ গান গায়? এই কি গান গাইবার জায়গা? রিনি বলে-উপযুক্ত পরিবেশ কী এটা?
নয় কেন? যেখানে কিনা একটি বেশ পরী আমার পাশটিতেই, তার মতন পরিবেশ–আর আছে নাকি? আমার সামনে গঙ্গা আর পাশেই এই সুরধুনী-এর চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে বল?
গঙ্গা আর সুরধুনী আবার আলাদা নাকি? অবাক করলে!
গঙ্গা সবার আর সুরধুনী শুধু আমার-শুধু আমারই। আমার ভাষ্যকরণঃ তুই-ই আমার সুরধুনী!
আমি আবার কিসের সুরধুনী!
প্রথম সুর আমি তোর গলাতেই শুনি। সুরের সাড়া আর আমার প্রাণের সাড়া পাই তোর কাছ থেকেই। তোদর দিকের বারান্দা থেকে গাইতিস না, এধার থেকে আমি শুনতাম…কতো শুনেছি…সেই যে একদিন গেয়েছিলিস, ও গো দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে/আমার সুরগুলি পায় চরণ/আমি পাইনে তোমারে।…তোর ওই গানটা শুনেই না আমার প্রাণে সাড়া পড়ল প্রথম। প্রথম যেদিন এই গানটা শুনি…আমাকে লক্ষ্য করেই গাইছিলিস তো?
রিনি হাসতে থাকে। তোমার মাথা! কী না কী! ছেলেরা কী যে সব আলতু-ফালতু ভাবে…কিসের থেকে কোথায় আসে, নিজের মনেই কতো কী যে ধরে নেয়!…আশ্চয্যি। এটা যে রবিঠাকুরের গান গো, তাও জানো না? ভগবানের উদ্দেশে রচনা-কোনো মানুষটানুষের উদ্দেশে নয় আদপেই! তোমার জন্যে গাইতে যাবো কেন–কোন দুঃখে?
না গাইতেও পারিস, কিন্তু আমার তাই মনে হয়েছিল, তাই আমি বলছিলাম। রবিবাবুর গানগুলো সব কেমনধারা! সব কিছুতেই খাপ খায়–সবখানেই লাগে। মশারির মতন চারদিকেই খাটানো যায়। গানটাকে তুই ভগবানের জন্যে বলছিস? তাও হতে পারে, সত্যি! ভেবে দেখছি তাও হয়। কিন্তু অন্য কাউকে বাগানোর জন্য হলেও এমন কিছু মিথ্যে হয় না।…আমি ভাবছিলাম তুই আমার কানটাকে হাতের নাগালে পাচ্ছিস না, কান ধরে টানতে পারছিস না আমার, তাই ওই সুরের আঁকশি বাড়িয়েছিস! কিন্তু যাই বল তুই, ওই গানটা, কানে আসা মাত্রই তোদর বাড়ি ছুটে গেছলাম, মনে আছে তোর?
তুমি তো হরদমই আমাদের ধারটায় ছুটে আসতে তোমাদের ভাঁড়ারের দরজার ছিটকিনি খুলে–তা যে আমার জন্যেই আসতে তা কী করে জানব। আমি ভাবতাম বুঝি খাবার লোভেই। মা তোমাকে এটা ওটা সেটা খাওয়াতেন না…
এখন তো জানলি!…..তাতে কী হয়? বিস্কুটের জন্যে গেলে আর অমৃত হাতে পেলে…কিংবা যদি একটু ঘুরিয়ে বলি, অমৃতের নাগালে যেতে অযাচিত বিস্কুট গালে এলে এমন কি ইতরবিশেষ হয় শুনি? কোনো পাওয়াটাই তাতে মিথ্যে হয়ে যায় না। তারপরে তোর সেই গানটা? আমার বকুল বনে/যেদিন প্রথম ধরেছে কলি/তোমার লাগিয়া/তখনই বন্ধু! গেঁথেছিনু অঞ্জলি! এটা…এটাও কি তোর সেই ভগবানের জন্যেই গাওয়া? ভগবানের জন্যেই বাঁধা কবির এ গানটাও?
জানিনে বাপু! ছেলেরা এত কিছু ভাবতেও পারে! এমন সব ধরে নেয় যে, তার কোনো মাথামুণ্ডু যদি পাওয়া যায়?
তারপর, তোদর সেই কলকাতায় চলে আসার দিনটায় সকালে সেই আমাদের ছাদে ছুটে এলি না? সেদিন যে গানটা তুই গেয়েছিলি, এখনো তা আমি ভুলিনি…..সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে/ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা/ভুলো না…ভুলো না! সেদিন বাতাসে কী ছিলো তা জানো?তোমারই মনের মাধুরী মাখান/আকাশে আকাশে আছিলো ছড়ানোতোমারো হাসির তুলনা…!
মানেটা কী এর শুনি?
যাই মানে হোক, ভগবানের কিছু নয়। আমি ভগবানের হাসি কখনো দেখিনি ভাই–তুই হয়তো দেখে থাকতে পারিস। আমি মা কালীর জিভ ভ্যাঙানি পর্যন্ত দেখেছি…..দেখলে ভয় করে। তবে হ্যাঁ, আমার মা দুর্গার মুখ টিপে টিপে ঐ হাসিটা আমি ভালোবাসি। কী মিষ্টি যে! তবে এই চর্মচক্ষে নয়, দেখেছি তোর ঐ প্রতিমাতেই। তুইও দেখেছিস। সকলেরই দেখা।
গানের মানে…মানে, তার মর্মটা তুমি কী টের পেয়েছিলে বলো তো?
মানে, এই যে আমার সামনেই। তোর হাসি তো তুই নিজে দেখতে পাসনে, কী বুঝবি তার! ভগবান তোদের নিজেদের দিকে দেখতে দেননি, নিজেকে দেখতে পাস না তাই রক্ষে-নইলে তোরা কি কোনোদিন এই সব কালো ভূত ছেলেদের দিকে ফিরে তাকাতিস! কোনো ছেলে কি তোদর কৃপাদৃষ্টি পেতে আর? নিজেদের দেখে, নিজেদের নিয়েই মশগুল হয়ে থাকতিস! ভুলেও তাকাতিসনে আমাদের দিকে।
এই বুঝি সেই গানের মর্ম?
আমার মনে হয়েছিল কী–বলব? মনে হয়েছিল যাবার আগে, সেই যে আমরা বিকেলে রোজ মাঠের ধারে ধারে ঘুরতাম, পাটালি গুড দিয়ে চিড়ে খেতাম না? যাবার আগে সেই কথাটাই গানের ছুতোয় মনে করিয়ে দিচ্ছিলি তুই আমায়। সেদিন দুজনে দুলেছিন বনের মানে হচ্ছে সোজা বাংলায় গদ্য করে বললে, গুড চিড়ের দোলনায় সেদিন আমরা যে ঝুলে পড়েছিলাম, সে কথাটা যেন তুমি কখনো ভুলে যেয়ো না।…
এই তুমি বুঝেছিলে! চিঁড়ের ডোরে চিরতরে বাঁধা পড়ে গেছি আমরা–এই?
গানটায় তো তোর কথা ছিল না, আমার মনের কথাটাই ছিল যে। যে কথাটা নাকি আমার বলবার, সেইটাই তুই আমার হয়ে বলে দিয়েছিলিস! ওটা আমারই মর্মের গাথা ছিল…আমার মর্মেই গাঁথা হয়েছিল…সেই আমার মমগাথা এখনো এই মর্মে গাথা হয়ে আছে…এইখানটিতে। ওই সুরের ভিতে আমার মর্মর-গাঁথনি খাড়া করি নিভৃতে-আসল কথাটা হচ্ছে, তোর গানের কোনো তুলনা হয় না–যেমন কিনা আমার কাছে তোর কেউ সমতুল নেই। এত গান আর এত এত সুর তুই তুলোর মতন আমার মনের মধ্যে ধুনেছিস না! তাতে তোকে আমার জীবনের সুরধুনী ছাড়া আর কিছুই আমি ভাবতে পারিনে।
এক কথায় ওর গানের সঙ্গে ওকে আমি তুল্যমূল্য করি। ধুনে ধূল পরিমাণ করে দিই।
এতক্ষণে বুঝলাম! ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো আমার! সে হাসতে থাকে।
তুলনাহীন যে হাসিটি নাকি আকাশে আকাশে ছড়ানো ছিল সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার আমার ফুরসত নেই তখন–তাই যেন নিমেষের মধ্যে আমার সকাশে সুরের নিঝরিণী হয়ে প্রকাশ পায়–সেই রিনি!
এমন সময় সদরে ঘণ্টা পড়ে।
তৎক্ষণাৎ আমি সচকিত গান থাক, খাবার ডাক পড়েছে এখন। চল আপিসে যাই, তোর নাম লিখিয়ে লোটা কম্বলগুলো নিয়ে আসি গে…
লোটা কম্বল? লোটা কম্বল কিসের?
দুখানা করে জেলের কম্বল দেবে না আপিস থেকে? বিছানা করে পাতবার আর গায়ে দেবার জন্যে নিতে হবে তাই। সেই সঙ্গে রুটি তরকারি ইত্যাদি-রাত্তিরের খাবার যা দেয় তারপর।
আর ঐ লোটাটা কিসের জন্যে?
জল খেতে-লোটা মার্কা গেলাস দেবে একখানা। তাকে ঘটিই করো আর বাটিই বানাও।
রিনির নাম রেজেস্ট্রি করে আপিসের থেকে কম্বল দুটো জোটানো গেল।
চল, এখন বিছানাটা পেতে ফেলা যাক গে…
আর খাবার?
খাবার এসে দিয়ে যাবে সীটে সীটে ওয়ার্ডাররা। একটু বাদেই দেবে আর। থালা রেডি করে রাখতে হবে।…খিদে পেয়েছে বুঝি তোর?
তা একটু পেয়েছে…তবে খুব নয়…
বাস, খাবার পর আর তো কোনো কাজ নেই। খেয়েই ঘুম। সারা রাত যত পারিস ঘুমো না! তবে শীত এখানে বেজায়, ঘুমোতে পারলে হয়। মাঝ রাত্তিরে না, হাড় কাঁপিয়ে দেয়–বলতে কি!
কিন্তু কম্বলগুলোও বেশ ধক্কর দেখা যাচ্ছে। খুঁটিয়ে দেখে সে বলে-ঘোড়ার কম্বল।
জায়গাটা গঙ্গার ওপরেই তো, দারুণ ড্যামেজেটাও বেশ স্যাঁতসেঁতে। রাত্তিরে গোটা গুদোম জুড়ে যা কাশির সাড়া পড়ে যায় না–একাধার থেকে যা ঐক্যতান শুরু হয়। …এটা গঙ্গার পশ্চিম কূল কিনা কে জানে!
তার মানে?
বাবা বলেন যে, গঙ্গার পশ্চিম কুল বারাণসী সমতুল। কাশীক্ষেত্রের মতই সেটা পুণ্যভূমি নাকি! এটা তাই হবে বোধ হয়। কাশীবাসের পুণ্যফলে কাশীপ্রাপ্তি না হয় শেষটায়…হাড় কখানা এখানেই না রেখে যেতে হয় আমাদের।
তোমাকেও ধরেছে নাকি কাশিতে? সারা রাত তুমি কাশবে নাকি গো? তাহলে তো ঘুমোতে দেবে না দেখছি।
এখনো তো ধরেনি কাশিতে, পরে কী হবে কে জানে।
গুদোম ঘরে ঢুকে দেখি আমাদের তাকটা একেবারে ফাঁকা। আমার কম্বলগুলো পড়ে রয়েছে কেবল। দেবেন তার কম্বল গুটিয়ে কোথায় চলে গেছে। যতদূর চোখ যায় তাকে পর তাক তাকিয়ে দেখি, কোনো ফাঁকে কোথাও আর তাকে দেখা যায় না। কোনখানে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে কে জানে!
এই উপরের তাকটায়…এই যে আমার কম্বল পাতা রয়েছে…দেখছিস তো? উঠতে পারবি এই তিনতলায়?
অক্লেশে। তোমাদের দেশে গিয়ে কতো পেয়ারা গাছে উঠতাম দ্যাখোনি? তবে এটার একতলা দুতলা সবই তা খালি পড়ে রয়েছে–এগুলোয় বিছানা পাতলে হয় না?
পাতা যায়। তবে বললাম না, ঠাণ্ডটা বেজায়। ওপর থেকেও পড়ে আবার নীচের থেকেও ওঠে-ড্যাপো কিনা জায়গাটা। তেতালায় যা ঠাণ্ডা একতালায় তার তিন ডবল হবে বোধ হয়। এক কাজ করা যাক, আমাদের দুজনের চারখানা কম্বল তো? একটা কম্বল শুধু পাতি, তাতেই দুজনের কুলিয়ে যাবে–যাবে না? শীতের রাত্তিরে হাত-পা না ছড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুতেই আরাম…।
তাই হবে না হয়। তার দ্বিমত দেখি না-শিবরাম আর আরাম একাধারে নিয়ে না হয় মোয়া যাবে এখন।
আর তিনখানা কম্বল এক করে যদি গায়ে চাপাই? তা হলে শীতের বাবাও সেই দুর্গ ভেদ করতে পারবে না। তিনগুন শীত পড়লেও।
বেশ, তবে তাই হোক।
সন্ধ্যের খাবার সেরেই না কম্বলের ঘরে গিয়ে সেঁধুলাম দুজনায় ঘুমোনো যাক এবার, কী বলিস?
হ্যাঁ। যা ঘুম পাচ্ছে না!… বলতে বলতে ওর চোখের পাতা বুজে এসেছে। সেদিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থেকেই আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনে।
মাঝরাতে গুদামঘরের ছাদে ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে। সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছে আমাদের
ও কি গো? কিসের শব্দ ও?
বৃষ্টি পড়ছে বোধ হয়। শীতকালে মাঝে মাঝে অকালবর্ষণ হয় না?
এটা তো মাঘ মাস। খনার বচন আওড়ায় সে-যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।… ইংরেজকে তা হলে ধন্যি বলতে হয়। কী বলে?
ইংরেজ আমাদের রাজা নাকি? তার রাজত্বের প্রজা আমরা? এখনো তাই আছি নাকি? আমাদের হচ্ছে গান্ধী মহারাজ-তিনিই ধন্য। তাঁকেই ধন্যবাদ! আর পুণ্য আমাদের এই ভারতভূমি।
চড়বড় করে আমার কথাটার সাড়া পাওয়া গেল ছাদের ওপর। রিনি চমকে উঠে বসেছে তৎক্ষণাৎ। শিল পড়ছে। শিল পড়ছে। তার উৎসাহ দেখবার মতন।
কুড়িয়ে আনব বাইরে গিয়ে? কেউ কিছু বলবে না তো?
পাহারাওলারা গার্ড দিচ্ছে না বাইরে? পাকড়ায় যদি?
কী করবে আমার? জেল তো হয়েইছে, তার ওপর আবার কী হবে? আবার জেল দেবে নাকি? দেয় দিক, না হয় আরেক মাস জেল দেবে, তাই খাটব, তার কী হয়েছে?
রিনি বলে, তোমার ক মাস হয়েছে গো?
দুমাস। তোর?
মোটে এক মাস। আমার সঙ্গী আর যারা ছিল, তাদের দুমাস, তিন মাস করে সব।
জজসাহেব তোর চাঁদপানা মুখ দেখে ভুলে গেছে, বুঝেছিস? তাই তোর এত কম। এক যাত্রায় পৃথক ফল সেই জন্যেই। বঙ্কিমবাবু বলে গেছেন না, সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র।
আমি বঙ্কিম দৃষ্টিতে ওকে নজর দিই। বঙ্কিমের নজরানাও।
বঙ্কিমবাবুর বউ খুব সুন্দর ছিল বোধ হয়, তাই না?
সে আর বলতে! জান কী হয়েছিল একবার? বঙ্কিমজীবনীতে আমি পড়েছি। বঙ্কিম সস্ত্রীক যাচ্ছিলেন ট্রেনে। কোন ষ্টেশনে গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। একটা ছোকরা তাঁর বউয়ের দিকে ঘুরেফিরে আড়চোখে তাকাচ্ছিল আর ঘুরঘুর করছিল তাঁর কামরার সামনে। বঙ্কিম তাকে ডাকলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী করো তুমি, কতো মাইনে পাও, এই সব। তারপরে বললেন, দেখ বাপু, তাকাতে হলে ভাল করে তাকাও। কোনো আপত্তি নেই। দোষও নেই কোনো-সুন্দর জিনিস দেখবে–তাতে কী! সুন্দর তো দেখবার জন্যই হে, তবে অমন চোরা চাহনি হানা কিসের জন্যে? ও তো কিছু ঘোমটা টেনে বসে নেইকো। তাকিয়ে দ্যাখো ভালো করে! দেখবার মতন মুখখানা বটেই তো। তবে মুখ দেখেই যা, মন পাওয়া ভার। আমি আড়াই হাজার টাকার চাকরে, মাসকাবারে সব টাকাটা পায়ের গোড়ায় ধরে দিয়েও মন পাইনে ওঁর। আর তুমি কি ওই সামান্য টাকায় পাবে আশা করো?
ছেলেটা বোধ হয় মাথা নামিয়ে চোঁচা দৌড় দিয়েছিল তার পর?
কে জানে! তা আর লেখেনি বইটায়। তবে আমি ভাবছি কি, বাইরে গেলে পাহারাওলারা তোকে ধরে যদি…
ধরে ধরুক। আমার কুড়োনো শিলের আদ্দেক ভাগ দেবো না হয়…।
তারা যদি অতত সুশীল না হয়। তাতে না ভোলে যদি…এমন কি, তোর এমন সুন্দর মুখ দেখে?
এর জন্যে আরো এক মাস জেল হয় যদি আমার? ভালোই হবে তা হলে বলব। দুজনে মিলে এক সাথে বেরুতে পারব এখান থেকে।
আরে না না, সে কথা ভাবছিনে। ধর যদি তোকে পাকড়ে নিয়ে জেলখানার বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসে। বলে যে, যাও ভাগো হিয়াসে। চরে খাওগে যেখানে খুশি-এখানে আর তোমার ঠাঁই হবে না। তা হলে?
তা হলে তো মুশকিল। সেটা ভাবনার বিষয় বটে। ওর মুখে গুমোট দেখা দেয়।
তোর চেয়ে আমার ভাবনা আরো। বৈষ্ণব পদাবলীর একটি কলি, ঠিক গুঞ্জন-ধ্বনিতে নয়, আমার বেসুরো গলার গঞ্জনায় দক্কা গমক হয়ে বেরয়…তিমির দিক ভরি ঘোরা যামিনী/অথির বিজুরিক পাতিয়া/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/কৈসে কাটাও দিন রাতিয়া।
রাখো! কী সব উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাচ্ছো-বলো তো!
কি রকম? এটা মাঘ মাস নয় তাই বলছিস বুঝি। বৃষ্টি পড়লেই বাদলা হলেই মাঘ মাস ঘনিয়ে আসে। ঋতুতে না হলেও–মনের মধ্যে। মানে মনের মাঘ-বুঝেছিস?
আহা! আমি জানিনে বুঝি? পদাবলীর বই পড়িনি নাকি? তোমাদের বাড়ির সব বই-ই তো তোমার কাছ থেকে নিয়ে নিয়ে পড়েছি–কেবল একটা বাদে। একটা সংস্কৃত বই–তবে তার সঙ্গে বাংলা মানে দেওয়া ছিল। বাৎসায়ন না কার যেন-কামসূত্র না কী! বইটা তুমি আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলে, পড়তে দাওনি।
খুব খারাপ বই কিনা তাই। তার মধ্যে বিচ্ছিরি সব কথা। আমার হাতে একদিন দেখে না মা আমাকে পড়তে মানা করেছিলেন–এই বয়সে ওসব বই পড়তে নেই নাকি।
তুমি পড়োনি?
আগাগোড়া। কামসূত্রের তামাম আমার পড়া। লুকিয়ে লুকিয়ে আমি পড়েছিলাম, টের পায়নি মা। টের না পেলেই তো হলো। মার মনে দুঃখ না দেওয়া নিয়ে কথা।
কী ছিলো সেই বইটায়, শুনি?
সেসব কথা মুখে আনা যায় না। মানেও বোঝা যায় না ঠিকঠিক। আন্দাজে বুঝে : নিতে হয়–তবে একটুখানি ওঁর আঁচ পেয়েছি তার মধ্যেই। এককথায়, সেসব বলবার নয়, বলনীয় না, করণীয়।
তাহলে মার কথাটা তুমি রাখোনি? শোনননি একেবারে?
কোন্ কথাটা শুনেছি মার? জীবনে কোন্ কথাটা রাখলাম! মার কথা শুনলে তো মানুষ হয়ে যেতাম রে। এ দশা কি হতো আজ আমার! চাই কি কোনো মহামানব হয়ে যেতেও পারতাম হয়ত। কী সর্বনাশটা যে হতো আমার তাহলে!
মহামানব হওয়াটা কি সর্বনাশের?
কোনো স্বাধীনতা থাকত না তখন কোনো কিছুর। আষ্টেপৃষ্টে বাঁধাছাঁদা ছক বাঁধা গণ্ডীর ভেতর একলাটি–এদিকে ওদিকে তাকাবার যো নেই–এ পাশে সে পাশে বেড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবে যে, উপায় নেই তার। সর্বদা ঘেরাওয়ের মধ্যে বাস করো। ঘোরো ফেরো দিন রাত।
তোমায় বলেছে! কেন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ হওয়াটা কি খারাপ?
কে বলেছে? তাঁরা সব ওপর থেকে নামেন, একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন-ভগবানের বিশেষ নির্দেশ নিয়ে। তাই পালন করতে আসা তাঁদের। এ কথা তো মা-ই বলেছেন। আর আমরা? মাটি খুঁড়ে উঠেছি সব-ভুইফোড় সবাই। যা খুশি করার, যা কিছু হওয়ার স্বাধীনতা গেলে সবই গেল, আমাদের রইলো কি আর। ব্যক্তিস্বাধীনতা সবার চেয়ে বড়ো। তা জানিস? একথাটাও মারই বলা। কিন্তু এটা আমার মনের মতন কথা। এটাই আমি মানলাম। এত উল্টোপাল্টা কথা বলে না মা!।
মানেটা কী ওর? ঐ ব্যক্তিস্বাধীনতার?
কে জানে কী মানে! তবে মোটামুটি আমি বুঝেছি যা-বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর হতে গেলে আর রঙ্গলাল হওয়া যায় না।
রঙ্গলালতা কে আবার?
সেই যে–যিনি বলেছিলেন–স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়?
সে হচ্ছে ইংরেজের অধীনতার থেকে মুক্তি–সেই স্বাধীনতার কথাই ওতে বলেছিলেন কবি।
আমি সেটা সব রকমের স্বাধীনতায় ধরে নিয়েছি! স্বাধীনতার কি আবার ভাগাভাগি আছে নাকি? যোগবিয়োগ হয়? তবে তুই যে বললি, আমি উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়েছি–কোথায় চাপালাম শুনি?
পদবলী কীর্তনে ছিলটা কী, আমার মনে নেই নাকি? ছিল যে, সখিরে হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/ল্য মন্দির মোর। বলতে বলতে সে গুনগুনিয়ে ওঠে মৌমাছির মতইঃ তিমির দিক ভরি/ঘোরা যামিনী/অথির বিজুরিকো পাতিয়া/কান্ত পাহনুবিরহ দারুণ/ফাটি যাওত ছাতিয়া…
এই ছিল?
এই ছিল, নয় তো-বিদ্যাপতি কহে কৈসে গোঙায়ব/হরি বিনু দিন রাতিয়া……এও হতে পারে।
বিদ্যাপতি খুব বিদ্বান লোক হতে পারেন কিন্তু সত্যবাদী নন। আমি বলব।
সত্যবাদী নন?
এ ক্ষেত্রে যে না, তা আমি বলতে পারি। বাদলার দিনে মোটেই হরির জন্যে বিদ্যাপতির প্রাণ কাঁদছিল না…।
তবে কার জন্যে শুনি?
হলে পরে বিদ্যাপত্নীর জন্যেই হবে…।
শুনে সে হাসে-বিয়ে না হতেই বউয়ের কান্না কাঁদতে লেগেছো? বউ-এর বিরহ বুঝতে শিখেছ? টের পেয়ে গেছ এর মধ্যেই? বটে?
বৈষ্ণর পদাবলীর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজের মনে কী জিজ্ঞাসা ছিল তা জানিস?–শুধু বৈকুণ্ঠের লাগি বৈষ্ণবের গান? বলেছিলেন না তিনি–তাঁর কবিতায়? পড়িসনি?
পড়েছি তো।
আবার নিজেই সেই প্রশ্নটার জবাবও দিয়ে গেছেন। বৈকুত কুতিত রহে নিজ কুঠাভরে। বৈষ্ণবের গান শুধু বৈষ্ণবীর তরে।
কোথাও বলেননি এমন কথা, আমার মনে আছে বেশ। এটা তুমি মুখে মুখে বানালে এক্ষুনি।
মুখে মুখে বানাবো এত বড়ো কবি আমি হইনি এখন। মুখে মুখে শুধু একটা জিনিসই আমি বানাতে পারি, কবিতাই হয়ত সেটা, না হলেও কবিতার মতই প্রায়। বানাবো? বানাবো এখন? একটা মোটে! আমি সাধি–কিংবা আধখানাই–যদি বানাই?
না না না। সে নিজের মুখ চাপা দিয়ে কয়, এখানে ওসব নয়। কেউ যদি দেখতে পায় না-পেলেই আমাদের ধরে জেলের বার করে দেবে। দুজনকেই। ব্ল্যাক লিস্টে নাম তুলে দেবে আমাদের। কক্ষনো আর জেলে ঢুকতে দেবে না। তোমার এই ব্যক্তি স্বাধীনতা শিকেয় উঠবে–কি করে রঙ্গলাল হবে তখন?
.
৪৭.
বেশ কিছুক্ষণ গুম থাকার পর গুমোট কাটে ওর। তুমি অবাক করে দিয়েছ আমায়। বড়ো হবার বাসনা নেই তোমার? বিদ্যাসাগর হতে চাও না তুমি?
চাইলেই হওয়া যায় বুঝি? বিদ্যাসাগর হওয়া কি এতই সোজা ভাই। আমি গুমরাই।
চাইতে দোষটা কী? সবাই বড়ো হতে চায়। উচ্চাশা পোষণ করে। তুমি কেমন সৃষ্টিছাড়া যেন! বাবা বলেন, সাত হাত লাফাতে চাইলে তবে লোকে পাঁচ হাত লাফাতে পারে সেটাও কিছু কম নয়। সকলেই ধনে মানে জ্ঞানে গুণে বড় হতে চায়; তুমি যেন কী?
আমি কিছুই না। আমার সায় তার কথায় : কিছুই হতে চাইনে আমি। আমি শুধু আমিই হতে চাই আমিত্বের এই অহমিকা ছাড়া কিছুই আর নেই আমার, বুঝেছিস। কিছু না হওয়ার মজাটাই কিছু কম নয় রে!
বুঝেছি। কিন্তু ওই আমিত্ব ফলিয়ে চলা তোমার চলবে না–তোমাকে মানুষ হতে হবে–মানুষের মত মানুষ। বড় হতে হবে, উঁচুতে উঠতে হবে–আরো–আরো–আরো…
রক্ষে কর। আমার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই-মনের কোনো কোণেও না। উঁচু নজর নেই আমার, নীচু নজরও নেই অশ্যি তেমনটা, আমার ইচ্ছাটা কী জানিস? সবার সঙ্গে সমান–সবার মতন সাধারণ হতে চাই–যাকে বলে সমদৃষ্টি-সমতার প্রতি মমতা…
তুমি বড়ো হতে চাও না! আশ্চ!ি ঘুরে ফিরে তার মুখে সেই এক কথা। আমার নিরাকাঙ্ক্ষা নিয়েই তার মাথাব্যথা যত না!
বড় হওয়ার মত বড় দুঃখ আর নেই। বড় হওয়ার ভারী কষ্ট–তা জানিস? বিদ্যাসাগর মশায়ের জীবনী তুই পড়েছিস? চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা, বাড়িতে আছে আমাদের। তোদের পাড়ার লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে পড়িস না! পড়লে জানবি তখন। অনেক দুঃখে তিনি বড় হয়েছিলেন, বড় হয়ে অনেক দুঃখ পেয়েছিলেন। অত দুঃখ কষ্ট সইবার সামর্থ্য আমার নেই ভাই। আমি অমন কষ্টসহিষ্ণু না।
অনেক দুঃখ কষ্ট সয়ে বড় হয়েছিলেন তাতে কী, বড় হতে হলে অমনি করেই হতে হয়। তাতেই জীবন সার্থক।
কে বলেছে? ছোট হয়েই বড় সুখ। ছোটখাটতেই যতো সুখ আর মজা আর আনন্দ। অনেক কিছু ছেড়ে ছেড়ে, অনেকখানি ছেড়ে দিয়ে তবেই গিয়ে বড় হতে হয়। বহু ছাড়াছাড়ির পর একটুখানি বাড়াবাড়ি। আমি জীবনের কোনো কিছুই ছাড়তে চাইনে, ছাড়তে পারব না, সব কিছুই পেতে চাই, সব কিছুই হতে চাই আমি। সর্বত্যাগী বিদ্যাসাগর হয়ে কোনো সুখ নেই রে! অনেক আত্মত্যাগ করেই বিদ্যাসাগর আর অনেক আত্মসাৎ করেই আমরা-সর্বসাধারণ! তাঁর দিয়ে যাওয়া আর আমাদের হয়ে যাওয়া। মুহূর্তে মুহূর্তে আদান-প্রদানের মুহুর্মুহু এই হওয়া আমাদের।
তোমায় বলেছে। তার মানে তুমি মোটেই পরিশ্রম করতে চাও না– শ্রম বিমুখ–সেই কথাই বলো? অনেক বিদ্যা আয়ত্ত করলেই বিদ্যাসাগর হওয়া যায়। বিস্তর পড়াশুনা করতে লাগে। বিদ্যার্জন করতে করতেই তো বিদ্যাসাগর হয়।
আর, ওইটিই আমার দ্বারা হবার নয়। বিদ্যার্জনে আমার উৎসাহ নেই। আমার বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচ—
অথচ ভয়ের কিছু নেই তো পড়াশুনায়। রোজ রোজ অল্প অল্প বিদ্যালাভ-তার ফলেই মহাবিদ্বান হওয়া যায়। বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠা যায় এক দিন। বিন্দুর সঙ্গে আরেক বিন্দু জল–এই মিলেই বিন্দু বিন্দু জলযোগেই সাগর হয় তা জানো?
বিন্দু বিন্দু জলযোগে ডিসপেপসিয়াও হতে পারে তেমনি আবার। স্বাস্থ্য সমাচারে আমি পড়েছি। যখন-তখন টুকটাক খেয়ে খেয়েই অম্বল দাঁড়ায় একদিন।
যেটা কিনা তোমার ব্যারাম। সব সময় মুখ নড়ছে। চলছে টুকটাক…।
পেলে তো খাই, খেলেই তো পাই। টুকটুকে দেখলেই টুকটাক খাই… কিন্তু পাচ্ছি কোথায়?
হচ্ছে কী? বলেছি না যে, কেউ দেখলে পরে তক্ষুনি ধরে জেলের বার করে দেবে? ঢুকতে দেবে না এখানে আর?
না দেয় বয়েই গেল আমার! এখানে আসার জন্যে প্রাণ যেন কাঁদছে এমন!
না আসতে চাও নাই এলে! কে আসতে বলছে জেলে? কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে পড়াশুনায় মন দেবে বলল। আমিও তাই করব। ইস্কুলে ফিরে যাব আবার। তুমিও যাবে তো, কেমন? পড়াশুনা না করলে মানুষ হবে কি করে? মানুষের মত মানুষ? বিদ্যাসাগর না হতে পারো উপসাগর তো হতে পারবে। মাথা থাকলেই হওয়া যায়।
মাথা থাকলেই হওয়া যায় না মশাই, হৃদয় থাকা চাই। মাথা তো কতজনারই দেখা যায়, কিন্তু হৃদয় কজনার হয়? বিদ্যাসাগরের মতন অমন হৃদয়–আছে আর কারো? সেই তাঁর ছিল আর আছে এই চিত্তরঞ্জনের।
অতশত জানিনে বাপু, বিদ্যালাভ হচ্ছে অর্থলাভের জন্যে এই বুঝি। বিদ্যে না হলে টাকাকড়ি হবে না তাই জানি। আর টাকা কড়ি না হলে কোনো সুখই নেই জীবনে।
বিদ্যার মানেই জানিসনে তুই। বিদ্যে তোর ওই পুঁথিগত নয়–অত সোজা নয় ওর মানে।
বিদ্যালাভ যে সহজ নয় সবাই জানে। রিনি বলে : কিন্তু সহজ না হলেও ওই বইপত্তর পড়েই তা আয়ত্ত করতে হয়, বুঝলে?
বিদ্যা মানে বিদ্যামানতা। সেটা পুঁথিগত নয় মোটেই, অস্তিত্বগত। সোজা কথায়-হওয়ার মধ্যে। বিদ্যে বিদ্যে তো সবাই করে, কিন্তু তার মানে জানে কটা লোক? জানে শুধু আমার মা-মার কাছ থেকেই জানা আমার।
মোটেই সহজ মানে না। তা জানি।
নয়ই তো। বিদ্যার মর্ম বোঝা মোটেই সহজ নয়, বিদ্যাটাই সহজ। বিদ্যা সর্বদাই হচ্ছে–আমাদের দেহে মনে জীবনে–হচ্ছেই। হয়ে চলেছি অবলীলায়। যেমনটা নিশ্বাস প্রশ্বাস, যেমন কিনা রক্ত সঞ্চালন, তার মতই হচ্ছি সহজে। সেটা টের পাবার বুদ্ধি যখন তোর হবে…তোর কিংবা আমার, কিংবা অপর কারো–তখনই তার বিদ্যাবুদ্ধি হয়েছে, বুঝলি?
ছাই বুঝলাম।
তুই নিজে হচ্ছিস তা বুঝতে পারিস না? কিসে হচ্ছিস, কিসে তোর নিজের অস্তিত্ব টের পাচ্ছিস, সেটা ঠাওর হয় না তোর? বলিস কি রে! সেই অস্তিত্ববোধ হওয়াটাই তো বিদ্যমানতা–সেইটেই বিদ্যা। মনের মধ্যে একটা ইচ্ছে হলে তো জানা যায়, যায় না? সেটা মনের বিদ্যমানতা। মনের সেই ইচ্ছাটাকে কর্মের দ্বারা জীবনে বিদ্যমান করা, মানে কিনা, রিয়্যালাইজ করার কৌশলই হচ্ছে বিদ্যা-কৌশলই বল আর বুদ্ধিই বল। বিদ্যা আর বুদ্ধি প্রায় এক জিনিস-হরিহরাত্মা। একটা হলেই আরেকটা হয়।
এই হচ্ছে বিদ্যার মানে?
হ্যাঁ, এই বিদ্যার দ্বারাই, সেই যে বিদ্যয়ামৃতমতে বলেছে না–সেই অমৃত লাভ করা যায়। আমার বাবা কথাটা প্রায়ই আওড়ান কিন্তু মানে জানেন না মোটেই–জানে আমার মা। এবার তো বুঝলি?
বিদ্যায় অমৃত লাভ করা যায়? অমৃতটা কী? সেই যে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধে লেখা থাকে দেখেছি–যেনাহাং নামৃতাস্যা নোহং কিম কুৰ্য্যাম? সেই অমৃত?
সেই অমৃতই। একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেবো?
দাও। সে ঘাড় নাড়ে।
ধর এখন আমার মনে যে ইচ্ছাটা বিদ্যমান, যে ইচ্ছেটা হচ্ছে, সেটা যদি আমার কাজ দিয়ে এই জীবনে ফলাও করি তাহলে যা হয় কিনা তাই হোলো বি-বি-বি-বি
বিদ্যা বিতরণে বাড়ে। বিতাড়িত বিস্তৃতি লাভের পর আমার মুখ ফোটে–এই যে আমরা মুহূর্তের জন্য বিদ্যমান হলুম না? পরস্পরের অস্তিত্ব বোধ করলুম তো? সেই বিদ্যাটাই হোলো গে অমৃত। আর তাই হেলো গে আমাদের হওয়া।
তুমি মোটেই কোনো শিষ্ট আচরণ শেখোনি। হচ্ছে একটা সিরিয়াস কথা, তার মধ্যে এই ছ্যাবলামি? এটা কি শিষ্টতা?
সেই জন্যেই তো বিশিষ্ট হতে চাইনে রে। বিশিষ্ট হতে গেলে শিষ্ট হতে হয় গোড়াতেই। বড় হওয়ার ভারী অসুবিধে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা চলে যায়। আত্মপ্রকাশের সুযোগ থাকে না। যা খুশি হওয়া যায় না, যা ইচ্ছে করা যায় না। যা ইচ্ছে তাই হওয়ার করার অধিকার চলে যায়।
তুমি যাচ্ছেতাই হয়ে যেতে চাও?
পদে পদে বাধা পেয়ে বাঁচতে চাই না। প্রতি-পদে বাধ্য হয়ে বেঁচে কী সুখ? সামনে ঘোর অমাবস্যা নিয়ে? আমি চতুর্দশীর চোদ্দ কলায় পূর্ণ হয়ে বাঁচতে চাই–যখন কিনা সামনে আমার পূর্ণিমা। মানে, তুই বা তোর মতই কেউ আমার সম্মুখে। তখন আমার মুখে যা আসে বলব, করব।
নাঃ, তোমাকে মানুষ করতে পারলাম না। দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল তার–আমি চাইছিলাম তুমি মানুষ হও, মানুষের মত মানুষ হও একটা।
আমাকে মানুষ করতে চাইছিলিস নাকি? আমার মা হার মেনে গেল আর তুই পারবি? আমি হাসলাম –তবে হ্যাঁ, কখনো যদি তুই হার ম্যাজেষ্টি হোস তখন কী হয় বলা যায় না। তখন আমার হার অনিবার্য।
যাঃ-ওঃ!
তবে এ মণিহার আমায় নাহি সাজে-এ কথা আমি বলবই। তা হলেও এমনই হার চাই আমি, যে-হার কিনা কবির ভাষায় মুক্তোর হারই হবে নির্ঘাৎ! তা হলেও আমার সে হার… সেই হার…কবির ভাষায়…তোমার কাছে যে হার মানি সেই তো আমার জয়। জয় আবার ইংরিজি বাংলা দুই বানানেই হয়। এক কথায়, পরাjoy স্বীকার।
কথা শিখেছ খুব। আজেবাজে যত নভেল পড়ে বেজায় পেকে গেছ এই বয়সেই। পাকা পাকা কথা, কইতে পারো খুব। সে বলে, তোমার মত কোনো ছেলের মুখে এ সব কথা–এ ধরনের কথা কখনো শুনিনি।
তারা সব বিদ্যাসাগর হবে–সাগর না হলেও বিদ্যের আড়ত হবে নিশ্চয়ই। আদব কায়দায় রপ্ত হয়ে কায়দাকানুনে পোক্ত হয়ে একেকটা দিগজ হবে তারা। আমি সে অসুবিধার মধ্যে পড়তে চাই না…
অসুবিধার মধ্যে?
অসুবিধা নয়! যখন যা খুশি করতে পারব না, যা ইচ্ছে খেতে পাব না, তার চেয়ে ঘোরতর আর কী আছে? সাধারণ লোকের নানান সুবিধে, অসাধারণের তা নেই। ধর, আমি রাস্তায় আলুকাবলি খেতে পারি…খেতে খেতে যেতে পারি, কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু বিদ্যাসাগর হলে? লোকে আঙুল দিয়ে দেখাবে–বিদ্যাসাগরটা কী করছে দ্যাখোনা। আমার ওপর নজর থাকবে সবাইকার। আমি কাউকে নজর দিতে পারব না, নজরানা তো নয়ই। তা হলেই নিন্দে রটবে। আমার নিন্দের আমি পরোয়া করিনে…অতো নিন্দে-মন্দর ভয়ে ভয়ে চললে বাঁচার মতন বাঁচাই হয় না কিছু করা যায় না জীবনে। নিজের কলঙ্ক কেয়ার করিনে, কিন্তু বিদ্যাসাগর-গোত্র হয়ে সারা বিদ্যাসাগর সমাজের মুখে কালিম! লপন করতে চাইনে আমি।
রাস্তায় ওই আলুকাবলি খাবার খাতিরেই?
কেবল আলুকাবলি কেন, আরো কত কীই তো খাওয়া যায় রাস্তায়। রাস্তা ছাড়া জায়গা কোথায় খাবার? আমার কি বাড়িঘর আছে? আমার খাবার রাস্তা ওই রাস্তাতেই। খাবার রাস্তাও সেইখানে। ভালোমন্দ কিছু খেতে হলে, পেতে হলে, ওই পথচলতি। পথে যেতে যেতেই খেতে হয় আমায়।
কোনো ভদ্রলোক কখনো রাস্তায় খায়?
ভদ্রতার বালাই অনেক, বলছি না? ভদ্রলোক হতে চাইনে সেই কারণেই। এমন কি, চলার পথে সাথী, মনের মত সঙ্গী হলে–কবির কথায়, আমার পথ চলাতেই আনন্দ! দুজনে মিলেই খেতে খেতে যাও না! বাধা কী? কিসের অসুবিধে? এমন কি, যে জিনিস দুজনে মিলেই খাব, খাওয়া যায় নাকি যুগপৎ, পেলেই খায় আর খেলেই পায় যে জিনিস, তাও
তুমি ওই যেতে যেতেই খেতে পারো, খেতে খেতেই যেতে পারো…
সেই যুগপৎ জিনিস? রাস্তায়? শুনেই সে হাঁ হয়ে যায়।
হাঁ-করা মেয়ে আমার মোটেই সহ্য হয় না। বিশেষ করে চোখের সামনে। আমি সেই হাঁকারটা অবলীলায় বুজিয়ে দিতে যাই…
কিন্তু আমার মুখবন্ধের ভূমিকাতেই সে হাঁ হাঁ করে ওঠে–ও কী হচ্ছে? বারণ করলাম না তোমাকে?
না দিস নাই দিলি! তার জন্যে তোর সঙ্গে মারামারি করতে চাইনে। জানি তো, এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে। যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে। তবু যতই বেড়ে হোক না, কেড়ে নেবার জিনিস নয়। তবে একথাও কই, একটা না হোক, আধখানা দিতে পারতিস। চাঁদমুখের অর্ধেক দিয়ে ওইভাবেও কি আমায় অর্ধচন্দ্র দেওয়া যেত না?
অমন করলে এখান থেকে উঠে যাবো-একতলায় শোব গিয়ে।
তোর কম্বল-টম্বল সব নিয়ে? তাই যা। কোন দুটি তোর, মার্কা মেরে রাখিনি তো। ওপরের দুটোই টেনে নে তাহলে…
দুটো চাইনে, একটাই ঢের। একটাতেই হবে আমার। সেটাই পাতবো, তারই আধখানা গায়ে জড়ানো যাবে। একটাতেই হবে।
শীত করবে না?
আমাদের মেয়েদের অতো শীত করে না গো। দার্জিলিঙের ঠাণ্ডাতেও মেয়েরা ফিনফিনে শাড়ি পরে ঘোরে, দ্যাখোনি?
কবে আর দেখলাম! তোরা বড়লোক, দার্জিলিং গেছিস- আমার এজন্মে দার্জিলিং নেই। তবে হ্যাঁ, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি বটে, আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যায় আকাশ ফাঁকা থাকলে।…আরেকবার দেখেছিলাম বটে কাঞ্চনজঙ্ঘা… সেই ছাদেই… আমার মনে পড়ে। –সে-সে-সে-সে-সেই কা-কাকা-কানচন… কথাটা মুখে আনতে দাঁতে দাঁতে খিটিমিটি বাধায়, কাঁপুনির মধ্যে কাঁদুনি হারিয়ে যায় আমার।
ও মা! এ কী, কাঁপছ যে তুমি?
ই-ই-ই-হাঁ-হাঁ-হাঁ… হি হি করতে করতে আমি হাঁ হাঁ করি।
এত শীত করছে তোমার?
করবে না? একটু আগে বর্ষাটা হয়ে গেল না? তারই বর্শা এসে আমায় বিদ্ধ করছে এখন। এতক্ষণে। কী রকম করছে যে! দারুণ শীতে মানুষ হাটফেল করে তা জানিস?
বাবার মুখে শুনেছি বটে। তুমি এমন শীতকাতুরে তা তো জানতুম না। সে আমার গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখে-হ্যাঁ, কাঁপছে তো সত্যিই!
এক হাতে শক্ত করে জড়িয়ে আমার কাঁপুনি সে থামাতে চায়।
তিনখানা কম্বলে কি এই শীত শানায় রে! তার বাহুবেষ্টনে কম্পান্বিত আমি কই।
আরেকটা কম্বল এখন কোথায় পাই!
কম্বল নয়, লেপ হলে হতো… লেপের বদলে তুই হলেও হয়…তুই যদি কিনা সেই লেপ হয়ে যাস্! গায়ের ওপর তোকে লেপের মতন টেনে বিছিয়ে নিতে হয়। তা হলে তোর চাপে আর গায়ের তাপে শীতটা যায়। কিন্তু তা কি আর হয় নাকি! সেটা তো অভদ্রতা হয়ে যাবে। তাই না?
সে চুপ করে থাকে। তাকে ভাবিত দেখা যায় যেন।
থাক গে। তা চাই না। তার চেয়ে তার চে-চে-চে-চে. হিহিকারের সাথে আমার হাহাকার ব্যক্ত হয়-আজ রাত্তিরেই আমার হাটফেল হয়ে যাক না-হয়! রাত আরো গম্ভীর হলে শীত আরো পড়বে। শেষ রাত্তিরেই…।
রাত্রিশেষ অবধি এগুতে হয় না, তার আগেই সেই মুহূর্তেই সে নিজেকে আমার ওপর বিছিয়ে দিয়েছে–প্রলেপের মতই।
স্বর্গীয় উত্তাপে সঙ্গে সঙ্গেই গরম হয়ে উঠেছে আমার মন। আর মন, যেকালে দেহেরই অঙ্গীভূত, অথবা দেহই মনের অঙ্গীকার-সঙ্গীভূত হয়ে সেও গরম তৎক্ষণাৎ।
বাব্বা! এতক্ষণে কাঁপুনিটা থামলো তোমার? যা কাঁপছিলে না! কিন্তু এভাবে আমাদের কেউ দ্যাখে যদি,কী ভাববে কে জানে!
দেখছে কে? এই শীতে কম্বলের বাইরে মুখ বাড়িয়ে বসে আছে কেউ? সবাই এখন গুটিসুটি মেরে কুকুরকুন্ডলী। তা ছাড়া, ভাববেটা কী? তুই তো আর মেয়ে নোস। ছেলেই এখন। একটা ছেলের ওপরে আরেকটা ছেলে শুয়ে-তাতে কার কী ভাবার আছে? ভাবাভাবির কী আছে এতে?
তুমি জানো না, ভাবুক লোকরা ভাবেই। না ভেবে তারা পারে না। সে তার ছোট্ট মাথাটি নাড়ে, সবতাতেই তারা ভাবে, সব কিছু নিয়েই ভেবে থাকে। ছেলেদের এই বেয়াড়াপনাও তাদের ভাবনার বিষয় হতে পারে। যারা নিজেরা কাউকে ভালোবাসেনি, বাসে না, বাসতে পারে না, তাই কেউ কাউকে ভালোবাসলে তাদের ভারী খারাপ লাগে। বেজায় বিসদৃশ লাগে তাদের কাছে।
লাগুক গে, বয়েই গেল আমাদের। আমাদের কাছে তো অমৃতসদৃশ! তাহলেই হলো। কিন্তু আমি কী ভাবছি জানিস? বলে একটুখানি ভাবি-বলবো কথাটা?
বলো।
মুখ ফুটে বলা যায় না যে কথাটা। মুখ বুজেই বলতে হয়। আর, মুখটি বুজেই শুনতে হয়–বুঝলি? মুখ বুজেই কথাটা বুঝবার, তা বুঝেছিস?
বুঝেছি, আর বলতে হবে না। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। তুমি হাঁ করলেই তোমার
কথার আমি আঁচ পাই। পেয়ে যাই এক আঁচড়ে–তা জানো?; আঁচ পেলেও, না আঁচাননা পর্যন্ত ঠাওর পাওয়া যায় না ঠিক। মানে পাওয়া যায় না প্রমাণে। কথাটা বৈষ্ণ পদাবলীরই একটা কলি, কিন্তু মুখের ভাষায় তার তত্ত্ব ঠিক ব্যক্ত হয় না, গানের ভাষাতেই বলা যায় বোধ হয়। কিন্তু যেভাবে মুখর হব, সুরের সেই গলা কই আমার?
বৈষ্ণব পদাবলীর সেই কলিকে অগত্যা আমার সম্মুখেই প্রস্ফুটিত করি–কথাটা কী জানিস, এখন আমার যা মনে হচ্ছে না, তার কথাটাই রয়েছে এই কথায়। বৈষ্ণর কবির এই কথাটা রে! প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর। হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁদে। পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বাঁধে।
বুঝেছি। কিন্তু বুঝলেই বা আমি তার কী করছি! তোমার এ কান্না থামানেনা তো আমার কম্ম নয়। বিয়ে করে টুকটুকে একটি বউ নিয়ে এসো ঘরে। সে-ই যথাসময় যে তোমার এই দুঃখ দূর করবে। তাতেই গিয়ে সুরাহা হবে তোমার।
আমাকে আর এখানে সেখানে রাহাজানি করে বেড়াতে হবে না বলছিস? কিন্তু তেমনটি পাই কোথায়! সেই বহুরত্ন–তোর মতই হুবহু আরেকটা কি কোথাও পাওয়া যায়?
তপিস্যে করো। সে বলে আমরা যেমন বর চেয়ে শিবরাত্রি করি…
আমার তপস্যা করা লাগে না। না চাইতেই পেয়ে যাই সব। আমার মা-ই আমায় পাইয়ে দেয়। এই যেমন, অযাচিত তোকে এখন আমার বুকের ওপরেই পেয়েছি…আমার মুখের এত কাছটিতেই…
আমি ঐরূপ বলি। আর বলতে বলতে বৈষ্ণব পদাবলীরই আরেকটি কলি আমার মুখের ওপর ফুটে ওঠে–
আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়নু
পেখনু পিয়ামুখ চন্দা/
জীবন যৌবন সফল করি মাননু…
দশদিশ ভেল নিরদন্দা/
আজু মঝু দেহ/দেহ বলি মাননু/
আজু মঝু গেহ ভেল গেহা/
আজু বিহি মোহে/অনুকূল হোয়অল/
টুটল সবহু সন্দেহা/পাঁচ বান অব/
লাখ বন হোউমলয় পবন বহুমন্দা/
আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়নু…
চুপ! এক কথায় সে চুপ করিয়ে দেয় আমায়–যে কথাটা মুখ বুজেই বইতে হয় আর মুখ বুজেই শুনতে হয় নাকি সব সময়। হাঁ-করা নেহাত অবুঝ ছেলেরও বুঝবার দেরি হয় যে কথা!
.
৪৮.
সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে দেখি সে আমার পাশটিতে শুয়ে। বক্ষ বিহারের থেকে কখন সে আমার পাদেশে নেমে এসেছে কিছুই টের পাইনি।
নামলি কখন? টের পাইনি তো!
যখন তোমার কাঁপুনিটা থামল, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ দেখলাম–তার পরেই।
ঘুম হয়েছিল তোর?
ঐ ভাবে শুলে কখনো ঘুম আসে? অমন করে ঘুমোনো যায় নাকি?
আমি তো তোর গরমের আওতায় চমৎকার ঘুমিয়েছি। কিন্তু আমি তোর লেপের আরাম পেলেও তোকে তো আর গদির মজা দিতে পারিনি…খটখটে এই কখানা রে খট্টাঙ্গে শুয়ে…সত্যিই। যথার্থই আমার দুঃখ হয় ওর জন্যে।
শরীরটা বাগালেই পারো। কষ্ট করে দিনকতক নিয়মমত একটু ব্যায়াম করলেই মাসকুলার বডি বানানো যায়। তোমার বন্ধুর মতই চমৎকার চেহারা হতে পারে।
বন্ধু আবার কেটা আমার? কার কথা কইছিস?
দেবেন তোমার বন্ধু না। তার কথাই বলছিলাম।
তার চেহারাটা খুব ভালো বুঝি? ওর কথায় আমার কান জ্বালা করে, প্রাণে জ্বালা ধরে যায়।
ভালো নয়? গদির মতন নাদুস-নুদুস না হলেও…তাহলেও গদগদ হবার মতই চেহারা বইকি।
বুঝেছি।
আমার মনে গুমোট নেমে আসে, আমি কোনো কথা কই না আর। দেবেনের ওপর এমন রাগ হতে থাকে আমার যে…! কিন্তু সেই অন্তর্দাহের ওপরেই রিনির সদুপদেশের কথামৃত বর্ষিত হতে থাকে।
খালি যদি তোমার শরীরটাই বানাও, স্বাস্থ্যটাই মজবুত করো, কেবল দেহটা বাগাতে পারলেই অর্ধেক মানুষ হওয়া যায়। তার পরে ফের কিছু বিদ্যে সাধ্যিও হয় যদি বাকী আট আনাও এসে গেল তোমার। তার ওপর যদি টাকাকড়িও হয় আবার…এমনটা হলে হতে বাধ্যই, তখন তো ষোলো আনার ওপর আঠারো আনাই হোলো- পুরোপুরিই মানুষ হয়ে গেলে।
মানুষ হয়ে কাজ নেই আমার। কোনো গরজও নেই তেমন।
আর কিছু নয়, রোজ একটুখন আলাদা করে সময় রেখে একটুখানি ফ্রি-হ্যান্ড একসারসাইজ করলেই হয়। তাতেই ঢের। আমার দাদারা তো তাই করে। তাদের শরীর দেখেছো কেমন? তোমার ওই দেবেনের মতন অত সুঠাম না হলেও ভালোই বলতে হবে। তাও যদি না পারোনা করতে চাও তো মাইলটাক রোজ দৌড়লেও হয়। বাবার মতে দৌড়টাও কিছু খারাপ ব্যায়াম নয়। এমন কি, জোর কদমে কিছুক্ষণ হাঁটলেও হয়, তাতেও দম বাড়ে। সেও অনেকখানি।
কার জন্যে দৌড়ব শুনি?
কেন, আমার জন্যেই। রোজ সকালে কি বিকেলে, যখন তোমার সুবিধে, আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসবে। আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্যে। আর তোমার সেই আসাটা নেহাত পায়চারিতে না হয়ে এক দৌড়েই হয়ে গেল না হয়! একটু তাড়াতাড়িই এসে পৌঁছবে তাহলে।
যাব যে, তোদের বাড়ির ঠিকানা কি দিয়েছিস আমায়?
ঠিকানা দিতে লাগে না। কতো বড় রাস্তা আহিরিটোলা, কখানা বাড়ি সেখানে। একটা রাস্তায় কজনা ডাক্তার থাকে গো? পাড়ার সবাই সেখানকার ডাক্তারকে চেনে। চিনে রাখে, এলাকার প্রায় সবাই পেশেন্ট, কখনো না কখনো যেতেই হয় ডাক্তারের কাছে–খবর রাখতে হয় ডাক্তারের।
খবর কেউ কখনো দেয় নাকি কাউকে? কলকাতার লোকদের তুই এখনো চিনিসনি রিনি। কাউকে যদি শুধোই তিন্ন নম্বর বাড়িটা কোথায় দাদা? বলবেন দয়া করে? তক্ষুনি তার জবাব আসবে, ঐ যে, বাহান্ন নম্বরের ঠিক পরেই-বুঝলে দাদু? যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপান্ন। লাও ঠ্যালা।
আহা, নাই কেউ জানলো, তাই বলে কি কোনো ডাক্তারের পাত্তা পাওয়া যায় না নাকি? ডাক্তারের বাড়ির সদরে দরজার গায়ে তাদের নেমপ্লেট লাগানো থাকে না? তাই দেখেই তোবোঝা যায়, কে ডাক্তার, আর কে ডাক্তার নয়কার নাম কী। তার থেকেই তুমি ঠাওর পেতে কোন্ বাড়িতে আমি থাকি। পেতে না?
তা না হয় বুঝলুম। কিন্তু আমি এধারে তোর জন্যে ছুটোছুটি করে মরি আর তুই ওধারে পাড়ার কোনো মাসকুলার বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়িস বেড়াতে। আমার আসার আগেই ফুড়ুৎ!
তা কখনো হয় না গো। বাজিয়ে একবার দেখলেই না হয়?
না বাজিয়েই তোর যা ঢং দেখছি না! আমার ঢনৎকার ওর কথায় : বাজালে তো তোর ঢঙের আর অত থাকবে না!
রিনি বলে, আমি কোথাও নড়বো না বাড়ির থেকে–তুমি দেখো। তুমি আসবে আর আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব, তোমার ওপর কি একটুখানিও টান নেই আমার–তুমি বলতে চাও?
বেশ, সেটা হাতে হাতেই বাজিয়ে দেখা যাক না। আমার ওপর যা তোর টান তা বোঝাই গিয়েছে। আমি তক্ষুনি তাকে টেনে দেখতে চাই।
না না না। দেখছ না কখন সকাল হয়েছে। এতক্ষণে জেগে উঠেছে সবাই। কেউ আর এখন কম্বলের তলায় মুখ গুঁজে শুয়ে নেই।
কেউ তোর দিকে তাকাচ্ছে না। তুই তো আর মেয়ে নোস যে, তোর দিকে তাকাবে। আমি ছাড়া তোর দিকে দৃকপাত করার কে আছে এখানে আর?
অনেকে আছে। তুমি জানো না–তুমি কিছুই জানো না। সুন্দর ছেলেকেও লোকে। তাকিয়ে দ্যাখে। তা জানো?
সে খালি তোরা মেয়েরাই তাকাস–এই ছেলেদের দিকে।
না মশাই, অতো নেকনজর নেই আমাদের ছেলেদের ওপর। আমরা মেয়েদেরই বেশি লক্ষ্য করি। মেয়েদেরও ঠিক নয়, তারা কী পরেছে আর কেমন সাজগোজ করেছে তাই দেখি আমরা। কিন্তু তোমাদের ছেলেদের দুদিকেই নজর–মেয়েদের দিকেও তাকাও, আবার ছেলেদের দিকেও লক্ষ্য থাকে।
তোর ওপর এখানে তাক পড়েছেও নাকি কারো? কারো নজরানা পেয়েছিস তুই?
বলব কেন? আর বললেও তুমি বুঝতে পারবেনা। সে অন্য রকম চাউনি–যার জন্য কেবল সেই বুঝতে পারে, আর কেউ নয়। যে বোঝে, সেই বোঝে কেবল। সে আরেক রকমের দৃষ্টি!
কি রকমের দৃষ্টিটা? দেখে মূৰ্ছা যাবার মতন? নাকি, একটু একটু সন্দিগ্ধ? হয়ত তুই ঠিক ছেলে নোস তাই ভেবেই…?
না না, সে সব নয়। সে রকম সন্দেহ কারো হয়নি। কি করে হবে, যা একখানা ব্যান্ডেজ বেঁধেছি না ধরবার যো নেই কারো।
তবে আবার কী ভাবে তাকাবে…আহা মরি চাউনি যদি না হয়। রকমারি নজরের কোন আমি ঠাওর পাই না। তার কোনো নজির কখনো পাই নি তো?
সে তুমি বুঝবে না। সে আমি তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। সে যেন কেমন একরকমের চাওয়া! যাকে চায় সেই টের পায় কেবল।
বুঝেছি। ওই বলে তুই আমায় ভোলাতে পারবিনে। তুই যে তোর বাসায় আমার মুখাপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকবি আমি তার প্রমাণ চাই। সেটা আমি হাতে হাতে পরীক্ষা করে দেখতে চাই…।
হাতে হাতেই?
হাতে হাতে নয়, মুখোমুখি। আমার সম্মুখেই…এখানেই…এক্ষুনি।
কক্ষনো না। বাড়ি যেয়ো আমাদের–তখন যত চাও, যত খুশি… যত ইচ্ছে তোমার…
না। তুই কাল সারা রাত আমায় গাল দিয়েছিস, আমি তার কোনো জবাব না দিয়ে ছাড়বো? তার সোথ আমি নেব না–ভেবেছিস তুই?
না না না। এখানে এত লোকে সামনে, এত জনার চোখের ওপর…কে কোথায় তাকিয়ে আছে, লক্ষ্য করছে আমাদেরকে জানে! এখানে না, এখন না, দোহাই লক্ষীটি। দেশের জন্যে জেলে এসে এমন করে নিজেদের মুখ পোড়াতে নেই।
না…আমি শুনব না…কিছুতেই না…
ওমা, সত্যি তো! মুখটা তো পুড়িয়ে দিলে সত্যিই! কী হয়েছে তোমার গা? গালটা এমন ছাঁৎ কর উঠল যে আমার?
কিচ্ছু হয়নি-কী আবার হবে আমার? কেন, এখন আবার যে?… আমায় গাল দিচ্ছি, যে বড়ো? না সাধতেই নিজের থেকেই দিচ্ছিস যে ফের?
তোমার গা এত গরম কেন গা? জ্বর হয়েছে বোধ হয়। রাত্তিরের সেই কাঁপুনি দেয়া ঠান্ডাটা লেগেই… ভালো করে আমার আঁচ নিয়ে তার পরে সে আঁচায়
বেশ জ্বর। ইনফ্লুয়েঞ্জাই হবে হয়ত। তোমার এমন জ্বর হয়েছে আর তুমি তা টের পাচ্ছ।?
তুই থাকতে তোকে ছাড়া আর কিছুই আমি টের পাই না। টের পেতেও চাই না আর কিছু।
দাঁড়াও, তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি আগে। বিছানার ওপর সে উঠে বসে-বসে চারদিকে তাকায়-জেলের আপিসে গিয়ে খবর নিই গে। জেলখানায় ডাক্তারখানা থাকে আমি জানি। সব জেলেই থাকে, না থেকে পারে না। এখানেও আছে নিশ্চয়। হাসপাতাল, ডিসপেনসারি সব আছে। আমার বাবা যখন মহকুমা শহরে কাজ করতেন তখন তিনি যেমন জেলার ডাক্তার, তেমনি ঐ জেলের ডাক্তারও ছিলেন। রুগী দেখতে বাবাকে নিয়মিত যেতে হত জেলখানায়।
না, তোকে কোথাও যেতে হবে না। এখানে থাক। আমার কাছে থাক। তুই থাকলেই ভালো থাকব আমি।
কতক্ষণের জন্যে গো? যাব আর আসব তো। তারপর সারাক্ষণই থাকব এখানে। আমার তো জেলে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই আর। খালি খাওয়া আর শোয়া।
আমারও কাজ প্রায় তাইতো ভাই! শোয়া আর খাওয়া। শুয়ে শুয়ে খালি খাওয়া কেবল।
সেকথা বলছিনে। বলছি যে এখানে নাওয়া-টাওয়া তো নেই একদম–সে পার্টই নেই যে দুমাস এখানে আছি। যা-ব্যান্ডেজ বেঁধেছি না, কাউকে আর টের পেতে হবে না আমাকে। কিন্তু নাইতে গিয়ে খালি গা করলেই হয়েছে।
দরকার কি নাইবার? নেয়ে-টেয়ে কে কবে বড়লোক হয়েছে। আমিও তো নাইব না। শীতে আবার নায় কে?
কেন, তোমার আবার কী হোলো? নাইবে না কেন? নাইতে কী হয়েছে তোমার? আমারো খালি গা হতে লজ্জা করে ভারী। এত লোকের সামনে…সবার কেমন সুগঠিত শরীর–আর তার মধ্যে আমার এই হাড়-জিরজিরে চেহারা নিয়ে সকলের চোখের ওপর…
ব্যায়াম করতে বলছি তো সেই জন্যেই গো! দেখতে না দেখতে ওদের মতই হয়ে যাবে দেখো।
ওদের সব জন্ম থেকে পাওয়া–ব্যায়াম করে পায়নি কেউ। তবে কেউ কেউ তার ওপরেও ফের ব্যায়াম করে কিছু বাড়িয়ে থাকতে পারে-ঐ দেবেনের মতই হয়ত।
একই কথা। কেউ বড়লোক হয়ে জন্মায়, কাউকে আবার জন্মাবার পর বড়লোক হতে হয়। বড়লোক হওয়া নিয়ে কথা।
তবে হ্যাঁ, বাহাদুরি বটে তোর। কথাটা আমি পালটাই : যা একখানা ব্যান্ডেজ বেঁধেছিস। তোর বাঁধুনির তারিফ করতে হয়। তুই ডাক্তারি পড়লে পারিস-বড়ো লেডি ডাক্তার হবি। নির্ঘাৎ!
হবো তাহলে। পড়বো তাহলে–যদি তুমি ডাক্তারি পড়ো, ডাক্তার হও–আমি কথা দিচ্ছি তোমায় তুমিও ডাক্তার হবে, আমার সঙ্গে তোমাকেও হতে হবে কথা দাও তবে।
ইস, কী মুশকিলে যে পড়লাম! তুই আমায় মানুষ না করে ছাড়বি না দেখছি-ততর মতন মেয়ের পাল্লায় পড়লে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কারো কিছু থাকে না আর। আমি হাঁফ ছাড়ি-আচ্ছা, হবো ডাক্তার। হবই না হয়,কী হয়েছে? এখন তো নয়, পরে। পরের কথা। পরে। যখনকার কথা তখন। যখন হব তখন দেখা যাবে।
এখনকার কথা হচ্ছে, এখানকার ডাক্তারের খবর নেওয়া। এক্ষুনি যাই–দেরি করলে বেশি বেলায় ডিসপেনসারিতে ভিড় জমে যায় বেজায়।
আলতো করে একটুখানি আদর চুঁইয়ে সে উঠে পড়ে-চুপ করে শুয়ে থাকো লক্ষীটি। নেমেটেমো না। বেরিয়ে না বাইরে। জেলের গেটের কাছেই আপিসটা তো? যাবো আর আসবো।
একটু বাদেই ফিরে এসে জানাল–হ্যাঁ, আছে এই জেলে ডাক্তারখানা। ওষুধ দেয় রুগীদের-তবে এখানে তারা কেউ তোমায় দেখতে আসবে না, সেখানে গিয়ে দেখাতে হবে।
বলল বুঝি আপিসে?
না, আপিস পর্যন্ত যেতে হয়নি। বেরুতেই তোমার বন্ধুটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তার কাছেই জানলাম। এর মধ্যেই সে এখানকার সব কিছু জেনেছে…দেবেনদাই বলল আমায়।
অ্যাঃ, তুই কী বললি? ফোঁস করে উঠলাম আমি শুনেই না–এর মধ্যেই দেবেনটা তোর দাদা হয়ে গেছে? দেবেনা?
বাঃ রে। সে আমায় গোড়ায় রিনিদি বলল যে? দাদা না বলে আমি কী করি তখন?
রিনিদিও বলা-টলা হয়ে গেছে বটে? টের পেয়েছে সে এর মধ্যেই? সমস্ত?
হ্যাঁ, আমাকে ও রিনিদি বলেছে বটে, কিন্তু আমাকে ঠিক বলেনি। আমার সঙ্গে দেখা হতেই সে-ই আগ বাড়িয়ে এসে শুধোলো-তুমি রিনিদির ভাই না? তাই না? তক্ষুনি আমি যা সামলে নিয়েছি না! বলেছি-কী করে টের পেলেন? সে বলল, রিনিদির মতই দেখতে কিনা অবিকল। তোমার নামটি কী ভাই? আমি বললাম-রিনটু। আবার কেমন সামলে নিয়েছি দ্যাখো। তখন সে বলল, বাঃ, বেশ নাম তো! রিনি নম্বর টু রিনটু! রিনিদিকে আমি দিদি বলি তো। তুমিও তাই বলো! আমরা তাহলে ভাই ভাই হলাম আজ থেকে, কেন কিনা? তার জবাবে তখন আর আমি কি করি? বললাম, হ্যাঁ, দেবেনদা। আজ থেকে তাই। আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছি তার কথায়, কী করব?
কি আর করবি। সত্যি! ছেলের মতই কাজ করেছিস। কিন্তু সেই পার্কের থেকে থানায় আসার পথে কোন্ ফাঁকে যে সে তোকে দিদি বলে ডেকেছিল, আমি তো টেরই পাইনি।
আমিও না। এর আগে তার সঙ্গে আলাপই হয়নি আমার। দিদি হওয়া তো দূরের কথা। …হয়তো মনে মনে ডেকে থাকবে।
ভারী মিথ্যুক তো ছেলেটা। এমন রাগ হতে থাকে আমার দেবেনের ওপর-এক : নম্বরের লায়ার। হামবাগ কোথাকার। ফেথলেস, ট্রেজারার্স, বিশ্বাসঘাতক।
ছেলেরা ওরকম বানিয়ে বলে, বাড়িয়ে বলে থাকে, এতে কোনো দোষ হয় না। পরের মন-রাখা কথা কইতে ওরা ওস্তাদ। পরী হলে তো কথাই নেই।
ওরমন-রাখা কথা আমি বার করছি! বদমাইসের ধাড়ি। পাজি ইস্টুপিড গাধা আহামোক…
আহা, রাগছো কেন এত?
রাগব না? পরের দিকে হাত বাড়াতে চায়? পরের জিনিস লুফে নিতে হাত বাড়ায়। লোফার একটা!
রাগ করছো কেন? রাগের কী হল? ভাই-ভাই কি ভাই-বোন, এসব সম্পর্ক কি খারাপ?
বাঃ! আমি দাদা হতে পেলুম না, তুই আমায় দাদা বলে ডাকলিই না কোনো দিন–আর ও হতভাগাটা কোথা থেকে উড়ে এসেই না দাদা হয়ে গেল হঠাৎ?
দাদা হতে চাও তুমি? দাদা হবে আমার? বললেই হয়! সঙ্গে সঙ্গে সে সতর্কৰ্বাণী আওড়ায়–ডাকতে কী আর! কিন্তু মনে রেখো, দাদা হলে কিন্তু দাদাই হয়ে গেলে চিরদিনের মতন–তারপর আর আপসোস করতে পারবে না। কোথাও যদি কিছুতে আটকায়, আমার কোন দোষ নেই, সেটা কিন্তু বলে রাখলাম।
কোথায় আটকাবে? কোনো বাধা আমি মানলে তো? কেন, দাদাদের কি নিজের বোনদের আদর করার রাইট থাকে না?
তা থাকে। দাদার তো বার্থরাইট আদর, তবে যতটা শোভা পায় ততটাই। আদর করতে পাবে তুমি আমায়–কিন্তু ঐ বোনের মতই। মনে রেখো।
তবে আর কোথায় আমার আটকালো শুনি? তার বেশি আর আমি চেয়েছি কী? আসলে, পেলেই হলো আমার।
যখন আটকাবে তখন টের পাবে।…এখন তার কী।
তাহলে আর কোথায়, কখন আমার আটকাতে পারে… শুনি? শুনিই না?
গোধূলিলগ্নে গিয়ে। সে মুখ টিপে হাসে-যদি আমাদের বিয়ে আটকায়?
গোধূলিলগ্নীকৃত দশায় সেই সুতহিবুকযোগের সমস্যাটা আমি আমলই দিই না। অদ্যভক্ষ্য ধনুর্গণ, চিরকালের বাউন্ডুলের ভবিষ্যৎ ভাবনার বালাই নেই।
কোথায় বিয়ে তার ঠিক নেই। আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি। আমি মানুষ হলে তবে তে তুই আমায় বিয়ে করবি…আমি ডাক্তার হব, শরীর ভালো করব, খুব টাকা কড়ি উপায় হবে আমার…তোকে দোষ দিইনে, সব মেয়েই তাই চায়। নিছক ভালোবাসার জন্যে কখনো কাউকে বিয়ে করে না মেয়েরা–আমি ভালোই জানি। নভেলেও পড়েছি বিস্তর। তা আমিও মানুষ হয়েছি, আর তুইও আমায় বিয়ে করেছিস! দুই-ই শিবের অসাধ্য। শিবরামের সাধ্য কী! সাত মণ তেল পুড়লে তবেই নেচেছে আমার রাধা! আমি বলি-না, আমি অত গাধা নই ভাই! গাছের মেওয়ার জন্যে হাতের নগদ লাভটা ছাড়তে যাই কেন? তার আগে, ঢের আগেই–এখনই তো আমি দাদা হতে পারি যখন!
তা পারো। হতে চাও তো বলল।
হ্যাঁ, চাই হতে। এক্ষুনি–এই দণ্ডেই…
বেশ, ডাকছি তবে। দাদা…দাদা…দাদা…
কী বললি? শুনতেই পেলাম না। কানেই এল না–কথাটা ভালো করে বলবি তো? যেমন করে বললে শুনতে পাব তেমনিভাবে বল, যাতে বেশ করে টের পাই আমি।
খুব চেঁচিয়ে বলব? গলা ফাটিয়ে? জেলখানা চৌচির করে?
তাহলেও কানে ঢুকবে কি না কে জানে। আমার সন্দেহ থাকে–কান ফাটিয়ে বললেই কি শোনা যায় রে সব কথা। কান দিয়ে শোনাও যায় না–শোনাবারও নয় সব অন্যরকমের বলতে হয়, শুনতে হয়-তবেই কিনা শোনা যায়।
যে কথায় কর্ণপাত করা যায় না, দৃম্পাত করারও নয়, তা বুঝি মুখপাতে মুদ্রিত হলেই ভালো হয়। কিন্তু আমার সেই ধারণা ব্যক্ত করার আগেই কালকের রাতের অপ্রত্যাশিত শিলাবৃষ্টির মতই আচম্বিতে অকালবর্ষণ নেমে আসে…
শিব্রামদা…শিব্রামদা…শিব্রামদা… মৃদুল ছোঁয়ার রিনিঝিনি শুনি ওর মুখে শিব্রামদাঃ! হয়েছে? টের পেয়েছে তো?
হ্যাঁ, পেয়েছি। এতক্ষণে টের পেলাম।
যথোচিত কথাটা যথাযথভাবে কইলে কে না শুনতে পায়? কে-বা না বুঝতে পারে? কার বা বোঝার অসুবিধে?
.
৪৯.
হলো তো? এবার ছাড়ো তাহলে লক্ষীটি! জেলের ডাক্তারখানা থেকে তোমার ওষুধটা নিয়ে আসিগে, কেমন?
জেলের ডাক্তারখানা কোথায় তুই জানিস?
দেবেনদার সঙ্গে গিয়ে দেখে আসব আজ।
না, দেবেনের সঙ্গে যেতে পাবিনে।
আজই তো খালি। কাল থেকে আমি একলাই যাবো। আজ দিনটা কেবল।
না। আজকেও না। কারো সঙ্গে আমি তোকে যেতে দেব না। আজও না, কালও না, কোনোদিনও না।
বাবারে বাবা! দেবেনদা কি খেয়ে ফেলবে আমায়?
না খেলেও। আমি প্রাণ ধরে তোকে আর কারো সঙ্গে ছাড়তে পারব না বলে দিচ্ছি সাফ। তাতে ওষুধ না খেয়ে মরে যাই সেও আমার ভালো।
ইস্! কি হিংসুটে গো তুমি! ভারী সন্দিগ্ধ মন তো তোমার। ভাগ্যিস্, তুমি দাদা পাতিয়েছ সেই রক্ষে! বড়ডো ফাঁড়াটা কেটে গেছে আমার। বৌ হলে তো তুমি বোরখা পরিয়ে রাখতে আমায় বোধ হয়।
মোটেই না। আমি নিজেই তোর বোরখা হয়ে থাকতুম দিনরাত। বোরখার মতই তোকে ঘিরে রাখতুম সব সময়। কারো নজর পড়তে দিতুম না তোর ওপর।
কি রকম?
কোনোদিকে তাকাবার ফাঁক পেতিসনে তুই। তোর পূর্বে আমি, পশ্চিমে আমি, উত্তরে আমি, দক্ষিণে আমি…এক আমি একাই একশ। যেমন কিনা, আমাদের এই বঙ্গদেশ। উত্তরে হিমালয়, পূর্বে ব্রহ্ম, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে বিহারের দ্বারা পরিবেষ্টিত, তেমনি…।
বুঝেছি। রাতদিন পাহারা দেবে আমায়–বুঝলাম। কাজকর্মের ধান্দায় বেরুতে হত না তোমাকে?
আমার আবার কী কাজ? এক বৌ-ই তো বহু কাজ। তার ওপর কারো কাজ আছে নাকি আরো? থাকে নাকি?—
খেতে কী?
সে আমি ঠিক খেতাম। ঠিকই খেতাম, খাওয়ার ব্যাপারে কিছু অবহেলা, কোনো ত্রুটি থাকত না আমার।
তাতে পেট ভরত না মশাই। আমি বলছিলাম, অন্নবস্ত্র জুটত কোত্থেকে শুনি? কাজকর্ম না করলে।
মা অন্নপূর্ণা যোগাতেন। তিনিই যুগিয়ে যেতেন ঠিক ঠিক। সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। মার একটা গল্প বলি শোন্ তাহলে–উসিতরসের গল্প। শুনেছিস এর আগে?
না তো। উসিত সেটা কী? কে?
এক সাধু। গল্পটা বলি তোকে। একবার এক সাধু নাকি আমাদের রাজবাড়ির পিলখানায় এসেছিল। এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতীদের খাওয়া দেখছিল সে। বড় বড় গামলা ভর্তি চাল, গুড, কলার ঘোড়, আরো কত কী-মেখেচুখে বড় বড় গরাসে করে মাহুতরা হাতীদের খুঁড়ে ধরে দিচ্ছে আর তারা অ্যায়সা আরামে চোখ বুজে আয়েস করে চিবুচ্ছে-প্রত্যেক হাতীর জন্যেই আধ মণ করে বরাদ্দ। সবচেয়ে বড় দাঁতালো হাতী মোহনপ্রসাদের জন্যে তার ওপর রাজাবাহাদুরের পাঠানো নিত্যকার রাজভোগ–তার প্রিয় খাদ্য এক হাঁড়ি বাণিজ্যার দোকানের ইয়া বড়ো বড়ো রসগোল্লা। তাই দিয়ে রাজোচিত মর্যাদায় তার মধুরেণ সমাপয়েৎ হোত রোজ। একজন মাহুতকে সাধু নাকি শুধিয়েছিল, কেন, এমন করে এদের খাইয়ে দিতে হচ্ছে কেন? এরা কি গোরু-ভেড়ার মত চরে খেতে পারে না, নিজেরা মুখে তুলে নিতে পারে না? খেটে খুটে খেতে শেখেনি? কি পাখিদের মতন খুঁটে খুঁটে? না সাধুজী। জবাব দিয়েছিল মাহুতটা, হাতী সেরকম জানোয়ার নয়। এদেরকে এমনি করে খাইয়ে দিতে হয়। নইলে এরা এমনিতে খাবে না। মুখে তুলে না দিলে কিছুই মুখে তুলবে না কিছুতেই। উসিতরসে খিলানে হোগা। খোদা এইসা বানায়া এলোগ কো না! উনহি ইসি তরে বানায়া, উহি উসিতরসে খিলাতা!
তারপর?
শুনে তো সাধুটি হাঁ; তারপর করল কি সে, রাজবাড়ির শ্রীরাম মন্দিরে গিয়ে হত্যা দিয়ে পড়ল-পড়ে থাকে দিনরাত, খায় না টায় না, কারো কাছে কিছু চায় না। পূজারী পুরুতরা রামচন্দ্রের প্রসাদ এনে ধরে দিল ওর সামনে, ও ষ্টুলো না, শুধু বলল, উসিতরসে। যে কিছু ভালোমন্দ খাবার-দাবার ফলমূল নিয়ে আসে–সাধু ছোঁয় না–খায় না-খালি বলে, উসিতসে। রাজাবাহাদুর খাবার নিয়ে এলেন, রানী কাকিমাও এলেন তাঁর সঙ্গে-সাধুর শুধু ঐ এক বুলি–উসিতরসে। সবাই হাঁ করে তাকায়, হতাশ হয়ে ফিরে যায়, ওর কথার মর্ম কেউ বোঝে না।
সাতদিন এইরকম ঠায় উপোসে পড়ে থাকার পর একদিন শেষরাতে কে নাকি এসেছিল তার কাছে খাবার হাতে করে-খাওয়ার জন্য সাধতে। তার বহুৎ সাধ্যসাধনায় চি চি করে সাধু বললে-ঐ এক কথাই! উসিতরসে। শুনে লোকটা যেই না তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে গেছে, অমনি সাধু গরাসটা ফেলে দুহাতে পাড়ে ধরেছে তার পা-ঠাকুর! এইবার তো ধরেছি তোমায়। ধরা পড়ে গেছ তুমি। আর তো তোমায় ছাড়ছিনে! আর কোথায় পালাবে! যিনি হাতাঁকে খাওয়ান, তুমিই সেই তিনি! আমার ভগবান! তুমি ছাড়া তো আমার এই কথাটার মানে আর কারো জানবার কথা নয় ঠাকুর।
ভোর রাতের সেই কান্ডটা কেউ দেখেছিল নিজের চোখে? রিনি শুধোয়।
কেউ না। কে জেগে বসেছিল তখন? তবে তার পরদিন সকালে কেউ আর সে সাধুটির দেখা পাইনি। শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর দিব্য অঙ্গ মিশিয়ে গেল কি না কে জানে!
তুমি এসব বিশ্বাস করো?
মা বলে তাই বলছি। মার কথায় কি কেউ অবিশ্বাস করে?
তোমার বাবা কী বলেন এ বিষয়ে?
বলেন, গাঁজাখুরি। তিনি আবার কবিতাও আওড়ান, মহাকবি হেমচন্দ্রের। ছিল বটে আগে তপস্যার বলে/কার্যসিদ্ধি হত এ মহীমন্ডলে/আপনি আসিয়া ভক্ত-রণস্থলেসগ্রাম করিত অমরগণ/এখন সেদিন নাহিক রে আর/দেব আরাধনে ভারত উদ্ধার হবে না হবে না খোলো রবার/এসব দৈত্য নহে তেমন।
তোমার বাবাই ঠিক কথা বলেন। দেবতার সাহায্যে, দৈবলীলায় যেমন ভারত উদ্ধার : হবার নয়, তেমনি কেউ নিজেকেও উদ্ধার করতে পারবে না। তুমিও পারবে না। তোমাকে। কাজ করতে হবে-রীতিমতন, সবার মন। প্রাণপণে কাজের মানুষ হতে হবে, মানুষের কাজ করতে হবে… উসিতসের কৃপা কখন বর্ষে তার ভরসায় হাঁ করে বসে থাকলে চলবে না।
বাবা আরো কী বলেন জানিস? বলেন উদ্যোগিনঃ পুরুষসিংহ উপৈতি লস্মী/ দৈবেন দেয়মিতি কাপুরুষা বদন্তী। এর মানে হচ্ছে…
বলতে হবে না, আমি জানি। দৈবের কৃপায় কিছু মেলেনা, সব কিছুই চেষ্টা করে পেতে হয়-এই তো! তোমার বাবার কথাই ঠিক।
তুই তো বলবিই। তোর কথার সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলছে কি না! কিন্তু আমি ওকথা মানিনে। চেষ্টা করে কিছুই আমি কখনো পাইনি, যা আমি চাই–আমি যা পাবো বলে কখনো ভাবতেই পারিনি, তাও কেমন করে কে জানে আচমকা পেয়ে গেছি। দৈবাৎ আমি পেয়ে যাই।
দৈবাৎ পাও? দেবতার কাছে প্রার্থনা করে পাও? কোন্ দেবতার কাছে শুনি?
কোনো দেবতার কাছেই কিছু প্রার্থনা করিনে। এমন কি চাইতেও হয় না। এমনিতেই আসে…এই যেমন তুই! এলি না এই আমার জীবনে? ঠিক সেইরকমটাই।
এমনিতেই মিলে যায়? তা কি করে হয়! হতে পারে কখনো? আশ্চর্য তো।
তাই তো দেখছি জীবনভোর। কবি তুলসীদাসের একটা কথা বলেন মা। যো যাকো শরণ লিয়ে/সো তাকো রাখে লাজ। উলটু জলে মছলি চলে/ভাসি যাওয়ে গজরাজ।
মার কাছে শোনা তুলসীদাসের দোঁহার গাওয়া আমার!
তার মানে?
যে যার শরণ নেয়, সেই তার লজ্জা বাঁচায়, রক্ষা করে। মাছরা সব নদীর আশ্রিত তো? তারা বিপরীত স্রোত কাটিয়েও অনায়াসে কেমন উতরে যায়। কিন্তু মহাশক্তিধর মদমত্ত ঐরাবতও স্রোতের মুখে পড়ে কুটোর মতন কোথায় যে ভেসে যান তার হদিশ মেলে না। তেমনি কেউ যদি ঠিক ঠিক ভগবানের প্রত্যাশায় থাকে সে কখনো ভেসে যায় না, বুঝলি?
ভেসেও যায় না, ডুবেও যায় না হয়ত সে ঠিকই, কিন্তু তার ঐ ভেসে থাকাটাই সার হয়। নাই বা সে তুলালেলা, কোনোদিন সে কোথাও পৌঁছতেও পারে না কখনো, তাও ঠিক। তুমি কি ফকির বৈরাগী ভিখিরিদের দ্যাখোনি, খালি ভগবানের প্রত্যাশায় হাঁ করে বসে থেকে কী দশা হয়েছে তাদের?
দেখব না কেন? মামাকেই দেখেছি আমার। ভালো চাকরি করতেন, কোন্ সদাগরী আপিসে, সুখদেব না দুখদেব কোন্ এক গুরুর পাল্লায় পড়ে চাকরি-বাকরি ছেড়েছুঁড়ে হরিনাম কীর্তনে মজেছেন, আর সেই গুরুদেবটা তাদের আশ্রমে চাকরের মত খাটাচ্ছে তাঁকে-তার মতন আরো সব শিষ্যদের বিনা বেতনের খানসামাগিরিতে। কী দুর্দশা যে তাদের কী বলব! মামাকে আমি বলেছিলাম, কৃষ্ণকে ভজে আর গুরুসেবায় মজে তোমার এ কী হাল হোলো মামা। মামা আবার তাঁর সাফাই গান–যে করে আমার আশাকরি তার সর্বনাশ ॥ তবু যদি না ছাড়ে আগ/হই আমি তার দাসের দাস।
তাতে লাভ? কী এল গেল আমার?
তাই তো বলে কে? আমারই বা দাস হবার দরকার কী তাঁর, আর তাঁকেই বা দাসের দাস বানিয়ে কী চতুর্বর্গ লাভ আমার? তোর কথাটা যে মিথ্যে তা আমি বলিনে! তবে আমি ভগবানের ভরসা করিনে রে। ভগবানের দ্বারা কারো কখনো কিছু ভালো হতে আমি দেখিনি। তাঁর কাছে হাজার প্রার্থনাতেও কচু হয়। আমি তাঁরই প্রত্যাশা করি ভাই, সবাই যাঁর প্রত্যাশায়, এমন কি ঐ ভগবানও, স্বয়ং শিবও যার দুয়ারে ভিখারী।
কার?
আমার মার। আমীর মা, তোর মা, আমার মারও মা সবার মা, সারা বিশ্বের মা বিশ্বজননীর। তাঁকে ডেকে কেউ কখনো ভিখিরী হয়ে যায় না, না চাইলেও তিনি তোর দুহাতের মুঠো ভরে দেবেন মুহুর্মুহু দশ দিক থেকে দশ হাতে। তাঁরই ভরসা করি আমি। করবও চিরকাল।
আমার বাবা কী বলেন জানো? ভগবানকে ডাকো–তাঁর কাছেও চাও, আবার সেই সঙ্গে তোমার প্রাণপণ চেষ্টাও চালাও-দুইই চালিয়ে যাও–তবেই হবে তোমার। কে একজন জেনারেলও এই কথা বলে গেছেন নাকি। প্রে টু গড বাট কীপ ইওর পাউডার ড্রাই–যদি যুদ্ধে জিততে চাও। সংসার-সগ্রামেও ঠিক সেই কথাই।
তোর কথাটা মিথ্যে না, তোর বাবার কথাও সত্যি। জেনারালি কথাটা খাটে কিন্তু সব কিছুরই ব্যতিক্রম আছে না? সত্যকে যা প্রমাণ করে? আমি আমার মার কথাটাই মানব। কথাটা আমার মনের মত।
তার মানে, কথাটায় তোমার কুঁড়েমির সায় পাও কিনা। মোটেই খাটতে চাও না তুমি। তোমার মা-ই তোমার মাথা খেয়েছেন বুঝতে পারছি।
আর আমার মা কী বলে জানিস? তুই-ই আমার মুভুটা চিবিয়ে খেয়েছিস। বখিয়েছিস আমাকে।
সবার মা-ই সেই রকম বলে। সব মা-ই একরকম। তাঁরা নিজের ছেলেমেয়েদের কোনো দোষ দেখতে পান না, বিশ্বাস করেন না–পরের ছেলেমেয়েদের দায়ী করেন তার জন্যে। জানি আমি।… বেশ তো, তোমার মার কথাটাই মানো না।.সেই বিশ্বমায়ের ওপর ভরসা রেখেই ছেড়ে দাও আমাকে। তোমার ওষুধটা নিয়ে আসিগে। ভয়টা কিসের? তিনিই দশ হাতে আমাকে সামলাবেন-দেবেন-টেবেন সবার খর্পর থেকে বাঁচিয়ে, তোমার হাতে তুলে দেবেন শেষ পর্যন্ত।
তা তুই যা-ই বল, তোর কথায় আমি ভুলছিনে। ছাড়ছিনে তোকে। তুই এখানে থাক–আমার কাছটিতে বসে। মার কথা মতন আমি সেই মার ভরসাতেই থাকি বরং, দ্যাখ তুই, আমি বিনা চিকিৎসায় কোনো অষুধ-বিষুধ না খেয়েই সেরে উঠছি কিনা। তাহলে তো তখন বিশ্বাস হবে তোর?
নেচারেও সারে। সারে নাকি? বাবা বলেন, ন্যাচারালিও সারা যায়, কিন্তু ভুগতে হয়। ওষুধ থাকতে অকারণে ভোগবার দরকারটা কি?
মাই বল, আর নেচারই বল, তার ভরসার থেকে বরং নাচার হবো, তবু কারো ভরসাতেই আমি তোক ছাড়তে পারব না। আমি জানি, দেবেনটা তোর জন্যে ওত পেতে আছে বাইরে। হাড়ে হাড়ে শয়তান। তাকে আমি চিনিনে!
সব ছেলেই তোমার মতন নয়। উদার মন অনেকের। কেন, অন্য ছেলের সঙ্গে মিশলে কি আমি ক্ষয়ে যাবো নাকি? কই, আমি তো তোমার মতন নই। তুমি অন্য মেয়ের সঙ্গে মিশলে আমার তো কোনো রাগ হয় না, মনের কোণেও কোনো সন্দেহ জাগে না, হিংসে কর না মোটে।
মিশব যে, মেয়েটা কোথায়? তাহলে প্রমাণ পাওয়া যেত তোর কথার। হাতে হাতে বাজিয়ে দেখতাম।
মিশতে চাও তুমি?
মেয়ে কোথায় এই জেলে? আছে এখানে কোনো মেয়ে!
আছে বইকি। আমার মতই আছে কত। তোমারা ধরতে পারবে না। আমাদের চোখে ধরা পড়বে। ধরতে পেরেছি আমি কজনাকে। তারাও আমায় ঠাউরে নিয়েছে ঠিক।
বলিস কি রে? এখানে…আমি জানতে চাই–এসেছে কেন তারা?…দেশের জন্যে? নাকি, বন্ধুদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার নেশায়?
তারাই জানে! তবে তুমি যে বলো ওই ব্যক্তি স্বাধীনতা সবাই চায়, এমন কি ঐ মেয়েরাও। কেন, মেয়েরা কি ব্যক্তি নয়?
কে বলে নয়? তুই তো রীতিমতই এক অভিব্যক্তি।
আবার এমনও হতে পারে, বাড়িতে বিয়ের কথা পাকা হয়েছিল, সেদিকে এখন মন নেই ওদের, এই সুযোগে ই ছুতো করে পালিয়ে এসেছে বাড়ির থেকে…তুমি কি ওদের কারো সঙ্গে ভাব করতে চাও? চাও তত বলল।
আমি চাইলেই তারা চাইবে কেন ভাব করতে-ভূতের মতো চেহারা এই আমার সঙ্গে মিশতে কেন যাবে? আমি নিশ্বস ফেলি-আমার সঙ্গে কোনো মেয়েই মিশতে চায় না–এমন কি তোর দিদিও নয়।
মেয়েরা চেহারায় ভোলে না গো। মন বুঝে মেশে। যার সঙ্গে মনের খাপ খায় তার সঙ্গেই মেশে তারা, বুঝেছ? তার সঙ্গেই ঘর বাঁধে গিয়ে শেষটায়।
অতত মন বোঝাবুঝির গরজ নেই আমার। একে তো মেয়েদের মন বোঝাই যায় না লোকে বলে! বইয়েও লেখে তাই। এখন নতুন করে মেয়ের মন বুঝতে যাবার সময় নেই আমার! কষ্টেসৃষ্টে যে একজনের একটুখানি বুঝতে পেরেছি তাই বজায় রাখতে পারলেই বাঁচি! ও! বুঝতে পেরেছি। আমি এদিকে নতুন মন বোঝার চেষ্টায় হয়রান হই গে, আর তুমি ওদিকে দেবেনের সঙ্গে গিয়ে ভাব জমাও! না বাবা, সেটি হচ্ছে না। গাছের ফলে হাত বাড়াতে গিয়ে হাতেরটা আমি খোয়াতে চাই না।
ঘাবড়াচ্ছো কেন তো? আমি তো হাতের পাঁচ, হাতেই আছি যাচ্ছি কোথায়? যেমন তলারটা কুড়োবে তেমনি গাছেরটা পেলে আরো ঢের মজা না? তাছাড়া, তারা প্রত্যেকেই খুব সুন্দর–আমার চেয়েও। দুরণ সুন্দর সব! দেখো তুমি।
সুন্দর না ছাই। আমি কারো সঙ্গে আলাপ করতে চাইনে। দেখতেও না।
মেয়ে যে তা তুমি টের না পেলেও, সুন্দর যে সেটা দেখলেই মালুম হবে-ওই ছেলে সেজে থাকলেও। ওই তো একজনা ওধারে দাঁড়িয়ে প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে রয়েছে এই দিকে–আমাদের দিকে নজর দিচ্ছে, চেয়ে দ্যাখো না! . আমার দরকার নেই দেখবার। সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিই আমি–একটি যে আমার আছে তাই বেঁচে বর্তে থাকলেই ঢের, তার বেশি আমি চাইনে। তুই ওদেরকে দেবেনের সঙ্গে ভাব করিয়ে দে বরং, দেখিয়ে দে দেবেনকে। যা শত্রু পরে পরে…ওদের ওপর দিয়েই ফাঁড়াটা কেটে যাক আমার।
আমার দরকার করবে না দেখাবার। দেখবার হলে তারাই নিজেরাই ঠিক দেখে নেবে। বলে সে নিশ্বাস ফেলে-ভালোই করেছিলাম তোমার, আরো আরো মেয়ের সঙ্গে ভাব করিয়ে দিচ্ছিলাম কেমন। বোনের কাজ, বন্ধুর কাজই করছিলাম। অনেকের সঙ্গে আলাপ হলে তুমি নিজের মনের মতনটিকে খুঁজে পেতে তার ভেতরে…সুখী হতে পারতে হয়ত একদিন…
আবার সেই এক কথা! বলছিনে সুখী হবার আমার দরকার নেই। এই বলে ভুলিয়ে তুই যদি আমায় ছেড়ে যেতে চাস, তোকে অতত করে বোঝাতে হবে না, এমনিই সোজাসুজি চলে যা। আমার ঘাড়ে আর কাউকে গছিয়ে দিয়ে যেতে হবে না। আমিও নিশ্বাস ফেলি-তোকে না পাই না-ই পাবো, আর কাউকে আমি চাইবো না। চাইও না। কক্ষনো নয়।
আমি ঠিক তোমার মনের মতটি নই, আমি জানি কিন্তু তুমি তা জানো কি? এখন না জানলেও আর সবার সঙ্গে মিশলে তুলনায় জানতে পারতে তখন। জানো, আমাকে চাইলে পরে অনেক কষ্ট পেতে হবে তোমায়। আমায় নিয়ে বৃহৎ দুঃখ আছে তোমার বরাতে–অনেক ভোগাভি জীবনে…
আমি জীবনের মত চেয়েছি কি? তুই তো বোনের মই হতে চেয়েছিস–তাহলে আর দুঃখটা কোথায়? বোনরা কি কষ্ট দেয়? বন্ধুর মত পেলেই আমার ঢের।
সেভাবে পেতে হলেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে তোমাকে। আমার মনের মতটি হতে হবে তোমায়। বন্ধুরাও বেশ কষ্টদায়ক হয়-তা জানো? যে বন্ধু তোমার সত্যিকার ভালো চাইবে, সে তোমায় দুঃখ না দিয়ে পারবে না। আমার বন্ধু হতে হলে গোড়াতেই তোমায় আলসেমি ছাড়তে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, পরের প্রত্যাশায় থাকলে চলবে না, আমি মোটেই অপরের প্রত্যাশায় নেই। পরের কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করিনে, যদি করি তো কোনো পরীর…
কথা ঘোরালে চলবে না। একটু আগেই তুলসীদাসী দোঁহা আউড়ে কতো কী গেয়েছে, ভুলে গেলে এর মধ্যে? তুমি পরের ভরসাতেই থাকো কি ঐ পরাৎপরের ভরসাই রাখো, ফল একই। তোমার ভবিষ্যৎ ফর্সা। স্বখাত সলিলে ডুবে মরলে জগন্মাতাও দশ হাতে তোমায় টেনে তুলতে পারবে না। কোমর বেঁধে তাঁর শরণ নিয়েই যদি ডোবো, তাহলেও নয়।
জগন্মাতা তার আগেই বাঁচাবেন আমায়, নির্ঘাৎ জানি। খাত কাটতেই দেবেন না আমাকে। স্বখাত হলে তবে তো সলিল জমবে, ডুবে মরতে হবে? সেই খাল কেটে কুমীর আনতে আমায় দিচ্ছে কে? আমি কই : তাহলে তুই গাইতিস কেন চাঁচলে–নিশিদিন ভরসা রাখিস/ওরে মন হবেই হবে/যদি তুই পণ করে থাকিস/সে পণ তোর রবেই রবে। গাইতিস কেন তাহলে?
ওসব হচ্ছে ভাবের কথা-কাব্যে গানেই শোভা পায়। উচ্চ কথারা যতো তুচ্ছ কথাই। অভাবের মুখে পড়লে কোথায় যে এ সব তত্ত্ব উড়ে যায় তার পাত্তাই মেলে না।
এত সব তুই শিখলি কি করে? কোত্থেকে? ভারী যে পাকা পাকা বুলি ঝাড়ছিস?
মেয়েরা অনেক কিছুই জানে, মনেতে চেপে রাখে, মুখের বাইরে আনে না। সব সময় তাদের চোখ কান খোলা থাকে তা জানো? চারদিকে নজর রাখে, দেখে শিখতে পারে তারা। ছেলেদের সেখানে ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়। ঠকে ঠকে শেখে তারা। তাই বলছিলাম, যদি জীবনে কোথাও ঠেকতে না চাও, ঠকতে না চাও তাহলে আগে নিজেকে মানুষ করে গড়ো, তারপর অপরকে মানুষ করো, দেশের সেবায় লাগো।
কি রকম মানুষ হতে বলছিস তুই? কার মতন মানুষ?
কেন, ঐ সুভাষ বোস, কি ঐ দেশবন্ধু! আগে হয়েছে, পেয়েছে–তারপরে দিয়েছে, বিলিয়েছে। তোমার কোনো কিছু পুঁজি নেই-না স্বাস্থ্য না অর্থ না বিদ্যে–এই দুআনার মানুষ হয়ে তুমি দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে, দুঃখ বাড়াবে পৃথিবীর। ষোলো আনা হয়নি যে, নেই যার, সে কি ষোলো আনা দিতে পারে? এই ভাবে চললে দেখো তোমার হাড়ির হাল হবে একদিন। তোমার দুঃখে দেশের শেয়ালকুকুর কাঁদবে।
শুনে আমি চুপ করে থাকি, জবাবদিহির ভাষা খুঁজে পাই না।
রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি! যাই আমি, ওষুধটা নিয়ে আসি গে তোমার। চুপটি করে শুয়ে থাকো ততক্ষণ। আমি যাব আর আসব।
না, আমিও তোর সঙ্গে যাব তাহলে ডিসপেনসারিতে।
না। তোমার গিয়ে কাজ নেই। নড়াচড়ায় জ্বরটা বাড়বে। বাবা বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জায় কমপ্লিট রেস্ট। আমি তোমার সিষ্ট বলে ওষুধ আনতে পারব। ডাক্তারের মেয়ে না আমি? ওষুধ চিনি।
কিন্তু ওই দেবেনটা যে ওত পেতে আছে ওখানে…
দেবেন মোটেই ওখানে বসে নেই। ছেলেরা ছটফটে হয়–জানো না? দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এক জায়গায়? কোথায় চলে গেছে এতক্ষণ। দেবেনের সঙ্গে আমি মিশব না, তাকে আমার সঙ্গে মিশতে দেব না কথা দিচ্ছি, গায়ে পড়ে মিশতে এলেও আমি পাশ কাটিয়ে চলে যাবো তক্ষুনি।
বেশ, যা তুই। কিন্তু যদি সে এই ফাঁকে একটুখানিও মিশে নেয়, আমার কত ক্ষতি হবে যে…! সেই ক্ষতিপূরণ কে দেবে আমায়? সেই ক্ষতিপূরণটা দিয়ে যা তুই তা হলে।
পরে দেব। রাত্তিরে। মাঝ রাত্তিরে সবাই ঘুমোবার পর–সেই কালকের মতন…
না। এখন। আগাম চাই। বেশি না, মোটমাট পাঁচটা। তা না হলে ছাড়ব না…
চার দিকে সবাই তাকিয়ে রয়েছে দেখেছো? এর ভেতর মেয়েরাও সব রয়েছে…বেশি বেশি নজর দিচ্ছে তারাই…না, তুমি যতই বলল, তাদের সামনে নিজের মান আমি খোয়াতে পারব না। কিছুতেই না। তারা কী ভাববে বলো তো!
তবে তোর ভাবনা নিয়েই তুই থাক্। ওষুধ আনতে গিয়ে কাজ নেই তোর। শান্তিতে মরতে দে আমায়।।
আচ্ছা চুমোখোড়ের পাল্লায় পড়লাম তো! কী মুশকিলেই যে পড়েছি…
বয়সে বড়ো একজনা যাচ্ছিলেন আমাদের তাকের পাশ দিয়ে। রিনির কথায় থমকে দাঁড়ালেন-কী হয়েছে? কী মুশকিল! কিসের মুশকিল শুনি?
দেখুন না, কাল রাত্তিরে ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছে দাদার, জেলের হাসপাতালে গিয়ে ওষুধটা নিয়ে আসব, কিছুতেই দিচ্ছে না আমাকে…বলছে, তুই থাক এখানে। এদিকে দেখুন! দাদার গাটা কী গরম হয়েছে যে!…
বলে সে তার গালটা আমার কপালের ওপর এনে রাখল–ইস্! পুড়ে যাচ্ছে আমার মুখখানা! কী গরম!
তারপর কপালীটোলার থেকে নেমে তার মুখ আমার গালের ওপর এসে থামল, ইস্ট। গালুডি স্টেশন থেকে গালুডি ওয়েটে চলে গেল সটান-মাঝখানের মধুপুর জংশন ছুঁয়ে ছুঁয়ে জানান দিয়ে–একবার নয়, এমনি পাঁচবার।
রেলওয়ে ভূগোলে এমনটা ঠিক না মিললেও সেদিনের গণ্ডগোলে কেমন করে যেন মিলেছিল? ভেবে এখন অবাক হই।
যে নাকি এতক্ষণ ধরে এত ওজর করছিল, এতজনের নজরের পরোয়া ছিল যার, সেই কিনা এখন প্রায় এক দাদুতুল্য লোকের চোখের ওপর অকাতরে অম্লানবদনে…এক লহমার এক ম্যাজিক দেখিয়ে দিল যেন!
আশ্চর্য এক ভেলকি খেলাই দেখলাম।
.
৫০.
এত ঢঙও জানে মেয়েরা!
যদিও তখন অব্দি রিনিই আমার কাছে অদ্বিতীয়, তার বাইরে দ্বিতীয় কোনো মেয়ের দেখা আমি তখনো পাইনি, তবুও এই চকিতদর্শনেই চরাচরের তাবৎ মেয়ের সাক্ষাৎ আমি পেয়ে যাই। এই রিনির এই চাল থেইে দুনিয়ার সব মেয়ের হাঁড়ির খবর মিলে যায় আমার। তাদের সহজাত স্বয়ংসিদ্ধির সংবাদটাও অবিদিত থাকে না।
রিনির যে কাণ্ডে আমি থ, থই পাচ্ছিনে, সেই দৃশ্য দেখেও নেতৃস্থানীয় ঐ দাদাটি কিন্তু অবিচলিত। তাঁর মুখে কোনো বিকার দেখলাম না। আশেপাশের কেউ কোনো ক্ষেপ করেছে, তা আমি দেখতে পেলাম না। সেদিকে আমার চোখই ছিল না আদপে। দাদাটি আমার কপালে হাত ছোঁয়ান-হ্যাঁ, একটুখানি গা গরম হয়েছে বটে। এমন কিছু নয়। ঠাণ্ডা লেগে সর্দি হয়েছে-সর্দির জন্যই এটা হবে।…নাক টানো তো!
কার নাক? আমি জিগ্যেস করি।
হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিতে হয়।
ওর নাকটা ধরে টানতে বলছেন আমাকে?
ওর কেন, তোমার নিজের নাক নেই?
তা তো আছে। বলে আমি চুপ মেরে যাই। নিজের নাক-কান ধরে খামোখা টানাটানি করতে যাব কেন আমি ভেবে পাই না। তাছাড়া, ব্যাপারটা পছন্দসই বলেও বোধ হয় না আমার। নিজের কান কিংবা ঐ নাকই হোলো-টেনে কি কেউ কখনো আরাম পায়?
কি করে নাক টানতে হয় জানো না বুঝি? গলাখাঁকারির মত তিনি নাক খাঁকারি করে দেখান–এমনি করে টানতে হয়।
বুঝেচি। আপনি নাক ঝাড়তে বলছেন।
ওঁর অনুকরণের প্রয়াস পাই কিন্তু নাক আমার ডাকে সাড়া দেয় না।-ঝাড়া যাচ্ছে না যে, কী করব? নিরুপায় হয়ে কই- নিশ্বাস ফেলতে পারছি না, ঝাড়ব কি করে?
নিশ্বাস নিতে পারছ না, বলছ কী হে? তিনি বিস্মিত হন–বেঁচে আছে কী করে?
হাঁ করে। আমি জানাই-নাক বোজা আমার, সর্দিতে বোঝাই। মুখ দিয়ে তাই নিতে হচ্ছে নিশ্বাস-বাধ্য হয়েই। হাওয়া খাচ্ছি একরকম–বলতে পারেন।
এখন ধরতে পারলাম। ঐটেই হচ্ছে তোমার ব্যায়রাম। ওই হাঁ করে থাকাটা। মুখ বুজে থাকতে হয় সব সময়-বুঝেছ? মুখ হচ্ছে খাবার জন্যে-খাবার খাতিরেই শুধু যা ঐ হাঁ করবে, তা ছাড়া নয়। (তাঁর কথায় বাধা দিয়ে বলার ইচ্ছে হয়েছিল, বহুৎ খাদ্য আবার মুখ বুজেও খেতে হয় মশাই। কিন্তু গুরুজন না হলেও লোকটা দাদুস্থানীয় আর বেশ গুরুগম্ভীর–তাই কোনো উচ্চবাচ্য করি না। মুক্তকণ্ঠে তিনি কন- আর নিশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে রয়েছে নাক-বিধাতার ব্যবস্থায়। বিধাতাই বলল আর প্রকৃতিই কও, তার অন্যথা করলে অসুখে পড়তে হবে বই কি।
আমি কোনো জবাব দিই না, চুপ করে থাকি। সর্দির জন্যই নাক বোজা না নাক বোজায় হেতুই এই সর্দি-বোঝা আমার পক্ষে সহজ হয় না।
তিনি কিন্তু বোঝাই করে যান–নাক দিয়ে নিশ্বাস নিলে হয় কী জানো? বাতাসটা নাকের গোড়ার শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির ভেতর দিয়ে যাবার কালে পরিশোধিত হয়ে লাংসে গিয়ে পৌঁছয়-ঘুরপথে যাবার জন্যে একটু গরমও হয়ে যায় আবার। কিন্তু হাঁ করে নিলে, বিশেষ করে এই শীতকালটায়, বাতাস গরম হতে পায় না তো, সোজাসুজি বুকে গিয়ে সেঁধোয়-সরাসরি ঠাণ্ডা লাগিয়ে দেয়। ফলে এই সর্দি। তার ফলে এই নাক বোজা। তরুণ ঐ হাঁ করে থাকাটা। প্রতিফলে ফের আবার বুকে ওই ঠাণ্ডা লাগাটা-তার ফলে বুকে শ্লেষ্মা জমা হওয়া, তাই আবার নাকে এসে জমাট বাঁধা, তস্য ফল তোমার নাক বোঝাই, তার দরুণ তোমার ঐ হাঁ করে থাকা, পরিণামে ফের আবার ঠাণ্ডা লাগা-ফের আবার…সদি নাক বোঝাই, হাঁ করে থাকা, তার ফলে ফের তিনি হাঁকড়ে যান এক নাগাড়ে।–ফের আবার ঐ সর্দি লাগা…আবার ফের… বারম্বার সদির ফেরেববাজির তিনি ফিরিস্তি গান।
ফলতঃ এই পাকচক্র–যা আপনি বলতে চাইছেন। আমি বুঝতে পেরেছি।
তাঁর ওই কমপ্লেকস্ সেনটেনস, যা মোটামুটি আমার ডেথ পর্যন্ত গড়াতে পারত, এক কথায় সেরে দিয়ে তার সেই ডেথ সেনটেনসের হাত থেকে অব্যাহতি পাই। সেই বচ্চক্রের ব্যুহ ভেদ করে বেরুতে পারি।
যাক, যা হবার হয়ে গেছে। এখন ওষুধ খেতে হবে, যাতে আর না বাড়তে পারে। খোকা, তুমি আমার সঙ্গে এসো। জেলের ডাক্তারখানাটা কোথায় জানোনা বোধ হয়। দেখিয়ে দিচ্ছি আমি। ডাক্তারবাবুকে রোগের ব্যাপার খুলে বলবে। সীমটম সব বুঝিয়ে ওষুধ নিয়ে আসতে পারবে তো? মিকশ্চার ট্যাবলেট যা উনি দেন। আনলেই হবে না, নিয়মমত খাওয়াতে হবে। ন্যাসাল ডুপের মতন কিছু পাওয়া যায় কি না খোঁজ কোরো, তাই এ-নাকে এক ফোঁটা ওনাকে এক ফোঁটা দিলে তক্ষুনি সাফ হয়ে যায় নাক। শুপিয়ে সেটা ডাক্তারবাবুকে, কেমন?
নম্র খোকাটির মত তাঁর কথায় সায় দিয়ে রিনি তাঁর সঙ্গে যায়-যায়, এমন সময় জেলের সদর থেকে ঢনৎকারের আওয়াজ এলো। সব এলোমেলো হয়ে গেল সেই আওয়াজে।
রিনির ঢঙ দেখে হাঁ হয়েছিলাম, তার পরে এতক্ষণ ধরে ভদ্রলোকের মুখে বাতাসের নাসিক শহরে গতিবিধির পর্যটন কাহিনী শুনছিলাম হাঁ করে, কিন্তু সদরের এই ঢঙঢঙানি শোনার পর মনে হল, আমার ওই হাঁ করে থাকাটা রিনির ঢঙ দেখে নয় ঠিক, বা এই নাসিক অবরোধের দরুণ হাওয়া খাওয়ার হেতুও না, আসলে সকাল বেলাকার প্রাতরাশের প্রত্যাশাতেই।
কারণ নিজের গর্ভগৃহেও ঐ ঘন্টার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল।
রিনিকে ডেকে বললাম, যাচ্ছিস যখন, লোহার প্লেটগুলোও নিয়ে যা। ওষুধ নিয়ে ফেরার পথে তখন তোর-আমার খাবারটাও নিয়ে আসবি ঐ সঙ্গে।
জ্বরের ওপর জেলের খাবার খাবে ও? রিনি ওঁকে শুধোয়।
এখানে সাবু বার্লি কোথায় পাবে! ঐ লপসিই খেতে হবে বাধ্য হয়ে। দ্যাখো, যদি পাঁউরুটি-টুটি পাও কিছু-খোঁজ নিয়ে হাসপাতালে।
তা তো আনবিই, আমি বলে দিই : কিন্তু ঐ সঙ্গে খিচুড়িটাও চাই আমার। খিচুড়ি দিয়ে আমি পাঁউরুটি খাবো।
তোমার খালি খাই খাই। খাওয়া ছাড়া আর কিছু শেখোনি তো! রিনি বলে তার কথার ভেতর কোনো গুহ কথার কিছু কি উহ্য থাকে?-বুঝলেন মশাই, আমার দাদাটি বিদ্যাসাগর মশায়ের আদর্শ একটি সুবোধ বালক–যাহা পায় তাহাই খায়। তার ওপর যাহা খাওয়া উচিত নয়, পেলে পরে তাহাও ছাড়ে না।
ভদ্রলোক তার জবাব শুনে হাসেন।–তাই বটে! জেলের লপসিকে বলছে কিনা খিচুড়ি! অখাদ্যও ওর কাছে খাদ্য।
না না! পাঁউরুটি পাই আর না পাই-খিচুড়ি আমার চাই। চাই-ই চাই।
আচ্ছা আচ্ছা! তাই হবে গোয় মাথা হেলিয়ে হেসে চলে যায় সে।
রিনি যাবার পর আমি ভাবনায় পড়লাম আবার। ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন ওর? জেলের গেট আর আপিস তো সামনেই, ডিসপেনসারিটা আর কর হবে? এইটুকুন তো পথ! সামান্য ওষুধপথ্য নিয়ে ফিরে আসতে এত দেরি হয়?
দেবেনের খর্পরে পড়ল না তো?
যাবার পথে ভাবার কিছু ছিল না। দাদুজনোচিত দায়িত্ব নিয়ে জাঁদরেল গোছের যে কজনা দাদা জেলের মধ্যেকার ছেলেদের ওপর অযাচিত মোড়লী করতেন, তাঁদের একজনার সঙ্গেই গেছে সে। কাজেই মাঝখানে পড়ে হামলা করার সাহস হবে না দেবেনের।
কিন্তু সেখান থেকে একা ফেরার পথে রেহাই কোথায় তার? পাকড়াবেই তাকে সে-যে করেই হোক। নির্ঘাত।
সকাল থেকেই ওর রিনিদির ভাই রিনটুর জন্যে ও যে বাইরে ওত পেতে ছিল, সেকথা আমি হলফ করেই বলতে পারি। কিন্তু অভাবিত এক দাদার সাথে ওকে বেরুতে দেখে আগ বাড়িয়ে গা-পড়া হয়ে তখন না এলেও তাদের পিছু পিছু ফলো করেছে সে নিশ্চয়। (ছেলেদের কোনো মেয়ে বা মনের মত কাউকে এই ফলো করে যাওয়ার রহস্য আমার অজানা নয়, কলকাতার পথে আমিও কিছু কম যাইনি–যদিও ফলোদয় আমার ভাগ্যে কাঁচকলাই!) কিন্তু দেবেনের বরাতে অন্য রকম ফলার জুটতেও পারে। কী সুন্দর তার চেহারা! অমন ফলোয়র পেলে কোন্ অগ্রণী নায়িকাই না ফিরে তাকাবে, থমকে দাঁড়াবে ওর জন্যে? আঙুলের স্পর্শ থেকে আঙুরের অভ্যর্থনা নিয়ে তৈরি থাকবে না?
আর, যদি থমকি থেমে যাও পথ মাঝে/আমি চমকি চলে যাব আন কাজে-বলে সরে পড়ার পাত্রই নয় সে! রবিবাবুর নায়কের ন্যায় অমন লজ্জাকাতর নয় আদৌ।
আর কী খেলেয়াড় ছেলে সে, টের পেয়েছি প্রথম রাত্রেই। তাকের ওপর ফাঁকে পেয়ে যা ফাউল খেলছিল না। তার শটের চোটে পদাহত বলের মতন ফিল্ডের থেকে প্রায় পাস আউট হয়ে যাই আর কি! পড়তে পড়তে কোনোমতে আপনাকে সামলেছি!
আমার জায়গায় অসহায় রিনিকে আজ যদি পায় সে। অফসাইড থেকেই ওকে কর্নার করবে। আর সেই পাল্লায় এই আমাকেও কোণঠাসা করবে নির্ঘাত। রিনিকে নিয়ে একটা গোল না বাধিয়ে ছাড়বে না সে।
খিচুড়ি, পাঁউরুটি আর মিকশ্চারের শিশি হাতে হাসতে হাসতে ফিরল রিনি।
ও বাবা! বাঁচলাম। হাঁফ ছাড়লাম আমি-যা ভাবনায় পড়েছিলাম না।
এই জগাখিচুড়ির জন্য এত ভাবনা। সে প্লেটটা আমার সামনে রাখে নাও, ধরো, খাও। এখন বাঁচলে তো!
খিচুড়ির জন্যে ভাবছিলুম বুঝি! হা কপাল! জানতাম যে মেয়েরা বেশ বুঝদার হয়! কিন্তু তুই দেখছি তার অন্যথাই।
কী তাহলে ভাবছিলে এত শুনি?
ভাবছিলাম যে, দেবেনটা তোকে অফসাইডে পেয়ে সেখান থেকে পাসিয়ে ক্যারি করে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছে কে জানে! সেন্টার ফরোয়ার্ড-এর খেলোয়াড় সে, বলছিল আমায়। যা ভাবনা হচ্ছিল আমার না!
দেবেন কোথায়? দেখতেই পেলাম না তাকে। সে এই ইন্দ্রলোকের ছদ্মবেশী কোনো দেবীকে নিয়ে কোন নন্দনবনে বিহার করছে এখন কে জানে!
বাঁচি তাহলে! আহা, তাই যেন হয়। তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। কোনো দেবীর সঙ্গে যদি তার একটা হিল্লে হয়ে যায়, মনের মত মেয়ে নিয়ে ঘর বেঁধে সুখে ঘরকন্না করে–তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হয় না। তারও, আমারও।
তা আমার জন্যে তোমার এত ভাবনা কিসের গো!
ভাবনা নেই? তুই বলিস কী রে! তুই-ই তো আমার একমাত্র ভাব আর একটি মাত্র ভাবনা।
ভাব হতে পারি, কিন্তু ভাবনা নয়। বোনের জন্য কেউ ভাবে কখনো? বোন আর কদ্দিন? কদ্দিন ভাব রইবে তার সঙ্গে? সে তো পরের জন্যেই, পরের বাড়ি যাবে, পর হয়ে যাবে–একদিন না একদিন! তার জন্যে কেউ ভাবে নাকি?…পরের জন্যেই জন্মেছে সে-পরই তো। এক কথায় আমায় সে ভাবনামুক্ত করতে চায়।
হ্যাঁ, মানি সে কথা। মায়ের পেটের বোন হলে তাই হয় বটে, কিন্তু পেটের না হয়ে প্রাণের বোন হয় যদি? তার জন্যে প্রাণ আইঢাই করে না? যখন পর হবে, যখন হবে তখন, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত সে তো আর পর নয়–পরীই বটে…প্রাণের বোন, বুঝলি কি না, প্রাণের মতই-প্রাণ যখন যাবে তখন যাবে, কিন্তু তার আগে অবধি যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ!
আমার আশা রাখা কি আশায় থাকা তো উচিত নয় তোমার-সে কয়–তুমি আমায়– কোনোদিন বোনের চোখে দেখতে পারবে না দেখছি। ঠিক ঠিক বোনের মতন ভাবতে। পারবে না। তাকে বেশ ভাবিত দেখা যায়। এমন কি, বন্ধুর মত ভাবতে পারলেও বাঁচতাম।
বোন আর বন্ধুর মধ্যে তফাৎটা কী? কোনো তারতম্য আছে কিছু?
নেই? সব ভালোবাসাই কি এক নাকি?
এক নয়? একই রকমের তো সব। আমার তো তাই মনে হয়। যেমন কি না মায়ের প্রতি টান তেমনিই ওই ছেলেমেয়ের ওপর, যেমন বন্ধুর জন্যে মন কাঁদে, বোনের জন্যও তেমনটা। মন কেমন করার থেকে আদর করা পর্যন্ত–সবই তো প্রায় এক ধারার…এর ভেতর তারতম্যটা কোথায়? কেবল ই বউয়ের বেলাতেই যা একটু ইতরবিশেষ। সেই ইতরতম পর্বটা বাদ দিলে তো একই পার্বণ ভাই-একই মহোৎসব সব। …এমন কি, ওই ভগবানকেও যদি একান্ত আপনার করে পেতে চাই, কান্তভাবে ভজনা করি যদি…।
কথা হচ্ছে দাদা-বোনের সম্পর্ক নিয়ে তার মধ্যে এই সব গভীর তত্ত্ব আসছে কোত্থেকে? আমি বলি কি, বলছিলাম যে–দাদার অধিকারেরর সীমানাটা কোনখানে? তুমি তো জানো না ঠিক। দাদার দৌড় কদ্দূর?
আমি কী জানি তার। আমার কি নিজের বোন আছে যে জানব। আমার তো পরের বোন সব-পরীর মত হলেও তারা বোনের মতন…দূরের মাঠ যেমন আরও সবুজ, পরের বোন তেমনি আরো মধুর, গভীর, মায়াময়–সেই বোনান্তরালে কতো কী রহস্য আরো–কতো না আলো-আঁধারি–তার কিছু জানি, কিছু জানিনে!
এ তো গেল তোমার কাব্যকথা, আমার কথার ঠিক জবাব হোলো না তো!
মোল্লার দৌড় জানি মসজিদ পর্যন্ত, কিন্তু দাদার দৌড় কর তার আমি কী বলব! দিদিরাই জানেন! তুই-ই বলবি তো।
দাদার দৌড় বোনের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত–(যদ্দিন সে পরের না হয়–তদ্দিনই তার বোনের ওপর অধিকার) তার পর আর না।
বললেই হোলো! আমি ফোঁস করে উঠি : তার পর আমার বার্থরাইটটা চলে যাবে বুঝি? গেলেই হোলো?
যাবে না? তোমার কি আর আমার নিজের দাদাদেরই কি–আমার ওপর ওই বার্থরাইটটুকুই তো খালি। তার পরে বিয়ের পর আমার কপিরাইট অন্য লোকের হয়ে গেল না? যার কপিরাইট তারই অধিকার তখন।…কপিরাইট মানে জানো?
কেন জানব না? সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত। সে তো শুধু বইয়ের বেলাতেই রে।
বউয়ের বেলাতেও তাই। যার সেই রাইট আছে, বইয়ের মত, বউয়ের ও মুদ্রণের, প্রকাশের, যন্ত্রস্থ করার তারই অধিকার। সে যেমন খুশি ছাপাবে, বাঁধাবে, যেমন করে ইচ্ছে তার শো-কেসে সাজিয়ে রাখবে। অন্য কারো কিছুটি কওয়ার নেই।
না থাকে নাই থাকলো! সর্বসত্ত্ব চাইছে কে! আমসত্ত্ব আমার থাকলেই ঢের। মিষ্টি জিনিস পেলেই খুশী–চাইলেই যেমন আমি তা পাই–তাই হলেই হোলো। নিজের বোনকে আদর করার সেই আমার বার্থরাইট আমি ছাড়চিনে ভাই!
তা অবশ্যি থাকবে তোমার। বছরে দুদিন মাত্র–ভাইফোঁটার দিনটিতে আর আমার জন্মদিনে। আমার আর সব ভাইয়ের সঙ্গে তোমারও বাঁধা বরাদ্দ।… হ্যাঁ, আরেক দিনও হতে পারে, তোমার জন্মতিথিতে। ভালো কথা, তোমার জন্মদিনটা কবে গো?
জানিনে। আমার দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ে-এবার আমি জন্মেছি কোথায়, জন্মালাম কবে। সত্যি বলতে আমি জন্মাইনি এখনো। এ জন্মে আর জন্মলাভ হল না আমার।
এমনকি আমি যথার্থই জীবিত কি না আমার সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে।
তবে আর কী হবে? নিশ্বাস ফেলে রিনিও-তা হলে আরেক দিন হত আবার! কিন্তু জন্মদিন না থাকলে আর…
মৃত্যু দিনটা আছে ঠিকই। সেই দিনটি পেছোনোর জন্য যমের দুয়ারে কাঁটা দিতে ভাইফোঁটায় তোদর বাড়ি যেতেই হবে আমায়।
তা ছাড়া যাবে না আর? কীসের জন্যে আবার? বোন যদি সংসারের গভীরে হারিয়েই গেল–তা সে সহোদর বোন হোক, আর সুরভিত উপবনই হোক-সে তো তখন বোনও নয় বন্ধুও নয় আর! তার জন্যে হন্যে হয়ে নিরুদ্দেশে গিয়ে লাভ? সেই কন্টকিত বন্ধুর পথে শ্বাপদসঙ্কুল বনস্পতিদের আওতায় সেই মহারণ্যে রোদন করতে যায় কে? তবে হ্যাঁ, তোর জন্মদিনগুলোয় যাব আমি নিশ্চয়ই, সেদিনটি আমার মনে গাঁথা রয়েছে, আমার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত যাব, তুই নিশ্চিত থাক। খুব ভালো হয় যদি তোর জন্মদিন আর আমার মৃত্যুদিন একদিনেই আসে। তার চেয়ে ভালো বুঝি আর হয় না। আমার শেষ খাওয়াটা খেয়ে চলে যেতে পারি বেশ। বেশ খাওয়াটা খেয়ে চলে যাই শেষটায়!