‘ঈশ্বরের শক্তিতে সব শক্তিমান’

‘ঈশ্বরের শক্তিতে সব শক্তিমান’

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: তিনিই অখণ্ড-সচ্চিদানন্দ, তিনিই আবার জীব জগৎ হয়েছেন। (৩-১৬-১) যাঁরা জ্ঞানপথে চলেন তাঁরা অনেক সময় এই জীবজগৎকে অস্বীকার করেন। তাঁদের মতে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জীবজগৎ মিথ্যা। কিন্তু ভক্ত এই জীবজগৎকে স্বীকার করে। ভক্ত দেখে, এই জীবজগৎ তাঁর লীলা, তাঁর শক্তির খেলা। তিনিই এ সব হয়েছেন। ঠাকুর বলছেন: সেই অখণ্ড-সচ্চিদানন্দই জীবজগৎ হয়েছেন। আমরা উপনিষদেও দেখি, পরম সত্তা কামনা করলেন: ‘বহু স্যাম্‌’। ‘ব্রহ্ম’, তাঁর যেন আর একা ভাল লাগছে না। যেন নিঃসঙ্গ বোধ করছেন তিনি। তাই বলছেন, ‘বহু’ হব আমি। ‘প্রজায়েয়েতি’—বহুরূপে আমি জাত হব। তাই বহু হলেন তিনি। সেইজন্য এই জগৎ হল, জীবজন্তু হল, কত রকমের প্রাণী হল—মানুষ হল। তিনিই এই সব হলেন। আমরা সবাই আসলে তিনি, স্বরূপত ব্ৰহ্ম। ঠাকুর বলছেন: শরীরটা যেন একটা সরা। মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার এগুলি যেন জল। ব্রহ্ম সূর্যস্বরূপ—সেই জলে ব্রহ্মের প্রতিবিম্ব পড়েছে। আমাদের সবার মধ্যে সেই প্রতিবিম্ব। ‘এক এব হি ভূতাত্মা ভূতে ভূতে ব্যবস্থিতঃ’ —একই আত্মা বিভিন্ন জীব ও বস্তুর মধ্যে রয়েছে। ‘একধা বহুধা চৈব দৃশ্যতে জলচন্দ্রবৎ’—আকাশে এক চাঁদ, কিন্তু সেই চাঁদের ছায়া সমুদ্রে পড়েছে, নদীতে পড়েছে, পুকুরে পড়েছে, আবার একটা ছোট গামলাতেও পড়েছে। বিভিন্ন জলাধারে চাঁদের অনেকগুলো ছায়া দেখছি। এক চাঁদ, বহু বলে মনে হচ্ছে। তেমনি এক ব্ৰহ্ম—বিভিন্ন প্রাণীতে, বিভিন্ন মানুষে তাঁর প্রতিবিম্ব পড়েছে। ‘বহু’ বলে মনে হচ্ছে তাঁকে। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: নানারকম বালিশ। কোনটা মাথায় দেওয়ার, কোনটা পাশে দেওয়ার। কিন্তু সব বালিশের ভিতর এক তুলো। আবার বলছেন: চিনির রস দিয়ে মিষ্টি তৈরী হয়েছে। কোনটা হাতী, কোনটা ঘোড়া, কোনটা উট—কত রকমের দেখতে সব মিষ্টি। কিন্তু সব মিষ্টি এক উপাদানে তৈরী—চিনির রস দিয়ে। তেমনি, এই জীবজগতে কত কিছু বৈচিত্র্য দেখছি—কিন্তু স্বরূপত সবাই এক। সর্বভূতে সেই এক ব্ৰহ্ম। ‘এক’ই ‘বহু’ হয়েছে।

একটা শ্লোকে বলছে যে, ব্রহ্মের লক্ষণ কি আর জগতেরই বা লক্ষণ কি:

অস্তি ভাতি প্রিয়ং রূপং নাম চেত্যংশপঞ্চকম্‌।

আদ্যত্রয়ং ব্রহ্মরূপং জগদ্রূং ততো দ্বয়ম্॥

—অস্তি, ভাতি, প্রিয়, রূপ এবং নাম, এই পাঁচটি জিনিস। এর মধ্যে প্রথম তিনটি ব্রহ্মের লক্ষণ, বাকি দুটি জগতের লক্ষণ। অর্থাৎ ব্রহ্মের লক্ষণ হচ্ছে ‘অস্তি-ভাতি-প্রিয়’। ‘অস্তি’ অর্থাৎ তিনি আছেন। তিনিই একমাত্র বস্তু যা আছে। ‘ভাতি’ অর্থাৎ তিনি চৈতন্যস্বরূপ। ‘প্রিয়’ অর্থাৎ তিনি আনন্দস্বরূপ। ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ’ বলতে যা বোঝায়, ‘অস্তি-ভাতি-প্রিয়’ বলতেও তা-ই বোঝায়। আর জগতের কি লক্ষণ? নাম এবং রূপ। নামরূপাত্মক জগৎ। জগতে যা কিছু বৈচিত্র্য বা বিভিন্নতা দেখি—এই নাম এবং রূপের পার্থক্যের জন্য। আপনার একটা নাম, আমার একটা নাম; আপনার একরকম রূপ, আমার একরকম রূপ। তাই আমি আর আপনি আলাদা মনে হচ্ছে। এই নামরূপের তফাতটা যদি চলে যায়, তাহলে দেখা যাবে, আমি আর আপনি আলাদা নই, স্বরূপত আমরা এক ব্ৰহ্ম। এই নামরূপটাকে বলা হচ্ছে বিকার। নামরূপের বিকারে এক ব্ৰহ্ম বহু বলে প্রতিভাত হচ্ছেন। যেমন মাটির ঘোড়া, মাটির হাতি এসব হয়তো তৈরী হয়েছে। নানারকম রূপ তাদের, আবার নানারকম নাম। কিন্তু আসলে সব মাটি। মাটি দিয়েই হাতি-ঘোড়া তৈরী হয়েছে। উপনিষদে বলছে: ‘যথা সোম্যৈকেন মৃৎপিণ্ডেন সর্বং মৃন্ময়ং বিজ্ঞাতং স্যাৎ’—একটা মৃৎপিণ্ডকে যদি তুমি মাটি বলে জানতে পার তাহলে মাটির তৈরী সব জিনিসকেই তুমি জানতে পারবে। তখন তুমি বুঝবে যে, এই যে ঘোড়া দেখছি, হাতি দেখছি, উট দেখছি—কত কি দেখতে পাচ্ছি—এগুলি সত্য নয়। মাটিই সত্য। মাটিই বস্তু। আর এগুলি হচ্ছে আরোপ করা জিনিস। ‘নাম আর রূপ’ আরোপ করা হয়েছে। ‘বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্‌’—মৃত্তিকাই সত্য। আর এগুলি হচ্ছে ‘বিকার’। তেমনি নামরূপের বিকারে এই জগতে এত বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। এই বৈচিত্র্য সত্য নয়, এই বিভিন্নতা সত্য নয় —সত্য হচ্ছেন ব্রহ্ম। সেইজন্য জ্ঞানপথে যাঁরা চলেন, তাঁরা অনেক সময় এই জগৎটাকে অস্বীকার করেন।

ভক্তেরা কিন্তু তা করে না। ভক্তেরা বলে এই জগৎ ভগবানের ঐশ্বর্য। আকাশ, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য, পর্বত, সমুদ্র, জীব, জন্তু এ সব ঈশ্বর করেছেন। তাঁরই ঐশ্বর্য। তিনি অন্তরে হৃদয়মধ্যে আবার বাহিরে। (১-২-৩) আমার ভিতরে তিনি, আবার বাইরেও তিনি। উত্তম ভক্ত বলে, তিনি নিজে এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব—জীব জগৎ হয়েছেন। (ঐ) সাংখ্যে এই চতুর্বিংশতি তত্ত্বের কথা পাওয়া যায়। সাংখ্যমতে বলছে: এই জগৎসংসার কি কি উপাদানে তৈরী হয়েছে? প্রথমে বলছে: ‘প্রকৃতি’। তারপরে ‘মহৎ’। এরপরে ‘অহঙ্কার’। অহঙ্কার না হলে কিছুই হবে না। অহঙ্কার থেকেই একটা ইচ্ছা বা বাসনা জাগে। তারপরেই ‘পঞ্চতন্মাত্র’। কি সেগুলি? শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। তারপরে হচ্ছে ‘পঞ্চমহাভূত’—ক্ষিতি, অপ্‌, তেজ, মরুৎ, ব্যোম্‌। ‘পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়’—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্‌। তারপরে ‘পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়’—বাক্, পাণি, পাদ, উপস্থ, পায়ু। আর হচ্ছে মন। সব মিলিয়ে মোট চব্বিশ। সবগুলিকে জোড়া দিচ্ছে, ধরে রেখেছে মন। মন না হলে কিছুই হবে না। এই হচ্ছে ‘চতুর্বিংশতিতত্ত্ব’। ভক্ত বলে: চতুর্বিংশতিতত্ত্ব, যা দিয়ে জীবজগৎ তৈরী হয়েছে, তা-ও ঈশ্বর।

ঠাকুর বলছেন: ব্ৰহ্ম—জীবজগৎবিশিষ্ট। (১-১৩-৬) রামানুজের এরকম একটা মত আছে। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলে একে। এই জীবজগৎ ‘অসৎ’ না—ব্রহ্মের অংশ। অংশ-অংশী সম্পর্ক। বলছেন: প্রথম নেতি নেতি করবার সময় জীবজগৎকে ছেড়ে দিতে হয়। (ঐ) সাধক-অবস্থায় জগৎকে বর্জন করতেই হয়। এই জগৎটার প্রতি আমার এখনকার যে দৃষ্টি সেটা ভুল দৃষ্টি। জগৎকে আমি ঈশ্বরের প্রকাশ হিসেবে এখন দেখতে পাচ্ছি না, জগৎকে ‘জগৎ’ই দেখছি। ‘জগৎবুদ্ধি’তেই জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আছি। সেইজন্য এখন আমাকে জগৎ থেকে মনটাকে টেনে এনে পুরোপুরি ঈশ্বরে দিতে হবে। কিন্তু ঈশ্বরকে যখন আমি লাভ করব, লক্ষ্যে পৌঁছে যাব যখন, তখন দেখব, তিনিই সব হয়েছেন—ঈশ্বরমায়াজীবজগৎ। তখন বোধ হয় জীবজগৎসুদ্ধ তিনি।(১-৯-২) উদাহরণ দিচ্ছেন যে, একটা বেলের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে বেলের সার পদার্থ হচ্ছে শাঁস। কারণ শাঁসটাই আমরা খাই, খোলা আর বীচিটা ফেলে দিই। কিন্তু কেউ যখন বেলের মোট ওজনটা জানতে চায় তখন কিন্তু শুধু শাঁস ওজন করলে চলবে না—তাহলে ওজনে কম পড়বে। শাঁসের সঙ্গে খোলা আর বীচিও ওজন করতে হবে। ওজনের সময় শাঁস, বীচি, খোলা সব নিতে হবে। যারই শাঁস, তারই বীচি, তারই খোলা।(১-১৩-৬) বলছেন: খোলাটা যেন জগৎ; জীবগুলি যেন বীচি। বিচারের সময় জীব আর জগৎকে অনাত্মা বলেছিলে, অবস্তু বলেছিলে। বিচার করবার সময় শাঁসকেই সার, খোলা আর বীচিকে অসার ব’লে বোধ হয়। বিচার হ’য়ে গেলে, সমস্ত জড়িয়ে এক বলে বোধ হয়। আর বোধ হয়, যে সত্তাতে শাঁস সেই সত্তা দিয়েই বেলের খোলা আর বীচি হয়েছে। বেল বুঝতে গেলে সব বুঝিয়ে যাবে। (১-৯-২) ঈশ্বর লাভ করার পরে দেখা যাবে সব ঈশ্বর। কাউকে বাদ দেবার নেই, কোন কিছু বর্জন করবার নেই। সবকিছু নিয়ে তিনি। ‘জীবজগৎসুদ্ধ।’ ঠাকুর তাই বলছেন: আমি সবই লই। ···ব্রহ্ম আবার মায়া, জীব, জগৎ আমি সবই লই। ···যাঁবই নিত্য, তাঁরই লীলা। তাই আমি নিত্য, লীলা সবই লই। মায়া ব’লে জগৎ সংসার উড়িয়ে দিই না। তা হ’লে যে ওজনে কম পড়বে। (১-১৩-৬)।

শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদে এই মায়ার সম্বন্ধে বলা হচ্ছে। ‘দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈনিগূঢ়াম্‌’। মায়া হচ্ছে পরমাত্মার শক্তি। ব্রহ্মের শক্তি এই মায়া। এই শক্তির প্রভাবেই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সবকিছু হচ্ছে। এই শক্তির ক্রিয়াতেই সমস্ত জগৎ চলছে। অনেক বেদান্তী আছেন যাঁরা মায়া মোটেই স্বীকার করেন না। কিন্তু মায়া বা শক্তি না মানলে এই সৃষ্টির কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। ব্ৰহ্ম তো নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়—তিনি কি করে সৃষ্টি করবেন বা জগৎ চালাবেন? কাজেই, মায়া মানতেই হয়। ঠাকুরের সন্ন্যাসগুরু তোতাপুরীও মায়া মানতেন না। ব্ৰহ্ম মানতেন—কিন্তু ব্রহ্মের যে শক্তি, যে শক্তির প্রভাবে জগৎ-সংসার চলছে, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সবকিছু হচ্ছে, সেই শক্তিকে তিনি মানতেন না। ঠাকুর হাততালি দিয়ে ভগবানের নাম করতেন, উনি ঠাট্টা করতেন: কেঁও রোটী ঠোক্‌তে হো? সাধুরা অনেক সময় বেলুনীর অভাবে হাত দিয়ে ঠুকেই রুটি তৈরী করেন। ঠাকুর হাততালি দিচ্ছেন বলে ব্যঙ্গ করছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকেও শক্তি মানতে হল। তিনি দক্ষিণেশ্বরে অনেকদিন ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের জলহাওয়া তাঁর সহ্য হল না—রক্ত-আমাশা হল তাঁর। তবে সমাধিমান পুরুষ, পেটে যন্ত্রণা হলেই মনটা শরীর থেকে তুলে সমাধিতে ডুবে যেতেন। তখন আর তিনি শরীরের যন্ত্রণা বোধ করতেন না। কিন্তু একদিন রাত্রিবেলায় যন্ত্রণা এত বেড়ে গেল যে, কিছুতেই আর মনকে শরীর থেকে তুলে নিতে পারছেন না। যত বার চেষ্টা করেন, ততবারই মনটা ঘুরে ফিরে শরীরে নেমে আসে। তখন তিনি খুব বিরক্ত হলেন শরীরের উপর, ঠিক করলেন হাড়মাংসের এই খাঁচাটাকে এক্ষুনি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন—শরীর ত্যাগ করবেন। গঙ্গায় নেমেছেন শরীর ত্যাগ করবেন বলে, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, যতদূর যান ডোববার মতো জল নেই। হাঁটতে হাঁটতে তিনি প্রায় গঙ্গার ওপারে চলে এলেন—তবুও ডোববার মতো জল পেলেন না। তখন তোতাপুরী বুঝলেন: এ মহামায়ার খেলা। দেখতে পেলেন: ‘জলে মা, স্থলে মা; শরীর মা, মন মা; যন্ত্রণা মা, সুস্থতা মা; জ্ঞান মা, অজ্ঞান মা; জীবন মা, মৃত্যু মা···।’ সর্বত্র সেই মা, ‘অচিন্ত্যশক্তিরূপিণী’ মা। ‘অঘটনঘটনপটীয়সী’ মা। শক্তিকে মেনে নিলেন তোতাপুরী। মা-কালীকে প্রণাম করে দক্ষিণেশ্বর থেকে বিদায় নিলেন।

শঙ্করাচার্যের সম্বন্ধেও এইরকম একটা কাহিনী শোনা যায়। তিনিও শুধু ব্ৰহ্ম মানতেন, শক্তি মানতেন না। একবার তিনি গেছেন কাশীতে, ভোরবেলা মণিকর্ণিকা ঘাটে স্নান করতে যাচ্ছেন, দেখেন—যাওয়ার সরু পথের উপর একজন নারী তাঁর স্বামীর শব রেখে চিৎকার করে কাঁদছেন। এমনভাবে তিনি শবটা রেখেছেন যে, চলাচলের পথ বন্ধ। শঙ্করাচার্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন, তারপর ঐ মহিলাকে বললেন: মা, তুমি দয়া করে শবটি সরিয়ে একটু পথ করে দেবে? আমরা গঙ্গায় যাব। সেই রমণী শঙ্করাচার্যকে বললেন: বাবা, তুমিই শবকে আদেশ কর না সরে যেতে। শঙ্করাচার্য বললেন: শোকে নিশ্চয়ই তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে। না হলে এমন কথা কি করে বলছ? আমি শবকে সরে যেতে বলব, আর শব সরে যাবে? তার কি শক্তি আছে সরে যাবার? তখন সেই মহিলা তাঁর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন: সন্ন্যাসী, তুমি তো শক্তি মান না, তুমি তো বল একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, ব্রহ্মই সব করছে। তাহলে তো এই শবও ব্রহ্ম, তবে কেন এ সরতে পারবে না? শঙ্করাচার্য বললেন: কি করে সরবে? কে সরাবে তাকে? মহিলা বললেন: তাহলে ব্রহ্মই সব নয়? আর একটা কিছু আছে, একটা শক্তি যে আছে, সেটা তুমি স্বীকার করে নিচ্ছ তাহলে? শঙ্করাচার্য আর কিছু বলতে পারলেন না, শক্তি মেনে নিলেন। মহামায়া স্বয়ং এসেছিলেন তাঁকে শিক্ষা দিতে।

বেদান্তদর্শনে দেখা যায়, শঙ্করাচার্য পরিষ্কারভাবে বলছেন যে, মায়াটা হচ্ছে ব্রহ্মের শক্তি। এই শক্তি না মানলে সৃষ্টির কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। ব্ৰহ্মসূত্রের ভাষ্যে তিনি বলছেন: ‘নহি তয়া বিনা পরমেশ্বরস্য স্রষ্টৃত্বং সিধ্যতি, শক্তিরহিতস্য তস্য প্রবৃত্ত্যনুপপত্তেঃ।’—শক্তি বাদ দিলে ব্রহ্মের স্রষ্টৃত্বই সিদ্ধ হয় না। ব্রহ্ম হচ্ছেন নিষ্ক্রিয়, অনপেক্ষ, দ্রষ্টা। তাঁর কি করে এইসব সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কার্যে প্রবৃত্তি হবে? শক্তি না মানলে এর কোন যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না—এই বলছেন শঙ্করাচার্য, শক্তি মানছেন তিনি। তাছাড়া, তাঁর জীবনটা একটু ভাল করে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, জগৎকে তিনি অস্বীকার করেননি। কী অদ্ভুত কর্মময় জীবন তাঁর! ভারতবর্ষের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত পদব্রজে ঘুরছেন—সেইযুগে। একের পর এক পণ্ডিতদের পরাজিত করে সনাতনধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছেন। কত ভাষ্য, কত শ্লোক রচনা করছেন। কত লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার করছেন। ভারতবর্ষের চার প্রান্তে চারটে মঠ প্রতিষ্ঠা করে একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন হিন্দুধর্মকে রক্ষা করবার জন্য। এত কাজ যে তিনি করলেন, জগতের কল্যাণের জন্যই তো? তাঁর নিজের জন্য তো এসবের প্রয়োজন ছিল না। কাজেই তিনি নিশ্চয়ই জগৎকে সত্যি হিসেবে দেখেছিলেন। ব্রহ্ম সত্য, তাঁর প্রকাশ এই জগৎ, তাই জগৎও সত্য। অন্তত ব্যবহারিক অর্থে।

‘কথামৃতে’ ঠাকুর বার বার করে বলছেন: যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা। (১-১৩-৬) যিনি ব্রহ্ম, তিনিই কালী (মা আদ্যাশক্তি)। (১-১২-৯) এই কালীমূর্তি সম্বন্ধে সেযুগে লোকের একটা ভয়ানক বিতৃষ্ণা ছিল। অনেকেরই ভারী অপছন্দ এই কালীমূর্তি। ‘কথামৃত’তেই দেখতে পাই, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক, তিনি বলছেন: কালী? সে তো একটা সাঁওতাল রমণী। নিবেদিতা একবার কলকাতার অ্যালবার্ট হলে কালী সম্বন্ধে বক্তৃতা করেছিলেন। সেই বক্তৃতা নিয়ে তুমুল কাণ্ড। একদল বলে: অপূর্ব বক্তৃতা। আর একদল বলে: অশ্লীলতার চূড়ান্ত। এই দ্বিতীয় যে দল, তাতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন ডাক্তার সরকার। ভাবতে অবাক লাগে, একজন বিদেশী মহিলা মা-কালীর হয়ে লড়াই করছেন। আর আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশ মা-কালীকে বলছে: সাঁওতাল রমণী। একদিক থেকে দেখতে গেলে শ্রীরামকৃষ্ণই মা-কালীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন।

ঠাকুর বলছেন: নিত্য আর লীলা আলাদা নয়, ব্ৰহ্ম আর কালী এক। কালী হচ্ছেন ব্রহ্মের শক্তি। শক্তি আর শক্তিমান অভেদ। বলছেন; আমি জানি, ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। যেমন জল আর জলের হিমশক্তি। অগ্নি আর দাহিকাশক্তি। (২-১৪-৪) দুধ আর দুধের ধবলত্ব···। একটাকে ভাবলেই আর একটাকে ভাবতে হয়। (১-১২-৯) প্রকৃতির সাথে পুরুষের, শিবের সঙ্গে শক্তি বা কালীর, ব্রহ্মের সঙ্গে মায়ার এই হচ্ছে সম্পর্ক। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও ঠিক একই কথা আছে যা ঠাকুর বলছেন। ‘যথা দুগ্ধে চ ধাবল্যম্‌’—দুধ যেখানে আছে, দুধের সাদা রংও সেখানে আছে। ‘যথা জলং তথা শৈত্যম্‌’—জল যেখানে আছে, সেখানেই শৈত্য রয়েছে। ‘যথা বহৌ চ দাহিকা’—আগুন যেখানে আছে সেখানে দাহিকাশক্তিও আছে। ‘ন তয়োর্ভেদঃ’—দুয়ের মধ্যে কোন ভেদ নেই। এর ব্যতিক্রম আমরা কখনও দেখি না। তেমনি যেখানে ব্ৰহ্ম আছেন সেখানে মায়াও আছেন, যেখানে পুরুষ আছেন সেখানে প্রকৃতিও আছেন, যেখানে শিব আছেন, শক্তি বা কালীও সেখানে আছেন। যখন নিষ্ক্রিয়, তাঁকে ব্ৰহ্ম ব’লে কই। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এই সব কাজ করেন তাঁকে শক্তি ব’লে কই। স্থির জল ব্রহ্মের উপমা। জল হেল্‌চে দুল্‌চে, শক্তি বা কালীর উপমা। (ঐ) ব্ৰহ্ম হচ্ছেন সাক্ষিস্বরূপ, নিষ্ক্রিয়, দ্রষ্টা। যে-অবস্থায় কোন ক্রিয়া নেই সেই অবস্থার নাম ব্ৰহ্ম। ব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার, নির্বিশেষ—তাঁর কোন বিশেষ নেই, বিশেষত্ব নেই। নিরুপাধিক তিনি, কোন উপাধি নেই। সেই ব্ৰহ্ম যখন আবার সৃষ্টি করছেন, পালন করছেন, ধ্বংস করছেন, তখন তিনি হচ্ছেন কালী বা শক্তি। এই যে শিব আর কালী—শিব যেন নিত্য, মা-কালীর পায়ের নিচে শব হয়ে পড়ে আছেন। নিষ্ক্রিয়, দ্রষ্টা, উদাসীন। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছেন—কিছু করছেন না। কিন্তু তিনিই আবার ঐ কালী হয়েছেন, তিনিই ঐ নিত্যচঞ্চলা, নিত্যলীলাময়ী। নিত্য আর লীলা অভেদ। মা-কালীর এক হাতে বরাভয় আর এক হাতে খড়্গ। এক হাত দিয়ে তিনি সকলকে অভয় দান করছেন, সৃষ্টি-স্থিতি-পালন করছেন, আবার আর এক হাতে তিনি ধ্বংস করছেন। একদিকে তিনি অভয়া অন্যদিকে ভয়ংকরী। একদিকে দয়াময়ী অপরদিকে সংহাররূপিণী করালী। একই মৃর্তিতে পরস্পরবিরোধী ভাব।

আবার এই জগতেও দেখছি তাই। একদিকে ধ্বংস আর একদিকে সৃষ্টি। একদিকে বুদ্ধের মতো লোক, চৈতন্যের মতো লোক। অপরদিকে চেঙ্গিস খাঁ-তৈমুরলঙ্গের মতো নিষ্ঠুর যুদ্ধোন্মাদ লোক। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে কে একজন মন্তব্য করেছে: ঈশ্বর দয়াময়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: কি করে তিনি দয়াময় হলেন? তিনি যে কত দিয়েছেন, এইজন্য? কিন্তু তিনি যে আবার কত কেড়েও নিচ্ছেন! বৃষ্টি তাঁর দান, আবার অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টিও তো তাঁরই দান। একজনের অল্পবয়স, সমস্ত জীবন পড়ে আছে—তার হঠাৎ মৃত্যু হল। অথচ আর একজন একেবারে বৃদ্ধ, অসুস্থ—সে নিজেও হয়তো মৃত্যু কামনা করছে—তার মৃত্যু হচ্ছে না। কি করে ভগবানকে দয়াময় বলব? আবার হয়তো ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা, মৃত্যু নিশ্চিত—অলৌকিকভাবে জীবন রক্ষা হয়ে গেল। তাহলে তিনি যে দয়াময় নন তাও তো নয়? আসলে তিনি দয়াময় এবং নির্দয় দুই-ই। কারণ তিনিই সব। আবার আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার, এই জগতে ভালর সঙ্গে মন্দ, মন্দের সঙ্গে ভাল সবসময় মেশানো থাকে। নিছক ভাল বলে কিছু নেই, আবার নিছক মন্দও কিছু নেই। ১৯৭৮ খ্রীষ্টাব্দে কী ভীষণ বন্যা হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গে! কত ক্ষয়ক্ষতি হল। কিন্তু আবার সেই বন্যার ফলে কত ভাল ফসল হল সব জায়গায়। আমি মেদিনীপুরে গেছিলাম বন্যার বছরখানেক পরে। অনেকেই বললেন: এত ভাল ফসল বহুবছর হয়নি। অথচ মেদিনীপুরই বন্যায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার! এই মায়ার জগতে এমনই চলছে সব সময়—এই ভাঙাগড়া। আমরা ভাল-মন্দ বলি আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। আসলে ভাল-মন্দ সব আপেক্ষিক। ঈশ্বর তিনি ভালও যেমন, মন্দও তেমন। তিনি দয়াময়ও যেমন, তেমনি আবার দয়াময় ননও। দুই দেশের যুদ্ধ লেগেছে, দুই দেশের লোকই তাঁর কাছে প্রার্থনা করছে। এখন, ঈশ্বর তো একজনই, আবার যুদ্ধের ফলও তো একটাই হবে। আমার দেশ যুদ্ধে জিতল, আমি তাঁকে ‘দয়াময়’ বলব, কিন্তু যারা যুদ্ধে হেরে গেল তারা তো বলবে না। একই ঘটনা আমার চোখে ভাল, আর একজনের চোখে মন্দ। একই জিনিসের জন্য আমি তাঁকে বলছি ভাল, আর একজন বলছে মন্দ। বাস্তবিক সব তিনি—ভাল-মন্দ সব তিনি। রামপ্রসাদ গাইছেন: ‘ওমা তুমি দুঃখ, তুমি সুখ, চণ্ডীতে তা লেখা আছে।’ লক্ষ্য করবার বিষয়, ‘মা’কে বলা হচ্ছে ‘তুমি দুঃখ তুমি সুখ’। ব্রহ্মকে কিন্তু বলা হচ্ছে না। ব্রহ্ম এসবের ঊর্ধ্বে। ব্রহ্মের শক্তিকে বলা হচ্ছে যে, তুমিই ভাল-মন্দ সব। ‘চণ্ডীতে তা লেখা আছে’। চণ্ডীতে কি লেখা আছে? চণ্ডীতে আছে: তুমি শান্তি, তুমি ক্ষান্তি, তুমি ভ্রান্তি, তুমি সৃষ্টি, তুমি ধ্বংস, তুমিই সব। ‘বিশ্বস্য বীজং পরমাসি মায়া’—সব কিছুর বীজ বা মূল তুমি। ভালর মূল, মন্দেরও মূল। ‘ত্বমীশ্বরী দেবি চরাচরস্য’—চরাচর সকলের তুমি হচ্ছ অধীশ্বরী। ‘আধারভূতা জগতস্ত্বত্মেকা’—সকলের আধার তুমি। এক তুমিই আছ। তুমি আছ, তাই সব আছে। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: ‘এক’-এর পিঠে শূন্য পর পর বসিয়ে যাও, বিরাট সংখ্যা হবে। কিন্তু ‘এক’ মুছে দিলে কোন সংখ্যা নেই, শুধু শূন্য। মা, তুমি সেই ‘এক’। ‘অধিষ্ঠান’ তুমি। তুমি আছ তাই সব আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: একদিন দক্ষিণেশ্বরে দেখলাম, হঠাৎ এক নারী গঙ্গা থেকে যেন উঠে এলেন। আমার সামনেই তিনি এক সন্তান প্রসব করলেন। সন্তান প্রসব করে কিছুক্ষণ তাকে খুব আদর-যত্ন করলেন। তারপর সেই সন্তানকে তিনি নিজেই খেয়ে ফেললেন। তিনি সৃজনকর্ত্রী, তিনি পালয়িত্রী, তিনিই আবার সংহাররূপিণী। এক শক্তি—তারই বিভিন্ন রূপ। এক বিদ্যুৎ—তা দিয়ে কত ভাল কাজ হচ্ছে, আবার এই বিদ্যুতেই কত কিছু ধ্বংস হচ্ছে। কেউ হয়তো অনেক অপরাধ করেছে, আদালত তাকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মেরে ফেলতে আদেশ দিয়েছে। আবার এই বিদ্যুতের অভাবে আমরা হাহাকার করছি। আমাদের দেশে এখন সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত জিনিস বোধহয় বিদ্যুৎ। একই শক্তি—তাকে ভাল বলব না মন্দ বলব? স্বামীজী একটা কবিতায় বলছেন: মা, এই সংসারটা তোমার খেলাঘর। —‘স্বরচিত লীলাগার···সুখ দুঃখ ল’য়ে সদা নানা খেলা খেলিছ।’ কখনও সুখ কখনও দুঃখ—আমাদের কাছে যা সুখ দুঃখ, তাঁর কাছে তা খেলা। জগতের ধর্ম এই ‘দ্বন্দ্ব’—দিনরাত, আলো-অন্ধকার, ভাল-মন্দ, জন্ম-মৃত্যু। দুই নিয়ে এই জগৎ। কিন্তু এ সব তাঁর শক্তির খেলা। তাঁর থেকেই সব আসছে। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায়: তিনিই আস্তিক, তিনিই নাস্তিক; তিনিই ভাল, তিনিই মন্দ; তিনিই সৎ, তিনিই অসৎ; জাগা, ঘুম এ সব অবস্থা তাঁরই। (২-৭-২) বলছেন: সাপ হয়ে খাই আমি রোজা হয়ে ঝাড়ি, হাকিম হয়ে হুকুম দিই পেয়াদা হয়ে মারি। সাপ হয়ে তিনি কামড়াচ্ছেন, আবার রোজা হয়ে তিনিই আসছেন বিষ ঝাড়তে। হাকিম হয়ে হুকুম দিচ্ছেন তিনি, আবার তিনিই পেয়াদা হয়ে সেই হুকুম তামিল করছেন। সব তিনিই। এটা কিন্তু লীলার অবস্থা। আবার তিনি এসব অবস্থার পার। (ঐ)—যখন তিনি নিত্য, সৎ, নিষ্ক্রিয়। ঐ শিব তখন তিনি—শব হয়ে পড়ে আছেন। কিন্তু তিনিই আবার আর এক অবস্থায় লীলা। —তখন তিনি ভাঙছেন গড়ছেন সব কিছু করছেন। যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা।

‘কথামৃতে’ আমরা প্রকৃতি, মায়া, শক্তি—এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হই। এই তিনটেই কিন্তু একই জিনিসকে বোঝাচ্ছে। বেদান্তে যাকে বলছে ব্ৰহ্ম ও মায়া, সাংখ্যে সেটাকে বলছে পুরুষ ও প্রকৃতি, আর তন্ত্রে সেটাকেই বলছে শিব ও শক্তি বা শিব ও কালী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে ভগবান বলছেন: ‘প্রকৃতির্মদ্বিকারা’—আমারই একটা বিকার বা অবস্থান্তর হচ্ছে এই প্রকৃতি। ঠাকুর বলছেন: প্রকৃতি ত্রিগুণময়ী! এঁর ভিতরে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিন গুণ। (২-১৯-৩) এই তিন গুণের ক্রিয়ায় সমস্ত জগৎ সংসার সৃষ্টি হয়েছে, এবং চলছে। ‘সাপ্যহং প্রকৃতিঃ স্বয়ম্‌’ —আমি নিজে এই প্রকৃতি হয়েছি। এখানে একটা প্রশ্ন: বিশ্বসংসারে সবকিছুই তো এই মায়া বা প্রকৃতির অধীন, ব্ৰহ্ম বা পুরুষও কি এর অধীন? না, তা নয়। ব্রহ্মের মায়া, সবাই সেই মায়ার বশ—কিন্তু তিনি মায়াধীশ। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: সাপের ভিতর বিষ আছে, সাপের কিছু হয় না। যাকে কামড়াবে, তার পক্ষে বিষ। ব্রহ্ম নিজে নির্লিপ্ত। (ঐ) শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদে বলা হচ্ছে:১০ ‘মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনন্তু মহেশ্বরম্‌’—মায়াকে প্রকৃতি বলে জানবে, আর এই প্রকৃতিকে যিনি চালাচ্ছেন সেই পরমেশ্বরকে বা মহেশ্বরকে জানবে মায়াধীশ।

ঠাকুর বলছেন: প্রকৃতি বা কালী নানাভাবে লীলা করছেন। তিনিই মহাকালী, নিত্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, শ্যামাকালী। মহাকালী, নিত্যকালীর কথা তন্ত্রে আছে। যখন সৃষ্টি হয় নাই; চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, পৃথিবী ছিল না; নিবিড় আঁধার; তখন কেবল মা নিরাকারা মহাকালী—মহাকালের সঙ্গে বিরাজ ক’রছিলেন। (১-২-৪)

বলছেন: শ্যামাকালীর অনেকটা কোমল ভাব—বরাভয়দায়িনী। গৃহস্থবাড়িতে তাঁরই পূজা হয়। যখন মহামারী, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি হয় রক্ষাকালী পূজা করতে হয়। শ্মশানকালীর সংহার মূর্তি। শব, শিবা, ডাকিনী, যোগিনী মধ্যে, শ্মশানের উপর থাকেন। রুধিরধারা, গলায় মুণ্ডমালা, কটিতে নরহস্তের কোমরবন্ধ। (ঐ) একই শক্তি বিভিন্নভাবে ক্রিয়া করছে। তার প্রতীক হিসেবে কালীর এইরকম নানারকম মূর্তি কল্পনা করা হয়েছে। যখন জগৎ নাশ হয়, মহাপ্রলয় হয়, তখন মা সৃষ্টির বীজ সকল কুড়িয়ে রাখেন।(ঐ) সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় সবই তো তিনি করছেন। যখন প্রলয় হল, যখন তিনি এই জগৎ ধ্বংস করেন, তখন সৃষ্টির বীজগুলো তিনি যত্ন করে রেখে দেন। গিন্নীর কাছে যেমন একটা ন্যাতা-ক্যাতার হাঁড়ি থাকে, আর সেই হাঁড়িতে গিন্নী পাঁচ রকম জিনিস তুলে রাখে। ···ভিতরে সমুদ্রের ফেনা, নীল বড়ি, ছোট ঘোট পুঁটলি বাঁধা শশা বীচি, কুমড়া বীচি, লাউ বীচি এইসব রাখে, দরকার হ’লে বার করে। (ঐ) ঐ বীচিগুলো পরে তিনি মাটিতে পোঁতেন। তা থেকে আবার গাছ হয়। তেমনি মা ব্রহ্মময়ী সৃষ্টি নাশের পর ঐ রকম সব বীজ কুড়িয়ে রাখেন। (ঐ) তা থেকেই আবার তিনি নতুন করে জগৎ সৃষ্টি করেন। ঠাকুর বলছেন: অনুলোম বিলোম।(১-৯-২) অনুলোম অর্থাৎ জগৎকে যখন তিনি গুটিয়ে আনছেন, ধ্বংস করছেন—Involution; আর বিলোম অর্থাৎ যখন তিনি এই জগৎ সৃষ্টি করছেন—নিজেকে যেন বিস্তার করে দিচ্ছেন—Evolution। মাকড়সা যেমন নিজের লালা দিয়ে একটা জাল তৈরী করছে আবার সেই জাল সে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিচ্ছে—বিলোম আর অনুলোম। তেমনি আদ্যাশক্তি বা কালী কখনও নিজেকে ব্যক্ত করছেন, কখনও আবার নিজেকে সংহত করছেন, অব্যক্ত অবস্থায় চলে যাচ্ছেন। ঠাকুর বলছেন: সৃষ্টির পর আদ্যাশক্তি জগতের ভিতরেই থাকেন! জগৎ প্রসব করেন, আবার জগতের মধ্যে থাকেন। (১-২-৪) তিনিই জীবজগৎ সৃষ্টি করেছেন আবার তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন। ‘তং সৃষ্টত্বা তদেবানুপ্রাবিশৎ।’১১ জীবজগৎ সৃষ্টি করে তিনি তাতে প্রবেশ করলেন। তিনি এই জগতের ‘নিমিত্ত কারণ’ আবার ‘উপাদান কারণ’। কিরকম? ধরা যাক, একটা কাঠের টেবিল। সেটা গড়েছে একজন ছুতোর। সে এর নিমিত্ত কারণ। আর টেবিলটা কাঠের—তাই এর উপাদান কারণ হচ্ছে কাঠ। এখানে উপাদান কারণ আর নিমিত্ত কারণটা আলাদা হল। কিন্তু এই জগতের ক্ষেত্রে নিমিত্ত কারণ উপাদান কারণ দুই-ই তিনি। তিনি এই জীবজগতের স্রষ্টা আবার তিনিই এই জীবজগৎ। উদাহরণ দিয়ে বলছেন: বেদে আছে ‘ঊর্ণনাভির’ কথা; মাকড়সা আর তার জাল। মাকড়সা, ভিতর থেকে জাল বা’র করে, আবার নিজে সেই জালের উপর থাকে। (ঐ) জাল তৈরী করেছে মাকড়সা, আবার জালের উপরে যে রয়েছে সে-ও ঐ একই মাকড়সা। তেমনি ঈশ্বর জগতের আধার আধেয় দুই। (ঐ) তিনিই জীবজগৎ সৃষ্টি করেছেন, আবার তিনিই এই জীবজগৎ হয়েছেন। বাপ, মা, ছেলে, প্রতিবেশী, জীব-জন্তু, ভাল-মন্দ, শুচি, অশুচি সমস্ত। (১-৯-২)

শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদে রয়েছে:১২ ‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি’—তুমি স্ত্রী আবার তুমিই পুরুষ। ‘ত্বং কুমার উত বা কুমারী’—তুমি বালক আবার তুমিই বালিকা। ‘ত্বং জীর্ণো দণ্ডেন বঞ্চসি’— জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ, লাঠি ছাড়া যে চলতে পারে না, সেও তুমি। ‘ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ’—তুমিই নানা রূপ ধারণ করে বিরাজ করছ। স্বামীজী একদিন বেলুড় মঠে এই প্রসঙ্গ করতে করতে এমন অনুপ্রাণিত হয়েছেন যে, যাকে সামনে দেখছেন তাকেই দেখিয়ে বলছেন: ঐ ব্রহ্ম, ঐ ব্রহ্ম। আর উপস্থিত সবারও ঠিক সেইরকম অনুভূতি হচ্ছে। তাদেরও মনে হচ্ছে যে, সর্বত্র ব্রহ্ম বিরাজ করছেন, ঈশ্বর বিরাজ করছেন। আমরা বলি, ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’। (জীবই ব্ৰহ্ম) এই তত্ত্বগুলি কিভাবে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে চলে এসেছে আমরা সবসময় খেয়াল করি না। আমরা মন্দিরে ঠাকুর-দেবতাকে নমস্কার করি। আবার কারও সাথে দেখা হলেও তো বলি ‘নমস্কার’। কেন বলি? কারণ প্রত্যেকের ভিতর ব্ৰহ্ম রয়েছেন, ঈশ্বর রয়েছেন, নারায়ণ রয়েছেন। আমি তাঁকেই নমস্কার করছি, আর কাউকে করছি না। আমরা সকলের মধ্যেই সেই এক ঈশ্বরকে দেখতে চেষ্টা করি। সকলের মধ্যেই তিনি বিরাজ করছেন। সাধুর মধ্যেও যেমন আছেন, ঘৃণ্যতম যে পাপী তার মধ্যেও আছেন। ঠাকুর বলছেন: যেমন সাধুরূপী নারায়ণ, তেমনি ছলরূপী নারায়ণ, লুচ্চারূপী নারায়ণ···সকলই নারায়ণ। (২-২৪-৫) স্বামীজীর ভাষায়: God the wicked, God the sinner—দুষ্ট নারায়ণ, পাপী নারায়ণ। কাকে আমি অবহেলা করব? কাকে অশ্রদ্ধা করব? যদি জীব দেখি তাহলে তো ভাল-মন্দের প্রশ্ন ওঠে, শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধার প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু আমি যে সবার মধ্যে ঈশ্বর দেখছি। ঈশ্বরকে আমি কি অশ্রদ্ধা করতে পারি, ঘৃণা করতে পারি? আমরা শুনি সমদৃষ্টির কথা, সাম্যের কথা। প্রকৃত সমদৃষ্টি তখনই হয়, যখন মানুষ সর্বভূতে ঈশ্বরকে দেখতে শেখে।

ঠাকুর বলছেন: শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত শুনতে শুনতে হাজরা (প্রতাপচন্দ্র হাজরা) বলে, এসব শক্তির লীলা—বিভু এর ভিতর নাই। বিভু ছাড়া শক্তি কখন হয়? এখানকার মত উল্টে দেবার চেষ্টা! (২-১৪-৪) ‘এখানকার মত’ অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের মত। ‘আমি’ ‘আমার’ এই কথাগুলি তিনি পছন্দ করতেন না, সেইজন্য বলছেন: ‘এখানকার মত’। অর্থাৎ তাঁর যা মত। তাঁর মত হচ্ছে: বিভু ছাড়া কি শক্তি হয়? বিভু অর্থাৎ ব্রহ্ম। হাজরামশাই বলছেন: চৈতন্যদেবের যা কিছু লীলা, এ শক্তির খেলা, এর মধ্যে বিভু নেই, ঈশ্বর নেই। তিনি শক্তি মানছেন, কিন্তু ব্ৰহ্মকে অস্বীকার করছেন। লীলা নিচ্ছেন, নিত্যকে অস্বীকার করছেন। ‘Relative’ বা আপেক্ষিক সত্যটাকে মানছেন কিন্তু যেটা আত্যন্তিক বা পারমার্থিক সত্য, ‘Absolute’ সেটা গ্রহণ করছেন না। ঠাকুর বলছেন: এটা ভুল। নিত্য ছাড়া লীলা হতে পারে না। ব্রহ্ম ছাড়া শক্তি হয় না। আমি ব্ৰহ্মকে মানছি অথচ শক্তি মানছি না সেটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি শক্তিকে মানছি অথচ যার শক্তি তাকে মানছি না, শক্তিমানকেই অস্বীকার করছি—সেটাও ভুল। শক্তি আর শক্তিমান অভেদ। শক্তি সত্য, ব্রহ্মও সত্য। লীলা সত্য, নিত্যও সত্য। নিত্য ছাড়া লীলা সম্ভব নয়। ব্ৰহ্ম ছাড়া জগৎ সম্ভব নয়। তিনি আছেন বলেই জগৎ আছে। তিনি জগতের অধিষ্ঠান। দর্শনশাস্ত্রে যাকে বলে ‘The Ground’। টেবিলের উপর একটা বই আছে। বইটা শূন্যে থাকতে পারে না—একটা কিছুর উপর তাকে থাকতে হবে, টেবিলটার উপরে আছে। তাই টেবিলটা এর ‘Ground’। সমুদ্রে কত ঢেউ উঠছে, কত ঢেউ ভাঙছে, কিন্তু ঢেউ-এর একটা ‘অধিষ্ঠান’ তো আছে—সমুদ্র সেই ‘অধিষ্ঠান’। স্বামীজী উদাহরণ দিচ্ছেন: সিনেমার পর্দার উপরে ছবি পড়ছে। কত কি ঘটে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সবকিছুর পেছনে একটা অপরিবর্তনীয় বস্তু আছে—পর্দা। পর্দা অর্থাৎ ‘অধিষ্ঠান’ আছে বলেই ছবিতে এতসব দেখতে পাচ্ছি। তেমনি এই জগৎসংসারে কত কি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছুর পেছনে একটা অপরিবর্তনীয় বস্তু আছে। তাঁকে আমরা বলছি ব্ৰহ্ম বা ঈশ্বর। তিনিই ‘অধিষ্ঠান’। তিনিই ‘নিত্য’। তিনি আছেন বলেই সব আছে। নিত্য আছে বলেই লীলা আছে।

ঠাকুর বলছেন: বিভুরূপে তিনি সকলের ভিতর আছেন—আমার ভিতরে যেমনি পিঁপড়েটির ভিতরেও তেমনি। (১-১২-৩) তবে প্রকৃতিতে এত বৈচিত্র্য কেন? একজনের সাথে আর একজনের তফাৎ দেখি কেন? কারণ, শক্তিবিশেষ আছে। (ঐ) তিনিই সব হয়েছেন বটে, কিন্তু কোনখানে বেশী শক্তির প্রকাশ, কোনখানে কম শক্তির প্রকাশ। (২-১০-৩) পাথরের মধ্যে তাঁর খুব কম প্রকাশ, তাই পাথর জড়। আমাদের মধ্যে তাঁর বেশী প্রকাশ তাই আমরা মানুষ। আবার বুদ্ধ, চৈতন্য, যীশুখ্রীষ্ট, শ্রীরামকৃষ্ণের মতো মানুষ—তাঁদের মধ্যে তাঁর সর্বোত্তম প্রকাশ। তাই তাঁরা অবতার। কিন্তু স্বরূপত সবাই সেই এক ঈশ্বর, এক ব্ৰহ্ম। বিদ্যাসাগর শ্রীরামকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: তিনি কি কাউকে কম শক্তি কাউকে বেশী শক্তি দিয়েছেন? শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিয়েছিলেন: তা নাহলে আমরা তোমাকে দেখতে এসেছি কেন? তোমার কি দুটো শিং গজিয়েছে? —স্বরূপত সব এক হলেও প্রকাশের তারতম্য স্বীকার করতেই হবে। গীতায় আছে, যাকে অনেকে গণে-মানে—তা বিদ্যার জন্যই হউক, বা গান-বাজনার জন্যই হউক, বা লেক্‌চার দেবার জন্যই হউক, বা আর কিছুর জন্যই হউক—নিশ্চিত জেনো যে, তাতে ঈশ্বরের বিশেষ শক্তি আছে। (১-১২-৩) শ্রীকৃষ্ণ বলছেন অর্জুনকে:১৩

যদ্‌ যদ্‌ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদৃর্জিতমেব বা।

তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম॥

—যেখানেই তুমি শ্রী দেখবে, বিশেষ বিশেষ গুণ দেখবে, জেনে রেখো সেই ব্যক্তি বা বস্তুতে আমারই অংশ বিরাজ করছে। অর্জুনের কাছে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন:১৪ তুমি জান কি আমি কে? ‘অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ’—সর্বভূতের আত্মা আমি। ‘অহমাদিশ্চ মধ্যঞ্চ ভূতানামন্ত এব চ’—সকলের আদিতে আমি আছি, মধ্যে আমি আছি, আবার সকলের শেষেও আমি আছি। আমি অজর অমর। কত জীব আসছে যাচ্ছে, আমি কিন্তু নিত্য বিরাজ করছি। তারপরে বলছেন: ‘আদিত্যানামহং বিষ্ণুঃ’—যত আদিত্য* আছে, তাদের মধ্যে আমি বিষ্ণু। ‘জ্যোতিষাং রবিরংশুমান্‌’—সমস্ত গ্রহনক্ষত্রের মধ্যে আমি সূর্য। ‘মরীচির্মরুতামস্মি’—বায়ুর মধ্যে আমি হচ্ছি মরীচি। ‘নক্ষত্রাণামহং শশী’— নক্ষত্রের মধ্যে আমি চন্দ্র। ‘বেদানাং সামবেদোহস্মি’—সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ! ‘দেবানামস্মি বাসবঃ’—দেবতাদের মধ্যে আমি দেবরাজ ইন্দ্র। ‘ইন্দ্রিয়াণাং মনশ্চাস্মি’—ইন্দ্রিয়ের মধ্যে মনই সবচেয়ে শক্তিশালী, সেই মন হচ্ছি আমি। ‘ভূতানামস্মি চেতনা’—সমস্ত জীবের মধ্যে চৈতন্যস্বরূপ আমিই বিরাজ করছি। যা কিছু মহৎ যা কিছু সুন্দর সবকিছুর মধ্যে আমারই শক্তির প্রকাশ, বলছেন শ্রীকৃষ্ণ। ‘তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি’১৫—তাঁর দীপ্তিতে সবকিছু দীপ্যমান। তাঁর শক্তিতে সবকিছু শক্তিমান। ঠাকুর বলছেন: একটা হাঁড়িতে চাল-আলু-বেগুন সব চড়িয়েছ। যখন জল ফুটতে থাকে, চাল-আলু-বেগুন সব লাফাতে থাকে। ছোট ছেলেরা দেখে ভাবে, আলু বেগুন সব বুঝি জীবন্ত। কিন্তু বড়রা জানে যে, এরা জীবন্ত নয়, হাঁড়ির নীচে আগুন আছে, তাই লাফাচ্ছে। যদি উনুন থেকে জ্বলন্ত কাঠ টেনে নেওয়া হয়, তাহলে আলু-বেগুন আর নড়বে না। তেমনি ঈশ্বরের শক্তিতে সব শক্তিমান। জ্বলন্ত কাঠ টেনে নিলে সব চুপ। (১-১৭-৪) উপনিষদে বলছে:১৬ ‘ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি’—অগ্নি তাপ দিচ্ছে, তাঁরই ভয়ে। ‘ভয়াত্তপতি সূর্যঃ’—সূর্য তাপ দিচ্ছে, তাঁরই ভয়ে। তাঁরই শক্তিতে এরা যার যা কাজ করছে। ‘ভয়াদিন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ’—ইন্দ্র, বায়ু, সব তাঁর শক্তিতে শক্তিমান। মৃত্যু যে, তারও শক্তি এই ব্রহ্ম। আবার বলছে: আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি যে কাজ করছে, এর পেছনেও তিনি আছেন। এই চোখ দেখে না, এর পিছনে আর একটি চোখ আছে, এই কান শোনে না—এর পিছনে আর একটি কান আছে। তিনি আছেন সবার পিছনে। তাই এরা ক্রিয়াশীল।**

বাস্তবিক তিনি সর্বশক্তিমান। এই অর্থে সর্বশক্তিমান যে, সব শক্তি তাঁর কাছ থেকে আসছে। বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে, পাখা ঘুরছে—একটা মূল উৎস আছে, যেখান থেকে এরা শক্তি পাচ্ছে। সেই মূল উৎস যদি শক্তি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে সব আলো নিভে যাবে, পাখা চলবে না। তেমনি জগতে যত প্রাণচাঞ্চল্য, যত ক্রিয়াকলাপ—ভাল অথবা মন্দ—সবকিছু ঈশ্বরের শক্তিতে। তিনি সেই মূল উৎস। আমি জানি বা না জানি, বিশ্বাস করি বা অবিশ্বাস করি—সেই শক্তিতেই আমি সবসময় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। আর যে তা জানতে পারে, যে পরিষ্কার দেখতে পায় তার পিছনের সেই অনন্ত শক্তিকে, সে অসাধ্য-সাধন করে ফেলে। তার আত্মবিশ্বাস, তার মনোবল লক্ষগুণে বেড়ে যায়। যেমন, যীশুখ্রীষ্ট। দরিদ্রতম ব্যক্তি। কয়েকজন মাত্র জেলে শিষ্য তাঁর। কত নির্যাতন তাঁদের সহ্য করতে হয়েছে। ক্রুশবিদ্ধ হয়ে জীবন দিলেন যীশু। অথচ আজ সর্বত্র তাঁর জয়গান। খ্রীষ্টধর্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ, ঐশ্বরিক শক্তি রয়েছে এঁর পেছনে। আবার এই যুগে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শ্রীরামকৃষ্ণের বেলাতেও সেই সত্য। দরিদ্র, প্রায় নিরক্ষর। অথচ পণ্ডিতরা তাঁকে কত সম্মান করছেন। আজ সারা পৃথিবীতে কত অনুরাগী তাঁর। শুধু তো হিন্দুধর্মের নয়, সব ধর্মের লোকেরাই তাঁকে সম্মান করছেন। আসল কথা, ঈশ্বরের উপর সর্বতোভাবে কেউ যদি নির্ভর করতে পারে, সে অসাধ্য-সাধন করে। কারণ, ঈশ্বরের শক্তি তখন তার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মমহাসভায় যোগ দিতে গেলেন—অজ্ঞাতকুলশীল এক সন্ন্যাসী। ধর্মমহাসভায় ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিলেন আর রাতারাতি তিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তার পরের ঘটনা তো সবাই জানেন। স্বামীজী বলেছিলেন : একদিন আমি বোমার মত ফেটে পড়ব সমাজে। সত্যিই তো বোমার মতো ফেটে পড়লেন। গোটা ভারতবর্ষকে এই একটি মানুষ যেন নাড়াচাড়া দিয়ে জাগিয়ে তুললেন। আজ দেখছি, সমস্ত পৃথিবীকেই তিনি জাগিয়ে তুলছেন। এ অসম্ভব কি করে সম্ভব হল ? ঈশ্বরের শক্তিতে। স্বামীজী একসময় বলেছিলেন : আমার পিছনে আমি এমন একটা শক্তি দেখতে পাই, যার ক্ষমতা মানুষ বা অন্য যে কোন কিছুর থেকে অনেক বেশী। সেই শক্তির জোরেই স্বামীজী অসাধ্যসাধন করেছেন। জার্মান সাধক একহার্ট বলছেন : কেউ যদি আমাকে একটা পাথর বয়ে নিয়ে যেতে বলে— এরকম এক হাজারটা পাথর সে আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে বলতে পারে, তাতে কিছু ফল হবে না। কিন্তু ভগবান যখন তাঁর কাজ কাউকে দিয়ে করিয়ে নিতে চান, তখন তিনি তা করিয়ে নেবেনই। বলছেন :১৭‘Let your soul stay where it belongs and then everything will be with you.’ তোমার মন-প্রাণ তাঁর পাদপদ্মে পড়ে থাকুক, সেটাই তার আসল জায়গা। তাহলে দেখবে, তোমার হাতের কাছে সব এসে যাচ্ছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব যোগাযোগ হয়ে যাচ্ছে। তিনি তাঁর কাজ তোমার মাধ্যমে করছেন। তুমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। তাই তাঁর কাজের জন্য যা যা দরকার তোমার হাতের কাছে তিনি সেসব জুটিয়ে দিচ্ছেন। অসম্ভব সম্ভব হচ্ছে তোমার দ্বারা। বাস্তবিক, সম্ভব-অসম্ভব কথাটা মানুষের ক্ষেত্রে খাটে, তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না। যীশুখ্রীষ্ট বলছেন ; তোমার যদি ভগবানে বিশ্বাস থাকে তাহলে তোমার কথাতে এই পাহাড়টা এখান থেকে ওখানে চলে যাবে। শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন বললেন : মা, আমার এসব দর্শন যদি সত্যি হয়, তাহলে এই যে পাথরটা দেখছি, এটা তিনবার লাফাবে। সত্যিই পাথরটা লাফাল। এইসব ঘটনার তাৎপর্য কি ? তাৎপর্য এই যে, ভগবানে যে নির্ভর করে, ভগবানকে যে ভালবাসে তার দ্বারা অসাধ্য সাধন হয়। তার ইচ্ছা ভগবানের ইচ্ছা তখন একাকার হয়ে যায়। ভগবানের শক্তিই তার মধ্যে দিয়ে তখন প্রকাশ পায়। একটা প্রবল আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে জাগে। যার জোরে সে শত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও অবিচল থাকে, অসংখ্য বাধা-বিঘ্নের মধ্যে দিয়েও সে পথ করে নেয়। স্বামীজী বলছেন : তুমি হতে পার একটা বুদ্‌বুদ্‌ কিংবা একটা বড় তরঙ্গ —কিন্তু সবসময় মনে রেখো তোমার পেছনে সেই এক মহাসমুদ্র। অনন্ত শক্তির উৎস সবারই পেছনে রয়েছে। যে সেই উৎসের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারে সে-ই বড় হয়। স্বামীজী তাই বলছেন : আমার জীবনের উদ্দেশ্য মানুষকে তার দৈবী সত্তা জানানো। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, তুমি ক্ষুদ্র নও, সামান্য নও, দুর্বল নও। তুমি ভূমা, তুমি ঈশ্বর, তুমি ব্ৰহ্ম।

একজন আমেরিকান অধ্যাপক আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন। আপনারা এই রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ধর্ম প্রচার করছেন, কিন্তু আপনারা সমাজসেবার কাজ কি করেন ? আমি তাঁকে সংক্ষেপে বললাম, আমরা কি কি করি। তারপরে বললাম : দেখুন, সমস্ত দেশের যা প্রয়োজন, সেই তুলনায় এই কাজ হয়তো খুব বড়রকমের কিছু নয়। তবে আমরা যেটা করতে চেষ্টা করি, স্বামীজীর ভাষায় বলতে গেলে, মানুষের মধ্যে শ্রদ্ধা বা আত্মবিশ্বাস জাগাতে চেষ্টা করি। আমরা আমাদের দেশবাসীকে এই কথা বলি যে, পরমুখাপেক্ষী হয়ো না। হ্যাঁ, সমস্যা অনেক আছে ঠিকই, কিন্তু সেই সমস্যা সমাধান করবার শক্তিও আমাদের অর্জন করতে হবে। অন্য কেউ আমাদের সমস্যা দূর করে দেবে না। সেই অধ্যাপককে আমি বললাম : দেখুন, ধর্মের মূলকথা এই নিজের উপরে বিশ্বাস। আমি হীন নই, দুর্বল নই, আমি ঈশ্বরের শরণাগত, তাঁর কৃপাতে আমি অসাধ্য-সাধন করতে পারি। ঈশ্বরের শরণাগত হওয়া মানে জীবন-যুদ্ধ থেকে সরে যাওয়া নয়, প্রবল পরাক্রমে জীবনের মুখোমুখি হওয়া। স্বামীজী বলেছিলেন : একটা গ্রামে যদি সারা পৃথিবীর অর্থ ঢেলে দেওয়া হয় তবুও সেই গ্রামের দুর্দশা ঘুচবে না—যদি সেই গ্রামের মানুষগুলি আত্মনির্ভরশীল না হয়। সত্যিসত্যিই বিদেশ থেকে আজ অনেক অর্থসাহায্য আমাদের দেশে আসছে। কিন্তু সেই অর্থ কোথায় যাচ্ছে আমরা বুঝতে পারি না। শুনতে পাই, সেই টাকার নাকি সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। কেউ যদি আমার হাতে অনেক টাকা দেয় অথচ আমার নিজের প্রতি শ্রদ্ধা না জাগায়, তাহলে সেই টাকার আমি সদ্ব্যবহার করতে পারব না। রামকৃষ্ণ মিশন চেষ্টা করে মানুষের মধ্যে সেই শ্রদ্ধা জাগাতে। তাকে ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে উঠতে বলে। আমরা তাদের বলি তোমার পক্ষে কিছু অসাধ্য নয়, সব পার তুমি—কারণ, তুমি ঈশ্বরের সন্তান, বা তুমিই ঈশ্বর।

অনেকদিন আগে একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম। তাতে হিটলারের অত্যাচারের কথা লেখা আছে। হিটলার তাঁর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে অনেক লোককে আটকে রেখেছিলেন। তাদের উপর নানারকম অত্যাচার চলছে। খেতে পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না, না খেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে মারা যাচ্ছে মানুষগুলি। এরই মধ্যে যারা ধর্মে বিশ্বাস করে আছে, নিত্য তারা প্রার্থনা করছে। সামান্য হয়তো একটুকরো রুটি দিয়েছে আর একটু পাতলা জলের মতো সূপ দিয়েছে, তা খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না, শুকিয়ে শুকিয়ে মারা যাচ্ছে মানুষগুলি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এরই মধ্যে যারা ধর্মপ্রাণ, ঈশ্বরে যাদের মন আছে, তারা তাদের ভাগের খাবারটা অন্যকে দিয়ে দিচ্ছে। যারা দুর্বল, অক্ষম, রোগী অথবা বৃদ্ধ, তাদের দিচ্ছে। লুকিয়ে লুকিয়ে দিচ্ছে। কারণ, যারা প্রহরী তারা যদি দেখতে পায় তাহলে হয়তো শাস্তি দেবে। কিন্তু তবুও দিচ্ছে, জীবন বিপন্ন করে দিচ্ছে। নিজের মৃত্যু কাছে এগিয়ে আসছে, এ জানে তারা। সব বিপদ উপেক্ষা করে নিজেদের মুখের গ্রাস অন্যকে দিয়ে দিচ্ছে। এত মনের বল। আবার এরই মধ্যে সকলকে উৎসাহ দিচ্ছে, সকলের কাছে এগিয়ে গিয়ে ধর্মপ্রসঙ্গ করছে। এই বিপদকে উপেক্ষা করা, সবকিছু অতিক্রম করে যাওয়া—এ শক্তি মানুযের আসে ঈশ্বরে নির্ভরতা থাকলে। ধর্ম সম্বন্ধে বলা হয়, ধারণ করে রাখে। এই অর্থে ধর্ম ধারণ করে রাখে যে, মানুষকে শক্তি দেয়। দেহের শক্তি বড় নয়, আত্মার শক্তিই বড়। ইতিহাসে কত বড় বড় সভ্যতার কথা শুনি। গ্রীক সভ্যতা, রোমের সভ্যতা—সে সব ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ ভারতীয় সভ্যতা এখনও বেঁচে আছে। কত ঘাত-প্রতিঘাত গেছে এই দেশের উপর দিয়ে। তবুও বেঁচে আছে। কেন বেঁচে আছে ? কি রহস্য ? কারণ, এই দেশ, এই সভ্যতা ধর্মের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আত্মার শক্তিকে, ঈশ্বরের শক্তিকে ভারতবর্ষ চিরকাল সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে এসেছে।

কয়েকবছর আগে পশ্চিম জার্মানীর এক ভদ্রলোক এসেছিলেন এদেশে, আমার সাথে তাঁর এখনও যোগাযোগ আছে। আমি তাঁকে কথায় কথায় বলেছিলাম : তুমি দুর্গাপুরে যাবে ? সে বলল : দুর্গাপুর ! সে আবার কি ? কি আছে সেখানে ? বললাম : সেখানে একটা বড় স্টীল প্ল্যান্ট আছে। সেই ভদ্রলোক তখন হেসে বললেন : স্বামীজী,তুমি বোধ- হয় ভুলে যাচ্ছ আমি পশ্চিম জার্মানী থেকে আসছি ; বিরাট বিরাট স্টীল প্ল্যান্ট সেখানে। না স্বামীজী। ওসব দেখার জন্য আমি তোমাদের দেশে আসিনি। আমি পৃথিবীর অনেক দেশে ঘুরেছি—ওসব অনেক দেখেছি। তার চেয়ে বরং আমাকে কামারপুকুরে নিয়ে চল। যেখানে ভারতের শক্তি নিহিত আছে। তোমাদের মন্দিরে-মসজিদে যে শক্তি নিহিত আছে, যার জোরে তোমাদের দেশ হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে রয়েছে, তার সামান্য একটুও যদি নিয়ে যেতে পারি, তাহলে বুঝব আমার এতদূরে আসাটা সার্থক হল। সেইজন্যই আমি তোমাদের দেশে এসেছি।

স্বামীজী বলেছেন : ভারতের প্রাণটা রয়েছে আধ্যাত্মিকতায়। যুগে যুগে ভারতবর্ষে কত মানুষ এসেছে, যারা ঈশ্বরের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছে। ভারতবর্ষ এত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও বেঁচে আছে কেন ? জগৎকে এই বাণী দিতে যে, এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের পেছনে আরও অনেক বড় সত্য আছে, সেই সত্যই সত্য, তার শক্তিতেই বিশ্বসংসার চলছে। সেই শক্তিতে শক্তিমান বলেই ভারতবর্ষ এখনও বেঁচে রয়েছে। স্বামীজী বলছেন ; ভারতবর্ষ আবার উঠবে। তার ভবিষ্যৎ এত উজ্জ্বল যে, তার অতীত গৌরবও তার কাছে ম্লান হয়ে যাবে। তবে ভারতবর্ষ উঠবে জড়ের শক্তিতে নয়—চৈতন্যের শক্তিতে, আধ্যাত্মিক শক্তিতে। তাই সবার আগে ভারতবর্ষকে ধর্মের প্লাবনে প্লাবিত করে দিতে হবে। যে শক্তিতে সব শক্তিমান, যে শক্তির প্রকাশ সবকিছুর মধ্যে, যে শক্তি ব্রহ্মের শক্তি, যে শক্তির খেলায়’ জগতের সমস্ত লীলাচাঞ্চল্য—সেই শক্তিকে আশ্রয় করেই ভারতবর্ষ উঠবে।

আকর-তালিকা

 । ছান্দোগ্যোপনিষদ্‌, ৬/২/৩ ; তৈত্তিরীয়োপনিষদ্‌, ২/৬.; ঐতরেয়োপনিষদ্, ১/১/১

 । অমৃতবিন্দু-উপনিষদ্‌, ১২

 । দৃগ্‌-দৃশ্য বিবেক, ২০

 । ছান্দোগ্যোপনিষদ্‌, ৬/১/৪

 । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্, ১/৩

 । লীলাপ্রসঙ্গ, ১ম ভাগ, গুরুভাব–পূর্বার্ধ, ১৩৮৬, পৃঃ ২৬২

 । শঙ্করভাষ্য, ব্রহ্মসূত্র, ১/৪/৩

 । ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ (কৃষ্ণজন্মখণ্ড), ৭৩/৪৬-৭

 । ঐ, ৭৩/৪৬

১০। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্, ৪/১০

১১। তৈত্তিরীয়োপনিষদ্, ২/৬

১২। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্, ৪/৩

১৩। গীতা, ১০/৪১

১৪। ঐ, ১০/২০-২

১৫। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ৬/১৪

১৬। কঠোপনিষদ্‌, ২/৩/৩

১৭। Meister Eckhart. A Modern Translation by Raymond Bernard Blakney, 1941, p. 135

* দ্বাদশ আদিত্য—ধাতা, মিত্র, অর্যমা, রুদ্র, বরুণ, সূর্য, ভগ, বিবস্বান্‌, পূষা, সবিতা, ত্বষ্টা ও বিষ্ণু।

** শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্‌

বাচো হ বাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ।

চক্ষুষশ্চক্ষুরতিমুচ্য ধীরাঃ

প্ৰেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি॥

—তিনিই কর্ণেরও কর্ণ, মনেরও মন, বাক্যেরও বাক্য, প্রাণেরও প্রাণ, চক্ষুরও চক্ষু। বিবেকিগণ ইন্দ্রিয়াদিতে আত্মবুদ্ধি ত্যাগ করে এই সংসার হাতে নিবৃত্ত হয়ে অমৃতত্ব লাভ করেন। (অথবা দেহত্যাগান্তে পুনর্বার দেহধারণ করেন না।) —কেনোপনিষদ্‌, ১/২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *