।। বিরাশি।।
দেয়ালের দু’পাশে সাদা দুটো ফ্লুরোসেন্ট আলো। জানালা খোলা। বারান্দা পার হলে উঠোন। মসৃণ ঘাস উঠোনে। সেখানে জ্যোৎস্না খেলা করে বেড়াচ্ছে। তারপর সব নানা বর্ণের ফুল এবং ফুলের বাগান। পরে মাঠ, ডানদিকে বড় অর্জুন গাছের ছায়া, আরও পশ্চিমে সব মাঠ, ঠিক মাঠ বলা যায় না, সব ছাড়াবাড়ি। যেন প্রথম দেখলে মনে হবে, মহামারীতে গ্রামের মানুষজন কেউ বেঁচে নেই, এবং এ-ভাবে রাত গভীর হলে কেমন ছম্ছম্ একটা ভাব। বোধ হয় আজ মঞ্জু ঘরে দুটো বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে এ-জন্য। সোনা অথবা সোনাকাকা, যখন যা খুশি ডাকার স্বভাব, সে সোনা যাতে ভয় না পায়, নানাভাবে তার চেষ্টা করেছে। ঘরের ফ্যান এখন বন্ধ। টেবিলে দামি ফুলদানি, নকসী কাঁথার মাঠের মতো টেবিলের ঢাকনা। বাতিদানে ভিন্ন ভিন্ন কারুকাজ। আর সাদা চাদর, বড় খাট, খুব বড়, দুজন অনায়াসে শোওয়া যায়। মনে হয় ওর অনুপস্থিতিতে এ-ঘরের অনেক কিছু পাল্টে গেছে, এবং ঘরে ঢুকেই মনে হল এক আশ্চর্য সৌরভ। সে দেখল, এক কোণে একটা টিপয়। সেখানে বাগানের সবচেয়ে বড় বড় গোলাপ কেটে আনা হয়েছে। এবং মনে হয় এটা মঞ্জু কিছুক্ষণ আগে রেখে গেছে। কাছে গেলে সে বুঝতে পারল গোলাপের পাপড়িতে কুয়াশার জল এখনও লেগে আছে।
এ-ভাবে এ ঘরের মসৃণ দেয়াল, নানা বর্ণের পাথরের মেঝে, দেয়ালে সব বর্ণাঢ্য ছবি এবং বাতিদান আশ্চর্য ফুল ফল আঁকা বিদেশী কাচ, যা দুর্লভ মনে হয় খুব, মনে হয় খুব অহমিকা নিয়ে যারা বাঁচে তাদের জন্য এমন ভাবে ঘর সাজানো দরকার, কিন্তু সোনা সরল সহজ মানুষ, বড় আশা নেই, বড় আকাঙ্খা নেই, কেবল কোনও রকমে টুটুল মিণ্টুকে বড় করে তুলতে পারলে জীবনের কাজ সারা এমন যার ধারণা, তার কি হবে এত প্রাচুর্য দিয়ে। তার মনে হল, কিছুতেই ঘুম আসবে না, এবং মঞ্জু বুঝি চায়, সে এভাবে সারা রাত না ঘুমিয়ে থাকুক। মঞ্জুর এই বাড়াবাড়ি ওর একেবারে পছন্দ হল না। আর পাশের বসার ঘরটায় ঢুকলেই মনে হয় দেয়াল থেকে সব মৃত বাঘ হরিণের মাথা সজীব হয়ে ছুটে আসছে এবং এভাবে এক অস্বস্তি, সে সেখানে ঢুকে ডাকল, মঞ্জু
সে কোনও সাড়া পেল না।
সে আবার ডাকল, মঞ্জু।
কেয়া দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, মঞ্জুদি খাচ্ছে। সে নিজের ঘরে বসে থাকল কিছুক্ষণ। মঞ্জুকে তার যেন কি বলার আছে। কিন্তু কারো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কি করছে মঞ্জু! তার সংকোচ হল সামনের ঘরটায় ঢুকে যেতে। এ-ঘরে থাকে নীলু। পাশের খাটে কেয়া। কেয়া যা কুঁড়ে মেয়ে সে হয়তো চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। সে যেভাবে জীবন কাটায় তাতে করে, অনাত্মীয় মেয়ের ঘরে ঢুকে যেতেও সংকোচ সে বাইরে দাঁড়িয়েই বলল, কি করছ?
—কিছু না। তারপর কেয়া দরজার কাছে এসে বলল, আসুন না।
সে বলল, না যাব না। ঘুমোও। দশটা কখন বেজে গেছে!
—তাতে কি হয়েছে। এটা আবার রাত নাকি! আমরা কতদিন সারারাত জেগে রয়েছি।
কত সহজ ভাবে কথা বলে মেয়েটা! ওর অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে না। চৌকাঠে সে সামান্য হেলান দিয়ে কথা বলছে। এবং কথা বলতে বলতে সে জানে না, চৌকাঠ একটু একটু দোলাচ্ছে। সে লতাপাতা আঁকা শাড়ি পরেছে।
অতীশ বলল, তুমি জাগতে পার, কিন্তু আমি তো পারি না। রাতে ঘুম না হলে কাল দেখবে, চোখ মুখ আমার বসে গেছে। মঞ্জু যে কি! অত বড় খাটে আমার শোবার অভ্যাস নেই। আর ঘরটাকে কি করেছে। রাতে এ ভাবে কেউ ফুল কেটে আনে। বাগান থেকে রাতে ফুল তুলতে নেই। পাপ। মঞ্জু কি জানে না এসব।
—ফুল মঞ্জুদি আনেনি। আমি এনেছি। আমাদের ধর্মে এসব নেই। ফুল তোলার ব্যাপারে কোন পাপের কথা নেই। ফুল এবং বিলাসিতা আমাদের গুনাহ, বলতে পারেন পাপ। যদি হয় সেটা আমার হবে। আর আমি কিছু জানি না।
অতীশ অবাক হয়ে গেল। যেন এতটুকু সংকোচ নেই বলতে, আমি এনেছি। বিশ-বাইশ বছর আগে কোনও মুসলিম পরিবারে এদেশে একথা বোধ হয় কেউ ভাবতে পারত না। এবং এটা বোধ হয় হয়েছে, ওরা জেনেছিল, ওরা স্বাধীন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এদের হাতে। হিন্দু সাম্রাজ্যবাদ নিপাত গেছে। এবং এভাবে সে যেন বুঝতে পারে এক নতুন জেনারেশন তৈরি হয়েছে এ দেশে। প্রায় হিন্দু কলেজের সময় অথবা যেন ডিরোজিও হেঁটে যাচ্ছে। সেও একটা সাদা ঘোড়ার সন্ধানে ছিল বোধ হয়। সে বলল, ঘরে গোলপ ফুটে থাকলে কেউ কখনও ঘুমোতে পারে কেয়া! প্লিজ তুমি ওগুলো নিয়ে এস।
কেয়া বলল, না।
তবে আমি মঞ্জুকে বলতে বাধ্য হব, তুমি এমন করছ!
—বলুন। ভয় পাই না।
—কেয়া।
কেয়া বলল, আপনি কাপুরুষ মশাই। বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল।
—এই কেয়া, শোনো। দরজা বন্ধ করলে কেন?
দরজা আবার খুলে গেল। না, নেই। কেয়া ঘরেই নেই। নীলুর পাশ দিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে যাবার দরজা। সে দরজা দিয়ে অতীশ কখনও পাশের ঘরে ঢোকে নি। এবং ঘরটা অন্ধকার। এ-ঘর থেকে সামান্য আলো ও ঘরে গিয়ে পড়েছে। দরজা দিয়ে যতটা আলো ঢুকতে পারে, সে আলোতে দেখল অতীশ, কেয়া ও-পাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ওর পায়ের কাছে আলো। শাড়ির সামান্য লতাপাতা দেখা যাচ্ছে। এবং কি আশ্চর্য এই পা দুটো ওর কাছে লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মনে হচ্ছে। সহসা আলোতে ঢুকে অতীশ পা এবং শাড়ি, সামান্য অংশ আবিষ্কার করে কেমন দাঁড়িয়ে গেল। এক পা নড়তে পারল না। নীলু পাশ ফিরে শুয়ে আছে। একটা সাদা চাদরে ঢাকা।
অতীশ খাটের একপাশে, ঘরে খাট, তারপর দরজা, তারপর আলো ও-ঘরে, এবং শেষ দেয়ালে কেয়া আলোছায়ায় দাঁড়িয়ে ওর শরীরে কেমন মায়া জড়িয়ে দিচ্ছে। সে বলল, কেয়া তুমি ও-ভাবে প্লিজ দাঁড়িয়ে থাকবে না। আমার ভয় করে।
কেয়া ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেবেলাকার লুকোচুরি খেলার মতো। কেয়া কি চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে, কেয়া কি বুঝতে পারছে না, সে টের পেয়ে গেছে, সে কেয়াকে দেখতে পাচ্ছে, কেয়ার শাড়ি আলোতে সে দেখতে পাচ্ছে, দেখতে দেখতে কি করে যে মায়া বেড়ে যায়। এই মেয়ে মনে হয় তখন বড় শ্রীময়ী, মনে হয় লক্ষ্মী প্রতিমার মতো, যাবতীয় সব সৌন্দর্য এবং লাবণ্য শরীরে জড়িয়ে ছড়িয়ে বেঁচে আছে। ওর রূপ আছে, রূপ থাকলে অহংকার থাকে, কিন্তু রূপ লাবণ্য দুই আছে, বড় সুষমামন্ডিত, অথবা মহীয়সী ভাবতে ভাল লাগে। তখন কাপুরুষ অথবা যা কিছু কেয়া বলতে পারে। মুহূর্তে মেয়েটা বড় বেশি কাছে এসে গেছে। একেবারে নিজের মতো, আপনজন, ভয়-ভীতি তার কিছু নেই। সে এখন যা কিছু করে বসতে পারে। অতীশ বলল, কেয়া এ-ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সত্যি বলছি ভয় পাব, তুমি এস। ফুল আমি আর ফিরিয়ে নিতে বলব না। দেখি না ঘরে ফুল থাকলে ঘুমোতে পারি কিনা। সব কিছু অভ্যাস থাকা ভাল।
কেয়া দাঁড়িয়ে আছে তেমনি। এবং এই যে অন্ধকার, আবছা অস্পষ্ট অন্ধকারে ধীরে ধীরে কেয়া ফুটে উঠছে, মনে হয়, কেয়া সারা শরীরে অন্ধকারের বোরখা পরে যেন বলছে, ভয় আমাদেরও কম নেই মশাই। আপনি কি না কি মানুষ কে জানে। ফুল রেখে দেখছি, ফুল নিয়ে সারা রাত কাটাতে কেমন লাগে আপনার। কি ভাবে কাটান। এমন যে তাজা ফুল, ফুলের সৌরভ আপনাকে কেমন রাখে, দেখার বড় বাসনা।
মেয়েরা কি এই বয়সে বেশি সাহসী হয়! কেয়াকে তো সে সকালেও দেখেছে। কেয়া সকাল থেকে আসলে কি যে সৌরভ পেয়ে গেছে এই শরীরে সেই জানে। সে বলল এই মেয়ে, তুমি তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে এস। না হলে কিন্তু ভীষণ খারাগ হবে। আমি মঞ্জুকে ডাকব, মঞ্জু, কেয়া আমাকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভয় দেখাচ্ছে।
নীলু ঘুমোচ্ছে। ঠিক এ-সময়ে সে জোরে কথা বলতে পারে না। নীলুর ঘুম ভেঙ্গে যাবে। সে যদি ছেলেমানুষ হয়ে যেতে পারত, তবে অন্ধকার থেকে সে কেয়াকে টেনে বের করে আনতে পারত। মনে তার পাপ আছে বলে কাছে যেতে পারছে না। কি যে হয় মানুষের মনে, কি ভাবে যে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। ওর আর বুঝি জীবনেও সাহসে কুলাবে না। সে বলল, কেয়া আমি যাচ্ছি। তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাক
সঙ্গে সঙ্গে কেয়া বের হয়ে এল। বলল, না, আমি ওখানে থাকব না। আপনি বললেই থাকব।
এই মেয়েটার ব্যবহার সকালে বিকেলে পাল্টে যায়। যেন ওকে অপমান না করতে পারলে শান্তি পায় না। মেয়েটা আবার দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে বলল, কাল যাচ্ছেন?
—কাল, না হয় পরশু। আর থেকে কি হবে! যেতে তো হবেই। মঞ্জু শেষে এ-জন্য চিঠি লিখবে আশা করিনি।
—কি আশা নিয়ে এসেছিলেন মঞ্জুদির কাছে?
—না, তেমন কিছু না। আমার আশা-আকাঙ্খা কিছু আর নেই।
—মিছে কথাও এত বলতে পারেন।
—মিছে কথা না কেয়া। ছেলেবেলা থেকে আমি এমন স্বভাবেরই মানুষ। মঞ্জুকে বললে জানতে পারবে। তারপর যেন বলার ইচ্ছে, নারী নিজে ধরা না দিলে আমি কোনদিন কাছে যেতে সাহস পাইনি। আমি ভাল না এটা খুব বুঝি না।
—মঞ্জুদি সব বলে না।
—সব কোনদিন কেউ বলে!
—না। তবে অন্তত কেউ কিছু বলে।
—মঞ্জু তোমাকে তাও বলে না?
—না। কেবল আপনি অত্যন্ত সরল সহজ মানুষ এটুকু বলে। খিদে থাকলেও চেয়ে খেতে পারেন
—ব্যাস, সবই তো তবে বলেছে!
—এতটুকুতে সাহস পাই না।
—যা দেখাচ্ছ, ওতে তো আমার বীরাঙ্গনা ছাড়া আর কিছু তোমাকে ভাবতে ইচ্ছে হয় না। তারপর বলার ইচ্ছে হল, আমার বাড়িঘর আছে, আমার স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। তারা আমার পায়ের বেড়ি।
—ভাল।
—হয়তো আর আসা হবে না। সকালে উঠেই ঠিকঠাক করে নিতে হবে সব। কি ভাবে যাব, মুর্শেদের নাম কি হবে। তাকে কি ভাবে কোথায় পাঠাব, তাও স্থির করে নিতে হবে। সে আমার কে, আমার সম্পর্কে কি হয়, এবং বাপের নাম, ঠাকুর্দার নাম বাড়ি সব ওকে মুখস্থ করিয়ে নিতে হবে। বলা যায় না, কখন কি দরকার পড়ে।
—আপনারা চলে গেলে বাড়িটা খালি হয়ে যাবে। আমাদের দিন কাটবে না।
—কেন এর পর তো তোমাদের স্কুল কলেজ আরম্ভ হয়ে যাবে, পড়াশোনায় মন দাও। দেখবে সব ভুলে যাবে। এক ঘেয়ে লাগবে না।
—আপনার কাছে তো জানতে চাইনি কি করে এক ঘেয়েমি আমাদের কাটবে। আচ্ছা, বলেই থামল। কি বলতে গিয়ে সংকোচ বোধ করল কেয়া, বলতে পারল না।
এবং তখন এ-ঘরে ও-ঘরে আলো। বারান্দায় আলো নেভানো। চারপাশে যা আলো থাকে জব্বার চাচা তা নিভিয়ে দিচ্ছেন। কেবল বড় উঠোনে একটা আলো জ্বালা আছে, ওটা থাকে, কারণ ওটা না থাকলে বোধ হয় এই দুই মেয়ে এমন একটা নির্বান্ধব পরিবেশে থাকতে ভয় পায়।
অতীশ বলল, তুমি কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলে কেন?
—না, এই বলছিলাম, আসার আগে কি ভেবেছিলেন? মঞ্জুদির চিঠি পেয়ে আপনার কি মনে হয়েছিল।
—ভেবেছিলাম, মঞ্জু এখনও এখানে বেঁচে আছে কি করে! মঞ্জু কি এতদিন পর বুঝেছে, আমাকে ওর খুব দরকার।
—এসে দেখলেন, আপনাকে ওর কোনও দরকারই নেই।
—দরকার নেই বলতে পারব না, দরকার আছে, তবে আমার তাতে কিছু আসে যায় না।
—এটা মঞ্জুদির হয়ে উপকার করছেন, এমন ভাবছেন।
অতীশ দেখেছে কেয়া খুব সিরিয়াস হয়ে গেলে আপনি আজ্ঞে করে, কখনও তুমি, কি যে মর্জি এই মেয়ের। সে বলল, তা ছাড়া কি। মঞ্জুর হয়ে উপকার করলাম। মুর্শেদ চলে যাবে তার দেশে। সে তো জানে, যে ডেজার্টার হিসাবে তার নাম খাতায় নেই। ওর বাড়ির লোকেরা হয়তো খবর পেয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিকের মৃত্যু, যুদ্ধক্ষেত্রে সে প্রাণপণ লড়ে প্রাণ দিয়েছে, অথবা নিখোঁজ। এ-ভাবে অনেক সৈনিক নিঁখোজ হয়ে যায় যুদ্ধে
—এত কে বলল আপনাকে!
—কেন, মঞ্জু। মঞ্জু বলল, মার্চ পাস্টের দৃশ্যে সে যখন জানালায় দাঁড়িয়ে নিজের কথা ভাবছিল, তখন দেখতে পেয়েছে, একজন মৃতের শকট, এবং খবর অন্য একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; নতুবা, এই ১৭ নম্বর রেজিমেন্টের এটি একটি বড় কোম্পানির দু’জন বাদে সবার আত্মসমর্পণের হিসাব আছে।
—আপনি ভাবছেন ওরা আর কিছু খবর রাখে না।
—না। না রাখাই স্বাভাবিক। এমন একটা সময়ে কোথায় কি-ভাবে কি ঘটেছে তার ইতিহাস ঠিক ঠিক লেখা হবে না।
—আমরা তো মরে যাই নি। আমরা তো বেঁচে আছি। লেখা ঠিক হবে।
—সব আমি জানি না। তুমিও বল নি, মঞ্জুও বলছে না। কেউ এ-সব কথা হয়তো মুখ ফুটে কোনদিন বলবে না। তবে না বলাই ভাল। নির্যাতনের কথা যত ভুলে থাকা যায় ততই ভাল।
—হবে হয়তো। কেয়া বলল, মুর্শেদ চলে গেলে সবচেয়ে কষ্ট হবে নীলুর। নীলুর কষ্ট হবে কেন?
—সে নীলুর একমাত্র সঙ্গী ছিল এ ক’মাস। সে, নীলুকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে। মুর্শেদের কষ্ট হবে। সে দুনিয়ায় কখনও আর একটা নীলুকে খুঁজে পাবে না।
নীলু বোধ হয় জেগে গেছে। সব শুনছে হয়তো। কেয়া ভাবল, নীলুর কষ্ট পেলে খারাপ। নীলু কোন দুঃখ সইতে পারবে না। এমন কি সে জানে না, তার বাবা নেই, তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে লড়ছে, এমনই সে জানত। এবং এখনও তার কাজ শেষ হয়নি, হলেই চলে আসবে। মাঝে মাঝে নীলু বড় বড় চোখে মুর্শেদকে দেখত, সে কে, কেন আসে এ-বাড়িতে এক সময় তার প্রশ্ন ছিল তার মায়ের কাছে। মঞ্জুদি বলত, ও তোমার বাবার বন্ধু। এখানেই সে থাকবে। তোমাকে মুর্শেদ ভীষণ ভালবাসে। তারপর কেয়া থামল, কেয়ার চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে বলতে বলতে। মুর্শেদের কাছে নীলু মাঝে মাঝে জানতে চাইত, বাবা কোথায়, কবে আসবে। মুর্শেদ বোকার মতো বলতো, আসবে, সে ঠিক একদিন চলে আসবে। ওর চোখ চিকচিক করত। বোধ হয় সে তার ছোট ছেলের কথা ভাবত তখন। মর্জিনাকে হয়তো ওর ছেলে ঠিক এমনি প্রশ্ন করছে, বাবা কবে আসবে?
এ-ভাবে ওরা দু’জনই কেমন ঘনিষ্ট হয়ে গেছে কথা বলতে বলতে। অতীশ লম্বা। কেয়া তত লম্বা নয়। অতীশের বুকের সামান্য ওপরে ওর মাথা। কখনও সান্ত্বনার জন্য অতীশের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লে ওর মুখ, অতীশের বুকে অনায়াসে হারিয়ে যাবে। এবং এত কাছাকাছি যে, মনে হয়, ওরা আসলে কোনও কথা বলছে না। একটা ছেলের, একটা জাতির বিশৃঙ্খলার দিনে হাজার হাজার এমনি পরিবারের ছবি ওদের ভেতর এ-ভাবে বোধ হয় ভেসে উঠছে শুধু।
তখন নীলুর শুকনো গলা, পিসি
কেয়া তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াল।—আমাকে ডাকছ নীলু?
—পিসি, মুর্শেদ চাচা চলে যাবে?
তবে ঘুমোয়নি নীলু! সে ভাবল, এটা ঠিক হয়নি। সে বলল, হ্যাঁ চলে যাবে। নীলুকে ধীরে ধীরে সব সইয়ে নেওয়া উচিত।
নীলু বলল, কেন?
—সে তার দেশে যাবে।
—দেশ!
—হ্যাঁ, ওর দেশে।
—সেটা কোথায় পিসি?
—সেটা হিন্দুস্তান পার হয়ে
—কত দূর?
—অনেক দূর, পাকিস্তান।
—মুর্শেদ চাচা আমাদের ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাবে!
—তার দেশে সে যাবে না!
নীলুর বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। সে মুর্শেদ চাচাকে দেখেছে, খুব ভীতু মানুষ। ওর পাশে চুপচাপ বসে থাকত শুধু। সে কিছুতেই মুর্শেদ চাচার মিলিটারি পোশাকের চেহারা মনে করতে পারে না। ওটা যেন ওঁর একটা ছদ্মবেশ। তখনও আসত। চুপচাপ আসত। ওরা মিলিটারি, সে তাই ভাবত। অবনী কবিরাজ বলত, দ্যাখো মুর্শেদ, এই আমার কপাল। সারা জীবন ওকে এ-ভাবে বহন করতে হবে আমাকে। নিজের হাতে যে ভাগ্য রোপণ করেছি তাই এখন বড় হয়ে বটবৃক্ষ হয়ে গেছে। কেয়া জানে এটা ছিল অবনী কবিরাজের স্বভাব। সে কথা বলতে বলতে দুঃখের কথা এলে সাধুভাষা ব্যবহার করতে পারলে বাঁচত।
তখন মুর্শেদকে নীলু জানত, দেশের মানুষ। দেশের হয়ে সে বিদেশীদের সঙ্গে লড়ছে। এবং এই বিদেশ কথাটির কোনও অর্থ নেই কেয়া বুঝতে পারত। আসলে মানুষের কোনও দেশ বিদেশ থাকতে নেই। এবং কারা যে এ-সব করে বেড়ায়। তারপর দীর্ঘদিন নীলু দেখেনি মুর্শেদকে। মুর্শেদ আবার যখন এল, একেবারে আলাদা মানুষ। সে আগের চেহারার সঙ্গে এ-চেহারার সঙ্গে কোনও মিল খুঁজে পেল না। আগের ছবি ভুলে যেতে ওর এতটুকু সময় লাগেনি। মার কথাই সে শেষবারের মতো বিশ্বাস করেছে। তারপর তার মনে হয়নি কখনও মুর্শেদ চাচা এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে। যেমন জব্বার চাচা, কেয়া পিসি, মা আছে, সেও তেমনি থাকবে এখানে। এবং এ-ভাবে সে, মুর্শেদ এ-ঘরে এলে কেমন যেন সবচেয়ে বেশি প্রাণ পেয়ে যেত। মুর্শেদ বোধ হয় এ-ক’মাসে সবার চেয়ে আপন হয়ে গেছিল নীলুর।
কেয়া দেখল ব্যথায় থমথম করছে নীলুর মুখ। এবং নীল হয়ে গেছে মুখটা।
কেয়া বলল, তুমি ঘুমোও নীলু। কাল সকালে মুর্শেদ তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে! না ঘুমোলে সে ভীষণ কষ্ট পাবে।
নীলু দেখল, পিসি তার শিয়রে দাড়িয়ে আছে। সে তার মুখ ব্যথায় নীল হয়ে গেছে বুঝতে দিতে চায় না। সে বলল, মা জানে পিসি?
—কেন জানবে না। মা-ই তো ওর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
নীলুর বোধ হয় মনে হচ্ছিল কেউ ভালবাসে না মুর্শেদ চাচাকে। ভালবাসলে কেউ মানুষকে যেতে দেয় না। নীলু বুঝতে পারে না, আর কে এমন আছে, যাকে ফেলে মুর্শেদ চাচা থাকতে পারে না। সেতো জানে সে-ই, সব মানুষটার। এবং অভিমান এ-জন্য নীলুর। সে ভাবল, কাল সকালে এলে কথা বলবে না। ভিতরে ভিতরে একটা দুঃখ সারা শরীর বেয়ে বুকের কাছে কেমন থেমে গেল। অসহ্য ব্যথা। সে বুঝতে পারছে বুকের কাছে সেই ব্যথাটা সূচের মতো বিঁধছে। সে অভিমানে মুখ কুঁচকাল না। কাউকে সে তার কষ্টের কথা বুঝতে দেবে না। কিন্তু কেয়া ওর মুখ দেখেই ভীষণ ঘাবড়ে যায়। সে জানে, নীলু ওর দুঃখ লুকিয়ে যাচ্ছে। নীলুর মাথার কাছে থরে থরে সাজানো সব ওষুধ। কোনটা কখন দিতে হবে সে সব চেয়ে ভাল জানে। কিন্তু নীলুর এমন কাতর মুখ তো কখনও দেখেনি। তার কেমন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এবং এমন হলেই কেয়ার ভেতরটা গোলমাল হয়ে যায়। ওর ভীষণ হাত কাঁপে।
এ-ভাবে অতীশ দাঁড়িয়ে দেখল সব। কেয়ার হাত নিরাময় ঈশ্বরের মতো নীলুর সব দুঃখ কষ্ট মুছে দিল। সে সিরিনজে ওষুধ ভরে নিল। য়্যাম ভেঙে কেমন আয়াসে সে কাজ করে যাচ্ছে। কত তাড়াতাড়ি। একবার মঞ্জুকে ডাকল না পর্যন্ত। মঞ্জুর কোনও দায় নেই, যা কিছু দায়-দায়িত্ব সব কত সহজে কেয়া নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে।
এ সব দেখে অতীশের মনে হল, কেয়া, এই নীলুর বিষ ধীরে ধীরে নিজের করে নিচ্ছে। মঞ্জুকে বোধ হয় নীলুর দুঃখ বুঝতে দিচ্ছে না। এমন কি কেয়া যে এ ঘরে থাকে, সব সময় নীলুর সেবা শুশ্রূষা করে, সেও মঞ্জুকে বিষণ্ণতা থেকে দূরে রাখার জন্য। সবাই জানে শুধু দিন মাস অথবা বৎসর। এ-ভাবে কিছুদিন অপেক্ষা করলেই নীলুর ছুটি হয়ে যাবে।
কেয়া দেখল, এখন নীলু ঘুমোচ্ছে। এটা ঠিক ঘুম না। ঘোরের ভিতর পড়ে যাওয়া। ওষুধ রক্তের ভিতর মিশে গেলে সে একটা বুঝি আশ্চর্য জগতের সন্ধান পায়। জেগে গেলেই মুখ বিকৃত হয়ে যায়, শ্বাস নিতে পারে না নীলু। তখন দুঃখটা চোখে সহ্য হয় না।
মাঝে মাঝে কেয়ার বলতে ইচ্ছে হয়েছে, নীলু তখন তুমি কোথায় যাও?
সে বলত, জানি না।
—কিছু মনে করতে পার না?
—একটা নীল রঙের অন্ধকারের ভিতর ডুবে যাই পিসি।
—আর কিছু না?
—আমার কাছে নীল রঙের অন্ধকারটা আলোর মতো লাগে।
—সেখানে কি দেখতে পাও?
—সব ছোট ছোট গাছ, ছোট ছোট মানুষ, ফুল ফল, নানা রকমের পাখি। ফুলের গন্ধ।
—ঠিক শালিখ-কাকের মতো?
—না। সব পাখিগুলো কাকাতুয়ার মতো সাদা। ওরা আমার সঙ্গে কথা বলে।
—আর কিছু দ্যাখো না?
নীলু ভেবে বলত, আর কি দেখি আমি জানি না পিসি। আমি মনে করতে পারি না। ঘুমোবার আগে এমন দেখি, ঘুম ভাঙবার সময় এমন দেখি। মাঝে বোধ হয় কিছু থাকে, কিন্তু আমি মনে রাখতে পারি না।
কেয়া বুঝতে পারত, নীলু শুয়ে শুয়ে যা-ভাবে সবই সেই কথা। যেমন একবার একটা লোক কাকাতুয়া নিয়ে খেলা দেখাতে এসেছিল, সেই থেকে ওর খুব ইচ্ছা এ-ঘরের দাঁড়ে একটা কাকাতুয়া থাকবে। বাড়ির চারপাশে যা সব গাছ আছে, সব এত বড় যে, সে গাছগুলোকে নিজের ভাবতে পারে না। পাখিগুলো এত ভীতু, যে ওর ঘরে কেউ আসে না। ওর ধারণা কাকাতুয়া খুব পোষ মানে। যদি সে ভাল হয়, তবে বাড়ির চারপাশে সব কাকাতুয়া ছেড়ে দেবে। বাগানে নানা রকমের ফুল ফুটে থাকবে। ফুলের ভিতর সে বসে থাকবে। আর চারপাশে যে-সব পাখিরা উড়বে, তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে দিন শেষ করে দেবে।
মঞ্জুদি সময় পেলেই ছেলেবেলাকার সব সুন্দর সুন্দর গল্প বলত তাকে। সোনা কাকার প্যান্টে দড়ি থাকত না, ছুটে গেলে ওর প্যান্ট হড়-হড় করে নেমে যেত। এমন ভাবে গল্প বলত যে নীলু ভীষণভাবে হেসে উঠত। আর মঞ্জুদি তখন ভাবত বুঝি নিলুকে স্বাভাবিক করে রাখতে পারলে তার নিজের ভিতরই একসময় নিরাময়ের আকাঙ্খা জাগবে। নিরাময়ের আকাঙ্খা জেগে গেলে সে ভাল হয়ে যাবে।
নীলুকে দেখতে দেখতে কেয়া কত সব হিজি-বিজি ভাবল। সে এবার উঠে দাঁড়াল। চাদরটা নীলুর বুক পর্যন্ত টেনে দিল। ও-ঘরে পিঁড়ি ওঠানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। বোধ হয় মঞ্জুদি খেয়ে উঠেছে। কেয়া এবার বলল, যান,। শুয়ে পড়ুন গে। মঞ্জুদি আসছে।
—মঞ্জুদি এলে আমি থাকতে পারি না?
—কি দরকার! আপনি মঞ্জুদির ভালবাসার মানুষ। আপনাকে ভালবাসলেও পাপ।
অতীশ ভাবল, কি আশ্চর্য নির্ভীক, অথবা ও কি এই ক’মাসে এত সব নিষ্ঠুর ঘটনায়, অনেক বেশি অভিজ্ঞ হয়ে গেছে! মানুষের সঠিক ঠিকানা জেনে ফেলেছে। অথবা মানুষ সম্পর্কে অবিশ্বাস। সে তো কেয়ার সঙ্গে এমন ব্যবহার করে নি, যাতে কেয়া এ-সব ভাবতে পারে। নিজের মতো করে যা খুশি সব বলে যাচ্ছে।
অতীশ বলল, মঞ্জু আমাকে আর ভালবাসে না।
কেয়া সামান্য তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। বলল, আপনি মঞ্জুদির নামে আর কলঙ্ক রটাবেন না। অতীশ থ হয়ে গেল। মঞ্জুদি সম্পর্কে সে কলঙ্ক কতদূর রটাতে পারে! যা হবার সব তো হয়ে গেছে। যদি কোনও ঘটনা ঘটে থাকে অর্থাৎ মুর্শেদ যদি ওর ভালবাসার মানুষ হয় তবে সে কিছু করতে পারে না! এবং কি-ভাবে মুর্শেদ এমন ভাবে মঞ্জুর এত কাছাকাছি চলে এসেছে সে জানে না। সে কেমন সব ভাসা ভাসা জানে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার স্বভাব তার না। এবং মঞ্জুকে কি সে এখনও সেই ফ্রক পরা মেয়ে ভেবে থাকে। মঞ্জু ওকে যা যা বলত, সে মঞ্জুর পাশে বসে শৈশবে তখন ঠিক তাই তাই করেছে। এখনও কি মঞ্জু তাকে সেভাবে ভেবে থাকে! ভাবলে ভুল করেছে। সে বলল, কেয়া, মঞ্জুর কলঙ্ক বলতে কিছু নেই। মঞ্জু আমাদের চেয়ে অনেক বেশি স্থির প্রাজ্ঞ। সে বোধ হয় শৈশব থেকে বুঝতে পেরেছিল, ওর এই অসামান্য রূপ নানাভাবে তাকে পীড়ন করবে। সে যা কিছু সুখ, তখন থেকেই, খুব কম বয়স থেকেই নিতে আরম্ভ করেছিল। কলঙ্ক রটালে তখনই রটতে পারত।
এ-ভাবে অতীশের মনে হল, না সে ঠিক বলেনি। সে বাহবা নেবার জন্য কিছু কিছু কলঙ্কের কথা অবনীকে বলেছে। এখন মনে হয়, অবনী সেই সুযোগ নিয়ে মঞ্জুকে বাগে এনেছে। সে কেয়াকে চট করে মিথ্যা কথা বলে কেন যে বাহবা নিল বুঝছে না। আসলে, এখানে থেকে যাওয়া, মঞ্জুর অবনীর সঙ্গে বিয়ে, সব কিছুর মূলে নিজেকে কেমন জড়িয়ে ফেলল। এর জন্য সে নিজেকে দায়ী ভাবল। সে কেয়াকে কিছুতেই বলতে পারল না, সব কিছুর মূলে হয়ত আমিই। ওর জীবনের সব দুঃখের মূলে হয়তো আমার শৈশবের প্রেম, সামান্য ছেলেমানুষী ভালবাসা, পুতুলের বিয়ে দিতে দিতে, একসঙ্গে স্বামী স্ত্রী সেজে শুয়ে পড়া, এবং কিছু কিছু ঘটনা, তখন তো ওর জায়গাগুলো ছিল একান্ত মসৃণ। কোথাও কিছু তেমন ফুটে ওঠেনি। প্রথমে অমলা, পরে মঞ্জু, আরও পরে বনি। তারপর বন্যার বেগে জীবনে নেমে এল নির্মলা। অবনীকে বললে, সে হিংসায় জ্বলে যেত। সে কি শেষ পর্যন্ত বদলা নিয়ে চলে গেল! কত কি যে মনে হচ্ছে! অতীশ মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে, কেন যে নীলুর মুখ দেখে, কেয়ার মুখ দেখে হাত তুলে বলতে পারল না, আমি নিরাপরাধ নীলু।