॥ আটাত্তর ॥
কেয়ার ভীষণ ভাল লাগছিল অতীশকে নিয়ে ঘুরতে। লম্বা মানুষটা, চোখে ভারি চশমা। মাথায় ঘন চুল। বয়স অনুপাতে ছেলেমানুষী মুখ। আর কলকাতায় থাকে বলে কেন জানি মনে হয় অন্য গ্রহের মানুষ তিনি। কলকাতা খুব বড় শহর, সে শুনেছে। অরাজকতার সময় বাংলাদেশের অনেক বড় বড় মানুষ কলকাতায় চলে গেল। দেশ স্বাধীন হলে ফিরে এল, তখন কেয়ারও স্বপ্ন ছিল, সেও একবার কলকাতা শহর দেখে আসবে। আরও একটা যে বাংলাদেশ আছে, ঠিক এ-দেশেরই মতো ঘরবাড়ি, কথাবার্তা এবং তেমনি হয়তো আজানের সময় মোরগের ডাক শোনা যায়। এবং তেমনি চারপাশে সব ফুল ফল, যা এদেশে সে নিত্য দেখে থাকে। বিশ বাইশ বছর এভাবে একটা দেশ কত দূরত্বে ছিল। যখন নিমেষে দেশটা বাংলাদেশ হয়ে গেল তখন সোনাবাবুর সঙ্গে ঠিক সে কখনও কলকাতা দেখতে চলে যেতে পারবে। মঞ্জুদিকে একবার বলতে হবে এই যা।
কেয়া বলল, এত তাড়াতাড়ি উঠবেন। এখানে আপনাদের ঠাকুরঘর ছিল না?
—তুমি কি করে জানলে?
—সব জানি।
—নিশ্চয় কেউ বলেছে।
—এই যেমন, এখানে ঠাকুরঘর, ডানদিকে স্থলপদ্মের গাছ। পুকুরপাড় ধরে উঠে এলে দুটো লাল রঙ্গনের গাছ। কি ঠিক না মশাই?
—খুব ঠিক্। কিন্তু দেশভাগের সময় তো তুমি জন্মাওনি!
—এই যে ঠাকুরঘর, তার পেছনে পুকুরের পাড়ে পাড়ে ঝুমকো লতার গাছ। একবার আপনার পাগল জ্যাঠামশাই হাতিতে চড়ে কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেল!
—তাও ঠিক।
—এই কোণে তেতুল গাছ ছিল।
—এখানে আপনাদের উঠোন।
—বেশ, কিন্তু তুমি তো কিছুই দেখোনি। জব্বার চাচা নিশ্চয়ই সব বলেছেন।
কেয়া বলল, না। বা’জান একমাত্র দেখেছি সব সময় দুটো বাড়ি সম্পর্কে চুপ থাকত।
—কোন কোন বাড়ি বলতো?
—এই সেনেদের বাড়ি আর আপনাদের বাড়ি। বা’জানকে কিছু বললে, শুধু তামাক খায়। যেন বা’জানের বলার ইচ্ছে, যা বলব, তা ঠিক হবে না। দু-বাড়ির পূজা-পার্বণ, মানুষগুলো, তাদের ব্যবহার আমি ঠিক ঠিক বলতে পারব না। ওদের বলতে গিয়ে ছোট করে ফেলব।
—তবে ঠিক মঞ্জু বলেছে।
কেয়া বলল, মঞ্জুদি এ-বাড়িতে সময় পেলেই চলে আসত।
—এখন আসে ना?
—কম।
—কেন কম আসে বলতে পার?
—জানি না সোনাবাবু
—আগে খুব আসত?
—খুব। অবনীদা ঘোড়ায় চড়ে রুগী দেখতে চলে গেলেই বলত, চল কেয়া সোনাবাবুর বাড়ি কথেকে ঘুরে আসি।
অতীশদের বাড়ি বলতে তো সব বন-জঙ্গল।
ঐ মঞ্জুদির স্বভাব। মঞ্জুদি বলত, এদিকে ওদের বড় ঘর, ওদিকে দক্ষিণের ঘর, কাঁঠাল গাছটার নিচে ছিল পুবের ঘর, উত্তরের ঘরে থাকত অন্ধ ঠাকুরদা। কেবল খক খক করে কাশত।
অতীশ বলল, ওসব কিছু নেই। কেবল দেখছি আছে কাঁঠাল গাছটা, কিছু আম গাছ। জামরুল গাছটাও নেই, খালে কত মোত্রাঘাস ছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে অতীশ কি দেখে সহসা চিৎকার করে উঠল। জঙ্গলের ভেতর প্রকান্ড সাপ। জিভ বের করে হিসহিস করছে।
কেয়া হেসে দিল। সোনাবাবু কি ভীতু! ওটা সোনালী। রূপালীকে দেখা যাচ্ছে না।
অতীশ যেন কি সব পুরোনো কথা মনে করতে পারে। সে এতবড় গো-সাপ কবে যেন কোন জঙ্গলের ভেতর অথবা নালা ডোবার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত। সঙ্গে ফতিমা থাকত। যেন সেই নামকরণ করেছিল, এবং মঞ্জুও যখন শহর থেকে ফিরে আসত তখন সে অনেকদিন বিকেলের হলুদ রোদের ভিতর সোনালীকে খুঁজে বেড়িয়েছে। এবং আশ্চর্য অতীশ দেখেছে, মঞ্জু যেই ডাকত, সোনালী, রূপালী, তখনই ওরা ঝোপের ভেতর থেকে অতিকায় দুটো কুমীরের মতো বের হয়ে আসত, অথবা জলে থাকলে ভেসে উঠত। মঞ্জু বোধ হয়, শহরে থাকত বলে, গ্রামে এলে আশ্চর্য এক ঘ্রাণ পায়, সে টের পায়, অথবা চোখ বুজে যেন বলতে পারে কোন গাছের ছায়ায় সে হেঁটে যাচ্ছে। গাছের নাম, ফলের নাম, ফুলের নাম সে চোখ বুজে বলে দিতে পারে। এমন মেয়ে যখন মঞ্জু তখন এই সোনালী রূপালী যেখানেই থাকুক না সাড়া তো দেবেই।
অতীশ আমলকী গাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে গাছের নিচে ছুটে এসেই যেন অনেকদিন আগের একটা দৃশ্য দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়াল। কেয়া কিছু গাছপাতা ঝোপজঙ্গলের ভেতর বেশ নির্ভাবনায় দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষাকালে ঝোপজঙ্গল ঘন হয়, চারপাশে আগাছা, লতাপাতায় জড়াজড়ি করে আছে বড় বড় গাছ, অথচ কি আশ্চর্য অতীশ দেখতে পায়, সব ঝোপজঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেন পায়ে হাঁটা একটা পথ রয়ে গেছে। অতীশের মনে হল, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সাদা জ্যোৎস্নায় এই ছাড়া-বাড়িতে মঞ্জু বোধ হয় এখনও কাউকে খোঁজে। ছায়া ছায়া অন্ধকারে ডাকে, সোনালী রূপালী, তোরা আয়।
অত আগের সেই বড় গো-সাপ দুটো এখনও তবে বেঁচে আছে। ঠিক বেঁচে আছে বললে ভুল হবে, যেন এই বাড়ির পাহারাদার হয়ে আছে।
কেয়া বলল, মঞ্জুদি রোজ একবার এখানে আসে। ওদের খেতে দেয়। ওরা যতক্ষণ খাওয়া শেষ না করে মঞ্জুদি দাঁড়িয়ে থাকে।
—কি খায়?
—সব। ভাতমাছ, যা দেবে হুঁস-হাঁস খেয়ে নেবে। কি মজা লাগে না দেখতে।
—আজও দেবে?
—দেবে না মানে! ঠিক দেবে।
ওর বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, অবনীর মৃত্যুর দিনে ওদের খাওয়াতে নিশ্চয় মঞ্জু ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু এমন কথা বলতে কেমন সংকোচ বোধ করল। সে বলল, ওরা আমাকে দেখছে।
—মনে হয়। বলে পাশে এসে দাঁড়ান কেয়া।
—আমাকে চিনতে পারছে মনে হা কেয়া
—আমারও মনে হচ্ছে।
—দ্যাখো কি লম্বা জিভ! বাবা! না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
—কেমন দ্যাখো লাল চোখ। আর দ্যাখো কেমন লেজ নাড়ছে।
অতীশ বলল, কি সোনালী রূপালী চিনতে পারছিস?
ওরা তখন বেশি করে লেজ নাড়ছিল।
অতীশ বলল, আমি কিছু খাবার আনিনি। কি করে বুঝব, তোরা বেঁচে আছিস। তোরা আমাদের বাড়িটা পাহারা দিচ্ছিস।
কেয়া বলল, এবার যা। আমরা আবার আসব।
ওরা গেল না। কুমীরেরা যেমন রোদ পোহায় ঠিক পায়ের কাছে নয় তেমনি একটু দূরে চোখ বুজে শুয়ে থাকল ওরা। নড়ল না।
কেয়া বলল, এই যা বলছি।
ওরা তবু গেল না।
—ভারি বেহায়া তো। দেখেই একেবারে গলে গেছে।
অতীশ বলল, তোমার বুঝি রাগ হচ্ছে কেয়া।
আর সঙ্গে সঙ্গে আপনমনে কেয়ার মুখ কেমন লাল হয়ে গেল।
অতীশ ফের বলল, এই কেয়া।
কেয়া কথা বলল না।
—আরে আমি ঠাট্টা করেছি। এস। ওরা যাবে না। ওরা একবার চিনতে পারলে সহজে যায় না।
কেয়া শুধু হাঁটতে লাগল। অতীশ আগে, কেয়া পিছনে। আর আশ্চর্য, সেই কুমীরের মতো বড় গো-সাপ দুটোও এগিয়ে আসছে। পাতার খসখস শব্দে কেয়া এটা বুঝতে পারছিল।
কেয়া উঠোনে এসে বলল, এটা উঠোন। বোঝা যায় না। কত রকমের গাছ দেখুন। সে বসে পড়ল। একটা ছোট্ট আগাছা তুলে বলল, এর নাম আপনি জানেন না।
—না।
—এরা কিন্তু আপনারা যখন ছিলেন তখনও হত।
—হবে হয়ত।
—না হলে, এতদিন পর ওরা হত না।
—তা, ঠিক বলতে পারব না।
—মাটির গুণ তো পাল্টে যায় না। এ-মাটিতে যা হয় তাই হবে। এখানে আপনি কোনও বিদেশী গাছ খুঁজে পাবেন না। লাগালেও বাঁচবে না।
—তা অবশ্য ঠিক। এবং এ-ভাবে অতীশ বুঝতে পারছে না, কেয়া কি বলতে চায়। ওর কি বলার ইচ্ছে, ওকি অতীশকে এখন অপমান করবে, আপনার আস্পর্ধা ভীষণ। যদি এমন বলে, তবে সে সহজেই ক্ষমা চেয়ে নিতে পারবে। অতীশ নিজের ছেলেমানুষীর জন্য ভীষণ লজ্জা পেল। সে ঠিক কিছু ভেবেও বলেনি এটাও আর বোঝাতে পারছে না। কি যে করে এখন।
কেয়া আগাছা ফেলে দিয়ে হাত ঝাড়ল। একটু মাটি লেগেছিল। দু-আঙুলে ঘসে ঘসে মাটি আঙুল থেকে তুলে ফেলল। বর্ষাকাল। চারপাশে মাথার ওপর আমলকি গাছ, কাঁঠাল গাছ। এ-সব নানারকমের গাছ ছায়া মেলে থাকলে নিচের মাটি ভেজা থাকে। কেয়া বলল, আপনারা চলে গিয়ে ভুল করেছেন সোনাবাবু।
অতীশ বলল, কেন?
—দেখলেন তো এ-মাটিতে অন্য গাছ হয় না। মাটির যা স্বভাব তাই হবে। আপনারা কেন যে চলে গেলেন।
—সে তো বাবা জ্যাঠা বলতে পারে। তখন তো আমি ছোট।
—যেই গেছে, ভাল করেনি। নিজের মাটিতে বড় হওয়াই ভাল।
অতীশ বলল, দেখ কেয়া, সব মাটিই সবার। তুমি যদি ধর্ম মানো, তবে দেখবে, মানুষের জন্য এ-পৃথিবী। মানুষ এখানে আছে থাকবে। আবার সে যেতেও পারে। যেখানে যাবে সেটাই তার আস্তানা। মানুষ তার ঠিকানা বদলাতে সব সময়ই ভালবাসে।
—আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
—বলতে চাইছি, যারা চলে গেছে, তারা আর ফিরবে না। কারণ মানুষ যেখানে বাস করে, বড় হয় সেটাই তার বাসভূমি। যেমন আমি কিছুতেই ভাবতে পারি না, এখানে ফিরে এসে আমাকে বাঁচতে হবে। অথচ দ্যাখো শৈশবের জন্য এক মায়া থাকে, ঘুরে ফিরে সেই মায়া আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কিন্তু যখন চোখ মেলে ভালভাবে তাকাই, বুঝতে পারি আমি ভীষণ বদলে গেছি। নির্জনতা, এখন আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়।
—তা হলে আপনি আমাদের ঠিক মানুষ ভাবেন না।
—তার মানে!
—আমরা বনে-জঙ্গলে থাকছি।
—তুমি কেন যে কেয়া ঝগড়া করতে আরম্ভ করলে বুঝি না!
—আপনার সঙ্গে আমি ঝগড়া করতে যাব কেন?
—কি জানি, আমিও ভেবে পাচ্ছি না তুমি ঝগড়া করতে যাবে কেন।
—ওখানে আপনি দুলে দুলে পড়তেন। শশীমাষ্টার পড়াত। আপনার দাদারা পড়ত। একবার শ্মশানে ভূত দেখেছিলেন। কি মনে পড়ছে!
—হ্যাঁ ও-জায়গায় ছিল দক্ষিণের ঘর। শশী মাষ্টারের চারপাশে আমারা গোল হয়ে বসতাম। অবশ্য তুমি না দেখালে আমি চিনতে পারতাম না। একটা তক্তপোশ ছিল, বড় তক্তপোশ। আমরা সবাই গোল হয়ে পড়তে বসতাম। মাস্টারমশাই মাঝখানে বসে পড়াতেন।
কেয়া বলল, আমি সব জানি। মঞ্জুদি বলেছে।
অতীশের খারাপ লাগছিল ভাবতে, সে যা বলতে যাচ্ছে, দেখছে, সবই মেয়েটা জানে। সে বলল, চল। আর না। বলে সে বড় জামগাছটা পার হয়ে চলে এল। কেয়া পেছনে পেছনে আসছে তেমনি। গোসাপ দুটো আর আসছে না। পাশের পুকুরে ওরা বোধ হয় ভেসে গেছে।
এক সময় বাড়ির কাছাকাছি এলে অতীশ বলল, কিছু আজে বাজে কথা বলে ফেলেছি কেয়া, তুমি মনে কিছু কর না।
—আমিও তো কি সব মাথামুন্ডু বললাম। দেখাতে গেলাম, কত কিছু জানি-আপনাদের সম্পর্কে একটা গাছ তুলে কত কি বললাম। আসলে আমি কিছুই জানি না সোনাবাবু। কেন যে আপনার ওপর এমন রেগে গেলাম বুঝতে পারলাম না।
—কিছু হয়তো এমন বলে ফেলেছি যা তুমি শুনতে চাও না। কেয়া আমি আর এক উপগ্রহের মানুষ বলতে পার।
কেয়া সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর চুল কি ঘন! মুখ কি লাবণ্যময়! চোখ কি বড়। যেন সে সহসা আশ্চর্য এক যুবতী হয়ে গেছে এবং ক্রমে ভীষণ সাহসী হয়ে যাচ্ছে। সে দু’পায়ে ভর করে অতীশের মতো লম্বা হতে চাইছে, পারছে না, কষ্ট। সে বলছে, সোনাবাবু না ভেবেচিন্তে পাগলের মতো কি সব বলেছি! মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। আপনি কিন্তু মঞ্জুদিকে আবার এ-সব বলতে যাবেন না। মঞ্জুদি জানতে পারলে কষ্ট পাবে। আমার রক্ষে থাকবে না।