2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৭৬

।। ছিয়াত্তর।

মুর্শেদ লাফ দিয়ে উঠে বসল। তারপর ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলে, এক ঝলক হাসি কেয়ার সে বলল, মিঞার আর তর সইছে না।

—ছোটবিবি সত্যি বলছি, তর সইছে না।

—আবার ছোট বিবি!

মুর্শেদের মনে হল অনেক দিন হল সে কেয়াকে ছোটবিবি ডাকছে না। বিশেষ করে যেদিন থেকে ঢাকায় ইন্ডিয়ান আর্মি মার্চ করে ঢুকে গেল সেদিন থেকে। আগে সে কথায় কথায় বলত, দ্যাখো ছোটবিবি তোমার ভয় নেই। তখন কেয়া ছিল কতকটা মুর্শেদের আন্ডারে। যদিও মুর্শেদের তেমন ক্ষমতা ছিল না, তবে কেয়াকে নিয়ে মোটামুটি মেজর সফিকুল সাহেব খুশিই ছিলেন। ওর কাছে কেয়াকে খুব একটা নাস্তানাবুদ হতে হয়নি। অন্তত মেজরের হাতে পড়ে কেয়ার প্রাণের আশঙ্কা ছিল না। একটু কাছাকাছি খুব সুন্দরী মেয়ে নিয়ে বসে থাকার স্বভাব ছিল সফিকুলের।

তবু কি করে যে কি হয়ে যায়। মুর্শেদ সেই বিরল জনহীন প্রান্তরে একা একদিন কেয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। মেজরের যে কোথায় গন্ডগোল তার জানা ছিল না, কেয়াকে মুর্শেদের আন্ডারে না রেখে আবার তাকে অন্য একজন সুবেদারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার হুকুম হয়েছিল। মুর্শেদের ওপর শুধু ভার কেয়াকে ঠিকমতো পৌঁছে দেওয়া। কেয়ার জন্য মুর্শেদ তখন চুপচাপ বন্দুকের নলে হাত রেখে বসে থাকত। এবং কখনও কেয়াকে খুব কাতর দেখালে ওর কেন জানি মিনারের চোখ দুটো ভেসে উঠত। মনে হত ইন্ডিয়ান আর্মি সারা পাকিস্তানে ঢুকে গেছে। টেরর তারা। যেন একটা মরুভূমির ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নেওয়া হচ্ছে, ওর বিবি মর্জিনাকে। অনেক দূরে উটের ওপর সে দেখতে পেত একজন ভারতীয় সৈন্য, এবং ওর কাঁধে লুটিয়ে পড়ে আছে মিনার। সে তখন ভয়ে রাতে ঘুম যেতে পারত না। দুঃস্বপ্ন থেকে আঁৎকে উঠলে সে ভাবত, কেন এ-ভাবে মানুষেরা যুদ্ধে আসে, সে তো কখনও নিজেকে হিন্দুস্তানের লোক ভাবতে পারে না।—কিন্তু সেই যে তার বাল্যস্মৃতি—ফুলবাগান পার হয়ে কেবল সামনে নলখাগড়ার বন, কাঠের গোলা, এবং উল্টোডাঙার খাল বরাবর গেলে এক বিস্তীর্ণ মাঠ—নিচু নাবাল জলাভূমি, কতরকমের পাখি উড়ে আসত। ভেড়িগুলোতে অজস্র মাছ। সে কতদিন খুব সকালে মাছের আশায় হাঁটতে হাঁটতে উল্টোডাঙার পুল পার হয়ে নিচু নাবাল জমিতে নেমে গেছে। বড় বড় পাবদা, অথবা কখনও গলদা চিংড়ি সে ধরে আনত, অথবা পুলের নিচে এক মসজিদ, সেখানে সকাল সকাল বাপজি চলে যেত আজান দিতে। বাড়ির চাতালে আম্মা বদনা থেকে পানি ঢেলে বলত, উঠ মুর্শেদ, সবের হয়ে গেল। পড়তে বোস।

কেয়া দেখল, মুর্শেদ খুব নিবিষ্ট মনে চা খাচ্ছে। সে কেয়াকে আর কিছু বলছে না। এমন কি কেয়া যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে যেন বেমালুম ভুলে গেছে। কেয়ার তখন ভারি রাগ হয়। সে না বলে পারে না, মিঞার ছোট বিবির কথা আবার মনে আসে কেন?

—মনে আসে, এই এমনি, মানে চলে যাব তো। অনেক কথা মনে পড়ছে।

কেয়ার সেই দুষ্টমি বুদ্ধি ফের, কে বলেছে তুমি চলে যাবে।

—কেন মঞ্জু।

—মঞ্জুদি বলেছে তুমি চলে যাবে?

—না, ঠিক না বললেও, ঐ যে কে এসেছে, আমাকে নিয়ে যাবে কথা আছে, আমি তার সঙ্গে চলে যাব। আমার আর ভয় নেই।

—সব গন্ডগোল হয়ে গেছে।

—তার মানে!

—মানে ভীষণ পাকিস্তানী বিদ্বেষ তার। তোমার কথা শুনে ভীষণ ক্ষেপে গেছে।

—মানে! তুমি কি বলছ কেয়া?

—বলছে, এতবড় একটা রিস্ক তোমরা আমার ঘাড়ের ওপর ছেড়ে দিচ্ছ। পুলিশে এতদিন খবর দাওনি! একজন ডেজার্টারকে ঘরে লুকিয়ে রেখেছ!

কেয়া দেখল, চোখমুখ ভীষণ শুকিয়ে গেছে মুর্শেদের। এমনি লম্বা মত মানুষটা। গাল সাফ- সোফ রাখার স্বভাব। রঙ ভীষণ উজ্জ্বল। চোখ বেশ বড়। নাক উঁচু। একজন ভাল মানুষের স্বভাবে যা যা থাকে, মুর্শেদের মুখ দেখলেই বোঝা যায় সব তার আছে। সে এখন চুপচাপ পাশে চায়ের কাপটা রেখে দিয়েছে। মাথা নিচু করে রেখেছে এবং মনে হয় কিছু ভাবছে। মুর্শেদের এমন করুণ চেহারা দেখে কেয়ার ভীষণ মায়া হল। সে রসিকতা করতে গিয়ে কেমন একটা বাজে ছেলেমানুষী করে ফেলেছে। এটা করা ঠিক হয়নি। সে এবার বেশ জোরে হেসে দিল, আরে সাহেব ছোটবিবি থাকতে তোমার ভয় নেই। মঞ্জুদি এখনও কিছু বলেনি। সোনাবাবু খুব ভাল মানুষ।

মুর্শেদ যেন এখনও ভরসা পাচ্ছে না।

কেয়া বলল, চা খাও। কাপ প্লেট নিয়ে যাব। তোমার দুধ আসবে আবার। মুর্শেদ বলল, মঞ্জু এখনও বলেনি।

—না! বলবে, তুমি ব্যস্ত হবে না। মঞ্জুদি, ঠিক সময় হলেই বলবে।

সে এবার কোন চোখ উদাস করে ফেলল। সামনের জানালার একটা পাট খোলা। সে বলল, আমার কিছু ভাল লাগছে না কেয়া। তারপরই কি মনে হলে বলল, নীলু কেমন আছে?

কেয়া বলল, ভাল না সাহেব।

—আমি কখন যাব ওর কাছে?

—বলতে পারছি না।

সোনাবাবু আসায় একটা মুশকিল দেখা দিয়েছে, যখন তখন কেয়া ওকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসতে পারছে না। কখন সোনাবাবু বাইরে থাকবে, অথবা সোনাবাবুকে কিছু সময়ের জন্য বাইরে নিয়ে যেতে হয়, না হলে টের পাবে, টের পেলে কি-ভাবে নেবে, একজন ডেজার্টার মানুষ, ধরা পড়লে ভীষণ হাঙ্গামা এবং নানাভাবে উৎপীড়ন শুরু হতে পারে—মুসলমান পাড়ার লোকেরা খবর পেলে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। দুশমন খতম করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যেতে পারে এত সব ভেবেই হয় তো মঞ্জুদিও চট করে বলতে পারছে না। তবু মুর্শেদ এখানে যতদিন আছে, অর্থাৎ সেই নিষ্ঠুর দিনগুলির প্রায় প্রথম থেকেই, এবং কি করে যে অবনীদার সঙ্গে ওর আলাপ, হয়তো ওষুধের জন্য প্রথম মুর্শেদ অবনীর কাছে এসেছিল। একটা কলিক পেন-টেন হবে। কবিরাজী প্রায় ধন্বন্তরির সামিল। এবং এক সময় নিরাময় হলে, মুর্শেদ প্রায় বুক আগলে রাখত ওদের। অথচ মুর্শেদ তখনও জানত না, সে এ-ভাবে বেশিদিন তাদের রাখতে পারবে না। শান্তি কমিটির মানুষেরা ক্রমে মেজরকে নানাভাবে উৎসাহিত করত, অবনীবাবু কলাবরেটর। ও পাকিস্তানের দুষমণ। ক্রমে এ-ভাবে একটা সাংঘাতিক অবিশ্বাস এবং পরে মুর্শেদের সঙ্গে আরও চারজন এসেছিল—মুর্শেদ একজন ডিসপ্লিনড মিলিটারি পার্সন, সে আজ্ঞাবহ দাস মাত্র। সে চুপচাপ হেঁটে হেঁটে তার কঠিন শক্ত হাত ধরে যেন বলার ইচ্ছে ছিল, অবনীবাবু আমার কসুর মাপ করবেন। আল্লার কাছে কি জবাব দেব জানি না, আপনি আমার দোস্ত। আমার কাছে আপনি বড় কাছের মানুষ অবনীবাবু কিন্তু আমি একজন মিলিটারি পার্সন। আমার কোনও ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু নেই। শুধু হুকুম তামিল করতে পারি। হুকুম তামিল করা আমার ধর্ম।

অথচ আগের দিনগুলো কি যে ভীষণ ভালো ছিল। বিকেলে ফল-ইনের আগে, অথবা সন্ধ্যার রোল কল হয়ে গেলে একটা টর্চ নিয়ে মুর্শেদ বের হয়ে পড়ত। সাইকেলে চলে আসত অবনীবাবুর ডিসপেনসারিতে। তারপর গল্পগুজব, মাঝে মাঝে জব্বার চাচা চা নিয়ে আসত ভেতর থেকে। যাবার সময়, সে ডাকত মঞ্জু ভাবি, কেয়া, কেয়া কোথায় মঞ্জু ভাবি, আমার ছোটবিবি।

আর এই নিয়ে ছিল ভীষণ হাসাহাসি। কেয়া ভীষণ ক্ষেপে যেত। সে বলত, মুর্শেদ তোমার মাথায় লাঠি ভাঙব।

মুর্শেদ হাসতে হাসতে বলত, ছোটবিবি, তরমুজ। তরমুজ তুমি, কেটে কেটে চিনি দিয়ে খেতে ও কি যে আরাম! একেবারে চিনির রস! টুই টুম্বুর।

—মুর্শেদ ভাল হচ্ছে না।

মাঝে মাঝে তখন মঞ্জু ধমক দিত, কেয়া এটা কি হচ্ছে? অসভ্যতা। সাহেব তোর ছোট না বড়।

কেয়া তখন কথা না বলে চুপচাপ বড় বড় পা ফেলে ভিতরে চলে যেত। এ-ভাবে মুর্শেদ এ- বাড়িতে আত্মীয়ের মতো ছিল। সে সাইকেলে মাঠের ওপর দিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে যেত। কখনও গোপেরবাগ পার হয়ে দেখতে পেত সেখানে সোনালী বালির নদীর চর সামনে, ধু ধু বালিরাশি, এবং চাঁদ উঠলে ওর বিবির কথা মনে পড়ত। বিবির কথা মনে পড়লেই মঞ্জুদির কথা মনে পড়ত, মঞ্জুদির কথা মনে হলে কেয়ার কথা, অবনীবাবুর কথা—সব কথা, এবং বর্ডার পার হয়ে গেলে সেই উল্টাডাঙার মাঠ, কারখানা, তারপর বস্তি বাড়ি, একটা বিরাট দেশের সে মানুষ, অথচ কেন যে সে নিজেকে আলাদা ভাবতে ভালবাসে—ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। শৈশবে সে এমন কখনও ভাবতেই পারেনি, কেউ তাকে তার শৈশব থেকে নির্বাসনে নিয়ে যাবে।

কেয়া দেখল মুর্শেদের চোখ জানালায়। কথা বলছে না। অবনীদার জামা প্যান্ট অথবা পাজামা পাঞ্জাবি সব ছোট বলে তাকে দেখতে কিছুটা জোকারের মতো লাগছে। কখনও কখনও এই নিয়ে হাসাহাসি। মুর্শেদ তখন ছেলেমানুষের মতো আরও সব হাঁটাহাঁটি, চোখের ইসারা, কখনও বেঁকে, কখনও লম্বা হয়ে যাওয়া সে একেবারেই তখন জোকার সাজতে ভালবাসে। আসলে তখন কেয়া বুঝতে পারে এ-সবের ভেতর মুর্শেদ তার ছেলেমেয়েদের স্মৃতি ভুলে থাকতে চায়। এবং যখন চুপচাপ থাকে, কথা বলে না, দশটা কথা বললে, একটা কথার জবাব দেয় তখন কেয়া কি করবে ভেবে পায় না।

কেয়া বলল, আমি গিয়ে সোনাবাবুকে কোথাও পাঠিয়ে দিচ্ছি।

—কোথায় পাঠাবে!

—দেখি।

আবার সেই করুণ চোখ। কেয়া হেসে দিল, আরে তোমার কাছে ওঁকে পাঠাচ্ছি না। তোমার যেমন ছেলেবেলা কলকাতার কোন ডাঙ্গায় না বাজারে কেটেছে, সোনাবাবুর তেমনি এখানে কেটেছে। অথচ দ্যাখো তোমারা দুজনই দুদেশের মানুষ। বলে কেয়া কি ভাবল। বলল, আমি এখন এ-দেশের। আমার এখন তিনটা দেশ। তুমি আমি সোনাবাবু তিন দেশের মানুষ। ভাবা যায় না।

মুর্শেদ বলল, সত্যি।

কেয়া বলল, অথচ দ্যাখো তোমরা আমাদের কি না করেছ!

মুর্শেদ চুপ করে থাকল।

—কি কথা বলছ না কেন?

—কি বলব বল!

—জবাব দাও।

কেয়ার চোখ মুখ দেখলে মনে হবে সত্যি সে জবাব না নিয়ে ছাড়বে না। তারপর কেয়া খুব একটা সরল মেয়ের মতো বলল, কিগো মুর্শেদ মিঞা, কোন জবাব দিতে পার না। এত দূর থেকে ধর্মের নামে দেশ শাসন করলে এই হয়। মানুষের সুখ দুঃখ বুঝলে না, কেবল শাসন করে গেলে। তারপর কেয়া কি ভেবে বলল, সোনাবাবুকে পাঠিয়ে দেব! তুমি সোজা কথার মানুষ না!

—এই কেয়া! প্লিজ।

—প্লিজ-ফ্রিজ না।

কিন্তু তবু কেয়া ছুটে বের হয়ে যেতে চাইলে মুর্শেদ বলল, আল্লার কসম!

কেয়া হা হা করে হেসে উঠল। এবং ঘাসের ওপর বসে পড়ল হাসতে হাসতে। কেমন ভয় পাইয়ে দিয়েছে। সে মানুষটাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে। সোনাবাবুর নামে কি ভয়!

.

কেয়া এসে দেখল, সোনাবাবু চুপচাপ বসে রয়েছে। মঞ্জুদি কাছে নেই। বা’জান হাম্বাল দিস্তায় শুকনো লতাপাতা গুঁড়ো করছে। এবং ঘোড়াটা ছাড়া বাড়িতে ঘাস খাচ্ছে।

কেয়ার কেন জানি আজ লম্বা বারান্দায় সকালের রোদে এ-ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। এটা শরৎপাল। জল ক্রমে কমে যাচ্ছে। জলে ঘাসপচা গন্ধ উঠছে।

সে অতীশকে বলল, চা খেয়েছেন।

—কখন!

—আবার দেব।

—দাও।

—কতবার দিনে চা হয়?

—যতবার দেবে।

—এখানে তো তা হবে না। চিনি পাওয়া যায় না। গুড় নেই। সব আকাল।

—তবে যা দেবে।

—সব সময় মিলতে নাও পারে।

—তবে দিও না।

—আপনি একবার ওদিকটায় যাবেন?

—কোন দিকটায়?

—আপনাদের বাড়ির দিকে।

—চল।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকল, মঞ্জুদি, আমরা যাচ্ছি।

—কোথায়!

—সোনাবাবুদের বাড়ি।

—এখন যাচ্ছিস। মাছ কে কাটবে।

—এসে কাটব।

আসলে এই যে জোরে জোরে কথা, সব মুর্শেদকে যেন শুনিয়ে দেওয়া, আমরা যাচ্ছি। তুমি এই ফাঁকে নীলুর কাছে এসে বসতে পার

যাওয়ার সময় কেয়া দেখল মুর্শেদ জানালার বসে আছে। ডিসপেনসারি পার হয়ে ছাড়া বাড়িতে ঢুকে দেখল, মুর্শেদ জঙ্গলের আড়ালে তাদের যেন অনুসরণ করছে। ইন্ডিয়ার মানুষ। এখানে এসেছে। কলকাতায় থাকে। কলকাতা মানে তার কাছে, ষষ্ঠীতলা, চন্ডিতলা, বাগমারি, অথবা সেই সব জলা, যার পাড়ে পাড়ে সে নিত্যদিন ওর শৈশবে ঘুড়ি ওড়াতো অথবা সব কাঠের গুদাম পার হলে শুধু মাঠ, ঘাস, কবরভূমি এবং নিশিদিন ওর কাছে ছিল সব কিছু অত্যন্ত কাছের, সেখানে কি সেই মানুষ যায়! মসজিদের পাশে সেই পীরের দরগা এবং একটা কাঞ্চন ফুলের গাছ ছিল, অথবা, সেই নুরুল মিঞার দোকান, মোহরমের দিনে যে লোকটা রাঙতার টুপি, রাঙতার তরবারি বিক্রি করত। নুরুল মিঞা ছিল ওর কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে আশ্চর্য মানুষ। সে তো সব সময় মক্কা অথবা মদিনার গল্প, সব নাবিকের গল্প, যেন ওর শুনলে মনে হয় সে নিজের চোখে সব দেখে এসেছে।

সেই মানুষটাকে কি এখনও ষষ্ঠীতলার মাঠে বসে থাকতে দেখা যায়! অথবা সেই লোকটা, যে আসত শীতে বহুরুপী সেজে। যে সকালে এসেই ঢোল পেটাত। আর বস্তির সব ছেলেমেয়েরা ছুটত ঢোলের শব্দ শুনে। ওরা ঘিরে দাঁড়াত। সাদা রঙের ঘোড়া, আসলে ওটা ঘোড়া ছিল না, মানুষটার নাম ছিল মনসুর, সে থাকত মাঝে, সামনে ঘোড়ার মুখ, পিছনে লেজ, কাপড় দিয়ে ঢাকা। এবং নিচে কি যে থাকে কে জানে, সে হাতে রাখত চাবুক, সে লাফালে ঝাঁপালে ঘোড়াটাও লাফাত ঝাঁপাত। এমন একটা কাপড়ের ঘোড়া তার কাছে কখনও মনে হয়নি, কাপড়ের। জ্যান্ত ঘোড়া চড়ে এলেও সে মনসুরকে তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য মানুষ ভাবত না। সে নেচে নেচে গান গাইত। যেন ঘোড়ায় চড়ে গাইছে। দুলহ যায়। আর কি সব, সাদি সমন্দের গান, তার মনে নেই। তবু সে যেন ভাবে, মনসুর যে জগৎ নিয়ে বেঁচে ছিল, তার গানে, এবং এখনও সে যখন মিনার অথবা মর্জিনাকে গল্প করতে বসে, বার বার ঘুরে ফিরে আসে সেই দুটো মানুষ, একজন নুরুল, অন্যজন মনসুর। ইণ্ডিয়া বাদে সে দুটো মানুষকে পৃথিবীর আর কোথাও আবিষ্কার করা যাবে না সে জানত। ওর বুক থেকে তখন সামান্য দীর্ঘশ্বাস উঠত। শৈশবে সে কেন যে এ-ভাবে বার বার ফিরে যেতে চায়। কলকাতার মানুষটা হেঁটে যাচ্ছে। যে কেবল বলতে পারে, ইণ্ডিয়াতে ওরা এখনও বেঁচে আছে কিনা।

মুর্শেদের ভারি লোভ হচ্ছিল, কেয়া এবং সেই মানুষটার পাশে পাশে হেঁটে যায়। কিন্তু পারে না। কারণ মঞ্জু এখনও কিছু বলছে না। মঞ্জু না বললে সে হুট্‌ করে কিছু করতে পারে না। মানুষের মনে কি থাকে কেউ কখনও সঠিক বলতে পারে না।

সে গাছের আড়াল থেকে এবার সরে এল। ওরা ছাড়াবাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে। পরে পুকুর। হাজা মজা। এখন বর্ষাকাল বলে সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এবং একটা বাস পাকা রাস্তা ধরে চলে যাচ্ছে। এটা সকাল আটটার বাস। আটটা বেজে গেছে তবে। এবং ওরা যখন একটু ঘুরতে গেছে, সে এই ফাঁকে নীলুর ঘরে যেতে পারে। নীলু ওকে দেখলে ভীষণ খুশি হয়। আর শিশুর মুখের সঙ্গে কেন যে সে সব শিশুদের মিল খুঁজে পায়। সে তখন আর কেন জানি ওর পাশ থেকে উঠতে পারে না, কেবল বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। শিশুরা পৃথিবীতে একই রকমভাবে বাঁচে।

সে বারান্দায় এসে দেখল, মঞ্জু একটা বড় থালায় চিংড়ি মাছ, বেলে মাছ, পাবদা মাছগুলো ঢেকে রাখছে। যে কাজ করে দেয়, সে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। সে এখন এদিকে নেই। এবং সে দেখেছে মঞ্জু, ওর সামনে মুর্শেদকে বের হতে বারণ করে না।

এ-ভাবে মুর্শেদ ঘরে ঢুকে দেখল, জানালা খোলা নেই। সে নীলুর মাথার সামনের জানালা খুলে দিল। হয়তো কেয়ার কাজ। সকালের দিকে সে খুলে দিয়েছিল হয়ত। অবার যাবার সময় বন্ধ করে রাখতে পারে। সে এ-সব ভাবল। আর বেশি সে এখন সামনের দিকে যেতে পারবে না। কারণ একটু পরেই সামনের ঘর পার হয়ে বার-বাড়ির বারান্দা, মাঠ, বাঁ দিকে নীল ডাকবাক্‌স।

সে চুপচাপ নীলুর পাশে বসল। নীলু ওকে দেখে খুব খুশি। নীলু তো জানে না, যে তার বাবাকে এক বিকেলে না সেটা সকালেই হবে, ঠিক যেন সে মনে করতে পারে না, কাকে, কখন, কোন সময়ে বড় মাঠে নামিয়ে হত্যা করেছে। শুধু অর্ডার—কিল। সমস্ত কলাবরেটরদের খুঁজে বার কর। যারা দেশের চর, যাদের জন্য আমাদের আজ গৃহযুদ্ধ, তাদের খুঁজে বার কর। অ্যান্ড স্যুট দেম আনটীল দেয়ার ডেথ্।

হায় সে তো একজন আজ্ঞাবহনকারী মানুষ। সে এ-ভাবে মেরে গেছে, তা কত, সে এখন সংখ্যা নিরূপণ করতে পারে না। কেবল নীলুর সামনে বসলেই সে কেমন বোকা হয়ে যায়। যেন নীলু ইচ্ছে করলে ওর বোকামির জন্য ওঠ-বোস করাতে পারে। এবং এ-ভাবে সে মাঝে মাঝে কেন যে নীলুকে ভীষণ ভয় পায়। নীলু হাসলে, সে তখন আর কিছুতেই হাসতে পারে না। মুখ গোমড়া করে বসে থাকলে, নীলু বলবে, মুর্শেদ চাচা তুমি কাঁদছ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *