।। তিয়াত্তর।।
মুর্শেদ তখন বসে বেশ আরাম করে একটা সিগারেট খাচ্ছিল। এবং মনে কি যেন তার কবিতার মতো বাজছিল। কেউ এসে গেছে এখানে –যে তাকে নিয়ে যাবে হিন্দুস্থানে। রাজাবাজারের অলিগলিতে অথবা পার্কসার্কাসে কেউ যদি থেকে যায় তবে দেখা হয়ে যাবে –আর না যায় তো অত বড় দেশ পার হলেই সে হোসেনিয়ালার কাছে একটা জায়গা পেয়ে যাবে, যার ভিতরে ঢুকে গেলে সেই পবিত্র স্থান, সেখানে আছে তার পুত্র রহমান, বিবি মর্জিনা, মেয়ে মিনার। সে কেমন মনে মনে একটা আশ্চর্য রকমের বিশ্বাস গড়ে ফেলেছে –এসে গেছে, এসে গেছে ভাব। তাকে খুব দেখার ইচ্ছে, যে তাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু কেয়া বলেছে, সাহেব অত তাড়াহুড়া করলে চলবে না। মঞ্জুদির জানমান নিয়ে কথা। এমন কথায় মুর্শেদের মুখ ভীষণ কালো হয়ে গেছিল একটুকুতেই এখন মুর্শেদ ছেলেমানুষের মতো ভয় পেয়ে যায়।—তবে কি হবে কেয়া?
কেয়া মুর্শেদের চোখেমুখে এমন ভীতির ছাপ দেখে বলেছিল, এখানে তোমাকে আমরা আটকে রাখবো।
মুর্শেদ বলেছিল, আমার মেয়েটা কত বড় জানো?
—কত বড়, তুমি তো কতবার বলেছ।
—বলেছি!
—বলনি?
-আমার মনে থাকে না কেয়া।
—বলনি, তোমার মেয়ে মিনার আসার সময় প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল।
—হ্যাঁ, বলেছি!
—বলনি, রহমান চুপচাপ পাথর হয়ে গেছিল যেন!
—বলেছি!
—বলনি, মর্জিনা, চোখ তুলে তাকাতেই সাহস পায় নি, পাছে তুমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেল।
—এত সব বলেছি!
—তুমি সাহেব ভুলে যাও!
—ভুলে না গেলে বাঁচতে পারতাম না কেয়া। পাগল হয়ে যেতাম।
তারপর কেয়া আর কথা বলে না। হ্যারিকেন নিয়ে নেমে আসে। মুর্শেদ সংসার অন্ত প্রাণ। দুবছরের
ওপর হতে চলেছে, সে তার আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না।
কেয়া জানে মুর্শেদ এখনও দরজা বন্ধ করেনি। এখনও সে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। এবং হ্যারিকেনের আলো নিভে গেলেই সে দরজা বন্ধ করে দেবে। একটা সিগারেট খাবে।
তারপর গালিব থেকে, সেই কবিতাটা আবৃত্তি করবে—
ইশ্বক পর জোর নহী হ্যায় যে বো আতিশ গালিব
কি লগায়ে ন লগে প’র বুঝায়ে ন বনে।
কেয়া একদিন কবিতাটা শুনে বলেছিল, মানে?
—মানে? এর মানে হচ্ছে আচ্ছা তোমাকে কবিতা করে বলব, না গদ্য করে বলব কেয়া।
—কবিতা করে বল।
কবিতা করলে এমন হয়তো দাঁড়ায়,
প্রেমের পরে জোর খাটে না গালিব সে তো বহ্নি
জ্বালতে গেলে জ্বলবে না তো নেভাতে গেলে তেমনি।
—হয়েছে থাক! তোমার প্রেম মিঞা তোমার বিবির জন্য কত আছে আমি জানি। তুমি একটা নচ্ছার মানুষ।
মুর্শেদ তখনই দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকে। ওর ঘরে আছে বড় এটা বাক্স। বাক্সতে আছে সব অবনীর জামা কাপড়। মুর্শেদ এক জামা প্যান্টে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। মুর্শেদ জানতো এখানে সে সবচেয়ে বেশি নিরাপদে থাকবে। ওর মনে হয়েছিল, সে মঞ্জুর জন্য এতটা যখন করেছে, তখন মঞ্জু তার জন্য কিছু করবে। এবং এখানে এসেই সে বুঝে ফেলেছিল, মঞ্জু তাকে নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়ে গেছে। আর্মি থেকে একজন ডেজার্টার মানুষকে নিয়ে সে যে কি করে! হিন্দুস্থান থেকে রিফুজিরা আবার ফিরে আসছে। কিছু কিছু এ-গাঁয়েও উঠে আসতে পারে। তখন অত নিরিবিলি থাকবে না গ্রামটা। নরেণ দাসের বাড়ি থেকে আরম্ভ করে দালানবাড়ি পর্যন্ত, তারপর ঘোষদের ছাড়াবাড়ি পর্যন্ত একটা এমন নিবিড় অরণ্য সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে দিনের বেলাতেও মানুষেরা যেতে ভয় পায়। এইটাই মঞ্জুর পক্ষে রক্ষা।
অবনীর জামা-কাপড় তার খাটো হয়। খাটো জামা-কাপড় পরেই সে থাকে। মাঝে মাঝে খুব হাসাহাসি করে এই নিয়ে কেয়া। এত লম্বা মানুষের জামা-কাপড় কোথায় পাওয়া যাবে। বাবা ওর উর্দু ভাষী মানুষ। লম্বা, বড় বেশি খিদমতগার, সে ওর বাবার মতো লম্বা হয়েছে। মা বাঙ্গালী, ছোট্ট মেয়ে, স্বভাবে ভীতু, এবং সে মায়ের মতো স্বভাব পেয়েছে। সে যখন আর্মিতে জয়েন করে তখন ওর মা আল্লার কাছে সারাদিন মোনাজাত করেছে। রোজা রেখেছে। মা দরগায় মোমবাতি জ্বেলেছে। সবই করেছে, ছেলে সুখে থাকুক, এই ভেবে।
মঞ্জু বলেছিল, নাও মিঞা। আমার মানুষের জামা-কাপড় দিলাম। তোমরা আমার সব কেড়ে নিয়েছ, আমি তোমাকে এইটুকু দিলাম। তুমি জামা-কাপড় ছাড়া থাকবে কি করে?
কেয়া বলেছিল, এটা তুমি কি করছ মঞ্জুদি!
মঞ্জুকে খুব শক্ত দেখাচ্ছিল। সে বলেছিল শুধু, কেয়া আমারটা আমি ভাল বুঝি। সে বুঝি আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, বলতে চেয়েছিল, ওরা সব যখন নিয়েছে, এটুকু নিয়ে নিক। অর্থাৎ মানুষের স্থিতিটুকু। মানুষকে খুব কষ্ট দেয় স্মৃতি। সব সময় বেদনার কথা মনে করিয়ে দেয়, সুখের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার জীবনে সুখের কথা বলতে কিছু নেই। নিজের ভাগ্য দেখে মনে হয় মার সঙ্গে আমার ভাগ্যের কোথাও মিল আছে।
তারপর কেয়া আর বাধা দেয়নি। মঞ্জু কিছুই করে উঠতে পারেনি। মঞ্জু হিন্দু বলেই কিছু সুযোগ- সুবিধা সে এখন সরকারের কাছ থেকে বেশি পাচ্ছে। যেমন কেয়াকে পবিত্র করার ইচ্ছায় কোনও সংস্থা তার ভার নিতে চেয়েছিল। কিন্তু মঞ্জু তা হতে দেয়নি। কেয়ার ভেতরে যে কীট বাসা বেঁধেছিল—সেই নিয়ে জব্বার চাচার যেন কোনও ভাবনা ছিল না। মঞ্জু জব্বার চাচাকে নানা ভাবে বুঝিয়েছে, এখনই করে ফেলা দরকার। জব্বার চাচা ধার্মিক মানুষ। সে বলেছে, আমি পারি না মা। এবং মঞ্জু নিজের হাতে রসগোল পাতার বড়ি নিয়ে কেয়াকে খাইয়ে দেবার সময়, কেয়ার সেই কঠিন মুখ দেখে কেমন ভয় পেয়ে গেছিল। তারপর কেয়াকে কি ভাবে যে সুস্থ এবং স্বাভাবিক করে তুলেছে, সে সব মনে হলেও মঞ্জু মাঝে মাঝে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে।
সবই জানে মুর্শেদ। যখন সব মনে হয় তার, নিজের ভেতরও এক অস্বস্তি সে বয়ে বেড়ায়। সেতো সেই মানুষেরই বংশধর। যেমন যোসেফ একদা সমুদ্রে পথ করে দিয়েছিল, অথবা সেই সব দৈববাণী, মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সব, অথচ মানুষ মাঝে মাঝে কেন এমন হয়ে যায়। সব ভেঙ্গে চুরে সে নষ্ট করে দিতে ভালবাসে।
কেয়া চলে গেলেই সে প্রথম মশারির নিচে যায় না। খাটো জামাকাপড়ে কেমন দেখায় আয়নায় দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ তা দেখে। বেশ মজা লাগে নিজেকে দেখতে। অবনীবাবু খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। জামা-কাপড়ের কাটিং দেখে সে সেটা বুঝতে পারে। সে তো এখান থেকে কিছুই নিয়ে যেতে পারছে না। শেষ দিকে সে তো সরকার থেকে মাইনে পর্যন্ত পেত না। সে যদি ডেজার্টার না হত, তবে বন্দী তালিকায় তার নাম থাকত। মাঝে মাঝে সে এটা করে যে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছে বুঝতে পারে। এবং তখনই গুনগুন করে গালিবের কোনও কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে।
শরমিন্দা রাখতী হ্যায় মুঝে বাদে বাহরসে
মিনারে বেশরাব্ ওয়াদিল-এ বে-হাওয়ায়ে গুল।
কেয়া যদি বাংলা মানে জানতে চায় তবে সে বলবে,
বসন্তকে এড়িয়ে চলি নিতান্তই নিজের দোষে।
পুষ্পবিহীন হৃদয় আমার শূন্য মদের পাত্র হাতে।
সে বসে থাকল কিছুক্ষণ। ঘর অন্ধকার। শুধু হাতের সিগারেটটা জ্বলছে। এবং একটা জোনাকির মতো, অন্ধকারে সিগারেটের আগুন নিয়ে খেলা করতে থাকল। সে সিগারেটের আগুন চোখের সামনে রেখে দেখল। ফু দিয়ে কতটা আলো প্রবলভাবে জ্বালা যায় দেখল। তারপর ওটা সে হাওয়ায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অন্ধকারে হেঁটে বেড়াল। আসলে সে জানে এখন শুলে তার ঘুম আসবে না। সে সারাদিন এই ঘরটাতে বন্দী থাকে। ঘর থেকে বের হওয়া তার বারণ। বিশেষ করে সকালের দিকে। সকালে ডাকঘর খোলা থাকে। লোকজন আসে নৌকায়। কেউ দেখে ফেললে মঞ্জুর পক্ষে বোঝানো মুশকিল হবে। তবে মঞ্জু তাকে প্রথম রাতেই কিছু পরামর্শ দিয়েছিল। যেমন ধরা পড়লে নাম বলতে হবে, নীলমাধব সেন। বাবার নাম, অনিলমাধব সেন। বাড়ি হুগলির কাছাকাছি একটা গ্রাম। গ্রামটার নাম মুর্শেদ নিজেই বলেছে। গ্রামটার সঙ্গে তার ছেলেবেলার কিছু পরিচয় আছে। এ-ভাবে সে নিজের একটা ছদ্মনাম আগেই ঠিক করে রেখেছিল। সম্পর্কে মঞ্জুর কে হয় তাও। কাজেই সে এখন এই ঘরে একা। মিনার এখন হয়তো ঘুমিয়ে কাদা। মার জন্য জেগে থাকার স্বভাব রহমানের। মার কাজটাজ করে শুতে রাত হয়। বাড়িটাতে বাবা মা মারা যাবার পর মর্জিনা একা। বাঙ্গালী মেয়েদের মতো খুব ঘরকুনো। সংসার বাদে সে কিছু জানে না। সবাই শুয়ে পড়লেও সে জানে মর্জিনা ঘুমায় না। ওর চোখে ঘুম নেই। বন্দীদের একটা লিস্ট দেশে পৌঁছে গেছে। সে লিস্টে তার নাম নেই। মর্জিনা জানে যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষটা গেছে, হয়তো একটা পেনসনও সে এতদিনে পেয়ে যেতে পারে। মর্জিনার কথা মনে হলেই সে কেমন ভেতরে ভেতরে ভীষণ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। তার কিছু ভাল লাগে না। আবার সে গালিবের বিখ্যাত গজল থেকে কিছু আবৃত্তি করে সব ভুলে থাকতে চায়।
আসলে এখন সে বোঝে না মানুষ হিসাবে সে কে? সে তো বাংলাভাষা ছেলেবেলায় মায়ের কাছ থেকে শিখে ফেলেছে। বাবা ছিলেন ধর্মভীরু মানুষ, তখন যদিও মনে হয় সে ইচ্ছে করলে তামাম ভারতবর্ষের মানুষ হিসাবে নিজের একটা পরিচয় দিতে পারত, তার বাবা কেন যে দেশ ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। আসলে বাবা এসেছিলেন কলকাতায় —তিনি ছিলেন উত্তর প্রদেশের মানুষ। আখের চাষ ছিল বাবার। তবু বাবা বেশী টাকার খোঁজে কলকাতায় এসে স্ক্র্যাপের ব্যবসা করে বেশ দু পয়সা করেছিলেন। তারপর কলকাতায় দাঙ্গার সময় সে তার বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারত না। বাবা সে সময় খুব ঘাবড়ে গেছিলেন। এবং কেন যে তার মনে হয়েছিল, নিজেদের জন্য একটা আলাদা দেশ না হলে বাঁচবে না। তিনি নিজে উর্দুভাষী মানুষ বলে করাচি জায়গাটা বেশি পছন্দ করে ফেলেছিলেন। সে এখন ঠিক বুঝতে পারে না, কেন এমন হয়! মঞ্জু বলেছে সিন্ধুতে ভীষণ দাঙ্গা লেগেছে। রহমান যে কি করছে এ-সময়! সে কোন্ দেশের মানুষ নিজেও ঠিক করতে পারছে না। এবং এমন মনে হলেই তার পায়চারি বেড়ে যায়। চোখে ঘুম আসে না। সে তখন কি করবে ভেবে পায় না।
সিগারেটটা কখন নিভে গেছে। সে বুঝতে পারছে, অনেকক্ষণ ধরে সে তার বাড়ি, বাড়ির পাশে বড় ইদগাহের আজান, এবং মাজারে যারা মোমবাতি দিতে এসে বসে থাকে তাদের মুখ দেখতে দেখতে কখন যেন দেখে ফেলেছে মর্জিনা বসে আছে। সারা শরীর তার কালো বোরখায় ঢাকা। সে মাজারে মোমবাতি জ্বেলে দিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের কোনও গঞ্জে অথবা মাঠে ওর মানুষটা দেশের জন্য শহিদ হয়েছে। এবং বেইমান মানুষেরা দেশটাকে দু’টুকরো করে কি যে লাভ পেল! এসব ভেবে মর্জিনার চোখ থেকে হয়ত ভীষণ একটা আক্রোশ ফেটে পড়ছে। যেন রহমানকে সে একটা গাছের নিচে ডেকে নিয়ে বলছে, তুমি তোমার আব্বার কথা মনে রেখ। তামাম হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে তোমার হাজার হাজার বছরের জেহাদ ঘোষণা থাকুক, না থাকলে রহমান আমি মরেও শান্তি পাব না।
মর্জিনা হয়তো খুব ভেঙ্গে পড়েছে। সে অন্যদের মতো বোধহয় আর কখনও ভাববে না তার অথবা যদি সে
খসম ফিরে আসতে পারে। সেজন্য সে নিজেকে হয়তো তৈরি করে ফেলেছে রাতে চুপি চুপি চলে যায়, সে গিয়ে বলে, মর্জিনা আমি এসেছি, আমি নিজেকে বন্দী বলে ঘোষণা করতে লজ্জা পেয়েছি, নানাভাবে আমি এসেছি সীমানা পার হয়ে। তখন এমন অবস্থা যে কোম্পানির সৈন্যসংখ্যা কত তার হিসাব দিতে গেলে কমান্ডারের কপালে ঘাম দেখা দিত। কে কোথায় মরে আছে কেউ ঠিক বলতে পারছে না। সে যে ডেজার্টার কে আর সেখানে তা প্রমাণ করবে। কেবল একটা কাজ, কাজটার কথা মনে হলেই ওর বুকটা ভয়ে কাঁপে। কাজটার বিরুদ্ধে সে কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে এখনও পারেনি। তখন তার মাথা গরম হয়ে যায়। সে স্বদেশে আবার অপরাধীর তালিকায় না পড়ে যায়। এখন তার শুধু একটাই ভাবনা একজন মানুষ এসেছে তাকে নিয়ে যেতে। সে যদি বাংলাদেশের সীমানা তাকে পার করে দিতে পারে তবে বাকিটা নসিবের সঙ্গে লড়াই। সে-লড়াইয়ে সে জিতে যেতেও পারে।
এখন আর কি করা। এই জানালায় সে একা একা দাঁড়িয়ে এমনিই ভাবছে। তার প্রতিটি গাছ, লতাপাতা চেনা, আর একটু পরে আমড়া গাছটার নিচে কটা ডাহুক্ ডেকে উঠবে। চারপাশে তার কি কি গাছ আছে সে বলে দিতে পারে। কোন্ গাছে কোন্ পাখি কখন উড়ে আসবে সে বলে দিতে পারে। সব পাখিদের নাম সে এখন বলে দিতে পারে। ঝোপের ভেতর বর্ষার জল রোজ কতটা বাড়ে কমে তার চেয়ে কেউ বেশি জানে না। একটা পাখি অথবা গাছের মতো সে এখানে নিরিবিলি বেঁচে আছে।
ক’দিন হল মশার উপদ্রবটা বেড়েছে। আর চারপাশে ঝোপ জঙ্গল বলে মশাটা একটু বেশি। তবু রক্ষা দু’দিন আসমানে মেঘ নেই, সারাটা দিন কি সুন্দর রোদ। গাছের ফাঁকে রোদ নামলে কেমন জায়গাটা ভীষণ একটা দূরের পৃথিবী মনে হয়। সে চুপচাপ ঝোপ জঙ্গলের ভেতর তখন আউল বাউলের মতো ঘুরে বেড়াতে পারে। মঞ্জু বলেছে, মুর্শেদ তুমি যে বনটায় থাক মানুষ ঢোকে না, সেখানে কেবল হেঁটে যাওয়া যায়, এবং আমাদের বাড়ি বলেই এখানে যে কেউ যখন খুশি ঢুকতে পারে না, সেখানে তুমি বেড়াতে পার।
মুর্শেদ মাঝে মাঝে ভীষণ হা হা করে হাসে। এখন মঞ্জু, তার কমান্ডার-ইন-চিফ। মঞ্জু যা যা বলবে তাই তাকে করতে হবে। যেমন সে রোজ রোজ গোসল করতে চাইত না। সে তার স্বভাবে কিছুটা মরুভূমির মানুষ হয়ে গেছিল। স্নান ছ সাতদিন বাদে করার স্বভাব। কিন্তু মঞ্জু বলেছে—সাহেব তোমার এসব চলবে না। রোজ চান করবে। তোমাকে কেয়া একটা ঘাট দেখিয়ে দেবে সেখানে তুমি চান করলে কেউ দেখতে পাবে না।
মুর্শেদ বলেছিল, আমার কোন অসুবিধা হয় না মঞ্জু।
—তোমার না হলেও আমাদের হয়।
—কেন তোমাদের এমন হয়?
—চান আমরা অসুখ হলে করি না। তুমি সুস্থ সবল মানুষ, চান না করে খাবে সে কি করে হয়!
—গোসল করতে খুব ডর লাগে।
—কোন ভয় নেই। না পার, কেয়া তোমাকে ডুব দেওয়া শিখিয়ে দেবে।
—কেয়া রোজ গোসল করে!
—করে না! তোমার মা তো বাঙ্গালী ছিল, তিনি করতেন না।
—করতেন।
—বাবা!
—আব্বাও করতেন। কিন্তু ওখানে গিয়ে স্বভাব পাল্টে গেছিল। অত পানি পাব কোথায়?
—এখানে তো আর পানির অভাব নেই।
—কিন্তু পুকুরে! ওরে বাপরে! আমি পারব না। পুকুরে গোসল করার অভ্যাস আমার নেই।
—না থাকে, কেয়া আছে।
তারপর কমান্ডার-ইন-চিফ কেয়াকে পাঠিয়ে বলেছিল, মুর্শেদকে পুকুরে নিয়ে যা। চান না করলে গায়ে ভীষণ গন্ধ হয় ঘামের। কাছে যাওয়া যায় না।
কেয়া বলেছিল, ও যদি পুকুরে গোসল করতে গিয়ে ডুবে মরে তবে কিন্তু আমি কিছু জানি না। তুমি ওটাকে পাঠাচ্ছ……. আমার ভয় লাগে।
—তোমার ভয় নেই কেয়া। ঠিক দেখবে আমি ডুব দিতে পারব। কমান্ডার-ইন-চিফের অর্ডার।
তারপর এক ভয়াবহ ব্যাপার। আসলে সে তো কখনও পুকুরে স্নান করেনি।
ওদের বাড়িটা ছিল কিছু ঊষর অঞ্চলে। করাচি থেকে ট্রেনে যেতে হয়। আর এমন সমতল ভূমি সে পাবে কোথায়। এমন নির্মল জলই বা পাবে কোথায়। সে স্নান করতে নেমে সিঁড়িতে বসে ছিল কিছুক্ষণ। জলে তার মুখ দেখা যাচ্ছিল। এত বড় দীঘির মতো পুকুরে সে যেন নামতে ভয় পাচ্ছে। আর কেয়া কি আশ্চর্য তর তর করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে যাচ্ছে। ওর কি সুন্দর পা। ও কি সুন্দর করে শাড়ি পরতে ভালবাসে। চোখে কি যে আশ্চর্য এক লম্বা টান সুর্মার। কেয়া কেমন কালো জলে সাদা ফুলের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। কেয়া ডাকছিল, গোসল না করলে দিদি বলেছে ভাত দেবে না। বসে রয়েছ কেন মিঞা, এস। নামো। ডুব দাও।
—যা পানি। পানির অতল মেলা ভার। আমি আবার ডুবে যাবো নাতো?
—ডুবে গেলে আমি কি করব!
—আমাকে একটু ধর না। বলে সে পা টিপে টিপে নিচে নামছে।
—আমার বয়ে গেছে।
—বয়ে গেছে! আচ্ছা কামান্ডার-ইন-চিফকে যদি না বলছি কথাটা!
—তুমি মিঞা এখনও সেই পাকিস্তানী আছো?
—না থাকলে উপায় কি। যা মানুষের পাল্লায় পড়েছি।
—তুমি মঞ্জুদিকে গাল দিলে!
—তোবা, তোবা! সে আমি পারি! তারপর মুর্শেদ মুচকি হেসেছিল। তারপর বলেছিল, মঞ্জুকে বলব, তুমি মঞ্জু এমন লোক দিয়েছ, যে আমার হাত ধরে পানিতে পর্যন্ত নামায় নি। আমি ডুবে গেলে তোমার ভীষণ একটা কেলেঙ্কারি হবে।
—তোমাকে আমি হাত ধরে নামাবো না বলেছি!
—তবে! কিন্তু কেয়া ওকে হাত ধরে বাচ্চা ছেলের মতো নামাতে গেলে বলল, ঠিক আছে, দ্যাখো না পারি কিনা। সে একা একা বেশ কোমর জলে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু সে যতবার ডুব দিতে যাবে ততবার কেয়া দেখেছে গলা পর্যন্ত ডুবে যায়। মাথাটা কিছুতেই জলের নিচে ডুবে যেতে চায় না। মুর্শেদ নানাভাবে চেষ্টা করছিল। কেয়া পাশে দাঁড়িয়ে ভীষণ রেগে যাচ্ছে। এক দুই তিন, ডুব। বা এটা ডুব হল?
—হল না!
—কৈ মাথা ডুবেছে?
—ডোবেনি!
—তোমার মাথা মিঞা। আমি পারব না, পারব না!
তখন পাড়ে মঞ্জুর গলা, কি হয়েছে রে?
—কি হবে আবার দ্যাখো না এসে কি হয়েছে! কেয়ার কান্না কান্না গলা।
মঞ্জু কাছে গেলে কেয়া বলল, দেখবে কেমন ডুব দিচ্ছে!
কেয়া যেন এখন হাবিলদার মেজর। বলল, আবার এক, দুই, তিন, ডুব! আবার জলের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার কেয়ার, ওটা ডুব হল!
মুর্শেদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল একবার কেয়ার দিকে আবার মঞ্জুর দিকে। মঞ্জু বুঝতে পারল মুর্শেদ পারছে না, ভীষণ ভয় পাচ্ছে জলের নিচে মাথা ডোবাতে। বোধ হয় ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার একটা ভয় ভেতরে আছে। তা ছাড়া এটা যে কত বড় অভ্যাসের ব্যাপার এখন মঞ্জু পাড়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে। অথচ তখন মনেই হয়নি মানুষ কখনও জলের নিচে ডুবে স্নান করতে পারে না।
মঞ্জু বলেছিল, ঠিক আছে, একদিনে হবে না। মুর্শেদ তুমি শরীরটা মুছে সিঁড়িতে বসে মাথাটা ধুয়ে নাও।
কেয়া কেমন হয়ে গেল। পাড়ে উঠে শাড়ি থেকে জল নিঙড়াতে নিঙড়াতে বলল, তুমি এলে বলে। না হলে ওকে দেখাতাম গোসল কাকে বলে।
মুর্শেদ মঞ্জুকে বলল, মঞ্জু, কেয়া ভীষণ ক্ষেপে গেছে। দুটো ভাত সে আজ বেশি খাবে।
—ঠিক আছে মিঞা, তোমায় আর উপদেশ দিতে হবে না। কাল মজা দেখাব।
পরদিন কেয়া ভেবেছিল, মুর্শেদ ডুব না দিতে পারলে জলে দাঁড় করিয়ে রাখবে। কিন্তু যেই না বলা, এক, দুই, তিন, ডুব। বেশ ডুবে গেল। তারপর ভোঁস করে নাক ভাসিয়ে বলল, কি ঠিক আছে বিবিজী!
কেয়া একেবারে স্তম্ভিত। বলল, মিঞা মঞ্জুদিকে বলে দেব সব। তোমার ক্যামফ্লেজ ভেঙ্গে দেব।
—কি বলবে?
—বলব, বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতক মানে?
—বিশ্বাসঘাতক মানে, যাকে বিশ্বাস করা যায় না।
—অঃ। বলেই মুর্শেদ তর-তর করে সিঁড়ি ধরে উঠে গেল। বাংলাদেশে এসে সে যে আগেই এ-সব রপ্ত করে নিয়েছিল, কেয়া অথবা মঞ্জুকে কিছুতেই বুঝতে দেয়নি। সে বলল, গোসল না করিয়ে যখন ছাড়বে না আর কি করা! গোসল করেই ভাত ডাল চানা যা হয় কিছু খাব। তারপর বলল, কি যেন মঞ্জু বলে, পড়েছি যবনের হাতে………
কেয়া বলল, আমরা যবন, না তোমরা যবন!
—সবাই আমরা যবন, সবাই আমরা কাফের, জায়গা মতো সবাই আবার আমরা মানুষ, কি ঠিক না!
কেয়া মানুষটার ভেতর কিছু এলেম আছে এটা বুঝতে পেরে চুপ পরে গেছিল সেদিন।