2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৭২

।। বাহাত্তর।।

অতীশ পশ্চিমের জানালাটা খোলা রেখেছিল। জানালা বন্ধ করে সে ঘুমোতে পারে না। পাখার হাওয়া তেমন একটা দরকার নেই। রাত বাড়ার সঙ্গে কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব উঠে আসছে।

সে চুপচাপ বিছানায় এপাশ ওপাশ করছিল ঘুরে ফিরে মাথার ভেতর শুধু মঞ্জুর কথা, রসো অবনী, টুলু ফুলু এবং আরও যারা এই মাটিতে শৈশব ফেলে গেছে তাদের কথা। সে ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজনায় ভুগছে। সে যত সহজে ভেবেছিল ঘুমোবে, ঠিক তত সহজে ঘুমোতে পারল না। বার বার মঞ্জুর মুখ উঁকি দিচ্ছে। মঞ্জুকে এখন ভীষণ মহিমময়ী দেখায়। ওর ভারি চশমার ভেতর ওকে যেন ঠিক চেনা যায় না। সে যতটা না গম্ভীর তার চেয়ে চোখের ভারি চশমাটা তাকে আরও বেশি গম্ভীর করে রাখে। মঞ্জু তখন, ছোট মঞ্জু, মঞ্জু মাঠের ভেতর ঘোড়া নিয়ে ছুটছে। এ ছবিটাই মঞ্জুর সবচেয়ে মনে রাখার মতো। আর একটা ছবি সে মনে করতে পারে, মঞ্জুর মায়ের মৃত্যুর দিনে ওঁর পায়ের কাছে বসে থাকা।

দাদা মা বাবা, গাঁয়ের সবাই দূরে দাঁড়িয়েছিল। জলে ডুবে মরেছিল মঞ্জুর মা। ওঁর কি যে দুঃখ ছিল! কেন যে জলে ডুবে মরে গেল মঞ্জুর মা এখনও সে রহস্যটা আবিষ্কার করতে পারেনি। মঞ্জুর চোখ দিয়ে জল পড়ছিল না। সে সাদা পাথরের প্রতিমা যেন। চারপাশে সবাই ভিড় করেছে। এমন একটা অপমৃত্যুর খবর থানায় সেদিন কেউ পৌঁছে দিতেও সাহস পায়নি। সেনবাবু নির্বিঘ্নে, খালপাড়ে মঞ্জুর মাকে দাহ করেছিলেন।

এবং কতদিন যে এই ব্যাপারটা গ্রামের ভেতর একটা ভুতুড়ে ব্যাপার হয়ে ছিল! কতদিন যে সে এবং বড়দা মেজদারা এমন একটা ভুতুড়ে ব্যাপারে পড়ে গিয়ে রাতে-বিরাতে কিছুতেই ঘর থেকে বের হত না। তাদের কষ্ট ছিল মঞ্জুর জন্য। মঞ্জুর মা মরে যাবার পর তাদের মায়া কেমন মেয়েটার ওপর আরও বেড়ে গেল। ওরা মঞ্জুকে আর কিছুতেই অকারণে আঘাত করতে সাহস পেত না।

অথচ অবনীকে কিছুতেই বাগে আনা যেত না। সে ক’দিন বেশ চুপচাপ ছিল এ-ব্যাপারে, সেও যেন সাংঘাতিক শোকসন্তাপে পড়ে গেছে এমন ভাব-–তারপর মঞ্জু শহরে চলে যেতেই সব ভুলে অবনী আবার আগের অবনী হয়ে গেছিল। সে বলেছিল, কবিরাজ মানুষটা আসলে ভাল নয়।

—কে বলেছে ভাল নয়!

—আমি বলছি। না হলে মঞ্জুর মায়ের মতো মানুষ আত্মহত্যা করে!

কোথায় যে গন্ডগোলটা ছিল –সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। আর তখনই মনে হল, জানালার ওপাশে কে যেন হ্যারিকেন হাতে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। সে লাফ দিয়ে উঠে বসল।

মশারির ভেতর থেকেই সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে একজন লম্বা মতো মানুষ হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। হাতে হ্যারিকেন। এত রাতে এমন বর্ষার বনজঙ্গলের ভেতরে কোনো পথ থাকতে পারে সে যেন কিছুতেই ভাবতে পারে না। বর্ষাকাল বলে চারপাশে সবুজের সমারোহ। আগাছা বনঝোপ চারপাশে ভীষণভাবে পথঘাট ঢেকে দিয়েছে। তার ভিতর মানুষটা হারিয়ে যেতেই ওর কেমন কৌতূহল হল। বাথরুমের ও-পাশের দরজাটা খুলে সে দেখতে পেল, বন-জঙ্গলের ভেতর সেই পুরানো বেহারাদের থাকবার কোঠাবাড়িটা। সেখানে মানুষটা উঠে গেল। দরজায় কে দাঁড়িয়ে!

কেয়া! এত রাতে ওখানে! কেয়া মানুষটার সঙ্গে কথাবার্তা পর্যন্ত বলছে। কেয়া ওখানটায় কি করছে! মঞ্জু এখন কি করছে! তারপরই মঞ্জুর গলা কিরে এত দেরি করছিস কেন? খাবি দাবি না?

তবে মঞ্জুও জানে ব্যাপারটা! সে কি কেয়ার কেউ হয়! ওর কেমন মঞ্জু সম্পর্কে আরও রহস্য বেড়ে গেল। এবং এভাবে একটা জায়গায় চলে আসা, সে ঠিক ঠিক এসেছে কিনা, না এমন একটা গাঁয়ে সে হাজির হয়েছে, যেখানে কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। সবাই মরে গিয়ে ভূতটুত হয়ে গেছে। সে একটা ভুতোড়ে বাড়িতে হাজির। তার তো বিশ্বাসই হয় না মঞ্জু এমন একটা নির্জন গাঁয়ে একা পড়ে থাকতে পারে! তারপরই নীলুর মুখ এবং জব্বার চাচার সেই গোলমেলে ব্যাপারটা মনে হলে তার ভেতরে সাহস ফিরে আসে।

তবু কেন যে ভীষণ সংশয় অতীশের মনে। মঞ্জুকে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তার হাতে যদিও ছুটি অনেকদিন তবু কালই মঞ্জুর চিঠির কথা সে খোলাখুলি জানতে চাইবে। এ-ভাবে এখানে সে বেশিদিন থাকতে পারবে না। তার কারখানার অবস্থা ভাল না। সে কেমন হাঁপিয়ে উঠছে। মঞ্জুকে সে আগের মতো করে চিনতে পারছে না।

কেয়া হ্যারিকেনটা নিয়ে ফিরছে। ফেরার সময় সে গুনগুন করে একটা গান গাইছিল। মনে হল সুরটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের। সব ঠিক কানে আসছে না। হ্যারিকেনের আলোটা কেয়া এদিকে এসেই নিভিয়ে দিল।

আড়াল থেকে অতীশ দেখতে পেল এখন কেয়া আর মঞ্জু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি বলতে বলতে হাসছে। মঞ্জুর চেয়ে কেয়া জোরে হাসতে পারে। ওর হাসি কানে এলে অতীশ ফের ঘরে ঢুকে গেল। ও বুঝতে পারল, কিছুতেই রাতে তার ঘুম আসবে না। কলকাতায় এখনও বাস-ট্রাম চলছে। সে রাতে ঘুম থেকে উঠলেও যেন টের পায় লাস্ট ট্রাম ধর্মতলায় যাচ্ছে। তবু তার কি ঘুম! ঘুমে সে চোখ মেলতে পারে না।

আর এখানে কোনও শব্দ নেই, কেবল নির্জনতা, নীলুর অসুখ, জব্বার চাচা ডিসপেনসারির দরজা- জানালা বন্ধ করছে, এবং মনে হচ্ছে মঞ্জুও সব জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। মঞ্জুর ঘর, ওর সাদা চাদর এবং মঞ্জুর শোওয়ার ভঙ্গী সে এখন অনুমান করতে পারছে। যত মনে হচ্ছে তত মাথায় আশ্চর্য একটা জ্বালা। তার ঘুম আসছে না। নিরিবিলি সত্বেও সে কিছুতেই ঘুমোতে পারছে না।

আর তখন, মনে হচ্ছে রাত বেশ অনেক, কেউ ওর দরজায় খুট খুট করে কড়া নাড়ছে। অতীশের মনে হল এ-ভাবে কেন! কে আসছে! সে ঠিক অনুমান করতে পারছে না, কেয়া না মঞ্জু। সে এখন কি করবে বুঝতে পারছে না।

তবু উঠতে হয়। ওপাশের দরজায় কেয়া অথবা মঞ্জু বাদে কেউ এখন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কেয়াকে আসতে হলে মঞ্জুর ঘর পার হয়ে আসতে হবে। সে এতটা সাহস কিছুতেই পাবে না। তাছাড়া মঞ্জুর অন্য সময় হল না! সে মঞ্জুকে যতভাবেই ভেবে থাকুক, এভাবে তার কাছে মঞ্জু এলে মঞ্জু কেমন ছোট হয়ে যাবে। সে চায় না মঞ্জু এভাবে তার কাছে আসুক।

এ-ভাবে কতক্ষণ পার হয়ে গেছে জানে না। আসলে সে দরজা খুলতে ভয় পাচ্ছে। ভয় একটা লম্বা হাত যদি মশারির ভিতর ঢুকে যায়! তারপর কঙ্কালের কোনও হাত। কেন যে এমন মনে হয় মঞ্জু কেন যে চোখের ওপর একটা কঙ্কালের মতো ছবি হয়ে যাচ্ছে। দরজার খট খট শব্দটা ফের থেমে গেল। আর কোনও শব্দ হচ্ছে না। এবং সেই খট খট শব্দটা থেমে গেলে ওর মনে হল, না, ঠিক এ-ভাবে শুয়ে থাকা উচিত না। দেখা দরকার ও-পাশে কে দাঁড়িয়ে আছে! কে হেঁটে বেড়াচ্ছে! তবু উঠতে গিয়ে ভয়। যদি মঞ্জু না হয়, যদি কেয়া না হয়। যদি মঞ্জুর মা দাঁড়িয়ে থাকে। এতদিন পর সে ফিরে এসেছে জেনে যদি মঞ্জুর মার মায়া হয়—তুই এসেছিস? কত বড় হয়ে গেছিসরে! তোকে কতদিন দেখি না! যেমন সে তাদের বাড়িতে বন-জঙ্গলের ভিতর থেকে ঠাকুমার জেঠিমার কথা শুনতে পেয়েছিল, তেমনি যদি মঞ্জুর মা দরজার ও-পাশে এখন দাঁড়িয়ে তাকে ডাকে!

তার কপালে ঘাম দেখা দিল। বেশ ঘেমে যাচ্ছে। সে ঢোক গিলল ক’বার। গলা ভীষণ শুকনো মনে হচ্ছে। পারে সে মোটেই শক্তি পাচ্ছে না। কোথাও আর কোন শব্দ নেই। ও-পাশের জানালাটা খোলা। সে জানালার সামনে যেতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে। বন-জঙ্গলের ভেতরে কোনো একটা পাখীর ডাক অনবরত ভেসে এলে যা হয়, নির্জনতা আরও বেড়ে যায়—একটা কট্ কট্ শব্দ, যেন ঝিঝি পোকা কাঠ কাটছে অনবরত, আর কোনও শব্দ নেই—না, আছে অনেকদূরে শেয়ালেরা হেঁকে যাচ্ছে, কুকুরেরা ডাকছে। তবু সে দরজার কাছে এসে সহসা দরজাটা খুলে দিলে, মনে হল শুধু আবছা অন্ধকার চারপাশে। ঘরটা ফাঁকা, বসবার ঘর। কিছু সোফা সেট আর দেয়ালে নানা বর্ণের ছবি। সে অস্বস্তি বোধ করছে, কারণ সে স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ঘর ফাঁকা। কেউ নেই। গেল কোথায় সব। দরজার ঠক ঠক শব্দ করে কে পালাল কোথায়!

এতসব ভাববার ওর সময় ছিল না। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে গেলেই মঞ্জুর ঘর। ঘরে আলো জ্বলছে না। মঞ্জু কি ঘুমোচ্ছে! নাকি অন্ধকার থেকে মঞ্জু বলে উঠবে, এই যে আমি এখানে। তুমি এস।

মঞ্জুর শৈশবে ছিল এমন স্বভাব। সে লুকোচুরি খেলার সময় কিভাবে যে ঝোপের ভেতর নিজেকে অদৃশ্য করে রাখত। কেউ যখন খুঁজে বের করতে পারত না, সবাই যখন কাছারি বাড়ির মাঠে, অথবা নরেন দাসের তামাকের জমিতে কিংবা চন্দন গোটার জঙ্গলে খুঁজে বেড়াতো মঞ্জুকে, তখন সে ঝোপের ভেতর থেকে তার পায়ে চিমটি কাটত।—আমি এখানে। বলে সে হাত টেনে ঝোপের ভেতর বসিয়ে দিত অতীশকে।

এ-ভাবে এত রাতেও মনে হচ্ছে অতীশ তেমনি মঞ্জুর কথা শুনতে পাবে। সেই আশায় যেন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকল! চারপাশের দেওয়ালগুলো মাঝে মাঝে হিন্দি ছবির মতো ওর কাছে এগিয়ে আসছে আর পিছিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালের ছবিগুলো ছোট হয়ে যাচ্ছে, বড় হয়ে যাচ্ছে। মৃত হরিণের মুখেরা সজীব হয়ে পরস্পর ডেকে বেড়াচ্ছে। সে ভাবল, ভালোরে ভালো, এতো আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল। কেমন তাড়াতাড়ি ঘর থেকে পালাবার জন্য ছুটে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে সে ধাক্কা খেল। সে পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াল। এবং ভয়ে দরজা জানালা বন্ধ করবে ভাবতেই মনে হল ও-পাশের ঘরটায় কেউ দরজা খুলছে। আলো এসে পড়ছে অন্ধকার ঘরটায়। আলোর ভেতর মঞ্জু প্রায় একটা আবির্ভাবের মতো সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে। অতীশ সেদিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।

মঞ্জু কাছে এসে বসল, কিসের শব্দ হল বলতো?

—চৌকাঠে ধাক্কা খেয়েছিলাম।

—তুমি কি করছিলে? ঘুমাওনি?

—ঘুম আসছে না মঞ্জু। বড় ফাঁকা মনে হচ্ছে সব।

—কি হয়েছে বলতো? মঞ্জু পাশে বসল। হঠাৎ কিসের যেন শব্দ হল, আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।

—চৌকাঠে তুমি ধাক্কা কি করে খেলে?

—ও ঘর থেকে আসতে গিয়ে! তারপর লজ্জায় সে কি বলতে গিয়ে বলতে পারল না।

—ও ঘরে কি করতে গেছিলে?

—আমার মনে হল কেউ দরজায় কড়া নাড়ছিল!

—যা, কে নাড়বে!

—আমি সত্যি বলছি মঞ্জু কেউ নেড়েছে।

তারপর মঞ্জু কি ভাবল। সে বলল, এখানে এস। এটা কি!

—বুঝতে পারছি না।

—দেখছ না পাল্লাটা একটু লুজ আছে। একটু হাওয়া দিলেই নড়ে। অতীশ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, হবে হয়তো

মঞ্জুর মুখ দেখে মনে হয় না সে ঘুমিয়েছিল। বোধ হয় মঞ্জু শোবার আগে পাটভাঙ্গা শাড়ি পরতে ভালবাসে। কালোপাড়। শাড়ির সাদা জমিন। সাদা জমিনে কখনও কখনও কাজ করা থাকে। সে বেশ একপাশ হয়ে শোয়। আর নড়ে না। সেজন্য ওর শাড়ির পাট ভাঙ্গে না। অতীশ মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এমনই ভাবছিল।

মঞ্জু বলল, শুয়ে পড়। বলে উঠতে যাবে, এমন সময় কেন যে ভেতরে কি হয়ে যায়, ওর উঠতে ইচ্ছে করে না। আজ ন’ মাসের ওপর সে একা। এভাবে একা থাকতে থাকতে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এবং অতীশকে দেখলে ওর এই হাঁপিয়ে ওঠা কমে যেতে পারে —ওকে কি অজুহাতে যে এখানে নিয়ে আসা যায়! সেই শৈশবের সোনা, যে ছিল ভীষণ লাজুক, তার চোখ ছিল টানা, সে লম্বা ছিল অথচ শরীর যার সবল ছিল না তেমন, সে এখন দেখতে কেমন হয়েছে এই ভেবে একটা চিঠি, অবশ্য আরও কাজ আছে তার জন্য, সেটা এখন বলা যাচ্ছে না। দুদিন না গেলে বলতে পারবে না, একজন আর্মি ডেজার্টার এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।

মঞ্জু বলল, দরজাটা বাইরে থেকে ভাল করে টেনে দিয়ে যাচ্ছি। আর ঠক ঠ; করে নড়বে না। অতীশ বলল, ঠক ঠক করে কিছু নড়লে আমার ঘুম আসে না। তারপরই যেন ওর বলার ইচ্ছে, মঞ্জু আর একজন মানুষ এ-বাড়িতে আছেন, সে কে? তার সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। তাকে দেখলাম তোমাদের সেই পুকুরের ধারে আলগা ঘরটাতে ঢুকে যেতে। সেখানে তো কিছু বেহারা খাত। সেখানে সে কি করে! কেয়া সেখানে কি করছিল?

মঞ্জু বলল, তুমি এত ঘামছ কেন? বলে সে উঠে পাখা ফুল স্পিডে চালিয়ে দিল।

—ঠিক বুঝতে পারছি না।

মঞ্জু ও-পাশের চেয়ারে বসল। দু’জন মুখোমুখি। সামনে বাতিদান। এখন যেন নিরিবিলি ওরা অনেক কথা বলতে পারে। অতীশ বুঝতে পারছে মঞ্জুর ওঠার ইচ্ছে নেই। এতদিন পর দেখা। অথচ ওর শরীরের সেই মনোরম গন্ধটা এখনও ঠিক তেমনি আছে। মঞ্জুকে অতীশ ঠিক ভালভাবে দেখতে ভয় পাচ্ছে। সে কেমন অন্যদিকে কি দেখছে এমন মুখ করে বলল, অঞ্জু পিসিরা কোথায় আছে?

—জামাইবাবু নাগপুরে আছেন। অঞ্জুদির একটাই ছেলে। ছেলেটা দেরাদুন মিলিটারি কলেজে পড়ছে।

আর কি বলবে অতীশ বুঝতে পারছে না। সব জানেও না। মঞ্জুই এখন কথা বলছে। সে শ্রোতা মাত্ৰ।

—তবে যা হয়ে থাকে। ওরা এল। ওকে ডাকল। মাঠে নিয়ে গেল। তারপর …..। মঞ্জু চোখ নিচু করে দিল। ওর মুখ ভারী থমথম করছে। এত রাতে এ-সব কথা না তোলাই ভাল ছিল। তবু যেন এই সময়, দু’জনে কিছু কথা বলা, কিছু না বলে তো চুপচাপ বসে থাকা যায় না, আসলে এতদিন পর যেন এমন একটা অবসরের জন্য দুজনেই অপেক্ষা করছিল—কত কথা ওদের জমা হয়ে আছে, অথচ বলতে পারছে না। মঞ্জুর বিয়ে হয়েছে, ছেলে হয়েছে, অতীশের জীবনটা নানাভাবে ব্যর্থতায় ভরা। আর সে জানে এ-জন্য সে নিজেই দায়ী। অবশ্য বনি কিংবা আর্চি তাকে ইদানিং আর তাড়া করে না। ফতিমার কাছে সব অকপটে স্বীকার করার পরই সে নিরাময় হয়ে গেছে।

অতীশ বলল, তোমরা চলে গেলে না কেন?

—কোথায় যাব?

—কেন যেখানে সবাই গেছে।

মঞ্জু হাসল। সেই এক ম্রিয়মাণ হাসি। কঠিন বিষাদে ভরা। তুমি তো দেখলে আমার ছেলেটা এ-ভাবে জন্মের পর থেকে শুয়ে আছে। এ-ভাবে বিছানাতেই বড় হয়েছে। ওকে ফেলে আমরা কোথায় যাব বল!

মঞ্জু বলল, বাবাকে তো তুমি জানতে। এত বড় একটা অঞ্চলে কত প্রতাপ নিয়ে বেঁচেছিলেন, এমন ভাবে মানুষের সঙ্গে দেশের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন যে আর কোথাও গিয়ে নতুন ভাবে বাঁচতে সাহস পাননি।

—কেন নীলুর বাবাকে নিয়ে তুমি চলে যেতে পারতে?

—সে মানুষটাকে তো তুমি জানতে, কতটা সে একগুঁয়ে ছিলো তাও তুমি জানতে—সে কি ভেবেছিল কে জানে, সে বলত, না বেশ কবিরাজিটা যখন শিখে ফেলেছি আর যখন রুগীপত্রও হচ্ছে তখন আর নতুন দায় নিয়ে কাজ নেই, বেশ আছি। দেশ ছেড়ে কোথাও পালাব না।

—সে কে মঞ্জু? অতীশ কেমন স্মার্ট গলায় কথাটা বলে ফেলল।

—তোমাদের অবনী।

—আমাদের অবনী! যেন সে অবনীকে চেনে না জানে না। অবনী তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। মঞ্জু আর কোনও কথা বলল না। মাথা নিচু করে বসে থাকল।

এ-ভাবে কি যে হয়ে যায়। কেন যে মঞ্জুর এমন বলার পর কপাল ঘামে! মঞ্জুকে দেখে মনেই হয় না, সে এমন একটা শোক সামলে উঠতে পারে। অথবা অবনী তার যৌবনে কেমন দেখতে ছিল, তার কথা বলত কিনা মঞ্জুকে, তাকে যে একবার মঞ্জু বসিয়ে কি সব শিখিয়েছিল এবং সে-সব কথা সেতো অবনীকে বলে দিয়ে বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়েছিল—আর অবনী এমন জেনেও মঞ্জুকে বিয়ে করেছিল কি করে—না অবনী বুঝতে পেরেছিল, শৈশবে বালক বালিকাদের নানারকম কৌতূহল থাকে, মঞ্জু তাকে নিয়ে সামান্য কৌতূহল মিটিয়েছিল —ওতে আর দোষের কি! অথবা যদি অবনী বলে দিয়ে থাকে, মঞ্জু তুমি ভীষণ পাকা ছিলে ছোট বয়সে। তুমি যা জানতে ছোট বয়সে আমরা তা জানতাম না। তুমি সোনাকে কি সব করেছ! সোনা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল। তুমি সোনাকে এসব করতে গিয়ে কি সব বুঝিয়েছ, যে সোনা একদম উঠতে পারেনি।

এবং এসব মনে হলেই অতীশ কেমন সংকোচের ভেতর পড়ে যায়। কি দরকার ছিল এসব বলার অবনীকে। অবনীকে না বললে কি ক্ষতি হত। সে কেন যে বলতে গেল! আসলে, মঞ্জু ওকে কত ভালবাসে, এবং মঞ্জুর কাছাকাছি থাকার মতো মানুষ যে সেই –সেদিন যেন এটা গর্ব করে বলার মতো একটা ব্যাপার ছিল তার। সে বলল, অবনী তোমাকে ছেলেবেলাতেই ভীষণ ভালবাসত।

সেই ছেলেবয়সে মঞ্জু কি জবাব দিত এমন কথায় অতীশ যেন এখনও তা বলে দিতে পারে। কিন্তু এ বয়সে মঞ্জু কি দেবে সে জানে না। জানে না বলেই যেন সে জানতে চায়, অবনী ওর কতদূর কাছের মানুষ ছিল! অবনীকে সে শেষ পর্যন্ত সত্যি ভালবাসতে পেরেছিল কিনা! না অবনী সেই জোরজার করে, কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে মঞ্জুকে নিজের করে নিয়েছিল।

তারপর অতীশের মনে হয় সে সত্যি এখনও সেই শৈশবেই থাকতে চাইছে। সে সেই বয়স থেকে উঠে আসতে চাইছে না। অবনী মঞ্জুকে বিয়ে করেছে ভাবতেই কেন এত সব সংশয় এসে দেখা দিচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। আসলে সেও একটা সেই মানুষ যার ভেতরে আছে কঠিন, অমানুষের ছবি। আর্চিকে খুন, বনির নিখোঁজ থেকে নির্মলার প্রতি সংশয় সব এক ঘোর থেকে। সেটা উঁকি দিলেই সংশয়। এবং বিশ্বাস হয় না মঞ্জু অবনীকে কোনও দিন সত্যি ভালবাসতে পারবে। অতীশ এবার নিজের মনেই হেসে দিল। বলল, অবনীর কথা মনে হতেই শৈশবের কত আজেবাজে কথা মনে আসছে মঞ্জু।

মঞ্জু বলল, তুমি এবারে শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে। কোন ভয় নেই। দরজায় শব্দ হলেও কিছু ভাববে না। বলে সে আর বসল না, উঠে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করে দেবার সময় জোরে জোরে বলল, অতীশ অবনী আমাকে একদম ভালবাসত না, সে আমাকে ভীষণ সন্দেহ করত। অতীশ আর কি ভাববে। সেই লোকটার কথা আর কিছুই জানা হল না।

শেষদিকে বনিও তার ঘোর সংশয়ে পড়ে গেছিল। আর্চির প্রেতাত্মা বনিকে তার প্রতিপক্ষ করে তুলেছিল। অ্যালবাট্রস পাখিটাও। ফতিমাকে সব বলেছে। সব। ফতিমা চুপচাপ শুনত। কথা বলত না। তার যন্ত্রণা টের পেয়ে বলেছিল, আপনি ভাল হয়ে যান সোনাবাবু। আপনি ভাল হয়ে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *