2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৬৮

।। আটষট্টি ॥

মানুষেরা এ ভাবে এ পৃথিবীতে এক আশ্চর্য খেলার ভেতর বড় হয়ে যায়। যেন সুদূরে তার দেখা, অদূরে সে এখনও আছে, কিছুতেই জীবন থেকে সে শেষ হয়ে যায় না।

মঞ্জুর সাড়া শব্দ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। কোনদিকে মঞ্জু থাকতে পারে। এ বাড়িটাতে কটা ঘর আছে, মঞ্জুর চেয়ে সে কম ভাল জানে না। সে তো ছেলেবেলা এ বাড়ির সব ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখত। দেয়ালে কি সাদা রঙ! একটা দাগ পড়ত না। এখনও নেই। যেন এখানে কখনও ছবি পুরানো হয় না। তেমনি, সাদা এনামেল কালারের ভাস। নানা বর্ণের ফুল।

অতীশ এ বাড়ির সব কিছুর ভেতর সেই ছেলেবেলা থেকে দুর্লভ কিছু আবিষ্কার করে বেড়াত। শৈশবে সে ভাবত, এ বাড়ির মানুষেরা কোথায় যেন অন্য সব মানুষের চেয়ে আলাদা। সব মিলে এদের সব কিছুর ভেতর ছিল আশ্চর্য সৌরভ। সেই সকালে কবিরাজ দাদা ঘোড়ায় চড়ে রুগীবাড়ি বের হতেন। খুব সকালে সে পুকুরপাড়ে দাঁড়ালে দেখতে পেত, মঞ্জু বাগানে ফুল তুলছে। তারপর সূর্য মাঠের ঘাসে হলুদ রঙ ছড়িয়ে দিত। বাড়ির ভেতর থেকে বড় ডিসে নানারকম প্লেটে চা-বিস্কুট, মঞ্জু ওদের লনে বসে চা খেত। এতটুকু মেয়ে সকালে চা খায় ভাবতে সে ভীষণ অবাক হত।

ঘোড়াটা তখন অর্জুন গাছের নীচে, লাল রঙের ঘোড়া। অলিমদ্দি ঘোড়াটার শরীরে জোরে জোরে বুরুশ মারছে। সামনে কাঠের একটা বড় গামলা। চানা আর ঘাস। ঘাস আলাদা। ঘাস শেষ হলেই ঘোড়াটা চানা খেত।

ঘোড়াটার একটা নাম ছিল।

সোনা ডাকত, লাল বলে।

মঞ্জুও ডাকত, লাল।

আসলে ঘোড়াটার নাম ছিল যমুনা। কবিরাজ দাদা ঘোড়ার খোঁজখবর নিতে হলে বলতেন, যমুনাকে চান করিয়েছিস অলি।

যমুনার জন্য মঞ্জুর বাবা ভীষণ উদবিগ্ন থাকত যেন সব সময়।

যমুনা ছিল গোনাদের খেলার সঙ্গী। কবিরাজ দাদা ঢাকা গেলে, ওরা অলিকে মাছ ধরতে পাঠিয়ে দিত। অলির ছিল ভীষণ মাছ ধরার নেশা। অলি মাছ ধরতে গেলে, মঞ্জু সোনাকে ঘোড়ায় চড়া শেখাতো।

এভাবে মানুষের ঘোড়ায় চড়ার ইচ্ছে কি ভাবে যে জন্মে যায়। সে যে কি করে জেনে ফেলে চারপাশে যা কিছু আছে সবই সে মাড়িয়ে যাবে। সব তার জন্য। সে দুহাতে এমন সৌন্দর্য লুটেপুটে না খেতে পারলে কেমন নিজেকে ভীষণ দুঃখী ভেবে থাকে। সোনার মনে হত তখন সে আর মঞ্জু’ পাশাপাশি অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটে যাবে। সবুজ উপত্যকায় ঘুরে বেড়াবে। অথবা কোনও নদীর পাড়ে হেঁটে গেলে সোনার মনে হবে, মঞ্জু ভারি সুন্দর। ফতিমা দূরে দাঁড়িয়ে দেখত। মুখ ভ্যাংচে চলে যেত। আবু শোভাও সঙ্গে।

সকালবেলা মঞ্জু নীল স্ট্র্যাপের খড়ম পায়ে দিত। মঞ্জু বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলে টের পাওয়া যেত মঞ্জু হেঁটে যাচ্ছে। খুব সকালে তার কাজ ছিল ফুল তোলা, শহর থেকে এলেই ওর ঠাকুমা ওকে ফুল তুলতে বলত।

আসলে মঞ্জুরও খুব ভাল লাগত ফুল তুলতে। খুব সকাল সকাল মঞ্জুরও ঘুম ভেঙে যেত। ওর মনে হত, হয়ত এতক্ষণে ওরা সব ফুল চুরি করে নিয়ে গেছে। ওরা বলতে আবু, শোভা আর রসো। সোনা কখনও ফুল চুরি করে নেবে সে ভাবতে পারত না।

সে ছিল মুখচোরা স্বভাবের মানুষ। তাদের বাড়িতেও ছিল নানারকম ফুলের গাছ। কত রকমের জবা। কিন্তু একটা ফুল ওদের ছিল না। রক্ত জবার গাছ তাদের বাড়িতে বাঁচত না। ঠাকুরঘরের পেছনে সব জবা ফুলের গাছ। সেখানে ছোট কাকা নানাভাবে একটা রক্তজবা গাছের ডাল পুঁতে দেখেছে গাছ বাঁচে না। অথচ কাকা রক্তজবা না হলে বিগ্রহের পূজায় সব ঠিকঠাক থাকছে না এমন ভাবতো।

মঞ্জু জানত, সোনা আসবে। সোনা আসবে কটা রক্ত জবার জন্য। সে এসেই চুপচাপ ঠাকুমার ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে।

ঠাকুমার গলা—কেরে? সোনা!

—আমি সোনা।

—মঞ্জু, ওকে কটা ফুল দিয়ে দিস। কারণ সোনা জানত, মঞ্জু এলে একটাও রক্ত জবা গাছে রাখবে না। মঞ্জুর এটা স্বভাব, সে সাজি থেকে ফুল তুলে দিতে ভালবাসে। সোনা নিচে ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে। মঞ্জু বারান্দার সিঁড়িতে। এবং বেছে বেছে সব বড় বড় ফুল সোনার সাজিতে তুলে দেবার সময় মঞ্জু বলত, তুমি ঢাকা গেলে না! লক্ষ্মীবাজারে মতি সাহার আইসক্রিম খেলে না; আইসক্রিম না খেলে কেউ কখনও বড় হয় না। ঠিক ফতিমাও তাই বলত।

সোনা ভাবত, সত্যি বড় হয় না! সে বলত, কি করব বল, বাবাতো আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না। একটু থেমে বলত, তুমি আমার জন্য একটা নিয়ে আসবে!

—তুমি কি বোকা!

সে ভাবত, সে সত্যি বোকা। আইসক্রিম না খেলে হয়ত মানুষ বোকাই থাকে। কারণ সে তো জানে না আইসক্রিম খেতে কেমন, সে তো জানে না, ওটা দেখতে কেমন! এই যে মাঠ, মাঠ পার হলে গোপেরবাগ, তারপর গ্রাম মাঠ পার হলে ওর স্কুল, সে জানে না তার পর কি আছে।

সোনা তখন চুপ করে থাকত!

মঞ্জু বলত, কি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে!

সোনার মুখে তবু কোনও কথা যোগাতো না। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলত, যাই। অনেক পড়া বাকি।

তারপর ফুল নিয়ে সে সোজা চলে আসত। ঠাকুরঘরে ফুল রেখে সে দক্ষিণের ঘরে শশী মাস্টারের কাছে পড়তে বসত। মেজদা বড়দা খোঁটা দিত, এতক্ষণে আইলেন। খুব জোরে জোরে পড়ার স্বভাব ছিল তার। মঞ্জু এলে যেন সে আরও গলা ছেড়ে পড়ত। সে এই একটা জায়গাতে মঞ্জুর চেয়ে বড়। সে ওর চেয়ে দু’ক্লাশ ওপরে পড়ে। পড়তে বসলেই যেন সে মনে করতে পারে আইসক্রিম বরফের হয়। বরফ গলে যায়। সে খুব বোকার মতো মঞ্জুর সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে।

এমন মনে হলেই সে দু তিন দিন আগ্রুদের বাড়িতে যেত না। মঞ্জুকে সে এড়িয়ে চলত। অথচ মঞ্জু কি করে যে টের পেয়ে যায়। মাকে সে এসে বলত, দিদিমা সোনা কোথায়।

সোনা তখন হয়ত বড় কামরাঙ্গা গাছের ডাল কেটে দিচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে—মঞ্জু উঠোনে দাঁড়িয়ে, পায়ে আলতা, মঞ্জু আলতা পরতে ভালবাসে। মঞ্জু সুন্দর জুতো পায়ে দিয়েছে।

সোনাদের ছোট্ট গ্রামটাতে মেয়েরা জুতো পরত না। দালান বাড়ির মেয়েরাও জুতো পরত না। কেবল মঞ্জুর দিদি পরত। সে শহরেই বড় হয়েছে বলে গ্রামে একটা বড় বেশি আসত না। মেয়েরা জুতো পরলে সেই বয়সে রহস্যটা আরো বেড়ে যায়। আর তারা ছিল, কবে কখন মঞ্জু হাত তুলে ডাকবে। একটু কথা বলবে। মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলার জন্য ওরা ছলছুতোয় মঞ্জুদের বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াত। জুতো মোজা পরলে মঞ্জুকে গাঁয়ের পথে বনদেবী-টেবি মন হত। মঞ্জুর জন্য ওর আর অবনীর একটা নেশা ছিল। বড়দা মেজদারও।

মঞ্জুদের বাড়িতে ছিল একটা বুড়ো মতো মানুষ। সে কেবল হাম্বল দিস্তায় সারাদিন সব লতাপাতা, শুকনো হরতকি, জায়ফল গুঁড়ো করত। কেমন একটা ঢং ঢং করে শব্দ হত হাম্বল দিস্তার। দূরে, যতদূরেই যাক, হাম্বল দিস্তার শব্দ তাদের কানে এসে বাজত।

সকাল থেকেই সব মানুষজনেরা আসত। মঞ্জুর বাবার নাম অবিনাশ কবিরাজ। রমণী কবিরাজের জামাই অবিনাশ কবিরাজ। বড় আটচালা ঘর, ওপরে টিনের চাল, বড় জানালা কাচের, ভিতরে অনেক সব উঁচু আলমারি, অজস্র শিশি বোতল এবং সব হলুদ নীল সোনালি বড়ি। কত সব নাম। সে আলমারির পাশে দাঁড়িয়ে আগে সব নাম মুখস্থ করত। এখন তার একটা নামও মনে নেই। দরজার সামনে লাইন লেগে যেত। অবিনাশ কবিরাজ ওদের জিভ দেখে, পেট টিপে বিনা পয়সায় ওষুধ দিতেন।

রুগী বাড়ি যাবার সময় অবিনাশ সেন মাথায় শোলার হ্যাট পরতেন। কাপড়ের নীচে ফুল-শার্ট গুঁজে দিতেন। পায়ে পরতেন পামসু। চোখে চশমা। এবং দু’পাশে দুটো টিনের বাক্‌সে লাল নীল হলুদ রঙের বড়ি নিয়ে দু’তিন দিনের জন্য কখনও কখনও কোথায় চলে যেতেন। মাঠে ওঁর ঘোড়া ছুটলে বলত, ঐ যায় অবিনাশ কবিরাজ, বড় কবিরাজ। ধন্বন্তরি। মঞ্জু সেই সুন্দর সুপুরুষ মানুষটির মেয়ে। শহর থেকে এলেই মঞ্জুর শরীরে থাকত আশ্চর্য সুবাস। সারাদিন গন্ধটা তার নাকে লেগে থাকত। সে সোনার জন্য নিয়ে আসত সুন্দর সুন্দর জলছবি। সোনা ওকে বন থেকে সংগ্রহ করে চন্দনের গোটা উপহার দিত। অতীশের কত কথা মনে পড়ছে!

শহর থেকে এলেই মঞ্জু বলত, এগুলো তোমার জন্য এনেছি সোনা।

—কি দেখি।

—দ্যাখ না। বলে মঞ্জু নানা রঙের জলছবি দিত। কোনোটা ফুলের, কোনোটা ফলের, কোনোটা তিন-পা-আলা জোকারের। এমন সব চিত্র বিচিত্র ছবি।

মঞ্জু বলত, কি করে জলছবি তুলতে হয় জান?

সোনা যেমন দাঁড়িয়ে থাকত, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকে। সেতো ও-সবের কিছু জানত না।

মঞ্জু লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যেত ভেতরে। সে লম্বা কাচের গ্লাসে জল নিয়ে আসত। এমন সুন্দর কাচের গ্লাসও কোনদিন সোনা দেখেনি। নানারকম লতাপাতার প্রিন্ট গ্লাসটার গায়ে। জলের ভেতর মনে হত লতাপাতা সব ভেসে বেড়াচ্ছে।

মঞ্জু এসেই বারান্দায় বলত, ধর।

সোনা ধরত।

—বোসো এবার।

সে বসত। সোনার কত কথা যে মনে পড়ছে। ফতিমার সঙ্গে যেন সে বেশি না ঘোরে, তার জন্য মঞ্জু ঢাকা থেকে জলছবি নিয়ে এসেছিল।

তারপর সাদা পাতার ওপর মঞ্জু ছোট ছোট ছবি জলে ডুবিয়ে চেপে রাখত। বেশ সময় পার করে দিত ঢাকা শহরের গল্প করে। বুড়িগঙ্গায় কত আনারস আর কাঁঠালের নৌকা আছে সে যেন চোখ বুজে বলে দিতে পারত তখন। অথবা সূত্রাপুরের পুল পার হয়ে গেলে একটা বড় মাঠে বটগাছ পাওয়া যাবে। সেখানে রঙ্গীন সুতোয় কে একটা ঘুড়ি বেঁধে রাখে। সোনা সঙ্গে থাকলে সে ঘুড়িটা ঠিক পেড়ে আনত। এবং এমন সব গল্প বলত যার মানে সব সময় সে ধরতে পারত না।

ছবিগুলো সাদা পাতায় আকাশে তারা ফুটে ওঠার মতো ফুটে উঠলেই সে বলত, নাও ধর। তোমার স্কুলের খাতায় একটা একটা করে জলছবি ছেপে দেবে। নিচে একটা নাম লিখবে।

সোনা মাথা কাত করে বলত, লিখব। যেন সে খুব ছোট, ছোট ভাইটির মতো একান্ত বশংবদ হয়ে থাকতো মঞ্জুর। কারণ মঞ্জুকে খুশি করতে না পারলে যে কোনও সময় সে মাকে জেঠিমাকে বলে দিতে পারে, ফতিমা না, সোনাকে ছুঁয়ে দিয়েছে!

—কি লিখবে?

—কি লিখব আবার? আমার নাম লিখব।

—তা হলেই হয়েছে!

সোনা তাড়াতাড়ি সংশোধন করে নিতে গিয়ে আর কিছু বলতে পারত না।

—আমার নাম লিখবে। এগুলো আমি তোমাকে দিয়েছি লিখবে।

এমন কথায় তার সায় থাকত না। মনে মনে সে বলত —না এ হয় না। ফতিমা জানতে পারলে রাগ করবে। কিন্তু মুখে বলত, আচ্ছা। আসলে সে যে বড় হয়ে উঠছে এটা টের পেয়ে যাচ্ছে। সে মঞ্জুর নাম কিছুতেই বইয়ে লিখতে পারে না। কোথাও না। এমন কি মঞ্জু যে মনের ভেতর একটা নাম হয়ে আছে সেটাও যেন একটা ভয়। কখন ধরা পড়ে যাবে। ফতিমা টের পেলেই হয়েছে!

শহর থেকে মঞ্জু এলে, ওর তাজা মুখ, মাখনের মতো গায়ের রঙ দেখে সে কেমন দুঃখী মানুষ বনে যেত। ফতিমাও শহরে গেল, কিন্তু আর ফিরে এল না। মঞ্জু যে-ভাবে যত কথা বলতে পারত, সোনা তার উত্তরে কিছুই বলতে পারত না।

এই ছিল তাদের মঞ্জু। তার মানে তিন জন, মঞ্জু, ফতিমা, আর সোনা। আর অবনী ছিল একগুয়ে। মঞ্জুকে দেখলেই ক্ষেপে যেত। স্কুল থেকে ফেরার পথে মঞ্জুদের ঘোড়াটাকে ঢিল ছুঁড়ে মারত। কেন যে মারত! ওর রাগ ছিল ভীষণ। মঞ্জু ওর সঙ্গে কথা বলত না বলে আরও রাগ। সে ভাবত কেবল ঠিক সময়ে ঘোড়ার পায়ে ঝোপের ভেতর থেকে ঢিল ছুঁড়ে দেবে। ঘোড়াটাকে খোঁড়া করে দেবে। মঞ্জুর ঘোড়ায় চড়া সে বের করে দেবে। তখন ফতিমা ঢাকায়। দাঙ্গার খবর আসছে। দেশ ভাগের কথা শোনা যাচ্ছে। সোনার জ্যাঠামশাই বাড়ি এলেই লোকজন জড় হত। তিনি বলতেন অবস্থা ভাল বুঝছি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *