॥ ছেষট্টি ॥
সোনার স্বদেশ যাত্রা
অতীশের প্রায়ই কেন যে মনে হয়, এটা তার জন্মান্তর। সে জলে ডুবে যাচ্ছিল ফতিমা হাত বাড়িয়ে ডাঙ্গায় তুলে দিয়ে গেছে। সেই ফতিমারও খবর নেই। কতদিন হয়ে গেল ফতিমার শেষ চিঠি উড ফোর্ড গ্রীন থেকে। টুটুল মিণ্টুর কথাই সে বেশি জানতে চাইত। ঠিকানাটাও মনে আছে। তিরাশি মোংখাম এভিনিউ, উড ফোর্ড গ্রীন, এসেকস্, লণ্ডন। তারপর সে নিজেই কেমন নিখোঁজ হয়ে গেল। সেদিন বাসায় ফিরে এলে নির্মলা বলল, বাংলাদেশ থেকে কে তোমাকে চিঠি দিয়েছে।
—কৈ দেখি!
তার চিঠি আজকাল একটু বেশীই আসে। পাঠক পাঠিকাদের চিঠি আসে। টুটুল মিণ্টু চিঠি খুলে পড়ে। নির্মলাও। কে দিয়েছে চিঠি, এমন না বলে, নির্মলা শুধু বলল, বাংলাদেশ থেকে কে তোমাকে চিঠি দিয়েছে!
বাংলাদেশে তার আত্মীয়স্বজন কেউ আছে মনে করতে পারল না। চিঠিটা কার তাও বলছে না। বাংলাদেশ বললেই ভিতরটা কেন যে তার গর্বে ভরে যায়। চিঠিটা কে দিয়েছে জানার আগ্রহ না যত, বাংলাদেশের খাম পোষ্টকার্ড দেখতে কেমন, এটাই যেন তাকে বেশি উদ্রগ্রীব করে তুলছে।
মিণ্টু ও-ঘরে পড়ছে। টুটুল মিণ্টু আর আগের মতো সে এলেই কাছে ছুটে আসে না। বড় হয়ে গেলে বাধ হয় এসবই হবার কথা। কেমন দূরত্ব তৈরী হচ্ছে। ওরা পড়ার টেবিল থেকে উঠে একবার শুধু উঁকি দিয়ে দেখে গেছে।
বাংলাদেশের চিঠি বলতেই ফতিমার মুখটাও কেন যে ভেসে উঠল সে বুঝতে পারছে না। ফতিমা নির্মলার স্কুলে গিয়ে কি যে মন্ত্র পড়ে এল সেই জানে। নির্মলার তখন এক কথা, না আর না। আর থাকছি না। খুব হয়েছে! মাস্টারির চাকরিটা ছেড়ে ছুড়ে চলে এল।
—কি হল, চিঠিটা দিলে না!
অতীশ নির্মলাকে খোঁজাখুজি করছে। ঘর ফাঁকা। কেউ নেই। চিঠির খবর দিয়ে নির্মলা রান্নাঘরে ঢুকে গেল! সুখি কি করছে! আর তখনই সুখির মুখ দরজায়।
—কাকা কিছু বলছেন!
তার রাগ হচ্ছিল। বাংলাদেশের চিঠির যেন কোনও গুরুত্ব নেই। পাঠক পাঠিকাদের চিঠির মতো। পাঠক পাঠিকারা কি লিখবে সে জানে, হয় গালমন্দ, না হয় প্রশংসা। সে তাদের চিঠি নিয়ে কখনও বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে না। লেখার টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রাখা হয়। সে সময়মতো পড়ে। চিঠিগুলি খোলা থাকে। মিণ্টুর এটা খারাপ স্বভাব, কি কৌতূহল বোঝে না, পাঠক পাঠিকাদের চিঠি সে খুলে পড়বেই। তার মাঝে মাঝে হাসি পায়। বাবার জন্য চিন্তা! তাদের বাবাকে আবার না কেউ কেড়ে নেয়।
সুখি দরজা থেকে নড়ছে না।
সে বিরক্ত মুখে বলল, না কিছু বলছি না।
সুখি চলে যাচ্ছিল, সে ফের ডেকে বলল, তোর কাকিমা কি করছে!
—বাজার গোছাচ্ছে।
তা গোছাতেই পারে। নির্মলা স্কুল ফেরত বাজার করে আসে। লোকাল ট্রেনে সে যায়। আশ্চর্য মনে হয় সব। যেন ফতিমা চাকরিটা ছাড়িয়ে না আনলে, এ-চাকরিটা তার হত না। লোকাল ট্রেনে আধঘণ্টাও লাগে না। তার একজন প্রকাশক কত সহজে একটা ফোনে, এখানকার স্কুলের চাকরিটা করে দিয়েছিল। কার যে কোথায় প্রভাব থাকে—সে বুঝে উঠতে পারে না। কত দৌড় ঝাপ, কত চেষ্টা, শেষে কি না, শুধু একটা ফোন। শুধু দরখাস্ত নিয়ে সেক্রেটারীর কাছে হাজির হওয়া। চার- পাঁচদিনের ভিতর এপয়েন্টমেন্ট। যেন বাবার কথাই ঠিক, চেষ্টা করবে। চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে কিছু হয় না। ফতিমা আসার পরই তার ভাগ্য বোধ হয় ফিরছিল। সেই তাকে আত্মহনন থেকে রক্ষা করে গেল। ঘোর থেকে মুক্তি দিল। বাংলাদেশের চিঠি —ফতিমাও তাকে দিতে পারে। তার কেন যে মনে হল ঠিক ফতিমাই চিঠি দিয়েছে। ফতিমাকে নির্মলা খুব একটা পছন্দ করে না জানে। এ-জন্য চিঠিটা নিয়ে নির্মলার অনাগ্রহ থাকতেই পারে।
চিঠিটা কে দিল, কোথায় রেখেছে জানার জোরটাও অতীশ হারিয়ে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। সে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। এ-ঘরে একটা সিঙ্গল খাট। ও-ঘরে ডাবল খাট একদিকে। একটা সিঙ্গল খাট ইদানীং কিনেছে। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে আলাদা শুতেই হয়। ঘরগুলি এত প্রশস্ত যে অনায়াসে কাঠের পার্টিশান করে তিনটে বেডরুম, একটা বসার ঘর করে নেওয়া যায়। ইচ্ছাও আছে। নির্মলা মাথা পাতছে না। ঢাকুরিয়ার দিকে দু-কাঠা জমি কেনার কথা হচ্ছে। টাকার খুব দরকার। লেখা থেকে রোজগার বাড়ছে। নির্মলার আয়, তার চাকরি, সব মিলে মনে হয় না আর সে এ-শহরে নির্বান্ধব। তার নিরাপত্তার অভাবটাও আর নেই। রাজবাড়ির চাকরি থাকল কি গেল আসে যায় না। নির্মলা বাজি রেখেছে যেন। বাপের বাড়ির সঙ্গে তার যে গোপন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, এটা সে আজকাল বেশ টের পায়। জমি কিনে বাড়িটা করা না পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই।
অতীশ একটা সিগারেট ধরাল। কেমন আলস্য লাগছে। একবার ও-ঘরে উঠে গেল। মিণ্টুকে বলল, কে চিঠি দিয়েছে রে। চিঠিটা কোথায়!
—দাঁড়াও দেখছি।
আরে মেয়েটা তো যজাবে শেষ পর্যন্ত। তর সয় না। মেয়ের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে! এখুনি আবার তার মাকে গিয়ে না বলে, বাবা চিঠিটা চাইছে। অতীশ তাড়াতাড়ি বলল, থাক। পড়ছিস পড়।
টুটুলের খাতায় মলাট দেওয়া। নির্মলা সুন্দর হস্তাক্ষরে, টুটুলের নাম, স্কুলের নাম, কোন ক্লাস, ছবির মতো লিখে রেখেছে। ক্লাস সিক্স কথাটা বেশ বড় করে লেখা। সংসারের কোনো দায়িত্বই আর এখন তার হাতে নেই। এমন কি টাকা পয়সার হিসাবও নির্মলা রাখে। লিখছ লেখ। কে তোমাকে সবতাতে মাথা গলাতে বলছে।
নির্মলা ঘরে ঢুকে অবাক। অতীশ সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে সিগারেট টানছে।
—কী হল! বসে থাকলে কেন! হাত মুখ ধুলে না! জামাকাপড় ছাড়লে না!
—যাচ্ছি।
সে উঠে পড়ল! তার কেন যে ফের মনে হল চিঠিটা ফতিমাই দিয়েছে। ফতিমা বাসায় রাতও কাটিয়ে গেছে—নির্মলা এও জানে। ক’দিন মুখ গোমড়া—সেই থেকে কেন যে নির্মলা ফতিমার নাম শুনতে পারত না। ফতিমার চিঠি এলে কিংবা টুটুল মিণ্টুর জন্মদিনে উপহার পাঠালেও রাগ করত। ফতিমাকে কি খারাপ কিছু লিখেছে নির্মলা। লিখতেই পারে। ফতিমা কি সে জন্য যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিল!
বাথরুমে এত সব ভাবলেও খুলে বলার সাহস নেই। নির্মলার উপর দিয়ে কত বড় ঝড় গেছে সে টের পায়। স্বামী, নিরাপত্তা বোধের অভাবে মানসিক অবসাদে ভুগলে কার না জীবন বিপন্ন হয়। এ-সব মনে হলেই আর সে নির্মলার উপর রাগ অভিমান কিংবা কোনো ক্ষোভ পুষে রাখতে পারে না।
সে বাথরুম থেকে বের হয়েই ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। রান্না ঘরের পাশের ঘরটা খাবার ঘর করে নিয়েছে নির্মলা। কিছুটা অন্ধকার সব সময় থাকত। আগে কয়লা ঘুঁটে রাখা হত। আরশোলার উপদ্রব ছিল খুব। বাসায় গ্যাস আসার পরই, ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেল। চুনকাম করিয়ে, তারটার পাল্টে ডানিং টেবিল কিনে সৌখিন খাবার ঘর বানিয়ে ফেলেছে।
বিকেলের জলখাবার খেয়ে তাকে বাসা থেকে আজকাল বের হতে হয়। এখন আর অফিস থেকে সে কলেজস্ট্রীট পাড়ায় সোজা চলে যেতে পারে না। নির্মলার কড়া হুকুম। বাসায় ফিরে মুখে কিছু দিয়ে রোজ যে যায়, তাও না। তবে প্রায়দিনই যায়। তার বাসা থেকে কলেজস্ট্রীট দূরও না। কয়েক মিনিটের পথ। এতে তার বিশেষ অসুবিধা হবার কথা না। কফি-হাউসে তার একটা আড্ডা আছে। সেই আড্ডায় না গেলে বন্ধু বান্ধবরা রুষ্ট হয়। সে যায়।
খাবার টেবিলেও বলতে পারল না, কৈ চিঠিটা দাও। কে দিল চিঠি!
চিঠি সম্পর্কে সে আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাল না। ফতিমাই দিয়েছে। দেখা যাক, বাংলাদেশ হয়ে যাবার পর ফতিমা কেমন আছে। যেতে টেতে লিখতে পারে। জায়া জননী জন্মভূমির কথা কেউ ভুলতে পারে না। নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যাবার আনন্দ কম না। বাংলাদেশ হবার পরই কুম্ভবা একদিন বলেছিল, চলুন যশোর থেকে ঘুরে আসি। বাংলাদেশটা কেমন দেখতে দেখে আসি। আপনার বাংলাদেশে তো এখন কাতারে কাতারে লোক যাচ্ছে। চেকপোষ্টে কেউ কাউকে আটকাচ্ছে না।
সে বলেছিল, যশোর গিয়ে কি হবে, গেলে জন্মভিটায় যাব। যশোর যশিডি আমার কাছে সমান।
—তুমি আবার বের হবে! নির্মলার প্রশ্ন।
সে চাতালে দাঁড়িয়েছিল। বেশ গরম পড়েছে। ক’দিন বৃষ্টি না হওয়ায় ভ্যাপসা গরম। পাখার হাওয়াতে কেমন গরম বাতাস ঝলকাচ্ছে। চাতালে এসে দাঁড়ালে—কোথা থেকে যেন ঠাণ্ডা হাওয়া উঠে আসে। নীলরঙের বেতের চেয়ার পাতা থাকে। দেয়ালে আলোর ডুম জ্বালা থাকলে এখানটায় বসে বেশ আয়াস করা যায়। বইটই পড়া যায়। ঘরের কোলাহলও তেমন টের পাওয়া যায় না।
নিৰ্মলা তবু চিঠিটা দিচ্ছে না। চিঠি গোপন করার ইচ্ছে থাকলে বলতই না, বাংলাদেশ থেকে কে তোমাকে চিঠি দিয়েছে। তবু নির্মলা নিজে চিঠি না দিলে, সে যেন বলতেও পারবে না। দেশে তো আর কেউ নেই। সব ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। না, কোনো আত্মীয়স্বজনেরও চিঠি নয়। সবাই রানাঘাট, ধুবুলিয়া অথবা আগরপাড়া বেলঘরিয়া, কেউ পলতায় কলোনিতে আশ্রয় নিয়েছে। নির্মলা সব খবরই রাখে। কোনো আত্মীয়স্বজনের নাম করে চিঠিটা চাইতে সাহস পাচ্ছে না।
সে কেন যে বলল, না। বের হচ্ছি না। কেন যে বলল?
তখনই চিঠিটা এগিয়ে দিল। বলল, মঞ্জু কে হয় তোমার! মঞ্জু দিয়েছে।
—মঞ্জু দিয়েছে!
—হ্যাঁ। কে হয় তোমার?
—কেউ না। কবিরাজদার মেয়ে। ফতিমা তো বলেছিল, মঞ্জুরা নাকি দেশ ছেড়ে আসেনি! কি লিখেছে! বেঁচে আছে তাহলে!
—যেতে লিখেছে।
অতীশ কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। দেশটায় গৃহযুদ্ধে কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। লুণ্ঠন, গৃহদাহ, অগ্নি সংযোগ, গণহত্যা আত্মহত্যা নির্বাচারে চলেছে। তবু মঞ্জু দেশ ছাড়েনি! মঞ্জু কি তার বয়সী, না ছোট, না কিছু বড়, এতদিন পর কিছুই মনে করতে পারছে না। সেই শৈশবেই মঞ্জু যে কত পেকে গিয়েছিল, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ফতিমা শহরে চলে গেলে, মঞ্জুই ছিল তার শৈশবের সঙ্গী। মঞ্জুর কথা ভাবলেই অন্ধকারে একটা সাদা মোম জ্বলছে এমন কেন জানি মনে হয়। সে বসার ঘরে ঢুকে খামটা দেখল। বাংলা ভাষায় লেখা, বাংলাদেশ। শাপলা ফুলের নীলরঙের ছবি খামটায়। সে অপলক ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। রান্নাঘরের কাজ বোধ হয় শেষ। নির্মলা আঁচলে হাত মুছে পাশে বসল।
মিণ্টু বলল, মা আসব।
নির্মলার শাসন আছে। বড়রা কথা বললে, ছোটদের কাছে থাকতে নেই। অবশ্য সে ছোট নেই, হাবভাবে বুঝিয়ে দিতে কসুর করে না।
—অঙ্ক হয়ে গেছে। নির্মলার প্রশ্ন।
—সব হয়নি। এটা দেখতো। মিলছে না।
নির্মলা অঙ্ক বইটা হাতে নিল। খাতাটাও। তারপর কি ভেবে বলল, সকালে দেখব। এখন রেখে দাও।
মিণ্টু ততক্ষণে পাশের ডিভানে বসে পড়েছে। ফ্রক টেনে হাঁটু ঢাকছে।
মিণ্টুর দিকে তাকিয়ে অতীশ বলল, দেশ ছেড়ে আসার সময় বোধ হয় মিণ্টুর মতো বড় ছিল। একই বয়েস। আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি।
—বোধ হয় কেন!
ওরা তো ঢাকা শহরে থাকত। স্কুলের ছুটিতে বাড়ি আসত। যখন দেশ ছাড়ি মঞ্জু ফতিমা সব ঢাকার। আমাদের অঞ্চলে মেয়েদের কোনো স্কুল ছিল না।
মিণ্টু উঠছে না। টুটুল চলে এসেছে। বাবা মা সামনা-সামনি বসে। বাবার হাতে সেই খামটা। মা চিঠিটা পড়েছে। তারাও পড়েছে লুকিয়ে। মা পছন্দ করে না, বাবার চিঠি ছেলে মেয়ে পড়ুক। তবু যে পড়ে এটা টের পায় নির্মলা। কিছু বলে না। অন্তত মানুষটার কোনো গোপন খবর থাকুক কেউ তারা চায় না। পাঠিকাদের ন্যাকামির শেষ থাকে না। কোথাকার জল কোথায় গড়াবে শেষ পর্যন্ত কে জানে! ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে—এটা টের পাইয়ে দেবার জন্যও খোলামেলা আচরণ—সংসারী মানুষের বেশী দূর যাওয়া ঠিক নয়, অতীশের চিঠি পড়ার অধিকার সবারই আছে ইঙ্গিতে তাও বুঝিয়ে দেওয়া।
মিণ্টু বলল, তোমাকে যেতে লিখল কেন বাবা?
—তাতো জানি না। আর লিখলেই যাই কি করে।
নির্মলাই বলল, মঞ্জুর কথা তো কখনও বলনি!
—কার কথা বলেছি! ফতিমার কথা বলেছি! ও গায়ে পড়ে না এলে বুঝতেই পারতে না আমরা কত বড় প্রকৃতির মধ্যে বড় হয়ে উঠেছিলাম। টুটুল কিছুই দেখল না। কত বড় আকাশ, কত নদী নালা, কত কাশফুল, ঢাকের বাদ্য, বিসর্জনের বাজনা, নদীর পাড়ে হ্যাজাকের আলোর মাধুর্যই ওরা টের পেল না।
কেমন ঠোঁটে সামান্য বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল নির্মলার। বলল, যাবে নাকি! ঢাকের বাদ্যি শুনতে।
অতীশ চোখ তুলে তাকাল। নির্মলার মুখের রেখাতে ভাঁজ পড়লে সে টের পায়। তবু বলল, যেতে তো ইচ্ছে করে। এ সুযোগে নিজের জন্মভিটায় ঘুরে আসা যেত। অনেকে তো যাচ্ছে। আর তখনই ফতিমার অনুযোগ যেন শুনতে পায়। ফতিমা যেন বলছে, আপনার এত লেখা পড়লাম, কোথাও মঞ্জু নেই।
সে বলেছিল, তুই আছিস?
ফতিমা বলেছিল, নামে না থাকলেও কামে আছি।
এটা ঠিক, মঞ্জুর কথা যেন ফতিমাই মনে করিয়ে দিয়ে গেল। মঞ্জু, অবনী, রসো, সুভাষ, নন্দ, নারান সবাই তারা সমবয়সী ছিল। অবনী কিছুটা বয়সে বড়। তাদের গাঁয়ে দুজন রসো ছিল। পাল বাড়ির রসো, নাপিত বাড়ির রসো। নাপিত বাড়ির রসো আর চন্দদের বুড়ি পালিয়ে নৌকায় শাপলা তুলতে গিয়ে জলে ডুবে গেছিল। নিখোঁজ। পরে বর্ষা নেমে গেলে জলে কাদায় তাদের কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া গেছিল।
আজ কেন জানি অতীশের মনে হল, তার শৈশব কেমন ছিল, সবার জানা দরকার। সে তার লেখায় বার বার ঘুরে ফিরে শৈশবের কথাই লিখে যাচ্ছে। কিন্তু তবু যেন শেষ হয় না। রসোবুড়িকে নিয়ে সুন্দর গল্প সৃষ্টি হতে পারে। মঞ্জুকে নিয়েও। মঞ্জুর কথা কবিরাজ বাড়ির কথা না লিখে যেন ভালই করেছে।
সহসা মিণ্টু বলল, তুমি গেলে আমরা যাব বাবা।
—যাবে। যাবে বলে, চিঠিটা শেষ করল। কয়েক লাইনের চিঠি। কত কথা মনে পড়ছে।
সে বলল, জান কি বোকাই না ছিলান। নির্মলা যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কি বলে!
-–জান, দেশ স্বাধীন হল, আর বাবা জ্যাঠাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ১৫ আগষ্ট দিনটা অভিশাপ হয়ে নেমে এল। বাবা, মেজ জ্যাঠামশাইকে এত বিচলিত হতে কখনও দেখিনি! বাবা জ্যাঠামশাই, ঠাকুরদার শ্মশানে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছেন। আমরা সবাই নিথর। ফতিমার উপর, ওর জাতভাইদের উপর কি ক্ষোভ। আমরা কেউ না! এখন বুঝি, সহিষ্ণুতা থাকলে ধর্ম। অসহিষ্ণুতা ধর্মকে প্রেতাত্মা করে ছেড়ে দেয়। প্রেতাত্মার তাড়া খেয়ে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু এ-দেশে। আমরাও।
নির্মলা বলল, তুমি কি মনে করছ, দেশটার উপর তখন প্রেতাত্মা ভর করেছিল।
—তাইতো মনে হয়। দেখ, আমি পোড় খাওয়া মানুষ। জীবনে কম ঘাটের জল খাইনি। অথচ আমিই কি করে ভেবে ফেললাম, ধূপদানিটা আমার ঈশ্বর। সব অমঙ্গল থেকে সেই আমাকে রক্ষা করবে। ফতিমা না এলে এটা টের পেতাম না। সে না এলে আমার বোধ হয় জন্মান্তরও হত না।
মিণ্টু বাবার এতসব ভারি ভারি কথা কখনও শোনেনি। এক জীবনে তারা দেখেছে দুশ্চিন্তায় বাবার মুখ কালো। বাবা তাদের ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকত। বাবার সেই আচ্ছন্ন অবস্থা দেখলে তার কান্না পেত। এখন বাবা হাসিখুশি মানুষ। তাদের নিয়ে বাবা রঙ্গ তামাসা করতেও ভালবাসে।
টুটুল বলল, বাবা আমরা যাব। তোমার সঙ্গে যাব।
—নাও হয়ে গেল! যাব কি না তার ঠিক নেই। তেনারা এখনই লাফাতে শুরু করেছেন! যাবে না কেন!
—যাও না, ঘুরে এস। মনটা ভাল হবে। নিজের দেশ মাটি কার না দেখতে ইচ্ছা হয়।
নির্মলা এত সহজে রাজি হবে সে ধারণাই করতে পারে নি।
—ঘুরে এলে লেখার খোরাক পাবে। ঘর ছেড়ে কোথাও তো যেতেই চাও না। তারপরই বলল, বোকামির কথা বললে, সেটা কি!
—আর বল না, তখন তো আমি খুব ছোট না! তের চোদ্দ বছরের ছেলে। তবু কেন যে নিখোঁজ জ্যাঠামশাইর জন্য অর্জুন গাছে বার্তা রেখে এলাম, জ্যাঠামশাই আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি ইতি সোনা। আসলে ক্ষোভ থেকে। জ্যাঠামশাই ফিরে এলে যেন বোঝে হিন্দুদের জন্যও একটা দেশ আছে। ফতিমাকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলাম, তোরা আমার কেউ না। তোদের দেশ আছে, আমাদেরও একটা দেশ আছে। অথচ দ্যাখ ফতিমা না এলে বোধ হয় আরোগ্য লাভ করতাম না। ধূপদানির হাত থেকে মুক্তি পেতাম না।
বার বার ফতিমার কথা বলায় নির্মলা যেন রুষ্ট। ফতিমা না এলে তার জন্মান্তর ঘটত না কিসের জন্মান্তর, এই যে আরোগ্যলাভ! ফতিমাই তো বলেছে, সব বলুন, সব মনে করার চেষ্টা করুন, তারপর কি, তারপর মনে করতে পারছেন না, আচ্ছা আমি বলছি, যেন ফতিমা সব জানত বনির নিখোঁজ হওয়া, অ্যালবাট্রস পাখির মৃতু সব যেন সে ধরিয়ে দিয়েছিল। সূতো আলগা ছিল, সে তা জুড়ে দিতেই তার সব মনে পড়ে গেল। স্মৃতি বিভ্রম থেকে তার উদ্ধার। জীবনের পাপ বোধ থেকে আত্মরক্ষার উপায় সে যে বাতলে দিয়ে গেল! জীবন থাকলেই পাপ থাকে পুণ্য থাকে। পাপ পূন্য জীবনের বড় ব্যাধি। ব্যাধি থেকে মুক্ত হোন। ঘোরে পড়ে যাবেন না। অতীতকে এত কে মনে রাখে। আপনার টুটুল মিণ্টু আছে না! তাদের কথা ভাববেন না! আর পাপ কার নেই। পাপ ভাবলে পাপ, পুণ্য ভাবলে পূণ্য। আপনি কে? আপনার ক্ষমতা আছে কিছু করার! তাঁরই মর্জি। আপনি তাঁর আজ্ঞাবহ দাস।
ফতিমার কথা বেশী বলা ঠিক হবে না বুঝেই, সে চুপ করে গেছিল।
নির্মলা রান্নাঘরে সুখিকে কি বলতে গেল, আবার ফিরে এল। বসল। বলল, তোমার বোকামিটা কি বুঝলাম না। তা গাছে লিখে দিয়ে আসতেই পার। নিখোঁজ জ্যাঠামশাই ফিরে এলে বুঝতে পারবেন, দেশটা আর বাংলাদেশ নেই। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেছে। ওতে বোকামির কি আছে!
—বোকামির কিছু নেই বলছ! হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি! হিন্দুস্থান কি রাজার বাড়ি। এলেই আমাদের ঠিকানা পেয়ে যাবে! বোকামি না! কোনো ঠিকানা নেই। হিন্দুস্থানের কোথায়, কি ঠিকানা, কিছুই তো লিখিনি। বড় বড় অক্ষরে হিন্দুস্থান লিখে রেখে এসেছিলাম শুধু।
নির্মলা বলল, কোথায় গেলেন তিনি। কেন গেলেন!
—সেই তো রহস্য। মঞ্জু দেশ ছেড়ে এল না। এটাও কম বড় রহস্য না। ওর বাবা অবিনাশ কবিরাজ। তাঁর সাধ্যের বাইরে চলে গেলেই ডাক পড়ত তারিণী কবিরাজের। তিনি ছিলেন এলাকার ধন্বন্তরী। রমণী কবিরাজের জামাই। রমণী কবিরাজের পশার ছিল খুব। বাড়ির অসুখে বিসুখে তাঁকে ডাকা হত। তিনি ঘোড়ায় চড়ে ওষুধ ফেরি করতে বের হতেন। তাঁর সাধ্যের বাইরে চলে গেলেই ডাক পড়ত তারিনী কবিরাজের। তিনি ছিলেন এলাকার ধন্বন্তরী।
ঘোড়ার কথা শুনেই টুটল লাফিয়ে উঠল।
—ঘোড়াটা কত বড় বাবা!
—খুব বড়। কি ছুটত! কদম দিলে আমরা পিছু নিতাম।
নির্মলা বলল, থামতো। ঘোড়া কত বড় তোমার বাবা বোঝাবে কি! যাও পড়তে বসগে। এই মিণ্টু বসে থাকলি কেন। পড়াশোনা নেই! গল্প পেলে আর নড়তে চায় না।
অতীশ চিঠিটা ফের পড়ছিল। মঞ্জুর সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা। মুখ তুলে বলল, আজ না হয় নাই পড়ল। ওরা তো আমার স্বদেশ দেখেনি। ওদের বড়ঠাকুরদা পাগল ছিলেন, ঐ পর্যন্ত জানে।
নির্মলা বলল, উনি কি একেবারে উন্মাদ ছিলেন!
—না আদৌ না।
—কি করতেন সারাদিন?
—বৈকখানার বারান্দায় বসে থাকতেন। হাত কচলাতেন। আর ক্ষণে ক্ষণে গ্যাৎচোরেৎ শালা বলতেন। মিণ্টু বলল, গ্যাৎচোরেৎ শালা কি বাবা!
—তা আমরাও জানি না। মঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। আমরা খুঁজতে বের হতাম দল বেঁধে। আবু শোভা মতি গগনি, কালপাহাড়, মেজদা সবাই। কখনও আমি একা। কখনও ফতিমা থাকত সঙ্গে। মঞ্জু বাড়ি এলে সেও যেত। অবনী রসো কেউ বাদ যেত না। নদী নালার দেশ—বন-জঙ্গলের দেশ। সেই দেশে এমন একজন মানুষ না থাকলেও যেন এত প্রিয় মনে হত না দেশটাকে। বাড়িতে কত লোকজন তখন। বাবা জ্যাঠা কাকারা, মা জেঠি ঠাকুমা, ঠাকুরদা, মাষ্টারমশাই। ইশম দাদা, সোনালি বালির নদী, তরমুজ খেত, শীতে অথবা হেমন্তে আসত জসীম। মুড়াপাড়ার বাবুদের হাতি নিয়ে চলে আসত। কোজাগরি লক্ষীপূজা, সাদা জ্যোৎস্নাধূসর মাঠ, আবেদালির বিবি বিলে ডুবে গেল—কত স্মৃতি—সবাইকে জড়িয়ে বড় হচ্ছিলাম। যত বড় হচ্ছি, তত পাতা ঝরে যাচ্ছে। এখন তোমাদের ঘাটে নৌকা ভিড়িয়েছি।
নির্মলা বোধ হয় খোঁটা দিয়ে কথা বলছ ভাবল! সে কিছুটা তুচ্ছ বোধ করল নিজেকে। বলল, অন্য ঘাটে নৌকা ভিড়লে বেশি সুবিধা হত বুঝি!
—আরে না না। আমি এসব ভেবে বলেছি! বুঝছ না কেন, চিঠিটা আমার স্বদেশকে বড় বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে। কী ক্ষোভ, সব ক্ষোভ ফতিমার উপর। এমন সুন্দর বাংলাদেশ, তার নাম পাল্টে হয়ে গেল পূর্ব-পাকিস্তান। বল সহ্য হয়। স্বদেশে ফিরি না ফিরি, এটা যে কত বড় মর্যাদার প্রশ্ন এখন সেটা আরও বেশি টের পাচ্ছি। যদি যাই পূর্ব পাকিস্তানে যাচ্ছি না, যদি যাই, বাংলাদেশে যাচ্ছি। মঞ্জুদের লাল ইটের বাড়ি, নীল রঙের ডাক বাকস, ওর বাবার লাল রঙের ঘোড়া—মঞ্জু ঘোড়ায় চড়তে পারত। নির্মলা বুঝল, তার মানুষটা সারা জীবনই ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে চেয়েছে। দিগ্বিজয়ে বের হবার কার না ইচ্ছে হয়। কিন্তু স্বদেশের নাম পাল্টে দিয়ে তাকে যেন এতদিন খোঁড়া করে রেখেছিল। দেশের জন্য এত মায়া পোষণ করে তার মানুষটা আজ প্রথম টের পেল। বলল, কবে যাবে?
—যাব। হাসুকে চিঠি দাও। ও আসুক। ও এসে থাকুক। তোমাদের একা ফেলে যাই কি করে!
—কি দরকার! এলেই যাই যাই করবে। আমরা তো জলে পড়ে নেই। ক’দিনের জন্য এসে হবেটা কি।
গল্পে গল্পে বেশ রাত হয়ে গেল। টুটলের চোখে ঘুম নেই। ঢুলছে না। বাবা তার বয়সী ছিল, তার বয়সে বাবার নানা দুষ্টুমির খবর পেয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। কেবল এক কথা, তারপর বাবা?
—তারপর! তারপর যে রাজপুত্র রাজকন্যার ঘরে বন্দী হয়ে গেল। আর নড়তে পারল না। কেউ তাকে উদ্ধারও করতে পারল না।