2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৬৪

॥ চৌষট্টি ॥

এ-দেশের ওপর দিয়ে চৈত্র বৈশাখ চলে গেল। অবনী ডিসপেনসারিতে আজ ক’দিন হল বসছে। প্রায় মাসাধিককাল সে শুয়েছিল। অবনীর অসুখ। কি অসুখ তল্লাটের কেউ খবর পায়নি। ছাউনিতে থাকে যে লোকটা, মুর্শেদ সে মাঝে মাঝে এসে খোঁজখবর নিয়েছে—অন্যান্য সবাই। একই খবর। সে অসুস্থ। জানালায় কেউ কেউ উঁকি দিয়ে দেখে গেছে—অবনীর রং সাদা হয়ে গেছে—রক্তশূন্য—মাথার কাছে জেগে হয় কেয়া না হয় মঞ্জু। একটা সাদা চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢাকা। জব্বার চাচা কবিরাজী মতে ওষুধ দিয়ে যাচ্ছে। যেন অবনী এবং জব্বার চাচা মিলে এই চিকিৎসা—আর অবনীর তো এমনিতেই ডাক্তারদের উপর ভরসা কম। সে তার রোজগারপাতির জন্যই সব হাস আমলের ডাক্তারদের যমের তুল্য মানুষ ভাবত। মাঝে মাঝে সে তার রুগীদেরও এমন বলত। কবিরাজী ওষুধে কি না আছে। যত প্রাচীন রোগ জরা ব্যাধি সবই নিরাময় হয় এই চিকিৎসায়। সুতরাং এমন বিশ্বাসের মানুষ যে ডাক্তার ডাকবে না তা মুর্শেদও মেনে নিয়েছিল। রুগী বাড়ি যেতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে—দুদিন খোঁজ ছিল না, এমনও চাউর করে দিয়েছেন জব্বার চাচা। আসলে একটা গুলিতে কাঁধ এফোঁড় ওফোঁড় এ-খবর মানুষেরা ঘুণাক্ষরে জানলে সপরিবারে হাজত, কিংবা তারও ওপরে আরও কি যে হতে পারে, মাঠে পড়ে থাকতে হতে পারে কত কি হতে পারে এ-সবের জন্যই সব সময় জব্বার চাচার শ্যেনচক্ষু, কিতা চাই!

—অবনী ভাইরে দেখতে আইছিলাম।

—তামাশা।

—শরীলডা শুনছি ভাল না।

—যাও দূর থাইকা দেখবা। কাছে যাইবা না। সংক্রামক ব্যাধি। কখন কারে ধরে কওয়ন যায় না।

অনেকে এ সব শুনে আর আসতই না। কারণ অবনীর ইদানীং কবিরাজীতে নাম ডাক হয়েছে।

অসুখ শুনে গ্রাম ভেঙে লোকজন আসতে শুরু করেছিল। কি থেকে কি হয় কে জানে। খান সেনাদের চর তো লেগেই আছে। মুর্শেদ যতই অবনীর মিতা হোক, লোকটাকে জব্বার চাচা ভাল চোখে দেখে না। মঞ্জুরে চোখ দেয়। জব্বার চাচা সেই লোকটাকেও দেখেছে আসতে। সে ঘরে বসে অবনীর সঙ্গে গল্পও করে গেছে। সুতরাং শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে, সংক্রামক ব্যাধি বলে চাউর করে দিতেই লোকজনের আসা যাওয়া কমে গেল। ডিসপেনসারির ওপাশে একটা নীল বাক্স, সঙ্গে পোস্টাফিস। পোস্ট মাষ্টার এসে যখন দরজা খুলে বসেন, তখনই আবার কিছু লোকজন—জব্বার চাচা তক্তপোশে বসে হুকা খায় আর বলে সেই এক কথা, সংক্রামক ব্যাধি। বাড়িটার ওপরে শকুন উড়ছে। কি যে হইব, এবং এই ভাবে জব্বার চাচার এক কাজই ছিল তখন গভীর রাতে ক্ষত স্থান ধুয়ে দেওয়া, ভেরাণ্ডার কষ গরম করে লাগিয়ে দেওয়া। মানুষ জানেই না, এই কষে কি আছে সঞ্জীবনী সুধা—কর্কট রোগেও কাজে আসে এমনই কইছেন কবিরাজ দাদা।

সে যাই হোক, মাসাধিককাল পরে অবনী প্রথম একদিন লম্বা বারান্দায় এক পাশে জামা গায়ে দিয়ে ইজিচেয়ারে বসল। সেখানে বসেই রুগীপত্তর দেখল। জব্বার চাচাকে বলে দিল কি কি ওষুধ দিতে হবে। তারপর একদিন হেঁটে হেঁটে ডিসপেনসারিতে গিয়ে বসল। বাঁ হাতটায় জোর পাচ্ছে না। অবশ মনে হয় হাতটা। সে বুঝতে পারছিল, দেশের জন্য তার আর কিছু করার নেই। কেমন শক্তিহীন দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং মগজের মধ্যে একটা শংকা কখন সব ফাঁস হয়ে যাবে, আর সে যা দেখে এসেছে তাতে নীলু মঞ্জু কেয়া জব্বার চাচা কেউ সেফ নয়। সবার জীবনই যে কোনও সময় বিপন্ন হতে পারে। মঞ্জুকে নিয়েই ভয় বেশি। কারণ পরিবারের মধ্যে ফিরে মনে হচ্ছে

এ অবস্থায় পালাতে পারলে সব চেয়ে ভাল। কিন্তু নীলুর কথা মনে হলেই অবনী টের পায় মরুক বাঁচুক, এখান থেকে তারা নড়তে পারছে না। নীলুকে কোনও শহরে যদি নিয়ে যাওয়া যায়, মঞ্জু যেতে চাইবে না। আসলে অবনীর মনে হয় মঞ্জু একগুঁয়ে, জেদি, কতবার অবনী বলেছে, চল, ওপারে চলে যাব—মঞ্জুর এক কথা, না বেশ আছি। আসলে কি মঞ্জুর মধ্যে তার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিশোধমূলক ইচ্ছা কাজ করে। মঞ্জু যখন কিশোরী, সেই তখনকার কথা। অবনী সেই সব কথা ভাবতে ভাবতে কেমন বিচলিত হয়ে পড়ল।

বেশ কিছুদিন অবনী সমসেরের কোন চিঠি পেল না। সব ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। এমন কি একটা চিরকুটও কেউ দিয়ে যায় নি। ওরা কি অবনীকে অবিশ্বাস করছে, মঞ্জুকে! অন্তত সমসেরের উচিত ছিল একটা খবর নেওয়া। তারপরই মনে হল, ওরা বেঁচে নাও থাকতে পারে। যেখানেই খান সেনাদের সংশয়, সেখানেই নির্বিচারে হত্যা। দাবানলের মতো জ্বলে যাচ্ছে ঘর বাড়ি। পাড়াকে পাড়া নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। ধরে নিয়ে যাচ্ছে মা বোনেদের। পর পর এমন সব খবর আসতে থাকল অবনীর কাছে এখানে শান্তি কমিটি হয়েছে। মোল্লা মৌলভীরা এখন মাতব্বর। শান্তি কমিটি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। খান সেনারা দেশের স্বার্থেই লড়ছে চুং মুখে দিয়ে বলে গেল সেদিন হোসেন চৌধুরী। সে বলেছে সব মুক্তি যুদ্ধই হিন্দুস্তানের চর। দেশদ্রোহী যেখানে যে আছে ধরিয়ে দিন, ইনাম মিলবে এমন সব কথা এবং সভা সমিতিও হচ্ছে। জালসা হচ্ছে। ইসলামই সব আর সব দুনিয়ার মিথ্যা এমন প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে শান্তি কমিটির লোকগুলি। শরিয়তি আইনের ব্যাখ্যা করল সেদিন একটা লোক। সে যেতে পারেনি মিটিং-এ। তার শরীর ভাল না। কারণ এ অঞ্চলের সে একজন গণ্যমান্য লোক। ভয়টা সে জন্য তার বেশি। সংশয় যে বাড়ছে সেটা মুর্শেদও একদিন বলে গেল। অবনীবাবু যেখানে সেখানে যান, ভাল না। কোনও খবর ছিল না দুদিন, কি করছিলেন!

অবনী কিছু বলেনি, চুপ করে ছিল।

রাতে তারা আজকাল খুব সন্তর্পণে কলকাতা রেডিওর খবর শোনে— দেশাত্মবোধক গান, ওপারের কবিদের কবিতা পাঠ থেকে সব সময় আশ্চর্য এক স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু অবনী দেখেছে, মঞ্জুর যেন এতে কিছু আসে যায় না। আসলে নীলুর জন্মের পর থেকেই মঞ্জু কেমন বদলে গেল। কথা কম বলে, গম্ভীর প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছে। বয়সের জন্যও হতে পারে। নাকি সোনা, ঠাকুর বাড়ির সোনা, সেই কবে শৈশবে দেশ ছেড়ে চলে গেল—সেই থেকেই যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। এখন কত রকমের ভাবনা অবনীকে যে কুরে কুরে খাচ্ছিল! সে সকালে রোজ একবার নীলুর মাথার কাছে গিয়ে বসে। নীলু এখন আবার ক’দিন ভাল আছে। বিছানায় উঠে বসতে পারছে। তাকে বারান্দায় কখনও বসিয়ে দেওয়া হয়। সে সকালের পাখ-পাখালী দেখে! গাছের পাতা পড়তে দেখে। কখনও সে বলে ওঠে, মা মা দেখ গাছে একটা ইষ্টিকুটুম পাখি! কখনও জব্বার চাচা গাছে উঠে যায়। আম পেড়ে নিয়ে আসে। কখনও দেখতে পায় ঘোড়াটা ঘাস খাচ্ছে মাঠে। নীলু বলে, বাবা আমি ভাল হলে ঘোড়ায় চড়ে যাব। অনেক দূর যাব। কোথায় কতদূর গেলে সেই নদী এবং মাঠ পাবে সে জানে না। কারণ নীলুর চোখে একটা স্বপ্নের জগৎ তৈরি হয়ে গেছে সেখানে আছে বড় নদী, আছে বালির চর আছে তরমুজের খেত। কোনও বালিকার মুখও সে দেখতে পায়। নাকে নোলক ঝুলছে—টুনটুনির রাজরানী বোধ হয় সেই মেয়েটা। ঘোড়াটা যখন ঘাস খায় নীলু তখন ভাবে। নীলু জানেই না এ-দেশে এখন নির্বিচারে গণহত্যা চলছে এবং যে কোনও সময় এ-বাড়িটায় আগুন ধরে যেতে পারে। নীলুকে সব সময় সব রকমের ভয় শংকা থেকে দূরে রাখতে হচ্ছে। নীলুকে বলতে হচ্ছে, আমরা নীলু বর্ষায় তোমাকে নিয়ে নাঙ্গালবন্দের বান্নিতে যাব। বিন্নির খৈ কিনে দেব। লাল বাতাসা খাব। কি মজাই না হবে!

কেয়ার এটা স্বভাব, এমন বলা, কিছু বললেই বলবে, কি মজাটাই না হবে!

অবনী বারান্দায় ইজিচেয়ারে, পাশের টিপয়ে চা রেখে গেছে কেয়া। সকালের দৈনিক সংবাদটা সে উল্টে পাল্টে দেখছিল। কিছু কিছু সংঘর্ষের খবর আছে। এই পর্যন্ত।

মঞ্জুর অভ্যাস সকালে উঠেই স্নান করে নেওয়া। জব্বার চাচা দুধ দুয়ে নিয়ে আসেন। গগনা জেলে মাছ দিয়ে যায়। কেয়ার কোনও তাড়াহুড়ো নেই কাজে। স্কুল কলেজ সব বন্ধ। অফিস কাছারিতে কাজ হচ্ছে না। বুদ্ধিজীবীদের গোপনে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এবং গোপনেই হত্যা করা হচ্ছে। কবীর সায়েবের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অনুমান খান সেনারা তাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে।

এ-সব অবস্থায় এ-সংসারে কেবল একজনই স্থিতধী মানুষ। তিনি জব্বার চাচা। দেশ নিয়ে তাঁর কোনও ভাবনা নেই। তাঁর ভাবনা, মঞ্জুমার কি আবার না অসুবিধা ঘটে। এই একটা শংকাই কেবল বুড়োর বুকে। মঞ্জুর বাবার মৃত্যুর পর কে যেন তাঁকে এই দায়িত্বটা দিয়ে গেল।

সকাল থেকে আকাশটা ভার ভার। গুমোট গরম। সামনের পাকা সড়ক দিয়ে মাঝে মাঝে মিলিটারি জিপ ট্রাক কোথাও উধাও হয়ে যাচ্ছে। কখনও দূরে অদূরে ঘণ্টা বাজছে। ঘণ্টা বাজলেই শঙ্কা। বিভীষিকার মধ্যে মানুষেরা কালাতিপাত করছে। মঞ্জু এমনিতে এতটুকু যেন বিচলিত নয়। অথচ অবনী লক্ষ্য করছে, রাতে মঞ্জু ঘুমাতে পারে না। তার চোখেও ঘুম নেই। জব্বার চাচার রাতে এমনিতেই কম ঘুম। এখন যেন সেটা আরও কমে গেছে। দেশ চোর ছ্যাঁচোড়ে ভরে গেছে। বেইমানরা কে কখন কি করবে কে জানে।

তবে জব্বার চাচা খুবই স্থিতধী মানুষ বলে সবই আল্লার মর্জি ভেবে নিয়ে কামকাজ সব ঠিকঠাক করে যাচ্ছেন। ঘোড়াটাকে মাঠে নিয়ে ছেড়ে দেবার আগে সামনের দু’পা বেঁধে দিলেন। ঘরে ফিরে আকাশের অবস্থা বুঝে বাসকের ছাল, অর্জুনের ছাল, এবং নানারকমের ফল-মূল যা রোদে শুকোতে দিয়েছিলেন সব তুলে ফেললেন। ঝড় উঠবে মনে হয়। এ-সব ভেবে তিনি হামান দিস্তা বোয়েম সারি সারি সবই তুলে নিলেন।

আকাশ ক্রমে আরও ঘন কালো হয়ে উঠল। একটা পাতা নড়ছে না। দুপুর থেকে এ-ভাবটা চলতে চলতে ঠিক বিকেলের মুখে ধেয়ে এল ঝড়। ঘোড়াটা তিনি খুঁজতে গেলেন মাঠে। মঞ্জু চিৎকার করে বলছে, চাচা যাবেন না। কার কথা কে শোনে। জব্বার চাচা ঝড়ের মধ্যে সোনালি বালির নদীর চরে ঘোড়া খুঁজতে ছুটে বের হয়ে গেলেন।

সন্ধ্যায় চাচা যখন ফিরলেন একেবারে ভিজে গেছেন। বৃষ্টি পড়ছে বড় বড় ফোঁটায়। ব্যাঙ ডাকছে। সবই ঠিকঠাক আছে। সব পুকুরগুলি জলে ভরে উঠতে থাকল। একটা বাসও চলে গেল পাকা সড়ক দিয়ে। গোপালদির বাস। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে চাচা ঢাকার খবর জানার চেষ্টা করছেন। কেউ কোনও কথা বলে নি। একজনও বলে নি—আল্লা ভরসা। সুতরাং ব্যাজার মুখে জব্বার চাচা আজ ফিরে এলেন। বাস যাত্রীদের চোখে মুখে কী আতঙ্ক। তবে কি সেই কেয়ামতের দিন ঘনিয়ে আসছে।

বৃষ্টি ভিজে ডিসপেনসারিতে ঢুকে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে বলে ও-পাশের লাল বাড়িটার সব দরজা জানালা বন্ধ। কেমন নির্জন খাঁ খাঁ করছে বাড়িটা।

ক্রমে সন্ধ্যা গাঢ় হল, গভীর হল। কোথায় কি হয়েছে কে জানে! জব্বার চাচা ডিসপেনসারিতে আলো জ্বেলে দিলেন। দু’জন লোক এল বৃষ্টি মাথায় করে। বোয়েম থেকে তাদের জন্য কিছু বাসব লেহ তুলে দিয়ে বললেন, নিয়া যাও মিঞা। অবনী কর্তার শরীলডা ভাল না। আজ আর বইস না। তারপর অজু সেরে মেঝেতে গামছা পেতে নামাজ পড়লেন। আল্লার কাছে দোয়া চাইলেন এ-পরিবারের জন্য। এবং আস্তাবলে ঘোড়াটা বেঁধে রেখে লণ্ঠন নিয়ে বের হলেন দেখতে, কোথায় কোন গাছপালার ডাল ভেঙে পড়েছে। বড় অর্জুন গাছটার ডাল তিনি টেনে সরিয়ে দিলেন। ঠাকুর বাড়ির পুকুর পাড়ের অর্জুন গাছটা এখন আর যেন ঝড়ের মুখে দাঁড়াতে পারছে না। সেই কবে ধনকর্তা শচীন কর্তা দেশ ছাড়া। বাড়িটা বন-জঙ্গলে ভরে গেছে। দিন কাল কি যে হয়ে গেল! একটা ডাল পাতা পড়ে থাকতে পারে না। সব চুরি হয়ে যায়। গাছের নিচ থেকে লণ্ঠনের আলোতে যেখানে যা পড়ে ছিল কুড়িয়ে ডাঁই করে রাখলেন জব্বার চাচা। আমে ব্যাগ ভর্তি হয়ে গেল। কেয়াকে ডেকে বললেন, দরজা খুইলা দ্যাখ। তখন ঝোপে জঙ্গলে একদল ডাহুক ডাকছে। ক’বার বিদ্যুৎ চমকাল কড়কড় করে। আকাশ ভেঙে পড়ল দু-বার মাথায়। জব্বার চাচার কোন হুঁশ নেই।

মঞ্জু জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। সে জানে, বলে কিছু হবে না। তিনি তাঁর মতো কাজ কাম করে যাবেন। এই বয়সে এমন ঝড়ো বাতাসের মধ্যে বুড়ো মানুষের ঘুরে বেড়ানো ঠিক না কে বোঝাবে! সুতরাং মঞ্জু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। আর তখনই মনে হল একটা ছায়া পুকুরপাড় ধরে এগিয়ে আসছে। বিদ্যুৎ চমকালে দেখল লোকটা লম্বা জোয়ান মানুষ। তার পরণে লুঙ্গি গায়ে গেঞ্জি। লম্বা দাড়ি গালে। বন-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লোকটা তাকিয়ে আছে ভিতর বাড়ির দিকে।

মঞ্জু ডাকল, কেয়া কেয়া!

কেয়া এলে বলল, দেখত চন্দন গোটার গাছটার নিচে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে!

বিদ্যুৎ চমকাল। সত্যি একজন বীভৎস চেহারার মানুষ। মঞ্জু চিৎকার করে উঠল, শুনছ অবনী পাশের ঘরে বসে কিছু কবিরাজী বইপত্রের পাতা ওল্টাচ্ছিল। মঞ্জুর আর্ত ডাকে সে প্রায়

ছুটে যেতে চাইলে মনে হল, শরীর এখনও তার দুর্বল। সে আর শরীরে কোন দিন বল পাবে না। কাছে গিয়ে বলল, ডাকছ আমারে।

—একটা লোক!

ঘরে আলো নেই। অন্ধকার। কেয়া মঞ্জু অবনী দেখল লোকটা বারান্দায় উঠে ডাকছে। খুব সন্তর্পণে বলছে, অবনীবাবু বাড়ি আছেন?

মঞ্জু অবনীকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, কে আপনি!

—আমি মেহের।

—অবনীর ফ্যাকাশে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

—মেহের!

মঞ্জু বলল, আস্তে কথা বল।

কেয়া দরজা খুলে দিল। আলো নিয়ে এল পাশের ঘর থেকে। লোকটার হাতে চামড়ার ব্যাগ। বোঝাই যাচ্ছে, মানুষটা অনেক রাস্তা হেঁটে এখানে এসেছে। বাসে আসে নি। অবনী কিছু বলার আগেই মেহের বলল, সময় নেই। ভিতরে যাব না। মঞ্জুদিকে সাবু এগুলি পাঠিয়েছে।

অবনী সাবু বলে কাউকে চিনতে পারল না।

মঞ্জুও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একে অন্ধকার, তার ওপর ঝড় বৃষ্টি, আর অসময়ে মেহেরের উপস্থিতি কেমন ভীত বিহ্বল করে তুলেছে মঞ্জুকে। সে বলল, সাবু, সাবু সে কে!

এতক্ষণে মেহের বুঝতে পারল, সাবুকে মঞ্জুদির চেনার কথা নয়। সমসের যে তার শেষ ইউনিটে গিয়ে সাবু হয়ে গেছে—সে খবর এরা রাখে না। সমসেরের নামে হুলিয়া বের হয়েছিল, কাগজে ছবি বের হয়েছিল, এবং সর্বত্র চর লেগেছিল। সমসের তাই শেষ ইউনিটে গিয়ে বাধ্য হয়ে নাম পাল্টে ফেলল। সে নিজেকে শুধরে বলল, সমসের ভাই।

সাবু, সমসের ভাই সব মিলে কেমন আরও গুলিয়ে ফেলল মঞ্জু। সে বলতে পারছে না, বাইরে দাঁড়িয়ে আর ভিজবেন না। ভিতরে আসুন। অবনী পেছনে দাঁড়িয়ে। এখনই হয়তো মেহের খবর দেবে—পালান, আসছে। কখন কোথা থেকে কি খবর আসবে কেউ জানে না। সে মেহেরকে কি বলবে তাও বুঝতে পারছে না।

মঞ্জুই বলল, সমসেরের খবর কি! সে কোথায় আছে?

কোথাও নেই! যাবার আগে বলে গেছে ব্যাগটা যেন আপনার হাতে পৌঁছে দেই। কোথায় থাকবে আমরাও জানি না।

এবার মঞ্জু বলল, ভিতরে আসুন। মিনু আবুল ….।

মেহের মঞ্জুকে কথাটা শেষ করতে দিল না। বোঝাই যাচ্ছে তার কাজ শেষ। সে যত দ্রুত সম্ভব সে এখান থেকে সরে পড়ার চেষ্টায় আছে। কোনও রকমে বলল, কোনও খবর নেই। সমসের ভাইয়ের শেষ কাজ এটা। শেষ ইচ্ছা এটা। বলে ব্যাগটা বাড়িয়ে ধরল।

অবনী বলল, তুই বইসা যা

মেহের বলল, না অবনী কর্তা আমরা সব বর্ডারে আছি। হিন্দুস্থান থেকে সাপ্লাই আসছে। আমরা বাঁচব। আমরা মরব না। আর ভয় নেই। কোন রকমে দু-একটা মাস আর বেঁচে থাকুন। তারপর আর মেহের দাঁড়াল না। অন্ধকারে হারিয়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকালে ক্রের কোন ছায়া মূর্তিকে অপসৃত হতেও দেখা গেল না। ভোজবাজির ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু ব্যাগে কি আছে। তাজা কার্তুজ। অথবা পিস্তল টিস্তল। লড়ার জন্য তৈরি হতে বলে গেল কি লোকটা!

ঘরের মধ্যে সবাই নির্বাক। চামড়ার ব্যাগটা মঞ্জুর হাতে। এটা নিয়ে কি করতে হবে কেউ যেন বুঝতে পারছে না। এমন কি খুলতে শংকা বোধ করছে। দরজা বন্ধ করে অবনী নিজেই ব্যাগটা তুলে নিল হাতে। তারপর টেবিলে রেখে ধীরে ধীরে খুলল ব্যাগটা। তার হাত কাঁপছে। একটা বড় বাণ্ডিল কাগজের। কিছু হিজিবিজি লেখা। আর কিছু নেই ফাঁকা। মঞ্জু বন্সে পড়েছে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সমসেরের হস্তাক্ষর। এলোমেলো লেখা। যেখানে যেমন কাগজ পেয়েছে লিখে গেছে। প্রথম পাতায় কিছু ছাড়া ছাড়া লেখা—আমাদের সংগ্রামের কথা। মান্নানকে মনে হয়েছে এ-কালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। আমরা জানি, শেষ পর্যন্ত আমরা জিতবই। এটা একটা দলিল। হীনতা নীচতার সঙ্গে আত্মত্যাগের দলিল। মানুষের সত্যাসত্যের দলিল। সমসেরের শেষ ডাইরি।

তারপর লিখেছে, ধর্ম মানুষের চেয়ে বড় নয়। মানুষের মধ্যে ধর্মের সহিষ্ণু রূপ ফিরে আসুক।

তারপর লিখেছে, অজ্ঞাতবাস। দু-দিকে দুটো বড় লাইন টেনে দিয়েছে। নিচে তার সই। মঞ্জু সইটা দেখতে থাকল। সইটা দেখতে দেখতে চোখ জলে ভেসে গেল। অজ্ঞাতবাসে কি লেখা আছে—সে ঝাপসা চোখেই প্রথম পড়ল—মান্নানকে নিয়েই প্রথমে সে বোধ হয় কিছু লিখতে চেয়েছে—

সমসের লিখেছে, মান্নান অন্ধকারে চুপি চুপি এসে জামরুল গাছটার নিচে দাঁড়াল। সে অনেকটা রাস্তা হেঁটে এসেছে। গতকাল সারাদিন সে হেঁটেছে। ঠিক একে হাঁটা বলা চলে না। কারণ ভোর রাতের দিকে ওরা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে বুঝেছিল, ওরা হেরে যাচ্ছে, ওদের পরাজয় আসন্ন। এবং সেই মুহূর্তে শেষবারের মতো ওরা যখন মরিয়া হয়ে ব্যারাকের দক্ষিণ লাইনে যাবে তখন প্রচণ্ড গোলা বর্ষণে আগুন লেগে গেলে—ওরা ব্যারাক ছেড়ে চলে এসেছে। পরবর্ত্তী নির্দেশ কি ওরা জানে না। যে যার যতো রাইফেল কাঁধে ফেলে সহর ছেড়ে মাঠ এবং মাঠ পার হয়ে নদী, ওরা যে যার গাঁয়ে নদী পার হয়ে অন্ধকারে অথবা যেখানে বন আছে, বনের ভিতর দিয়ে চলে এসেছে। এখন মান্নান শুধু জানে তাকে কোথাও যেতে হবে। সেটা কোথায় সে জানে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *