2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৬২

।। বাষট্টি ॥

আবেদালি খালি গায়ে নৌকা বাইছে। সামনে বেশিদূর আর লগি মেরে যাওয়া যাবে না। বরং গুণ টেনে নিলে তাড়াতাড়ি হবে। ফিরোজ পাড়ে পাড়ে যাচ্ছে। ওর কাঁধে রাইফেল। এ অঞ্চলে এখনও কোনও আক্রমণ ঘটেনি। চারপাশে বেশ নির্জনতা। তবু সাবধানে যাওয়া ভাল। সে চারপাশটা দেখে আগে যাচ্ছে। সাইকেলটা সঙ্গে নিয়েছে। সে একটু আগে থাকলে সুবিধা, কোন সন্দেহ দেখা দিলেই দ্রুত সে পিছনে ফিরে নৌকায় খবর দেবে।

মিনু তখন নৌকার ভিতরে একপাশে আবুলকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। সে প্রথম আবুলকে একটু ঘুমিয়ে নিতে বলেছিল, কিন্তু আবুল অবনীর পাশে রয়েছে। আবুল নড়ছিল না। মেহের ছইয়ের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে মাঝে মাঝে আবেদালির নৌকা বাইতে কষ্ট হলে তাকে সাহায্য করছে। মেহের বলল, ভাবি বসে থাকবেন না। শুয়ে পড়ুন। একটু ঘুমিয়ে নিন।

সবাই জেগে আছে, সে ঘুমোয় কি করে! মিনু বলছে, ঘুম আসে, বল?

—তবু একটু চুপচাপ শুয়ে থাকুন। আমাদের পালা করে একটু জিরিয়ে না নিলে চলবে কি করে?

কথাটা ঠিক। এ-ভাবে সবাই জেগে বসে থাকলে হবে কি করে? মিনুর ঘুম আসার কথা নয়। সে আবুলকে পাশে নিয়ে শুলো। ঠিক মাথার কাছে আর একজন মানুষ। কোন রা করছে না। শুয়ে থেকেই সে মাঝে মাঝে ডাকছে, অবনীবাবু কিছু কষ্ট হচ্ছে?

অবনী খুব ক্ষীণ গলায় কথা বলছে, না। কোন কষ্ট হচ্ছে না। বোধহয় আবুল ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। জলে পচা গন্ধ উঠছে। মিনু কিছুতেই শুয়ে থাকতে পারছে না। যেন জোর করে শুয়ে থাকা। কেবল ওর ইচ্ছা ছইয়ের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। আর কত সময়, কতক্ষণ লাগবে শেষ চৌকিটা পার হতে? যত এগিয়ে যাচ্ছে তত ওর চোখ-মুখে অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠছে। সে একবার বসছে, একবার বাইরে এসে দাঁড়াচ্ছে, একবার অবনীর মাথার কাছে বসে টর্চ মেরে ব্যাণ্ডেজটা দেখছে। কেমন নিস্তেজ চোখ-মুখ। অধিক রক্তপাতে মুখটা বুঝি সাদা হয়ে গেছে। এবং মুখের উপর সামান্য টর্চের আলো পড়তেই বুঝল অবনী ওর ভয়ঙ্কর কষ্ট কাউকে বুঝতে দিতে চাইছে না। সে দাঁত খিঁচিয়ে পড়ে আছে।

এখন আর কিছু ওরা করতেও পারছে না। এভাবে ওরা যেন এই সব শক্ত কঠিন মুখ দেখে আরও বেশি সাহসী হয়ে যাচ্ছে। নতুবা মিনু জানে, অন্য সময় হলে সে এতটুকু স্থির থাকতে পারত না। সে ছটফট করত ভীষণ। এখনও যে করছে না তেমন নয়, তবু সে কোথায় যেন একটা সাহস পাচ্ছে, যা তাকে ভেঙে পড়তে দিচ্ছে না।

সে এবার বাইরে এসে দাঁড়ালে মেহের বলল, ঘুম হয়ে গেল?

মিনু ঘুমের কথা না বলে বলল, ফিরোজকে দেখা যাচ্ছে?

মেহেরের হাই উঠছিল। সে হাই তুলতে তুলতে বলল, না।

—ওটা কি গ্রাম?

—জানি না ভাবি।

—গ্রামের নাম জানেন না?

—না ভাবি। আবেদালি বলতে পারবে। বলে সে ওপাশের কাউকে উদ্দেশ্য করে বলল, ওটা কি গ্রাম রে?

—মাঝের চর।

—তারপর তো কোন গ্রাম দেখা যাচ্ছে না।

—সব মাঠ দু’পাশে।

—এখানে বড় একটা মেলা হয় চৈত্রমাসে।

—কবে হবে?

—কবে হবে! বলে আবেদালি হিসাব করে বলল, আর চার-পাঁচ দিন পরেই হবে। মেলার তো কোনও কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

—এখন আলিপুরাতে মেলা বসার কথা। মেলার জন্য প্রচুর নৌকা এসেও ছিল। কিন্তু মেলা এবার হবে না, সব ছত্রভঙ্গ। নৌকাগুলি আটকে দিয়েছে।

—আমাদের বড় জায়গা কোনটা? মিনুর মাথা থেকে ঘোমটা সরে গিয়েছিল, সেটা একটু তুলে আবেদালিকে প্রশ্ন করল।

—আলিপুরার বাজার।

—বাজারে তবে সেই সব নৌকা থাকছে?

—থাকবে।

—আচ্ছা আমাদের পিছনে দুটো নৌকা আসছে দেখতে পাচ্ছ?

আবেদালি বলল, মনে হচ্ছে এগুলো পাশের গাঁয়ের নৌকা। ওরা শহর থেকে আসে নি।

—একটা ব্যাপার তোমরা লক্ষ্য করেছ কিনা জানি না, কিন্তু আমার কাছে বড় বিস্ময়ের মনে হচ্ছে।

এমন কথায় মেহের এবং ফিরোজ উভয়ে কেমন সহসা চমকে গেল। ওরা বলল, কিছু তুমি বুঝতে পারছ?

—না, বুঝতে পারছি না।

আবেদালি লগিটা এবার ছইয়ের মাথায় গুঁজে দিল। লাফ দিয়ে সে ছইয়ের মাথায় উঠে দুটো বৈঠা দুদিকে ঠেলে ফেলে দিল, তারপর ছপ্ ছপ্ করে দাঁড় বাইতে থাকলে মিনু বলল, আলিপুরার বাজারের চৌকিতে সব নৌকা দেখে ছাড়ছে। একমাত্র ফ্যামিলি থাকলে খুব একটা বেশি দেখছে না। সব বুঝলাম। কিন্তু এ পথে তো নৌকাই আসছে না। এটা শহর থেকে প্রায় আট দশ মাইল হবে, ওরা নৌকা চেক করবে বলে আমার মনে হয় না।

মেহের বলল, তুমি ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারছ না। পাঁচ-ছদিন থেকে যত নৌকা শহর থেকে ছেড়েছে সব পঞ্চমীঘাটের কাছে আটকে দিয়েছে। নৌকা ছাড়ছে না। যা খবর, তাতে আমরা জানি হাড়ি-পাতিলের নৌকা, বাঙ্গির নৌকা, তরমুজের নৌকা সব পঞ্চমীঘাটের কাছে আটকে দিয়েছে। নৌকা ছাড়ছে না।

আবেদালি একটা বিড়ি ধরাল, এবং চোখে-মুখে তার বিড়িটার আস্বাদ ধরা পড়ছে। দুটো টান মেরে সে বিড়িটা ছুঁড়ে দেবার সময় বলল, আমাদের সবই শোনা কথা ভাবি। তবে যা মনে হচ্ছে আমার, সব নৌকাই একজায়গায় আটকে দিচ্ছে। ওরা যখন খুশি হবে দেখে শুনে ছাড়বে।

সামনে তখন তিন-চারটে নৌকায় করলা ঝিঙে। শহরে যাবার কথা তাদের। শহরে যাচ্ছে না। ওগুলো যাবে খাড়ি নদী ধরে শীতলক্ষ্যায়। কোথাও পথ নেই। বোধহয় ওদের সব নষ্ট হয়ে যাবে। ওদের একজন মাঝি বলল, দুটো একটা করে নৌকা ছাড়ছে। সার্চ করে ছেড়ে দিচ্ছে।

আরও খবর, যাদের সন্দেহ হচ্ছে ওদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর গুলির আওয়াজ। যেখানে ছাউনি পড়েছে সেদিকটায় আর কোন লোকালয় নেই। সব খালি হয়ে গেছে।

ওরা যাবার সময় আরও দুটো একটা নৌকা দেখতে পেল। এখানে নদীটা বেশ প্রশস্ত। এবং নৌকা চালাতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। দু-পাড় খাড়া। বোধহয় বর্ষায় পাড় ভাঙার জন্য দু-পাড় এত বেশি খাড়া হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও খণ্ড খণ্ড জমি ফাটল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোন সময় যেন নদীর জলে ভেঙে পড়বে। অথচ ওরা জানে পাড় ভেঙে পড়বে না। বর্ষা না এলে এবং খরস্রোতে জল না নেমে এলে এই সব কানি দুকানি জমি নিয়ে ফাটল ভেঙে পড়বে না। ওরা সেজন্য যতটা পারছে কিনারে কিনারে থাকছে।

মিনু যে কি করবে! এবং ভয়েই যেন সে আবার হাত দিয়ে অবনীকে দেখতে সাহস পায় নি। মাঝে মাঝে ডাকলে তন্দ্রার মত অবনী উত্তর দিয়েছে। সে যদি ঘুমায়, যদি তার ঘুম আসে, এই ভেবে মিনু তারপর আর ডাকেনি পর্যন্ত। অনেকক্ষণ হল ওর কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং এখন যা কিছু কাজ আমিনুল করবে। অথচ আশ্চর্য, আমিনুল একপাশে ঘাড় গুঁজে বসে রয়েছে। এমন কি সে যে আছে নৌকায়, বোঝাই যাচ্ছে না।

মিনু এবার ছইয়ের ভিতর দিয়ে ওপাশে উঠে গেল। উঠে গিয়ে দেখতে পেল, আমিনুল চুপচাপ বসে নেই। সে তালপাতার পাখা দিয়ে অবনীর মাথায় বাতাস করছে। সে ওর পাশে বসে বলল, তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও আমিনুল। আমি বাতাস করছি।

আমিনুল বলল, ভাবি, এখন কথা বলবেন না। আমরা কিন্তু আর বেশি দূরে নেই।

মিনু বলল, কতদূর আর?

সে হাত তুলে দেখাল, উপরের দিকে দ্যাখেন।

মিনু উপরের দিকে তাকাল।

—একটা ছায়া মত গাছ, বড় গাছ দেখা যাইতেছে, না?

মিনু গাছটাকে খুঁজে পেল না। বস্তুত, আকাশের নিচে শুধু বড় একটা নক্ষত্র জ্বলছে। এবং আকাশ কেমন কৃষ্ণকায় অদ্ভুত এক অস্পষ্ট ফলার মত মাথার উপরে জেগে আছে। সে বলল, না, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

ওরা এ-ভাবে যাচ্ছিল। এবং যেতে যেতে মনে হল আরও সব নৌকা চলে আসছে। এবং নৌকাগুলো যে ভয় পেয়ে যে যার মত ছুটে চলে যাচ্ছে, নৌকার চলে যাওয়া দেখে তা ধরা যাচ্ছে। আরও কাছে গেলে ওরা টের পেল অনেক নৌকায় লোকজন নেই। ওরা নৌকা ছেড়ে পালিয়েছে। এবং মনে হয় দু’পাশের জমিতে কিছু লাশ পড়ে আছে। নদীর জলে লাশ। ওরা বুঝতে পারল, যারাই নৌকা ছেড়ে পালাতে গেছে তাদের দিকে খান সেনারা মেশিনগান দেগেছে। অথচ আশ্চর্য, এখন মনেই হয় না ওপারের ছাউনিতে কোনও লোক আছে। কেমন নিঝুম হয়ে আছে সব। কেবল মাঝে মাঝে নৌকার শব্দ, লগির শব্দ। কোন মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *