2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৫৭

॥ সাতান্ন ॥

সমসের ওদের বিদায় দিয়ে কিছুক্ষণ মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। নানু মিঞা দাঁড়িয়ে আছে গোলাপজাম গাছটার নিচে। সে সমসেরকে নিয়ে ফিরবে। কিন্তু সমসের মাঠের দিকে সেই যে তাকিয়েছিল, আর পেছনে ফিরে তাকাবার কথা ভাবে নি। কেউ ওর জন্য গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে তাও তার মনে নেই। যেন তার এখানেই দাঁড়িয়ে থাকার কথা, এবং এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার ভোর হয়ে যাবে।

নানুমিঞা ডাকল, চলেন।

সমসের পিছনে তাকালে দেখল নানুমিঞা তেমনি হ্যারিকেন হাতে। চিমনিতে কালি পড়ে গেছে বলে, উপরটা অন্ধকার। হ্যারিকেনের আলোতে নানুমিঞার কোমর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বাকিটা অস্পষ্ট। সে সিঁড়ি ধরে নেমে নানুমিঞার কাছে গেল। এবং কাছে গেলে বুঝল নানুমিঞাও এখন ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ার জন্য পীড়াপীড়ি করবে তাকে। ওদের পাঠিয়ে দিয়েও কোথাও যেন এক অনিশ্চয়তা, এবং চারপাশ থেকে যা খবর আসছে—সব মৃতুর খবর, আর সব নিপীড়নের কথা শুনলে সে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। এতক্ষণে হয়তো অবনী, মিনু আবুলকে নিয়ে আলিপুরার বাজার ডাইনে ফেলে ক্রমে আরও উত্তরে এগিয়ে যাচ্ছে। আলিপুরার বাজারের ওপাশে খানেরা ছাউনি ফেলেছে। ঘাট পারাপার হতে দিচ্ছে না। যদি কাঠের বাক্সটা ধরা পড়ে, কি যে হবে! এবং বুলেটে বিদ্ধ প্রিয় সন্তানের মুখ অথবা ছোট্ট সেই মেয়েটি, কখনও মিনুর আশ্চর্য কোমল মুখে পীড়নের ছবি মনে হলে সে স্থির থাকতে পারে না। সে মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি সব ভাবছিল। ওর সব, সব বলতে সে যা বোঝে, সব তার এখন নৌকায়। সে এতসব করবার পরও কেন জানি স্থির থাকতে পারছে না।

নানুমিঞা বলল, কি ভাবছেন?

—কিছু না, চলুন।

কিছুদূর এগিয়ে সমসের বলল, যদি মেহের ওরা ফিরে না আসে, এখানকার সব ভার আপনার থাকবে।

—কি যে কন! আমি পারি?

—নিশ্চয়ই পারবেন।

যেতে যেতে নানুমিঞার মুখ সহসা কেমন সুখী মানুষের মত মনে হল।

—এত বড় কাজকর্মে আমার মত মানুষ লাগে জানতাম না।

সমসেরের এত বিনয় ভাল লাগছিল না। সে বলল, মেহের ফিরে এলেও আপনাকে চার্জ বুঝে নিতে হবে। আমি মেহেরকে অন্য জায়গায় পাঠাব।

—কোনখানে?

—সে আছে—।

নানুমিঞা জানে সে বেশি কিছু আর প্রশ্ন করতে পারবে না। নিয়ম নেই। পুকুরের পাড় ধরে হেঁটে আসছিল। পানি কম, পানি কম বললে ভুল হবে, প্রায় নেই, পানি ঘোলা এবং গরু-বাছুর স্নান করিয়ে পানির আর কিছু নেই। সেইজন্য ওরা পুকুরে নেমে হাত মুখ ধুল না। পাশের টিউবওয়েলে হাত-পা ধুল। সমসেরের চোখ জ্বালা করছে বলে মুখে-চোখে পানির ঝাপটা দিল বেশি করে।

ঘরে ঢুকে দেখল সমসের, পরিপাটি করে বিছানা করে রেখেছে নানুমিঞার দ্বিতীয়পক্ষের বিবি। পানির গ্লাসে পানি রেখেছে। টেবিলের ওপর দুটো বই। এবং নিচে, ঠিক তক্তপোশের নিচে, বদনা, বড় থালা, রেকাবিতে পান, এসব দেখে সমসের মনে মনে হাসল। ওরা জানে না, ওর শুয়ে থাকার সময় আর নেই। নানুমিঞা হ্যারিকেন একটু নিভু নিভু করে রাখবে কিনা ভাবছিল, এবং সমসের শুয়ে পড়লে নিভিয়ে দেবে কি না, অথবা নানুমিঞা দাঁড়িয়ে আছে, কতক্ষণে সমসের শোবে, শুয়ে পড়লেই মশারি ফেলে দেবে, গুঁজে দেবে। এমন মানী মানুষ ওর বাড়িতে রাত কাটাচ্ছে, এবং এখানে থেকে যাবে কিছুদিন। অন্ততঃ এখানকার কমাণ্ড—যতদিন মেহের ফিরে না আসে, সেই দেখাশোনা করবে। এই যে রাস্তায় আসতে আসতে বলা, নিশ্চয়ই পারবেন–সবই বুঝি ঠাট্টাচ্ছলে। সুতরাং সে কতক্ষণে সমসের শুয়ে পড়বে, এবং শুয়ে পড়লে মশারি গুজে দেবে এমন যখন ভাবছিল, তখন সমসের চুপচাপ, এবং দেয়ালে ঘড়ি দেখছে, টিক টিক ঘড়ির কাঁটা বাজছে, বেজে চলেছে, সে হ্যারিকেনের আলোতে ঘড়ির কাটা দেখতে পাচ্ছে না, সে তাড়াতাড়ি উঠে নানু মিঞার কাছ থেকে হ্যারিকেনটা নিয়ে একটু ওপরে তুলে কটা বাজে দেখল। একটা বেজে গেছে। গভীর রাতে সে যদি সাইকেলে সোজা পথে অর্থাৎ ভয়ের পথ ধরে, বিপদের পথ ধরে যায়, তবে বেশি সময় নেবে না। প্রায় ওদের সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পৌঁছে যাবে।

সমসের বলল, বারো নম্বর কুটিরের ফাইলটা দিন।

এত রাতে ফাইল-পত্র নিয়ে বসা, অবশ্য যা সময়, কিছুই বলা যায় না, কখন কি হবে কেউ জানে না। সুতরাং নানুমিঞা উবু হয়ে বসল। তারপর ভাঙা তোরঙ্গ ঠেলে, একটা কাঠের বাক্স থেকে ছোট ক’টা চিরকুট তুলে বলল, বারো নম্বর দিলাম। দেখেন, ঠিক আছে কি না।

সমসের ছাপ এবং হাতের লেখা দেখে টের পেল, ঠিক আছে। সে তার ওপর খচখচ করে কি লিখল। তারপর চিরকুট ক’টা ওর হাতে দিয়ে বলল, এখানে যে-ই ফিরে আসবে, তাকে চিরকুটগুলি দেখাবেন। চিরকুটগুলি দেখলেই ওরা আপনাকে মেনে নেবে। আপনার নির্দেশে কাজ করবে।

নানুমিঞা এতটা ভাবে নি। সে এ অঞ্চলে অনেকটা যোগাযোগের কাজ করে যাচ্ছিল। ওর জমি আছে, বাড়িতে গোলা আছে। ছেলেরা বড় হয়েছে। দুই ছেলের সাদি দেবে ভাবছে, সে মান্যগণ্য মানুষ এলে একটু দেখা সাক্ষাৎ করে সুখ পায়। সে নিজেও একজন মানী মানুষ। ভোটের আগে কি না খেটেছে। তারপর ধীরে ধীরে সে কোথায় চলে এল। আগে তার মনে হ’ত সে মুসলমান, তাবৎ মুসলমান মানুষ দুনিয়ার তার জাতভাই, সব আপন, এখন সে আর তা ভাবতে পারছে না। এই মাটি অথবা গাছের ফল আর বেতঝোপে যখন বেতফল পেকে থাকে, তখন কেন জানি কোন মরুভূমি সদৃশ অঞ্চলের সঙ্গে একটা সে তফাৎ খুঁজে পায়। এবং সে যখন শহরে যায়, সেই সব খান মানুষেরা, সে দেখেছে, ওদেশ থেকে যারাই এসেছে তারাই কেমন লম্বা এবং বলশালী আর কটা চোখ! কটা কখনও, কখনও কি ফর্সা দেখতে! ওদের বড় ঘৃণা করত। সে দুঃখী মানুষের মত মুখ করে গঞ্জ থেকে ফিরে এলে সেই যে কে যেন একটা বাংলা গান গেয়েছিল, গানটা কেবল মনে পড়ে যায়, ছিল ধান গোলা ভরা শ্বেত ইঁদুরে করল সারা—এমন গান মনে এলে সে বুকে বল পায়। সে এখনও বুঝি সেই গান শুনতে শুনতে অসীম এক বলশালী মানুষ হয়ে গেলে, টের পায় সমসের উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর হাতে সব দিয়ে বলছে, আমাকে কিছু কার্তুজ, একটা রাইফেল দিতে হবে। সোজা পথে যাচ্ছি।

সমসের আর কিছু বলল না। বস্তুত সে বলতে চাইল না। সে তার স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তানকে যে ছেড়ে দিয়েছে নেকড়ে বাঘের কবলে, এখন তা টের পেয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। এসব নানু- মিঞা যাতে টের না পায় সেজন্য সে বলল, মেহেরকে সাহায্য করার জন্য আরও লোকের দরকার। ১৭ নম্বর কুটির থেকে পাঠাতে পারতাম, কিন্তু যা রসদ আছে, দু-একদিনের ভিতরে এ অঞ্চলে আক্রমণ ঘটতে পারে। যদি তাড়াতাড়ি আর একটা অঞ্চল গড়ে তুলতে না পারি, তবে আমরা সরে পড়ব কোথাও। কাজ সারা হলে আমি আর মেহের বের হয়ে পড়ব। দন্দি পরাপরদির কাছে আমার মনে হয় আর একটা মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে পারব।

নানুমিঞা হ্যারিকেন রেখে ভিতর-বাড়িতে ঢুকে গেল। ছোট একটা করমচা গাছ। গ্রীষ্মের সময় বলে করমচা গাছের পাতা কম। গাছটা ঝোপের মত, তার নিচ দিয়ে উঠে যেতে হয়। এবং একটা মই লাগালে বেশ উঁচু হয়ে যায় জায়গাটা। সমসের মই বেয়ে উপরে উঠলে ‘কাড়’ হাতের নাগালে পেল। এবং সেখান থেকে টেনে বের করে চার নম্বর কুটিরে যে রাইফেল যাবার কথা, তার একটা নামাল। বাক্স থেকে কিছু কার্তুজ। সে গুনে গুনে পনেরোটা নিল। পাঁচটা করে তিনবার সমসের লোড করতে পারবে।

সমসের পনেরোটা কার্তুজ নিল না। সে তা থেকে আবার পাঁচটা কি ভেবে রেখে দিল। একটা জানের বিনিময়ে একটা কার্তুজ, এমন নির্দেশ আছে। সুতরাং সে ইচ্ছামত কার্তুজ নিতে পারে না। সে কোমরে একটা থলের ভিতর কার্তুজগুলো রেখে দিল। নানুমিঞা সাইকেল আনতে গেছে। সে রাইফেলের নল খুলে আলোর মুখে নলটা চোখে রেখে দেখল। ভিতরে ময়লা পড়ে থাকতে পারে। দেখল, না, বেশ সাফ আছে নলটা। এখানে যে কটা রাইফেল আছে, সব দেখা-শোনা করে নানুমিঞার ছেলেরা, বিবিরা। এবং নিশ্চিন্ত এটা একটা ওদের বড় ঘাঁটি হয়ে গেছে। কোনও সন্দেহজনক লোক ঘোরাফেরা করলে ধরে আনা হয়, জিজ্ঞাসাবাদের পর নিশ্চিন্ত হলে ছেড়ে দেওয়া হয়, না হলে ছ’নম্বর কুটিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই কুটির নদীর পাড়ে। ওখানে কি যে হয়, নানুমিঞা বলতে পারে না।

এভাবে একটা জাতি ভিতরে ভিতরে লড়ছিল। অথবা বলা যায় লড়াই আরম্ভ করে দিয়েছে। ঈশ্বর এবং আকাশ দুই ওদের কাছে বড় হয়ে নেই। আছে মানুষ। মানুষ বলতে বোঝে ওরা নদী-নালার মানুষ। মাঠ পার হলে যে মসজিদ-মন্দির অথবা গঙ্গা-পদ্মার পানি বয়ে যায় তার পাশে থাকে এক বটবৃক্ষ, সেই গাছের নিচে দাঁড়ালে, দেশটাকে খুব বড় মনে হয়।

নানুমিঞা এই বয়সে কত খাটতে পারে! সে সাইকেল এনে রেখে দিল। সমসের বাইরে এসে দাঁড়ালে সে দেখল সমসেরের কাঁধে রাইফেল, চোখে চশমা। নানুমিঞা বলল, অন্ধকারে ঠিক পথ চিনা যাইতে পারবেন তো?

—ঠিক যেতে পারব।

—চোখে কম দ্যাখেন শুনছিলাম?

—চোখে এ সময় কম দেখলে চলবে কি করে। বলে হাসতে হাসতে সাইকেল চালিয়ে অদ্ভুত গতিতে সমসের মিঞা গাছপালার ভিতর অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *