।। চুয়ান্ন।
সমসের এখন একটা বাঁশের মাচার উপর বসে রয়েছে। শরীরে জ্বরটা বাড়ছে। শীত শীত আর করছে না। ওর যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, কিছুতেই মিনুকে অথবা অবনীকে বলেনি। বললে হয়তো মিনু আরও দুর্বল হয়ে পড়ত। অবনী অথবা আমিনুল ভাবত সে ভয় পেয়েছে। সে সব সময় শক্ত থেকেছে। এমন কি সিঁড়ি দিয়ে পাড়ে ওঠার সময়ও পিছনে তাকায়নি। সে পেছনে ফেলে এসেছে যাদের তারা বুঝি ওর কেউ নয়! তারা সবাই বাংলাদেশের মানুষ। সে নিজেকেও একমাত্র এখন বাংলাদেশের মানুষ বলে ভাববার চেষ্টা করছে। সে অনেক দূর ঝোঁকের মাথায় হেঁটে এসেছে। একবারও পিছনে তাকায়নি।
পিছনে তাকালেই এখন যেন বড় একটা শিমুলের বন দেখতে পাবে। গাছের গুঁড়িতে মুখ অদৃশ্য করে গোপনে মা আর ছেলে মানুষটাকে দেখছে। ভারি মজা পাচ্ছে ওরা। চোখ দুষ্টুমিতে ভরা। ওরা দুজনেই দেখছে সমসেরের আকুল চোখ। সে ধরা পড়ে যাবে এমন ভাবতেই আরও জোরে হাঁটছে। ওরা ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে বড়। সে প্রায় অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ছুটছে। সে নিজের উপর সমস্ত বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। দ্রুত পা ফেলে যেন সে এই অন্ধকার ভেঙে আকাশের নক্ষত্র গুনতে গুনতে এখন মাঠ পার হয়ে যাচ্ছে। কে বলবে, এখন, সমসের যাচ্ছে, সমসের এক মানুষ, যার ভালবাসার মিনু, নাবালক ছেলে আবুল যুদ্ধক্ষেত্রে এবং সে একা এক মাঠে নিঃসঙ্গ মানুষের মত দু’হাত উপরে তুলে বলছে, আল্লা তুমি আমার আশৈশব ছিলে, এখনও আছ। তোমার অদৃশ্য হাত আমার চারপাশে। আমার চারপাশে যা কিছু আছে এই মাঠ নদী, বাংলাদেশে, সবই আমার কাছে মিনুর দুই চোখে ভাসে। আমি ওর চোখ ছুঁলে টের পাই সব। তোমাকে অনুভব করি। এখন আমি তাদের ভাসিয়ে দিয়ে সূর্য ধরতে যাচ্ছি।
সে এসব কথা ভেবেই নিজের ভিতর সাহস সঞ্চয় করছিল। সে অন্ধকার মাঠে এসে কোন পথটা গোয়ালদি গেছে খুঁজে খুঁজে দেখছে এখন। যখন পথ খুঁজে পাচ্ছে না অথবা ভুল করছে, তখন সে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এত নিঝুম হয়ে আছে সব এবং কোথাও সে একটা লন্ঠন পর্যন্ত জ্বলতে দেখছে না। সে শুধু জানে পূবদিকে হাঁটলেই গ্রামটা পাবে। গ্রামটা যে গোয়ালদি সে টের পাবে, একটা অশ্বত্থ গাছের নিচে কুটিরে কিছু লোকজন জেগে থাকবে। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সজনে ফুল বললেই ওরা ওকে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাবে। এবং পথের শেষে যদি কোন আর পথ না থাকে তখনই যত ভয়। সে দাঁড়িয়ে পড়েছে। থমকে পড়ছে। কেউ ডাকছে পিছনে মনে হলেই ছুট। ছুটতে ছুটতে একটা ঝোপ মত দেখতে পেল। বাঁশের মাচা দেখতে পেল। গ্রামের শেষে ছোট্ট চায়ের দোকান। নিভু নিভু আলো জ্বলছে। কুপির আলো। ওর ভীষণ জল-তেষ্টা পেয়েছে, দাড়ি সে তিন-চারদিন থেকে না কামিয়ে আছে। ফলে মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। বড় উত্তেজনা গেছে। রাতে ঘুমোতে পারছে না। কি যে হবে! লোকটা ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখে এবং চোখের মুখের এমন অবস্থা দেখে ঠিক ভেবে ফেলতে পারে শহর থেকে তাড়া-খাওয়া মানুষ। সে নানাভাবে তাকে প্রশ্ন করবে—শহরে আমাগো ফৌজেরা লড়তাছে ক্যামন?
—মিঞা মনে লয় আমি যাই। বলে হয়তো সে তাকে বলবে, কি লাগবে কন? দিতাছি। পয়সা লাগব না।
আবার এও মনে হয়, গ্রামটাতে সেই সব মানুষেরা থাকে, শোষণের নামে নিজেদের বাংলাদেশের মানুষ ভাবছে না। কত রকমের মানুষ যে গজিয়ে উঠেছে। সে সবাইকে এখন ঠিক চিনতে পারছে না। ফলে সর্বত্র তাকে খুব সাবধানে চলা-ফেরা করতে হচ্ছে। সে ইচ্ছা করলেই আঁজলা পেতে পানি চাইতে পারে না। তবু সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে দোকানীকে দেখছিল। কেউ নেই দোকানীর কাছে। দোকানী এবার ঝাঁপ বন্ধ করবে। দিন-কাল খারাপ যাচ্ছে বলে মানুষজন রাতে চলাফেরা বন্ধ করে দিয়েছে। কখন ওরা একটা গ্রামকে ভেবে ফেলবে—ওটা মুক্তি যোদ্ধাদের গ্রাম। সুতরাং জ্বালিয়ে দাও। যারাই পালাতে চেষ্টা করবে, বুলেট বিদ্ধ করো। নিরিবিলি সংসারে কায়ক্লেশে দিনযাপন যাদের, তারা কেউ কেউ উটকো ঝামেলা ভেবে আগু পিছু ঠিক করতে পারছে না। সমসের দোকানীর মুখ দেখে কোন জাতের মানুষ প্রথমে টের পাবার চেষ্টা করল। তেষ্টায় বুক ফাটছে। চোখ জ্বলছে। একটু পানি না খেলে সে মরে যাবে। ছাতি ফেটে মরে যাবে। শুধু কাছে যাবার আগে অন্ধকারে একটু দেখে নিল। তারপর কাছে গিয়ে ছায়ার মত দাঁড়াতেই দোকানী বলল, কেডা?
সে বলল, পানি আছে মিঞা? পানির তেষ্টাতে বুক ফাটে।
লোকটা ওকে মুখ তুলে দেখলে না পর্যন্ত। পানি যে চায় তাকে আর কোন প্রশ্ন করতে নেই। সমসেরকে সে বলল, ব’স। পানি আনতাছি। বোধ হয় এটা কোন এগ্রিকালচার অফিসের বাংলো। দোকানী বোধ হয় বাংলোর দারোয়ান। শহর থেকে সাহেবরা এলে সে তদারক করে। এখন বাংলোতে কেউ নেই। অন্ধকারে শুধু জোনাকিপোকা জ্বলছে। কিছু কীট-পতঙ্গের আওয়াজ। লোকটা বোধহয় এই মাঠের ভিতর বিলের পাশে সংসার পেতেছে। কারণ এতক্ষণে সমসের বুঝতে পারল এটা গ্রামের শেষ নয়। বরং বলা চলে বড় বিলে যাবার পথে এটা প্রবাসের মত বাড়ি-ঘর। একটা কুকুর ডাকছে। পানির জন্য সে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটার আর একটা ঘর ঠিক দোকানের পিছনে। এবং দুটো পেঁপেগাছ বাড়িটার মাথায়। কিছু কলাগাছ আর ফিসফিস কথা
সমসেরের মনে হল এটা ঠিক করেনি। ভিতরে ফিসফিস করে কেউ কথা বললেই সে ভয় পায়। দু দশজন মানুষকে সে ভয় পায় না। ওরা তার কেউ কিছু করতে পারবে না। কারণ সে ইচ্ছা করলে একটা বড় দলকে রিভলবার দেখিয়ে আটকে দিতে পারে। সে মৃত্যুর জন্য ভয় পায় না। অযথা ঝামেলা বাধানো এসময় একেবারেই উচিত নয়। সে একটু কষ্ট করে এগিয়ে গেলেই পারত। বেশি দূর হলে আর ক্রোশখানেকের মত পথ। সে এখন কি করবে ঠিক করতে পারছে না।
লোকটা এল এক বদনা জল নিয়ে। হাতে মাটির সরা। সরাতে মুড়ি-গুড়। সে এসেই সমসেরকে বলল, ব’ন। খালি পেটে পানি খাইতে নাই। মুড়ি খান। মুড়ি-গুড় খান
এমন যে মানুষ তাকে অবিশ্বাস করতে নেই। কেন যে মনের ভিতর এখন অপরিচিত মানুষ দেখলেই ভয়। সমসের বলল, কিছু খামু না।
—কি যে কন!
যেন এমন হয় না। হতে নেই। হলে খারাপ। হলে সে সংসারী মানুষ, সংসারী মানুষের অমঙ্গল হবে। পানি চাইলে খালি পানি দিতে নাই। দিলে খারাপ। দিলে গুণা। সে বলল, না খাইলে আমার গুণা হইব সাব।
মানুষটা ঠিক টের পেয়ে গেছে—ওরা সেই মানুষ, যারা এখন বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করছে।
দোকানী বলল, আপনে খান। ডর নাই। আমি আছি, আমার বিবি আছে আর আছে একটা হাসুয়া। খানেরা নাই।
সমসের পানি খেল। দুঃখ পাবে বলে সে তাড়াতাড়ি মুড়িটাও খেয়ে ফেলল। সমসেরকে সে প্রশ্ন করল, এত রাইতে কই যাইবেন?
সমসের উত্তর দিল না। বাঁশের মাচায় বসে থাকতে তার ভাল লাগছে।
হাঁটতে গেলেই মনে হচ্ছে কপালটা ছিঁড়ে পড়ছে। মাথাটা ভারি। পনি খেয়ে সে বল পেয়েছে। ওরা হয়ত এখন খাঁড়ি নদীর মুখে। মুখের দু পাড়ে মিলিটারি বেস আছে। প্রত্যেকটা নৌকাই খাঁড়ির মুখে তারা চেক করবে। বিপদের মুখে ওরা কি ভাবে যে পার হবে। সমসের কেবল সেই নৌকা, নৌকায় মিনুর মুখ, আবুলের অর্থহীন বোকা বোকা চোখ এবং অবনীর শক্তসমর্থ চেহারার কথা মনে করতে পারছে। ওরা শেষ পর্যন্ত না পারলে রূপগঞ্জ থানা, আড়াই হাজার থানা এবং দক্ষিণে বৈদ্যেরবাজার থানা একটাও ওরা দখল করতে পারবে না।
সমসেরকে বড় চিন্তিত দেখাল। সে আর বসে থাকতে পারছে না। বসে থাকলেই কুড়েমিতে তাকে পেয়ে বসছে। সে এবার উঠে দাঁড়াল। পাশের মানুষটা তাকে যেন এখন কিছু বলতে চায়। সে কি বলবে তাও যেন তার জানা। সে বলবে, এই রাইতে আর কোন খানে যাইবেন? এইখানে থাইকা গেলে ভাল হয়!
সমসের এবার ওকে বলল, কোন গন্ডগোল হয়েছে এদিকে?
—হইবে মনে লয়।
আর কোনও প্রশ্ন করতে তার সাহসে কুলাল না। সে এবার মাঠের দিকে হাঁটতে থাকল।
লোকটা তখন সঙ্গে সঙ্গে আসছে। সে বলল, তুমি আমার সঙ্গে কোথায় যাচ্ছ?
—একটু আওগাইয়া দেই।
—না না, আমি ঠিক চিনে যেতে পারব।
তখন লোকটা বলল, সজনে ফুল।
সমসের ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল। ওর আগেকার ব্যবহার এবং এখনকার ব্যবহারে কত তফাৎ। সে বলল, সজনে ফুল।
লোকটা এবার বলল, এডা সোজা পথ না। আর পথটা ভাল না। আমার লগে আসেন। ঠিক পথে নিয়া যাই।
—বাড়িতে বলে এলে না?
—আপনের দেরি হয়ে গেল। এত দেরি দেইখা ঝাপ বন্ধ করমু ভাবছি। আর দেখি তখন আপনে।
—ওদের সঙ্গে দামগড় পর্যন্ত গেছি। সেখান থেকে হেঁটে আসছি।
—আপনার সাইকেলে আসার কথা—
—সাইকেলে আসা গেল না। বন্দরের মুখে ওরা পল্টন সাজিয়ে বসে আছে।
সমসের হাঁটতে হাঁটতে বলল, তোমাকে এখানে কে রেখেছে?
—আমার বাস এহানে। মোড়ে মোড়ে আপনের লাইগা মানুষ আছে আমাগো।
সমসের বুঝল ওদের সাবধানতার শেষ নেই। ওর পোষাক এবং মুখ আর চশমা এবং সরু গোঁফ, চুল ছোট করে ছাঁটা, পাজামা, পাঞ্জাবি, সব মিলে যেন তাদের কাছে একটা ছবি হয়ে আছে। সে যেখানে যে ভাবে থাকুক, ওরা চিনে ফেলবে। যেখানে যে কোনও বিপদে পড়ুক দেখতে পাবে সে, চারপাশ থেকে সবাই ছুটে এসে ওকে রক্ষা করছে। সে যদি এভাবে নৌকার চারপাশে দুর্ভেদ্য দূর্গ তৈরী করতে পারত! কি ভেবে সমসের এবার সজনে ফুলকে বলল, তুমি যাও। আমি ঠিক চিনে যেতে পারব।
সজনে ফুল বলল, আমাগো কাছে নির্দেশ আছে, আপনেরে পাইলেই নিয়া যামু।
সমসের এবং সজনে ফুল এখন একটা উঁচু টিবিতে উঠে যাচ্ছে। তারপর ছোট্ট একটা খাল এবং বাঁশের সাঁকো। আম জাম গাছের ঘন একটা অন্ধকার ওপারে। সে সেই ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি অনর্থক কষ্ট করছ।
সে বলল, কষ্ট কইরা দেখি পার পাই কিনা!
সমসের আর কিছু বলল না। আম জাম গাছের অন্ধকারে সরু পায়ে-হাঁটা পথে ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল।
আর তখন সেই খাঁড়ির মুখে, দুই তীরে খানেরা পাহারা দিচ্ছে। খাঁড়ির মুখে সব নৌকা আটক করে দিয়েছে। অথবা পাড় থেকে সার্চলাইট জ্বেলে যা কিছু নদীতে দেখছে, এমন কি একটা মরা গরু ভেসে গেলেও ওরা বুলেটে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। কিছু নৌকা ফিরে যাচ্ছিল, অথবা কিছু নৌকা ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর ভিড়িয়ে দিয়েছে। জল ভেঙে সোয়ারিরা হাঁটা-পথে মাঠের দিকে উঠে যাচ্ছে। আমিনুল অন্ধকারেই টের পেল, আর একটু এগুলেই সেই আলোর মুখে পড়ে যাবে। খাঁড়ির মুখে কাল পর্যন্ত রাতের অন্ধকারে কোনও আলো ফেলার ব্যবস্থা ছিল না। খানেরা টের পেয়ে গেছে এই পথে কাল থেকে ঘাসি অথবা গহনা নৌকায় আর্মস পাচার হচ্ছে।
ঘাসি অথবা গহনা নৌকা দেখলেই মর্টার দেগে নৌকা জলে ডুবিয়ে দিচ্ছে। ভিতরে কি আছে, যদি সোয়ারি থাকে, পলাতক মানুষ থাকে, তবে গতকাল পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। আমিনুল নৌকাটাকে একটা গাছে বেধে পাড়ের গ্রাম থেকে এমন খবর নিয়ে যখন পৌঁছাল, তখন মিনু ছইয়ের বাইরে। মিনু চারপাশটা দেখছে। অবনী, আবুল নদীর চরে দাঁড়িয়ে আছে, কখন আমিনুল খবর নিয়ে আসে। কোনও নৌকাই খাড়ির মুখে ঢুকতে দিচ্ছে না। মিনু সেই থেকে বড় আতঙ্কে আছে। আমিনুলকে নিয়ে ওরা আসছে। অন্ধকারে ক’ জন তারা বোঝা যাচ্ছে না।
চরের বালি-মাটি ভেঙে ওরা এসে নামছে। শেষে তিনটে ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসতেই মিনু বুঝতে পেরেছিল, আমিনুল খবর নিয়ে ফিরছে। কি খবর আছে—এই আশায় সে পাটাতন থেকে লাফ দিয়ে হাঁটুজলে নেমে গেল, এবং ওদের কাছে পৌঁছবার জন্য প্রায় ছুটে গিয়ে বলল, কিছু খবর পেলে?
অবনী এবার ধমক দিল, ভাবি, তোমাকে না কইছি, জলে নাইম না! তুমি তো দ্যাখছি আমাগো শেষ পর্যন্ত বিপদে ফ্যালবা।
মিনুর মুখটা ভারি কালো হয়ে গেল। বস্তুত সে আর অপেক্ষা করতে পারছিল না, সামান্য নদীর চর ভেঙে নেমে আসতে ওদের যেন কত সময় লেগে যাচ্ছে। অধীর হয়ে নেমে এসেছে। আর আসতেই ধমক অবনীবাবুর। সে বলল, আমি আর পারছিলাম না!
অবনী কথাটা ধরতে পেরে বলল, এ-সময় অধীর হয়ে কি লাভ বল? অবনী যখন গভীর এবং দৃঢ় কথা বলে, তখন ভাল ভাবে বলার চেষ্টা করে। কিছুটা বইয়ের ভাষার মত। সে-ও ইচ্ছা করলে যে মিনু ভাবির মত কথা বলতে পারে এক এক সময় ওর গাম্ভীর্য দেখলে তা টের পাওয়া যায়।
আমিনুল বলল, খুব বিপদ। যাওয়ন যাইব না। খাঁড়ির মুখ বন্ধ কইরা দিছে।
আবুল বলল, কি দিয়ে বন্ধ করছে চাচা?
—বন্দুক দিয়ে।
—আমাদেরও তো বন্দুক আছে।
একটু জোরে কথা হয়ে যাচ্ছিল বলে মিনু বলল, আস্তে আবুল।
ওরা কি করবে ভেবে কিছুই স্থির করতে পারছিল না। এত বড় কাঠের বাক্সটাকে পারে নিয়ে যাওয়া কঠিন। পাড়ে যদিও নিয়ে যাওয়া যায়—তারপর? তারপর কি হবে! এখনও প্রায় সাত ক্রোশের মত পথ। অবশ্য পঞ্চমীঘাটে নামিয়ে দিতে পারলে পাঁচ ক্রোশের মত পথ পার হতে হবে।
অবনী আমিনুলের পরামর্শ শুনে বলল, গোটা ব্যাপারটাই অ্যাবসার্ড। প্রথম কথা, যদি পাড়ের গ্রামে সজনে ফুল না থাকে, যদি তোর কথা মত লোকজন না পাওয়া যায়, এত বড় কাঠের বাক্স মাথায় করে নিয়ে যাবে কে? কারও সাধ্য আছে এটা নাড়ায়?
মিনু বলল, তবে কিভাবে যাবেন? সকাল হতে না হতে আমাদের পৌঁছাতেই হবে। সে যেমন করে হোক। বলে সে বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বলে আবার থাবড়ে দিল।
আবুল বলল, মা আমি নৌকা ঠেলে নিয়ে যাব।
নৌকা ঠেলার কথা কানে আসতেই অবনীর বুদ্ধিটা মাথায় এসে গেল। ছেলেটা বুঝে-শুনে একটা কথা বলেছে, অথচ আশ্চর্য সেই কথা থেকে কি করে যে সে এমন একটা দুর্লভ ফন্দি আবিষ্কার করে ফেলল! সে আনন্দে আবুলকে বুকে তুলে নিল। এবার, এবার আমরা পার হয়ে যাব ভাবি! আমিনুল নৌকা ওপারে নিয়ে যাবে। ভাবি আসুন, আর দেরি করবেন না। এখন অনেক কাজ আমাদের।
কেউ ওরা অবনীর অহেতুক আনন্দের অর্থ ধরতে পারল না। প্রায় সে যেন আর্কিমেডিসের সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছে। সে আবুলকে কাঁধে নিয়ে আগে আগে বালির চর ভেঙে নৌকায় উঠে গেল।
আর ক্রোশখানেক পথ। সেই ক্রোশখানেক পথ পার হলেই খাঁড়ির মুখ। সেখানে একটা ফ্লাস লাইট বৃত্তাকারে ঘুরছে। প্রায় নদীর মোহনায় অথবা ব-দ্বীপে কেউ লাইট হাউসে বসে যেন সমুদ্রের তরঙ্গ পাহারা দিচ্ছে।
অবনী বলল, মিনু-বৌদি, আমিনুল, আবুল তোমরা নেমে যাবে। প্রায় আদেশ এটা। এখন সে এই ফ্রন্টের একমাত্র নেতা। ওর নির্দেশ সবাইকে মান্য করতে হবে। যদি সে এমন কথা বলে দেয়, তোমরা তিনজনে এই নদীর জলে প্রাণ বিসর্জন দেবে তবেই আমি নৌকাটাকে মরা মানুষ নিয়া ভাইসা যায়, এমন কইর্যা নৌকাটাকে জলে ভাসাইয়া দিতে পারুম। খাঁড়ির মুখে পাটাতনে লাশ দেখলে ওরা আঁতকে উঠবে। সেই ফাঁকে আমি নদীর জলে নৌকা ঠেলে দেব। এখন এমন বললেও ওদের যেন রাজী হয়ে যেতে হবে।
সে পাড়ে নৌকা ভিড়ালে একটা হাঁসুয়া বের করে নিল। অন্ধকারেই সে গাছপালা চিনে চিনে বড় বড় ডাল কেটে লে গাছের। সবই শ্যাওড়াগাছের ডাল। আমিনুল ওর নির্দেশ মত সব গাছের ডালগুলো নিয়ে নৌকার কাছে ঠিক গলুইয়ের মুখে জড় করেছে। ওরা কেউ বুঝতে পারছে না কিছু। এই ডালপালা দিয়ে কি হবে? কিছু হিজলের ডালও সে কেটে এনেছে। হিজল ফুলের জন্য, ডালগুলোকে আর ডালপালা মনে হচ্ছে না। সব ফুলের গুচ্ছ মনে হচ্ছে।
ঘড়িতে এখন কটা বাজে? মিনু ঘড়ি দেখল। দশটা বেজে গেছে। ওদের এতটুকু পথ আসতেই রাত দশটা বেজে গেল। এইসব গাছপালা কেটে অবনীবাবু কি যে করছে! কিছু বলছেও না। সে কিছু না বললে মিনুও কিছু বলতে পারছে না। আবুল আমিনুল শুধু নির্দেশ মত কাজ করছে। মিনু বাচ্চাটাকে কাঁধে ফেলে দাঁড়িয়ে আছে।
অবনী এবার লাফ দিয়ে জলে নেমে পড়ল। নদীর জল কমে গেছে বলে এখন এখানে বুক জল। বালি-মাটি নিচে, দুটো একটা ঝিনুক পায়ে লাগছে। এ নদী ঝিনুকের নদী। এইসব পাশাপাশি গ্রামগুলো প্রতি বছর এখানে এই নদীর জলে ঝিনুকের চাষ করে বলে পাড়ে অনেক ঝিনুক স্তূপীকৃত। এবং একটা পচা গন্ধ উঠছে সব সময়। গাদামারা ঝিনুক। ছাই চাপা এবং ছাই দিয়ে ঝিনুক পচিয়ে নিচ্ছে। ছাই দিলেই ঝিনুক পচে গিয়ে হাঁ হয়ে যায়। ভিতরের মাংসটা পচে গলে খসে যায়। এবং সাদা, কি ধবধবে সাদা ঝিনুক পড়ে থাকে সে সময়। ওকে সন্তর্পণে নৌকাটাকে টেনে একেবারে পাড়ে তুলে দিতে হচ্ছে। অন্ধকারে ঝিনুকে পা পড়লে কেটে যেতে পারে—এবং অহেতুক অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে ভেবে সে আবুল এবং মিনুকে নৌকা থেকে নেমে ছুটোছুটি করতে বারণ করল। সে ডাকল, আমিনুল।
আমিনুল কাছে এলে বলল, তুই নৌকায় উইঠা আয়।
আমিনুল নৌকায় উঠে গেল।
অবনী এবার আমিনুলকে বলল, তুই পাটাতনগুলি সব তুইলা আমারে দে।
আমিনুল একটা একটা করে পাটাতন খুলে দিচ্ছে, আর অবনী সেগুলো পাড়ে জড় করছে। পাটাতন তোলা শেষ হয়ে গেলে বলল, এবারে ছইটা আয় নামাই।
ওরা দুজনে মিলে ছইটাও নিচে নামিয়ে দিল।
অবনী বড় একটা ডাল, ডালটাতে ঝোপজঙ্গল আছে অর্থাৎ ডালটা নিবিড় পাতায় ঠাসা, সে ডালটাকে ঠিক নৌকার মাঝখানে পালের খুঁটির মত পুঁতে দিল। তারপর ছইটা এনে রেখে দিল নৌকার গলুইতে। পাছাতে এবং মাঝখানে যেখানে যতটা জায়গা আছে ডালপালাগুলি পালের খোঁটার মত দড়ি দিয়ে বেঁধে দিল। নৌকার চারপাশে ঝোপ-জঙ্গলে ঢেকে দিয়ে সে মিনুভাবিকে টর্চের আলো জ্বেলে নৌকাটা দেখতে বলল।
মিনু টর্চের আলো জ্বালতেই অবাক। সে নৌকাটাকে এখন আর দেখতে পাচ্ছে না। যেন একটা জঙ্গল রাতারাতি নদীর পাড়ে গজিয়ে উঠেছে। দূর থেকে নদীর কিনারে ভেসে গেলে কেউ টেরই পাবে না এটা নৌকা। নৌকার ভিতরে একটা কাঠের বাক্স আছে। এবং একটা নৌকা ধীরে ধীরে জলের কিনারে কিনারে আসছে। দেখলে মনে হবে একটা ঝোপ প্রাণ পেয়ে গেছে। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। ক্রমে অন্ধকার রাতে নদীর কিনারে কিনারে ভেসে চলেছে। স্রোতের মুখে পড়ে ঝোপটা ভেসে চলেছে।
মিনু এবার সব ধরতে পেরে বলল, তাই বলি! শেষে জলের কাছে নেমে এল। শাড়িটা একটু তুলে পায়ের পাতা জলে ভিজালে ধমক দিল অবনী, আপনে আবার জলে নামতাছেন ক্যান?
—পানিতে নামছি না।
—তবে কি করতাছেন?
—একটু মাটি তুলে এপাশটা ঢেকে দিচ্ছি।
—ওটা আমি করতে পারব।
মিনু টর্চ জ্বেলে রাখল। ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে নৌকার কাঠ দেখা যাচ্ছে। কাঠ যাতে না বোঝা যায়, কাঠের রং মাটির মতো করে দেবার জন্য জল থেকে কাদা তুলে লেপে দিল অবনী। টর্চ মেরে মেরে মিনু কাঠ খুঁজছে আর সেখানে মাটির প্রলেপ। এভাবে নিমেষে ছোট্ট একটা বনের সৃষ্টি হয়ে গেলে সহসা মনে হল কুঁচকিতে কি জড়িয়ে ধরেছে। এবং হাত দিতেই সে বুঝল একটা জোঁক রক্ত খেয়ে পটলের মত হয়ে আছে। ছুটে সে জল ভেঙে উপরে উঠে গেল, সে মিনুকে ওর শরীরে টর্চ মারতে বলল। টর্চের আলোয় মিনু, আবুল, আমিনুল দেখল ওর সারা গায়ে জোঁক। আবুল খুব ভয় পেয়ে গেল। মিনু ভয়ে কাছে আসছে না। কেবল আমিনুল টেনে টেনে জোঁকগুলো তুলে ফেলছে।
অবনী বলল, এটা একটা ঝামেলা হইয়া গ্যাল।
ঝামেলাই বটে। নদীর জলে সব সময় সাঁতার কাটলে শরীরে জোঁক বসতে পারবে না। কিন্তু ওকে যে কোনভাবে যেতে হবে—সে এখন যদি একটু কেরোসিন তেল পেত। সামান্য কেরোসিন তেল শরীরে মেখে নিলে জলের কীট-পতঙ্গের ভয় থাকে না। এখন জলে তেমন জোয়ার খেলে না বলে জল ঘোলা। নানা রকমের মশা-মাছি। এবং উলানি পোকা। সারা শরীর উলানি পোকার কামড়ে ফুলে গেছে।
আমিনুল বলল, তুই অর লগে যা। নৌকা ভাসাইয়া পানিতে আমি ভাইসা যাই।
অবনী লুঙ্গিটা চিপে একটা বিড়ি ধরাল। একটা সিগারেট অথবা বিড়ি খেতে পেলেই সে তাজা হয়ে যাবে।
মিনু বলল, আপনি দুপুরে পেট ভরে খান নি অবনীবাবু, অমিনুলও খায়নি। আপনার ভাইসাব আমাকে আসার সময় কিছু খাবার নিতে বলেছিল। এখন যদি খেয়ে নিতেন।
—কি আনছেন দ্যাখি।
—সেউই ভাজা। সে বাচ্চাটাকে আবুলের কোলে দিয়ে পুঁটলি খুলল।
—গ্র্যান্ড, বলে অবনী বসে পড়ল মাটিতে। ভিজা লুঙ্গিটাই সে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, দ্যান খাই। বাঁচি মরি খাইয়া লই।
এখন আর একজন মানুষ যে কোথায় আছে! সমসেরের কথা মনে আসতেই কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল মিনু। সে, সব প্রায় অবনীকেই দিয়ে দিচ্ছিল।
—এটা কি হচ্ছে ভাবি। আবুলকে দ্যান।
—আমরা তো খেয়ে বের হয়েছি।
—এ হয় নাকি! আবুল আয় রে, তুই আমার লগে খা। আমিনুল বস। একটা ডালের উপর আমিনুলকে বসতে বলল—অরে দ্যান।
প্রায় সবটাই মিনু দিয়ে দিলে অবনী বলল, ভাবি আপনের লাইগা কি রাখছেন দ্যাখি।
মিনু বলল, আছে।
—কি আছে দ্যাখি।
—বললাম তো আমার জন্য রেখেছি।
অবনী এবার না হেসে পারল না। –ভাবি আপনেগো জাতের একটা দোষ আছে। মঞ্জুর মতই স্বভাব আপনের।
অবনী আবার বলল, মঞ্জুও দ্যাখি নিজের লাইগা কি থাকল দ্যাখে না। মাইয়া জাতটার দোষ অনেক এডা তার ভিতর অন্যতম।
মিনুর মুখে অদ্ভুত এক দুঃখের হাসি ফুটে উঠল। সে এই মানুষটাকে যে ক’বারই দেখেছে, হাসিখুশী মানুষ। এবং গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে যেন মানুষটা যাবতীয় সুষমা দেখতে পায়। অবনী মুখ নিচু করে খাচ্ছে। মিনু দেখতে দেখতে ভাবল, সমসের যেদিন প্রথম মঞ্জুদির স্বামী অবনীকে নিয়ে আসে, আশ্চর্য—লাজুক। কিন্তু সব লজ্জা সমসের ভেঙে দিয়ে বলেছিল, ওকে তুমি একটা গান শুনিয়ে দাও তো। তুমি কত ভাল গাইতে পার ও একবার নিজের কানে শুনে যাক।
—কেন, অবনীবাবু তোমার কথা বিশ্বাস করে না?
—বললেই বলে, বড্ড বৌর নামে তুই যশ গেয়ে বেড়াস।
খালি গলায় সেদিন সে একটা আশ্চর্য গান গেয়েছিল। সেই গানটি কেন জানি আবার এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে কোরাস গাইতে ইচ্ছা করছে। এখান থেকে ওরা দুটো দল হয়ে যাচ্ছে। পায়ে হেঁটে একটা দল যাবে নাঙ্গলবন্দের ঘাট পর্যন্ত। অন্য পথে অবনীবাবু। অবনীবাবু ছাউনির সামনে দিয়ে যাবে, আলোর মুখে পড়লে অবশ্য একটা বন-জঙ্গল মনে হবে। আলোটা ঘুরে ঘুরে এলেই অবনীবাবু দাঁড়িয়ে পড়বে জলে অথবা গলা ভাসিয়ে সে ঝোপের আড়ালে ভেসে থাকবে—না পারলে ধরা পড়ে যাবে এবং বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হলে ফসলের মাঠে আর ফের দেখা হবে না। সে ভাবল, এই সময়। এ সময়ে গানটা ওরা সমস্বরে গাইবে।
অবনী উঠে দাঁড়াল। বলল, নাঙ্গলবন্দের ভৈরবতলা ঘাট, আমিনুল চিনা যাইতে পারবি তো? আমিনুল বলল, মামুর বাড়ি যাইতে একবার ঘাটে নাও ভিড়াইয়া ইলিশ মাছের ঝোল-ভাত খাইছিলাম।
মিনু বলল, কতদূর হবে?
—ক্রোশ দেড়েকের মত পথ। পথে কোন ভয় নাই। দেখবেন বাড়ি বাড়ি জয় বাংলার পতাকা উড়ছে।
এবার অবনী আবুলকে বুকের কাছে এনে বলল, বাইচা থাকলে বাপজানের লগে আবার দ্যাখা হইব। তারপর আমিনুলকে বলল, ভৈরবতলা ঘাটের বড় অর্জুনগাছটার নিচে বইসা থাকবি। অন্ধকারে বুঝতে পারবি না। গাছটার নিচে আইলে আমি সজনে ফুল বইলা হাঁক দিমু। দিলেই টের পাইবি আমি আইসা গ্যাছি।
আর যাবতীয় নির্দেশ, ঠিক একজন বিবেচক সেনাপতির মত সে এখন কাজ করছে। সে এবং আমিনুল ঠেলে নৌকাটাকে ফের জলে নামিয়ে দিল। এবং সে যখন জলে ভেসে যাবে, সে নেমে যাচ্ছিল যখন, তখন মিনু ডাকল। বলল, দাঁড়ান।
অবনী মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াল।
মিনু ডাকল আবুল এস।
আবুল এলে সে আবুলকে অবনীর পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর ডাকল, আমিনুল ভাই। আমিনুল এলে তাকেও দাঁড় করিয়ে দিল। সেই ফিজিক্যাল ট্রেনিংয়ের দিনগুলির মত। সে তাদের ফল-ইনে দাঁড় করিয়ে দেবার মত ঠিকঠাক করে, নিজে দাঁড়াল সবার শেষে। সে বলল, আমরা একটা কোরাস গাইব। সবাই আমরা গাইব। প্রাণ ঢেলে গাইব। অন্ধকারে এ-গান যারাই শুনতে পাবে, এই গাছপালা, পাখি, নদীর জল এবং দূরে দূরে যে বাংলা দেশের মাঠ আছে—সর্বত্র সবাই এ-গানে জেগে উঠবে। খুব আবেগের সঙ্গে বলার সময় ভাষার গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
মিনু তার স্কুল জীবনের সেই দিনগুলির কথা মনে করতে পারছে। মঞ্জুদি, প্রধানশিক্ষিকা, সে বাংলার শিক্ষিকা। স্কুলে প্রতিদিন প্রার্থনা সঙ্গীত হত। কোনদিন নজরুলগীতি, কোনদিন লালন ফকিরের গান অথবা কোনদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত। রবীন্দ্রসঙ্গীত হলেই মিনুর ডাক পড়ত। সেদিন মিনুকে প্রার্থনা সভা পরিচালনা করতে হত।
অনেক দূরে টিলার ওপর মিলিটারি ছাউনি। ওদের সার্চ-লাইট তন্ন তন্ন করে খুঁজছে যেন কিছু আলোটা কখনও আকাশে, কখনও দু-পাড়ের গাছপালায়, কখনও নদীর জলে এসে পড়ছে। তারপর যতদূর সবই অন্ধকার। নিচের অন্ধকারে নদীর পাড় খাড়া বলে বোঝা যাচ্ছে না। ছোট ছোট কীট- পতঙ্গের মত দাঁড়িয়ে মানুষেরা গাইছে – বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পুণ্য হউক হে ভগবান।