।। তিপ্পান।
বুড়ো রহমত মিঞার কাছারি বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। এখানে খুব ঘন নয় নৌকাগুলো। ফাঁকা ফাঁকা নদীর জল ঘোলা। শীতলক্ষ্যার জলের রং কেমন সাদা। এখন তেমন জল নেই। কম জল, কোথাও সেই পার হয় গরু পার হয় গাড়ি, তার ওপর জল এমন ঘোলা যে মুখে দিতে কষ্ট হয়। আর এই জলে কত মৃতদেহ ভাসছে। কাক-শকুন উড়ছে। শহরের কোথাও গাছপালা নেই, কারণ সব গাছপালা কেটে পথ আটকে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং নিশীথে সব শকুনেরা আকাশে উড়ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সকাল হলে টের পাবে এই ঘাটে অনেক মৃতদেহ পড়ে আছে। সমসেরদের কেউ আহত হয়নি। কারণ ওরা জানত আক্রমণ অনিবার্য। ওরা খুব সন্তর্পণে চলাফেরা করছিল, ওরা বন্দুকের নল থেকে গুলি বের হলেই নৌকার আড়ালে অথবা জেটির অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ছিল। কিন্তু যারা যাবে চরসিন্দুর অথবা কালীগঞ্জে, অথবা যাদের মুন্সিগঞ্জে যাবার কথা, তারা নৌকা ছাড়বে বলে তাড়াতাড়ি শুঁটকি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে বেশ খেয়ে নৌকা ছাড়বে ভেবেছিল, তারা কি করে জানবে, এখানে মুক্তিফৌজের একটা দল মাল পাচার করছে! তারা কি করে জানবে দানবের মত খানেরা এসে কামান দেগে অথবা মেশিনগান দেগে ওদের চিৎপাত করে ফেলে রেখে যাবে! ওরা এমন হবে জানত না, ওরা সোয়ারি নিয়ে রওনা দেবে, তখন কিনা বৃষ্টির মতো গুলি!
সুতরাং সকাল হলে সবাই টের পাবে অথবা ভয়ে আঁতকে উঠবে এমন এক দৃশ্য নদীর ঘাটে দেখে। চিৎপাত হয়ে রক্তাক্ত শরীর মুখ নিয়ে নিরীহ মানুষেরা নৌকার পাটাতনে পড়ে আছে। খানেরা ভীত, সন্ত্রস্ত। সন্ত্রস্ত না হলে ওরা এভাবে গুলি চালাবে কেন? ওদের কাছে সব মানুষই এদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা। কি যে ওদের ক্যামোফ্লেজ হবে, খানেরা বুঝি তা জানে না।
গুলির আওয়াজ থেমে গেলে ওরা কিছু সময় চারপাশে নজর রাখল। চারপাশের নৌকাগুলি থেকে মড়াকান্না ভেসে আসছে। চিৎকার এবং গোঙানি। রাতের অস্পষ্ট জ্যোৎস্না ভয়াবহ। আকাশে সব তারা নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। ফ্ল্যাশলাইট আর জ্বলছে না। জ্বললে ওরা কিছু কিছু উৎকট দৃশ্য দেখতে পেত। সমসের দাঁতে দাঁত চেপে বলছে—বেইমান।
এমনভাবে আর কতকাল, হায় খোদা, অথবা যদি এই পৃথিবীর কোথাও কোনও মুক্তির নিশ্বাস ফেলার জায়গা থেকে থাকে তবে যেন বলার ইচ্ছা, হায় খোদা মেহেরবান, তুমি দ্যাখো ওদের। আর তখন ওরা দেখতে পেল নৌকার ভিতর মা রক্তবমি করছে আর কোলের শিশু তার দুহাত শক্ত করে ধরে রেখেছে স্তন, দুধ খাবে বলে। কারণ সেতো বুঝতে পারছে না মায়ের গলা ফুটো হয়ে গেছে, সে ক্ষুধায় স্তন থেকে শেষ দুধটুকু বের করার জন্য চুষে চুষে স্তন খাচ্ছে। হায় হায় এ-দৃশ্য দেখা যায় না।
সমসের তাড়াতাড়ি জল ভেঙে পাটাতনে উঠে গেল। কাতর শব্দ আসছিল। কি বলছে বোঝা যাচ্ছে না। অবনী বিরক্ত হচ্ছে। আর একটু এগিয়ে গেলে, এ-অঞ্চলে ওদের ভয় থাকার কথা নয়। কেবল নিরিবিলি গ্রাম। এবং নৌকাটাকে টানতে হবে না তবে, জল বেশি বলে বৈঠা চালাতে পারবে। নদীর পাড় থেকে ওদের কেউ দেখতে পাবে না। কাশবনের আড়ালে নৌকা চালালে ভয়ের কোন কারণ থাকবে না।
আর তখন কিনা সমসের অন্য নৌকায় উঠে কি খুঁজছে। আমিনুল বলল, সমসের মায়া-মমতা বুকে রাখলে কষ্ট। তাড়াতাড়ি পাড়ি দিমু কি কইরা তা না, অহন গ্যাছেন আবার কেরায়া নৌকায়।
মিনু বলল, তুমি ওকে নিয়ে কি করবে?
–তোমার সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি।
–আচ্ছা তুমি কি পাগল?
সমসের কোন কথা বলল না। শিশুটি বোধহয় মেয়ে। ফ্রক পরা, প্যান্ট হিসি করে ভিজিয়ে দিয়েছে। সমসেরের হাতে এসে প্রথমে খলবল করছিল। এবং হাসছিল। সমসের বুঝল, মায়ের দুধ এবং রক্ত দুই চুষে ওর পেট ভরে গেছে। মুখে রক্ত লেগে আছে। সমসের নদীর জল তুলে মুখ ধুয়ে দিল। এবং মিনুর কাছে গিয়ে বলল, রাখ। তোমাদের যা হয় এরও তাই হবে।
অবনী আর থাকতে পারল না—সমসের তুই একটা পাগল। তরে পাগল কমু না ছাগল কমু বুঝতে পারতেছি না। আমাগ এখন মরণের সময় নাই, তুই এডা কি করলি!
–চোখের সামনে পড়ে গেল কি করি বল? না নিলে হামাগুড়ি দিয়ে জলে পড়ে যেত। জলে ডুবে যেত।
অবনী এ-সময় অস্পষ্ট আলোতেও দেখল সমসেরের মুখ থমথম করছে। সে নিজের ছেলেটার দিকে কিছুতেই তাকাতে পারছে না। কিছু বলছেও না তাকে। কিছু বলতে গেলেই হয়তো ভেঙে পড়বে। আবুল তার মায়ের কোলে সেই শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা যা কিছু পারছি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, এমন মুখ এখন মিনুর। কোলে আঁচলের ভিতর সেই বালিকা, যেন ছোট্ট একটা বোন মিলে গেছে আবুলের। সে এবং মা পাটাতনে পাশাপাশি বসে আছে। বাবা গলুই’র দিকে। অবনীকাকা নৌকাটাকে টেনে টেনে গভীর জলে নামিয়ে দিচ্ছে।
নৌকাটা জলে ভাসিয়ে দিয়ে অবনী লাফ মেরে উঠে পড়ল। এখন আর আকাশে জ্যোৎস্না নেই। পাটাতনের নিচে সেই বাক্সটা। মেয়েটা মিনু ভাবির কোলে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত বাড়ছে ক্রমশ। ওরা কাশবনগুলোর পাশ দিয়ে গেলে কিছু কীট-পতঙ্গ অথবা ফড়িং উড়ে এসে নৌকায় পড়ছে। ওদের নৌকা ক্রমে গঞ্জ পিছনে ফেলে দামগড়ের দিকে যাচ্ছে। কাছেই সেই ব্রহ্মপুত্রের খাড়ি নদী এসে শীতলক্ষ্যায় মিশেছে। অন্ধকারে ওরা সেই নদীটির উদ্দেশ্যে এখন নৌকা বাইছে। সমসের খাঁড়ির মুখে নেমে যাবে। সে এখনও বোধহয় ঠিক করতে পারছে না কি করবে। নয়তো যেমন কথা ছিল—ঘাসি নৌকাটা এলেই সমসের ওদের তুলে দিয়ে চলে যাবে, অথচ সমসের যাবার নাম করছে না। অবনীর মুখ ক্রমে কঠিন রুক্ষ হয়ে উঠছে। সে বুঝতে পারছে, সমসের মায়ায় এখন আটকে পড়েছে। যতটুকু সময় নিজের মানুষের কাছে থাকা যায়। অবনী এটা পছন্দ করছে না। যেমন সে পছন্দ করেনি আগ বাড়িয়ে একটা ঝামেলা বয়ে আনা, অন্য নৌকা থেকে। সে জানে ওটাতে কারা যাচ্ছে। এ নৌকাগুলো সাহাদের। সাহারা শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। ঠিকঠাক হয়ত চলে যেত, বাধ সেধেছে এই জেটি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ যাচ্ছে। খানেরা এত ভীত হয়ে পড়েছে যে কিছুতেই চরে এসে সরেজমিনে দেখতে চাইছে না। দূর দূর থেকে কামান অথবা মেশিনগান দেগে সব নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
এ-ভাবে অবনী জানে সমসের নৌকা থেকে এই যে শিশুটিকে তুলে এনেছে সে সাহাদের কেউ হবে। অবনীর কাছে সবচেয়ে শক্ত কাজ এই কাঠের বাক্সটা পৌঁছে দেওয়া। সমসেরের নির্দেশমতই অবনী সব করছে। সমসেরেরই নির্দেশ ছিল, মায়া মমত। আমাদের এখন রাখলে চলবে না। আমরা এক পরিবারের ছেলে। সেই পরিবারের নাম বাংলাদেশ। আমাদের এখন আর কোন ব্যক্তিগত সত্তা নেই। আমাদের সবচেয়ে বড় অভাব আর্মসের। আমাদের দলবল আছে। আছে খাদ্য। শুধু আর্মস অ্যান্ড অ্যামিনিউসানের জন্য সংগ্রাম বিলম্বিত হতে পারে। সমসের যখন কথা বলে, খুব গুরুত্ব দিয়ে কথা বলে। মাঝে মাঝে সাধুভাষা প্রয়োগ করে তার বক্তব্যের দৃঢ়তা প্রকাশ করতে চায়। সে’ই বলেছিল, একটা বন্দুক ছিনিয়ে নেবার আগে আমাদের জান কবুল করতে হবে। অর্থাৎ সে যেন বলতে চেয়েছিল, জীবন পরে, অস্ত্র আগে। আর সেই সমসেরই কি না একটা গন্ডগোল বাধিয়ে বসল যাবার মুখে। সমসের নেমে যেতে চাইছে না। ওর আরও অনেক কাজ। সমসের সংগঠনের ভিতর আছে। সমসেরের মত মানুষেরা শুধু ভাবেন—কিভাবে কোথায় কোন অন্ধকারে অতর্কিতে আক্রমণ ঘটাতে হবে, কোথায় কিভাবে রসদ পৌঁছে দিতে হবে এবং কিভাবে সব আগ্নেয়াস্ত্র পৌঁছে দিতে হবে। তা না করে সমসের কি না তাদের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। অবনী ওর নেমে যাবার লক্ষণ না দেখে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিল। সঙ্গে আবার অপোগন্ড জুটিয়েছে একটা!
এখন দামগড়ের কলকারখানাগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। জল কম আবার এখানে। জায়গায় জায়গায় কচুরিপানা ঠাসা। এবং দু-পাড়ে কোনও সাড়াশব্দ নেই। আর তখনই কিনা মিনু-বৌদির কোলে অপোগন্ডটা কাঁদছে। টের পেয়েছে বুঝি মিনু-বৌদি ওর কেউ হয় না। রক্তে যে কি মিশে থাকে! মিনু- বৌদি নানাভাবে ওকে থামাবার চেষ্টা করছে। একটু আগেও বেশ চুপচাপ ছিল। এসব দেখে অবনী ভিতরে ভিতরে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে। কারণ এভাবে কাঁদলে নদীর জল বেয়ে কান্নার শব্দ ওপারে উঠে যাবে। কে যায়! নদীর জলে নৌকা। কারা যায় দ্যাখো। দ্যাখো কোন স্বাধীন মানুষ, গ্রামে গঞ্জে পালিয়ে যায়। নৌকা আটক কর। নৌকা আটকে সরেজমিনে তদন্ত। ভয় পেলে ওরা সরেজমিনে আসবে না। সামান্য এই নৌকার উদ্দেশ্যে কামান দেগে জলের নীচে ডুবিয়ে দেবে।
সমসের বসেছিল চুপচাপ। আবার অতর্কিতে মেশিনগানের শব্দ ভেসে আসছে। জুটমিলের ডানদিক থেকে মনে হয় শব্দটা আসছে। ওখানে চটকল ইউনিয়নের কর্মীরা আছে। ওদের ব্যারাক হয়তো উড়িয়ে দিচ্ছে। অন্ধকারে সে দেখল, আগুনের গোলা উপরে উঠে শহরময় এক অতীব নৃশংস দৃশ্য। হাউইয়ের মত আকাশে বাতাসে আগুনের গোলা। বোধহয় কোনও পল্লীতে ফসফরাস গ্রেনেড দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পল্লীগুলোর কোথাও শনের চালাঘর, কোথাও টিনের ঘর, বাঁশের বাতা দিয়ে বেড়া, কাঠের থাম। এমনিতেই গ্রীষ্মের দিন, রোদে খাঁ খাঁ করছে সারাটা দিন। শনের বেড়া, বাঁশ চাল উত্তপ্ত হয়ে আছে, সামান্য একটা দেশলাইয়ের কাঠি অজ্ঞাতে ফেলে দিলেই হাওয়ায় হাওয়ায় আগুন ভেসে যাবে, এবং ঘরগুলো জতুগৃহের মত হয়ে আছে বলে আগুনে সারা আকাশটা একটা চকচকে আয়না হয়ে গেছে। আগুন উপরে উঠে গেছে এত, যে ওদের নৌকার ভিতর সবার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অবনী আর চুপচাপ থাকতে না পেরে বলল, কালীগঞ্জে মনে হয় আগুন লাগাইছে।
আবুল বলল, আসমানটা লাল হয়ে গেল!
মিনু বাচ্চাটাকে অনেক চেষ্টা করে শান্ত করতে পেরেছে।
সমসের বলল, বোধহয় আমাদের পাড়াতে আগুন দিয়েছে।
মিনু বলল, আবুল বাইরে বসে থাকিস না। ভিতরে আয়।
আবুল মা-র কথামত ছইয়ের ভিতর ঢুকে গেল। এখন দূরে দূরে শহর জ্বলছে বলে প্রায় দিনের সামিল হয়ে গেছে। সমসের বলল, এটা তোমরা ভাল করে দেখে নাও।
আমিনুল নৌকায় নেই। সে পাড়ে পাড়ে গুন টেনে নৌকা নিয়ে যাচ্ছে। অবনী হালে বসে রয়েছে। যখন যেমন অবস্থা হচ্ছে তখন তেমন করতে হচ্ছে। গ্রীষ্মের দিনে জল থাকে না, এবার মনে হয় নদীতে আরও জল কম। আর মাঝে মাঝে চর জেগে গেছে। মাছ ধরার জন্য যারা জঙ্গল ফেলে রেখেছিল, জলে সে-সব এখন নদীর চরে অথবা জলের কিনারে। অন্ধকারে গুণ টানা বড় কষ্টকর। তাছাড়া আমিনুল কবে যে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিল কলেজে পড়তে, সেই থেকে নৌকা বাওয়া, গুণ টানা, সব অভ্যাস কেমন তার উঠে গেছে। পায়ে ওর কেডস্ জতো। কাশের বনে থাকলে হাত- পা কেটে যাচ্ছে। সে ঘাড়ে গুণ টানা দড়ি ফেলে হাঁটছে। মনে হয় কাঁধের চামড়া ছিঁড়ে গেছে এবং রক্ত পড়ছে। সে যে জামাটা গায়ে দিয়েছিল ওটাও বোধহয় ছিঁড়ে গেছে। কেমন শীর্ণ চেহারা। অথচ আমিনুল এতটুকু ভেঙে পড়ছে না। সে বলল, যার যার বায়ে। অন্ধকার নয় তেমন, তবু আমিনুল কেন যে কথাটা বলল। অবনী গলুইতে বসে চিৎকার করে উঠল, সজনে ফুল।
এখানে নদীর পাড় খাড়া। মিনু মানচিত্রটার গায়ে উবু হ’য়ে দেখছে কোথায় নদী বাঁক নিয়েছে, কোথায় কোথায় কোন মসজিদ অথবা মন্দির পড়বে। আলিপুরার বাজারে এখন কিছু নৌকা সব সময় ঘাটে বাঁধা থাকে। কোন গন্ডগোল দেখা দিলে সেই নৌকার ভিতর মিশে যেতে হবে—সমসের এমন বলছিল। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালতে হচ্ছিল সমসেরকে। কারণ আগুনের হল্কা কমে গেলে মানচিত্রের সব কিছু অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবনীও হাল থেকে দেখার চেষ্টা করছে। আবুল, ওর মা এবং বাবার পাশ দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়েছে।
অবনী বলল, ভাবি তোমরা সব বুঝে নাও। আমি পরে তোমাদের কাছে বুঝে নেব।
সমসের এবার অবনীর দিকে পেছন ফিরে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল। তারপর বলল, আমাকে তোরা নাঙ্গলবন্দে নামিয়ে দিবি। গোয়ালদিতে অরুণ আছে, আমি সোজা ওর বাড়িতে গিয়ে উঠব। লালু-মেহের সবাই থাকবে। যদি পঞ্চমীঘাটে দেখিস অসুবিধা, তবে দন্দির শ্মশানঘাটে চলে যাবি। ওখানে কেউ থাকবে। মিনু তুমি নেমে যাবে, লাধুরচরে হাসিম থাকবে। তোমরা ওদের বাড়ির কুটুম। খুব সকালে দু-একজন কেউ দেখে ফেললে বলবে জয় বাংলা। তবে আর ভয় থাকবে না। পাশাপাশি নৌকা চলতে থাকলে, অবনী তুই যেমন বলে থাকিস সজনে ফুল, তেমনি বলবি। নিজেদের মধ্যে আবার মারামারি বেধে না যায়।
অবনী বলল, আজকাল আবার খানেরা উর্দি না পইরা গঞ্জের মানুষের লগে মিশা থাকে। টের পাওয়া যায় না, জয় বাংলা কেডা, আর পাকিস্তানি কেডা।
—সজনে ফুল বললে ওরাও বলবে সজনে ফুল। দু-নম্বর কোড বেলফুল। কামাল তিনটে নৌকায় আরও তিনটে ইউনিট পাঠাচ্ছে। ওরা রূপগঞ্জ থানা আক্রমণ করবে আর একটা দল যাচ্ছে নার্সিন্দিতে। কামাল সবই নৌকায় পাঠাচ্ছে, কারণ নৌকায় যেতে সময় বেশি, বেশি সময়ই তো নিচ্ছে। সন্দেহটা ছোট ছোট নৌকায় কম। তারপর একটু থেমে বলল, তবে সব জায়গাতেই ভয় আছে। তোমাদের খুব সাবধানে যেতে হবে। কথা আছে থানার লোকেরা আমাদের সাহায্য করবে।
এবারে সে আবুলের মাথায় হাত রেখে বলল, অবনীকাকা যা বলবে তাই করবে।
আবুল বলল, ওরা গুলি চালালে আমরা গুলি চালাব না?
—সে তোমার অবনী কাকা জানে।
—আমি না থাকলে কত কিছু ঘটতে পারে! অবনী অন্যমনস্কভাবে কথাটা বলল।
—তুই না থাকলে আমিনুল। আমিনুল না থাকলে মিনু। মিনু না থাকলে আবুল
—এই অপোগন্ডের কি হবে?
—সে আমাদের শেষ সৈনিক। যেখানেই যাবে বুকে রক্ত নিয়ে যাবে। জ্বলবে সারাজীবন। আবার আগুন জ্বলবে এই মাঠে-ঘাটে। স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়।
মিনু বলল, তারপর আমাদের কি করণীয় কিছুই বললে না?
—হাসিমের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ থাকবে। তোমরা সবাই ওর পরামর্শমত তারপর থেকে কাজ করে যাবে। কবে আমাদের দেখা হবে ঠিক নাই। দেখা আর আদৌ হবে কিনা তাও বলতে পারি না।
মিনুর মুখটা বড় ম্লান হয়ে গেল। দুশ্চিন্তায় তার মাথা খারাপ হবার যোগাড়। সে এখন আর নিজের কথা ভাববে না, এমন কতবার ভেবেছে, অথচ সমসের যা বলল তা ওকে বড় কাতর করছে ভিতরে ভিতরে। কিছুতেই সে মনকে বোঝ প্রবোধ দিতে পারছে না। ভিতরে সে ভীষণ ভেঙে পড়ছিল। হাহাকার শুধু সম্বল। তার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সে এই নৌকার পাটাতনে আবুলকে জড়িয়ে ধরে আছে। কি নরম আর সুন্দর আবুলের চোখমুখ! বড় বড় চুলে আবুলের তেলের গন্ধটা কি যে ভাল লাগছে! সে আবুলের চুলে মুখ গুঁজে দিলে টের পায় ভেতরে কে আবার তাকে সাহস যোগাচ্ছে। চারপাশের বনলতা, নদী জল মাঠ এবং নদীর চরে কত রকমের পাখ-পাখালির কলরব তাকে নতুন করে এক জীবনের কথা, আশার কথা শোনাচ্ছে। সে বলল, তুমি সাবধানে থেকো, ঠান্ডা লাগাবে না, গায়ে জ্বর। মেহেরকে বলবে পাতলা করে যেন বার্লি করে দেয়। ভাত খেও না।
সে বলল, রাতে ভাত খাব না মিনু। নাঙ্গালবন্দ থেকে কত দূর গোয়ালদি মিনুর জানার কথা নয়। মিনুর ধারণা, নদীর পারেই গ্রাম, অথবা কিছু পথ হেঁটে গেলেই মেহেরের বাড়ি। এবং সেখানে পৌঁছে গেলেই যেন সমসেরের সব কাজ সারা। সে ইচ্ছে করেই মিনুকে আর দূরত্বের কথা বলে ঘাবড়ে দিতে চাইল না। অথবা এই যে মিনু যাচ্ছে আরও বড় দায়িত্ব নিয়ে, হয়তো মিনু টেরই পাচ্ছে না, দায়িত্বটা কতবড়, বাক্সটাতে কি আছে, এবার এটাও ভাল করে বলা দরকার এই ভেবে সে একটা লিস্ট বের করে অবনীর হাতে দিল।
এখন আর দূরের যে আগুন গ্রামের মাথায় উঠে গেছে তা দেখা যাচ্ছে না। কেবল মাঝে মাঝে আগুনের হলকা এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলি আকাশে উঠে গেছে। অজস্র বাঁশ ফাটার অথবা টিনের চাল উড়ে যাবার শব্দ কানে আসছে। আর এখন নৌকার মুখ ঠিক উত্তরের দিকে নয়। কিছুটা উত্তর-পূর্ব কোণে। ফলে আগুনের যে আলোটুকু এই নৌকায় আসা দরকার অথবা আসতে পারলে সুবিধা হত, তা আসছে না। ওরা টর্চ না জ্বালিয়েও ম্যাপটা দেখে নিতে পারত তবে। কিন্তু এখন উত্তর-পুবমুখী নৌকার মুখ, গলুইতে সমসের বসে রয়েছে। ওর পা জলে ভিজে গেছে। কারণ মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঢেউ এসে ওর চারপাশে জলের ঘূর্ণি সৃষ্টি করছে। নৌকাটা জল কেটে বেশ দ্রুতবেগে এই এলাকা পার হয়ে যাবার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে কোনও বনজঙ্গলে গুণ টানার দড়ি আটকে গেলে ওরা লগি দিয়ে তা ছাড়িয়ে দিচ্ছে। এবং সেই একটা সাদা পাতায় কামালের হস্তাক্ষর। সব উৎসর্গীকৃত প্রাণদের উদ্দেশ্য করে লেখা—সংগ্রাম আমাদের কবে শেষ হবে জানি না। কিভাবে শেষ করব তাও জানি না। আমি তোমাদের কোনও মোহের ভিতর টেনে না নিয়ে শুধু বলতে চাই, আমি অথবা আমরা যেভাবে পারব সংগ্রাম করে যাব। এই দুঃসময়ে কোনও সংগঠনে যাবার আমাদের বড় কোনও পথ নেই। কেউ কেউ দিশেহারা হয়ে গেছে। যারা আমাদের পাশে থাকবে ভেবেছিলাম, এই ধ্বংসলীলা দেখে তারা স্থবির হয়ে গেছে। কেউ কেউ জানি পাগল হয়ে যাবে। তোমরা জান ময়নাকে। ময়নার স্বামীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। ময়নাকে উলঙ্গ করে দিয়েছিল। বেয়নেটের খোঁচা মেরেছে। পিঠে ওর বেয়নেট দিয়ে কেটে কেটে মাংসের ভিতর জালিমশাহির বর্বর ইতরেরা লিখেছে—পাকিস্তান। ওর পিঠে মাংসের ঘা শুকিয়ে গেলে, সে জীবনে কোনদিন এই দাগ তুলতে পারবে না। এবং উলঙ্গ করে—ওর যৌবন ওরা নানাভাবে—আমি এসব কথা আর লিখতে পারছি না। ওকে মেহেরের কাছে পাঠিয়েছি। সে এখন সুস্থ আছে। এভাবে শুধু তোমাদের আমি সাহস দিতে পারি, অত্যাচার যত বাড়বে, আমাদের বাহিনী তত শক্ত হবে। ময়না এখন কি যে সাহসী, সে এখন আমাদের বড় অ্যাসেট। সে মাঝে মাঝে পাগলের মত বলে ওঠে, রাইফেল কাঁধে ফেলে আমরা কবে ঢাকার দিকে মার্চ করে যাব? আমি ভীষণ ভয় পাই। ওকে দেখলে তোমরাও পাবে। ওর মত অসংখ্য মেয়েরাও আজ তোমাদের পাশে। তোমরা নিঃশঙ্ক চিত্তে সব সময় মৃত্যুর জন্য তৈরী থাকবে। এইটুকু লিখে সে একটা লম্বা টান দিয়ে চিঠিটা শেষ করেছে। উপরে লিখছে আমার বন্ধুগণ, নিচে লিখেছে, বাংলাদেশের একজন দীনতম সন্তান কামাল ইব্রাহীম। তারপর লিখেছে—বিঃ দ্রঃ একটা ফিরিস্তি—পি ফোরটিন ম্যাগাজিন রাইফেল—বারোটা। হাত গ্রেনেড বাইশটা, দুশো তেরো রাউন্ড গুলি, সে তেরো কেটে ফের চোদ্দ করে দিয়েছে। তারপর লিখেছে জয় বাংলা।