1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৪৪

।। চুয়াল্লিশ ॥

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সুখি দৌড়ে যাচ্ছে করিডর ধরে।

অসময়ে তো কাকা ফেরেন না। কারখানা থেকে সোজা কলেজ স্ট্রিটে যান। টুটুল দিদির কাছে পড়ছিল। অয় অজগর আসছে তেড়ে—সাঁজবেলায় মিণ্টু বই খাতা নিয়ে বসে। ভাইকেও ডেকে বসায়। বাবা সকালে পড়া দিয়ে যান। টুটুলকে ছড়া শেখাতে হয়। হাতের লেখা শেখাতে হয়। টুটুলকে বানান করে সহজ পাঠ পড়াতে হয়। তবু এই ছড়াটা সেই কবে থেকে টুটুলের প্রিয় হয়ে গেছে। যতই বায়না করুক, ছড়া বললেই শান্ত। কিছুতেই বই নিয়ে বসবে না। দিদির সঙ্গে তার মারামারিও শুরু হয়ে যায়। সুখি পড়ে যায় মহাফাঁপরে। কাকা ফিরে এলেই মিণ্টুর নালিশ জান বাবা, টুটুল হাতের লেখা করেনি। নামতা পড়েনি। কাকা তখন নিরুপায় গলায় বলেন, তোমার মা এলে কত কষ্ট পাবে বল! কী বলে গেছে বল! বলেনি, দিদির কথা শুনবে। বাবাকে কষ্ট দেবে না। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। বলেনি, লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।

বাবা আমাকে একটা ঘোড়া কিনে দেবে।

এই হলো মুশকিল। সুখি বুঝতে পারে কাকা বড় অসহায়। কাকিমা থাকলে, কাকার তবু যেন কিছুটা ভরসা থাকে। কাকিমা না থাকলে কেমন জলে পড়ে যান।

সুখি দরজা খুলে অবাক।

অচেনা এক আইবুড়ো মেয়ে। হাতে সোনার বালা, কপালে নীল রঙের টিপ। সে তো চেনে না। কাকার চেনাজানা বলেও মনে হয় না। রাজবাড়ির একেবারে অন্দরমহলে হাজির। চেনা নেই, জানা নেই কার খোঁজে, সে প্রথমে বুঝতে পারল না। নাকছাবির পাথরটা চকচক করছে।

টুটুল মিণ্টু, বাবা এসেছে ভেবে ছুটে এসেছিল। কিন্তু বাবা না। পড়া হয়ে গেলে সে আর টুটুল জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। জানালার পাতাবাহারের গাছ পার হয়ে নতুন বাড়ির রাস্তা। রাস্তাটা মেসবাড়ির পাশ দিয়ে টেনিস কোর্ট পার হয়ে সদর গেটে চলে গেছে। জানালায় দাঁড়ায়, কে আগে বাবাকে আবিষ্কার করবে। আর আশ্চর্য, টুটুল পড়তে বসলে ঘুম পায়– পড়া থেকে ছুটি হলে, আর ঘুম! হুটোপুটি। বাবা না এলে টুটুলকে খাওয়ানো কঠিন। বাবার অপেক্ষায় জানালায় দু’জনের দাঁড়িয়ে থাকা চাই। অতীশের ফিরতে বেশ রাত হয়। যতই রাত হোক ভাই বোন কাউকেই সুখি খাওয়াতে পারে না।

সুখিকে দেখে কী ভাবল কে জানে!

ফতিমা ঠিক বুঝতে পারছে না কী বলবে। দারোয়ান গাড়ি দেখে সদর গেট খুলে দিয়েছে। বউরাণীর কেউ হবে। এছাড়া যে যার গাড়ি নিয়েই ঢুকুক সে চেনে। সবাই রাজার আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব কিংবা ইয়ার। সে কখনও কোনো মহিলাকে গাড়ি চালিয়ে এ বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেখেনি। হর্ণ দিতেই লোহার গেট টেনে খুলে দিয়েছিল—ফতিমার দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করেছে। কে হতে পারে! বউরাণীর বোন যদি হয়। হতেই পারে। বিদেশে থাকেন। যদি দেশে ফিরে আসেন। এক-দুবার দেখেছে সেই কবে, মনে না থাকারই কথা।

ফতিমা দরজা খুলে নামতেই দারোয়ান সাদেক আলি স্যালুট করেছিল। কিন্তু সোনাবাবু কোন দিকটায় থাকেন বলতেই, এই রে, সোনাবাবুটা কে? রাজার আমলারা প্রায় সবাই বাড়িটাতে থাকে। সে তো সোনাবাবু বলে কাউকে চেনে না। রাজার বাড়ি, রাজার সব আমলাদের নাড়িনক্ষত্র সে জানে। বউরাণীরও কেউ না। সে তারপর রাজবাড়ির দারোয়ানের মতোই জেরা শুরু করেছিল। বিপাকেই পড়েছিল ফতিমা।

বাড়িটার মাথায় পরী। ভিতরে বিশাল এলাকা। শহরের এমন ঘুপচি জায়গায় বলতে গেলে এলাহী ব্যাপার। মাঠ, দেবদারু গাছ, আমলাদের কোয়ার্টার, ধোপাখানা পর্যন্ত আছে। ফতিমা টের পেয়েছিল, লোকটি তাকে আর গ্রাহ্য করছে না। সোজা বলে দিল, সোনাবাবু বলে এখানে কেউ থাকে না। সে সোজা চলে গেল আগের জায়গায়। এমন কি গেটও বন্ধ করল না। যেন গাড়ি নিয়ে সসম্মানে বের হয়ে গেলেই দারোয়ান খুশি হতো।

সে নাছোড়বান্দা। গাড়িটা সাইড করে আবার ফিরে এল। বলল, সোনাবাবু এখানে থাকে। রাজার কারখানার ম্যানেজার সে।

ম্যানেজার তো অতীশবাবু।

ফতিমা কিছুটা সাহস ফিরে পেয়েছিল।

অতীশ কি?

অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক।

বুকের মধ্যে অজস্র বাজনা—সে বুঝতে পারছে, দেশ ছেড়ে এসে সোনাবাবু নিজের নামটাও হারিয়ে ফেলেছেন। দেশের সবাই ঠাকুরবাড়ির পোলা বলেই চিনত। আবার যাঁরা প্রবীণ ছিলেন, তাঁরা ভূঁইয়া বাড়ি বলত। সে বলল, খুব লম্বা?

—হ্যাঁ, লম্বা।

—খুব ফর্সা?

—হ্যাঁ, খুব ফর্সা।

ফতিমা মাথায় শাড়ি সামান্য তুলে দিল। খোঁপার কাছে একটু ঝুলে থাকার মতো ঘোমটা। কপালে সিঁদুর নেই, সিঁথিতে নেই, খোঁপার কাছে শাড়ি তোলা—অতীশবাবুকে সনাক্ত করার সঙ্গেই সে অজ্ঞাতে মাথায় সামান্য শাড়ি তুলে দিয়েছিল।

সে বলল, সোজা চলে যান। সামনে নতুন বাড়ি। পাশ দিয়ে গলি, ভিতরে অন্দর। অন্দরের একটা দিকে বাবু থাকেন।

মূল প্রাসাদের পেছনে তবে সোনাবাবু থাকেন। সে আসার সময় দেখেছে, অফিস ফেরতা বাবুরা পাশের দু-তলার সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে। সবাই তাকে লক্ষ্য করছে। তার অস্বস্তি হচ্ছিল। অচেনা গ্রহের মতো—সে বেশ ঝুঁকি নিয়েই বাড়ির ভিতর ঢুকেছে। আসলে জেদ। তাঁকে খুঁজে বের করার পর হারিয়ে যাবেন—তা কিছুতেই হতে দেবে না। দেশের বাড়িতে নানী যখনই তাকে নিয়ে গেছে, সে দেখেছে, নানীকে উঠানে বসতে দিয়েছে। গোল মতো একটা কাঠের পিঁড়ি। নানী গিয়েই পিঁড়িটার খোঁজ করত। যেন ওটা ছাড়া অন্য কোনো বসার জায়গা তার পছন্দও ছিল না।

এতসব ঝককি ঝামেলা আছে বলেই সোনাবাবু মিছে কথা বলতে পারেন–তর ত মাইয়া সাহস কম না। মুসলমানের মাইয়া তুই বাসায় ঢুকলে জাত যাইব না!

সোনাবাবু সেই আতঙ্কেও বলতে পারেন, ইস ভুল হয়ে গেল। বাড়িতে কেউ নাই। তালা মারা। তর ভাবি বাপের বাড়ি গেছে।

বাপের বাড়ি! বাপের বাড়ি। সে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠার মতো তীব্র ধিক্কারে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। এমন কি তার স্পষ্ট যেন মনেও পড়ছে না। গুলিয়ে যাচ্ছে। বাসায় নিয়ে যেতে গেলে জাত যাবে বাবুর। আমার ইজ্জত নাই! মিছা কথা বলতে মুখে আটকাল না!

সুখি দেখছে, অচেনা যুবতী সিঁড়ির একপাশে দাঁড়িয়ে টুটুল মিণ্টুর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। টুটুলকে দেখেই চিনে ফেলেছে, এই তো আমার সোনাবাবু। একেবারে অবিকল নকল সোনাবাবু তাকে দেখছে, আর দিদির ফ্রক টেনে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছে।

সুখি কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। টুটুলের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে অচেনা মেয়েটি। কে এই যুবতী, কার খোঁজে—কিংবা শ্যামলা দীর্ঘাঙ্গী নরম মুখ, আভিজাত্য আছে—এবং সে ভেবে পাচ্ছে না, কপালে সিঁথিতে সিঁদুর নেই—হাতে বালা, নাকে নাকছাবি—বিধবা রমণী বলেই মনে হচ্ছে, মাথায় সামান্য আঁচল তোলা—এটাই তাকে কিছুটা বিভ্রমে ফেলে দিচ্ছে। সে না বলে পারল না, কাকিমা বাড়ি নেই।

সুখি ভাবতে পারে কাকিমার বান্ধবী হতে পারে।

—সোনাবাবু আছেন?

সুখি বলল, সোনাবাবু! না, সোনাবাবু বলে তো কেউ এখানে থাকেন না।

ফতিমা এবার হাসল। চোখ বিস্ফারিত করে মুচকি হেসে বলল, আপনি সোনাবাবুর কে হন?

—আমি এখানে থাকি। সে যে রান্না করে, টুটুল মিণ্টুকে সামলায়, কাকা বাড়ি এলে খেতে দিয়ে রাজবাড়ির ভিতরের বস্তির মতো অঞ্চলে চলে যায় বলতে আটকাল। সে বলল ফের, সোনাবাবু বলে কেউ এখানে থাকেন না। আপনি ভুল করছেন।

—না না, আমি ভুল করিনি। আপনি ঠিক জানেন না।

শত হলেও সুখি স্বামী পরিত্যক্তা—তার বাবা রাজার অফিসের বেয়ারা, সেই সুবাদে রাজার কারখানার ম্যানেজারের কাছে আশ্রয়। সকালে আসে—কাকা রাতে ফিরে এলে চলে যায়। এত সে জানে, কাকার ভাল নাম তো অতীশবাবু, সোনাবাবু হতে যাবে কেন, কিন্তু খুব সাহসের সঙ্গে বলতেও পারছে না, এ বাসা নয়, অন্য বাসায় খোঁজ করুন—যেভাবে দাঁড়িয়ে টুটুলকে দেখছে। তারপরই আশ্চর্য সুখি, সিঁড়িতে যুবতী চুপচাপ বসে পড়ে টুটুলকে বলল, আপনার কি নাম?

টুটুল বলল, তুমি কে?

—আমি, আমি!

—এ তো খুবই বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন। কী বলবে! সে কে! সে যে ফতিমা, সোনাবাবু তার সত্যি কে হয়, কেউ না, বিধর্মী কাফের—কাফের মানুষটা এই মুহূর্তে তার কে হয় বলতে পারল না। যেন বলার ইচ্ছে ছিল, সেই স্বপ্নের পৃথিবীতে আমরা ছুটতাম। কোঁচড়ে লটকন ফল। আপনার বাপজান আমার পেছনে ছুটত। জানতামই না, আমরা কে বা কার কি হই। শুধু প্রকৃতির সেই নিরিবিলি অবকাশ আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখত।

সুখি খুব বিড়ম্বনা বোধ করছে।

—ভিতরে এসে বসুন। বাইরের সিঁড়িতে কেউ বসে!

—ও ভাববেন না।

—কাকা এসে শুনলে রাগ করবেন। অপরিচিত বলে সিঁড়িতে বসিয়ে রাখলি?

টুটুলের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার মা কোথায়? মামার বাড়ি গেছে?

মিণ্টুর ভীষণ অভিমান। তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। কেবল টুটুলকে বলছে, আপনার মা কোথায়? মামার বাড়ি গেছে!

মিণ্টু দরজায় ঠেস দিয়ে বলল, আমার মা এখানে থাকে না।

ফতিমার বুকটা সহসা কেন যে কেঁপে উঠল। ঠোঁট কাঁপল—চোখ ভারি হয়ে উঠছে। এমন দুটো ডল পুতুলের মতো ছেলেমেয়ে রেখে নারী কতদূর যেতে পারে! জীবনের কোনো বড় কেচ্ছা কী সোনাবাবু গোপন রাখতে চান তার কাছে। তাকে সেজন্য বাসায় নিয়ে আসতে রাজী হননি। বাসায় আসবেন বলে বের হয়ে শেষে কফি-হাউসে নামিয়ে দিতে বললেন! সে কি অকারণ বাবুটিকে তবে অপমান করেছে। অকারণ চিৎকার করে উঠেছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল, ডল পুতুল দুটিকে বুকে তুলে নিয়ে আদর করে। তাও পারছিল না। চোখ জলে ভার হয়ে আসছে। সোনাবাবু এত একা! মা কাছে নেই, কাছে থাকে না। সব বলেও দিতে পারে শিশুটি। শিশুরা তো কিছু গোপন করতে জানে না। যেন এ প্রসঙ্গে আর কোন প্রশ্ন করা ঠিক হবে না।

সোনাবাবু বলতেই পারেন আমার অজ্ঞাতে তোকে গোয়েন্দাগিরির রাইট কে দিয়েছে! আমাকে ছোট করে তোর কী লাভ! দেশেও পেছনে লাগার ওস্তাদ ছিলি, এখানে এসেও রেহাই নেই।

ফতিমার এখন কি যে হচ্ছে!

সে বলল, আপনার নাম কি?

আমার নাম! বলে টুটুল ঢোক গিলল। আমার নাম টুটুল। দিদির ফ্রক ধরে বলল, আমার দিদি। তুমি বাইরে বসে আছ কেন। ভিতরে এস না। আমার বাবা না বলেছে, লাল রঙের ঘোড়া কিনে দেবে। তুমি আমাকে হাতি কিনে দেবে কেমন?

শিশুটির এক নাগাড়ে কথা শুনতে শুনতে সেই শৈশব তাড়া করছে। সোনাবাবুরা শেষে কোথায় এসে উঠলেন? বাইরে থেকেই বোঝা যায় ভিতরে বিশাল বিশাল ঘর। পুরনো আমলের, প্রাচীন ইট, কাঠ, নোনা ধরা দেয়াল। লাইটের তার এ-ধার ও-ধার ঝুলে আছে। করিডরের মেঝে চটা ওঠা। জানালার পাশে বড় বড় পাতাবাহারের গাছ। রাস্তার ও-পাশে ফুল-ফলের বাগান। বড় বড় আলোর ডুম জ্বলছে।

সুখি বলল, দিদি আপনি ভুল করছেন। সোনাবাবু বলে কেউ নেই।

এবার ফতিমা মিষ্টি হেসে বলল, আছে। টুটুলের দিকে আঙুল তুলে বলল, মুখ দেখেই বুঝেছি সোনাবাবুর ছেলে। যেন সে বলতে পারলে আরও খুশি হতো, কোনো মেলায় কিংবা বান্নিতে হারিয়ে গেলেও চিনতে পারতাম। আমি তো সোনাবাবুর সেই যব-গমের খেতে এই ছোট্টবাবুটিকে নিয়ে লুকোচুরি খেলেছি। যেন অবিকল সেই দৃশ্য, গ্রামের পর মাঠ, গোপাট, সেই অর্জুন বৃক্ষ, বটের ছায়ায় আবার সে হাজির। ছোট বাবুটিকে কোলে তুলে আদর পর্যন্ত করতে পারছে না, তার তো সারা জীবনের স্বপ্ন, এমন এক ছোট্ট শিশুর হাত ধরে অর্জুন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বলবে, দেখ দেখ তোর মামুর কান্ড। কী লিখে গেছে দ্যাখ—জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থান চলিয়া গিয়াছি। কী লিখে গেছে দ্যাখ! এ-সব ভাবলেই চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। সে কোনরকমে একবার হাত বাড়িয়েও সাহসে বেড় পেল না—যদি সোনাবাবু ফিরে এসে রাগ করেন। ছোট্ট শিশুটিকে স্নান করান। এটা যে কত অপমান মানুষের পক্ষে সোনাবাবুরা বুঝতেই পারেন না।

সুখি কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সোনাবাবু এখানে থাকেন না, ভুল করছেন দিদি, বলতে পারছে না, সিঁড়ির ধাপে বসে আছে। চোখে মুখে এতটুকু অস্বস্তি নেই।

ফতিমার কেমন সব গন্ডগোল—সোনাবাবুর স্ত্রী এখানে থাকে না। এই দুই শিশুকে কে তবে আগলায়? সে ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়েছিল।

—আপনার কাকা কখন ফেরেন?

সুখি বলল, কাকার ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়।

—আপনার কাকিমা কোথায় থাকেন? সোনাবাবু তো বললেন, মাস্টারি করে।

সুখি বুঝতে পারছে, কাকার তবে আর একটা নাম আছে। তারপরই মনে হলো, তাই তো টুটুলের বিদ্যারম্ভের সময় কাকার আত্মীয়-স্বজনরা এসেছিল। টুটুলের দাদু এসেছিলেন। সে তখন সবে কাজে লেগেছে। দাদু অতীশ বলেই ডাক-খোঁজ করতেন। কেবল যেন একবার বলেছিলেন, সোনাকে বল, চা খেলে কোনো দোষের হবে না। কাকিমাকে ডেকে ওর মনে হলো ঐ একবারই বলেছিলেন। তার খেয়াল ছিল না।

—মাস্টারি করেন অনেক দূরে।

–কোথায়?

—বর্ধমান থেকে বাসে যেতে হয়। কোথায় বলতে পারব না।

—এদের কে দেখে?

—আমি। কি দুষ্টু না! আপনি ভিতরে এসে বসুন। কাকা এসে শুনলে রাগ করবেন।

—আপনি ওর কোন দাদার মেয়ে? ফতিমা প্রশ্ন না করে পারল না।

সুখি যে এ-বাড়িতে কাজ করে বলতে সংকোচ হচ্ছিল। এমন ছিমছাম, নাকে নাকছাবি, কমলা রঙের ছাপা সিল্ক এবং আশ্চর্য এই সিঁড়ির ধাপে বসে থাকায় কেন যে মনে হচ্ছিল, ইচ্ছে করেই কাকাকে অপমান করছে, কিংবা মনে হচ্ছে, কোনো মন কষাকষির ব্যাপার থাকতে পারে, ভিতরে ঢুকবে না—কিন্তু কে এই যুবতী, কোনোদিন যাকে দেখেনি, কাকিমার কেউ হলে, এভাবে বসে থাকতে পারে! নানা দ্বিধায় সে ভুগছিল।

টুটুলের তর সইছে না। সে সোজা দরজার বাইরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, শাড়ি টেনে, হাত টেনে বলল, ভিতরে এস না। এস না। আমার কত বই আছে জান? আমি ইস্কুলে পড়ি। তুমি আমার কে হও?

ফতিমা আর পারল না, বুকের ভিতরে গভীর ক্ষত টের পায়। সে টুটুলকে দু’হাতে জাপটে মাথায় মুখ ঘষে দিল। বলল, আমি কেউ হই না তোমার।

—কেউ হও না তো, এলে কেন?

সেই তো! শিশুর এমন সোজাসুজি প্রশ্নে কেমন সে অস্থির হয়ে উঠল। পরমুহূর্তে সংকোচ—যদি সোনাবাবু নিন্দায় পড়ে যায়। কথা হয়। গোটা রাজবাড়ি এলাকা চাউর হয়ে যাবে—বাড়ির অন্দরে যবনী ঢুকে গেছে। ভাবতে গিয়ে সে কিছুটা বিস্মিতও হলো। বিদেশে তার আলম সাবের বন্ধু-বান্ধবী কত, হিন্দু বাঙালীই বেশি। কোনো সংকোচ বোধ করেনি। অথচ সে নিজের দেশে ফিরে কতরকমের কূট কামড়ে ভুগছে।

ফতিমা বলল, টুটুল আপনি আমার বাসায় চলেন। আপনার বাবা-মা কেউ ভাল না। আপনাকে একা ফেলে চলে যায়।

—যাব কেন! তুমি কে হও বল না!

মিণ্টুরও আবদার ভিতরে এস না।

সুখিও বলছে, ভিতরে এসে বসুন। কাকাকে কী বলব!

—কিছু বলতে হবে না।

মুখে তার বড় আবিষ্কারের সুখ। এরা তো জানে না। বাসায় যাব বলতেই সোনাবাবু বিপাকে পড়ে গেছিলেন। ধন মামী, ধন মামা সবাইকে নিয়ে সোনাবাবুর সংসার এমনও ভেবেছিল। সে সোনাবাবুর শৈশবেই কত রকমের অশান্তির কারণ হয়েছে। এখন আবার যদি কোনো অশান্তির কারণ হয়! সোনাবাবুর বাবা জ্যাঠারা বড় ধর্মভীরু মানুষ, সংসারে নানা সংস্কার। নানী তাকে পই পই করে বুঝিয়েছে হিন্দুবাড়ি, মনে রাখিস। ছুঁইয়া দিলে জাত যায়। ভিতরে বোধহয় সেই কোড়া পাখিটাই ডুব ডুব করে ডাকছে। না হলে সিঁড়িতে কে বসে!

তার সাহস হয়নি, সাহস না, কোনো ঝামেলা হয় এ-সব ভেবেই সে সিঁড়িতে বসে আছে। তার তেষ্টা পাচ্ছে। আর উঠতেও ইচ্ছে করছে না। খারাপ লাগছে।

টুটুলকে কোলে নিয়ে বসে আছে। সোনাবাবু সামনে থাকলে এতটা বোধহয় সাহস পেত না। ছুতমার্গ হিন্দু জাতটা তাদের কেন এত দূরে সরিয়ে রেখেছে সে বোঝে। তবু আছে কোথাও নরম উষ্ণতার লোভ—যা সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছে না। যা হয় হোক, সে লড়বে।

রাজবাড়ির এদিকটায় লোকজনের বিশেষ কোনো সাড়া নেই। হোঁৎকা মতো একটা লোক ফতুয়া গায়ে দিয়ে যাচ্ছে। মাথায় লম্বা টিকি। খালি পা। পরনে হাঁটু পর্যন্ত কাপড়। টুটুল তাকে দেখেই চেঁচাতে থাকল, দুমবার দাদা, আমার পিসি। এই দ্যাখ পিসির কোলে আমি বসে আছি।

দুমবার এদিকেই আসছে।

ফতিমার গলা শুকিয়ে উঠছে। রাজবাড়ির পাইক পেয়াদা হবে।

সে তাড়াতাড়ি টুটুলকে আরও জড়িয়ে ধরল। কাছে এসে বলতেই পারে, আপনি সিঁড়িতে বসে কেন? কিন্তু পিসি হয় শুনে দুমবার বলল, না, আমার পিসি।

দুমবার এভাবে টুটুলকে রাগাতে পছন্দ করে। মজা পায়। টুটুল বাবার হাত ধরে রাজবাড়িতে বের হলেই বলবে, আমার বাবা। দুমবারকে দেখলেও বলবে, আমার বাবা। দুমবার বলবে, না আমার বাবা। ব্যস লেগে গেল দু’জনে। টুটুল আঁচড়ে খামচে তার যুদ্ধ ঘোষণা করবে। তার বাবা আর কারো বাবা হলে, সে ক্ষেপে যায়। না পারলে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে অকারণ কাঁদতে থাকে।

সেই দুমবার এত বড় মজা পেয়েও এদিকটায় এল না। সভ্রান্ত চেহারার কোনো আত্মীয়া ম্যানেজার বাবুর হতেই পারে। তার সঙ্গে আলাপ নেই। আর নারীজাতি মাত্রেই দেবী—সামনে যেতে হলে, কথা বলতে হলে, দেবীর আগ্রহ থাকা দরকার, বোঝে। দুমবার দেখল, দেবী টুটুলকে কোলে নিয়ে বসে আছেন ঠিক, তবে তাকে বিশেষ যেন পছন্দ করছেন না। সে দাঁড়াল না। কিংবা ঐ একবারই বলা, তারপর হন হন করে সামনের বাগান পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ফতিমা।

ফতিমার এত তেষ্টা পাচ্ছে কেন! সে বলল, জল।

সুখি ছুটে গিয়ে ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে জল এগিয়ে দিলে বলল, কাচের গ্লাস নেই?

—আছে।

—কাচের গ্লাসে দিন।

সুখি গ্লাসটা তাকিয়ে দেখল। কোথাও এঁটো-কাঁটা যদি লেগে থাকে। কিংবা অপরিচ্ছন্নতার আভাস থাকলেও খারাপ। কিন্তু গ্লাসটা বড় এবং কোথাও তার দেওয়া জলে বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই। তবু এই অনাগ্রহ, কাচের গ্লাসে জল খাওয়া এবং পরে একটু জল চেয়ে গ্লাসটা ভাল করে ধুয়ে উপুড় করে রাখার কি কারণ সে বুঝল না।

সুখি না পেরে বলল, কিছু না খেয়ে গেলে কাকা রাগ করবেন। আপনি এখানে বসেছিলেন শুনলে রাগ করবেন। ভেতরে ঢোকেননি জানতে পারলে গুম হয়ে যাবেন। কাকা তো এমনিতে বড় বেশি চাপা স্বভাবের!

ফতিমা বলল, খুব রাশভারি।

—না। ঠিক রাশভারি না। কাকা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে রাতে ঘুমোন না। অনিদ্রার রোগ আছে। কাকিমা বড় তটস্থ থাকেন কাকাকে নিয়ে।

ফতিমার মুখ ব্যাজার হয়ে গেল। বলল, কোনো অসুখ হয়েছে।

—না। অসুখ না। কাকা তো একবার না বলে, না কয়ে চলে গেছিলেন। দু-দিন পর ফিরে এলেন।

—কোথায় গেছিলেন বলেননি?

—কাকিমার কাছে। তা কেউ যেতেই পারে। কাকার কী যে হয়, কিছুই মনে রাখতে পারেন না। টুটুল মিণ্টু বাড়িতে একা, সারা রাজবাড়ি তোলপাড় থানা পুলিশ।

ফতিমা আর পারল না। সত্যি তো, জেমসেও যে মানুষটাকে প্রথম বিশ-বাইশ বছর পর দেখেছিল, কেমন শূন্য দৃষ্টি—তারপর তাকে চিনতে পেরে বালকের মতো হেসে বলেছিলেন, তুই ফতিমা না! তারপর বাসায় ধরে নিয়ে গেলে এতটুকু অস্বাভাবিক আচরণ তাঁর টের পায়নি। সোনাবাবু কি তার বড় জ্যাঠামশাইর মতো হয়ে যাবেন! ভাবতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। বলল, কত রাতে ফেরেন?

—তা নটা-দশটা বেজে যায়।

—কোথায় যান কিছু বলে যান না! সেদিন তো বললেন, কফি-হাউসে নামিয়ে দিতে।

—আপনার সঙ্গে কাকার কোথায় দেখা!

—এই একটা সিনেমায়। ও কিছু না।

তবে কি সে না জেনে, না বুঝে বাবুটির সঙ্গে অন্যায় করেছে। কেমন জ্বালাবোধ করছিল। আর কেন যে মনে হচ্ছিল, দুই নিরুপায় শিশু বাড়িতে বন্দী।

সে না বলে পারল না, ওদের পড়াশুনা কে দেখে?

—কাকা।

কখন বের হন?

—সকাল আটটায়। কারখানায় গন্ডগোল। কাকা তো একবার প্রাণে বেঁচে গেছেন নেহাত বাপ ঠাকুরদার আশীর্বাদে।

–কী গন্ডগোল!

—ঐ ইউনিয়ন, লক আউট। আমি ঠিক বুঝি না দিদি।

ফতিমা বুঝল, সোনাবাবু ভাল নেই। সংসারে অর্থাভাব আছে। না হলে বৌকে কেউ এতদূরে পাঠিয়ে দেয়। বাবুর মাথার উপর বড় বোঝা এও টের পেল যেন ফতিমা।

—ওঁর বাবা-মা কোথায় থাকেন?

—মুর্শিদাবাদের দিকে। কলোনিতে।

—আসেন না?

—খুব কম। ঠাকুমা মাঝে এসেছিলেন।

সোনাবাবুদের সেই বৈভব তাকে তাড়া করছে। কত বড় সব টিন, কাঠের ঘর, সোনাবাবুদের উপনয়নে কী জাঁকজমক, অতিথি অভ্যাগত কত! সামনে বিশাল পুকুর, গোপাট, তার পাগল জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে বার হওয়া, ফতিমা, মঞ্জু কতদিন সোনাবাবুর সঙ্গ নিয়েছে। কোনো ঝোপ জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে যদি। কোনো খোঁজ পাওয়ার আশায় তারা একবার ট্যাবার জঙ্গলে ঢুকে গেছিল। তার সব মনে পড়ছে। কাটা মোষ নিয়ে যায়, বাস্তুপূজায় বলি হয়। লোকজন বাঁশে ঝুলিয়ে কাটা মোষ নিয়ে যায়। পেটে কাটা মুন্ডু। হু হুম না। সেই সব স্মৃতির মধ্যে ঢুকে গেলে সহসা মনে হলো, সেই সুপুরুষ পাগল মানুষটির মতোই যেন সোনাবাবু কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সেটা কী? কিংবা সব মানুষই কী কোনো না কোনো খবরের আশায় থাকে! এমন কোনো খবরের প্রতীক্ষায় আছেন, সোনাবাবু-–যা পৃথিবীর অন্য কোনো ছবি তুলে ধরবে!

সে কেমন নিজের ভিতর ডুবে যাচ্ছিল। আর তখনই টুটুল বলল, তুমি আমার পিসি হও না! –আমি আপনার পিসি।

—কোথাকার পিসি তুমি! লিলুয়ার পিসি।

–না। আমি পাকিস্তানের পিসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *