1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৩৬

॥ ছত্রিশ ॥

সুরেনের বড় মেয়ে সুখি সকাল থেকেই বারান্দায় বসে আছে। অতীশ বাজারে যাবার সময় দেখল, সিঁড়ির একপাশে সুখি বসে আছে। যাবার সময় বলে গেছে, ভেতরে যা। এসেও বলেছে কিরে বসে আছিস কেন! ভেতরে আয়। তোর কাকিমা জানে, বলে রেখেছি। কিন্তু সুখি কি যেন বলতে চায় ভেতরে ঢুকলে বলা হবে না। অথবা একবার কাজ আরম্ভ করে দিলে পরে আর দরাদরি হয় না। সে বুঝতে পেরে বলল, ঠিক আছে না হয় আর পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেব। টাকাটা আলাদা আমার কাছে নিস। তোর কাকিমাকে বলতে যাস না।

সুখি উঠে দাঁড়িয়েছে। কোনদিকে যাবে যেন বুঝতে পারছে না। অতীশের দিকে মুখ তুলে কথা বলতে পারে না। না পারারই কথা! অতীশ রাজার আমলা, বড় কোয়ার্টার, গেটে অতীশকে শাদেক আলি সেলাম দেয়, তার বাবাও দূর থেকে দেখলে গড় হয়, আরও কি আছে সম্ভবত, যা সুখিকে এ সময় দেখে সে বুঝতে পারছে না। কেবল আঁচল সামলাচ্ছে। স্বামী পরিত্যক্তা, সুখি বাপের কাছে চলে এসেছে, দেখতে খারাপ না। ভদ্র বংশের মেয়ে দেখলে বোঝা যায়। দেশ ভাগ না হলে সুরেনকে হয়তো এই রাজবাড়িতে শেষ পর্যন্ত উঠে আসতে হতো না। সুখির সরল অকপট মুখ, বিষণ্ণতা আছে বোঝা যায়, যুবতী সুখির স্বামী কাপড়ের দোকানে কাজ করে, মা ভাই আছে, অনাহারের জ্বালায় চলে এসেছে। অনাহার না অন্য কোনো জটিলতা, যাইহোক, কাজের বাড়ি, অতীশের একদন্ড দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই, হাসু ভানু দেশ থেকে চলে এসেছে, বৌদিকে নিয়ে বাজার প্রতিমা সব কেনাকাটা সারা।

সুখি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে না। সে ভেবে পেল না আর কি বলা যায়। দু’হাতে ব্যাগ। বেশ ভারি। নির্মলা কাজ নিয়ে চলে গেলে সুখি তার ঘরসংসার দেখবে। টুটুল মিণ্টুকে সামলাবে। সে অফিস থেকে ফিরে এলে সুখির ছুটি। এমনই কথা আছে। নির্মলা সুখির মধ্যে কি আবিষ্কার করেছে কে জানে, প্রথমে রাজি হয়নি, মা কিংবা অলকাকে এনে রাখার জন্য বলেছে।

অতীশ বলেছে, আসবে না।

নির্মলা ছেড়ে কথা বলেনি, আসবে না কেন! আমি চলে গেলে কে দেখবে ওদের। কার জন্য যাচ্ছি।

অতীশ জানে, তার যা আয় তাতে সংসারে টানাটানি থাকার কথা না। দুটো সংসার টানতে গিয়ে ঘাড়ের জোয়াল ভারি হয়ে গেছে। নির্মলা তার কিছুটা হাল্কা করতে চায়। এক সময় বাড়ির টাকা নিয়েও কম কথা কাটাকাটি হয়নি।—তোমার দাদাকে বল কিছু করে দিক।

দেবে না।

তোমার মা বাবা, তার মা বাবা হয় না!

হয়।

তবে?

দায়িত্ব কেউ নেয়, কেউ নেয় না। চাপিয়ে দিলেও গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়।

সুখিকে হাসি কুম্ভবাৱু মিলে ঠিক করে দিয়েছে। বৌদির সঙ্গে কথা বলেই কুম্ভ ঠিক করেছে, বেচারা বড় বিপাকে পড়ে গেছে, রাখুন। বিশ্বাসী। ভদ্রঘরের মেয়ে। কোথায় যাবে! টুটুল মিণ্টুর কথা ভেবেই নির্মলা রাজি হয়েছে। রাতে থাকতেও চেয়েছিল, নির্মলা রাজি হয়নি। তার মানুষটি বাসায় ফিরে এলেই সবাইকে খাইয়ে সে চলে যাবে। বাবুর্চি পাড়ায় সুরেনের এক চিলতে ঘর, সামনে বারান্দা, বিশাল ময়লার নালা পাশ দিয়ে চলে গেছে। ঘরে পাশাপাশি করে শুলেও সুরেন আর তার বউ তিন মেয়ের জায়গা হবার কথা না। এরই মধ্যে কি করে যে থাকে, অতীশের মাথায় আসে না। অতীশ চুপচাপ ছিল। নির্মলা একবার অতীশের দিকে তাকিয়ে কি ভেবেছিল কে জানে। বলেছিল, না হবে না। বাগানটা পার হলেই তো সুরেনের বাসা। দূর তো নয়!

দূর নয়, কিন্তু নির্মলা এক কথায় বুঝিয়ে দিয়েছিল, তবে কাজ করে দরকার নেই, আমি যাচ্ছি না। সুখি কি ভেবে বলেছিল, ঠিক আছে কাকিমা, চলে যাব। আমাকে তবু রাখুন।

কিন্তু আজ সুখি কেন ঢুকছে না ভেতরে!

সে বলল, কি বলবি বল!

সুখি মাটির দিকে তাকিয়েই বলল, এত জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকবে! রাতে থাকলে কি দোষ!

সেই এক কথা।

অতীশের মাথা গরম হয়ে গেল। কার ওপর সে বুঝতে পারছে না। নির্মলা কেমন মাঝে মাঝে অবুঝ হয়ে যায়। যুক্তির ধার ধারে না। নিঃস্ব এই যুবতীটিকে দেখলে মায়া হবারই কথা। কতদিন দেখেছে একগাদা কাপড় কাচাকাচি করলে, হাসি দুটো রুটি দিয়ে বলেছে, নে খা।

কি খুশি! রুটি গুড় তারিয়ে তারিয়ে মানুষ খেতে ভালবাসে সুখিকে না দেখলে সে জানত না। আহার মানুষের জন্মের সঙ্গী। সুখিকে দেখেই তার কথাটা মনে হয়েছিল। সেই সুখি আহারের সঙ্গে একটু আশ্রয়ও চাইছে। সুখি রাতে থাকলে সে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, নির্মলা সেই ভেবেই রাজি হয়নি। কিন্তু নির্মলা তো জানে না, এই বাসাবড়িতে সে একা থাকতে ভয় পায়! রাতে খুট খুট আওয়াজ, মনে হয় অন্ধকার করিডরে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। কখনও সহসা জেগে গেলে মনে হয়েছে, আবছা মত এক ছায়া তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। জেগে যেতেই সেই ছায়ামূর্তি বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কি দেখে! কাকে দেখে! ঠিক স্পষ্ট নয়, আবার মনে হয় সেই বাঘের মত ডোরা কাটা মুখ, যেন হা হা করে অনেক দূরে থেকে কেউ হাসছে। ছোটবাবু আমি আছি, যতদিন তুমি আছ আমি থাকব।

বিশাল বাসাবাড়িটা আলগা, সামনের জানালায় পাতাবাহারের গাছ। তারপর অন্দরের গাড়িবারান্দা, সেখানে মাত্র একটা অল্প আলোর ডুম জ্বলে, কিছুটা ফাঁকা জায়গা পার হয়ে নতুন বাড়ি রাজার। বাড়িটায় কেউ থাকে না। বিশাল ঘরগুলো খালি, কোনো ঘরে শুধু বইয়ের আলমারি। কাচের আলমারিতে সব দুর্লভ বই, কেউ ওসব এখন ছুঁয়েও দেখে না। সকালে একবার দরজা খুলে সাফসোফ করা হয়, তারপর সারাদিন দরজা বন্ধ। জানালা বন্ধ, হাওয়া পর্যন্ত ঢুকতে পারে না। নতুন বাড়ির পাশ দিয়ে গাড়ি বের হবার রাস্তা। ডানদিকে ফুলের বাগান, করবী, গুলঞ্চ, মাধবীলতা, রজনীগন্ধা, কাঠমালতী, বিঘেখানেক জমি জুড়ে বাগানটা। রাতে এ-দিকটা ভারি নিঝুম। পুকুরপাড়ের দেবদারু গাছটা দেখলেও গভীর রাতে গা ছমছম করে। সুখি বাড়িতে থাকলে মনে সে জোর পেত।

সুখি আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে।

সে বলল, ঠিক আছে পরে কথা বলব। ভেতরে যা। তোর কাকিমা সকাল থেকেই বলছে, কৈ সুখি তো এল না!

সুখির আজ থেকেই কাজে লাগার কথা। সেই সুখি সকাল সকাল না আসায় গজগজ করছিল নির্মলা। কুঁড়ে অলস এমন অপবাদ দিচ্ছিল সুখিকে। সদরের বাইরে সিঁড়িতে সুখি এসে বসে আছে টেরও পায়নি। সে বাজার থেকে ফিরেও বসে আছে দেখতে পাবে আশা করেনি।

সে বলল, যা ভাল বুঝিস কর।

সে এগিয়ে গেলে সুখি বলল, কাকা আমি টাকা পয়সা চাই না। খেতে থাকতে দিলেই হবে। আমি কারও অনিষ্ট করব না কাকা।

অতীশ বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেল। সুখি আশ্রয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। টাকা পয়সাও চায় না। ছাড়া গরুর মত এখানে সেখানে পড়ে থাকে। তবে কি তারও মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে, নবর জামা প্যান্ট সনাক্ত করা যায়নি। সেই দেড় দুইবছর আগে নব যে প্যান্ট শার্ট গায়ে বের হয়ে গিয়েছিল, সেই জামা প্যান্ট সনাক্ত করার কথাও ওঠে না। কে মনে রেখেছে জামা-প্যান্টের কথা! কী রঙ ছিল প্যান্টের, জামা ডোরাকাটা না হলদে কিংবা নীল রঙের কার এত স্মৃতিশক্তি! পুলিস সুরেনকে ছেড়ে দিয়েছে! সুরেনের খকখক কাশি সারারাত, সে চবর চবর পান খায়, কফের সঙ্গে রক্ত ওঠে, এটা গোপন করার জন্যই পানের বন্দোবস্ত। এক একবার তো যায় যায়। আবার ভাল হয়ে ওঠে। কবিরাজি করায়। ডাক্তার ডাকে না। ধরা পড়ার ভয়ে সুরেন গুটিয়ে গেছে কেমন।

সুখি কি টের পেয়েছে, বাপের মরণ হয়েছে। এক ঘরে থাকলে সেও মরবে। এ সময় কেন জানি অতীশের মনে হল এই সংক্রামক ব্যাধি সুখি তার বাড়িতে বয়ে আনতে পারে। সুখিকে রাখা ঠিক কাজ হবে না। রাখলেও বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে দেওয়া অনুচিত কাজ হবে।

সে বলল, ঠিক আছে পরে কথা বলব। আয়।

সুখি আর কিছু বলল না।

অতীশ বাজারের থলে সিঁড়িতে রেখে কড়া নাড়ল। টুটুল ছুটে এসে দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখল কে দাঁড়িয়ে, বাবা! দরজা খুলতেই অতীশ দেখল, নির্মলা পাশে দাঁড়িয়ে।

এত দেরি?

আর বল না, কুশ বাজারে পাওয়া গেল না। সেই বৈঠকখানায় যেতে হল।

সুখির দিকে তাকিয়ে নির্মলা বলল, এত দেরি, কোন সকালে আসার কথা!

সুখি রান্নাঘরের দিকে ঢুকে গেল।

ব্যাগ দুটো রেখে করিডর পার হয়ে অতীশ দেখল, বাবা, পঞ্চতীর্থকাকার স্নান হয়ে গেছে। এই শীতের মধ্যে সামান্য নামাবলি গায়। মূর্তি জল চৌকিতে বসান। অতীশ তার সন্তানের মঙ্গলার্থে প্রথম কাজ করছে। এই ধূপ দীপ, পুষ্প পত্র পল্লব মিলে মানুষের আর এক জগৎ থাকে, সন্তানের দীর্ঘ আয়ু বিদ্যা যশ সব দরকার, অথচ সেই এক ইচ্ছের তাড়নাতেই সব। টুটুল, মিণ্টু, বাজার স্কুল অফিস এবং আরও সব কত বিচিত্র জটিলতা। সে যে আর্চির প্রেতাত্মার তাড়নায় রাতে ঘুমোতে পারে না মাঝে মাঝে চোখের নিচে কালি পড়ে যায়, এবং তখন সেই দূরের সমুদ্রে সাদা বোট আর বনি ছাড়া কাউকে দেখতে পায় না, এসব তার এখন মনেই পড়ছে না। নির্মলা নিমপাতা কাঁচা হলুদ বেটে রেখেছে, রান্নাঘর থেকে বলছে, তোর বাবাকে বল চান করে নিতে। টুটুল বাটি নিয়ে দৌড়ে আসছে। ভয় দিদিটা না আবার তার আগে বাটিটা বাবার কাছে নিয়ে যায়। পঞ্চতীর্থকাকা, এবং বাবা শাস্ত্র আলোচনা করছেন, তার মনে হয় তখন, এক বয়সে বাবাও ঠিক তার মত রাতে সহবাসের তাড়নায় ভুগত, কিংবা বাবাও নারীর সেই গোপন সন্ধিস্থলে অবগাহন করতে গিয়েই—সে, হাসু ভানু, অলকা। অথচ এত গোপন এই কর্মধারা, জীবনের চলাফেরায় তার কোনো অস্তিত্ব আছে মনে হয় না। কিংবা মুখোশ পরে থাকা সংসারে, আসলে সেই প্রবল ইচ্ছের তাড়নাতেই মানুষের এই ধর্মশাস্ত্র, বীজ বপন এবং আবাদ। কে বলবে এর গভীরে আছে এক অশ্লীল মুহূর্ত, যা সব নারী পুরুষের কাম্য। নির্মলা যেভাবে রাতে পাগলের মত সংলগ্ন হবার জন্য তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে লেপের নিচে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, তাতে এ মুহূর্তের নির্মলাকে চেনাই যায় না। নির্মলার বোধহয় রাতে ঘুমই হয়নি। সবার আগে নির্মলা স্নান সেরে নিয়েছে। দুধ গরদ পরেছে। নির্মলার শ্যামলা রঙ, হাতে দু-গাছা শাঁখা, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতেও চওড়া করে সিঁদুর পরেছে, আশ্চর্য পবিত্র মুখ নারীর। ব্যস্ততার শেষ নেই।

ঘরে ঢুকে তাড়া লাগাল, চান করে নাও।

আজ পার্বণের দিন। কাঁচা হলুদ নিমপাতা বাটা বাটিতে, সে টুটুল মিণ্টুকেও অতীশের কাছে ঠেলে দিয়ে গেল।

স্নান করিয়ে দাও।

ওফ্ কি ঠান্ডা বাপ। টুটুল জামা খুলতে চাইছে না।

টুটুলকে উপলক্ষ করেই এই অনুষ্ঠান, এতটুকু শিশুও তা বোঝে।

সে বলল, বাবা আমি নতুন কাপড় পরব, না? জামা পরব, না?

অতীশ বলল, আজ পাথরে তুমি অ আ লিখবে। স্কুলে যাবে। দিদির মত বই কিনে দেব।

বাবা ওদিকের চাতালে রোদে বসে আছেন। জল চৌকিতে বসে কলার খোল কেটে ডোঙা বানাচ্ছেন। কুশ মাপ মত কেটে নিচ্ছেন। কুশের অঙ্গুরী তৈরি করছেন। এসবের মধ্যে বাবা জীবনে শুভ প্রভাবের খোঁজ পান। সংসারে অশুভ প্রভাবের তো শেষ নেই। কখন কোন অনাচারের ফলে তার নাতির অমঙ্গল হবে, সংসার রসাতলে যাবে, এই এক ভয় থেকেই তাড়া খেয়েছেন তিনি। যেন এই তাড়া আর্চির প্রেতাত্মার চেয়ে কম বড় তাড়া নয়।

অতীশের সহসা হাসি পেয়ে গেল। মানুষের জরা-ব্যাধি মৃত্যুই ঈশ্বর বিশ্বাসের কারণ। আসলে সে যে এতদিন তা পারেনি, তার কারণ জীবনের কোনো অনুভূতিমালায়, দেবীমূর্তিরা তার কাছে আশ্রয় হয়ে দেখা দেয়নি। বরং তারা খড়কুটো মাটির পুতুল ছাড়া বিশ্বাস হয় না। কোনো মন্দির গাত্রেই সে দৈববাণী শোনেনি। বরং মনে হয়েছে, দেব-দেবীকে কেন্দ্র করে এ-দেশে এক বড় কারুকার্য তৈরি হয়েছে। এছাড়া এই সব দেব-দেবী তার কাছে কোনো শুভ বার্তা বহন করে আনেনি।

তবে কেন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন! সে-তো বলতে পারত, না বাবা বিদ্যারম্ভ কিংবা মৃত্যুযোগ নিয়ে আচার অনুষ্ঠানের দরকার নেই। শুধু অপচয়। তাও বলার সাহস হয়নি। টুটুল মিণ্টুর মুখের দিকে তাকালে সে তার ভিতরের জোর হারিয়ে ফেলে।

বসে থাকলে চলে না। সে দ্রুত এখন সব হাতের কাজ সারছে। বাবা ডেকে বললেন, অতীশ শোনো।

অতীশ কাছে গেলে বললেন, খাগের কলম বানাতে হবে। মাটির দোয়াত এনেছো তো! বৌমাকে বল, কিছুটা কাঁচা দুধ যেন আলাদা করে রেখে দেয়।

সে বলল, বলছি।

দৌড়ে রান্নাঘরের দরজার মুখে ঢুকতেই দেখল হাসি দাঁড়িয়ে আছে। হাসি কি সেজে এসেছে! হাসি সাজতে ভালবাসে। নারীরা ঠিক বোঝে কে কোন সাজ পছন্দ করে। হাসির ঠোঁটে হাল্কা নীল রঙের লিপস্টিক, নীল জর্জেট এত টান টান করে পরেছে, যে অতীশ তাকাতে পারছে না ভাল করে। সে একবার কোনরকমে চোখ তুলে যেন দেখল, যাক তুমিও এসে গেছ। দাঁড়িয়ে থেকো না। এবারে কাজে লেগে পড়।

নির্মলা বলল, তুমি কি!

কেন কি করেছি!

চা-টা খাক। এসেই হেঁশেলে ঢুকবে। চা হচ্ছে। তোমাকে দেব?

দাও। বাবা যখন বলেছেন, চা খেতে পারব। চা-এ দোষ নেই।

অঞ্জলি না দেওয়া পর্যন্ত উপোস করতে হবে। কিন্তু অতীশ জানে এটা তার কাছে বড় রকমের বিড়ম্বনা। সকালে খালি পেটে চা না খেলে তার বাথরুম পরিষ্কার হয় না। পেটে অস্বস্তি থাকলে, অঞ্জলি কার নামে। মানুষের ইহকাল পরকালের ভাবনা বড় মারাত্মক ব্যাধি। এই ব্যাধির ভয়ে সে তটস্থ আছে।

সকালে নির্মলা চা করে দিলে খায় নি।

নির্মলা কি জানে, মানুষটার নানারকম কু-অভ্যাসের মধ্যে সকালে চা এবং বাথরুম আছে। বাবা কাল সতর্ক করে দিয়েছিলেন, উপবাস, অঞ্জলি দেবার আগে কিছু খাবে না। সেও যে জানে না তা নয়। তবু বাবা বিশ্বাস করেন না তাকে। সে তো আচার নিয়ম লঙ্ঘন করার মধ্যে মজা পায়। তাই বাবার সতর্কতা। সে নিজেও চা ফিরিয়ে দিয়েছে। বলেছে, থাক। একটা তো দিন। ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারব।

ম্যানেজ আর হয় নি।

অস্বস্তি কি মুখে ফুটে ওঠে!

সে বাথরুমে যাবার জন্য সকাল থেকে পায়চারি করেছে। চা খেয়ে সামান্য পায়চারি করলে, এবং একটা সিগারেট খেলে বাথরুম তার ঝকঝকে পরিষ্কার। নির্মলা ঠিক খেয়াল করছে। এই যে স্নানে যাচ্ছে না, একই কারণ—পায়চারি করে দেখছে, চেষ্টার ত্রুটি নেই, কিন্তু অমোঘ নিয়তির মতোই এক কাপ চা তাকে তাড়া করছে বুঝতে কষ্ট হয় নি নির্মলার। তাই আর একবার বলে দেখা, দেব এক কাপ। আচার অনুষ্ঠান এবং ঈশ্বরের চেয়েও বেশি জরুরী, মানুষটার অস্বস্তি দূর করা। নির্মলা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বাবাকে বলেছে, ওর তো বাবা সকালে এক কাপ চা না খেলে মাথা ধরে। দেব এক কাপ?

অতীশ শুনতে পেয়ে বলেছে, আরে না না। মাথা ধরবে না। চা লাগবে না। বাথরুমের কথা বলেনি নির্মলা। বড় খারাপ লাগে শুনতে। বাবা বলেছেন, খেতে পারে। ঈশ্বর তো সবার ভিতরেই আছেন, তাকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ!

বাবার সবই ঈশ্বরকেন্দ্রিক। যা কিছু করছে তাঁরই ইচ্ছেতে। আর্চির খুনও কি তবে তাই। সে কি বাবার কাছ থেকে এই খুনের বিধান জেনে নেবে! কারণ ঈশ্বরই যদি শরীরে বসবাস করেন তাঁর ইচ্ছেতেই সে তবে কাজটা করেছে। তিনিই রক্ষক ভক্ষক এবং সবকিছুর নিয়ামক। তবে সে অশুভ তাড়নায় এত ছটফট করছে কেন! তাঁরই ইচ্ছে ছিল, আর্টি এবারে খুন হোক। সে খুন হল। যেমন বনি বলত, দেন গড সেইড, লেট দেয়ার বি লাইট অ্যান্ড লাইট এপিয়ার্ড। অ্যান্ড গড ওয়াজ প্লিজড্ উইথ ইট, অ্যান্ড ডিভাইডেড দ্য লাইট ফ্রম দ্য ডার্কনেস। সেও কি আর্চিকে খুন করে লাইট অ্যান্ড ডার্কনেস তৈরি করেছে জীবনে। আর্চি তার জীবনে ডার্কনেস, আর বনি আলোর প্রতীক। সহসা সুঘ্রাণ ভেসে এলে অতীশ চোখ তুলে তাকাল। সামনে হাসি। হাতে এক কাপ চা।

হাসি মিষ্টি করে হাসল, চা দাদা।

রাখ! কুম্ভবাবু অফিসে বের হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। কিছু বলতে হবে?

না।

পুজোর ঘরে চা খাওয়া ঠিক হবে না ভেবেই উঠে দাঁড়াল অতীশ। বলল, বড় গামলা লাগবে। তোমার থাকলে নিয়ে এস।

আমি দেখছি কি লাগবে না লাগবে। আপনি চানে যান।

তুমি চা খেয়েছ?

অঞ্জলি দিয়ে খাব।

তাহলে চা না খেলেও হাসির বাথরুম ঝকঝকে থাকে। হাসির এই সৌন্দর্যের অন্তরালে কোনো কদর্য বাথরুম থাকতে পারে না। মানুষের বাইরের শরীর এবং কদর্য এই বাথরুমে কত ফারাক! তার এ-সব কেন মনে আসে! আর্চির অন্ধকারটাই সে দেখছে জীবনে বেশি প্রভাব ফেলেছে। কোনো সুন্দরী নারীকেই সে রেহাই দেয় না। যেন সে সব দেখতে পায়। নির্মলা কিংবা বনি দু’জন নারীকেই সে চেনে, ভাল করে দেখেছে। সাদা বোট ভেসে যাচ্ছে, তখনও র‍্যাফটে রসদ মঞ্জুত। ঝড়ের দাপটে বোট ঠিক রাখতে পারছে না। ঢেউয়ের ঝাপটা এসে তাকে বনিকে ভিজিয়ে দিয়েছে। নোনাজলে কুটকুট করছে শরীর। চুলকাচ্ছে। সে অস্থির হয়ে পড়েছিল, গায়ে জামা প্যান্ট রাখা যাচ্ছে না। বনিও দড়িদড়া সামলাচ্ছে। তারও গাউন জব-জবে ভিজে। বনি বৃষ্টির মিষ্টি জল সঞ্চয়ের জন্য বালতি পাটাতনে রেখেছে। ঢেউরের ঝাপটা থেকে বালতিটা রক্ষার জন্য শক্ত করে ধরে বসে আছে। হলে কি হবে, বার বার বালতিসহ সে উল্টে পড়ে যাচ্ছে। খোলে জল জমছে, সে এক হাতে হাল আর এক হাতে নুয়ে ঢেউয়ের জল বাইরে ফেলছে। কিন্তু শরীর এত কুটকুট করলে সব সামলায় কি করে! সে হেঁকে উঠেছিল, বনি জামাটা ধর। গা তার খালি। কুটকুট করছে না। সে জামা প্যান্ট সব খুলে ফেলতেই আরাম। বৃষ্টির জলে সাফ। বনিকে চিৎকার করে বলছে, কারণ ঢেউয়ের গর্জনে শোনা যায় না কিছু আকাশে ভারি মেঘেরা দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বনির শরীরেও নোনাজলের কুট কামড়। সে চিৎকার করে উঠল, ছোটবাবু, ‘তোমার জামা প্যান্ট জলে ভেসে গেল।

সেও চিৎকার করে বলছিল, চুলকে ঘা করে ফেলছ শরীর। খুলে ফেল সব।

বনির কোনো দ্বিধা ছিল না।

বনি সব খুলে বোটের ছইয়ের মধ্যে ঢুকে গেছিল। বাইরে থাকলে ঝড়ো হাওয়া কিংবা ঢেউয়ে সব উড়িয়ে নেবে। এবং দুজনেই নগ্ন হয়ে বোট সামলাচ্ছে। নোনা ঢেউয়ের ঝাপটায় শরীর ভিজে গেলে, বৃষ্টির জলে তা ধুয়ে যায়। বনি তার কাজে মন দিতে পারছে। শরীর কুটকুট করছে না।

মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিদিনের এই লড়াই দুজনকেই সাহসী করে তুলেছিল। জাহাজ থেকে যারা আগে তিনটে বোট নিয়ে নেমে গেছিল, তারা কে কোথায় জানে না। ডাঙা পেয়েছে কিনা জানে না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তের দুঃসাহসিক অভিযানের শেষে এক নারী তার কাছে এভাবে উলঙ্গ হয়ে সামনে বসে থাকলে, সে চরম উত্তেজনা বোধ করত বেঁচে থাকার জন্য। তার জন্য না হলেও বনির জন্য কোনো ডাঙা চাই, নিরন্তর এই ভেসে চলা, কখনও মনে হতো গভীর অতলে রয়েছে সব রহস্যময় অতিকায় জীব, ব্যস্ত হাহাকারের মধ্যে নীল জলরাশির তান্ডব। ছোটবাবু পাল খাটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দানবের মত দু’বাহু বাড়িয়ে দিয়েছে অধিক ষড়যন্ত্রকারী সমুদ্র। অতি তুচ্ছ সব। সে সমুদ্রের খ্যাপামিকে জয় করতে শিখে গেছিল। সেসব তোলপাড় করা ঢেউয়ের মাথায় বোট উঠে গেলে সে অনেক দূরের সমুদ্র দেখতে পায়, চিৎকার করে ওঠে, শক্ত করে ধর। উড়িয়ে নিয়ে যাবে। জল খোলে জমছে। বালতি পাটাতনের নিচে রেখে দাও।

বনি চিৎকার করে বলত, জল নোনা। বৃষ্টির জলের সঙ্গে ঢেউয়ের ঝাপটা মিশে গিয়ে জল নোনা হয়ে গেছে। দড়ি আলগা হয়ে গেলে বোট কাত হয়ে যাচ্ছে, বনি, শিগগির দড়িটা টেনে ধর। ইস্ কি করছ, আরে হাত আলগা কেন, শিগগির বেঁধে ফেল। বোটে জল উঠে আসছে।

কাপ্তান তাকে বোটে নামিয়ে দেবার সময় যেসব নির্দেশ দিয়েছিলেন, সে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করছে। মাথা ঠান্ডা রাখবে, মনে রাখবে উই লিভ উইদ-ইন দ্য শ্যাডো অফ দ্য অলমাইটি, সেলটারড বাই দ্য গড হু ইজ এবাভ অল গডস।

নামিয়ে দেবার সময় তিনি কাঠের ক্রসও দিয়েছিলেন। অনন্ত হাহাকার সমুদ্রে যদি তৃষ্ণায় অনাহারে মৃত্যুও হয়, তবু ঈশ্বর মাথার কাছে আছেন। বাইবেলটি যত্ন করে সিলোফিন কাগজে মুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, এটা সব সময় শিয়রে রাখবে। বনিকে তিনি কিছু বলেননি, যেন বনিকে ছোটবাবুর সঙ্গে পাঠানো হচ্ছে ডাঙার খোঁজে। ডাঙা পেয়ে গেলে ছোটবাবু আবার জাহাজের অবশিষ্ট দুজন নাবিককে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।

অতীশ হাসল, আসলে তখন বালিকা বনি যুবতী হবার মুখে। বনি তার বাবাকে অবিশ্বাস করতে পারেনি। তাছাড়া ছোটবাবু একা ডাঙা খুঁজতে বের হলেও, সে জাহাজে থাকতে পারত না, কোথাকার এক ছোটবাবু তার সর্বস্ব হরণ করে নিল!

অতীশের মুখে বিষণ্ণ হাসি খেলে গেল অজ্ঞাতে। নির্মলাও যেন বনির মতই নির্ভর করে আছে। চালচুলো নেই এমন একজন মানুষের জন্য সে সব ছেড়ে এল। বনি নির্মলা এক গোত্রের। যেন লাভ ডাজ ব্রিং এবাউট জাস্টিস ইফ ইউ ওনলি ওয়েট এট লাস্ট। বনি এবং নির্মলা দুজনেই এক আকাশের নক্ষত্র! একজন পাশে, অন্যজন দূরে। সে জানে যত দূরেই থাক বনি, তাকে সব সময় লক্ষ্য রাখে। সে বসে থাকলে টের পায়, ঘুমিয়ে থাকলেও টের পায় বনি শিয়রে বসে আছে। বলছে, এভরি মর্নিং টেল হিম, থ্যাংক ইউ ফর ইওর কাইন্ডনেস, অ্যান্ড এভরি ইভনিং রিজয়েস ইন অল হিজ ফেইথফুলনেস।

সে বলল, বনি টুটুলের আজ বিদ্যারম্ভ। বনি, বাবা বলেছেন, টুটুলের কোষ্ঠীতে তার বাবার মৃত্যুযোগ আছে। সে কুলুঙ্গির দিকে তারপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

একি তুমি চানে গেলে না!

নির্মলা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে তাড়া লাগাল।

অতীশ যেন জেগে গেল মুহূর্তে। অ তাই তো। যাচ্ছি। এই টুটুল, মিণ্টু, ইস কোথায় থাকিস তোরা! আয় আয়।

বাবা বলছেন, যাও তোমরা, ডাকছে শুনতে পাচ্ছ না।

টুটুল তার বিদ্যারম্ভ বুঝে ফেলেছে। তার দুষ্টুমি আজ একটু বেশি মাত্রায়। আত্মীয়-স্বজনরা আসবে। নির্মলা তার বাপের বাড়ির লোকদের খেতে বলেছে। কোনো অনুষ্ঠানেই সে তার বাবা দাদা দিদিদের বলতে পারেনি। সে-ভাবে কোনো অনুষ্ঠানই অবশ্য হয় নি। এটাই তার জীবনে প্রথম অনুষ্ঠান। তাছাড়া নিজের এই প্রথম অনুষ্ঠানে বাপের বাড়ির দিকের কেউ না থাকলে সে কষ্ট পাবে। অপমান বোধে জ্বলবে। তাকে না, তার মানুষটাকে এই অপমান। অতীশ টের পায়, নির্মলা মাঝে মাঝেই জানালার কাছে গিয়ে কেন দাঁড়িয়ে থাকছে!

বাবা চাতালে বড় হরিণের চামড়া পেতে নিয়েছেন। নিজে সঙ্গে এনেছেন এটা। ওতে বসেই শুভ কাজ সারতে হয়। টুটুল বাবার কাঁধে ঝুলে পড়েছে, বাবার টিকি নিয়ে মিণ্টু খেলা করছে, বাবা এতে এক ধরনের আরাম পাচ্ছেন।

নির্মলা চলে গেলে, সে একা। টুটুল মিণ্টু তার সঙ্গে থাকবে। দুই শিশুর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই নির্মলা চাকরির জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। শুধু নির্মলা কেন, সে নিজেও নির্মলার কিছু একটা হলে তারা অন্তত জলে পড়ে যাবে না। নির্মলা কিছু করুক সেও চাইত। দরখাস্ত লেখা, টাইপ করা, পোস্ট করার কাজটা সেই করত। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিত। শহরের স্কুলে হল না, গাঁয়ের স্কুলে হয়েছে, এই খবরেও সে সেদিন রাতে হাতের কাছে খড়কুটোর অবলম্বন খুঁজে পেয়েছিল। তবে কি আর্চির প্রেতাত্মার তাড়া এই নিরাপত্তা বোধের অভাব থেকে। শহর কত নির্বান্ধব, সে এই ক’ বছরে হাড়ে হাড়ে তা টের পেয়েছে। খরচ বাড়ছে, কিন্তু সে ভাবে আয় বাড়ছে না। সে এসবই ভাবছিল আর টুটুল মিণ্টুকে নিম হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছিল শরীরে। সে নিজেও মাখছিল। চাতালের এক পাশে শীতের রোদ, বাবা পঞ্চতীর্থকাকা ঘরে, কোথায় কি লাগবে, তিল তুলসী বেলপাতা, পঞ্চদেবতার নৈবেদ্য সব বাবা নির্মলাকে সাজিয়ে দিতে বলছে।

সারাদিন এভাবে অনুষ্ঠানের মধ্যে তার দিনটা কেটে গেল।

বাবা, সে, নির্মলার দাদা, পঞ্চতীর্থকাকা বসে গেছে। কলাপাতায় খিচুড়ি ভোগ, পায়েস লাবরা, বেগুন ভাজা, টুটুল ধুতি পাঞ্জাবি পরেছে, মিণ্টু নতুন ফ্রক গায়ে দিয়েছে। টুটুলের ধুতি খুলে গেছে, এবং সে-সবটাই খুলে ফেলে শুধু পাঞ্জাবি গায়ে বাবার সঙ্গে খেতে বসে গেছে।

নির্মলার মেজদি, বাবা এসেছেন। গাড়ির শব্দ শুনেই বুঝতে পেরেছিল ওরা সবাই তবে এল। রাজবাড়ির গাড়ি যে নয়, রাজবাড়ির গাড়ি হলে পাতাবাহারের গাছগুলির পাশ দিয়ে অন্দরের গাড়ি- বারান্দায় ঢুকে যেত। গাড়িটা গাছগুলির পাশে থামায় বুঝেছে, ওঁরা তবে এলেন। নির্মলার ছুটে যাওয়া দেখেও বুঝেছে, নির্মলার বাবা মা মেজদিরা এসেছেন। দাদা এসে আগেই খবর দিয়েছিলেন, ওঁদের আসতে একটু দেরি হবে। মেজদি চেম্বার থেকে না ফিরলে আসতে পারছেন না।

নির্মলা আজ বালিকার মত চঞ্চল। তার পুত্রের যশ, বিদ্যা পরমায়ু প্রার্থনা করছে সবার কাছে। নির্মলার বাবাকে অতীশ সমীহ করে। কেমন অপরাধবোধ কাজ করে তার মধ্যে। যেন সে কুহকে ফেলে নির্মলাকে তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। অবিবেচক এবং মতিভ্রম না হলে এত সাহস হয় না।

নির্মলাই বলল, যাও। বসে থাকলে কেন। বাবাকে প্রণাম কর।

অতীশের যেন কোনো গরজ নেই। নির্মলা যেমন তার বাবা মাকে সহজেই বাবা মা বলে ডাকতে পারে, সে পারে না। সে শুধু বলবে, এই তোমার বাবা কি জানে, আমরা রাতে কি করি!

আবার অসভ্যতা শুরু করলে!

কোনো কোনো রাতে সে নির্মলাকে বুকে নিয়ে এমন মজার কথা বললে, নির্মলা বলত, মারব! তুমি কি! আমার বাবা তোমার কে হয়?

কেন শ্বশুরমশাই।

কেন তুমি বাবা বলতে পার না?

আচ্ছা তুমি আমি, বাবা মা, তারাও বাবা মা, অথচ সবাই কি নিষ্পাপ, কোনো নারীর সঙ্গে সহবাস করলে, সে কি অপবিত্র হয়?

জানি না যাও।

অতীশ উঠে গিয়ে প্রণাম করল।

একজনকে করলে সবাইকে করতে হয়, নির্মলা জানে তার মানুষ এই রকমেরই, সে শুধু নির্মলার বাবাকে প্রণাম করেই চলে যাচ্ছিল, আরে এ কি চলে যাচ্ছ কেন! বাবাকে করলে না!

করলাম তো।

তার বাবা জানে অতীশ এ-রকমেরই। তিনি তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে যাও। আমাকে আর করতে হবে না।

অতীশ যেন নিষ্কৃতি পেয়েছে।

এবং রাতে সবাই শুয়ে পড়লে অতীশ আজ লেখার টেবিলে বসে সকালের কাগজটায় খুঁজতে থাকল, সেই অমোঘ খবর। যেখানে নকশাল আন্দোলন জোতদার থেকে ম্যানেজারে উঠে এসেছে।

তালিকায় শুধু জোতদার নেই সেও আছে।

সে দেখল খবরটা ঠিক প্রথম পাতার নিচের দিকে। স্টাফ রিপোর্টার, ২৭ জানুয়ারি ‘৬৮ কারখানার ম্যানেজার খুন।

খুন কারা করেছে জানা যাচ্ছে না।

তবে উগ্রপন্থীদের কাজ পুলিসের সংশয়।

সে সহসা চিৎকার করে উঠেছিল, তুমিই শুধু যুগ যুগ বেঁচে থাকবে। আমরা মরে যাব। আমাদের কি দোষ! আমরা কি জলে ভেসে এসেছি!

.

নির্মলা বলুল, তুমি ক’দিন ছুটি নাও। একসঙ্গে যাই। টুটুল মিণ্টু জায়গাটা দেখে আসুক।

আরে এই তো দু’দিন ছুটি নিলাম। কত ছুটি পাওনা থাকে! হাসু তোমাকে দিয়ে আসবে।

অতীশ ক’দিন থেকে খুব গম্ভীর। এটা যে কেন হয়। একসময় নির্মলার চাকরি নিয়ে সেও কম চেষ্টা করেনি। দু’জনের আয়ে সংসারে সচ্ছলতার মুখ দেখতে চেয়েছে। কারণ টুটুলের জন্য চাই রাজার টুপি, মিণ্টুর জন্য ছোট্ট পরীর দুটো পাখা। শিশুরা সংসারে আসে, বড় হয়, যত বড় হয় তত দুশ্চিন্তা বাড়ে। এরা দুধে-ভাতে বড় হবে সব। সব বাবা-মা’ই এটা চায়। বাবার মাসোহারাও এক জায়গায় থেমে থাকছে না, জিনিসপত্রের দাম হু-হু করে বাড়ছে। চারজনের পরিবারে কত খরচ, যত দিন যাচ্ছে টের পাচ্ছিল অতীশ। তার অবশ্য একভাবে চলে গেলেই হল, বাবার জীবন থেকে এমন সে শিক্ষালাভ করেছে। কিন্তু নির্মলার জীবন অথবা তার বাবা-মা’র সংসার অন্যরকমের। নির্মলার সচ্ছলতা যে টান ধরেছে বাসায় ফিরলে এটা সে টের পেত। সে খেতে বসলে, টের পেত, নির্মলা গুম মেরে আছে। রাতে তার পাতে মাছ দিতে পারেনি, মিণ্টুর একটা লেসের ফ্রক না কিনলে নয়, দুটো পাজামা সার, তার আরও দুটো প্যান্ট শার্ট হলে ভাল হয়, জুতো জোড়া পাল্টানো দরকার—সবসময় একটা না একটা বাড়তি খরচ সংসারে লেগেই থাকে, আর তারই মধ্যে বাবার চিঠি, সংকুলান হচ্ছে না। তোমার মা’তো যা দেবী সর্বভূতেষু হয়ে আছেন, পার তো, এ-মাসে কিছু টাকা বেশি পাঠাবে। এই সব বিপাকের মধ্যেই নির্মলার চাকরির কতটা দরকার সে টের পেত।

কিন্তু চাকরিটা হয়ে যাওয়ার পর তার মনে হয়েছে—এত দূরে চলে যাবে! ট্রেনে বর্ধমান, সেখান থেকে ঘন্টা দেড়েকের বাস জার্নি। একা থাকবে নির্মলা। মেয়েদের স্কুল, সঙ্গে শিক্ষয়িত্রীদের কোয়ার্টার। পাশেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ডাক্তার নার্স রুগী, জায়গাটা নাকি ছবির মতো দেখতে। নির্মলাকে ছেড়ে থাকার কষ্টটাই তার এখন বেশি। সে অফিস থেকে ফিরে এসে টের পাবে সবাই আছে, কেবল নির্মলা নেই। সে যে কি নিঃসঙ্গ জীবন এখন থেকেই তা যেন টের পাচ্ছে।

এক রাতে বলেছিল, দরকার নেই অতদূরে যেয়ে। আমি আরও না হয় বেশি করে লিখব।

নির্মলা বলেছিল, কি বলছ! হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে দিচ্ছ। অন্তত শ’দেড়েক টাকা আমি তোমাকে দিতে পারব। বাড়ির টাকা নিয়ে আর তোমার দুশ্চিন্তা থাকবে না।

নির্মলা কি বোঝে মানুষটা তার নিরাপত্তার অভাব থেকে মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। রাতে সে যে অনিদ্রায় ভোগে, সেও দুশ্চিন্তা থেকে।

আবার উঠছ কেন?

জল খাব।

কোথায় যাচ্ছ?

সদরটা বন্ধ আছে কি না দেখছি।

তুমি কি আমাকে ঘুমোতে দেবে না! কেবল এ-পাশ ও-পাশ করছ।

সে কি করে যে বলে, নির্মলা আমার ঘুম আসছে না। কাল লেবার পেমেন্ট করতে হবে। কোনো ব্যবস্থা নেই। গো-স্লো শুরু হয়ে গেছে। ইউনিয়ান এগ্রিমেন্ট করতে চায়। মাইনে বাড়াবার দাবি। প্রোডাকসান মার খাচ্ছে। দু-পক্ষের পুরনো চুক্তি শেষ। চুক্তি মতো কাজ দেয় নি। আজ ডাইস খারাপ, কাল মোটর খারাপ, পরশু ভ্যাকুয়াম মেশিনে গন্ডগোল—এই করে প্রোডাকসান মার খাইয়েছে, আমি কি করব!

তার অবশ্য স্বভাব নয়, কারখানার কোনো গন্ডগোল নিয়ে বাসায় কথা বলা। বরং যেদিন সে, পাওনাদারদের তাগাদায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে সেদিন আর সোজা বাসায় ফিরে আসে না। কফি-হাউসে বন্ধুদের সঙ্গে বসে থাকে। ইয়ার্কি ফাজলামি করার স্বভাবও তার নয়। তবু উঠতি লেখক বন্ধুদের সঙ্গে বসে থাকলে মনটা কেমন হাল্কা হয়ে যায়। লেখায় অনুপ্রেরণা আসে। আসলে এই আড্ডা তাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখে। ফলে আড্ডার আকর্ষণ বাড়ছে। বাড়িতে নিৰ্মলা আছে, নির্মলা চলে গেলে সে সেখানেও আর বসে থাকতে পারবে না। বিচ্ছু দুটো যে কখন কি করে বসবে—এই এক দুশ্চিন্তা। এ-সব কারণে নির্মলার যাবার দিন যত এগিয়ে আসছিল, তত সে বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে। একা শুয়ে থাকার কি কষ্ট এটাও যেন সে টের পেয়ে গেছে।

নির্মলা বলল, হাসু পারবে?

পারবে না কেন।

রাত বাড়ছিল।

টুটুল মিণ্টু এক বিছানায়, অন্য বিছানায় সে আর নির্মলা। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে সব টের পায়। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে, অতীশ বালিশ দুটো বগলে করে নির্মলার ঘরে চলে আসে। নির্মলা জরায়ুর অসুখে ভোগার সময় থেকেই আলাদা শুতো, এখন দু’জনের একসঙ্গে শোওয়ার অভ্যাস। এই অভ্যাস অতীশকে অনেক মোহ থেকে মুক্তি দিয়েছে। এমনকি চারুর খোঁজও করে না আজকাল। চারু তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, কিংবা ঘোরে পড়ে চারুর সঙ্গে সহবাস এইসব আর তার মনে পড়ে না।

নির্মলা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। কি ভেবে কোনো আর কথা বলছে না। চাপা অভিমান হতে পারে। নির্মলা চায় সে সঙ্গে যাক অন্তত। অনুষ্ঠানের সময় ছোট দু-ভাই হাসু ভানু এসেছিল। হাসু থেকে গেছে। হাসুর বিছানা টুটুল মিণ্টুর সঙ্গে করে দেওয়া হয়েছে। দরজা ভেজানো। দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে, টের পাবার কথা নয়।

আসলে অতীশও কেমন অভিমানে ভুগছে। তার প্রতি, টুটুল মিণ্টুর প্রতি নির্মলার টান নেই। সে নির্মলার চাকরির জন্য চেষ্টা করেছে ঠিক, তবে তা শহরে। শহরের বাইরে নয়। শেষপর্যন্ত শহরে তো নয়ই এমনকি শনিবারে যে চলে আসতে পারবে তারও ঠিক নেই। স্কুল ছুটির পর পাঁচটার বাসে বর্ধমান এলে ট্রেন পেতে সাড়ে সাতটা হয়ে যাবে। হাওড়ায় পৌঁছতে ন’টা সাড়ে ন’টা। ট্রেন লেট থাকলে, রাস্তায় বাস গড়বড় হলে তো কথাই নেই। একা একজন মেয়ের পক্ষে শনিবার ছুটির পর বের হয়ে পড়া কত দুশ্চিন্তার বিষয় নির্মলা বুঝছে না।

নির্মলার এক কথা, আমার কে কি করবে। তুমি অত ভয় পাও কেন বুঝি না। আমি ঠিক শনিবার শনিবার চলে আসব। সোমবার ব্ল্যাক-ডায়মন্ডে চলে যাব। তুমি একদম ভাববে না। প্লিজ, তুমি আমার সঙ্গে চল। সুখি আছে। হাসু থাকবে। দু-তিন দিনের জন্য চল। একা ভাল লাগে বল!

অতীশ উঠে বসল। শক্ত বালিশটা নীচে রেখে নরম বালিশটা ওপরে তুলে নিল। থাবড়ে থুবড়ে আবার শুয়ে পড়ে কি ভাবল কে জানে। সহসা তার মনে হল, নির্মলা ইচ্ছে করেই দূরে সরে যাচ্ছে। টুটুল মিণ্টুকে তার নিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল অথবা নির্মলা যেন নিজের জীবনে আলাদা স্বাধীনতা চায়। এই স্বাধীনতার আকাঙ্খাই তাকে বোধহয় বেশি তাড়া করছে। এখানে পড়াশোনার অসুবিধার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। শত হলেও গাঁয়ের স্কুল। অতীশ বলল, একজন লোকের থাকা খাওয়ার কম খরচ! কি বেশি সংসারে সুখ আসবে বুঝি না।

নির্মলার বোধহয় গরম লাগছে। সে লেপটা গা থেকে সরিয়ে দিল। বুকের ওপর হাত। জানালা খোলা—বাইরে জ্যোৎস্না, ওদিকের দরজা খোলা। সদর বন্ধ থাকলে করিডরের দরজা বন্ধ করে শুতে পারে। শীত চলে যাচ্ছে এবং বেশ গরম পড়েছে বলে, নির্মলা করিডরের দরজা খোলা রেখেছে। চাতালের দিকের দরজা বন্ধ। যাবার আগে নির্মলা যে দু-এক রাত পাবে সব দিয়ে থুয়ে মজে থাকার জন্যই উত্তরের দরজা খোলা রেখেছে। হয়ে গেলেই কিছুক্ষণ নির্মলা অসাড়। কোনো সাড়া পাওয়া যায় না, যেন অন্য কোনো গ্রহের স্বাদ তাকে এই নিষ্ঠুর জীবনযাপান সম্পর্কে অচেতন করে রেখেছে। আসলে রমণের এই অপরূপ তৃপ্তি কিছুদিন হল আবার শরীরের মধ্যে ফিরে এসেছে। এটা হয়, এবং অতীশ সাত আট বছরে দেখেছে, জোয়ার ভাটার খেলা আছে নির্মলার শরীরে। জোয়ারের সময় মাসের পর মাস নির্মলা যে কি পাগল হয়ে থাকে—আর ভাটার সময় তাকে দেখলেই ভয় এবং এক ধরনের আশঙ্কা, রাতে তখন আলাদা বিছানা হয়ে যায়—টুটুল মিণ্টুর পাশে শুয়ে থাকে, তার ছায়া মশারির পাশে নড়ে উঠলেও কে কে করে ওঠে! সেই মেয়ে এখন জোয়ারে ভাসছে। দু-পাড় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—ঠিক এ-সময়ে তার চাকরির সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা যেন ঠিক হয়নি। না বললেই ভাল করত। উত্তরের দিকের করিডরের দরজা খোলা রাখার একটাই কারণ, আসলে সে ঘুমের জন্য বিছানায় শুয়ে নেই, সে একজন মানুষের উত্তাপের জন্য অপেক্ষা করছে। এবং হয়ে গেলেই সে উঠে যায় না। বোধহয় সহবাসে তার শরীরের গ্রন্থিগুলি অবশ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। উঠে সিগারেট খেতে গেলে আলো ধরাতে হয়। নগ্ন নির্মলাকে দেখতে তার তখন ভাল লাগে না। নিজেরই কেমন লজ্জা লাগে। আশ্চর্য সে দেখেছে, আলো জ্বাললেও নির্মলার হুঁশ ফেরে না। সে-জন্য নামার আগে নির্মলার শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর সে যখন শুয়ে পড়ে কিংবা টেবিলে ল্যাম্প জ্বেলে বই পড়ে তখন নির্মলা ওঠে বাথরুমে যায়। নির্মলা যে দরজা খোলা রেখেছে তার কারণ ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া, আমি চলে যাব। তুমি আমাকে জড়িয়ে থাক।

তার এ সময় কিছুই ভাল লাগছে না। এমন কি নির্মলা এমনভাবে সায়া শাড়ি আলগা করে রেখেছে যে জিরো পাওয়ারের নীল রঙের আলোতেও ঊরুর ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে আছে। কোমরের সায়ার দড়ি আলগা করে শোবার অভ্যাস তার এমনিতেই, তাও একটু বেশি নিচে নামানো। স্তন এত পুষ্ট যে মনে হয় সে দু’হাতে দুটো স্তন কিছুতেই কখনও সামলাতে পারবে না। সে দু’হাতে একই স্তনে হাত রেখে মজা পায় এবং এও দেখেছে, বাঁদিকের স্তনের চেয়ে ডানদিকের স্তনে হাত দিলে নির্মলা বেশি সুখ পায়।

নির্মলা হঠাৎ বলল, দূরে চলে গেলে আমি খারাপ হয়ে যাব ভাব? তোমার মন পরিষ্কার না।

অতীশ চুপ করে আছে।

সে ফের বলল, বললাম তো ঠিক শনিবারে চলে আসব। তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। এখানে মেয়েরাই থাকে। সুবোধদা বলেছেন, জায়গাটা ভাল।

সুবোধদাই কাজটা ঠিক করেছেন সে জানে। বি. টি. কলেজে তাদের তিনি প্রিন্সিপল অফ এডুকেশন পড়াতেন। অবসর নিয়ে মির্জাপুর স্ট্রীটের বাড়িতে আছেন। তাঁরই এক ছাত্রকে ধরে কাজটা ঠিক করা হয়েছে। ভদ্রলোক স্কুল ইন্সপেক্টার। ওঁর আওতায় কিছু স্কুল থাকায় নির্মলার পক্ষে চাকরিটা পাওয়া সহজ হয়েছে।

নির্মলাই ফের বলল, আমার মত ওখানে আরও চারজন কাজ করে। ওরাও শনিবার শনিবার বাড়ি চলে যায়।

ওরা কি কলকাতার দিকে থাকে?

তা জানি না। সুবোধদা তো যাননি। ভদ্রলোকের কাছে যতটুকু জেনেছে।

আসলে এই কাজটা বলতে গেলে নির্মলা নিজেই ঠিক করে নিয়েছে। সুবোধদা তার হয়ে ঠিক করে দিয়েছেন। ট্রেনিং কলেজে অবশ্য সুবোধদাকে কেউ খুব একটা সুনজরে দেখেনি। এমনিতে ভালমানুষ, তবে মেয়েবাজ, যে যেমনভাবে দেখে। অতীশ সুবোধদাকে সমীহ করত। প্রবীণ মানুষটির যেন মায়া- দয়া একটু বেশি। নিঃসন্তান। তবে মেয়েদের প্রতি একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব ছিল। অতীশ নিজে গেলে হয়তো কাজটা নির্মলার এত তাড়াতাড়ি হতো না, অথবা খুব গা করতেন না। নির্মলা যাওয়ায় তিনি নিজে রাইটার্সে ছোটাছুটি করে হাতে চিঠি দিয়ে গেছেন।

যা দিনকাল, এতো রাত করে কেউ ফিরতে পারে!

দশটা সাড়ে দশটা রাত বলছ!

রাত না। হাওড়ায় ন’টা সাড়ে নটার আগে নামতে পারবে না। তারপর বাস। বড়বাজারের জ্যামে কতক্ষণ আটকে থাকবে কে জানে!

একটু কষ্ট করতেই হবে। আর যাই বল, কাজটা ছাড়া ঠিক হবে না। মিণ্টু তো লাফাচ্ছে, আমরা মার কাছে বেড়াতে যাব।

অতীশ টের পায়, মিণ্টু কিংবা টুটুল এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, মা কতদূর যাচ্ছে! এক হপ্তা কত দীর্ঘকাল তাদের কাছে! মাকে ছেড়ে থাকার অভ্যাস নেই, মাকে ছেড়ে থাকার কি কষ্ট তাও বুঝছে না। অতীশ তার শৈশব স্মৃতিতে ডুবে যাচ্ছে। জমিদার বাড়িতে ঢাক বাজছে, শরৎকাল, সে নদীর পাড়ে পাড়ে একা হেঁটে যাচ্ছে। মাকে ছেড়ে সে তার দাদাদের সঙ্গে পুজো দেখতে গেছে। বর্যকাল, পাঁচক্রোশ নৌকায়, দশরার পরে ফিরবে। মা পাশে না থাকলে, শৈশব কত অর্থহীন সেবারেই টের পেয়েছিল। দুর্গোৎসবের দিন, কাশফুল উড়ছে নদীর চরে, শীতলক্ষার ঢেউ, পাখিরা উড়ে যাচ্ছে, তিনমহলা প্রাসাদ, বৈভব, ঢাকের বাজনা, ফুল ফল সবুজ মাঠ এবং সেই নীল আকাশ অবারিত, কোথাও প্রকৃতিতে খামতি নেই, অথচ অতীশের সারাদিন গোপনে অশ্রুপাত, মাকে ছেড়ে চলে এসে মনে হয়েছিল সে বড় একা। মেজ জ্যাঠামশাইর পাশে শুয়ে ঘুম আসছিল না। মা পাশে নেই, সে ছটফট করছিল।

কিরে ঘুমোচ্ছিস না কেন? মার জন্য মন খারাপ। দশেরার পরেই তো চলে যাবি। তুই কিরে?

আর তখন গোপন অশ্রুপাত প্রবল বেগে উঠে এসেছিল, সারাদিন এই কষ্ট সবার কাছ থেকে গোপন করে রাখতে পারলেও রাতে পারেনি। হাউহাউ করে কাঁদছিল শুধু। নির্মলা তাদের ছেড়ে পাঁচ ক্রোশ দূরে যাচ্ছে না। পঞ্চাশ ক্রোশও নয়। তারও বেশি। শনিবার শনিবার আসা নির্মলার পক্ষে সম্ভব নয়। ছুটিছাটায় শুধু আসতে পারবে। তবু সে বোঝে যত কষ্টই হোক নির্মলা শনিবার এলেই স্থির থাকতে পারবে না। সে তাদের আকর্ষণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও চলে আসবে। আর এই আসাটা কত দুশ্চিন্তার সেটা ভেবেই অতীশের মন খারাপ। তার সময় ভাল যাচ্ছে না। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, এবং এ সময় তার কেন জানি সেই কুলুঙ্গির নিচে দাঁড়িয়ে আর একবার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, জীবন আমার কখনও সুখের হবে না বনি। জীবন বড় ভারবাহী জন্তু, এ কথাটাও মনে হল। উচাটনে থাকা, সকাল থেকে রাত, আবার রাত থেকে সকাল। নির্মলা চলে গেলে সব আতঙ্ক যেন তার মাথার ওপর আরও বেশি ভর করে বসবে। সে শুধু বলল, তোমার কি কি লাগবে একটা লিস্ট করে ফেল।

কি আবার লাগবে। সঙ্গে বেডিং আর সুটকেশ। একটা প্রেসার সঙ্গে নেব। চাল ডাল কিছু। কোনো রকমে ফুটিয়ে খেয়ে নেব। তারপর অতীশের হাত টেনে নিয়ে বলল, একটা কথা বলব!

অতীশ জানে সে আগ্রহ প্রকাশ না করলেও নির্মলা তার কথাটা বলবে।

নির্মলা বলল, তুমি কিন্তু মন খারাপ করে থেকো না। আমি তাহলে শান্তি পাব না। সকাল সকাল অফিস থেকে চলে এস। সুখিকে বলবে, হুটহাট যেন দরজা খোলা রেখে বাইরে বের হয়ে না যায়। সুখি তোমাকে ভয় পায়।

অতীশ বোঝে, নির্মলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। রেসের মাঠে সে দৌড় শুরু করেছে। চারপাশের মানুষজন, বাপের বাড়ির সচ্ছলতা এবং অতীশ নামক এক মানুষের জন্য সে নিজেই এবার মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। টুটুল মিণ্টুকে বড় করে তোলা, যশ প্রতিপত্তির অহঙ্কার এতো দূরে চলে যাবার বেদনাকেও তুচ্ছ করতে শিখিয়েছে।

নির্মলার জন্য তিরতির করে কোনো গ্রন্থিতে বেদনার সঞ্চার হচ্ছে। নিরুপায় শুধু সে নিজেও নয়। নির্মলাও। কেউ কাউকে কোনো আশ্বাস দিতে পারে না। নিজের ভেতরেই থাকে এক সহজাত প্রবৃত্তি যা তাকে বাঁচতে শেখায়।

সে বলল, আমি সঙ্গে যাব।

যাবে তুমি!

হ্যাঁ। আমি তোমাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাইনি। আমার কেন জানি ইচ্ছে কোথাও তোমাকে নিয়ে যাই। সেখানে শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ না। জ্যোৎস্না থাকলে আমরা দুজনে ভেসে যাব।

সত্যি যাবে বলছ?

বললাম তো যাব। আমরা হনিমুনে যাইনি। এই যাওয়াই হবে আমাদের হনিমুন। কি মজা হবে না! তোমার কোয়ার্টার। সামনে বারান্দা থাকবে। স্কুল থেকে দুটো চেয়ার চেয়ে নেবে। আমি বাজার করব। রান্না, স্কুল থেকে টিফিনে এলে, দুজনে মুখোমুখি বসে খাব। তারপর বিকেলে মাঠ পার হয়ে ক্যানেলের ধারে বেড়াতে যাব। ফাঁকা জায়গায় প্রকৃতির মধ্যে আমরা—ও আমি ভাবতে পারছি না!

নির্মলা সহসা বুকের ওপর অতীশের হাত টেনে নিয়ে বলল, জান কতদিন ভেবেছি, কোথাও কোনো নির্জন প্রান্তরে আমি আর তুমি, আর কেউ না।

বড় বিস্ময়কর এ জীবন। মৃত্যুযোগ, আর্চির প্রেতাত্মা, টুটুল মিণ্টু একদণ্ডে সব তুচ্ছ হয়ে গেল, পড়ে আছে শুধু এক নির্জন বনভূমি, সেখানে শুধু দুই নারী পুরুষ খেলা করে। শুধুই খেলা করে। প্রকৃতির অবাধ জন্ম মৃত্যু এই খেলার নিত্যসঙ্গী।

.

সব কেমন দিন দিন ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে। ভাঙছে শুধু। শৈশবের বর্ণমালা নিঃশেষ। হারিয়ে গেছে তার শৈশবের অনুভূতিমালাও। এমন একা নির্বান্ধব জীবন সে কখনও অনুভব করেনি। মানুষের জীবন এ-রকমেরই বোধহয়। সব পিছনে পড়ে থাকে, সামনে শুধু অজ্ঞাত সন্ত্রাস।

জানালায় বসে থাকলে এমন মনে হয় তার। কে কোথায় যে ছিটকে পড়ল।

বড়দার সঙ্গে তাঁর কতদিন দেখা নেই।

মেজ-জ্যাঠামশাই কেমন আছেন সে জানে না। মেজদার খবর মাঝে মাঝে পায়। সেও খুব সুখবর না।

বড় জেঠিমা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছেন এমন চিঠি পেয়েছিল বাড়ি থেকে। কুশপুত্তলিকা দাহ করে সেই নিখোঁজ মানুষের পারলৌকিক কাজ সারা হবে। সে যেতে পারলে সবাই খুশি হবে। বড়, জেঠিমার খুব ইচ্ছে পাগল-জ্যাঠামশাইর শ্রাদ্ধে সে উপস্থিত থাকে। নির্মলা চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে, বাবাকে জানায় নি। এমন কি দেশেও চিঠি লেখেনি। কেমন চাপা ক্ষোভ দিন দিন তার মধ্যে দানা বাঁধছে।

বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ পেল সে।

নির্মলা বের হয়ে দরজায় উঁকি দিতেই দেখল, সে চুপচাপ বসে আছে। নির্মলা বিস্মিত। তার ফিরতে রাত হয়। আজ এত তাড়াতাড়ি! সে বলল, কি ব্যাপার! অফিস থেকে সোজা চলে এলে!

—অফিস যাইনি। রাইটার্সে গেছিলাম। কিরণ বলল, জায়গাটা খারাপ না। অযথা দুশ্চিক্তা করো না। কিরণ আমাদের ইয়ারেই পড়ত। তুমি ভুলে গেছ বোধ হয়।

সুবোধদাও বলেছেন। নির্মলা, সামনের চাতালে তারে শাড়ি মেলে দেবার সময় বলল, আরও মেয়েরা থাকে বলেনি! মেয়েদের স্কুল তবে কিছু মেল টিচার আছেন। ওরা ওখানকারই লোক। মেয়েদের কোয়ার্টার ছোট হলেও খারাপ না। বাথ, রান্নাঘর আছে। তোমাকে তো সব বলেছি।

শীত যাবার মুখে। বিকেলের দিকে গরম তেমন থাকে না। শীত শীত লাগে। অতীশ জামা প্যান্ট ছাড়েনি। টুটুল মিণ্টু বাবাকে বলে সামনের মাঠে খেলতে গেছে। সে না করেনি। এখন তো টুটুল মিণ্টুকে একাই থাকতে হবে। সে বুঝতে পারছে বাড়ি থেকে কেউ এসে থাকবে না। যে যার মতো শেকড়-বাকড় গজিয়ে নেয়। নড়তে পারে না। নির্মলা এটা একদম বুঝতে চায় না। অবুঝ হলে যা হয়। তার এক কথা, শুধু টাকার সম্পর্ক। তুমি বাঁচলে মরলে বয়েই গেল।

মাঝে মাঝে অতীশ ভাবে—টাকার সম্পর্কই কি শেষ কথা! হাসু এখনও আছে। নির্মলাকে অতীশ নিয়ে যাবে। সে তখন দাদার বাসা আগলাবে। হাসুর থাকতে ভাল লাগছে না। দায়ে পড়ে আছে যেন। বিকেলেই বের হয়ে গেছে। কলকাতার এখানে সেখানে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদিন চুঁচুড়ায় গিয়েছিল, ছোট মাসীর কাছে। সেখানে দু’দিন থেকে এসেছে। রোজই এক প্ৰশ্ন, কবে যাবি দাদা। বৌদিকে নিয়ে কবে যাবি! সে নির্মলাকে রেখে এলেই তার ছুটি। মাঝে একদিন সোদপুর গিয়েছিল, পিসিমার বাড়ি। সঙ্গে টুটুল মিণ্টুকেও নিয়ে গেছিল। নির্মলার ইচ্ছা ছিল না। ট্রেনে যাবে। দুটো বিচ্ছুকে সামলানো দায়। যদি কিছু হয়ে যায়। সারাটা দিন নির্মলা দুশ্চিন্তায় ছিল। অতীশও যে ছিল না বলতে পারে না। তবে সে তা প্রকাশ করেনি। অফিস থেকে ফিরেই বলেছিল, ওরা এসেছে! মিণ্টু টুটুল।

না।

নির্মলার গোমড়া মুখ দেখে অতীশ টের পেয়েছিল—দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে। মিণ্টুকে সাদা ফ্রকে এখন ছোট্ট পরীর মতো দেখতে লাগে।

এসে যাবে। অতীশ সান্ত্বনা দিয়েছে। এসে গেছিলও। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই অতীশ ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল। ভাইপো ভাইঝি একেবারে ক’দিনেই কাকা অন্ত প্রাণ। কত কথা দুজনের। রাস্তায় কি দেখল, পিসির আদর সব মিলে সারাক্ষণ ঘরে ছোটাছুটি, দাপাদাপি

নির্মলার এটা যে খুব পছন্দ নয়, তার আচরণে ফুটে উঠেছিল। কাকারা উদ্ধার করবে তোমাদের। এমন ক্ষোভের প্রকাশও সে দেখেছে। কিছু বলতে পারেনি। যেন অতীশের পরিবারের জন্যই সে বনবাসে যাচ্ছে। ঠিক মতো বাবার টাকা পাঠাতে না পারলে কেমন জলে পড়ে যায় মানুষটা—আসলে মর্যাদাবোধ, অতীশ নামক এক পুত্রের বাপ অর্থকষ্টে আছেন ভাবলেই মানুষটা স্থির থাকতে পারে না। মুখে পাউডারের পাফ বুলাবার সময় বলল, কিরণবাবু আর কিছু বলল?

কিরণকে নির্মলা ঠিকই চিনেছিল। একই সঙ্গে তারা সবাই বি টি পড়ত।

সরকারি চাকরি নিয়ে কিরণ এখন রাইটার্সে। সিনিয়ার বেসিক স্কুলগুলির টাকা স্যাংশানের ফাইল সে ডিল করে। সুবোধদার প্রিয় ছাত্র।

কিরণ তো বলল, সকালের ট্রেনেই সুবিধা। বর্ধমান থেকে বাসে। ট্রেনে গুসকরা গেলেও হয়। গুসকরা থেকে বাসে বিশ ত্রিশ মিনিট।

তবে গুসকরা হয়েই চল।

ট্রেন সব সময় থাকে না। ওখান থেকে উজিয়ে আসতে হবে। সঙ্গে মালপত্র কিছু তো নিতেই হবে।

ও আমি লিস্ট করে ফেলেছি। কবে থেকে ছুটি নিচ্ছ! একটা দিন হাতে রেখ। হোল্ডঅল দরকার। ফ্রাই প্যান কড়াই স্টোভ। একটা সসপেন। আর কিছু লাগবে না।

থালা বাসন। অতীশ পা ছড়িয়ে দেবার সময় কথাটা বলল। তার হাই উঠছিল।

ঐ গ্লাস একটা থালা একটা।

বালতি মগ লাগবে।

ওখানে কিনে নেব।

অতীশ হাসল। বিড়ম্বনার হাসি। নির্মলা ঠিক বুঝতে পারছে না। গ্রাম জায়গা সম্পর্কে নির্মলার খুব ভাল ধারণা নেই। তার দেশের বাড়ি গ্রাম জায়গা ঠিক না। কলোনি বাজার স্কুল সব আছে। দু-এক ক্রোশের মধ্যেই শহর। সব হাতের কাছে। নির্মলা যেখানে যাচ্ছে, তার পাঁচ সাত ক্রোশের মধ্যে কোনো শহর নেই। কেমন গ্রাম! শুনেছে, গাঁয়ে একটি হেলথ সেন্টার আছে। ছেলেদের হাইস্কুল আছে। ঐ পর্যন্ত। আর কি আছে জানে না। বালতি মগ সঙ্গেই নিয়ে নেওয়া ঠিক হবে। এ নিয়ে সে আর তর্ক করল না। আজকাল নিৰ্মলা পছন্দ অপছন্দ সোজাসুজি বলে দেয়। এমন কি সে দেখেছে, রেগে গেলে বলতে ছাড়ে না, তোমার মতো মানুষের হাতে পড়ে কত দুর্ভোগ পোহাতে হয় দ্যাখ। অতীশ তখন কথা বলতে পারে না। তার নিজের উপরই ক্ষোভ বাড়ে। সত্যি সে ভারি অক্ষম। তার এই অক্ষমতার জন্যই নির্মলাকে এত দূরে চলে যেতে হচ্ছে। মাসে মাসে শ’ দেড়েক টাকা তাকে দিতে পারবে নির্মলা। এ যে কত বড় অবলম্বন—আসলে এখন থেকে সে আর নির্মলা মিলে দুই সহযোদ্ধা।

কী, বসে থাকলে হবে! জামা কাপড় ছাড়বে না?

যাচ্ছি।

অতীশের মনে হল—স্কুলে চাকরিটা পাবার পর নির্মলা ক’দিনে যেন আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পাঁচ সাত বছরের চেষ্টায় চাকরি। দেশে থাকতে নির্মলা চাকরি নিয়েই গিয়েছিল। কিন্তু বাড়ির বৌ শহরে যাবে মাস্টারি করতে, বাবার পছন্দ ছিল না। বিয়ের প্রথম দিকে নির্মলা খুবই অনুগত ছিল বাবার। বাবার পছন্দ অপছন্দ বুঝত। সে অবহেলায় কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল। সে জয়েনই করল না। সেই নির্মলা কলকাতায় এসে কেমন মুক্তি পেয়ে গেছিল। চাকরির চেষ্টা অতীশ নিজে করেছে। নির্মলাও করেছে। হয়নি। শহরে চাকরি না পেয়ে অগত্যা গাঁয়ে চলে যাচ্ছে। এখন সে কারও অনুগত নয়, দেখলে এমন মনে হবে। আচরণেও।

এখানে এসেই নির্মলা ভেবেছিল, কোথাও কোনো স্কুলে তার চাকরি হয়ে যাবে। মাস যায় বছর যায়—হয় না। মাঝে মাঝে ডিপ্রেসান দেখা দিতে থাকল। ডিপ্রেসান থেকে অসুখ-বিসুখ। পিরিয়ডে গণ্ডগোল। ডিপ্রেসান দেখা দিলেই অস্থিচর্মসার। নির্মলা কেমন বুড়ি হয়ে যায়। খেতে চায় না। ঘুম হয় না। ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েও তার সারারাত অনিদ্রা গেছে কত রাত। অতীশই যেন তার বড় শত্রুপক্ষ। নির্মলার গানের গলা ভাল। সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখ তোমার কোলে—যাক না গো সুখ জ্বলে। কখনও জানালায় দাঁড়িয়ে একাকী গাইত—সহেনা যাতনা দিবস গনিয়া বিরলে। নিশি দিন বসে আছি শুধু পথ পানে চাহি—সখা হে এলে না! এমন সব গানের মধ্যে মাঝে মাঝে অতীশ টের পেত কি যেন প্রত্যাশা থেকে তাকে সে দিন দিন বঞ্চিত করছে। স্বপ্ন ভঙ্গ হলে যেমনটা হয়ে থাকে আর কি!

অতীশ বলল, তুমি গানটা ছেড়ো না।

হঠাৎ এমন কথায় নির্মলা বিস্মিত। সে তার গান নিয়ে মানুষটাকে কম বিড়ম্বনার মধ্যে রাখেনি। রেডিও খুলে অনেক সময় গলায় গোপনে গান তুলত। তারপর গুন-গুন করে গাইত। আবদার করত, একটা হারমোনিয়ামের। সংসারের টানাটানিতে অতীশ কিনে দিতে পারেনি। চাপা স্বভাবের বলে, সে অভিমান পুষে রাখত। অভিমান থেকে ঘৃণা, কম কথা বলত। রাতে এক বিছানায় শুত না। দুই মেরুর বাসিন্দা হয়ে যেত তারা।

নির্মলা অতীশকে চুরি করে দেখছিল। চাপা ক্ষোভ থেকে অতীশ যদি কথাটা বলে। বলতেই পারে। সে নিজে এখন স্বাধীন এমনও ভাবতে পারে।

সে বলল গান ছাড়লে কি হবে! ছেড়েই তো দিয়েছি। বিয়ের পর ও-সব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। তোমার খুবই ইচ্ছে ছিল হারমোনিয়াম কেনার। এবার মনে হয় হয়ে যাবে। টাকা আমাকে না দিলেও চলবে। এত সুন্দর গলা। আমার পাল্লায় পড়ে সব নষ্ট হয়ে গেল। নির্মলা ভাবল, তবে কোনো কটাক্ষ নয়। সাদা মনেই বলছে। বলল, জান বাবা আমার জন্য গানের মাস্টার রেখেছিলেন। বলেছিলেন নিমু, তুমি বড় গাইয়ে হবে। এমন দরাজ গলা—তোমার হবে। বাবার সঙ্গে কত ফাংশানে গেছি। বাবা আগে থেকেই বলে দিতেন, কোন গান গাইব।

তোমার বাবা গান ভালবাসেন।

তুমি বাস না?

গান কে না ভালবাসে!

তবু অতীশ ভাবল, জীবনে গান যদি ভাসিয়ে নিয়ে যায় তবে সংসারে কাঁটা ফুটে থাকে কোথাও! তাছাড়া গানের জন্য সময় পাবে কি করে! সংসারে দুটো বিচ্ছুকে বড় করে তুলতে গেলে, গান যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে নির্মলা টের পেয়েই বোধ হয় খুব জোরজার করেনি। জোরজার করলে ভাল করত কখনও এমন মনে হয় অতীশের। তবে অযথা রাগ পুষে রাখতে হত না। ইউটেরাসে গণ্ডগোল দেখা দিত না। হরমোন ডিসব্যালেন্স থেকে এমন হয় মেজদি একবার যেন বলেছিল। হাসপাতালে অপারেশন, ইউটেরাস পর্যন্ত বাদ দিতে হল। চাপা ক্ষোভে এত বিষে জর্জর হয় শরীর নির্মলার স্বভাব একই কথা বার বার বলা। তার বাবার কথা উঠলে গানের কথাও উঠত। নির্মলার শৈশব যেন তার মুখস্থ। সরকারি ডাক্তারদের যা হয়, এক জায়গায় বেশিদিন থাকার নিয়ম থাকে না, বদলি চাকরি, আজ এখানে কাল ওখানে, কখনও পাহাড়ে, কখনও সমতলে। নির্মলা তার শৈশবের গল্প বড় বেশি বলতে ভালবাসে। কোনো স্বপ্নের পৃথিবী থেকে উঠে এসে যেন নিমু তার শৈশবের কথা বলত। একই কথা বার বার বলত। একই খবর বার বার দিত।

নির্মলা একবার নাকি ভ্যাক করে কেঁদেও দিয়েছিল।

কোথায় যেন জায়গাটা, ডাল্টনগঞ্জের দিকেই হবে, এক বাঙালি ছোকরা নিমুকে গান শেখাত। নিমু তখন ক্লাস এইটে পড়ে। দু-বিনুনী, সাদা ফ্রক গায়ে স্কুলে যায়। স্কুল থেকে এসেই, কড়া হুকুম তার বাবার, রেওয়াজ। সকালে ঘুম থেকে উঠে রেওয়াজ। সাঁজবেলায় রবিবারে গানের মাস্টার আসবে। না এলে তার ফাঁকা ফাঁকা লাগত—বিপুলদা কি দরদ দিয়ে শেখাত জান! বলেই একদিন কি কথায় নিমু এত খোলামেলা হয়ে গেছিল যে সব বলে ফেলেছিল।—চাকরি নিয়ে বিপুলদা চলে যাবে—বাবার সঙ্গে দেখা করতে এল। বাবা আমাকে ডাকলেন, বললেন, বিপুল চলে যাচ্ছে।

জান আমি না কেঁদে ফেলেছিলাম।

কেন কেঁদেছিলে?

কি জানি! বুঝি না!

অতীশ মুচকি হেসে বলেছিল, মানুষটিকে তোমার ভাল লেগেছিল।

যা! বাজে বকবে না।

বাজে কোথায় বকলাম। ভাল না লাগলে দুঃখ সৃষ্টি হয় না জান! এতে নিন্দার কি আছে বুঝি না।

কি জানি বাপু, তোমাকে কিছু বলাও মুশকিল। আসলে কি জান, বাবার চেয়ে বিপুলদারই বেশি আগ্রহ ছিল। বলেছিল, মেসোমশাই নিমু একদিন বড় গাইয়ে হবে। এখন ভাবলে হাসি পায় জান!

ডিপ্রেসানের সময় নিমুর সেই বিপুলদার কথা কি খুব বেশি মনে হয়! কোনো সবুজ অরণ্য থাকে মানুষের, মানুষ সারাজীবন সেই অরণ্যে হেঁটে বেড়াতে চায়। জীবনের নিত্য গ্লানি সেখানে থাকে না। অতীশ, বিপুলদাকে হিংসা করে। অতীশ অবশ্য সবই ভুলে যেতে পারে—কারণ সেতো সেই কোনো সবুজ অরণ্যের খবর সুদূর সমুদ্রে রেখে এসেছে। এ-সব এখন তার গত জন্মের কথা।

নির্মলারও। মানুষ বোধ হয় তার গত জন্মের মধ্যে বেঁচে থাকতে ভালবাসে।

নির্মলা পাজামা পাঞ্জাবি এনে হাতে তুলে দিয়ে বলল, চা করছি। যাও হাত মুখ ধুয়ে নাও। সিনেমায় যাব। কি এসেই চুপচাপ বসে আছ। তোমার কি হয়েছে!

নির্মলা সিনেমায় যাবার কথা বলছে! অবাকই লাগল তার। নির্মলা এখানে এসে কোনোদিন বলেনি, চল সিনেমায়। ভাল বই এলে, সেই বলেছে, যাবে? সামনের হলটায় সত্যজিতের জলসাঘর হচ্ছে। একা দেখব। সঙ্গে যদি যাও।

নির্মলা যদি ডিপ্রেসানে না ভুগত, তবে বলত, চল। ডিপ্রেসানে ভুগলে বলত, জান তলপেটে ব্যথা, বেশি হাঁটাহাটি করলে বাড়ে। তুমি যাও। পরে না হয় একদিন দেখব।

আসলে কোনো গোপন ক্ষোভ পুষে রেখে নির্মলা জীবনে কষ্ট পাচ্ছে। ক্ষোভটা কি তবে সে সেই শৈশবের স্বপ্ন থেকে সরে এসেছে বলে! কেউ তাকে জোর করে সরিয়ে এনেছে। সেতো নির্মলার কোনো ইচ্ছের বিরুদ্ধেই যায়নি। একমাত্র ঘোরে পড়ে গেলে তার নাকি কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দেয়—সেই ঘোরও কেটে গেছে তার। অন্তত মাসখানেক সে কখনও কোনো সমুদ্র, অথবা সাদা বোটের ভয়ে আড়ষ্ট হয়নি। নির্মলা কি ভেবেছিল মানুষটা তাকে মর্যাদা দেবে। সে যা ভালবাসে, মানুষটা তা ভালবাসবে। ভালবাসলেই কি মানুষকে মর্যাদা দেওয়া হয়!

সে বলল, সারা দিন তো তোমার গাঁয়ে একা কাটবে। গানের চর্চা করলে অত একা নাও লাগতে পারে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সঙ্গে কিছু একটা চাই।

হঠাং এসব বলছ কেন বল ত!

কি বললাম!

না এই গান, হারমোনিয়াম, একা লাগবে! গানটা ছেড়ো না!

এখানে সময় পেতে না। ওখানে পাবে। তাই বলছি।

ওখানে একা আমার খুব বুঝি ভাল লাগবে মনে করছ। তোমাদের ছেড়ে আমি বুঝি খুব সুখে থাকব ভাবছ—

ভাল লাগবে না বলেই তো বলছি।

ভাল না লাগলে কিছু করতে ইচ্ছে করে!

করে।

করে বলছ!

করে না। একাকী হয়ে গেলে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। নিজের মধ্যে ডুবে যাওয়া যায়। জানালায় দাঁড়ালে রাতের আকাশ তোমার একাকিত্বকে আরও বাড়িয়ে দেবে। তখন গান ছাড়া আর কি মানুষকে মুক্তি দিতে পারে!

নির্মলা ঘরের টুকিটাকি কাজ সারছিল, সুখি একটু বাদেই আসবে। কলতলায় বাসন জমা হয়ে আছে। কাকের উপদ্রব আছে। এঁটো পাতে কাকের হামলে পড়ার স্বভাব। নির্মলা বালতি করে জল নিয়ে গেল। জল ঢেলে দিল। জলে ডুবিয়ে রাখলে কাকের উপদ্রব থাকে না। চেয়ারের ঢাকনা টান টান করে দিচ্ছে। জানালায় পর্দা উড়ছিল। কিছুদিন আগেও জানালায় কোনো পর্দা ছিল না। হাঁ করে থাকত ঘরবাড়ি। সে চলে যাবার আগে বাড়িঘর ঠিক করে দিয়ে যাচ্ছে। জানালায় দাঁড়ালে একাকিত্ব টের পাবে। অতীশের এমন কথায় সে চুপ করে গেছে। কোথাও কোনো সংশয় থেকে এমন বলছে নাতো! নিজের সঙ্গে কথা বলছিল নিৰ্মলা।

হয়, এমন হয়। বিয়ের মাস দুইও পার হয়নি—মিণ্টু পেটে চলে এসেছিল। যেদিন টের পেল, সেদিনটায় কেন যে মনে হয়েছিল, অতীশ স্বার্থপর। অতীশের কি কোনো আশঙ্কা ছিল, সে বড়ঘরের মেয়ে, গরীবের সংসারে বেশিদিন তার ভাল নাও লাগতে পারে। খেলার সঙ্গীর মতো, আজ আছে কাল নেই। তার বাবাতো খবরটা পাবার পর দু’দিন অন্নজল পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। সে কাউকে না জানিয়ে যেমন রেজিস্ট্রি করেছিল, তেমনি কাউকে না বলে, অতীশের সঙ্গে চলেও গেছিল। মিণ্টু পেটে আসার পরই অতীশের প্রতি কেমন চাপা ক্ষোভ—তুমি এত অবিবেচক, কত করে বললাম, না না পারব না। তুমি কাল নিয়ে এস, হবে। অতীশের এক কথা, একদিনে আর কি হবে! আমার ঘুম আসছে না। সত্যি অতীশের ঘুম আসছিল না। এ-পাশ ও-পাশ করছে, জড়িয়ে ধরছিল, চুমো খাচ্ছিল। সেও কেমন আর ঠিক থাকতে পারেনি। অতীশের ছলাকলার কাছে হেরে গেছিল। হাত পা ছড়িয়ে দিলে অতীশ ক্ষ্যাপা মোষের মতো তাকে তাড়া করেছিল। এ-ভাবে মাঝে মাঝে যেন ইচ্ছে করেই অতীশ আনতে ভুলে যেত। এবং শেষ পর্যন্ত সেও সারেণ্ডার করত। মিণ্টু পেটে আসুক অতীশ চাইত। জড়িয়ে না গেলে কবে কখন সে হারিয়ে যাবে এমনই বোধ হয় আতঙ্ক ছিল অতীশের। সেই যে সে জড়িয়ে গেল, আর মুখ তুলে ভাল করে আকাশ দেখতে পেল না। কতদিন পর যেন সেই আকাশ দেখার সৌভাগ্য হবে তার। টুটুল মিণ্টুর জন্য কষ্ট হবে, অতীশের জন্যও, তবু নিজের উপার্জন, নিজের স্বাধীনতা সে আবার ফিরে পাচ্ছে। ইচ্ছে করলে যা সে হারিয়েছে, এখন আবার তা ফিরে পেতে পারে। তাকে নিয়ে তার বাবা-মারও কম আশা ছিল না! অতীশকে দেখার পর কেমন মতিভ্রমে পড়ে গেল। বাবার মুখের দিকে তাকালে তার এমন মনে হত। অতীশের সরল সহজ কথাবার্তা, কিংবা মাঝে মাঝে বিষণ্ণ হয়ে যাওয়া, অথবা চুপচাপ যখন কলেজ ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে বড় বড় গাছের ছায়ায় সে একা হেঁটে চলে যেত, তখন কি যে খারাপ লাগত তার! কি এমন হারিয়েছে সে, কথা কম বলে, মেয়েদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে বালকের মতো। বাঙাল উচ্চারণে যখন বান্ধবীদের মধ্যে হাসির হুল্লোড় পড়ে যেত, তখন সে মরিয়া হয়ে উঠত, এই শুনুন!

কি!

আজ আবার মউজা বলছিলেন। মউজা হবে না। মোজা হবে। বুঝতে পারলেন। কি মানুষরে বাবা! জ্যোতির্ময় হবে। জুতিময় হবে না। আবার কখনও ভুল করেছেন তো খুব খারাপ হবে।

অতীশ বলত, তাই নাকি। আমি চেষ্টা করব। আচ্ছা জ্যোতির্ময় হবে। তাই না!

আজ্ঞে তাই। বেশ তো বলতে পারেন। বলেন না কেন। জাহাজে ছিলেন, কত দেশ ঘুরেছেন, অথচ নিজের ভাষাটি রপ্ত করতে পারেননি।

আমাকে জানেন, কেউ ধরিয়ে দেয়নি। আপনি থেকে পরে তুমি। কামিনী ফুলের গাছ, তার নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে, কিচেনে ঢোকার মুখে সে দেখতে পেত সেই সুপুরুষ মানুষটি —গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সে পরীক্ষা দেবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার সময় কোথায় কি উচ্চারণে বেঠিক হয়ে যায়, ধরিয়ে দেবার জন্য অপেক্ষা করছে। বছর ধরে এই চললে, তাকে ফেলে কোথাও আর যাওয়া যায় না। শিশুর মতো সরল একেবারে। কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই, সে যা বলত, অতীশ মনে প্রাণে তা করার চেষ্টা করত।

কি, এখন আর নিশ্চয়ই আপনার বান্ধবীরা হাসাহাসি করবে না! মউজা বলি না, জুতিময় বলি না, জুতু বলি না। সব ঠিক হয়ে গেছে। মোজা, জ্যোতির্ময়, জুতো সব।

কি ব্যাপার বলতো! জামা কাপড় ছাড়বে না! কি ভাবছ!

কিছু না।

তুমি কেমন হয়ে যাচ্ছ? আগে একরকম ছিলে, চাকরি হওয়ায় অন্য রকম। আপত্তি থাকলে যাব না।

অতীশ হেসে দিল। অন্য রকম মানে! যাবেই বা না কেন?

জলে পড়ে গেছ মনে হয়।

না না জলে পড়ে যাব কেন! ভাবছিলাম, তোমার সঙ্গে যেদিন প্রথম দেখা—কলেজ, ক্যান্টিন, কিচেন, নির্জন সড়কে দুজনের হেঁটে যাওয়া। শেষে আমরা এখানটায় এসে যাব ভাবিনি।

নির্মলা বলল, আমিও জান, কলেজের কথাই ভাবছিলাম। আচ্ছা মানুষ ঘোরে পড়ে যায় কখনও তাই না!

আমি তো পড়ি। তুমি পড়েছ কি না জানি না।

নির্মলা শঙ্কিত হয়ে উঠল। ঘোরে পড়ে যাবার কথা ঠিক তোলা উচিত হয়নি। কুলুঙ্গির নিচে অতীশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। সে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। ঘোরের কথা বললে, আবার না ঐ ধূপদানিটার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে সে বলতে চেয়েছিল, তোমাকে দেখার পরই আমি ঘোরে পড়ে গেছিলাম। সেই ঘোরে পড়ে এতদূর হেঁটে এসেছি। জান ভয় করে, আবার না ঘোর কেটে যায়। নির্মলা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। কি ভাবে তার নিজের ইচ্ছের কথা প্রকাশ করবে বুঝতে পারছে না। ইচ্ছেটা ভেতরে পাক খায়—অথচ সবটা পুরোপুরি সত্যও নয়। তার দুর্বলতা আছে গানের প্রতি—সে যে আগেই ভেবে রেখেছিল, এবার তার উপার্জনের টাকা বাঁচিয়ে একটা হারমোনিয়াম কিনবে। সকালে গলা সাধবে। ভাতে ভাত করতে সময় লাগবে না। কোয়ার্টার সংলগ্ন স্কুল। গ্রাম জায়গা, কাজের লোকেরও খুব অসুবিধা হবে না। সে সহজেই আবার সেই বিপুলদার জীবনে চলে যেতে পারে। মানুষটা কোথায় আছে সে জানে না। কিন্তু কি এক সংকেত রেখে গেছে জীবনে—বার বার তার কথাই আজকাল মনে হয়। রেডিওতে কেউ ভাল গাইলে—সে বিষণ্ণ হয়ে যায়। যেন তারও হত। ঘোরে পড়ে গিয়ে তার সব গেছে। যতই চাপা ক্ষোভ থাকুক, অতীশ টুটুল মিণ্টু ছাড়া তার অন্য কোনো জোর ছিল না। এখনও থাকতে পারে না। টুটুল মিণ্টুকে সঙ্গে নিতে পারত। কিন্তু পাড়াগাঁয়ের স্কুলে ওরা ঠিক সুবিধে করতে পারবে না। প্রতিযোগিতা নিরন্তর জীবনে ধাওয়া করছে। টুটুলকে হিন্দু স্কুলে দেবার কথা ভাবছে। মিণ্টুকে লরেটোয় ভর্তি করার স্বপ্ন আছে। গাঁয়ের স্কুলে নিয়ে গেলে কিছুই শিখতে পারবে না। তা-ছাড়া অতীশ রাতে এই এত বড় বাসাবাড়িতে একা থাকতে ভয় পায়। গাঁয়ে একা থাকলে সে ইচ্ছে করলে শনিবার শনিবার চলে আসতে পারবে। শনিবার দু’জনের প্রতীক্ষা আরও ঘন হয়ে উঠবে। একজন বাসে বসে,বাড়ির কথা ভাববে, আর একজন জানালায় কিংবা রাজবাড়ির গেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বাস থেকে লোক নামলেই খুঁজবে, তার সেই আশ্চর্য নারী নেমেছে কি না। বা সে ছুটে যাবে। এতসব নির্মলা চা করার সময় ভাবছিল। অবাক সে, কি করে অতীশ তার ইচ্ছের কথা টের পেয়ে গেছে। না হলে, বলতে যাবে কেন, গানটা ছেড়ো না। না হলে, বলবে কেন, টাকা না দিলেও চলবে আমার। তার মানে তুমি দূরে থাকলে, আমার লেখা ছাড়া আর কি থাকবে, লেখায় ডুবে গেলে, তোমাকে ভুলে থাকতে পারব। লেখা থেকে যে উপার্জন হবে, অর্থাৎ উপার্জন বাড়বে—উপার্জন বাড়লে, আর্থিক দায় লাঘব হবে, তোমার টাকা না হলেও চলবে। অতীশ কি তাকে বুঝিয়ে দিতে চায়, আমি তোমার উপার্জনে নির্ভরশীল থাকতে রাজি না। তুমি যা চেয়েছ, তাই হও। এক বয়সে বাবা মা ভাই বোন, এক বয়সে স্বামী পুত্র কন্যা—অথচ সব বয়সেই আরও কিছু থাকে—যেটা না থাকলে মানুষের বেঁচে থাকার অর্থ হয় না। এখন তার মধ্যে সেই ইচ্ছেটা প্রবল। সে ভিতরে ভিতরে খুশি। বিচ্ছু দুটোকে ছেড়ে থাকার কষ্ট, তার নিজের স্বাধীনতা কেমন অপহরণ করে নিয়েছে। তার এখন মানসিক অবসাদ নেই। সে নিজেই অতীশের সংলগ্ন হবার জন্য পাগল হয়ে থাকে। একেবারে বিপরীত স্বভাবের হয়ে যায়। ক’দিন থেকে অতীশ এটা টের পেয়ে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। অহেতুক ভয়ে শঙ্কিত অতীশ। আগে ছিল এক রকমের ভীতি, এখন যেন সেটা আর এক রকমের লেখার টেবিলে একটা ফুল তোলা চায়না কলমদানি, পিতলের ফ্লাওয়ার ভাস, একগুচ্ছ রজনীগন্ধা- সবই আজ নির্মলা যত্নের সঙ্গে সাজিয়ে দিয়েছে। মন প্রসন্ন না থাকলে নির্মলা এত যত্ন নেয় না। অতীশ তার এমন আচরণেও ঘাবড়ে যেতে পারে। অতীশ কি আশা করেছিল, যাবার দিন যত এগিয়ে আসবে, তত সে মুষড়ে পড়বে। মুষড়ে পড়লে অতীশের মনে কোনো সংশয় থাকত না! তার নারী তারই আছে। কিন্তু সে ভেঙে পড়লে নাটক হতে পারে, জীবনের সত্য থাকে না। চিঠিটা যেদিন সে পেয়েছিল, সেদিন সে যেমন উৎফুল্ল হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে নির্বাসনে যাচ্ছে ভেবে আড়ালে চোখের জলও ফেলেছিল। কিন্তু তারপর সে যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝার চেষ্টা করেছে। তখনই মনে হয়েছে, দু’জন দূরে সরে থাকলে আকর্ষণ বাড়ে। জীবনে একঘেয়েমি থাকে না। শুধু অর্থই নয়, উপার্জনই নয়, স্বাধীনতাও নয়—নিজের এক আলাদা পৃথিবীর অস্তিত্ব টের পেয়ে সহজেই মনে করতে পেরেছিল, স্কুলের চাকরি, ছুটি-ছাটা নিরন্তর, মাঝে এক দু-দিনের ছুটি নিয়ে চলে এসে হৈ-চৈ করে কাটিয়ে দেওয়া এই আনন্দটা টের পেতেই মানসিক অবসাদ নিমিযে কেটে গেছিল।

নির্মলা চা নিয়ে ভিতরে ঢুকলে দেখল, তখনও অতীশ বসে আছে।

কি, যাবে না?

কোথায়!

সিনেমায়!

হ্যাঁ তাইতো।

সে চটপট উঠে পড়ল।

বাথরুমে গেল, ফ্রেস হয়ে এসে, চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলল, রেডি হয়ে নাও। দেখতো সুখি এল বুঝি। দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ। নির্মলা দরজা খুলে দিয়ে এসে বলল, এত তাড়াতাড়ি করছ কেন। বিযম খাবে। তোমার যে কি! যেন ট্রেন ছেড়ে দেবে। সে টেবিল ঘড়িটায় চোখ রাখল। সময় আছে। সুখিকে বলল, ওরা মাঠে খেলছে। এলে খেতে দিস। সন্দেশ বের করে দিস। হরলিকস দিবি। কি মনে থাকবে!

নির্মলা চলে গেলে সুখি সারাক্ষণ এই বাড়িঘরে থাকবে, অতীশ ফিরলে তাকে খেতে দিয়ে চলে যাবে, এখন থেকেই টুকিটাকি কাজ দিয়ে সুখিকে, এ-সংসারের দায়িত্ব যেন বুঝিয়ে দিতে চায়।

নির্মলা তক্তপোশের নিচ থেকে ট্রাংক টেনে বের করছে। অবসাদ কেটে গেলে চঞ্চল বালিকা হয়ে যায়। সে ছুটে ছুটে কাজ করছে। একবার অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, পাজামা-পাঞ্জাবি বের করছি। এতে তোমাকে মানায়।

অতীশ এ-সব নিয়ে ভাবে না। ভদ্রগোছের হলেই হল। খুব ফ্যাশনদুরস্ত নয়। আর অশ্চর্য সে দেখল, সিল্কের পাঞ্জাবি শাল বের করে দিচ্ছে। শীত এখনও আছে। তাই বলে এতটা শীত নেই যে শাল গায়ে দিতে হবে। সে অবশ্য কিছু বলল না। নির্মলার পছন্দই তার পছন্দ। শালটা কাঁধে ফেলে রাখলেও হবে। তবে তার কেন জানি সংকোচ হচ্ছিল, সে সিল্কের পাঞ্জাবি পরে বের হলে রাজবাড়ির আমলাদের পরিবারের লোকজন দেখবে রাজার কারখানার ম্যানেজার অতীশবাবু স্ত্রীকে নিয়ে সেজেগুজে বেড়াতে বের হচ্ছে। এই বের হওয়াটা তার কখনও হয় না। এমন কি সে তার স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতেও পছন্দ করে না। একসঙ্গে বের হলে লোকে কি ভাবে সে টের পায়। নির্মলার মুখে আভিজাত্য আছে, দীপ্তি আছে, রূপের ছটা ঝকমক না করলেও, ওর ফিগার মনোরম। বেশি সেজেগুজে বের হলে এরা টের পাবে, বাবুটি বেশ ভাল ঘোড়সওয়ার।

নির্মলা নিজেও এটা দেখেছে। অতীশ বের হলে সঙ্গে মিণ্টু টুটুলকে নেয়। ওরা দু’জনে বের হয়েছে আর কেউ নেই, খুব কমই এমন ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছে থাকলেও নির্মলা বের হতে পারত না। দুটি শিশুকে একা বাসায় রেখে যাওয়াও যায় না।

জামাইযষ্ঠীর দিনটাতেই অতীশকে বেশি বিপাকে পড়তে হত!

কুম্ভবাবু বলত, জামাইষষ্ঠী করতে সকালেই বের হবেন!

সে বলত, হ্যাঁ। সে না বলতে পারত না। পাশাপাশি সব অফিসারদের কোয়ার্টার। শহরে শ্বশুরালয় অনেকের। তারও। সামাজিক অনুষ্ঠান, না গেলে ত্রুটি, কিংবা অসামাজিক কিছু ব্যাপার আছে, অথবা স্ত্রীর পিত্রালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না—এটা কেউ জানুক অতীশ চাইত না। তাকে যে জামাইষষ্ঠীতে নিমন্ত্রণই করা হয় না। নির্মলার এক সময় ক্ষোভ ছিল এ-নিয়ে, এদিকটাতে গা সওয়া হয়ে গেছে। জামাইষষ্ঠীর দিন, সে, নির্মলা টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় গিয়ে বসে দিনটা কাটিয়ে দিত।

রাতে ফিরত। রাজবাড়ির সদর দরজায় ঢুকে গেলেই কেউ না কেউ প্রশ্ন করত, জামাই আদর কিরূপ হল! মেস-বাড়ির বারান্দায় উকিলবাবু খালি গায়ে উপবীত ঝুলিয়ে বসে থাকেন, আর হাত পাখায় হাওয়া খান। জামাই-আদর কিরূপ হল, তাঁরই প্রশ্ন। জামাইষষ্ঠীর দিনে অতীশ সবাইকে নিয়ে ফিরছে, শ্বশুরালয় থেকেই এ-দিনটাতে সবাই ফেরে, সুতরাং প্রশ্নটা উকিলবাবুর ঠোঁটে লেগে থাকবে বেশি কি! অতীশ মুচকি হাসত, কিছু বলত না। সে যে সবার চোখে ধুলো দেবার জন্য সারাদিন চিড়িয়াখানায় কাটিয়ে এসেছে—বুঝতে দিত না।

এ-সব মনে হওয়ায় অতীশ কী ভেবে বলল, তোমাদের বাড়িতে জানানো উচিত ছিল।

নির্মলা ও-ঘরে সাজগোজ করছে। সে উঁকি দিয়ে বলল, কি বললে?

বলছিলাম, ফোন করব কি না অফিস থেকে।

কাকে?

তোমাদের বাড়িতে।

কেন?

তুমি গাঁয়ে মাস্টারি নিয়ে চলে যাচ্ছ, জানানো দরকার।

ফোনে বলতে হবে না। ফিরে এসে যাব। তখন বলব।

তবে এক্ষুনি খবরটা জানাজানি হোক নির্মলা চায় না। আর সে নিজেও সাহস করে বলতে পারবে না, নির্মলার স্কুলে চাকরি হয়েছে। বললে, নির্মলার বাবা বলবেন, ও আচ্ছা! যেন, এটা জানাই ছিল, অপরিণামদর্শিতার ফল এ-রকমের হবে, আর বেশি কি। নির্মলাকে একা একটা অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকতে হবে শুনলেই ভিতরে তিনি চটে যাবেন। মুখে কিছু প্রকাশ করবেন না। একমাত্র মেজদি বলতে পারেন, তার মানে? টুটুল মিণ্টু কার কাছে থাকবে! ও চলে গেলে ওরা থাকতে পারবে! ওদের সঙ্গে নিয়ে গেলেও খুশি হবে না অতীশ জানে। রাজবাড়ির বড় পুকুর বাদে, আর অন্য ভয় নেই। বিশাল এলাকার মধ্যে রাজপ্রাসাদ, খেলার মাঠ, ফুলের বাগান, টেনিস কোর্ট, সব কিছুই সতর্ক প্রহরায় থাকে। বিশাল পাঁচিল বাড়িটাকে বড় রাস্তা থেকে গোপন করে রেখেছে। রাস্তায় চলে যাবার ভয় নেই। তা-ছাড়া গাঁয়ে থাকতে পারবে কেন! শহরের সুখ-সুবিধা গাঁয়ে পাওয়া যায় না—টুটুল মিণ্টু সঙ্গে গেলেও মেজদির অপছন্দের কারণ থাকতে পারে। নির্মলা বোধ হয় এতসব ভেবেই আপাতত এই সুখবরটা গোপন রাখতে চাইছে।

নির্মলা বলল, আমার হয়ে গেছে। বলে ছাড়া শাড়ি সায়া আলনায় রেখে আয়নায় নিজের মুখ দেখল। টেবিলে আয়নাটা দাঁড় করিয়ে, চুলের ভাঁজ ঠিক করল। তারপর আয়নাটা অতীশের হাতে দিয়ে বলল, ধরো।

এখন অতীশের কাজ আয়নাটা ধরে রাখা। দেড় ফুট বাই এক ফুট কাঠের আয়নায় নির্মলা নিজের বেশভূষা সবটা দূর থেকে দেখতে চায়। সামান্য ড্রেসিং টেবিল কেনার সামর্থ্য নেই। অথচ তেজ ষোলআনা। বাবা ফার্নিচার কিনে দেবেন বলে এসে বেকুব। অতীশ সকালেই কোথায় উধাও। এত যার তেজ, তার আয়না ধরে না রেখে উপায় কি!

একটু সরে দাঁড়াও!

উপরে তোলো।

নির্মলা যে-ভাবে বলছে, অতীশ সে-ভাবে আয়নাটা নিচে উপরে তুলছে।

ধুস, তুমি কি! দাঁড়াও না।

অতীশ বলল, দেখা যাচ্ছে না?

না।

নির্মলা আয়নায় তার পেছনটা দেখার চেষ্টা করছে।

নিচটা টেনে দাও।

অতীশ নিচু হয়ে শাড়ি টেনে দিল।

আরে করছ কি!

কি করলাম।

সব খুলে ফেলবে নাকি, আস্তে টানতে পার না!

অতীশ বুঝতে পারে, একটা ড্রেসিং টেবিল কত দরকার। বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যেন নির্মলা নিজেকে কতদিন দেখেনি! পিছন ফিরে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে যে বড় হয়ে উঠেছিল, পাঁচ সাত বছরে আয়নাটা তার এত ছোট হয়ে যাবে সে বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবেনি

এবারে একটা বড় আয়না কিনব। অতীশ বলল।

আয়না ফিট করা একটা ড্রেসিং টেবিল মধ্যবিত্ত সংসারে যে কত দরকার অতীশ আজ যেন প্রথম টের পেল।

এ-জীবনে আর করতে হবে না। মুরদ জানা আছে।

অতীশ খোঁচা খেয়ে হজম করতে পারল না। আসলে এ-ভাবেই নির্মলা মাঝে মাঝে রক্তপাত ঘটায়। সে বিষণ্ন হয়ে গেল।

কি হল! মুখ গোমড়া করে ফেললে! মিছে বলেছি। বল! যার এত দায়, তার কখনও কিছু হয়! বাড়ির সবাই যদি ভাবে তুমি তাদের রক্ষা করবে, তবে চলে! একটা আয়না কিনতে পারবে না কেন, কিন্তু কিনবে না। কিছু বেশি টাকা বাবাকে দিলে খুশি হবে। বোনের জন্য পাত্র দেখা আছে। মুখ দেখে তো নেবে না। সেটা তুমিও বোঝ, বাবাও বোঝেন

অতীশের কেন জানি কিছু ভাল লাগছিল না। আয়নাটা রাখতে গিয়ে হাত ফসকে পড়ে গেল। আর যা হয় ঝনঝন করে কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। নির্মলা হতভম্ব। মাত্র একটা আয়না, ভেঙে দিলে! অতীশ যেন ইচ্ছে করেই আয়নাটা টেবিলের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল।

অতীশ বলল, যা পড়ে গেল!

সব পড়বে তোমার। হাত থেকে সব খসে পড়বে। আমি জানি, আমি বুঝি। বলে সে একটানে শাড়ি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বলল, তোমার কোথায় যাবার আছে যাও। আমি যাচ্ছি না।

এতে রাগের কি হল বুঝি না!

না।

বোঝ না!

না।

খোঁচা খেয়ে জ্বলে উঠেছ।

না খোঁচা খাইনি।

তুমি মিথ্যুক। তুমি ইচ্ছে করেই ভেঙেচ্ছ।

সত্যি বলছি, বিশ্বাস কর। পাগলামি কর না। চল। সময় নেই। ট্যাকসি করে যাব।

না। যেতে হয় তুমি যাও। মা ঠিকই বলেছে—

কি বলেছে?

কি বলবে আবার। আমার কপালের কথা বলেছে। বলেছে জীবনেও আমার বড় আয়না হবে না।

তার মানে?

মেজদি কি সুন্দর স্টিলের আলমারি কিনেছে। আয়না ফিট করা। দেখে কেমন ছেলেমানুষের মতো বললাম, আমিও একটা কিনব।

কিনতে না পারার কি আছে। সামলে উঠি সব হবে।

মা বলল, তোমরা কিনবে! তা হলেই হয়েছে। জান, আমার চোখে জল এসে গেছিল।

অতীশ বুঝতে পারে অপমানটা কোথায়, কেন নির্মলার চোখে জল এসে গেছিল। তাকে কেউ ছোট করলে নির্মলা ক্ষমা করতে পারে না। এমন কি তার জননীকেও না। এই অসহ্য ক্লেশ নির্মলা বহন করে চলেছে। জানে না, সে নির্মলাকে এই অপমানের হাত থেকে কি ভাবে রক্ষা করতে পারে। কেমন একটা জেদ তাকে তাড়া করতে থাকল। একটা আয়না আজই কিনে আনতে হবে। বড় আয়না —ড্রেসিং টেবিল। কিন্তু মাসের শেষ। নির্মলার অসুখে একগাদা খরচ—সে তার আত্মসম্মান রক্ষার্থে ধার দেনা করে সব মিটিয়েছে। হাসপাতালের খরচ, ডাক্তার ওযুধপথ্যি সব। সে ইচ্ছে করলেই আয়না কিনতে পারে না। বড় আয়না তো নয়ই।

সে বসে পড়ল। পায়ের চারপাশে ভাঙা কাচের টুকরো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বেসামাল হলেই পা কাটবে। সারা ঘরে, যেদিকে চোখ যাচ্ছে, কাচের টুকরো ঝকঝক করছে। বরফের কুচির মতো তারা আনাচে কানাচে পড়ে আছে। সে কেমন ক্রমে স্থবির হয়ে যেতে থাকল। এক নিরুপায় মানুষ—আর তখনই মনে হল দূরে কারা ছুটে আসছে। জানালা পার হয়ে পাতাবাহারের গাছ, রাজবাড়ির বাগান, ফুল ফল এবং কোনো কণ্টকময় রাস্তায় দুই বালক-বালিকা—তারা দৌড়ে আসছে। সারাঘরে ভাঙা কাচের ছড়াছড়ি—কি ভাবে কখন কার রক্তপাত ঘটবে সে জানে না। দু-হাত বাড়িয়ে দিল সে।

নির্মলা হঠাৎ দেখল, অতীশের সেই ঘোর লাগা চোখ। সে কেমন ভয় পেয়ে গেল। বলল, এই শুনছ।

হুঁ।

চল, আমার যে কি হয় ছাই, ঠিক বুঝতে পারি না। মাথা ঠিক রাখতে পারি না। চল। অতীশ ঘড়ি দেখে বলল, গিয়ে টিকিট পাব না।

না পেলে কিছু হবে না। মাঠে না হয় দু’জনে বেড়াব। আমরা কোথাও দু’জনে একসঙ্গে বের হই না। চল না!

এবার তো যাচ্ছি। এক সঙ্গে। শুধু তুমি আর আমি।

অতীশ ধীরে ধীরে ফের স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।—দু-পাঁচদিন তোমার কোয়ার্টারে থেকে—আর ভাবতে পারছে না। কি যে হবে না! শুধু আমরা আর কেউ না।

যাঃ! তুমি কেবল একটাই বোঝো।

না একটাই বুঝি না। আমরা তো স্বামী স্ত্রীতে সত্যি কোথাও একা বেড়াতে যাইনি। এই প্রথম।

নির্মলা কাচের টুকরোগুলি ঝাঁট দিয়ে জড় করছে। বলছে, যেতেই চেয়েছিলে না। হাসু দিয়ে আসবে। যাক শেষে যে সুমতি হল তোমার!

অতীশ বলতে পারত, কেন যেতে চাইনি বুঝবে না। সবাই ভাববে, লোকটা অপদার্থ। বউকে ফেলে রেখে যাচ্ছে। স্বার্থপর। কিংবা ভাবতে পারে—মানুষটার কোনো মর্যাদাবোধ নেই। স্ত্রীকে এতদূরে এমন নির্বান্ধব জায়গায় রেখে যেতে সাহস পায় কি করে! আমার অক্ষমতাই তোমাকে নির্বাসনে পাঠাচ্ছে। তোমার বাপের বাড়ির কি দোষ। তোমার কষ্ট তাদের কষ্ট। সহসা অতীশ কেমন বিমূঢ় হয়ে গেল ভাবতে ভাবতে। ধীরে ধীরে বলল, মিণ্টু বড় হচ্ছে। মিণ্টুর দিকে তাকালে আমার ভয় করে।

কি এক অশুভ তাড়না থেকে অতীশ টের পায়, সে বড় একা নিঃসঙ্গ। টুটুল মিণ্টু একা হয়ে যাবে। বাড়িতে তাদের মা থাকবে না। খালি বাড়ি। সবাই তারা একা হয়ে যাবে। সংসারে নারী না থাকলে নির্জন মাঠের মতো শুধু অপেক্ষা। বাড়ি ফিরে দেখবে সবই আছে শুধু একজন নেই। ভাবতে গিয়ে তার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *