1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৩২

।। বত্রিশ।।

নার্স বলল, এখন ঘুমুচ্ছে। ডাকবেন না।

অতীশ খুব সতর্ক পায়ে কেবিনের ভেতর ঢুকে গেল। হাসপাতালে ঢোকার মুখেই সে কেমন পায়ের জোর হারিয়ে ফেলে। অবশ লাগে। কী গিয়ে দেখবে জানে না। সে সবার আগে এই ফিমেল ওয়ার্ডের নিচে এসে বেঞ্চিতে বসে থাকে। চারটে না বাজলে ভিতরে ঢোকার হুকুম নেই। বার বার এখন ঘড়ি দেখা সার। সময় এত দীর্ঘ হয় সে আগে কখনও টের পায়নি।

সে সবার আগে আসে, সবার শেষে যায়।

কেবিনে মৃদু আলো জ্বালা। সাদা বিছানায় নির্মলার ফ্যাকাসে মুখ। আর রক্ত দেওয়া হচ্ছে না। স্যালাইন বন্ধ। নাকে অক্সিজেনের নলও লাগানো নেই। সাদা চাদরে শরীর ঢাকা।

করিডরে কার পায়ের শব্দ পেল। কেউ আসছে। ও-পাশের কেবিনে যাচ্ছে তারা। সে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের চেয়ারটায় সে বসতে পারে। কিন্তু নির্মলার মুখ ভাল করে দেখা যায় না। একবার ইচ্ছে হল কপালে হাত রাখে। একবার মনে হল ঘুমোচ্ছে, আবার কী ভেবে নাকের কাছে হাত নিয়ে গেল। হাসপাতালে ঢুকলেই সে কেমন একটা অচেনা গন্ধ পায়। গন্ধটা কেবিন পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করে।

সে অপেক্ষা করে থাকে—নির্মলা চোখ মেলে তাকাবে। এ ক’দিন নির্মলার ঘোরের মধ্যে কেটেছে। সকালে নির্মলার মেজদি ফোনে জানিয়ে ছিলেন, ঘোর কেটে গেছে। চিনতে পারছে। নির্মলা চোখ মেলে তাকালে চিনতে পারবে এই আশাতেও মাথার কাছ থেকে নড়তে পারছে না। তাকে দেখতে পেলে নির্মলা সাহস পাবে। টুটুল মিণ্টুকে দেখতে চাইতে পারে। কিন্তু মেজদি বারণ করে দিয়েছেন ওদের সঙ্গে আনবে না। আসলে অতীশ টের পায়, টুটুল মিণ্টু এলে হয়ত যেতে চাইবে না। বলবে মাকে নিয়ে চল। আমাদের মাকে এখানে এনে ফেলে রেখেছ কেন!

নির্মলার মেজদি এ-ওয়ার্ডেরই হাউজ-স্টাফ ছিলেন। নার্স আয়া সবাই তাঁকে চেনে। তিনি শেষপর্যন্ত সব করেছেন। মেজদি না থাকলে কী যে হত! এমন নির্বান্ধব সে এর আগে কখনও টের পায়নি।

বাবা কী চিঠিটা পাননি!

বাবাকে কবে চিঠি লিখেছে সে যেন তাও মনে করতে পারছে না। নির্মলা অসুস্থ হবার পর, না আগে। পরে হলে নিশ্চয়ই সে নির্মলার অসুখের খবর দিয়েছে। শহরে তাকে নিয়ে আসার পরই যেন বাবা জানতেন এটা হবে। এটা শহরের অসুখ। অভিমানবশে শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে দিয়ে যে ভাল করেনি, এটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। শহর মানেই বাবার কাছে পাপের জায়গা—এখানকার হাওয়া বাতাস নির্মল নয়। নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে তা ঢুকবেই, সে তুমি যত বড় যোগী পুরুষ হও না। সে যে বিশ্বাস নিয়ে শহরে এসে রাজবাড়িতে উঠেছিল, এখন দেখছে সেখানে যেমন ফুলফলের বাগিচা রয়েছে তেমনি নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নোংরা জল। নোংরা জল না মাড়িয়ে শহরে ঢোকা যায় না।

অতীশ দাঁড়িয়ে আছে।

নির্মলার চোখ বোজা। রোগা, ক্ষীণকায়। অথচ কী সুন্দর অপাপবিদ্ধ যুবতীকে সে ভালবেসেছিল। তার চোখ ফেটে জল আসছে।

বাবাকে কবে চিঠি দিয়েছি, মনে করতে পারছে না। সে কলকাতা নামক এই নগরীতে এসে সত্যি ভারি বিপাকে পড়ে গেছে। তার স্মৃতিশক্তি এত দুর্বল তাও আগে এমনভাবে টের পায়নি। সে ঘোরে পড়ে যায় ঠিক, পচা টাকার গন্ধ পায়, আর্চির অশুভ প্রভাব তাকে অনুসরণ করছে সব টের পেলেও স্মৃতি এত দুর্বল কখনই বোধ করেনি। মাকে আসতে লিখেছে এটা সে মনে করতে পারছে। অফিসে চলে গেলে রাজবাড়ির বিশাল অন্দরমহলের দিকটা ভারি জনহীন থাকে। টুটুল মিণ্টুকে একা ফেলে দু-দিন অফিস করা গেলেও রোজ অফিস করা যাবে না। মা কিংবা বাবাকে সে কখনও এত কাছে পাবার যেন আগ্রহ বোধ করেনি। অথচ না চিঠির জবাব না কেউ এসে হাজির হচ্ছে। সে টাকা পাঠালে বাবার সংসার সচ্ছল, এই প্রথম সে বাবার সংসার কথাটা ভাবল। এসব কেন মনে হয়! তবে কী বাবাই ঠিক, শহরে গেলে মানুষের শেকড় আলগা হয়ে যায়। সে কি বাবা মার জীবন থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছে! কিংবা বাবা মা কি তার জন্য, টুটুল মিণ্টুর জন্য আগের মতো আশংকায় থাকে না। দু- আড়াই বছরের শহরবাস তাকে এমন একলা করে দেবে জীবনেও ভাবতে পারে নি।

আর তখনই মেজদি সতর্ক পায়ে ঢুকে গেলেন।

সে চোখ না তুলেও বুঝতে পারে মেজদি। তাঁর শরীরে কেমন বাসি জুঁই ফুলের ঘ্রাণ। কি একটা সাবান ব্যবহার করেন তিনি, বিদেশী আতর, যা সে নির্মলাদের বাড়ি গেলেই টের পায়। আশ্চর্য সুঘ্রাণ। মেজদি যে একা আসবেন না, সঙ্গে নির্মলার বাবা মা, আত্মীয়স্বজনরা একে একে আসবেন তাও সে জানে। তার দিকের আত্মীয়স্বজনও কিছু কিছু এই শহরে আছে—তারা ঠিকই খবর পেয়েছে, অতীশের বৌ হাসপাতালে—অথচ এই পাঁচ সাত দিনের মধ্যে একবারও কেউ দেখে যায় নি।

মেজদির সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবা মা ছোট ভাই, কাকা কাকীমা, নির্মলাদের বাপের বাড়ির দিকের সব আত্মীয়স্বজন এই পাঁচ সাত দিনে সবাই ঘুরে গেছে। মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। আজ মেজদি অনেকটা যেন হাল্কা। তাকে দেখেই অতি সন্তর্পণে বললেন, কখন এলে?

সে লজ্জায় বলতে পারে না, সেই কখন! হাসপাতালে দেখছি ঘড়ির কাঁটা একদম নড়ে না। শুধু বলল, এই এলাম।

মেজদি নির্মলার পালস্ দেখছিলেন। হাতটা খুব আস্তে নামিয়ে রাখার সময়ই নির্মলা চোখ মেলে তাকাল। যেন অন্য এক গ্রহ থেকে তাদের দেখছে। ঠোঁটের এক কোণে সামান্য সলজ্জ হাসি। অতীশের বুকটা গুরুগুরু করে উঠল। অতীশকে দেখল, আত্মীয়স্বজনদের দেখল। তারপরও যেন সে আর কাউকে দেখার জন্য চোখে আকৃতি ফুটিয়ে তুলল। কথা বলার চেষ্টা করল। পারল না। নির্মলার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। সে যাদের দেখতে চায়, তার নাড়ি ছিঁড়ে যারা এই পৃথিবীতে বড় হয়ে উঠছে তারাই নেই। বিষাদে মুখ ভরে গেল। মেজদি নির্মলার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে আসব। তুই ভাল হয়ে গেছিস। কাঁদছিস কেন? বলে আঁচল দিয়ে ছোট বোনের দু-চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।

অতীশ দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছিল না। সে ধীরে ধীরে বের হয়ে দোতলার করিডরে দাঁড়িয়ে নিজেকে সংযত করল। আর তখনই দেখল কিছু লোক নিচে, খাটিয়া, ফুল—কেউ আজ আবার রওনা হয়েছে।

হাসপাতালের এই দৃশ্যটা তাকে কাবু করে ফেলে। যেন এটা তার জন্যও অপেক্ষা করে আছে—হাসপাতালে ঢোকার মুখে এমন মনে হত তার। টুটুল মিণ্টুর হাত ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে—পাথর- টুটুল মিণ্টুর কেউ থাকল না এমন এক আশংকায় সারা মুখে এক বিষাদ ছড়িয়ে পড়ত।

আজও দেখল সেই খাটিয়া, ফুল এবং শোকসন্তুপ্ত কিছু মানুষ।

আর এ-সময় সহসা বিদ্যুতের মতো খেলে গেল কোনো সুদূরের এক দৃশ্য। –না না ছোটবাবু পাগলামি করবে না। তুমি সমুদ্রে সাঁতার কাটছ কেন। বোট চলছে। উঠে এস। উঠে এস।

আসলে সেই নিরুপায় জীবনে অতীশের মনে হয়, হাহাকার সমুদ্রের মধ্যে বোট স্থির অবিচল। নড়বে না। আর্চির প্রেতাত্মার অশুভ প্রভাব তাকে ঘিরে ধরেছে। সে চিৎকার করে উঠেছিল,সাঁতার কেটে আমি সমুদ্র পার হয়ে যাব। বোট টেনে নিয়ে যাব। কেউ আটকাতে পারবে না।

আর সব অতিকায় হাঙর যেন দূরে গন্ধ পেয়ে গিয়েছিল। ছুটে আসছে। বনি দ্রুত হাত ধরে ওকে তুলে আনবার সময় বলল, এখনও আমাদের বেঁচে থাকার মতো খাবার ও জল আছে। দেখ এলবা উড়ছে ডাঙার সন্ধানে। সে ডাঙার খোঁজ নিয়ে আসবেই।

অতীশ দেখল, দূরে সেই প্রিয়তম পাখি। সে সেই কবে থেকে সঙ্গ নিয়েছিল সমুদ্রে। সে উড়ে চলে যেতে পারে—কিন্তু সে যাচ্ছে না। বনি বোটের হাল কম্পাস রিডিংয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বসে আছে।

আর আশ্চর্য পাখিটা এক সময় দিগন্তে হারিয়ে গেল। আর দেখা যাচ্ছে না। এ ক’দিন বোটে তারা তিনটি প্রাণী ছিল, এলবা উড়ে গেছে, কিন্তু কোনোদিন দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে যায় নি! সমুদ্রের গভীর নীল জল, অনন্ত আকাশে রাতের নক্ষত্রমালা, পাখিটার প্রয়োজনে দুটো একটা উড়ুক্কু মাছ ছোঁ মেরে তুলে আনা, এ-সবই ছিল দৈনন্দিন দেখার মতো ঘটনা। রাতে বনি ছইয়ের নিচে বসে তাকে বাইবেল পড়ে শোনাতো। ভেবে দেখ তাঁর কী অনন্ত মহিমা—ক্যান ইউ সাউট টু দ্য ক্লাউডস অ্যান্ড মেক ইট রেইন? ক্যান ইউ মেক লাইটনিং এপিয়ার অ্যান্ড কজ ইট টু স্ট্রাইক অ্যাজ ইউ ডাইরেক্ট ইট? হু ডিক্রিট দ্যা সিজ। হ্যাভ ইউ এভার ওয়ানস কমাডেণ্ড দ্য মর্নিং টু এপিয়ার অ্যাণ্ড কজড দ্য ডন টু রাইজ ইন দ্য ইস্ট! দেন ছোটবাবু, সেই অপার মহিমার উপর নির্ভর করে থাকা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। তুমি শান্ত হও।

তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস! এদিকে আয়। বউরাণী! অমলা! অমলা আজ তবে এসেছে। নিজেই। সে বলল, ভিতরে যাও। আমি যাচ্ছি।

আর তখনই দেখল, টুটুল মিণ্টু করিডর ধরে ছুটে আসছে।

অমলা বলল, নিয়ে এসেছি। জানালায় উঠে ভাইবোন বসেছিল। জিজ্ঞেস করলাম তোদের মা কেমন আছে। বাবা নিয়ে যায় নি?

অতীশ অমলাকে দেখছিল। দেখে মনেই হবে না, এই অমলা রাজবাড়ির অন্দরে বিশাল সব ঘরের মধ্যে একা রাতে পায়চারি করে, মনেই হবে না মানসদাকে মাঝে মাঝে ডেকে নিয়ে শাসায়, তার উপরয়ালারা এই অমলার ভয়ে তটস্থ থাকে—দেখলেই দূর থেকে কুর্নিশ করে—এখনও যা আছে রাজার, স্থাবর অস্থাবর, কলকারখানা, মাইসন, সব মিলে এলাহি ব্যাপার। জমিদারি গেলেও প্রভাব প্রতিপত্তির খামতি নেই।

অতীশ শুধু বলল, তুমি ওকে দেখতে আসবে ভাবতে পারিনি।

—কি করব বল! খারাপ লাগল। টুটুল কেবল বলছে, জান আমার মা না হাসপাতালে! মিণ্টু ভ্যাক করে কেঁদে বলল, বাবা, মাকে নিয়ে আসছে না। আমাদের মার কাছে নিয়ে যাচ্ছে না। দুমবারকে বললাম গাড়ি বের করতে। নিজেই নিয়ে এসেছি।

—একা!

—কী হয়েছে?

কী হয়েছে সে বলতে পারে না। রাজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ওরফে মহারাজকুমারের স্ত্রী এই বউরাণী, তার পূর্বপরিচিত বালিকা অমলাকে সে যেদিন আবিষ্কার করেছিল, সেদিনই তার মনে হয়েছে জীবনে তার অনেক দুঃখ আছে। সে ভয় পায়, ভয় অমলার সাদা মার্বেল পাথরের মতো মজবুত যৌবন, দীর্ঘাঙ্গী এবং হেঁটে গেলে মনে হয় প্রাচীন মিশরের সেই ক্লিওপেট্রা হাঁটছে—অনন্তকাল ধরে পৃথিবীর বুকে হেঁটে যাচ্ছে—তার সেই কুটিল সৌন্দর্যের মোহে সব সিজার নতজানু, আজ তার কেন জানি এই রহস্যময়ী নারীর এই আবির্ভাব তেমন তাকে হতবাক করল না। সামান্য একজন আমলার স্ত্রীকে নিজেই দেখতে এসেছে, রাজবাড়ির ইতিহাসে এটা আর কখনও হয়েছে কিনা জানে না। রাজার গুরুত্বপূর্ণ কাজে যারা থাকে, রাজবাড়ির ভেতরেই তাদের বাসাবাড়ি। বাবু পাড়ায় কোনো কোয়ার্টার খালি না থাকায়, রাজার অন্দরে আলগা একটা এলাকা তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অমলা আসতেই পারে।

বউরাণী বলল, আয়।

টুটুল মিণ্টু এখন মাসিদের কোলে। নির্মলার আত্মীয়রা অমলাকে চিনতে পারছে না। সে ওদের সঙ্গে অমলার পরিচয় করিয়ে দিল।

অমলা শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। নির্মলাকে দেখছে। শিয়রের দিক থেকে সরে এসে নির্মলার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, কিছু হয়নি। ভাল হয়ে যাবে।

নির্মলা হাত তোলার চেষ্টা করল। বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। নির্মলাও ভাবতে পারেনি বউরাণী তাকে দেখতে আসতে পারে! মাথার উপরে এই মহিলা আছেন বলেই অতীশ এখনও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে। যা একখানা মানুষ—নিরন্তর আশংকায় ভোগে। নির্মলা একদিন তাকে বলেছিল, কী বল তো, তুমি কেমন, জান বউরাণী আজ নিজেই এসেছিল। কী বলেছে জান! উনি নাকি তোমার পিসি হন। তুমি নাকি কিছুতেই পিসি ডাক না। তুমি নাকি মানুষ না, তুমি নাকি অপদেবতা। অতীশ সেদিন বড় বিপাকে পড়ে গিয়েছিল, বাবা জ্যাঠা যে অমলাদের বাড়িতে আমলা ছিল! বাবা জ্যাঠা যে জমিদার বাড়িতে কাজ করতেন দেশ ভাগের আগে—নির্মলা তা জানত, কিন্তু জানত না, অমলা সেই জমিদার বাড়ির মেজবাবুর মেয়ে। জানত না, অমলা আর সে সমবয়সী না হলেও দু-এক বছরের ছোটবড়। জমিদারের নাতনী অমলা, জমিদারের ছেলেরা বাবা জ্যাঠাকে কাকা বলে ডাকত, সুতরাং জমিদার গিন্নিই বলেছিল, সোনা, তুই অমলাকে পিসি বলে ডাকবি। অমলা তোর চেয়ে বড়। কত বড় তাও বলেছিল—এখন মনে করতে পারে না। তখন যে ছিল সোনা, আর বউরাণী ছিল অমলা—এবং সেই আধিভৌতিক অন্ধকারে, অমলা তাকে যেখানে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, শ্যাওলা পিচ্ছিল এক গভীরতা, কিংবা আশ্চর্য উষ্ণতার স্বাদ এবং এই নারীই প্রথম সোনাকে চিনিয়েছিল জীবনের আসল রহস্য।—অমলার সঙ্গে দেখা হলে সেই দৃশ্যটাও মাঝে মাঝে তাড়া করে। নির্মলাকে সেদিন সে বলেছিল, আমার পিসি, সত্যি সাতজন্মের পিসি। তারপরই হেসে বলেছিল, শৈশব থেকে অমলা এক বিন্দু সরে আসতে পারে নি। সেই জেদ, ক্ষোভ অভিমান, হিংস্র স্বভাব কিছুই পাল্টায় নি তার। দু-বছরেই এটা আমি টের পেয়েছি নির্মলা। সে যেমন এখানে আমার আশ্রয়, সেই আবার এক দন্ডে আমার মাথা নেবার হুকুম দেবার অধিকারী।—আর দরকার নেই। রাজবাড়ি ছেড়ে দিতে বল। এবং হুকুম অনায়াসেই এই রাজবাড়ির দু-একজন আমলার উপর জারি করে দিয়েছে। রাজেন্দ্রনারায়ণ আসলে এই এস্টেটের ডামি। অমলাই সব। অমলার হাত মাথার উপর থাকলে সব কুকর্ম করেও পার পেয়ে যাব। না থাকলে যত সাধুই হও, কেউ তাকে আশ্রয় দিতে পারবে না।

অতীশ তখন দেখছে, বউরাণীর হাত নির্মলা চেপে ধরেছে। কিছু বলছে না। বউরাণী নির্মলার হাতের উপর হাত রেখে মৃদুচাপ দিয়ে অভয় দিচ্ছে, ভাল হয়ে ওঠো। টুটুল মিণ্টুর জন্য ভাববে না। আমরা ত আছি।

টুটুল মিণ্টু কোলে থাকতে চাইছে না। মিণ্টু বোধ হয় লজ্জা পাচ্ছে। সে বড় হয়ে গেছে নিজেই টের পায়। মাসিরা ধরে রাখতে পারছে না। সে মার কাছে আসতে চায় বোধ হয়। দুজনেই ভারি ছটফট করছে।

কিন্তু অতীশ অবাক হয়ে গেল দেখে, মিণ্টু কোল থেকে নেমে মার কাছে গেল না। সে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার কাছে থাকতে বোধ হয় তার ইচ্ছে হচ্ছে। কিংবা মার খুব অসুখ এটা সে বুঝতে পারে। মাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে, না এলে মা ভাল হবে না তাও বোধ হয় বুঝতে শিখেছে, কিংবা ভয়, এই বিশাল হাসপাতাল এলাকায়, তার বাবার কাছের কেউ নেই এটাও মনে হতে পারে তার। পেছন থেকে মিণ্টু তাকে জড়িয়ে ধরে কোমরে মুখ গুঁজে দিয়েছে। অতীশের মনে হল, মিণ্টু যেন বলতে চায়, বাবা তুমি ঘাবড়ে যেও না। আমরা তো আছি।

না কি এই অবস্থায় বাবার কাছে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ ভাবছে। এ-সবই জীবনে এক গভীর টানের সৃষ্টি করে। সে মিণ্টুকে জোর করে মায়ের কাছে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, টুটুল মিণ্টু এসেছে। এই দ্যাখ।

নির্মলা চোখ খুলে তাকাল।

আর সঙ্গে সঙ্গে প্রসন্ন চোখে কেমন বেঁচে থাকার অনন্ত আগ্রহ জন্মে গেল। শিরা উপশিরায় সন্তানের জন্য যে অপার মায়া সেই প্রাণের উন্মেষ থেকে চলে আসছে, তার ঝাঁকুনি লাগল তার শরীরে। নির্মলা টুটুল মিণ্টুকে আদর করার জন্য হাত বাড়াল। হাত তুলতে কষ্ট। মিণ্টুকে বেডের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। টুটুলের হাত বাড়িয়ে দিল।—মা মা, দিদি আমি বাবা, দেখ আমরা তোমাকে দেখতে এসেছি। টুটুল আর কারুর নাম বলল না। যেন আসলে এই তিনজন‍ই নিৰ্মলা ভাল হয়ে উঠবে আশায় সবচেয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এতটুকুন ছেলেও টের পায় সব।

নির্মলার মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। খুব আস্তে আস্তে বলল, তুমি ক’দিন ছুটি নাও। ওদের একা ফেলে অফিস যেও না।

অতীশ বলল, যাচ্ছি না। অযথা ভেব না।

বউরাণী বলল, আমি যাচ্ছি রে! নির্মলার দিকে তাকিয়ে ফের অভয় দিল, তুমি ভাল হয়ে গেছ। অযথা চিন্তা করবে না। আমরা ক’দিন বাদেই তোমাকে নিয়ে যেতে পারব। টুটুলের হাত ধরে তুমি ঘরে ঢুকে যেতে পারবে।

বউরাণী চলে গেলে সে মেজদির দিকে তাকাল। যেন বউরাণীকে তাদের খুব পছন্দ হয়নি। অতীশ উদ্বাস্তু যুবক, কলোনির ছেলে, সে এখন রাজবাড়ির এক কারখানার ম্যানেজার। মেজদি এবং নির্মলার মা বাবা রাজবাড়িতে এসেছে, সদরে ঢোকার মুখে দারোয়ান সাদেক আলি গেট খুলে দেবার আগে পরিচয় জেনেছে কার কাছে যাবে, সব বৃত্তান্ত জানার পর গেট খুলে দিয়েছে, এবং সে ম্যানেজারবাবুর আত্মীয় জেনে সেলাম দিয়েছে। নির্মলার বাবা ঘরে ঢুকেই বলেছিল, জমিদারি গেলেও দেখছি ঠাট বাট ঠিকই বজায় রেখেছে। অতীশ জানে নির্মলার বাবার পছন্দ নয়, ভাঙা একটা লাড়ে কারখানার ম্যানেজার হয়ে কলকাতায় অতীশ বসবাস করুক। হঠাৎ বিনা নোটিশেই প্রায় অতীশ এই চাকরিটা নিয়ে এখানে এসেছিল। নির্মলা লিখতে পারে, আমরা কলকাতায় যাচ্ছি—কিন্তু অতীশ যতটা জানে, সে চিঠির জবাব নির্মলা পায়নি। পেলেও গোপন করে গেছে। রাজবাড়িতে এসে সপ্তাহখানেক পার হবার পর নির্মলাই একদিন ফোন করে বলেছিল, আমরা এসে গেছি। এই খবরটা দিতেও সংকোচ হচ্ছিল—কারণ এসে দেখতে পাবে, ঘরে কোনও খাট আলমারি, বসার চেয়ার টেবিল কিচ্ছু নেই। যেন কোনও স্টেশনে এসে তারা উঠেছে। বাবা দাদারা নির্মলার এমন দুরবস্থায় প্রসন্ন হবে না। ফলে নির্মলার বাবা প্রথম যেদিন এলেন,একটাই প্রশ্ন, কত মাইনে দিচ্ছে!

সে মাইনের কথা বললে, নির্মলার বাবা গম্ভীর হয়ে গেছিলেন।

—এই মাইনেতে চলবে কী করে?

অতীশ মনে মনে বিরক্ত হয়েছিল—সে বুঝতে পারে মাইনের অঙ্কটা খুবই কম, লুজিং কনসার্ন, মহারাজকুমার বলেছিলেন, কারখানার উন্নতি হলে মাইনে বাড়াবে—এত সব কিছুই না বলে শুধু বলেছে, চলে যাবে।

—আমি বুঝতে পারছি না, সে যাকগে, আমি রবিবার আসছি। তুমি বাড়ি থাকবে। তোমাকে নিয়ে বের হব।

নির্মলা এগিয়ে দিতে বাবার গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে গেছিল। অন্দরমহলে শুধু বউরাণী কিংবা রাণীমা অথবা আত্মীয়স্বজনের গাড়িই ঢুকতে পারে। অন্য সব গাড়ি নতুন বাড়ির মহলে। গাড়ি রাজবাড়িতে ঢুকলেই দুমবারসিং দৌড়ে যাবে। বাইরের গাড়ি পার্ক করার জায়গায় সে দাঁড়িয়ে যাবে। কার গাড়ি, রাজার দিকের হলে সেলাম ঠুকবে, অন্যের হলে হাতের ইশারায় গাড়ি থামিয়ে বলবে, বাবুজী, গাড়ি এখানে রাখুন। এই পর্যন্ত। নির্মলা বাবাকে এগিয়ে দিতে গেছে। মিণ্টু যায় নি। এটা সে বুঝেছে মিণ্টু যেন ছোট থেকে টের পেয়ে গেছে বাবাকে মামার বাড়ির লোকেরা ঠিক পছন্দ করে না।

মিণ্টু মার সঙ্গে যায়নি। সে বাবার পাশে বসেছিল। নিচে মাদুর পাতা। টেবিল চেয়ারের দরকার আছে। লেখালেখিতে যে সামান্য আলগা টাকা আসে তাতে সে দু-একমাস গেলে করে নিতে পারবে ভেবেছিল। নির্মলার মুখ গম্ভীর দেখলে সে কেমন অশান্ত হয়ে ওঠে। কী বলে গেল কে জানে! মেয়েকে নির্বুদ্ধিতার জন্য কোনো উপহাস করে গিয়ে থাকে যদি! সে কেমন যেন সেদিন বড়ই অপরাধ করেছে এমন ভেবে বলেছিল, আমি বের হচ্ছি।

নির্মলা জানে কোথায় বের হবে। সে বলল, আজ নাই গেলে! আসলে সময় পেলে কফি হাউসে যাবার তাড়া বোধ করে অতীশ। সেখানে উঠতি লেখকেরা আড্ডা জমায়। তার নিজের লেখা দু-চারটে গল্প উপন্যাসের জন্য সে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছে। সেখানে গেলেই সব অপমানের জ্বালা তার আর থাকে না। সাহস পায়। বন্ধু বান্ধবদের অনেকের তার চেয়েও অসহায় অবস্থা। কিন্তু একটা জায়গায় তারা ঈশ্বরের কাছাকাছি। সেখানে দু-দন্ড বসলে এই অহংকার তাড়া করে।

নির্মলা বলেছিল, তুমি কিন্তু রবিবার সকালে হাতে কোনো কাজ রাখবে না। বাবা বার বার বলে গেলেন। তোমার তো কাজের শেষ নেই। আসলে এটা ঠেস দিয়ে বলা, তুমি আমার আত্মীয়স্বজনদের পছন্দ কর না। তাঁরা এলেই তোমার দেখছি এখানে সেখানে জরুরী কাজ পড়ে যায়। তুমি বের হয়ে যাও। বাবা এসে কিছু ফার্নিচার কিনে দিয়ে যাবেন। তুমি পছন্দ করে কিনবে।

অতীশ রা করেনি। এবং রবিবার সকালে অতীশ বিনা নোটিশেই বের হয়ে গিয়েছিল। কেবল মিণ্টুকে বলে গিয়েছিল, তোর মাকে বলবি, রবিদার বাড়ি যাচ্ছি। ফিরতে বেলা হবে। নির্মলা বাথরুমে। এই সুযোগ। অতীশ সিঁড়ি ধরে নামছিল। নির্মলাকে দেখার জন্য দুজন আয়া আছে, কেবিনের ভাড়া কত টাকা না জানি লাগবে! একটা বড় রকমের অপারেশন হয়েছে নির্মলার। জরায়ু বাদ দিতে হয়েছে। অনেক টাকার দরকার। বাসায় টুটুল মিণ্টু একা—তার অফিস, বাড়ি থেকে কেউ এল না, ছুটিছাটা নেই, এত একা অসহায় যে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে জানে এ সময় একমাত্র টুটুলের মামার বাড়ির লোকেরাই তার অবলম্বন। হাসপাতালের খরচ তারাই চালিয়ে দেবে। আয়ার খরচ, এমন কী মেজদি বলে গেলেন কাল পথ্য দেবেন—মেজদিই বাড়ি থেকে রান্না করে দুবেলা নিয়ে আসবেন। এরা এত করছে, অথচ কোথায় যে আত্মসম্মানে ঘা লাগে সে টের পায়। নিজের উপরে এক আক্রোশ—মনে হয় কেবল মাথার উপর শকুন উড়ছে।

তাকে যে করে হোক, আয়ার খরচ এবং কেবিন ভাড়ার টাকাটা সংগ্রহ করতেই হবে। ইজ্জতের প্রশ্ন। ওরা যত দু-হাত তুলে খরচ করতে পারবে, তত যেন তাকে বুঝিয়ে দেবে, সে কত অবিবেচক মানুষ।

টুটুল ওর হাত ধরে হাঁটছে।

মিণ্টু ওর হাত ধরে হাঁটছে।

হাসপাতালের গেটের সামনে এসে বুঝল, হয় তাকে হেঁটে বাসায় ফিরতে হবে, নয় ট্যাকসিতে। টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে এসে বউরাণী ঠিক করেনি। একা সে হেঁটেই চলে যায়। অফিস ছুটির সময়। বাদুরঝোলা বাস ট্রামে টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না।

মেজদি পাছে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে চলে যান সে-ভয়ে টুটুল মিণ্টু বাবার কাছ ছাড়া হয়নি। তাছাড়া সেও চায় না বিশাল সাদা বাড়িটায় সে একা থাকে! কেমন ভয় লাগে একা থাকতে। টুটুল মিণ্টু কাছে থাকলে সে সাহস পায়। দুই শিশুকে দুপাশে নিয়ে নির্ভয়ে ঘুমোতে পারে। টুটুল মিণ্টুকে যেন তার নিজের আত্মরক্ষার্থেই বেশি দরকার।

সে বলল, কিরে হাঁটতে পারবি?

দু’জনই মহাখুশি। বলল, হ্যাঁ।

হাসপাতাল থেকে বের হতেই অতীশ কেমন যেন অনেকটা হাল্কা হয়ে গেল। এই মানুষজন, ভিড় দোকানপাট, রাস্তার ভিখারি, নোংরা সব মিলে অন্য এক জীবন, যেন এখানে কেউ মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে নেই। মৃত্যু বলে কিছু আছে তারা জানে না। হঠাৎ হঠাৎ সচকিত করে দেয় তাদের, বল হরি হরি বোল, ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা, এবং আবার বাস ট্রাম যায়, দোকান-পসরা চলে, বিজলি বাতির নিচে প্রেমিক-প্রেমিকা অপেক্ষা করে থাকে, গোপন কোনো জায়গায় দু-দন্ড বসার বাসনা।

টুটুলের স্বভাব, রাস্তায় যা দেখবে তাই কিনতে চাইবে। একটা লোক ঝুমঝুমি বাঁশি বাজিয়ে ফুটপাথে হল্লা জুড়ে দিয়েছে। তার গায়ে কালো রঙের পোশাক, সেপটিপিনে হরেক রকম প্লাস্টিকের খেলনা, রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, শিশুদের যা চাই যেমন হরিণ প্রজাপতি এবং বিড়াল ম্যাঁও ম্যাঁও ডেকে উঠলে অতীশ ভাবল, টুটুল ফুটপাথ দিয়ে গেলেই বায়না ধরবে—বাবা, রেলগাড়ি।

রেলগাড়ির প্রতি টুটুলের ভারি ঝোঁক। একটা রেলগাড়ি কিনে দিতেই হবে, আজ হোক কাল হোক, রেলগাড়ি একটা দরকার। কিন্তু এখন তার পক্ষে কোনো অপচয় সম্ভব নয়। অতীশ রাস্তা পার হতে গেলে টুটুল হাত টেনে ধরল। ঠিক টের পেয়েছে বাবা ফুটপাথ বদল করতে চায়। অতীশ বুঝে ফেলেছে টুটুল ও-ফুটপাথে যাবে না। এমন রোমাঞ্চকর দৃশ্য সামনে ফেলে বাবা যদি ফুটপাথ বদল করতে চায় সে তা দেবে কেন!

মিণ্টু বলল, কিরে হাঁদা, দাঁড়িয়ে থাকলি কেন! আয়!

টুটুল অন্য দিকে তাকিয়ে বাপের হাত ধরে টেনে রেখেছে। ছাড়ছে না। বলছে দিদি লোকটা নাচছে। হাতে বেলুন।

তা ঠিক, লোকটার হাতে সুতোয় বাঁধা অজস্র বেলুন। অতীশের মনে হল লোকটা ধড়িবাজ, কোনো শিশুকেই সে ছেড়ে দেবে না। দূর থেকে বেলুন উড়িয়ে শিশুদের যাদুতে ফেলে দেওয়া। তার কাছে আছে শিশুদের মজার ভান্ডার। টুটুল দূর থেকেও তা লক্ষ্য করেছে। লোকটা স্টেশনের কাছাকাছি কোনও জায়গায় থাকে, কখনও নিউ ছায়া স্টোর্সের সামনে, কখনও ব্যারন হোটেলের গায়ে দাঁড়িয়ে চেঁচায়, লাফায়—একেবারে সার্কাসের কোনো ক্লাউনের মতো। টুটুলকে কিছুতেই ফুটপাথ বদল করানো গেল না। বাধ্য হয়ে অতীশ বলল, টুটুল, এখন না। পরে কিনে দেব।

টুটুল গোঁ ধরে আছে। –বাবা, আমার রেলগাড়ি।

—এখন রেলগাড়ি না। পরে। এসো।

—আমার রেলগাড়ি।

—বলছি না পরে। তোমার মার শরীর ভাল না। বাড়ি আসুক তখন কিনে দেব।

কিন্তু টুটুল নড়ছে না।

অতীশের মাথায় কেমন জেদ চেপে গেল।

—যা চাইবে কিনে দিতে হবে! এসো বলছি। না হলে মার খাবে।

টুটুল দাঁড়িয়েই আছে। মার খাবে এটা সে বাবার মুখ থেকে শুনতে ভালবাসে না। অভিমানে টুটুলের চোখে জল এসে গেল।

সামান্য একটা রেলগাড়ির জন্য টুটুলের চোখে জল, মাকে দেখে চোখের জল ফেলেনি, মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময়ও টুটুল বাবার সঙ্গে হাসপাতালে গেছে, তখন তার মার জন্য কোনো যেন দুঃখ হয়নি, আসলে সে বুঝতেই পারে না সংসারে এটা কত বড় অঘটন, এমনকি হাসপাতালের বাইরে এসে মার সম্পর্কে কোনো প্রশ্নও করেনি, সেই ছেলে সামান্য একটা রেলগাড়ির জন্য কাঁদছে। অতীশ কেন জানি আর রূঢ় হতে পারল না। টুটুলকে বুকে তুলে নিয়ে বলল, ঠিক আছে কিনে দেব। কথা দিচ্ছি। এস লক্ষ্মী আমার। বলে বুকে তুলে রাস্তা পার হয়ে গেল। আর দেখল যতক্ষণ লোকটাকে দেখা যায় টুটুল সেদিকে চেয়ে আছে। মিণ্টু বাবার দুঃখ বুঝতে শিখে গেছে। সে বাবার পিছু পিছু হাঁটছে।

সে বলল, ভাই তোর রেলগাড়িতে আমাকে নিবি না?

—না।

অতীশ বলল, আমাকে নিবি না?

—না।

—তোর মাকে?

টুটুল বলল, মাকেও না।

—ঠিক আছে কাউকে নেবে না। রেলগাড়িতে চড়ে তুমি একলা কোথায় চলে যাবে, তখন আমরা তোমায় খুঁজে পাব না!

টুটুলের কেমন ভয় ধরে গেল।

–কোথায় যাব বাবা?

–কোনো স্টেশনে একা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। হুইসিল বাজাবে। দেখবে তোমার গাড়িতে কেউ উঠছে না। সবাই বলবে, ও বাবা, এ-কেমন গাড়ি, মা নেই, বাবা নেই, দিদি নেই। ছেলেটা একলা। ছেলেটা বড় স্বার্থপর ভাববে।

স্বার্থপর কি টুটুল বোঝে না। সে দু-হাত ছুড়ে বলল, না আমি যাব না।

—কোথায় যাবে না?

কোথায় যাবে না তাও বলতে পারল না। শুধু বলল, ইস্টিশন কী বাবা?

—যেখানটায় রেলগাড়ি থামে।

এখন টুটুল হাজার রকমের কথা বলবে। অতীশ সব কথার জবাব দিয়ে যাবে। টুটুল রেলগাড়ির কথা ভুলে গেছে। এটা রক্ষা। এখন তার মাথায় হাসপাতালের বিল, এতগুলি টাকা, কী করে পেতে পারে, কার কাছে পেতে পারে!

আসলে অতীশ জানে, কোম্পানি থেকে লোন নিলে কোনো ঝামেলা থাকবে না। কিন্তু কোম্পানির যা অবস্থা, লোন নেওয়া ঠিক না। লোনের চার পাঁচটা দরখাস্ত পড়ে আছে। সবাইকে নানা বাহানা দেখিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে। সেখানে সে নিজে নেয় কী করে! সে নিলে ওদের দেওয়া দরকার। আর একবার যদি কারখানার কর্মীরা এটা টের পায় তবে সবাই ঝেঁটিয়ে আসবে। কারণ এটা তো আর গোপন থাকবে না। কারখানায় তার বড় প্রতিপক্ষ কুম্ভবাবু, সেই চাউর করে দবে, ম্যানেজার কারখানা থেকে ধার নিয়েছে। সে নিতে চাইলে শুধু অমলাকে বললেই হবে। কিন্তু অন্যদের বেলায় লোন স্যাংশানের মালিক সে। কারখানার কর্মীরা এমনিতেই কম মাইনে পায়—চলে না। সবাই খালাসি বাগানের বস্তির বাসিন্দা। কেবল প্রিন্টার মণিলালের বাড়ি আছে। সোদপুরের দিকে। স্টেশনে নেমে মাইলখানেক রাস্তা হেঁটে গেলে তার বাড়ি। তার কারখানায় মণিলালই সচ্ছল মানুষ। একমাত্র সেই ধার দিতে পারে।

রাস্তা পার হয়ে সে এখন আবার হাঁটছে। মিণ্টু আগে। অতীশ টুটুলের হাত ধরে হাঁটিয়ে আনছে। এদিকের ফুটপাথগুলো সব রিফুজিরা দখল করে রেখেছে। কিছু ফার্নিচারের দোকান পার হয়ে এলেই রাজবাড়ির গেট। রাস্তায় আলো জ্বলছে, দোকানে বাসে ট্রামে সর্বত্র।

সে কতটা নিরুপায় ভেবে নিজের মনেই হাসল। প্রিন্টারের কাছ থেকে ধার! মরে গেলেও এটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অতীশ দেখছে সহসা মিণ্টু অনেক পিছনে পড়ে গেছে। এতটা অন্যমনস্ক যে সে খেয়ালই করেনি, কখন মিণ্টু তার হাত ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তার সেই নিরন্তর ভয়, কিংবা এক ধরনের টেনসান, যেমন এদের বেলায়, রাস্তায় না হারিয়ে যায়। যদি হারিয়ে যায় কী বলবে, প্রায় দিনই পাখি পড়াবার মতো মুখস্থ করিয়ে দেয়।

—কী বলবে!

—বাবার নাম অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক।

–কী বলবে!

—কুমারদহ রাজবাড়িতে থাকি।

—কত নম্বর?

মিণ্টু নম্বর বললে, অতীশের আবার প্রশ্ন রাস্তার নাম বল।

সে দৌড়ে গিয়ে মিণ্টুকে ধরে আনল, কী দেখছ?

এস। মিণ্টু কী দেখছে বলতে পারল না।

সে আবার সেই প্রশ্ন করল, হারিয়ে গেলে কী করবে? ধর এই শহরে তুমি মার সঙ্গে বের হয়েছ। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলে তখন তোমার কাজ হবে পুলিশের কাছে বলা। তুমি হারিয়ে গেছ, কেমন! কেউ কিছু দিলে হাত পেতে নেবে না। খাবে না।

মিণ্টু বলল, আচ্ছা বাবা, রাস্তার লোককে বলব না কেন?

—কার মনে কী আছে!

এই শহরে আসার পর তার এটাই মনে হয় শুধু, কে না কবে তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। অফিসে বসে কাজ করতে পারে না। বাবা কি চিঠি পাননি? গেট দিয়ে ঢোকার মুখে দারোয়ান সাদেক আলি উঠে দাঁড়াল। সেলাম দিল। শেষে হাত নামিয়ে বলল, এক আওরত আপকে সাথ মিলনে চাহতি হ্যায়।

আওরত? চারু নয়তো। সে চারুকে কবে থেকে খুঁজছে। চারু ধোঁকা দিয়ে চলে গেল! নাকি চারু বলে কোনো মেয়েকে সত্যি ঘোরে পড়ে গেলে দেখে! নির্মলা অসুস্থ হবার পর—সেই কবে থেকে নির্মলা ক্রমে খিটখিটে মেজাজের হয়ে যেতে থাকল, মাঝে মাঝে এমন হয় যে বিছানার পাশ দিয়ে হাঁটলেও নির্মলা ভয় পায়। অবদমিত কামের প্রতিক্রিয়া কি না কে জানে। অথচ একই ট্রেনে পিয়ারিলাল চারুকে তুলে দিয়ে গেল। সেই পিয়ারিলালও বলেছে, নেহি, বাবুজী, চারু কোন হ্যায় হ্যাম জানতে নেহি। কুম্ভবাবু সেদিন ফোন ধরে বলল, আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন! কৈ কেউ তো কথা বলছে না।

সে কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছিল, না না পিয়ারি কথা বলছে। দেখুন। বলছে চারু বলে ওর কোনো ভাইঝি নেই। চারু বলে সে কাউকে চেনে না।

কুম্ভর তখন কী হাসি! –– দাদা, চারু দেখছি আপনার মাথাটি খাবে। পিয়ারিলাল কবে থেকে কারখানার মাল নিচ্ছে। কবে থেকে আমি তাকে চিনি, চারু বলে ভাইঝি আছে তার কোনোদিন বলেনি।

অতীশ গুম মেরে গিয়েছিল।

—সাহাব! সাদেক ফের ডাকল।

টুটুল মিণ্টু রাজবাড়ির ভেতরে দৌড়ে ছুটে গেছে। তাদের এখন আর বাবার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। নিজের বাড়িঘরে হাজির। সামনের ব্যাডমিন্টন খেলার লনের পাশ দিয়ে ওরা ছুটছে। তাদের বাবা যে ভীষণ বিপাকে পড়ে গেছে বুঝবে কী করে!

—সাহাব, বাহার মে বৈঠা হ্যায়।

—কোথায়?

সাদেক আলি গেটের বাইরে বসিয়ে রেখেছে। অতীশ চটে গেল।—তুমি বাইরে বসিয়ে রেখেছ! কোথায়?

আর দেখল গেটের ওদিকে বিশাল দেবদারু গাছটার নিচে কেউ বসে! শীর্ণকায় এক মহিলা। পরনে জীর্ণ বাস। সে প্রথমে চিনতে পারল না। অতীশকে অপলক দেখতে দেখতে বললেন, আমাকে চিনতে পারলি না বাবা!

—ও বড়জেঠিমা! আপনি! এখানে বসে!

—আমাকে ঢুকতে দিল না।

না দেবারই কথা। জেঠিমার শাড়ি সায়া ব্লাউজ সোডায় কাচা। ট্রেনজার্নিতে চুল উসখো খুসকো। চোখ কোটরাগত। কেমন ছিন্নভিন্ন উদ্ভ্রান্ত চোখমুখ। শীর্ণকায় এই আওরতকে সাদেক আলি রাস্তার আর দশজন গরীব উচ্ছিষ্ট মানুষ ভেবে ঢুকতে দেয়নি। সাহেবের কেউ হয় বিশ্বাসই করতে পারেনি। মতিচ্ছন্ন লোক শহরটায় বেড়ে গেছে। রাজবাড়ির সদর গেটে উপদ্রব লেগেই থাকে। পাঁচিলের বাইরের দিকে ঝুপড়ি বসে গেছে কটা। লাঠালাঠি হয়েছে, তবু তুলতে পারেনি। পুলিশ এসে ঝুপড়ি ভেঙে দিয়ে যায়, আবার দু-দিন যেতে না যেতেই ঝুপড়ি পাঁচিলটাকে গ্রাস করে ফেলে। গোটা রাজবাড়িটাই না বেদখল হয়ে যায়—বড় সতর্ক থাকতে হয় সাদেক আলিকে।

সে দেখল পাশে ফুল তোলা টিনের সুটকেস। সুটকেসটা হাতে নিয়ে অতীশ বলল, আসুন।

-–তোকে চিঠি দিলাম, কোনো জবাব দিলি না বাবা!

অতীশ দিশেহারা—কী বলবে বুঝতে পারছে না। চিঠির জবাব দেয়নি। কী লিখবে? পাঁচ-সাঁত বছরের উপর হবে জেঠিমার সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ নেই। বড়দা, মেজ জ্যাঠামশায় আলাদা বাড়ি করে একসঙ্গে থাকে। দেশভাগের পর এখানে এসে একান্নবর্তী সংসার ভেঙে সব আলাদা ঠাঁই হয়ে গেছে। বড়দার বিয়েতে যেতে পারেনি। তখন সে জাহাজে। জাহাজেই চিঠি পেয়েছিল বাবার, পল্টুর বিয়ে হয়ে গেল। পাত্রীপক্ষ এ-দেশীয়। তারপর এক-দুবার গেছে। কলোনিতে মাটির দেয়াল তুলে তিনটে ঘর। একটা বাছারি। কলাগাছ, পেঁপে গাছ ছাড়া বাড়িটায় অন্য গাছপালা নেই

জেঠিমা হাঁটছেন। বেশ কাবু হয়ে গেছেন। জেঠিমার হাঁটা দেখেই সে এটা টের পেল।

–তোরা সব এত পর হয়ে গেলি! চিঠির জবাব দিলি না! চলে এলাম।

চিঠির জবাব কী দেবে বুঝতে পারেনি। কী লিখবে তাও ভেবে পায়নি। পাগল জ্যাঠামশাইর কুশপুত্তলিকা দাহ, শ্রাদ্ধ এ-সব করা হবে চিঠিতে জেঠিমা লিখেছিলেন। একটা মানুষ বিশ-বাইশ বছরের উপর নিরুদ্দেশ, সংসারের শুভ অশুভ বলে কথা! জ্যাঠামশাইর পারলৌকিক কাজ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বড়দার ছেলে-মেয়েদের অসুখ বিসুখ লেগেই আছে। বড় বৌদিও মাঝে কী একটা অসুখে দীর্ঘদিন হাসপাতালে, বড়দার নিজের শরীরও ভাল যাচ্ছে না, এ-সব কারণে, শান্তি স্বস্ত্যয়ন করার মতো পাগল জ্যাঠামশাইর পারলৌকিক কাজ সেরে ফেললে বড়দার সংসার থেকে অশুভ প্রভাব কেটে যাবে—চিঠিতে জেঠিমা এমন লিখেছিলেন। বাড়ি গিয়েও অতীশ শুনেছে—বাবা, কাকা, মেজ জ্যাঠামশাই সবাই চান, কাজটা হয়ে যাওয়া দরকার, কিন্তু জেঠিমাকে রাজি করানো যাচ্ছে না। জেঠিমার এক কথা, আমার মন বলছে তিনি বেঁচে আছেন। মানুষটা বেঁচে থাকতে আমি বিধবা হতে পারব না।

অতীশ দেখল, জেঠিমার কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর—একজন সধবা রমণী যেমন হয়ে থাকে। এই প্রৌঢ়া কী তবে তার কাছে ছুটে এসেছেন পরিত্রাণের জন্য। চিঠিতে লিখেছিলেন, তুই যা বলবি, তাই হবে। যদি বলিস, তোর জ্যাঠামশাই বেঁচে নেই, তবে আমিও ভাবব তিনি বেঁচে নেই। তুই ছিলি তাঁর সবচেয়ে কাছের। তুই ঠিক টের পাবি, আরও এমন সব কথা লিখেছিলেন, যা তাকে ভারি গোলমালে ফেলে দিয়েছিল। সে তো ঠিক জানে না, তিনি বেঁচে আছেন কিনা, সে তো ঠিক জানে না, তিনি মরে গেছেন কি না। কী লিখবে। সংসারে এই নিয়ে যে জেঠিমার উপর খুব নির্যাতন চলেছে, চিঠি পড়ে তাও সে টের পেয়েছে। আসলে তার পাগল জ্যাঠামশাই বেঁচে আছেন কি নেই—এই নিয়ে তার মধ্যেও কম জটিলতার সৃষ্টি হয়নি। সেই সুপুরুষ দীর্ঘকায় মানুষটির চেহারা চোখ বুজলে এখনও সে দেখতে পায়—সারা দিনমান, তিনি হেঁটে চলেছেন যেন, কোনও এক অপার্থিব জগতের সন্ধানে। কিংবা মনে হয় এক বড় অন্বেষণে গৃহত্যাগ করেছেন; যদি সাধু সন্ন্যাসী হয়ে গিয়ে থাকেন—কে জানে! কোনও পর্বতের গুহায় সেই মানুষ ঈশ্বর লাভের প্রতীক্ষায় যে বসে নেই কে বলবে! চিঠির জবাব সে সে-জন্য দিতে পারেনি।

অতীশ বলল, কখন রওনা হয়েছেন? একা এলেন?

—আমি পালিয়ে চলে এসেছি বাবা। তুই কিন্তু তোর বড়দাকে কিছু লিখে জানাস না।

প্রাসাদের গাড়িবারান্দায় আলো জ্বলছে। ডানদিকে বাবুপাড়ার জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ছে। রাস্তায় মেস বাড়ির নিচে খোপ খোপ পায়রার ঘর। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। উকিলবাবু বারান্দায় বসে হাওয়া খাচ্ছেন। টুটুল মিণ্টুর সঙ্গে খুব ভাব। বুড়ো মানুষ হলে যা হয়—খালি গা। ধুতি পরনে মানুষটা কোর্ট-ফেরত এ সমটায় বারান্দায় বসে হাওয়া খান। দূর থেকে অতীশ দেখতে পাচ্ছে তাদের। সে জানে টুটুল মিণ্টু ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে বাবার অপেক্ষায়।

জেঠিমা পালিয়ে এসেছেন। এটা তার কাছে খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার। সে বড়দাকে চিঠি লেখে না। এমনিতে এলে, কোনো কথা ছিল না। কিন্তু কাউকে না বলে চলে এসেছেন ভারতে গিয়ে কেমন বিভ্রমে পড়ে গেল।

জেঠিমা চুপচাপ তার পেছনে হেঁটে আসছেন।

সে বলল, মেজ জ্যাঠামশাইর শরীর কেমন!

আসলে সে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

জেঠিমা বললেন, কত বড় বাড়িরে বাবা!

অতীশ দেখছে টুটুল মিণ্টু বাবার হাতে টিনের সুটকেস দেখে অবাক। ওরা নতুন বাড়ির কাছে এসে গেছে। মানসদা দোতলার রেলিংয়ে ঝুঁকে আছে। যেন অতীশের অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই বলল, হে নবীন যুবক, বৌমা কেমন আছে?

—একটু ভাল দাদা। কাল ভাত পথ্য দেবে।

মানসদা বলল, ভাল হবে না মানে! ভাল হতেই হবে। তোমার তো আর রাজবাড়ি নেই। পাপ নেই। একবার এস। নতুন ছবি এঁকেছি। দেখবে।

অতীশের এখন বেশি কথা বলার সময় নেই—তবু এই রাজবাড়ির ভিতরে হাজার কিসিমের মানুষের বাস। যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে তার একটাই প্রশ্ন, নির্মলা কেমন আছে। নির্মলাকে নিয়ে সে ভারি বিপাকে পড়েছে, রাজবাড়ির সবাই এটা জানে। সকাল হলে অনেকে খবর নিতেও আসে। এ ক’দিন সে মেস থেকে খাবার আনিয়ে নিজে খেয়েছে, টুটুল মিণ্টুকে খাইয়েছে। রোজ আশা করছে, মা কিংবা অলকা খবর পেয়েই চলে আসবে। কিন্তু কেউ অসেননি। এ-সময় জেঠিমা এসে পড়বেন সে কল্পনাও করতে পারেনি। তার শৈশব কেটেছে জেঠিমা কাকিমার কোলে। একান্নবর্তী সংসারে মা- জেঠিমার তফাত কোনোদিন বুঝতে পারেনি।

টুটুল মিণ্টুকে বলল, প্রণাম কর। তোমাদের বড় ঠাকুমা।

জেঠিমা টুটুলকে দেখে বললেন, ছোটবেলায় তুই ঠিক তোর ছেলের মতো দেখতে ছিলি। হুবহু এক।

অতীশ দেখল ওরা প্রণাম করছে না। ওরা তার জেঠিমাকে দেখেনি। বাবার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। অবাক হয়ে শুধু দেখছে। জেঠিমাকে পছন্দ হচ্ছে না।

অতীশ রাস্তায় আর ওদের পীড়াপীড়ি করল না। রক্তকরবী গাছের নিচে আসতেই জেঠিমা বললেন, বৌমার কী হয়েছে! ও কোথায়? কী অসুখ?

—হাসপাতালে।

—হাসপাতালে কেন! খুব কঠিন অসুখ?

—না খুব কঠিন না। ভাল হয়ে উঠছে। কাল পথ্য দেবে।

—তোর বাবা ক’মাস আগে গিয়েছিল। বলল, বৌমার শরীর ভাল যাচ্ছে না। কলকাতার জল হাওয়া সহ্য হচ্ছে না। কেন যে চাকরিটা ছেড়ে ও কলকাতায় চলে গেল! কলকাতায় মানুষ থাকে! বাবার অভিযোগ এ-রকমেরই হবে সে জানে। কিছু বলল না। দরজা খোলার সময় হাত থেকে সুটকেসটা নামাল। সিঁড়ির নিচে টুটুল মিণ্টু দাঁড়িয়ে আছে। জেঠিমা টুটুলকে কোলে নিতে চাইছে। কিন্তু টুটুল কী ভাবছে কে জানে—সে ঠেলে দিয়ে বলছে, কেন তুমি আমাদের বাড়ি এলে? চলে যাও।

—টুটুল! অতীশ জোর ধমক লাগাল। কী বাঁদরামি হচ্ছে! হ্যাঁ। আমার জেঠিমা। বড় জেঠিমা। ওঁরা না থাকলে তোমরা আমাকে পেতে কোথায়?

জেঠিমা বলল, বকিস না। ও বোঝে? একটা শিশুকে এ-ভাবে কেউ বকে!

অতীশ তালা খুলে দরজা ঠেলে দিল। বারান্দায় উঠে লাইট জ্বালল। এবারে সে জেঠিমার মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল। বিপর্যস্ত না হলে এ-ভাবে কেউ পালিয়ে আসে না। সহসা সেই দূরের মাঠ, আদিগন্ত ফসলের খেত, পুকুর-পাড়ের অর্জুন গাছটা চোখের উপর ভেসে উঠল; দূরে সোনালী বালির নদী, তরমুজের খেত, এক বালক দৌড়ায়। মানুষ তো একা বড় হয় না; সবাইকে নিয়ে বড় হয়। টুটুল মিণ্টু কী করে বুঝবে, এই প্রৌঢ়া বয়সকালে পাগল জ্যাঠামশাইর অজস্র অবিবেচক চিন্তা ভাবনার শরিক হতে গিয়ে কত না যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কোনো নালিশ ছিল না। জ্যাঠামশাই না ফিরলে কামরাঙা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দূরের মাঠের দিকে অপলক দৃষ্টি। কখনও তাকে কাছে ডেকে বলতেন, যা না বাবা, টোডারবাগের বটগাছটার নিচে বসে আছে কি না দেখে আয়। আসলে পাগল মানুষ হলে যা হয়—বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে যান, ফেরার কথা মনে থাকে না। কেউ মনে করিয়ে দিলে ফিরে আসেন, ফিরে আসার সময় পথ চিনে আসতে পারেন না। মাথায় গন্ডগোল থাকলে যা হয়। তখন সে ঈশম দাদাকে নিয়ে খুঁজতে বের হত। কোনোদিন পেয়ে গেছে, কোনোদিন পায়নি। কোনোদিন দেখেছে, কোনো গাছের নিচে তিনি শুয়ে আছেন ঘাসের উপর, কোনোদিন দেখেছে, নদীর গভীর খাতের দিকে বালিয়াড়িতে চুপচাপ বসে আছেন। সে পেছন থেকে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত আর সঙ্গে সঙ্গে বুঝি মানুষটার মনে হত বাড়ি ফেরার কথা। হাত ধরলে, শিশুর মতো তার সঙ্গে উঠে আসতেন। সে হাঁটলে তিনি হাঁটতেন, দৌড়ালে, তিনি দৌড়াতেন। সে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন। আকাশের অথবা গাছের ছায়ায় নিরন্তর পাখিরা ওড়ছে, সে পাখি দেখলে তিনিও দাঁড়িয়ে পাখি দেখতেন। এমন দশাসই গৌরবর্ণ সুপুরুষ মানুষটিকে সে খুঁজে পেলে সহজেই নিয়ে আসতে পারত। না পেলে জনে জনে জিজ্ঞেস করত, দেখেছেন, জ্যাঠামশায় কোনদিকে গেছেন—এদিক ওদিক, জমি মাঠ পার হয়ে অন্য গাঁয়ে পর্যন্ত একা একা কিংবা ঈশম দাদাকে নিয়ে জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে চলে গেছে। না পেলে সেও অনেকদিন চুপচাপ বসে থেকেছে কোনো গাছের নিচে। ঈশম দাদা নড়তেন না। তাকে না নিয়ে ফিরতেন না। কতদিন তরমুজের জমিতে গিয়ে সে বসে থেকেছে। বলেছে, চলুন, জ্যাঠামশাই কাল থেকে বাড়ি নেই। জেঠিমার মুখের দিকে তাকানো যেত না। বাড়ির আর সবাই এমন কি ঠাকুমা পর্যন্ত তাঁর পাগল ছেলে সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ বোধ করতেন না। এত বড় তল্লাটে বিশ পঁচিশ মাইলের মধ্যে মানুষটাকে যে যার মতো ভেবে নিয়েছে। কারো কাছে তিনি ছিলেন পীরের শামিল, কারো কাছে সংসারবিরাগী মানুষ, ঠিক কেউ না কেউ তাঁকে পথ চিনিয়ে দেবে। চলে আসবেন একদিন। কেবল তার রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যেত। যেন বাড়ি এসে ডাকছেন, সোনা, দরজা খুলে দে। আমি ফিরে এসেছি। ফিরেও আসতেন। দু-পাঁচ সাতদিন এমন কি মাসও পার হয়ে যেত, তাঁর খোঁজ থাকত না।

অতীশ কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েছিল ভাবতে ভাবতে। সে মুহূর্তের জন্য তার স্ত্রী পুত্র কন্যার কথা ভুলে গিয়েছিল। জেঠিমা ভিতরে ঢুকে বিশাল সব থাকার ঘর দেখে অবাক! পুরানো আমলের প্রাসাদসংলগ্ন এই বাড়ির কড়ি বরগা অনেক উঁচুতে। দরজা জানালা বিশাল। তিনি বললেন, টুটুল মিণ্টু বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। নিয়ে আয়। কিছুতেই আসছে না।

অভিমান! তার কেমন টান ধরে গেল। সে যেন এখানে এক নতুন পৃথিবী তৈরী করে নিয়েছে। এখানে একটা আলাদা গ্রহ। এই গ্রহে নতুন আগন্তুক আসায় টুটুল আর মিণ্টু অখুশি। তারা বাবা ছাড়া কিছু বোঝে না। সেই বাবা, কোথাকার এক নতুন আগন্তুকের খোঁজ পেয়ে তাদের অবহেলা করছে। সহ্য হবে কেন! সে ছুটে গেল। টুটুলটা না আসায় সে ভাবল বাবাকে ভয় দেখাবার জন্য দিদির হাত ধরে কোথাও না গিয়ে আবার লুকিয়ে থাকে! সে বাইরে বের হয়ে দেখল, না, ওরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দিদি, ভাইকে জড়িয়ে ধরে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাবার ধমক দু’জনের একজনও সহ্য করতে পারে না।

অতীশ কাছে গিয়ে বলল, আয়, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলি কেন! কান্নার কী হল! আমার জেঠিমা এসেছেন। তোদের বড় ঠাকুমা। আমার যেমন তোরা, আমিও তোর ঠাকুমার তেমনি ছিলাম। আমি কি একদিনে বড় হয়ে গেছি! তোর বড় ঠাকুমা, আমি যখন ছোট ছিলাম না, চান করিয়ে দিত, কোলে নিয়ে ভাত খাওয়াতো, কাঁদলে আদর করত। ঠিক তোরা যেমন দুষ্টুমি করিস, ছেলেবেলায় আমিও কত দুষ্টুমি করেছি। মা মারধোর করলে জেঠিমা ছুটে এসে ছিনিয়ে নিতেন।

বাবাকেও মারত! এমন কথায় দুজনেরই কান্না থেমে গেল।

—তুমি দুষ্টুমি করতে বাবা!

—করতাম না!

—তোমাকে ঠাকুমা মারত!

—মারবে না দুষ্টুমি করলে!

নিমেষে অভিমান তাদের জল হয়ে গেল। তারা শুধু দুষ্টু নয়, বাবাও দুষ্টু ছিল। ভারি মজা। ওরা এক দৌড়ে বারান্দায় উঠে এসে তাদের বড় ঠাকুমাকে টুপ করে প্রণাম করে ফেলল।

জেঠিমা বললেন, বেঁচে থাক ভাই। বেঁচে থাক দিদি। বংশের মুখ উজ্জ্বল কর।

টুটুল এসব বোঝে না। সে জেঠিমাকে তার যাবতীয় সব আশ্চর্যের খবর দেবে বলে তক্তপোশের নিচে ঢুকে গেল। তার নিজের খেলনার বাড়িঘর টেনে বের করতে থাকলে, অতীশ বুঝল, এখন ভাইবোন মিলে সব দেখাতে বসবে। জ্বালাবে।

অতীশ জেঠিমাকে বলল, এদিকে দুটো ঘর। ওদিকে রান্নাঘর। পাশের দরজা খুলে বলল, ‘এটা বাথরুম। রাতে কি খান?

—একটা কিছু হলেই হবে। তুই কি বৌমাকে দেখতে গেছিলি?

অতীশ বলল, আজ সকালে ওর ঘোর কেটেছে। খুব বড় অপারেশন হয়েছে। ক’দিন হাসপাতালে আরও থাকতে হবে। মার আসার কথা, কিন্তু এল না কেন বুঝতে পারছি না।

আসলে সে কিছুটা নিরুদ্বেগ, কারণ জেঠিমা থাকলে টুটুল মিণ্টুকে দেখার নিজের একজন কেউ থাকল। শহরে এসে সে দেখেছে, নিজের লোকের বড় অভাব। মেস থেকে খাবার দিয়ে যাবে, কিন্তু জেঠিমা সে-সব ছোঁবেন না। তিনি কী খাবেন, ঘরে কিছু আনাজপাতি আছে।

সে বলল, স্টোভ ধরিয়ে দিচ্ছি। আপনি চান-টান করে একটু জিরিয়ে নিন। আমি দৌড়ে বাজারটা সেরে আসছি। সে জানে, জেঠিমার মাছ ভাত হলে আর কিছু লাগে না। কতকাল পরে সে যেন সেই সোনা, আর জেঠিমা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে। তেঁতুল গাছের ছায়ায় জেঠিমার মুখে কোনও এক অতীত থেকে এক মায়াবী আলো ফুটে উঠেছে।

জেঠিমা স্নানে যাবার আগে বললেন, তোরা কী খাবি! আমার খাওয়া নিয়ে অত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন!

—আমাদের খাবার মেস থেকে দিয়ে যাবে।

মেস কথাটা জেঠিমা ঠিক বুঝতে পারেন নি। সুটকেস খুলে শাড়ি বের করছেন। এবং অতীশ দেখল, সবই সোডায় কাচা। সে বলল, এগুলো বের করে দিন ধোপা নিয়ে যাবে। নির্মলার শাড়ি সায়া দিচ্ছি। কারণ অতীশ জানে আজ হোক বা কাল হোক নির্মলাদের বাড়ি থেকে কেউ চলে আসবে। ওরা জেঠিমার এই বিবর্ণ শাড়ি ব্লাউজ দেখলে খুশি হবে না। অতীশ এ-জন্য নির্মলার পাটভাঙা শাড়ি ব্লাউজ সায়া বের করে দিয়ে বলল, আপনি চানে যান। শাড়িগুলি বের করে দিন। সকালে মনোহরকে বলে যাব, সে নিয়ে যাবে। তারপরই কী মনে পড়ে যাওয়ায় অতীশ বলল, মেস আছে, যারা পাশের মেসবাড়িতে থাকে তাদের রান্না হয়। কেউ আলাদা মিল চাইলে দিয়ে যায়। একা পেরে উঠছিলাম না। কাল সকালে আপনাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাব। বাড়িটায় কত লোক থাকে বুঝতে পারবেন। বাবুপাড়া, বাবুর্চিপাড়া, ধোপাঘর, দুটো বিশাল পুকুর, মাঠ কী না আছে। বলেই সে ব্যাগ হাতে বের হবার সময় বলল, মিণ্টু, তোমার ঠাকুমার যা লাগে দেবে। আমি আসছি।

জেঠিমার দিকে তাকিয়ে বলল, গামছাটা রেখে দিন, বাথরুমে ধোওয়া তোয়ালে আছে, সাবান সব।

সে জানে জেঠিমা ফিটফাট থাকতে ভালবাসতেন। বড়দা খুবই কষ্টে আছে, না, বড় বৌদি জেঠিমার এমন অবস্থার জন্য দায়ী সে কিছুই বুঝতে পারছে না। জেঠিমা কখনও এত বিবর্ণ শাড়ি সায়া ব্লাউজ পরেছে সে দেখেনি। সে খুব দ্রুত কথা বলে যাবার সময় শুনতে পেল, জেঠিমা ডাকছেন, সোনা বাজারে যাচ্ছিস, আমার জন্য পান-সুপারি আনিস। আর শোন, মেসে বলে যা, মিল লাগবে না। একার জন্য আমি রাঁধতে পারব না বাবা।

এতটা রাস্তা এলেন কিছু মুখে দেননি, চোখমুখ দেখেছেন আয়নায়!

জেঠিমা হেসে ফেললেন, আয়নায়! তুই দেখছি কেমন হয়ে গেছিস। আমি রাঁধব, তোরা খাবি না। তোরা মেসের খাবার খাবি, আমার খেতে ভাল লাগবে! বলে অতীশের দিকে এমন কাতর চোখে তাকিয়ে থাকলেন যে সে আর একটা কথাও বলতে পারল না।

কিন্তু গোল বাধল খেতে বসে। সে বাজার থেকে পাবদা মাছ এনেছে। জেঠিমা পাবদা মাছ খেতে ভালবাসেন। তাজা নয়, বরফ দেওয়া। তাজা পাবদা কলকাতায় এসে অতীশ কোনোদিন খায়নি। সকালের বাজারে তবু পছন্দমত মাছ পাওয়া যায়, বিকালের বাজারে তাও পাওয়া যায় না। যা পাওয়া গেছে—খেতে বসে অতীশ অবাক, জেঠিমা মাছের বাটিটা সবটাই তাকে এগিয়ে দিলেন। মুগের ডাল বেগুন ভাজা মাছের ঝোল। বেশ রাত হয়ে গেছে। টুটুল মিণ্টু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওদের তুলে চোখে মুখে জল দিয়ে অতীশ নিজের পাশে বসিয়ে নিয়েছে। নিজেও খাবে, ওদেরও খাইয়ে দেবে। ঘুমের চোখে এমনিতেই খেতে চায় না দুজনে, সে তবু পারে খাওয়াতে। জেঠিমার আচরণে সে কেমন অবাক হয়ে গেল। বলল, সবটা দিলেন কেন? আপনারটা কোথায়? আপনি পাবদা খেতে ভালবাসেন বলে এনেছি।

জেঠিমা শুধু বলল, তুই খা। আমি মাছ খাই না।

অতীশ কেমন আহাম্মকের মতো বলল, কবে থেকে খান না? এখানে পালিয়ে চলে এলেন—কারণ অতীশের ধারণা জেঠিমা বৈধব্য মেনে নিলে মাছটাও খেতে পারবেন না বলেই, নিখোঁজ পাগল জ্যাঠামশাইর পারলৌকিক কাজে মত দিচ্ছেন না। মা এবং অন্য আত্মীয়স্বজনরা অতীশকে এমনই বুঝিয়েছে। হতে পারে। একজন মানুষ বিশ বাইশ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে গেছেন, তাঁর স্মৃতি আর সে-ভাবে প্রখর থাকার কথা না। সবই মন থেকে ক্রমে মুছে যায়। জ্যাঠামশাইকে সেও কম ভালবাসত না। এখন তাঁর মুখটাই সে মাঝে মাঝে মনে করতে পারে না। ধূসর স্মৃতি। জেঠিমার বয়েস হয়ে গেছে, তিনি কি বিশ বাইশ বছর পরও সেই তাজা মানুষটার স্পর্শ অনুভব করেন! না, নিছক অভ্যাস ছাড়তে পারবেন না বলে আত্মীয়-স্বজনের সবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।

অতীশের খুব খারাপ লাগত এসব ভাবতে। এটাও মনে হত, যদি আজীবন জেঠিমা সধবাই থাকেন কার কী ক্ষতি! এখন জেঠিমার কথায় বুঝেছে, তাড়নায় পাগল হয়ে যাবার যো।

জেঠিমা বললেন, কীরে বসে আছিস কেন? এই মিণ্টু, এই টুটুল আবার ঢুলছে।

—আপনি একটা বাটি দিন তো।

—পাগলামি করিস না। মুগের ডাল বেগুন ভাজা দিয়ে হয়ে যাবে। তুই ভাবিস না বাবা।

—না দিন।

—বলছি মাছ খাই না।

অতীশ জেঠিমার কপাল দেখল। বড় করে সিঁদুরের টিপ, মাথায় লম্বা সিঁথিতে সিঁদুর একটাও চুল পাকেনি। চুল কোঁকড়ানো, স্নান করায় জেঠিমাকে বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে। এত বয়সেও কোথায় যেন এক গোপন সৌন্দর্য শরীরে লুকিয়ে রেখেছেন। জেঠিমা কি বোঝেন, তিনি সাদা থান পরলে ইহকালে বেঁচে থাকা তাঁর অর্থহীন। একটিই ছেলে, তাঁর বৌমা নাতি নাতনী সব থাকতেও জেঠিমা কেন যে এত নিঃস্ব—তার কেমন টান ধরে গেল। বলল, খাবেন না কেন, আপনি না খেলে এত কষ্ট করে আনতে গেলাম কেন? আপনি না খেলে আমরাও খাচ্ছি না।

জেঠিমা নিজেকে সংবরণ করার জন্য মুখ আড়াল করছেন।

অতীশ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। মাথা নিচু করে বসে আছে। টুটুল মিণ্টু ঢুলছে।

জেঠিমা আর পারলেন না। মুখ অন্যদিকে লুকিয়েই বললেন, বৌমা দিব্বি দিয়েছে বাবা, মাছ খেলে আমি ছেলের মাথা খাই। অতীশ বুঝতে পারছে, নির্যাতনের শেষ পর্যায়ে আজ জেঠিমা ভেঙে পড়েছেন। ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। মুখে আঁচল চেপে কান্না সামলাবার চেষ্টা করছেন।

অতীশ বুঝতে পারে, মগজের মধ্যে হাজার কোটি কোষ আছে, এইসব কোষে স্মৃতিরা জেগে থাকে, কিংবা দেখতে পায় বিশাল খাঁ-খাঁ প্রান্তরে শকুন উড়ছে, কখনও মনে হয় এক বুড়ো বসে আছে গাছের নিচে, হাতে লাঠি। শীত জাঁকিয়ে পড়েছে। সামনে নদী, তার তরঙ্গ নেই অথবা বালিয়াড়ি পার হয়ে কেউ হেঁটে যায়। কোনো পাহাড়ী উপত্যকায় মনে হয় কখনও কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে—আবার এই কোষেই শুয়ে থাকে নির্মলা নামে এক যুবতী। এ ক’দিন মনে হয়েছে যুবতী তার মগজের কোষের সবটা অধিকার করে শুয়েছিল। সাদা বিছানা, ওষুধের গন্ধ, স্যালাইন, ব্লাড ছাড়া কোষের অভ্যন্তরে অন্য কোন ছবি ফুটে উঠত না। দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা প্রবল হলে যা হয়, এবং মাথাটা মনে হত ভারি, কেউ পাথর চাপিয়ে রেখেছে। আজ বিকালে সেই যুবতী আরোগ্যলাভের দিকে, তার দিকে তাকিয়েছে। নির্ভর বলতে সেই তার—আর এখন সামনে বসে আছে সেই নিখোঁজ মানুষটির স্ত্রী। এবং ভেতরে কেমন সে ছটফট করতে থাকল। শেষে কি ভেবে টুটুল মিণ্টুকে খাইয়ে তুলে নিয়ে গেল।

জেঠিমা কখন এক ফাঁকে উঠে গেছেন। বিছানা করছেন। বলেছেন, তোর ছেলেমেয়েরা আজ আমার সঙ্গে শোবে। দেখে মনে হয় কতদিন তুই ঘুমোস না!

অতীশ কিছু বলল না।

জেঠিমা ওদের কাছে টেনে নিলেন। সে কিছু বলল না। জেঠিমার ধারণা, ওরা তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়—আসলে জেঠিমা জানেই না, ওরা আছে বলে সে বেঁচে থাকতে চায়—নাকি, এটা তার একটা মানসিক বিকার—কেউ না থাকলেও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। সে যতই একা হয়ে যাক, পৃথিবীর টান বড় টান।

অতীশ টেবিল-লাইট জ্বালিয়ে চেয়ারে বসল। খাবার পর কিছুক্ষণ লেখার টেবিলে চুপচাপ বসে থাকল। হাসপাতালের বিল, কত টাকার দরকার! তার কাছে দু-পাঁচশ বাড়তি টাকা সংগ্রহ করা কত কঠিন, মুহূর্তে টের পেল। সে অনেক দিন ভেবেছে, সেই সমুদ্র এবং বনি, একটা বোট এবং অনন্ত জলরাশির খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে তার কিছু টাকা হয়ে যেতে পারে।

সে ভেবেছিল লেখাটা হবে দিনলিপি পর্যায়ের 1

সেটা কোন সাল তার মনে আছে! কী মাস তাও মনে আছে! ডিসেম্বর মাস। না জানুয়ারী! জানুয়ারি না ডিসেম্বর! কেমন গোলমাল শুরু হয়ে গেল মাথায়। তের চোদ্দ বছর আগের ঘটনা—ঠিক মাসটাও মনে করতে পারছে না। তারিখ অনুযায়ী লিখলে মাস তারিখ বছর দিতে হয়। তারপরই মনে হল, মাস তারিখ বছর গুরুত্ব পাচ্ছে কেন। সেটা যে কোনো মাস হতে পারে, তারিখ হতে পারে সাল হতে পারে।

আসলে সেই দীর্ঘ অজানা সমুদ্রে বনি এবং তার বিচিত্র মানসিকতার কথা লিখতে পারলেই যথেষ্ট। বিষয় হিসেবে একেবারে নতুন। এমন দুঃসাহসিক অভিযানের খবর পৃথিবীর কেউ রাখে না।

তখনই মনে হয় সুদূরে স্যালি হিগিনস দাঁড়িয়ে। তাকে প্রশ্ন করছে, হোয়াট ইজ লাভ!

সে এই বুড়ো লোকটাকে কেন যে এত ভয় পায়!

এই বুড়ো লোকটাই যত নষ্টের মূলে।

জাহাজে বনিকে নিয়ে ওঠার কি দরকার ছিল!

উঠেছিলেন তো বনিকে ছেলে সাজিয়ে রাখার কী দরকার ছিল! জ্যাক বলে চালিয়ে দেবার কী দরকার ছিল! জ্যাক আসলে বনি, বালিকা, এই চাতুরী ভেবেছিলেন বেশ মেনে নেবে সবাই। ছোট করে চুল ছেঁটে এনেছিলেন। সারা ডেকে দাপাদাপি করে বেড়াত। জাহাজিরা তো ভয়ে কাছেই যেত না। কাপ্তানের দূরন্ত ছেলে, কখন কী করে বসবে। কাপ্তানের একমাত্র বংশধরকে শেষ সফরে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এত দুরম্ভ যে আত্মীয়রা রাখতে চায় না। মা-মরা মেয়েকে কোথাও রেখে আসতে পারতেন না! কেন পারলেন না! আসলে আপনি জানতেন, বনিকে একা ফেলে বেশিদিন সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে আপনার ভাল লাগে না। শেষ সফর, বয়স হয়ে গেছে, কখন কফিনের ভিতর ঢুকে যেতে হবে, যে কটা দিন কাছে কাছে রাখা যায়!

জাহাজে উঠেই সারেঙকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কেন এখন বুঝি!

সারেঙসাব সেদিন, জাহাজের সবাইকে ডেকেছিলেন।

ডেক-সারেঙ হাজির। জাহাজ গঙ্গার মোহনা ছাড়িয়ে সমুদ্রে তখন ঢুকছে।

কসপ টিভাল, ডংকিম্যান, ফায়ারম্যান, গ্রীজার, কোলবয় এবং সব খালাসিরা হাজির।

যেন সতর্কবাণী শোনাচ্ছেন—সাবধান এবারের সফরে জাহাজে শুধু তোমরা আছ ভেব না। সঙ্গে একজন ইবলিশও বিসমিল্লা বলে উঠে এসেছে।

—কে সেই ইবলিশ

—জ্যাক। কাপ্তানের বয়ে যাওয়া পোলা।

—তা পোলা যে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেল!

অতীশের হাসি পেল এ-সময়।

দরজা ভেজিয়ে অনেক দূরের স্মৃতির মধ্যে ডুবে আছে সে।

কী মাস?

ধরা যাক জানুয়ারি। দক্ষিণ সমুদ্র। শেষ বন্দর সামোয়া। এখানেই বড় টিন্ডাল মৈত্রদাকে ছোট্ট একটা পাহাড়ী দ্বীপে দাহ করা হয়েছিল।

আবার চিৎকার—হোয়াট ইজ লাভ ছোটবাবু?

—লাভ!

—ইয়েস লাভ!

—জানি না! জানি না!

মৈত্রদা কেন যে সমুদ্রের জলে ডুবে আত্মহত্যা করল। এটা আত্মহত্যা! আপনি স্যালি হিগিনস জানেন, সে কেন আত্মহত্যা করল! সে কেন জাহাজে পাগল হয়ে গেল! সে কী কোনো ভালবাসার জন্য?

সমুদ্রের গভীর অন্ধকারে বোটের অদূরে স্যালি হিগিনস বলেছিলেন, লাভ ডাজ ব্রিং এবাউট জাস্টিস অ্যাটলাস্ট, ইফ ইউ ওনলি ওয়েট।

আসলে তিনি বলতে চেয়েছিলেন, প্রেম হল ঈশ্বরলাভের মতো। প্রেম এবং ঈশ্বরে কোন তফাত নেই।

বনির সেদিন কি কারণে যে মেজাজ গরম হয়ে গেছিল, মনে করতে পারছে না অতীশ।

সেও মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি।

অ্যালবাট্রস পাখিটা বোটের গলুইয়ে বসে চুপচাপ দুজনকেই দেখছে। নীল চোখ। ঘাড় কাত করে আছে।

তারা তিনটে মাত্র প্রাণী।

আর অসীম জলরাশি।

দৃশ্যটা অতীশ মনে করতে পারছে।

সে এগিয়ে যাচ্ছে ডেক ধরে। রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল। কী কঠিন আর বিভিষিকাময় সমুদ্ৰ ক্ৰমে পাক খাচ্ছে। সব কিছু দুলছে। সে তবু শক্ত। জাহাজ থেকে সবাই নেবে গেছে। চারটে লাইফবোটের তিনটেই দিয়ে দিয়েছেন তিনি। একটা মাত্র আছে। আর আছে সে, বনি, সারেঙসাব, কাপ্তান স্যালি হিগিনস্! সামোয়া থেকে রওনা হবার আট দশদিন পর এই দুর্ঘটনা। বয়লার চক বসে গিয়ে ইনজিনরুমে বিস্ফোরণ। প্রপেলার স্যাফট দু-টুকরো। ঝড়ে ট্রানসমিসান রুম উড়ে গেছে।

ওফ কী শব্দ!

চীৎকার চেঁচামেচি। ছোটাছুটি। এবং ধস্তাধস্তি। ঝড়ের রাতটাই ছিল সেই শয়তানের—দুরাত্মা আর্চি, বনির কেবিনে ঢুকে ধর্ষণের নিমিত্ত পাগল হয়ে গেছে।

শক্ত মজবুত ছোটবাবু সিঁড়ি ভেঙে উঠছে উপরে-দরজা ঠেলে দিতেই সেই অসহায় নারী!

অতীশ হাসল। কী সব স্মৃতি এলোমেলো বান ডেকে যাচ্ছে মগজের কোষে।

অতীশ চুপি চুপি বলল, স্যার সে যে নারী হয়ে গেল দীর্ঘ সফরে। স্যার জ্যাক যে নারী, এটা জাহাজে সবার আগে টের পেয়েছিল আর্চি। দুরাত্মা আর্চির মুখটা আমার কাছে সব সময় বাঘের মুখ মনে হত! ধর্ষণের সময় সেই দুরাত্মাকে খুন না করলে আপনার একমাত্র বংশধরকে ইজ্জতের হাত থেকে যে বাঁচাতে পারতাম না! আমার কী পাপ বলুন! সে বলল, মাই হার্ট ট্রেমবেলস অ্যাট দিস! আমি তাকে খুন না করে পারিনি! আমার কী পাপ বলুন! কেন আমার জীবনে এত সাফারিস

অতীশ শুনতে পাচ্ছে তিনি সেই সুদূর থেকে যেন বলছেন, গড সেন্ডস দ্য স্টর্ম অ্যাজ পানিশমেন্ট। আমার পাপ ছিল হে। তারপরই সেই হাহাকার শুনতে পেল অতীশ, হ্যালেলুজা। আই অ্যাম অন মাই ওয়ে। তিনি কাঠে পেরেক পুঁতে দিচ্ছেন। দুটো ক্রস তৈরি করেছেন, দুটোই তুলে দেওয়া হবে তাদের বোটে। দুটো ক্রস, না একটা! সে কেমন সব গোলমাল করে ফেলছে। কাঠে পেরেক পুঁতে দেবার সময় বলেছেন, বুঝলে ছোটবাবু, সাফারিঙস-সাফারিঙস অফ ম্যানকাইন্ড। মানুষ নিজেই তার ক্রস বধ্যভূমিতে বহন করে নিয়ে যায়। তোমার স্ত্রী নির্মলা অসুস্থ। ভাল হয়ে উঠবে। কিন্তু সাফারিঙস মানুষের জন্মের সঙ্গী। তাকে তুমি এড়াতে পার না।

তিনি বললেন, লেট মি গো অন অ্যান্ড আই উইল শো ইউ দ্য ট্রুথ অফ হোয়াট আই অ্যাম সেইং। আই অ্যাম টেলিং ইউ দ্য অনেষ্ট টুথ, ফর আই অ্যাম এ ম্যান অফ ওয়েল-রাউন্ডেড নলেজ।

অতীশ চেয়ে আছে। জানালা অতিক্রম করে দূরের আকাশে দু-একটা নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। স্যালি হিগিনস সেখান থেকে যেন তারবার্তা পাঠাচ্ছেন—গড ইজ অলমাইটি, অ্যান্ড ইয়েট ডাজ নট ডেসপাইজেস এনিওয়ান অ্যান্ড হি ইজ পারফেকট ইন দিজ আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

অতীশ চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল—আমি কিছু মানি না। অল বোগাস।

তখনও প্রশ্ন, তুমি বাতিদানটা কুলুঙ্গিতে রেখেছ কেন? জবাব দাও। তোমার সন্তানদের ওটা ধরতে দাও না কেন? তোমার জন্য অদৃশ্যলোকে কেউ থাকুক এটা তুমি চাও। নাহলে সাহস পাবে কী করে! সামান্য হাসপাতালের বিল মাথা গরম করে দিয়েছে। হা হা হা কী হাসি!

—আপনি হাসছেন?

–তোমার পাগল জ্যাঠামশাই কোথায়?

—জানি না।

—সেই অন্ধকার অদৃশ্য জগতে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁকে তোমরা আর ফিরে পাবে না। তোমার জেঠিমা কাঁদল কেন? মানুষের স্মৃতিই সব। তাকে সে কিছুতেই বিনষ্ট হতে দিতে চায় না। তোমার চারুকে খুঁজে পেলে?

অতীশ কেমন বিভ্রমে পড়ে গেছে। যেমন সে মাঝে মাঝে পাড়ে যায়—একটা ঘোরের মতো। এই ঘোরের মধ্যেই সে যদি তার সেই আশ্চর্য সফরের কথা লিখতে পারত। বলল, আমাকে সাহস দিন। বোটে ওঠার দিনক্ষণ সব ভুলে গেছি। মনে করিয়ে দিন। নির্মলার অসুখের পর আমি একটা লাইন লিখতে পারছি না। বনি মাঝে মাঝে এসে উদয় হয়। বাতিদানটার মধ্যে বনিকে আমি স্পষ্ট দেখেছি। বাতিদানিটায় বনি আশ্রয় নিয়েছে।

তিনি বললেন, দেয়ার ইজ নো ট্রয়ার স্টেটমেন্ট দ্যান দিজ। দেখতেই পার। তিনি নানাভাবে মানুষকে দেখা দেন। গড ইজ নেভার উইকেড অ্যান্ড আনজাস্ট। তিনি ভালবাসার সামগ্রী। ইফ গড ওয়েয়ার টু উইদড্র হিজ স্পিরিট, অল লাইফ উড ডিজএপিয়ার অ্যান্ড ম্যানকাইন্ড উড টার্ন এগেইন টু ডাস্ট।

তিনি ফের বললেন, বনি ওয়ান্টেড টু লিউর ইউ অ্যাওয়ে ফ্রম ডেনজার ইনটু এ ওয়াইড প্লেজান্ট ভেলি অ্যান্ড টু প্রসপার ইউ দেয়ার। বনি ইজ লাভ, লাভ ইজ গড। নাউ গড উইথ ইউ। প্রেইজ হার।

অতীশ আর স্থির থাকতে পারল না। কুলুঙ্গি থেকে বাতিদানটা তুলে আনল। কষ্টিপাথরের ছোট্ট দেবীমূর্তি। মাথায় মুকুট—কয়েকটা ফোকর। কিন্তু এই বাতিদানটায় হাত দিতেই ফের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল। যেন বনি সামনে দাঁড়িয়ে—ছোটবাবু তুমি আমাকে ছুড়ে ফেলে দেবে! আমি যে তোমার মধ্যে বেঁচে আছি।

অতীশ ফের বলল, মাই হার্ট ট্রেমবেলস অ্যাট্ দিস। আমি ফেলে দিতে পারিনা। তুলে রেখেছিলাম। আমার যেন এটা শেষ আশ্রয়।

অতীশ টেবিলে বাতিদানটা রেখে দেখছিল। কালো কষ্টিপাথরের নগ্ন দেবীমূর্তি ক্রমে সেই সুচারু রমণী হয়ে যেতে থাকল—নীলাভ চুল, শঙ্খের মতো সাদা গায়ের রঙ—নীল চোখ এবং এক ঔদার্যময় গভীর আকাঙ্ক্ষা বুকের ভেতর—নরম এবং উষ্ণ হালকা লেসের গাউন শরীরে। ভেতরের সব দেখা যায়—সমুদ্রে সূর্য নেমে যাচ্ছে। হাওয়া দিচ্ছে না তেমন—চারপাশে অসংখ্য ডলফিনের ঝাঁক, কোন অতিকায় মনস্টার নিচে দাপাচ্ছে কে জানে—একরাশ কাশফুলের রেণুর মতো উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক বাতাসে উড়ে যাচ্ছে—অথবা মনে হয় হাজার হাজার বর্শাফলক সমুদ্রের অতল থেকে উঠে এসে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে বাতাসে।

পালে বাতাস। অজানা সমুদ্রে দুই তরুণ-তরুণী। সকাল হলেই কাপ্তানের নির্দেশমতো বোটের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নেওয়া। ৯০° ডিগ্রি বরাবর কম্পাসের কাঁটা রাখতে বলেছে। হালের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে জানে। পালে বাতাস লাগলে বোট চলছে, না লাগলে বোট থেমে থাকছে—অথবা যেন হিগিনস জানতেন সমুদ্রে চোরা স্রোত থাকে, কোথায় শেষ পর্যন্ত ভেসে যাবে কেউ বলতে পারে না। শুধু দৈব নির্ভর। আসলে ৯০ ডিগ্রি ফিগ্রি সব বোগাস ব্যাপার। আসলে সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ের মৃত্যু চোখের উপর দেখতে সাহস পাননি। বোট দিয়ে বলেছেন, এবারে সামনে এগিয়ে যাও। ক্রস বোটে রাখার সময়ই সে টের পেয়েছিল, এই বোটই হবে তাদের সমাধিক্ষেত্র। নিরন্তর ভেসে চলবে, সে আর বনি মরে পড়ে থাকবে বোটে। শিয়রে বাইবেল, পাশে ক্রস, ক্ষুধায় তৃষ্ণায় পাগল হয়ে যেতে হবে। কে কার গলা কামড়ে ধরবে ঠিক নেই। তবু শেষ অবলম্বনের কিছু নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, যখন জল এবং খাবার ফুরিয়ে যাবে—তখন প্লাংকাটন খাবে। সমুদ্রের সেই শ্যাওলা জীবনধারণের পক্ষে খুবই উপযোগী। আসলে ওগুলো শ্যাওলা না। একধরনের জীবাণু বিশেষ বলেছিলেন ছাঁকনি ফেলে রাখবে—ছাঁকনিটা যত্ন করে রাখবে। ওটা র‍্যাফটে রাখবে না। ঝড়ে র‍্যাফটের দড়িদড়া আলগা হয়ে গেলে—বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। ছাঁকনিটা বোটে রেখে দাও। পাটাতনের নিচে তিনি নিজেই শেষে ছাঁকনিটা রাখার সময় বলেছিলেন, দেখে নাও কোথায় রাখলাম। অয়েল-ব্যাগের পাশে থাকল।

বনির গভীর আস্থা ছোটবাবুর উপর। সে তো বোটে ওঠার সময় বুঝতেই পারেনি, অজানা সমুদ্রে বাবা তাদের ভাসিয়ে দিচ্ছেন।

অতীশ অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে বলল, ছোটবাবু তুমি জানতে—অথচ বনিকে বোটে ওঠার সময় কিছু বলনি। বনির শরীরের প্রতি তোমার তীব্র আগ্রহ—তুমি ভেবেছিলে—সেই অসীম জলরাশির মধ্যে যে ক’দিন বেঁচে থাকা, সবটাই এক সৌন্দর্যময় জগৎ, নারীর রমণীয় শরীর এবং কোনো ঝড় উল্কাপাতের চেয়েও তার আকর্ষণ কত বেশি, তোমার চোখ মুখ দেখে আমি টের পেয়েছিলাম।

—অতীশ বোঝে না, কেন যে মাঝে মাঝে ছোটবাবুর সঙ্গে এই রহস্যময় লড়ালড়ি শুরু হয়। ছোটবাবু বলল, দেখ অতীশ, বনির আগ্রহই আমাকে অধীর করে রেখেছিল। ওর আগ্রহ না থাকলে, জাহাজে জোর করে থেকে যেতে পারতাম। কাপ্তানের নির্দেশ অমান্য করতে পারতাম—বনি ডাঙায় উঠে যাবার জন্য সব সময় দূরবীন চোখে নিয়ে বসে থাকত। জাহাজ আমাদের ভাসছে। জাহাজ ক্রমে অজানা সমুদ্রে ঢুকে যাচ্ছে। তিনি নিরুপায় ছিলেন। আর জাহাজে থাকলেই বা কী হত। চাল, ময়দা যা ছিল, তিনি বোটে তুলে দিয়েছিলেন—বনি টের পেলে কান্নাকাটি করবে। রাতের অন্ধকারে আমরা কাজ করেছিলাম। বনি কেবিনে ঘুমোচ্ছে—বনিকে বুঝতেই দেওয়া হয় নি তাকে নামিয়ে দেওয়া হবে। তুমি তো জানো অতীশবাবু, কাপ্তানের কী মেজাজ।

মাঝে মাঝে এটা হয়। যেন অতীশ আর ছোটবাবু আলাদা অস্তিত্ব। অতীশ নিজেই জাহাজের ছোটবাবু বিশ্বাস করতে পারে না। এ-যেন অন্য জন্মের ইতিহাস।

আর তখনই অতীশ ক্ষেপে ওঠে।—ছোটবাবু, তুমি স্বার্থপর।

—কেন এ কথা বলছ!

—নিরীহ মেয়েটা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কী না করেছে! সে কী খেল না খেল দেখনি?

—দেখেছি। ও তো বলতো ওতেই ওর হয়ে যাবে। বেশি খেতে পারে না।

—যখন খাবার ফুরিয়ে গেল, তুমি প্লাংকাটন খেতে। ওকে খাওয়াতে পারলে না কেন? খেতে পারলে ও ঠিক তোমার মতো ডাঙা পেয়ে যেত।

—কম চেষ্টা করেছি! ও বমি করে সব ফেলে দিত। প্লাংকাটন দেখলেই ওর ওয়াক উঠে আসত। না পেরে জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা করেছি। বনির তখন এক কথা, আমাকে মেরে ফেলতে চাও! তখন কার না রাগ হয়!

—তুমি বললে না কেন ছোটবাবু, বনি, তুমি না খেলে আমিও না খেয়ে থাকব। তুমি না খেয়ে বোটে মরে থাকবে, আমি তোমাকে নিয়ে সমুদ্রে ভেসে বেড়াব সেটা ভাবছ কী করে!

আর অতীশ তখনই দেখল ছোটবাবু কখন আবার তার শরীরের সঙ্গে মিশে গেছে। সে-ই ছোটবাবু—মরীচিকা তখন, সারারাত দু’জনই জেগে দেখল একটা জাহাজ তাদের উদ্ধার করতে আসছে।

বনি চিৎকার করছে—আসছে আসছে ছোটবাবু। ঐ দেখ, আলো জ্বলছে। ঐ দেখ, অন্ধকার সরে গেছে। সিগনেলিং টর্চটা কোথায়? ইস্ তুমি যে কী না ছোটবাবু, কোথায় সব রাখো দরকারমতো আর পাওয়া যায় না।

—আমি রেখেছি, না তুমি রেখেছ!

বনি জিভ কামড়ে বলল, ইস্ ভুলেই গেছি। আর সিগনেলিং টর্চ জ্বাললেই অন্ধকারে জাহাজের আলো বাতাসে মিশে যেত। সারা রাত এবং দিনের বেলাতেও মাঝে মাঝে বনি কি দেখে চিৎকার করে উঠত—ছোটবাবু—রকেট প্যারাসুট ছাড়। ওরা দেখতে পাচ্ছে না। বনি হাত তুলে গাউন উড়িয়ে দিত। তারপরই ছোটবাবু দেখতে পেত, একটা জাহাজ সত্যি এগিয়ে আসছে।

জাহাজটা চলে যাচ্ছে ছোটবাবু কী হবে!

জাহাজটা সহসা সমুদ্রে ফের অদৃশ্য হয়ে গেল।

ছোটবাবু দমে গেল। সে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে পাটাতনে। বনি পাশে বসে, ডাকছে, ছোটবাবু ওঠো। আবার জাহাজ আসবে। উই আর ইননোসেন্ট। গড সেভস দ্য ফাদারলেস অ্যান্ড দ্য পুওর ফ্রম দ্য গ্র্যাসপ অফ দিজ অপ্রেসার।

পালে বাতাস আছে তখনও। বোট চলছে। পাঁচ সাতশ মাইলের মধ্যে দুটো দ্বীপ পেয়ে যাবার কথা। পালে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু এসে জোর ধাক্কা মারছে। কথামতো ৯০ ডিগ্রি বরাবর কম্পাসের কাঁটা বাঁধা। জোর হাওয়া দিচ্ছে ক’দিন থেকে। নীল জলে অজস্র তরঙ্গমালা উঠছে, নাচছে, অজস্র কুরচি ফুলের মতো সাদা ফেনায় ঢেউয়ের মাথা ঢেকে যাচ্ছে, আবার কিছুক্ষণের মধ্যে মিশে গিয়ে নীল জলরাশি হয়ে যাচ্ছে। বোট উঠছে নামছে। পুরো দশ দিন বোট চালাবার পর মরীচিকা। এলিস দ্বীপের পাত্তা নেই।

বনি হাঁটু গেড়ে বসে ভাবছে, এই ছোটবাবু, কী হল!

—জাহাজটা চলে গেল! আর দেখা যাচ্ছে না।

—বনি!

—বল।

—জাহাজটা সারারাত ভেসে থাকল। দিনের বেলাতেও দেখেছ জাহাজটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

—ছিলো তো।

—আমাদের তুলে নিল না কেন!

—মনে হয় দেখতে পায়নি।

–কী বলছ, এত কাছে দেখতে পায়নি!

—দেখতে পেলে তুলে নিত না!

ছোটবাবু মনের জোর হারিয়ে ফেলছে। বনি এবার চুমু খেল। বলল, খাবে না!

—কী খাব? –আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।

—ডাকব এলবাকে!

তখন যত নালিশ বনির এলবার কাছে। আলবাট্রস পাখিটা বোট ছাড়ছে না। জাহাজের মাস্তুল থেকে উড়ে এসে এতদিন যেন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেই পাখিটাও কাল থেকে বোটের গুলুইতে বসে থাকছে। ঠোঁট পাখার মধ্যে গুঁজে দিয়ে কেবল ঘুমাচ্ছে। খিদে পেলে উড়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। দুটো একটা মাছ খেয়ে সমুদ্রে, ঢেউয়ের উপর ভেসে থেকেছে, ডুবে ডুবে স্নান করছে আবার উড়ে এসে বোটের গলুইতে বসে পাখা ঝাড়ছে। ঠুকরে ঠুকরে পাখা থেকে শরীর থেকে নোনা জল ঝেড়ে ফেলে কক কক করে ডেকে উঠছে।

—এই ওঠো। আজ দেখবে কী সুন্দর পোশাক পরে আমি সাজব। জ্যোৎস্না রাত। কী ভাল লাগে! তোমার ভাল লাগে না!

আকাঙ্খা শরীরে, কত রকমের উষ্ণতার খেলা শরীরে—কত ভাবে বনি যে ছোটবাবুর কাছে ধরা দিচ্ছে! যেন এই নিরুপায় সমুদ্রে বনি তার শরীরের উষ্ণতা দিয়ে ছোটবাবুর মধ্যে বেঁচে থাকার উত্তাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। মসৃণ নরম হাত, ঊরুর কোমল স্পর্শ, নাভিমূলে বর্ণময় দ্বীপ, যার মধ্যে ছোটবাবুর অমৃত অবগাহন। সব যখন মেলে দেয়, ছোটবাবু তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে। তছনছ করে ফেলে বনিকে। ছোটবাবু যা যা চায়, সে সব দিয়ে বলে, এবারে এস খাবে।

বনি আজও সেভাবে পাশে শুয়ে পড়ল। হাঁটু তুলে বলল, আমার আর কী থাকল ছোটবাবু। তুমি ভেঙে পড়লে আমি যাব কোথায়! তুমি কেন বললে না আগে, তুমি কেন গোপন করে গেলে? তুমি জানতে সব। আমি একা কী করব? তোমরা সবাই আমার সঙ্গে ছলনা করেছ। বাবা আমাদের বোটে ভাসিয়ে দিয়েছেন। ডাঙা যদি পাই, ভাসতে ভাসতে যদি ডাঙায় আমাদের বোট কোনোদিন পৌঁছে যায়—বাবা কাছে থাকলে এত ভয় থাকত না!

ছোটবাবু লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। বনি ভেঙে পড়লে সব গেল। সে বলল, আমারও মনে হয় জাহাজটা আমাদের দেখতে পায়নি।

কিন্তু সংশয় মনে, জাহাজটার কাছাকাছি যাবার যত চেষ্টা করেছে, দেখেছে দূরে আরও দূরে জাহাজ সরে যাচ্ছে। আবার মনে হয়েছে, এই তো সামনে, মাইলখানেকও হবে না—তবে সমুদ্রের দূরত্ব মাপা বড় কঠিন। মনে হয় খুব কাছে, কিন্তু গেলে বোঝা যায়, অনেক দূর, জাহাজটাকে মরীচিকা ভাবতে ছোটবাবুরও কষ্ট হয়। শয়তানের পাল্লায় পড়ে গিয়ে থাকে যদি। আর্চির প্রেতাত্মা জাহাজ হয়ে গিয়ে ছলনা করতে পারে। আর্চির প্রেতাত্মা তাদের অজানা সমুদ্রে একা পেয়ে কখন গলা টিপে ধরবে কে জানে! সে তবু বনির কাতর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, দাও।

বনি হুডের নিচে চলে গেল। দুটো প্লেট বের করে খোসাসুদ্ধু দুটো বড় আলু প্লেটে রাখল। একটু নুন গোলমরিচ ছড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও। বোট প্রচন্ড দুলছে।

বোট দুলছে বলে ছোটবাবু প্লেটটা দু-হাঁটুর ফাঁকে রেখে, একটা আস্ত আলু বনিকে দিল। খাও।

—আমি খেয়েছি।

–কখন?

–কেন এই মাত্র।

—মিছে কথা বনি! তুমি খাওনি।

বনির ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। –তোমাকে মিছে কথা বলব কেন! আচ্ছা ডাঙা পেলে আমরা উঠে কী করব প্রথম বলতো! আসলে বনি তার খাওয়ার বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চায়।

—কী করব?

—বোটটা বালিয়াড়িতে রেখে উঠে যাব। মিষ্টি জলের হ্রদ পেলে আমরা স্নান করব। গাছটাছ থাকবে কী বল! নারকেল গাছ!

—থাকার কথা।

—আর কিছু না থাক, নারকেল গাছ হলেই হবে। ডাঙায় কচ্ছপেরা ডিম পেড়ে রেখে যাবে। ডিম ভাজা—ওতেই যথেষ্ট। কী বল!

—তুমি খাবে কি না বল?

—কী যে কর না? দাও। তাই বলে একটা আস্ত আলু! তুমি খাবে কী? সারাটা দিন কী খাটুনী যায়! আমি অত খেতে পারব না। তুমি আমার পেছনে এত লেগে থাক কেন বল তো! বলছি, আমি খেয়েছি!

অতীশ মাথা নিচু করে বসে আছে। সত্যি তারা তিনজন মিলেই বনিকে ছলনা করেছে। বনিকে বোঝান হয়েছিল, ছোটবাবু বোট নিয়ে ডাঙার খোঁজে যাচ্ছে। বেশিদূর না। সে একা গেলে ভাল দেখায় না। তিন চারশ মাইলের মধ্যেই এলিস দ্বীপ। সেখানে মানুষজনদের খবর দিতে হবে—একটা জাহাজ অচল হয়ে পড়ে আছে সমুদ্রে। জাহাজ ভেসে আছে। বুড়ো কাপ্তান, সারেঙসাব আটকে পড়েছেন। তাদের উদ্ধার করে আনতে হবে।

বনিকে এমন না বোঝালে বাবাকে ছেড়ে আসত কিনা সংশয় ছিল। ছোটবাবু বলল, ছলনা না করে উপায় ছিল না বনি।

বনি কেমন মুখ ভার করে ফেলল। বলল, তুমি ছলনা করেছ বলেছি! তুমি ছাড়া আমার কে আছে! তুমি অজানা সমুদ্রে ভেসে যেতে পারবে, আমি পারব না ভাবলে কী করে! রাগের মাথায় কখন কী বলি, সেটা ধরে বসে আছ! বনির চোখ অভিমানে ছলছল করছে।

বনির চোখ অভিমানে ছলছল করতে থাকলে ছোটবাবু কেমন আরও ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। চারপাশে তাকায়। খড়কুটো অবলম্বনের মতো সমুদ্রের কোথাও এক টুকরো ডাঙার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। সামান্য ডাঙা, কোনো দ্বীপ-টিপ, হোক বালিয়াড়ি কিংবা শুধু কাঁটা ফণিমনসার গাছ নিয়ে একটা অতি ক্ষুদ্র কচ্ছপের পিঠের মতো দ্বীপ—যতই আবাসের অযোগ্য হোক—পাশে বনি থাকলে সে দ্বীপটাকে মানুষের আবাসযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হবে—বনি তার সাহস, প্রেরণা, বনি ছাড়া পৃথিবীতে তার জন্য আর কেউ অপেক্ষা করে আছে মনে করতে পারে না। সুদূরে কেউ লম্ফ জেলে রাত জাগতে পারে নিখোঁজ পুত্রের আশায়, এটাও সে মনে করতে পারত না। জীবন বিপন্ন, এবং শুধু সমুদ্রের বিভীষিকা ছাড়া চারপাশে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। সবচেয়ে ভয় শান্ত নিরীহ সমুদ্রের নিঃসঙ্গতা—কী সব আধিভৌতিক আবছা অন্ধকারে সমুদ্রের গভীর তলদেশ ডাইনির কালরহস্য নিয়ে জেগে থাকে। পালে হাওয়া থাকে না। নিথর সমুদ্রে বোট স্থির। মাঝে মাঝে দূরে অদূরে কোনো মনস্টার দাপিয়ে বেড়ালে ওরা দু’জনে কেমন ভূতগ্রস্ত হয়ে যায়। শুধু সেই দাপাদাপি দেখতে দেখতে মনে হয় সহস্ৰ অজগর একসঙ্গে জলের নিচে ফুঁসছে। ঝড়ের সমুদ্রে এ সব টের পাওয়া যায় না। পালে বাতাস এসে ধাক্কা মারে, বোট তখন দুরত্ত অশ্বের মতো বেগবান হয়ে যায়। দু’জনের মধ্যে হৈ-হল্লা, জলের ঝাপটা থেকে আত্মরক্ষার জন্য বোটের হুড তুলে দেওয়া হয়। ছইয়ের মতো কাজ করে। ঝড়ের দাপটে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে বোটের গায়, বড় সতর্কতায় ঢেউয়ের উপর দিয়ে বোট ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হয়—আসলে বিপাকে পড়ে লড়ে যাওয়ার মধ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা থাকে। সমুদ্র নিথর হয়ে গেলে তাও থাকে না। তখন যত রাজ্যের আতঙ্ক তাদের কাবু করে ফেলে। সে দেখতে পায় এক পুরুষ, দীর্ঘকায় হয়ে সমুদ্রের দূরে দাঁড়িয়ে বোট মাথায় করে এগুচ্ছে। সমুদ্রের জল ডিঙিয়ে মানুষটা কোথাও যেতে চায়—পাশে এক নারী হাতে পোঁটলা পুঁটলি, পুরুষকে অনুসরণ করছে।

আর তখনই কে ডাকছে।—বাবা ওঠো। ও বাবা!

জেঠিমার গলা পেল, সোনা ওঠ। কত বেলা হল!

অতীশ ধড়ফড় করে উঠে বসল। বিশ্বাসই করতে পারছে না, মিণ্টু ডাকছে! যেন সে সমুদ্রেই ভেসে যাচ্ছে। টেবিল ছেড়ে কখন শুয়েছে, আর ভোর রাতে বনিকে স্বপ্ন দেখছে, সেই বোট, সেই দড়িদড়া, সেই অ্যালবাট্রস পাখিটা—তার যেন আর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। বনির কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে তাড়াতাড়ি চটি গলিয়ে মশারির ভেতর থেকে বাইরে বের হয়ে বলল, কত বেলা হয়ে গেছে! বাথরুমে যাবার আগে এক কাপ চা খাবার অভ্যাস, এক গ্লাস জল। সে দেখছে জেঠিমা হাতে জলের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে।—মিণ্টুর নাকি স্কুল আছে!

অতীশ বুঝতে পারল, এতদিন চোখের পাতা এক করতে পারেনি। আজ সে ঘুমিয়েছে। ঘুমের গভীরে বনিকে সে কতদিন পর যেন খুব কাছাকাছি পেয়ে গেছিল। এখনও সে বিশ্বাস করতে পারছে না, এটা এক রাজবাড়ি, সে রাজবাড়ির এক লোকসানের কারখানার ম্যানেজার। টুটুল মিণ্টু তার সন্তান। নির্মলা তার স্ত্রী। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না জেঠিমা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবার চিঠি আসার কথা।

বনির চুলের গন্ধ পর্যন্ত সে যেন এখনও টের পাচ্ছে।

অতীশ বলল, মিণ্টু সেদ্ধ ভাত খেয়ে যাবে।

—তোর অফিস ক’টায়?

—নটায়।

অতীশ কথা বলছে আর দাঁত মাজছে। মিণ্টুকে বলল, তোর টাস্ক দেখি। মিণ্টু বাবার কাছে বইয়ের বাক্স এনে হাঁটু গেড়ে বসল। খাতা বের করছে—সেই বনির মতো মেয়ে ববকাট চুল—পেছন থেকে মিণ্টুকে বালিকা বনি ভাবতে এতটুকু কষ্ট হয় না। মেয়েরা পৃথিবীতে সব বুঝি একরকমের। সবুজ দ্বীপে সোনার হরিণ—গোটা জীবনটাই মরীচিকা এমন মনে হল মিণ্টুর খাতা দেখতে দেখতে। বলল, চারটে বানান দেখছি ভুল করেছ। দশবার করে লিখতে বলেছে। লিখে ফেল। আমি বাথরুম থেকে আসছি। জেঠিমাকে বলল, বাজার থেকে কী আনব?

অর্জুন গাছটা এখন কত বড় হয়েছে কে জানে!

জেঠিমা মশারির দড়ি খুলছিলেন। বললেন, বাজারে গন্ধপাঁদাল পাতা পাওয়া যায়?

—কলকাতায় সব পাওয়া যায়।

—শুনেছি, বাঘের দুধও নাকি পাওয়া যায়।

—যায় শুনেছি, তবে সেটা কোথায় পাওয়া যায় জানি না।

অতীশের মনে হল জেঠিমা বোধহয় বাঘের দুধও দেখতে চাইতে পারেন! জেঠিমার যে এ-শহর সম্পর্কে ভারি কৌতূহল আছে সেটা সে জানে। জেঠিমার শৈশব এ-শহরে কেটেছে। তিন চার যুগের আগের কথা। সেই শহরটা পাল্টে গেছে। তখন বাঘের দুধ পাওয়া যেত না। এখন তিনি শুনে এসেছেন তাও পাওয়া যায়। এই শহরে এসে বড় জ্যাঠামশাই যৌবনে পাগল হয়ে যান। অতীশ নিজেও ফোর্ট- উইলিয়মের পাশ দিয়ে একদিন বাবুঘাটের দিকে যাবার সময় ভেবেছিল, এই মাঠেই হয়ত জ্যাঠামশাই সেই এক ইংরেজ যুবতীকে নিয়ে কতদিন হেঁটে গেছেন। বসে গল্প করেছেন। কত বছর আগে কে জানে, তখন একই ভাবে এই শহরে বৃষ্টিপাত হয়েছে, শরতের হাওয়া বয়ে গেছে, শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে শহরটা রাতে ঘুমিয়ে থাকত। এখনও তাই। কিংবা উড়ত হাজার কিসিমের পাখি—চিড়িয়াখানায় জীবজন্তু এবং জাদুঘর, সব এক রকমের ছিল—শুধু জ্যাঠামশাই নিখোঁজ। এই শহর সম্পর্কে বাবারও কম আশংকা নয়। কারণ বাবা কী টের পান তাঁর বড়দা এই শহরে এসেই সংসার থেকে আলাদা মানুষ হয়ে গেলেন! বাড়ির কথা ভুলে গেছিলেন, সেই ইংরেজ যুবতীর খপ্পরে পড়ে তাঁর দাদার মস্তিষ্ক বিকৃতি, এই শহরের নামে বদনাম দিতে কেউ এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করে না। জেঠিমা কী একদিন বলে বসবেন, আমাকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাবি বাবা! আমি দেখতে চাই। গড়ের মাঠে আমাকে একদিন নিয়ে যাবি! গঙ্গার ধারে মাঠ। তিনিতো মাঝে মাঝে একেবারে সরল সোজা মানুষ হয়ে যেতেন। তোর বড়দা না হলে আমার পেটে আসে কী করে!

অতীশ দাঁত মাজছিল—কত রকমের ভাবনা সহসা এই মস্তিষ্কের কোষে কোষে খেলে যায়।

চারু আর এক বিড়ম্বনায় ফেলে গেছে।

সে জানতে চায় সত্যি চারু বলে, চারুহাসিনী সেই যুবতী এই কলকাতার কোথাও আছে কি না। না ঘোরের মধ্যে পড়ে সে এমন দেখেছে। চারুর সঙ্গে তার আসলে দেখাই হয়নি, চারু বলে সেই সুন্দর শ্যামলা দীর্ঘাঙ্গী যুবতী আর এক মরীচিকা নয় কে বলবে! কিন্তু বিভ্রম থেকে এমন হয় সে বিশ্বাস করবে কী করে! চারুর সঙ্গে সহবাসের স্মৃতি সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।

এই একটা পাপ বোধ তাকে নিরন্তর দগ্ধাচ্ছে। যেন সে এক ট্রেনে চড়ে স্টেশনের পর স্টেশন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এক একটা স্টেশন স্মৃতি হয়ে আছে তার। সেই গোপাট, অশ্বত্থ গাছ, ফতিমা, ঈশম দাদা, ফকির সাব, জোটন, জালালি সব এক একটা স্টেশনের বাসিন্দা। কে কোথায় আছে এখন সে জানে না। ফতিমা এখন যুবতী, একবার ইচ্ছে হয় সে ছুটে গিয়ে তার ফেলে আসা দেশ ঘুরে দেখে আসবে। তারপর মনে হয়, আসলে গাছপালা আর আগের মতো নেই–অর্জুন গাছটা কত বড় হয়েছে কে জানে! সেই লেখাটা পাগল জ্যাঠামশাইয়ের নামে সে একখানা চিঠি লিখে রেখে এসেছিল, “জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি। ইতি—সোনা।” বড় অক্ষরে গাছে খোদাই করে লিখে রেখে এসেছিল। জ্যাঠামশাইর যদি কোনোদিন বাড়ির কথা মনে হয়, যদি ফিরে আসেন, দেখবেন, ঘরবাড়ি কিচ্ছু নেই। বাড়ির মানুষজন হাওয়া। তিনি তখন ঠিক একা গাছের নিচে চুপচাপ রসে থাকবেন। ভাববেন, আসলে এটাই তাঁর সঠিক ঠিকানা ছিল কি না—না অন্য কোনো গ্রহে এসে উঠেছেন। যাতে জ্যাঠামশাই বুঝতে পারেন, সবাই হিন্দুস্থানে চলে গেছে, সেজন্য সে গাছের কান্ডে বড় বড় অক্ষরে লিখে রেখে এসেছিল। এখন নিজের ছেলেমানুষির কথা ভেবে ভারি হাসি পায়। অথচ সে-জীবনে, এর চেয়ে বড় সত্য তার কাছে আর কিছু ছিল না।

সে তাড়াতাড়ি জামা পাল্টে পাজামা পরে বলল, টুটুল, যাও খেলগে। দিদির সুটকেস হাঁটকাবে না। কী লিখেছিস!

মিণ্টু তক্তপোশের উপর বসে হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে লিখছে।—এই যে লিখছি! দেখতে পাচ্ছ না!

টুটুল উবু হয়ে দেখছে।

অতীশ ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হবার সময় বলল, আমি আসছি। ভাতটা বসিয়ে দিন জেঠিমা। জেঠিমা কত সকালে উঠেছেন, এখন সে টের পেল। এক হাতে ঘর-দোর ঝাঁট দিয়েছেন, মুছেছেন, রান্নাঘরটার লন্ডভন্ড অবস্থা আর নেই। সব কিছু কী ছিমছাম! শুধু একবার অতীশ ঘরে উঁকি দিলে বলেছিলেন, এখানে বাবা একটা তাক করিয়ে নিস। জিনিসপত্র রাখতে সুবিধা হবে। বিকেলে আমি কিন্তু বৌমাকে দেখতে যাব। নিয়ে যাস বাবা।

অতীশ বের হয়ে গেল জেঠিমার কথা শুনতে শুনতে।

সিঁড়ি থেকে নামতেই দেখল, দুমবার হন্তদন্ত হয়ে আসছে। তাকে দেখে আরও জোরে জোরে ছুটছে। কাছে এসে বলল, বউরাণীমা অফিস যাওয়ার আগে দেখা করে যেতে বললেন।

অতীশের দাঁড়াবার সময় নেই। এদিকটায় সকাল বেলা লোকজন থাকে না। কিছু ফুলের গাছ। রক্তকরবী গাছটার পাশ দিয়ে সে হেঁটে গেল। মেস বাড়ির সিঁড়িতে কুম্ভবাবু বসে দাঁতন করছে। তাকে দেখেই বলল, বৌদি কেমন আছে?

অতীশ আজ অনেকটা হাল্কা। জেঠিমা আসায় আরও হাল্কা। সে বলল, অফিস যেতে দেরি হবে। বউরাণী দেখা করে যেতে বললেন।

কুম্ভবাবুর সে উপরওয়ালা, কথাবার্তায় মনেই হবে না। বউরাণী দেখা করে যেতে বলেছেন কি বলেন নি সে জানেত চায়নি। সে অতীশবাবুর স্ত্রীর খবর জানতে চেয়েছে। এই একটা মজা আছে কুম্ভবাবুর অতীশকে নিয়ে। অতীশ যত বিপাকে পড়বে তত তার মজা। বউরাণী কাল হাসপাতালে গেছিলেন খরবটাও রাজবাড়িতে চাউর হয়ে গেছে। কুম্ভর বাবা কুমারবাহাদুরের বাবার আমলের আমলা। তার একটা এমনিতেই জোর আছে, কুম্ভ ভাবে। এই লোকটা এসে বাড়ির আদব কায়দা ভেঙে সব তছনছ করে দিচ্ছে। বউরাণীর আসকারাতে সব হচ্ছে। কুম্ভ দেখল, অতীশবাবু চলে যাচ্ছেন। বৌদি কেমন আছে প্রশ্নের কোনো জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করছেন না।

কুম্ভ এবার দৌড়ে গেল। এই লোকটাকে পাঁকে ফেলে দেবার সে যত চেষ্টা করছে তত জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। চারুকে সেই পাঠিয়েছিল। সে আর পিয়ারিলাল দু-নম্বরী মালের সাপ্লাই আবার চালু করার জন্য পিয়ারিলালের ভাইঝি সাজিয়ে ট্রেনের ফার্স্টক্লাস কামরায় তুলে দিয়েছিল। কোথায় ভেবেছিল, চারুকে আর বাবুকে নিয়ে গোপন একটা কেচ্ছা গড়ে তুলবে, এখন সেই বাবুই তাকে বলছে, চারু বলে কাউকে চেনেন! রাতের ট্রেনে তুলে দেবার সময় কুম্ভ সঙ্গে ছিল না। সে পিয়ারিলালকে বলেছিল, যে দেবতা যাতে তুষ্ট। বৌটা অসুস্থ, তাগড়া জোয়ান, বৌ অসুস্থ থাকলে মেজাজ ঠিক থাকবে কেন! তোমার পাউডার কারখানার চারুকে দেখ ধরিয়ে দিতে পার কি না। তুমি তো বলো চারু তোমার অসাধ্যসাধন করতে পারে।

কুম্ভও বিশ্বাস করে, চারু অসাধ্যসাধন করতে পারে। বেশ্যা মেয়েরা পারে না হেন কাজ নেই। কিন্তু সেই চারু এখন কিছু বলছে না। রাতের ট্রেনে কামরা খালি—বাবুটি কিছু করেনি বিশ্বাস করতে পারে না। এদিকে দেশ থেকে ফিরেই চারু চারু করে মাথা খারাপ। এ-ক’দিন হাসপাতাল আর বাড়ি করতে হয়েছে বলে, চারুর কথা মনে পড়েনি। কিন্তু কাবুলকে বলেছে, চারু বলে কাউকে চেনেন? কাবুল কুমারবাহাদুরের মামাতো ভাই, বউরাণীর দোসর, দোসর রাজার কাছের লোক, সেই তবে বউরাণীর কানে তুলে দেবে। সে-জন্য কুম্ভ আর দেরি করেনি।

কাবুল এই রাজবাড়িতে তার সঙ্গে বড় হয়েছে, একসঙ্গে মাঠে খেলেছে, গোবর্ধনের মেয়েটাকে বাগানে ফেলে রাতে দু’জনে ভাগাভাগি করে দেখেছে, দু’জনের এত ভাব, এবং এই ভাবটার উপর ভরসা করেই কুম্ভ কাবুলকে, বলেছে, কী বিড়ম্বনা মাইরি, ছুটি কাটিয়ে বাবু ফিরে এলেন, সঙ্গে নিয়ে এলেন আর এক বাই—চারুকে চিনি কি না! আমি চারুকে চিনব কেন! কোন চারু, কে চারু—কিন্তু এক কথা, সারিগাছিতে চারু ভোর রাতে হারিয়ে গেল। বাথরুমে যাবে বলে গেল, সারিগাছি স্টেশনে দেখে চারু নেই। পিয়ারিলালকে ফোন করেছিল, ভাগ্যিস পায়নি। বার বার এক কথা, চারু ঠিকমতো পৌঁছেছে? ওর তো বহরমপুরে বাবার কাছে যাবার কথা!

কুম্ভ বলল, দাদা, আমরা না হয় আপনার কেউ না। তবে মানুষ তো। বৌদি কেমন আছে বললেন না?

—ভাল আছে। আজ ভাত পথ্য দেবে।

কুম্ভর মুখ থেকে শালা কথাটা বের হয়ে যাচ্ছিল। বেজন্মার বাচ্চা, তাই এত অবহেলা। বিপদ কেটে গেছে। সে বলল, কাল একবার দেখতে যাব ভাবলাম, হয়ে উঠল না। বৌদি কি না ভাবছে! অতীশ মনে মনে হাসল। বৌদির জন্য প্রাণ কাঁদছে! তবে অতীশ দেখেছে, নির্মলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যাপারে কুম্ভবাবুই সবচাইতে বেশি ছোটাছুটি করেছে। কাবুলকে দিয়ে গাড়ি বের করিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে।

সে তাড়াতাড়ি বাজার সেরে ফিরে এল। মিণ্টুকে স্কুলে দিয়ে এল। অফিস যাবার মুখে জেঠিমাকে বলল, দরজায় তালা দিয়ে দিন। টুটুলের পুকুরে যাবার বড় বাই। ঘাটালায় দাঁড়িয়ে সিঁড়ির জলে উবু হয়ে বেলে মাছ খোঁজে। দু-দিন ধরে দিয়ে গেছে সুখী।

টুটুলের সঙ্গে জেঠিমার ভাব হয়ে গেছে। সে বাজার থেকে ফিরে এসে দেখেছিল, জেঠিমা টুটুলকে কোলে নিয়ে সব হাতের কাজকর্ম সারছেন।

অতীশ বলেছিল, ধেড়ে খোকা, কোলে, কী লজ্জা কী লজ্জা!

টুটুল জেঠিমার আরও সংলগ্ন হয়ে তখন মিশে যেতে চেয়েছিল।

অতীশ বুঝতে পারে, টুটুলের মা তার কাছে আসার পরই বুঝেছে সত্যি জলে পড়ে গেছে। একটা ভাঙা ঝরঝরে কারখানার ম্যানেজার, মাইনেও তেমনি, কুমারবাহাদুরের মর্জির উপর চাকরি থাকা না থাকা, এ-সব ভাবনা তাকে পেয়ে বসেছে। বাপের বাড়ি গেলে নির্মলা এটা আরও বেশি টের পায়! বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এলে, অতীশ দেখেছে, নির্মলার মুখ ব্যাজার। ভিতরে তার অতীব এক নিরাপত্তার অভাব—এই অভাববোধ থেকেই ক্রমে সে কেমন যেন ক্ষীণকায় হয়ে গেল। কাজে কর্মে উৎসাহ পায় না। সংসারটা তার কাছে ভারবাহী জন্তুর মতো। টুটুল মিণ্টুর আদর যত্নের বড় অভাব। জেঠিমার কোলে টুটুলকে দেখে অতীশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাইরে বের হয়ে সোজা সে চলে গেল রাজবাড়ির অফিসে। আটটায় বউরাণী নামেন। অফিস সুপারিনটেনডেন্ট, প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে ঘন্টাখানেক বউরাণীর রোজ সকালেই কী কাজ থাকে জানে না! তারপর একে একে অন্য আমলাদের ডাক পাড়ে। বউরাণীর খাস বেয়ারা হস্তদন্ত হয়ে আসছে যাচ্ছে। শঙ্খকে সে বলে রেখেছে, খবর দিও আমি আছি।

শঙ্খের এক কথা, একটু বসতে বলেছেন বউরাণীমা।

অতীশকে পার হয়েই আমলাদের বউরাণীর ঘরে যেতে হচ্ছে। ওকে দেখে সবারই এক প্রশ্ন, বৌমা এখন কেমন! এই একটা প্রশ্নের জবাব ক’দিন থেকে হাজার বার দিতে হচ্ছে। আজ যেন একটু বেশি। বিশেষ করে বউরাণী গতকাল স্বয়ং নিজে দেখতে যাওয়ায় এ-বাড়িতে খরবটা আরও যেন বেশি গুরুত্ব পেয়ে গেছে।

এখানে আসার পরই সে লক্ষ্য করেছে, সবাই তার খোঁজখবর নেবার জন্য ব্যস্ত। সে বুঝতে পারে বউরাণীর সে পেয়ারের লোক বলেই এটা হয়—এখন এই ঘরটায়, ঘর বলা ঠিক কি না বুঝতে পারে না—কারণ প্রাসাদের বিশাল বারান্দা থেকে এ-ঘরের দূরত্ব যেন যোজন প্রমাণ। বিশাল হলঘরের মতো বসার ঘর, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর, একদিকে পার্টিসান করা অফিস, রাজার স্থাবর সম্পত্তি কত কুমারবাহাদুর নিজেও হয়তো ভাল জানেন না। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিনকে দিন যা দাঁড়াচ্ছে তাতে এত সম্পত্তি রাখা দুষ্কর। এমনিতেই কুমারদহের বড় বড় আমবাগান সব জবর দখল হয়ে যাচ্ছে। কোর্ট কাছারি করার আলাদা দপ্তর। সদরে, এবং এমন কি এই শহরে আদালতে অসংখ্য মামলা। লিজ নিয়ে মামলা, বাড়ি ভাড়া নিয়ে মামলা, একটা দপ্তর আছে যাদের কাজই হল ভাড়া তোলা—আর মামলার তদারকি করা। পুরো খালাসি বাগান বস্তিটা রাজার—টেনেন্সি রাইট—আইন কানুন বছর বছর পাল্টে যাচ্ছে—বউরাণীকে একা সব সামলাতে হয়। কুমারবাহাদুর বছরের কিছুটা সময় বিদেশে কাটান। একটু হাত খালি না হলে তাকে ডাকতে পারছে না। কেন এই তলব সে বুঝতে পারছে না। নতুন শেয়ার ফ্লোট করা হবে, কিন্তু এ-সব ব্যাপারে যদি তাকে ডাকত, সঙ্গে কুম্ভবাবুকেও আসতে বলত। কুম্ভবাবু কারখানার পুরানো লোক—এ-সব বিষয়ে তার মাথা বেশি পরিষ্কার। কেন যে তলব সে বুঝতে পারছে না।

বিলিয়ার্ড স্টিকগুলো এক কোণায় জমা। ছোট বড়, অনেক কিসিমের স্টিক। সবই আছে। অথচ এই ঘরে কখনও কাউকে খেলায় অংশ নিতে দেখেনি। শুধু স্টিকগুলি গোল রিঙের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কোনো চিত্রকরের মতো।

আসলে স্মৃতি ধরে রাখা। রাজকীয় বনেদিয়ানা যতটা পারা যায় একটা শক্ত পাথরের মতো পাহাড়ের উপরে তুলে নিয়ে যাওয়া। ওটা যে গড়াতে পারে এরা বিশ্বাস করতে চায় না। কিংবা বিশ্বাস করলেও থাবড়া মেরে আটকে রাখার মতো। ঝাড়লণ্ঠন, আর সেই সুঘ্রাণ আগেকার মতোই আছে। বিলিয়ার্ড টেবিলের পাশে উঁচুমতো আসনটায় অতীশ যেন এখন আর এক কাঙাল রাজা। সে বসে আছে, তার ডাক কখন পড়বে বুঝতে পারছে না!

—বাবু, যান।

শঙ্খ এই একটা কথা বলেই ভিতরের বিশাল পর্দা ঠেলে কোথায় হারিয়ে গেল।

শঙ্খ কি উপরে চলে গেল!

সে বিলিয়ার্ড টেবিলটা পার হয়ে পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল। অন্দরের দিকের বসার ঘর পার হয়ে বউরাণীর দপ্তরে ঢুকে গেল। এবং দেখল বউরাণী সোজা উপরের দিকে তাকিয়ে কী দেখছে!

সে গলা খাঁকারি দিল।

চোখ নামালো না।

লাল পেড়ে দামি সিল্ক শাড়ী পরনে। লেভেন্ডার জাতীয় কোনো সুঘ্রাণ সারা ঘরে। ঘোড়ার ক্ষুরের মতো বিশাল টেবিলের ভিতর রিভলবিং চেয়ার। পাশে সব বিশাল দেয়াল আলমারি এবং ভেতরে সোনার জলে বাঁধানো ইংরাজি সব ক্লাসিকস। দেখলে মনে হবে সেই ক্লাসিকসের কোনো নায়িকা ঠেলে বের হয়ে এসেছে এবং এই সামনের চেয়ারটায় বসে আছে। বব করা চুল, নাকে হীরের নাকছাবি থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে। কানে দুটো দামী পাথর সেট টপ। হাতে সোনার কাজ করা হাতির দাঁতের বালা। হাতের রঙের সঙ্গে এমন মিশে গেছে যে নগ্ন হাত মনে হয় টেবিলটায় ছড়ানো।

অতীশ জানে অমলার মেজাজ সব সময় এক রকমের থাকে না। কখনও এমন ব্যবহার যে অমলা মনে করিয়ে দেয়, এ বাড়ির বউরাণীমা। তখন একটা এমন দূরত্ব সৃষ্টি হয় যে সহজে আর সে তার স্বাভাবিক আত্মপ্রকাশ রক্ষা করতে পারে না। কুণ্ঠিত চিত্তে কথাবার্তা, যেন তখন অতীশ পালাতে পারলে বাঁচে।

—তুমি ডেকেছ!

—অঃ তুই, বোস।

—না আর পারা যাবে না! শঙ্খ শঙ্খ! অতীশ ঠিক বুঝতে পারছে না কাকে লক্ষ্য করে বলা। শঙ্খ সিঁড়ি ধরে দৌড়ে নেমে আসছে।

এত উত্তেজিত যে কলিংবেল টিপতেও ভুলে গেছে অমলা।

শঙ্খ এলে বলল, দেখছিস উপরে! পোকা।

অতীশ লক্ষ্য করল সত্যি বড় একটা পোকা কোথা থেকে উড়ে এসে বসো

উঁচু সিলিং। শঙ্খ পড়ি মরি করে কী আনতে ছুটে গেল। পোকাটা বউরাণীর খাস দপ্তরে কী করে ঢুকে গেল এই নিয়ে এখন মাথা গরম। কাচের জানালা দিয়ে অন্দরমহলের শৌখিন বাগান দেখা যায়। সেখানে দেশী, বিদেশী সব ফুলের গাছ। দুটো ম্যাগনোলিয়া ফুলের গাছও আছে। লতানে গোলাপ এবং উঁচু পাঁচিল দিয়ে এই মহলটাকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। বিশাল সব শ্বেতপাথরের নগ্ন নারীমুর্তি বাগানে এবং তার নিচে বেদির মতো বসার জায়গা। পোকাটা তাড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত অমলা তার দিকে তাকাল না। বড় পোকার ভয়। পোকায় কাটছে, পোকার কামড়ে অস্থির যেন। সে যে সামনে বসে আছে অমলার ব্যবহারে তার বিন্দু মাত্র প্রকাশ নেই।

—অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

—যাক। বসতে বলেছি, বসবি।

আর কিছু বলার থাকে না। শঙ্খ বের হয়ে গেলে আচমকা বউরাণী তাকে দেখল। দেখেই যাচ্ছে। চোখ হিংস্র দেখাচ্ছে।

অতীশ ভয় পেয়ে গেল। এ অমলাকে যেন চেনে না! তার ভিতরে যেন চোখের দৃষ্টি এখন ফণা তুলে আছে।

—চারু কে! বল চারু কে?

সে আমতা আমতা করে বলল, চারু বুঝলে, এই মানে…

—মানে বুঝি না! চারু চারু করে লোকের মাথা খাচ্ছিস! মাথায় তোর কত রকমের পোকা আছে বল! তুই ভাবিস কী! তোর কী মনে হয়! এখানে কাজ করতে আসিসনি! মাথায় এত পোকা ছিল তো এখানে মরতে এলি কেন? কে বলেছিল? কথা নেই বার্তা নেই সারা ঘরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকিস, পচা টাকার গন্ধ পাস—এ-সব কী? আমি এত কথা শুনব! আমার দায় পড়েছে! তুই আমার কে? মানস আর তুই দেখছি এক গোত্রের! তোর দুটো বাচ্চা, বউ হাসপাতালে, তোর বাবা মার সংসার আছে—সবাইকে টেনে তুলতে গেলে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকলে হয়! এখন আবার এক চারু!

অতীশ কথা বলছে না, সে গম্ভীর হয়ে গেছে। সে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকে, পচা টাকার গন্ধ পায়, আর্চির প্রেতাত্মা তাড়া করে সব ঠিক, এখন নতুন উপদ্রব চারু। সে নিজেও ভেবে পায় না এ-সবের হাত থেকে কী করে রক্ষা পাওয়া যায়। টুটুল মিণ্টুর দিকে তাকালে, মা-বাবা ভাইবোনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবতে গেলে, মগজ সাফ না রাখলে চলে না।

অমলা ক্ষোভে যেন জ্বলছে। অতীশ সম্পর্কে কোনো অভিযোগ এলেই সে অস্থির হয়ে ওঠে। কাল রাতে খাবার টেবিলেই কাবুল বলেছে, কিছু হবার নয় বৌদি। কারখানাটা একটা খ্যাপার হাতে শেষ পর্যন্ত তুলে দিলে! তোমার দ্যাশের পোলা এখন চারুর নামে পাগল

—বল চারু কে! এই মেনিমুখো বসে আছিস কেন? বাইরে জানাজানি হলে এতে তোর সুনাম বাড়ে! কীরে চুপ করে আছিস কেন? কুম্ভকে বলেছিস, চারুকে চেনেন? কুম্ভর বৌকে বলেছিস, চারুকে তুমি চেন? শুনলে ভাববে কী!

অতীশ বলল, চারু যে আমার সঙ্গে গেল।

—কোথায়?

—টেনে একসঙ্গে।

—চারু তোর কে হয়?

—কেউ না, পিয়ারিলালের ভাইঝি।

—পিয়ারিলালটা কে!

—আমাদের দু-নম্বরী মালের কাস্টমার।

—মানে যার মাল নিয়ে লড়ে যাচ্ছিস, দু-নম্বরী মাল দিবি না বলে, যার মাল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিস?

—হ্যাঁ সেই লোকটা!

অমলা সহসা আলতো করে ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। সে কোনো থৈ না পেলে এটা করে। এতে তার মুখে যে চাপা আগুনের ফুলকি থাকে অমলা টের পায় না। অতীশ ঠিক টের পায়। সে অমলার মুখের দিকে তাকিয়ে শঙ্কা বোধ করে। নিজের উপর সে ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছে। তার পাপ বোধ প্রখর। জাহাজের বুড়ো কাপ্তান স্যালি হিগিনস, শৈশবের ঈশম দাদা তাকে যে কখন কীভাবে সংসারের শুভ অশুভ বুঝতে শিখিয়ে গেছে। এখন বাবা, বাবা কেন যে বললেন, শেকড় আলগা হতে দিও না। জীবনে সার জল দরকার। জীবন বৃক্ষের মতো। সে ছায়া দেয়, তাতে পাখিরা বাসা বানায়, গাছ নিজের জন্য কিছু করে না। শুধু বেঁচে থাকার জন্য মাটি থেকে রস শোষণ করে। তোমার কোনো মতিভ্রম হয়েছে টের পাচ্ছি। এতে শিকড় আলগা হতে পারে। সামান্য ঝড়ে মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। টুটুল মিণ্টু, নির্মলা আমাদের সবাইকে ধারণ করাই তোমার কাজ।

সে জানে বাবা মাঝে মাঝে অনেক দূরের ছবি দেখতে পান। বাবার কাছে প্রতিবেশীরাই শুধু খবর নিতে আসে না, দূর থেকেও মানুষজন আসে—যাও ঠাকুরকর্তার কাছে যাও, উনি কী বলেন, দ্যাখ। তাদের সরল বিশ্বাস—এসে বাবার পায়ের কাছে বসে থাকে—জামাই তো কর্তা চাকরিস্থলে গেল। চিঠি নাই। কি করি কন তো! দ্যাখেন চোখ বুজে কী ব্যাপার!

বাবা কী ব্যাপার বোঝে কে জানে, মাঝে মাঝে অতীশ শুনেছে, বাবা বলেছেন, মন বসাতে পারছি না। কাল খুব সকালে আয়। মনে তখন আধিব্যাধি থাকে না, দেখি মন বসে কি না। বাবা চোখ বুজলে তখন এক অদৃশ্য জগৎ নাকি দেখতে পান। সেখানে মানুষজনের আলাদা পরিচয়। ভিতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, মনের সঙ্গে দৈবের—এবং বাবাও দেখে ফেলেন যেন সব। বাবা এত টের পান, সে যে নির্মলাকে নিয়ে বিপাকে আছে টের পাচ্ছেন না! চিঠির জবাবও নেই। কেউ এল না পর্যন্ত! ভাগ্যিস জেঠিমা এসে গেলেন। বড়দাকে একটা চিঠি দিতে হবে, জেঠিমা আমার বাসায় এসে উঠেছেন। চিন্তা করবেন না।

এমন এক আশ্চর্য নারীর সঙ্গে বসে থাকতেও ভয় অতীশের—মুহূর্তের মধ্যে সে যদি কিছু একটা করে ফেলে। ফেলতেই পারে—এই অমলা পাশের দরজা খুলে যদি বলে আয়—এই আশঙ্কার চেয়ে প্রবল, সে কোনো অসতর্ক মুহূর্তে কিছু না করে ফেলে! চারুর বেলায় যা ঘটেছে এটা জীবনে ফের ঘটুক চায় না। যেন এটা ফের ঘটলে সে তার সাহস হারিয়ে ফেলবে। টুটুল মিণ্টু নির্মলা সবাইকে প্রতারণা করবে।

খানিকক্ষণ কেটে গেছে। অমলা কথা বলছে না! কাকে ফোন করল। ফোনে ধরতে পারছে না। দু-তিনবার ডায়াল করে ছেড়ে দিল। বিরক্ত মুখে বলল, সেই মেয়েটার সঙ্গে তোর কোথায় দেখা

—স্টেশনে। যেদিন রাতের ট্রেনে বাড়ি গেলাম…।

–ক’টার ট্রেনে গেছিলি?

—দশটার টেনে। সকালে পৌঁছায় টেনটা।

—পিয়ারি নিজে গেল, না আগে থেকে কথা ছিল তোর সঙ্গে যাবে?

—কোনো কথা ছিল না।

—তবে?

—স্টেশনে এনকোয়ারির সামনে গিয়ে দেখি পিয়ারি দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলল, আপ! কাঁহা যায়গা! বললাম, বাড়ি যাচ্ছি। সে তখন হাইমাই করে বলল, বহুত মুসিব্বত বাবুজী, এ মেরা ভাতিজী, আপ কো সাথ চল যায়েগা। দুটো টিকিটও দিল ফার্স্ট ক্লাসের। বলল, স্টেশনে, কে খবর দিয়ে গেল, ওর শ্বশুর হাসপাতালে, আর কী সব বলল, আমার ঠিক মনে নেই।

অমলা সহসা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ও বলল, আর তুই ধিং ধিং করে নাচতে থাকলি। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে উঠে পড়লি! তুই কীরে!

—উঠে পড়েছি তো কী হয়েছে!

—কিচ্ছু হয়নি। যা। ওঠ। ভাগ বলছি। পাজি নচ্ছার। তুই মরবি। বললাম মরবি।

অতীশ অবাক হয়ে গেল, সবটা না শুনেই অমলা এত ক্ষেপে গেল কেন! সে বলল, পরে কী হল জান?

—গেট আউট।

অতীশ উঠল না।

—আই সে গেট আউট।

অতীশ তবু উঠল না। তার কারণ অতীশের মাথায় বীজবীজ করছে অন্য পোকা। তার মাথা ভারি হয়ে আছে কাল থেকে। হাসপাতালের কেবিন ভাড়া, আয়ার খরচ—ক’দিন থাকতে হবে কে জানে! দু’জন আয়া, রাতে একজন, দিনে একজন, মোট ষোল টাকা রোজ। ষোল টাকা রোজ সে নিজেও রোজগার করতে পারে না। কোম্পানির ক্যাশ তার কাছে থাকে। অলিখিতভাবে সে কারখানার ক্যাশিয়ারও। লোহার সিন্দুকের চাবিটা যে কী অস্বাভাবিক ত্রাসের মধ্যে তাকে রাখে! রাস্তায়, কফি- হাউসে, বাড়িতে, সহসা ধক করে ওঠে বুকটা—এইরে আসার সময় লক করা ছিল তো, কতবার যে সংশয় বশে অসময়ে ছুটে গেছে কারখানায়! দারোয়ানকে দিয়ে অফিসের দরজা খুলিয়ে টেনেটুনে দেখেছে—প্রথম প্রথম আচমকা গেলে ওরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেত, এখন তারা সব বুঝে ফেলেছে বোধ হয়। গেলেই বোঝে, ম্যানেজারবাবু কিছু ভুলে ফেলে গেছেন।

অতীশ উঠছে না দেখে হতাশ হয়ে অমলা বসে পড়েছে। কেউ আর কথা বলছে না। এত জোরে চেঁচামেচি, কেউ ছুটে আসতে পারে—কিন্তু অতীশ দেখল, কেউ দরজায় উঁকি দেয়নি। শঙ্খ অদ্ভুত আসতে পারত। কিন্তু সেও কেমন বে-পাত্তা। গোপন সলা-পরামর্শ চলার সময় সে দেখেছে, বাইরে লাল আলো জ্বলে। এখনকি অমলা বাইরে লাল আলো জ্বালিয়ে রেখেছে! অমলা কি জানে, তার চেঁচামেচি কেউ শুনতে পাবে না! অথবা শুনলেও ছুটে আসার সাহস হবে না। লাল আলোটা খুবই মারাত্মক। অমলা লাল আলোটা নিজের শরীরেও জ্বালিয়ে রেখেছে। সেই কবে থেকে যেন এক লাল আলোর সংকেত শরীরে—কখন যেন নীল অথবা সবুজ হয়ে যাবে, লাইন ক্লিয়ার করে দেবে, আর বলবে, এই দ্যাখ, আমি এখন এই। আমি হাত পা নাভীমূলে সর্বত্র ফুটে উঠেছি—ফুল ফোটার মতো। আমি কবে থেকে নারী হয়ে গেছি—লাইন ক্লিয়ার। আমি সুস্তনী, সুনিতম্বিনী, সুকেশী, একবার হাত দিয়ে দেখবি না!

অমলা তার দিকে তাকিয়েই আছে। চোখ জ্বলছে। অথচ অতীশ বিন্দমাত্র বিচলিত নয়। সে মাথা নীচু করে বসে আছে।

অতীশ বলল, অমলা! আমার কিছু টাকার দরকার।

—আমি তার কী করব?

—কিছু ধার নেব ভাবছি। তোমাকে বলে রাখছি। আসলে অতীশ যদি কোথাও ব্যবস্থা না করতে পারে তার জন্য বলে রাখা। তার মাথার উপর আরও একজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অনুমতি তার কাছেও নিতে হবে। তবে তার মেজাজ ঠিক না থাকলে, তিনি হয়তো দায়িত্বটা নিজের কাঁধে রাখবেন না—বউরাণীকে বলে অনুমতি নেবেন কিংবা না বলেই হয়তো বলবেন, তুমি ধার নিলে সবাই নিতে চাইবে। বরং তুমি বউরাণীর পার্সোনাল একাউন্ট থেকে নাও। তিনি দিতে পারেন। তোমার সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ আছে।

কটাক্ষ কিংবা খোঁচা তার নবীন বয়সকে। যুবকদের প্রতি প্রৌঢ়দের যেমন চিন্তা-ভাবনা করার অভ্যাস। অতীশের লাগে—এতে কোথায় যেন বউরাণীকে খাটো করা হয়। সে নিজে খাটো হলে লাগে না, কিন্তু বউরাণীকে কেউ খাটো করলে তার বড় লাগে। কুম্ভবাবুর তো মুখ আলগা। আড়ালে সে এই বউরাণীকে নিয়ে কত কথা বলে, তার সামনে বলতেও দ্বিধা করে না। রাজার এস্টেট ছারখার করে দিল, সব যাচ্ছে, যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে। রাজার ঘরে কালসাপ ঢুকে গেছে।

সে উঠতে যাচ্ছিল।

বউরাণী কী খচখচ করে লিখছে প্যাডে। প্যাড থেকে মুখ তুলে বলল, চারু পিয়ারিলালের ভাইঝি, না?

—হ্যাঁ।

—চারু এখন কোথায় জানিস না?

—না।

—না জানলে ক্ষতি কি তোর?

অতীশ কেমন ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। সে বলল, আরে বুঝছ না তুমি, একটা মেয়ে জলজ্যান্ত উধাও হয়ে গেল, তার খোঁজ নিতে হয় না!

—কার কাছ থেকে উধাও হয়ে গেল?

—আমার কাছ থেকে।

—পুলিশে খবর দিলি না কেন?

—খেয়াল হয়নি। ভাবলাম, ওর চাকরের খোঁজে গেছে।

—সঙ্গে তবে নোকরভি ছিল? অমলার গলায় বিদ্ৰূপ।

অমলার ঠোঁটে বিদ্রুপের ছটা। ঠোঁট উল্টে বলল, নোকর থাকতে তোর মতো বেল্লিকের হাতে তুলে দিল! চিন্তার কথা!

—খুব!

—আর কিছু হয়নি?

সঙ্গে সঙ্গে অতীশের মুখটা কালো হয়ে গেল। যেন পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে অতীশ।

অমলা দেখল অতীশ আর চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। কী যেন ভাবছে!

—কী হল তোর? এই নে। বলে একটা চিরকুট ওর হাতে দিল। শেষে বলল, আমাকে তোর ভয় বুঝি। জোরজার করব না। চাকর বাকরের মতো থাকতে চাস তাই থাকবি। তোকে দিয়ে কিছু হবে না, বুঝে ফেলেছি। ভয় পাস না। তোর আমি অনিষ্ট করব না। নে ধর।

—নধরবাবুকে দিবি।

—অতীশ চিরকুটটা হাতে নিল। দেখল।

—দেখলে তো মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানিস না, ভেতরে তুই কত শয়তান আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

অতীশ তবু কোনো কথা বলল না।

অমলা অতীশের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এই! এই অতীশ।

–হুঁ।

—শুনতে পাচ্ছিস? আমি অমলা বলছি।

সুদূর থেকে কেউ ডাকছে, বনি অথবা অমলা কিংবা জীবনের চারপাশে যে সব বালিকারা একসঙ্গে বড় হয়েছে, সবাই যেন, এই মুহূর্তে অমলার মধ্যে এসে আশ্রয় নিয়েছে। সে কেমন ঘোরে পড়ে যাচ্ছিল। আমি অমলা বলে তার সাড়া পাবার চেষ্টা করছে।

অতীশ কেমন বালকের মতো হয়ে গেল। বলল, জান অমলা, পিয়ারিলাল বলছে, তার কোনো ভাইঝি নেই। বলছে, সে সে-দিন স্টেশনে যায়ইনি। তবে বল কে গেল! কে পিয়ারিলাল হয়ে আমার কাছে এসেছিল, কে চারু হয়ে আমার কাছে এসেছিল! আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না অমলা। আমি কি তবে ঘোরে পড়ে যাই! আমি কি সত্যি কোনো অশুভ প্রভাবে পড়ে যাই! আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি আমাকে আর যাই ভাব, আমি শয়তান নই!

অতীশ মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল আর কী—শয়তান হল আর্চি। সে আমাকে এখনও তাড়া করছে। শয়তান আমার হাতে খুন হয়েছে। এই একটা আমার কঠিন অসুখ। শয়তানকে কোন অসতর্ক মুহূর্তে খুন করে ফেলি আমি, নিজেও টের পাই না। আমি জানি না কখন তাকে কোন ঘোরে পড়ে খুন করেছি। অতীশের এমন অকপট স্বীকারোক্তিতে অমলা ভারি বিভ্রমে পড়ে গেল। বলল, তুই দেখেছিস, পিয়ারিলাল!

—বারে দেখব না!

—অন্য কউে নয় তো?

—হতে পারে।

—হতে পারে মানে?

অমলা এবার নিজেই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। এ কীরে বাবা, বলছিস পিয়ারিলাল, আবার বলছিস, হতে পারে! সে বুঝতে না পেরে বলল, পিয়ারিলাল কি ভূত!

—হতে পারে।

আরে এও দেখছি জ্বালা, বলছে কি না ভূত! অমলা কী বলবে আর ভেবে পাচ্ছে না। বলল, তোর মাথায় ভূত আছে। ভূতটাকে তাড়া। না তাড়ালে তুই বিপদে পড়বি। তুই মরবি। তোকে চারু সারাজীবন তাড়া করবে। মাথা থেকে ভূতটাকে নামিয়ে ফেল।

অতীশ বলল, চেষ্টা তো করছি। পারছি না।

সত্যি আর পারা যায় না! অমলা হাতের ঘড়ি দেখে বুঝল, প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে কখন! কত কাজ বাকি! অফিসে অনেকে বসে আছে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য। সবাই তার এস্টেটের আমলা। কুমারদহ থেকে দু’জন বাড়ির দালাল আসার কথা। শহরের সর্বত্র বিশাল বিশাল বাড়ি সব পরিত্যক্ত এখন। বাদুর চামচিকের বাসা। মেরামত করার সামর্থ্য থাকলেও সে-সব বাড়িতে হাত লাগানো হচ্ছে না! কে খাবে! নিজের বলতে কেউ নেই। এর পর বংশটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। রাজেনের চেষ্টার ত্রুটি নেই। কিন্তু রক্তে বিষ মিশে গেছে। কার রক্ত, রাজার না অন্য কারুর। অমলা আজ কেন জানি ভাবল, কোন এক প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই সব মানুষকেই ভূত তাড়া করছে। না হলে সে ছিল মানসের প্রেমিকা, চেহারার সঙ্গে কিঙ্করনারায়ণের আশ্চর্য মিল। রাজেনের সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পায় না। সেই সন্দেহ বাতিকটা তাকে রাত হলে মহলের পর মহল ভূতের মতো ঘুরিয়ে মারে। রাজেনের কজ্বায় সে চলে এসেছে আসলে সেই ভূতটার দাপটে। ভূতটার নাম বৈভব।

মানসের মাথাতেও ভূত চাপে। মাঝে মাঝে সে পাগল হয়ে যায়। প্রায় গৃহবন্দী সে। কে আসল কে নকল এটাই বুঝতে পারছে না অমলা। বৈভবের মোহে সে নিজেও রাজেনের কাছে বন্দী। কেমন নিজের মধ্যেই একটা পাগলা ঘোড়া এখন ছোটাছুটি করছে। অমলার বেশবাস সামান্য আলগা হয়ে গেছে, শাড়ি খসে পড়েছিল। আঁচল দিয়ে শরীর ভাল করে ঢেকে বলল, তুই যা এবার!

অতীশ উঠে পড়ার সময় বলল, কিছু টাকা পাবার কথা আছে। একজন নতুন প্রকাশকের আমার বই করার কথা। টাকাটা পেলেই তোমাকে দিয়ে যাব।

—কিসের টাকা।

—এই যে ধার দিলে।

—ধার আমি কাউকে দিই না।

–কী দাও?

—এমনি দিই। ভালবাসলে দিতে হয়। এ তো সামান্য কটা টাকা

—আমি নিতে পারছি না।

—কেন?

—ভিক্ষে দিতে চাও?

–ভিক্ষে ভাবছিস কেন?

—তবে কী?

—আমি তোকে দিতে পারি না!

—না! না! না! অতীশ চিৎকার করে উঠল।

অমলাও কেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এই যুবক বড় বেশি আত্মসচেতন। অতীশ আর আগের অতীশ নেই। বড় হতে হতে মানুষ বার বার খোলস পাল্টায়। অতীশও আর শৈশবের সোনা নয়। যে হাত টেনে বলবে, দেখ তো আমি নারী কি না। হাত দে। আমি তোর থেকে আলাদা বুঝতে পারছিস! কিন্তু এখন ইচ্ছে করলেই হাত টেনে নিয়ে বলতে পারে না, আর কিছু না পারিস আমাকে তুই মা হবার একটা সুযোগ দে অতীশ! আমি বড় একলা! বড় একা। কেমন প্রবল কান্না উঠে আসছিল অমলার ভিতর থেকে। অভিমান এবং উত্তাপে সে গলে গলে পড়ছিল। তারপরই সহসা কী হয়ে যায়, উঠে দাঁড়ায় এবং চিরকুটটা অতীশের হাত থেকে টেনে নিয়ে ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলে হাঁপাতে থাকে।

অতীশ বের হয়ে গেল।

অমলা দেখল অতীশ মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছে। তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অতীশ এত বড় অপমান করতে সাহস পায়—রাজপ্রাসাদের কুকুর বেড়ালেরও কান্ডজ্ঞান আছে, তোর তাও নই অতীশ! অমলা গুম মেরে বসে থাকল। শঙ্খকে ডেকে বলল, অফিসে খবর দিতে! কেউ যেন আর তার সঙ্গে দেখা করতে না আসে। প্রাইভেট সেক্রেটারীকে ডেকে বলল, আমি উঠে যাচ্ছি। কুমারদহ থেকে কারা যেন আসবে। নধরবাবুকে বলবেন, যা হয় কথা বলে যেন নেয়। আপনাদের কুমারবাহাদুর এলে ফাইনাল কথা হবে।

আসলে সব কিছু বিস্বাদ লাগছে। অমলা সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে যাবার সময় কিছুই দেখছে না। কেমন এক প্রাণহীন জীবন–এবং বৈভব যে তার কাছে অতিশয় ভার ঠেকছে। মনে হচ্ছে তার, একজন ফুটপাতের বাসিন্দাও তার চেয়ে সুখী। সে সূর্যের আলোর নিচে বসে থাকে। সে যেখানে খুশি চলে যেতে পারে—তার স্বাধীনতার শেষ নেই। রাজেন বিদেশে কিসের টানে চলে যায় বুঝতে কষ্ট হয় না—কিন্তু সে তো পারছে না। সে তো বার বার হেরে যাচ্ছে। আগে ছিল মানস, এখন অতীশ। এরা পাপবোধের তাড়নায় ভুগছে। কোথাকার এক চারু ভর করেছে এখন অতীশের মাথায়। চারুটা কে?

সে একদিন কুম্ভকেও বলল, তুই জানিস চারু কে?

কুম্ভকে অফিসে ডেকে এনে বলেছিল, তাহলে তুই জানিস না!

—আজ্ঞে না বউরাণীমা!

—পিয়ারিলালও জানে না?

—আজ্ঞে জানবে কি করে! পিয়ারিলালের কোনো ভাইঝি নেই।

কাবুলকে খাবার টেবিলে বলেছে, তোকে কে বলেছে অতীশ ঘোরে পড়ে যায়। তুই দেখেছিস?

—না।

—তবে কার কাছে শুনলি?

—রাজবাড়ির সবাই জানে।

—আমি বলছি তুই নিজে দেখেছিস?

—না!

—তবে লোকের কথায় নাচছিস কেন? ওকে পাগল সাজাতে পারলে তোরা মজা পাস। কাবুল ট্যারা। সে নরম মুরগির ঠ্যাং চিবুচ্ছিল। সে এই বিশাল প্রাসাদে একমাত্র কুমারবাহাদুরের নিজের আত্মীয়। আগে আরও সব আত্মীয়স্বজন গিজগিজ করত। রাজেনের তারা মামা-মামী, তাদের সব লতায় পাতায় কুটম্ব—রান্নাবাড়ি বাবুর্চিখানায় এক এক কিসিমের রান্না। কে কি খায়, খেতে পছন্দ করে, রাণীমার আলাদা হেঁশেল, সেখানে বিধবা আত্মীয়ারা খায়, আলাদা মহল, সেখানে রাণীমার ঠাকুরদালান —দাস-দাসী এক এলাহি ব্যবস্থা। অমলা এসে বুঝেছিল, ফাঁকা জায়গা টের পেয়ে রাজ্যের সব কাক উড়ে এসেছে। নড়ছে না। কেবল পাখা ঝাপটাচ্ছে। অমলার প্রথম কাজই হয়েছিল, সাফ করা। সে সাফ করার কাজে হাত দিতেই ফোঁস! এতদিনের মৌরসিপাট্টা ছাড়তে কে রাজী! কিন্তু অমলার প্রবল ব্যক্তিত্ব সব কিছু অবহেলায় ছুঁড়ে দিয়েছিল। আছে মাত্র কাবুল, তারও বসে খেলে চলবে না। আদরে এই বাড়ির কোনো আত্মীয়ই মানুষ হয়নি, ঘোড়দৌড় থেকে আরম্ভ করে, বাইজি বাড়ি যাওয়া আসা সব এস্টেটের আয় থেকে। গিলে করা পাঞ্জাবি ধুতি পরে কানে আতর গুঁজে যে যার জায়গায় চলে যেত। অথবা খেলার মাঠে খেলা দেখত কেউ। দীয়তাং ভোজ্যতাং ছিল বাড়ির ঐতিহ্য। অমলা এসে সব বন্ধ করে দিয়েছে। অমলার এ জন্য রাজার আত্মীয়-স্বজনের কাছে নিন্দার শেষ নেই। তাকে যে কেউ রেন্ডি পর্যন্ত বলেছে, সে কথাও তার কানে উঠেছে।

কাবুল বলল, অফিসে মাঝে মাঝে ধূপবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকে জান!

—ধূপবাতি কে না জ্বালায়।

—তাই বলে প্যাকেট প্যাকেট ধূপ!

—ইচ্ছে হলে জ্বালাতেই পারে!

সহসা কাবুল যেন বেশ হাতের কাছে মোক্ষম একটা অস্ত্র পেয়ে গেছে। সে বলল, তুমি জান, তোমার সাধের পাতাবাহারের গাছগুলি ভেঙে ফেলেছিল।

—কে?

তোমার দ্যাশের পোলা।

—মিছে কথা!

—না মিছে কথা না। কুম্ভর বাবা বলেছেন, কত কষ্ট করে এ সব লাগানো হয়েছে, কত দূর দেশ থেকে এই অমূল্য গাছ নিয়ে আসা হয়েছে, সব গাছগুলোর ডালপালা অতীশ ভেঙে দিল!

—অতীশের নাম বলেছে!

—অতীশের নাম বলেছে।

—সে তো কবে! কতদিন আগেকার কথা! আজ তুই বলছিস এটা অতীশের কাজ!

—ভয়ে বলিনি। তুমি তো বিশ্বাস করবে না।

–কুম্ভর বাবা কবে বলল?

–এই ক’দিন আগে। তবে তিনি বলেছেন, এটা তাঁর অনুমান। রাজবাড়ির কার সাহস আছে তোমার বাগানের ডালপালা নষ্ট করে, অতীশ ছাড়া কেউ না! কারো সাহস নেই তোমার বাগানের ডালপালায় হাত দেয়।

–পরদিন সকালেই তলব, অফিস-সুপারের। সেই সুপার বউরাণীর ঘরে ঢুকলে বলল, বসুন।

অফিস-সুপার ক্যাশ বাক্স দেখল টেবিলে নেই। ক্যাশ বাক্সটা রোজ মেলাবার দায়িত্ব তার। অফিসের শেষে ক্যাশ-বাক্সটা অন্দরমহলে চলে যায়। তাতে সারাদিনের জমা খরচের একটা সাদা পাতা থাকে। সকালে সাদা পাতার হিসাব বউরাণীকে বুঝিয়ে ছিঁড়ে ফেলার নিয়ম। কোনো কিছুর রেকর্ড থাকে না। রেকর্ড রাখতে গেলে সরকার সব টাকায় ভাগ বসাবে—এ জন্য কোনো লকার নয়, সিন্দুক নয়, কাঠের একটা হাত বাক্স—লাখ লাখ টাকা এর মধ্যেই পাচার হয়ে যায় বিনা রেকর্ডে। কিন্তু আজ কুম্ভর বাবা দেখল, ক্যাশ-বাক্সটা নেই। তবে কেন ডাকলেন!

বউরাণীর মুখ কঠিন।—এত সাহস তোর। অন্দরমহলে থাকতে দিয়েছি বলে তুই আমার মাথা কিনে নিয়েছিস! কুকুর বেড়ালের মতো রাস্তায় ফ্যাঁ ফ্যাঁ করতিস, তোর রাজেনদা না নিয়ে এলে খেতিস কী! দেমাক দেখিয়ে মাস্টারির চাকরি ছাড়লি, একবার ভাবলি না, বৌ-ছেলেপুলের কথা! তোর মা- বাবার কথা ভাবলি না! তোর উপর তাদের কত ভরসা।

নিয়ম নয় বউরাণী কিছু না বললে কথা বলা। অফিস-সুপার রাধিকাবাবু টাকে হাত বুলাচ্ছিলেন। প্রৌঢ় মানুষ। শক্তসমর্থ। লম্বা, আদ্দির পাঞ্জাবি, পাট করা ধুতি পরে আছেন। পায়ের চটি-জুতো দরজার বাইরে। এ-ঘরে জুতো পরে ঢোকার অনুমতি কারো নেই। অতীশ তাও মানে না। আমলারা সবাই জুতো খুলে ঢোকে আর সেদিনের ছোঁড়া অতীশ, সে কিনা জুতো পরেই গট গট করে ঢুকে যায়। আমলারা, বেয়ারারা চোখ ট্যারচা করে দেখে—বুকের পাটা আছে বলতে হবে।

বউরাণী বলল, আপনি নাকি বলেছেন, অতীশ পাতাবাহারের সব ডালপালা ভেঙেছে।

—না না। আমি বলব কেন?

—আপনার নাকি অনুমান?

—অনুমান, হ্যাঁ তা বলতে পারেন। অতীশ তো নিজের খুশিমতো চলে!

—ও ভাঙবে কেন?

—আজ্ঞে শুনেছি, কিসের ঘোরে নাকি পড়ে যায়। ঘোর থেকে যদি হয়!

—হতেই পারে। রাতে রাধিকাবাবুর কাজ এই বিশাল বাড়িটা একবার ঘুরে দেখা। সকালে উঠেও এই কাজ। প্রাসাদের চারপাশে যে-সব অতিথি ভবন ছিল, ম্যানেজার, নায়েব, গোমস্তার বাড়িঘর ছিল, সব এখন ভাড়া। অতিথিশালা পর্যন্ত! কারও কোনো ঘরে নতুন কেউ এসে উঠেছে, তার কৈফিয়ত তলব করা অফিস-সুপারের কাজ। বাড়ির উঁচু পাঁচিলের ওপাশটায় রাস্তায় সব ঝুপড়ি রিফুজিদের। কে কখন ঢুকে পড়বে কে জানে! রাতে রাউন্ড দেবার সময় দেখেছেন, অন্দরমহলের সব কটা পাতাবাহারের গাছ অক্ষত। সকালে গিয়ে দেখেন, ভাঙা ডালপালা সব। পাতা বাহারের গাছগুলো অতীশের জানালা বরাবর। অতীশের সিঁড়ি ধরে নামলেই হাতে নাগাল পাওয়া যায়। এ-সব কারণে তাঁর এই অনুমান। এদিকটায় রাতে কেউ ঢুকে এত বড় অপকম করার সাহস পাবে তা তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। তখন অতীশ নতুন। রাধিকাবাবু মনে মনে সংশয় পোষণ করলেও প্রকাশ করতে সাহস পাননি। কিন্তু কুম্ভর পিছনে যে-ভাবে লেগেছে তাতে করে শেষ পর্যন্ত কে থাকবে বলা কঠিন। কুম্ভর ছ্যাঁচড়া স্বভাব আছে, দু-নম্বরী মাল দিয়ে আলগা পয়সা কামাত, সব অতীশ এসে বন্ধ করে দিয়েছে। দু-নম্বরী মাল সিট মেটালে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ-ছাড়া কুম্ভকে কখন বিপাকে ফেলে দেবে কে জানে! শত হলেও কুম্ভ তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান, তিন পুরুষ ধরে রাজবাড়ির নুন পেটে, তুই সেদিনের ছোঁড়া কী বুঝবি!

—আপনার অনুমান! না কেউ দেখেছে অতীশ রাতে গোপনে সব ডালপালা ভেঙে দিয়েছে! গরমের সময় গাছগুলোর জন্য হাওয়া ঢুকতে পারে না অতীশের বাসায়। এ কারণেও অতীশ কাজটা করতে পারে। সব সত্ত্বেও বউরাণীর সংশয় থেকেই গেল। অতীশকে এক সকালে কারখানায় যাওয়ার আগে আবার দেখা করতে বলল।

অতীশ ঢুকলে বলল, তোর বৌকে বাড়ি নিয়ে এলি?

—হ্যাঁ।

–এখন কেমন আছে।

—এই একরকম।

অমলা সব খবরই রাখে। খবর রাখে না, হতে পারে না। সে বুঝতে পারে, আসল কথায় আসবার আগে এদিক ওদিক দু-একটা কথা—এবং ও-সব কথা যখন বেশি হয় তখনই সে টের পায়, একটা বড় ঝড়ের মুখে তাকে পড়তে হবে।

অতীশ সব কথায় হাঁ হুঁ বলে যাচ্ছে। সব দায়সারা গোছের। কেন ডেকেছে, কেন সহসা আবার তলব, কে আবার কানে কি কথা তুলেছে—এ-সব ভাববার সময়ই অমলা বলল, পাতাবাহারের ডালগুলো কে ভেঙেছিল?

—পাতাবাহারের ডাল!

—ভুলে গেলি?

—সে তো কবে! কবেকার কথা! বছর ঘুরে গেছে। তা পাতাবাহারের ডাল ভাঙলে কী হয়! এখন এ-সব কথা উঠছে কেন?

—তুই ভেঙেছিস কিনা বল!

—হ্যাঁ আমিই ভেঙেছি।

—তুই!

—হ্যাঁ আমি।

—তোর এত সাহস!

—সাহসের কি আছে!

—কেন ভাঙলি! আমার এত শখের গাছগুলো তোর কী ক্ষতি করেছে?

তাজ্জব বউরাণী। কোনো দ্বিধা নেই, কোনো সংকোচ নেই! অতীশের চোখ তখন কেমন লাল হয়ে উঠছে।

—তুই এ কাজ করতে গেলি কেন? বল! তোকে বলতে হবে।

আর সঙ্গে সঙ্গে অতীশ কেমন মিইয়ে গেল, সে তো তার অন্য জন্মের কথা বলতে পারে না। সেই জন্ম কবে তার শেষ হয়ে গেছে। বনি, আর্চি, কাপ্তান, স্যালি হিগিনস, মেজমালোম ডেভিড, ভাঙা লঝঝরে জাহাজ—সেই কবে যেন সুদূর অতীতে সে একটা বড় পাপ কাজ করে এসেছে। আর্চিকে খুন করেছে। কেউ জানে না। কেউ জানে না, কেবল স্যালি হিগিনস বলেছিলেন, রাতের অন্ধকারে গোপনে তুমি আর্চিকে খুন করেছ। বনি ছাড়া পেয়ে ছুটে বের হয়ে গিয়েছিল—জাহাজ তখন টালমাটাল। স্যালি হিগনস বলেছিলেন, আজীবন আর্চি তোমাকে তাড়া করবে। তার হাত থেকে তোমার রেহাই নেই।

যত দিন যাচ্ছে তত সে এটা টের পাচ্ছে। যেন আর্চি তার সব সুখ কেড়ে নিতে চায়। আর্চি বদলা নিচ্ছে। নির্মলার অসুখ সেই আর্চির প্রভাবে। রাজার দু-নম্বরী কারবারে এসে হাজির—সে ও সেই আর্চিরই কাজ। মাঝে মাঝে কুন্তবাবুর মুখটা আর্চির মতো হয়ে যায় কেন? সে আবার তার কোনো অসতর্ক মুহূর্তে কুম্ভকে খুন করে বসবে না তো। মাথায় তার পোকা ঢুকে গেছে—পচা টাকার গন্ধ পায়। অফিসে গেলে সব সময় মনে হয় টুটুলটা না আবার পুকুরের ঘাটলায় গিয়ে বসে থাকে! বাবার চিঠিতেও যেন আর্চির প্রেতাত্মা ভর করেছে। কেবল অনুযোগ এই টাকায় কী হয়! তোমার বোনের বিয়ের কি করলে! পাত্রের সন্ধান করতে বলেছিলাম তার কী করলে! আমার বয়েস হয়েছে, এখন তুমিই আমাদের নির্ভর। জমি তো না যম। খরচের টাকা উঠে আসে না। যজন যাজনে পয়সা নেই। তোমার পাঠানো টাকায় পাঁচজনের সংসার কীভাবে চলে! গরুটা দুধ দিত, তাও বন্ধ করে দিয়েছে। বাঁটে ঘা হয়েছে। সুরেশ চিকিৎসা করছে। বুড়ো বয়সে সামান্য দুধ না খেতে পারলে বাঁচি কী করে!

শেষে এসে চারু হাজির। শেষ বেলায় চারু।

আসলে মনে হয় সবই সে ঘোরে পড়ে করে যাচ্ছে। সবই মরীচিকা। না হলে সে কেন বউরাণীর এত শখের পাতাবাহারের ডালপালা ভেঙে ফেলবে! কী করে বলবে, তুমি বিশ্বাস কর আমি একা থাকলে, আর্চির দৌরাত্ম্য বাড়ে। বিশ্বাস কর রাতে আমার বাসাবাড়িতে অন্ধকার ঘরে আর্চি হাজির। দেখি ছায়ার মতো সে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন কুয়াশার মতো তার অবয়ব। ধীরে ধীরে সে জানালা গলিয়ে পাতাবাহারের গাছটায় মিশে গেল। দৌড়ে বের হয়ে গিয়েছিলাম। দরজা খুলে পাতাবাহারের গাছটায় হাত দিতেই দেখি পাতায় ডালে জল লেগে আছে। আর্চি এখন ঐ গাছটায় এসে উঠেছে। গাছটা কত দ্রুত বাড়ে তুমি অমলা টের পাও না! আমি পাই। আমার জানালার হাওয়া বাতাস বন্ধ করে দিতে চায়। আমি কেমন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলাম। আর্চি দিন দিন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে। তাকে আমায় শেষ করতেই হবে। ডালপালায় সে লেগে থাকবে, আমি সহ্য করি কী করে! সব ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিলাম।

বউরাণী অতীশের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অতীশ কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে।

—কী রে কি বলছি শুনতে পাস না! চুপ করে আছিস কেন! বল কেন ভাঙলি? তোর কোন পাকা ধানে গাছগুলি মই দিয়েছিল?

অতীশ কী বলবে! বললে বিশ্বাস করবে কেন! সেই বা বলে কী করে, এই অতীশ একজন খুনী। তোমরা কেউ জান না, সেই অসতর্ক মূহুর্তে এই অতীশ কী হিংস্র হয়ে উঠেছিল। অতীশ তখন যে তার মধ্যে ছিল না।

সে উঠে চলে যাচ্ছিল।

সঙ্গে সঙ্গে বউরাণী আঁচল সামলে ছুটে যাচ্ছে—তুই কিছু না বলে চলে যাচ্ছিস! বলে দরজায় দু-হাত ছড়িয়ে দিল।

—আমার কিছু বলার নেই। সরে দাঁড়াও।

—না দাঁড়াব না।

—অমলা! সে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে থেমে গেল। অমলার সারা শরীরে এক পরম উষ্ণতা সে টের পাচ্ছে। অমলা সিফনের শাড়ি পরে আছে। শরীরের সর্বত্র তার যেন এক অপার অলৌকিক মহিমা। টোকা দিলেই ফুলঝুরির মতো জ্বলে উঠবে। অমলার দিকে তাকাতে পারছে না। সে যদি অসতর্ক মুহূর্তে চারুর মতো অমলাকে ব্যবহার করে ফেলে—কারণ নিজেকে সে বিশ্বাস করতে পারে না। নির্মলা আলাদা বিছানায় শোয়, সে একা শুয়ে থাকে। ঘুম আসে না। চোখ জ্বালা করে। ভিতরে সে বড় বেশি উত্তপ্ত। কোনো কোনো রাতে বারান্দায় বের হয়ে পায়চারি করে। টুটুল মিণ্টু তার পায়ের বেড়ি। নির্মলা এক বড় গন্ডি এঁকে দিয়েছে। তার বাইরে বের হবার শক্তি আর নেই। আর্চি এখন মজা পাচ্ছে। বোঝ এখন, দীর্ঘ সমুদ্র সফরে একজন জাহাজী কত নিঃসঙ্গ থাকে। যুবতীরা আছে বলেই পৃথিবী এত মধুর। তারা না থাকলে কী করতে! বোঝ কেমন লাগে! আসলে চারুকে সেও ধর্ষণ করেছে। বনিকে ধর্ষণ করার চেষ্টার চেয়ে এটা আরও দুষ্কর্ম। বড় পাপ।

অতীশ এবার খুব ক্ষীণ গলায় বলল, অমলা, তোমরা আমাকে সবাই মিলে নষ্ট করে দিও না। দোহাই তোমাদের।

অতীশ দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

অমলা দেখল দীর্ঘকায় এক যুবক চলে যাচ্ছে। তারপরই মনে হল এ যেন অতীশ নয়, ক্রুশবিদ্ধ যিশু। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিসের যন্ত্রণা এত সে বুঝতে পারে না। একবার ভাবল, ভূইঞা কাকাকে একটা চিঠি লিখবে। আপনাদের সোনা কেমন হয়ে যাচ্ছে! ওকে সাইকিয়াট্রিক দেখানো দরকার। কিন্তু অতীশ কি তার বাবাকে বলেছে, মেজবাবুর বড় মেয়ে অমলা কুমারবাহাদুরের স্ত্রী। সে কি বলেছে, অমলা রাজবাড়িতে এখন বউরাণীমা!

তখন অতীশ একটা ট্রামে লাফিয়ে উঠে গেল। চারপাশের কোলাহল তার কানে আসছে না। সেই পাগলটাও নেই। হরিশকে দেখলে তার কেন জানি মনে হয় দিনটা ভাল যাবে। গাছ তলায় বসে থাকে। একটা পুঁটুলি পাশে। হাজার কিসিমের তালি মারা জামা গায়, কখনও উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। শহরটাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে পাগলা হরিশ বেঁচে আছে।

দেয়ালে সেই সব লেখা ফুটে উঠেছে। শহরের ফুটপাথে মানুষ উপচে পড়েছে। খবরের কাগজ খুললে, ধর্ষণ, রাহাজানি, ছেলেধরার উৎপাতের খবর। যুক্তফ্রন্ট সরকার কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করেছে। নকসাল বাড়িতে জোতদার খুন। দিকে দিকে চরম অরাজকতা। পত্রিকা ওল্টালে মাথা ঠিক থাকে না। দেয়ালে কে বা কারা লিখে যাচ্ছে—চিনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান। কারা বিদ্যাসাগরের মুন্ডু কেটে সেখানে আগুন জ্বেলে দিয়েছে। মানুষ ক্রমে ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। বাড়ি থেকে বের হলে, সে আর ফিরবে কিনা ঠিক থাকছে না। নির্মলার এক কথা, অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে এস। কোথাও যেও না।

মিছিল যাচ্ছে। আমাদের দাবি মানতে হবে—মানুষের দাবিদাওয়ার কথা ফেস্টুনে লেখা। ব্রিগেড ময়দানে জনসভা। পার্টির ডাকে লরি বোঝাই সব মানুষজন যাচ্ছে। ট্রাম থেমে আছে। সে দেখল রাজাবাজারের কাছে কেউ বসে আছে চাদর বিছিয়ে। লোকে দু-পাঁচ পয়সা দিয়ে সরে পড়ছে। অতীশ যখন খালাসি বাগানের বস্তিতে ঢুকছে, সূর্য তখন মাথার উপর। শীতকাল এসে গেছে। এ-কটা মাস তার নিদারুণ অসময় গেছে। সে অফিসে ঢুকে যাবার মুখে দেখল, কুম্ভবাবুর ঘরে পিয়ারীলাল বসে আছে। আবার দেখা করতে এসেছে লোকটা। ছিনে জোঁকের মতো লেগে আছে।

পিয়ারীলালের সঙ্গে তার আবার অনেকদিন পর দেখা। ফোনে অনুনয় বিনয় করেছে।—তার কাজ-কাম বন্ধ। দু-নম্বরী মাল সে অন্য কোথাও থেকে নিতে পারে—কেন যে এখান থেকে নেবার জন্য জেদ ধরে বসে আছে বুঝতে পারছে না।

টিনের কৌটার কারখানা, এ-অঞ্চলে ছোট বড় অনেক আছে। তারা দিচ্ছে না কেন! কেন দিচ্ছে না অতীশ টের পায়। এত সস্তায় মাল আর কোথায় পাবে!

তাকে দেখেই সুধীর এগিয়ে এসে ব্যাগটা হাতে নিল।

পিয়ারীলাল উঠে দাঁড়াল তাকে দেখে। বলল, রাম রাম বাবুজী!

অতীশ সুইংডোর ঠেলে তার অফিস ঘরে ঢুকে গেল। দেখল, ক্যাশবুক এবং একগাদা ভাউচার। কুম্ভবাবু বলল, সান-রাইজ কোম্পানি থেকে লোক এসেছিল। অতীশ শুনেও কিছু শুনছে না। সে আজ সত্যি ভাল নেই। এদিকের শেডটার নিচে প্রিন্টিং মেশিন। গ্যাস চেম্বার। কুম্ভবাবুদের বসার ঘর কারখানার সদরে ঢোকার মুখে। তার অফিসের বিশাল টেবিলের পাশে ফোমের গদিআটা চেয়ার। বসলে সে অনেকটা ডুবে যায়।

টেবিলে এক গ্লাস জল। সে বসে এক চুমুকে সব জলটা খেয়ে বেল টিপল। সুধীর। সুধীর এলে বলল, কুম্ভবাবুকে ডাক।

কুম্ভ এসে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল। চুল খাড়া, গোবদা চেহারা। মুখটা ফোটকা মাছের মতো ভারি। হাতে চার পাঁচটা আংটি, গোমেদ, পলা, মুনস্টোন। কথা আছে একটা নীলা ধারণ করবে। তাহলেই ওর যা মনস্কামনা সব পূর্ণ হবে। মনস্কামনা একটাই অতীশকে উৎখাত করা। আংটিগুলি দেখলে অতীশের ভীষণ হাসি পায়। এবং হাত বিছিয়ে কুম্ভ যেন এই আংটির দৈবরহস্য কত শক্তি-শালী তার নিদর্শন সাজিয়ে রাখে।

কুম্ভ নিজে থেকেই বলল, পিয়ারীলাল শুনল না। বললাম হবে না। একবার আপনার সঙ্গে কথা বলবেই। কী করি! শত হলেও কাস্টমার। উঠতে না চাইলে………

অতীশ সে কথায় না গিয়ে বলল, মিটিংয়ের নোটিশ পাঠিয়ে দেবেন।

—কুমারবাহাদুর না এলে মিটিং হবে কী করে?

—এসে যাবেন।

কুম্ভ নিজেও এসব খবর রাখে। তার বাবাই সবার আগে রাজবাড়ির খবর পায়। তারপরই কুম্ভ নিজে। এমন কি অনেক গুহ্য খবরও সে পায়। তবে ফাঁস করে না। গুহ্য খবর আরও আছে। যেমন কুম্ভ জানে কুমারবাহাদুর ফিরে এলে কারখানার নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু হয়ে যাবে। অতীশের ঘোর আপত্তি টিকবে না। কারণ কারখানার লাগোয়া রাজার ছ’সাত কাঠা জমি শিউপূজন দখল করে রেখেছে। কেউ তাকে শিউপূজন ডাকে, কেউ তাকে আবার শিবলালও ডাকে। লোকটার কুষ্ঠ। কারখানায় বড় মিস্ত্রি ছিল বলে সে, আগেকার বড়বাবুকে ভজিয়ে জায়গাটায় ঠেলা রাখত। এখন তার পাঁচিশ- ত্রিশটা ঠেলা, নামমাত্র ভাড়ায় জায়গাটায় রাখে। জায়গাটার দখল তার। শিউপূজনকে কুম্ভই রাজি করিয়ে উৎখাত করছে জায়গাটা থেকে। বলেছে, কোম্পানির নতুন বিল্ডিং হবে, ক্যানেস্তারা মেশিন কেনা হচ্ছে। বার্মাশেল থেকে মেশিন আসবে—রাজার জায়গার দরকার। ট্যা ফু করবে তো চ্যাংদোলা করে রাস্তায় রেখে আসব। অতীশ নতুন বিল্ডিং তোলার পক্ষপাতী নয়। কারখানা মার খাচ্ছে, মান্ধাতা আমলের মেশিনপত্রের জন্য। ওয়ার্কিং ক্যাপিটেল দরকার। তার এক কথা নতুন প্রিন্টিং মেশিন দরকার। লিথো প্রিন্টিং অচল। কামড়ি মেশিন, পাঞ্চিং মেশিন, ভ্যাকুয়াম মেশিন সব পাল্টানো দরকার। বাজারে টিকে থাকতে হলে আরও দুটো ল্যাদ মেশিনের দরকার। বিল্ডিং ধুয়ে জল খেলে চলবে না।

কুম্ভ বুঝিয়েছে, রাজার জমিটা বে-হাত হয়ে যাবে। নতুন বাড়িতে প্রিন্টিং মেশিন গ্যাস চেম্বার সব তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। এই শেডটায় ক্যানেস্তারা মেশিন বসবে।

কারখানার চেয়ে রাজার যেন এই জমির দখল বেশি দরকার। অতীশ জানে বিল্ডিং উঠলে তার ইঁট বালি সিমেন্ট থেকে সব সংগ্রহের ভার, রাজমিস্ত্রি ঠিক করার দায় কুম্ভ মাথা পেতে নেবে। কনট্রাক্টরকে দিলে, অর্ধেক টাকা মেরে দেবে—নিজেরাই দেখেশুনে করাতে পারলে টাকা বাঁচবে—এবং এইসব অজুহাতে কেন যে অতীশ টের পায়—হাজার হাজার টাকা তছরূপের একটা সূযোগ এসে যাবে কুম্ভবাবুর। দু-নম্বরী মাল বন্ধ করে অতীশ কুম্ভকে যে লোকসানে ফেলে দিয়েছে, বিল্ডিং তুলে, ক্যানেস্তারা মেশিন বসাবার দায়িত্ব নিয়ে তা সুদে আসলে কিংবা বলা যায় এক অভাবিত অর্থের সন্ধানে কুম্ভ এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে।

কুম্ভ বলল, ডাকব পিয়ারিলালকে!

অতীশ বলল, পাঠিয়ে দিন গে।

কুম্ভ কেমন প্রমাদ গুনল। যদি পিয়ারীলাল বাবুজীকে খুশি করার জন্য সামনাসামনি সব বলে দেয়! যদি অতীশবাবু বলে, লালজি দু-নম্বরী মাল পাবেন—কিন্তু তার আগে বলুন, চারু আপনার সত্যি কে হয়। বলুন, স্টেশনে আপনি সত্যি গিয়েছিলেন কি না। চারু বলে কাউকে আপনি আমার সঙ্গে তুলে দিয়েছিলেন কি না, সত্যি কথা বলুন, মাল আপনি পাবেন।

কুম্ভ বলল, এই সুধীর, পিয়ারিকে আসতে বল।

অতীশ চোখ তুলে কুম্ভকে দেখল। তাকে কুম্ভ বিশ্বাস করছে না। কুম্ভ ভাবছে গোপনে কোনো লেনদেন হবে। সে কপাল কুঁচকাল। টের (?) পেল মাথাটা খুব ধরেছে। অমলার আজকের ব্যবহার তাকে অসহায় করে রেখেছে। এটা ভাল না। একজন গেরস্ত মানুষ সে। অমলার টান টান শরীর এবং প্রাচীন মিশরীয় সৌন্দর্য তাকে পাগল করে দিচ্ছে ভেতরে। যেন আর্চি সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এই একটা পাপ কাজ করিয়ে তার প্রতিশোধ নেবে। চারুর সঙ্গে সহবাসের পরই নির্মলার রক্তপাত। নির্মলা প্রায় যমের ঘর থেকে ফিরে এসেছে। ফিরে এসেও তার নিস্তার নেই। নির্মলা হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর একদিনের জন্যেও সে তাকে আদর করতে পারেনি। পাশে বসে আদর করতে চাইলেই, নির্মলার এক কথা, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও!

এমন কথা শোনার পর মাথায় রক্তপাত শুরু হয়। সে স্থির থাকতে পারে না। ভারি বিমর্ষ হয়ে থাকে। কখনও জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা কুটে মরতে ইচ্ছে হয়। নির্মলা তার স্ত্রী। তার আকর্ষণ বড় গভীর। নির্মলা পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। তার ভিতরে অগ্নুৎপাত হচ্ছে, লাভা নির্গত হচ্ছে, –ওতে নির্মলার কিছু আসে যায় না। যুবতীর মুখ ফ্যাকাসে—ভয়ে কী ঘৃণায় বুঝতে পারে না। দিন যায়, মাস যায় নির্মলার একই রকমের আচরণ।

—বাবুজী।

—বলুন।

—হামার গদ্দি বিলকুল বনন্ধ হো জায়গা।

—আমি কী করতে পারি! তারপরই অতীশ কেমন উন্মত্তের মতো আচরণ করল।—নিকালো ইঁহাসে।

—বাবুজী!

—কোনো কথা শুনতে চাই না। আপনি সেদিন চারুকে নিয়ে গেছিলেন কেন!

—নেহি বাবুজী!

—আবার মিছে কথা বলছেন। চারু আপনার কে হয়।

—কেউ না বাবুজী।

—আপনার ধরম এ বাত বলে!

—সাচ বাত, বিলকুল সাচ বাত।

—বাহার যাইয়ে।

কুম্ভ বলল, আপনি মিছিমিছি পিয়ারিকে টানছেন। আপনার সঙ্গে তার ভাইঝি গেলে কী ক্ষতি—গেলে বলবে না কেন! দাদা আপনি যে মাঝে মাঝে কী সব বলেন বুঝি না!

না, সে আর পারল না। ঘোরে পড়েই হয়েছে। মানুষ এত নিচে নামতে পারে না। সে নিজের দুর্ব্যবহারের জন্য কেমন অনুতপ্ত গলায় বলল, সারাটা ট্রেনে চারু আমার সুখের জন্য কী না করেছে। সেই চারু ট্রেন থেকে উধাও!

আর আশ্চর্য গায়ে হাত দিতেই, চারু তাকে সাপ্টে ধরেছিল। চারু পাগলের মতো তাকে সাপ্টে সাপের মতো পেঁচিয়ে সব নিংড়ে নিয়েছিল—সেই অবিরাম তৃষ্ণায় চাতকের মতো অতীশ ছিল কতকালের কাঙাল, চারু অবলীলায় কোনো এক বর্ষণমুখর রাত্তিরে জোনাকি পোকা হয়ে উড়তে থাকল—তারপর কী ভাবে যে কতদিন পর অতীশ ঘুমে ঢলে পড়েছিল জানে না! ঘুম ভাঙতেই সে টের পেল, চারু বলে পাশে কেউ নেই। চারু হাওয়া। চারুর আর খোঁজ পাওয়া গেল না। চারু মাথায় পেরেক পুঁতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

—বাবুজী।

—বলিয়ে।

—মেহেরবানি আপনার।

কুম্ভ বলল, দাদা আপনার শরীর ভাল নেই!

—কেন বলুন তো!

—না, মানে, চোখ এত লাল! রাতে ঘুমোননি!

অতীশ জবাব দিল না! ভাউচার উল্টে সই করতে থাকল। ভাউচার থেকে চোখ না তুলেই বলল, পিয়ারিলাল, আর কটাদিন সবুর করুন। দেখি কী করা যায়। মনমেজাজ ভাল নেই। আমি খুব দুঃখিত। কোনটা বেঠিক বুঝতে মনে হয় আরও সময় লাগবে। পরে আসবেন।

আর তখনই ফোন, হ্যালো, কে?

—আমি।

অতীশ কিছু বলছে না।

ও-প্রাক্ত আমি বলেই চুপ।

সেও চুপ।

যেন ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছে। কেউ কথা বলবে না। অতীশও কম একগুঁয়ে নয়। সে ফোন ধরেই আছে।

কুম্ভ বলল, কার ফোন, কে কথা বলছে?

—কেউ না।

—কেউ না! ফোন তুলে রেখেছেন, কেউ না!

—বলছি কেউ না! আচ্ছা, পিয়ারিলাল, পরে কথা হবে। আসুন।

কুম্ভকে বলল, নোটিশটা টাইপ করতে দিন।

—পিয়ারিলাল তোর সামনে?

—হু!

—বললি কিছু? চারুর কোন খবর পেলি?

—না।—কুম্ভবাবু সামনে বসে আছে।

কুম্ভর কৌতূহল বাড়ছে। সে বলল, কে কথা বলছে দাদা। বলছেন, কেউ না। আবার বলছেন, কুম্ভবাবু সামনে বসে আছে।

—বউরাণী।

কুম্ভ আঁতকে উঠল। বসে আছে কেন, কাজ নেই। বসে থাকলে চলবে। কুম্ভ বেশ জোরে বলল, নোটিশ তাহলে টাইপ করতে দিচ্ছি। বলে কুম্ভ পিয়ারিলালকে ইশারায় ডেকে নিয়ে গেল। বাইরে বের হয়ে বলল, খবরদার মুখ খুলবে না। চারু বলে কেউ নেই। মনে থাকে যেন। চারুকে লেলিয়ে দিয়েছি জানলে তোমার আমার দু’জনেরই অন্ন উঠবে।

পিয়ারি বলল, নেহি বাবু, কভি হাম বলবে না।

তখন অতীশের ভেতর তোলপাড় চলছে। সে কী করবে ঠিক করতে পারছে না। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। শরীর গরম হয়ে গেছে। কান গরম, চোখ আবার জ্বলছে—এক নিয়তি থেকে আর এক নিয়তি তাড়া করছে তাকে—আবার মনে হয় ঘোরে পড়ে হচ্ছে—অমলাও এক ঘোরে পড়ে গেছে।

অতীশ অধীর গলায় বলল, কখন যাব?

—নম্বরটা টুকে রাখ। তিনশ আটাশ। রিশেপসানে গিয়ে নম্বরটা দিলে তোকে বলে দেবে। ছটার মধ্যে যাস। কিরে যাবি তো?

—যাব। বলতে পারল না আমাকে নষ্ট করে দিও না।

যাব কথাটা বলতে গিয়ে কেমন গলা ফ্যাসফেঁসে হয়ে গেল। অমলার সঙ্গে হোটেলে কয়েক ঘন্টা—সে স্থির থাকতে পারছে না। আরও একবার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। এবারে সে নিজেই ধরা দিয়েছে। অস্থির হয়ে উঠেছে। আবার জল খেল এক গ্লাস। উঠে দাঁড়াল। এক যুবতী আজ তার অপেক্ষায় বসে থাকবে—সেই সুচারু নারীর গভীরে সে দীর্ঘকাল পর, কারণ সে জানে না, শৈশবের সেই বালিকা নারী হয়ে গেলে, তার খ্যাপামি কটা? কীভাবে কতটা অধীর আগ্রহে জলপ্রপাতের ধারা নেমে আসবে! অথবা মনে হয় তার রক্তের গোপন গভীরে সেই জোনাকী পোকা দপদপ করে জ্বলতে থাকলে আগুন সারা শরীরে কখন না জানি জ্বলে উঠবে—আর সে দেখতে পায় সারাক্ষণ মাথার মধ্যে শুধু এক নারী হাসপাতালেই শুয়ে থাকে না, এক নারী উলঙ্গ হয়েও শুয়ে থাকে।

—ছাড়ছি।

—আচ্ছা।

অতীশ ফোন নামিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল। তার ভিতর পাপবোধ প্রখর। বাবা তাঁর এই সর্বনাশটি করেছেন। বাবা! না টুটুল মিণ্টু। না নির্মলা! কে! কিংবা সেই সুদূর অতীতে যে ছিল, অনন্ত হাহাকার সমুদ্রের একমাত্র সঙ্গী—সে না তো! এও এক হাহাকার সমুদ্র। সারাদিন খাটাখাটনির পর বাড়ি ফিরে তাকে দেখতে হয় বিষণ্ণ রমণী জানালায় দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতীক্ষায়। সে-প্রতীক্ষায় কোনো উষ্ণতা থাকে না। বরফের কুচি টের পায় হাড়ে মজ্জায় ঢুকছে। নিষ্প্রাণ গলা, এত দেরি কেন! সেই কখন দুটো খেয়ে গেছ! টিফিন করেছিলে? চোখ মুখের কী চেহারা হয়েছে! হাত মুখ ধুয়ে নাও। এই মিণ্টু, বাবার পাজামা পাঞ্জাবি বাথরুমে রেখে আয়! তার তখন চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হয়, তোমার মধ্যে প্রাণের সাড়া নেই কেন? সে দু-হাত তুলে চিৎকার করলে যেন বাঁচে, তোমার রক্তেও কী আর্চি আশ্রয় করেছে? সে তোমাকে শুষে খাচ্ছে। সে তোমার সব জীবনের উষ্ণতা নিঃশেষে মুছে দিচ্ছে! দিন দিন কাঠের পুতুল হয়ে যাচ্ছ, একটা কাঠের পুতুল দিয়ে আমার কি হবে নিৰ্মলা! আমি ঠিক থাকি কী করে! তুমি বুঝছ না কেন, আমি মানুষ—আমি রক্ত মাংসের মানুষ নির্মলা।

আর তখনই মনে হয় সে ঘোরের মধ্যে পড়ে আছে—এক সাদা বিছানায় প্রাচীন মিশরীয় সৌন্দর্য নগ্ন হয়ে আছে—অপেক্ষার অনন্ত ইচ্ছেয় নারী মোমবাতির মতো গলে পড়ছে—সিজারের মতো মাথায় পাতার মুকুট পরে নতজানু অতীশ! নাভিমূলে সে এক ক্রীতদাস।

ঘোরের মধ্যেই অতীশ কাজ করে যাচ্ছিল। টুটুল মিণ্টুর কথা মনে নেই, নির্মলার কথা মনে নেই—সে কারখানার ভিতরে ঢুকে দুটো নতুন অর্ডারের মাল পরীক্ষা করে দেখল। কন্টেনারের ঢাকনা লুজ কিংবা টাইট কিনা দেখল। প্রিন্টিং রুমে ছাপা টিন তুলে রেজিস্টেন্স ঠিক আছে কিনা দেখল—ক্যাশ বুকে কটা এন্ট্রি করল, শিউপূজনকে ডেকে বলল, তোমার লোককে বলবে, স্ক্র্যাপের দাম বেড়ে গেছে, বেশি দাম না দিলে দেওয়া যাবে না। নোটিশ সই করে নিয়ে গেল কুন্তবাবু—আর মগজের মধ্যে শুয়ে থাকে সাদা বিছানায় নগ্ন সৌন্দর্য—সে টের পায়, এবং টের পায় বলেই আশ্চর্য স্বাভাবিক হয়ে গেছে কাজ কর্মে। সে একা এত কাজ করতে পারে? নিজেই কেমন আশ্চর্য হয়ে যায়। এক ফাঁকে কুম্ভবাবুকে ডেকে বলল, বাসায় বলবেন আমার ফিরতে রাত হবে। একটু কাজ আছে।

অফিসের বাথরুমের আয়নায় নিজেকে অনেকদিন পর দেখছিল। খুঁটিয়ে দেখছিল। গোপন অভিসারের কোন রেখা মুখে ভেসে উঠছে কিনা দেখছিল। ফোনটা ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে।

—সুধীর ফোনটা ধর।

সুধীর বাইরে থেকে ছুটে এসে ফোন ধরে বলল, বাবু রাজবাড়ির ফোন। আপনাকে চাইছে।

এ-সময় কে চাইবে! ছুটি হয়ে গেছে। বের হয়ে পড়ার কথা। অমলা তিনটায় বের হয়ে কোথায় যাবে, তারপর আজ সাঁজবেলায় জমবে—এবং লোভ অতীব কঠিন আকর্ষণ, সে আজ গোপন হয়ে আছে ভিতরে—আর এখন এই অসময়ে ফোন!

–ধরতে বল, যাচ্ছি।

সে তার জামার কলার ঠিক করল। কোট ঠিক করল। পামলিভ সাবানের ঘ্রাণ মুখে নিয়ে উবু হয়ে বলল, কে!

—আমি রাধিকাদা বলছি, শীগগির বাড়ি চলে এস। তোমার মেয়ে জলে ডুবে গেছিল। তোলা হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই। শীগগির।

মুহূর্তে সারা শরীর অসাড় হয়ে গেল। গলা কাঠ। সে আবার থরথর করে কাঁপছে। দৌড়ে বের হয়ে বাস ট্রাম ধরবে তারও যেন ক্ষমতা নেই—সে ডাকল, কুম্ভবাবু।

কুম্ভবাবু ছুটে এলে বলল, মিণ্টু পুকুরের জলে ডুবে গেছিল!

কুম্ভবাবু বলল, কে বলল?

—জানি না। জানি না। সে ব্যাগ নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল পাগলের মতো। কুম্ভবাবু বলল, এই সুধীর দ্যাখ সব বন্ধ আছে কিনা, বলে সেও অতীশের পেছনে ছুটতে লাগল। যে-ভাবে ছুটছে ট্রামে বাসের তলায় না আবার চাপা পড়ে।

অতীশ একটা ট্যাক্সি পেয়ে উঠে বসল। কুম্ভও দরজা খুলে জায়গা করে নিয়েছে।

সে কি তখন বাথরুমে নিজের আয়নায় নিজেকে আবিষ্কার করতে ব্যস্ত! পুকুরের গভীর কালো জলে ছোট্ট এক জলপরী ফ্রক গায়ে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে! তখন সে দৃশ্যটার কথা ভাবতেই বুঝল, সেই আর্চির প্রেতাত্মা—তাকে এক দন্ডের জন্য সুস্থির থাকতে দেবে না। সে ভয়ে চোখ মুখ দু-হাতে ঢেকে ফেলল। কী দেখবে গিয়ে কে জানে!

গেট দিয়ে ঢোকার মুখে দেখল সব স্বাভাবিক। কেউ জলে ডুবে গেছে কাউকে দেখে মনেই হল না। সাদেক আলি সেলাম দিলে সে বলল, মিণ্টু জলে পড়ে গেছিল?

—জী সাব।

কিন্তু কারো কথা শোনার সময় অতীশের নেই। সে পাগলের মতো দ্রুত হাঁটছে! প্রচন্ড ঠান্ডায় সে দরদর করে ঘামছে ভিতরে। নতুন বাড়ি পার হয়ে সে অবাক। মিণ্টুই সবার আগে এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেছে।

বলছে, জান বাবা টুটুল না আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।

মিণ্টু সাঁতার জানে না। টুটুল ও সাঁতার জানে না। সে এই বাড়িতে ঢুকে সবচেয়ে ভয়ের মধ্যে ছিল—যেন এক অন্ধকার জলাশয় কাউকে গ্রাস করার জন্য উদ্যত হয়ে আছে। সে সাঁতার শেখাবার চেষ্টা করেছে, পেরে ওঠেনি।

টুটুলের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

সবাই ছুটে এসে বলছে, আপনার সাত জন্মের পুণ্যফল, ভাগ্যিস অধীর দেখতে পেয়েছিল! অতীশ চুপচাপ অন্দরের গাড়ি-বারান্দার রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দম ফুরিয়ে গেছে। সে দাঁড়াতে পারছে না। কোনোরকমে সিঁড়ি ধরে ওঠার সময় দেখল টুটুল দরজার পাশে লুকিয়ে পড়েছে তাকে দেখে। টুটুল তার অপরাধ বুঝতে পেরে বাবাকে দেখেও কাছে আসছে না। নির্মলা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে।

অতীশ ব্যাগটা রেখে বসে পড়ল।

মিণ্টু অতীশের কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। বলছে, জান বাবা টুটুল ঘাটলায় না, জলে নেমে গেছিল। কথা শোনে না বাবা। টেনে তুলতে গেছি। আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। আমি বলেছি, বাবা এলে তোকে মারবে দেখিস।

মিণ্টুর যেন কিছুই হয়নি।

অতীশ দেখতে পাচ্ছে ফ্রক গায়ে একটা জলপরী ক্রমে গভীর অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। অতলে, মধ্য রাতের জ্যোৎস্নার মতো জলের অন্ধকার সুগভীর। নিশ্বাস নিতে পারছে না। ছটফট করছে। খড়কুটো অবলম্বনের মতো সবুজ নীল অন্ধকারে ঘাস পাতা যা পাচ্ছে সাপটে ধরছে! ভাবতে ভাবতে ওর নিজেরও কেমন যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। শুধু সামান্য হেরফের। মিণ্টু পাশে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। অজস্র নালিশ। টুটুল তেমনি দরজার আড়ালে লুকিয়ে আছে। এতবার নিষেধ সত্ত্বেও টুটুল একা ঘাটলায় চলে যায়। পুকুরের পাড় ধরে হাঁটে। কোন আকর্ষণে? কে সে? অতীশ গম্ভীর গলায় ডাকল, টুটুল, এদিকে এস!

টুটুল নড়ছে না।

কে সে? অতীশের ব্যক্তিত্বের চেয়ে প্রবল —কে সে? এতবার মানা করা সত্বেও দরজা খুলে পুকুরের গাছপালার ছায়ায় তাকে টেনে নিয়ে যায়। চরম কিছু একটা সে ঘটাতে চায়! জীবনের সবচেয়ে বড় এক প্রতিদ্বন্দ্বী সামনে দাঁড়িয়ে। অতীশ ফের ডাকল, এস বলছি!

টুটুল নড়ছে না। দরজার সঙ্গে সেঁটে গেছে যেন।

—শুনতে পাও না। কী বলছি! কেন গেছিলে? কেন, কে তোমাকে টেনে নিয়ে যায়? বল সে কে? পাগলের মতো উঠে দাঁড়াল অতীশ। হাতে হ্যাঙার নিয়ে অতীশ ক্রমে দৈত্য হয়ে যাচ্ছে। সে ছুটে গিয়ে টুটুলের হাত টেনে টানতে টানতে ঘরের মাঝখানে নিয়ে এল।

কে বল? কেন যাও? আর যাবে? বল, আর যাবে? এতবার বলি, যাবে না, বল আর যাবে?

টুটুল কিছু বলছে না।

এত সাহস তোমার! আমরা তোমার কেউ না? কেউ না? বলেই সে অমানুষের মতো এক ছোট শিশুকে পেটাতে থাকল—চিৎকার, বাবা, আর যাব না। বাবা, তুমি আমাকে মের না। লাগছে।

অতীশ জীবনের সব কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। নির্মলা তার স্ত্রী-বিরস মুখ, সে বড় নির্বান্ধব, বড় নির্বান্ধব—অতীশ দেখল পায়ের কাছে পড়ে তার ছেলেটা ছটফট করছে। নির্মলা ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলেছে—বলছে, তুমি এত নিষ্ঠুর! হ্যাঙারটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবার সময়, দু-চোখ

তার জলে ভার হয়ে আসছে।

—তুমি টুটুলকে মারলে!

তারপর অতীশের আর কিছু মনে নেই। কতক্ষণ সে গুম মেরে বসেছিল মনে নেই। কখন সে তার বিছানায় শুয়ে পড়েছে মনে নেই। এক অযাচিত আশংকায় সে শুধু কাঁপছে। সে বুঝতে পারছে, তার এই নিষ্ঠুর আচরণের পেছনেও আর্চির প্রেতাত্মার প্রভাব। কত সহজে তাকে অমানুষ করে তুলছিল।

জিরো পাওয়ারের বালব ঘরে জ্বলছে। তার ঘুম আসছে না। ও-ঘরে নির্মলা টুটুলকে বিছানায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। সে দাঁড়িয়ে আছে। সে শুয়ে শুয়ে সব টের পাচ্ছে। ভিতরে অনুতাপের জ্বালা, যেন অতীশ টুটুলকে মারেনি—নিজের আত্মার ওপর পীড়ন চালিয়েছে।

তখনই পাশে কেউ দাঁড়িয়ে ডাকছে, বাবা!

অতীশ বুঝল, টুটুল এসে তার শিয়রে দাঁড়িয়েছে। অতীশ মুখ তুলে টুটুলের দিকে তাকাতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে। সে অমানুষ। এমন সরল নিষ্পাপ শিশুর গায়ে হাত তুলে সে কেমন দিশেহারা।

টুটুল আবার ডাকছে, বাবা।

বালিশে মুখ গুঁজে অতীশ বলল, বল।

—আমি তোমার সঙ্গে শোব। তোমার পাশে শোব।

আর সঙ্গে সঙ্গে অতীশের মধ্যে কী হয়ে যায়। যেন সে আর অতীশ নেই, সে শৈশবের সোনা—পৃথিবীটা ছিল আশ্চর্য রকমের সবুজ গাছপালায় ভরা, পাখিরা সব উড়ছে। পাখি, প্রজাপতি, শস্যক্ষেত্র সব মাড়িয়ে এক বালক শুধু দৌড়ায়। অতীশের চোখে জল এসে গেল!

টুটুল মশারি তুলে তার পাশে শুয়ে লেপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। বুকের কাছে মুখ লুকিয়ে শুয়ে পড়েছে। বলছে, বাবা, আমাকে রেলগাড়ি কিনে দেবে? রেলগাড়ি। অতীশ বলছে, দেব। সব দেব! সব। টুটুলের ফের বায়না, দিদিকে কিচ্ছু দেবে না। দিদি আমাকে মারে। বাবাকে জড়িয়ে টুটুল একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

অতীশ তখন গোপনে টুটুলের পিঠে হাত রেখে খুঁজছে—কোথায় লেগেছে তার। কোথায় তার রক্তপাত!

আর তখনই যেন শুনতে পেল সেই দূরাতীত গ্রহ থেকে কেউ তারবার্তা পাঠাচ্ছে—লাভ ডাজ ব্রিং অ্যাবাউট জাস্টিস অ্যাট লাস্ট, ইফ ইউ ওনলি ওয়েট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *