1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৩১

।। একত্ৰিশ।

অতীশ অফিসে ঢুকতেই সুধীর বলল, বাবু আপনার ফোন এয়েছিল।

অতীশ বলল, কিছু বলেছে?

—আপনি এলে ফোন করতে বলেছে। সুধীর তার টেবিল ডাইরিতে ফোন নম্বর লিখে রেখেছে দেখল। নির্মলাদের বাড়ির ফোন। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। নির্মলা চলে আসায় ওর মেজদি, বাবা মা সবাই বিরক্ত হতে পারে। ওরা কী বোঝে, অতীশের কাছে এলেই নির্মলা ফের অসুস্থ হয়ে পড়বে। নির্মলা তার স্ত্রী কে বলবে!

সে তবু ফোন তুলে বলল, কে বিমলা?

হাঁ। ধরুন। মেজদি কথা বলবে। মেজদি অতীশদার ফোন

ওর মুখটা ভয়ে চুন হয়ে গেল। মেজদির কথাবার্তায় কোনো রাখঢাক নেই। ডাক্তার, তার ওপর গাইনি, কথায় রাখঢাক কম।

—কে? অতীশ!

—হ্যাঁ।

—শোনো, নির্মলা চলে গেছে। ও ঠিকমতো গেছে তো? কারো কথা শুনল না। আর কটা দিন কিছুতেই থাকতে চাইল না। শোনো ওর কিন্তু রেস্টের দরকার। মনে হচ্ছে ভি-সি করতে হবে না। ফ্যাকাসে ভাবটা কেটে গেছে। হিমোগ্লোবিন নর্মাল। আর কিছুদিন থাকলে একেবারে সুস্থ হয়ে উঠত। সে যাকগে, ওকে ভারি কাজ করতে দেবে না। আর শোনো…

অতীশ টের পাচ্ছে, মেজদি কেমন আমতা আমতা করছে ঠিক কিভাবে কথাগুলো বলা যায় বুঝতে পারছে না।

অতীশ এবার কেমন মরীয়া হয়ে বলল, আচ্ছা মেজদি, অসুখটা কি….। ওর কী ইউটেরাসে সত্যি টিউমার হয়েছে!

অসুখটা ইনফেকশান থেকেই মনে হয়। টিউমার হয়নি। হরমোন ডিজব্যালেন্স থেকেও হতে পারে। স্যার গত সোমবার দেখেছিলেন। বলেছেন, নাইনটি পারসেন্ট কিওর। তবে কী জান অসুখটা একটু ভাল হয়ে গেলেই মনে করে সেরে গেছে। হ্যাঁ শোনো, তোমরা কিন্তু মানে… আমি বলছিলাম ওকে আলাদা বিছানায় শুতে দেবে। টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে তুমি আলাদা বিছানায়। বুঝলে কিছু!

অতীশের বলার ইচ্ছে হল, কিছুই বুঝলাম না। কারণ সে জানে আলাদা বিছানা কোনো দেয়াল তুলে দিতে পারে না। সে বলল, হ্যাঁ বুঝেছি! আসলে মেজদি সোজাসুজি না বলে ঘুরিয়ে বললেন,… নিষিদ্ধ। কিন্তু সেতো নির্মলা ঘরে ফেরার পরই…।

সে ফোন ছেড়ে দিতে পারছে না। দুটো চিরকুট হাজির। দুজন কাস্টমার দেখা করতে চায়। একজন আবার কানপুর থেকে এসেছে। বাইরে কুম্ভবাবুদের ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ম্যানেজারবাবুর অনুমতির জন্য তারা অপেক্ষা করছে।

—ওর ওষুধ সব ব্যাগে ভরে দিয়েছি। ঠিক মতো যেন খায়। তুমি দেখবে খায় কিনা!

—দেখব।

—কোনো কমপ্লিকেশন এরাইজ করলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে। ওর স্বভাব তো তুমি জান। নিজের কথা একদম ভাবে না। খুবই অদূরদর্শী। নিজের কষ্টের কথা কাউকে সহজে বলে না।

অতীশ এর কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না।

—এত করে বলি, তোর শরীরটা ভাল না থাকলে ছেলে মেয়ে দুটো মানুষ হবে কী করে, কে দেখবে! অসুখটা একদিনের নয়। আগেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল।

অতীশ সব শুনে যাচ্ছে। যতক্ষণ কথা বলবে শুনে যেতেই হবে। আর কোনো অভিযোগই তো মিথ্যে নয়। নির্মলা যে অদূরদর্শী, চাল নেই চুলো নেই –এমন একটা লোকের সঙ্গে চলে যাওয়াই তার প্রমাণ। নির্মলা খুবই অবুঝ যুবতী। মাঝে মাঝে এটা তার নিজেরও মনে হয়েছে। কতবার বলেছে দ্যাখ, আমরা উদ্বাস্তু, কলোনিতে থাকি, কিছু কুঁড়েঘর, কলা গাছ, পেঁপে গাছ কিছু আম গাছ নিয়ে আমাদের বাড়ি। তুমি ভেবে দেখ। আমার সামান্য স্কুলের মাইনেতে সংসার চলে। জমিজমার আয় তেমন কিছু নেই। অত বড় ঘর থেকে এসে তুমি এডজাস্ট করতে পারবে কিনা!

নির্মলার তখন এক কথা, আমি কি কিছুই বুঝি না মনে কর!

—বুঝবে না কেন! ভুল করছ এটাই আমার বার বার মনে হয়। তোমাকে তো মেজদি বলেই দিয়েছে, তোদের দুজনেরই মাথা খারাপ আছে।

—কার মাথা কত সাফ আমাকে আর বোঝাতে এস না। আমি তোমার সঙ্গে যাব। বাড়িতে ফিরলে আটকে দেবে। তারপর থেকেই মনে হয়েছে যে এতটা ভরসা নিয়ে তার সঙ্গে চলে আসতে পারে, তাকে সে অবহেলা করে কী করে! বরং মনে হয়েছে, কিছু একটা করতে হবে, নির্মলার সম্মান তার সম্মান। নির্মলাকে অপমান করলে তার লাগে। আসলে যেন বাপের বাড়ির মানুষেরা বুঝিয়ে দিতে চায় সে নির্মলার বড় ক্ষতি করেছে। সে ভাবল, এমন কিছু করবে না, যাতে তার বাপের বাড়ির লোকেরা মজা পায়। অবশ্য মজা যে পাচ্ছে, এটা সে নির্মলার অসুখ দিয়েই টের পাচ্ছে। মেজদি আজই ইনফেকশনের কথাটা বলল। এতদিন এটা বলেনি। নির্মলা সেরে ওঠায় বোধহয় এটা বলতে সাহস পেয়েছে। সে নাবিক ছিল এক জীবনে, জাহাজের ছোটবাবু, বন্দরে জাহাজ নোঙর ফেললে নাবিকেরা নেমে যায়। নাবিকের স্বভাব যেমন, যে-কোন ঘরে, যে কোনও নারীর সঙ্গে রাত কাটানো—সে তা থেকে ব্যতিক্রম বিশ্বাস করবে কি করে! বিশ্বাস নাই করতে পারে। মেজদি কী এরপরই বলবে, তোমারও কিছু পরীক্ষা করা দরকার। ব্লাড স্টুল ইউরিন সব।

মেজদি কখন ফোন ছেড়ে দিয়েছে, সে টেরই পায় নি। হঠাৎ কেন যে মাথাটা তার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে—নির্মলার জন্য সে কোথাও যেতে চায়—তার সুখের উৎস সন্ধানে সে বের হয়ে পড়েছে, আর তাকে এত অবিশ্বাস! এমন যে একটা লজঝড়ে কোম্পানির ম্যানেজার, এটাও যেন নির্মলার সুখের জন্য কোনো এক উৎস সন্ধান। রাজার বাড়িতে সে থাকে। রাজার কারখানার সে ম্যানেজার। নাবিক হলেই কি চরিত্র খারাপ হয়, এ কেমন ধারণা! নির্মলাও হয়েছে তেমনি, সহ্যের বাইরে চলে না গেলে সে কিছুতেই তার কষ্টের কথা অতীশকে জানাবে না। পাছে তার মানুষটা অযথা চিন্তা করে। নির্মলা চায় তার মানুষটা সব রকমের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাক। এমনকি সে এও দেখেছে, বাবার মাসোহারা সময়মতো পাঠাতে না পারলে যখন মেজাজ অপ্রসন্ন তার তখন নির্মলার এক কথা, আমি তো আছি। ভাল হয়ে গেলে ঠিক একটা মাস্টারি পেয়ে যাব। তখন অসুবিধা হবে না। তুমি দেখ না, তোমার বন্ধুবান্ধবদের বলে! আমিও কাগজ দেখে এপ্লাই করেছি। হয়ে যাবে মনে হয়। অযথা এতো ভাববে না তো! দুজনে চাকরি করে ঠিক দুটো সংসার চালিয়ে নেওয়া যাবে।

তাকে অপ্রসন্ন দেখলেই নির্মলা কেমন যেন ভয় পেয়ে যায়। এই বুঝি প্যাকেট প্যাকেট ধূপবাতি আনার জন্য ছুটবে। সে তখন দিশেহারা হয়ে যায়। দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় কী নির্মলার তবে হরমোন ডিসব্যালেন্স ঘটেছে! সে তো বলতে পারে না, নির্মলা আসলে এই আমার নিয়তি। বনি আমার ভিতর সাহস যোগায়। আর্চির প্রেতাত্মা আমাকে তাড়া করছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন, ঈশম, কাপ্তান স্যালি হিগিনস আর আমার বাবা। মাথার উপর দেখতে পাই সেই অতিকায় পাখিটা উড়ছে—যে আমাকে বনিকে ডাঙায় পৌঁছে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল।

অথবা সে ভাবে তার নিজের মধ্যেই কি হরমোন ডিসব্যালেন্স ঘটে! মাঝে মাঝে যে-জন্য সে আর্চির প্রেতাত্মাকে দেখতে পায়। অথবা গন্ধ পায়, পচা টাকার দুর্গন্ধ। তার নার্ভাসনেস থেকে যদি এসব হয়। হতেই পারে। সে তো সেই জাহাজে পালিয়ে গিয়েছিল কাজ নিয়ে দুমুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য। তখন নির্মলা ছিল না, টুটুল মিণ্টু ছিল না। বাবা মা ভাইবোনের জন্যে সে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিল। সেই গ্রহে অবশ্য কোনো অশুভ আত্মার প্রভাব ছিল না। সবকিছু ছিল নির্মল—জীবন সূর্যের মতো দিগন্তে উঁকি দিয়ে উঠে আসছিল। কিন্তু বনিই তার কাল। তার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়েই সে আর্চিকে খুন করেছিল। আসলে ওটা তার এক ভিন্ন গ্রহ। সে গ্রহ থেকে ধীরে ধীরে সে কবেই বিচ্যুত হয়েছে। নতুন গ্রহে সে এখন হাজির। মিণ্টু টুটুল নির্মলা তার উপগ্রহ। তাই নিয়ে মহাবিশ্বের অনম্ভ জিজ্ঞাসার মতো মহাকালের গর্ভে এখন সে পাক খাচ্ছে।

আর এ-সময়ই সুধীর এসে বলল, ডাকব স্যার!

সে ফোনটা তাড়াতাড়ি নামিয়ে রাখল। রুমাল দিয়ে মুখ মুছল। টেবিলের ফাইলপত্র একদিকে সরিয়ে রেখে বলল, বল আসতে।

বেশ সুদর্শন এক প্রৌঢ় মানুষ এসেই ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কাস্টমাররা অধিকাংশই অবাঙালী। ভাঙা হিন্দিতে অতীশ তাদের সঙ্গে কথা বলে। যারা অতীশের সঙ্গে কথা বলে, তারা ভাঙা বাংলায় কথা বলে। ফলে উভয়ের কথোপকথনে যে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির হাসির উদ্রেক হতে পারে। অবশ্য, সুধীর কিংবা কুম্ভবাবু অথবা কারখানার অন্য শ্রমিকদের সামনে এমন ভাষাতেই কথা বলার প্রথা—এটা তাদের সহ্য হয়ে গেছে।

কিন্তু এই মানুষটি তাকে বাংলাতেই বলল, বোধহয় প্রবাসী বাঙালী। দেখুন এটা। বলে সে তার ব্যাগ থেকে একটা কালো রঙের কনটেনার বের করল। কনটেনারটি টেবিলে রেখে বলল, আমার চিঠি বোধহয় পেয়েছেন? সব জানিয়েছি।

এতক্ষণে অতীশ মানুষটি কোন কোম্পানির তরফ থেকে এসেছে বুঝতে পারল। গলার টাই সামান্য আলগা করে দিচ্ছিল কথা বলার সময়। টাইয়ের নটে কোনো গন্ডগোল নেই তো! অতীশও জাহাজে কাজ করার সময় টাই ঠিক করতে পারত না। তার সতীর্থরা টাইয়ের কত রকমের নট আছে শিখিয়ে দিয়েছিল। অধিকাংশ এদেশী লোকেরা নটে গন্ডগোল করে থাকে। টান মারলে ফাঁস লেগে যেতে পারে বোঝে না।

—চিঠি! কাস্টমার অতীশকে একটি চিঠি ফাইল থেকে খুলে দেখাল।

—হ্যাঁ। এবারেও ঢাকনা টাইট হয়েছে। ফিটিং ঠিক নেই। বলে কন্টেনারটি অতীশের দিকে বাড়িয়ে দিল। অতীশ ঢাকনা খুলতে গিয়ে দেখল সত্যি বড় বেশি টাইট। ভ্যাকুয়াম করা মুখ। সামান্য লুজ ঢাকনা না দিলে মাল নষ্ট হয়। কামড়ি আলগা হয়ে যায় জোরজার করে ঢাকনা লাগাতে গেলে। চিঠির মধ্যে সব ত্রুটির উল্লেখ আছে।

অতীশ জানে সারা দিনমান এই চলবে। কতজন যে হরেক রকমের সমস্যা নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে থাকবে! অতীশ বলল, ঠিক আছে বিলে লেস করে দেব। তবে চেকিংয়ে লোক যাবে। ডেমেজড কন্টেনার রেখে দেবেন।

কাস্টমারটি এতদিন দেখেছে, যে পারসেন্টেজ ডেমেজ বলে লিখে পাঠাত সিট-মেটাল সেটাই মেনে নিত। এই নতুন ম্যানেজারবাবুর আমলেও সে তিনবার মাল নিয়েছে। দুবার ডেমেজড মালের পারসেন্টেজ কম লিখেছিল বলে, কোম্পানিকে চিঠি লিখেই রিবেট পেয়ে গেছে। কারণ কুম্ভবাবু নতুন ম্যানেজারটি আসার পর চাউর করে দিয়েছে, সাবধান, মাথা খারাপ লোক আছে। হিসেব করে চলবেন। সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লিখে সতর্ক করে দিয়েছে। এতে ধারণা হয়েছে, আরও বেশি দেখালে মন্দ কী! এবং সে শুনেছে, ম্যানেজার কাজ ভাল বোঝেন না। কুম্ভবাবুই তাকে চালায়। কিন্তু এতো ফ্যাসাদে পড়া গেল। কোনো মালই এবারে ডেমেজ হয়নি। কিছুটা রিবেট হাতিয়ে নেবার তালে এসেছিল। কিন্তু এখন যা দেখছে, তাতে বড় অবিশ্বাসের কাজ হয়ে যাবে। অবশ্য ব্যবসাতে এগুলো চালু, এ জন্য কুম্ভবাবু কমিশন নিতেন। অর্থাৎ ডেমেজ এলাউ করলে একটা পারসেন্টেজ কুম্ভবাবুর পকেটে চলে যেত। পুরোনো কর্মীর কথার গুরুত্ব দিতেন ম্যানেজারবাবু।

কাস্টমারটি এমন সরলভাবে কথা বলেছে যে বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। অতীশ যদি মেজদির সঙ্গে ফোনে কথা না বলত তবে বোধহয় সেও রিবেট এলাউ করত। কিন্তু মাথা উত্তপ্ত হয়ে থাকলে যা হয়, সংশয়, শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, সুতরাং সে বলল, আমাদের লোক যাবে।

—কাকে পাঠাবেন?

—আমি নিজেও চলে যেতে পারি।

কাস্টমার ভদ্রলোকটি সহসা কেমন গভীর গাড্ডায় পড়ে গেল। কিন্তু বিষয়ী মানুষেরা সহজে ঘাবড়ে যায় না। টিকে থাকার নাম জীবন এমন ভাবে। অপরপক্ষকে বুঝতে দেওয়াই হবে না, আদৌ সে এ-নিয়ে ভাবছে। কিন্তু অতীশের অত্যন্ত সতর্ক চোখ—বুঝতে পেরে বলল, চা খান। মনে মনে ভাবল শত হলেও কাস্টমার। তারপর বলল, কোথায় উঠেছেন?

কাস্টমারটি সিগারেট বাড়িয়ে দিল। নিজেও একটা ধরাল। কেমন আলস্য শরীরে যেন, চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, এ-জন্য স্যার অতদূর যাবেন! আমরা তো ডেমেজ মাল রাখিনি। স্ক্রাপ করে দিয়েছি। বাজারে কেজি দরে বিক্রি হয়ে গেছে। এবার থেকে রেখে দেব।

অতীশের সামনে ডাঁই করা ভাউচারের ফাইল। সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তবে সই। বিশেষ করে টি-এ এবং এনটারটেনমেন্ট বাবদ খরচগুলি তাকে বেশি লক্ষ্য রাখতে হয়। টাকা পাচার হয়ে যাবার এটা একটা রন্ধ্রপথ

—হয়ে যখন গেছে, কী আর করা। ভবিষ্যতে করবেন না। অতীশ ভাউচারে সই করছে। মুখ না তুলেই কথা বলছে। মুখ তুলে কথা বললে, আজ সারাদিন কেন, আগামীকালও কাজ সেরে উঠতে পারবে না। আজই সনৎবাবু ভাউচারে কাউন্টার সই করবেন বলেছেন। কিছুটা কাজ সেরেই তিনি বলবেন, বাড়িতে পাঠিয়ে দিও। রাতে সেরে রাখব। সনৎবাবু কোম্পানি থেকে যে এলাউন্সটা নেন, সেটা অতীশের মাইনের থেকে বেশি। আসলে রাজা অর্থাৎ রাজেনদা তার মাথার উপর আর একটা চেকপোস্ট বসিয়ে রেখেছে। তার সামান্য মাইনে, লুজিং কনসার্ন হলে যা হয়। যারা আগে কাজ করে গেছে, মাইনের বদলে, এদিক ওদিক থেকে টাকা তুলতেই ব্যস্ত ছিল। মাইনেটা ছিল ফাউ। রাজার এতে খুব যেত আসত না। তিনি একটা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মালিক তাতেই তাঁর সুখ। কিংকর নারায়নের অন্তত তাই ছিল। কিন্তু রাজেন্দ্রনারায়ণ ওরফে, কুমারবাহাদুরের হাতে এস্টেট চলে আসতেই চারপাশে নাড়াচাড়া দিয়ে দেখতে গেলেন, কোথায় কিরকম টাকা ওড়ে। এখানটায় দেখলেন টাকা ওড়ে, তবে যে যার খুশিমতো পকেটে পুরে নিয়ে যায়। কুম্ভবাবু তখন কে কি নেয়, কীভাবে নেয় তার খবর দিয়ে যেত। কারণ কুম্ভ ভেবেছিল চেয়ারটা তার দখলেই আসবে। কারণ তার বাবা রাজার বিশ্বাসী আমলা।

ফোন বেজে উঠল ফের।—হ্যালো।

—রাম রাম বাবুজী।

—বলিয়ে।

—মাল কব মিলেগা।

বেল টিপলে সুধীর হাজির। অতীশ এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল—সুপারভাইজারকে ডাক। তারপর বলল, চা দে।

অতীশ চায় লোকটি এখন উঠে যাক। মালের অর্ডারপত্র কুম্ভবাবু নেয়। কিংবা হরিচরণ। নতুন ছেলেটিকে কুম্ভবাবুই তাকে বলে ঢুকিয়েছে। কারখানা ছোট হলে কী হবে, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি—সব ঝকমারি পোহাতে হয়। ই এস আই, প্রভিডেন্ট ফান্ড, সেল ট্যাকস্, ইনকাম ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, তিনমাস অন্তর অন্তর বোর্ড মিটিং, রেজলিউশন, পারচেজ প্রোডাকশন রেজিস্টার, এমন হরেক রকমের কত দায় আছে তার। কোনো সেক্রেটারি নেই। ব-কলমে বলতে গেলে সনৎবাবুই ওপর ওপর সেটা করেন। কাজ মেলা বলেই হরিচরণ কুম্ভবাবুর লোক হওয়া সত্ত্বেও অতীশ অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে রাজি হয়েছে। জানে হরিচরণ কুম্ভর বাধ্যের—কুম্ভ ঢুকিয়েছে, বাধ্য না হওয়াটাই অস্বাভাবিক কিন্তু যা তাকে পীড়ন করে, হরিচরণের মতো সৎ ছেলেটিকে কুম্ভবাবু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অসাধু করে তুলবে! সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না দিলে কিংবা সে যদি পছন্দমতো অন্য লোককে নিত–পারত না। কুম্ভর বাপ রাধিকাবাবুকে দিয়ে রাজার কানে তুলত, কী কাজ, ওটা আমরা তুলে ফেলতে পারি। পারি বলে ঠিক, কিন্তু পরে অতীশকে ঝুলিয়ে রাখার স্বভাব। কোনো রিটার্ন ঠিক সময়ে সাবমিট না হলেই অতীশের নামে চিঠি। সময়ে এরিয়ার পড়লে তার নামে চিঠি, মাঝে মাঝে অতীশের হাত কামড়াতে ইচ্ছে হয়—এ কি জগঝম্প জায়গা! এক দন্ড মাথা তুলবার ফুরসত নেই। তারপর ইউনিয়ন, কর্মী বিক্ষোভ, ই এস আইয়ের দৌলতে ফলস্ মেডিক্যাল– কোম্পানির হাফ মাইনে, অন্যত্র ফুরনে ডবল রোজগার—নিজের বিট মেশিন, কামড়ি মেশিন ফেলে অন্য কনসার্নে ফুরনে কাজ চলে। বেটারা বেইমান। মরবি। সব মরবি। আমিও মরব। তোরাও মরবি। পাশাপাশি আরও কয়েকটা সিট মেটালের কারখানা আছে। সবগুলিরই ব্যক্তিগত মালিকানা। নো প্রোডাক্সন, নো পে। এমন একটা লজঝড়ে ভাঙা জাহাজ বন্দরে ভিড়িয়ে দেওয়ার সাধ্য তার কেন, কাপ্তান স্যালি হিগিনসেরও ছিল না।

সুপারভাইজার এলে ফোন দিয়ে বলল, কথা বলুন।

অতীশ দেখল সুধীর তখন চা দিয়ে গেছে। সে ভাউচারে সই করতে করতে কথা বলছে কাস্টমারের সঙ্গে, টুটুলটা আবার ফাঁক পেয়ে দরজা গলিয়ে পুকুরপাড়ে চলে যায়নি তো! পুকুরটা একটা মারাত্মক বধ্যভূমি মনে হয়। টুটুলকে আসার সময় বার বার সাবধান করে আসে। ইস নির্মলাকেও বলতে ভুলে গেছে, দরজায় তালা দিও, নাহলে কোন ফাঁকে পরী খুঁজতে বের হয়ে যাবে টুটুল। সামনে বিশাল পুকুর, পড়ে টড়ে গেলে সর্বনাশ।

আসলে অফিসে বের হবার মুখে সে খুব খুশি ছিল না। স্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘদিন পর অন্তরঙ্গতার সুখ কোনো এক সুষমায় নিয়ে যেতে পারত তাকে—কিন্তু বার বার একটা মুখ, চারু, চেনা নেই জানা নেই, সে যে কী করে বসল! এটা ব্যাভিচার! এই অপরাধ বোধ থেকে নির্মলার সঙ্গে বের হবার সময়ও একটু হেসে কথা বলতে পারে নি। চারুই তাকে পীড়নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফলে সব ভুলে গেছে। স্টেশনে পিয়ারিলাল চারুকে ট্রেনে তার সঙ্গে তুলে না দিলে জানতই না চারু বলে কোন যুবতী আছে পৃথিবীতে। এখন কুন্তবাবু বলছে, চারু বলে কেউ নেই। সবটাই আপনার ঘোর থেকে! নির্মলাকে বলেনি তালা লাগিয়ে দাও। নির্মলার যা ভুলো মন কিংবা এতদিন পর বাপের বাড়ি থেকে এসে সব গোছগাছ করতে যদি ব্যস্ত হয়ে পড়ে! বের হবার মুখে বলা উচিৎ ছিল, খেয়ে শুয়ে পড়বে। আমি এসে করব। তবে কতটা শুনত সে বিষয়ে তার সন্দেহ আছে। মাস খানেক বাপের বাড়ি থাকলে যা হয়, সব এলোমেলা।

—উঠি স্যার।

—হ্যাঁ, আচ্ছা। ঠিক আছে মালের অর্ডার পাঠালে একটু আগে পাঠাবেন। এখন নরম টিনের বড় অভাব। লাইসেন্স, কোটা কখন কি মিলবে বলা মুশকিল। বাজার থেকে ইমপোর্টেড টিন তোলা যায়—হার্ড, খুবই হার্ড, দাম তিনগুণ। হার্ড বলেই কামড়ি খুলে যায়।

অতীশ দরজা পর্যন্ত কাস্টমারকে এগিয়ে দিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসল।

সুপারভাইজার তখন কাকে যেন বলছে, ও আমি কিছু বলতে পারব না। ম্যানেজারবাবুকে সাথ বাত কিজিয়ে।

অতীশ বলল, আপনি যা হয় বলে দিন, আমাকে দেবেন না।

সুপারভাইজার মহাফাপরে। কী করে! ফোনের মুখ চেপে অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, এ সপ্তাহে মাল যাবার কথা ছিল।

—গেল না কেন?

—পি সি আর সি টিনই নেই।

—তার মানে!

—বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।

—ওকে বলে দিন তবে। আমাকে দিয়ে কী হবে?

—শুনতে চাইছে না। বলছে, ওর লোকজন বসে যাবে। লোকসানে পড়ে যাবে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।

কেমন তিতিবিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, বলিয়ে।

–মাল কব মিলেগা বাবুজী?

—দেখি কী করতে পারি। বলেই সে ফোন ছেড়ে দিল। কুম্ভবাবুকে ডেকে পাঠাল। বলল, শেঠজীর মাল এ হপ্তায় দেবার কথা ছিল।

—এই অর্ডারবুকটা নিয়ে আয় তো। কুম্ভ গলা বাড়িয়ে হরিচরণকে ডাকল।

কুম্ভ এতেও মজা পায়। মাল কথামতো না দিতে পারলে দায় অদায় সব ম্যানেজারের। তবে একটা জায়গায় সহসা খচ করে কামড় দিল। তিনি তো মাসখানেক ছুটিতে ছিলেন। তার চার্জে ছিল সব। কুম্ভ সম্ভবত হারতে রাজি না। অর্ডার বুকটা উল্টে পাল্টে দেখে বলল, তাই কথা আছে।

—গেল না কেন?

অতীশ খুব গম্ভীর। মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। ভাউচার দেখছে। সই করছে।

—যাবে কী করে! জোর করে যদি অর্ডার লিখিয়ে যায়, আমরা কী করব! এত করে বললাম, শেঠজী হবে না, বাজারে মাল নেই—দিন তো ফোনটা বলেই সে শেঠজীকে ফোনে পেয়ে গেল। আরে আপতো আচ্ছা আদমি হ্যায়। আপলোগকো বোলা না বাজার মে মাল মিলতা নেই। জোরজার কিয়া, হামলোক ক্যা করেগা,আপতো বোলা না, ঠিক আছে লিখে নিন, পেলে দিবেন। না পেলে কোত্থেকে দিবেন!

অপর প্রান্তে কী কথা হচ্ছে অতীশ বুঝতে পারছে না। সে শুধু কুম্ভর কথাই শুনছে।

কুম্ভ ফোন ছেড়ে দিয়ে বলল, যত্ত সব গাঁজাখোর লোক নিয়ে পড়া গেছে। কিচ্ছু মনে রাখতে পারে না। অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলেন, বললাম হবে না, পি সি আর সি বাজারে নেই। কিছুতেই মানবে না। নেই—আসবে। বাজার খালি থাকে কখনও। লিখে নিন। হয়ে যাবে। নিজে গাঁজা ভাঙ খায় বলে, ওকী ভাবে আমিও শিবঠাকুর। একেবারে জোঁকের মুখে নুন।

অতীশ এত কথা শুনতে চায় না। সে বলল, বাইরে যারা বসে আছে, ওদের কথা বলে ছেড়ে দিন। দেখছেন তো কী হয়ে আছে টেবিল!

কুম্ভর ভিতরে তখন নানা কারণে উচাটন। যেভাবে খুঁটিয়ে সব ভাউচার দেখছেন তাতে করে ধরা পড়ে যেতে পারে। স্ক্র্যাপ বিক্রির টাকা এত কম কেন! ডায়মন্ডহারবার কেন গিয়েছিলেন। যাওয়া আসার ট্যাক্সি বিল কেন, সে হেসে বলল, দাদা অত খুঁটিয়ে দেখলে আজ কেন আগামী সপ্তাহেও শেষ হবে না। আমি দেখে রেখেছি নিশ্চিন্তে সই করতে পারেন।

অতীশ ভাবল সে পারে ঠিকই। যা ভাউচার হয়ে গেছে তা আর পাল্টানো যাবে না। সনৎবাবু তাকে শুধু বলবে, এগুলো মিস-ইউজ অফ মানি। কুম্ভ যে এসব জায়গায় না গিয়েও কোম্পানির টাকা মেরে দিচ্ছে, সোজা কথায় চুরি করছে—কিছুতেই সনৎবাবু তা বলবেন না। কেবল তাকে বলবেন টাকা যাতে মিস-ইউজ না হয় দেখবে। পরে তিনি কুম্ভকে ডাকবেন, ডেকে সব জানতে চাইবেন—কেন কি দরকারে—কিন্তু প্রতিবারই দেখেছে, এমন সব অকাট্য যুক্তি তুলে ধরে কুম্ভবাবু যে, কোম্পানির ভালর জন্যই এই টাকা খরচ করতে হয়েছে। সনৎবাবুর মত প্রবীণ এবং ঘুঘু লোকও টের পান সব, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না। কেবল বলবেন, ঠিক আছে,এ-ধরনের কাজে আমাকে আগে বলে নেবে। ব্যাস এই পর্যন্ত। এবং সনৎবাবু যতক্ষণ থাকে কুম্ভবাবুর মুখ বড় মলিন, এবং আজ্ঞাবহ দাস, তার নিজস্ব পৃথিবী বলতে কারখানা ছাড়া আর কী আছে—এমন মুখ। শুধু একটা জায়গায় তার জোর, বাবা তার রাজার দু-নম্বরী টাকার হিসাব রাখে। বেশি ঘাঁটাতে সাহস পাবে না। কুম্ভ বলল, না দাদা, বাইরে যারা আছেন, ওদের সঙ্গে আপনিই কথা বলুন।

—ওরা কী জন্যে এয়েছে জেনে নিন, কেন আমার সঙ্গে দেখা করবে।

–এরা বস্তির লোক। আমাকে কিছু বলবে না। আপনার সঙ্গে ওরা কথা বলবে বলছে। অতীশের মুখটা কেন জানি খুব গম্ভীর হয়ে গেল। কুম্ভবাবু তাহলে এদের চেনে। এই গোটা বস্তি অঞ্চলটাই রাজার। ট্যাক্স আদায়, বিল, ভাড়া সব রাজার প্রাইভেট অফিস থেকে আদায় হয়। রাজবাড়ির শ্রীনাথ প্রতিদিন এই অঞ্চল ঘুরে যায়। তারই কত দাপট সে দেখেছে। আর কুম্ভবাবুর বাপ, রাজার বড় আমলা, কুম্ভবাবু রাজবাড়ির বড় আমলার জ্যেষ্ঠপুত্র। তার দাপট আরও বেশি থাকার কথা। অথচ নিজে কথা না বলে তার কাছে ভিড়িয়ে দিতে চাইছে।

অতীশ বলল, এরা আপনাকে চেনে?

—চিনবে না কেন?

—ওরা জানে আপনি সুপারিনটেনডেনটের ছেলে?

কুম্ভ ঠিক বুঝতে পারছে না, অতীশবাবু তার সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন কেন!

কুম্ভ হাতের আংটি আলগা করে অন্য আঙুলে ঢোকাচ্ছে। বিচলিত হলে সে এটা করে।

—কী, জানে ওরা? আপনি রাজবাড়ির প্রভাবশালী মানুষ

—জানবে না কেন!

—তাহলে আপনিই কথা বলুন। আমার সময় হবে না। বলুন। আপনার কাছ থেকে আমি পরে জেনে নেব।

কুম্ভ আর পারল না। ফস করে বলেই ফেলল, আমাকে বলেছে।

—এই যে বললেন বলেনি। অতীশ মাথা তুলছে না।

—না মানে, ওরা আমাকে ধরেছে, আমি বলছি, আমার কোনো কথা দেবার ক্ষমতা নেই।

—আপনার না থাকলে আমার থাকবে মনে করলেন কি করে?

—আপনি ওপরওয়ালা। কথা দেওয়া না দেওয়া আপনাকেই মানায়।

—ঠিক আছে, আমি আপনাকে আমার হয়ে কথা বলতে বলছি। আপনি যা বলবেন, ধরে নেবেন এটা আমারই কথা। দায়দায়িত্ব আমার। নিন, কথা বলুনগে। আসলে অতীশ কোনরকমে এই কঠিন জট থেকে আত্মরক্ষা করতে চায়। মনে হয় সবটাই প্রেতাত্মা আর্চির কাজ। কুম্ভ যেন আর্চির প্রেতাত্মা বহন করে বেড়াচ্ছে।

কুম্ভ এমন ফাঁপড়ে পড়বে আগে অনুমান করলে কিছুতেই এদের লেলিয়ে দিত না। আসলে সে চেয়েছিল, বুঝুক ম্যানেজারগিরি করা কাকে বলে, ঠেলা কতদিক থেকে আসে। রাজা নতুন কারখানা করছে, বিল্ডিং উঠবে, ক্যানেস্তারা মেশিন বসবে, নতুন শেয়ার ফ্লোট করবে রাজা, বস্তির সব পান্ডাদের বলে বলে মাথাভারি করে রেখেছে। এই তল্লাটে কারখানা, পান্ডাদের সঙ্গে দেখা হলেই এক কথা, কুম্ভবাবু আর কিন্তু মানব না। পাড়ার একটা ছেলে কাজ পাবে না। বে-পাড়ার লোকে ভর্তি করে রেখেছেন। বস্তির বেকার যুবকরা যাবে কোথায়!

কুম্ভ ওদের বলেছিল, আমি কে? জানেনই তো, আগে ছিল বুড়ো ম্যানেজার, সে তার দেশবাড়ি থেকে সব লোক সাপ্লাই করেছে। এখন নতুন ম্যানেজার এসেছেন, গোঁয়ার লোক, নিজে যা বুঝবে তাই করবে। এক চুল নড়ান যাবে না। মাথার গোলমাল আছে। যখন তখন ধূপবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকে।

—গোলমাল!

—আরে মশাই অই। কারখানা চালাবে, ঘুষ দেবে না, খোলাবাজার থেকে মাল কিনতে গেলে নিজে দরদাম করবে! তুই কারখানার ম্যানেজার এসব কী তোর শোভা পায়! আমরা আছি কী করতে! চরম অবিশ্বাস আমাদের। ভাল করলেও খারাপ, খারাপ করলে তো কথাই নেই। এই তো রাজা নতুন ক্যানেস্তারা মেশিন কিনবে, নতুন বিল্ডিং হচ্ছে, আপনাদের একটা ছেলে কাজ পাবে? পেলে আমার কান মলে দেবেন।

—কেন পাবে না। এটা কি তার বাপের জমিদারী!

—সে আর কে বলে! আপনারা দেখা করে আগে থেকেই গাওনা গেয়ে রাখুন। আমি তো আছিই। বাবাও বলেন, রাজার বস্তি, বস্তির বেকার যুবকেরা কাজ পেলে রাজারই সুনাম তারাই এখন এসেছেন।

কুম্ভকে এখন তাদের সামলাতে হবে। অতীশবাবু এমন প্যাঁচে ফেলে দেবে সে অনুমানই করতে পারেনি। অতীশবাবু ভুল করলে সাতখুন মাপ, –ও কী বোঝে নতুন, তুই তো জানিস সব, জেনে তুই অতীশ বলল বলেই—এ ভাবে ওদের কথা দিলি!

কী করব! অতীশবাবু বললেন, ওঁর হয়ে কথা বলতে।

ঠিকই করেছে। ও কী বোঝে সব! কুম্ভর মাথায় চড়াৎ করে একটা কাক যেন মল ছিটিয়ে চলে গেল। এমনই মনে হচ্ছে, রাগে ক্ষোভে সে কি করবে বুঝতে পারছে না। বোঝে না তো এখানে বসালে কেন! কে বলেছিল? এত প্রাণপাত করা, তবু বিশ্বাস নেই। আমি ছ্যাঁচড়া স্বভাবের। আমি কিছু জানিনা। যা বলবে করব, তার একচুল বাইরে যাব না। সে বিরক্ত মুখে বের হয়ে গেল। অতীশ লক্ষ্য করল না যাবার মুখে ওর দিকে তাকিয়ে কুম্ভ কী দেখছিল! চোখ জ্বলছিল। কাউকে খুন করার আগে মানুষের চোখে এমন আগুন জ্বলে ওঠে।

ঘাড় গুঁজে কতক্ষণ থাকা যায়। কুম্ভ বের হয়ে গেলে অতীশ সোজা হয়ে বসল। ঘাড়ে হাত বুলোচ্ছে। পিঠটা কেমন ধরে গেছে। হরিচরণ গুচ্ছের বিল রেখে গেছে। তার সই। পে-বিলের কতটা হল, কে জানে! ব্যাংক ব্যালেন্স দেখল। মাসের পয়লা তারিখ যত এগিয়ে আসে তত যেন সে দুশ্চিন্তায় ঘুমোতে পারে না। টাকা সংগ্রহের জন্য তখন তার কুম্ভকে সঙ্গে নিয়ে ছোটাছুটি। বার্নিশ, রঙ, টিন, লিথো, ডাইস এ সব মজুদ না থাকলে চলে না। সানরাইজ বার বার লোক পাঠাচ্ছে। এক গাদা বিল বাকি কোন দিন দুম করে বলে না বসে, এত বাকি রাখা যাবে না। অন্তত কিছু দিন—কিছুটা দিতে গেলেই কয়েক হাজার, মাইনের টাকায় টানাটানি, কী যে করবে!

এই অফিস ঘরটায় এসে বসলেই অতীশের মধ্যে কেমন আতঙ্ক জেগে ওঠে। কথা রাখতে পারে না। কথা না রাখতে পারলে অজস্র মিছে কথা বলতে হয়। তাও সে পারে না। সাফ এক কথা, নেই। দেব কোত্থেকে? কুম্ভ কাছে থাকলে রেগে যায়, নেই বললেন কেন, যদি লোকে টের পায় কারখানার অবস্থা ভাল না, তবে আর মাল দেবে? ঘুরিয়ে বলতে হয়। বলবেন, আদায়পত্র হচ্ছে না। হলেই দেবেন। নেই বলবেন কেন!

আসলে তখন অতীশের ক্ষোভ বাড়ে। কেন যে মরতে এল এমন একটা কারখানায়! সে আবার তার স্কুলজীবনে ফিরে যেতে পারলে যেন বেচে যেত। বার বারই ভাবে—কিন্তু পারে না। কলকাতা নামক এই মহানগরী তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। লেখা-লেখির সুবিধা। ফোনে সবাই তাকে হাতের কাছে পায়। কলকাতায় না থাকলে যোগাযোগটা যেন সব তার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কেমন অসহায় চোখে চারপাশটা দেখে। জাহাজের সে ছোটবাবু, সে এক জীবন গেছে। ছোটবাবু এসে তখন মাথায় ভর করতে চায়। দিগন্ত প্রসারিত অসীম অনন্ত সমুদ্র। কাপ্তানের নির্দেশে বোটে তাদের ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে আর বনি। বোটের পাল তোলা। কমপাশের কাঁটা নর্থ-ইস্ট-ইস্ট। দাঁড়ে হয় বনি, না হয় সে। ডাঙার সন্ধানে কাপ্তান স্যালি হিগিনিস শেষ আশ্রয় ভেবে তাদের ভাসিয়ে দিয়েছেন। ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। জাহাজ বিকল। হাজার হাজার মাইল ব্যাপ্ত সমুদ্রে জাহাজীরা আগেই বোটে জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। জাহাজে ছিল, সে বনি, বুড়ো কাপ্তান আর সারেং। শেষ নির্দেশ এবার তোমাদের পালা। তিনি কী জানতেন, সমুদ্র তাদের আজ হোক কাল হোক গ্রাস করবে। একমাত্র শেষ অবলম্বন বনির মৃত্যুদৃশ্য চোখের ওপর দেখতে হবে ভেবেই বোটে কাপ্তান তাদের ডাঙার সন্ধানে যাবার জন্য কি জাহাজ থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন! নামার আগে, ফল্কার এক অদৃশ্য গহ্বরে নামিয়ে প্রায় কাপালিকের মত কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন! সব কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। যেন অন্য জন্মের কথা। সঙ্গে বাইবেল এবং একটা ক্রশও দিয়েছিলেন তিনি।

এই কারখানায় ঢুকলেও তার মনে হয় সেই এক অজানা সমুদ্রে সে ভাসমান। একই বোট, দড়িদড়া,পাল, শুধু বোটে এখন বনি নেই—আছে নির্মলা, টুটুল মিণ্টু। আগের বার সে শুধু বনিকে ডাঙায় পৌঁছে দেবার জন্য অকুলসমুদ্রে যাত্রা করেছিল, এবারে সে নির্মলা টুটুল মিণ্টুকে ডাঙায় পৌঁছে দেবার জন্য যাত্রা শুরু করেছে। কে জানে মাঝপথে তার বোট সমুদ্রের গর্ভে তলিয়ে যাবে কিনা সে চোখের সামনে কোন কূল-কিনারা দেখতে পাচ্ছে না। সেই এক অসহায় চোখ, মাথার মধ্যে অজস্র মরীচিকা ভেসে বেড়ায়। এখানেও আর্চির মতো তার শত্রুপক্ষ কুম্ভ।

এক-এক সময় মনে হয় বনি এবং সে যাত্রা শুরু করেছিল নিরুদ্দেশে, তার লিপি লিখে রাখলে কেমন হয়। নতুন একটা সাপ্তাহিক বার বার তাগাদা দিচ্ছে, এবারে কিছু ধারাবাহিক শুরু করুন। আপনি যা লিখবেন তাই ছাপব। এই একটা জায়গায় তার খুঁটি এখনও শক্ত আছে। রাত জেগে লিখতে বসলে, কেমন এক অলৌকিক প্রভায় সে ভেসে যেতে পারে। জীবনের সব কিছু অতি তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয়, মানুষের জীবনটাই এক অলৌকিক জলযান। সে অকূল সমুদ্রে যাত্রা করেছে। সে জানে না, কাল কি হবে, জানে না, সে কোথায় যাচ্ছে, জানে না, এই অলৌকিক যাত্রার কী উদ্দেশ্য। কে সে? কোন অমোঘ নিয়তি তাকে বধ্যভূমির দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!

আবার ফোন! কার? সে বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরতেই টের পেল পিয়ারীলালের গলা। সে চমকে উঠল।

—বাবুজী!

—হ্যাঁ।

—রাম রাম।

অতীশের মনে হল সে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে আছে। কথা বলতে পারছে না।

—বাবুজী! বাবুজী!

সে জেগে ওঠার মতো বলল, বলিয়ে।

—তবিয়ত ঠিক নেই?

—না আছে।

—কুম্ভ বাবুকো সাথ বাতচিত থা। উনকো দিজিয়ে না।

আর তখনই মনে হল, চারু। সেই শ্যামলা মেয়ে, সে তো তার খোঁজে যাবে বলে আকুল হয়ে উঠেছিল। একই ট্রেনে, একই কামরায়!

অতীশ বলল, শেঠজী চারু তো দু স্টেশন আগে নেমে গেল। ও ভাল আছে?

—চারু! ও কোন্ হ্যায়?

—আপকা ভাইঝি।

—নেই। চারু হামার কেউ হয় না।

—ঠিক বলছেন! আপনি স্টেশনে তুলে দিলেন। রাতের ট্রেন। ভুলে গেলেন?

—সাচ বাত বাবুজী! এ তো ভারি গড়বড়কা বাত আছে!

অতীশ আবার কেমন তলিয়ে যাচ্ছিল। সে তো ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত চারু বলে কেউ আছে। তবে কী ঘোরে পড়ে এটা হয়েছে। হরমোন ডিজব্যালেন্স। তার হাত-পা কেমন কেঁপে উঠল। চিৎকার করে বলল, না, না, আপ ঠিক বাত বলছেন না। চারু বলে কেউ আছে। সে কোথাও আছে। তাকে আমায় খুঁজে বের করতেই হবে। ওর কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নেব। খালি কামরায় চারু আর আমি, চারু আমাকে না বলে নেমে গেছে।

এত জোরে চিৎকার করে উঠেছে যে, কুম্ভবাবু হরিচরণ পর্যন্ত ছুটে ভেতরে ঢুকেছে। ম্যানেজারবাবুর আবার কিছু হয়নি তো! ওদের দেখেই বলল, চারু বলে কেউ নেই কুম্ভবাবু। পিয়ারিলাল নিজেই বলল, কেউ নেই। চারু তার কেউ হয় না। আপনি কথা বলুন।

কুম্ভ বলল, দিন। তারপর ফোন ছেড়ে দিয়ে অতীশ বড় কাতর কলায় বলল, সুধীর এক গ্লাস জল খাওয়াবি?

কুম্ভ কেমন শাসনের গলায়, অতীশকে বলল, আপনার যে কী হয় বুঝি না দাদা! সে ফোনে বলল, পিয়ারিলাল ক্যা বাত! তারপর সে ফোনের মুখ চেপে বলল, কেউ তো আপনাকে ফোন করেনি। ও পার তো ফাঁকা, কার সঙ্গে কথা বলছিলেন! দেখুন না।

অতীশ এমন চোখে তাকিয়ে আছে যে দেখলে ভয় হয়। চোখ ঘোলা, মাথায় এখন বাবুটির সব উধাও! বাবুটি ফোন ধরতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে।

অতীশ আর পারল না। পিয়ারি নিজে কথা বলেছে, আর কুম্ভবাবু বলছে, কেউ কথা বলছে না। ফোনটা ধরতেও তার ভয় হচ্ছে। সত্যি যদি কেউ কথা না বলে, তবে সে কে, কে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথা কয়ে ওঠে। এক সময় ছিল আর্চি, এখন কী তবে অদৃশ্যলোক থেকে পিয়ারিলালের গলায় কেউ কথা বলে। সেই প্রেতাত্মা কি পিয়ারিলালের গলায় তার সঙ্গে কথা বলেছিল। মিণ্টু টুটুল ভাল আছে তো। বিশাল এলাকা জুড়ে রাজবাড়ি, মাঠ পুকুর, মেসবাড়ি, বাবুপাড়া, বাবুর্চিপাড়া, গোলাঘর, ভুট্টার জমি, সব মিলে এক অরণ্য, সেই অরণ্যে টুটুল মিণ্টু নির্মলা যদি হারিয়ে যায়! আর্চির প্রেতাত্মা প্রলোভনে ফেলে দিতেই পারে। ছোট্ট টুটুল, মিণ্টু পরী থাকে রাজবাড়িতে শুনেছে। দুমবার সিং বলেছে, কুয়াশার জালে পরীরা আটকে যায়। দুমবার সিং বলেছে, টুটুলকে ছোট্ট পরী ধরে দেবে। পরীর খোঁজে টুটুল যদি একা বের হয়ে যায় এবং পুকুরের জলে টুপ করে ডুবে যায়—যেভাবে আর্চি পিয়ারিলালের গলা নকল করে কথা বলল, তাতে করে সে দুমবার সিং সেজে, টুটুল মিণ্টুকে পরীর লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাবে না কে বলতে পারে। তারপর পুকুরে ডুবিয়ে যদি মেরে ফেলে বলে, ছোটবাবু, প্রতিশোধ, আমি বনিকে রেপ করেছি তুমি ট্রেনে চারুকে কী করেছ! তোমার তো নির্মলা আছে, তবু কেন চারুকে তুমি….

অতীশ কেমন সত্যি ঘোরে পড়ে যাচ্ছে। তারই সামনে দাঁড়িয়ে কুম্ভ ফোনে পিয়ারিলালের সঙ্গে সঙ্কেতে কথা বলছে।

অতীশ ভিতরে প্রায় পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিল। সে বলল, আমি যাচ্ছি কুম্ভবাবু। সুধীরকে বলল, একটা ট্যাকসি ডেকে দে।

সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে, না না, আমি চারুকে রেপ করিনি। চারু আমাকে প্রলোভনে ফেলে দিয়েছিল। চারু…চারু…

আর্চির সেই তীক্ষ্ণ হাসি, বনি আমাকেও সেই প্রলোভনে ফেলে দিয়েছিল। কেবিনে ঢুকে গেছিলাম। তারপর সমুদ্রে থাকলে যা হয়, অমানুষ, এক নারী শুধু জাহাজে, বালিকা যুবতী হয়ে উঠছে, তুমি জানতে, সে বালিকা, আর আমি, আর সবাই জানত, কাপ্তানের ছেলে জ্যাক। পুরুষের পোশাকে বনি জ্যাক সেজে সবাইকে প্রতারণা করেছে।

—না না জ্যাক প্রতারণা করেনি!

–করেছে। মেয়ে পুরুষের বেশে থাকলে প্রতারণা হয় না!

—না আর্চি, দোহাই তোমার, কেবিনে ঢুকে তুমি কেন তাকে রেপ করতে গেলে! কেন কেন! মাথা আমার ঠিক ছিল না। আমি বালিশে তোমার মুখ চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কেউ জানত না। কেবল তার সাক্ষী আমি আর বনি। ঝড়ের সমুদ্রে ফেলে দিয়েছি। তারপর দেখি না আরও একজন টের পেয়ে গেছেন। তিনি কাপ্তান। শুধু বলেছেন, ছোটবাবু, উই স্যাল হেভ টু সাফার। ম্যান ক্যারিং দ্য ক্রস। কেন কথাটা বলেছিলেন বুঝতে পারছি। আর্চি তোমার যেশাসকে মনে পড়ে, তিনি ক্রস বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন বধ্যভূমিতে। কেন সেটা? ওটা আর কিছু নয় আর্চি, ওটা হল সিমবল। মানুষ জন্মেই পিঠে ক্রস বহন করে বধ্যভূমির দিকে এগোয়। ইট ইস দ্য সিমবল, ইট ইস দ্য সাফারিং অফ হিউম্যান ম্যানকাইন্ড। আমি চারুকে না হলে খালি কামরায় পাগলের মতো জড়িয়ে ধরবো কেন!

আর তখনই সেই অদ্যশ্যলোক থেকে হাহাক্কার হাসি।

অতীশ ট্যাকসির মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

—ওরা কেমন আছে কে জানে! তখন ফোনে কুম্ভ বলল, তুমি বলেছ, চারু বলে কেউ নেই!

—হ্যাঁ বলেছি।

—খুব ভাল করেছ। তোমার দু-নম্বরী মাল মিলে যাবে। চারুই পারবে সব। যে দেবতা যাতে তুষ্ট। টাকা দিয়ে পারলে না, তাই চারুকে দিতে বললাম। ও কী বলে!

—কিছু বলছে না!

—ট্রেনে কিছু হয়নি!

—কিছু বলছে না!

—আরে বেশ্যা মেয়েছেলের এত দেমাক কিসের। খেতে দাও পরতে দাও, পাউডার কারখানার মেয়েদের দিদিমণি করে রেখেছ, এত সুখ তবু কিছু বলছে না!

—না।

হঠাৎ কুম্ভ কেমন মুখ গোমড়া করে ফেলল, সাবধান, চারু যেন সব ফাঁস করে না দেয়। আমরাই যে চারুকে বাবুটির সঙ্গে তুলে দেবার যড়যন্ত্র করেছিলাম, কেউ যেন জানতে না পারে। ম্যানেজার বাবু তো চারু চারু করে পাগল। পিয়ারি একটা কথা মনে রাখবে, রাজা কিংবা বউরাণীর কানে কথা উঠলে আমার চাকরি যাবে, তোমার ব্যবসা লাটে উঠবে।

—উঠবে না বাবুজী। হাম তো হ্যায়।

এখন একটাই কাজ বুঝলে পিয়ারি। চারু চারু করে বাবুটিকে পাগল করে ফেলা। ফোনে চারু যেন কোনোদিন রা না করে। তুমিই বল, সেই কবে থেকে কারখানার জন্য এত করছি, কোথাকার একটা আধ পাগলা লোক উড়ে এসে জুড়ে বসল। সয়? তুমিই বল। বেটাকে পাগল না বানাতে পারলে আমার নিস্তার নেই। ঈশ্বর মানে না, ধর্ম নেই, বামুনের ছেলে, গলায় পৈতা রাখে না, অধর্ম হয় না! বেটা নিজের ঘায়ের জ্বালাতেই দেখবে একদিন পাগল বনে যাবে। রাজবাড়িতে ঢুকলেই নাকি পচা টাকার গন্ধ পায়!

—পচা টাকা!

—হ্যাঁ তুমি এলেও পায়। তখন ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকে।

—বহুত মুসিব্বত কী বাত।

—হ্যাঁ। মুসিব্বত যারে কয়। চারপাশ থেকে জড়িয়ে ফেলতে চাইছি। যাবেটা কোথায়! আমার পিতৃদেব আছেন, রাজার দু-নম্বরী টাকার হিসেব রাখে। আমাকে এ জন্য ঘাঁটায় না। কিন্তু বুঝলে—

—কিন্তুটা কী বাবু?

—আরে বউরাণীর পেয়ারের লোক অতীশবাবু। চেহারাখানা সাধু-সম্ভের মতো। দেখছো না। কী বড় বড় চোখ আর কী উঁচু লম্বা, কি গায়ের রঙ। বউরাণী পর্যন্ত ক্ষেপে আছে। কব্জা করার তালে আছে। খুব সাবধানে এগোতে হবে বুঝলে? বলেই পেছনের দিকে তাকাল। না কেউ নেই। কারখানা ছুটি হয়ে গেছে। সে একা।

—রাতে কি হয়েছে জান?

—না বাবুজী।

—অতীশবাবু দেশে ছুটিতে গেছিল। অতীশবাবুর কোয়ার্টার, বউরাণীর অন্দর মহলের ঠিক পেছনে বুঝলে! আচ্ছা তবে শোন, বৌকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে অতীশবাবু দেশে গেছিল ছুটিতে। কিছু বুঝলে? তবে শোন, বউরাণী কোয়াটার রঙ করে, ঘরে সব দামী আসবাবপত্রে সাজিয়ে রেখেছিল গোপনে, অতীশবাবু এলেই বেশ জমে যাবে। রাজা মানে কুমারবাহাদুর, বাইরে। তিন চার মাস আসছেন না বুঝলে? শরীর মানবে কেন! আর এমন দশাসই চেহারা, বউরাণীও কম পাগল নয় বুঝলে। কী বুঝলে!

পিয়ারি শুধু বলল, সব বুঝি বাবু, নালে চারুকে তুলে দিতে যাব কেন ট্রেনে!

আর তখন অতীশ রাজবাড়ির সদর গেট পার হয়ে যাচ্ছে। রোজ এ সময় বাবার অপেক্ষায় মিণ্টু টুটুল সামনের বাগানটায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর চিৎকার—বাবা আসছে। অতীশ দেখল, ওরা নেই।

মনটা তার খচ করে উঠল।

এখানে নাও থাকতে পারে। হয়ত নতুন বাড়ির পেছনে বাঁক নেবার মুখে ওরা দুজনে গলা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাবার অপেক্ষায়।

না,—তাও নেই। অতীশের বুকটা ধক করে উঠল।

জানালায় নির্মলা, মিণ্টু, টুটুল বোধহয় দাঁড়িয়ে আছে। তার ফেরার সময় হলে, গোটা সংসারটাই তার অপেক্ষায় থাকে। নির্মলা হয়তো দুজনকেই আটকে রেখেছে। তিনজনে হয়তো জানালায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সে কখন ফিরবে।

জানালায়ও নেই।

ভিতরে কী এক দুর্যোগের আশঙ্কায় সে ছুটে সিঁড়িতে উঠে চিৎকার করে উঠল, নির্মলা!

সাড়া নেই।

আর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখল মিণ্টু দরজার ভিতরের দিকে; দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

—কী হল কাঁদছিস কেন! তোর মা কোথায়?

—মা রা করছে না।

সঙ্গে সঙ্গে কী হয়ে যায়—কেন যে ার পা দুটো কাঁপতে থাকে—শরীর অবশ হয়ে আসে—সে যেন তবু সব জোর সংগ্রহ করে দৌড়ে ভিতরের ঘরে ঢুকে দেখল, নির্মলা ছটফট করছে। রক্তে ভেসে গেছে বিছানা। টুটুল বোকার মতো মার বুকে মাথা খুঁটে বলছে, তুমি এমন করছো কেন মা! তুমি কথা বলছ না কেন?

মাত্র কয়েক দন্ড। কখন এমন হল! কেউ নেই। বড় অসহায় সে। তার মাথায় বিদ্যুৎ বেগে কী যেন এক প্রলয় নেমে আসার চেষ্টা করছে। আর তখনই সে দেখে ফেলল, কুলুঙ্গির সেই দেবী মূর্তি ধীরে ধীরে বনি হয়ে যাচ্ছে। গোটা দেয়াল জুড়ে সেই কুলুঙ্গি অতিকায়, মানুষের অবয়বে সে হাজির- বলছে, আমি আছি ছোট-বাবু। কোনও ভয় নেই। আবার তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—ভিক্টরি, ডিফিট, পেইন, বার্থ, ডেথ—লাইফ ইজ অল অফ দিজ। তুমি ঘাবড়ে যেও না ছোটবাবু। তোমার মিণ্টু টুটুল আছে, তোমার কিছু হলে ওরা একা হয়ে যাবে। তোমার নির্মলা ভাল হয়ে উঠবে।

সঙ্গে সঙ্গে অতীশ স্বাভাবিক হয়ে যায়—কুলুঙ্গিতে দেবীমূর্তি, সে নির্মলার মাথায় হাত রেখে বলল, আমি যাচ্ছি, ডাক্তার ডাকতে। ভয় নেই। আমি তো আছি। এই মিণ্টু এদিকে আয়। মার কাছে থাক। কোথাও যাবে না। বলে সে প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে পাগলের মতো ছুটে বের হয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সেই ঈশ্বর এবং প্রেতাত্মা দুইই তাড়া করছে এখন। কখনও ভয়ের মধ্যে কখনও অভয়ের মধ্যে। বনি—এভাবে আসে কেন! ঈশ্বর তাকে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। না, মাথাটা তার গোলমাল করে। সে তো জাহাজের মাস্তুল থেকে পড়ে গিয়ে একবার প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিল। মগজের শিরা- উপশিরায় কী কোনো পালছেঁড়া ভাঙা জাহাজের মতো গন্ডগোলে দোদুল্যমান! মানসিক আঘাতের মধ্যে তা নড়ে ওঠে। সবটাই কী তার মগজের বুজরুকি!

আর তখন দূরবর্তী মেঘ কিংবা আরো সুদূরে কে হেঁকে যায়। অফ অল দ্যা বিস্টস্ হি ইজ দ্য প্রাউডেস্ট—মনার্ক অফ অল দ্যাট হি সিজ। ছোটবাবু ডোন্ট ইগনোর হিম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *