।। কুড়ি।।
অতীশ এ-সময় মনে করতে পারল না, কোথায় যেন সেই নাটক, নাটকের পাত্র-পাত্রীরা সব গন্ডার হয়ে যাচ্ছে। শরীরে সবুজ রঙ এবং গায়ের চামড়া ক্রমশ ভারি হয়ে যাচ্ছে। নাটকের করুণ পরিণতি—বেরিনজার কাঁদছে। বেরিনজার চুল ছিঁড়ছিল। প্রাণদন্ডের আসামীর মত দু’হাত ছুঁড়ে বলছিল, ঈশ্বর আমি মানুষের মত বাঁচব। আমাকে গন্ডার করে দিও না ঈশ্বর।
সেই দৃশ্যের ভিতর অতীশ ফোনের রিসিভারটা দেখছে। রিসিভারটা নড়েচড়ে উঠছে। তারপর হাত পা মুখ গজিয়ে যাচ্ছে। আস্ত গন্ডার। সারাটা সকাল সে রাজেনদার সঙ্গে কথা বলেছিল এই নিয়ে। শেষমেষ চুকে বুকে যাক। কেমন একটা জেদ তাকে পেয়ে বসেছিল। ভেবেছে হেস্তনেস্ত হোক। সে পারবে না। তারপরই মিণ্টু টুটুল, নির্মলা, বাবা মা, সে অতীশ, বাপের সুপুত্র, নির্মলার অনুগত স্বামী এবং দায়িত্বশীল পিতা হয়ে যায়। কোথায় দাঁড়াবে। ফুটপাথ, সে ত ক্রমেই লম্বা হয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য গন্ডার দৌড়াচ্ছে। ঠিক সেই নাটকের মত মানুষেরা তার কাছে প্রায় গন্ডারের শামিল। এবং রাজেনদাকে মনে হয়েছে আরও সাবলীল গন্ডার। ঘাসের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দেখছে দলবল কোনদিকে যায়। এবং ফোনটাও যখন নড়েচড়ে গন্ডার হয়ে যেতে চাইল তখনই সে কেমন ভয় পেয়ে ডাকল, সুধীর সুধীর! সে বেল টিপতে ভয় পেয়ে গেছে। এবং সেই ঘ্রাণ। আর্চি আবার হাজির। মজা দেখছে। তার মনে হল, আর্চি তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আজ মজাটা দেখবে। কি রকম, কি রকম হে সাধুপুরষ! এখন নিজেও যে গন্ডার হয়ে যাচ্ছ! ভয় করছে না।
সে বলল, আর্চি তুমি যাও। তুমি না গেলে আমি এখানেও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকব। যাও বলছি। হাসছ কেন!
—না হাসছি না। দেখছি।
—কি দেখছ?
—ঘুষ কিভাবে দাও দেখব।
—আমার জন্য দিচ্ছি না।
—কার জন্য?
—কোম্পানির জন্য।
—বনিকে আমি ভালবাসতাম। আর্চি দাঁত বের করে হাসল।
—চউপ। অতীশ প্রায় চিৎকার করে উঠতে চাইল। ভালবাসলে শয়তানের মত কাজটা করতে না।
—বনি না ভালবাসলে কি করি! শরীর ত।
—তুমি একটা বাচ্চা মেয়েকে তাই বলে রেপ করবে!
—বাচ্চা! বনি বাচ্চা! কি বলছ! তুমি তাকে নিয়ে বোটে কি না করেছ। আমি বুঝি দেখিনি! বাচ্চা মেয়েকে ওভাবে করা যায়!
—প্লিজ আর্চি, তুমি নোংরা হয়ে যেও না। বনিকে ছোট করে দিও না।
—না না,, ছোট কেন করব! মহীয়সী। মহীয়সী। মেয়েরা সব মহীয়সী! বউরানী কেমন খাওয়াচ্ছে। কত সুন্দর করে।
—তা খাইয়েছে। ছোটবেলা থেকে ওর ভারি টান।
—বুঝতে পারছ কি হবে বিষয়টা?
—না বুঝতে পারছি না। তুমি যাও আর্চি। আমাকে ক্ষমা কর। বনিকে ক্ষমা করে দিও। আমি এখন বাবা। দুটো বাচ্চা আমার। আমি না থাকলে ওদের কি হবে ভেবে দেখ। বাবা না থাকলে, তাদের আর কেউ থাকে না।
—সেই ত বলছি। তুমি বাবা। তবে এতক্ষণ বলছিলে কেন, কোম্পানীর জন্য ঘুষ দিচ্ছ। অজুহাত খাড়া করছ কেন! চাকরিটা ছাড়তে পারছ না! ভয় ফুটপাথে দাঁড়াবে। ভয় ফুটপাথের পাগলা হরিশ হয়ে যাবে। মানুষের টাকা না থাকলে কি হয়, বেকার থেকে কতবার সেটা বুঝেছ?
—তা বুঝেছি।
—এখন আমি চাই তুমি বেকার হয়ে যাও। আত্মহত্যা কর।
তখনই অতীশ আরও ভয় পেয়ে গেল। –না করলে!
—তোমাকে গন্ডার হতে হবে। চামড়া ভারি হবে, টের পাবে না। বুঝতে পারবে না চামড়া পুরু হচ্ছে! পুরু হতে হতে যখন সত্যি গন্ডার হবে তখন দেখবে কোন আর দুঃখ নেই। চারপাশে তোমার মত সব লোকজন, সমাজটাকে মনে হবে বিচরণ ক্ষেত্র। মানুষের নির্যাতন তোমার চোখে লাগবে না।
—যদি না হই!
—তবে আত্মহত্যা।
—বলছ!
—বলছি। দুটোর যে কোন একটা, বলে যেন আর্চি তার দুটো আঙুল দেখাল। ডোরাকাটা সেই বাঘের মত মুখ। সারা গায়ে কিম্ভুতকিমাকার দাগ—দুলছে, নড়ছে। দুটোর একটা। দুটোর যে কোন একটা। দুলছে। নাচছে। লাফিয়ে লাফিয়ে নাচ দেখাচ্ছে। দুটোর যে কোন একটা। অনেক দূরে কোন নীল জলরাশির ওপর অনন্ত আকাশের নিচে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে, দুটোর যে কোন একটা। তারপর সেই গোলাকার চোখ, লাল কটা চোখ, হাতের আঙুলে ভি। ভিক্টরি! তখনই অতীশ আর পারল না। ডাকল, সুধীর সুধীর! সুধীর এলে বলল, শিগগির দু প্যাকেট ধূপকাঠি নিয়ে আয়। বলে সে উঠে দাঁড়াল। যেন কিছু খুঁজছে! কোথায় আরও কিছু অবলম্বন পাওয়া যেতে পারে—খুঁজছে। সে অফিস ঘরেই পায়চারি শুরু করল। একবার কাঁচের জানালা দিয়ে দেখল, ঐ তো আসছে! সে জানালায় ভাল করে দেখল, হ্যাঁ আসছে। বুকটা কাঁপছিল। মানুষটা কত সহজে পান চিবুতে চিবুতে চলে আসছে। পেয়ে থাকি। কতদিন থেকে পেয়ে আসছি। যেন আর্চিই আসলে ভিন্ন চেহারায় তার কাছে হাজির হচ্ছে। কখনও কুম্ভবাবু কখনও ইস্কুলের সম্পাদক, কখনও রাজেনদা, কখনও সেই ঘুষখোর লোকটা অথবা শেঠজী। রাজেনদার রাশভারি গলা, তুমি অতীশ, কোম্পানীর তাই বলে ক্ষতি করতে পার না। টাকাটা না দিলে কোম্পানীর ক্ষতি হবে। বেশি টাকা কে দেয় বল। আইন ফাঁকি দেয় না, কে এমন আছে। শেষে যেন বলতে চেয়েছিল, আসলে তুমি গোঁয়ার। এভাবে ত কাজ হবে না। এর নাম সততা নয়।
তারপরই আবার আর্চি জানালায় দুল দুলে নাচছে। আর উৎকট গলায় চেঁচিয়ে বলছে—আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল ছোটবাবু। নিশ্বাস নিতে না পারলে কত কষ্ট বল। বালিশে মুখ চেপে হত্যা করেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ ফেটে বের হয়ে যেতে চাইছে। অতীশ তাড়াতাড়ি অন্য দিকে মুখ সরিয়ে নিল। দম বন্ধ করে দেখল, দেখা যাক কতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে রাখা যায়। মৃত্যু যন্ত্রণা সে অনুভব করতে চাইল।
অস্বাভাবিক যন্ত্রণায় সে কাতর হয়ে পড়ছিল। কষ্টটা কিসের? সম্ভ্রমবোধের! ইজ্জতের। ইজ্জত শব্দটি মাথার ঘিলুর মধ্যে পাক খাচ্ছে। ইজ্জত না পাপ! আর্চি তাকে দিয়ে সব রকমের পাপ কাজ করিয়ে নিতে চায়। বিজয়ীর মত সেই যে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে আর বের হতে চাইছে না। গন্ধটা আরও বেশি আজ ভুর ভুর করছে। সুইংডোর কেউ খুলছে। সুধীর। হাতে ধূপের প্যাকেট। সে প্রায় হামলে পড়ে প্যাকেট দুটো খুলে নাকের কাছে ধরল। তারপর যা হয় টেবিলে, কাঠের দেয়ালে, আলমারির কোণায় গুচ্ছ গুচ্ছ ধূপ জ্বালাতেই দেখল সব পরিষ্কার, সব স্বাভাবিক। টেবিলের ওপর স্তূপীকৃত ফাইল এবং ক্যাশবুক। কিছু ডেবিট ভাউচার, ক্রেডিট ভাউচারের বান্ডিল। দোয়াঙ্গানিতে নানা রকমের কলম। জানালা কাঁচ দিয়ে ঘেরা। পাখাটা ভাল ঘুরছে না। সুতরাং সে নিজের জানালাটা খুলে দিল। ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢোকায় শরীরটা হাল্কা লাগছে। সামনে রাস্তা। দুজন লোক ঠেলাগাড়ি টেনে এনে কারখানার গেটে লাগিয়েছে। মাল যাবে। কারখানার কারিগরেরা নদমাতে ছেপ ফেলে সদর দরজায় ঢুকে যাচ্ছে। তারপর ঘন্টার শব্দ, মেশিন চালু করার শব্দ। সুপারভাইজার হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে। সব অতীশের কাছে এখন পরিষ্কার। এই ধূপকাঠি জ্বেলে দিলেই গন্ধটা মরে যায়। সে খুব স্বাভাবিক বোধ করে। সুইংডোর ঠেলে সুপারভাইজার মুখ বাড়াতেই দেখল, তার ম্যানেজার সারা অফিসে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিয়েছে। মুখ ভয়ঙ্কর গম্ভীর। সুপারভাইজার অবশ্য জানে মাথায় বাবুটির গন্ডগোল আছে। ধূপকাঠি জ্বালায়। সে কিছুটা বিভ্রমে পড়ে গেল। কিন্তু তখনই তাঁর গম্ভীর কথাবার্তা, কিছু বলবেন?
সুপারভাইজার অবাক। প্রখর ব্যক্তিত্বে মানুষটা কথা বলছে। সে বলল, স্যার ভিতরে আসব?
—আসুন।
—সাতজন কামাই করেছে টিফিনের পর।
—কি করব?
—এ-ভাবে ত চলে না। আপনি জোর অ্যাকশন না নিলে কি করব?
—একটা লিস্ট করে দেবেন, দেখব কি করা যায়।
—কিন্তু মেডিক্যাল দিলে কি করবেন?
—এত মেডিক্যাল পায় কি করে?
—স্যার ই এস আইর ডাক্তারদের সঙ্গে রফা আছে। ওষুধ দেয়। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেয়। ওরা মেডিক্যাল নিয়ে অন্য জায়গায় কাজ করে। এখানে কাজ না করেও তারা হাফ মজুরি পায়। সুবিধা কত দেখুন। এখানে হাফ মজুরি অন্য জায়গায় ফুল মজুরি। কে ছাড়ে!
অতীশ বলল, আমার কিছু তবে করার নেই! আসলে অতীশের মনে হল, আচ্ছা জাঁতাকলে সে পড়েছে। এত কামাই হলে সে কি করে! সে বলল, বার্নিশ থেকে তুলে নিন।
—তিন নম্বর পাঞ্চ মেশিন খালি। প্রেস মেশিনের দুজন আসে নি। বিশ্বনাথ নিমাই নন্দ সবক’টা ডুব মেরেছে।
—চলুন ত দেখি। অতীশ উঠে পড়ল। কারখানায় ঢুকলে দেখল সব ভালমানুষ। গভীর মনোযোগ কাজে। কেউ যেন ফাঁকি দেয় না জীবনে। কামড়ি এক গাদা জমে আছে। মাল তুলে দেবার লোক নেই। হাত খালি করে চাপা মেশিনে পরাণ বসে আছে। পর পর মেশিনগুলির কাজ বন্ধ। চেন সিস্টেমে কাজ। ভ্যাকুয়ামের কাজও হচ্ছে না। কানপুর পার্টির মাল হচ্ছে। সে বলল, এই বিশ্বনাথ এদিকে আয়। বিশ্বনাথ এলে বলল, যা মাল দে। বার্নিশ বন্ধ রাখ। এই গোপাল আমার সঙ্গে আয়। চাপা থেকে ভ্যাকুয়ামে নিয়ে যাবি। তারপর বিটের মনোরঞ্জনকে বলল, আপনারা ইউনিয়ন করেন, এদিকটা দেখেন না কেন! হঠাৎ ডুব মারলে, কোম্পানীর ক্ষতি হয় না!
মনোরঞ্জন বিট থামিয়ে বলল, দেখছেন না স্যার, কেমন দিনকাল। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। মাধাটাকে বের করে দিয়েছে বাড়িয়ালা। টি বি পেশেন্ট রাখে কি করে!
—কোথায় আছে?
—পুরান দালানের রোয়াকে শোয়। সেখানেই থাকে।
এটা অতীশের দায়িত্ব। সে এখনও ই এস আইকে বলে কিছু করতে পারেনি। সে কুম্ভবাবুকে নিয়ে ক’দিন থেকে দৌড়াদৌড়ি করেছে। একটা বেডও খালি নেই। দরিদ্র বান্ধব হাসপাতালে দুটো ই এস আইর বেড আছে। খালি না হলে কিছু করা যাচ্ছে না। সকালে এসে মনোরঞ্জন বলেছিল, স্যার যাবেন একবার। দেখবেন কি অবস্থা। সে যায় নি, যেতে তার ভয় লাগে। সে জানে, এই শহরের বুকে যেমন দশটা পাঁচটা লাশ রাস্তায় পড়ে থাকে মাধবের বেলাতেও তাই হবে। রোগ নিরাময়ের সে কিছুই করতে পারছে না। দশটা টাকা দিয়েছিল, তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত সনৎবাবুর সেই কথা। তুমি কেন বুঝছ না, অতীশ এটা তোমার টাকা না। তোমার টাকা যে ভাবে ইচ্ছে খরচ কর, আমরা কিছু বলব না। এ-টাকা দিতে হলে বোর্ড থেকে অ্যাপ্রুভাল নিতে হবে। এতদূর গড়াবে সে জানবে কি করে। অগত্যা সে বলেছিল, ঠিক আছে ভাউচারটা ছিঁড়ে ফেলুন। ক্যাশবুকে খরচটা কেটে দেব। আমার যখন দায়, তখন সেটা আমার পকেট থেকেই যাক। আর তখনই সনংবাবু হাঁ হাঁ করে উঠেছিল। না না, তুমি দেবে কেন। দেখি কুমারবাহাদুর কি বলেন! দশটা টাকা এত মহার্ঘ সে আগে জানলে বোধহয় আহাম্মকের মতো কাজটা করত না। অথচ আজই সেই নিরেট গন্ডারটি আসছে। তাকে এক দেড়শ টাকা ঘুষ দিয়ে যে-ভাবেই হোক খুশি রাখতে হবে। মাথার মধ্যে কি যে হয়, সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠতে চাইল, মাধবকে বলুন না মশাল নিতে হাতে। সব বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে বলুন। কি হবে শুধু শুধু মরে গিয়ে।
মাধব সেই এক মানুষ, ঢ্যাঙা পাতলা। খড়খড়ে চেহারা। আগে ফুটপাথে শুত, মাইনে পেলে স্নান আহার, হোটেলে ভাত, ঐ নির্দিষ্ট দিনেই সে শুধু ভাত খায়। থুতনিতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চুল কাটে ছ’মাসে ন’মাসে। লম্বা চুল উস্কোখুষ্ক। ছেঁড়া তালিমারা জামাপ্যান্ট। আর এক ধাপ এগিয়ে গেলেই রাস্তার সেই পাগলা হরিশ। বসুন্ধরা তার করতলে। মাধবটা সেই হয়ে যেতে পারত। রাজরোগে তাকে খেয়েছে। এবং চোখ জবাফুলের মতো করে তাকালে অতীশের ভয় করত। মাইনে বাড়তে মাঝে মাঝে জুয়া খেলার নেশায় মাধবকে পেয়ে বসে। এই মানুষের যেমন দশটা সখ থাকে। সে সপ্তাহে একবার বেশ্যালয়ে যায়। শরীর বলে কথা, সুখ সখ বলে কথা। দুনিয়ায় এসে সুখ সখ না মিটিয়ে যায়টা কি করে। সে সহজেই বচসা করতে পারে মারামারি করতে পারে। সেই মাধা এখন চিৎপাত হয়ে আছে রোয়াকে।
অতীশ বলল, খায় কি? ওষুধপত্র কে দেয়?
—নিমাই-এর বৌ দুবেলা দুটো করে রুটি দেয়। আমরা পালা করে ওষুধ খাইয়ে আসি। কথা শোনে না স্যার। ঐ শরীর নিয়েই বেশ্যাবাড়ি গেছিল। নিজে বাঁচতে না চাইলে কি করি! ই এস আই থেকে কিছু হল না স্যার?
অতীশ আর কথা খুঁজে পেল না। শুধু বলল, চেষ্টা ত করছি। কিন্তু কি করব বলুন। সে জানে ঘুষ দিলে হয়ে যেত। কে দেয়! ঘুষ দূরের কথা, দশটা টাকা দেবারও তার ক্ষমতা নেই। সে আর তার দশটা টাকার কথা বলল না। এই নিয়ে তাকে কুম্ভবাবু জ্বালিয়েছে, জানাজানি হয়েচে জানলে, কোনদিকে আবার ফণা তুলবে কে জানে। কম কথা বলা ভাল। যত দিন যায় তত এটা তার মনে হয়েছে।
তারপর সদর দরজা অতিক্রম করতেই শিউপূজনের মুখ। সে ভাঙা টুলে বসে হাত পা চুলকাচ্ছিল। ওর চোখ মুখ টোপা কুলের মতো। হাতে ঘা। আঙুলগুলো ফুলে আছে, কাঁকড়ার মতো বেঁকে গেছে। নখ খসে গেছে। হাতে পায়ে সব সময় ব্যান্ডেজ বাঁধা। একদিন শিউপূজন ব্যান্ডেজ খুলে পাটা অতীশকে দেখিয়েছিল—ঘন সাদা রঙের ঘা, ক্ষতস্থানটুকুতে অবিরাম দুর্গন্ধ। আর এই সব দেখলেই গা শিরশির করে। যেন পোকাটা তার শরীর বেয়ে উঠছে। নিজের মধ্যে এক অসুখের খবর টরে টক্কা বাজায়। সে দেখি না দেখি না করেও সবটা দেখে ফেলেছিল। শিউপূজন বলেছিল, মানুষ মরে যেতে চায় না কেন বাবু। মরে গেলে রেহাই। আমর মরার ইচ্চে কবে হবে বাবু? আমর বেঁচে থাকতে এত ভাল কেন লাগে বাবু?
অফিস ঘরে ঢুকতেই ফোনটা বেজে উঠল। অতীশ ইচ্ছে করেই হাত বাড়াল না। ইদানীং সে এই ফোনটাকে বড় ভয় পায়। অদ্ভুট সব স্বর ভেসে আসে। যেন আর্চি গলা নকল করে কথা বলছে। কেবল তাগাদা। দাও। আর দাও। সবাই তার কাছে তাগাদা মারে। মালটা গেল না। টাকাটা কবে দেবেন। না, এ-ভাবে ঘোরালে চলবে না। বার্নিশ বন্ধ করে দেব। ডকে মাল ডেমারেজ খাচ্ছে। সেলট্যাকসের কি হল। রং খারাপ। বার্নিশ ঠিক হয়নি। ঢাকনা আলগা, মাল ফেরত যাবে।
—সুধীর বলল, বৌদিমণির ফোন।
—ফোন! নির্মলা কোত্থেকে ফোন করছে! তারপরই মনে হল, অমলা তো তার পিসি হয়। ফোনটা হাতে নিয়ে অতীশ বলল, বল।
—শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।
—সে ত আসার সময় দেখে এলাম!
—দাদা এসেছেন। আমি বরং ক’দিন মার কাছ থেকে ঘুরে আসি।
—সে ত ভাল কথা। যাও। আসলে এটাও অতীশের অভিমান থেকে বলা। সংসারে তার একটা বড় দুঃখের দিক আছে। সেটা কেউ বোঝে না। সে একা থাকলে আরও কষ্টের মধ্যে পড়ে যায়। বড় নি:সঙ্গ লাগে। কলকাতায় এসে সে এটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। নির্মলারও বুঝি একঘেয়ে ঠেকছে তাকে। সে মাসে ছ মাসে নির্মলাকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়। তার সময় হয় না। তার নিজের বলতে একটাই কাজ,একটু লেখা, আর বাকিটা সে নির্মলা টুটুল মিণ্টুর জন্যে করে যাচ্ছে। অথচ নিৰ্মলা এটা টের পায় না। নির্মলা চায় ঘুরতে ফিরতে। সে বেড়াতে ভালবাসে। নির্মলার জীবনে সচ্ছলতা দরকার। সে এভাবে যে শেষ পর্যন্ত জীবন কাটাতে পারবে না যেন আড়ে ঠাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
অথচ নির্মলার সঙ্গে তার একটা ভালবাসার যুগ ছিল। নির্মলাই তাকে সেই বিষণ্ণতা কাটিয়ে পৃথিবী সবুজ শস্য-শ্যামলা, বৃষ্টিপাত হয়, গাছপালা বাড়ে, আবার শীত আসে, পাতা ঝরে যায়, রুখো মাঠ, কড়কড়ে হাওয়া, ধুলোবালি ওড়ে এ-সব শিখিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, নির্মলা তাকে ফের কোনও বড় বেলাভূমিতে নিয়ে যাবে। সেই নির্মলা এখন তাকে একা ফেলে কিছুদিন বাবা মার কাছে থাকতে চায়।
তখনই পার্ট-টাইম কাজের লোকটা এসে বলল, স্যার, সব পার্টিদের স্টেটমেন্ট অফ একাউন্টস ত্রিশ তারিখের মাধ্যে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব।
—কেন?
—স্যার, একা পেরে উঠব না।
—কুম্ভবাবুকে সঙ্গে নিন।
কারখানা থেকে হাপরের শব্দ আসছে। কিছু ঝালাইর কাজ থাকে মাঝে মাঝে। দূরে কোথাও বচসা হচ্ছিল। সেখানে অনেক লোক জমেছে। সে কাচের জানালায় বসে সব দেখতে পায়। সামনের অনেকটা পথ চোখে পড়ে। ভাল করে তাকালে, দূরের বেশ্যালয় চোখে ভেসে ওঠে। সেখানেও সে ভিড় দেখতে পেল। সুধীর এসে খবর দিল, স্যার মারামারি হচ্ছে।
—মারামারি হচ্ছে কেন?
—লীলাকে নিয়ে ঝগড়া। লীলা মরে গেছে।
লীলা কে সে জানে না। লীলা কোনও বেশ্যারমণী হবে। সুধীর এত কথা বলতে পারে না। সে এ-পাড়ার ছেলে। ঘরদোর সব জানা চেনা। সে লীলাকে চিনতে পারে।
সে বলল, লীলাকে নিয়ে ঝগড়া কেন?
—লীলার স্বামী এসেছে। সে তার মরা বৌকে দেশে নিয়ে যেতে চায়। ওরা বলছে দেবে না।
—ওরা কারা।
লীলার ঘরে যারা আসত।
কেমন একটা রহস্য টের পেয়ে ওর কত কিছু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। লীলার স্বামী আছে অথচ লীলা তবে এখানে কেন এসে উঠেছিল। অভাব অনটন থেকে এটা যদি হয়। মানুষ কি অভাব অনটনে পড়ে গেলে মাথা-ফাতা গুলিয়ে ফেলে। তখনই সে দেখতে পাচ্ছে কয়েকজন মাতাল যুবক লীলার খাটিয়া নিয়ে এদিকেই আসছে। একবার রাস্তায় নামাল পর্যন্ত। কি ফেলে এসেছে, কেউ তা আনতে গেছে। সে দেখল কপালে সিঁদুর, হাতে নোয়া। বড় সুন্দর মুখ। চোখ বুজে আছে মতো। লীলা স্বামীকে ফেলে চলে এল কেন? শহর কি টানে! যুবকেরা খাটিয়া বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সব যুবকেরাই লীলার স্বামী। লীলা চোখ বুজে যেন মুচকি হাসছে। শরীরটা কেমন গুলিয়ে উঠল। তা তুমি যাও না! তোমার যদি নিত্য অভাব এত বেশি মনে হয়, যাও। চাকরি কর গে। টুটুল মিণ্টুকে না হয় আমিই দেখব। তারপর লীলার খাটিয়া ঝুলিয়ে তারা চলে গেলে, রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। এবং পরে সে দেখতে পেল, এক ঝাঁকা ফুল নিয়ে কেউ যাচ্ছে। বেল ফুলের মালা। তার ইচ্ছে হল তাকে বলে, এই বেলফুলের মালার কত দাম রে? মাঝে মাঝে নির্মলা বেলফুলের মালা পরতে চায়। সব মেয়েরাই বেলফুলের মালা পরতে চায়। সংসার ঠিকঠাক রাখতে হলে কিনে দেওয়া দরকার! নির্মলার বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এলে গোপনে কলাপাতায় সে একদিন বেলফুলের মালা কিনে নিয়ে যাবে ভাবল।
অতীশ ক্যাশবুকের ওপর এই ভেবে মাথা রাখতেই ফোনটা বেজে উঠল। সেই নীরেট গন্ডারটি নয় তো! স্যার যাচ্ছি। টাকাটা ঠিকঠাক রেখেছেন ত। সে কোনরকমে ফোনটা তুলে বলল, বলুন।
—আমাদের ডিজাইনটা?
কেমন সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বলল, একটু ধরুন। এই জগৎ, জগৎ। অতীশ জগৎকে গলা ছেড়ে ডাকতে থাকল। ভুলেই গেছে তার বেয়ারা বাইরে বসে আছে। ভুলেই গেছে লাল নীল আলো জ্বললে, সুধীর ছুটে আসে।
সুধীর বাইরে বসেই টের পায় সব। স্যার ভাল নেই। স্যারের কিছু আজ একটা হয়েছে। সে উঠে গিয়ে বলল, জগৎদা, স্যার আপনাকে ডাকছে।
জগৎ এলে অতীশ বলল, ধর্মবীর কোম্পানীর ডিজাইনটা হয়েছে?
—ওর কোন ডিজাইনটা? ডিজাইন তো তিনটে করতে দিয়েছে।
—গঙ্গা যমুনা পাউডারের।
—হাতে দুটো ব্লকের কাজ আছে। ওটা হয়ে গেলেই।
অতীশ বুঝতে পারে আরো বেয়াড়া প্রশ্ন করলে জগৎ আরও বেশি মিছে কথা বলবে। অনেক অজুহাত দেখাবে। সুতরাং পার্টির কাছে কথা ঠিক রাখার জন্য বলল, আজই ওটা ওভারটাইমে করে দেবে। করে দিতে হবে। যাও।
আবার অতীশ কিছুটা অন্যমনস্কভাবে বলল, আজই করে দিতে হবে। যাও তারপর ফোনটা রাখার আগে বলল, কাল আসবেন। ডিজাইনটা এপ্রুভ করে যাবেন। তারপর সে টেবিলে রাখা উইকলি প্রোগ্রামটা দেখে বুঝল, টিন দরকার। খোলা বাজার থেকে টিন তোলা দরকার। পি সি আর সি হলেই হবে। সে ফোন করল, হেলো, পি সি আর সি।
—হ্যাঁ স্যার।
—আপনাদের ব্ল্যাক প্লেট আছে?
—আছে।
—কত গেজের?
—পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ অ্যাসরটেড।
—দাম কি নিচ্ছেন?
—পুরো দুই স্যার।
—পঞ্চাশ কমবে না?
—হয় না স্যার। কিছু তবে থাকবে না।
অতীশ কুম্ভবাবুকে ডেকে পাঠাল। কুম্ভবাবু সব সময় ডাকলেই আসে না, একটু দেরি করে আসে। যেন বোঝাতে চায় ডাকলেই আসা যায় না। সবাই দেখুক, এ-অফিসে তারও দাপট কম না। অর্ডার করলেই সে দাসানুদাস হতে পারে না। তারপরই এসে বলবে, দাদা ডাকছিলেন, পে-বিল করছিলাম। যেন কত কাজে মগ্ন থাকে সে।
কুম্ভ এলে একটা চেক এগিয়ে দিল।—এটা ভাঙিয়ে আনবেন। পনের তারিখে তেষট্টির সেলটেক্স, কেস আছে। কাগজপত্র সব ঠিক করে রাখবেন। ডিক্লারেশন বাকি থাকলে আদায় করে নিন। তের তারিখে আমার টেবিলে সব প্রডিউস করবেন।
কুম্ভ চোখ টান করে ফেলল। খুব বসগিরি ফলানো হচ্ছে। খুব তেজি ঘোড়া। সে এই মাত্র এসেছে পার্টির ঘর থেকে। এসেই শুনেছে বড়বাবু ঘরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে আছে। কারো সঙ্গে ভাল করে কথা বলছে না। খুব গম্ভীর হয়ে গেছে। কুম্ভ শুনে বেশ মজা পেয়েছে। এ-সময়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক না। সেই লোকটা আসবে ভয়েই জুজু হয়ে আছেন।
তার ভারি মজা লাগছিল। কোনদিকে সামলাও শূয়োরের বাচ্চা এবার দেখব। জাল পাতা হচ্ছে, তুমি জান না এটা কলকাতা শহর। এটা তোমার বাইনচুত জাহাজ না। কত ধূপকাঠি পোড়াতে পার দেখি। সে বলল, কিছু ভাববেন না দাদা। সব ঠিক করে রাখব।
আর এ-সময়েই অতীশ দেখল, আসছে। বেঁটে মোটা মতো মানুষ। চুলে পাক ধরেছে। গাল গলা মসৃণ। মাথায় টাক। আর বেশ ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে। ডোরাকাটা দাগ মুখে নেই ত! অথবা পোড়া দাগ। না কিছু নেই। সামনে এলে দেখল কপালে শুধু বড় একটা আব। ঠিক মাঝ কপালে। সেদিন সে দেখেছিল বেশ ছোট, ক’দিনেই বড় হয়ে গেছে। মাংস হাড় ফুটে বের হয়ে আসছে। গন্ডারের মতো বোধ হয় খড়গ গজাচ্ছে। যেন যতদিন যাবে লম্বা হয়ে যাবে আবটা। এবং ধারালো হয়ে উঠবে। সে লোকটি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বলল, দেখুন এখানে আমি নতুন। কার কি প্রাপ্য ঠিক জানি না। আপনি সেদিন টাকা চাইলেন দিতে পারলাম না।
বাবুটি অসভ্যভাবে হাই তুলছিল। অতীশের কথাবার্তা কর্কশ হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে কেমন জ্বর জ্বর ভাব। সে দেখল অজগর সাপেরা বাবুটির মুখে অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছে। অতীশের শরীর গোলাচ্ছিল। কোনরকমে বলল, এ-ব্যাপারে ওপরয়ালার সঙ্গে কথা বলেছি।
—তিনি কি বললেন?
—আপনারা পেয়ে থাকেন।
—আপনি নতুন আছেন।
—খুব নতুন বলবেন না। কুম্ভ পাশ থেকে বলল।
লোকটির আবার হাই উঠছে। কি জ্বালা! মানুষের এত হাই ওঠে কি করে। হাই ওঠা সংক্রামক ব্যাধির মতো। অতীশেরও হাই উঠতে থাকল।
লোকটি আবার বলল, আপনি ত এ-লাইনে নতুন?
অতীশ স্বাভাবিক হতে চাইল। বলল, সব খবর রাখেন দেখছি।
—সব খবর রাখতে হয় স্যার। স্কুলে ছিলেন, বেশ ত ছিলেন। এখানে মরতে এলেন কেন?
সেই এক কথা। স্কুলে যে এখন আর সবুজ মাঠ গাছপালা কিংবা সবুজ শস্য ক্ষেত্র নেই সেটা সে বলতে পারল না। তার মুখটা সহসা খুব কাতর দেখাল। একজন সহকারী শিক্ষকের কাজ মোটামুটি মন্দ ছিল না। কিন্তু তা সে পাবে কোথায়। আর কতদূরে। তার মিণ্টু টুটুল বড় হয়ে উঠতেই সে কোনও নিরিবিলি গ্রাম্যজীবনের কথা আর ভাবতে পারে না। অসুখ-বিসুখ আছে। পড়াশোনা আছে। এই শহরেই তা সুলভ। কলকাতা কলকাতা বলে সে দুবার মন্ত্রপাঠের মতো বিড়বিড় করল কিছু।
কুম্ভবাবু ততক্ষণে বাবুটির জন্য চা এবং মিষ্টি আনার অর্ডার দিয়ে দিয়েছে।
অতীশ মাথা গোঁজ করে বসেছিল। মাথার ভেতরটাতে যেন আগুন জ্বলছে। সে মাথা গোঁজ করে সে আগুন থেকে রক্ষা পেতে চাইছে।
—আপনার সঙ্গে দেড়শ টাকায় রফা হতে পারে। দু’বছরে তিনশ টাকা দেবেন। পরে পঞ্চাশ করে দিলেই চলবে।
অতীশ কপালটা টিপে ধরল। শরীরে মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। আর এ সময় অযথা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে ইচ্ছে হচ্ছে। কাছাকাছি সেই বেশ্যালয়ে গেলে কেমন হয়। বেশ্যালয়, হারামি, শয়তান, ইতর অথবা জারজ এমন সব শব্দমালা, মগজে ভেসে যাচ্ছে। কুষ্ঠরুগী শিউপূজন লাঠির ওপর ভর করে হাঁটার চেষ্টা করছে। চোখ মুখ বীভৎস। ফুলে ফেঁপে আছে কেমন। ভয় ধরে যায়। যেন অতীশ নিজেই কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত। সে হাতের আঙুল দেখতে থাকল। কানের লতি ধরে দেখল। ফুলে উঠছে নাত! চুলকাচ্ছে। নাকের ডগা চুলকাচ্ছে। টের পাওয়া যায় না কখন কোথা থেকে আক্রমণ ঘটবে—এবং সে নিজেই বসে আছে একা এক শূন্য ঘরে। কেউ নেই। মিণ্টু টুটুল নির্মলা। কেউ নেই। ভয়ে তারা পালিয়েছে। সে ভীতু বালকের মতো চোখ মুখ করে আর একবার কর্পোরেশন বাবুটির মুখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করল। স্বাভাবিক হতে চাইল। গা ঝাড়া দিল। তবু সংক্রামক ব্যাধির মতো আত্মায় কারা পেরেক পুঁতে দিচ্ছে। শুধু অন্তহীন এক অন্ধকার জীবনের গাফিলতি নামে এক পাপের ভান্ডারে তাকে কেউ নিক্ষেপ করছে। পাপ খন্ডনের কি উপায় সে জানে না। এক পাপ থেকে আর এক পাপ তাকে পাগলা কুকুরের মতো তাড়া করছে।
বাবুটি বলল, আপনার শরীর ভাল নেই মনে হচ্ছে!
অভীশ এবার বাবুটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তরপর সেই এক অন্যমনস্কভঙ্গীতে বলা, না ভালই আছে। সে দেখল, অজগর সাপের লেজটা বাবুর মুখে টিকটিকির লেজের মতো নড়ছে। লেজ ধরে সাপটাকে টেনে বের করবার স্পৃহাতেই সে যেন উঠে দাঁড়াল। তারপরই কেমন হুঁশ ফিরে আসে। যেন বাবুটি বলছে, ওটা ঠিকই আছে। ওকে টানবেন না। টানলে অনর্থ ঘটবে। বসে পড়লে কুম্ভ বলল, দাদ! আপনার চোখ এত লাল কেন? রাতে ঘুম হয় নি বুঝি?
অতীশ বলল, ঠিক জানি না। অতীশের কোনও কথাই বলতে ভাল লাগছিল না। স্ত্রীর রুগ্ন শরীর ফ্যাকাসে। চোখের নিচটা সব সময় ফুলে থাকে। এই সব দৃশ্য অতীশকে কাতর করছে!
তখন একটা পুরো পানামা প্যাকেট কুম্ভ টেবিলের ওপর রাখল। বাবুটি বলল, চলে না। সে তার নিজের পকেট থেকে উইলস বের করে বলল, চলে?
অতীশ বলল, না।
তারপর আর কি কথা বলা যায়। বাবুটি যেন কথা খুঁজে পেয়ে গেল, বলল, বড্ড প্যাঁচ প্যাচে বৃষ্টি। আর ভাল লাগছে না। এবারে রোদ উঠুক।
অতীশ বলল, রোদের দরকার। সে ক্যাশ থেকে তিনশ টাকা গুণে টেবিলের উপর রাখল। আর তখনই সুদূর থেকে যেন কেউ ডেকে উঠল, বাবা বাবা!
ডাকটা ক্রমে এগিয়ে আসছে, বাবা! বাবা! টুটুল ভয় পেয়ে কোনও দুঃস্বপ্ন দেখে যেন ডাকছে, বাবা বাবা! সে পেছনে তাকাল। আবার কেউ ডেকে যাচ্ছে বাবা বাবা! এ মুহূর্তে কোথাও কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি ত। বাসের চাকার নিচে টুটুল চিৎপাত হয়ে পাড়ে নেই তো। বাস থেকে নামতে গিয়ে যদি কিছু হয়। সে চিৎকার করে উঠতে চাইল, টুটুল তোমাকে কি কেউ খুন করেছে। তুমি আগলায় ডাকছ কেন!
বাবুটি বলল, বড় খাম আছে?
অতীশ কোনও কথা না বলে, খাম বের করে দিল।
কুম্ভ গোছগাছ করে টাকাটা খামে ভরে বলল, কি যে উপকার করলেন!
অতীশ আর কোন কথা বলছে না। এ-সময় কেউ ডাকে কেন! কে ডাকে। টুটুল তুমি ডাকছ আমি বাবা, আমি তোমার বাবা। আমি মানুষ নই। গন্ডার হয়ে যাচ্ছি বলে তুমি ভয় পাচ্ছ! না কি সত্যি কোনও দুর্ঘটনা। তোমার দাদুর মতো দূরের কিছু কি আমি টের পাই। অতীশ কেমন চঞ্চল হয়ে পড়ল।
বাবুটি তখন সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে বললেন, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সেই যেন স্যালি হিগিনসের কথাবর্তা। ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড। উই আর ওনলি ক্যারিং দ্য ক্রস। ভারবাহী জন্তুর মতো এই জীবন। শুধু পিঠে ক্রস বয়ে নিয়ে যাওয়া।
অতীশ মাথা তুলতে পারছে না। ভেতরে ছটফট করছে। যদি কোনও পাপ কাজ করিয়ে নিয়ে আর্চি প্রতিশোধ নিতে চায়। এবং সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ডাকছে, বাবা বাবা। বাবা তুমি তো এমন ছিলে না। অতীশ তাড়াতাড়ি করতে চাইছে। এক্ষুনি বের হওয়া দরকার। না কি একবার ফোন করে দেখবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ফোন তুলে বলল, হ্যালো! কে?
—আমি বিমলা।
—ও বিমলা! শোন, টুটুল ওরা পৌঁছে গেছে?
—হ্যাঁ এই ত এল! দেব দিদিকে?
—না থাক। বলে ফোন ছেড়ে দিতেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তারপর মাথা নিচু করে রাখল, জীবনে সং থাকার প্রয়াস এক অতর্কিত আক্রমণে মুছে যাচ্ছে। আর এ-সময়েই সেই বিদ্যালয়ের সম্পাদকের মুখটি মনে পড়ল। ঠিক যেন এই বাবুটির মতো, এক বিরাট অজগর গিলে বসে আছে। অতীশ লেজ ধরে টানতেই সম্পাদক মশাই তেরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, ওটা টানবেন না। অনর্থ ঘটবে।
অতীশ বলেছিল, তা হয় কি করে?
সম্পাদক বলেছিলেন, হয়। সব হয়। জানতে পারেন না। সরকার থেকে অনুমোদিত টাকা ফলস্ ভাউচার করে খরচ দেখান এবং টাকাটা তুলে নিন। তারপর হাসতে হাসতে বলেছিলেন, বলুন তো টাকাটা তারপর কোথায় রাখবেন।
অতীশ বলেছিল জানি না।
সম্পাদক মশাই হা হা করে আবার হেসে উঠেছিলেন। কিছুই জানেন না দেখছি। ওটা আমার নামে ডোনেশান দেখাবেন। ডোনেটেড বাই ভূজঙ্গ-ভূষণ মজুমদার। বাস হয়ে গেল। বাবার নামে ইস্কুল। ডোনেশান কুড়ি হাজার থেকে বাইশ হাজারে দাঁড়াবে! লোকে বলবে বিদ্যার সাগর দয়ার সাগর তুমি বিখ্যাত ভুবনে। শেষ কথাটা না বললেও অতীশ বুঝেছিল, জেলা সমাহতাকে সভাপতি নির্বাচন, তারপর আরও কিছু হোলসেলের ডিলারশিপ। ব্যবসায়ী মানুষ। আখের ছাড়া তাঁর জীবনে আর কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই।
অতীশ বলেছিল, ফলস্ ভাউচার হবে না। অতীশ যথার্থ লেজ ধরে টান দিয়েছিল।
—তবে চলে যেতে হবে। ব্যবসায়ী সম্পাদক অমায়িক হেসে কথাটা বলেছিল। প্রভাব এবং প্রতিপত্তির কাছে অতীশ শেষ পর্যন্ত হেরে গেল। সে এখানেও হেরে গেল! তার এখন হু হু করে গায়ে জ্বর আসছে। সে শীতে কেমন কাঁপতে থাকল।
বাবুটি তখন তার সামনে বসেই হেলথ লাইসেন্স ইসু করছে। ট্রেড-লাইসেন্স পরে পাঠিয়ে দেবেন, এমন বলে তিনি টাকাটা সযত্নে ব্যাগে ভরে নিচ্ছেন প্রসন্ন মুখে। কুম্ভ চুপচাপ মজা উপভোগ করছে। আর তখুনি ফোনটা ঝমঝম করে বেজে উঠল। যেন সব নড়বড়ে করে দিয়ে ফোনটা ক্রমাগত বাজছে। অতীশ আর পারছে না। অতীশ ফোনের দিকে হাত বাড়াল। বলল, বলুন! অ তুমি! বল বল।
—আজ আসবি একবার।
—কুম্ভ বলল, কার ফোন দাদা?
—অমলার। যেন কতকাল রোগভোগের পর অতীশের গলার স্বর আর স্বাভাবিক নেই।