1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ১৩

।। তের।।

এই কলকাতা শহরে তখন একজন ভোজবাজিওয়ালা খেলা শুরু করার পাঁয়তাড়া করছে। ডুগডুগি বাজছিল। বাঁশের খুঁটি পোঁতা হয়ে গেছে। লোকজন জমছে না। সে হাঁকছিল, খেলা শুরু হ’গেল। রূপায়াকা খেলা জাদুকা খেলা। মরণ তারের খেলা। চাকতি কা খেলা। তার বিবি-বাচ্চা লেড়কি সব হরদম সং সেজে নাচছিল। হারমোনিয়াম বাজছিল।

লোকজন সব নানা ধান্দায় ছুটছে। সময় নেই। শুধু রূপায়া চাই। চাই জৌলুস। মানুষেরা তবু কেউ কেউ কেন যে কৌতূহলী হয়ে যায়—সূর্য ডোবার আগে এই নিরস ইঁট কাঠের শহরে পরম রোমাঞ্চ বোধ করে দাঁড়িয়ে যায়। লোকটির পরনে হাফ-হাতা জামা প্যান্ট, মাথায় জোকারের টুপি—পেটে চুনকালি দিয়ে মানুষের কঙ্কাল—হারেরে হাভাতে—বড়ই মরণ আমার। বাচ্চাভি রূপায়াকা জাদু ঘুচক লিয়া। এই ঘুচক লিয়া শব্দেই অতীশ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শহরের এদিকটায় একটা খালপাড়—ব্রীজের মুখে কেউ ঘুচক লিয়া বলছে। সে সবার মতো ভিড়ের ভেতর নিজেও উঁকি দিল। ভোজবাজিয়ালা বছর খানেকের বাচ্চাকে একটা ফুলপরী সাজিয়ে ছেড়ে দিয়েছে রাস্তায়। চোখে কালো কাপড় বাঁধা। ট্যাক থেকে যেখানে যে যা ছুড়ে দিচ্ছে—বাচ্চাটা হামাগুড়ি দিয়ে ছুটছে ঠিক সেদিকে।

—টান বুঝেন বাবু। টেনে লিয়ে আসছে। ও বাচ্চাকা কৈ তরিকা নেহি বাবু। যো কুচ তরিকা ই রুপায়াকো। তারপর হাত তুলে নেচে নেচে সে বলছিল, খানদানি বলেন, আমদানি বলেন, জামদানি বলেন, সব রূপায়াকা মেহেরবান। পয়দা হোয়া ও রোজ। লেকিন রূপায়া চিন লিয়া।

অতীশ সত্যি আশ্চর্য হয়ে গেল দেখে, সেই সেদিনের পয়দা, ভাল করে হামাগুড়ি দিতে শেখেনি, কিন্তু পয়সা চিনে গেছে। চোখ বাঁধা। অথচ যারা যেখানে যেদিকে পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছিল বাচ্চাটা হামাগুড়ি দিয়ে সেদিকেই ছুটে যাচ্ছে। হামাগুড়ি দিতে দিতে পয়সার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এবং পয়সা হাতে নিয়ে আর দিতে চাইছে না। সে খেলাটা দেখে সত্যি তাজ্জব বনে যাচ্ছিল। তার তাড়া আছে। সে সকাল সকাল অফিস থেকে বের হয়েছিল। আরও কিছু কেনাকাটা বাকি। আজ নির্মলা আসবে। ক’দিন থেকে তার কি উত্তেজনা! নির্মলা, সেই সুন্দর দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি এই বড় শহরে চলে আসছে। মিণ্টু টুটুল আসছে। প্রহ্লাদ কাকা নিয়ে আসবেন। ক’দিন থেকেই তার রাতের ঘুমটুম সব গেছে। কাল রাতে কি যে গেছে! এত বড় একটা বাসা বাড়িতে সে একা। সারাটা রাত তাকে আর্চি বনি নির্মলা টুটুল মিণ্টু ঘিরে রেখেছিল! সে টুটুলের কথা ভেবে কেমন ভয় পেয়ে গেছিল। কারণ সে স্পষ্ট দেখেছে, রাতের আঁধারে কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। কোনও ছায়ামূর্তি। সে মনের ভুল ভেবে আলো জ্বালিয়েছিল। না কিছুই নেই। কিন্তু দরজার ওপাশে কোনও মৃত হাত ঝুলে থাকলে যেমন দেখা যায় তেমন একটা হাতের ছায়া। সে চিৎকার করে উঠেছিল, কে ওখানে দাঁড়িয়ে! হাতের ছায়াটা দুলছে। বড় বড় তিনটে ঘর সামনে বিশাল বারান্দা, পাশে রান্নাঘর। প্রাসাদের পেছনের দিকে ওকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। ঘরগুলো কত লম্বা-উঁচু যেন। সে মই দিয়েও ছাদের নাগাল পাবে না। কথা বললে গম-গম করে উঠছে। সে জোরে কথাও বলতে পারছিল না। চিৎকার করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিল, গলা খুবই তীক্ষ্ণ হয়ে যায়—ঘুম ভেঙে যেতে পারে সবার। সে ধীরে ধীরে আবার বলেছিল, তুমি কে। অন্ধকার থেকে হাত বের করে ভয় দেখাচ্ছ!

তখনি হাতের ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে গেল। এতে অতীশ আরও ভয় পেয়ে গেছিল। সারা শরীরে ঘাম। সেই প্রেতাত্মার কোনও প্রভাব-টভাব হবে। সে সাহসী মানুষের মতো দরজার কাছে এগিয়ে গেল। না কিছু নেই। দুটো টিকটিকি তাড়া খেয়ে ছুটছে। সামনের দরজা খুলে সে বারান্দায় বের হয়েছিল। কেউ যেন বারান্দা দিয়ে চলে যাচ্ছে। কোনও ছায়া নেই অথচ জলীয় বাষ্পের মতো কোনও মানুষের অবয়ব। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস সে দেখেছে। প্রায় তার মতো বারান্দার ওপর দিয়ে হাওয়ায় ভেসে গেল! এবং বাইরে পাতাবাহারের গাছগুলির মধ্যে ঢুকে মিশে গেল সব কিছু। জ্যোৎস্না এবং হাওয়ায় তখন শুধু পাতাবাহারের গাছগুলো দুলছে। অতীশ দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এসেছিল। সে গাছের পাতায় হাত দিতেই আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। পাতার গায়ে সদ্য লেগে থাকা জলকণা। আর্চিকে সে কখনও আর এ-ভাবে, প্রত্যক্ষ করেনি। আর্চির প্রেতাত্মা অদৃশ্য হবার আগে আর কখনও এমন প্রত্যক্ষ প্রমাণ রেখে যায় নি। তারপরই যা হয় ভয়ে সে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সারারাত বসেছিল। নির্মলা টুটুল মিণ্টুকে সে রক্ষা করতে পারবে কিনা জানে না। আর্চি বনিকেও এ-ভাবে তাড়া করেছে শেষপর্যন্ত।—ঐ দেখ দেখ, জ্যোৎস্নায় কি ভেসে বেড়াচ্ছে!

জ্যোৎস্নায় হাত পা কাটা কখনও মুন্ডুহীন মানুষের ছায়া দেখে অতীশ ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। বিশাল সমুদ্র—রাতে ঝড় গেছে। ঝড়ের সময় বোটের সামনে অয়েল ব্যাগ ঝুলিয়ে দিয়েছিল। সারা আকাশময় জলকণা ভেসে বেড়াচ্ছে। তালগাছ প্রমাণ সব উঁচু ঢেউয়ে বোট আছাড় খেয়ে পড়ছে। অতীশ হাল ধরে বসে আছে পাথরের মতো। বনি ছইয়ের নিচে বসে অন্ধকারে চোখ বুজে। এত অন্ধকার যে বোটের ও পাশটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না। কিছু গড়িয়ে পড়েছিল। বনি লাফিয়ে বের হয়ে টর্চ জ্বেলে পাটাতন তুলে দেখতে গেছে কি পড়ে গেল! না, কিছুই পড়েনি। সব ঠিকঠাক। আবার পাটাতনের নিচে হুড়মুড় শব্দ। অতীশ বিপদে পড়ে যাচ্ছিল। পাটাতনের নিচে কে এত দাপাদাপি করছে! সে বলল, নিচে ঢুকে দেখ। আসলে সে হাল ছেড়ে উঠে যেতে পারছিল না। বড় বড় ঢেউ থেকে অজস্র জলকণা তার গায়ে এসে লাগছে। ঢেউয়ে বোট একটা তালপাতার ডোঙার মতো দুলছে। হাল বেসামাল হলেই ওরা সেই অন্তহীন গভীর সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। অতীশ সে-জন্য হাল ছেড়ে যেতে পারছিল না। সে বনিকে বার বার ধমকাচ্ছে। ও-কি করছ বনি। দেখ না। দেখ। নিচে দেখ।

বনি আবার পাটাতন তুলে বলেছে, না কিছু পড়ে যায়নি ছোটবাবু। জায়গারটা জায়গায় আছে। ঐ দেখ ছায়াগুলো সমুদ্রে আর ভেসে বেড়াচ্ছে না।

তারপর সারারাত ঝড় আর এই হুড়মুড় শব্দ। ঝড় উঠলেই এলবা আর বোটে থাকে না। আকাশে নিরন্তর ঢেউয়ের মাথায় ডানা ঝাপটায়। কখনও নেমে আসে, কখনও উঠে যায়। এই করে সারা আকাশময় সমুদ্রময় তখন তার খেলা। না কি এলবাও টের পেয়েছে, আর্চির আক্রমণ ঘটেছে বোটে। ভয়ে সেও পালিয়েছে।

সকালের দিকে ঝড়টা থেমে গিয়েছিল। সমুদ্রকে চেনাই যাচ্ছিল না। শান্ত বালিকার মতো সে যেন হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। মৃদু হাওয়া, এবং পালে সামান্য হাওয়া লাগায়, বোট ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। সকালে ওরা আশা করেছিল, দ্বীপটিপ পেয়ে যাবে। চারদিন হয়ে গেল অথচ কোনও কিছুর চিহ্ন নেই। শুধু দিগন্তব্যাপী আকাশ আর সমুদ্র। দিগন্তব্যাপী অসীম শূন্যতা। আর ভয়ংকর কঠিন এক মৃত্যুর যেন হাতছানি। তবু বনি অন্যদিনের মতোই উনুন জ্বেলেছিল। চাপাটি করেছে। ঝড়ে গোটা দশেক উড়ুক্কু মাছ এসে পড়েছিল বোটে। সেই মাছভাজা আর চাপাটি। সকালে শুধু মাছ ভাজা দিয়ে ব্রেকফাস্ট, দুপুরে চাপাটি মাছ ভাজা। রাতে চাল ডালে খিচুড়ি মাছ ভাজা। এবং জ্যোৎস্নায় যখন নিরিবিলি বনি অতীশকে বুকে নিয়ে বলছে—আমরা তো বাঁচব না। এ-কদিন যা কিছু আমাদের প্রিয় খেলা আছে খেলে নিই। এবং সেই পরম মুহূর্তে সহসা চিৎকার করে উঠেছিল বনি, ঐ দেখ। দেখ ছোটবাবু আকাশে কি ভেসে রয়েছে।

ঠিক সেই মুখ। জলীয় বাষ্পের মতো আর্টি ভেসে ভেসে চলে আসছে অথবা নেমে আসছে। কিছুটা দূরে এসেই সেটা কেমন স্থির হয়ে থাকল। নড়ল না। তারপর যেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় তেমনি আকাশের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে থাকল। একদিকে মুন্ডুটা ভেসে গেল, একদিকে পা, হাত আঙুল সব ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আকাশের গায়ে পেঁজা তুলার মতো উড়ে বেড়াতে থাকল। বনি তাড়াতাড়ি গাউন টেনে ছোটবাবুকে বুক থেকে ঠেলে দিল, ছোটবাবু, কেন কেন তুমি ওকে খুন করতে গেলে। কেন? কেন?

ছোটবাবু একজন নাবালকের মতো মুখ করে বসে ছিল। জবাব দিতে পারেনি। অতি দূর থেকে সেই সতর্কবাণী, কেউ যেন সমুদ্রের ধ্বনি তরঙ্গ থেকে বার বার প্রতিধ্বনি করে যাচ্ছে, ছোটবাবু তোমার ক্ষমা নেই। আর্চি তোমাকে ক্ষমা করবে না। সেই দূর অতীত থেকেই, তাকে তিনি যেন আবার বলছেন, মানুষের এই ভাগ্য ছোটবাবু। সে এ-ভাবেই পাপপুণ্যে জড়িয়ে যায়।

আর তখনই অতীশের চোখ মুখ অস্থির হয়ে ওঠে। আসলে সে যত জড়িয়ে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে, দায়দায়িত্ব গ্রহণ করছে তত এক অদৃশ্য আতঙ্ক তার চারপাশে বেড়াজালের মতো ঘিরে ফেলছে। কেউ জানে না সে খুনী। তবু ভয় পায়। কেউ সাক্ষী নেই, তবু সে ভয় পায়। সেই সমুদ্রে আর্চির শেষ অস্তিত্বটুকু অতিকায় মাছে হয়তো গ্রাস করেছে। লন্ডভন্ড করে খেয়েছে তার শরীর। ওদের রক্তে আর্টির কোনও অণু-পরমাণু বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে। আর্চির শরীর ওদের প্রোটিন যুগিয়েছে। নতুন রক্ত কণিকার জন্ম দিয়েছে। তারাই হয়তো সাবলীল এখনও। সে ভেবেছিল, মাছে খেলেও শেষ হয়ে যায় না। মানুষ মরেও শেষ হয়ে যায় না। কোথাও না কোথাও ধূলিকণায় সে পড়ে থাকে। বৃষ্টিপাত হয়, মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ে। ঘাস জন্মায়। ঘাস মাটি থেকে রস শুষে নেয়। সেই মানুষের অস্তিত্ব তার শরীরে—গাভীরা ঘাস খায়, দুধ দেয়। মানুষ আবার প্রোটিন সংগ্রহ করে। এবং শরীরে তার বীজের জন্ম হয়। সে এ-ভাবে কোনও পুনর্জন্মের কথা ভেবে থাকে—এ-ছাড়া মানুষের অন্য কোনও পরলোকে তার বিশ্বাস নেই। সে তার জীবনের সবটুকু অনুভূতি দিয়ে এটা বার বার ভেবে দেখেছে। এত সব সত্ত্বেও কি করে সে আর্চির প্রেতাত্মায় বিশ্বাসী বোঝে না।

সে তার জীবনের এই কালো দিকটার কথা পৃথিবীর কাউকে বলেনি! বাবাকে না, নির্মলাকে না, কাউকে না। বাবাকে বললে, জানে শান্তি পেত। তিনি তাকে নানাভাবে দৈবের কথা বলে অনুপ্রাণিত করতে পারতেন। ঈশ্বরের কথা বলে ভয় কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু সে জানে, বাবা শুনলেই বলবেন, এ-বেশ হয়েছে তোমার। ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, ভূতে তোমার বিশ্বাস আছে। অর্থাৎ বাবা বলতে চাইবেন, যেমন পৃথিবীতে ঈশ্বর আছেন, তেমনি ভূতও আছে। একজনকে বাদ দিয়ে আর একজনকে স্বীকার করা যায় না। সুতরাং এই ভয় দূর করতে হলে তোমার ঈশ্বর বিশ্বাস দরকার। তা না হলে উরাট মাঠে বীজ রোপণ করা যায় না।

অতীশ স্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সোজা স্টেশনে যাবে। চারপাশে মানুষজন পোকার মতো থিকথিক করছে। বাসগুলিতে ওঠা যাচ্ছে না। বাসের পাদানিতে পর্যন্ত একটু পা রাখার ফাঁকা জায়গা নেই। কখনও সে বাসের ভিড় এড়াবার জন্যও হেঁটে অফিসে চলে যায়। তাঁর হাঁটার অভ্যাস আছে। কিন্তু আজ তাড়া আছে। আশেপাশে একটাও ট্যাকসি নেই। রিকশাতে যেতে পারে। তাতে আর কতটা সময় বাঁচবে। সে তারপর ভাবল, বাসে না গিয়ে ট্রামে গেলে হয়। ভিড়টা কম মনে হয় ট্রামে। কোনরকমে সে গুঁতোগুঁতি করে একটা ট্রামে উঠে গেল। নানারকম কথা হচ্ছে। সরকার কম্যুনিস্টদের গ্রেপ্তার করছে। কে যেন বলল, চীনের দালাল এরা। এবং এ সময়েই মনে হল, দেয়ালে ভেসে উঠছে লেখা, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। এটা মনে হবার কারণ কি সে বুঝতে পারল না। তবু এইসব ভাবনা তাকে স্বস্তি দেয়। অফিসে বোনাস নিয়ে কোন প্রকার গন্ডগোল হয়নি। গত বছরের এগ্রিমেন্ট ছিল। সেই সুবাদে সব হয়ে গেছে। এ-ভাবে নিজেকে আর কি ভাবে অন্যমনস্ক রাখবে বুঝতে পারছে না। অমলার কথা তাদের বৈভবের কথা ভাবতে পারে। এখন অন্য যে কোনও ভাবনাই তাকে আর্চির অস্বস্তির হাত থেকে রক্ষা করবে। কিংবা আড়াই মাসে টুটুল আর কতটা বড় হয়েছে! বাবাকে চিনতে পারবে ত! কারণ টুটুল মিণ্টু জানেই না তারা যত বড় হচ্ছে তত সে অসহায় বোধ করছে। নিরাপত্তার অভাব এত বেশি এই শহরে যে মানুষগুলোকে পাগলা কুকুর বানিয়ে ছেড়েছে।

তখনই ট্রামটা স্টপেজে এসে গেল। ঘড়িতে পাঁচটা বেজে গেছে। সে কেমন দৌড়ে যাচ্ছিল। চারপাশের মানুষজনের প্রতি কোনও তার ভ্রূক্ষেপ নেই। এখনই এনকোয়ারিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে, ক নম্বর প্ল্যাটফরমে ট্রেনটা আসছে। লেট আছে কিনা। একটা প্ল্যাটফরম টিকিট কাটতে হবে। এগুলো সে স্টেশনে ঢুকেই সেরে ফেলল। ঘড়িতে দেখল, আরও আধ ঘণ্টাখানেক সময়। এই সময়টা সে কি করবে! এই সময়টা সে ভাবল মানুষজনের মুখ দেখে কাটিয়ে দেবে। অবশ্য এত নোংরা প্ল্যাটফরম যে পা ফেলার জায়গা নেই। দলে দলে উদ্বাস্তু আবার আসছে। সারা স্টেশন জুড়ে বাক্‌স প্যাঁটরা মলিন পোশাক পরা উদ্বাস্তুর দল। সেও এ-ভাবে তার বাবার সঙ্গে এ-দেশে এসেছিল। এখনও সেই মিছিল চলছে। এত ভালমানুষ জন্মায়, অথচ মানুষের নীচতা তাতে নষ্ট হয় না। ঈশম দাদার কথা আজ অনেকদিন পর হঠাৎ কেন জানি মনে পড়ে গেল। তিনি কেমন আছেন কে জানে। এরা কোথা থেকে এসেছে জিজ্ঞেস করলে হয়।—কোথা থেকে।

—ফরিদপুর বাবু।

লোকটা আরও কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু অতীশ জানতে চায়, সেই সোনালী বালির নদীর চরের কাছাকাছি কেউ আছে কিনা। থাকলে যেন প্রশ্ন করত, ফতিমাকে চেনেন? সামসুদ্দিনকে। ঈশম দাদাকে। তারপরই মনে হল সবটাই সে কোনও অদৃশ্য প্রেতাত্মার ভয় থেকে করছে। এইসব মানুষেরাও এক অদৃশ্য প্রেতাত্মার শিকার। ঈশ্বর এবং প্রেতাত্মা কেউ কম যায় না। এরা ঈশ্বরের নামে তাড়া খেয়ে ভিটে মাটি ছেড়েছে। এবং এই সময় সে কেমন তার বাবার ওপর কিছুটা বিজয়ী। সে মনে মনে বলল, বাবা আপনার ঈশ্বরের অবস্থা দেখে যান। আপনার ঈশ্বর ঈশমদাদার ঈশ্বরের এই পরিণতি।

সে তারপর আর দাঁড়াল না। দেখল সামনে সংখ্যায় প্ল্যাটফরম নম্বর ঝুলছে। ভিতরে ঢুকে গেল। কোথায় দাঁড়ালে ঠিক হবে বুঝতে পারছে না। পাশের প্ল্যাটফরমে একটা লোকাল গাড়ি এসে ভিড়ছে। মুহূর্তে প্ল্যাটফরমটা মশামাছির মত ভনভন করতে থাকল। চিৎকার এবং গুঞ্জন, ট্রেনের হুইসিল কানে প্রায় যেন গরম ইস্পাত ঢেলে দিচ্ছে। এবং কি ভয়ংকর উত্তেজনা তার। সে পায়চারি করছিল, আর ভাবছিল, কখন নির্মলার মুখ দেখতে পাবে। আগের দিকে থাকবে, না পেছনের দিকে থাকবে সেটা চিঠিতে জানালে ভাল করত। সে-ভাবে সে জায়গা ঠিক করে নিতে পারত। এবং সে বেশ অস্থির হয়ে পড়ছিল। পুত্র কন্যার মুখ দেখার জন্য অধীর হয়ে পড়ছে। কিছুটা সে বিচলিত বোধ করছে। দীর্ঘদিন পর স্বামীস্ত্রীর সঙ্গে দেখাদেখির বিষয়টা তার জানা নেই। আজ কেন জানি নির্মলার জন্য বড় বেশি আবেগ তার। কাল রাতেও। কিন্তু সবটা মাটি করে দিয়ে গেছে আর্চির প্রেতাত্মা। এখন আবার সেই জুজুর ভয়টা গ্রাস করতে চাইলে সে জোর করে ভাবল, সব মনের ভুল। সব সে ভুল দেখে। পাপবোধ তাকে পীড়ন করে চলেছে। যে ভাবেই হোক তাকে মনের জোরে লড়ে যেতে হবে। সে খুব স্বাভাবিক মানুষ। কাল রাতে জাগরণ গেছে নির্মলাকে কিছুতেই টের পেতে দেবে না। নির্মলা তবে ভেঙে পড়বে। এখানে ভেঙে পড়লে নির্মলাকে দেখার কেউ নেয়। ওখানে অন্তত আর কেউ না থাকুক তার বাবা ছিলেন।

অতীশ মনে মনে বলল, কিরে টুটুল আমাকে চিনতে পারবি ত। ভুলে যাসনি ত আমাকে। হামাগুড়ি দিতে দিতে উঠে দাঁড়াস। দু-হাত তুলে বা বা করিস। সে নিজের সঙ্গে নিজে যখন এ-ভাবে কথা বলছিল তখনই ট্রেনটা প্ল্যাটফরমের ভেতরে মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সে ছেলেমানুযের মতো ছোটাছুটি লাগিয়ে দিল। সে জানালাগুলো দেখে যাচ্ছে। কত মানুষ, ভদ্রজন, ভেণ্ডার, চাষী, শ্রমিক স্ত্রী পুত্র নিয়ে পরিবার, যুবক যুবতী, বুড়ো বুড়ি এবং হল্লা চেচাঁমেচি—সব আছে কেবল নির্মলা নেই। সে শেষ কামরা পর্যন্ত ছুটে গেল। না নেই। ওরা তাহলে আসেনি! চারপাশে মিছিলের মতো মানুষজন। সে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। আহাম্মকের মতো কতবার যাত্রীদের সঙ্গে ধাক্কাফাক্কা খেয়ে যখন একেবারেই নিরাশ, ফিরে যাচ্ছে তখনই চিৎকার মেজদা এদিকে। ঐ তো নির্মলা। প্ল্যাটফরমে বাক্স পেঁটরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টুটুল কোথায়? মিণ্টু! কিছুটা দুর থেকেই মিণ্টুকে দেখতে পেল। টুটুল দু-হাতে মায়ের পা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

তাড়াতাড়ি বের হওয়া দরকার। মানুষটা ছুটে আসছে। সারা রাস্তার ক্লান্তি উদ্বেগ মুহূর্তে নির্মলার জল হয়ে গেল। মানুষটা আসছে। প্রায় ছুটে আসছে। নির্মলা তাড়াতাড়ি টুটুলকে কোলে তুলে নিল।

অতীশ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, এত সামনে থাকবে বুঝব কি করে! ওদিকে খুঁজছি। প্ৰহ্লাদ কাকা সব নামিয়েছে ত। হাসু একবার দেখে আয় আর কিছু আবার পড়ে থাকল কিনা।

আর তখনই আশ্চর্য ছোট্ট টুটুল কেমন সহসা মার কোল থেকে অতীশের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল। টুটুল, দু-হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাবাকে দেখে এতটুকু শিশু বোঝে কি করে সে বাবা। সে তার প্রিয়জন। অতীশও দু-হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। টুটুল অতীশের কোলে উঠেই গলা জড়িয়ে ধরেছে। অতীশ বলল, –তুই আমাকে চিনতে পারলি। –আমার কত ভয় ছিল, আমাকে ভুলে গেছিস হয়ত।

নির্মলা বলল, কাণ্ড দেখ ছেলের। আমরা যেন কেউ না।

অতীশ নির্মলার কথায় হাসল। সে এই প্রথম নির্মলার দিকে চোখ তুলে তাকাল। লক্ষ্য করল নির্মলা ওর দিকে ভাল করে তাকাতে পারছে না। ক্লান্তি অথচ চোখে মুখে বড় বেশি অধীরতার ছাপ। সে বুঝতে পারছিল, নির্মলা ওকে গোপনে দেখছে। তাড়াতাড়ি সে কিছুটা অন্যমনস্ক হবার মতো বলল, নাও হাঁটো।

কুলিরা মাথায় দুটো নীল রঙের ট্রাংক বিছানা তুলে নিয়েছে। মিণ্টু পা পা হেঁটে যাচ্ছে। টুটুলটা ভীষণ পাজি। বাবাকে দখল করে বসে আছে। ওর ভারি হিংসা হচ্ছিল! সে কাছে গিয়ে বলল, বাবা আমি মিণ্টু।

—হ্যাঁ মা। তুমি আমার মিণ্টু। বলে সে নুয়ে এক হাতে মিণ্টুকেও বুকে তুলে নিল। এবং দুজনেই পরম নির্ভয়ে বাবার গলা জড়িয়ে কেমন শরীরে বাবা বাবা গন্ধ শুঁকছে। যেতে যেতে অতীশের মনে হচ্ছিল, শিশুরা বোধহয় গন্ধ শুঁকে টের পায় কে তার আপনজন। টুটুল কত কথা বলছে যার মাথামুণ্ডু সে কিছুই বুঝছে না। এক অতিকায় শেডের নিচে সে তার পুত্রকন্যাকে বুকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পরম গভীর উষ্ণতায় অতীশ জীবনের অন্য এক মহিমা অনুভব করল আজ। যেন কতকাল ধরে এদেরই প্রতীক্ষায় সে এই পৃথিবীতে বসেছিল।

হাসুর হাতে একটা অ্যাটাচি, একটা লেদার ব্যাগ। প্রহ্লাদ কাকা নিয়েছে বড় একটা পুঁটলি। মার দেওয়া সব টুকিটাকি জিনিষ আছে এতে। প্রহ্লাদ কাকার কাছে ওটা খুবই মহার্ঘ বস্তু। সব ফেলে গেলেও যেন কিছু আসে যায় না। কিন্তু এটা বাসায় পৌঁছে দেওয়া তার বড় দরকারী কাজ। নানারকমের আচার, আমসত্ব, লেবু, আনারস, গাছের পেয়ারা, ক্ষেতের মুসুরি ডাল, কিছু সুগন্ধ আতপ চাল—ছেলে কি খেতে ভালবাসে না বাসে, সব ঐ পোঁটলাটা খুললেই বোঝা যাবে। সুতরাং প্রহ্লাদ কাকা খুব প্রফুল্ল চিত্তে এখন যেতে পারছে। সে এই কলকাতা শহরে কখনও আসেনি। দরজার গোড়ায় সব নামিয়েই বলল, মেজবাবু আমাকে একবার কালীঘাট দর্শন করিয়ে দেবেন।

নির্মলা শেষ পর্যন্ত এত বড় বাসাবাড়ি দেখে অবাক। পুরানো বাড়ি, নতুন চুনকাম করা, দু- ঘরে দুটো তক্তপোশ। একটা টেবিল, বসার দুটো চেয়ার এবং বাসাটার পক্ষে এগুলি খুবই অকিঞ্চৎকর—কারণ, সোফা সেট, বাতিদান কিছুই নেই। জানালায় পর্দা কেনার পয়সা মানুষটার হয়নি। গাঁয়ের বাড়িতে একভাবে কেটে যায়। শহরে এলে যেন এসবের দরকার বোধ হয়। কিন্তু নির্মলা মানুষটাকে জানে—চলে যাবার মতো হলে সে বেশি কিছু চায় না। নির্মলার বাপের বাড়ির আত্মীয়স্বজন বড়ই প্রতিষ্ঠিত জীবনে। ওর বাবার যেমন গাড়ি বাড়ি আছে, আত্মীয়স্বজনদেরও তেমনি। সেদিক থেকে তার মানুষটা প্রায় খুব গরীবই বলা চলে। এবং মানুষটার এ-জন্যই তার বাপের বাড়ির প্রতি একটা তাচ্ছিল্য ভাব আছে। গরীবের অহংকার তো ঐ এক জায়গায়। সব কিছু তুচ্ছ করে দেখা। এবং তার মানুষটার ধারণা দেশটা যা তাতে বাড়ি গাড়ি সোফা সেট মানুষের মানায় না। যে পারে তাকে কিছুটা অধার্মিক হতেই হয়। কোনও না কোনভাবে সে শোষণের হাতিয়ার হয়ে পড়ে।

এই রাজবাড়ি, বাসা এবং সামনে পাতাবাহারের গাছ, কিছু দূরে বড় এক শেফালী ফুলের গাছ, তারপরে বাগান, এ-সব খবর চিঠিতেই জানতে পেরেছিল নির্মলা। মনে মনে সে এমনই আশা করেছিল। বাতিগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কুম্ভবাবু খবর পেয়ে এসে গেছে। টুটুলকে কোলে নিয়ে আদর করছে। নির্মলাকে বৌদি বৌদি করছে। ওর বৌ এসে ঘরদোর ঠিকঠাক করতে লেগে গেল নির্মলার সঙ্গে। অতীশ হাসুকে স্নান করে নিতে বলল। স্টোভে চা বসানো হয়েছে। কুম্ভবাবুর কথাবার্তা শুনে নির্মলা খুব খুশি। মানুষটা তাহলে একজন ভাল সহকারী পেয়ে গেছে। শহরে এ-সবের বড়ই দরকার।

অতীশ বলল, প্রহ্লাদকা, এখন একটু চা মিষ্টি খাও। পরে রান্না হলে খাবে।

—নাগো মেজবাবু। সারা রাস্তায় বৌমা বড়ই খাইয়েছে। মিষ্টি খেয়ে সুখ পাব না। রাত হলেই খাব।

টুটুল কখন তক্তপোশের নিচে গিয়ে বসে আছে। মিণ্টু টুটুলের ঠ্যাং ধরে টেনে আনছে। আর ডাকছে বাবা বাবা টুটুল কথা শুনছে না। দুষ্টুমী করছে। আমাকে কামড়াচ্ছে।

নির্মলা বলল, তোরা এসেই দু’জনে লাগলি!

অতীশের এসব বড় ভাল লাগছিল। এতদিন সে যেন বনবাসে ছিল। মনমরা, কেউ নেই, কেমন সম্পর্কহীন হয়ে পড়ছিল। আর্চি এই সুযোগে তার ওপর বেশ হামলা চালিয়ে গেছে। এখন আর্টি আসতে ঠিক ভয় পাবে। আর কাউকে না পাক টুটুল মিণ্টুকে পাবে। কারণ এ-বয়সে এরা বড়ই পবিত্র। ফলে আর্চির আক্রোশ থাকার কথাও নয়। তারপরেই কেন জানি মনে হল, এরা তার জাতক, যদি আর্চি এদের কোন অনিষ্ট করতে চায়; যদি আর্চি টের পেয়ে যায় তার পৃথিবী বলতে এরাই। সে কিছুটা তক্ষুনি কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। সামনেই বড় সেই পুকুর। কালো জল। হেঁটে হেঁটে যদি টুটুল চলে যায়, যদি পড়ে যায়, অথবা কে জানে, কোনও এক অদৃশ্য আক্রোশ কখন কিভাবে যে আক্রমণ করবে! পুকুরটা যে এত ভয়ের হতে পারে, টুটুল মিণ্টু আসার পরই অতীশ কেমন টের পেয়ে গেল সেটা।

নির্মলা তখন চা করে এনেছে। কুম্ভবাবু বলল, বৌদি কেমন লাগছে জায়গাটা।

—খুব ভাল। আর একট। মিষ্টি দি—?

কুম্ভ বেশ মনোযোগ সহকারে খাচ্ছে। অতীশকেও দেওয়া হয়েছে। চা নিয়ে তক্তপোশে বসতেই কোথা থেকে ঠিক গন্ধ পেয়ে টুটুল টলতে টলতে চলে আসছে। এক মাথা চুল, চোখ টানা। আর চাপা নাক বাদে এই ছেলের আর সবই বাপের মতো। অতীশ ছেলেকে ভাল করে দেখছিল। টলতে টলতে এসে হাঁটুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অতীশ ছেলেকে বসালে টুটুল গা বেয়ে উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বাপের চা টেনে নিতে চাইল। মিষ্টির প্লেট টেনে ফেলে দিতে চাইল। বাধ্য হয়ে অতীশ কিছুটা মুখে দিতেই শান্ত, চুপচাপ। আসনপিঁড়ি হয়ে ভাল ছেলে হয়ে গেল টুটুল। কেবল মুখের খাবার শেষ হয়ে গেলেই অস্থির হয়ে পড়ছে। মিণ্টু টুটুলের এতটা সহ্য করতে পারছিল না। সে বড় হয়ে গেছে এ-বোধটুকু খুব প্রবল। কাছে এসে বলল, নাম নাম। বাবা খাচ্ছে। খেতে নেই। কিন্তু জোরজার করেও নামাতে পারছে না। টুটুল বাপের জামা খামছে ধরে রেখেছে।

অতীশ এবার মিণ্টুকে তুলে নিল আর এক পাশে। এবং মিণ্টুর মুখে দিতেই সেও খুব ভাল মেয়ে হয়ে গেল। বলল, বাবা পুতুল দেবে। আমি পুতুল নেব। বাবা, একটা না বড় সাপ তেড়ে গেছিল। তুমি ভয় পাও না বাবা?

—হ্যাঁ মা আমিও ভয় পাই।

—টুটুলটা দুষ্টু, ও ভয় পায় না।

দিদির এসব কথা টুটুল গ্রাহ্য করছে না। সে প্রাণপণ বাপের সঙ্গে খেয়ে চলেছে। নির্মলা একবার এসে ধমক লাগাল, মানুষটাকে বসে তোরা শান্তিতে একটু খেতে দিবি না। নাম বলছি। অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি! নিজে খাচ্ছ না কেবল ওদের খাইয়ে যাচ্ছ। পেট ছাড়লে আমি কিছু জানি না বাপু।

সবই এত ভাল লাগছে কেন। এই যে সামান্য অভিমান নির্মলার তাও এত মধুর মনে হচ্ছে কেন! সে নিজে আরও উপভোগ করার জন্য টুটুলের মুখে সামান্য সিঙাড়ার কুচি দিতেই ঝাল খেয়ে থুতু ছিটাতে থাকল। তারপর না পেরে বাপের ধোয়া জামায় মুখ ঘষতে লাগলে জামাটায় হলুদ ছোপ ধরে গেল। নির্মলা এসে যখন দেখল রেগে কাঁই।—দাগটা উঠবে ভাবছ!

অতীশের সবই ভাল লাগছিল। বড় ভাল লাগছিল। জীবনের এই ভাল লাগাটার দাম সামান্য দাগে কিছু আসে যায় না। সে বলল, কুম্ভবাবু হাসিরাণীকে একটা লক্ষ্মীর পট কিনে দেবেন। মাঝে মাঝে কেন জানি মনে হয় সংসারে এই পটটা বড়ই দরকার।

কুম্ভ মনে মনে বলল, সবই দেব। আগে আপনাকে কি দিই দেখুন। তার এখন কাজ এ লোকটাকে বাগে আনা। সেই যে কি বলে না, ঘোড়া হাতি গেল তল, তারপরের লাইনটা সে মনে করতে পারল না। প্রথম রাউণ্ডে সে জিতেছে। নবর কাজে বাগড়া দিয়েছে। সনৎবাবুর ইগোতে ধুনি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয় রাউণ্ডটা জটিল ছিল বলেই পারেনি। রাজার কাছে ফয়সালার সময় সে আর সনৎবাবু এক পক্ষ থাকবে এমনটা তার মনে হয়েছিল – কিন্তু স্যারটি বেশ কায়দা করে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো ভণ্ড সেজে বসলেন। ফলে দ্বিতীয় রাউণ্ডে তার হার হয়েছে। তাছাড়া এই লোকটার পেছনে বউরাণী আছে। রাজা একটা ম্যাড়া। কি যে তুকতাক করেছে—বউরাণীর ওপর এখন রাজবাড়িতে কারো কথা নেই। শেষপর্যন্ত জাল মাল তৈরী করা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। যুদ্ধক্ষেত্রে জয় অনিবার্য সে জেনে এসেছে। এতে তার সহায় মা তারা। সকালে উঠেই স্নান সেরে মার পায়ে রাঙাজবা দেয়। ভূলণ্ঠিত হয়। মা, মাগো আমার কি অপরাধ বল। অজ্ঞানের জ্ঞান তুই মা তারা। ভুল হলে পথ দেখাস মা। সে হেরে গিয়ে মায়ের কাছে প্রায় হত্যা দিয়ে পড়েছিল। বুড়ো ম্যানেজারকে তাড়ানো থেকে লেবার প্রব্লেম ট্যাকল করা কত ওস্তাদী লাগে হাসিরাণী যদি বুঝত! সবই মায়ের কৃপা। এখন কৃপা পরবশে সে বুঝছে, কিছুদিন এই লোকটার হিতৈষী সেজে থাকা ভাল। কোনদিকে কে ধোঁয়া দেবে কে জানে। সে বলল, কি যে বলেন না দাদা! হাসিকে লক্ষ্মীর পট দেবেন তা আবার আমাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে?

—না যদি কিছু মনে করেন আবার!

—এই বোঝলেন, বৌদি দেখুন বৌদি ও বৌদি আমাকে কেমন পরপর ভাবছে।

নির্মলা সব গোছগাছ করছিল, সে শুনতে পাচ্ছে সব। পাশের ঘর থেকেই বলছে, আপনার দাদার আবার ঈশ্বর বিশ্বাস কবে থেকে হল। ওতো এসব কিছু মানে না।

অতীশের কোলে টুটুল। হাসুর স্নান হয়ে গেছে। নির্মলা ও-ঘর থেকেই কথা বলছে। ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়ে কথা বলছে, টুটুলকে কোলে নিয়ে সে কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আসলে আশ্রয়। হাসিরাণীর কিছুটা আশ্রয়ের অভাব আছে। কাবুল-বাবুর সঙ্গে সম্পর্কের কথাও তার মনে এসেছে। সেই থেকে কেন জানি মনে হয়েছে—একটু আশ্রয় পেলে প্রলোভনের হাত থেকে হাসি মুক্তি পাবে। মা জ্যাঠিমারা যেমন সব প্রলোভন থেকে নিজেদের আত্মরক্ষা করতে শিখেছিলেন হাসিরাণীও তেমনি তার প্রলোভন থেকে মুক্তি পাক।

মানুষের শুভাশুভের বিশ্বাস থেকেই কথাটা বলা। এটাকে অতীশ সেভাবে ঠিক ঠিক ঈশ্বরে বিশ্বাস ভাবে না।

কুম্ভবাবু ভূত দেখার মতো অতীশকে দেখছে। মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাস না থাকলে সে শুনেছে শয়তান হয়ে যায়। একমাত্র শয়তানেরই ঈশ্বর বিশ্বাস থাকে না। আর সেই উটকো সব কম্যুনিষ্ট আছে তারাও এটা করে না। কুম্ভর কাছে কম্যুনিষ্ট আর শয়তান এক। সে তাদের ফারাক বড় বেশি বোঝে না। সে বলল, দাদা আপনি তাহলে কম্যুনিষ্ট।

অতীশ হা হা করে হেসে উঠল। বলল, সুযোগ পেলাম কোথায়। দাড়ি গোঁফ না গজাতেই পেটের টানে বের হয়ে পড়েছি।

—কিন্তু এটা ত ভাল কথা নয়।

তারপরে তলে তলে কুম্ভর কূট অভিসন্ধি কাজ করতে থাকে। এই শয়তানের ভয় রাজবাড়িকে বড়ই কাবু করে রেখেছে। কম্যুনিষ্ট গন্ধ পেলেই হল। এবং এই সুযোগটা হাতছাড়া করা তার বোকামি হবে। সে আরও সামান্য রগড়ে দেখতে চাইল, বলল, ঈশ্বর ত কারো ক্ষতি করে না দাদা। তিনি মঙ্গলময়। সন্তান-সন্ততি নিয়ে ঘর করেন, ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না, অসুখে বিসুখে ভরসা পাবেন কিসে।

অতীশ বলল, এখনও ভেবে দেখিনি সেটা!

যাই হোক কুম্ভ বুঝতে পারল, সহজে নড়ে বসবে না। ধীরে ধীরে চামড়া খসাতে হবে। একদিনে হবার নয়। সে উঠে যাবার সময় বলল, দাদা যাই। তারপর টুটুলকে চুমু খেল। মিণ্টুকে দুবার লাফিয়ে ওপরে তুলে ধরে ফেলল।

নির্মলা বলল, মানুষটা বেশ।

অতীশ কিছুই বলল না। সে জানালায় দেখল সেই পাতাবাহারের গাছ। সবাই শুয়ে পড়লে সে গোপনে বের হয়ে দেখবে—আজও পাতায় জল লেগে আছে কিনা। তারপর কেমন ভীতু গলায় নির্মলাকে ডেকে বলল, সামনেই পুকুর। টুটুল মিণ্টুকে চোখে চোখে রেখো। পুকুরটা ভাল না। প্রায় বছরই কেউ না কেউ ডুবে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *