ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী

ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী

এ কাহিনি অভিজিৎ সেনের। কিছুটা কিছুটা জেনেছি তাঁর ডায়েরি থেকে। আমি তাঁর মুখেই শুনেছি, অনেক নাম এবং জায়গাগুলিও বদলাতে হবে। সংশ্লিষ্ট পাত্রপাত্রীরা অনেকেই বেঁচে আছেন এখনও। অভিজিৎ সেন গোপনীয়তায় তোয়াক্কা করতেন না। কিন্তু আমি কেন খামোখা ফ্যাসাদে পড়তে যাব।

অভিজিৎ সেন নিজেই আমাকে বলেছিলেন, যদি পারিস আমার জীবনের এই ঘটনাটা লিখিস। তাতে লোকশিক্ষা হবে।

কাহিনির শুরু বম্বে মেলের ফার্স্ট ক্লাসের কামরায়।

তার আগে বলে নিই, বিখ্যাত অভিজিৎ সেন আমাদের কাছে অভিদা। আমার চেয়ে বয়েসে অন্তত পনেরো বছরের বড়ো। বেশ সুঠাম, তেজি চেহারা। অনেকদিন পর্যন্ত যৌবন ধরে রেখেছিলেন।

আমার সঙ্গে পরিচয় পাড়ার ছেলে হওয়ার সুবাদে। তখন উত্তর কলকাতার রাজবল্লভ পাড়ায় থাকি। কিছু কিছু বাড়ির সামনের রকে আড্ডার আসর বসাবার রেওয়াজ ছিল। এখন সেই সব আড্ডা রক ছেড়ে বৈঠকখানায় স্থানান্তরিত হয়েছে, রকগুলো ভেঙে হয়েছে দোকানঘর। কিন্তু রকের আড্ডা আর বৈঠকখানার আড্ডার চরিত্রের তফাত আছে। রকের আড্ডায় রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে যে-কোনো লোক ভিড়ে যেতে পারে। যার যখন ইচ্ছে উঠে গেল, আবার নতুন কেউ এসে বসল।

বিভিন্ন রকে বিভিন্ন বয়সিদের আড্ডা। কোনোটা বুড়োদের, কোনোটা মাঝবয়েসিদের, আর কোনোটা ছেলে-ছোকরাদের।

কোনোটাতেই মেয়েদের যোগ দেওয়ার অধিকার ছিল না। ইংল্যান্ডে বা আমেরিকাতেও অনেক ক্লাবে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমাদের কলকাতাতেও এখনও অনেক ক্লাবে মেয়েরা মেম্বার হতে পারে না।

পাড়ার রকে গোঁফ গজাবার আগে কোনো ছেলে বসতে চাইলে তাকে ধমকে বিদায় করে দেওয়া হত। আমার তখন সদ্য গোঁফ গজিয়েছে।

প্রত্যেক পাড়াতেই গর্ব করার মতন কয়েকজন লোক থাকে। আমাদের ওই পাড়ায় যেমন নুটুদা আর অভিদা। নুটুদা ক্রিকেট খেলোয়াড়, রঞ্জি ট্রফিতে দুবার চান্স পেয়েছিল। ওয়ান ডে ক্রিকেট চালু হওয়ার আগে ক্রিকেট খেলোয়াড়দের এত রমরমা ছিল না, শীতকাল ছাড়া অন্য সময় তাদের নাম শোনা যেত না। কিন্তু অভিদার নাম প্রায় সারা বছরই দেখা যেত খবরের কাগজে। গায়ক হিসেবে নাম ছড়াবার পর ততদিনে মুম্বই থেকে তাঁকে ডাকাডাকি করছে। নমিতা সিংহ নামে একজন ফিল্মের অভিনেত্রীকেও এ পাড়ার মেয়ে বলে গণ্য করা হত। যদিও নমিতা সিংহ মাত্র সাড়ে চার মাস একটা ভাড়া বাড়িতে ছিল, তারপর চলে যায় নিউ আলিপুরে। তবু রাজবল্লভ পাড়া তার ওপর দাবি ছাড়বে না।

এ পাড়ায় অভিদাদের তিন পুরুষের পুরোনো বাড়ি। যৌথ পরিবার, অনেক নারীপুরুষে জমজমাট। বাড়ির মধ্যে একটা ছোটো মন্দির, তার মধ্যে রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ, সকাল-সন্ধে আরতি হত, সেই ঘন্টাধবনি শুনে আমরা সময় বুঝে নিতাম। সন্ধ্যারতির সময়ই আমাদের আড্ডা ভেঙে বাড়িতে ফিরে পড়তে হত।

মুম্বই পাড়ি দেওয়ার পরেও অভিদা মাঝেমাঝেই কলকাতায় আসতেন। তখন তিনি টালিগঞ্জে নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট নিয়েছেন বটে, কিন্তু দু-চারদিন এ পাড়ায় পৈতৃক বাড়িতে কাটিয়ে যেতেন। অন্তত যতদিন তাঁর মা বেঁচেছিলেন।

অত বিখ্যাত মানুষ, খবরের কাগজে ছবি বেরোয়, অথচ অহংকার ছিল না একেবারে। ক্রিকেট খেলোয়াড় নুটুদা বরং কলার উঁচিয়ে গম্ভীরভাবে হেঁটে যেতেন রাস্তা দিয়ে, বিশেষ কাউকে পাত্তা দিতেন না। কিন্তু অভিদা মিশতেন সব বয়েসিদের সঙ্গে।

আমাদের রকের আড্ডায় সাহিত্য-শিল্প-সিনেমা-পরনিন্দা-পরচর্চা সবই চলে। কথায় কথায় রাজা-উজির মারি। অল্প বয়েসে সব কিছুতেই আঘাত করার একটা প্রবণতা থাকে। আধুনিক গায়ক-গায়িকাদের আমরা নস্যাৎ করে দিতাম, অভিদাকেও বড়ো গায়ক মনে করতাম না। তবে গলার আওয়াজ জোরালো, আধুনিক গান না গেয়ে তাঁর ক্লাসিকাল গানে টিকে থাকা উচিত চিল। আমরা মুগ্ধ ছিলাম অভিদার ব্যক্তিত্বে।

বয়েসের অনেক তফাত থাকলেও আমাদের মতন অর্বাচীনদের আড্ডায় তিনি এসে বসতেন মাঝে মাঝে। অমন বিখ্যাত হয়েও পোশাকের কোনো আড়ম্বর ছিল না, পাজামা আর গেঞ্জি পরে রাস্তার ধারে বসতে দ্বিধা করতেন না। চওড়া বুক, ফরসা রং, তখনও পর্যন্ত একটাও চুল পাকেনি, চোখে পড়ার মতন চেহারা।

হাতে সবসময় সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার। অকৃপণ সিগারেট বিলোতেন। আমরা প্রথম প্রথম সংকোচ বোধ করতাম, তিনি হাসি মুখে বলতেন, নে নে, অত লজ্জা কীসের। আমি ষোলো বছর বয়েস থেকেই বিড়ি টানতে শিখেছি।

উলটোদিকে নিবারণদার চায়ের দোকান। অভিদা হাঁক দিয়ে বলতেন, নেবাদা, এখানে এক রাউন্ড চা দিয়ে যাও। ঠিক আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর চা দিয়ে যাবে।

তারপর আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, এ পাড়ার লেটেস্ট খবর কী বল! কেউ কারুর বউকে নিয়ে ভাগেনি? ওই কোণের বাড়িটায় নতুন ভাড়াটে এসেছে, দুটো ডবগা ডবগা ছুঁড়িকে দেখলুম, তোরা কেউ প্রেম করিসনি?

উত্তর কলকাতায় সে সময়ে মুখের ভাষায়, শালা, মাগি, বেজম্মা এইসব শব্দ অনায়াসে মিশে থাকত। কেউ খুব আদর করে তার বন্ধুকে ডাকত। এই শুয়োরের বাচ্চা, এদিকে আয়।

একদিনের কথা মনে আছে। আমার বন্ধু মানস বরাবরই পেটরোগা। কথা বলতে বলতে হঠাৎ বাথরুমের দিকে ছুটত। তার মা তারকেশ্বরে পুজো দিয়ে মন্ত্র পড়া ফুলপাতা মুড়ে একটা বড়ো রুপোর মাদুলি বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা সব সময় তাকে গলায় পরে থাকতে হত। সেদিন রুপোর মাদুলিটা তার জামার বাইরে বেরিয়ে পড়েছে, সেটা দেখে অভিদা জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী রে?

মানস তারকেশ্বর, মা পেট খারাপ এই সব বলতেই অভিদা ঝুঁকে এসে হ্যাঁচকা টানে সেটা ছিঁড়ে নিলেন।

তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, এতে সত্যি কাজ হয়?

মানস বলল, অনেকটা কমেছে।

অভিদা বললেন, ভালো কথা, আমাদের বাড়িতে নেপু নামে একটা বাচ্চা চাকর আছে, সেটা যখন তখন পেট ব্যথায় ছটপট করে। তাকে পরিয়ে দেব, যদি তার সারে…তোর মাকে বলিস তোর জন্য আর একটা গড়িয়ে দিতে।

মানস কাঁচুমাচু হয়ে গেল। তাদের বাড়ির অবস্থা সচ্ছল, ওইটুকু রুপোর জন্য কিছু যায় আসে না, কিন্তু মন্ত্রঃপূত মাদুলি কি অন্যকে দেওয়া যায়? বাড়িতে খুব বকাবকি করবে।

অভিদা কিন্তু মাদুলিটা ফেরত দিলেন না। তাঁর এই ব্যবহারটা খুব অদ্ভুত লেগেছিল।

যাই হোক, এবার আসল গপ্পে আসা যাক।

সেদিন আমার বম্বে মেল ধরার কথা। হাওড়া ব্রিজে দারুণ জ্যাম, ট্যাক্সি আর নড়ে চড়ে না। আমার কাছে শুধু একটা বড়ো ব্যাগ ছিল, একসময়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে প্ল্যাটফর্মে যখন পৌঁছলাম, তখন ট্রেন নড়াচড়া শুরু করেছে।

হুড়মুড় করে উঠে পড়ে আমার কিউবিকল খুঁজে ভেতরে ঢুকে দেখলাম, তলার একদিকের বাঙ্কে বসে আছে দুজন যাত্রী, অন্য বাঙ্কে পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আর একজন।

সবে কলির সন্ধে, এসময় কারও শুয়ে থাকার কথা নয়। হয়তো লোকটি অসুস্থ, তাই ভালো করে লক্ষ করিনি। ব্যাগটা সিটের তলায় রেখে, অন্য দুজনের পাশে বসার পর দেখি, সেই শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় সামান্য টাক, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।

সিগারেট দেশলাই পকেটে নেই, ব্যাগে ভরা আছে। আবার ব্যাগটা টেনে বার করে, সিগারেট দেশলাই নিয়ে একটা জ্বালাবার পর দেখি, তখনও শুয়ে থাকা যাত্রীটি চোখ ফেরায় নি। অন্য দুজন দক্ষিণ ভারতীয়, তারা গল্প করছে নিজেদের ভাষায়।

কয়েক মুহূর্ত পরে সেই লোকটি বলল, তুই সুনীল না?

সঙ্গে সঙ্গে গলার আওয়াজে চেনা গেল। অভিদা।

আশ্চর্য, আমি অভিদাকে চিনতে পারিনি, আর উনি আমাকে মনে রেখেছেন?

এর মধ্যে কেটে গেছে প্রায় বছর দশেক। আমি রাজবল্লভ পাড়া ছেড়ে চলে গেছি দমদম। অভিদার ছবি নিয়মিত পত্রপত্রিকায় দেখি, অনেক খবরও থাকে তাঁর সম্পর্কে। এখন তিনি আর শুধু গায়ক নন, অনেক হিন্দি ফিলমের সার্থক সুরকার।

আগে চশমা পরতেন না। মাথা ভরতি চুল ছিল। অভিজিৎ সেনের মতন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ওরকম খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে ট্রেনে যাচ্ছেন, এটাও কি ভাবা যায়? সবাই খানিকটা সাজগোজ করে। আর ফিলম সংক্রান্ত লোকজনদের কিছুটা ঝলমলে উৎকট পোশাক পরাই রেওয়াজ।

অভিদা জনপ্রিয়তার শিখরে, তাঁর কথা তো আমি জানবই , কিন্তু আমার নামটা তিনি দশ বছর পরেও মনে রেখেছেন, স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর, তা মানতেই হবে।

প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর অভিদা জিজ্ঞেস করলেন, তুই এখন কী করছিস রে সুনীল? সাকসেসফুল হয়েছিস তা বোঝাই যাচ্ছে, ট্রেনে ফার্স্টক্লাসে ট্রাভল করছিস। চাকরি, না বিজনেস?

না, নিজের পয়সায় টিকিট কেটে ফার্স্টক্লাসে যাওয়ার মতন অবস্থা আমার হয়নি। তখন পর্যন্ত আমি শুধু কবিতাই লিখি। কবিতা লিখে কিছু নাম টাম হলে, টাকা পয়সার দিক থেকে কোনো সুবিধে হয় না বটে, তবে বিভিন্ন জায়গা থেকে কবি সম্মেলন বা সাহিত্য বাসরে আমন্ত্রণ পাওয়া যায়, গল্প-উপন্যাস লেখকরা বরং এদিক থেকে খানিকটা বঞ্চিত। আমি ভ্রমণ-ক্ষ্যাপা, দূরের কোনো জায়গা থেকে ডাক পেলেই ছুটে যাই।

আমার গন্তব্য মুম্বই নয়, আমেদাবাদ। একটি গুজরাতি প্রতিষ্ঠান আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে। তারাই ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে দিয়েছে। মুম্বইতে এক রাত্রি বাস করে পরদিন আমেদাবাদের ট্রেন ধরতে হবে।

একটু পরে জিজ্ঞেস করলাম, অভিদা, তোমার শরীর খারাপ নাকি? এখন থেকেই শুয়ে পড়েছ?

অভিদা বললেন, দুদিন ধরে গা-টা ম্যাজ ম্যাজ করছে। তা ছাড়া পায়ের যা অবস্থা, বসতে গেলে পা-টা একেবারে সোজা সামনে মেলে থাকতে হয়। সেটা ভালো দেখায় না।

তলার দিকে চাদরটা একটু সরালেন অভিদা। তাঁর একটা পায়ের অনেকখানি প্লাস্টার করা। খুব নতুন নয়, তার ওপরে কিছু মানুষের সই রয়েছে।

কোনো মানুষের পা ভাঙা দেখলেই কৌতূহল হয়। জিজ্ঞেস করলাম, কী করে ভাঙল?

অভিদা হাসতে হাসতে বললেন, ভগবান ভেঙে দিয়েছে।

সবসময় ঠাট্টা-মসকরা করা অভিদার স্বভাব। এটা কী ধরনের মসকরা? আমি বললাম, ভগবান নিজে এসে ভেঙে দিলেন? তুমি তাঁকে দেখতে পেয়েছিলে?

অভিদা বললেন, নারে, দেখতে পাইনি। পেছন দিকে ছিল। ওই যে কথা আছে না, ‘ঠিক দুক্কুর বেলা, ভূতে মারে ঠেলা’, সেই রকমই। ভূতের বদলে ভগবান আমায় পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিল।

আমার চোখে তখন কৌতূহল দেখে অভিদা বললেন, তোকে ব্যাপারটা পরে বলব। এখন একটা কাজ কর তো, তোকে যখন পাওয়াই গেছে, একটু খাটিয়ে নিই। এই বাঙ্কটার তলায় দ্যাখ আমার বড়ো ব্যাগটার পাশে একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলা আছে, সেটা ওপরে নিয়ে আয়।

সেই ঝোলাটার মধ্যে একটা স্কচ হুইস্কির বোতল। লুকোবার কোনো চেষ্টাই নেই, ওপরের দিকটা বেরিয়ে আছে। একটা জলের ফ্লাক্স, আর একটি কাচের গেলাস।

অভিজিৎ সেনের জীবনযাত্রার কাহিনিও সুবিদিত।

ইচ্ছে করলে অভিদা হয়তো ফিলমের নায়কও হতে পারতেন। কিন্তু অত আলো ও ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার এক কথা বলা তাঁর পছন্দ নয় বলে, কয়েকজন পরিচালক আগ্রহ দেখালেও অভিদা রাজি হননি। কিন্তু তাঁর অনেক কীর্তি-কাহিনি অনেক নায়ক-নায়িকাকেও হার মানিয়ে দেয়।

মুম্বইতে পাকাপাকি যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে এক উঠতি অভিনেত্রীর বিয়ে হয়। সে বিয়ে ভেঙেও যায় দেড় বছরের মধ্যে তারপর আর বিয়ে করেননি, গুজব ছড়িয়েছে নানা রকম। কিছুদিন স্মিতা পাটিলের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়েছিল। কোনো একটা পার্টিতে মদ খেয়ে নাকি মারামারি করেছিলেন রাজ বববরের সঙ্গে। এক গায়িকাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ইউরোপ। এই তো কিছুদিন আগে মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে পুণে শহরে এক ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়, অভিদা মাথা গরম করে সেই পুলিশকে চড় মেরে বসেছিলেন। সেজন্য আদালতে গিয়ে তাঁকে জরিমানাও দিতে হয়েছে।

এ সবই আমার কাগজে পড়া বা লোকমুখে শোনা। হয়তো এর বাইরেও আরও অনেক কিছু ঘটেছে। হিন্দি ফিলম আমি প্রায় দেখিই না। অভিদার গাওয়া বা সুর দেওয়া অনেক গানই আমার শোনা হয়নি। তবে পুজো প্যান্ডেলের অনেক গান বাধ্য হয়ে শুনতে হয়, হঠাৎ অভিদার গলার আওয়াজ চিনতে পারলে মন দিই। মানুষটিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি বলেই। অভিদা বাংলা গানও কিছু কিছু রেকর্ড করেছে, সেগুলো বিশেষ সুবিধের না, অন্তত আমার রুচির সঙ্গে মেলে না। তবে, এরই মধ্যে একটা ভাটিয়ালি খুবই ভালো লেগেছিল। স্বীকার করতেই হবে, এরকম দরাজ গলা এখন আর কারও নেই।

অভিদা জিজ্ঞেস করলেন, তোর কাছে গেলাস আছে?

আমি বললাম, না তো।

এই তো মুসকিলে ফেললি। মোটে একটা গেলাস এনেছি। ঠিক আছে ফ্লাক্সের ঢাকনাটা ব্যবহার করা যাবে। এ সব খাস-টাস তো?

যদি একটু প্রসাদ দাও।

প্রসাদ কণিকা মাত্র। একটুই পাবি, বেশি না। আগে আমারটা ঢাল। মুম্বইতে কোথায় রাত কাটাবি?

দাদারে একটা ছোটখাটো হোটেল চিনি।

মুম্বইতে যাচ্ছিস, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করিসনি কেন?

তুমি বিখ্যাত লোক, আমাদের ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। তা ছাড়া অনেকদিন যোগাযোগ নেই।

অভিদা অন্য সহযাত্রীদের দিকে গেলাস তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ডু ইউ মাইন্ড?

দুজনেই ভদ্রতা করে বললেন, নো, নো, নো।

অভিদা আবার বললেন, উড ইউ লাইক টু জয়েন আস?

দেখা গেল, দক্ষিণ ভারতীয় দুজনই সাত্ত্বিক প্রকৃতির। মদ স্পর্শ করে না। তবে আমাদের ব্যাপারে আপত্তি নেই।

অভিদা আমাকে বাংলায় বললেন, এত লম্বা জার্নি, মদ না খেয়ে লোকে কী করে যায়, আমি বুঝতেই পারি না। তোর কাছে বোতল আছে?

না।

সঙ্গে রাখিস না? তার মানে এখনও নেশা ধরেনি।

আমি শুধু অন্য কেউ খাওয়ালে খাই।

ওইভাবেই শুরু হয়। নেশাখোর হবি কি না এখন থেকে ঠিক কর। যদি না হতে চাস, এখন থেকেই আর ছুঁবি না। আর নয় তো আমার মতন অবস্থা হবে।

তুমি রোজ খাও?

রোজ খাদ্য খেতে হয় না? আমার খাদ্যের সঙ্গে পানীয়ও লাগে। আগে মার কাছে গেলে খেতাম না। এবার মার কাছেও পারমিশান নিয়ে নিয়েছি। মুম্বইতে খুব কাজ ছিল, মাকে দেখতেই কলকাতায় এসেছিলাম তিন দিনের জন্য।

তোমার মা…এখন ভালো আছেন?

আমাকে দেখেই তো ভালো হয়ে গেলেন! প্লেনে এসেছিলাম, কিন্তু এই পা নিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে বেশ ব্যথা লাগে। তাই ফেরার সময় মনে হল, ট্রেনই ভালো।

টিকিট পেলে কী করে? অনেকদিন আগে তো কাটতে হয়।

কত দালাল আছে! আমার ভক্তও তো আছে রে। তারা জোগাড় করে দেয়। তুই আমার গান শুনিস?

তেমন শোনা হয়নি। একটা ভাটিয়ালি খুব ভালো লেগেছিল। এই রকম গান আরও বেশি গাও না কেন?

ওতে কি আর পয়সা আসে? এখন ফিলমে ঝিং চ্যাক ঝিং চ্যাক ছাড়া চলে না। ফাস্ট বিট। লাউড। সারা পৃথিবীতে প্রায় এক রকম। আমার টাকার দরকার, তাই ওই সব চ্যাংড়া গান গাই। আমরা নাকি রাজা রাজবল্লভের বংশ, তুই জানিস?

ও পাড়ায় থাকতে শুনেছি।

সত্যি কি-না কে জানে! বাবা-টাবাদের কাছে শুনেছি। হয়তো লতায়-পাতায় কিছু একটা সম্পর্ক ছিল। সে যাই হোক, সাহেবদের পা চেটে আমাদের কোনো পূর্বপুরুষ টাকা করেছিল অনেক। কলসির জল গড়াতে গড়াতে শেষ হয়ে গেছে। এখন আর কিছু নেই। ওই যে অত বড়ো বাড়ি, তার চোদ্দোজন শরিক। তবু বনেদিয়ানাটা রয়ে গেছে। দেখিসনি, আমার বাবা-কাকারা কুচোনো ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি ছাড়া পরত না! সব ফোতো কাপতেন! পেটে ভাত নেই, মুখে পান। অল্প বয়েস থেকেই আমি বুঝেছিলুম, ওসব নকলিবাজি আমার দ্বারা পোষাবে না। আমার টাকা চাই, আমি ভোগী লোক, আমার অনেক টাকা দরকার। চাকরি-বাকরি করা আমার দ্বারা পোষাত না, নেহাত গলাটা আছে, তাই গান গেয়ে টাকা পাই।

তুমি কারও কাছে গান শেখোনি?

কার কাছে শিখব? ধৈর্য ছিল না। মহম্মদ রফি-কে নকল করতাম। রফি সাহেব আমার গুরু। দূর থেকে, মানে আমি একলব্য শিষ্য। দু-একটা পাড়ার জলসায় গান গেয়ে বেশ হাততালি পেতাম। ব্যাস, বুঝে গেলুম, এই লাইনটাই ধরতে হবে। প্রথম দিকে স্রেফ বড়ো বড়ো গায়কদের নকল করে পপুলার হয়েছি। মুম্বইতে আসার পর হেমন্তবাবু আমায় খুব সাহায্য করেছিলেন। উনিই প্রথম বলেছিলেন, যথেষ্ট হয়েছে, এবার নিজের গলাটা খোলো!

তোমার গলাটা সত্যিই ভালো!

তুই প্রশংসা করছিস? গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। মুম্বইতে নাম করেছি বটে, কলকাতার লোক এখন আর আমায় তেমন পছন্দ করে না জানি! তুই কবিতা টবিতা লিখিস বললি, আমি কিছুই পড়িনি। এক সময় খুব পড়ার নেশা ছিল, এখন আর বিশেষ সময় পাই না। তুই গান লিখিস না? দে, দু-চারখানা গান লিখে দে। হিন্দিতে ট্রানস্লেট করে কোনো ফিলমে লাগিয়ে দেব। তুই কিছু পয়সা পাবি।

না, অভিদা, গান লেখার ক্ষমতা আমার নেই। আমি দুর্বোধ্য আধুনিক কবিতা লিখি, যা অনেক লোকই বোঝে না।

কেন, ওরকম লিখিস কেন?

কেউ কেউ তো খেয়াল তারানাও গায়, অনেকে বোঝে না।

হুঁ!

এর মধ্যে আমাদের রাত্তিরের খাবার এসে গেল। আমি ঢাকনা খুলে হাত দেওয়ার আগেই অভিদা ধমক দিয়ে বললেন, রেখে দে, আগে মালের নেশা না জমলে কেউ খায় নাকি?

ফ্লাস্কের ঢাকনায় আমি একটুখানি নিয়ে বসে আছি, অভিদা প্রায় আধবোতল উড়িয়ে দিলেন। তাতেও কথা একটুও জড়ায়নি, মাথা ঠিক আছে।

পায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরে গেছে। ডান পায়ের গোড়ালি থেকে উরু পর্যন্ত মোটা প্লাস্টার। আমি ঝুঁকে পড়ে তার ওপর নাম সইগুলো পড়বার চেষ্টা করলাম। মাত্র তিনটে চারটে নামই চেনা, দিলীপকুমার, নাসিরুদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি, আশা ভোঁসলে, আরও অনেক নাম আছে।

অভিদা বললেন, তুই বুঝি ভাবছিস, আমি ফাঁট দেখাবার জন্য ওই সব হিরো-হিরোইনদের নাম সই করিয়েছি? কদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল, তখন অনেকে দেখতে এসেছে নিজেরাই সই করেছে। গুড উইশ করার মতন। সুরকারদের সবাই খাতির করে, গান হিট হওয়ার ওপর ছবি হিট হওয়া নির্ভর করে অনেকখানি। তবে এগুলো আমি মুছিনি ইচ্ছে করে, কলকাতায় আমার ভাইপো ভাগনিরা দেখে মজা পাবে বলে। এখন মুছে ফেললেই হয়।

অভিদা হাতের গেলাস দিয়ে সেই নামগুলোর ওপর ঘষতে লাগলেন।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়েছিলে?

অভিদা বললেন, হ্যাঁ, তবে মদ খেয়ে গড়াইনি। দিনের বেলা, সুস্থ অবস্থায়। তখন বললুম না, ভগবান আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। ভগবান সব সময় আমার পেছন পেছন ঘোরে। হয়তো, এই কামরাতেও অদৃশ্য হয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে।

এটাকে মাতালের প্রলাপ মনে করে মুখ ফেরাতেই অভিদা হা হা করে হেসে উঠলেন।

তারপর আমার একটা হাত ধরে টেনে বললেন, বিশ্বাস করলি না তো? আমি পাগল না, মাতালও হইনি। তবে শোন, তোকে গোড়া থেকে ঘটনাটা বলি। তবে, যতদিন না আমি অনুমতি দেব, তুই আর কারোকে বলতে পারবি না। তাতে রাজি আছিস?

আমি মাথা ঝোঁকালাম।

অভিদা এক বিচিত্র কাহিনি বলতে শুরু করলেন।

সেই অভিদার জবানিতেই শোনা যাক।

অভিদার কথা

আমি জানি, আমার চরিত্রে একটা বৈপরীত্য আছে। ডুয়াল পার্সোনালিটি। তবে ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইডের মতন অতটা নয়। তবে কোনো খুনটুন করিনি। আমি ভালো লোক, আবার এই আমিই ঝোঁকের মাথায় এমন এক একটা কাণ্ড করে ফেলি, যাতে আমার নিজেরই চরম ক্ষতি হবে, শেষ মুহূর্তে সেটা আমি বুঝি, তবু জেদের বশে থামি না। কেন যে এরকম করি, তার যুক্তি খুঁজে পাই না। এক এক সময় স্বেচ্ছায় বিষাদ ডেকে আনি, যেন এটা আমার খেলা। আমার এক বন্ধু ডাক্তার, সে বলে, আমার মধ্যে নাকি আত্মহত্যা করার প্রবণতা আছে। হঠাৎ এত নামডাক, আর টাকাপয়সা পাওয়া আমার সহ্য হচ্ছে না। কথাটা ঠিক বলে মনে হয় না। আমি কক্ষনো আত্মহত্যার চেষ্টা করিনি, সে চিন্তাও মাথায় আসে না। যা কিছু পেয়েছি, তা নিজের চেষ্টায়, নিজের ক্ষমতার জোরে পেয়েছি, এ ব্যাপারে আমার কোনো হীনম্মন্যতাও নেই।

আমি হইচই ভালোবাসি, আবার নির্জনতাও ভালোবাসি। মুম্বইয়ের জীবন সব সময় উদ্দাম, বিশেষত আমাদের লাইনে। সব সময় সবাই ছুটছে, থামবার উপায় নেই। রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত জাগা, মদ্যপান, মেয়েদের নিয়ে হুল্লোড়, এ সব তো লেগেই আছে। আমি খুব পছন্দ করি এই সব, লোকে জানে, আমি এক নম্বর হুল্লোড়বাজ।

আবার এক এক সময় এই সবে দারুণ বিতৃষ্ণা জন্মে যায়। টানা দশ-পনেরো দিন চেনা কোনো লোকের সঙ্গে কথা বলতেই ইচ্ছে করে না। টেলিফোনের আওয়াজে গায়ে যেন হুল ফোটে। ফিলম লাইনের সবাই জানে, আমি মাঝে মাঝে রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে যাই কয়েকদিনের জন্য। কোথায় যাই, কেউ টের পায় না।

সে সব সময়ে আমি কোনো হোটেলেও উঠি না। আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকি। রান্নাবান্না, আর সব কিছুই নিজেরটা নিজে করে নিই। দাড়িও কামাই না সেই কদিন।

সে রকমই একবার গিয়েছিলুম এক জায়গায়, নাম বলছি না, ধরা যাক সে জায়গাটার নাম দুরানিগঞ্জ, মহারাষ্ট্রের মধ্যেই, নদীর ধারে ছোটো শহর, চারপাশে ছোটো ছোটো পাহাড়ঘেরা। শহর থেকে অনেকটা বাইরে, একটা পাহাড়ের গায়ে অনেকগুলো কটেজ বানিয়ে রাখা আছে, ভাড়া দেওয়ার জন্য। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে আমি বুক করেছিলাম সেরকম একটা কটেজ।

দুরানিগঞ্জের একমাত্র সিনেমা হলে তখনও যে ছবিটা চলছে, সেটা আমারই সুর দেওয়া। সুরকারদের ছবি তো পোস্টারে থাকে না, তাই আমাকে দেখে কেউ চিনবে না। শহরে আমি যেতামই না, একসঙ্গে অনেক খাবারদাবার কিনে এনে বাড়িতে বসে থাকতাম চুপচাপ।

পরিবেশটা ভারি সুন্দর। আমার কটেজটা পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায়, বারান্দায় দাঁড়ালেই অনেক নীচে দেখা যায় নদীটাকে। প্রচুর গাছপালা। অনেক পাখি এসে বসে। কোনটা কোন পাখি তা চিনি না। এক একটা পাখি দেখে মনে হয়, এ রকম পাখি আগে কখনও দেখিনি। আমি শহুরে মানুষ, পাখি আর দেখলাম কবে?

প্রথম দু-তিনদিন কানের মধ্যে যেন ঝনঝন শব্দ হত। মুম্বইয়ের জীবন, পার্টি, পঁয়ষট্টিটা ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে মিউজিক, রেকর্ডিং অনবরত গাড়ির আওয়াজ, এ সবের রেশ বয়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে সেগুলো কমে গেল, উপভোগ করতে লাগলুম নির্জনতার ঝঙ্কার।

এরকমভাবে চাঁদও তো দেখিনি কতদিন। পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে আস্ত একখানা চাঁদ, দুধের মতন তার জ্যোৎস্না। এক এক সময় আবার মনে হত, একটা সাদা সিল্কের চাদরের মতন জ্যোৎস্না দুলছে। আমি কবিটবি নই, অন্যের লেখা কবিতায় সুর দিয়ে গান গাই। তবে মনে এমন এমন সব ভাবনা আসত যে নিজেই অবাক হয়ে যেতুম। ধোঁওয়া নেই, ধুলো নেই, পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। সত্যি কথা বলছি, সেই আকাশের তলায় বসে থাকতে আমার মদ খাওয়ার ইচ্ছেটাই যেন চলে গিয়েছিল। অভ্যেসবশত একটু একটু খেতাম ঠিকই, আবার ভরতি গেলাস পড়েই থাকত, ছুঁতাম না।

এরকম চমৎকার জায়গায় একটাই শুধু অসুবিধে ছিল।

আমাদের দেশের অনেক পাহাড়ের চূড়াতেই একটা করে মন্দির থাকে। এ পাহাড়টাতেও ছিল, ঠিক মন্দির নয়, একটা আখড়া। বিশেষ এক ধরনের বৈষ্ণব কাল্টের আখড়া, সর্বেশানন্দ নামে এক সাধু এর প্রতিষ্ঠাতা, তিনি বেঁচে নেই, তাঁর প্রধান শিষ্য প্রেমঘনানন্দ এই সম্প্রদায়ের গুরু, তাঁর বয়েস পঁচাশি। তিনি থাকেন ওই পাহাড়চূড়ায়।

আশ্রম বা আখড়া থাকে থাক, তাতে আমার কী! প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা ওখানে খোল-করতাল বাজিয়ে প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধরে কীর্তন বা প্রার্থনা-টার্থনা হয়, অনেক লোক একসঙ্গে গান গায়। সেই আওয়াজ আমার বাড়ি পর্যন্ত আসে। সেই গানে আমার শান্তি ভঙ্গ হয়। বিরক্ত লাগে। সুরেলা গান হলেও তবু কথা ছিল, কিন্তু তা তো নয়, মাঝে মাঝেই বেসুরো হয়ে যায়। আফটার অল আমি তো গানবাজনার লাইনের লোক, বেসুরো গান একেবারে সহ্য করতে পারি না।

কিন্তু কী আর করা যাবে! কারও বাড়িতে খুব বেশি চেঁচামেচি হলে অন্য কেউ নালিশ জানাতে পারে। কিন্তু ধর্মস্থানে যতই হল্লা হোক, কোনো আপত্তি করা চলবে না। সন্ধের সময় ওই দেড় ঘন্টা আমি দরজা জানলা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতাম।

একদিন বিপদ যেন পায়ে হেঁটে উপস্থিত হল আমার কাছে। সে বিপদ এল নারীর বেশে।

আমার বাড়ির পাশ দিয়েই পাহাড়ের চূড়া থেকে নীচে নামবার পায়ে-হাঁটা রাস্তা, এ আখড়ার লোকজনদের সেই রাস্তা দিয়ে ওঠা-নামা করতে দেখি। কারও সঙ্গে ডেকে কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না।

তখন বেলা এগারোটা, আমি দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায়। নীচের নদীটায় স্নান করতে যাব কি না ভাবছি। দুটি মেয়ে পাকদণ্ডী ছেড়ে আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। একজন গেরুয়া পরা, একজন সাদা শাড়ি, বোঝা গেল, ওই আখড়ার।

প্রথম কয়েক মিনিট মনে হল, তারা আমার বাড়িটাই দেখছে। যদিও এমন কিছু দর্শনীয় নয়, ওখানকার সব বাড়িই এক রকম। কিছু বাড়ি ফাঁকাও পড়ে আছে।

আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে একজন বলল, আমরা একটু ভেতরে আসতে পারি?

এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা দরকার! আমি বেশি বেশি নারী-চর্চা করি। এ রকম একটা সুনাম বা দুর্নাম আমার আছে। কিন্তু আমি যখন এই ধরনের অজ্ঞাতবাসে যাই, তখন নারী-সঙ্গের কোনো অভাব বোধ আমার থাকে না। ইচ্ছে করলেই তো আমি মুম্বই থেকে যে-কোনো একটা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারি। কিন্তু ওই ধরনের লালসা পেছনে ফেলে রেখে আসি আমি। একাকিত্বের অনুভবটাই আমাকে সবচেয়ে আনন্দ দেয়।

মেয়ে দুটিকে কোনো উত্তর না দিয়ে আমি ভেতরে চলে গেলেই ল্যাঠা চুকে যেত। ওরা আর ঢুকত না ভেতরে। অভদ্রতার মতন দেখালেও সেটাই আমার চরিত্রে মানায়। কিন্তু কোনো কারণে আমার মনটা তখন নরম ছিল। মনে হল, ওরা নিশ্চয়ই চাঁদা চাইতে এসেছে। কিছু দিয়ে দিলেই তো হয়।

বললুম, আসুন।

বাড়িটা দোতলা। বসবার ঘর একতলায়, খুব কাছেই সেই পায়ে-চলা রাস্তা। দরকার হয়নি বলে, এ ঘরটা আগে ব্যবহার করিনি। যদিও সোফাটোফা দিয়ে সাজানো আছে।

খুলে দিলাম সবকটা জানলা। মেয়ে দুটি চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। যে গেরুয়া শাড়ি পরা, তার বয়েস বছর তিরিশেক হবে। অন্যজন একটু ছোটো মনে হয়।

আমি বললুম, ভেতরে এসে বসুন।

ওরা তবু দাঁড়িয়েই রইল। গেরুয়া পরা মেয়েটি বলল, কাল পূর্ণিমা, আমাদের আশ্রমে একটা উৎসব আছে। আপনাকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি। আপনি একবার চরণধুলি দিলে আমরা ধন্য হব। গুরুদেব বলে দিয়েছেন, আপনি অনুগ্রহ করে ওখানেই প্রসাদ গ্রহণ করবেন।

বৈষ্ণব বিনয়! চাঁদা চাইতে আসেনি, বরং নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে চায়। দু-চারজন শাঁসালো ভক্ত টাকা জোগায় বোধ হয়।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, আপনাদের ওখানে কীসের উৎসব?

সাদা শাড়ি চঞ্চল চোখে নীরব, গেরুয়া মেয়েটি কথা বলছে। সে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে, চক্ষু বুজে প্রণাম করে বলল, পরমগুরু সর্বেশানন্দজির কাল আবির্ভাব দিবস। দয়া করে আসবেন। বেশিক্ষণ লাগে না ওপরে উঠতে, বড়োজোর দশ মিনিট। নামগান হবে, শুনেই চলে আসবেন।

জন্মদিনকে এরা বলে আবির্ভাব দিবস!

আমি ঠোঁট কাটা মানুষ, ফস করে বলে ফেললুম, নামগান হবে? কিছু মনে করবেন না। রোজ সন্ধেবেলা আপনাদের ওখানে কীর্তন-টির্তন হয়, এখান থেকেও শুনতে পাই। মাঝে মাঝে বড্ড বেসুরো শোনায়!

মেয়েটির ওষ্ঠে এবার একটা পাতলা হাসির রেখা ফুটেই মিলিয়ে গেল। সে বলল, বেসুরো হয় বুঝি? তাহলে আপনিই সুর শিখিয়ে দিন না।

একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললুম, আমি শেখাব? তার মানে, আমি কে, তা কি আপনি জানেন?

মেয়েটি আবার একটু হাসি দিয়ে বলল, এখানে অনেকেই জেনে গেছে, আপনি গায়ক অভিজিৎ সেন।

কী করে যে খবর ছড়ায়! এখানে এসে কারও সঙ্গে কোনো কথা হয়নি, দেখা হয়নি, তবু…। যে কেয়ারটেকারটি প্রথম দিন চাবি এনে দরজা খুলে দিয়েছে, সেই বোধ হয় নামটা বলে দিয়েছে অন্যদের।

এই গেরুয়া-নারী কি বাঙালি?

অবশ্যই। প্রথম থেকেই সে বাংলায় কথা বলছে আমার সঙ্গে। হয়তো মহারাষ্ট্রে জন্ম, কিন্তু বাংলা উচ্চারণ পরিষ্কার। কণ্ঠস্বর বেশ নরম, তার সঙ্গে বৈষ্ণব-বিনয় মিশে মধুর হয়েছে।

এরকম একটা অখ্যাত জায়গার আশ্রমে একটি বাঙালি তরুণী মেয়ে এল কী করে? কৌতূহল হবেই।

অন্য মেয়েটি বাঙালি নয়। সে এবার মারাঠি ভাষায় বলল, তাই চল! এরপর ঘিয়ের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

গেরুয়া মেয়েটি তাকে মারাঠি ভাষায় উত্তর দিল, দাঁড়া, ইনি এখনও কথা দেননি!

আমি বললুম, আপনারা দাঁড়িয়ে কেন, বসুন না।

গেরুয়া মেয়েটি একটি সোফায় বসল। অন্য মেয়েটির অস্থির ভাব।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, আপনাদের এই আশ্রমটি কত দিনের?

সে বলল, সত্তর বছর! তখন এখানে আর কোনো বাড়িঘর ছিল না।

আপনি কতদিন ধরে আছেন?

সাড়ে চার বছর।

এর মধ্যেই আপনাকে গেরুয়া দিয়েছে? আমি যতদূর জানি, এত তাড়াতাড়ি তো গেরুয়া দেওয়া হয় না।

আমাদের এখানে অন্য নিয়ম।

অন্য মেয়েটি এবার বলল, তুমি কথা বলো, আমি ততক্ষণে দৌড়ে গিয়ে কিনে আনি? না পেলে মুশকিল হবে! ফেরার সময় তোমাকে এখান থেকে ডেকে নেব?

গেরুয়া মেয়েটি বলল, না, চল, আমিও যাই তোর সঙ্গে।

তারপরই মত বদলে ফেলে বলল, আমি কি এখানে একটু বসতে পারি? আপনার অসুবিধে হবে? অনেকদিন বাংলা কথা বলিনি। এতদূরে তো বাঙালি বড়ো একটা আসে না!

বসুন না। কোনো অসুবিধে নেই।

বোঝা গেল, সন্ন্যাসিনী হলেও মাতৃভাষার ওপর টান থাকে। বোঝা গেল, সন্ন্যাসিনী হলেও বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার বাসনা থাকে।

আমি এবার আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে একটা সিগারেট ধরালুম। মেয়েটি তেমন কিছু সুন্দরী নয়, কিন্তু সুশ্রী বলা যায়। ফিলম দুনিয়ায় অনেক ডাকসাইটে সুন্দরীদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি। তারা সবসময় লিপস্টিক মেখে থাকে, ভুরু কামিয়ে আঁকে, আরও নানারকম প্রসাধন করে। শুধু ফিলমের মেয়ে কেন, সমাজের মাঝারি স্তরের মেয়েরাও এরকমভাবে আছে। ভুরু আঁকা, লিপস্টিক ছাড়া মেয়েদের অনেক বছর দেখিইনি বলা যায়। সেই তুলনায় এ যেন একটি মাটির মেয়ে। গায়ের রং মাজা মাজা, কপালে আর নাকে চন্দনের রেখা, মুখের চামড়া ও চোখের দৃষ্টিতে একটুও উগ্রতা নেই। বরং যেন একটা স্নিগ্ধতার আলো রয়েছে।

তিন-চারদিন আমি কারও সঙ্গে কথা বলিনি। কেয়ারটেকারটি দিনে একবার এসে আমার খোঁজ নিয়ে যায়। তাঁর সঙ্গে হুঁ হাঁ বললেই কাজ চলে যায়, কথা বলার প্রয়োজন হয় না।

লেখাপড়া শিখলে মানুষের মুখে একটা ছাপ পড়ে, এ মেয়েটির মুখে সেই ছাপ আছে।

জিজ্ঞেস করলুম, আপনার নাম কী?

সে বলল, অনসূয়া, আমাকে সবাই অনু বলে ডাকে।

পদবি বলল না। বিবাহিতা কি না বোঝবার উপায় নেই। বৈষ্ণবীদের কণ্ঠী বদল করে বিয়ে হতে পারে কারও সঙ্গে, কিন্তু তার বোধ হয় বাইরের কোনো চিহ্ন থাকে না।

আবার জিজ্ঞেস করলুম, আপনার এত কম বয়েস। এই জায়গাটার কথাও বেশি লোক জানে না, আপনি এখানে যোগ দিলেন কী করে?

অনসূয়া মুখ নীচু করে বলল, মন টেনেছিল। আমাদের আর একটি আশ্রম আছে কোলাপুরে, সেখানে একদিন গুরুজির ভাষণ শুনেছিলাম। তখনই মনে হয়েছিল, এটাই আমার পথ।

আপনার বাড়ির লোক বাধা দেয়নি। বাবা-মা আছেন নিশ্চয়ই?

পূর্বাশ্রমের কথা আমাদের বলতে নেই।

আপনি সিনেমা দেখেন?

না।

লোকের মুখে শুনেছেন, আমি একজন গায়ক? নাকি, আপনি নিজে কখনও আমার গান শুনেছেন?

এখানে আসবার আগে শুনেছি।

দেখুন, হয়তো আমার বেশি কৌতূহল দেখানো হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে না করলে উত্তর দেবেন না। আপনার বয়েসি একটি মেয়ে, এখানে সারাজীবন থেকে যাবেন? কী পাবেন? কীসের আশায়…

কিছু তো পেতে চাই না। এখানে আমি স্বামী-সেবা করি।

স্বামী? ঠিক বুঝলাম না। আপনি বিবাহিতা?

হ্যাঁ।

স্বামী সেবার জন্য আশ্রমে থাকতে হবে কেন?

আমার স্বামী বংশীধারী, ব্রজবিহারী প্রভু শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর বিগ্রহের সঙ্গে মালা বদল করে আমার বিবাহ হয়েছে। আমাদের আশ্রমে যে-কজন মেয়ে আছে, সকলের জন্যই এই নিয়ম।

মীরাবাই? মীরাবাইয়ের তবু একজন জলজ্যান্ত স্বামী ছিল, শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদিনি ছিল, সংসার ছিল। সেই সংসার জীবন অসহ্য বোধ হওয়ায় মীরাবাই কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আপনার কি সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা আছে?

আমাদের এ সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের।

তার মানে কি দেবদাসী?

দাসী নই, আমি প্রভুর জীবনসঙ্গিনী।

একবার ইচ্ছে হল বাঁকাভাবে জিজ্ঞেস করি, ওই প্রভুটি কে? শ্রীকৃষ্ণের বকলমে গুরুজিটি নাকি? অনেক সাধুরই এরকম লীলাসঙ্গিনী থাকে।

তারপরই মনে হল, প্রথম দিন কেয়ারটেকারটি এ জায়গাটা সম্পর্কে হড়বড় করে অনেক কিছু শুনিয়েছিল। তখনই জেনেছি, পাহাড়ের ওপরের আখড়ায় গুরুজিটির বয়েস পঁচাশি। তবে আরও কমবয়েসি কয়েকজন চ্যালাট্যালাও থাকতে পারে। কিন্তু অনসূয়ার মুখের সারল্য দেখে ওই ধরনের কোনো সম্পর্কের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না।

খানিকটা সহানুভূতির সঙ্গেই বললুম, আপনার কথা শুনেই বোঝা যায়, আপনি কিছুটা লেখাপড়া শিখেছেন। আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন, একটা পাথরের বিগ্রহ কোনো জীবন্ত রমণীর স্বামী হতে পারে?

প্রভু তো শুধু পাথরের বিগ্রহ নন। তিনি জীবন্ত।

জীবন্ত? যে কথা বলে না, সাড়া দেয় না, যার চোখের পলকও পড়ে না, সে জীবন্ত হয় কী করে?

আমার প্রভু আমার সঙ্গে কথা বলেন।

কথা বলেন? দেখুন, আমি এটা জানতে চাই, সত্যিই কি তা সম্ভব? পাথরের মূর্তি…

প্রভু আমার সঙ্গে কথা বলেন স্বপ্নে। প্রত্যেক দিন। তিনি হাসেন, গল্প করেন…

এবার আমার হাসি পেয়ে গেল। বায়ুরোগ না থাকলে এরকম স্বপ্ন কেউ দেখে না। আর প্রত্যেকদিন একই স্বপ্ন দেখা মানুষের পক্ষে অসম্ভব! অন্ধ বিশ্বাস ছাড়া এটা আর কিছুই নয়।

কেষ্টঠাকুরটিরও তো আহ্লাদ কম নয়। দ্বাপর যুগে সে তিনটি বউ, শ্রীরাধার মতন পরকীয়া এবং আরও ষোলো হাজার গোপিনীর সঙ্গে লীলাখেলা করে গেছেন। কলি যুগেও তার এমন দাপট? তার এমনই সেক্স অ্যাপিল যে অনসূয়ার মতন একটি সরল, কমনীয় মেয়ে এই আশ্রমেরই আরও কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে স্বামী হিসেবে তাকে ভাগ করে নিতেও রাজি?

এরপরেই আমি যে কাণ্ডটি করলুম, যার আপাত কোনো যুক্তি নেই। এটা আমার স্বভাবের সেই দিক, যা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

অনসূয়া বসেছিল দরজার ঠিক কাছের সোফায়। আমি খানিকটা দূরে। হঠাৎ আমি বাঘের মতন এক লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে অনসূয়ার পিঠে একটা হাত জড়িয়ে, অন্য হাতে তার থুতনিটা উঁচু করে চুমু খেলুম। নিছক এক টোক্করের চুমু নয়, গভীর, গাঢ় চুমু। প্রথমে সে ঠোঁট খুলতে চায়নি, খানিকটা জোর করেই ঠোঁট ফাঁক করতে হল।

চুমু শেষ করে আমি দ্রুত ফিরে গেলুম নিজের জায়গায়।

ব্যাপারটা এমনই আকস্মিক এবং অচিন্ত্যনীয় যে অনসূয়া আমাকে ঠিক মতন বাধা দিতেও পারেনি। তা ছাড়া আমার সঙ্গে গায়ের জোরে পারবে কেন? আমি ছেড়ে দিতেই সে প্রথমেই ত্রস্তে জানলার দিকে তাকাল। এটা মেয়েদের সাধারণ ইনস্ট্রিংক্ট। জানলার পাশেই রাস্তা, মাঝে মাঝে লোক চলাচল করে, কেউ না কেউ দেখে ফেলতে পারত, দরজাও খোলা, ওর সঙ্গিনীও ফিরে আসতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে।

আমার কৈশোর বয়েসে মাসতুতো বোনকে ছাদের সিঁড়িতে জোর করে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছিলাম। সে মুখে না না, একি একি বললেও সেটাকে খুব একটা জোর জবরদস্তি বলা যায় না, তার ব্যবহারে যথেষ্ট ইঙ্গিত ছিল। এ ছাড়া আমার বাকি জীবনে আমি কখনো কোনো মেয়ের ওপর জোর করিনি। ‘কবিতা বনিতা চৈব সুখদা স্বয়মাগতা।’ কবিতা যেমন জোর করে লেখানো যায় না, সেরকম কোনো বনিতাও স্বয়মাগতা হলেই সুখপ্রদা হয়। সহবাস সম্মতি আইনে আমি একেবারে নির্দোষ।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে, অনসূয়ার প্রতি আমার ওই ব্যবহার প্রায় বলাৎকারের পর্যায়েই পড়ে। আমি আগের মুহূর্তেও তাকে সিডিউস করার চেষ্টা করিনি। আমি যে পুরোপুরি দোষী, তা আমি স্বীকার করতে বাধ্য।

অনসূয়ার চোখ দিয়ে দর দর করে জল বেরিয়ে আসতে লাগল। নিদারুণ আহত গলায় বলল, এ আপনি কী করলেন? এ আপনি কী করলেন?

সে থরথর করে কাঁপছে। তাকে দেখে আমার মায়া হল, খানিকটা অনুতাপও হয়েছিল কি? না, তা বোধ হয় হয়নি। অনুতাপ করলে তো কবেই আমি শুদ্ধ সাত্ত্বিক লোক হয়ে যেতুম।

আমি আবেগহীন গলায় বললুম, তোমাকে হঠাৎ আমার আদর করতে ইচ্ছে হল। হয়তো এটা অন্যায়। অনেকে তাই মনে করবে। আমি এরকমই।

দুদিকে মাথা নেড়ে সে বলল, না, না, ছি ছি। কী করলেন? আপনার যদি বিপদ হয়?

আমি বললুম, তুমি চেঁচিয়ে লোক ডাকতে পারো। সব কথা বলে দিতে পারো। তোমার কথা সবাই বিশ্বাস করবে!

সে আরও জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগল আর ফোঁপাতে লাগল।

আমি বললুম, লোকজন এসে যদি শাস্তি দেয়, তা আমি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি।

অনসূয়া বলল, আপনার জন্য আমি প্রার্থনা করব।

আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলুম, আমার জন্য প্রার্থনা করবে? কেন? কী প্রার্থনা করবে? আমি যাতে আজ রাত্তিরেই মরে যাই? যাতে কেউ কিছু জানতে না পারে?

অনসূয়ার সারা শরীরটা আরও জোরে কেঁপে উঠল। সে বলল, না, না, প্রভু যদি রাগ করেন, আপনাকে শাস্তি দিতে চান, আমি ক্ষমা চাইব।

প্রভু? মানে পাথরের বিগ্রহ?

আবার আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। একটা পাথরের মূর্তি আমার ওপর প্রতিশোধ নেবে? এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? দেখি তো তার কত ক্ষমতা! চ্যালেঞ্জ রইল।

পাপ যদি করে থাকি, তাহলে আর একটু বেশিই করা যাক।

এইভাবে লাফিয়ে গিয়ে ফের জড়িয়ে ধরলুম অনসূয়াকে। পাগলের মতন আদর করতে করতে বলতে লাগলুম, এত সুন্দর একটা মেয়ে, সে সারাজীবন শুধু একটা পাথরের সঙ্গে…সে আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।

অনসূয়া ছটফট করলেও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারেনি। এবারে শুধু চুমু নয়, আরও আদর দিলুম তার বুকে। তার নীচে আর নামিনি। একটু পরে ফিরে এলুম নিজের জায়গায়।

দরজা জানলা সব খোলা। কোনো লোক দেখা যায়নি অবশ্য। অনসূয়া কোনো কথা বলছে না। কিন্তু শরীর যে উষ্ণ হয়ে উঠছিল, তাও আমি টের পেয়েছি। শুধু উষ্ণতা নয়, তার বুকে যেন আগুনের হলকা। সাধারণ জৈবিক নিয়মেই তার শরীর সাড়া দিয়েছে। কোনো পাথর কি এই উষ্ণতা জাগাতে পারবে?

বাগানের লোহার গেটে ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল। অন্য মেয়েটি ফিরে আসছে। অনসূয়াও শুনতে পেয়েছে। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। চোখ মুখ মুছে নিল ভালো করে। অন্য মেয়েটি বাগান পেরুবার আগেই অনসূয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে একবার আমার দিকে সরাসরি চাইল। চক্ষু দুটি লাল, কান্নার ফলে মুখখানি ভাসাভাসা, ঠোঁট ফোলা। ধরা গলায় বলল, আপনার জন্য আমি প্রার্থনা করব প্রত্যেকদিন।

বলাই বাহুল্য, এরপর পাহাড় চূড়ায় সেই আখড়ার উৎসবে আমি যাইনি। ওখান থেকে আর কেউ আসেনি আমার কাছে। অনসূয়াকে ওই রাস্তা দিয়ে যেতেও দেখিনি। দিন তিনেক পরে ফিরে এলুম কাজের জায়গায়।

শুধু কাজ তো নয়, আবার পার্টি, হইহল্লা, রাত্রি জাগরণ। প্রত্যেকটি দিনই উত্তেজনা ও অস্থিরতাময়। এর মধ্যে ওই নির্জন প্রবাসের স্মৃতি আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসে। মাঝে মাঝে এক এক ঝলক চোখে পড়ে, তারপর হারিয়ে যায়।

হারিয়ে গেল না অন্য একটি কারণে।

মুম্বই ফেরার ঠিক সাড়ে চার মাস পর আমার জন্ডিস হল। এমনই গুরুতর ধরনের যে ভরতি হতে হল নার্সিংহোমে।

আমাদের হাঁচি-কাশি হলেও কাগজে খবর বেরোয়। রেডিয়োতে বলে। অনেক ভক্তর চিঠি আসে। দেখতেও আসে অনেকে। আমার একজন সেক্রেটারি আছে বটে, চিঠি সব আমি নিজেই পড়ি। নার্সিংহোমে শুয়ে শুয়েই অন্য অনেক চিঠির মধ্যে একখানা চিঠি দেখে চমকে উঠতে হল।

নাম সই নেই। গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে লেখা . আমি তিনদিন উপবাসে থেকে আপনার জন্য প্রার্থনা করছি। আপনি ভালো হয়ে উঠবেন। আপনি ক্ষমা পাবেন।

এ চিঠি নিশ্চিত অনসূয়ার। আসলে ওর ধারণা! ওর ভগবান রাগ করে আমাকে এই জন্ডিস রোগের শাস্তি দিয়েছে।

ভগবানগুলো খুব হিংসুটে হয় বটে। ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর তো নিজের মুখেই বলেছেন, আই অ্যাম আ জেলাস গড। গীতায় শ্রীকৃষ্ণও বলেছেন, মামেকং শরণং ব্রজ। একমাত্র আমাকেই শরণ করো। অন্যান্য ধর্মেরও ঈশ্বর বা অবতাররা বলেছেন, শুধু আমাকেই আশ্রয় করো, অন্য কোনো দিকে তাকাবে না! আরে বাপু, ভগবান হিসেবে যদি তোমার অতই গুণপনা ও আকর্ষণ থাকে, তা তোমাকে নিজের মুখে বলতে হবে কেন?

মুম্বইতে সেবার জন্ডিস প্রায় এপিডেমিকের আকার নিয়েছিল। আমার ওই নার্সিংহোমে প্রায় সব বেডেই জন্ডিসের রোগী। পটাপট করে কয়েকজন মরেও গেছে। তাহলে কি একা আমার অপরাধে অতগুলো লোককে ভগবান শাস্তি দিয়েছে? কিংবা ওই সব কটা লোকই ভগবানের বউদের ধরে টানাটানি করেছে? একমাত্র এই অপরাধ ছাড়া আর তো কোনো ব্যাপারে ভগবানের রাগারাগির চিহ্ন দেখি না। চতুর্দিকে জাল-জোচ্চুরি, কালোবাজার, নারীহরণ, নারী ধর্ষণ, নারী কেনা-বেচা, মাফিয়ারা থাকছে বুক ফুলিয়ে, রাজনৈতিক নেতাগুলো বদের ধাড়ি, দু-কান কাটা, চুরি করছে কোটি কোটি টাকা, কারুর কোনো শাস্তি হয়?

আমার পাশের বেডে রোগীটির বয়েস তেরো বছর, তার অবস্থা আমার চেয়েও সাংঘাতিক। সে কী অপরাধ বা পাপ করতে পারে?

অনসূয়া বৈষ্ণব, ক্ষমাই তার ধর্ম। আমার ওই গাজোয়ারি অপরাধ সে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু তার যে আরাধ্য দেবতা, সে রাগে বা হিংসেয় আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে, এই তার বিশ্বাস।

নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পেয়ে আরও কিছুদিন আমায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়। জন্ডিসের পর নিয়মকানুন মানতে হয় অনেক, ভাজাভুজি খাওয়া বারণ, মদ একেবারে নিষিদ্ধ। এ রোগের ওষুধ বিশেষ নেই, সংযম আর বিশ্রামই আসল। মুম্বইয়ের দিকে যেসব মাছ পাওয়া যায়, সেগুলো ঝোলের বদলে ভাজা খেতেই ভালো লাগে। মাছ ছাড়া আমি ভাত খেতে পারি না। মাঝে মাঝে মাছ ভাজা খেয়েছি, মদও দু-এক ঢোঁক খেয়েছি লুকিয়ে। তবু সেরে তো উঠলুম!

আবার গান রেকর্ডিং শুরু করার পর অনসূয়ার কাছ থেকে আর একটা চিঠি এল। এবারও অস্বাক্ষরিত। ‘আপনি সুস্থ হয়ে ওঠায় আমরা সবাই পুলকিত। আপনার নামে পূজা দিয়েছি। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’

আমি নয়, আমরা? এটাই বৈষ্ণবদের ভাষা।

তা হলে, আমার অসুখ সারল অনসূয়ার পূজা ও প্রার্থনার জন্য, না আমার মনের জোরে?

এর পরের বছরও আমার নির্জন বাসের দরকার হয়েছিল। দুরানিগঞ্জ যাইনি, গিয়েছিলুম মধ্যপ্রদেশের বস্তারে। সেখান থেকে ফেরার পর একদিন স্টুডিয়োতে একটি নতুন মেয়ের গান রেকর্ডিং করাবার সময় আমার রক্তবমি হল। বেশ অনেকখানি। প্রথমে ধারণা হয়েছিল, জন্ডিস ভালো করে সারেনি বলেই এই বিপত্তি। ডাক্তাররা জোর করে নার্সিংহোমে শুইয়ে দিল। পরে ধরা পড়ল আলসার।

আমার খাওয়াদাওয়ার কোনো ঠিক নেই, এক একদিন সারাদিন কিছু খাওয়ার সময়ই পাই না, তারপর সন্ধের সময় প্রচুর ভাজাভুজি, চানাচুর, প্রচুর মদ্যপান, এত সিগারেট, ঘুম কম, আমার আলসার হবে না তো কার হবে?

এর মধ্যেই অনসূয়ার আর একটা চিঠি চলে এল। ওই একই রকম বয়ান। সে আমার জন্য প্রার্থনা করছে। এই আলসারও ভগবানের রাগের প্রকাশ? এবারে মেরেই ফেলবে নাকি?

এমন কড়া জান, অত সহজে কি যায়? অপারেশন না করিয়েই সেরে উঠলুম। একেবারে ফিট। আবার অনসূয়ার চিঠি। যেন তার প্রার্থনাতেই আমি সেরে উঠেছি!

কী করে ও খবর পায়, কে জানে! মুম্বইয়ের বাঙালিদের মধ্যে আভাসে-ইঙ্গিতে খোঁজ খবর নিয়েছি, তাদের পরিবারের কোনো মেয়ে বৈষ্ণবী হয়ে আখড়ায় যোগ দিয়েছে কি না। মুম্বইতে এত বাঙালি, কজনকেই বা চিনি! কোনো সন্ধান পাইনি। অনসূয়া একবার কোলাপুরের নাম বলেছিল, হয়তো ও সেখানকারই মেয়ে। কিন্তু কোলাপুরে আর কে খোঁজ নিতে যায়? আমার অত সময়ই বা কোথায়?

মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে কিছু অসুখবিসুখ, কিছু দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতেই হয়। বিশেষত আমাদের মতন যাদের বলগা ছাড়া জীবন, সব সময় অনিয়ম, আমাদের ঝুঁকি বেশি।

যখনই এরকম কিছু ঘটে, তখনই অনসূয়ার চিঠি আসে। সাধারণ জ্বর হলেও। যেন তার ভগবান কিছুতেই প্রতিশোধ নেবার কথা ভুলতে পারছে না। আরে বাবা, তোমার শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে আমার গলাটা কুচুৎ করে কেটে দিলেই তো পারে! সে চক্রখানা কি হারিয়ে গেছে?

একবার একটা দুর্ঘটনা হল ইউরোপে। রাইন নদীর একটা ফেরি পার হচ্ছিলাম। অতি সুদৃশ্য স্টিমার, দুপাশের দৃশ্যও চমৎকার। বেশ শীত, আমার গায়ে ওভারকোট, দাঁড়িয়েছিলুম বাইরে রেলিং ধরে। হঠাৎ একটা বার্জ এসে স্টিমারটার উলটো দিকে ধাক্কা মারল। খুব জোর ধাক্কা। সেই ইমপ্যাক্ট সামলাতে না পেরে আমি, আরও দুজন ছিটকে পড়ে গেলুম নদীতে।

এটাকে বাংলায় যাকে বলে মস্ত বড়ো ফাঁড়া। একে তো জল একেবারে বরফের মতন ঠান্ডা, আমি সাঁতার জানলেও ওভারকোট সমেত অত জবরজং পোশাক নিয়ে সাঁতার কাটাও যায় না। আর স্টিমারের চাকার নীচে পড়ে যাওয়ার খুবই সম্ভাবনা। আমি ছাড়া অন্য দুজন সাহেব, তাদের মধ্যে একজনকে গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল, পরে সে বেঁচেছে কি না জানি না। আমি উদ্ধার পেয়ে গেলুম অক্ষতভাবে।

কাগজে এই খবর ছাপা হয়েছিল। দেশে ফেরার পর দেখি, অনসূয়ার চিঠি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

তার ভগবানের ক্রোধ আমাকে ইউরোপ পর্যন্ত তাড়া করে গেছে? কথায় বলে, রাখে কৃষ্ণ মারে কে? আর আমার বেলায় কৃষ্ণই বারবার আমাকে মারতে চেষ্টা করছে? আমি এটা ভাবতে চাই না। অনসূয়ার চিঠিই আমাকে মনে করিয়ে দেয়।

প্রত্যেকবার এরকম কিছু ঘটার পর আমি মনে মনে তেজের সঙ্গে বলি, কই হে, ভগবান, আমার কিছু করতে পারলে? তোমার মুরোদ তো বোঝা যাচ্ছে। চালিয়ে যাও, চেষ্টা চালিয়ে যাও।

আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। তবু এরকম মনে হওয়াটাই তো এক হিসেবে আমার পরাজয়। ভূতে বিশ্বাস না করে ভূতে ভয় পাওয়ার মতন।

অনসূয়ার এবারের চিঠিটা একটু অন্য রকম। যেন তার ঈশ্বর, তার জীবন স্বামীর প্রতি এতদিনে খানিকটা অভিমান হয়েছে। কেন তিনি আমাকে ক্ষমা করতে পারছেন না? কেন তিনি প্রতিশোধস্পৃহা ভুলতে পারছেন না। সেই জন্য, সে নিজের কাঁধে সব দোষ নিয়েছে। শাস্তি হিসাবে মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছে।

ইস, বড়ো সুন্দর চুল ছিল মেয়েটার। কিন্তু আমি কী করতে পারি? সে-ই তার ঈশ্বরকে বার বার দায়ী করছে, আমি তো করছি না? মানুষ কি জীবনে একবার দুবার আছাড় খায় না? মানুষ তো অনেক সময় শুকনো জায়গাতেও আছাড় খায়! মদ্যপান করার পর আমি সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় খুব সাবধানে নামি। কখনও দুর্ঘটনা হয়নি। একবার পোর্টে একটা জাহাজে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলুম। প্রচণ্ড খাওয়াদাওয়ার পর দড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়েছিল। ঠিক পেরে গেছি!

কদিন আগে নিজের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে দিনদুপুরে পা পিছলে পড়ে গেছি। কলার খোসা ছিল না, কিচ্ছু ছিল না। তবু এরকম হতেই পারে। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম। একটা গানের সুর কিছুতেই মনের মতন হচ্ছিল না। পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছি, কদিন বাদে সেরে তো যাবেই। তবু এর মধ্যে আবার অনসূয়ার সেই কাতর চিঠি। যেন এটাও তার ভগবানের কীর্তি।

ভগবানের কি খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই? বিশ্ব সংসার সামলাবার কথাও সে ভুলে গেছে? এ দেশে কত গরিব-দুঃখী, অনাথ-আতুর রয়েছে, তাদের জন্যও মাথাব্যথা নেই, শুধু ঘুরছে আমার পেছনে পেছনে? মাত্র দুখানা চুমুর জন্য এত?

ট্রেন প্রচুর লেট, ভিক্টোরিয়া টারমিনাসে পৌঁছল সন্ধেবেলা। অভিদা আগেই বলে রেখেছিলেন, আমার হোটেলে ওঠা চলবে না। ওঁর দুজন সহকারী গাড়ি নিয়ে স্টেশনে হাজির ছিল, অভিদার পায়ের অবস্থা বেশ খারাপ, ধরাধরি করে নিয়ে যেতে হল। মালাবার হিলস-এ একটা সতেরোতলা বাড়ি, তার সবচেয়ে উঁচু তলায় অভিদার ফ্ল্যাট। ঠিক সমুদ্রের দিকেই একটা চওড়া বারান্দা, সেখানে দাঁড়ালে চোখ জুড়িয়ে যায়। মুম্বইতে এলেই আমার মনে হয়, ইস কলকাতা শহরটা কেন যে সমুদ্রের ধারে হল না! তিন শয়নকক্ষের প্রশস্ত অ্যাপার্টমেন্ট, মস্ত বড়ো বসবার ঘর, একদিকে খাওয়ার জায়গা, দু-হাজার স্কোয়ারফুট তো হবেই। এখানে অভিদা একা থাকেন, একজন বাবুর্চি তাঁর রান্নাবান্না করে দেয়, রীতিমতন উর্দিপরা বাবুর্চি, মাথায় টুপি, ইংরেজিও বোঝে।

গায়ক ও সুরকারের বাড়িতে নানারকম গানবাজনার যন্ত্র তো থাকবেই। অত্যাধুনিক মিউজিক সিস্টেম। কিন্তু বেশি চোখে পড়ে বই। একটা ঘরের তিনদিকের দেয়াল জোড়া, বড়ো বড়ো র‌্যাক ভরতি বই, যত্ন করে রাখা। বহু রকমের বই, সাহিত্য, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি ছাড়াও বিজ্ঞান, দর্শন ও অনেক রকমের ধর্মগ্রন্থ। ইস, এরকম একটা জায়গায় যদি আমি টানা এক বছর থাকার সুযোগ পেতাম!

এইসব বাড়িতে সবাই লিফটে ওঠানামা করে। অভিদা তাহলে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেলেন কী করে?

সে কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, লিফটে উঠি ঠিকই, নামবার সময় হেঁটে নামি ইচ্ছে করে। এমনিতে তো ব্যায়াম-ট্যায়াম কিছু করি না, তবু নামবার সময় শরীরে কিছু নাড়াচাড়া হয়। এরকম দশ বছর নামছি, হঠাৎ একদিন পা হড়কে গেছে। সেটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়!

অভিদা, তোমাকে কি প্রত্যেকদিনই পার্টিতে যেতে হয়?

নিজের কাজের জন্য যেতে হয় না, তবে, একটা না একটা ছবির মহরত তো লেগেই আছে, তারা ডাকে। কোনো ছবি দশ সপ্তাহ চললেই শুরু হয়ে যায় সেলিব্রেশন। তা ছাড়া আজ এর জন্মদিন, কাল ওর বিবাহবার্ষিকী। তুই বিশ্বাস করবি না, এখানে কারও ডিভোর্স হলেও পার্টি হয়।

তা হলে তুমি নিজের জন্য সময় পাও কখন?

এরই মধ্যে সময় বার করে নিতে হয়। জীবনটা এরকমই চলছে, আর ফেরানো যাবে না। অনেক মানুষের জীবন মাটিতে আঁকা আলপনা, আর আমাদের মতন মানুষের জীবন হাউই কিংবা রকেট। আমাদের আয়ু কম নয়। কিন্তু আমাদের ছটা বেশি। যে যেটা বেছে নেয়! তবে যত রাতই হোক, আমি প্রত্যেকদিন ভোরবেলা উঠি। পরে দুপুরে খানিকটা ঘুমিয়ে-টুমিয়ে নিই, ভোরে ওঠা অভ্যেস হয়ে গেছে। তখন কিছুক্ষণ ধ্যান করি।

ধ্যান করো? কীসের ধ্যান?

যারা ধর্ম-টর্ম মানে, যাদের খুব ভক্তিভাব থাকে, তারা প্রত্যেকদিন পুজো-প্রার্থনা করে। নামাজ পড়ে। আমাদের ও সব ঝামেলা নেই। তবু আমাদেরও কিছু না কিছুর সাধনা করতে হয়। এটা আমি আমার এক জ্যাঠামশাইয়ের কাছে শিখেছি।

চোখ বুজে ধ্যান করো? তখন কীসের কথা ভাবো? কী দ্যাখো?

রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন, গান্ধিজি, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আবদুল করিম খাঁ, এঁদের ছবি মনের চোখে ভেসে ওঠে। এঁরাই তো এ যুগের দেবতা। ছেলেবেলায় গান শিখিনি তেমন, এখন গলা সাধি, কঠিন কঠিন রাগ গলায় তোলার চেষ্টা করি। তাতেই সকালবেলা মনটা ভালো হয়ে যায়! আর হ্যাঁ, লিভার ভালো রাখার জন্য নিমপাতার রস খাই। রবীন্দ্রনাথ মদ খেতেন না, তবু নিমপাতার রস খেতেন।

আটটা বাজতে না বাজতেই অভিদা বললেন, অনেকক্ষণ সন্ধে হয়ে গেছে, এখন আহ্নিক শুরু করতে হবে যে! গেলাস, সোডা আর বরফ দিতে বল। ওই কাবার্ডে বোতল আছে অনেক রকম, তোর যেটা ইচ্ছে নিয়ে আয়। সুনীল, তুই আমেদাবাদ গিয়ে কী করবি? এখানেই থাক না কদিন!

আমি বললাম, ওদের কথা দেওয়া আছে যে! স্টেশনে অপেক্ষা করবে!

কথা দিয়ে সব কথা রাখিস বুঝি? বেশ বেশ, অভ্যেসটা ভালো। আমার অবশ্য ধাতে নেই। তুই কবিতা-টবিতা তো লিখিস বুঝলাম, আর কিছু করিস?

একটা খবরের কাগজে…

সেই টিপিক্যাল ব্যাপার। সাহিত্য করতে গেলেই হয় খবরের কাগজে, আর নয় তো ইস্কুল-কলেজে মাস্টারি। সব জায়গায় এরকমই দেখি! অথচ যারা সাহিত্য রচনা করবে, তাদের সারা দেশ, এমনকি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো দরকার, মানুষকে চেনা দরকার। ছোটো একটা গণ্ডির মধ্যে থেকে…

ও সবের জন্য অনেক টাকা লাগে, অভিদা।

টাকা রোজগার করলেই পারিস! বড়ো বড়ো উর্দু কবিরা এখানকার সিনেমার জন্য গান লিখে অনেক টাকা রোজগার করে। আবার নিজস্ব কবিতা লেখে। তোরা বাঙালিরা পারিস না কেন?

বাংলা সিনেমায় তো স্কোপ নেই!

এখানে চলে আয়! তোর বয়েস এখনও কম, জীবনটা নিয়ে কী করবি ঠিক করেছিস? একটা কিছু জীবনদর্শন তো থাকা দরকার।

সত্যি কথা বলছি, অভিদা, সেরকম কিছু ঠিক করিনি। খানিকটা কনফিউজড অবস্থা বলতে পার!

তোকে আমার গল্পটা শোনাবার আগে জিজ্ঞেস করা হয়নি, তুই ধর্ম-টর্ম মানিস?

তেমনভাবে মানি না, আবার উড়িয়েও দিতে পারি না। মন্দিরে-টন্দিরে মাথা ঠুকি না। কিন্তু সরস্বতী মূর্তি দেখতে ভালো লাগে।

সেটা অন্য ব্যাপার। লিবিডোর ব্যাপার।

আচ্ছা অভিদা, উত্তর কলকাতায় তোমাদের বাড়িতে নিত্য তিরিশ দিন রাধাগোবিন্দের পুজো হতে দেখেছি। ছেলেবেলায় আমরা প্রসাদও খেয়েছি। সেই বাড়ির ছেলে হয়ে তুমি নাস্তিক হলে কী করে?

ওই মন্দিরটাই আসল কারণ। তুই জগদীশ্বর সেন-এর নাম শুনেছিস?

জগদীশ্বর সেন…মানে যিনি ইতিহাসের বই লিখেছেন?

হ্যাঁ।

বেশ কয়েকটা বই লিখেছেন, তার মধ্যে একটা আমার দারুণ লেগেছে, ‘টোটেম অ্যান্ড রিচুয়ালস’, এ বইটার বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিত।

ওই জগদীশ সেন আমার জ্যাঠামশাই। কলকাতা ইউনিভার্সিটির কারমাইকেল অধ্যাপক ছিলেন। আমার বাবারা সাত ভাই, চার বোন। জ্যাঠামশাই সবচেয়ে বড়ো। বাড়ির তিনি একজন প্রধান শরিক। অন্য ভাইদের সঙ্গে তার গণ্ডগোল লেগেছিল ওই রাধাগোবিন্দ মন্দিরের নিত্যপূজা নিয়ে। পড়ন্ত অবস্থায় বেশিরভাগ শরিকের কোনো রোজগার নেই। মন্দিরে প্রতিদিন দুবেলা পুজো চালাতে তো খরচ আছে, কে দেবে। এ ওকে ঠেলাঠেলি করে। একদিন বড়ো জ্যাঠামশাই সবার সঙ্গে এক সঙ্গে খেতে বসেছেন, হঠাৎ প্রস্তাব দিলেন—

মন্দিরের পুজো বন্ধ করে দাও। পঞ্চ ধাতুর বিগ্রহটা পুরোনো, ওটা দান করে দেওয়া হোক মিউজিয়ামে। মন্দিরটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে, এখন আমাদেরই ঘরে কুলোচ্ছে না। মন্দিরটা ভেঙে ওখানে অনায়াসে একটা তিনতলা বাড়ি উঠতে পারে। কিছু ভাড়া দিলে রোজগারও হবে।

খাবার টেবিলে যেন একটা বাজ পড়ল। কতদিনের পারিবারিক ঐতিহ্য, সেই পুজো বন্ধ করার কেউ প্রস্তাব দিতে পারে? তার ওপর মন্দির ভাঙার কথা? এ যেন কানে শোনাও পাপ।

শুরু হয়ে গেল চিৎকার চেঁচামেচি, বড়ো জ্যাঠামশাই আবার দৃঢ় গলায় বললেন—

আগে যখন জমিদারি ছিল, তখনই এসব মন্দির গড়া হত। সব জমিদারই মন্দির বানিয়েছে, মন্দিরের খরচ চলত প্রজাদের শোষণ করা টাকায়! এখন জমিদারি উচ্ছন্নে গেছে, এখন আর নিজেদের মন্দির রেখে লাভ কী? বাইরেতো কত বারোয়ারি মন্দির আছেই।

আমার ঠাকুমা তখন বেঁচেছিলেন। ঠাকুমা দারুণ ইন্টারেস্টিং ক্যারাকটার। তাঁর কথা তোকে পরে একদিন বলব। বড়ো জ্যাঠামশাইয়ের ওই কথা শুনে ঠাকুমা বললেন—

জগু, তুই যদি আর একবার ওই রকম কথা উচ্চারণ করিস, তাহলে আমি গলায় কাটারি দেব! আমি যতদিন বেঁচে আছি…

বড়ো জ্যাঠামশাই বললেন—

সে তুমি যাই বলো বলো মা, এটাই আমার কথা। তোমরা যদি না মানো, আমি আমার বাড়ির অংশ বেচে দিয়ে চলে যাব!

আমার তখন সতেরো-আঠারো বছর বয়েস। ওই যে তুই বললি না, কনফিউজড অবস্থা, আমারও সেই রকম। বড়ো জ্যাঠামশাইকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতাম, কিন্তু তিনি এটা কী বললেন? অন্যরা যে বলছে, মন্দির ভাঙলে বংশনাশ হবে?

বড়ো জ্যাঠামশাই থাকতেন বাড়ির ডান দিকের তিনতলার অংশে। বড়ো জ্যাঠাইমা মারা গেছেন দুবছর আগে, ওঁদের একটিমাত্র মেয়ে, আমাদের যমুনাদি, বিয়ের পর থাকে আলজিরিয়ায়। জ্যাঠামশাই একা হয়ে গেছেন। আমি দেখা করতে গেলাম তাঁর সঙ্গে।

বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বড়ো জ্যাঠামশাইয়ের বিশেষ ভাব ছিল না। এতগুলো ছেলেমেয়ে, সবার নামও জানতেন না বোধ হয়। আমার মুখ চিনলেন অবশ্য। প্রথমে আমার দু-একটা প্রশ্ন শুনে উনি ঠিক পাত্তা দিলেন না, গম্ভীরভাবে বললেন—

আমি যা বলব, তা তোমাকে মানতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তুমি যুক্তি দিয়ে বুঝতে শেখো।

আমি খুব আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করলুম—

বড়ো জ্যাঠামশাই, একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারি না। যুক্তি গুলিয়ে যায়। আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন তো ঈশ্বর বলে সত্যিই কি কেউ আছে, না নেই?

জ্যাঠামশাই আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। মানুষটা বেশ লম্বা। ধারালো নাক, বয়েস হলেও মাথায় চুল কমেনি, চুল কপালের ওপর এসে পড়ে, তিনি কথা বলতে বলতে চুল সরান। তীব্রভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ আছেন। কোটি কোটি মানুষ যাঁকে বিশ্বাস করে, তাঁকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’

উনি আবার বললেন—

তবে ঈশ্বর মোটেই একজন নয়, কয়েকজন। এক এক ধর্মের এক এক ঈশ্বর। প্রত্যেক ধর্মের লোকই মনে করে, তাদের ঈশ্বর শক্তিমান, তিনিই বিশ্ব জগতের স্রষ্টা। চার-পাঁচজন সর্বশক্তিমান আর স্রষ্টা হয় কী করে। সুতরাং, এই ঈশ্বরের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। বিশ্বাসের ওপর যুক্তি চলে না।

হয়তো একজনই আছে। বিভিন্ন ধর্মে তাঁকে আলাদা করে দেখা হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলেছেন, যত মত তত পথ।

ওটা কথার কথা। শ্রীরামকৃষ্ণ একজন সাধক, সমস্ত হিন্দুর ধর্মগুরু নন। অধিকাংশ হিন্দুই তাঁর এই কথা মানে না। তাঁকে অন্য ধর্মের লোকরা তো একেবারেই মানে না। তারা মনে করে, মতটাই ঠিক পথ ও একমাত্র পথ। অন্য ধর্মের লোকরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সারা পৃথিবীতে এখনও এরকম ধর্মীয় ভেদাভেদই চলছে।

কিন্তু সব ধর্মেই তো কিছু মানুষ ঈশ্বর উপলব্ধির কথা বলেন। তাঁরা কি মিথ্যে কথা বলেছেন?

তাঁদের সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না। বলবে মনস্তাত্ত্বিক বা ডাক্তাররা। ধরে নেওয়া যাক, সত্যিই একজন ঈশ্বর আছেন। থাকলেই বা কী? মানুষের ভালো বা মন্দ, কিছু করার ক্ষমতাই তাঁর নেই। কলাগাছে মুলো ফলাবার ক্ষমতা তাঁর নেই। এইসব গাছপালা, জীবজগৎ তিনি সৃষ্টি করেননি, এর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে।

বিজ্ঞান কি একেবারে শেষ কথা বলে দিতে পারে? বড়ো জ্যাঠামশাই, অনেক বৈজ্ঞানিকেরও ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে, আমরা পড়েছি।

বিজ্ঞান কখনও শেষ কথা বলতে পারে না। অনন্ত জিজ্ঞাসার নামই বিজ্ঞান। এখনও অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে মানুষের। হয়তো এরপর এমন কিছু আবিষ্কার হবে, যাতে এখনকার সব ধারণা আবার বদলে যাবে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হতেও পারে। হোক না! একটা ব্যাপার এর মধ্যে অবধারিতভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে। একজন মানুষ যদি সারা জীবনেও কোনো ধর্মের আওতায় না থাকে, কোনো রকম আচার-অনুষ্ঠান না মানে, ঈশ্বর আছেন কি নেই, তা নিয়ে মাথাও না ঘামায়, তাহলেও সে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। অর্থাৎ ঈশ্বরকে তার জীবনে প্রয়োজন নেই, ঈশ্বরও তাকে ঘাঁটায় না। পৃথিবীতে এই ধরনের মানুষের সংখ্যা অনেক বাড়ছে। লোকে এদের বলে নাস্তিক। কথাটা ঠিক নয়। ঈশ্বর নিয়ে যে মাথাই ঘামায় না, তার চিন্তা নেগেটিভ হবে কেন? সেটা পজিটিভ।

আর বৈজ্ঞানিকদের কথা বলছিস? বিজ্ঞান নিয়ে যারা চর্চা করে, বিজ্ঞান যাদের পেশা, তারা সবাই বৈজ্ঞানিক নয়। অনেকের অনেক সংস্কার যায় না। কেউ কেউ প্রকাশ্যে অস্বীকার করতে এখনও ভয় পায়। জিয়োর্দানো ব্রুনো, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিয়ো এঁদের কী অবস্থা হয়েছিল মনে নেই? আইনস্টাইন খুব চালাক। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি না বলুন। আইনস্টাইন কায়দা করে বলেছিলেন, আমি স্পিনোজার ঈশ্বরকে মানি। (স্পিনোজা না স্পিনোৎসা, কী উচ্চারণ হবে কে জানে?) দার্শনিক স্পিনোজা বলেছিলেন, এই যে প্রকৃতির এত বিচিত্র সৃষ্টি, এই সৃষ্টির এমন নিয়মশৃঙ্খলা, এটাই ঈশ্বর, এর বাইরে আকাশে ঈশ্বর খোঁজার দরকার কী?

অভিদা একটুখানি থামলেন। মাছ ভাত খেতে খেতে আমরা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। আমার মাথায় অনসূয়ার কাহিনিটা ঘুরছে। ওই কাহিনির মধ্যে এখনও যেন অনেক না-বলা কথা রয়ে গেছে।

এ সময় আমি জিজ্ঞেস করলাম, অভিদা, অনসূয়া তোমাকে যে চিঠিগুলো লিখেছে, তা আমাকে দেখাতে পারো? যদি তোমার আপত্তি না থাকে।

অভিদা বললেন, আপত্তি কী আছে? প্রথম দুটো চিঠি আমি রাখিনি, পড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। পরেরগুলো রেখে দিয়েছি। কেন ফেলিনি কে জানে? তুই পাশের লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে দ্যাখ, টেবিলের ডানদিনের দেরাজে, একটা হলদে খামের মধ্যে।

একটা টেলিফোন এল, অভিদা কথা বলতে লাগলেন, আমি পড়তে লাগলাম চিঠিগুলো। পরিষ্কার সাদা কাগজে লেখা। চিঠিগুলো ক্রমশ বড়ো হয়েছে, তাও বেশি বড়ো নয়, প্রথমটা তিন লাইন, শেষতমটি দশ লাইন। শেষের দিকে ব্যাকুলতা যেন বেড়েছে, অভিদার বিপদের চিন্তায় মেয়েটি খুবই কাতর।

টেলিফোন করা শেষ হলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, অভিদা, তুমি এই চিঠির কখনও উত্তর দিয়েছ?

অভিদা বললেন, উত্তর দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। চিঠিতে নাম নেই। তা ছাড়া আশ্রমে চিঠি পাওয়ার কোনো নিয়ম আছে কি না, তাই বা কে জানে!

এগুলো পড়লে মনে হয়, মেয়েটি তোমাকে আসলে ভালোবেসে ফেলেছে। তুমি তা বোঝোনি?

সেটা বুঝব না, আমি কী এতই গবেট? তুই কবিতা লিখিস বলে সব বুঝে ফেলবি? প্রেম বা এক ধরনের আকর্ষণ ওর হয়েছে তা ঠিকই। কিন্তু ও নিজে কি তা বোঝে? বোঝে না। ওর ধারণা, ও ক্ষমার আদর্শ প্রচারের জন্য প্রাণপাত করে যাচ্ছে।

তুমি কী করে জানলে যে ও বোঝে না? ওর সঙ্গে তোমার আর দেখা হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে আর একবার!

আরে সেই কথাটাই বলনি এতক্ষণ? কবে দেখা হল, কোথায়?

দাঁড়া, কেন দেখা হল, সেটা আগে বুঝিয়ে বলা দরকার।

গেলাস শেষ করে অভিদা আবার ঢাললেন। সিগারেট ধরিয়ে ছড়িয়ে দিলেন ভাঙা পা-টা, তারপর বলতে শুরু করলেন।

আমার যে মাঝে মাঝে অসুখ হয়েছে কিংবা একটা-দুটো দুর্ঘটনায় পড়েছি, এগুলো একবারে স্বাভাবিক ব্যাপার, আমি জানি। মানুষের জীবন বদলাবার কোনো ক্ষমতা যে ঈশ্বরের নেই, তার আমি মর্মে মর্মে প্রমাণ পেয়েছি অনেক ঘটনায়। সেসব আমি ডায়েরিতে লিখে এক সময় পড়তে দেব। ধর, গরিব বিধবার একমাত্র ছেলেটি যদি বিনা দোষে পুলিশের গুলিতে মারা যায়, তখন মনে হয় না, ঈশ্বরকে ঈশ্বরত্ব থেকে বরখাস্ত করা উচিত? কর্তব্যে চরম অবহেলা? অনেক ধর্মভীরু এই ঘটনার পরেও বলে কী জানিস, ওই বিধবার নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে পাপ ছিল, তাই এ জন্মে শাস্তি পাচ্ছে। প্রথমত, পূর্ব জন্মটাই একটা ভুল ধারণা, আর সেই পাপে এ জন্মে শাস্তি? যত্তসব গাঁজাখুরি ব্যাপার।

আমি ভুলে থাকতে চাইলেও আমার কিছু একটা ঘটলেই যে অনসূয়ার চিঠি আসে, সেটা এক হিসেবে বিরক্তিকর! কেন আমি ওর জীবনবল্লভকে নিয়ে মাথা ঘামাতে যাব?

সে যাই হোক, গত বছর অন্যরকম একটা ব্যাপার হল। আমি বাচ্চাদের খুব ভালোবাসি। আমি আর বিয়ে করব না, আমার ছেলেপুলে হবে না, কোথাও আমার অবৈধ সন্তানও নেই, এটা বিশ্বাস করতে পারিস। কিন্তু বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতে আমার খুব ভালো লাগে।

আমার মিউজিক হ্যান্ডসদের মধ্যে একজনের নাম রামরতন ঝাঁ। সে হারমোনিয়াম বাজায়। এখানকার অনেক গানেই তো আর হারমোনিয়াম লাগে না। সিন্থেসাইজারে কাজ চলে যায়। সেইজন্য বেচারির অবস্থা ভালো নয়। অনেক দিনের পরিচয়, এদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই যাই। রামরতনের মেয়ে সবিতা, তাকেও ছোটো অবস্থায় দেখেছি, বড়ো হয়ে গেল, বিয়ে করল। বিয়ের ঠিক সাড়ে তিন বছরের মাথায় তার স্বামী মারা যায় রাস্তায় ট্রাক চাপা পড়ে। সাইকেলে সে বাড়ি ফিরছিল, মাথাটা এমনভাবে পিষে যায় যে চিনতেও কষ্ট হয়েছে। সবিতা দু-বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে ফিরে এল বাবার কাছে। ছেলেটার নাম পিন্টো, কী সুন্দর, লাভলি বাচ্চা, একদম কাঁদে না। সব সময় হাসে, চেনা-অচেনা নেই। আমার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল, গেলেই আংকেল আংকেল বলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। আমারও এমন মায়া পড়ে গেল যে প্রত্যেকদিন ওকে দেখার জন্য মনটা কেমন করে। যতই কাজ থাক, দিনে একবার ওর কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করে আসি। সেই পিন্টোর হল টাইফয়েড, প্রচণ্ড জ্বর। অমন হাসিখুশি বাচ্চাটা বিছানায় শুয়ে কষ্টে ছটফট করে, সেই দৃশ্য সহ্য করা যায় না। এখন টাইফয়েড এমন কিছু শক্ত অসুখ নয়। ঠিক করলুম, যেমনভাবে হোক, ওকে বাঁচাতেই হবে, রামরতন যেন টাকার জন্য চিন্তা না করে।

আমি গিয়ে ওর শিয়রের কাছে বসে থাকতুম। তবু পিন্টোর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। হঠাৎ এক সময় আমার কী মনে হল জানিস? মানুষের সংস্কার কী সাংঘাতিক প্রবল। আমার মনে হল, আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য অনসূয়ার হিংসুটে ভগবান এই বাচ্চাটাকে মারতে চাইছে না তো? ঈশ্বরের অস্তিত্বে বদ্ধমূল অবিশ্বাস। তবু এরকম চিন্তা মাথায় আসে?

এমনকি, এ কথাও মনে হল, আমার অসুখের সময় অনসূয়া প্রার্থনা করে। অনসূয়া তো পিন্টোর অসুখের কথা জানে না। অনসূয়া প্রার্থনা করলে পিন্টোও সেরে উঠতে পারে? একবার অনসূয়াকে গিয়ে বলব?

আমারই যদি সব যুক্তি চলে যায়, তাহলে আমার চেয়ে যারা দুর্বল তারা তো বারবার হার মানবেই। তোকে সত্যি কথা বলছি সুনীল, ওই সময়টাই আমার বারবার মনে পড়ত অনসূয়ার কথা। খুব ইচ্ছে করত, তার কাছে ছুটে যাই।

যাওয়া হয়নি। বলতে গেলে, আমার কোলে মাথা রেখেই পিন্টো মারা গেল। এমন ফুটফুটে সুন্দর মুখটা কী শুকনো, বিবর্ণ হয়ে গেল আমার চোখের সামনে। আমি কাঁদিনি, আমার রাগে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ডাক্তারদের ওপর ভরসা না রেখে শেষ পর্যন্ত সবিতা কোন মন্দিরে যেন মাথা ঠুকতে গিয়েছিল। আমার ইচ্ছে করছিল, কালাপাহাড়ের মতন সব কটা মন্দির ভেঙে দিই। পরের দিন সবটা রাগ পড়ল অনসূয়ার ওপর। তার ভগবান আমাকে মারতে না পেরে ওইটুকু শিশুকে মেরে প্রতিশোধ নিল, সে এত কাপুরুষ? অনসূয়া জানুক, বৈষ্ণবদের আরাধ্য ঈশ্বরও কত হৃদয়হীন হতে পারে।

অভিদাকে বাধা দিয়ে আমি বললাম, কিন্তু পৃথিবীতে অনেক শিশুই যে এভাবে মরে। আমাদের ব্যক্তিগত শোক হয় ঠিকই। কিন্তু চিকিৎসা সত্ত্বেও কে বাঁচবে আর কে বাঁচবে না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তুমিই তো বলেছ, ভগবান বলে কেউ থাকলেও মানুষের মঙ্গল বা অমঙ্গলের ব্যাপারে তার কোনো ভূমিকা নেই!

অভিদা বললেন, তা ঠিকই, কিন্তু ওই বললুম, পিন্টোর অসুখের সময় আমি এমনই কাতর হয়ে পড়েছিলুম যে যুক্তি-টুক্তি সব চলে গিয়েছিল। আমার ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আমি আবার ছুটে গেলাম দুরানিগঞ্জে। কিছু কিছু বাড়ি ওখানে খালিই থাকে। আগের বাড়িটা পাওয়া গেল না, অন্য একটা বাড়িতে উঠলুম, সেটা পাহাড়ের একটু নীচের দিকে। নদীটা স্পষ্ট দেখা যায়।

অনসূয়াদের আশ্রমে গিয়ে যে লণ্ডভণ্ড করা চলে না, এমনকি সেখানে অনসূয়ার সঙ্গে কথা বলাটাও ঠিক নয়, সেটুকু কাণ্ডজ্ঞান আমার ছিল। কিন্তু অনসূয়ার সঙ্গে দেখা করতেই হবে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকি, দ্বিতীয় দিনে অনসূয়াকে দেখাও গেল, সঙ্গে আরও তিনটি মেয়ে, গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে। অনসূয়া এক পলক আমার দিকে তাকাল, যেন আমাকে চেনেই না।

পরদিন দুপুরবেলা রাস্তায় ওদের দলটাকে দেখতে পেয়েই আমি বাড়ি থেকে ছুটতে ছুটতে চলে এলুম। হাঁটতে লাগলুম ওদের পাশে পাশে। রাস্তা দিয়ে তো যে-কোনো লোক যেতেই পারে। কথা বলায়ও দোষ নেই। আমি আগে অন্য দু-একটি মেয়েকে নিরীহ কৌতূহলের সুরে জিজ্ঞেস করলুম, আপনারা কোন আশ্রমে থাকেন? আপনাদের উদ্দেশ্য কী? আপনারা কি গরিব-দুঃখীদের সেবা করেন? এই সব। এরা উত্তর দিয়েছিল। তারপর এক সময় অনসূয়ার পেছন পেছন গিয়ে, চাপা গলায় বাংলায় বললুম, অনসূয়া, তোমার সঙ্গে আমার দেখা করার বিশেষ দরকার। তুমি যদি আমার বাড়িতে আসতে না চাও, নদীর ধারে বড়ো বটগাছটার তলায় এসো, বিকেল বা সন্ধের সময়…

বিকেল হতে না হতেই আমি গিয়ে বসে রইলুম নদীর ধারে। এই নদীতে সকালের দিকে অনেকে স্নান করতে আসে। বিকেলের দিকে মানুষজন বেশি থাকে না, তা ছাড়া একটু একটু শীতও পড়েছে। সে দিনটা আবার আকাশ মেঘলা হয়ে গেল। শীতকালেও তো মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। কী মুশকিল, বৃষ্টি হলে অনসূয়া আসবে কী করে?

ওই দিকটায় ওপর থেকে নামবার জন্য আর একটা সরু পাকদণ্ডী পথ আছে। আমি হাঁ করে সেই দিকে চেয়ে বসে রইলুম। একটার পর একটা সিগারেট পোড়াচ্ছি, কারুর জন্য এরকমভাবে অপেক্ষা করে থেকেছিস কখনও? থিয়োরি অব রিলেটিভিটির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। পাঁচ মিনিটকে মনে হয় এক ঘন্টা। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছি। আমি জীবনে কক্ষনো কোনো মেয়ের জন্য ওরকমভাবে প্রতীক্ষা করিনি। আমার একটা অহমিকা আছে, আমি মেয়েদের কাছে যাই না, তারা আমার কাছে আসে। অথচ সেই আমিই…

তা ছাড়াও, মনে হচ্ছিল, অনসূয়া আসবে তো? সে তো হ্যাঁ কিংবা না কিছু বলেনি। আশ্রম থেকে একা আসার অসুবিধে থাকতে পারে। যে-কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। এর মধ্যে কী অজুহাতে সে বেরুবে আশ্রম থেকে? কিংবা সে হয়তো আমার সঙ্গে আর দেখা করতেই চায় না। তাহলে আমি কী করব?

কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না। আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। তারই মধ্যে হঠাৎ একসময় দেখি, ওপর দিকের রাস্তায় কী যেন একটা উড়ছে। অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তো, দৃষ্টি বিভ্রম হতে পারে! সত্যিই মনে হল, একটা পাখি যেন নেমে আসছে। পাখি নয়, সে অনসূয়া, নামছে দৌড়ে দৌড়ে। আমার অত কবিত্ব নেই। তবু অনসূয়াকে পাখি বলেই মনে হতে লাগল। শীতের জন্য সে একটা চাদর জড়িয়েছে, সেই চাদরটা উড়ছে ডানার মতন। আমার মনে হল, এমন সুন্দর দৃশ্য আমি আগে কখনও দেখিনি।

আমার শরীর থেকে সমস্ত রাগ চলে গেল। আমি একদৃষ্টে দেখছি সেই মেয়েটিকে।

অনসূয়া কাছে এসে ঝপ করে বসে পড়ে ব্যাকুলভাবে বলল, আপনার কী হয়েছে? কী হয়েছে বলুন? আমি প্রার্থনা করব, আমি আমার আয়ু দিয়েও…

অনসূয়া ভেবেছে, আমার শক্ত কোনো অসুখ হয়েছে, তাই আমি জীবন বাঁচাবার জন্য ওর কাছে প্রাণভিক্ষা করতে এসেছি!

আবার আমার রাগে জ্বলে ওঠা উচিত ছিল। তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ওকে বিঁধতে পারতুম। প্রাণভিক্ষে করব আমি? অভিজিৎ সেন? ওর ভগবানের কাছে? তার আগে আমি থুতু ফেলে ডুবে মরব!

কিন্তু রাগ হল না, ওরকম কথাও এল না। একটি মেয়ে আমাকে তার আয়ু দিতে চায়। আমি ফস করে বলে ফেললুম, আমার সে সব কিছু হয়নি অনসূয়া, আমি এসেছি তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলতে। তোমার মতন একটা নিষ্পাপ সরল মেয়ে, তাকে আমি জোর করে ছুঁয়েছি, এটা আমার অন্যায় হয়েছে! তুমি কী জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রমে যোগ দিয়েছ জানি না, তোমার আগের জীবনে কী ছিল জানি না। আমি বলতে এসেছি, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই!

বিশ্বাস করো সুনীল, এটা বলে ফেলার আগের মুহূর্তেও আমি এটা ভাবিনি। জীবনে আর কখনও বিয়ে করব না, এরকম আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল। কিন্তু অনসূয়াকে দেখে কী যেন হয়ে গেল, আমি বদলে গেলুম, আমি ওর হাত চেপে ধরে বললুম, অনসূয়া, আমি তোমাকে চাই। আমি তোমাকে যথাসাধ্য সুখী করবার চেষ্টা করব। অন্যরকম জীবনযাপন করব, তুমি যদি মুম্বই শহরে না থাকতে চাও…

অনসূয়ার মুখখানা রক্তশূন্য বিবর্ণ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বলল, এ কী বলছেন আপনি? আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে!

আমি বললুম, পাথরের মূর্তির সঙ্গে সত্যি কারুর বিয়ে হতে পারে? ওর কোনো মূল্য নেই! অনেক সন্ন্যাসীও তো সংসার জীবনে ফিরে আসে। তুমি ফিরে এসো।

অনসূয়া বলল, তা কখনও হয়? তাতে আপনার বিপদ বাড়বে না। না, না, এমন কথা উচ্চারণও করবেন না। ছি ছি ছি ছি। আমি যাই, চলে যাই।

অনসূয়ার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললুম, তুমি আমার বিপদের কথা ভাবছ? অনসূয়া, তোমার ঠাকুর আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রাখো! এভাবে তোমার জীবনটা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তোমাকে পেলে আমার জীবনটাও সুন্দর হবে।

অনসূয়া কোনো কথাই শুনতে চায় না, সে আবার কান্না শুরু করল। চলে যেতে চায়, আমার হাত ছাড়িয়ে যেতে পারছে না। এক সময় আমাকে হাল ছেড়ে দিতে হল, কিন্তু তখনও ওকে পাওয়ার ইচ্ছে আমার মধ্যে তীব্র। আমি ইচ্ছে করলে, সেইখানে ওকে জড়িয়ে ধরে ওকে ভোগ করতে পারতুম। আমি জানি, অনসূয়ার ইচ্ছে থাক বা না থাক, ও চিৎকার করে লোক জড়ো করত না। আমাকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করত না।

ওকে জোর করে বুকে টেনে আনতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে সংযত হয়েছি। সেটুকু বিবেক আমার এখনও অবশিষ্ট আছে। শরীর সম্ভোগকে আমি পাপ মনে করি না, কিন্তু ও করে। কেন ওকে কষ্ট দেব? ও আমাকে ওর আয়ু দিতে চায়, কিন্তু জীবনসঙ্গিনী হতে চায় না! এ কী ধরনের ভালোবাসা?

সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যে আমি সেদিন ওকে ভোগ করিনি, সেজন্য কেউ কি আমাকে প্রশংসা করবে? আমি একটা অন্যায় করলে আমাকে ছি ছি করার লোক অনেক আছে। কিন্তু সেই নির্জন নদীর ধারে আমি যে অন্যায় ইচ্ছেটা দমন করতে পেরেছিলাম, সেজন্য কেউ আমাকে সাধুবাদ দেবে না!

অভিদার সঙ্গে এরপর থেকে মাঝে মাঝে আমার যোগাযোগ হত। কলকাতায় এলে আমাকে খবর দিতেন। অনসূয়ার সম্পর্কে আমার কৌতূহল যায়নি, কিন্তু ও প্রসঙ্গ তুললেই বলতেন, দূর দূর, ওর কথা বাদ দে। আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি!

অভিদার ক্যানসার। একজন গায়কের পক্ষে এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে?

খবরটা পড়েই আমি কেঁপে উঠেছিলাম। এই কি তবে অনসূয়ার ভগবানের চরম প্রতিশোধ? এবারে আর নিষ্কৃতি নেই!

পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, আমারও সংস্কার যায়নি? ক্যানসার তো কত লোকেরই হয়। সেটাকে আমি ভগবানের অভিশাপ ভাবছি কেন? শ্রীরামকৃষ্ণেরও গলায় ক্যানসার হয়েছিল, তাঁকে কে অভিশাপ দেবে? জন্ম-মৃত্যুরই মতন রোগভোগ প্রাকৃতিক ব্যাপার।

সেবারে অভিদা যখন কলকাতায় এলেন, তাঁকে দেখে খুবই কষ্ট হল। এর মধ্যেই রোগা হতে শুরু করেছেন, গলার আওয়াজ ফ্যাসফেসে। কিন্তু তেজ যায়নি। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, সে মেয়েটা আবার চিঠি লিখেছে জানিস তো? না খেয়েদেয়ে প্রার্থনা করছে। এবারে আর ও সবে কিছু হবে না। কাকতালীয়ও হবে না। সিগারেট, বুঝলি, সিগারেটই দায়ী।

তারপর বললেন—

জেনিভায় যাচ্ছি বুঝলি! অপারেশন করাব। টাকাপয়সা অনেক খরচ হবে, আমি আর টাকা নিয়ে কী করব? গলাটা না থাকলে বাঁচারই কোনো মানে হয় না। ডাক্তাররা বলছে ফিফটি-ফিফটি চান্স! হয় বাঁচব, গালা ঠিক হয়ে যাবে, নয়তো অপারেশন টেবিলেই ফুটে যাব! তোকে আমার ডাইরিগুলো আর চিঠিপত্র পাঠিয়ে দেব। যদি কখনও সুযোগ হয়, লিখবি আমার কথা। আমি জীবন কাটিয়েছি নিজের ইচ্ছেমতন, ভগবান-টগবানের তোয়াক্কা করিনি। জীবনের প্রতি আমার বিশ্বাস পজিটিভ। আমি মরতেও যাচ্ছি স্বেচ্ছায়!

বলতে গেলে একটা মিরাকলই ঘটিয়ে দিলেন অভিদা। জেনিভা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন। অপারেশন সাকসেসফুল। ছ-মাস বাদে আবার রেকর্ড করলেন নতুন গান। গলা নষ্ট হয়নি।

এত বড়ো জয়ের পরও কিন্তু বেশিদিন বাঁচেননি অভিদা।

নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দে আবার শুরু করেছিলেন উদ্দাম উৎসব। আবার আগেকার মতন মদ্যপান ও পার্টি। একটা পার্টিতে কোনো একটি অভিনেত্রীকে অপমান করার খবরও কাগজে ছাপা হয়েছিল। আমার ধারণা, জীবনে অনেক কিছু পেয়েছেন অভিদা, কিন্তু অনসূয়া-প্রত্যাখ্যান তিনি সহ্য করতে পারেননি। পাথরের বিগ্রহের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জিতেছেন বার বার , তবু তার কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে পারেননি অনসূয়াকে।

মুম্বই শহর থেকে খানিকটা দূরে পানবেল নামে একটা জায়গায় একজন প্রোডিউসারের বাগানবাড়িতে মস্ত বড়ো পার্টি ছিল। সেখানেই আকণ্ঠ মদ্যপান করে মধ্যরাত্রের পর একা গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। গৃহস্বামী অনেক অনুরোধ করেছিল সেখানেই থেকে যেতে। কিন্তু ওই যে অভিদার জেদ? তাকে কে আটকাতে পারে!

এক জায়গায় রাস্তা সারাবার জন্য খানিকটা ঘেরা ছিল। সেখানেই দাঁড়িয়েছিল একটা রোড রোলার। অভিদা অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে সোজাসুজি ধাক্কা মারেন। গাড়ি বেশ স্পিডে আসছিল, হেড অন কলিশন যাকে বলে। বেশি যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।

অভিদা বলেছিলেন, মাটিতে আঁকা আলপনার মতো নয়, তাঁর জীবন উল্কার মতন। সেরকম জীবনের এরকম পরিণতিই তো স্বাভাবিক।

এটাও কি প্রতিশোধ? অনসূয়ার বিশ্বাসের ভগবান কখনো-কখনো বামন অবতার, কখনও নৃসিংহ অবতার হয়ে দুষ্টের দমন করেছেন। তিনি রোড রোলারের রূপও ধারণ করতে পারেন কি না জানি না!

অনসূয়ার সঙ্গে একবার দেখা করার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। অভিদা যেবারে জার্মানিতে স্টিমার থেকে বরফগলা নদীতে পড়ে গিয়েছিলেন, সেবার তার মাথার চুল সব কেটে ফেলেছিল। এবারে অভিদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সে কী করেছে?

যাইনি। গিয়ে কী হবে? সে তো আমার প্রেমিকা নয়। আমাকে সে চিনতেই পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *