ঈশ্বরের ন’লক্ষ কোটি নাম – আর্থার সি. ক্লার্ক

ঈশ্বরের ন’লক্ষ কোটি নাম – আর্থার সি. ক্লার্ক

‘আপনাদের অর্ডারটা একটু অস্বাভাবিক ধরনের’, বিস্ময়ের মাত্রাটা যথাসম্ভব কমিয়ে বললেন ডাঃ ওয়াগনার। ‘আমি যতদূর জানি, এর আগে কোনো তিব্বতী গুম্‌ফা থেকে অটোমেটিক সিকুয়েন্স কম্পিউটারের জন্য অর্ডার আসেনি। আপনাদের ঠিক এই ধরনের মেশিনের প্রয়োজন হতে পারে সেটা আমি ভাবিনি। আপনারা কী কাজের জন্য যন্ত্রটা চাইছেন সেটা একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?’

‘নিশ্চয়ই’, তাঁর সিল্কের আলখাল্লাটিকে সামলে নিয়ে, স্লাইড রুলের সাহায্যে ডলার ও তিব্বতী মুদ্রার পারস্পরিক সম্পর্কের হিসাবটা স্থগিত রেখে বললেন লামা। ‘নিশ্চয়ই বলব। আপনাদের মার্ক-৪ কম্পিউটার সব রকম গণনারই কাজ করতে পারে, যদি না এক সঙ্গে দশটার বেশি সংখ্যার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের কাজের জন্য আমরা সংখ্যার কথা ভাবছি না—আমরা ভাবছি অক্ষরের কথা। আপনারা যদি যন্ত্রের সার্কিটে কিছু অদল-বদল করে সেটাকে এমন একটা অবস্থায় এনে দিতে পারেন যাতে তার সাহায্যে সংখ্যার বদলে অক্ষর ছাপা হবে, তাহলেই আমাদের কাজ হয়ে যায়।’

‘ব্যাপারটা কিন্তু আমার কাছে এখনও ঠিক’—

‘আমরা এই কাজটা বিনা যন্ত্রে গত তিনশ’ বছর ধরে করে আসছি। অর্থাৎ আমাদের গুম্‌ফা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকে। হয়ত কাজটা আপনি এখনো ঠিক অনুধাবন করতে পারছেন না, কিন্তু যদি একটু মন দিয়ে শোনেন, তাহলেই পারবেন।’

‘বেশ ত।’

‘আসলে ব্যাপারটা খুবই সহজ। আমরা একটা তালিকা প্রস্তুত করছি যাতে ঈশ্বরের যতরকম নাম, হয় তার সবগুলিই থাকবে।’

‘মানে—?’

লামা নিরুদ্বিগ্নভাবে বলে চললেন, “আমাদের বিশ্বাস ঈশ্বরের কোনো নাম লিখতেই নটির বেশি অক্ষরের প্রয়োজন হয় না। অবিশ্যি, নাম লিখতে যে বর্ণমালা ব্যবহার হবে, সেটা নতুন এবং আমাদেরই তৈরি।’

‘এই কাজ আপনারা তিনশ’ বছর ধরে করছেন?

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা অনুমান করি কাজটা সম্পূর্ণ হতে লাগত আরো পনের হাজার বছর।’

ডাঃ ওয়াগনার এখনও খেই পাচ্ছেন না। তিনি বললেন, ‘বুঝলাম। এখন বুঝতে পারছি কেন আপনারা কম্পিউটার ব্যবহার করার কথা ভাবছেন। কিন্তু এই কাজের আসল উদ্দেশ্যটা কী?’

লামার মধ্যে যেন কিঞ্চিৎ ইতস্তত ভাব। ডাঃ ওয়াগনারের আশঙ্কা হল তিনি বুঝি অজানতে অপমানসূচক কিছু বলে ফেলেছেন। কিন্তু লামার উত্তরে কোনো বিরক্তি প্রকাশ পেল না।

‘এই কাজটা আমাদের আচারানুষ্ঠানের একটা অঙ্গ। আমরা এটাকে একটা কর্তব্য বলে মনে করি। যতরকম নামে মানুষ ঈশ্বরকে জানে—গড্, জেহোভা, আল্লা, ইত্যাদি—এগুলো সবই মানুষের দেওয়া নাম। এখানে অবিশ্যি কতগুলো দার্শনিক প্রশ্ন এসে পড়ছে যেগুলো আমি আলোচনা করতে চাই না, কিন্তু নটি অক্ষরে সীমাবদ্ধ রেখে যদি আমরা সেগুলিকে পারমিউটেশন কম্বিনেশনের সাহায্যে পাশাপাশি বসিয়ে চলি, তাহলে আমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত আমরা ঈশ্বরের সব কটি নামই লিখে ফেলতে পারব। সেই বিন্যাসের কাজটা আমরা এতদিন যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই করে আসছি।

‘বুঝেছি—আপনারা AAAAAAAA থেকে শুরু করে ZZZZZZZZZ পর্যন্ত যেতে চান।’

‘ঠিক তাই। যদিও—যে কথাটা বললাম—এক্ষেত্রে অক্ষরগুলো আমরাই তৈরি করেছি। সংখ্যা থেকে অক্ষরে পরিবর্তন করার কাজটা আপনাদের পক্ষে কঠিন হবার কথা নয়। তবে এমন সার্কিট করা দরকার যাতে অক্ষরগুলো যুক্তিসম্মতভাবে পর পর সাজানো হয়। যেমন, কোনো শব্দে একই অক্ষর পর পর তিনবারের বেশি ব্যবহার করা চলবে না।’

‘তিনবার? না দুবার?’

‘তিনবার। কেন তিনবার সেটা বোঝাতে গেলে বৃথা সময় নষ্ট হবে।’

‘ওঃ’, বললেন ডাঃ ওয়াগনার। ‘আর কিছু বলার আছে কি?’

‘আমার বিশ্বাস আপনাদের যন্ত্রটিকে আমাদের কাজের উপযুক্ত করে তৈরি করে দিতে বেশি সময় লাগবে না। তার পরেই সংখ্যার বদলে অক্ষর-বিন্যাসের কাজটা শুরু হয়ে যেতে পারবে। আমার ধারণা, যে কাজটা আমাদের লাগত পনের হাজার বছর, সেটা যন্ত্রের সাহায্যে হয়ে যাবে একশ’ দিনে।’

ডাঃ ওয়াগনারের ঘরের খোলা জানালা দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের ট্রাফিকের মৃদুগুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সে শব্দ তাঁর কানে প্রবেশই করছে না। তাঁর মন এখন সম্পূর্ণ অন্য জগতে বিচরণ করছে। যেখানে গগনচুম্বী পাহাড়গুলি প্রকৃতির সৃষ্টি, মানুষের নয়। সেই পাহাড়ের চূড়োয় গুম্‌ফায় বসে এই তিব্বতী সাধকেরা যুগের পর যুগ ধরে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তাদের অর্থহীন তালিকা তৈরি করে যাচ্ছে। মানুষের পাগলামির কি কোনো সীমা নেই? যাই হোক, তাঁর মনের ভাব বাইরে প্রকাশ করা চলবে না। কথাই ত আছে—‘দ্য কাস্টমার ইজ নেভার রং।’

ডাঃ ওয়াগনার বললেন, ‘এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে আমাদের মার্ক-৪ কম্পিউটারকে আপনাদের কাজের উপযুক্ত করে তৈরি করে দিতে পারি আমরা। আমি এখন যে কথাটা ভেবে চিন্তিত হচ্ছি সেটা হল আপনাদের গুম্‌ফাতে যন্ত্রটিকে বসানো, চালানো এবং তার পরিচর্যা নিয়ে। ওটাকে তিব্বতে নিয়ে গিয়ে ফেলাটাও ত একটা দুরূহ কাজ।’

‘সে ব্যবস্থা আমরা করব। আপনাদের কম্পিউটারের অংশগুলো তেমন কিছু বড় নয়—যে কারণে আমরা আপনাদের মডেলটা বাছাই করেছি। ওটাকে একবার ভারতবর্ষে পৌঁছে দিতে পারলে বাকি পথটুকুর ব্যবস্থা আমরাই করব।’

‘আর আপনি বলছিলেন আমাদের এখান থেকে দুজন লোক নেবার কথা?’

‘হ্যাঁ। তিন মাসের জন্য। তার বেশি সময় নিশ্চয়ই লাগবে না।’

‘সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে’, বিষয়টা প্যাডে নোট করে নিয়ে বললেন ডাঃ ওয়াগনার। ‘অবিশ্যি আরো দুটো ব্যাপার—’

কথা শেষ করার আগেই লামা তাঁর আলখাল্লার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ওয়াগনারের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা হল এশিয়াটিক ব্যাঙ্কে আমার কত টাকা জমা আছে তার সার্টিফিকেট।’

‘ধন্যবাদ। হ্যাঁ—তা, এতে যথেষ্ট হবে বলেই মনে হয়। দ্বিতীয় ব্যাপারটা এতই মামুলি যে সেটা উল্লেখ করতেও আমার সঙ্কোচ হচ্ছে—অথচ না করলেও নয়। আপনাদের ইলেকট্রিসিটির কী ব্যবস্থা?’

‘১১০ ভোল্টে ৫০ কিলোওয়াট উৎপাদনকারী ডিজেল জেনারেটর। বছর পাঁচেক হল এটা বসানো হয়েছে এবং কাজ দিচ্ছে ভালোই। এটা আসার পর থেকে গুম্‌ফার জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়ে গেছে। অবিশ্যি ওটা আনার মূল উদ্দেশ্য ছিল বড় বড় জপ-যন্ত্রগুলোকে চালানো।’

‘তাতো বটেই’, বললেন ডাঃ ওয়াগনার। ‘এটা আমার অনুমান করা উচিত ছিল।’

গুম্‌ফার ছাতের বেঁটে পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে নিচের দিকে চাইলে প্রথমে মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঠিকই, কিন্তু ক্রমে সবই অভ্যাস হয়ে যায়। এই তিন মাসেও দু’হাজার ফুট নিচে খাদের দৃশ্য বা দূরে উপত্যকায় শস্য ক্ষেত্রের নানারকম জ্যামিতিক নক্‌শা জর্জ হ্যানলির মনকে নাড়া দিতে পারেনি। সে এখন ছাতের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দূরের পর্বতশৃঙ্গগুলোর দিকে চেয়ে আছে। সেগুলোর নাম জানার কোনো ঔৎসুক্য সে বোধ করেনি। এমন বেয়াড়া অবস্থায় তাকে কোনোদিন পড়তে হয়েছি কি? নিশ্চয়ই না। গত তিন মাস ধরে মার্ক-৫ কম্পিউটারে উদ্ভট অক্ষরে সমষ্টি ছাপা রোলের পর রোল কাগজ বেরিয়ে আসছে। অক্ষরগুলির যতরকম সম্ভাব্য বিন্যাস হতে পারে, যান্ত্রিক টাইপরাইটার তার প্রত্যেকটি ছেপে চলেছে অক্লান্তভাবে। কাগজের রোল বেরোনর সঙ্গে সঙ্গে লামারা প্রত্যেকটি শব্দ কাঁচি দিয়ে কেটে সেগুলোকে বিরাট বিরাট খাতায় সযত্নে সেঁটে ফেলছে। আর এক সপ্তাহে কাজ শেষ হবার কথা। কোন হিসাবের ভিত্তিতে যে এরা কথাগুলোকে ন-অক্ষরে সীমাবদ্ধ রেখেছে তার রহস্য জর্জ হ্যানলির অজানা। একটা আশঙ্কা মাঝে মাঝে হ্যানলির বুক কাঁপিয়ে দেয় সেটা হল এই যে, লামারা হয়ত হঠাৎ একদিন স্থির করবে যে কাজটা ২০৬০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত চালানো দরকার। এদের পক্ষে সবই সম্ভব।

একটা ভারী কাঠের দরজা খোলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে চাক্ ছাতে এসে জর্জের পাশে দাঁড়ালো। চাকের মুখে চুরুট—যে চুরুট লামাদের ভারী প্রিয় হয়ে উঠেছে। ধর্মযাজক হলেও এরা অল্পবিস্তর ফুর্তির স্বাদ গ্রহণ করতে বিমুখ নয়। এরা ছিটগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু গোঁড়া নয়।

চাক্ এসেছে একটা জরুরী বক্তব্য নিয়ে।— ‘যা শুনেছি জর্জ, তাতে কিন্তু ব্যাপার গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে।’

‘কী শুনছ? যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে না?’ জর্জের মতে এর চেয়ে বেশি গোলমেলে আর কিছু হতে পারে না। যন্ত্রের গণ্ডগোল হলে তাদের যাওয়া পিছিয়ে যেতে পারে আর সেটাই হবে চরম বিপর্যয়। ইদানীং টেলিভিশনের রদ্দিমার্কা বিজ্ঞাপনের ছবিগুলোর কথা ভেবেও জর্জের মন কেমন করে, কারণ সেগুলোও তো দেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

‘না না’, বলল চাক্, ‘সেধরনের গোলমাল নয়।’ চাক্ সাধারণতঃ ছাদের পাঁচিলে বসে না কারণ তাতে তার বুক ধড়ফড় করে, কিন্তু আজ ও সেখানেই বসে বলল, ‘আমি আসল ব্যাপারটা জেনে ফেলেছি।’

‘তার মানে? ব্যাপার ত সবই আমাদের জানা।’

‘আমরা যেটা জানি সেটা হল লামারা কী করতে যাচ্ছে; কিন্তু কেন করতে যাচ্ছে সেটা ত জানতাম না। এখন সেটা জেনেছি, এবং সে এক অভাবনীয় ব্যাপার।’

‘তোমার ও-সব বাজে কথা ছাড় ত।’

‘কিন্তু লামা যে আমায় নিজে বলেছেন। তুমি ত জান উনি রোজ এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কম্পিউটার থেকে টাইপ করা কাগজের রোল বেরিয়ে আসা দেখেন। আজও এসেছিলেন এবং আজ কেন জানি অন্যদিনের তুলনায় ওঁকে একটু বেশি উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছিল। আমি যখন বললাম যে আমাদের কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে, উনি আমাকে তাঁর অদ্ভুত ইংরিজি উচ্চারণে জিগ্যেস করলেন আমরা কোনোদিন এই কাজটার পিছনে আসল উদ্দেশ্যটা সম্বন্ধে কিছু অনুমান করেছি কিনা। আমি বললাম—সেরকম উদ্দেশ্য কিছু আছে নাকি? তখন ভদ্রলোক ব্যাপারটা বললেন।’

‘কী বললেন?’

‘এরা বিশ্বাস করেন যে যখন ঈশ্বরের নামের তালিকা তৈরি হয়ে যাবে—এঁদের মতে নামের সংখ্যা হচ্ছে নয় লক্ষ কোটি—তখন ঈশ্বরের কাজও ফুরিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল যে কাজ করার জন্য, তাও শেষ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়—এরপরে মানুষের পক্ষে কিছু করতে যাওয়াটাই হবে ঈশ্বরবিরোধী কাজ।’

‘তাহলে আমরা এখন করছিটা কী? আত্মহত্যা?’

‘সেটার প্রয়োজন কোথায়? তালিকা শেষ হলে পর ঈশ্বর নিজেই যা করার করবেন। অর্থাৎ—খেল খতম!’

‘বুঝলাম। আমাদের কাজ শেষ হওয়া মানে পৃথিবীর কাজও খতম।’

চাক্ একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, ‘আমি ঠিক সেই কথাটাই বলেছিলাম লামাকে। কিন্তু তার ফল কী হল জান? উনি আমার দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে বললেন—‘ব্যাপারটাকে অত হালকাভাবে নিও না।’

জর্জ একটুক্ষণ চিন্তিতভাবে চুপ করে থেকে বলল, ‘কিন্তু এ ব্যাপারে কী করা উচিত সেটা ত বুঝতে পারছি না। অবিশ্যি সেরকম দেখতে গেলে যাই করি না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। এরা যে বদ্ধ পাগল সে ত জানাই আছে।’

‘কিন্তু একটা জিনিস ভেবে দেখ জর্জ—তালিকা শেষ হবার পর যদি কিছু না ঘটে, পৃথিবী যেমন আছে তেমনি থেকে যায়, তাহলে দোষটা আমাদের ঘাড়ে পড়বে না ত? আমাদেরই যন্ত্র ত কাজটা করছে। ব্যপারটা আমার কাছে মোটেই ভালো লাগছে না।’

‘কথাটা খুব ভুল বল নি’, জর্জ গম্ভীরভাবে মন্তব্য করল। ‘কিন্তু এ ধরনের ব্যাপার ত আগেও ঘটেছে। লুইসিয়্যানায় আমার ছেলেবেলায় এক ছিটগ্রস্ত পাদরী হঠাৎ একদিন বলে বসলেন—আসছে রবিবার পৃথিবীর শেষ দিন। বহু লোক তাঁর কথা বিশ্বাস করল। এমন কি সেই বিশ্বাসে তাদের ঘরবাড়ি সব বিক্রি করে দিল। শেষটায় যখন কিছুই হল না, তখন কিন্তু তারা এই নিয়ে কোনোরকম মাতামাতি করল না। তারা ধরে নিল পাদ্রীর হিসেবে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। আসলে ঘটনাটা ঘটবে ঠিকই, কিন্তু পরে।’

‘যাই হোক, এটা যে লুইসিয়্যানা নয় সে খেয়াল আশা করি তোমার আছে। এখানে কেবল আমরা দুজন শ্বেতাঙ্গ, বাকি হল তিব্বতী সাধকদের বিরাট দল। এরা লোক ভালোই এবং সত্যিই যদি লামার ভবিষ্যদ্বাণী না ফলে, তাহলে আমার ওঁর জন্য একটু কষ্টই হবে। কিন্তু তাও বলছি, এ সময়টা এখানে না থেকে অন্য কোথাও থাকলে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করতাম।’

‘সে কথাটা আমার কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমরা যে চুক্তি সই করেছি। আর আমাদের ফেরত যাবার প্লেন না আসা পর্যন্ত ত আমরা কিছুই করতে পারছি না।’

চাক্ চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর প্রায় আপনমনেই বলল, ‘অবিশ্যি আমরা ব্যাপারটা ভণ্ডুল করে দিতে পারি।’

‘খেপেছ? ওতে আরো বিপদ।’

‘আমি যেভাবে ভাবছি তাতে বিপদ নেই। শোন! মেশিন চলবে আর চারদিন—দিনে চব্বিশঘণ্টা করে। আমাদের প্লেন আসবে একহপ্তা পরে। বেশ। এখন ধর যদি এর মধ্যে যন্ত্রে কোনো গণ্ডগোল হয়, দুদিন কাজ বন্ধ থাকে। গণ্ডগোল আমরা শুধরিয়ে দেবো ঠিকই; কিন্তু সেটা করব একেবারে শেষ মুহূর্তে। আমরাও প্লেনে উঠব, আর ঈশ্বরের শেষ নামটিও উঠবে তালিকায়। তখন আমরা লামাদের আওতার বাইরে।

‘ব্যাপারটা আমার মনঃপূত হচ্ছে না’, মাথা নেড়ে বলল জর্জ। ‘এ ধরনের কারচুপি আমার ধাতে নেই ভায়া। তাছাড়া এতে ওদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। নাঃ, যেমন চলছে চলুক, তাতে যা হবার হবে।’

সাতদিন পরে খচ্চরের পিঠে চড়ে প্যাঁচানো রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জর্জ বলল, ‘আমার এখনও ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। এটা ভেব না যে আমি ভয় পেয়েছি বলে পালাচ্ছি। আমার ওই বুড়ো লামাগুলোর জন্য মমতা হচ্ছে। তারা যখন দেখবে যে তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ফলল না, তখন তাদের অবস্থা কী হয় সেটা আমি দেখতে চাই না। আর আমাদের হেড লামার যে কী প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে।’

চাক্ বলল, ‘আশ্চর্য!—ওঁকে যখন গুডবাই করলাম, তখন কেন জানি মনে হল যে উনি আমাদের মনের কথা সব জানেন, কিন্তু তাই নিয়ে কোনো উদ্বেগ বোধ করছেন না, কারণ মেশিন আবার ঠিকমতো চলছে, আর কাজও অল্পক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর—অবিশ্যি ওঁর মতে তারপর বলে আর কিছু নেই।’

জর্জ ঘোড়ার পিঠে উল্টোমুখে ঘুরে পাহাড়ের দিকে চাইল। এরপরে মোড় ঘুরে আর গুম্‌ফাটাকে দেখা যাবে না। সূর্যাস্ত হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আকাশের শেষ রঙের সামনে বিরাটাকৃতি গুম্‌ফাটাকে দেখা যাচ্ছে। কালো প্রাসাদের গায়ে এখানে সেখানে জানালার ভিতরে আলো, যেমন দেখা যায় সমুদ্রগামী জাহাজের গায়ে পোর্টহোলের ভিতরে। ওগুলো সবই জেনারেটার চালিত বৈদ্যুতিক আলো, এবং একই জেনারেটারে চলছে কম্পিউটার। আর কতক্ষণ চলবে যন্ত্র? ভবিষ্যদ্বাণী না ফললে লামারা কি তাদের আক্রোশ প্রকাশ করবে ওই যন্ত্রকে ধ্বংস করে? নাকি তারা আবার নিরুদ্বেগে শুরু করবে তাদের হিসাব?

গুম্‌ফায় ঠিক এই মুহূর্তে কী হচ্ছে সেটা অবিশ্যি জর্জের জানতে বাকি নেই। লামাপ্রবর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে যন্ত্রটার কাছে বসে আছেন। অপেক্ষাকৃত কম-বয়স্করা তাঁদের সামনে এনে হাজির করছে যন্ত্র থেকে নতুন বেরিয়ে আসা নামের তালিকা। লামারা নামগুলোর উপর চোখ বোলাচ্ছেন, তারপর সেগুলো কেটে কেটে খাতায় সেঁটে ফেলছেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই, একমাত্র শব্দ হচ্ছে যান্ত্রিক টাইপ-রাইটারের, কারণ মার্ক-৫ কম্পিউটার প্রতি সেকেণ্ডে হাজার হিসেবের কাজ করে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে। জর্জ ও চাক্ তিন মাস ধরে এই কাজ দেখেছে। তাদের যে মাথা খারাপ হয়ে যায়নি এটা পরম ভাগ্যি।

‘ওই দেখ’, বলে উঠল চাক্ সামনের উপত্যকার দিকে হাত বাড়িয়ে। ‘আহা, কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে বল ত।’

জর্জ মনে মনে ভাবল—সত্যিই সুন্দর। পুরোন ডিসি থ্রী বিমানটা রানওয়ের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি রূপালি ক্রুশের মতো। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ওদের দুজনকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে সভ্য জগতে, যেখানে তারা পাবে মুক্তি। উৎকৃষ্ট সুরাপানে যে আনন্দ হয়, চিন্তাটা মাথায় আসতে জর্জ সেই আনন্দ অনুভব করল।

হিমালয়ের হঠাৎ-রাত্রি এখনই তাদের গ্রাস করবে। তবে সৌভাগ্যক্রমে রাস্তা ভালো, আর দুজনের কাছেই রয়েছে টর্চ। একমাত্র যদি না শীত হঠাৎ বেড়ে গিয়ে অস্বস্তির কোনো কারণ ঘটায়, এ ছাড়া কোনো চিন্তা নেই। মাথার উপরে মেঘমুক্ত আকাশে অগণিত অতি পরিচিত নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। জর্জের একমাত্র দুশ্চিন্তা ছিল যে প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য হয়ত প্লেন না উড়তে পারে; কিন্তু এখন সে দুশ্চিন্তাও দূর হয়েছে।

জর্জের গলা দিয়ে গান বেরিয়ে এল; তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। পর্বত পরিবেষ্টিত এই বিশাল প্রান্তরে গানটা যেন কিঞ্চিৎ বেমানান। সে রিস্টওয়াচের দিকে চাইল।

‘আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া উচিত’, সে চেঁচিয়ে জানালেন পিছনে চাক্-এর উদ্দেশে। তারপর আরো কতগুলো কথা সে জুড়ে দিল। ‘কম্পিউটারের কাজ শেষ হল কিনা কে জানে। এখনই ত হবার কথা।’

চাক্-এর কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে জর্জ উল্টোমুখে ঘুরল। সে দেখল ঘোড়ার পিঠে চাক্‌কে—তার দৃষ্টি আকাশের দিকে।

‘ওপরে চেয়ে দেখ’, বলল চাক্।

জর্জ চাইল—হয়ত শেষবারের মতো।

মাথার উপরে সন্ধ্যার আকাশ থেকে নির্বিবাদে একটি একটি করে তারা মুছে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *