ঈশ্বরের ডাইরি – ১

আলোর টুকরো আজ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে! আর তার মাঝে ও শুনল, ‘না, তুমি এমন কথা বলবে না আমায়! কোনওদিনও বলবে না! আমি অন্য একজনকে ভালবাসি! তুমি আমার কেউ নও! কোনও অধিকার নেই তোমার! দূরে থাকবে, তুমি দূরে থাকবে আমার থেকে। বুঝেছ!’

ও শুধু তাকাল মুখ তুলে! মনে হল আকাশ থেকে হাজার হাজার মৃত পাখির পালক ঝড়ে পড়ছে সামনে! আর তার মধ্যে দিয়ে ওর চলে যাওয়ার পথটুকুই আজ স্পষ্ট হয়ে আছে কেবল! ওর মনে হল আজ থেকে ওর জীবনে চলে যাওয়াটুকুই থাকবে শুধু, ফিরে আসা বলে কিছু থাকবে না কোনওদিন!

ও মাথা নিচু করল। তারপর আলোছায়া পেরিয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল মনমরা গলিটার বাঁকে। না, পেছনে ফিরে তাকাল না একবারও।

ঈশ্বরের ডাইরি – ১

আমি জানি একদিন সে আসবে। জানি তার আসার পথে যে কলকাতা নামক শহরটা পড়ে সেখানে পাহাড় থাকবে একটা। তাতে উঠে মাঝে মাঝে অন্ধ বোষ্টম দাদু পতাকা নাড়াবে। আমি জানি একদিন সেই পাহাড়ের মাথায় প্রচুর কাক জড়ো হয়ে পুচ পুচ করে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হাগু করবে। আমি জানি একদিন আমাদের বাড়িতে রাখা কামানটা দিয়ে আমি সেই সব মুনাফাখোর কাকেদের মেরে ক্রান্তি আনব। আমি জানি একদিন সেই আনন্দে মনুমেন্ট খুলে মাটিতে শুইয়ে সেটা দিয়ে ময়দানের মতো একটা বিরাট রুটি বেলা হবে! আর সেই রুটির টুকরো ছড়িয়ে নতুন করে ডেকে আনা হবে আরও নানান রকমের আধ ঢ্যামনা, ফুল ঢ্যামনা কাকেদের! আর জানি এই এসব দেখে একদিন আমি আবার অসুখ থেকে সেরে উঠে সবার মতো ডিপ্রেশানে ভুগতে শুরু করব! আমি জানি একদিন আমাকেও আমার মাইনে দিয়ে মাপা হবে! আমাকে আমার সেলফি দিয়ে পছন্দ করা হবে! জানি, জন্মদিনের বেলুন কিনতে গিয়ে আমি কিনে আনব ডটেড আর রিবড! নিজের প্রেমিকাকে বিক্রি করে দেব উন্নতি আর লোভের কাছে। আমি জানি তার পরের দিন আমি মানুষ হয়ে উঠে ইঁদুরের মতো দৌড়তে শুরু করব আবার! আবার আমি কিছু না করেও অন্যের পরিশ্রমের কাজে হাফ-পন্ডিতি আঙুল খুঁচিয়ে নিজেকে কয়েক মিনিটের জন্য বিখ্যাত আর শব্দ করে তুলব! আমি জানি তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ব আর জেগে উঠে দেখব টিভি সিরিয়ালের মতো সবার হাসিকান্নারাগকষ্টবমিপায়খানার পেছনে মিউজিক বেজে উঠছে আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে! আমি জানি একদিন আমিও জানব কী করতে নেই! তবু ভালমানুষের মতো মুখ করে সেটাই করে যাব রোজ! আমি জানি একদিন আমিও পা চাটব চালাক লোকেদের মতো। রাজা-উজির মারব ছদ্ম-মেধাবীদের মতো! একদিন আমিও ভাল হয়ে উঠে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বুড়ো আঙুলের জোরে বিপ্লব আনব দেশে! আমিও একদিন অন্যের মাংস খেয়ে ঢেকুর তুলব! তারপর আচমকা একদিন ভোরবেলা উঠে বুঝব আসলে এখানে রাত্রি চলছে কুড়ি হাজার বছর ধরে! বুঝব মা, বাবা, ভাই, বোন, প্রেমিকা, প্রেমিক আসলে কেউ হয় না আমাদের! বুঝব সবাই আমরা মৃত এক অ্যালব্যাট্রস পাখি গলায় ঝুলিয়ে ঘুরছি! যে আমায় বাঁচিয়েছে আমরা তাকে হত্যা করে সেই দোষে আটকে আছি পৃথিবী নামক তেল-সাগরে ভেসে থাকা এক জাহাজে! আর তবু আমি বিশ্বাস রাখব যে একদিন সে আসবে! বিশ্বাস রাখব, সে আমাদের এই জোড়াতাপ্পি দেওয়া জাহাজটাকে আবার পথ দেখিয়ে এই গোলকধাঁধা থেকে বের করে নিয়ে যাবে নতুন এক ভোরবেলার শহরে!

১ আদিত

আজও রাস্তার পাশে ঈশ্বরকে বসে থাকতে দেখল আদিত। ঈশ্বর বেশ লম্বা। ভারি চেহারা। জামা কাপড় হাকুচ কালো। এক মাথা এলোমেলো চুল। বড় দাড়ি। চামড়াতেও ম্যাপের মতো ছোপ ছোপ ময়লার দাগ। কিন্তু যখনই ঈশ্বরকে চোখে পড়ে আদিতের, ও দেখে একটা খাতায় উপুড় হয়ে কীসব যেন লিখছে ও! অবাক লাগে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা পাগল কী লেখে এত! কে ওকে এমন খাতা কিনে দেয়! এমন পেন কিনে দেয়!

ওকে দেখে আদিতের কেমন একটা হিংসে আর হীনমন্যতা আসে। এত শব্দ আর হইচইয়ের মধ্যে কী করে একটা পাগল নিজেকে এক বিন্দুতে এমন করে ধরে রাখে! আদিত পারে না কেন এমন? কেন বারবার বাঁধন খুলে যাওয়া ঝাঁটার মতো ছড়িয়ে পড়ে ওর মন! কী আছে পাগলটার মধ্যে যা ওর নেই!

লেক গার্ডেন্স স্টেশনে আপ বজবজ লোকাল ঢুকছে। লেভেল ক্রসিং পড়ে আছে। কিন্তু আদিত কখনও লেভেল ক্রসিঙের তলা দিয়ে গলে যায় না। এমন কী পাশ দিয়েও যায় না! ও অপেক্ষা করে গেটের সামনে। যতক্ষণ না গেট খোলে ও রেল লাইন পার হয় না!

ওকে এমন করতে দেখে মাকু খুব হাসে। বলে, ‘শালা তুই নিয়ম মানার জন্য নোবেল প্রাইজ পাবি! অস্কারও পেতে পারিস!’

আদিত বিরক্ত হয় মাকুর কথায়। বলে, ‘দেশটা কার? কার এই দেশ? আমাদের না? এই নিয়মগুলো করা হয়েছে কেন? মানার জন্য তো নাকি? সবাই বলবে দেশের কিছু হচ্ছে না, কারও কিছু হচ্ছে না, কিন্তু কেউ শালা নিয়মকানুন কিছু মানবে না। সবাই নিয়ম ফোটায়, কিন্তু অন্যের জন্য! সবাই এমন করলে দেশটা চলবে?’

মাকু তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তারপর কিছু সময় পরে বলে, ‘ছোটবেলায় মাথায় চোট পেয়েছিলি? নাকি কোনও পার্ভার্ট কাকু তোকে ইয়ে করেছিল? বিয়ন্ড রিপেয়ার এমন চু… মানে ঘেঁটে গেলি কী করে বলত?’

ট্রেনটা স্টেশানে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা হুইসল দিল! আদিতের মনে হল কেউ যেন সরু লোহার শলাকা কানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে! তীব্র শব্দ একদম সহ্য করতে পারে না আদিত! আচ্ছা পাশেই এত বড় লেক। এত সব গাছ। এত এত পাখি আছে তাতে, সেই সব তুলো বলের মতো এক ফোঁটা দুই ফোঁটা পাখির বাচ্চাদের কতটা কষ্ট হয় এমন শব্দে! মনে মনে যেন কষ্টে কুঁকড়ে যাওয়া পাখির বাচ্চাদের দেখতে পায় আদিত। কেমন একটা কষ্ট হয় ওর! আর এক ঝলকে ওর মনে পড়ে যায় স্মাহির কথা!

স্মাহিদের বাড়িতে কত্ত পাখি ছিল! ওর জেঠুর পাখির শখ ছিল খুব। বিরাট লম্বা বারান্দার এক পাশে তারের জাল দিয়ে ঘেরা বিশাল একটা খাঁচা ছিল পাখির! কত রকমের রঙবেরঙের পাখি ছিল সেই খাঁচায়!

খাঁচার লোহার জাল ধরে দাঁড়িয়ে পাখিদের দিকে তাকিয়ে থাকত আদিত! কী ভাল যে লাগত! মনে হত এত রঙ কী করে এল পৃথিবীতে!

মাঝে মাঝে স্মাহি এসে দাঁড়াত ওর পাশে। পাখিদের নাম বলে দিত ওকে। বলে দিত কোন পাখি কোন অঞ্চলের। কী খায়! কেমন করে বাসা বানায়!

একবার আদিত জিজ্ঞেস করেছিল, ‘পাখিদের বাসা কেন বলে? পাখিদের বাড়ি কেন বলে না?’

স্মাহি হেসেছিল। কী সুন্দর মুক্তোর মতো দাঁত ছিল স্মাহির! ছোট্ট মুকুট কপাল। নাকের দুই পাশে ছোট্ট দুটো তিল! থুতনিতে আলতো একটা টোল! রঙ্গন ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁটের ওপর আলতো একটা কাটা দাগ! স্মাহি হাসলে আদিতের মনে হত কে যেন হাজার হাজার আয়না ছড়িয়ে দিয়েছে চারিদিকে! মনে হত বাতাসে অক্সিজেন বেড়ে গেল! মনে হত সিংহের মতো হলুদ কেশর নাড়িয়ে আকাশে উঠে দাঁড়াল সূর্য!

সেই অদ্ভুত হাসি নিয়ে আদিতের দিকে তাকিয়েছিল স্মাহি। নিচু শান্ত গলায় বলেছিল, ‘পাখিদের মতো ভালবাসা আর কজন দিতে পারে! তাই হয়তো ওদের বাসস্থানকে বাসা বলে। আর মানুষরা অমন পারে না, তাই তাদের হল বাড়ি!’ কথা শেষ করে মাথা নামিয়ে নিয়েছিল স্মাহি।

আদিতির ইচ্ছে করেছিল স্মাহির অদ্ভুত সুন্দর আঙুলগুলো একবার ও ধরে আলতো করে। আর বলে, ‘আমাদের বাসস্থানকেও বাসা বলা হবে। দেখো!’

ঘটাঘট ঘটাঘট শব্দে ট্রেনটা সামনে দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল শিয়ালদার দিকে। স্মৃতির পাতলা কাচটা আলতো করে ভেঙে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়!

‘কীরে? রাজুদার বাড়িতে যাচ্ছিস?’ পাশের থেকে মাকুর গলা পেয়ে তাকাল আদিত।

দেখল, সকাল সকাল লাল জামা, লাল সোয়েটার আর সবুজ প্যান্ট পরে ফিটবাবু হয়ে এসে পড়েছে মাকু। মুখে হাসি। পানের রসে লাল হয়ে যাওয়া দাঁতগুলো ম্যাচ করে গেছে জামার সঙ্গে! কটা চোখ চঞ্চলভাবে ঘুরছে!

আদিত হাসল। মাকু ছেলেটা ভাল। একটু বেশি বকে, কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই! আসল তো মন। সেদিক থেকে ছেলেটা সহজ সরল।

‘নে এবার যাবি তো?’ মাকু পাশের থেকে খোঁচা দিলে ওকে।

ট্রেন চলে যাওয়ার পরে কেমন ফুলস্টপের মতো মানুষজন ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এখানেও মানুষ লাইন পার হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তাঘাটে।

সামনের লেভেল ক্রসিঙের গেট উঠে গেছে। মানুষজন তড়বড় করে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। এদিক দিয়ে আর গাড়ি যায় না। লেক গার্ডেন্স ওভার ব্রিজ হয়ে যাওয়ায় ব্রিজ পেরিয়ে সব চলে যায় আজকাল।

সাবধানে লাইন পার করে অন্যদিকে গেল আদিত আর মাকু।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই কলকাতায় শীত পড়ে গেছে বেশ। সকালের দিকে একটা হালকা ওড়নার মতো ঝিরঝিরে কুয়াশা এসে জড়িয়ে থাকে শহরের চোখে মুখে। বেশ ভাল লাগে আদিতের। মনে হয়, কোনও পাহাড়ে ঘুরতে এসেছে!

পাহাড়ে যেতে খুব ইচ্ছে করে ওর। ছোটোবেলা একবার পাহাড়ে গিয়েছিল আদিত। বাবা তখন সুস্থ ছিল। ওদের বাড়িটা কী হাসিখুশি আর আনন্দের ছিল! বাবা আর মায়ের হাত ধরে কার্শিয়াঙ শহরের উঁচু নিচু রাস্তায় ঘুরেছিল আদিত। রঙিন টয় ট্রেন স্টেশানটা কী ভাল লেগেছিল! কেমন ছোট্ট শহরের মধ্যে দিয়ে ঝিকঝিক করে যেত সেই ট্রেন! কাঠের স্টেশানের মাথায় জড়িয়ে থাকত মেঘ! পুরোনো অভিমানী ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে থাকত স্টেশানের এক কোণে!

সেই বয়সে আদিতের মনে হত বড় হয়ে ও টয় ট্রেনের ড্রাইভার হবে! রোজ পাহাড়ের পাকদন্ডি বেয়ে উঠে যাবে মেঘেদের ওপরে! ঝাউ, পাইন আর পপলার গাছের ফাঁক দিয়ে দেখবে কীভাবে সূর্য ঘুরে যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর দিয়ে অন্য কোনো অজানা পাহাড়ের মাথায়!

আজ এতদিন পরে আদিতের মনে হয় সেসব আসলে বিগত জন্মের স্মৃতি। মনে হয় আসলে ও জাতিস্মর! এক সকালে ঘুম থেকে উঠে যেন অন্য জন্মের সেইসব কিছু হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছে ওর!

কলকাতায় কাকুলিয়া রোডের এক তস্য গলিতে থাকে আদিত। সেখানে অসুস্থ বাবা আর ভাঙা টেরাকোটার মতো মাকে নিয়ে ওর মনখারাপের সংসার। কখনও কখনও রাতে নিজের ঘরে শুতে গিয়ে ওর মনে হয়, এই জীবনটা ফালতুই কেটে গেল! কিছুই ঠিকভাবে করা হল না।

চাকরি একটা করত আদিত। একটা খবরের কাগজে সাব এডিটারের কাজ করত ও। বর্ধমানে পোস্টিং ছিল। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেখেছিল, রাজনীতিটা করতে পারছে না! কোনও কিছুই অর্ধেক বা ভাঙাভাবে করতে পারে না আদিত। মনে হয় ও অন্যকে ঠকাচ্ছে! তাই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল।

রাজুদা বকেছিল খুব। বলেছিল, ‘শালা গাধা নাকি তুই? পাচ্ছিলি কুড়ি হাজার টাকা। এখন কী করবি? ফালতু সেন্টি হয়ে যাস কেন বল তো? কেন ছাড়লি চাকরি?’

রাজুদার কথায় কিছু মনে করে না আদিত। রাজুদাকে ও নিজের দাদার মতোই দেখে! এই যে ও রাজনীতি করে সেটা তো রাজুদার জন্যই। সেই কলেজ লাইফ থেকে দেখে আসছে পার্টির জন্য রাজুদার কী ডেডিকেশান! আর গত আট বছরে উঠতে উঠতে রাজুদা এখন এম.এল.এ.! ওরা শুনছে সামনের বার নাকি মন্ত্রীও হতে পারে। আজকাল মাঝে মাঝেই রাজুদার ছবি দেখা যায় খবর কাগজে!

বুদ্ধিমান, সৎ আর পরিষ্কার মনের মানুষের খুব দরকার এই দেশের। নিজেরটা গোছানো পাবলিকে চারিদিকটা থিকথিক করছে! তাই রাজুদাকে অনুসরণ করে আদিত। ওর কথা শুনলে আদিতের মনে হয় এখনও কিছুটা হলেও আশা আছে!

এ ছাড়া রাজুদা মাস গেলে ওকে সাত হাজার টাকা মতো দেয়। কিন্তু ও জানে সেটা যথেষ্ট নয়। মা তো প্রায়ই বলে, ‘এইভাবে সারা জীবন কাটবে? সাতাশ হল। এখনও সিরিয়াস হলি না? হিস্ট্রিতে এম.এ. করলি, সেটা এমন বেকার যাবে!’

আচ্ছা, অনেক টাকা রোজগার করাই বুঝি সিরিয়াসনেস? দেশের কাজ, দশের কাজ করাটা কিছু না? সবাই যদি নিজের কথা ভাবে তাহলে দেশের কথা কে ভাববে?

তবে মায়ের উদ্বেগের কারণটা বুঝতে পারে আদিত। বাবার জন্য মাসে হাজার সাত আটেক টাকা খরচ হয়ে যায়। তারওপর ওদের নিজেদের বাড়িটা বন্ধক রাখা আছে অনাদি সরখেলের কাছে। মাসে মাসে তাকেও হাজার চারেক করে দিতে হয়!

রাজুদার থেকে হাত পেতে টাকা নিতে ইচ্ছে করে না আদিতের। কিন্তু ওর জীবন ওকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসে ফেলেছে যে বাস্তবটাকে অস্বীকারও করতে পারে না! কিন্তু প্রতিবার হাত পেতে টাকা নেবার সময় একটু একটু করে যেন মরে যায় ও।

রাজুদা বোঝে। ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘আমার থেকেই তো নিচ্ছিস! তাও সংকোচ? ঠিক আছে একদিন সব উশুল করে নেব!’

‘কীরে, তখন থেকে সাইলেন্স মেরে আছিস? কোনও কেস করেছিস নাকি?’

মাকুর কথায় ওর দিকে তাকাল আদিত। ক্লাস ইলেভেন অবধি পড়েছে মাকু। তারপর আর ইচ্ছে করেনি। ও বলে, ‘শালা বাবরের ছেলের নাম জেনে আমার কী হবে? রাশিয়ার কোন কয়লা খনিতে কয়লা পাওয়া যায় সেটাই বা জেনে আমি কী ছিঁড়ব? পড়াশুনো হল ঢপবাজি! ওসবে আমি নেই।’

আদিত ওর সঙ্গে বিশেষ মুখ লাগায় না। জানে লাভ নেই।

মাকুদের বাড়িটা ঢাকুরিয়ায়। ওরা তিন ভাই। মাকু সবার ছোট। কিছুই বিশেষ করে না। তাই ওর বাবা মা আদিতকে বলে রাজুদাকে বলে কোনও কাজে ঢুকিয়ে দিতে।

কিন্তু এসব কথা রাজুদাকে বলে না আদিত! ক্ষমতাবান লোক দেখলেই লোকে হাত বাড়িয়ে ভিক্ষে করা শুরু করে! এসবে গা ঘিনঘিন করে ওর!

তবে কয়েক দিন হল মাকু ওর সঙ্গে আসছে রাজুদার বাড়ি। কিছুই না, এমনিই আসছে। রাজুদা দেখছে সব। কিন্তু এখনও বলছে না কিছু।

আজ রাজুদা বিশেষ দরকারে ডেকেছে আদিতকে। কাল রাতে ফোন করে যখন রাজুদা ওকে যেতে বলছিল, মাকুও সামনে ছিল। ব্যাস পাগলটা চলে এসেছে!

স্টেশান পার করে লর্ডসের মোড়ের দিকের রাস্তাটায় পা বাড়াল আদিত। আর তখনই দেখল লোকটাকে। বেশ লম্বা। কাঁচা পাকা কোঁকড়া চুল। টানা ঝুলপি। চোখে রিমলেস চশমা। গায়ের রঙে কেমন যেন গোলাপি আভা! একটা মেরুন রঙের হুডি আর কারগো প্যান্ট পরে লোকটা নিজের মনে হেঁটে চলে গেল। সপ্তাহ দুয়েক হল লোকটাকে দেখছে আদিত। এমন লম্বা, সুন্দর দেখতে একটা লোক রাস্তা দিয়ে গেলে চোখে তো পড়বেই! কত বয়স হবে লোকটার! পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ! লোকটার হেঁটে যাওয়া দেখলে অদ্ভুত লাগে আদিতের। ওর মনে হয় লোকটা যেন এখানে থেকেও এখানে নেই!

মাকু চাপা গলায় বলল, ‘শালা বিলিতি মাল খাওয়া চেহারা। দেখেছিস, কেমন লালটুস আছে? বিলিতি পেট্রোলে এসব গাড়ি চলে!’

মাকু মদ খায়। এটা পছন্দ করে না আদিত। কিন্তু একটা সীমার পরে তো আর অন্যের ব্যাপারে কথা বলা যায় না। তাই কিছু বলে না।

মাকু আবার বলল, ‘বাংলা খেয়ে খেয়ে জিভের সেন্স হারিয়ে যাচ্ছে। একদিন আমিও বিলিতি খাব।’

আদিত বলল, ‘তোর সেন্স কি ছিল কোনওদিন?’

মাকু হাসল, ‘আমার প্রচুর সেন্স! একদিন বুঝতে পারবি।’

দূর থেকে রাজুদার বাড়িটা দেখতে পেল আদিত। এই সকাল নটাতেও লোকজন দাঁড়িয়ে আছে সামনে। সব মোসাহেব আর ধান্দাবাজের দল! দেখলেই শরীর জ্বলে যায় ওর! তাদের মধ্যে রাজুদাকেও দেখতে পেল ও। স্নান-টান সেরে পাট-পাট করে আঁচড়ানো চুল। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি আর হাত-কাটা কোট!

আরে, রাজুদা যে বলল থাকবে সকালে! তাহলে এখন আবার কোথায় বেরচ্ছে! ও কি দেরি করে ফেলল!

মাকু বলল, ‘ওই তো রাজুদা জার্সি পরে রেডি!’

‘জার্সি?’ আদিত ভুরু কুঁচকে তাকাল মাকুর দিকে।

‘ম্যাক্সিমাম নেতারাই দেখি এমন জামা কাপড় পরে! আমার তো মনে হয় পলিটিক্স করলে এই জার্সিটা পরতে হয়! কোনওদিন থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর কোটেশান লেখা টি-শার্ট পরা কোনও নেতাকে দেখেছিস কাজে যাচ্ছে?’

আদিত বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুই এইসব ভাট বকা বন্ধ করবি? রাজুদার সামনে একটাও ফালতু কথা বলবি না কিন্তু!’

মাকু হিহি করে লালচে দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল, ‘আলিয়া ভাট-ই একমাত্র সঠিক ভাট, নারে?’

রাজুদা দূর থেকে আদিতকে দেখে নিজেই স্তাবকদের জটলার ব্যূহ ভেঙে বেরিয়ে এল। তারপর চোখের ইশারায় আদিতকে একা আসতে বলল এক কোণায়।

মাকু ওসব ইশারা-টিশারা বোঝে না। বুঝতেও চায় না। আদিতের পেছন পেছন ও নিজেও এগোল।

রাজুদা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুই আসছিস কেন? তোকে ডেকেছি?’

মাকু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘ও প্রাইভেট কথা? কোনও কেস-ফেস হয়েছে নাকি?’

আদিত মাকুর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রাজুদার সঙ্গে রাস্তার এক পাশে সরে গেল।

রাজুদা নিচু গলায় বলল, ‘শোন, একটা ঝামেলা হয়েছে আমাদের দলেরই মধ্যে। সেই জন্য হাই কম্যান্ড থেকে ডেকে পাঠিয়েছে আমায়। তোর সঙ্গে ডিটেলে তাই কথা বলতে পারছি না। শুধু এটকু বলছি, আমার কন্সটিটিউয়েন্সিতে একটা ঝামেলা হয়েছে। রাবার ফ্যাক্টরি আছে একটা। সেখানে দু’মাস হল মাইনে দিচ্ছে না ওরা লেবারদের। সেই নিয়ে ক’দিন হল একটা গোলমাল চলছে। তুই ওখানে যাবি। ইউনিয়ান লোকদের সঙ্গে কথা বলবি। মালিক পক্ষের সঙ্গেও পারলে কথা বলবি আমার নাম করে। তবে নিজে ডিসিশান নিবি না! যা হবে আমায় জানাবি! দেখবি অপোজিশান যেন কোনও সুবিধে না করতে পারে। ওরা তো স্ট্রাইকের ভান করে মালিকের থেকে টাকা খেয়ে নেবে। সেটা আমরা হতে দিতে পারি না। গরিবদের দিকটা আমাদের দেখতে হবে, তাই না?’

আদিত মাথা নাড়ল। একদম খাঁটি কথা। গরিবের দিক ওরা না দেখলে কে দেখবে? এই জন্য রাজুদাকে ওর এত ভাল লাগে!

রাজুদা বলল, ‘আর শোন, বিলুর থেকে কিছু টাকা নিয়ে যাস। ওখানে লাগতে পারে।’

বিলু রাজুদার সেক্রেটারি গোছের। সিড়িঙে ধরনের চেহারা। লোকটাকে সুবিধের লাগে না আদিতের।

ও বলল, ‘রাজুদা, ওই লোকগুলোর রেশন কার্ডটা তো…’

‘হবে হবে,’ রাজুদা পিঠ চাপড়ে দিল আদিতর, ‘তুই ওদের কথা দিয়েছিলি। ওরা আমাদের ভোট দিয়ে রাখালিয়া পৌরসভায় জিততে সাহায্য করেছে। আমি তো ভুলিনি। চেয়ারম্যান অমলবাবুকে আমি বলে দেব। উনি ফর্মে সই করে দেবেন। ভাবিস না!’

‘হয়ে যাবে তো?’ আদিত আবার জিজ্ঞেস করল।

রাজুদা চলে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল, ‘আমি বলছি তো! ভরসা করিস না আর আজকাল!’

‘না না…’ আদিতর খারাপ লাগল।

রাজুদা ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ‘তুই রাবার ফ্যাক্টরিটায় যা। ওটা ইমপরট্যান্ট খুব। দেড় হাজার মানুষ কাজ করে। ওটা নিয়ে ভাব। জানবি সামনের বছর রাজ্যসভা নির্বাচন, আমি চাই না আমাদের অসুবিধে হোক, বুঝলি?’

আদিত কিছু বলার আগেই দেখল, সেই লম্বা লোকটা একটা জলপাই রঙের সাইড কার লাগানো মোটর বাইক করে সারা পাড়া কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেল সামনের রাস্তা দিয়ে!

ও শুনল মাকু বলছে, ‘শালা, আমি একদিন বিলিতি পেট্রোল খাবই!’

২ নিরমুক্তা

ক্যাপসিউল এলিভেটারের ভেতর দিয়ে অন্ধকার নেমে আসা শহরটার দিকে তাকাল মুকু। ডিসেম্বরে এবার ঠান্ডা পড়েছে বেশ। মুকুর ঠান্ডা একটু বেশি। আর এখন মূলত দক্ষিণ ভারতে থাকে বলেই হয়তো একটু শীত পড়লেই ওর বেশি ঠান্ডা লাগে!

ডিব্রুগড় থেকে অফিসের কাজ সেরে ও কলকাতায় এসেছে আজ। ওদিকে তো আরও ঠান্ডা! ফ্লাইট লেট ছিল তাই এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে হোটেলে আসতে আসতে অন্ধকার হয়ে গেছে।

রাতের কলকাতাকে এখন এল.ই.ডি. লাইটে সাজানো বিয়ে বাড়ি মনে হচ্ছে!

ঘড়িটা দেখল একবার মুকু। সাড়ে আটটা বাজে। প্লেনে আসার সময় খাবার নেয়নি। কিন্তু এখন খিদে পাচ্ছে। ও ভাবল ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুম সার্ভিসে বলে কিছু খাবার নিয়ে নেবে।

এখন ওর ছুটি। গত দু বছর ছুটি নেয়নি ও। তাই দু সপ্তাহ ছুটি পেতে অসুবিধে হয়নি। ওর বস, রভি গুপ্তা খুব রিজনেবল মানুষ! পরপর দুটো বড় কাজ ওরা পেয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ষাট কোটি টাকা। আর দুটোতেই মুকুর খুব ভাল পারফরম্যান্স!

রভি তো আজ সকালে ফোন করে বলেছিল, ‘নিরমুক্তা, ইউ হ্যাভ ডান আ গ্রেট জব। নাও এনজয় ইয়োর লিভ। আফটার দ্যাট কাম টু আস উইথ রিনিউড জিল! তোমাকে টেক্সাস যেতে হবে সামনের জ্যানিউয়ারিতে! বাট আই ডোন্ট নো হোয়াই ইউ আর স্পেন্ডিং ইয়োর হলিডেজ ইন কলকাতা! বাট, ঠিক আছে। আমার হয়ে ফুচকা খেয়ো কয়েকটা বেশি। হ্যাভ ফান। বাই!’

রভির বয়স প্রায় পঞ্চান্ন। কড়া বস, কিন্তু মানুষটা ভাল। স্কুল জীবন কলকাতায় কাটিয়েছে বলে বাংলা ভালই বলে। আর কলকাতার খাবারের খুব ভক্ত! বলে, ‘সারা পৃথিবীতে এমন অ্যাসর্টেড ফুড আর কোথাও পাওয়া যায় না! বিশেষ করে ফুচকা! ইট ইজ অরগ্যাস্মিক গুড!’

কথাটা মনে পড়াতে হাসি পেল মুকুর। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল প্রিতমের কথা।

প্রিতম সুর। বিদেশি ব্যাঙ্কের বড় পদে আছে। বেঙ্গালুরুতেই থাকে। তবে বেশিরভাগ সময় লন্ডন টোকিও সিডনি আর নিউ ইয়র্ক করে বেড়ায়! এখন যেমন ও আছে সিঙ্গাপুরে! তবে যেখানেই থাকুক না কেন দিনে একবার ও ফোন করবেই মুকুকে।

প্রিতমের বয়স বেয়াল্লিশ। যদিও মাথার চুল বেশিরভাগ পেকে গিয়েছে। তাই বয়সের চেয়ে বেশ কিছুটা বুড়ো লাগে ওকে। প্রিতম বুদ্ধিমান, কেয়ারিং আর লয়াল!

ওর প্রথম বিয়েটা টেঁকেনি। সেই বিয়ের থেকে একটা ছেলে আছে ওর। সেই স্ত্রী আর ছেলে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। বছরে একবার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে ওখানে যায় প্রিতম!

ছেলেকে খুব ভালবাসে ও। কিন্তু তাও ছেলের কাস্টডি নিয়ে লড়াই করেনি! কারণ ওর মতে, ‘সুমিতার কাছে থাকলে ঋষি অনেক ভাল থাকবে!’

একটা পার্টিতে গত বছর প্রিতমের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মুকু।

নিরমুক্তা নামটা শুনে বেশ চমকে গিয়েছিল প্রিতম। বলেছিল, ‘নিরমুক্তা? অদ্ভুত নাম তো? কী মানে এর?’

মুকুর এই একটা জিনিস ভাল লাগে না। ছোট থেকেই দেখছে সবাই ওর নাম শুনলে এর মানে জানতে চায়।

তাও ও সামান্য হেসে বলেছিল, ‘ফ্রি ফ্রম বন্ডেজ।’

‘ও!’ প্রিতম হেসেছিল, ‘ফ্রি? ট্রুলি?’

মুকু বলেছিল, ‘নো বডি ইজ ট্রুলি ফ্রি!’

সেই প্রথম আলাপ। মুকু একটু এড়িয়েই গিয়েছিল ওই কথাটুকুর পরে। কিন্তু বুঝতে পারছিল ও যেখানেই যাচ্ছে এক জোড়া চোখ ওকে ঠিক খুঁজে বেড়াচ্ছে ওই বড় ব্যাঙ্কোয়েটের মধ্যে!

তার ঠিক দু’দিন পরে একটা ফোন পেয়েছিল মুকু। অফিসেই ছিল তখন। অজানা নাম্বার দেখে সামান্য ইতস্তত করেছিল ও প্রথমে। তারপর ধরেছিল ফোনটা।

প্রিতম বলেছিল, ‘ইটস মি, প্রিতম। রিমেম্বার?’

‘প্রিতম?’ সামান্য সময় নিয়েছিল মুকু। আসলে সত্যি চট করে বুঝতে পারেনি!

‘আরে আমি প্রিতম সুর। দ্যাট গাই উইথ প্রিম্যাচিওর হোয়াইট মেন! মনে পড়েছে, ফ্রি ফ্রম বন্ডেজ ম্যাম?’

‘ও আপনি!’ অবাক হয়েছিল মুকু, ‘কিন্তু আমার নাম্বার কী করে পেলেন!’

‘ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়!’

‘তা ইচ্ছেটাই বা হল কেন শুনি?’ মুকু হেসেছিল সামান্য।

প্রিতম সময় নিয়েছিল সামান্য, তারপর বলেছিল, ‘আমার তো বন্ডেজ ভাল লাগে। তাই…’

দু’দিন পরে ডিনারে দেখা করেছিল ওরা। দেখা হওয়ার আধ ঘন্টার মধ্যে নিজের সম্বন্ধে সব বলে দিয়েছিল প্রিতম! কী করে, কোথায় থাকে। আগের বিয়েটা ভাঙল কেন। সব।

খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল মুকু। এমন একটা বড় পোস্টে চাকরি করে একজন সে এমন টিনএজারদের মতো হয় কী করে!

মুকু সব শুনে সামান্য হেসে বলেছিল, ‘ইউ আর রানিং টু ফাস্ট, নো?’

প্রিতম সামনে রাখা হুইস্কিতে সামান্য চুমুক দিয়ে বলেছিল, ‘আমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আর টাইম নষ্ট করতে চাই না।’

‘মানে?’ মুকু অবাক হয়েছিল খুব।

‘মানে আমার আপনাকে ভাল লেগেছে খুব। আমি আপনার সম্বন্ধে খবর নিয়েছিলাম তাই। তাই… মানে…’

‘একদিন দেখেই ভাল লেগে গেল?’ অবাক হয়েছিল মুকু।

প্রিতম হেসে বলেছিল, ‘হোয়াই পিপল হ্যাভ প্রবলেম উইথ দিস আই ডোন্ট নো। ভাল লাগার কোনও ফর্মুলা হয় নাকি? এতদিন, এত ঘণ্টা দেখার পর ভাললাগা আসবে! তার আগে আসা বারণ। আরে সারা জীবন এক সঙ্গে থেকেও যেমন প্রেম তৈরি হয় না, তেমন এক মিনিট দেখেও তো ভাল লাগতে পারে! মানুষ সব কিছু কেন নিয়মে বাঁধতে চায় কে জানে?’

মুকু থেমেছিল একটু। তারপর বলেছিল, ‘আপনি আমার পাস্ট জানেন তো?’

প্রিতম আবার চুমুক দিয়েছিল গ্লাসে। সামনে রাখা একটা মাংসের টুকরো তুলে তাতে সস মাখিয়ে সময় নিয়ে কামড় দিয়েছিল। তারপর ওই অবস্থাতেই বলেছিল, ‘আপনি দিল্লির মেয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং করে এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট পড়েছেন। আঠাশে বিয়ে করেছিলেন। লাস্ট তিন বছর আগে ডিভোর্স হয়। এখন বেঙ্গালুরুতেই থাকেন। স্ট্রবেরি আইসক্রিম ভালবাসেন। ম্যাক্সিমাম ব্লু পড়েন! আর… আর… হ্যারি বেলাফন্টে পছন্দ! পামুকের লেখা ভালবাসেন। আর…’

‘ব্যাস ব্যাস,’ হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করেছিল মুকু, ‘এর পর আর কী কী বলবেন কী জানি! এত কথা জানলেন কী করে?’

‘আরে,’ প্রিতম হেসেছিল, ‘আপনি শুনতে পাচ্ছেন না, আমার আপনাকে ভাল লেগেছে। মানে জাস্ট ভাল লাগেনি। আন্ডার লাইনড ভাল লেগেছে! তাই খবর নিয়েছি।’

মুকুর ভাল লেগেছিল। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে বলেছিল, ‘আরে আপনি তো ডেঞ্জারাস!’

‘ঠিক। আসলে মোসাডে চাকরি করার ইচ্ছে ছিল! কিন্তু এমন কপাল যে ব্যাঙ্কে আটকে গেলাম! শুধু একটা জিনিস!’

মুকু নিজেও ছোট ছোট কামড়ে মাংস খাচ্ছিল। শেষের কথাটা শুনে কৌতুহলী হয়ে মুখ তুলে তাকিয়েছিল, ‘কী?’

প্রিতম, পরিষ্কার করে কামানো গালে হাত ঘষে বলেছিল, ‘একটা জিনিস জানতে পারলাম না। আপনার এক্স-এর নাম!’

চট করে এবার মুকু তাকিয়েছিল প্রিতমের দিকে। আর কেন কে জানে বুকের খুব গভীরে, কোথাও ছোট্ট এক কুচি একটা পোকা কামড়ছিল মুকুকে!

প্রিতম হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘খুব বোকা লোক। নাহলে আপনাকে ছেড়ে দেয়!’

মুকু চোয়াল শক্ত করে মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। এক কুচি পোকাটা খুঁড়ছিল ওর বুক। কে কাকে ছেড়েছে, সেটা যদি প্রিতম জানত!

‘ম্যাম ইয়োর ফ্লোর!’ সামনে দাঁড়ানো স্টুয়ার্ডটির কথায় সংবিত ফিরল মুকুর। ও লিফটের থেকে বেরিয়ে করিডোরে দাঁড়াল।

লম্বা কার্পেট পাতা করিডোর। সুন্দর করে সাজানো। স্টুয়ার্ড ছেলেটি বড় ট্রলি ব্যাগটা টেনে নিয়ে ওর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কার্ড পাঞ্চ করে দরজা খুলে ঢুকে গেল!

বিশাল বড় আর নামি হোটেল এটা। আরামের কোনও অসুবিধে নেই। ও ঘরে ঢুকেই বুঝল যে রুম হিটার জ্বালানো আছে। কলকাতার এই ঠান্ডাতেও রুম হিটার! হাসি পেল মুকুর। ও একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিল ছেলেটির হাতে। ছেলেটি ব্যাগ রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

হাতব্যাগটা পাশের টেবলে রেখে বড় সোফাটায় আধশোয়া হয়ে সামান্য চোখ বুজল মুকু। ভাবল, কী করছে ও কলকাতায়?

প্রিতম এখন সিঙ্গাপুরে। ওকে বলেছিল চলে আসতে। দু’সপ্তাহ এক সঙ্গে থাকবে। পারলে ইউরোপও ঘুরে আসবে। কী সহজেই চলে যেতে পারত, কিন্তু না গিয়ে ও কলকাতায় এসে বসে আছে। দামি হোটেলে উঠে এক গাদা টাকার গুনাগার দিচ্ছে! কেন করছে ও এসব? কার জন্য করছে? কী পাবে ও এসব করে? সব তো মরে গেছে! শেষ হয়ে গিয়েছে! তাহলে? কেন এখানে এসেছে ও! ওকে দীপন ফোন করল বলেই চলে এল খড়ের গাদায় সূঁচ খুঁজতে?

নাঃ, আর ভাববে না। কী হবে ভেবে? একবার যখন রাজি হয়ে গেছে তখন তো চেষ্টা করতেই হবে!

মুকু উঠে বাথরুমে গেল একবার। সময় নিয়ে ফ্রেশ হল। সারা দিনের ক্লান্তি গরম জলে স্নান করে কাটল কিছুটা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে খিদেটাও যেন মাথা তুলে দাঁড়াল আবার।

ঘরে এসে সুটকেস খুলে ঢিলেঢালা একটা ট্র্যাক প্যান্ট আর টি শার্ট বের করে পরে নিল মুকু। তারপর বিছানায় বসে টেলিফোনটা টেনে নিল। ফোনের পাশেই রুম সার্ভিসের নাম্বার দেওয়া আছে। দুটো গার্লিক ব্রেড, স্যালাড আর শ্রেডেড চিকেন বলে দিল।

আজ খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে! কাল সকালে উঠে ভাববে কী করা যায়।

বিয়ের পরপর মুকু কলকাতায় এসেছিল ওর সঙ্গে। নানান জায়গায় ঘুরেছিল ওরা। কত চেনাশুনো ছিল ওর! খুব সামান্য প্রান্তিক মানুষ থেকে সমাজের উপরতলার মানুষ! সবার সঙ্গে কী করে এমন বন্ধুর মতো মেশে একটা লোক! মুকুর অবাক লাগত খুব। ভালও লাগত!

তারপর দশ বছর কোথা দিয়ে যে বেরিয়ে গেল! সব উলটোপালটা হয়ে গেল কেমন! এত বছর পরে এই শহরে এসে এখন কেমন অচেনা লাগছে সবকিছু। এত বড় বাড়ি! এত ফ্লাইওভার! এত মানুষ! কেমন একটা তিরতিরে ভয়ে কাঁপছে যেন বুক! এর মধ্যে কী করে ওকে খুঁজে পাবে?

আচমকা মোবাইলটা বেজে উঠল। এখন আবার কে কল করছে? মা নাকি? আজ সারাদিন মাকে ফোন করা হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা ছোট ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গেই থাকে লক্ষ্ণৌয়ে।

দ্রুত মোবাইলটা তুলল মুকু। না দেখল কৃতি ফোন করেছে।

কৃতি ওদের কোম্পানিতেই আছে। ওর কোলিগ। ভাল বন্ধুও। খুব আপ রাইট মেয়ে। সোজা কথা সোজা ভাবে বলে দেয়।

‘বল,’ ফোনটা কানে লাগিয়ে মুকু বালিশে হেলান দিয়ে বসল।

‘রিচড সেফলি না?’

‘টু সেফলি!’ হাসল মুকু।

‘একটা হোয়াটসঅ্যাপ তো করতে পারতিস! যাই হোক। ব্যাস রিল্যাক্স কর। স্টিফ ড্রিঙ্ক নে। একটা ভাল এসকর্ট ছেলেকে ডেকে নে। হ্যাভ কাপল অব নাইস হার্ড ফাক! দেন স্লিপ টিল নুন!’

‘খালি আজেবাজে কথা!’ মুকু হাসল। কৃতি এমনই। ভুলভাল কথা লেগেই আছে ওর মুখে!

‘নাতো কী?’ আমি কোম্পানির কাজে গিয়ে ব্রেক পেলে তো তাই করি! মাউথ অ্যান্ড ভ্যাজাইনা, বোথ হ্যাভ নিডস ইয়ার! যা বলছি শোন। তোর বেয়ারাকে ডাক। ওদের বল। ওরা জোগাড় করে দেবে!’

‘আমি ফোন রাখছি!’ মুকু হাসতে হাসতে বলল।

‘ওকে ওকে,’ কৃতি হাসল শব্দ করে, ‘বাঙালি শালা! ইউ বঙ আর সো ফাকিং হিপোক্রিট!’

‘আর তোরা তো সুইডেনে থাকিস!’

কৃতি বলল, ‘ভাল কথা বললাম আর তুই… যাক গে, শোন, স্ট্রেস করবি না একদম কিন্তু। ইন দ্যা ফার্স্ট প্লেস এমন একটা কাজে রাজি হলি কেন কে জানে! এক্সেস ব্যাগেজ!’

মুকু উত্তর দিতে গিয়েও শুনল টুঁ টুঁ করে একটা আওয়াজ হচ্ছে! ও ফোনটা কানের থেকে সরিয়ে স্ক্রিনটা দেখল। দীপন ফোন করছে।

মুকু বলল, ‘শোন না কৃতি, দীপন ইজ কলিং। ওর সঙ্গে কথা সেরে তোকে ফোন করি?’

‘একদম না!’ কৃতি বলল, ‘আমায় আজ আর ফোন করবি না। জয়ন্তের সঙ্গে আজ বেরিয়েছি। ডিসক, ডিনার, ডগি! আজ পুরো ডি-এর ওপর থাকব! সো ডোন্ট ডিস্টার্ব!’

‘ইশ তোর এই লেম জোকগুলো সো ডেটেড!’ মুকু ইচ্ছে করে বলল।

‘বেশ হয়েছে। তোর মতো তো নই! সব ছেড়ে বাঁশ নিতে গেছে!’ কৃতি নিজের বিরক্তিটা লুকোল না!

‘রাখছি।’ হেসে ফোন কেটে দিল মুকু। কিন্তু নামিয়ে রাখার আগেই আবার ফোনটা ঢুকল। দীপন। মুকু দীর্ঘশ্বাস চেপে ধরল ফোনটা!

‘বউদি!’ দীপন আলতো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি পৌঁছে গেছ?’

বউদি! এইটা শুনতে ভাল লাগে না মুকুর। কিন্তু কী আর করবে? এই নিয়ে কথা বাড়ালে কথাই বাড়বে। আর পাঁচটা অপ্রয়োজনীয় কথা উঠবে। তাই এই নিয়ে আর জল ঘোলা করে না ও।

‘বলো দীপন। আমি হোটেলে।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ বউদি,’ দীপন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বলল, ‘আমি তোমায় একটা হোয়াটসঅ্যাপ করে করে কয়েকটা ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি। মানে সম্ভাব্য যে কটা জায়গায় থাকতে পারে আর কী! তুমি প্লিজ একটু দেখো!’

‘আচ্ছা!’ মুকু আবার দীর্ঘশ্বাস চাপল, ‘তুমি কিন্তু এখনও বললে না তোমার দাদা কেন এখানে এসেছে! ডোন্ট ইউ থিঙ্ক আমার এটা জানা উচিত!’

দীপন বলল, ‘আমি বলতে চাই বউদি। কিন্তু দাদা এটা বারণ করেছিল! কথা দিয়েছিলাম!’

‘তোমরা কি মহাভারতের যুগে আছ? কথা দিয়েছিলে মানে কী!’ মুকু রাগ লুকোল না!

দীপন বলল, ‘দাদাকে খুঁজে পেলে তাকেই জিজ্ঞেস কোরো প্লিজ। প্লিজ আমায় এটা জিজ্ঞেস কোরো না! তোমার কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। আমি যদি সুস্থ থাকতাম তোমায় জ্বালাতাম না। কিন্তু জানোই তো আমার কী অবস্থা! তাই তোমায় কষ্ট দিচ্ছি! প্লিজ কিছু মনে কোরো না।’

‘তুমি ঠিকানাটা পাঠিয়ে দাও। কেমন? আমি ডিনার করব।’ মুকু ছোট করে বলল। বুঝল দীপন বলবে না কিছুতেই! যেমন দাদা তেমন ভাই! গোঁয়ারদের ফ্যামিলি!

‘শিয়োর শিয়োর। আমি তোমার ওপর ছাড়া আর কারও ওপর ভরসা করতে পারি না বউদি। তাই তোমায়…’ দীপনের গলাটা কেমন যেন বুজে এল কষ্টে, ‘যাক গে, ডিনার করে নাও। আমি ঠিকানাগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছি। গুড নাইট।’

ফোনটা কেটে মাথা নিচু করে বসল মুকু। নিস্তব্ধ ঘর। ঘড়ির টিকটিক শোনা যাচ্ছে শুধু। ওর মনে হল এই শহরেরই কোথাও আছে সেই লোকটা। সেই লোক যার সঙ্গে দশ বছর আগে এই শহরে এসেছিল ও। মুকু যেন দেখতে পেল ওর দিকে বড় বড় চোখ তুলে তাকিয়ে আছে সে! আর আচমকা কোনও কারণ ছাড়াই চোখে জল চলে এল মুকুর! ও যেন শুনতে পেল, বুকের অনেক অনেক গভীরে পুচকি সেই পোকা এখনও কিটির-কিটির শব্দে কষ্টের সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চলেছে একা!

৩ স্মাহি

জটাদাদু রোজ গান করে স্টেশানের কোনায় বসে। একটা পেতলের খঞ্জনি বাজিয়ে, এক পায়ে বাঁধা একটা ঘুঙুরে তাল দিতে দিতে জটাদাদু নানান রকম গান করে।

জটাদাদুর পরনে একটা অদ্ভুত আলখাল্লা থাকে। কত রঙের যে তাতে তাপ্পি মারা তার ইয়ত্তা নেই। আর মাথায় একটা বিরাট জটা। তাতে আবার লাল কাপড় বেঁধে রাখে দাদু। গানের তালে তালে সেই জটা নাড়ায়। স্মাহির কী যে ভাল লাগে জটাদাদুর গলা, গান!

আর কেউ যদি ভেবে থাকে জটাদাদু শুধু ভক্তিমূলক গান করে তা কিন্তু নয়! জটাদাদু নানান রকমের গান গায়। এমন কী হিন্দি গানও গায় মাঝে মাঝে।

এই আজই যেমন একটা গান গাইছিল দাদু, ‘চাহুঙ্গা ম্যায় তুঝে শাম সবেরে…’!

এমন করে আকাশের দিকে মুখ তুলে গানটা গাইছিল দাদু যে স্মাহির মনে হচ্ছিল কাউকে বোধহয় এই গানের মধ্যে দিয়ে খবর পাঠাতে চাইছিল মানুষটা।

জটাদাদু স্মাহিকে চেনে। প্রতি মাসে স্মাহি দাদুকে তিনশো করে টাকা দেয়। ও জানে এই সামান্য টাকায় কিছু হয় না। কিন্তু স্মাহির যে এর চেয়ে বেশি কিছু দেবার ক্ষমতা নেই! তবে এই টাকাই জটাদাদু এত আনন্দ করে নেয়! স্মাহির মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদের কীসব যেন মন্ত্র বলে! সেসব বোঝে না স্মাহি, কিন্তু ভালবাসাটা বোঝে! এখন, ভালবাসাটা খুব বুঝতে পারে ও!

অন্যদিনের মতো আজও গান শেষ হওয়া অবধি দাঁড়িয়েছিল স্মাহি।

গান শেষ করে মানুষজনের দিয়ে যাওয়া খুচরোগুলো গুছিয়ে তুলতে তুলতে জটাদাদু বলল, ‘কীরে, আজ তাড়াতাড়ি?’

স্মাহি হাসল, ‘ওই ছুটি হয়ে গেল। আসলে ফ্যাক্টরিতে একটা গোলমাল চলছে। তাই কীসব মিটিং আছে ইউনিয়ানের সঙ্গে মালিক পক্ষের! আমি অ্যাকাউন্টসে আছি। আমার তেমন কাজ নেই! তাই ছেড়ে দিল!’

জটাদাদু হেসে স্টেশানের রেলিঙে পিঠ লাগিয়ে বসে বলল, ‘মোরব্বা খাবি? একজন দিয়েছে। দাঁড়া, দিচ্ছি!’

জটাদাদু তাপ্পিমারা ঝোলার থেকে একটা প্লাস্টিকের কৌটো বের করে তার থেকে দুটো মোরব্বা বের করল। অন্য কেউ হলে স্টেশানে বসে ভিক্ষে করা এমন একটা মানুষের থেকে কিছু নিতে হয়তো দ্বিধা করত। কিন্তু স্মাহির এমন মনে হয় না। ও হাত বাড়িয়ে মোরব্বা দুটো নিল। তারপর নিজের ব্যাগের সামনের চেন খুলে স্টিলের ছোট টিফিন বাক্স বের করে তাতে ঢুকিয়ে রাখল।

জটাদাদু বলল, ‘আর এখানে দাঁড়াস না। বাড়ি যা। আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছিস। বাড়ি গিয়ে রেস্ট কর।’

হাসল স্মাহি। রেস্ট! ওর তো সারা জীবনটাই রেস্ট! ওই ছোট্ট এক কামরার ঘরেই তো এখন থমকে আছে ওর জীবনটা। ওই অফিস আর ফিরে এসে ওই ঘর! আর কী আছে!

ও মাঝে মাঝে ভাবে ডুবু না থাকলে ওর কী হত এই জীবনে!

ডুবুর বয়স দু বছর। খুব দুষ্টু ছেলে। সারাক্ষণ ছটফট করে। আদো আদো একটু কথা বলে। আর মাঝে মাঝে মোনি মোনি বলে চিৎকার করে হারমোনিয়ামের ওপর চড়ে বসে!

রিতাদি আর নানুদার ছেলে ডুবু। ওরা পাশের ঘরে ভাড়া থাকে। এই বাড়িটায় ইটের দেওয়াল, মাথায় টালির ছাদ! এখানে দুটো ঘর আছে পাশাপাশি। সামনে টানা একটা বারান্দা। বারান্দার দু’দিকে দুটো ছোট্ট ঘেরা জায়গা আছে দুই ঘর ভাড়াটের রান্নার জন্য। স্নানের জায়গা আর ল্যাট্রিন একটাই। দু’জনকেই ভাগ করে ব্যবহার করতে হয়।

মাঝে মাঝে বর্ধমানে ওদের বিশাল বাড়িটার কথা মনে পড়ে স্মাহির। কত বড় উঠোন ছিল! কত বিশাল সব ঘর! সেখান থেকে এই এক কামরার ঘরটা কেমন যেন অদ্ভুত! কেমন যেন অন্য একটা গ্রহ বলে মনে হয় স্মাহির!

রিতাদি আর নানুদা ভাল গান করে। কিন্তু সেভাবে কেউ সুযোগ-টুযোগ দেয়নি কোনওদিন। দু’জনে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। তারপর একটা দুর্ঘটনায় নানুদার চোখ দুটো চলে যায়। এখন নানুদা আর রিতাদি ট্রেনে ট্রেনে গান গেয়ে বেড়ায়। ছোট একটা সিন্থেসাইজার বাজায় নানুদা। আর রিতাদি মাইক ধরে গায়। পোর্টেবল একটা স্পিকার গলায় ঝোলে রিতাদির!

রিতাদিরা যখন কাজে বেরোয়, ওদের বাড়িওলি দিদার কাছে ডুবু থাকে। মহিলা বয়স্ক। রাগী। কিন্তু মনটা ভাল। দেড় হাজার টাকা ভাড়া নেন ওদের থেকে। স্মাহির মনে হয় এই লেক গার্ডেন্স অঞ্চলে টাকাটা খুব বেশি নয়।

চারিদিকের চকচকে বাড়িঘরের ভেতরে এক মুঠো, দু মুঠো করে কয়েকটা ছোট ছোট কলোনির মতো আছে এখানে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পাড়া। স্মাহি বোঝে ওর জীবন এখানে এসেই ঠেকেছে!

বাড়িওলি দিদা প্রথমে অবাক হয়েছিল এমন একটা জায়গায় স্মাহি একা থাকবে বলে। কিন্তু যখনই শুনেছে যে মা বাবা নেই, চাকরি না করে উপায় নেই ওর, তখন আর ওকে ঘর ভাড়া দিতে দ্বিধা করেনি।

বাবা মা মারা যাওয়ার পরে জেঠু জেঠিমার কাছেই তারপর মানুষ হয়েছে স্মাহি। জেঠিমা চিরকালই ওকে বোঝা হিসেবে দেখে এসেছে! কিন্তু জেঠু কী যে ভালবাসত ওকে! এই সব নিয়ে চলছিল ঠিকই! কিন্তু তারপর যে কী হল! কেন যে ও অমন একটা লোকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল! তখন কি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল স্মাহি? আর তাই কি পথ হারিয়ে এতটা দূরে এসে ছিটকে পড়ল ও!

আগে পার্ক সার্কাসে একটা জায়গায় ভাড়া থাকত স্মাহি। মাস তিনেক হল এখানে এসেছে। আর আসার কিছুদিনের মধ্যেই রিতাদি আর নানুদার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গিয়েছে ওর! তারপর ডুবু! ও বাড়িতে এলেই ডুবু পাশের ঘর থেকে চলে আসে ওর কাছে। গলা ধরে ঝুলে পড়ে! কোলের মধ্যে গুটিয়ে শুয়ে থাকে। আদো আদো গলায় মাহি মাহি করে ডাকে। আর ডুবুকে জড়িয়ে ধরে, ওর পালকের মতো শরীরে নাক ডুবিয়ে দেয় স্মাহি। ছোটবেলার গন্ধ আসে ডুবুর শরীর থেকে। আর কে যেন স্মাহির মনের ছোট্ট পুকুরটায় একটা ঢিল ছোড়ে। মনে মনে কেঁপে ওঠে ও। ভাবে, সে থাকলে আজ তারও তো এমন বয়সই হত!

স্টেশান থেকে বেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে সোজা এগোল স্মাহি। বাঁদিকের একটা রাস্তা লর্ডস মোড়ের দিকে চলে গিয়েছে। ওই বাঁকের মুখে একটা রিকশা স্ট্যান্ড আছে। সেই স্ট্যান্ড থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে সোজা গেলে ওর বাড়ি!

ওই দিকে এগোতে এগোতে আজও আবার ঝানুকে দেখতে পেল স্মাহি। আর সঙ্গে সঙ্গে মুখটা তেতো হয়ে গেল ওর।

ঝানু ছেলেটা এলাকার উঠতি মাস্তান গোছের। শুনেছে বাড়ির দালালি করে। সঙ্গে প্রোমোটারি লাইনেও নাকি নেমেছে।

ছেলেটাকে দেখলেই বিরক্তি লাগে স্মাহির। মনে হয় পায়ের থেকে জুতো খুলে মারে। কয়েকবার তো কড়া ভাবে কথাও বলেছে। কিন্তু তাতে যেন আরও মজা পেয়েছে ঝানু।

কতগুলো রিকশা দাঁড় করানো আছে স্ট্যান্ডে। তার পাশে একটা মোটর বাইকে বসে আছে ঝানু। সঙ্গে দুটো চামচা গোছের ছেলে দাঁড়িয়ে। ঠান্ডার মধ্যেও ঝানুর পরনে একটা হাফহাতা টাইট, কালো হলুদের ডোরাকাটা গেঞ্জি। সেখান থেকে ভুঁড়িটা ফুটবলের মতো ঝুলে আছে। দু’কানে দুটো দুল। মাথার মাঝখানে চুলের ঝুড়ি! চাপা কালো প্যান্ট আর লাল রঙের একটা জুতো।

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল স্মাহির। ও মাথা নিচু করে দ্রুত পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল মোড়টা।

‘কী ম্যাডাম, আমায় দেখতে পাচ্ছেন না যে!’ ঝানু এসে দাঁড়াল সামনে।

স্মাহি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কেন আপনি আমায় ডিস্টার্ব করেন? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?’

‘ডিস্টার্ব? আমি?’ ঝানু যেন আকাশ থেকে পড়ল, ‘আমি তো আপনার খবরাখবর নিই! আপনাকে দেখলেই বোঝা যায় আপনি ভাল বাড়ির মেয়ে। কেন বেকার হাফ বস্তিতে পড়ে থাকবেন? আমার কষ্ট হয় আপনার জন্য। আমি আপনাকে ভাল বাড়ি দেখে দেব। ফ্ল্যাট। আমার চেনা জানা। টাকাপয়সাও খুব কম লাগবে। তেমন তেমন হলে দিতেও হবে না।’

‘তেমন তেমন হলে মানে?’ স্মাহি চোয়াল শক্ত করে তাকাল ঝানুর দিকে।

ঝানু গ্যালগ্যাল করে হাসল, ‘আপনি আমার স্পেশাল লোক। আপনাকে কেন টাকা দিতে হবে? তাই…’

‘প্লিজ, সরুন।’ স্মাহি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সামনে।

‘ভেবে দেখবেন ম্যাডাম। আমি কিছু দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি! তাই ক’টা দিন থাকব না। এর মধ্যে ভেবে নেবেন! সবার জন্য ওয়ান টাইম অফার কিন্তু আপনার জন্য লাইফ টাইম!’

বিকেল নত হয়ে আসছে সন্ধের পায়ে। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক মানুষ। কেউ কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে ঝানু আর স্মাহির দিকে। তারা বুঝতেও পারছে যে স্মাহিকে বিরক্ত করছে ছেলেটা। কিন্তু কেউ এসে প্রতিবাদ করছে না।

স্মাহি মাথা নিচু করে দ্রুত হাঁটতে লাগল। এ এক অদ্ভুত অবস্থা চলছে চারিদিকে। সারা দেশ জুড়ে লোকজন খেলা, সিনেমা, বই ইত্যাদি সমস্ত কিছু নিয়ে সোশ্যাল সাইটে বক্তব্য রাখছে। গলা ফাটিয়ে ন্যায় নীতি নিয়ে তোলপাড় করে দিচ্ছে চারিদিক। সবাই যেন প্রমাণ করতে নেমেছে কে কত সেনসেটিভ! কে কত মানুষের কথা ভাবে! কিন্তু রোজকার যে অন্যায়গুলোকে রাস্তায় নেমে আটকানো উচিত সেইসব নিয়ে কারও কোনও হুঁশ নেই! একটা মোটামুটি ভারসাম্যে থাকা পৃথিবী কী করে এমন সিলেক্টিভলি ইনটলারেন্ট পৃথিবী হয়ে গেল বুঝতে পারে না স্মাহি। এই যে ওকে এভাবে রাস্তার মধ্যে এতগুলো মানুষের সামনে এমন করে বিরক্ত করল ঝানু, তা নিয়ে কেউ একবারও কিছু বলল না! কিন্তু স্মাহি জানে এরাই আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ন্যায় নীতি আর ঠিক ভুল নিয়ে থিসিস লেখে! কেউ সামনে থেকে দায়িত্ব নেয় না! সবাই মেঘের আড়াল থেকে ফুটো মাস্তানি করতে ব্যস্ত!

কথাটা ভেবেই আচমকা স্মাহির মনে পড়ে গেল দীপকের মুখটা! সেও তো এমন ছিল। আসল সময় কী সুন্দরভাবে পালিয়ে গেল!

আকাশের আলো নিভে গেছে। ডিসেম্বরের এই সময়টায় দিন খুব ছোট হয়ে আসে। কেমন একটা মনখারাপ লাগে স্মাহির! আশেপাশে গাছেদের কাছে ফিরে আসে পাখিরা। কত কিচিরমিচির চলে! বর্ধমানের বাড়িতে ওই বারান্দা জোড়া পাখির বিশাল বড় খাঁচাটার কথা মনে পড়ে ওর! কাজ না থাকলে স্মাহি ওই পাখির খাঁচা ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। কী ভাল লাগত! মাঝে মাঝে ওর পাশে আরেকজনও এসে দাঁড়াত। তবে পাখি নয়, সে তাকিয়ে দেখত ওকেই। বুঝত স্মাহি। সবটাই বুঝত ও। কিন্তু কিছু বলত না! কেন বলবে! ওর তো দীপককে পছন্দ ছিল! দীপক মানে আসলে দীপককাকু। ওর চেয়ে বাইশ বছরের বড়। কিন্তু একা নিভৃতে ওকে তো দীপক বলেই ডাকত! তাই আর কোনও দিকে মন দেয়নি স্মাহি! শোনেওনি কারও কথা! তাইতো ওকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল! বলেছিল, ‘দূরে থাকবে, তুমি দূরে থাকবে আমার থেকে। বুঝেছ!’

বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়াল স্মাহি। সামনের গেটটা লোহার। তাতে টিনের পাত লাগানো। দরজাটার এক পাশে ইয়েল লক আছে। বাইরে থেকে টেনে দিলে বন্ধ হয়ে যায়। ওদের কাছে চাবি থাকে। যে যার মতো চাবি খুলে ঢুকে পড়ে।

অন্যদিন দরজাটা বন্ধই থাকে। কিন্তু আজ খোলা! সামান্য ভয় লাগল স্মাহির! না, ওর তেমন কিছু নেই ঘরে। তাও যেটুকু যা আছে তাও যদি চলে যায়! পনেরো হাজার টাকা মাইনে পায় ও। একার পক্ষে ঠিকই আছে। তাও সেটা তো আর অনেক টাকা নয়। সেসব দিয়ে আস্তে আস্তে জিনিসপত্র কেনে ও। জীবন গোছায়! এই যেমন গত মাসে যেমন একটা ল্যাপটপ কিনেছে টাকা জমিয়ে। সেটা যদি চুরি হয়ে যায়!

স্মাহি দ্রুত আধখোলা দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। সামনে একটা শ্যাওলা রাঙানো উঠোন। সেটা পার করে একদিকে ওদের ঘর।

সাবধানে সেই উঠোনটা পার করে নিজের ঘরের দিকে এগোল স্মাহি। আর তখনই দেখল রিতাদির ঘরের থেকে হাসি ভেসে আসছে!

কারা এল ওদের ঘরে! অবাক হল স্মাহি। তেমন তো কেউ আসে না! তাহলে? কিন্তু এই কৌতুহল ভাল না। কেউ তো আসতেই পারে। ওর সঙ্গে রিতাদিদের সম্পর্ক ভাল বলেই তো আর রিতাদিদের সব জানে না ও।

নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ও চাবি দিয়ে দরজাটা খুলল। আর তার আওয়াজেই রিতাদি বেরিয়ে এল পাশের ঘর থেকে।

‘ও স্মাহি তুই এসেছিস? খুব ভাল হয়েছে। একটা হেল্‌প করে দিবি বোন?’

‘হেল্‌প?’ স্মাহি অবাক হল। রিতাদি হাসছে। মুখ ঝলমল করছে।

‘জানি তুই অফিস থেকে আসছিস! তাও… সামনের দোকান থেকে চারটে সিঙাড়া এনে দিবি? একজন এসেছে! আয় তোকে আলাপ করিয়ে দিই!’

স্মাহি কিছু বলার আগেই রিতাদি ওকে টেনে নিয়ে গেল পাশের ঘরে। স্মাহি দেখল একটা ছেলে বসে রয়েছে ঘরের মধ্যে। ফিটফাট জামাকাপড়। পেতে আঁচড়ানো চুল। চোখটা কটা।

রিতাদি বলল, ‘মকরন্দবাবু এই যে স্মাহি। আমার বোন।’

মকরন্দ হেসে হাত জোড় করল। স্মাহিও হাসল। দেখল, ছেলেটার দাঁতগুলো লালচে!

রিতাদি আড়ালে ওর হাতে একটা একশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলল, ‘যা তাহলে। নিয়ে আয়। আর চারটে না, আটটা আনিস। তারপর বলছি সব কথা!’

স্মাহি মাথা নেড়ে কাঁধের ব্যাগ আর হাতের তালা চাবি রিতাদিকে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

মিষ্টির দোকানটা ছোট। বাড়ির কাছে। সকালে কচুরি ছোলার ডাল করে আর সন্ধেবেলা সিঙাড়া। অন্যদিন ভিড় থাকলেও আজ ফাঁকাই আছে দোকানটা। দোকানি বুড়োটা ঝিমোচ্ছে এই অসময়ে! মুখটা হাঁ হয়ে নীচের চোয়ালটা সামান্য ঝুলে আছে। এই লোকটা খুব খিটখিটে। সারাক্ষণ পুরনো ডিসি পাখার মতো কিটকিট করেই যায়!

স্মাহি হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমায় আটটা সিঙাড়া দিন!’

লোকটা ঘোলাটে চোখ মেলে তাকাল। তারপর বলল, ‘আটটার দাম বত্রিশ টাকা। সেখানে একশো নাচাচ্ছ? আমার কি খুচরোর আড়ত আছে?’

স্মাহির মাথা গরম হয়ে গেল। আবার অসভ্যতা শুরু করেছে লোকটা!

ও বলল, ‘আমার কাছে খুচরো নেই। আপনি দিন। আমি এনে দিচ্ছি। ওই সামনের বাড়িটায় আমি থাকি!’

‘বাকিতে? ধার বাকি আমি রাখি না! সব চোরের দল চারিদিকে! হবে না যাও!’

‘আরে!’ স্মাহি বলল, ‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি তো টাকা দিচ্ছি!’

‘টাকার গরম না খুব?’ লোকটা খেঁকিয়ে উঠল।

স্মাহি চোয়াল শক্ত করল। কেউ কেউ এমন হয়। অযৌক্তিকভাবে অসভ্যতা করে যায়! কিন্তু এদের কীভাবে সামলাবে সেটা বুঝতে পারে না ও। ওর রাগে হাত পা কাঁপছে। কিন্তু কোনও কথা বেরচ্ছে না মুখ দিয়ে।

‘এই নিন একশো টাকার খুচরো! এবার ওকে দিন যা চাইছে!’

আচমকা পেছন থেকে আসা কথাটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল স্মাহি। মুখ ঘুরিয়ে দেখল একটা লম্বা মতো লোক দাঁড়িয়ে আছে। এই দোকানের সামান্য আলোতেও বোঝা যাচ্ছে লোকটা খুব ফর্সা! কাঁচা-পাকা চুল। লম্বা ঝুলপি। নিঁখুত ভাবে দাড়ি গোঁফ কামানো। আর কী সুন্দর একটা গন্ধ আসছে লোকটার জামা থেকে!

দোকানিটা থতমত খেয়ে গিয়েছে। স্মাহি প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে হাসল। হাতের একশো টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিল লোকটার দিকে। অস্ফুটে বলল, ‘আপনি শুধু শুধু…’

লোকটা গভীর গলায় বলল, ‘ছোটবেলায় কী পড়েছিলাম মনে নেই? সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে! মনে নেই? ঠিক কাজ কখনও শুধু শুধু হয় না!’

স্মাহি হাসল। কিন্তু আর কিছু বলার আগেই দেখল লোকটা অন্ধকারে ডুবে ভেসে মিলিয়ে যাচ্ছে ওদের গলির শেষে!

আর ওর আচমকা মনে পড়ে গেল সেই একজনের কথা! সেও এমন বলত না! মানুষের জন্য কাজ করার কথা বলত না! তাকে কোথায় যে হারিয়ে ফেলল স্মাহি! তখন যার কথা মনে নিত না, এখন এক ভাঙাচোরা পৃথিবীর নানান গলিঘুঁজি ঘুরে বুঝতে পারছে সেই মানুষটাই ঠিক ছিল! ওর জন্য একদম ঠিক ছিল!

আবছায়া গলিতে দাঁড়িয়ে পাখির খাঁচার পাশে এসে দাঁড়ানো সেই ছেলেটার জন্য আচমকা চোখে জল এল স্মাহির! সেই শেষ দিনের মতো যেন আবার দেখতে পেল মাথা নামিয়ে, নরম আলোছায়া মোড়া গলি দিয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে সে!

৪ ঋত্বিজ

আজ বৃষ্টি পড়ছে খুব। চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি পড়ছে খুব। কালো, গোল্লা পাকানো মেঘ ঝুঁকে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে কৃষ্ণচূড়া গাছেদের মাথা। ভেজা কাক সার দিয়ে বসে আছে ভাঙা বিলবোর্ড জুড়ে। রাস্তায় জমে থাকা জল ছিটিয়ে হুশ করে চলে যাচ্ছে গাড়ি! আর এই সবের মধ্যে দিয়ে লোকটা হাঁটছে। নীল একটা ওয়াটারপ্রুফ পরে মাথা নিচু করে হাঁটছে। এই লোকটাই কি সে, যাকে ও খুঁজছে! সেই কি আজ আচমকা এসে ধরা দিল সামনে? এমন এক বৃষ্টির দিনে সেই কি ওভাবে হেঁটে যাচ্ছে? দ্রুত এগোল তিজু। লোকটা ক্রমশ যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। আর অনেক অনেক মেঘ কী করে যেন নেমে আসছে মাটির কাছাকাছি। নীল ওয়াটারপ্রুফ যেন আরও ডুবে যাচ্ছে মেঘের মধ্যে! তিজু হাঁটার গতি বাড়াল। লোকটা ক্রমশ আবছা হয়ে আসছে আরও। যেন ঘষা কাচের ওপারের কাল্পনিক কোনও মানুষ! তিজু জোরে দৌড় শুরু করল এবার। পিছল ফুটপাথ দিয়ে দ্রুত এগোল সামনে। বৃষ্টিটা বাড়ল আরও! আরও সুচের মতো এসে বিঁধল ওর মুখে, শরীরে। তবু থামল না তিজু। ওই মিলিয়ে যাচ্ছে নীল বর্ষাতি! মিলিয়ে যাচ্ছে ওর জীবন থেকে! মেঘ, আরও মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে মানুষটাকে! তিজু আরও গতি বাড়াল। দ্রুত মেঘ ভেদ করে এগোতে লাগল। আরও আবছা হয়ে এল সামনের মানুষটা। তিজু প্রাণপণে এগোল মেঘের তুলো সরিয়ে। আর তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘দাঁড়াও!’

ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে বসল তিজু! সারা শরীর ঘেমে গিয়েছে ওর। মাথাটা কেমন করছে! কী হল এটা? কী দেখল ও! সামনে পেয়েও কি ধরতে পারল না মানুষটাকে?

বিছানায় বসে কিছুটা সময় দিল ও নিজেকে। এমন জীবন্ত একটা স্বপ্ন হতে পারে!

মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল তিজু। তারপর পাশ ফিরে ঘড়িটা দেখল। সাড়ে পাঁচটা বাজে। বালিশের পাশে একটা বই উপুড় করে রাখা। দুপুরে খাবার পরে পড়ছিল। আর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি!

এমন করে বিকেলে ঘুমোনোর অভ্যেস নেই তিজুর। ও গায়ের থেকে পাতলা চাদরটা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। মাথার থেকে কিছুতেই ওই ছবিটা যাচ্ছে না। একটা লোক মেঘের মধ্যে ডুবে, হেঁটে, মিলিয়ে যাচ্ছে ওর জীবন থেকে!

তবে কি ও কিছুতেই লোকটাকে খুঁজে পাবে না? এতদিন ধরে কি তবে বৃথাই বসে আছে কলকাতায়?

দশ বছর আগে শেষ ও এসেছিল এই শহরে! তখন কী আনন্দ ছিল ওর মনে! কী ভাল ছিল জীবন! আর তারপর থেকে কী যে হল। সব কেমন ঝরা পাতার মতো ঝরে হারিয়ে গেল জীবনের হেমন্তের পথে! এই চুয়াল্লিশে আসতে আসতে আর কিছুই হাতে পড়ে নেই ওর! তাই তো ওই মানুষটাকে খুঁজে বের করা দরকার! এই জীবনে এখনও যে ওর একটা অস্তিত্ব আছে সেটা ওর নিজের কাছে একবার প্রমাণ করা দরকার!

নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে বসার ঘরে এল তিজু। এই ফ্ল্যাটটা ছোট। একটা বেডরুম, একটা ড্রইং কাম ডাইনিং, একটা বাথরুম আর এক চিলতে বারান্দা আছে। ইচ্ছে করেই ও বড় ফ্ল্যাট নেয়নি। দরকার নেই তো! এই লেক গার্ডেন্সের ভেতরে, এক কোনায় ছোট্ট এই ফ্ল্যাটটাই ঠিক আছে। জগন একদম ওর মনের মতো ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিয়েছে! ছেলেটা খুব এফিশিয়েন্ট! আর বিশ্বস্ত! এক সঙ্গে এমন দুটো গুণ এখন খুব একটা পাওয়া যায় না!

কলকাতায় এসে কিছুদিন থাকবে বলায় প্রথমে জগন খুব অবাক হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন দাদা? হঠাৎ কলকাতায় থাকবেন কেন?’

তিজু বলেছিল, ‘কারণ আছে। পারসোনাল। একটা ছোট ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিতে হবে তোকে। ভাড়ায়। আর দেখবি কেউ যেন না জানে। আমি কাউকে বলছি না কোথায় থাকব।’

জগন হেসেছিল, ‘সে তো কেউ জানবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তবে একটা ব্যাপার। কোনও লাফড়া হয়নি তো? মানে আর ইউ অ্যাবস্কন্ডিং?’

‘তোর মাথা খারাপ? আমি কি ক্রিমিনাল? আমার নিজের একটা কাজ আছে! তাই আই নিড স্পেস! তুই পারবি তো জোগাড় করতে?’

তা জগন পেরেছে। লেক গার্ডেন্সের ভেতরে একদম নির্জন একটা জায়গায় খুঁজে দিয়েছে মাথা গোঁজার জায়গা।

এখানে একজন কাজের দিদিও ঠিক করে দিয়েছে জগন। সে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদি সব কিছু করে দিয়ে যায়।

জগন শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘খুব পারসোনাল কাজ নাকি দাদা? মানে তেমন হলে আমায় বলতে পারেন!’

তিজু শুধু বলেছিল, ‘তেমন হলে বলব।’

জগন আর কথা বাড়ায়নি। চলে গিয়েছিল।

জগন বিহারের মানুষ। কিন্তু এখানে দীর্ঘ দিন থাকার ফলে ভাল বাংলা বলে। জগন বেঁটে। মাথার চুলগুলোয় কেমন একটা লালচে রঙ করা। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। মোটা গোঁফ! সারাক্ষণ পানমশলা খায়!

জগনের সঙ্গে তিজুর যোগাযোগ বেশ কয়েক বছরের। জগন যে আসলে কী করে সঠিক করে তিজু জানে না। কেউ বলে ও পুলিশের খোচড়। কেউ বলে ড্রাগ সাপ্লাই করে! কেউ আবার বলে, জগন আসলে সংসার মাঝে সন্ন্যাসী! কিন্তু আসলটা কী সেটা কেউ বলতে পারে না!

তিজুও সেভাবে জিজ্ঞেস করেনি কোনওদিন! তবে জগন একবার বলেছিল, ‘জীবনে তো কম কিছু কাজ করলাম না! শেষে দেখলাম কিছু না করাই সবচেয়ে ভাল! তাই আমি আর কিছু করি না! দেশে জমি আছে। বাবা দাদারা টাকা পাঠিয়ে দেয়! ব্যস আমি এখন রিটায়ার্ড!’

বত্রিশ বছর বয়সে রিটায়ার্ড! হাসি পায় তিজুর জগনের কথা ভেবে!

তবে সপ্তাহে একদিন করে আসে জগন। এই যেমন গত পরশু সকালেও এসেছিল।

তিজু নিজে কফি করে দিয়েছিল জগনকে। জগন কফির কাপে শব্দ করে চুমুক দিয়ে বলেছিল, ‘একা কী করে থাকেন দাদা! মোবাইলও রাখেন না একটা। রাতবিরেতে বিপদ হলে কী যে হবে!’

‘আমার কিছু হবে না!’ তিজু হেসেছিল।

জগন বলেছিল, ‘আপনি একটুও নিজের কথা ভাবেন না! এমন করলে হবে!’

নিজের কথা ভাবে না! সেকী! ওকে তো সারা জীবন সবাই বলে এল ওর মতো স্বার্থপর আর কেউ নেই! ওর মতো নিজের কথা কেউ ভাবে না! সবাই বলে এল, ‘এই জন্য তোর সঙ্গে কেউ টিকতে পারবে না! এই জন্য তোর বউ তোকে ছেড়ে চলে গেছে!’

কথাটা মনে পড়তে এখন এই আধো অন্ধকার সন্ধেবেলাতেও কেমন একটা লাগল তিজুর! বসার ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো বড় আয়নায় নিজের অস্পষ্ট ছায়া দেখল। লম্বা একটা রাক্ষস যেন! সবাইকে খেয়ে নিয়ে এখন একা হয়ে গিয়েছে!

মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করল তিজু। তারপর ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল! সন্ধেবেলা আলো জ্বালাতে হয়, মা বলত। তখন এসব মানত না তিজু। কিন্তু এখন মানে! গত দেড় মাস আগে মা মারা গিয়েছে। আর যে মানুষটা জীবিত থাকতে ওর দামালপনাকে সামলাতে পারেনি, সেই মারা যাওয়ার আগে শুধু একটা কথায়, মাত্র একটা বাক্যে পালটে দিয়ে গিয়েছে ওর সারা জীবন!

বেসিনের কল খুলে ভাল করে চোখ মুখ ধুল তিজু। তারপর পাশে ঝোলানো তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছল। বেশ শীত করছে। ওকে বেরোতে হবে। আনোয়ার শাহ রোডের কাছে একজনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে! ভদ্রলোক নাকি পুরীতে গিয়েছিলেন ঘুরতে। আজ সকালে ফেরার কথা। ওর বড় ছেলের সঙ্গে দেখা করেছিল তিজু। সেই বলেছে আজ সন্ধেবেলা গেলে দেখা হবে। দেখা যাক তার কাছ থেকে কিছু জানা যায় কিনা!

সামান্য খিদে পেয়েছে। এখন কিছু বানাতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে থেকে কিছু না হয় খেয়ে নেবে। ও দেওয়ালের হুক থেকে চাবিটা নিয়ে চারিদিকে দেখল। তারপর একটা জ্যাকেট চাপিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

ওর ফ্ল্যাটটা চার তলায়। কিন্তু কিছুতেই ও লিফট ব্যবহার করে না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে ওর ভাল লাগে। আজও সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামতে লাগল তিজু। আর দোতলার বাঁকে দেখা হয়ে গেল নীপার সঙ্গে। এই ভয়টাই পাচ্ছিল তিজু।

‘হাই, আজও সিঁড়ি দিয়ে!’ সিঁড়ির একপাশে বসে সিগারেট খাচ্ছিল নীপা। তিজু ভাবল সামান্য হেসে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে।

কিন্তু নীপা খপ করে হাত ধরল ওর, ‘নট সো ফাস্ট মিস্টার! অত তাড়া কীসের? কোথায় যাচ্ছ?’

নীপা মেয়েটা অদ্ভুত! বয়স বড় জোর কুড়ি একুশ! কেমন ছেলেদের মতো পোশাক-আশাক করে থাকে। ছোট চুল। আর সারা গায়ে পাঁচ ছটা ট্যাটু। তিজুর খুব একটা ভাল লাগে না এমন মানুষদের! কেমন প্রিটেনশাস লাগে! ‘ওয়ান্নবি’ লাগে!

নীপা বলল, ‘তুমি আমার কথায় উত্তর দাও না কেন? ইউ থিঙ্ক আয়াম বিনিথ ইউ?’

‘না, আয়াম ইন আ হারি!’ চট করে বলল তিজু।

‘ইউ আর অলওয়েজ ইন আ হারি! কেন? আমাদের দেশে সবাই ইন আ হারি! কিন্তু দেখো, তাও কোনও কাজ টাইমে হয় না! কোনও প্রজেক্ট শেষ হয় না। কোনও কমিশন তার রেজাল্ট জানায় না! এই তোমরা মিডিল এজেড মানুষগুলো এমন নকল ব্যস্ততা দেখিয়ে দেশটার সর্বনাশ করলে!’

‘নীপা, প্লিজ হাত ছাড়ো। আই হ্যাভ টু গো। প্লিজ।’ তিজু শান্ত গলায় বলল। কিন্তু ওর বলার মধ্যে এমন একটা দূরত্ব ছিল যে নীপা ছেড়ে দিল হাতটা।

তিজু আর সময় নষ্ট না করে নেমে গেল। শুধু শুনল পেছন থেকে নীপা বলছে, ‘একদিন দেখো আর ছাড়ব না!’

এখানে আসার চার দিনের মাথায় নীপার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তিজুর। ও আর কারও সঙ্গে কথা বলে না। নিজের মনে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। কিন্তু নীপা শোনার মেয়ে না। গায়ের ওপর উঠে আলাপ করেছিল।

এই ফ্ল্যাটের নীচে একটা গারাজ আছে। সেখানেই এক পাশে ওর মোটর বাইকটা রাখে তিজু। অলিভ রঙের রয়্যাল এনফিল্ড মোটর বাইক। সাইডকার লাগানো। জগনের মাধ্যমেই কিনেছে ও।

সাইড কারের মধ্যেই হেলমেটটা রাখে ও। সেটা বের করে মাথায় চাপিয়ে নিল তিজু। তারপর বেরিয়ে গেল।

বাইরে ঠান্ডা আছে বেশ। এখানে গলির মধ্যে রাস্তাগুলো খুব একটা চওড়া নয়। উলটো দিক থেকে কোনও গাড়ি এসে গেলে মুশকিল হয়। তিজু দ্রুত বড় রাস্তার দিকে এগোল। ছটা বেজে গিয়েছে। একবার ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে একটা সাইবার ক্যাফেতে যাবে। ইমেল চেক করতে হবে। ব্যারি কিছু মেল পাঠিয়েছে কিনা দেখতে হবে! বেচারা রেগে আছে খুব। এখানে মোবাইল, ল্যাপটপ কিছু নিয়ে আসেনি তিজু। ব্যারিকে আগে বলেছিল দিল্লিতে সব সেট আপ করে দেবে ও। কিন্তু এখনও সেভাবে কিছু করে দিতে পারেনি। ব্যারি তো শেষ ইমেলটায় রেগেমেগে অন্য সবার মতো ওকে সেলফিস, মেগালোম্যানিয়াক ইত্যাদি ভারী ভারী গালি দিয়েছে।

অবশ্য তাতে ব্যারিকে দোষ দেয় না তিজু। যে কেউ হলেই দিত। ট্র্যাভেলের ওপর ব্যারিদের যে আন্তর্জাতিক একটা ম্যাগাজিন আছে তার একটা ব্রাঞ্চ ওরা খুলতে চায় দিল্লিতে।

ওইটাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ওরা ট্র্যাভেল নিয়ে কাজ করতে চায়। তা ছাড়া হিন্দিতেও একটা ট্র্যাভেল বিষয়ক চ্যানেল লঞ্চ করতে চায় ব্যারিরা। সেখানে তিজু সাহায্য করবে বলেছিল। তিজুকে ওরা চ্যানেল হেড করবে ঠিক ছিল। কিন্তু তখনই মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। মারা গেল। আর যাওয়ার আগে এমন একটা কথা বলে দিয়ে গেল যে তিজুর এখন সবটাই গোলমাল পাকিয়ে গেছে!

রাস্তাটা এখানে এসে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। ডানদিকে একটা বড় ছাতিম গাছ আর বাঁদিকে মাদার ডেয়ারির দুধের ডিপো! তিজু বাঁদিকে মোড় নিল। আর তখনই দেখল মেয়েটাকে। মাথা নামিয়ে কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এখানে আলো কম, তাও চিনতে পারল। সেদিন ওই সিঙাড়ার দোকানে দেখেছিল মেয়েটাকে। দোকানি বয়স্ক লোকটা কেমন একটা খিটখিট করছিল! আর মেয়েটা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়েছিল।

তিজু দেখেছে অসভ্য, খারাপ মানুষদের সামনে ভাল মানুষেরা কেমন যেন দিশেহারা হয়ে যায়। তাই ও এগিয়ে গিয়েছিল নিজের থেকে। সামান্য একটা একশো টাকার খুচরো! সেটার জন্য কেন কেউ হেনস্থা হবে?

আজকাল রাস্তাঘাটে কাউকে না কাউকে সাহায্য করার চেষ্টা করে তিজু। মানে এক রকম গায়ে পড়েই করে! কেউ কেউ ওকে ভুল বোঝে এতে! কিন্তু তাতে কিছু মনে করে না ও! মানুষ তো এমনই! আসলে খারাপ আর নোংরামো দেখে দেখে আমরা সবাই সেটাকে স্বাভাবিক আর বাস্তব ধরে নিয়েছি। তাই কেউ কারণ ছাড়া যে আমাদের সাহায্য করতে পারে সেটাই ভুলে গিয়েছি আমরা!

তিজু সারা জীবন অন্যের কথা ভাবেনি। শুধু নিজের কষ্ট, নিজে সাফল্য নিয়েই ভেবেছে। তাই তো জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাও আর নেই!

এখন আশেপাশে সবাইকে সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করে। না, তার পরিবর্তে কিছু চায় না ও। শুধু নিজের ভেতরের আসল ঋত্বিজকে বাঁচাতে চায়। ও এখন বোঝে মানুষের সবার মধ্যেই হয়তো মাঝে মাঝে এমন ইচ্ছে আসে। কিন্তু সেগুলো আমরা ক্ষণিকের দুর্বলতা ভেবে এড়িয়ে যাই। কিন্তু তিজুর মনে হয় আসলে এইসব হল আমাদের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার কলিং!

লেক গার্ডেন্স স্টেশান থেকে সাদার্ন আভিউনিয়ের দিকে যেতে একটা পাগলকে বসে থাকতে দেখে তিজু। লোকটা সারাক্ষণ ময়লা কাগজপত্র নিয়ে কিছু লেখে। সেই লোকটাকে একদিন টাকা দিতে গিয়েছিল তিজু।

লোকটা টাকাটা নিয়ে জামার হাতার মধ্যে গুঁজে বলেছিল, ‘আর কাগজ কলম? সেটা কে দেবে? আমি না লিখলে তোমাদের কী হবে ভেবেছ? তোমাদের জীবনটা কী করে এগোবে আমি না লিখলে? আমায় কাগজ আর কলম এনে দেবে। মনে থাকে যেন।’

তা দিয়েছে তিজু। পরের দিন দুটো সাদা খাতা আর কয়েকটা পেন্সিল, ইরেজার আর পেন দিয়ে এসেছে।

লোকটা খুশি হয়ে সেসব নিয়ে বলেছিল, ‘যাও, এবার তোমার গল্পটা ভাল করে লিখে দেব। চিন্তা কোরো না! সব ঠিক হয়ে যাবে!’

কেন কে জানে তিজু উত্তর দিয়েছিল, ‘নাঃ, কিছু ঠিক হবে না!’

লোকটা মাথা তুলে তাকিয়েছিল সটান। তারপর আচমকা বলেছিল –

‘All that is gold does not glitter,

Not all those who wander are lost;

The old that is strong does not wither,

Deep roots are not reached by the frost.

From the ashes a fire shall be woken,

A light from the shadows shall spring;

Renewed shall be blade that was broken

The crownless again shall be king.’

কী বলবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল তিজু। এ কে!

লোকটা হাসি মুখে বলেছিল, ‘যাও এবার, তোমাদের কথা লিখতে দাও আমায়!’

পাগলের ওই খুশিটকুই এখন তিজুর রোজগার। মেয়েটার সেদিনের স্বস্তির নিশ্বাস্টুকুই ওর ভাললাগা! এতদিনে ও বুঝেছে অন্যের জন্য যদি ও একটুও চিন্তা করত আজ হয়তো এমন একলা আর নিঃসঙ্গ হয়ে যেত না ওর জীবনটা!

‘দাদা!’ আচমকা একটা পরিচিত ডাকে মোটর বাইকটা থামাল তিজু। জগনের গলা না!

ও ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল। ঠিক তাই। জগন এখন কী করছে এখানে!

‘কী হয়েছে?’ বাইক থামিয়ে জিজ্ঞেস করল তিজু।

জগন দৌড়ে এসে দাঁড়াল সামনে। কপালে ওর ঘাম। মোটা শরীরটা শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ঢেউয়ের মতো ওঠাপড়া করছে।

‘আরে হাঁপাচ্ছিস কেন?’ তিজু অবাক হল।

জগন বলল, ‘বিশাল খবর। বউদি এসেছে।’

‘মানে?’ অবাক হল তিজু। কী বলছে কী জগন!

‘দাদা আপনি কেন এমন লুকিয়ে আছেন বলুন তো? কিছু হয়েছে কি? নাহলে… নাহলে নিরমুক্তা বউদি কেন আপনাকে খুঁজতে আসবে কলকাতায়?’

৫ নিরমুক্তা

আত্মীয়স্বজন ব্যপারটাকে চিরকাল খুব ভয় লাগে মুকুর। এরা কী শোনে, কী বোঝে আর কী বলে সেটা এরা নিজেরাও জানে না! বিয়ের পরে দেখেছিল তিজুও আত্মীয়দের এড়িয়ে থাকে। ফলে মুকুকে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সামনেও বিশেষ যেতে হয়নি।

এমনিতেই মুকু ছোটবেলা থেকে স্বাধীনচেতা ধরনের। যেটা সত্যি মনে হয় শান্ত গলায় জানিয়ে দেয়! এমন মেয়েদের কে আর পছন্দ করে? ফলে আত্মীয়দের মধ্যে খুব একটা পপুলার নয় মুকু। আর সত্যি বলতে কী ও পপুলার হতেও চায় না। জীবন তো আর পপুলারিটি কনটেস্ট নয়! মিথ্যে করে কাউকে তোষামোদ করা মুকুর ধাতে নেই! কিন্তু এখন এমন একটা ব্যাপারে ও এসেছে যে ইচ্ছে না থাকলেও ওকে এইসব মানুষগুলোর সামনে যেতে হবে।

গাড়ির মধ্যে বসে ব্যাগ খুলে একটা ছোট আয়না বের করল মুকু। একবার দেখে নিল নিজেকে। আজ ওকে যেতে হচ্ছে কলেজ স্ট্রিটের ওদিকে। তিজু দীপনদের এক পিসি থাকেন ওখানে।

তিজুর কাছে এই পিসির কথা শুনেছিল মুকু। শুনেছিল, পিসির বিয়ে হয়েছিল উত্তর কলকাতার এক বনেদি বাড়িতে! তাঁদের বেদম পয়সা ছিল এক সময়! আর তার সঙ্গে ছিল সাঙ্ঘাতিক গোঁড়ামি। এখন শুনেছে পয়সা কমে গেলেও গোঁড়ামি কমেনি।

মুকু প্রথমে ভেবেছিল শাড়ি পরে যাবে কিনা। কিন্তু তারপর মনে পড়েছিল ওর। আরে শাড়ি তো সঙ্গেই নিয়ে আসেনি। আসলে এখানে যে আসতে হবে তাই তো জানা ছিল না। আর শাড়িই বা পরতে যাবে কেন? কে এখন ও এই পরিবারের? কেউ না! দীপনের কথায় ও সাহায্য করছে শুধু!

দীপনের কথাতেই কি শুধু সাহায্য করছে? শেষের এই কথাটা মনে পড়তেই কেমন যেন একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি লাগল মুকুর। ও সচকিত হয়ে উঠল। ও সত্যি কেঁপে উঠল, নাকি গাড়িটা কোনও গর্তে পড়েছিল?

ছোট্ট আয়নাটা ব্যাগের ভেতরে রেখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল মুকু। শীতের কলকাতা। দুপুরের রোদটা কেমন যেন কালচে ধরনের। মনখারাপ করা! গাড়ি শিয়ালদা ফ্লাই ওভারে উঠেছে। ডানদিকে শিয়ালদা স্টেশান দেখা যাচ্ছে। ওই তো বড় ডিজিটাল ঘড়ি। আর কী সব কনস্ট্রাকশান চলছে যেন!

দশ বছর পরে কলকাতায় এসে সব খুব নতুন লাগছে মুকুর। শহরটার এখানে ওখানে নানান ভাবে পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে ফ্লাইওভারের রিবন। দৈত্যের কেটে নেওয়া পায়ের মতো বিশাল লম্বা বাড়ি উঠেছে! আর চারিদিকে কী বিশাল সব ক্রেন! যেন কোনও বড় বড় কাঁটা চামচ কেউ গেঁথে রেখেছে খাবারে!

এই হিজিবিজি ভিড়ের মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে তিজু! কেন এমন সবাইকে না বলে চলে গেছে বাড়ি থেকে? কী হয়েছে? দীপন কিছু বলেছে কি? নাকি দীপনের স্ত্রী স্বপ্না কিছু বলেছিল? কিন্তু স্বপ্না তো অপমানজনক কিছু বলার মতো মেয়ে নয়। দীপনও ওর দাদাকে খুব ভালবাসে! তাহলে? মায়ের মৃত্যুর পরে কি তাহলে ডিপ্রেশানে চলে গিয়েছিল তিজু! দীপনকে এমনটাই জিজ্ঞেস করেছিল মুকু।

কাজ শেষ করে নিজের হোটেলে সেদিন একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছিল মুকু। ভাবছিল আর দু’দিন পরে কাজ সেরে ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে থাকবে কিছু দিন। তারপর দেখবে প্রিতম যেমন বলেছে সেভাবে ছুটি কাটানো যায় কিনা!

এমন সময় ফোনটা পেয়েছিল ও। দীপন! ফোনটা ধরে অবাক হয়ে গিয়েছিল মুকু। তিন বছর হল, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই মুকুর। ডিভোর্সের পরে সব তো মিটে গেছে! আর কেন শুধু শুধু পিছুটান বাড়াবে?

তাও এত বছর পরেও ফোনে দীপনের গলাটা চিনতে অসুবিধে হয়নি ওর। আর সত্যি বলতে কী, বুকটা কেমন যেন কেঁপেও উঠেছিল। মনে খারাপ চিন্তা এসেছিল! দীপন কেন ফোন করল? কোনও খারাপ খবর নাকি?

দীপন বলেছিল, ‘বউদি কেমন আছ? আমি দীপন।’

কেমন আছ জিজ্ঞেস করতে তো আর ফোন করেনি দীপন, সেটা বাচ্চা মেয়েও বুঝতে পারবে। প্রাথমিক অস্থিরতা কাটিয়ে নিজেকে কেমন একটা খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছিল মুকু। কেন কে জানে ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল!

ও বলেছিল, ‘ভাল আছি। তোমরা?’

দীপন সময় নিয়েছিল একটু। তারপর বলেছিল, ‘আমরা খুব ভাল কিছু নেই! মা তো মাস দেড়েক আগে মারা গেল। আর তারপর…’

‘তারপর?’ কেমন যেন গলাটা বুজে আসছিল মুকুর। কোনও খারাপ খবর কি?

দীপন সামান্য থেমে বলেছিল, ‘আসলে একটা বিপদ হয়েছে। দাদাকে পাওয়া যাচ্ছে না!’

‘কী?’ প্রথমে বুঝতে পারেনি মুকু।

‘দাদাকে পাওয়া যাচ্ছে না বউদি। মোবাইল, ল্যাপটপ সব ফেলে রেখে দিয়ে দাদা চলে গিয়েছে কলকাতায়!’

‘কলকাতায় গিয়েছে কেন বলছ? পাওয়া যাচ্ছে না যখন তখন এটা জানলে কেমন করে?’

দীপন বলেছিল, ‘আরে যাওয়ার আগের দিন স্বপ্নাকে রাতে বলেছিল, কলকাতায় একটা কাজ আছে। ব্যাস। সকালে উঠে দেখি নেই। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। যোগাযোগও করতে পারছি না। খুবই চিন্তা হচ্ছে। তাই তোমায় ফোন করলাম!’

‘আমায়?’ মুকু খুব অবাক হয়েছিল।

‘আর দাদার কে আছে? আমরা আর তুমি! আর কেউ তো নেই!’

দীপন এমন করে কথাটা বলেছিল যে মুকু বলতে পারেনি, তিন বছর হল সব চুকেবুকে গিয়েছে!

মুকু শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা মারা যাওয়ার পরে কি ডিপ্রেশানে ভুগছিল তোমার দাদা? মানে এমন হঠাৎ হল কেন? কী জন্য কলকাতায় গিয়েছে?’

দীপন সামান্য থমকে গিয়ে বলেছিল, ‘আসলে মানে… আমি ঠিক… মানে… তুমি প্লিজ একটু গিয়ে দেখবে?’

‘কিন্তু আমি কী করব?’ মুকু অবাক হয়েছিল।

দীপন বলেছিল, ‘বউদি আমার তো জানোই হুইলচেয়ারে জীবন কাটে। আমি যে খুঁজতে যাব সেটা সম্ভব নয়। আর আমাদের কোম্পানির লোকজনকে এতে ইনভলভ করতে পারব না। তাই তোমায় রিকোয়েস্ট করছি।’

‘পুলিশে যাচ্ছ না কেন?’ মুকু জিজ্ঞেস করেছিল।

‘পাগল নাকি! আমাদের স্ক্যান্ডাল হয়ে যাবে। কোম্পানির রেপুটেশান ঝাড় খাবে। প্লিজ বউদি। ফর ওল্ড টাইমস সেক! একটু দেখো প্লিজ!’

‘কিন্তু দীপন তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমরা কিন্তু ডিভোর্সড। আমাদের মধ্যে আর যোগাযোগ নেই। লাস্ট তিন বছরে তো আমার জীবনটাও পালটে গিয়েছে। সেখানে আমায় কেন বলছ? আমি কে?’

‘জানো বউদি তুমি যে গোল্ড ব্যান্ডের মতো আংটিটা দাদাকে দিয়েছিলে, সেটা দাদা আজও পরে থাকে হাতে। আজও তোমার আর দাদার ছবি বেডসাইড টেবলে রেখে দিয়েছে!’

‘কিন্তু এসব আমায় বলছ কেন? আমি তো কেউ নই আর!’ মুকু নিজেকে ছিঁড়ে আনতে চাইছিল ঘটনা থেকে।

‘তাই কি?’ দীপন বলেছিল, ‘তুমি একবার নিজেকে জিজ্ঞেস করো! তুমি ছাড়া আর কেউ নেই বউদি। এটা কি তুমি জানো না?’

ব্রিজের থেকে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে গাড়িটা আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে এগোচ্ছে। এদিকে খুব ভিড়। যেন জট পড়া একটা শহর। চারিদিকে পুরোনো বাড়ি ঘর। ইট বের করা থাম! কারুকাজ খসে পড়া দেওয়াল। ভাঙা ঝরোকা। চলটা ওঠা পরীর মূর্তি! এককালের সুন্দরী এখন যেন বাতিল হয়ে ঘরের কোনায় পড়ে আছে!

মুকু কলকাতার মেয়ে নয়। কিন্তু দশ বছর আগে তিজুর সঙ্গে এসে এমন করে ঘুরেছিল ও যে এই শহরটাকে ভাল লেগে গিয়েছিল খুব! কিন্তু আজ কেমন যেন অসহায় লাগছে। নিজের ওপর রাগও হচ্ছে! কী দরকার ছিল দীপনের সেন্টিমেন্টাল কথায় কান দেবার! কেন এল ও এখানে! ছুটি পেল এত দিন পরে, সেটা কেন এভাবে নষ্ট করছে!

ভাড়ার গাড়িটা ওকে ঠিকানা অনুযায়ী বড় বাড়িটার সামনেই নামিয়ে দিল।

মুকু রাস্তায় নেমে ভাল করে দেখল বাড়িটাকে। আঁকাবাঁকা গলির মধ্যে বড় বাড়ি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শেষ চল্লিশ বছরে হাত পড়েনি এর গায়ে। একপাশের একটা ঝুলবারান্দা তো প্রায় ভেঙে পড়ে গিয়েছে! নানান জায়গা দিয়ে মোটা গাছ বেরিয়েছে। তবে যেটুকু কারুকাজ আর থাম-খিলান এখনও ঠিক আছে তাতে বোঝা যাচ্ছে এক সময় এই বাড়ির সৌন্দর্যই অন্যরকম ছিল।

বাড়ির সামনের দরজাটা খোলা। সেটা দিয়ে ভেতরে ঢুকল মুকু। সরু গলির মতো জায়গা দিয়ে এগিয়ে একটা খোলা চৌকোনো উঠোনে পড়ল ও। দেখল একটা লোক বসে আছে ভাঙাচোরা চেয়ারে। লোকটার গালে খোঁচা সাদা দাড়ি। পরনে নীল চেক কাটা লুঙ্গি আর একটা চা-রঙের হাই নেক সোয়েটার। লোকটার বয়স সত্তরের ওপরেই মনে হল ওর। মাথায় ঘন সাদা চুল। তেল দিয়ে পাট করে ব্যাক ব্রাশ করা।

লোকটা ঘোলাটে চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে।

মুকু জিজ্ঞেস করল, ‘বিভাবরীদেবী এখানে থাকেন?’

লোকটা সময় নিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর হাত দিয়ে একটা সিঁড়ির দিকে দেখাল।

মুকু দেখল সরু একটা সিঁড়ি উঠোনের এক পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে দোতলার দিকে। এরও প্লাস্টার খুলে গিয়েছে। চারিদিকে মরে যাওয়া শ্যাওলা খয়েরি হয়ে ছেড়ে যাওয়া সাপের খোলসের মতো লেগে আছে সিঁড়ির গায়ে!

লোকটা হাত দিয়ে সিঁড়ি দেখিয়ে দিয়ে আবার মাথা নিচু করে নিয়েছে! মুকু আর ঘাঁটাল না। ও সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল। দোতলার জানলা দেখা যাচ্ছে। ভাঙাচোরা জানলা। কোনও কোনওটা আবার দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে।

সিঁড়ির শেষে একটা লোহার গ্রিলের দরজা। সেটা পার করে সরু বারান্দা। কী করবে বুঝতে পারল না মুকু। বারান্দায় দুটো টেবল রাখা। তারপর রাজত্বের হাবিজাবি জিনিস স্তূপ করা। টেবলের ওদিকে একটা খোলা দরজা দেখা যাচ্ছে। আর সেটা ছাড়িয়ে এই সরু দালানটা সামনে এগিয়ে গিয়েছে তিনতলায় উঠে যাওয়া আরেকটা সিঁড়ি অবধি!

‘বিভাবরী দেবী!’ মুকু এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল দু’বার।

সামান্য সময় পরে উত্তর এল, ‘কে রে? কে ডাকছিস?’

‘আমি…’ আর কী বলবে বুঝতে না পেরে মুকু এগিয়ে গিয়ে দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল।

দেখল, একটা পুরোনো দিনের বড় পালঙ্ক! তাতে আরও পুরোনো একজন ভদ্রমহিলা বসে রয়েছেন। পরনে সাদা শাড়ি। চোখে মোটা কাচের চশমা। মুখে অজস্র ভাঁজ!

‘কে গো তুমি? কাছে এসে বসো।’ বিভাবরী হাত তুলে ডাকলেন মুকুকে।

মুকু দরজার বাইরে জুতো খুলে ভেতরে ঢুকল। পালঙ্কের এক পাশে একটা হাতল ভাঙা চেয়ার! মুকু সেটায় বসল গিয়ে। ভাবল, এই বাড়িতে কি একটা জিনিসও আস্ত নেই?

বিভাবরী সামান্য এগিয়ে এলেন খাটের কোণায়, ‘কে গো মেয়ে তুমি? চিনলাম না তো? চিন্টুর কেউ?’

‘পিসিমা আমি নিরমুক্তা। ওই ঋত্বিজের…’ এইটুকু বলেই থমকে গেল মুকু। এই বয়সের মানুষকে কী বলবে ও! কী হয় ও ঋত্বিজের! ডিভোর্স-টিভোর্সের কথা এখানে বলার কোনও মানেই নেই!

‘কে সে? ঋত্বিজ কে?’ বিভাবরী অবাক হয়ে তাকালেন।

‘মানে… তিজু… আমি ওর স্ত্রী।’ শেষের কথাটা বলে কেমন একটা লাগল মুকুর।

‘তিজু… তিজু… ও দিল্লির তিজু! আমার রাজপুত্র!’ বিভাবরী হাসলেন, ‘কেমন আছে তিজু?’

‘পিসিমা, আসলে ও দিল্লি থেকে কলকাতায় এসেছে। কিন্তু কোথায় এসেছে, আমরা সেসব জানি না। তাই এসেছিলাম, বাই চান্স যদি এখানে এসে থাকে। মানে…’ মুকু আর কী বলবে বুঝতে পারল না।

‘সেকী!’ বিভাবরী উদ্বিগ্ন মুখে তাকালেন, ‘তিজুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! ও বেশ কিছুদিন আগে একবার এসেছিল আমার কাছে। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিল আমায়। কিন্তু তারপর তো আর যোগাযোগ নেই! মানে হঠাৎ এল আর হঠাৎ চলে গেল। এখন কী হবে?’

মুকু বুঝল এখানে আসাটাই পণ্ডশ্রম হয়েছে। ও আর সময় নষ্ট না করে উঠে দাঁড়াল। সত্যি এভাবে কি কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়! পূর্ণ বয়স্ক একটা মানুষ, সে যদি লুকিয়ে থাকতে চায়, তাহলে কে তাকে খুঁজে বের করবে। তাও পুলিশকে বললে তারা পারত হয়তো খুঁজে বের করতে। কিন্তু মুকু পারবে কী করে! ও কি পুলিশ নাকি?

মুকু বলল, ‘ঠিক আছে পিসিমা। সরি আপনাকে কষ্ট দিলাম। আমি আসি তাহলে?’

বিভাবরী কেমন যেন সামান্য সময়ের জন্য অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলেন। এবার ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আসবে? জানো তিজু আমাদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখত না। কিন্তু সেদিন কেন যে হঠাৎ এল! টাকাটা দিল। যদিও বড় বউমা সব নিয়ে নিয়েছে! আমায় কিছু আর দেয়নি!’

ও জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু কি বলেছে? মানে কিছু বলেছিল এসে?’

বিভাবরী সামান্য ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘নাঃ। শুধু টাকা দিয়ে চলে গেল! কিন্তু বড় বউমা…’ বিভাবরী কথাটা শেষ না করেই হাত বাড়ালেন সামনে, ‘মা-রে একটু কাছে আয়।’

মুকু কী করবে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইল বৃদ্ধার শিরা ওঠা হাতের দিকে। ওর কষ্ট লাগল। এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ধরল বিভাবরীর হাত।

বিভাবরী বললেন, ‘আমায় কিছু টাকা দিয়ে যাবি মা? আমার খুব অসুবিধে চলছে!’

মুকু ঘাবড়ে গেল! কী বলছেন বিভাবরী! ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

বিভাবরী বললে, ‘আমার বড় বউটা চামার। আমায় খেতে দেয় না। ওষুধ কিনে দেয় না। সারাক্ষণ গালি দেয়! আর ছেলেও হয়েছে তেমন। মাগভেড়ুয়া একদম! আমারই পাপের শাস্তি! তুই মা আমায় একটু কিছু দিয়ে যা! দয়া কর মা! তিজুর বউ তুই! তিজু থাকলে তিজুও দিত! মা-রে বুড়িটার কথা ফেলিস না মা!’

মুকু কী বলবে বুঝতে পারল না। কষ্ট লাগল খুব। এই বয়সে এমন করে কারও সামনে হাত পাততে কতটা খারাপ লাগতে পারে ও জানে! ও নিজেও খুব সাধারণ বাড়ি থেকেই এসেছে! এক সময় ওর মাকেও খুব কষ্ট করে বড় করতে হয়েছে ওকে!

মুকু একটু সময় নিল। তারপর নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগটা খুলল। আসলে নিজের কাছে খুব বেশি টাকা রাখে না ও। কার্ড আছে এখন! কেনই বা টাকা নিয়ে ঘুরবে! ও তাও দেখল। আড়াই হাজার টাকার মতো আছে! সেটাই বের করল মুকু। বিভাবরীর হাতে দিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটুকুই আছে পিসিমা। খুব বেশি নয়। তাও…’

‘এই অনেক মা! এই অনেক আমার কাছে! তুই খুব ভাল। একদম তিজুর যোগ্য! তোরা খুব ভাল থাকিস। তোদের ঘর আলো করে ঠাকুর আসুন!’

মুকু দেখল টাকা ব্লাউজের মধ্যে গুঁজে রাখলেন বিভাবরী! তারপর কেমন চুপ করে গেলেন! আবার ওকে সেই পথ হারানো মানুষের মতো লাগল মুকুর! সামান্য ভয়ও পেল ও। বৃদ্ধ বয়সে কার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে কে জানে!

রাস্তায় বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে এটিএম কাউন্টার খুঁজল মুকু। সব টাকা তো দিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে কিছু ক্যাশ রাখা দরকার। ও দেখল বেশ কিছুটা দূরে একটা কাউন্টার আছে। ও সেইদিকে পা বাড়াতে যাবে এমন সময় ব্যাগের ভেতর থেকে ফোনটা বেজে উঠল।

এখন আবার কে! সামান্য বিরক্ত হল মুকু। ফোনটা বের করে থমকে গেল ও। প্রিতম! গত দু’দিন ও ফোন করেনি প্রিতমকে। ওর ফোনও ধরেনি। মেসেজেরও উত্তর দেয়নি!

কেন এমন করছে ও সেটা নিজেই যেন বুঝতে পারছে না! মুকু সামান্য থমকে গেল! ও কি জানতে দিতে চায় না যে কেন ও এসেছে এখানে? নাকি প্রিতম জানলে কষ্ট পাবে বলে বলছে না? মুকু চোয়াল শক্ত করে ফোনটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

বিঠোফেনের নাইন্থ সিমফনি বেজে যাচ্ছে ফোনে! মুকু যেন মনে মনে দেখতে পাচ্ছে ফোনের ওই পারে চোয়াল শক্ত করে ভুরু কুঁচকে বসে আছে প্রিতম।

আচমকা রাস্তার উলটো দিকে একটা শব্দ হল। আর মুকু চমকে উঠে দেখল সামান্য দূরে একটা সাইকেল ধাক্কা মেরেছে একটা লোককে। সাইকেল চালক নেমে খুব চিৎকার করছে। আর অন্য লোকটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে চালকের দিকে। লোকটা বেঁটে খাটো। শক্ত পোক্ত চেহারা। মুখ চোখ বেশ শান্ত! লোকটা কিছুক্ষণ সাইকেল চালকের চিৎকার শুনল। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন মুখ করে পকেট থেকে একটা চিরুনি বের করে লাল রঙের চুলগুলো আঁচড়াতে লাগল!

মুকু তাকিয়ে দেখল ঘটনাটা। তারপর আচমকা যেন মনে পড়ে গেল হাতে ধরা মোবাইলের কথা। দেখল প্রিতম আবার ফোন করছে! বিঠোফেনের নাইন্থ সিম্ফনি ছোট ছোট ক্যান্ডিফ্লসের মতো ভেসে যাচ্ছে কলকাতার কালচে হলুদ রোদে! কী বলতে এতবার ফোন করছে প্রিতম!

৬ আদিত

এখানে আকাশ অনেক বেশি নীল। সকালে ট্রেন থেকে নেমে সেটাই প্রথম মনে হয়েছিল আদিতের। আর এখন সন্ধের মুখে ট্রেনে করে ফেরার সময় মনে হচ্ছে এখানে আকাশ অনেক বেশি গোলাপি।

মফসসলের শীতকালের একটা মজা আছে। দুপুর আর সন্ধের মাঝের বিকেলটা খুব অদ্ভুত একটা ঢালু বেয়ে ছড়িয়ে থাকে। আর বোঝার আগেই কেমন যেন মিলিয়ে যায়!

জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল আদিত। ট্রেন চলছে দ্রুত গতিতে। রেল লাইনের পাশের পোস্ট, গাছপালা পেছনে ছিটকে যাচ্ছে দ্রুত। যেন কেউ ছুড়ে ফেলছে তাদের! কিন্তু দূরের ধান কাটা মাঠ কেমন যেন শান্ত! তার ওপর কুয়াশা জমে আছে আইসক্রিমের মতো। যেন ইচ্ছে করলেই চামচ দিয়ে কেটে খেয়ে নেওয়া যায়! আর তারওপরে ছড়িয়ে আছে গোলাপি আকাশ! দেখলেই কেমন একটা মনখারাপ হয় আদিতের। বর্ধমানের সেই সময়গুলো মনে পড়ে যায়!

মনে পড়ে সেই বিরাট বাড়িটাকেও। তার সেই লম্বা বারান্দা! রঙবেরঙের কাগজকুচির মতো পাখি। আর নরম হাওয়াই চটি পরে সেই নিঃশব্দে এসে পাশে দাঁড়ানো সেই মেয়েটি!

আজও পাখির খাঁচায় আঁকড়ে ধরা সেই হাতের আঙুল ফিরে আসে। ফিরে আসে ওই ছোট্ট রঙ্গন ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁট! ছোট্ট মুকুট কপাল! আর আজও কী নিশ্চিতভাবে মরে যায় ও! নিজেকে বোঝায় আদিত। বলে, তোকে তো ফিরিয়ে দিয়েছে! তোকে তো তাড়িয়ে দিয়েছে! অপমান করেছে! তাহলে কেন? কেন মনে করিস আজও? মনে নেই শেষের দিনে কী বলেছিল? কী করে ঘুরিয়ে নিয়েছিল মুখ! ‘অন্য একজন’ ওর সব বলে কেমন করে তোকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল অন্ধকার একটা কুয়োর মধ্যে! তাহলে কীসের জন্য এমন করে আজও মনে করিস ওকে? কেন আজও কষ্ট পাস? কেন বারবার মনে মনে ফিরে যাস সেই লম্বা টানা বারান্দায়? কী আছে সেখানে? খাঁচা? কী আছে সেই খাঁচায়? নানান রঙের পাখি না তুই নিজে?

আদিতের মনে হল, ওই পেছন দিকে ছিটকে যাওয়া পোস্ট আর গাছপালার মতো নিজের অতীতটাকেও যদি এমন করে উপড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতে পারত!

‘মাইরি তুই আমার লস করিয়ে দিলি?’ পাশের থেকে মাকু চাপা গলায় বলল।

‘লস কীসের?’ আদিত দীর্ঘশ্বাস চেপে পাশে তাকাল।

মাকু ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ফালতু ট্রেনের টিকিট কাটালি! এই সময় চেকার দেয়? টাকাটা গেল আমার! শালা একটা পান হয়ে যেত ওটা দিয়ে!’

আদিত তাকাল মাকুর দিকে। রাজুদাকে বলে একটা কোম্পানিতে মাকুকে ছয় হাজার টাকার চাকরি করে দিয়েছিল। কিন্তু পাগলাটা যায়নি। ও নাকি পার্টি করবে! আরে এটা কি পেজ থ্রির পার্টি নাকি? বুঝিয়েছে ও মাকুকে। কিন্তু মাকুর মাথা ওয়ান ওয়ে ট্রাফিকের মতো। ও বলে, কিন্তু শোনে না কিছু! তাই আদিতের কথাও শোনেনি!

আজও ওর পেছন পেছন এসেছে এই ফ্যাক্টরিতে। রাজুদা বলেছিল, ‘মালটাকে নিয়ে যাচ্ছিস? দেখিস যেন ভুলভাল কিছু না বলে!’

আদিত মাকুকে পাখি পড়ানোর মতো করে বলেছিল যেন ফ্যাক্টরিতে গিয়ে কিছু না বলে। তা বলেনি কিছু মাকু। চুপচাপই ছিল। শুধু একবারই ফ্যাক্টরি ইউনিয়ানের সেক্রেটারি বাদলদাকে বলেছিল, ‘আপনারা কিন্তু স্ট্রাইক করবেন না যেন। দেশের খুব বিপদ হয়ে যাবে!’

আদিত ঘাবড়ে গিয়ে তাকিয়েছিল মাকুর দিকে। ফ্যাক্টরির মালিকরা ঠিক মতো মাইনে দিচ্ছে না। বোনাস দিচ্ছে না! এমন কী ই.এস.আই., পি.এফ. পর্যন্ত ঠিক মতো জমা দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে কী করা যায় সেই নিয়েই কথা বলতে গিয়েছিল আদিত। ইউনিয়ান রুমে বসেই কথা হচ্ছিল। সেখানে আচমকা মাকু এই ‘স্ট্রাইক করবেন না’ বলে পুরো আবহাওয়াটাকেই কেমন যেন ঘেঁটে দিয়েছিল।

বাদলদাও ঘাবড়ে গিয়েছিল। আসলে সামনে বছর ইউনিয়ানের নির্বাচন আছে। ফলে বাদলদার অনেক কিছু নির্ভর করে আছে এই দাবি আদায় আর শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে! আর আশেপাশে প্রায় জনা চল্লিশেক লোক ঘিরে বসে শুনছিল ওদের আলোচনা! সবার মুখে চোখেই কেমন একটা থমথমে ভাব ছিল। সেখানে কেউ ফস করে অমন কথা বলে!

বাদলদা প্রাথমিক থতমত ভাব কাটিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মানে? আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন? আমাদের রুজি রুটির ব্যাপার! মালিক এক কোটি টাকার গাড়ি চড়ে ঘোরেন। সেখানে আমাদের বাচ্চাদের স্কুল ফি বাকি পড়ছে। এত টাকা তো এই ফ্যাক্টরি থেকেই আসে। তাহলে? সেটা বন্ধ হয়ে গেলে মালিকরাও বুঝবে কত ধানে কত চাল! আমরা তো মরেই আছি! আর কত মরব!’

আদিত মাকুর হাতে চিমটি কেটে চাপা গলায় বলেছিল, ‘তুই চুপ কর। বলেছি না কথা বলবি না!’

‘না ওকে বলতে দিন!’ বাদলদা ভুরু কুঁচকে সাংঘাতিক একটা যুক্তি তর্কের জন্য তৈরি হচ্ছিল। সবার সামনে কেউ এমন একটা কথা বলে যাবে, আর ইউনিয়ানের সেক্রেটারি হয়ে সেটা বেমালুম হজম করে নিলে তো আর নিজের সম্মান থাকে না!

বাদলদা চায়ের গ্লাসটা পাশে সরিয়ে রেখে সামনে ঝুঁকে বসেছিল। আজ একটা এসপার-ওসপার না করে ছাড়বে না।

মাকু পান চিবোতে চিবোতে বলেছিল, ‘আরে, বললাম তো। স্ট্রাইক করবেন না! দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে!’

‘কীসের ক্ষতি হবে? দেশ কিন্তু এক শতাংশ বড়লোকদের নিয়ে তৈরি নয়। দেশে আমাদের মতো খেটে খাওয়া, পরিশ্রমী মানুষদের দিয়ে তৈরি হয়। আমাদের কাঁধে চড়েই দেশ এগোয়। সেখানে আমরা জীবনের বেসিক নিডগুলোই যদি না পাই! যদি বেসিক নিডগুলোই ফুলফিল না হয় তাহলে দেশ এগোবে কী করে? স্ট্রাইক করতে আমাদের ভাল লাগে ভেবেছেন? না লাগে না। কিন্তু জীবনে মাঝে মাঝে উপায় থাকে না। আমাদের এই পথ নিতেই হয়। বুঝলেন?’ এবার পাশের থেকে বলাই নামে একটা ছেলে বলেছিল কথাগুলো। ছেলেটা যে বাদলদার কাছের মানুষ সেটা প্রথমেই বুঝে গিয়েছিল আদিত।

মাকু মুখের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে একটা সুপুরির কুচি বের করে এনে সেটাকে টোকা দিয়ে ফেলে বলেছিল, ‘না না। আমি বলছি দেশের পপুলেশান বেড়ে যাবে খুব। কেস পুরো কেলো হয়ে যাবে। তাই স্ট্রাইক-ফাইক করবেন না।’

‘পপুলেশান! কেলো!’ বাদলদা কিছুতেই যেন হিসেব মেলাতে পারছিল না! কী বলছে কী ছেলেটা! বাদলদা হাঁ করে তাকিয়েছিল মাকুর দিকে।

মাকু বলেছিল, ‘আপনারা তো কন্ডোম তৈরি করেন, তাই না?’

‘কন্ডোম?’ বাদলদার সঙ্গে আদিতও এবার হাঁ করে তাকিয়েছিল মাকুর দিকে।

‘ফ্যাক্টরি গেটের পাশে দেখলাম একটা বিজ্ঞাপন। লাল একটা ত্রিকোণ। আপনারা কন্ডোম বানানো বন্ধ করলে কী হবে বলুন তো? পপুলেশান পাঁই পাঁই করে বেড়ে যাব না! লোকজন ইয়ে করে করে একদম ইয়ে করে দেবে না দেশের!’ মাকু আদিতের দিকে ফিরে চাপা গলায় বলেছিল, ‘অনেক লোকজন আছে এখানে। তাই লাগানো-টাগানোর মতো টার্ম আর ইউজ করলাম না!’

বাদলদা অবাক গলায় বলেছিল, ‘আমরা কন্ডোম তৈরি করি কে বলল?’

‘সেকি করেন না? ওই যে গেটের পাশে দেখলাম। প্লাস রাবারের ফ্যাক্টরি! বিদেশি সিনেমায় দেখি যে কন্ডোমকে রাবার বলে! তাই ভাবলাম!’ মাকু উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টটা ঠিক করতে করতে বলেছিল, ‘তা কন্ডোম তৈরি করেন না কেন? করে ফেলুন। দেশের উপকার করুন! কী যে করেন না আপনারা! দেশের কথা ভাববেন না?’

এখনও এমন করে কথাটা বলল মাকু যে প্রাথমিক ভাবে কী বলবে আদিত বুঝতে পারল না। ও একটু সময় নিল। তারপর বলল, ‘রেল চলবেটা কী করে আমরা সবাই যদি উইদাউট টিকিটে যাতায়াত করি? এটা ভেবেছিস?’

মাকু বলল, ‘আমি পাঁচ টাকার টিকিট না কাটলে রেল বন্ধ হয়ে যাবে! পাগল নাকি? আমার পাড়ার গরিব পানওয়ালাটার লস হবে আমি ওই টাকার পান না কিনলে! একে বলে ইকোনমিক্স। বুঝলি! কিছুই তো পড়াশুনো করিস না! অমর্ত্য সেনের বই পড়। জানতে পারবি!’

আদিত বলল, ‘তুই পড়েছিস? আর উনি কী লিখেছেন, ট্রেনের টিকিট না কেটে সেই টাকায় পান খাও!’

‘বই পড় জানতে পারবি। তবে উনি পান খান না বোধহয়। ফরেনে পান পাওয়া যায় না বলেই মনে হয়। সেই জন্য তো শালা আমি কোনওদিন ডায়মন্ড হারবার ক্রস করিনি!’

আদিত আর কথা বাড়াল না। মাকু এবার আর কাকে কাকে ডেকে আনবে এইসব কথায় কে জানে! ও শুনল মাকু আরও কিছু বলছে কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারল না। আদি গঙ্গার ওপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। ওরা চলতি কথায় এটাকে কালিঘাট ব্রিজ বলে। আগে ব্রিজের লোহার হ্যাঙারের ওপর সার সার শকুন বসে থাকতে দেখত আদিত। কিন্তু এখন আর দেখে না! শকুন জিনিসটাই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। ওর মাঝে মাঝে মনে হয় সেসব পাখিরাই বোধহয় মানুষ হয়ে সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে!

ঘড়ি দেখল আদিত। ঘড়িটা নতুন। ছোট মামা এনে দিয়েছে নেপাল থেকে। গতকাল এসেছিল ছোটমামা বাড়িতে।

ছোটমামা লোকটা ভাল। খুব ভালবাসে আদিতকে। মা যে আজকাল সারাক্ষণ ওকে বকাবকি করে সেটা থেকে ছোটমামাই যা ওকে রক্ষা করে বাড়ি এলে।

মা বাবার দুশ্চিন্তার কথাটা বোঝে আদিত। কিন্তু সবাই যদি নিজের কথা চিন্তা করে তাহলে কী করে দেশ চলবে?

ছোটমামা ওকে কাল আড়ালে নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘সাতাশ বছর তো হল। চোখের পলক ফেলতে ফেলতে দেখবি চল্লিশ হয়ে গিয়েছে। আর কতদিন এমন করে থাকবি বুড়ো? শোন, একটা ভাল কাজ আছে। নয়ডায়। ওদের এমন ছেলে চাই যে লিখতে জানবে। এডিট করতে জানবে। আমায় বলেছে খুঁজে দিতে। তুই বললে এখনই কাজটা তোর!’

‘চাকরি?’ ছোটমামার দিকে তাকিয়েছিল আদিত। এই ভারতবর্ষে এভাবে এখনও কাজ পাওয়া যায়?

ছোটমামা বলেছিল, ‘দেখ এখনও মাসখানেক সময় আছে। একটা ট্র্যাভেল অ্যান্ড টুরিস্ট ম্যাগাজিন খুলবে ওরা। সঙ্গে চ্যানেল লঞ্চ করবে। ডিজিটালে যাবে। ভাল কাজ। ভাল টাকা। আমায় ওরা বলেছে। ব্যারি সিমন্স আমার বিশেষ পরিচিত! তুই বল। দিদির বয়স হচ্ছে। জামাইবাবুর পেনশান আছে এখন। কিন্তু জামাইবাবু তো অসুস্থ। কত খরচ বলত! সমাজের দায়িত্ব পরে পালন করবি, ঠিক আছে, আগে নিজের কাছের লোকদের দায়িত্ব পালন কর। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম জানিস তো? প্লাস বিয়ে শাদি করবি তো নাকি?’

আদিত কিছু বলেনি। আচমকাই মনের মধ্যে ফিরে এসেছিল একটা ছবি! অনেক অনেক পাখির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন! তার মুকুট কপাল! রঙ্গন ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁট! তার ওপরে ছোট্ট একটা কাটা দাগ!

কেমন যেন শীত করে উঠেছিল আদিতের। ওদের বাড়ির ক্ষয়াটে বারান্দায় শীতে কুঁকড়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়েছিল ও। মনে পড়েছিল, সে এমন শীতের দিনে রোদের ঝালরের নীচে দাঁড়িয়ে সে বলত, ‘আমার খুব শীত পাচ্ছে!’

কিন্তু কাল ছোটমামার কথা শোনার পর থেকে কেমন যেন অস্বস্তি হয়েছিল! আচ্ছা, ও কি সত্যি এমন জীবনে আসত যদি না সেদিন অমন করে ওকে তাড়িয়ে দিত স্মাহি! ও কি আসলে নিজের কষ্টের থেকে বাঁচতে এভাবে অন্যদিকে ঢেলে দিচ্ছে জীবন? আসলে কি ও ভিতু? সামনে থেকে জীবনের মুখোমুখি হতে ভয় পায়? মানুষের মন গোলকধাঁধার মতো। নিজের অনেক প্রশ্নই সে এড়িয়ে যায়!

ছোটমামা বলেছিল, ‘বুড়ো, আমি জানি না তোর কী কষ্ট। কিন্তু জানবি আজ যেটাকে কষ্ট বলে মনে করে তুই সব কিছু থেকে সরে থাকছিস, আজ থেকে তিরিশ বছর পরে কিন্তু সেই জন্য তোকে আফশোস করতে হবে। জানবি, একটাই জীবন বুড়ো। আদিত কিন্তু আর ফিরে আসবে না এই পৃথিবীতে!’

আদিত তাও হাসার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, ‘কীসের কষ্ট! দূর কী যে বলো!’

ছোটমামা হেসেছিল খুব। তারপর ওর মাথায় হাত দিয়ে চুলটা ঘেঁটে দিয়ে বলেছিল, ‘আমার এখন একান্ন। কিন্তু আমার কি কোনওদিন সাতাশ ছিল না? আমি কি এমনি চিরকুমার! ঘড়িটা পরিস। সময়ের দামটা মাথায় রাখিস!’

টালিগঞ্জ স্টেশানে ট্রেনটা দাঁড়িয়েছে। লেক গার্ডেন্স স্টেশানটা এখান থেকে দেখা যায়, এত কাছে। এই স্টেশান থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামলেই রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশান! তা ছাড়া, ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি, অটো, সব আছে। তাই ট্রেনের বেশির ভাগ ভিড় এখানেই খালি হয়ে যায়।

মাকু জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি বালিগঞ্জে নামবি না লেক গার্ডেন্সে! মানে রাজুদার কাছে যাবি?’

‘হ্যাঁ রাজুদার সঙ্গে দেখা করতে হবে। বাদলদার সঙ্গে কী কথা হল জানানো দরকার!’ আদিত আর কথা না বাড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। ভিড় স্টেশান। তবে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় সব কেমন আবছা লাগছে।

ও ভাবল রাজুদা কি পার্টি অফিসে চলে গিয়েছে নাকি বাড়িতেই আছে। রাজুদার সামান্য জ্বর হয়েছে। নিশ্চয় বাড়িতেই থাকবে। কার যেন একটা আসার কথা। কোন এক ভদ্রমহিলার। আজ রাজুদা বলেছিল সকালে।

‘কে আসবে? ইমপরট্যান্ট কেউ?’ আদিত জানতে চেয়েছিল।

‘আরে না! প্রিতমদার গার্ল ফ্রেন্ড!’ রাজুদা মুখ বিকৃত করে নিয়েছিল।

‘সে কে?’ অবাক হয়েছিল আদিত। নাম শোনেনি আগে এই লোকটার।

রাজুদা বলেছিল, ‘সে আমার কলেজের সিনিয়ার! বিশাল টাকা। ব্যাঙ্কার না কী যেন। আমি ফরেনে গেলে টুকটাক হেল্‌প করে। ডিভোর্সি। আরেকজনের সঙ্গে এখন প্রেম করছে। তো সেই ম্যাডাম আসবে। কী কাজ ভগবান জানে!’

আদিত কিছু বলেনি। পুশি বউদি, মানে রাজুদার বউ এসে চা দিয়ে গিয়েছিল রাজুদাকে।

রাজুদা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আদা দিয়েছ তো?’

বউদি হেসেছিল, ‘দিয়েছি!’ তারপর আদিতকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি আজ লাঞ্চ করবে এখানে?’

‘না না,’ রাজুদা নিজের উত্তর দিয়েছিল, ‘ও সারেঙ্গাবাদ যাবে। কাজ আছে।’

বউদি আর কথা না বাড়িয়ে চলে গিয়েছিল।

রাজুদা বউদির চলে যাওয়া দেখে আদিতের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলেছিল, ‘পুশি কেমন হয়ে যাচ্ছে জানিস! বাচ্চা কি হাতের মোয়া বল!’

আদিত মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। এসব ওর জানার কথা নয়। রাজুদারা নিঃসন্তান। কিন্তু সেই নিয়ে রাজুদা কোনওদিন কিছু বলেনি। আজ কেন যে বলেছিল!

রাজুদা স্থির ভাবে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘তুই টক করে ঘুরে আয় সারেঙ্গাবাদ থেকে। কী হচ্ছে এসে খবর দে আমায়। আর তোর সঙ্গে একটা কথা আছে আমার। পরে বলব!’

লেক গার্ডেন্স স্টেশানে নেমে এদিক ওদিক তাকাল আদিত। মাকু নামেনি। ও বালিগঞ্জ যাবে কী একটা কাজে।

স্টেশানে ভিড় নেই! চারিদিকে কেমন একটা সর পড়া আলো আঁধারি!

রাজুদাকে ঠিক কীভাবে রিপোর্ট করবে ভাবতে ভাবতে সামনে এগোল আদিত। আর ঠিক তখনই শুনল একটা গলা। ভাঙা ভাঙা। সামান্য সর্দি জমা। কিন্তু সুর আছে। সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজছে।

ও শুনল ‘জব দীপ জ্বলে আনা, জব শাম ঢলে আনা!’ আদিত মাথা ঘুরিয়ে দেখল কোথা থেকে গানটা ভেসে আসছে! আর সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন বিদ্যুতের তার ছুঁইয়ে দিল ওর শিরদাঁড়ায়! থমকে গেল আদিত।

দেখল জটা মাথায় একটি লোক হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বহু বছরের ওপার থেকে আসা একটি মেয়ে!

আদিত পাথরের মতো তাকিয়ে রইল দূর থেকে। আর যেন দেখতে পেল গানের সুর ছোট ছোট পাখির মতো রঙিন ডানা মেলে উড়ছে মেয়েটার চারিধারে! এই আবছায়া অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না, তবু যেন এত বছর পরেও রঙ্গন ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁটের ওপর সেই কাটা দাগটা নিজের বুকের মধ্যে দেখতে পেল আদিত!

৭ স্মাহি

শীতের এই ছুটির দুপুরগুলোয় কেমন যেন মনখারাপ লাগে স্মাহির। ঠান্ডা একটা হাওয়া যেন পুরোনো জীবনের সব কথা মনে পড়িয়ে দেয়। যেন ছোটবেলার পাড়া থেকে সব পরিচিত মানুষদের গন্ধ নিয়ে আসে এই হাওয়া! আজও সেই হাওয়ায় মনখারাপ করছে স্মাহির। মনে পড়ে যাচ্ছে এই দিনটায় কী আনন্দই না হত আগে! মা বাবা যে নেই সেটা বুঝতেই দিত না জেঠু। সারা বাড়ি সাজিয়ে, লোকজনদের নেমন্তন্ন করে, কেক কেটে কত্ত আনন্দ করত ওরা! জেঠু বলত, ‘আজ মনখারাপ করে থাকবি না পাগলি! জন্মদিনে মনখারাপ করতে নেই!’

কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চটায় বসে কানের চারিপাশে ওড়নাটা জড়িয়ে নিল স্মাহি। ওর একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়। আর আজ ঠান্ডাটা পড়েছেও খুব। খুব শীত পাচ্ছে ওর! দুপুরের রোদের জোরই নেই!

ডুবু ঘুমিয়ে পড়েছে রিতাদির কোলে। এই দোকানের একপাশে একটা চওড়া বেঞ্চে ডুবুকে এই শুইয়ে দিল রিতাদি। এবার খেয়ে নেবে। স্মাহি এখন ডুবুকে ধরে বসে থাকবে।

নানুদা, বাড়িতে একা একা খাবার নিয়ে খেলেও বাইরে রিতাদির সাহায্য লাগে। ওদের ছোট কী-বোর্ডটা রাখা আছে নানুদার চেয়ারের পাশে। সামনে ভাত, ডাল আর ফুলকপির তরকারি ঠান্ডা হচ্ছে।

স্মাহি ভাত খায়নি। পাউরুটি আর ডিম খেয়ে নিয়েছে। এখানে থালা বাসন দেখে খুব একটা ভক্তি হয়নি ওর। তাই ভাতের দিকে যায়নি। রিতাদি বলেছিল, ‘তুই খেয়ে নে, তারপর একটু ডুবুকে দেখিস!’

ওড়নাটা কানে পেঁচিয়ে নিয়ে এবার এই বেঞ্চ থেকে উঠে ডুবুর পাশে গিয়ে বসল স্মাহি।

এখন প্রায় তিনটে বাজে। দুপুর একটু পরেই মিশে যাবে ছোট্ট বিকেলে। আকাশের দিকে তাকাল স্মাহি। জেঠুর কি মনে আছে আজ ওর জন্মদিন! জেঠিমা, দাদা, বোন, ওদের মনে আছে?

রিতাদি বা নানুদাকে ও বলেনি এই দিনটার কথা। কাউকেই ও আর বলে না এই নিয়ে। কী হবে? এই চব্বিশে আসতে আসতে সবাই তো হারিয়ে গিয়েছে ওর জীবন থেকে। মা, বাবা, জেঠু বা দীপক, কেউ নেই!

দীপকের নামটা মনে এলে এখন কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে স্মাহির! কতটা বোকা হলে ও এমন একটা লোকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে! আর শুধু জড়িয়ে পড়া নয়, ওই চরম অবধি যেতে পারে! সেই বছর দুয়েক আগের দিনগুলো কেমন দুঃস্বপ্নের মতো লাগে স্মাহির! কী জীবন কী হয়ে গেল!

বাবা মায়ের ভাব করে বিয়ে হয়েছিল। মায়ের বাড়ির অনুমতি ছিল না এই বিয়েতে। তাই বিয়ের পর মায়ের বাড়ির লোকজন কোনও সম্পর্ক রাখেনি ওদের সঙ্গে। মামাবাড়ি বলে কোনও ব্যাপারই ছিল না স্মাহির জীবনে। যা ছিল সবটাই ছিল জেঠু!

বাবা মা মারা গিয়েছিল একটা দুর্ঘটনায়। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে স্মাহি। আজও সেই দিনটার কথা মনে আছে। স্কুল থেকে ফিরে দেখেছিল ওদের বিরাট বড় বাড়ির সামনে প্রচুর মানুষ ভেঙে পড়েছে! একটা অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে! স্মাহি তো প্রথমে বুঝতেই পারেনি কী হল! এত লোক কেন বাড়িতে! আর পুলিশ! তারাই বা কী করছে!

বাড়ির সামনে পিঠে ব্যাগ নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্মাহি! আর দেখছিল আশেপাশের লোকজন কেমন একটা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে! স্মাহি বুঝতে পারছিল কিছু একটা হয়েছে! সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গিয়েছে! ও দৌড়ে ঢুকে গিয়েছিল বাড়ির মধ্যে। আর দেখেছিল ওদের বড় উঠোনটায় শোয়ানো ছিল বাবা মা! চোখ বন্ধ। নিথর! নিমেষে সব কিছু স্থির হয়ে গিয়েছিল ওর! চারিদিক জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল! কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছিল না! কাউকে যেন চিনতে পারছিল না! বাবা মা নেই! তাহলে এবার কী হবে? সামনের জীবনটা এবার কী ভাবে কার সঙ্গে কাটাবে ও!

থরথর করে কাঁপছিল স্মাহি! আর তখনই জেঠু এসে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়েছিল স্মাহিকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল, ‘এসব দেখিস না মা, ভুলে যা এই ছবি। আর ভয় পাবি না। একদম ভয় পাবি না। আমি আছি। আমি সারা জীবন আছি তোর সঙ্গে!’

সারা জীবন? সারা জীবন মানে কতটা জীবন! সারা জীবন কেউ থাকে না! মানুষ আসলে একাই! নিজের ওপর ছাড়া তার আর কারও ওপর ভরসা করার নেই! যেদিন ওকে সবাই বাড়ি থেকে বের করে দিল সেদিন ওপরের বারান্দা থেকে জেঠু দাঁড়িয়ে দেখছিল ওকে! কেমন একটা পাথরের মূর্তির মতো লাগছিল মানুষটাকে। এই লোকটাই যে এত দিন ওকে বুক দিয়ে আগলেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছিল না। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকা স্মাহির কানে যেন বাজছিল বহু বছর আগের সেই কথাগুলো, ‘ভয় পাবি না। একদম ভয় পাবি না। আমি আছি। আমি সারা জীবন আছি তোর সঙ্গে!’ কিছুটা গিয়ে ও মাথা ঘুরিয়ে শেষ বারের মতো তাকিয়েছিল বারান্দার দিকে। দেখেছিল আর জেঠু দাঁড়িয়ে নেই। শূন্য বারান্দায় সকালবেলার রোদ পড়ে আছে শুধু!

নীলাঞ্জনা তখন সাহায্য করেছিল খুব। ওর কলেজের বান্ধবী নীলাঞ্জনা, নীলু। ওর আর দীপকের ব্যাপারটা জানত নীলু। ওকে বলত, ‘একটা এমন লোকের সঙ্গে জড়াস না। কোনও লাইফ নেই কিন্তু। দেখবি পস্তাবি তুই!’

সেই সময়ে নীলু ওকে নিজেদের বাড়িতে রেখেছিল মাস দুয়েক। নিজের এক কাকাকে দিয়ে এই চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছিল। কলকাতায় পার্ক সার্কাসের কাছে একটা মহিলাদের মেসও জোগাড় করে দিয়েছিল।

যেদিন নীলুর বাড়ি থেকে শেষবারের মতো বেরিয়ে আসছে ও, সেদিন নীলু বলেছিল, ‘শোন স্মাহি, জীবনে তুই কিন্তু একা এখন। ফলে নিজেরটা নিজে দেখে নিবি। মুখচোরা হয়ে থাকবি না! আর দীপকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবি না কিন্তু! শক্ত হ। এবার থেকে মাথা দিয়ে মানুষ চেনার চেষ্টা কর। বুঝলি?’

নীলুর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তার মাস দেড়েক বাদে। এখন ও বিদেশে থাকে। সুইডেনের কোন একটা শহরে। মাঝে মাঝে ওকে মেসেজ করে। কিন্তু তাও ক্ষীণ হয়ে এসেছে! এটাই স্বাভাবিক। সবারই জীবন আছে। কে আর কার জন্য অপেক্ষা করে থাকে!

অপেক্ষা! সে কি অপেক্ষা করত! এই সব হিজিবিজি চিন্তার মধ্যে আজ হঠাৎ তার কথা মনে পড়ে গেল স্মাহির! যেন দেখতে পেল বড় বড় চোখ তুলে তাকিয়ে আছে সে! সামান্য জোড়া ভুরু! কপালে একটা ছোট্ট তিল! পাতলা মোম কাগজের মতো কান! সে যেন আজও তাকিয়ে আছে স্মাহির দিকে!

কেন কে জানে আজকাল মাঝে মাঝেই তার কথা মনে পড়ে স্মাহির! মনে পড়ে কী করে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ও! আর কীভাবে মাথা নামিয়ে ওদের আলো ছায়ার ডোরাকাটা পথ দিয়ে চলে গিয়েছিল সে। যেতে যেতে একবারও আর পিছনে ফিরে তাকায়নি!

কোথায় গেল মানুষটা? ওদের বর্ধমান শহরে এসেছিল খবর কাগজের চাকরি নিয়ে। সেটা ছেড়ে কোথায় মিলিয়ে গেল মানুষটা! আগে বুঝত না, কিন্তু আজকাল কেমন একটা কষ্ট হয় স্মাহির। নিজের ওপর রাগ হয়! কী করল এটা ও! আরেকবার কি কোনওভাবে দেখা হবে না। আবার পাশে এসে দাঁড়াবে না! আবার তাকাবে না অমন বড় বড় চোখ তুলে!

‘কী রে আজ বড্ড চুপচাপ, কী হয়েছে তোর?’ শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে ওর সামনে এসে দাঁড়াল রিতাদি! স্মাহি মাথা তুলে হাসল সামান্য। তারপর আলতো করে পাশের চওড়া বেঞ্চে শুয়ে থাকা ডুবুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল!

রিতাদিকে ও বলছে নিজের জীবনের কিছু কথা। কিন্তু সবটা বলেনি। দীপকের ব্যাপারটা বলেনি। কেন ও বাড়ি ছাড়া সেটা বলেনি। আর রিতাদিও জিজ্ঞেস করেনি কিছু। আসলে রিতাদি খুব একটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করে না। কৌতূহল খুব কম। বলে, ‘তুই আমার বোনের মতো এই আমার কাছে অনেক। এমন পৃথিবীতে কী করে যে একা বেঁচে আছিস ভেবে অবাক লাগে আমার। কত বড় বাড়ির মেয়ে তুই!’

বড় বাড়ি না ছোট বাড়ি সেসব কিছু বলেনি স্মাহি। কিন্তু ওকে দেখে কেন কে জানে রিতাদি এমনটাই ধরে নিয়েছে!

স্মাহি বলল, ‘নানুদার খাওয়া হয়ে গিয়েছে, না?’

‘হ্যাঁ রে। ওর শরীরটা ভাল লাগছে না বলছে। জ্বর জ্বর লাগছে নাকি! বাড়ি চলে যাই আজ। প্রায় সাড়ে তিনশো টাকা হয়েছে। খারাপ না, বল!’

স্মাহি হাসল। কিছু বলল না। ছুটির দিন মাঝে মাঝে রিতাদি আর নানুদার সঙ্গে ও বেরিয়ে পড়ে। ও এলে ডুবুও আসে। রিতাদিরা ট্রেনে গান গায়। আর ও ডুবুকে কোলে করে দাঁড়িয়ে থাকে।

স্মাহি বলেছিল, ‘আমি কি পয়সা তুলব?’

রিতাদি হেসেছিল ওর কথায়, ‘পাগল। এমন করে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে তুই ট্রেনে ট্রেনে ঘুরিস এতেই আমি লজ্জায় মরে যাই! কত বড় বাড়ির মেয়ে তুই। আর তোকে দিয়ে আমি পয়সা তোলাবো! আমি কি অমানুষ?’

অমানুষ কি মানুষ সেটা তো বৃত্তি দিয়ে বা সামাজিক অবস্থান দিয়ে হয় না! কিন্তু সেসব আর বলেনি স্মাহি। কী হবে! ও শুধু মাঝে মাঝে ছুটির দিনে বেরোয় ওদের সঙ্গে। ট্রেনের কামরার এক পাশে ডুবুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ডুবুও ওর গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে একদম। আর ও দেখে, রিতাদি কঞ্জিরা বাজাচ্ছে। নানুদা পাথরের মতো চোখ নিয়ে কী-বোর্ডে সুর তুলছে। আর ওর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে কিশোর, মান্না, রফি আর মুকেশ! খিদের সঙ্গে সুর মিশে লোকাল ট্রেনের মধ্যে দিয়ে গান ছড়িয়ে পড়ছে শহরতলির শিরা-উপশিরায়!

স্মাহি বলল, ‘তাহলে ফিরে চল। সোনারপুর স্টেশান থেকে এখনই একটা ট্রেন আছে না?’

সারা সকাল আজ দক্ষিণ শহরতলির ট্রেনে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছে ওরা। তারপর দুপুরে খাবে বলে সোনারপুর স্টেশানের পাশে একটা দোকানে এসেছিল। খাবার বাবদ নব্বই টাকা হয়েছে। সেটা আর রিতাদিদের দিতে দেয়নি স্মাহি।

ও ঘুমন্ত ডু্বুর দিকে তাকাল। অকাতরে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। এমনিতে খুব দামাল। কিন্তু একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর সাড় থাকে না। পৃথিবী উলটে গেলেও ঘুম ভাঙে না।

এই ছোট্ট ছেলেটাকে কেন যে এত ভাল লাগে ওর! দেখলেই মন কেমন একটা করে! কী একটা নেই নেই মনে হয়! মনে হয় সাদা চুনকাম করা একটা বিশাল বড় দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও! মনে হয় এমন তো ওরও হতে পারত! সেই একাই যখন হল, তখন ও কী দোষ করেছিল!

‘চল তাহলে। আর দেরি করব না।’

রিতাদির কথায় মুখ তুলে তাকাল স্মাহি। আর তখনই মোবাইলটা বাজল। ওঃ আবার! বিরক্ত হল স্মাহি। এই ছেলেটা ক’দিন হল এত গায়ে পড়ছে না! স্মাহি ভদ্রভাবে কতবার বুঝিয়েছে যে ও আগ্রহী নয়! কিন্তু কেমন একটা মুখ করে তাকায় ছেলেটা। রিতাদিকে ছেলেটার ব্যাপারে বলেছে স্মাহি।

‘ভাল তো! ভাল চাকরি করে! অসুবিধে কোথায়! তবে নামটা একটু সেকেলে, না? বলাই!’ রিতাদি কথাটা বলে খুব হেসেছিল!

ওদের কাটিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করে বলাই। ইউনিয়ানও করে। ভাল ছেলে। কিন্তু সারাক্ষণ আজকাল পেছনে ঘুরঘুর করে ওর। ভাল লাগে না একদম।

একদিন তো বলেছিল, ‘তোমার কথা আমি মাকে বলেছি।’

‘প্লিজ কাউকে বোলো না আমার কথা।’ স্মাহি বিরক্ত হয়েছিল, ‘প্লিজ এসব ভেব না। আমার পক্ষে কিছু সম্ভব নয়!’

তারপর থেকে আর সেভাবে সরাসরি কিছু বলে না বলাই। কিন্তু যোগাযোগ রেখে যায়। এক অফিসেই আছে। কী আর করে স্মাহি।

সামান্য চিন্তা করে ফোনটা ধরল স্মাহি।

‘হ্যালো,’ বলাই বলল, ‘তুমি কোথায়?’

‘কেন?’ স্মাহি শুকনো গলায় বলল, ‘কী হবে জেনে?’

‘না মানে,’ বলাই খুশির গলায় বলল, ‘আমি কাকে আর বলব আমার আনন্দের কথা! তাই ভাবলাম… মানে…’

‘আবার?’ স্মাহি সামান্য কড়া গলায় বলল।

‘আমি মানে…’ বলাই ঢোঁক গিলল, ‘সামনের বছর ইলেকশানে আমায় অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির জন্য দাঁড় করাবে দল। আজই আমায় বলল বাদলদা। তাই মানে…’

‘আচ্ছা,’ স্মাহি বলল, ‘ঠিক আছে আমি রাখছি। পরে কথা হবে।’

বলাইকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল স্মাহি। পাগল যত্ত সব। এমন করে বলছে যেন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন হয়েছে! আসলে স্মাহি বোঝে সবই ছুতো! নানান ভাবে যোগাযোগ করার ছুতো! কিন্তু কী করবে ও? উপায় তো নেই! বলাইকে ভাল লাগে না ওর। এ তো আর গড়িয়াহাটার মোড়ের ধূপকাঠি কেনা নয়! যে জোর করল বলে কিনে নেবে এক প্যাকেট!

ফোনটা জিনসের পকেটে রেখে ডুবুকে কোলে তুলে নিল স্মাহি। ওর মাথাটাকে নিজের কাঁধে সাবধানে রেখে তাকাল রিতাদির দিকে। দেখল রিতাদি হাসছে।

‘কী হল? চলো!’ স্মাহি ভুরু কুঁচকে বলল।

রিতাদি বলল, ‘সেই বলাই, না?’

স্মাহি বলল, ‘তো?’

রিতাদি খিলখিল করে হেসে বলল, ‘শিব্রামের মতো বলতে হয়, তোর জীবনে বলাই বাহুল্য!’

লেক গার্ডেন্স স্টেশানে ট্রেন থেকে নেমে বাড়ির দিকে এগোল স্মাহিরা। রোদ পড়ে এসেছে। তবে সেই পাতলা সেলোফেনের মতো ঠান্ডা হাওয়াটা আছে। কেমন একটা সিরসিরে ভাব যেন।

ট্রেনে থাকতেই নানুদার জ্বরটা বেড়েছে।

স্মাহি প্ল্যাটফর্মের এক পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমরা আর হেঁটো না। রিকশা করে চলে যাও। আমি ক্রোসিন কিনে নিয়ে যাচ্ছি। আজ তো আর ডাক্তার পাবে না। কাল সকালেই নাহয় একবার ব্যানার্জি ডাক্তারকে দেখিয়ে নিয়ো। আমি একটু পরে আসছি।’

রিতাদি সামান্য ঘাবড়ে গেছে। তাই আর কিছু আপত্তি করল না। ডুবুকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল স্টেশানের শেষ মাথার দিকে। ওদিকে রিকশাস্ট্যান্ড আছে।

স্মাহি বোঝে রিতাদির চিন্তার ব্যাপারটা। নানুদা খুব ভাল গান করে। ট্রেনে মোটামুটি রোজগার হয়। কিন্তু তার মধ্যে যদি আচমকা বসে যায় কয়েকটা দিন তাহলে সত্যি খুব মুশকিল!

স্মাহি দেখল রিতাদিরা আস্তে আস্তে প্ল্যাটফর্মের ঢাল বেয়ে নেমে গেল। ও এবার ডানদিকে কিছুটা এগিয়ে গেল।

লম্বা শেডের পাশের বড় পিলারটার কাছে বসে আছে জটাদাদু। স্মাহি গিয়ে দাঁড়াল ওর সামনে। জটাদাদু আজ সবে এসেছে। ঝোলা খুলে একটা আসন বের করে পাতছে। পাশে পুরনো হারমোনিয়ামটা রাখা।

ও দাঁড়াতেই জটাদাদু মুখ তুলে তাকাল, ‘কীরে আজ এখন?’

স্মাহি কিছু না বলে হাসল। তারপর ব্যাগের থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিল, ‘এটা রাখো আজ। কিছু কিনে খেয়ো!’

জটাদাদু দেখল নোটটা। তারপর মুচকি হেসে বলল, ‘হ্যাপি বার্থ ডে!’

কী! চমকে উঠল স্মাহি! কী বলল দাদু! আজ জন্মদিন জানল কী করে? ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

জটাদাদু পাশের ঝোলার থেকে একটা প্যাকেট বের করল। সুন্দর করে প্যাক করা একটা বাক্স! কী আছে এতে? জটাদাদু এটা দিচ্ছে ওকে?

জটাদাদু বলল, ‘আমি দিচ্ছি না। একজন দিয়ে গিয়েছে। বলেছে আজ তোর জন্মদিন। যেদিন দেখা হবে সেদিন যেন তোকে দিয়ে দিই!’

স্মাহি তাকাল জটাদাদুর দিকে, ‘কে দিয়েছে এটা? কেউ তো জানে না আমার আজ জন্মদিন! কেউ তো নেই আমার!’

জটাদাদু হাসল সামান্য। তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘জানে রে জানে। যে জানার সে জানে। যে মনে রাখার সে রাখে! সব সময় তো বলার সু্যোগ থাকে না! এবার সুযোগ পেয়েছে, তাই দিয়ে গেছে!’

‘কিন্তু কে দিল?’ স্মাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল জটাদাদুর দিকে!

জটাদাদু হাসল আবার। বলল, ‘সে বলা বারণ। কথার খেলাপ আমি করতে পারব না। শুধু এটুকু বলি তোর কেউ নেই এটা ভাবিস না! আমাদের সামনে কেউ না থাকলেও আড়ালে আড়ালে কেউ না কেউ আমাদের হয়েই থেকে যায় সারা জীবন! জানান দেয় না। কিন্তু থেকেই যায়। বুঝলি পাগলি!’

৮ ঋত্বিজ

ঘরের বাইরে বেরিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকাল তিজু। এমন করে হুট করে না বলে এসে পড়ায় কি রেগে গিয়েছেন মানুষটা। তাই কি এমন করে প্রায় কোনও কথাই বললেন না? সারাক্ষণ শুধু হুঁ হাঁ করে গেলেন নিজের ওই চেয়ারটায় বসে!

তিজুর খারাপ লাগল। ব্যাপারটা ঠিক হয়নি। এভাবে হুট করে চলে আসার আগে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত ছিল। মোবাইল নাম্বার তো দিয়েইছেন রাধুবাবু। বলেওছিলেন ফোন করে যেতে। কিন্তু তিজু এতটাই উত্তেজিত ছিল সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটার ঠিকানা পাবার জন্য চলে এসেছিল না বলেই!

‘সরি স্যার, আসলে, সাহেবের আজ শরীরটা ভাল নেই। ক্যান্সার পেশেন্ট, বোঝেন তো! নাহলে কিন্তু এমন করেন না। আপনি পরেরদিন আগের থেকে ফোন করে নেবেন। তাহলে দেখবেন আর সমস্যা হবে না।’

তিজু ছেলেটার দিকে তাকাল। লজ্জিত মুখ। অল্প বয়স। বড় জোর উনিশ কী কুড়ি হবে! দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটাই কোনও অপরাধ করেছে!

তিজু হেসে ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে আলতো করে চাপড় মারল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘উনি কি একাই থাকেন?’

‘হ্যাঁ স্যার। একাই। আসলে আমি সারাদিন থাকি। তারপর রাত আটটা নাগাদ চলে যাই। নীচের সিকিউরিটি ডেস্কে থাকেন মহাবীরদা, উনি রাতে দরকার পড়লে সাহেবের কাজ করে দেন। তেমনই বলা আছে।’

‘থ্যাঙ্কস,’ তিজু হাসল, ‘আমি পরের দিন নাহয় ফোন করেই আসব। আসলে তোমার বাবুর থেকে আমার অনেক কিছু জানার আছে! তাই… মানে… বাই দ্য ওয়ে তোমার নাম কী?’

‘কার্তিক! আর নিশ্চয় আসবেন স্যার। সাহেব খুব ভাল মানুষ! আজ শুধু কী যে হয়েছে!’ কার্তিক আমতা আমতা করল আবার।

তিজু আর সময় নষ্ট না করে পেছন ফিরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

এলগিন রোডের কাছে এই ফ্ল্যাটটা বেশ উঁচু। পনেরো তলা। যদিও অভিনব রাওয়াত থাকেন দোতলায়। গোটা বাড়িটার জন্য চারটে লিফট আছে। কিন্তু তিজু আর লিফটে চড়েনি! দোতলায় ওঠার জন্য অমন কল বাটন টিপে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না!

নামার সময়ও লিফট ব্যবহার করল না তিজু। ধীর পায়ে নেমে এল নীচে।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে রিসেপশান কাম সিকিউরিটি ডেস্ক! সেখানে গোমড়া মুখে দুজন সিকিউরিটি উর্দি পরে বসে রয়েছে। তিজুর দিকে ভারী চোখ তুলে অনিচ্ছুক ভাবে তাকাল তাদের একজন। তিজু ভেবেছিল একটু কথা বলবে। কিন্তু লোক দুটোর মুখ দেখে ভক্তি চটকে গেল।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে এই লাউঞ্জের মতো জায়গাটা বেশ বড়। সুন্দর করে সাজানো। যেন কোনও হোটেল! ও দেখল এক পাশের সোফায় জগন বসে রয়েছে। হাতে ধরা মোবাইলটা নিয়ে কীসব খুট খুট করছে।

ওকে দেখেই উঠে দাঁড়াল, ‘কথা হল দাদা? যাকে খুঁজছেন তার ঠিকানা পেলেন?’

তিজু মাথা নাড়ল, ‘আসলে না বলে এসেছি তো। দেখলাম কেমন একটা অসন্তুষ্ট যেন! পরের দিন ফোন করে আসব।’

‘ফোন করবেন কী করে! যাক গে! তবে আর কী! চলুন! বাড়ি যাবেন তো? নাকি…’

তিজু ঘড়ি দেখল। সন্ধে হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। আজ ঠান্ডাটাও পড়েছে বেশ। সাড়ে সাতটা বাজে। আর কোথায়ই বা যাবে! বাড়ি গেলেই হয়!

‘কী দাদা, বউদির সঙ্গে দেখা করতে যাবেন না একদিনও!’ কথাটা খুব সাবধানে বলল জগন, ‘না মানে দেখা করতেই পারেন। আপনাকে খুঁজতে এসেছে!’

ওকে খুঁজতে মুকু এসেছে! এটা ভাবতেই কেমন একটা লাগছে তিজুর। মধ্য কলকাতার একটা বড় হোটেলে উঠেছে। জগনের থেকে শুনেছে, কলেজ স্ট্রিটে পিসির বাড়িতেও গিয়েছিল। কিন্তু কেন!

তিজু বোঝে যে মুকু নিজে আসেনি। নিশ্চয় দীপন বলে-কয়ে রাজি করিয়ে পাঠিয়েছে! লোক জানা-জানি যাতে না হয়! যাতে ওদের বদনাম না হয় তাই মুকুকেই পাঠিয়েছে! কিন্তু মুকু কেন রাজি হল আসতে! মুকু তো বলেইছিল তিজুর মতো আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর একটা মানুষের সঙ্গে ও আর কোনও যোগাযোগ রাখতে চায় না!

তিজু বড় বাড়িটা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। এক পাশে অলিভ রঙের মোটর বাইকটা রাখা আছে। ও আকাশের দিকে তাকাল। কেমন একটা পাতলা সর পড়ে আছে শহরের মাথায়। ধোঁয়াশা!

মুকু বিয়ের পরপর বলত, ‘আমরা কেন দিল্লি ছেড়ে অন্য কোথাও যাচ্ছি না! ভাল লাগে না এখানে থাকতে আমার!’

সেই কলেজ জীবনের প্রেম ওদের। কয়েক বছরের সিনিয়ার ছিল তিজু। কলেজে প্রথম দিন দেখেই মুকুকে ভাল লেগে গিয়েছিল ওর। কেন কে জানে মনে মনে বলেছিল, ‘এই মেয়েটাকেই আমার চাই!’

মুকু সহজে যদিও রাজি হয়নি। প্রায় দু’বছর চেষ্টা করার পরে রাজি হয়েছিল। সেদিন ওরা কুতুবমিনারের কাছে বসে ছিল। আকাশ ফুঁড়ে উঠে যাওয়া পাথরের মিনারটাকে চিরকাল রকেট মনে হয়েছে তিজুর। কিন্তু সেদিন ওইদিকে মন ছিল না! ও মুকুর দিকে তাকিয়েছিল হাঁ করে!

মুকু আলতো করে ওর হাতে চিমটি কেটে বলেছিল, ‘আমার মা কিন্তু তোকে পছন্দ করে না। আমি মায়ের অমতেই এই সম্পর্ক করছি। আমায় কিন্তু কষ্ট দিবি না!’

‘দেব না।’ মুকুর হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলেছিল তিজু। মুকুর হাত দুটো কী যে সুন্দর ছিল! ছোট ঝিনুকের মতো নখ! কফি রঙের নেলপলিশ! মুকুর সামনে বসলে সব গুলিয়ে যেত তিজুর।

মুকু বলেছিল, ‘এই হাত ছুঁয়ে বললি কিন্তু! মনে থাকে যেন। মিথ্যে বললে আমি মরে যাব!’

‘আর তুই? তুই দিবি কষ্ট?’ তিজু আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছিল।

মুকু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কপালের ওপর এসে পড়া চুল সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘গ্যারান্টি দিতে পারছি না! দিতেও পারি! এখনও ভেবে নে! টাইম আছে। কষ্ট দিতে পারি কিন্তু!’

তিজু হেসে বলেছিল, ‘ভাবনা সব হয়ে গিয়েছে! আর টাইম নেই ব্যাক গিয়ারের। কষ্ট দিলে সামলে নেব ঠিক।’

সামলে নেবে কষ্ট! ঠিক সামলে নেবে? সামলাতে পারল কি! সামলাতে পারলে আজও কেন মুকুর মুখ মনে পড়লে এমন করে কাঁটা বিঁধে যায় মনের মধ্যে! চোখ জ্বালা করে! কষ্ট আর অভিমানে বুজে আসে পৃথিবী!

মিনারের থেকে সামান্য দূরে একটা জায়গায়, ভাঙাচোরা একটা দেওয়ালে অনেকের মতো ও নিজেও ইট দিয়ে লিখেছিল ‘তিজু প্লাস মুকু’!

আজ এতদিন পরে কলকাতা শহরের এই রাস্তায়, সন্ধের আবছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই দেওয়ালটার কথা মনে পড়ে গেল তিজুর! মনে হল যতদিন না ওই দেওয়ালটা কেউ ভেঙে ফেলছে অন্তত ওইখানে মুকুর পাশ থেকে কেউ সরাতে পারবে না ওকে!

‘আমায় একটু ছেড়ে দেবেন রাসবিহারী মোড়ে?’ জগন তাকাল তিজুর দিকে।

তিজু হেসে ‘ঠিক আছে’ বলতে গেল। কিন্তু পারল না। তার আগেই জগনের ফোনটা বেজে উঠল।

জগন ফোনটা দেখে ‘একটু আসছি’ বলে সরে গেল এক পাশে। তারপর নিচু গলায় কীসব কথা বলতে লাগল।

এই ছেলেটা সত্যি খুব অদ্ভুত। কী যে কাজ করে এখনও জানতে পারল না। জিজ্ঞেস করলেই বলে, ‘আমি কাজ করি না দাদা। বসে খাই। বাবা দাদা টাকা পাঠায় গ্রাম থেকে! গজব লাইফ! রিটায়ার্ড আমি!’

এমন একটা ছেলেকে যদি ব্যারির ওই চ্যানেলের জন্য পাওয়া যায়!

ব্যারির কথা মনে পড়তেই হাসি পেল। লোকটা রেগে গিয়েছে খুব। ভুবন গোঁসাই বলে একজনের সঙ্গে নাকি কথা বলছে ব্যারি। এই ফিল্ডের বহু দিনের লোক। কিন্তু তাও তিজুর কথা জানতে চাইছে ব্যারি। কবে থেকে কাজে যোগ দেবে জানতে চাইছে।

তিজু এখনও স্পষ্ট কিছু বলতে পারেনি। আসলে যাঁকে খুঁজতে দুম করে বেরিয়ে এসেছে তাঁর খবর না পেয়ে যায় কী করে! ওর যে কী হচ্ছে মনের মধ্যে সেটা ব্যারিকে বোঝানো সম্ভব নয়! আসলে কাউকেই সম্ভব নয়! দীপন পর্যন্ত বুঝতে পারেনি!

এখনও তো দীপনের অবাক মুখটা দেখতে পায় ও। দীপন বড্ড ভালবাসে ওকে। বয়সে বেশ কিছুটা ছোট। তারওপর স্পাইনে চোট পেয়ে এখন হুইল চেয়ার বাউন্ড হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার বলেছে যদিও সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সময় লাগবে! এই সময়ে হয়তো এভাবে ওকে না জানিয়ে এভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি! হয়তো মুকুর, ‘তুই স্বার্থপর’ কথাটাই আবার নতুন করে ওর ওপর প্রযোজ্য। কিন্তু উপায় কী! এই ব্যাপারটা তো জানতেই হবে ওকে! এই লোকটা কে না জানলে তো সারা জীবনেও শান্তি পাবে না!

মায়ের সেই সময়ের কথাটা তো এখনও কানে বাজে! একটা মাত্র কথা! কিন্তু কী ভাবেই না পালটে দিল সব!

‘কেন তুমি খুঁজতে চাইছ তাকে? কী হবে?’ রাধুবাবু অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন ওর দিকে।

সেদিন আনোয়ার শা রোডে রাধুবাবুর বাড়িতে গিয়েছিল তিজু।

দোতলা বাড়ি। সামান্য পুরনো। কিন্তু বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি করা!

আগের দিন শুনেছিল রাধুবাবু পুরী গিয়েছেন। তাই ওকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

সেদিন সন্ধেবেলা রাধুবাবুর বড় ছেলে নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিল। তিজুকে চিনতে পেরে বলেছিল, ‘আসুন। বাবা এসে গেছেন। আমি বলেছিলাম আপনার কথা। আপনি বসুন একটু।’

বসার ঘরটা বেশ বড়। পুরনো দিনের আসবাবে সাজানো। তবে সবটাই ঝকঝকে পরিষ্কার! চারিদিকে নানান ছবি টাঙানো! পেইন্টিং! কয়েকটা ‘আসল’ যামিনী রায় মনে হয়েছিল তিজুর।

‘হ্যাঁ ভাই বলুন।’ সাদা লেসের পর্দা সরিয়ে একজন বয়স্ক মানুষ ঢুকে এসেছিলেন ঘরে! তিজু উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করেছিল। মানুষটা তিজুকে দেখে কেমন যেন থমকে গিয়েছিলেন!

ফর্সা, বেঁটে মানুষ! উলটো করে আঁচড়ানো চুল। অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন তিজুর দিকে!

তিজু নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি দিল্লি থেকে আসছি। আমার নাম ঋত্বিজ মুখার্জি! আসলে আমার মাকে আপনি বোধহয় চিনবেন! কমলিনী মুখার্জি। বিয়ের আগে সান্যাল ছিল! আমি মায়ের কাছ থেকে আপনার কথা শুনেছি। তাই…’

রাধুবাবু ধীর পায়ে এসে বসেছিলেন সামনের চেয়ারে। তারপর সময় নিয়ে বলেছিলেন, ‘কমলিনী! সে পাঠিয়েছে? কেন? ও কেমন আছে?’

কেন! কীভাবে এবার বলবে ও! তাও বলেছিল, ‘আমি… মানে… আপনি তো এক সময় মায়ের খুব ভাল বন্ধু ছিলেন! তাই মা বলল… মানে বলেছিল…। আসলে মা আর নেই। মারা গিয়েছেন। আর যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন আমায়! বলেছেন আপনি জানেন সবটা। মানে ওই ব্যাপারটা। তাই…’

রাধুবাবু মাথা নামিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর খানিক ভেবে বলেছিলেন, ‘সব কি আর আমি জানি! যে সময়ে আমরা যুবক ছিলাম, কলকাতা খুব একটা শান্ত শহর ছিল না। সেই সত্তর একাত্তর খুব কঠিন সময় ছিল আমাদের। কমলিনী ফিজিক্স নিয়ে পড়ত। খুব দামাল ছিল। জড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনে! আমাদের চারজনের গ্রুপ ছিল একটা। আমি, কমলিনী, অভিনব আর লব! তারপর… আমি তো চলে গিয়েছিলাম বিদেশে। পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আসলে আমায়। ওদের তিনজনের যোগাযোগ ছিল। পরে আমি খবর পাই যে কমলিনী নানান বিপদে আছে। ওর বাড়ির লোকেরা ওকে একরকম বাঁচাতেই দিল্লিতে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল জোর করে! সরি, জোর করে কথাটা আমার বলা ঠিক হয়নি!’

‘না না, ইটস অল রাইট।’ তিজু বলেছিল সঙ্গে সঙ্গে।

আসলে মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়েটা সম্বন্ধ করেই দেওয়া হয়েছিল। বাবা কলকাতার ছেলে হলেও দিল্লিতে সেক্রেটারি লেভেলে বড় চাকরি করত। খুব সাহেবি ধাঁচের মানুষ ছিল। পরে বড় ব্যবসাও করেছিল। কিন্তু মায়ের সঙ্গে তেমন ভাল কিছু সম্পর্ক ছিল না। সেটা ওরা দুই ভাই-ই বুঝতে পারত! তবে বাবার অন্য মহিলার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল না। সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। মা কেমন যেন আনমনা ধরনের ছিল। ছোটবেলায় কয়েকবার লুকিয়ে মাকে কাঁদতেও দেখেছে তিজু। কিন্তু কেন সেটা বোঝেনি।

একবার তো ও জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন তুমি কাঁদো মা? বাবা বকেছে?’

‘না সোনা!’ ক্লাস ফাইভে পড়া ছোট্ট তিজুকে জড়িয়ে ধরেছিল মা।

‘তবে তোমার কীসের কষ্ট মা?’ তিজু মায়ের গায়ের থেকে ভেসে আসা কর্পূর-চন্দনের গন্ধে ডুবে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করেছিল।

মা আলতো ভাবে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘এখন বললে তুই বুঝবি না বাবা!’

‘কেন বুঝব না! আমি বড় হয়ে গিয়েছি! তুমি বলে দেখো! আমি বুঝব ঠিক।’ জেদ করেছিল তিজু!

মা সামান্য সময় নিয়েছিল। তারপর বলেছিল, ‘ “He was my North, my South, my East and West, / My working week and Sunday rest, / My noon, my midnight, my talk, my song; / I thought that love would last for ever : I was wrong.” বুঝলি কিছু?’

তিজু তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। আবছা মতো কিছু একটা বুঝেও যেন বুঝতে পারছিল না ও।

মা বলেছিল, ‘বলব তোকে। ঠিক সময়ে একদিন বলব। দেখিস!’

রাধুবাবুর কথায় আবার সেই বিকেলবেলাটা মনে পড়ে গিয়েছিল ওর।

রাধুবাবু বলেছিলেন, ‘তোমায় অভিনবের নাম্বার আর ঠিকানা আমি দিচ্ছি। ওকে ফোন করে যেয়ো। ও বলতে পারবে তুমি যা জানতে চাইছ! তবে ও খুবই অসুস্থ মানুষ। সেটা মাথায় রেখো!’

‘অনেক ধন্যবাদ!’ তিজু হেসেছিল সামান্য।

রাধুবাবু তাকিয়েছিলেন ওর মুখের দিকে। তারপর বলেছিলেন, ‘কমলিনী আমার বোনের মতো ছিল। ও নেই জেনে খুব কষ্ট পেলাম। কিন্তু তোমায় বলছি, কী দরকার পুরোনো জিনিস খুঁড়ে বের করার। যেভাবে আছে সেভাবে থাকতে দাও না।’

তিজু সামান্য হেসে বলেছিল, ‘আমার এটা জানা দরকার! সত্যি বলছি!’

রাধুবাবু মাথা নামিয়ে বলেছিলেন, ‘অভিনবের কাছে যেয়ো। দেখো যদি গুপ্তধন খুঁজে পাও!’

‘দাদা,’ জগন এসে দাঁড়াল সামনে, ‘যাবেন না?’

‘হ্যাঁ।’ তিজু বাইকে বসল।

‘একটা কথা!’ জগন আবার বলল।

‘কী?’

‘দাদা আপনার শাশুড়ি মা এন্ট্রি নিয়েছেন, খবর পেলাম!’

‘মানে?’ বুঝতে পারল না তিজু।

‘আরে আপনার শাশুড়ি। বউদির মা। লক্ষ্ণৌ থেকে এসে হাজির হয়েছেন!’ জগন বলল।

‘তুই এখনও এসব করছিস!’ অবাক হয়ে তাকাল তিজু।

‘আরে দাদা আমি রিটায়ার্ড মানুষ। কী করব আর! ওই টাইম পাস করি। তা কেসটা কী দাদা? এদিকে আপনি কিছু খুঁজছেন! ওদিকে আপনাকে কেউ খুঁজছে! ভুলভুলাইয়া পুরো!’

তিজু মোটর বাইকে স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘বসে পড়। সব কিছু বোঝার মতো বয়স তোর হয়নি!’

‘সেকি! আমি থার্টি টু! বুঝব না!’ জগন অবাক হল।

‘নকশাল। দিল্লি! ডাব্লিউ.এইচ. অডেন। বুঝলি কিছু?’ তিজু তাকাল।

জগন হাসল, ‘আমায় ভাল মানুষ পেয়ে গান্ডু বানাচ্ছেন!’

‘মানে?’ হাসল তিজু।

জগন বাইকের পেছনে বসে মাথায় হেলমেট পরে বলল, ‘আজকালকার দিনে ভাল মানুষদের ডাকনাম গান্ডু, জানেন না?’

৯ আদিত

কাকুলিয়া রোডের এই গলির পেটের মধ্যে পাক খাওয়া আরও সব ছোট সরু গলি যেন কলকাতার নাড়িভুড়ি! বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এমনটায় মনে হয়েছিল আদিতের।

আজ বাবাকে নিয়ে সকালবেলা ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। হার্টের পেশেন্ট। তার সঙ্গে আরও নানান সমস্যা আছে। সারাক্ষণ বিছানাতেই শুয়ে থাকে। দেখলে কে বলবে এক সময় এই মানুষটা এত কাজ করত!

স্নান হয়ে গিয়েছে আজ আদিতের। সকাল সকালই করে নিয়েছে! বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে মাকুও সঙ্গ দিয়েছিল। ছেলেটা এখন বাবার ঘরে বসে খবর কাগজ পড়ছে!

বাবাকে বাড়িতে এনে আদিত একটু বাজার করে এনেছে। সামান্যই সবজি বাজার। মা ফ্রিজে রেখে খেতে পছন্দ করে না! ওদের ফ্রিজটা বহু পুরোনো। সেই আশি সালে কেনা! ‘জেম’ বলে একটা কোম্পানির! সে কোম্পানি এখন আর নেই নিশ্চয়। নিরামিষ জিনিস রাখা হয় ওতে। মা গোপালের পুজো করে। তার জন্যই ফ্রিজটা ব্যবহার করা হয়।

বাজার করে দিয়ে রান্নাঘরে বসেই রুটি তরকারি খেয়ে নিয়েছে আদিত। ওর খাবারের ঝামেলা নেই। কিছু একটা হলেই হল। মা মাকুকে ঘরেই দিয়েছে খাবার। ওদের রান্নাঘরটা ছোট। পাশাপাশি দু’জন বসে খেতে পারে না!

খাওয়া শেষ করে বারান্দার পাশের ছোট বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে নিল আদিত। এখান থেকে ওর ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটা দেখা যায়। ও তাকাল সেই দিকে। সাড়ে নটা বাজে। বেশ দেরি হয়ে গেল। রাজুদা দশটার সময় পৌঁছতে বলেছিল। এখান থেকে লেক গার্ডেন্স যাওয়ার সোজা কোনও পথ নেই!

আজ একবার সারেঙ্গাবাদ যাওয়ার কথা। অক্টোবর আর নভেম্বরের মাইনে এখনও দেওয়া হয়নি ফ্যাক্টরিতে। পুজোর বোনাসও দেওয়া হয়নি। এটা ঠিক হচ্ছে না। রাজুদা ওকে বলেছে ব্যাপারটা দেখতে। আজ একটা মিটিং করে নেবে। সেখানে কোম্পানির চিফ অ্যাকাউনটেন্ট আর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার থাকবেন। আজ ওদের আলটিমেটাম দিয়ে দেওয়া হবে। সাত দিনের মধ্যে সব বকেয়া মিটিয়ে না দিলে লাগাতার ধর্মঘট চলবে!

মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দ্রুত মানিব্যাগ আর ঘড়িটা নিয়ে নিল। আর দেরি করা যাবে না। এখান থেকে হেঁটে গোলপার্ক। সেখান থেকে অটো ধরে রবীন্দ্রসরোবর স্টেডিয়াম। তারপর বাকিটুকু হাঁটা! সময় লাগবে।

একবার আয়নার সামনে দাঁড়াল আদিত। চুলটা আঁচড়ে নিল। বড় হয়েছে সামান্য। কাটিয়ে নিতে হবে। সাধারণত ছোট চুল রাখে আদিত। স্মাহি বলত, ‘তুমি এত ছোট করে চুল কাট কেন? কেমন লাগে!’

কেমন লাগে? নিশ্চয় খারাপ লাগে! মানে লাগত। তাই তো ওভাবে তাড়িয়ে দিয়েছিল!

ভাবলেই এখনও চোখের কোনটা জ্বালা করে ওর। কেমন কষ্ট হয় শ্বাস নিতে! রাগও হয় নাকি! হয় তো! রাগও হয়! বাবা যে বলে ‘জয়’ সেটা এখনও পারেনি! নিজেকে ‘জয়’ করতে পারেনি আদিত!

বাবা সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে। আর নানান বই পড়ে। খুব কম কথা বলে মানুষটা। কিন্তু যেটুকু বলে তাতেই জীবনের অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায় আদিতের।

কয়েকদিন আগে খুব মনখারাপ ছিল ওর। রবিবার ছিল সেটা। স্মাহির জন্মদিন ছিল। ওই দিনটা এলেই কেমন যেন লাগে ওর। কোথায় যেন মনে মনে মরে যায় ও। আর এই বার তো আরওই কষ্ট হয়েছিল। এতদিন কোথায় ছিল মেয়েটা জানত না। কিন্তু এখন যেই জেনে গিয়েছে তাই মনখারাপটা বেশি।

সেদিন ট্রেন থেকে নেমে স্মাহিকে দেখে তো অবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর মনে হয়েছিল কী করছে এখানে ও! সেদিন স্মাহি আর ওই জট পরা চুলের মানুষটার মধ্যের কথাবার্তা আড়াল থেকে যেটুকু শুনেছিল তাতে বুঝেছিল ওদের ভালই যোগাযোগ আছে!

তাই জন্মদিনের আগের দিন বিকেলে একটা ছোট্ট উপহার প্যাক করে ও নিয়ে গিয়েছিল স্টেশানের সেই মানুষটার কাছে।

লোকটা তখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছিল। আসা যাওয়ার পথে সামান্য পয়সাও পড়ছিল বাটিতে। গানটা শেষ হওয়া অবধি ও দাঁড়িয়েছিল দূরে। তারপর গান শেষ হলে পায়ে পায়ে গিয়েছিল সামনে।

লোকটি হয়তো ভেবেছিল আদিত কিছু পয়সা দিতে এসেছে। কিন্তু কিছু না বলে আদিত যখন সামনে হাঁটু মুড়ে বসেছিল, তখন লোকটি নিজেই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কিছু বলবে ভাই!’

আদিত তাও ইতস্তত করেছিল। তারপর দ্বিধার সঙ্গে বলেছিল, ‘আসলে আমার একটা অনুরোধ আছে।’

‘বলো।’ লোকটি হাসি মুখে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

‘আপনার কাছে সেদিন একটি মেয়েকে দেখেছিলাম। মানে সন্ধের মুখে। ফর্সা। দোহারা চেহারা। বাঁ হাতের অনামিকায় একটা সবুজ আংটি পরে। ঠোঁটের ওপর কাটা দাগ! মানে…’

‘স্মাহি…’ হেসেছিল লোকটা।

‘এটা তার জন্য। ওকে কি আপনি দিয়ে দিতে পারবেন? সেদিন কথা শুনে মনে হল আপনাদের মাঝে মাঝে দেখা হয়।’

লোকটা ওর হাতে ধরা প্যাকেটটা দেখেছিল। তারপর হেসে বলেছিল, ‘তুমি ওকে চেনো? নাকি…’

‘না না। আমি চিনি। অনেক দিন আগে থেকে চিনি। কিন্তু আর যোগাযোগ নেই। আসলে…’ কী বলবে বুঝতে না পেরে সামান্য থমকে গিয়েছিল আদিত। তারপর বলেছিল, ‘কাল ওর জন্মদিন। তাই… প্লিজ যদি দিয়ে দেন। কিন্তু বলবেন না আমি দিয়েছি। এটাই আমার অনুরোধ।’

লোকটা কী ভেবেছিল কে জানে। সামান্য চিন্তা করেছিল। তারপর হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে বলেছিল, ‘এসব নিজেকেই দিতে হয়। যা ঝামেলা হয়েছে মিটিয়ে নিতে হয়। স্মাহি খুব দুঃখী মেয়ে। একা থাকে। কেউ নেই ওর। ওরও তো কাউকে দরকার!’

আয়নায় নিজের দিকে তাকাল আদিত। এখন কষ্টে আছে স্মাহি। এখন কেউ নেই ওর! কেন নেই! জেঠু, জেঠিমা, দাদা, বোন, পিসিরা, সবাই তো ছিল! সবাই গেল কোথায়! আর সেই ব্যাপারটা! সেটার কী হল! আচ্ছা স্মাহি ভাল নেই জেনে ওর কি কোথাও একটা ভাললাগা এসেছিল! কোথাও কি মনে হয়েছিল, ওকে কষ্ট দেবার ফল পেয়েছে স্মাহি!

সেই প্যাকেটটা দিয়ে আসার পর থেকে খুব মনখারাপ ছিল আদিতের। দু’-তিনদিন বাড়ি থেকে বেরোয়নি। নিজের ঘরেই বই নিয়ে বসেছিল। কিন্তু আসলে বই পড়ছিল না। শুধু বসেই ছিল।

বাবা পুরো ব্যাপারটাই লক্ষ করেছিল। দুই ঘরের মাঝের জানলা দিয়ে বাবা দেখছিল আদিতকে। তারপর একদিন রাতে ডেকে নিয়ে বসিয়েছিল নিজের পাশে।

আদিত ঘরে এসে স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়েছিল বাবার দিকে। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কিছু বলবে?’

বাবা সামান্য সময় নিয়ে হাতের ভর দিয়ে উঠে হেলান দিয়েছিল বালিশে। তারপর দুর্বল গলায় বলেছিল, ‘আমাদের ভাষায় জানিস তো দুটো শব্দ আছে। জয় আর বিজয়! দুটোর পার্থক্য জানিস?’

‘নাতো!’ আদিত তাকিয়েছিল বাবার দিকে।

বাবা বলেছিল, ‘বিজয় মানে এমন একটা অবস্থা, যেখানে একজন জিতবে আর অন্য জন পরাজিত হবে। মানে এটা একটা এক্সটারনাল ব্যাপার। দু’জন আলাদা মানুষের ব্যাপার। আর জয় হল মানুষের নিজের ব্যাপার। একার ব্যাপার। তার রিপু, তার ইচ্ছে, তার মনের ন্যায় অন্যায়ের ব্যাপার! সেটাকে হারিয়ে দেওয়াটাই জয়। এই জয় সকলের কাম্য। তোরও এটা মনে রাখা উচিত! এমন করে মনমরা হয়ে থাকিস না। যে জন্য তোর মনখারাপ, সেটা জয় করার চেষ্টা কর।’

‘বুড়ো,’ মা এসে ঘরে ঢুকল এবার।

আদিত ঘুরে তাকাল।

মা বলল, ‘ভুবন ফোন করেছিল। কিছু ঠিক করলি চাকরির ব্যাপারে? ভুবন বলছিল তোকে যেন বলি। পার্টি পলিটিক্সের কী অবস্থা তুই দেখছিস তো! কটা ভাল লোক আছে বল! এখানে তুই টিকে থাকবি কী করে? তুই কাজটা নে বুড়ো!’

আদিত দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু, মাকে কিছু বলার মানে হয় না! মা বুঝবে না। জানে এই সংসারে টাকার দরকার। কিন্তু এই জায়গা থেকে বেরোতে গেলে ওর টাকার চেয়েও আরও বেশি কিছু কারণ দরকার! তা ছাড়া স্মাহি এসে গেছে এই অঞ্চলে! সেখানে কী করে এখন ও নয়ডা চলে যাবে? না স্মাহির সামনে ও যাবে না। কথাও হবে না। কিন্তু একই জায়গায় তো থাকবে! কাছাকাছি তো থাকবে! দূর থেকে হঠাৎ কোনও কোনও দিন তো দেখাও হয়ে যাবে। ওর এই সামান্য জীবনে সেটাই তো একটি মাত্র সুখ!

উত্তর না দিয়ে আদিত পাশের ঘরে গেল। মাকু বাবার পাশে পড়ে থাকা রেডিয়োটা নিয়ে কীসব খুটখাট করছে। ওকে দেখে রেডিয়োটা রেখে উঠে দাঁড়াল।

দু’জনে মিলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল এবার। এই গলির পাশে বড় বড় পুরোনো দিনের বাড়ি আছে। রোদ খুব একটা আসে না। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল আদিত। শীতটা ভালই পড়েছে এবার। রাস্তাঘাট বেশ ভেজা ভেজা। রাতের দিকে কাল খুব কুয়াশা পড়েছিল। আজ ভোরেও বাবাকে নিয়ে ট্যাক্সি করে বেরোবার সময় চারিদিক আবছা হয়ে ছিল কুয়াশায়!

পকেটে ফোনটা নড়ে উঠল এবার। কে আবার ফোন করল এখন! ও ফোনটা বের করল। একটা অচেনা নাম্বার। ফোনটা কানে ধরল আদিত, ‘কে বলছেন?’

‘তুই কোথায়!’ রাজুদার গলা! কিন্তু এই নাম্বারটা তো ও চেনে না!

‘আমি আসছি রাজুদা। রাস্তায় আছি। এই গোলপার্ক থেকে অটো ধরব।’

রাজুদা বলল, ‘তাড়াতাড়ি আয়। ট্যাক্সি, ওলা, উবার, যাহোক করে নে। আমি টাকা দিয়ে দেব। দরকার আছে। কুইক।’

কথাটা বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিল রাজুদা। অবাক লাগল আদিতের। কিছু হয়েছে নাকি! এভাবে তো রাজুদা ডাকে না!

মাকু বলল, ‘রাজুদা ডাকছে? চল চল তাড়াতাড়ি চল।’

আদিত তাকাল মাকুর দিকে। হাসি পেয়ে গেল। ভাবটা এমন যেন মাকুকেই ডেকেছে! ও কিছু না বলে পা চালাল দ্রুত।

গোলপার্ক থেকে ট্যাক্সি পেতে অসুবিধে হল না। আজকাল হলুদ ট্যাক্সি খুব একটা বায়না করে না!

কোথায় যাবে বলে পেছনের সিটে গুছিয়ে বসল আদিত।

মাকু পকেট থেকে একটা পান বের করে মুখে পুরে চিবোল কিছুক্ষণ। তারপর জানলা দিয়ে পিক ফেলল বাইরে। বলল, ‘তোকে ওই ব্যাপারটা বলেছিলাম। সেটা কিছু করলি নাতো!’

‘কোনটা?’ অবাক হল আদিত! মাকু তো সারাদিন কিছু না কিছু বলেই যায়! সব তো মন দিয়ে শোনেই না!

মাকু বলল, ‘আরে ওই যে রে। ট্রেনে আলাপ হয়েছিল আমার সঙ্গে। গান গেয়ে বেড়ায় একজন অন্ধ মানুষ! সঙ্গে তার স্ত্রী আছে! নানুদা আর রিতাদি। বলেছি না! আমি বাড়িতেও গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। আমায় সিঙাড়া আর চা খাইয়েছিল। ওদের কথা বলছি!’

আদিতের মনে পড়ে গেল। সত্যি বলেছিল বটে একবার। কিন্তু মনে ছিল না ওর।

ও জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’

‘রাজুদাকে বলে ওদের কিছু একটা করে দে না! দারুণ গায় ওরা!’

‘কী করবে রাজুদা?’ আদিত অবাক হয়ে তাকাল।

‘দুঃস্থ শিল্পী! একটা কিছু কর। একটা বাচ্চা আছে ওদের। ভারী মিষ্টি! প্লিজ বল না। প্লিজ!’

আদিত হাসল। আর সত্যি বলতে কী ভালও লাগল। এই যে মাকু, খ্যাপাটে টাইপ। ভুলভাল বলে। এই যে ওর বাবা মা আদিতকে বলে রাজুদাকে বলে ওর কিছু একটা করে দিতে। মাকু কিন্তু একবারও কিছু বলে না সেসব। ও নিজের আনন্দে থাকে। নিজের জন্য ভাবেও না। মনখারাপ করে না। এই যে ট্রেনে আলাপ হওয়া সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের জন্য কিছু করতে চাইছে এটাতেই বোঝা যায় ছেলেটা কত ভাল! বোঝা যায় এর ‘জয়’ হয়েছে!

আদিত বলল, ‘ঠিক আছে। আমি বলব। জানি না কিছু হবে কিনা। তবে বলব।’

মাকু বলল, ‘জানিস ওদের বাড়ির পাশে একটা মেয়ে থাকে। সেদিন আলাপ হল একটু। কী একটা যুক্তাক্ষর দিয়ে নাম। কী দেখতে রে! ব্যাপক! সাংঘাতিক!’

আদিত হেসে বলল, ‘সেই জন্য হেলপ করতে চাইছিস নাকি?’

‘পাগল! আমার কুত্তার পেট। অত দামি ঘি হজম হবে না।’ মাকু হি হি করে হাসল, ‘ওসব আমার জন্য নয়। ভাল কোনও ছেলের জন্য। আমি জাস্ট বললাম। তুই চল। তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। রিতাদি আমায় ফোন করে মাঝে মাঝে। যেতে বলে। ওই মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব তোর। তোদের দারুণ মানাবে। যাবি?’

আদিত হাসল। বলল, ‘আমার জীবনে আর যুক্তাক্ষরের জায়গা নেই। বুঝলি?’

মাকু হেসে বলল, ‘বুঝেছি! তুই গুল্লি খাওয়া বাঘ! লাথ খাওয়া প্রেমিক! তুই গ্যাও কেস!’

মাকুকে বাইরে রেখে রাজুদার বাড়িতে ঢুকল আদিত। মাকু বাইরের পার্টির ছেলেদের সঙ্গে গল্প শুরু করেছে। ওকে সবাই বেশ পছন্দ করে। ওর হাবিজাবি কথা শুনতে ভালবাসে সবাই!

রাজুদা নিজের ঘরে বসেছিল। ওকে দেখে ইশারায় আসতে বলল ঘরে। হাত দিয়ে দেখাল দরজাটা বন্ধ করে দিতে।

আদিত দরজা বন্ধ করে একটা বেতের মোড়া টেনে নিয়ে বসল সামনে। ব্যাপারটা কী বুঝতে পারছে না। বাদলদারা অপেক্ষা করে আছে। রাজুদা কী বলতে চায়!

রাজুদা সময় নিল একটু। পাশে রাখা গ্লাস তুলে জল খেল। রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছল। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘যে ফোনটা থেকে কল করেছিলাম, সেটা পুশি মানে তোর বউদির!’

‘ও!’ আদিত কী বলবে বুঝতে পারল না। বউদির নাম্বার ওর কাছে নেই। থাকার কথাও নয়।

রাজুদা চোয়াল শক্ত করে মাথা নিচু করল। যেন নিজের সঙ্গে কিছু একটা বোঝাপড়া করছে। তারপর মাথা তুলে বলল, ‘পুশির ডিপ্রেশানটা বাড়ছে আদিত। ডাক্তার বলছে এটা ভাল লক্ষণ নয়। আমাদের উনি দত্তক নিতে বলছেন! পুশিও রাজি ছিল। কিন্তু সমস্যা হল, ইদানীং ও অন্য কারও বাচ্চা নিতে চাইছে না। সব রকম ট্রিটমেন্ট ফেল করেছে। আমি বাবা হতে পারব না। কিন্তু পুশি মা হতে পারবে। তাই… তাই…’

আদিত তাকিয়ে রইল রাজুদার দিকে।

রাজুদা আবার জল খেল একটু। তারপর ঝুঁকে পড়ে আদিতর হাতটা ধরে বলল, ‘আমাকে একটা হেলপ কর ভাই। পুশি বলেছে আমায়। তাই তোকে বলছি। খুব ভেবেই বলছি। প্লিজ একটু শোন। তোকে দেখতে এত ভাল। তুই সৎ। ভাল বাড়ির ছেলে। পুশি চায়, তোর থেকে বাচ্চা নিতে। তারপর তোকে আমি ভাল কাজের জোগাড় করে দেব। তোকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেব। টাকাপয়সাও দেব। না না, জানি তুই ওসব চাস না। আমি আমাদের জন্য বলছি। তুই পুশিকে একটা বাচ্চা দে! ও নাহলে পাগল হয়ে যাবে এবার! সুইসাইড করবে! প্লিজ আদিত। আমি আমার সব সংস্কার, লজ্জা, দ্বিধা পার করে তোর কাছে হাত পাতলাম। আমি পুশিকে খুব ভালবাসি। ও কষ্ট পাচ্ছে! আমি দেখতে পাচ্ছি না! ও খুব চাইছে। তাই তোকে ফোন করে এমন করে ডেকে আনলাম। কেউ জানবে না। কেউ না। কথা দিচ্ছি! তুই প্লিজ না করিস না! আমায় এটা ভিক্ষে দে ভাই! প্লিজ!’

আদিত তাকিয়ে রইল সামনে। কিন্তু রাজুদাকে যেন দেখতে পেল না! ও দেখতে পেল বহু বছর আগে একটা লম্বা টানা বারান্দা! আর সেখানে আলোর নীচে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে একটা মেয়ে! আদিত কী করে, কী বলে সেটার জন্যই যেন অপেক্ষা করছে! মেয়েটার রঙ্গন ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁট! আর তার ওপরে ভীষণ অভিমানী একটা কাটা দাগ!

১০ স্মাহি

রেস্টুরেন্টটা বেশ বড়। আর পুরনো। পার্কস্ট্রিটের যে ক’টা পুরনো খাবারের জায়গা আছে এটা তার মধ্যে একটা। বড় রাস্তা থেকে কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই জীবনটা যেন লুডোর সাপের মুখে পড়ে এক ধাক্কায় ষাট দশকের কলকাতায় নেমে যায়!

এখানে চারিদিকে পুরনো কাজ করা চেয়ার টেবল। সিলিঙে কলকা। লম্বা ঝুলের নকশাকাটা টেবলক্লথ। একপাশে মাছের অ্যাকোরিয়াম! আর সঙ্গে ওয়েটারদের উর্দিটাতেও কেমন যেন উত্তম কুমারের কলকাতার ছাপ!

স্মাহি ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে তিনটে বাজে। এবার উঠে পড়তে হবে। না, ফ্যাক্টরিতে আজ যেতে হবে না। কিন্তু বাড়িতে যাবে। শরীরটা ভাল লাগছে না। এমন রেস্টুরেন্টে আসার অভ্যেস নেই। এমন খাবার-দাবার খুব কিছু ভাল লাগে না ওর। তাও আসতে হয়েছে!

স্মাহি আনমনে ঘড়িটা ধরে ডায়ালের ওপরের আলগা রিংটা ঘোরাল। কিটকিট শব্দে ঘুরল ডায়ালটা! ঘড়িটা বেশ সুন্দর। কালো আর লাল রঙের ডিজাইন করা ডায়াল। ওয়েলক্রো দেওয়া বেল্ট! ও হাত দিয়ে ঘড়িটা চেপে ধরে ভাবল, কে দিল এটা ওকে!

জটাদাদু তো কিছুতেই বলল না। এমন কী যে দিয়েছে তাকে কেমন দেখতে সেটাও একবার বলল না! কতবার যে জিজ্ঞেস করেছে! কিন্তু তাও বলল না! শুধু মিটিমিটি হেসে বলেছে, ‘কী হবে সব জেনে? জীবনের রহস্য সব জানতে নেই! যদি কপালে থাকে তোর, তবে একদিন ঠিক জেনে যাবি!’

বাড়ি ফিরে, নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে প্যাকেটটা খুলেছিল স্মাহি। দেখেছিল, একটা বাক্স! তার ভেতরে এই ঘড়িটা রাখা! আর রাখা আছে একটা পালক! হলুদ রঙের একটা পালক!

ব্যাস আর কিচ্ছু নেই! প্যাকেটটা উলটে পালটে নানান ভাবে দেখেছিল স্মাহি, যদি কিছু পাওয়া যায়! কিন্তু কিচ্ছু পাওয়া যায়নি! কে দিল এমন একটা জিনিস! কে জানে ওর জন্মদিনের কথা! সারারাত কেমন একটা অস্বস্তি নিয়ে এপাশ ওপাশ করেছিল লেপের মধ্যে! মনে হচ্ছিল কুয়াশার অন্য পারে কেউ একটা দাঁড়িয়ে আছে! তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিন্তু ও তাকে দেখতে পাচ্ছে না!

তবে ঘড়িটা পরেছে ও। সুন্দর ছিমছাম ঘড়ি! ভাল দেখতে! জটাদাদু দেখে বলেছে, ‘এই তো। ঠিক করেছিস! সে জানলে খুব খুশি হবে!’

‘কে জানলে জটাদাদু?’ শেষবারের মতো চেষ্টা করেছিল স্মাহি।

জটাদাদু হেসে বলেছিল, ‘সে আছে একজন। প্রাণের মানুষ!’

আবার ঘড়িটা দেখল স্মাহি। কোথায় গেল নীলু! একটা ফোন এসেছে বলে সেই যে বেরিয়ে গেল বাইরে, আর আসার নাম নেই! এখানে এভাবে ও একা আর কতক্ষণ বসে থাকবে!

নীলু, মানে নীলাঞ্জনার ফোন কলটা গতকাল পেয়ে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল স্মাহি। বলেছিল, ‘এটা কার নাম্বার! কোন নাম্বার থেকে ফোন করছিস তুই?’

নীলু হেসেছিল, ‘আরে আমি কলকাতায় এসেছি। রিতেশের তো ছুটি পড়েছে! ওদেশে ক্রিসমাস একটা বড় ব্যাপার। জানিস নিশ্চয়!’

ভাল লেগেছিল স্মাহির। কত্তদিন পরে কথা হচ্ছে নীলুর সঙ্গে! মেসেজে ওই যা একটু টুকটাক কথা হয়। কিন্তু এভাবে কথা হওয়াটা কী যে ভাল লাগছিল ওর! যেন বহু বছর পর ও নিজের কারও কথা শুনছিল! যেন নিজের হারিয়ে যাওয়া জীবনটা আবার ফিরে এসেছিল ওর কাছে।

ও বলেছিল, ‘কবে এলি তুই!’

‘চার পাঁচদিন হল। কিছু কাজ ছিল তাই আগে যোগাযোগ করতে পারিনি। সরি রে! কাল কিন্তু দেখা করব আমরা। লাঞ্চ করব এক সঙ্গে! পার্ক স্ট্রিটে! মনে থাকে যেন!’

স্মাহি বলেছিল, ‘দূর, সরি কীসের! আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলি এটাই অনেক!’

নীলু বলেছিল, ‘কীসব বলছিস! এখানে এলে তোর সঙ্গে যোগাযোগ করব না! পাগলি তুই! কিন্তু কাল দুটো নাগাদ চলে আসবি কিন্তু।’

‘কাল!’ সামান্য ইতস্তত করেছিল স্মাহি, ‘আমার তো অফিস আছে!’

‘ম্যানেজ কর। ছুটি নে! খুন কর। ডাকাতি কর। ডু হোয়াট এভার ইউ ক্যান! কিন্তু কাল দুটো। না করলে এটাই আমার আর তোর মধ্যে শেষ ফোন কল!’

ছুটি নেয়নি স্মাহি। ম্যানেজ করেছে। অফিস থেকে সব হিসেবনিকেশ নিয়ে সপ্তাহে একদিন অ্যাকাউন্টস অফিসারের সঙ্গে বসতে হয় ওকে। সেটাই আজকের জন্য ম্যানেজ করে নিয়েছিল ও। সকাল সকাল ও এসে পড়েছিল ক্যামাক স্ট্রিটে ওদের হেড অফিসে! এমনিতেই ফ্যাক্টরিতে টেনশান চলছে! সেই নিয়েই হেড অফিসে সবাই বেশ চিন্তিত ছিল। তাই বেশি সময় হিসেবপত্তর নিয়ে বসতে হয়নি ওকে। একটার মধ্যেই কাজ মিটে গিয়েছিল! হাতে সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে হেঁটেই ও এসে পৌঁছেছিল এই রেস্টুরেন্টে। আজ সকালে মেসেজে এখানে দেখা করার কথা বলেছিল নীলু!

আধঘন্টা অপেক্ষা করার পরে, স্মাহি দেখেছিল হন্তদন্ত হয়ে নীলু এসে ঢুকল দরজা ঠেলে। টি শার্ট, উইন্ডচিটার আর জিনস! ভাল লাগছিল নীলুকে দেখে। উঠে দাঁড়িয়ে নীলুকে জড়িয়ে ধরেছিল স্মাহি। আর কেন কে জানে আচমকা কোনও এক ভুলে যাওয়া ঘরের দরজা খুলে গিয়েছিল যেন! ঝরঝর করে জল এসে গিয়েছিল ওর চোখে! কতদিন পরে নিজের কোনও চেনা স্পর্শ পেয়েছিল ও! নিজের পুরনো জীবনের একটা টুকরো ফিরে এসেছিল ওর কাছে!

নীলু চোখ মুছিয়ে দিয়েছিল ওর। তারপর বসেছিল পাশে। কত কথা যে জমেছিল সেটা নিজেই বুঝতে পারেনি স্মাহি। পাথর সরিয়ে কতদিন পরে যে ফেটে পড়েছিল ঝরনা! প্রজাপতি উড়ছিল সেই ঝরনার পাশে। পাহাড়ি কুয়াশাও যেন জড়িয়েছিল ওড়নার মতো! আর রুকস্যাক কাঁধে দুই ট্রেকারের মতো পাহাড়, ঝরনা, প্রজাপতি আর কুয়াশা ছাড়িয়ে পুরনো দিনের দিকে উঠে যাচ্ছিল দুই বান্ধবী!

নীলু একসময় খাবারের অর্ডার দিয়েছিল। তারপর বলেছিল, ‘সব তো হল। তোকে একটা কথা বলব?’

‘কী?’ তাকিয়েছিল স্মাহি!

নীলু বলেছিল, ‘এবার কাউকে নিয়ে আয় নিজের জীবনে!’

স্মাহি কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করেছিল সামান্য। তারপর বলেছিল, ‘তুই জানিস তো কী হয়েছে! কী হয়েছিল! তাও বলছিস?’

‘হ্যাঁ বলছি! কেন বলব না?’ নীলু বলেছিল, ‘জীবন তাতে শেষ হয়ে যায় না! এমন ছেলেমানুষি করিস না! ওই তোর দীপককাকুকে এখনও ধরে রেখেছিস!’

‘না, তাকে আর ধরে রাখিনি! সত্যি বলছি রে!’ স্মাহি ক্লান্ত গলায় বলেছিল, ‘আসলে আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না! কেউ যে আবার অমন করবে না তার গ্যারান্টি কী! আর আমি নিতে পারব নারে! প্লাস দেখলি তো সবাই কেমন আমায় ভুলে গিয়েছে!’

‘তুই জানিস খবর?’ এবার যেন সামান্য সাবধান হয়ে গিয়েছিল নীলু।

‘কীসের খবর!’ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল স্মাহি।

‘তোর জেঠিমা আর নেই। গত ছমাস আগে মারা গিয়েছে!’

‘কী!’ স্মাহি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল শুনে! জেঠিমা নেই! মারা গিয়েছে! কেমন একটা লাগছিল ওর। সামনে রেখে যাওয়া খাবার যেন নামছিল না গলা দিয়ে। জেঠিমা নেই! মানুষটা কোনওদিন খুব কিছু পছন্দ করত না স্মাহিকে। এমন কী এই যে ওর এখনকার এমন একাকী জীবন সেটাও মূলত জেঠিমার জন্য! তাও মানুষটাকে ছোট থেকে দেখে এসেছে! সে নেই জেনে কেমন একটা ভোঁতা কষ্ট হচ্ছিল স্মাহির! কিন্তু কান্না আসেনি। ও হতভম্বের মতো তাকিয়েছিল নীলুর দিকে।

নীলু বলেছিল, ‘তোর দাদা দুবাই চলে গিয়েছে। চাকরি নিয়ে। জেঠু আর বোন এখন খড়দায় থাকে। ওই বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে এসেছে ওরা!’

স্মাহি কী বলবে বুঝতে পারছিল না! জেঠুদের জীবনে এতটা বদল এসে গিয়েছে! কী করে হল এত কিছু!

ও বলেছিল, ‘তুই এখন বলছিস আমায়!’

নীলু বলেছিল, ‘আমি দু’সপ্তাহ আগে জানলাম। তোর জেঠু ফোন করেছিলেন আমায়। আমাদের পুরনো বন্ধু প্রাণেশকে মনে আছে তোর! তার থেকে আমার নাম্বার পেয়েছিল! আমি আর ওই দেশ থেকে তোকে জানাতে চাইনি। কী রিঅ্যাক্ট করবি কে জানে! তাই সামনে জানালাম!’

স্মাহি মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। জেঠুকে খুব ভালবাসে ও! সেই বাবা মা মারা যাওয়ার পরে সেই লোকটাই ওকে বুকে আগলে রেখেছিল! বাড়ি থেকে চলে আসার সময় পেছন ফিরে একমাত্র ওই লোকটার জন্যই ওর কষ্ট হয়েছিল! আর আজ সেই লোকটাই এমন করে বেঁচে আছে! ও মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। আর যেন দেখতে পেয়েছিল একটা রোদ ছায়ার ডোরাকাটা বারান্দা! শূন্য, একাকী, পরিত্যক্ত!

‘সরি সরি,’ নীলু এসে বসল এবার সামনে, ‘আরে দেখ না ছোট মাসি ফোন করেছিল। রেস্টুরেন্টের ভেতরে টাওয়ার পাচ্ছিলাম না। তাই বাইরে বেরিয়ে গেলাম। কাল নেমন্তন্ন করেছে। আরে বাবা, তা কথাবার্তা কালকেই তো বলতে পারে। সে না, এখনই বকবক করছে! রাজ্যের কথা এখনই বলতে হবে তাকে!’

স্মাহি হাসল। কী আর বলবে। দেখল, ওয়েটার লোকটি একটা কালো বাঁধানো ডাইরির মতো দেখতে বইয়ের মধ্যে বিল রেখে গেল সামনে। স্মাহির খুব ইচ্ছে করছিল টাকাটা দিতে। কিন্তু ও জানে যা বিল হয়েছে সেটা দেবার মতো টাকা ওর নেই সঙ্গে। নানুদার জ্বর হওয়ায় রিতাদিরা কাজে বেরোতে পারছে না। গত পরশুই রিতাদি তিন হাজার টাকা ধার নিয়েছে ওর কাছ থেকে। হাত একেবারেই খালি ওর! তাই মাথা নিচু করে বসে রইল স্মাহি।

নীলু বিলটা টেনে দেখে নিল একবার। তারপর একটা কার্ড বের করে ওই ডাইরির মতো দেখতে বইয়ের মধ্যে গুঁজে দিল। হাত তুলে ওয়েটারটির দিকে ইঙ্গিত করল!

স্মাহি বলল, ‘তোর ফালতু কতগুলো টাকা নষ্ট হল!’

‘ভাগ!’ হাসল নীলু, ‘খালি বাজে কথা!’

ওয়েটারটি একটা সোয়াইপ মেশিন নিয়ে এল কাছে। পেমেন্ট করে দিয়ে নীলু একটা একশো টাকার নোট রেখে দিল টেবলে। তারপর উঠে পড়ল।

ক্রিস মাস আসছে। ধীরে ধীরে সেজে উঠছে পার্ক স্ট্রিট! রোদ নেই এইদিকে। লম্বা টানা একটা ছায়া সেই হবি সেন্টার থেকে ছড়িয়ে আছে এই ফ্লুরিসের সামনে অবধি! ছানা কাটা একটা ভিড় চারিদিকে। বেশ কিছু বিদেশি মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে! অল্প বয়সি ছেলে মেয়েরা ঝলমলে পোশাক পরে উড়ছে! আর এদের মধ্যেই ময়লা জামা কাপড় পরা, লাল-লাল জট পড়া চুলের কয়েকটা বাচ্চা বেলুন বিক্রি করছে। বিদেশিদের ধাওয়া করে পয়সা চাইছে! স্মাহির মনে হল, এরাই এই শহরের ফুলস্টপ, কমা, সেমিকোলন আর বানান ভুল!

নীলু ফোন করে নিজের গাড়িটা ডেকে পাঠাল। কাছেই কোথাও একটা পার্ক করা ছিল গাড়িটা। ডাকার মিনিট দুয়েকের মধ্যে চলে এল।

নীল রঙের সেডান। দেখেই বোঝা যায় দামি গাড়ি! ড্রাইভারটি বয়স্ক লোক। রিতেশ মানে, নীলুর হাজব্যান্ড ডাক্তার। ওই দেশে ভাল প্র্যাকটিস। এখানেও ওদের নার্সিংহোম আছে। নীলুর শ্বশুরমশাইও ডাক্তার! ওদের এমন গাড়ি থাকাটা তাই আশ্চর্যের নয়!

স্মাহি বলল, ‘ঠিক আছে তুই যা তাহলে। আমি আসি?’

‘আসবি মানে?’ নীলু খপ করে ধরল ওর হাত, ‘আমি টালিগঞ্জের ওদিকে যাব। ওই উত্তম কুমারের স্ট্যাচুর পাশ দিয়ে হরিদেবপুরের দিকে। তোকে ছেড়ে দেব। তুই লেক গার্ডেন্স স্টেশানের কাছে থাকিস, না?’

স্মাহি সংকুচিত হয়ে গেল সামান্য। ও কোথায় থাকে সেখানে নীলুকে নিয়ে যেতে চায় না। বাড়িটা খুব সাধারণ। একটামাত্র ঘরে ওর যা কিছু বেঁচে থাকা। ইটের দেওয়াল হলেও মাথায় টালি দেওয়া! সেখানে ও কিছুতেই নিয়ে যেতে পারবে না নীলুকে।

ও বলল, ‘কী যে বলিস! আমি চলে যাব।’

‘মারব ধরে, বস।’ নীলু ওকে এক রকম ঠেলেই ঢুকিয়ে দিল গাড়ির পেছনের সিটে। বলল, ‘আমি লেক গার্ডেন্স ফ্লাই ওভারে ওঠার মুখে ছেড়ে দেব তোকে! তুই লেভেল ক্রসিং পার করে চলে যাস! আমি বেরিয়ে যাব। কেমন!’

কলকাতার রাস্তার জ্যাম কাটিয়ে এগোতে লাগল গাড়িটা। স্মাহি জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। নীলু হাতের একটা ট্যাব খুলে কীসব করছে! আজকাল এই একটা ব্যাপার হয়েছে। স্মাহি দেখেছে, এক সঙ্গে হয়তো আড্ডা দিতে জড়ো হয়েছে সবাই, কিন্তু সেখানেও যে যার মতো নিজের নিজের মোবাইলে ঢুকে পড়ে আছে! ওর মনে হয় মানুষ চিরকাল ‘আন-রিয়াল’ বা ভারচুয়ালের দিকে আকৃষ্ট হয়!

গাড়িটা যখন বালিগঞ্জের কাছে পৌঁছল, নীলু ট্যাব থেকে মুখ তুলে বলল, ‘সেই ছেলেটার কী খবর রে, যোগাযোগ আছে?’

‘কোন ছেলেটা!’ স্মাহি তাকাল।

‘আরে সেই যে রে, সাংবাদিক। বর্ধমানে পোস্টিং ছিল! তোকে প্রোপোজ করেছিল। বড় বড় চোখ। ভাল দেখতে! কী যেন নাম! আদিত্য না কী!’

‘আদিত।’ কতদিন পরে নামটা বলল স্মাহি। আর ওর মনে হল টুপ করে মনের মধ্যে খসে পড়ে শব্দটা একটা ঢেউ তুলল যেন! কেমন একটা কেঁপে গেল ও। আজকাল মাঝে মাঝেই ওর কথা মনে পড়ে স্মাহির! অদ্ভুত একটা ভাল লাগা আসে! কেমন একটা এলাচ লবঙ্গের গন্ধ পায় ও! কেন মনে আসে আদিতের কথা? ও তো নিজেই তাড়িয়ে দিয়েছিল! তাহলে! নিজেকেই যেন মাঝে মাঝে চিনতে পারে না স্মাহি!

নীলু বলল, ‘ভাল ছিল ছেলেটা। যোগাযোগ করলে তো পারিস। নিজের লাইফ নিজেই কমপ্লিকেটেড করে বসে আছিস! একটাই লাইফ রাজকুমারী, এভাবে ছদ্মবেশে থেকে সেটি নষ্ট করবেন না!’

নীলু ব্রিজের কাছে ওকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। স্মাহি ঘড়ি দেখল। সাড়ে চারটে বাজে। বাড়িতে গিয়ে একটু শোবে! ভাল লাগছে না কিছু। কেন নীলু আবার মনে করিয়ে দিল ওর কথা! কেমন একটা অস্থিরতা লাগছে। এলাচ-লবঙ্গের গন্ধটা যেন তীব্র হচ্ছে ক্রমে! শরীরের ভেতরে আচমকা অন্য একটা মানুষ জাগছে!

স্মাহি মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করল। তারপর পা বাড়াল। আর হঠাৎ চোখ গেল সামান্য দূরে বসে থাকা পাগলটার দিকে। গত মাস কয়েক হল পাগলটাকে এখানে বসে থাকতে দেখছে ও। কোনও দিকে তাকায় না মানুষটা! মাথা নিচু করে কীসব যেন লেখে সারাক্ষণ।

আজ দেখল পাগলটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা লোক। লম্বা, ফর্সা টকটকে চেহারা। লোকটা পাগলটাকে কয়েকটা খাতা, পেন আর একটা প্যাকেট দিল! আরে এ তো সেই লোকটা। যে ওকে একদিন সিঙাড়ার দোকানে খুচরো দিয়েছিল! লোকটা কী দিচ্ছে পাগলটাকে?

স্মাহির হঠাৎ ইচ্ছে হল লোকটার সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু পারল না বরং আচমকা এমন একটা জিনিস দেখল যে মনে হল কে যেন হঠাৎ ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল অতলান্ত কোনও খাদে!

ও দেখল ওর থেকে কিছুটা দূরে একটা অটোর থেকে নামল একটা ছেলে। মকরন্দ! একে তো ও দেখেছিল রিতাদিদের ঘরে। আর তার সঙ্গে নামল দোহারা চেহারার আরেকজন। তার বড় বড় চোখ! প্রজাপতির ডানার মতো পাতলা কান! কপালে একটা তিল!

আর স্মাহি যেন দেখতে পেল বহু বছর পরে আবার অসংখ্য পাখির পালক তুষারের মতো ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে! যেন দেখতে পেল একটা ছেলে চলে যাচ্ছে আলোছায়ার গলি পেরিয়ে। চলে যাচ্ছে মাথা নিচু করে! চলে যাচ্ছে, কিন্তু ফিরে তাকাচ্ছে না একবারও!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *