পরিশিষ্ট

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : বাংলা গদ্যের মুক্তধারা

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : বাংলা গদ্যের মুক্তধারা

অনির্বাণ রায়

এমারল্ড থিয়েটার রঙ্গমঞ্চে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মরণসভায় রবীন্দ্রনাথ যে-স্মরণলেখটি পাঠ করেন (১৩ শ্রাবণ ১৩০২) তার এক স্থানে আছে:

বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্য-সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা-গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন। ভাষা যে কেবল ভাবের একটা আধারমাত্র নহে, তাহার মধ্যে যেন-তেন-প্রকারেণ কতকগুলা বক্তব্য বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্তব্য সমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্ত দ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়াছিলেন। তিনি দেখাইয়াছিলেন যে, যতটুকু বক্তব্য, তাহা সরল করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে।… সমাজবন্ধন যেমন মনুষ্যত্ববিকাশের পক্ষে অত্যাবশ্যক, তেমনি ভাষাকে কলাবন্ধনের দ্বারা সুন্দররূপে সংযমিত না করিলে সে ভাষা হইতে কদাচ প্রকৃত সাহিত্যের উদ্ভব হইতে পারে না। সৈন্যদলের দ্বারা যুদ্ধ সম্ভব, কেবলমাত্র জনতার দ্বারা নহে,… বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন।

রবীন্দ্রনাথের কথার সূত্র ধরে গদ্য এবং বাংলা গদ্য-বিষয়ক একটি সংক্ষিপ্ত কথাচালচিত্র রচনা করা যেতে পারে। বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছেন:

গদ্য বিণ [✓গদ্‌ + য(যৎ)-কর্ম্ম; স্ত্রী- দ্যা]

১ কথনীয়, বাচ্য। ২ উচ্চার্য্য।

১ কথ্যভাষার ন্যায় পদচ্ছন্দোবন্ধ-হীন ও তান-সাম্য (harmony)-যুক্ত কবিকৃত রচনাবিশেষ; বৃত্তলেশহীন শ্রব্যকাব্য।

চলন্তিকা-র সংজ্ঞা:

গদ্য— যে রচনা পদ্যের ন্যায় মাত্রাবিশিষ্ট নয়, Prose

শর্টার অক্সফোর্ড ডিকশনারি -কৃত সংজ্ঞা:

The ordinary form of written or spoken language, without metrical structure; esp. as a division of literature. opp. to poetry, verse, rime, or metre.

দণ্ডী তাঁর কাব্যাদর্শ-এ বলেছেন, ‘অপাদঃপদসম্ভানো গদ্যম’— যাতে চতুষ্পদীবৎ পদবিভাগ নেই তাকে গদ্য বলে।

সাহিত্যেতিহাসবেত্তারা জানাচ্ছেন যে, পৃথিবীর সমস্ত ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের আবির্ভাব পদ্যের পরে। রবীন্দ্রনাথ এই তথ্যটাই সুন্দর করে বলেছেন তাঁর পুনশ্চ কাব্যের অন্তর্গত ‘নাটক’ শিরোনামিত কবিতায়:

পদ্য হল সমুদ্র,

সাহিত্যের আদি যুগের সৃষ্টি।

তার বৈচিত্র্য ছন্দ তরঙ্গে,

কলকল্লোলে।

গদ্য এল অনেক পরে।

বাঁধা ছন্দের বাইরে জমালো আসর।

সুশ্রী কুশ্রী ভালোমন্দ তার আঙিনায় এল

ঠেলাঠেলি করে।

ছেঁড়া কাঁথা আর শাল-দোশালা

এল জড়িয়ে মিশিয়ে,

সুরে বেসুরে ঝনাঝন্‌ ঝংকার লাগিয়ে দিল।

গর্জনে ও গানে, তাণ্ডবে ও তরল তালে

আকাশে উঠে পড়ল গদ্যবাণীর মহাদেশ।

কখনো ছাড়লে অগ্নিনিশ্বাস,

কখনো ঝরালে জলপ্রপাত।

কোথাও তার সমতল, কোথাও অসমতল;

কোথাও দুর্গম অরণ্য, কোথাও মরুভূমি।

একে অধিকার যে করবে তার চাই রাজপ্রতাপ;

পতন বাঁচিয়ে শিখতে হবে

এর নানারকম গতি অবগতি।

বাইরে থেকে এ ভাসিয়ে দেয় না স্রোতের বেগে,

অন্তরে জাগাতে হয় ছন্দ

গুরু লঘু নানা ভঙ্গিতে।

৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে চর্যাপদ-র সূচনা থেকে পদ্যের দীর্ঘপথ পেরিয়ে বাংলা গদ্যের আত্মপ্রকাশ করতে সময় লেগেছিল সাড়ে আটশো বছর। এর কারণ অবশ্য ছিল। সুকুমার সেন লিখেছেন:

তখনকার দিনে সাহিত্যিক রস-বোধের প্রেরণা ছিল মুখ্যতঃ আবেগ ও গৌণতঃ অনুভূতির মধ্যে। আর গদ্য সাহিত্যে রস-বোধের প্রেরণা আসে প্রধানতঃ বোধ ও যুক্তিজ্ঞান হইতে।

সাহিত্যে সেভাবে গদ্য না থাকলেও তার দেখা মিলল চিঠিপত্রে, দলিলে। ১৪৭৭ শক বা ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে লেখা কুচবিহার মহারাজ নরনারায়ণের পত্র:

লেখনং কার্য্যঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তর বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইতে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্ত্তব্যে যে বর্দ্ধিতাক পাই পুষিপত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগত আছি তোমারো এ গোট কর্ত্তব্য উচিত হয় না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম।…

এখন দেখা যাক ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত একটি চুক্তিপত্রের গদ্য:

শ্রীকৃষ্ণ। সাথি শ্রীধর্ম্ম শ্রীযুত মিত্রি গই সাহেব মিত্রি গারবেল মহাসহেষু লিখিতং শ্রীকৃষ্ণদাস ও নরসিংহ দাস আগে আমরা দুই লুকে করার করিলাম জে কিছু বারে সুনারগায় ও গর খ রিকরি সকরাত ২ দ্ব ই রুপাইয়া করিয়া আরত দালালি লইব আর কুন দায়া নাই খুরাক সমেত এই নিষ্টামে [নিঅমে] করা পত্র দিলাম স ১১০৩ তে ১৪ আগ্রান।

ভারতে মুদ্রাযন্ত্র আগমনের পর প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ নাথানিয়েল ব্রাসি হালহেড-এর A Grammar of the Bengal Language (১৭৭৮)। এই গ্রন্থে গদ্যে লিখিত একটি পত্র আছে। সেটি এই—

৭ শ্রীরাম

গরিবনেওয়াজ শেলামত—

আমার জমিদারি পরগনে কাকজোল তাহার দুই গ্রাম দরিয়াশী কিশ্‌তী হইয়াছে সেই দুই গ্রাম পয়শ্‌তী হইয়াছে চাকলে একবরপুরের শ্রীহরেকৃষ্ণ চৌধুরী আজ রায় জবরদস্তী দখল করিয়া ভোগ করিতেছে আমি মালগু জারির শরবরাহতে মারা পড়িতেছি উমেদওয়ার যে সরকার হইতে আমিন ও এক চোপদার সরজমিনেতে পহুচিয়া তোরফেনকে তলব দিয়া লইয়া আদালত করিয়া হকদারের হক দেলায়া দেন ইতি শন ১১৮৫ শাল তারিখ ১১ শ্রাবন।

ফিদবি

জগতধির রায়১০

এই সূত্রে সজনীকান্ত দাস লিখেছেন:

১৭৭৮ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত যাহার সূত্রপাত, ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তাহার একুশ বৎসরের ইতিহাস খুব বিরাট ও বিচিত্র হইবার কথা নয়, কিন্তু তথাপি সেগুলিই গোড়ার কথা এবং সত্য ও কৃতজ্ঞতার খাতিরে এই ইতিহাস আমাদিগকে জানিতেই হইবে। সত্য বটে কোনও মৌলিক রচনা এই কালে রচিত হয় নাই, সত্য বটে লেখক ও সংগ্রাহক মাত্রেই বৈদেশিক, তথাপি একথা আমাদের আজ অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে ইহাদের সমবেত চেষ্টাতেই বাংলা লিখিত-গদ্য একটা রূপ ধারণ করিতেছিল— যাহা বাঙালী-লেখকের লেখনীমুখে সর্বপ্রথম ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ রূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমে পরিণতি লাভ করিয়াছে।১১

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার অধ্যাপক, ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ রামরাম বসু কলেজের ছাত্রদের জন্য লেখেন রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০১)। ‘বাংলা ভাষার সর্বপ্রথম মুদ্রিত মৌলিক গদ্য গ্রন্থ’। গ্রন্থ শুরু হয়েছে এইভাবে:

এ বঙ্গভূমিতে রাজা চন্দ্রকেতু প্রভৃতি অনেক২ রাজাগণ উদ্ভব হইয়াছিলেন/কিন্তু কদাচিত তাহারদের কেবল নাম মাত্র শুনা যায়/তদব্যতিরেক তাহারদের বিশেষ বিশেষণ কি মতে বৃদ্ধি কি মতে পতন নিরাকরণ কিছুই উপস্থিত নাহি/ তাহাতে যে সমস্ত লোকেরা এ সকল প্রশঙ্গ শ্রবণ করে আনুপূর্ব্বক না জাননেতে ক্ষোভিত হয়।১২

রামরাম বসু গ্রন্থ সমাপ্ত করেছেন একটি অনুচ্ছেদে:

এই এই কয়জন শ্রীযুত বিশিষ্ট রাজা বসন্তরায়ের সন্তান। ইহার মধ্যে রাজা স্যামসুন্দর রায়ের সন্তানেরা এখন প্রধান। তাহারাই যশহর সমাজের গোষ্ঠিপতি। আর২ সকল বঙ্গজ কায়েস্থরদিগকে তাহারাই প্রতিপালন করিতেছেন/ তাহারা সকলের কর্ত্তা।১৩

লক্ষণীয়, গ্রন্থসূচনায় আছে একটি দীর্ঘ বাক্য একটিমাত্র পূর্ণচ্ছেদ অবলম্বন করে। সমাপ্তিসূচক অনুচ্ছেদে চারটি সংক্ষিপ্ত বাক্য। সব ক’টিই শেষ হয়েছে পূর্ণচ্ছেদে। ডক্টর মনোমোহন ঘোষ তাঁর সম্পাদিত রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র-এর ভূমিকায় লিখেছেন—

‘প্রতাপাদিত্য চরিত্রে’র ভাষা নিন্দনীয় ত নয়ই, বরং এ পুস্তকের রচয়িতাই বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনকরূপে কীর্তিত হতে পারতেন যদি তাঁর বইএর, তথা ফোর্ট উইলিয়ম গ্রন্থমালার প্রচার খুব সীমাবদ্ধ না থাক্‌ত। রচনাপ্রচারের ব্যাপকত্ব ও প্রভাবের গভীরত্বের দিক থেকে দেখলে রাম বসুর বদলে রামমোহনই বাংলা গদ্যের জনকত্বের দাবী করতে পারেন এবং রাম বসুর কৃতিত্বের মূলেও রয়েছেন এই রামমোহন রায়।১৪

রামরাম বসু বাংলাসহ আরবি, ফারসি, সংস্কৃত এবং ইংরেজি ভাষা জানতেন। রামমোহন রামরাম-এর মতো অনেকগুলি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। অল্প বয়সে শেখেন আরবি, ফারসি এবং সংস্কৃত। পরবর্তীকালে ইংরেজি সহ উর্দু, হিব্রু, ফরাসি, গ্রিক এবং লাতিন ভাষায় নিজেকে শিক্ষিত করেন। রামমোহন রায় পনেরো বছরের জন্য (১৮১৫–১৮৩০) সাহিত্য তথা গদ্য চর্চা করেছিলেন মূলত ‘তর্ক বা বিবাদমূলক অথবা শাস্ত্র ব্যাখ্যা’কে অবলম্বন করে। এই চর্চায় অধীত ভাষার অভিজ্ঞতা নিশ্চয় সহায়ক হয়েছিল। বাংলা গদ্যকে তার প্রথম যুগে তিনি একটি শক্তভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। সুকুমার সেেনর প্রাসঙ্গিক অভিমত স্মরণীয়:

রামমোহনের গদ্যে কিছু সাহিত্যিক গুণ থাক বা না থাক, ইহা যে তখনকার দিনে শিক্ষিত লোকের ব্যবহারযোগ্য হইয়া উঠিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। রামমোহন না হইলে আমরা বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রকে পাইতাম কিনা সন্দেহ।১৫

কেমন ছিল রামমোহন রায়ের গদ্য? একটু নিদর্শন দেখে নেওয়া যেতে পারে:

প্রথমত বাঙ্গলা ভাষাতে আবশ্যক গৃহ ব্যাপার নির্ব্বাহের যোগ্য কেবল কতকগুলিন শব্দ আছে। এ ভাষা সংস্কৃতের যেরূপ অধীন হয় তাহা অন্য ভাষায় ব্যাখ্যা ইহাতে করিবার সময় স্পষ্ট হইয়া থাকে; দ্বিতীয়ত এ ভাষায় গদ্যতে অদ্যাপি কোনো শাস্ত্র কিম্বা কাব্য বর্ণনে আইসে না। ইহাতে এতদ্দেশীয় অনেক লোক অনভ্যাস প্রযুক্ত দুই তিন বাক্যের অন্বয় করিয়া গদ্য হইতে অর্থ বোধ করিতে হঠাৎ পারেন না ইহা প্রত্যক্ষ কানুনের তরজমায় অর্থবোধের সময় অনুভব হয়। যাঁহাদের সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি কিঞ্চিতো থাকিবেক আর যাঁহারা ব্যুৎপন্ন লোকের সহিত সহবাস দ্বারা সাধু ভাষা কহেন আর শুনেন তাঁহাদের অল্প শ্রমেই ইহাতে অধিকার জন্মিবেক। বাক্যের প্রারম্ভ আর সমাপ্তি এই দুইয়ের বিবেচনা বিশেষ মতে করিতে উচিত হয়।১৬

ভাবতে অবাক লাগে সেই কত বছর আগে রাজা রামমোহন রায় গদ্যের মূল অবলম্বন যে বাক্য তার গঠন নির্মাণের দুটি মূল বিষয় ‘প্রারম্ভ’ এবং ‘সমাপ্তি’র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে গিয়েছেন। ‘সংস্কৃতে’ ‘কিঞ্চিতো’ ‘ব্যুৎপন্ন’ মানুষের সঙ্গ করলে, তাঁদের ভাষা শুনলে এবং বললে ভাষায় মানুষের বিশেষ অধিকার জন্মায়। ভাষা শিক্ষা ও রপ্ত করার এক চিরকালীন সত্য সূত্র।

রামরাম বসুর রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র প্রকাশের এক বছর পরই ১৮০২ সালে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বত্রিশ সিংহাসন প্রকাশিত হয়। আনুমানিক ১৮১৩ সালে রচিত তাঁর প্রবোধচন্দ্রিকা থেকে সামান্য অংশ পড়ে নেয়া যাক:

শাক ভাত পেট পেট ভরিয়া যে দিন খাই সে দিন তো জন্মতিথি। কাপড় বিনা কেয়ো পাচা ঠুকরিয়া খায় তেল বিহনে মাতায় খড়ি উড়ে।… বাসন গহনা কখন চক্ষেও দেখিতে পাই না যদি কখন পাথরায় খাইতে পাই ও রাঙ্গা তালের পাতা কাণে পরিতে ও পুঁতির মালা গলায় পরিতে ও রাঙ্গ সীসা পিতলের বালা তাড় মল খাড়ু গায় পরিতে পাই তবেতো রাজরাণী হই।

মৃত্যুঞ্জয়ের এই ভাষার নমুনা উদ্ধৃত করে প্রমথ চৌধুরীর মন্তব্য: ‘… ইহা যে খাঁটি বাংলা সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। এ ভাষা সজীব সতেজ সরল স্বচ্ছন্দ ও সরস।’১৭ এবং ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘বাংলা গদ্যের যখন নিতান্ত শৈশবস্থা, তখনই তিনি [মৃত্যুঞ্জয়] বিভিন্ন গদ্যরীতি লইয়া পরীক্ষা চালাইয়াছেন এবং তাঁহার বিভিন্ন পুস্তক বিভিন্ন রীতিতে রচনা করিবার দুঃসাহস দেখাইয়াছেন।’১৮

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যাসাগর অনুবাদ করেন শ্রীমদভাগবত-এর দশম ও একাদশ স্কন্ধ। এই অনুবাদ মুদ্রিত হলেও ‘বাসুদেব-চরিত’ শিরোনামে প্রকাশের আলো দেখতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না মেলায়। তবে, তার রচনা-নিদর্শন ধরা আছে বিহারীলাল সরকার প্রণীত বিদ্যাসাগর নামক জীবনীগ্রন্থে। সুকুমার সেন সেই গ্রন্থ থেকে একটুখানি নিদর্শন তুলে ধরেছেন:

এক দিবস দেবর্ষি নারদ মথুরায় আসিয়া কংসকে কহিলেন, মহারাজ! তুমি নিশ্চিন্ত রহিয়াছ, কোনও বিষয়ের অনুসন্ধান কর না; এই যাবৎ গোপ ও যাদব দেখিতেছ, ইহারা দেবতা, দৈত্যবধের নিমিত্ত ভূমণ্ডলে জন্ম লইয়াছে এবং শুনিয়াছি দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়া নারায়ণ তোমার প্রাণ সংহার করিবেন, এবং তোমার পিতা উগ্রসেন এবং অন্যান্য জ্ঞাতিবান্ধবেরা তোমার পক্ষ ও হিতাকাঙ্ক্ষী নহেন; অতএব মহারাজ! অতঃপর সাবধান হও, অদ্যাপি সময় অতীত হয় নাই, প্রতিকার চিন্তা কর।১৯

লক্ষণীয়, যতিচিহ্নিত ধীর ও শান্ত গদ্যগতি। প্রতিটি বাক্যের শব্দ সুনির্বাচিত। স্থান সুনির্দিষ্ট। পাঠকালে ক্ষণিক বিরতি ও যতিচিহ্ন দ্বারা নির্ধারিত। প্রসঙ্গত স্মরণীয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত:

শব্দাদি একক উচ্চারিত হইলে স্বরাঘাত সমেত উচ্চারিত হয়, কিন্তু যে মুহূর্তে তাহা বাক্যে ব্যবহৃত হয়, সেই মুহূর্তে শব্দটির বিশিষ্ট স্বরাঘাত বাক্যের ছন্দগতির অধীন হইয়া পড়ে। স্বরাঘাতের দিক দিয়া বিচার করিলে, ইংরেজিতে একটি ক্ষুদ্র বা বৃহৎ বাক্য কতকগুলি বিচ্ছিন্ন, প্রবল স্বরাঘাতযুক্ত, স্বাধীনবৃত্ত শব্দের সমষ্টি; কিন্তু বাংলায় একটি বাক্য কতকগুলি বাক্যাংশের সমষ্টি মাত্র। এই সকল বাক্যাংশকে breath group অর্থাৎ ‘শ্বাস-পর্ব’ অথবা sense group অর্থাৎ ‘সার্থ-পর্ব’ নামে অভিহিত করা যাইতে পারে। প্রত্যেক শ্বাস-পর্ব বা সার্থ-পর্ব, বাক্যের পৃথক অঙ্গরূপে, সাধারণত আদ্যক্ষরে স্বরাঘাতযুক্ত হয়— পর্বস্থিত অন্য শব্দের স্বরাঘাত বিলুপ্ত হয়। বাংলা গদ্যের এই প্রকৃতি বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার অনন্য সাধারণ ভাষা বিষয়ক ধ্বনি ও ছন্দ বিচারশক্তির দ্বারা বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এবং এ সম্বন্ধে তিনি উত্তরোত্তর অধিক সচেতন হইয়াছিলেন। অর্থাৎ গদ্য রচনার ছন্দ বিষয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম দ্রষ্টা ও স্রষ্টা; গদ্যপাঠের ধ্বনি সামঞ্জস্যে যে পাঠক ও শ্রোতা আনন্দ পাইতে পারে, এই সূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁহার ছিল। কমা, সেমিকোলন, ও ড্যাশের ব্যবহার, বাংলা গদ্যের বাক্যাংশ শ্বাস- ও সার্থ-পর্ব অনুসারেই তিনি প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন।২০

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কথিত বিদ্যাসাগরের গদ্যে নিহিত ‘আনন্দ’-র সন্ধানেই এই অভিযাত্রা।

বিদ্যাসাগরের গদ্য-সৌন্দর্যের কথা উঠলেই অধিকাংশজন সীতার বনবাস-এর শরণাপন্ন হন।

এই সেই জনস্থানমধ্যবর্ত্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধর মণ্ডলীর যোগে, নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত; অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল, ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী, তরঙ্গবিস্তার করিয়া, প্রবল বেগে গমন করিতেছে।২১

এই অংশটি পাঠকালে ‘নিরন্তর নিবিড় নীলিমায়’ মনের মধ্যে এক অনাস্বাদিত নীলিমা ছড়িয়ে দিয়ে মনকে বিস্তৃত করে দেয়। কী যেন আনন্দে মন নেচে ওঠে। এ কী পড়লাম। জন্মজন্মান্তরেও ভুলব না।

বস্তুত, সীতার বনবাস জুড়ে উদ্ধারযোগ্য এমন বহু অংশ আছে। আর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে:

এই ভাবে কিয়ৎ ক্ষণ অতীত হইলে পর, সীতা চিত্তের অপেক্ষাকৃত স্থৈর্য্যসম্পাদন করিয়া বলিলেন, লক্ষ্মণ! কার দোষ দিব, সকলই আমার অদৃষ্টের দোষ; নতুবা, রাজার কন্যা, রাজার বধূ, রাজার মহিষী হইয়া, কে কখন আমার মত চিরদুঃখিনী হইয়াছে, বল? বুঝিলাম, যাবজ্জীবন দুঃখভোগের নিমিত্তই, আমার নারীজন্ম হইয়াছিল। বৎস! অবশেষে আমার যে এ অবস্থা ঘটিবেক, তাহা কাহার মনে ছিল। বহু কালের পর আর্য্যপুত্রের সহিত সমাগম হইলে, ভাবিয়াছিলাম, বুঝি এই অবধি দুঃখের অবসান হইল। কিন্তু, বিধাতা যে আমার কপালে সহস্রগুণ অধিক দুঃখ লিখিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহা স্বপ্নেও জানিতাম না। হায় রে বিধাতা! তোমার মনে কি এতই ছিল।২২

সীতার বনবাস ভবভূতির উত্তরচরিত এবং রামায়ণের ‘উত্তরকাণ্ড’ অবলম্বনে সংকলন করেছিলেন বিদ্যাসাগর। সরাসরি অনুবাদ নয়। পাঠকালে অনুবাদ বলে মনেও হয় না। সীতার আবেগকে কী সংযত গদ্যেই না প্রকাশ করেছেন শিল্পী বিদ্যাসাগর। সীতাকে একটি বারের জন্য মনে হয় না কোনও মহাকাব্যিক চরিত্র। সীতা যেন বাঙালি ঘরের কোনও বধূ। কিশোর বয়সে সেই সংগ্রামী দিনগুলোতে কলকাতার বড়বাজারনিবাসী সিংহ পরিবারে বেড়ে ওঠা বিদ্যাসাগর নারীজাতির যে অকৃপণ স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে নারীজাতির যে দুঃসহ অবর্ণনীয় যন্ত্রণার শরিক হয়েছিলেন, তারই মিলিত ফল যেন এই সীতার চরিত্রায়ণে সহায়ক হয়েছে। ‘আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া, অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয়, সে নির্দেশ অসঙ্গত নহে।’ আত্মচরিত-এ লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর। ঊনকথা একেবারেই নয়।

তাঁর জীবদ্দশায় সীতার বনবাস-এর পঁচিশটি সংস্করণ হয়েছিল। এ থেকে কি প্রমাণ হয় না তৎকালীন পাঠকের হৃদয় কতটা অধিকার করেছিল এই গ্রন্থ? আগাগোড়া সাধুভাষায় লেখা। তবে অনেক স্থলেই কথ্যভাষা যেন উঁকি দিয়ে পাঠকমন ছুঁতে চায়। দু’-একটি নিদর্শন উদ্ধৃত হল:

সীতা বলিলেন, বৎস! তোমার অপরাধ কি? তুমি কেন অকারণে এত কাতর হইতেছ ও পরিতাপ করিতেছ? তোমার উপর রুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হইবার কথা দূরে থাকুক, আমি কায়মনোবাক্যে দেবতাদের নিকট নিয়ত এই প্রার্থনা করিব, যেন জন্মান্তরে তোমার মত গুণের দেবর পাই; তুমি চিরজীবী হও।

তোমায় আর একটি কথা বলিয়া দি। আমি চিরদুঃখিনী, বিধাতা আমার অদৃষ্টে সুখ লিখেন নাই; সুতরাং আমার যে সর্বনাশ ঘটিল, তাহাতে আমি দুঃখিত নহি। কিন্তু এই করিও, যেন, আমার ভগিনীগুলি কষ্ট না পায়।২৩

এ কি কেবল সীতার কথা? বিদ্যাসাগরের গভীর অন্তরের কথাও কি নয়? আর তৃতীয় পরিচ্ছেদের শুরুতে যে-চিত্র তিনি এঁকেছেন:

দেখিলেন, রাম করতলে কপোল বিন্যস্ত করিয়া, একাকী উপবিষ্ট আছেন, মুহুর্মুহুঃ দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতেছেন; নয়নযুগল হইতে অনর্গল অশ্রুজল নির্গত হইতেছে।২৪

তার তুলনা কোথায় পাওয়া যাবে!

সীতার বনবাস-এর আগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যাসাগর হিন্দি বৈতালপচীসী অবলম্বন করে লেখেন বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৭)। এই কাজটি তাঁকে করতে হয়েছিল ‘অধ্যক্ষ মহামতি শ্ৰীযুত জি.টি. মার্শল মহোদয়’-এর আদেশক্রমে। প্রকাশের এক বছর পরে নিঃশেষিত হয় বেতাল। এরপর কয়েকবার পুনর্মুদ্রিত হয় এই গ্রন্থ।

দশম সংস্করণের ‘বিজ্ঞাপন’-এ বিদ্যাসাগর জানান:

এই পুস্তক, এত দিন, বাঙ্গালা ভাষার প্রণালী অনুসারে মুদ্রিত হইয়াছিল; সুতরাং ইঙ্গরেজী পুস্তকে যে সকল বিরামচিহ্ন ব্যবহৃত হইয়া থাকে, পূর্ব্ব পূর্ব্ব সংস্করণে সে সমুদয় পরিগৃহীত হয় নাই। এই সংস্করণে সে সমস্ত সন্নিবেশিত হইল।২৫

পুস্তকপ্রেমী বিদ্যাসাগর ইংরেজি গ্রন্থ পাঠের সময় ব্যবহৃত ‘বিরামচিহ্ন’দের গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করেছিলেন এই ‘বিজ্ঞাপন’ তারই উজ্জ্বলন্ত সাক্ষ্য।

বেতালপঞ্চবিংশতি-র ‘উপক্রমণিকা’ শুরু হয়েছে এইভাবে:

উজ্জয়িনী নগরে গন্ধর্বসেন নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার চার মহিষী। তাঁহাদের গর্ভে রাজার ছয় পুত্র জন্মে। রাজকুমারেরা সকলেই সুপণ্ডিত ও সর্ব্ব বিষয়ে বিচক্ষণ ছিলেন। কালক্রমে, নৃপতির লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, সর্ব্বজ্যেষ্ঠ শঙ্কু সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন। তৎকনিষ্ঠ বিক্রমাদিত্য বিদ্যানুরাগ, নীতিপরতা ও শাস্ত্রানুশীলন দ্বারা সবিশেষ বিখ্যাত ছিলেন; তথাপি, রাজ্যভোগের লোভসংবরণে অসমর্থ হইয়া, জ্যেষ্ঠের প্রাণসংহারপূর্ব্বক, স্বয়ং রাজেশ্বর হইলেন; এবং ক্রমে ক্রমে, নিজ বাহুবলে, লক্ষযোজনবিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের অধীশ্বর হইয়া, আপন নামে অব্দ প্রচলিত করিলেন।২৬

গল্প বলছেন বিদ্যাসাগর। গল্পরসকে ঘন করতে বাক্য ছোট করেছেন। বাক্য দীর্ঘ হয়ে পড়লে তাকে কমা-সেমিকোলন দিয়ে শাসন করেছেন। পাঠকও কোনওভাবেই নিজের ইচ্ছামতো গতিতে এই গদ্য পাঠ করতে পারবেন না। এ যেন গানের লয় বেঁধে দেওয়া। বেতালপঞ্চবিংশতি গল্পের বই। এখানে বিদ্যাসাগর তাঁর লেখনীজাদু দেখিয়েছেন। যতিচিহ্নিত বাক্য তো আছেই। তেমনই ক্ষণে ক্ষণে দেখা মেলে ‘কোমল করপল্লব’ ‘বচনবৈদগ্ধী’ ‘অসুলভ সুখসম্ভোগে’ ‘চিত্তচকোর চরিতার্থ’ ‘নিরতিশয় নির্বেদ’ ‘নিরতিশয় নির্বিবেক’ ‘মরণ ব্যবসায়’ (এই শব্দটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি লেখার শিরোনামে ব্যবহার করেছিলেন) প্রভৃতির মতো শব্দ বা শব্দবন্ধ, ‘জন, জামাই, ভাগিনেয়, এ তিন, কোনও কালে, আপন হয় না’-র মতো প্রবাদ; প্রবাদের অনুবাদ প্রয়োগ ‘যে পালাইতে পারিল, তাহারই প্রাণ বাঁচিল’; ‘ভাল, কথায় প্রয়োজন নাই, আমি তোমার সন্দেহ দূর করিতেছি’, ‘ভোজনকালে আমি নিকটে উপবিষ্ট না থাকিলে, পিতার তৃপ্তি হইত না; এজন্য, নিত্যই, ভোজন সময়ে তাঁহার সন্নিহিত থাকিতাম’— সাধুভাষায় সুস্বাদু কথ্যভাষার রস-দেওয়া মুখের কথা এবং সেইসঙ্গে ঘরোয়া ছবির। আর তার পাশাপাশি পদ্যের ঢেউ তোলা ‘সেই শাপে, এই পাপে’ ‘দিনযামিনী, সেই কামিনীর সহিত’— এককথায় অনবদ্য। সন্দেহ হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গোপনে কাব্যচর্চা করতেন। অবশ্য গোপনই-বা বলি কেন, সংস্কৃত কাব্য বিষয়ে যে গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল তা তাঁর সম্পাদিত মেঘদূত, কুমারসম্ভব, কাদম্বরী, উত্তরচরিত ইত্যাদি কাব্য ও কাব্যনাট্যের ‘বিজ্ঞাপন’সমূহে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মন্তব্য পাঠেই পরিষ্কার হয়ে যায়। বেতাল-এর চতুর্দশ উপাখ্যানে পাঠক যখন এই বাক্যটির কাছে উপস্থিত হন— ‘শশী কহিলেন, বোধ করি, কোনও নায়িকা ভ্রূচাপ দ্বারা কটাক্ষবাণ নিক্ষিপ্ত করিয়াছে, তাহাতেই এরূপে পতিত আছে।’— তখন তাঁর সামনে আনন্দে বিস্ময়ে নিস্পন্দ হওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প থাকে না।

বেতাল-এর উপক্রমণিকায় তিনি যে ঘনঘোর রাতের ছবি এঁকেছেন তাকেই-বা উপেক্ষা করা যাবে কী উপায়ে!

একে কৃষ্ণচতুর্দ্দশীর রাত্রি সহজেই ঘোরতর অন্ধকারে আবৃতা; তাহাতে আবার, ঘনঘটা দ্বারা গগনমণ্ডলে আচ্ছন্ন হইয়া মুষলধারায় বৃষ্টি হইতেছিল; আর, ভূতপ্রেতগণ চতুর্দ্দিকে ভয়ানক কোলাহল করিতেছিল। এইরূপ সঙ্কটে কাহার হৃদয়ে না ভয়সঞ্চার হয়। কিন্তু রাজার তাহাতে ভয় বা ব্যাকুলতার লেশমাত্র উপস্থিত হইল না। পরিশেষে, নানা সঙ্কট হইতে উত্তীর্ণ হইয়া, রাজা নির্দ্দিষ্ট প্রেতভূমিতে উপনীত হইলেন; দেখিলেন, কোনও স্থলে অতি বিকটমূর্ত্তি ভূতপ্রেতগণ, জীবিত মনুষ্য ধরিয়া, তাহাদের মাংস ভক্ষণ করিতেছে। কোনও স্থলে ডাকিনীগণ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালক ধরিয়া, তদীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চর্বণ করিতেছে। রাজা, ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে শিরীষবৃক্ষের নিকটে গিয়া দেখিলেন, উহার মূল অবধি অগ্রভাগ পর্য্যন্ত, প্রত্যেক বিটপ ও পল্লব ধকধক করিয়া জ্বলিতেছে; আর, চারিদিকে অনবরত কেবল মার্‌ মার্‌ কাট্‌ কাট্‌ ইত্যাদি ভয়ানক শব্দ হইতেছে।২৭

শুধুমাত্র অক্ষর যোজনা করে কীভাবে একটা ভয়াবহ পরিবেশ রচনা করা যায় এই উদ্ধৃতি তার প্রমাণ। এক নিরাবেগ চিত্র। আগাগোড়া ভীতিপ্রদ আঁধার আর শব্দ দিয়ে ভরা। অথচ কী স্পষ্ট। পড়তে পড়তে পুরো ছবিটা কল্পনার চোখে ভেসে ওঠে।

সংস্কৃতে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, সেইসঙ্গে ইংরেজির চর্চাও ছিল সুগভীর, নইলে ‘ইংলন্ডের অদ্বিতীয় কবি শেক্সপীরের প্রণীত ভ্রান্তি প্রহসন’ (Comedy of Errors) পড়ে তার উপাখ্যানভাগ বাংলায় অমন করে সংকলন করতে পারতেন না। বিদ্যাসাগর এই সংকলনের নামকরণ করেছিলেন ভ্রান্তিবিলাস। শেক্সপিয়র তাঁর এই প্রহসনে ‘হাস্যরসোদ্দীপনের নিরতিশয় কৌশল প্রদর্শন’ করেছেন। বিদ্যাসাগর তাঁর ভ্রান্তিবিলাস-এ শেক্সপিয়রীয় ‘অপ্রতিম কৌশল’ দেখানোর চেষ্টা করেননি। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল পাঠকচিত্তে ‘কিঞ্চিতমাত্র প্রীতিসঞ্চার’ করা।

এই প্রহসনেও বিদ্যাসাগর ছোট ছোট বাক্যে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কমা, সেমিকোলনের সঙ্গে যতিচিহ্নের দলে যোগ দিয়েছে বিস্ময়চিহ্ন। ‘হেমকূট ও জয়স্থল নামে দুই প্রসিদ্ধ প্রাচীন রাজ্য ছিল।’— এই সরল বাক্য দিয়ে শুরু হয় ভ্রান্তিবিলাস। চলতে চলতে চোখে পড়ে ‘এমন সময়ে অকস্মাৎ গগনমণ্ডল নিবিড় ঘনঘটায় আচ্ছন্ন হইল; প্রবল বেগে প্রচণ্ড বাত্যা বহিতে লাগিল; সমুদ্র উত্তাল তরঙ্গমালায় আন্দোলিত হইয়া উঠিল।’ আরও কিছুটা অগ্রসর হলে দেখা মেলে:

আহারসামগ্রী যত শীতল হইতেছে, কর্ত্রীঠাকুরানী তত উষ্ণ হইতেছেন। আহারসামগ্রী শীতল হইতেছে, কারণ আপনি গৃহে যান নাই; আপনি গৃহে যান নাই, কারণ আপনকার ক্ষুধা নাই; আপনার ক্ষুধা নাই, কারণ আপনি বিলক্ষণ জলযোগ করিয়াছেন; কিন্তু আপনকার অনুপস্থিতির জন্য আমরা অনাহারে মারা পড়িতেছি।২৮

ভ্রান্তিবিলাস-এ হাস্যরস হয়তো সে অর্থে তেমন করে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি কিন্তু অতি অল্প হইল বা আবার অতি অল্প হইল-তে গদ্যকে লঘুরসে মজিয়ে বিদ্যাসাগর যেভাবে গভীর কথা বলেছেন তার উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে ক’টি আছে বলা দুষ্কর। এই দু’টি গদ্যে কি সংস্কৃত কি বাংলা কি হিন্দি প্রবচন/প্রবাদের (‘শতং বদ মা লিখ’, ‘অসহ্যং জ্ঞাতিদুর্বাক্যম্‌’, ‘গাধা সকল ভার বইতে পারেন,/ কেবল ভাতের কাঠিটি সইতে পারেন না’, ‘চাপার মুখে না থেকো বাপা’, ‘গরজকী নহী লাজ’) ব্যবহার চোখে পড়ে আকছার। প্রতিপক্ষ ‘খুড়’কে এভাবে গদ্যের হাতুড়ি হেনে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন। শ্লেষ মাখানো তার্কিক গদ্যের এই ঢঙ একান্তই বিদ্যাসাগরের আবিষ্কার।

বলিতে কি, খুড় আমার বড় নির্বোধ; অকারণে, আপনার মান আপনি খোয়াইলেন। চালাকি করিয়া, বহি লিখিয়া, বাহাদুরি দেখাইতে না গেলে, এ ফেসাৎ ঘটিত না। ইহাকেই বলে, নালা কেটে রোগ আনা। প্রামাণিক লোকের মুখে শুনিয়াছি, খুড় সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন, যাহা লিখিয়াছি, তাহা অকাট্য; বিদ্যাসাগর দন্তস্ফুট করিতে পরিবেক না। খুড় আমার অহঙ্কারেই মারা গেলেন;—২৯

এইসব লেখায় উপযুক্ত ভাইপো বিদ্যাসাগর যদিও লেখক হিসেবে নিজের নামটা ফাঁস করেননি। মেঘনাদের মতো আড়ালে থেকে চোখা চোখা যুক্তির বাণ নিক্ষেপ করে ‘খুড়’কে নাজেহাল করে ছেড়েছেন।

জোঁকের মুখে চুন পড়িলে যেমন হয়, খুড় আমার অপ্রতিভ হইয়া সেইরূপ হইয়া গেলেন।

খুড় আমার ব্যাকরণ বিদ্যায় অদ্বিতীয় বলিয়া অভিমান করেন, এবং সেই অভিমানে মানুষকে মানুষ জ্ঞান করেন না;…৩০

কথায় বলে ‘পষ্ট কথায় কষ্ট নেই’, বিদ্যাসাগরের এই জাতীয় লেখা ওই কথারই দ্যোতক। এইভাবে খোলাখুলি শাণিত আক্রমণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পক্ষেই সম্ভব। কাউকেই যে তিনি রেয়াত করতেন না তার অনেক নিদর্শন তাঁর জীবনীতে পাওয়া যায়। এইখানে মনে পড়ে যায়, তাঁর এই গদ্যসূত্রে, ‘স্টাইল ইজ দ্য ম্যান’।

আবার অতি অল্প হইল-র ‘দ্বিতীয়আপত্তি’-তে বিদ্যাসাগর দাবা খেলার প্রসঙ্গ এনেছেন: ‘আমি যে কিস্তি দিয়াছিলাম, তাতেই খুড় মাৎ হয়েছেন।’ উপযুক্ত ভাইপো কি দাবা খেলা জানতেন? খেলেছেন কখনও? পরে পরেই বিদ্যাসাগর মশাই লিখেছেন:

প্রামাণিকেরা বলেন, ‘চাপার মুখে না থেকো বাপা’। এরূপ অবস্থায় চাপা দিলে সামলানো যায় না, দুই এক চালের পরেই মাৎ হইতে হয়। সে যাহা হউক আমি পুনরায় কিস্তি দিতেছি। এ কিস্তি চাপা দিয়া সামলাইবার নহে। এই কিস্তিতেই চালি বন্ধ ও মাৎ। হরেবোল।৩১

দয়ার সাগর করুণাসাগর সংস্কৃত পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কলম থেকে উৎসারিত হয়েছে এরকম অননুকরণীয় গদ্যাক্রমণ ভাবাই যায় না। শুধু কি তাই! ওই ‘হরেবোল’-এর পরেই তিনি গান ধরেছেন এই বলে:

বক্কেশ্বরেরা আপনি ভিন্ন আর সকলকেই বক্ক অর্থাৎ বোকা মনে করে এবং সকলের কাছেই, ফাজিল চালাকি করিয়া বেড়ায়। খুড় সেইরূপ চালাকি করিয়া আমার পুস্তকের জবাব লিখিয়াছেন। কিন্তু উপযুক্ত ভাইপোর কাছে চালাকি চলা সহজ নহে।৩২

এখনকার কালে কেউ এই কথাগুলো লিখলে ওই ‘নহে’র পরে হয়তো একটা ‘হুঁ হুঁ বাবা!’ জুড়ে দিতেন। আর ওই বোকা অর্থাৎ বক্ক এবং বক্কেশ্বরেদের উল্লেখ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক তিনি এইসব কথায় যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। ছিলেন যে তার প্রমাণ ধরা আছে এই আশ্চর্য গ্রন্থ আবার অতি অল্প হইল-তে। এর পরতে পরতে হাজারো বিস্ময়। হাস্যরস জারিত শাণিত আক্রমণ। খুড় মহাশয়কে ‘গালি দেওয়া আবশ্যক’ মনে করে ভাইপো লিখেছেন—

তিনি সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছেন, সংস্কৃতবিদ্যা কেবল তাঁর পেটেই অন্তঃসলিলা বহিতেছে। খুড় অনেক আহার অর্থাৎ সংগ্রহ করিয়াছেন, যথার্থ বটে; কিন্তু সংস্কৃতবিদ্যা নিরতিশয় গুরুপাক দ্রব্য, হজম করিতে পারেন নাই; সুতরাং অপচার ও উদরাধ্মান হইয়া রহিয়াছে; মধ্যে মধ্যে যে নিঃসরণ হইতেছে, তাহার সৌরভে সমস্ত দেশ আমোদিত করিতেছে।৩৩

সেকালে এই রচনা ‘সমস্ত দেশ’ ‘আমোদিত’ করেছিল কি না জানা নেই। তবে করারই কথা। এ যুগের পাঠকের মনেও যে সে-সৌরভ ছড়াচ্ছে সে কথা অনস্বীকার্য। এই অংশটুকু পাঠের পর এই প্রতিবেদকের অবস্থা হয়েছিল সেই ছোটলাটের মতো যিনি বাচস্পতির বুগবুলবুলিতে অনূদিত ‘দি হাব্বারফ্লুয়াস ইন্‌ফ্যাচুফুয়েশন অব আকবর ডর্বেণ্ডিক্যালি ল্যাসেরটাইজট্‌ দি গর্বাণ্ডিজম্ অফ হুমায়ুন’ শুনে ‘একেবারে টরেটম বনে গিয়েছিলেন; মুখ হয়েছিল চাপাহাসিতে ফুসকায়িত’; আর ‘খুড়’কে দেখতে পেয়েছিল এই প্রতিবেদক শেষের কবিতা-র অমিত রায়র মধ্যে, যে ছিল অক্সফোর্ডের রোমহর্ষক এম.এ, যাকে পড়তে হয়েছিল বিস্তর, বুঝতে হয়েছিল অল্প।

হাসি মশকরা থাক। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক। যাঁর হৃদয় দীনদরিদ্র অসহায় মানুষজনের জন্য সদা চিন্তিত ছিল, তাঁর লেখনী কি কোনওদিন অশ্রুবর্ষণ করেনি! হ্যাঁ, করেছিল। ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’ তার প্রমাণ।

ছোট্ট এক বালিকা প্রভাবতী। পিতা রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন। তিন বছর বয়সে বিসূচিকা রোগে প্রভাবতীর মৃত্যু হয়। এই সংবাদে বিদ্যাসাগর খুবই শোকাভিভূত হন। প্রভাবতীকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। তার স্মরণে বিদ্যাসাগর ‘একটি ছোট নিবন্ধ রচনা করে’ ‘নিজের কাছে রেখে দেন, কাউকে দেখাননি’। নিজে মাঝে মাঝে পড়তেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছেন, ‘মৃত্যুর তিনচারি-মাস পূর্বেও আমি তাঁহাকে একান্তে “প্রভাবতীসম্ভাষণ” পড়িতে দেখিয়াছি।’ কী লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর এক শোকলেখনে— একটু পাঠ করা যাক।

বৎসে প্রভাবতী! তুমি দয়া, মমতা ও বিবেচনায় বিসর্জন দিয়া, এ জন্মের মত, সহসা, সকলের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইয়াছ। কিন্তু আমি অনন্যচিত্ত হইয়া, অবিচলিত স্নেহভরে তোমার চিন্তায় নিরন্তর এরূপ নিবিষ্ট থাকি যে, তুমি, এক মুহূর্তের নিমিত্ত, আমার দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইতে পার নাই। প্রতিক্ষণেই আমার স্পষ্ট প্রতীতি হইতেছে—

১। যেন, তুমি, বসিয়া আছ, আমায় অন্য মনে চলিয়া যাইতে দেখিয়া, ‘নীনা’ বলিয়া, করপ্রসারণপূর্বক, কোলে লইতে বলিতেছ।

২। যেন, তুমি উপরের জানালা হইতে দেখিতে পাইয়া, ‘আয় না’ বলিয়া, সলীল করসঞ্চালন সহকারে, আমায় আহ্বান করিতেছ।৩৪

এই আন্তরিক গদ্যের নেপথ্যে কোমলহৃদয় স্নেহময় বিদ্যাসাগরকে যেন স্পষ্ট দেখা যায়। তাঁর নয়নকোণে কি অশ্রুবিন্দু ভূমি স্পর্শ করার জন্য স্থির হয়ে আছে! সংহত আবেগ-গরাদের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় প্রভাবতীর কচি মুখখানি। লেখার জাদুতে সত্যমূর্তিতে দেখা দেয় তার কচি হাত-নাড়া। অথচ এই লেখার সময় তিনি অত্যন্ত কঠিন অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। সংসার তাঁর কাছে ‘নিতান্ত বিরস ও বিষময়’ হয়ে উঠেছিল। প্রভাবতী ভিন্ন আর কোনও কিছুই তাঁকে সুখ দিতে পারত না। ‘একমাত্র তোমায় অবলম্বন করিয়া, এই বিষময় সংসার অমৃতময় বোধ করিতেছিলাম’— লিখেছেন তিনি। অনুমান করতে কষ্ট হয় না প্রভাবতী তাঁর হৃদয় কতখানি জুড়েছিল। সম্ভাষণের শেষ দিকে তিনি লিখেছেন:

বৎসে! তোমায় আর অধিক বিরক্ত করিব না; একমাত্র বাসনা ব্যক্ত করিয়া বিরত হই— যদি তুমি পুনরায় নরলোকে আবির্ভূত হও, দোহাই ধর্মের এইটি করিও, যাঁহারা তোমার স্নেহপাশে বদ্ধ হইবেন, যেন, তাঁহাদিগকে, আমাদের মত অবিরত, দুঃসহ শোকদহনে দগ্ধ হইয়া, যাবজ্জীবন যাতনাভোগ করিতে না হয়।৩৫

‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’ সম্পর্কে অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন:

গদ্যে রচিত এই ক্ষুদ্র শোকোচ্ছ্বাস অনেকের ততটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে না বটে, কিন্তু এতে বিদ্যাসাগরের এক অপূর্ব পরিচয় ধরা পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এই পুস্তিকায় বিদ্যাসাগর আর দেশমান্য বিশ্রুতকীর্তি প্রকাণ্ড ব্যক্তি নন, এখানে তিনি বিয়োগব্যথাতুর বিলাপের মধ্য দিয়ে তাঁর এক অজানা পরিচয় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এরকম আন্তরিক রচনা বাংলা সাহিত্যে বড় বেশী নেই।৩৬

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ (এপ্রিল ১৮৫৫) এবং বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ (জুন ১৮৫৫)। ‘শোনা যায়, প্যারীচরণ সরকার এবং বিদ্যাসাগর একদা সিদ্ধান্ত করেন যে, দু’জনে ইংরেজী ও বাংলায় বর্ণশিক্ষা বিষয়ক প্রাথমিক পুস্তিকা লিখবেন। তদনুসারে প্যারীচরণ First Book of Reading এবং বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ প্রকাশ করেন।… বিদ্যাসাগর মফঃস্বলে স্কুল পরিদর্শনের সময় পথিমধ্যে পালকীতে বসে বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন।’ (এই নিবন্ধলেখকের স্মৃতি বলে, পিতৃদেবের কাছে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ এবং ফার্স্ট বুক দিয়ে তার বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয়েছিল।)

বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ মূলত বর্ণমালা শিক্ষার বই। বাংলা স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ-এর সঙ্গে পরিচয় সাধনের পর শুরু হয়েছে ‘কর খল ঘট জল’ ইত্যাদি বর্ণযোজনা। এই পর্ব পেরিয়ে এসে দেখা মেলে ১ থেকে ২০টি পাঠের। প্রথম পাঠে ‘বড় গাছ। ভাল জল। লাল ফুল। ছোট পাতা।’ বিশেষ্য বিশেষণ দিয়ে গড়া ছোট ছোট বাক্য। শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে। বড় সুন্দর ছন্দ এবং গতি। নিমেষে মনের মধ্যে এক অপরূপ জগৎ সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয় পাঠে দেখা দিয়েছে ক্রিয়াপদ। দুই দুই শব্দের চারটি বাক্য: পথ ছাড়। জল খাও। হাত ধর। বাড়ী যাও। শুধুই কি বাক্য? না তা নয়। যেন ছোট একটা নাটক। দু’টি চরিত্র। একজন নবীন। অন্যজন প্রবীণ। চমৎকার ছন্দ। গতি। মনের মধ্যে চেপে বসে। থেকে যায় অনেকটা সময়।

অষ্টম পাঠেও ছবি। সবমিলিয়ে ছ’টা। কাক ডাকিতেছে। পাখী উড়িতেছে। পাতা নড়িতেছে। গরু চরিতেছে। জল পড়িতেছে। ফল ঝুলিতেছে। প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে ছোট ছোট বাক্যর হাত ধরে। বাক্যগুলি গতিময়। ছন্দ ভরা।

চতুর্দশ পাঠে দেখা দিয়েছে ছোট-বড় বাক্য দিয়ে গড়া একটি ছোট অনুচ্ছেদ: আর রাতি নাই। ভোর হইয়াছে। আর শুইয়া থাকিব না। উঠিয়া মুখ ধুই। ইত্যাদি। এখানেও যেন একটা একক অভিনয়ের চিত্রনাট্য।

উনিশ সংখ্যক পাঠের শুরু তিনটি শব্দের বাক্য দিয়ে: গোপাল বড় সুবোধ। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ কমা, সেমিকোলনের হাত ধরে বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে এইভাবে:

গোপাল যখন পড়িতে যায়, পথে খেলা করে না; সকলের আগে পাঠশালায় যায়; পাঠশালায় গিয়া, আপনার জায়গায় বসে; আপনার জায়গায় বসিয়া, বই খুলিয়া পড়িতে থাকে; যখন গুরুমহাশয় নূতন পড়া দেন, মন দিয়া শুনে।৩৭

সরলমতি শিক্ষার্থীদের কথা মনে করে রচনা। বাক্যগুলি সরল। স্নেহে ভরা। ভাল করে কান পাতলে একটু যেন সংগীত শুনতে পাওয়া যায়। এই অশ্রুত সংগীতস্রষ্টা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

দ্বিতীয় ভাগের শুরু হয়েছে সংযুক্ত বর্ণ দিয়ে। এরপর এক এক করে দশটি পাঠ। প্রথম দু’টি পাঠ শিরোনামহীন। তৃতীয় থেকে দশম পাঠ শিরোনামযুক্ত যথাক্রমে সুশীল বালক, যাদব, নবীন, মাধব, রাম, পিতামাতা, সুরেন্দ্র, চুরি করা কদাচ উচিত নয়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পাঠ–এর অনুচ্ছেদগুলি সংখ্যাচিহ্নিত। চতুর্থ পাঠ থেকে বর্জিত হয়েছে সংখ্যাচিহ্ন। যাদব নবীন মাধব রাম সুরেন্দ্র পাঁচটি বালকের কাহিনি। প্রতিটি কাহিনির গতি যেন একটি নির্দিষ্ট লয়ে এবং সুরে বাঁধা। পাঠকালে এক অনাস্বাদিত আনন্দের অনুভূতি হয়। সপ্তম পাঠ থেকে কয়েকটি ছত্র:

রাম বড় সুবোধ। সে কদাচ পিতামাতার কথার অবাধ্য হয় না। তাঁহারা রামকে যখন যাহা করিতে বলেন, সে তৎক্ষণাৎ তাহা করে, কদাচ তাহার অন্যথা করে না।৩৮

অষ্টম পাঠ: পিতা মাতা। পাঠ শুরু হয়েছে:

দেখ বালকগণ! পৃথিবীতে পিতা মাতা অপেক্ষা বড় কেহ নাই। মাতা গর্ভে ধরিয়াছেন। পিতা জন্ম দিয়াছেন। তাঁহারা কত যত্নে, কত কষ্টে, তোমাদের লালন পালন করিয়াছেন। তাঁহারা সেরূপ যত্ন ও সেরূপ কষ্ট না করিলে, তোমাদের প্রাণ রক্ষা হইত না।

তাঁহারা তোমাদিগকে যেরূপ ভাল বাসেন, পৃথিবীতে আর কেহ তোমাদিগকে সেরূপ ভাল বাসেন না। কিসে তোমাদের সুখ ও আহ্লাদ হয়, তাঁহারা সর্বদা সে চেষ্টা করেন।৩৯

বালকদের উদ্দেশে কথাগুলো উঠে আসছে হৃদয়ের গভীর থেকে। এর সঙ্গে মিশে আছে বিদ্যাসাগরের আপন অনুভূতি। সে-কারণে বাক্যগুলি নাতিদীর্ঘ, কাহিনিগুলি আজও উজ্জ্বল। প্রাণস্পর্শী এবং সমাজের প্রতি বার্তাবাহীও বটে।

দশম পাঠে চুরি করার পরিণাম কী, ছোটদের প্রতি অভিভাবকদের কী কর্তব্য সেই কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। ‘না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়, চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে তাহাকে চোর বলে।’ লেখার গুণে এসব বাক্য স্মৃতিতে স্থায়ী ঠিকানা করে নেয়। ভুবন নামক ছেলেটির প্রতি আজ বড় করুণা অনুভব করি। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ভুবনের এই গল্প বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনা নয়। এটি টমাস জেমস্ অনূদিত Æsop’s Fables-এর অন্তর্গত ‘The Thief and His Mother’ গল্পের প্রায় স্বচ্ছন্দ অনুবাদ।’৪০ তবে পড়ার সময় কখনওই মনে হয় না কোনও অনুবাদ পড়ছি। লেখার গুণে, প্রতিভার স্পর্শে অনুবাদও হয়ে উঠেছে নিরুপম মৌলিক।

বহুজনের অনুরোধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন। মাত্র দু’টি পরিচ্ছেদ তিনি লিখে উঠতে পেরেছিলেন। বাধা ছিল কাজের চাপ এবং শারীরিক অসুস্থতা। তাঁর তিরোধানের পর সাহিত্য পত্রিকায় (কার্তিক, ১২৯৮) ‘বিদ্যাসাগর রচিত “আত্মজীবনচরিতের” কয়েক পৃষ্ঠা’ নামে সেই রচনা প্রকাশ পায়। পুত্র নারায়ণচন্দ্র বিদ্যারত্ন অবশ্য এটি বিদ্যাসাগরচরিত (স্বরচিত) নামে প্রায় একই সময়ে পুস্তিকা রূপে প্রকাশ করেন (সেপ্টেম্বর ১৮৯১)। সাধনা পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১২৯৮ সংখ্যায় (পৃ. ৯২) এই আত্মজীবনী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন।

ইহাতে অলঙ্কারবাহুল্য বা আড়ম্বরের লেশমাত্র নাই।… এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ হইলে বাঙ্গালীদের পক্ষে শিক্ষার স্থল হইত। প্রথমতঃ একটি অকৃত্রিম মহত্ত্বের আদর্শ বঙ্গসাহিত্যে চিরজীবন লাভ করিয়া বিরাজ করিত, দ্বিতীয়তঃ আপনার কথা কেমন করিয়া লিখিতে হয় বাঙ্গালী তাহা শিখিতে পারিত।

সাধু তথা সুস্বাদু গদ্যে শুরু হয়েছে সেই আত্মচরিত:

শকাব্দ: ১৭৪২, ১২ই আশ্বিন, মঙ্গলবার, দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, বীরসিংহ গ্রামে আমার জন্ম হয়। আমি জনকজননীর প্রথম সন্তান।৪১

এরপর নিজের জন্মসংবাদ কীভাবে পিতামহ তাঁর পুত্র ঠাকুরদাসকে দিয়েছিলেন মজা করে বিদ্যাসাগর সেই ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। দু’টি অধ্যায়ের জীবনচরিতের প্রথম অধ্যায়টি পিতৃপুরুষের ইতিহাসে ঋদ্ধ। পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের যে-চরিত্রচিত্রণ বিদ্যাসাগর করেছেন, সাহিত্যে তার দৃষ্টান্ত সহজলভ্য নয়। পিতামহর কথা প্রথম অধ্যায় থেকে ছাপিয়ে চলে এসেছে দ্বিতীয় অধ্যায়েও। বিদ্যাসাগর কোন মানুষের উত্তরাধিকার বহন করে জীবন নির্বাহ করেছিলেন তার কিছু নিদর্শন বিদ্যাসাগরের রচনা থেকে উদ্ধার করি:

—শাকে, কার্তিক মাসে, পিতামহদেব, রামজয় তর্কভূষণ, অতিসার রোগে আক্রান্ত হইয়া, ছিয়াত্তর বৎসর বয়সে দেহত্যাগ করিলেন। তিনি নিরতিশয় তেজস্বী ছিলেন; কোনও অংশে, কাহারও নিকট অবনত হইয়া চলিতে অথবা কোনও প্রকারে, অনাদর বা অবমাননা সহ্য করিতে পারিতেন না। তিনি, সকল স্থলে, সকল বিষয়ে, স্বীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্ত হইয়া চলিতেন। অন্যদীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তন, তদীয় স্বভাব ও অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীতে ছিল। উপকার প্রত্যাশায় অথবা অন্য কোনও কারণে, তিনি কখনও পরের উপাসনা বা আনুগত্য করিতে পারেন নাই। তাঁহার স্থির সিদ্ধান্ত ছিল, অন্যের উপাসনা বা আনুগত্য করা অপেক্ষা প্রাণত্যাগ করা ভাল।৪২

স্পষ্টবাক, সাহসী, জব্দের অতীত রামজয় তর্কভূষণ শ্যালক, গর্বিত উদ্ধতস্বভাব গ্রামপ্রধান রামসুন্দর বিদ্যাভূষণ সম্পর্কে খোলাখুলি বলতেন, ‘বরং বাসত্যাগ করিব, তথাপি শালার অনুগত হইয়া চলিতে পারিব না।’

বিদ্যাসাগরের শিক্ষা প্রসঙ্গে আত্মজনদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ঠাকুরদাস তাঁকে সংস্কৃত কলেজে ভরতি করেছিলেন। পুস্তিকার উপান্ত্য অনুচ্ছেদে বিদ্যাসাগর লিখেছেন:

আমরা পুরুষানুক্রমে সংস্কৃত ব্যবসায়ী; পিতৃদেব অবস্থার বৈগুণ্যবশতঃ ইচ্ছানুরূপ সংস্কৃত পড়িতে পারেন নাই; ইহাতে তাঁহার অন্তঃকরণে অতিশয় ক্ষোভ জন্মিয়াছিল। তিনি সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন, আমি রীতিমত সংস্কৃত শিখিয়া চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা করিব;… তিনি বলিলেন, উপার্জনক্ষম হইয়া, আমার দুঃখ ঘুচাইবেক, আমি সে উদ্দেশে ঈশ্বরকে কলিকাতায় আনি নাই। আমার একান্ত অভিলাষ, সংস্কৃত শাস্ত্রে কৃতবিদ্য হইয়া দেশে চতুষ্পাঠী করিবেক, তাহা হইলেই আমার সকল ক্ষোভ দূর হইবেক।৪৩

পিতার ইচ্ছা পূর্ণ করতে পেরেছিলেন কি না, ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এই স্বল্পায়তন জীবনস্মৃতিতে আবেগের শিকার হয়ে পড়ার কিছু উপলক্ষ ছিল। বিদ্যাসাগর সেইসব স্থল নিরাবেগে পার হয়ে এসেছেন। ‘স্টাইল ইজ় দ্য ম্যান’-এর যথার্থ নিদর্শন বিদ্যাসাগরের গদ্যরচনা। পাঠকালে কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ বা ‘শান্তিনিকেতন’ ভাষণমালার কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘কবিকুলতিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্তভাইপোস্য প্রণীত’ ‘যৎকিঞ্চিৎ অপূর্ব মহাকাব্য’ ব্রজবিলাস বিদ্যাসাগরের বেনামি রচনা। বলেছেন ‘মহাকাব্য’ কিন্তু গদ্যে লেখা। এবং প্রকৃত অর্থেই ‘অপূর্ব’। এ যেন এক রসময় বিদ্যাসাগরের এক অদৃষ্ট প্রতিচ্ছবি। এখানে তিনি প্রবাদে প্রবচনে রঙ্গরসিকতায় এক অপূর্ব জগৎ সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছেন:

এক গণ্ডা এক মাস অতীত হইল, বিদ্যাসাগর বাবুজি, অতি বিদঘুটে পেটের পীড়ায় বেয়াড়া জড়ীভূত হইয়া, পড়িয়া লেজ নাড়িতেছেন, উঠিয়া পথ্য করিবার তাকত নাই। এ অবস্থায়, তিনি এই মজাদার মহাকাব্য লিখিয়াছেন, এ কথা যিনি রটাইবেন, অথবা, এ কথায় যিনি বিশ্বাস করিবেন, তাঁহার বিদ্যা, বুদ্ধির দৌড় কত, তাহা সকলে, স্ব স্ব প্রতিভাবলে, অনায়াসে উপলব্ধি করিতে পারেন।৪৪

পাঠক যাতে কোনওভাবেই বিদ্যাসাগরকে লেখক রূপে সন্দেহ করতে না পারে, তার পথ বন্ধ করতে চেয়েছেন তিনি। মূল ‘মহাকাব্য’-এর প্রথম উল্লাসে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, পাঠক যতই চেষ্টা করুন-না-কেন কে তিনি সে-তথ্য জানার, তিনি তাঁর পরিচয় কোনওভাবেই হাট করবেন না। তাঁর যুক্তি, ‘পরিচয় দিলেই, ভুল ভাঙিয়া যাইবে; তাহা অপেক্ষা, চালাকি ও গোলমাল করিয়া, যতক্ষণ আপনাদিগকে ফাঁকি দিতে পারি, সেই লাভ, সেই বাহাদুরি।’ তবে, একটু পরেই অবশ্য তিনি উপযুক্ত ভাইপোর পরিচয় দিয়েছেন এই বলে:

আমি, অজগরের ন্যায় অলস, কুম্ভকর্ণের ন্যায় নিদ্রালু; সহজে নড়িতে চড়িতে ইচ্ছা করে না; আর নিদ্রাগত হইলে সহজে নিদ্রাভঙ্গ হয় না।৪৫

উপযুক্ত ভাইপোর খুব ইচ্ছে ছিল একবার বিদ্যাসাগরকে চাক্ষুষ করার। সে সাধ তাঁর মিটেছিল। বিদ্যাসাগরের বাড়িতে একদিন সোজা চলে গেলেন তিনি। দেখলেন বাড়ি লোকে লোকারণ্য। একটা ঘরে একটা টেবল ঘিরে সাত-আটজন বসে আছেন। একজনকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বিদ্যাসাগরকে দেখিয়ে দিলেন। সেইসঙ্গে বললেন:

ঐটি বিদ্যাসাগর, ঐটি ভাটপাড়ার আনন্দচন্দ্র শিরোমণি, ঐটি নবদ্বীপের প্রধান স্মার্ত ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন। শ্রবণমাত্র, এক উদ্যোগে দুই মনস্কামনা পূর্ণ হইল, এই ভাবিয়া, আহ্লাদে গদগদ হইলাম। বিদ্যারত্ন ও বিদ্যাসাগর, উভয় জানোয়ারকেই, কিয়ৎক্ষণ অনিমেষ নয়নে, নিরীক্ষণ করিলাম।৪৬

নিজেকে নিয়ে এই তীক্ষ্ণ রসিকতা সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। এজন্য যেমন সাহস প্রয়োজন, তেমনই দরকার নিজেকে নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা। সেই দেখার দৃষ্টান্ত গোটা ব্রজবিলাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে।

আমি বড় ডাঙপিঠে, কোনও কারণে ভয় পাইবার ছেলে নই। উপযুক্ত ভাইপো, খুড়র সঙ্গে, বিচার করিতে পিছপাও হইবেন, যদি কেহ, ভুল ভ্রান্তিতেও, সেরূপ ভাবেন, তিনি যত বড় ধনী, যত বড় মানী, যত বড় বিদ্বান, যত বড় বুদ্ধিমান, যত বড় হাকিম, যত বড় আমলা, যত বড় তেঁদড়া, যত বড় বেদড়া হউন না কেন, তাঁহার মনোহর গাল, বসরাই গোলাপের মত টুকটুকেই হউক, আর রামছাগলের মত চাঁপদাড়িতে সুসজ্জিত ও সুশোভিত হউক, ঠাস ঠাস করিয়া, দশ বার জোড়া চড় মারিয়া সেই বেআদবকে, চিরকালের জন্য, দুরস্ত করিয়া দিব।৪৭

এ যে ব্যক্তি বিদ্যাসাগর পারতেন তাতে আর সন্দেহ কী! তাঁর জীবনচরিত খুঁজলে এর সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে, এটা ঠিক যে নিজেকে নিয়ে রসিকতা করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যতিক্রমী ব্যক্তি বিদ্যাসাগর। বলেছেন, ‘আমি, বিদ্যাবাগীশ খুড়দের মত, গর্দভচূড়ামণি’ তাই নাকি ‘অকারণে, এত ফেচফেচ’ এবং ‘অগড়ম বগড়ম’ বকছেন। কিন্তু যখন ‘পঞ্চম উল্লাস’-এ পাঠকদের সরাসরি সম্বোধন করে লেখেন:

দেখুন, বাটীতে বিধবা থাকিলে, গৃহস্থের কত মত উপকার হয়। প্রথমতঃ, মিনি মাইনায়, রাঁধুনি চাকরানি, মেথরানি পাওয়া যায়; দ্বিতীয়তঃ, সময়ে সময়ে, বাটীর পুরুষদিগের, প্রকারান্তরে, অনেক উপকার দর্শে; তৃতীয়তঃ, বাটীর চাকরেরা বিলক্ষণ বশীভূত থাকে, ছাড়াইয়া দিলেও, হতভাগার বেটারা নড়িতে চায় না; চতুর্থতঃ, প্রতিবাসীরা অসময়ে বাটীতে আইসেন। এটি নিতান্ত সামান্য কথা নহে; কারণ, যেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, অসময়ে কেহ কাহারও দিক মাড়ায় না।৪৮

তখন কি একে ‘অকারণে’র কোঠায় ফেলা যাবে? যে শ্লেষমিশ্রিত গদ্যে সমকালীন ছবি তিনি উত্তরকালের পাঠকদের জন্য রচনা করে গেছেন তার উদাহরণ কি সহজলভ্য? ইঙ্গিতে যে যে কথা তিনি বলেছেন মাত্র একটি-দু’টি শব্দপ্রয়োগে তার তুলনা, সম্ভবত মিলতে পারে রবীন্দ্রনাথেই। (স্মরণীয় চতুরঙ্গ উপন্যাসের একটি বাক্য: ‘এমনি করিয়া দামিনী যখন স্থির সৌদামিনী হইয়া উঠিয়াছে শচীশ তার শোভা দেখিতে লাগিল।’) আরও এক কথা, যে-ছবি তিনি তুলে ধরেছিলেন একশো বছর আগে তার কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে এই অতি-আধুনিক নয়া-উদারনীতি আর টেকনোলজির যুগে?

এই পঞ্চম উল্লাসে বিদ্যাসাগর এক উমেদারির গল্প শুনিয়েছেন। গল্প বলার ঢঙ এমনই যে আমাদের মনে হয়েছে, ইচ্ছে করলে তিনি মৌলিক গল্পও কিছু লিখতে পারতেন। গল্পের শেষ দিকে বাবু যখন উমেদারদের বলেন:

তোমরা ত বেশ লোক; যেই আমি বলিলাম, পটোল ভাল তরকারি নয়, অমনি তোমরা পটোলকে নরকে দিলে; যেই আমি বলিলাম, পটোল বড় মন্দ তরকারি নয়, অমনি তোমরা পটোলকে স্বর্গে তুলিলে।৪৯

উমেদাররা উত্তরে জানাল যে তারা ঝোল বা পটোল কারওই উমেদার নয়। উমেদার বাবুর। বাবু যাতে খুশি থাকেন উমেদাররা সর্বদা সেই চেষ্টাই করে। উত্তর শুনে বাবুর মুখে আর কথাটি নেই।

ব্রজবিলাস বিদ্যাসাগর মশাই শেষ করেছেন কবিতা দিয়ে:

খুড়র গুণের কথা অতি চমৎকার।

এমন গুণের খুড় না হেরিব আর॥

খুড়টির গুণের বালাই লয়ে মরি।

খুড়র পিরিতে সবে বল হরি হরি॥

হরিবোল! হরিবোল! হরিবোল! ৫০

বিদ্যাসাগরীয় গদ্য নিয়ে এই সামান্য সন্দর্ভ অতএব শেষ করব মেদিনীপুর বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির-প্রবেশ-উৎসবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রদত্ত (৩০ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬) ভাষণের কিয়দংশ উদ্ধৃত করে:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলায় সাহিত্যভাষার সিংহদ্বার উদ্ঘাটন করেছিলেন। তার পূর্ব থেকেই এই তীর্থাভিমুখে পথখননের জন্যে বাঙালির মনে আহ্বান এসেছিল এবং তৎকালীন অনেকেই নানা দিক থেকে সে আহ্বান স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁদের অসম্পূর্ণ চেষ্টা বিদ্যাসাগরের সাধনায় পূর্ণতার রূপ ধরেছে। ভাষার একটা প্রকাশ মননের দিকে এবং জ্ঞানের তথ্যসংগ্রহের দিকে, অর্থাৎ বিজ্ঞানে তত্ত্বজ্ঞানে ইতিহাসে; আর একটা প্রকাশ ভাবের বাহন-রূপে রসসৃষ্টিতে; এই শেষোক্ত ভাষাকেই বিশেষ করে বলা যায় সাহিত্যের ভাষা। বাংলায় এই ভাষাই দ্বিধাহীন মূর্তিতে প্রথম পরিস্ফুট হয়েছে বিদ্যাসাগরের লেখনীতে,…৫১

এই ভাষণের উপান্ত্য অনুচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন:

পুণ্যস্মৃতি বিদ্যাসাগরের সম্মাননার অনুষ্ঠানে আমাকে যে সম্মানের পদে আহ্বান করা হয়েছে, তার একটি বিশেষ সার্থকতা আছে। কারণ, এইসঙ্গে আমার স্মরণ করবার উপলক্ষ ঘটল যে, বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন তবে আমি যেন স্বীকার করি একদা তার দ্বার উদ্ঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।৫২

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বিদ্যাসাগরচরিত’, চারিত্রপূজা, রবীন্দ্র-রচনাবলী ১১ (কলিকাতা: পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৮৯), পৃ. ১৭২।

. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ (নিউ দিল্লি: সাহিত্য অকাদেমি, পুনর্মুদ্রণ ১৯৭৮), পৃ. ৭৬৬।

. রাজশেখর বসু, চলন্তিকা (কলিকাতা: এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স লি., তৃতীয় সংস্করণ ১৩৪৫), পৃ. ১৪৮।

. The Shorter Oxford English Dictionary. (Oxford. At the Clarendon Press for The Standard Literature Company Private Ltd., Calcutta, Reprinted with corrections 1964), Page 1602.

. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০১৮), পাদটীকা ২-এ উদ্ধৃত, পৃ. ১৬।

. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘নাটক’, পুনশ্চ, রবীন্দ্র-রচনাবলী ৩ (কলিকাতা: পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৮৩), পৃ. ১০–১১।

. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য (কলিকাতা: রঞ্জন প্রকাশালয়, ১৩৪১), পৃ. ১।

. সজনীকান্ত দাস, বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, পুনমুর্দ্রণ ২০১৭), পৃ. ২৭।

. তদেব, পৃ. ২৮।

১০. তদেব, পৃ. ৩০।

১১. তদেব, পৃ. ৪৬।

১২. রামরাম বসু, রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র, শ্রীমনোমোহন ঘোষ কর্তৃক সম্পাদিত (কলিকাতা: দাশগুপ্ত এণ্ড কোং, ১৯৪২), পৃ. ১।

১৩. তদেব, পৃ. ৯০।

১৪. তদেব, পৃ. ১|γ০।

১৫. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য, পৃ. ৩৪–৩৫।

১৬. তদেব, পৃ. ৩৫–৩৬।

১৭. প্রমথ চৌধুরী, প্রবন্ধ সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড (কলকাতা, ১৩৬৯), পৃ. ৭৬।

১৮. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার’, সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা—৩, চতুর্থ মুদ্রণ, পৃ. ৩৬।

১৯. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য, পৃ. ৪০।

২০. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, মনীষী স্মরণে (কলকাতা: পারুল, ২০১৬), পৃ. ৩৭–৩৮।

২১. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংকলিত, সীতার বনবাস, সম্পাদক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস (কলিকাতা: বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, চতুর্থ সংস্করণ, ১৩৭২), পৃ. ১৬–১৭।

২২. তদেব, পৃ. ৪৭।

২৩. তদেব, পৃ. ৫৩।

২৪. তদেব, পৃ. ২৯–৩০।

২৫. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’, বিদ্যাসাগর রচনাবলী, অখণ্ড সংস্করণ, সম্পাদনা সুবোধ চক্রবর্তী (কলকাতা: কামিনী প্রকাশালয়, ষষ্ঠ সংস্করণ, ১৪২৩), পৃ. ১।

২৬. তদেব, পৃ. ৫।

২৭. তদেব, পৃ. ১১।

২৮. তদেব, পৃ. ২৮৬।

২৯. তদেব, পৃ. ৮৮৭।

৩০. তদেব, পৃ. ৮৯২–৮৯৩।

৩১ তদেব, পৃ. ৮৯৪।

৩২. তদেব, পৃ. ৮৯৪।

৩৩. তদেব, পৃ. ৮৯৯।

৩৪ তদেব, পৃ. ৩৪০।

৩৫. তদেব, পৃ. ৩৪৪।

৩৬. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, পৃ. ৮৯।

৩৭. বিদ্যাসাগর রচনাবলী, সম্পাদনা সুবোধ চক্রবর্তী, পৃ. ১০১৯।

৩৮. তদেব, পৃ. ১০৩০।

৩৯. তদেব, পৃ. ১০৩০।

৪০. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, পৃ. ৮৯।

৪১. বিদ্যাসাগর রচনাবলী, সম্পাদনা সুবোধ চক্রবর্তী, পৃ. ৩২৫।

৪২. তদেব, পৃ. ৩৩৩।

৪৩. তদেব, পৃ. ৩৩৮–৩৩৯।

৪৪. তদেব, পৃ. ৯১২।

৪৫. তদেব, পৃ. ৯১৯।

৪৬. তদেব, পৃ. ৯২০।

৪৭. তদেব, পৃ. ৯২৩।

৪৮. তদেব, পৃ. ৯৩৫।

৪৯. তদেব, পৃ. ৯৩৮।

৫০. তদেব, পৃ. ৯৪০।

৫১. রবীন্দ্র-রচনাবলী ১১, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ. ২১৬।

৫২. তদেব, পৃ. ২১৭।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *