ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
১. বিদ্যাসাগরচরিত
উনিশ শতকের বাংলা দেশে বহু কীর্তিমান পুরুষের জন্ম হয়েছিল। এঁদের মধ্যেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বাতন্ত্র্য সহজেই ধরা পড়ে। যে-বিস্ময়বোধ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন, সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন’, যুগান্তরেও আমাদের সে-বিস্ময়বোধের অবসান হয় না।
অথচ তিনি লালিত হয়েছিলেন নিতান্ত প্রাচীনপন্থী পরিবেশে। মেদিনীপুর (তখন হুগলি) জেলার বীরসিংহ গ্রামে তাঁর জন্ম হয় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০। ১২ আশ্বিন ১২২৭)। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সামান্য কর্ম করতেন; তাঁর বেতন কখনো মাসে দশ টাকার বেশি হয়নি। দারিদ্র তাঁদের সহচর ছিল; সম্পদ বলতে ছিল পুরুষানুক্রমিক চরিত্রবল। বিদ্যাসাগর-জননী ভগবতী দেবীও এ-চরিত্রগুণের অধিকারী ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে বিদ্যাসাগর যদি তাঁর পরিবার থেকে কিছু পেয়ে থাকেন, তবে তা ছিল চরিত্রের এই তেজ।
পাঁচ বছর বয়সে বীরসিংহ গ্রামে বহুবিবাহিত ভঙ্গকুলীন কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় বিদ্যাসাগরের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। অতি দুরন্ত ও অবাধ্য বালক ছিলেন তিনি; অতিশয় বুদ্ধিমান ছিলেন, শ্রুতিধর বললেও অত্যুক্তি হতো না। আট বছর বয়সে পিতার সঙ্গে ছাব্বিশ ক্রোশ পথ হেঁটে তিনি কলকাতায় আসেন। এই পথে আসবার সময়েই মাইলস্টোন দেখে ইংরেজি সংখ্যা চিনে নেন। কিন্তু কলকাতায় এসে তাঁর ইংরেজি পড়ার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। ঠাকুরদাসের ইচ্ছে ছিল জ্যেষ্ঠ সন্তানকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করবেন। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের স্বেচ্ছাচারের নিন্দা তখন শুরু হয়ে গেছে; দরিদ্র ব্রাহ্মণের এই অভিলাষ একটু বিস্ময়কর বই কি! কিন্তু হিন্দু কলেজে পড়ার খরচ বিস্তর—তাই ঈশ্বরচন্দ্রকে ভর্তি করা হলো শিবচন্দ্র মল্লিকের বাড়ির পাঠশালায়, থাকার ব্যবস্থা হলো জগদ্দুর্লভ সিংহের বাড়িতে। পরবর্তীকালেও অন্যের আশ্রয়ে থেকেই বিদ্যাসাগরকে লেখাপড়া শিখতে হয়েছে।
১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্ররূপে। ব্যাকরণ শ্রেণিতে পড়তে পড়তে তিনি ইংরেজি শ্রেণিতেও যোগ দেন। দেড় বছর পর তিনি মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তিলাভ করেন, পরে তা আট টাকায় পরিণত হয়। বিদ্যাসাগর এ-টাকা ঠাকুরদাসকে পাঠাতেন; ঠাকুরদাস তা জমিয়ে বীরসিংহে জমি কিনেছিলেন—ভবিষ্যতে ঈশ্বরচন্দ্র টোল খুলবেন, এই ধারণা করে।
সংস্কৃত কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র প্রায় সাড়ে বারো বছর অধ্যয়ন করেন। শুধু ব্যাকরণের নয়, সাহিত্য, অলংকার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও জ্যোতিষ শ্রেণির ছাত্র হিসেবেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। পড়াশোনা সাঙ্গ করে ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলেজের প্রশংসাপত্র লাভ করেন। এর অন্তত দুবছর আগে তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পেয়েছিলেন, হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষাও পাশ করেছিলেন; আর প্রায় সাত বছর আগে দিনময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের সময়ে পাত্রের বয়স চোদ্দ, পাত্রীর আট। এত অল্প বয়সে দারপরিগ্রহ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র; কেবল পিতার ভয়ে তাঁকে মাথায় টোপর দিতে হয়। পুত্রের অবাধ্যতারোগ উপশম করার জন্যে ঘনঘন প্রহারের ব্যবস্থায় ঠাকুরদাস অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগে সেরেস্তাদার বা প্রথম পণ্ডিত নিযুক্ত হন। ওই কলেজের সেক্রেটারি ক্যাপ্টেন মার্শাল তাঁর একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পঞ্চাশ টাকা মাইনের চাকরি পেয়ে ঠাকুরদাসকে কর্মত্যাগ করতে বাধ্য করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। বাড়িতে মাসে মাসে তিনি কুড়ি টাকা পাঠাতেন, বাকি ত্রিশ টাকায় দুই সহোদরসহ এগারো জনের ব্যয়নির্বাহ হতো। এখানে থাকতেই তিনি হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় মনোযোগ দেন।*
পাঁচ বছর পর বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই পদ গ্রহণ করে তিনি কলেজের সংস্কারকার্যে প্রবৃত্ত হন বিশেষ উদ্যমের সঙ্গে। সংস্কৃত কলেজে ছাত্র বা শিক্ষকদের আসা-যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না; শিক্ষকেরা চেয়ারে বসে নিদ্রা যেতেন, ছাত্রেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতাস করত; পাঠ্যবইতে শ্লীল-অশ্লীল কবিতার বাছবিচার ছিল না। বিদ্যাসাগর এসব অনিয়ম দূর করেন। কলেজকে জুনিয়র ও সিনিয়র বিভাগে বিন্যস্ত করেন এবং পাঠ্যতালিকাও পুনর্গঠন করেন। সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক রসময় দত্ত বিদ্যাসাগরের এতটা কর্তৃত্ব পছন্দ করেননি। দুজনের সংঘাত বাধল অচিরে; বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করলেন। তিনি আকস্মিকভাবে পঞ্চাশ টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় রসময় দত্ত (মতান্তরে বিদ্যাসাগরের আত্মীয়েরা) নাকি কাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর খাবে কি ?’ একথা শুনে বিদ্যাসাগর জবাব দিয়েছিলেন, ‘বোলো বিদ্যাসাগর আলু-পটল বেচে খাবে।’
অবশ্য তার প্রয়োজন হয়নি। এর আগেই ক্যাপ্টেন (তখন মেজর) মার্শাল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাত্রদের উপযোগী বাংলা বই রচনা করতে অনুরোধ করেছিলেন বিদ্যাসাগরকে; এমন কি হিন্দি বৈতালপচ্চিসী ও মার্শম্যানের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলের বাংলা মর্মানুবাদ সংকলন করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন। সংস্কৃত কলেজের সংস্রব ত্যাগ করার মাসতিনেক আগেই বেতাল পঞ্চবিংশতি প্রকাশিত হয়। বাঙ্গালার ইতিহাস বের হয় ১৮৪৮-এ। ইতিমধ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে পরামর্শ করে সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যাসাগর এবং মার্শালের পরামর্শে অন্নদামঙ্গল মুদ্রণ করেন। মুদ্রিত পুস্তক বিক্রয়ের জন্যে সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি নামে একটি পুস্তককেন্দ্রও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষের পদে যোগদান করেন তিনি, তবে সংস্কৃত কলেজে ফিরে না আসা পর্যন্ত তাঁর রচিত আর কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপক এবং পরবর্তী মাসে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ বিদ্যাসাগরের জীবনে অন্য দিক দিয়েও উল্লেখযোগ্য। এই বছরেই হিন্দু কলেজের সিনিয়র ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদের মুখপত্র মাসিক সর্ব্বশুভকরী পত্রিকায় তাঁর ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধটি প্রকাশ পায়। বিদ্যাসাগরের হাতে সমাজবিষয়ক রচনার সূচনা হয় এখানে।
সহকারী সম্পাদক হিসেবে সংস্কৃত কলেজের পুনর্গঠনের যে-সূচনা বিদ্যাসাগর করেছিলেন, অধ্যক্ষের সর্বময় ক্ষমতা লাভ করে এখন দ্বিগুণ উৎসাহে সেই সংস্কারকার্যে প্রবৃত্ত হলেন তিনি। ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া আগে কেউ সংস্কৃত কলেজে প্রবেশাধিকার পেত না; বিদ্যাসাগর সকল বর্ণের হিন্দুর জন্যে কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করলেন। অষ্টমী ও প্রতিপদের ছুটির বদলে রবিবার ছুটির দিন ধার্য করলেন এবং গ্রীষ্মের অবকাশের ব্যবস্থা করলেন। কলেজে প্রবেশ-দক্ষিণার নিয়মও প্রবর্তিত হলো। শিক্ষাপ্রণালির পরিবর্তন করলেন তিনি এবং সেই প্রয়োজনানুযায়ী পাঠ্যপুস্তকও রচনা করলেন। কলেজের ইংরেজি বিভাগকে উন্নত ও সুনিয়ন্ত্রিত করতে সমর্থ হলেন এবং ইংরেজিকে অবশ্যপাঠ্য বিষয়রূপে প্রবর্তন করলেন। সংস্কৃত কলেজের সরকার-নিযুক্ত পরিদর্শক ডক্টর ব্যালান্টাইনের সঙ্গে পাঠ্যবিষয় সম্পর্কে তাঁর যে-মতভেদ হয়, তার মধ্যেও বিদ্যাসাগরের শিক্ষাবিষয়ক চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায়। বার্কলের দর্শনকে বেদান্ত ও সাংখ্যদর্শনের মতোই ভ্রান্ত দর্শন বিবেচনা করে বিদ্যাসাগর বার্কলের গ্রন্থ পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করেন। তিনি দৃঢ়ভাবে একথাও ঘোষণা করেন যে, হিন্দু শাস্ত্র ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের মধ্যে অনেকক্ষেত্রেই বিরোধ আছে এবং এ-দুয়ের সমন্বয়-চেষ্টার সার্থকতা নেই। উপযুক্ত শিক্ষকের পক্ষে মাতৃভাষায় সম্পূর্ণ অধিকারের আবশ্যকতার উপর জোর দিয়ে বিদ্যাসাগর বাংলা স্কুল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন।
অব্যবহিত পরবর্তীকালে বাংলা স্কুল স্থাপন করা বিদ্যাসাগরের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ-বিষয়ে তিনি বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্ণর হ্যালিডের সক্রিয় আনুকূল্য লাভ করেছিলেন। হ্যালিডে তাঁকে দক্ষিণবঙ্গের স্কুলসমূহের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন এবং তাঁর প্রতি মডেল স্কুল স্থাপনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৮৫৫ সালের আগস্ট থেকে পরবর্তী ছ মাসের মধ্যে নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলার প্রত্যেকটিতে পাঁচটি করে মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যাসাগর। প্রথমে সংস্কৃত কলেজই বাংলা শিক্ষকদের জন্যে নর্মাল স্কুলের ভূমিকা গ্রহণ করে; পরে বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় সংস্কৃত কলেজ ভবনেই স্বতন্ত্র নর্মাল স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয় এবং অক্ষয়কুমার দত্ত তার প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন।
একালেই বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ-আন্দোলনের এবং পরে বহুবিবাহ-সম্পর্কিত আন্দোলনের সূচনা করেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারেও ব্রতী হন। একাজে প্রথমে স্বনামধন্য বিটন তাঁর সহায় ছিলেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যখন দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয়সমূহের স্পেশাল ইন্সপেক্টর, তখন হ্যালিডে তাঁকে এ-বিষয়ে আরো উৎসাহিত করে তোলেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর থেকে পরবর্তী সাত মাসের মধ্যে বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর ও নদিয়ায় তিনি ৩৫টি বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপন করেন; এর মধ্যে বীরসিংহ গ্রামেও একটি বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে ভারত সরকারের কাছ থেকে নানা বাধা আসে। অনেকে বলেন, সেই কারণেই নাকি ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতা ও অন্যান্য সরকারি পদ থেকে তিনি সম্পূর্ণ অবসর গ্রহণ করেন। দু বছর পর বোর্ড অফ একজামিনার্স থেকেও তিনি পদত্যাগ করেন। কেউ কেউ বলেন, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তা তাঁকে হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ সাট্ক্লিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যে বারবার চাপ দিলে তিনি পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। তবে এর পরেও সংস্কৃত কলেজ এবং জনশিক্ষা-বিস্তারের বিষয়ে সরকারের একজন বেসরকারি উপদেষ্টা ছিলেন তিনি, পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন সমিতিরও সদস্য ছিলেন।
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী সভার সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেছিলেন। পর বছর সভা ভেঙে গেলে তিনি সেই পদ ত্যাগ করেন। সরকারি কর্ম ত্যাগের পর বিদ্যাসাগরের উল্লেখযোগ্য কীর্তি হিন্দু মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন স্থাপন। এ স্কুলের সূচনা হয়েছিল ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে, ভিন্ন নাম দিয়ে। ১৮৬১তে বিদ্যাসাগরকে সম্পাদক করে স্কুল-পরিচালনার জন্যে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ১৮৬৪-তে এই নতুন নামকরণ হয়। তাঁর পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত উন্নতিলাভ করে এবং ১৮৭২-এ এফ. এ. পড়াবার ও ১৮৭৯তে বি. এ. পড়াবার অনুমতি পায়। দেশীয় পরিচালনায় এই ছিল প্রথম কলেজ। বিদ্যাসাগরের সক্রিয়তার ফলে এই ইনস্টিটিউশন একটি প্রথম শ্রেণির শিক্ষাকেন্দ্রের মর্যাদালাভ করে। হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ডের সৃষ্টিও বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে বীরসিংহে তিনি মায়ের নামে একটি স্কুল স্থাপন করেন।
বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো (১৮৫৬) এবং রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য (১৮৬৪) নির্বাচিত হন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্ণর স্যার রিচার্ড টেম্পল বিধবাবিবাহ আন্দোলনের নেতা হিসাবে তাঁকে এক বিশেষ সম্মানলিপি প্রদান করেন। ১৮৮০-তে ভারত সরকার তাঁকে সি.আই. ই. উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে এক দুর্ঘটনায় বিদ্যাসাগর যকৃতে গুরুতর আঘাত পান। এর পরে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। ১৮৭১-এ তিনি মাকে হারান, ১৮৭৬-এ বাবাকে, ১৮৮৮-তে স্ত্রীকে। পুত্র নারায়ণ এর বহু আগে থেকেই—বিদ্যাসাগরের ভাষায়—‘যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী’ হয়ে পড়েন; ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর যে-উইল করেন, তাতে তিনি পুত্রকে বঞ্চিত করেছিলেন। মোটকথা, ব্যক্তিগত দিক দিয়ে শেষ জীবন তাঁর সুখের হয়নি। ১৮৯১-এর গোড়া থেকে তিনি নানারকম রোগভোগ করতে থাকেন; নানারকম চিকিৎসাও চলতে থাকে। সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ২৯শে জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর মৃত্যুতে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছিলেন :
তাঁহার সহস্র সদ্গুণের মধ্যে তাঁহার ওজস্বিতা এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞতাই সর্ব্বপ্রধান গুণ। যেটি কর্ত্তব্য সেটি অনুষ্ঠান করিব; যেটি অনুষ্ঠান করিব, সেটি সাধন করিব, এই ঈশ্বরচন্দ্রের হৃদয়ের সংকল্প। সমস্ত সমাজ যদি বাধা দিবার চেষ্টা করে, সিংহবীর্য্য ঈশ্বরচন্দ্র সে সমাজব্যূহ ভেদ করিয়া তাঁহার অলঙ্ঘনীয় সংকল্প সাধন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র আজি আমাদের এই পরম শিক্ষা দান করিতেছেন, এই শিক্ষা যদি আমরা লাভ করিতে পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হস্তে, পরের হস্তে নহে।
২. বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ
যে-কৌলিক সংকীর্ণতার পরিবেশে ঈশ্বরচন্দ্র জন্মেছিলেন, তার বিরুদ্ধেই তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন। এ-বিদ্রোহ তীব্র হলেও আকস্মিক নয়। বিনয় ঘোষ সংগতভাবেই নির্দেশ করেছেন যে, প্রথম স্তরে রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলন এবং দ্বিতীয় স্তরে ইয়ং বেঙ্গল দলের বিদ্রোহ পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবকে যেন অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। রামমোহনের সতীদাহ-নিবারণ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল দল। বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন, তখন এ-নিয়ে বাদানুবাদ চলছে। ছ মাস পর সতীদাহ আইনত নিষিদ্ধ হয় (ডিসেম্বর ১৮২৯)। বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজের ছাত্র, তখন ইয়ং বেঙ্গলদের মুখপত্র এনকোয়ারার (১৮৩১-৩৫) ও জ্ঞানান্বেষণ (১৮৩১-৪৪) প্রকাশিত হতে থাকে। এ-দুটি পত্রিকায় বহুবিবাহ ও কুলীনপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করা হয়; আট থেকে বাষট্টিবার দারপরিগ্রহ করেছেন, এমন কুলীনদের একটি তালিকাও তাঁরা প্রকাশ করেন।* বিধবাবিবাহের পক্ষেও এ-পত্রিকা দুটিতে আন্দোলন করা হয়। হিন্দু কলেজের এই বিদ্রোহীদের কর্মক্ষেত্র আর বিদ্যাসাগরের শিক্ষাক্ষেত্র ছিল একই ভবনে। এ-আন্দোলন বিদ্যাসাগরের মনে রেখাপাত করেছিল নিশ্চয়।
১৮৫০ সালে যে-সর্ব্বশুভকরী পত্রিকায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ কীর্তন করে সমাজ বিষয়ে রচনাধারার শুরু করেন বিদ্যাসাগর, সে-পত্রিকাও প্রকাশ পেয়েছিল হিন্দু কলেজের উদারপন্থী ছাত্রদের প্রচেষ্টায়। বিদ্যাসাগরের প্রবন্ধ ছাড়াও এই পত্রিকায় মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্ত্রী-শিক্ষাবিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন। তারপর বিদ্যাসাগরের সহোদর দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও সংস্কৃত কলেজের ছাত্র মাধবচন্দ্র গোস্বামী চৈত্রসংক্রান্তির সময়ে জিহ্বা বিদ্ধ করা ও মৃত্যুর পূর্বে গঙ্গায় অন্তর্জলি করা—এইসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সর্ব্বশুভকরীতে রচনা প্রকাশ করেন।
বিদ্যাসাগরের এই ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এ-প্রবন্ধ রচনা করেন; এর আবেদন শাস্ত্রজ্ঞানীর কাছে নয়, মানুষের বুদ্ধি ও অনুভবশক্তির কাছে। শাস্ত্রনিরপেক্ষ এই মানববাদই বিদ্যাসাগরকে হিউম্যানিস্ট পণ্ডিতের মর্যাদা দিয়েছে।
কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য্যরে কথা মানলে বলতে হয়, বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন। ধর্মবিষয়ে তাঁর যে তেমন উৎসাহ ছিল না, সেকথা তাঁর সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন স্পষ্টই জানিয়েছেন। শম্ভুচন্দ্রের উল্লিখিত আরেকটি ঘটনাও প্রমাণ করে যে, প্রচলিত অর্থে বিদ্যাসাগর ধার্মিক ছিলেন না। কাশীর ব্রাহ্মণদেরকে প্রচুর অর্থদানে বিদ্যাসাগর অসম্মতি জানালে তাঁরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি তবে কাশীর বিশ্বেশ্বর মানেন না ?’ বিদ্যাসাগর উত্তর করেন, ‘আমি তোমাদের কাশী বা তোমাদের বিশ্বেশ্বর মানি না।’ ‘আপনি তবে কি মানেন ?’—এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা উপস্থিত এই পিতৃদেব ও জননীদেবী বিরাজমান।’ এই হলো বিদ্যাসাগরের মানবমুখীনতার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। এই মানববাদ তিনি যুগের আবহাওয়া থেকে পেয়েছিলেন কিছুটা, কিছুটা পেয়েছিলেন পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে, বাকিটা তাঁর সহজাত মানবপ্রীতি থেকে জন্মেছিল, যে-মানবপ্রীতির অন্যবিধ প্রকাশে তিনি ‘দয়ার সাগর’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
বলা হয়ে থাকে যে, ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেবীর উৎসাহে বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ-আন্দোলনের সূচনা করেন; কেউ বলেছেন, একটি বিধবা বালিকার ক্রন্দনধ্বনিতে বিচলিত হয়ে তিনি এই সংগ্রামে প্রবৃত্ত হন। বহুবিবাহনিরোধ-আন্দোলন সম্পর্কেও এ-জাতীয় প্রসিদ্ধি আছে। মানবপ্রীতি এবং নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর স্বভাবজ ছিল; আর ছিল অমিত চরিত্রবল। রামমোহন যে-পথে অগ্রসর হয়েছিলেন, সেই পথের সীমায় পৌঁছোবার প্রেরণা তাই তাঁর অন্তরেই তিনি অনুভব করেছিলেন। রামমোহনের মতো তিনি ধর্মবিষয়ক প্রশ্নে ব্যাকুল হননি, তাই বলা যায়, রামমোহনের চেয়ে নবযুগের আদর্শ তাঁর মধ্যেই অধিকতর প্রতিফলিত হয়েছিল।
এ-সত্ত্বেও বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা ও বহুবিবাহের অশাস্ত্রীয়তা প্রমাণে তিনি যে অক্লান্ত চেষ্টা করেছিলেন, তার কারণ, যে-জনসমাজের কাছে তাঁর আবেদন, তারা শাস্ত্রনির্দেশের কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। শাস্ত্রবচনের উদ্ধৃতি তাঁর নিজের জন্যে আবশ্যক ছিল না; কিন্তু নবযুগের বৈশিষ্ট্যও এই যে, শাস্ত্রকে অবলম্বন করেই রক্ষণশীলতার দুর্গে আঘাত করতে হয়। তাঁর সংস্কৃত ভাষা ও শাস্ত্রচর্চা এবং ধর্মসমালোচনা তাঁর মানববাদেরই পরিপোষক অস্ত্র ছিল।
এ-বিষয়ে বিদ্যাসাগরের সচেতনতার পরিচয় বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব পুস্তকের (তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশ : ফাল্গুন ১৭৭৬ শকাব্দ; পুস্তকাকারে জানুয়ারি ১৮৫৫) সূচনায় পাওয়া যাবে :
বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না, এ বিষয়ের বিচারে প্রবৃত্ত হইতে হইলে, সর্ব্বাগ্রে এই বিবেচনা করা অত্যাবশ্যক যে এদেশে বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত নাই; সুতরাং বিবাহ দিতে হইলে এক নূতন প্রথা প্রবর্ত্তিত করিতে হইবেক। কিন্তু, বিধবাবিবাহ যদি কর্ত্তব্য কর্ম্ম না হয়, তাহা হইলে কোনও ক্রমে প্রবর্ত্তিত ও প্রচলিত হওয়া উচিত নহে। কারণ, কোন ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি অকর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইবেন ? অতএব, বিধবাবিবাহ কর্ত্তব্য কর্ম্ম কি না, অগ্রে ইহার মীমাংসা করা অতি আবশ্যক। যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এতদ্দেশীয় লোকে কখনই ইহাকে কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন। এরূপ বিষয়ে এ দেশে শাস্ত্রই সর্ব্বপ্রধান প্রমাণ, এবং শাস্ত্রসম্মত কর্ম্মই সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। অতএব, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত অথবা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কর্ম্ম, ইহার মীমাংসা করাই সর্বাগ্রে আবশ্যক।
শাস্ত্রবচনের আশ্রয় তাঁকে কেন নিতে হয়েছিল, সে-বিষয়ে আর সংশয় থাকে না।
বিদ্যাসাগরের পুস্তকপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই সারা দেশব্যাপী তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বহু পণ্ডিত শাস্ত্রীয় বিচারে প্রবৃত্ত হন। এরকম একুশ জন পণ্ডিতের যুক্তি খণ্ডন করে বিদ্যাসাগর তাঁর বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষরক প্রস্তাব। দ্বিতীয় পুস্তক (অক্টোবর ১৮৫৫) প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় পুস্তকটি কলেবরের দিক দিয়ে প্রথম পুস্তকের আটগুণ।
অবশ্য শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করেই তিনি ক্ষান্ত হন নি, শাস্ত্রনিরপেক্ষ আইনপ্রণয়নের চেষ্টায় তাঁর ক্লান্তি ছিল না। মানববাদী ভাবধারা থেকেই বিদ্যাসাগর রাষ্ট্রীয় বিধিরচনার আবশ্যকতা অনুভব করেছিলেন। তিনি জানতেন, বিশেষ বিশেষ শাস্ত্রবচনে আস্থাজ্ঞাপন ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়; অধিকন্তু দেশাচার শাস্ত্রাচারের বিরুদ্ধে। আইনের ক্ষমতা আরো বেশি, তার বিস্তার আরো ব্যাপক। তাই আইন-প্রণয়নের আন্দোলন। আর এই উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরসংগ্রহ অভিযান চালিয়ে আধুনিক সমাজসংগ্রামের আরেকটি অস্ত্রব্যবহারের শিক্ষাও তিনি দিয়েছিলেন।
স্বাক্ষর-সংগ্রহ অভিযানে অবশ্য প্রতিপক্ষের শক্তি প্রবলতররূপে দেখা দিয়েছিল। বিধবাবিবাহের সপক্ষে বিদ্যাসাগর এক হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ একটি আবেদনপত্র পাঠান সরকারের কাছে। এই মর্মে প্রেরিত অন্য কয়েকটি আবেদনপত্রে আরো চার হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর ছিল।* বিধবাবিবাহ প্রচলনের বিরুদ্ধে রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৭ হাজার স্বাক্ষরকারীসহ মোট পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার ব্যক্তি পাল্টা আবেদন পাঠিয়েছিলেন। এ-সত্ত্বেও ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়ে গেল। ওই বছর ডিসেম্বরেই মহাসমারোহে প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। পাত্র সংস্কৃত কলেজের এককালীন অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন; পাত্রী পটলডাঙ্গার ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দশ বছর বয়স্কা কন্যা কালীমতী দেবী। বিবাহ-অনুষ্ঠানে বিদ্যাসাগর উপস্থিত ছিলেন এবং এর জন্যে বহু অর্থও ব্যয় করেছিলেন। পরবর্তীকালেও বিধবাবিবাহের ব্যয়নির্বাহে তিনি কার্পণ্য করেননি, ফলে শেষ পর্যন্ত মারাত্মক ঋণভারে জড়িয়ে পড়েন। যাঁরা বিধবাবিবাহ করতেন, তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়ে যাতে সরকারি আনুকূল্য লাভ করা যায়, সে চেষ্টাও তাঁকে করতে হতো।** অন্যদিকে তাঁর প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং কিছুকাল পথে চলার সময়ে সঙ্গে একজন লাঠিয়াল রাখতে হয়েছিল।
কিন্তু এসব প্রতিকূলতা তিনি গ্রাহ্য করেননি। তাঁর একমাত্র পুত্র নারায়ণ বিধবাবিবাহ করতে উদ্যোগী হলে, তাঁর আত্মীয়েরা সম্পর্ক ছেদের ভয় দেখিয়েছিলেন। শম্ভুচন্দ্রের পত্রে এ-কথা জানতে পেরে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন :
আমি বিধবাবিবাহের প্রবর্ত্তক; আমরা উদ্যোগ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছি, এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবাবিবাহ না করিয়া কুমারীবিবাহ করিলে, আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিতাম না। ভদ্রসমাজে নিতান্ত হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইতাম। নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া, আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে এবং লোকের নিকট আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে, তাহার পথ করিয়াছে। বিধবাবিবাহ-প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম। এ জন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনো সৎকর্ম্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই। এ বিষয়ের জন্য সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙমুখ নহি। সে বিবেচনায় কুটুম্ববিচ্ছেদ অতি সামান্য কথা। … আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক হইবে, তাহা করিব; লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না।
বিদ্যাসাগরের কাছে বিধবাবিবাহ-আন্দোলনের গুরুত্ব কত অধিক ছিল, এই পত্রই তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ।
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দেই বহুবিবাহ রহিত করার দাবিতে ভারত সরকারের কাছে প্রেরিত এক লিপিতে বিদ্যাসাগর স্বাক্ষরদান করেছিলেন। তাঁদের আবেদন যে গৃহীত হবে, এ রকম প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গিয়েছিল; কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহের ফলে সরকার আর সামাজিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে সাহসী হননি। বহুবিবাহ-সম্পর্কিত প্রকৃত অবস্থা অনুসন্ধানের জন্যে সরকার ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যাসাগরসহ পাঁচ ব্যক্তির এক তদন্ত কমিটি নিযুক্ত করেন। সদস্যদের মধ্যে শুধু বিদ্যাসাগরই এ-ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলেন। হয়তো তাই এরপর সরকার এ-বিষয়ে আর কোনো উদ্যোগ করেন নি। কেবল পত্র-পত্রিকায় বহুবিবাহের শাস্ত্রীয়তা এবং এ-বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপের সারবত্তা সম্পর্কে নানারকম মতামত প্রকাশিত হতে থাকে।
এই পরিবেশে বিদ্যাসাগর তাঁর বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার প্রকাশ করেন (আগস্ট ১৮৭১)। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেছেন : ‘অধুনা এ দেশের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে রাজশাসন ব্যতিরেকে, ঈদৃশ দেশব্যাপক দোষ নিবারণের উপায়ান্তর নাই।’ তবু দেশের মানুষের কাছে এর অশাস্ত্রীয়তা প্রতিপন্ন করার প্রয়োজন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। শাস্ত্রঘটিত আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে বহুবিবাহ সম্পর্কে যে বাস্তব জরিপকার্যের পরিচয় তিনি এতে তুলে ধরেছেন, তা যেমন অভিনব, তেমনি তাঁর বক্তব্যের পক্ষে কার্যকর। বিতর্কের ঝড় উঠলে বিদ্যাসাগর রচনা করেন বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার। দ্বিতীয় পুস্তক (এপ্রিল ১৮৭৩)। আকারে প্রথম পুস্তকের দ্বিগুণ; বহুবিবাহ সমর্থনকারীদের মত এতে তিনি খণ্ডন করেছেন।
প্রতিপক্ষেরা এখানেই ক্ষান্ত হননি। বিদ্যাসাগর তখন বেনামিতে পাঁচটি পুস্তিকা প্রণয়ন করে প্রতিবাদীদের জবাব দেন। পুস্তিকাগুলি হলো : অতি অল্প হইল (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), ব্রজবিলাস (১৮৮৪), বিধবাবিবাহ ও যশোহর ধর্ম্মরক্ষিণী সভা (১৮৮৪) এবং রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬)। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য্য ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এগুলোকে বিদ্যাসাগরের রচনা বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন; অভ্যন্তরীণ প্রমাণও আছে। রঙ্গব্যঙ্গ-রচনায় বিদ্যাসাগরের নৈপুণ্য এ-বইগুলিতে যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে, সে-সম্পর্কে কৃষ্ণকমলের মন্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘এরূপ উচ্চ অঙ্গের রসিকতা বাঙ্গালা ভাষায় অতি অল্পই আছে, এবং ইহার গুণগ্রাহী পাঠকও বেশী নাই।’
বহুবিবাহ নিবারণ করে সরকারি বিধি শেষ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। তবে বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের ফলে কৌলীন্যপ্রথা ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে জনসমাজে সচেতন মতামত গড়ে উঠেছিল। সেদিক দিয়ে তাঁর প্রচেষ্টা নিরর্থক হয়নি।
এর পরে তিনি আর কোনো গুরুতর সামাজিক সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেননি। এমনকি, পরবর্তী দশ বছরে কোনো গ্রন্থও প্রকাশ করেননি। প্রধানত শিক্ষাবিস্তার এবং মানবকল্যাণমূলক কাজেই ব্যাপৃত ছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁকে আবার একটি গুরুতর সামাজিক প্রসঙ্গে মতামত ব্যক্ত করতে হয়। সহবাস-সম্মতি আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা দেখা দিলে বিদ্যাসাগর সরকারকে জানিয়েছিলেন :‘I should like the measure to be so framed as to give something like adequate protection to child wives without in any way conflicting with any religious usage.’ ওই পত্রের মধ্যে ‘শাস্ত্রসম্মত ধর্মাচারের সঙ্গে যাতে বিরোধ না হয়’ এ-ধরনের উক্তি একাধিকবার আছে। অথচ বাল্যবিবাহ সম্পর্কে এর চল্লিশ বছর আগে বিদ্যাসাগর দৃঢ় মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। শেষ জীবনে তাঁর এই ভূমিকা সম্পর্কে বিনয় ঘোষ সংগতভাবেই মন্তব্য করেছেন যে, ‘মনে হয়, প্রাচীন শাস্ত্রীয় ঐতিহ্য এবং নতুন সামাজিক কর্তব্য এই দুয়ের সমন্বয়-স্থাপনের দুরূহ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, সবসময় তিনি সমতা বজায় রাখতে পারেন নি।’
বিদ্যাসাগরের সামাজিক ভূমিকার আরেকটি সীমাবদ্ধতা কেউ কেউ এই বলে নির্দেশ করে থাকেন যে, বাঙালি হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেই তাঁর সকল সংস্কারপ্রচেষ্টা সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি যে-কালের মানুষ এবং তিনি যে-ধরনের সংস্কারপ্রয়াসী ছিলেন, তাতে অন্য সম্প্রদায়ের হয়ে কিছু বলবার অধিকার তাঁর ছিল না। যা অকল্যাণকর, তা সকলের জন্যেই অকল্যাণকর। কিন্তু সকলের জন্যে সংস্কার প্রার্থনা করতে গেলে তাঁকে অন্যের সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হতো। বহুবিবাহ পুস্তকের ‘সপ্তম আপত্তি’ অধ্যায়ে বিদ্যাসাগর যা বলেছেন, তাতে একথা স্পষ্ট যে, বাঙালি মুসলমান বা ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের হিন্দুর স্বাতন্ত্র্যকে তিনি লঙ্ঘনীয় বিবেচনা করেননি।
কিন্তু বাঙালি হিন্দু সমাজের জন্যে বিদ্যাসাগর নবযুগের আলোকবর্তিকা নিয়ে এসেছিলেন; ক্লাসিকাল ভাষা ও শাস্ত্রচর্চা এবং ধর্মসমালোচনার মাধ্যমে মানববাদী চিন্তার পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। শাস্ত্রীয় বিতর্কে মাতৃভাষার ব্যবহার এবং যুক্তিতর্কের বাহন গদ্যরীতির আশ্রয়গ্রহণ—এও সেই মানববাদী চিন্তাধারার অপরিহার্য রূপ।
৩. বিদ্যাসাগর ও বাংলা গদ্য
ধর্মমতের প্রচার ও সমাজসংস্কারের প্রয়াস বাংলা গদ্যকে একটা নির্দিষ্ট রূপ দিতে সাহায্য করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের বাংলা গদ্যগ্রন্থের দিকে তাকালে কথাটা বোঝা যায়। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাত্রদের জন্যে পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রয়াস থেকে বাংলা গদ্যের তিনটি রীতির সূচনা হয়—কথ্য, সাধু আর সংস্কৃতানুসারী। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার এর মধ্যে অনেকখানি সাহিত্যরস সঞ্চার করতে পেরেছিলেন, রামমোহন এনেছিলেন কিছুটা প্রাঞ্জলতা। বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী বাংলা গদ্য ব্যবহারোপযোগী হওয়া সত্ত্বেও দূরান্বয়, ছেদচিহ্নের অল্পতা, বাক্যের ভারসাম্যহীনতা ও সংযোজন অব্যয়ের সাহায্যে বিরুদ্ধ ভাবের একাধিক বাক্যের সংযোজন সে-গদ্যরীতিকে রসহীন করে রেখেছিল।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাত্রদের ব্যবহারের জন্যেই বিদ্যাসাগর বাংলা রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম বই বাসুদেব-চরিত কলেজ-কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করেনি বলে প্রকাশিত হতে পারেনি। কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত গ্রন্থ বেতালপঞ্চবিংশতি ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হলে বাংলা গদ্যের নতুন যুগের সূচনা হলো।
গদ্যের অন্তর্নিহিত ছন্দকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বলে বিদ্যাসাগরের পক্ষে সুষম বাক্যগঠনরীতি প্রবর্তন করা সম্ভব হয়েছিল। বাক্যাংশের অর্থজ্ঞাপকতা অনুযায়ী ছেদচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার করে গদ্যের এই তালকেই তিনি পরিস্ফুট করতে চেয়েছিলেন। বাক্যগঠনরীতির সুষমা তাঁর রচনাকে লালিত্য ও নমনীয়তা দান করে। তাই বিদ্যাসাগরই সর্বপ্রথম ‘সুশ্রব্য, সরস, ছন্দোময় অথচ গাম্ভীর্যপূর্ণ’ রচনা আমাদেরকে উপহার দিতে পারলেন।
বিদ্যাসাগরের গদ্যের ধ্বনিময়তা ও ছন্দোস্রোতের উদাহরণ বেতাল পঞ্চবিংশতি থেকে নেওয়া যেতে পারে :
বারাণসী নগরীতে, প্রতাপমুকুট নামে, এক প্রবলপ্রতাপ নরপতি ছিলেন। তাঁহার মহাদেবী নামে প্রেয়সী মহিষী ও বজ্রমুকুট নামে হৃদয়নন্দন নন্দন ছিল। এক দিন রাজকুমার, এক মাত্র অমাত্য-পুত্রকে সমভিব্যাহারে লইয়া, মৃগয়ায় গমন করিলেন। তিনি, নানা বনে ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে এক নিবিড় অরণ্যে প্রবেশ পূর্ব্বক, ওই অরণ্যের মধ্যবর্ত্তী অতি মনোহর সরোবর সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন ওই সরোবরের নির্ম্মল সলিলে হংস, বক, চক্রবাক, প্রভৃতি নানাবিধ জলচর বিহঙ্গমগণ কেলি করিতেছে; তীরস্থিত তরুগণ অভিনব পল্লব, ফল, কুসুম সমূহে সুশোভিত রহিয়াছে; উহাদের ছায়া অতি স্নিগ্ধ; বিশেষতঃ শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের মন্দ মন্দ সঞ্চার দ্বারা, পরম রমণীয় হইয়া আছে; তথায় উপস্থিত মাত্র, শ্রান্ত ও আতপক্লান্ত ব্যক্তির শ্রান্তি ও ক্লান্তি দূর হয়।
বাক্যের অংশগুলোকে এখানে সমান মাপে ভাগ করা যায়, অনুপ্রাসের আধিক্য অসতর্ক পাঠকের কাছেও ধরা পড়ে, ভাষার নমনীয়তা ও মাধুর্য শ্রুতি এড়ায় না।
গদ্যরীতি সম্পর্কে বিদ্যাসাগর পূর্ববর্তী লেখকদের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন ছিলেন। বিভিন্ন সংস্করণে একই গ্রন্থে তিনি যেসব পরিবর্তন সাধন করেছেন, তা এই সচেতনতার পরিচয় বহন করে। বেতাল পঞ্চবিংশতির বিভিন্ন সংস্করণে সাধিত পরিবর্তন সম্পর্কে সুকুমার সেন যে-মন্তব্য করেছেন, তা বিদ্যাসাগরের সমগ্র রচনা সম্পর্কেও প্রযোজ্য : ‘পরবর্তী সংস্করণে বেতাল পঞ্চবিংশতির ভাষা সরলতরও হয় নাই কঠিনতরও হয় নাই, হইয়াছে সুললিততর।’ এই সচেতনতার ফলেই বিদ্যাসাগরের রচনায় তাঁর ব্যক্তিত্বের ছাপও পড়েছে স্পষ্টভাবে।
বেতাল পঞ্চবিংশতি থেকে বিদ্যাসাগরের গদ্য দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। একটি ধারা শকুন্তলা হয়ে ভ্রান্তিবিলাস ও বিদ্যাসাগরচরিতের মধ্য দিয়ে বেনামি রচনায় এসে পৌঁছেছে। অন্যটি মহাভারতের অনুবাদের মাধ্যমে সীতার বনবাস ও রামের রাজ্যাভিষেকে রূপ নিয়েছে। বিদ্যাসাগরী গদ্যরীতি বলতে মূলত এই শেষ ধারাটি বোঝানো হয়ে থাকে, মনোমোহন ঘোষ যার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
সংস্কৃত ভাষার নিজস্ব অলঙ্কারকে বাংলার উপযোগী করার চেষ্টা থেকেই বিদ্যাসাগরের রীতি মুখ্যত তার অনিবার্য রূপটি পেয়েছে। এই রূপটির এক লক্ষণ হচ্ছে, খাঁটি বাংলা (প্রাকৃতমূলক বা তদ্ভব) এবং বিদেশি ভাষা থেকে পরিগৃহীত শব্দের আপেক্ষিক অল্পতা, অন্য লক্ষণ হচ্ছে স্থানবিশেষে সমাসবদ্ধ পদের সুপ্রচুর ব্যবহার; কতিপয় স্থানে সংস্কৃতসুলভ পদ এবং বাগ্বিন্যাসও তার সঙ্গে দেখা দিয়েছে।
বাংলা একাডেমির জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, সীতার বনবাসে শতকরা ৯১.৭ ভাগ তৎসম শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে; তদ্ভব শব্দের ভাগ শতকরা ৮.২ এবং দেশি শব্দের ভাগ ০.১। বিদ্যাসাগরের রচনায় তৎসম শব্দবাহুল্যের কথাটা এর থেকে প্রমাণিত হয়। কিন্তু এতেই সবটা বলা হয় না। এই প্রসঙ্গে সুকুমার সেন যা বলেছেন, তা এখানে উদ্ধৃতিযোগ্য :
বাঙ্গালা সাধুভাষায় ব্যবহৃত শব্দ অধিকাংশই তৎসম (সংস্কৃত) শব্দ। সুতরাং বিদ্যাসাগরের লেখায় সংস্কৃত শব্দের আধিক্য থাকিবারই কথা। কিন্তু আভিধানিক শব্দের ব্যবহার তাহাতে নাই বলিলেই হয়। শুধু বেতাল পঞ্চবিংশতির প্রথম সংস্করণে (এবং কিছু কিছু পরবর্তী সংস্করণেও) কয়েকটিমাত্র অপরিচিত তৎসম শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন—আস্যদেশ, বারযোষিৎ, প্রাড়িবাক, উৎকলিকাকুল, পুংশ্চলী, তন্ত্রবাপ, ডিণ্ডিম, কাদাচিৎক, মলিম্লুচ, নিকাম ইত্যাদি।* বিদ্যাসাগর তদ্ভব ক্রিয়াপদের স্থলে প্রায়ই তৎসম ভাববচন সংবলিত যুক্ত ক্রিয়াপদ ব্যবহার করিয়াছেন বলিয়াই তাঁহার রচনা অতটা গুরুগম্ভীর ঠেকে। যেমন—গেলেন স্থলে “গমন করিলেন”, হরিয়াছে স্থলে “হরণ করিয়াছে”, আনিতে স্থলে “আনয়ন করিতে”। এইরূপ যুক্ত ক্রিয়াপদের ব্যবহারে ভাষা কিছু ভারী হইলেও বাক্যের ওজস্বিতা ও মাধুর্য যে বাড়িয়াছে তাহা স্বীকার্য। -ইয়া প্রত্যয়ান্ত অসমাপিকার পরিবর্তে “প্রযুক্ত”, “পূর্ব্বক”, “পুরঃসর”, “অন্তর” ইত্যাদি শব্দযুক্ত ভাববচনের অত্যধিক ব্যবহার সেকালের লেখায় ছিল, বিদ্যাসাগরের লেখায়ও আছে এবং বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতেও বিরল নয়।
তৎসম শব্দের অধিক প্রয়োগ আর ‘সুললিতভাবে সুদীর্ঘ সমাসের ব্যবহার’, এই দুইয়েরই নমুনা পাওয়া যাবে সীতার বনবাসের নিম্নোদ্ধৃত অংশ থেকে :
রাম বলিলেন, প্রিয়ে! এই সেই সকল গিরিতরঙ্গিণীতীরবর্ত্তী তপোবন; গৃহস্থগণ, বানপ্রস্থধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক সেই সেই তপোবনের তরুতলে কেমন বিশ্রামসুখসেবায় সময়াতিপাত করিতেছেন। লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্য! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্ত্তী প্রস্রবন গিরি। এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে, নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত; অধিত্যকা প্রদেশ ঘন সন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবল বেগে গমন করিতেছে।
শুধু যে অনুপ্রাসের সৃষ্টিতেই ভাষা এখানে মধুর হয়েছে, তা নয়। গদ্যের অন্তর্নিহিত ছন্দও সেই সঙ্গে পরিস্ফুট হয়েছে বলেই এ-রচনা এত প্রশংসনীয়।
পুনরুক্তিদোষ বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির একটি ত্রুটি বলে মনোমোহন ঘোষ নির্দেশ করেছেন। মনে হয়, এই মন্তব্যে কিছু অতিশয়োক্তি আছে। যে-সীতার বনবাস থেকে তিনি এই পুনরুক্তিদোষের উদাহরণ গ্রহণ করেছেন, সেই সীতার বনবাস (এবং অতি অল্প হইল)কে গণ্য করে বাংলা একাডেমির জরিপে বলা হয়েছে, ‘If less repitition of words be a proof of better artistry, Iswar Chandra Vidyasagar excelled all others in artistry.’ এক অর্থে একাধিক শব্দের ব্যবহার করে বিদ্যাসাগর যে একই শব্দের পুনরুক্তি পরিহার করতে চেষ্টা করেছেন, তার পরিচয় বেতাল পঞ্চবিংশতির প্রথম উপাখ্যানেই আছে। একটি অনুচ্ছেদে নৃপতি, মহারাজ, রাজা ও ভূপাল, বারবনিতা, বারনারী, বারযোষিৎ ও বারাঙ্গনা এবং তপস্বী, তাপস, যোগী ও সন্ন্যাসী শব্দের ব্যবহার উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। অনেক সময়ে সমার্থক বিভিন্ন শব্দ স্বতন্ত্র তাৎপর্যমণ্ডিত হয়েই প্রযুক্ত হয়েছে, শুধু পুনরুক্তি পরিহারের প্রয়োজনেই তা নির্বাচিত হয়নি।
ওজস্বিতা বিদ্যাসাগরের গদ্যের একটি বড় গুণ। বিধবাবিবাহ দ্বিতীয় পুস্তকের উপসংহার অংশ এর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।
বলা হয়েছে, বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতি একই কেন্দ্রবিন্দুতে স্থির ছিল না। সীতার বনবাস তাঁর সবচেয়ে গুরুভার রচনা। তদ্ভব শব্দ ও ক্রিয়াপদের ব্যবহার বেতাল পঞ্চবিংশতিতেও কখনো কখনো দেখা দিয়েছে। লালিত্য ও প্রাঞ্জলতার সমাবেশ শকুন্তলার বিশেষ গুণ। ভ্রান্তিবিলাসের রচনারীতি তাঁর আখ্যানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে লঘু : তদ্ভব শব্দ ও ক্রিয়াপদের প্রাচুর্য এখানে চোখে পড়বার মতো।
বেনামিতে লেখা বইগুলোয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রীতির পরিচয় পাই। তৎসম শব্দের প্রয়োগ অপেক্ষাকৃত কম, দেশি ও বিদেশি শব্দের ভিড় বেশি। বাংলা একাডেমির জরিপমতে, অতি অল্প হইল পুস্তিকায় শতকরা ৭২.৫ ভাগ তৎসম, ২৪.১ ভাগ তদ্ভব, ১.৩ ভাগ দেশি এবং ২.১ ভাগ বিদেশি (আরবি-ফারসি) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সেই সঙ্গে এই বইগুলিতে সাবলীলতা এনেছে তদ্ভব ক্রিয়াপদের ব্যবহার, সমাসবদ্ধ পদের যথাসম্ভব পরিবর্জন এবং কথ্য ভাষার ঢং। বিদ্যাসাগরী রীতির বিরুদ্ধে প্যারীচাঁদ বিদ্রোহ করেছিলেন; কিন্তু একথাও সত্য যে, প্রয়োজনবোধে প্যারীচাঁদী রীতির আশ্রয় নিয়ে বিদ্যাসাগর অধিকতর সচেতনতা ও স্বভাবজ শিল্পবোধের পরিচয় রেখে গেছেন।
বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য উদ্ধৃত করে এই প্রসঙ্গের উপসংহার করা যেতে পারে :
বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।….
বাংলা ভাষাকে পূর্বপ্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বর হইতে মুক্ত করিয়া, তাহার পদগুলির মধ্যে অংশযোজনার সুনিয়ম স্থাপন করিয়া, বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবলমাত্র সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন তাহা নহে, তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। গদ্যের পদগুলির মধ্যে একটা ধ্বনিসামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া, তাহার গতির মধ্যে একটি অনতিলক্ষ্য ছন্দঃস্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য এবং সরল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া, বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন। গ্রাম্য পাণ্ডিত্য এবং গ্রাম্য বর্বরতা, উভয়ের হস্ত হইতেই উদ্ধার করিয়া তিনি ইহাকে পৃথিবীর ভদ্রসভার উপযোগী আর্যভাষারূপে গঠিত করিয়া গিয়াছেন। তৎপূর্বে বাংলা গদ্যের যে অবস্থা ছিল তাহা আলোচনা করিয়া দেখিলে এই ভাষাগঠনে বিদ্যাসাগরের শিল্পপ্রতিভা ও সৃষ্টিক্ষমতার প্রচুর পরিচয় পাওয়া যায়।
৪. বিদ্যাসাগর ও বাংলা সাহিত্য
শুধু সৃষ্টিক্ষমতা নয়, সেই সঙ্গে তাঁর সহজাত শিল্পপ্রতিভার সংযোগ সাধিত হয়েছিল বলেই বিদ্যাসাগরের পক্ষে বাংলা গদ্যের শুধু সংস্কর্তা নয়, সার্থক শিল্পী হওয়া সম্ভবপর হয়েছিল। এ-সত্ত্বেও অনেকে বিদ্যাসাগরকে কেবল পাঠ্যপুস্তক-রচয়িতা ও অনুবাদক বলেই জ্ঞান করেন, তাঁকে সাহিত্যিক মর্যাদা দিতে চান না। বঙ্কিমচন্দ্র এই মতের একজন প্রধান সমর্থক ছিলেন।
পাঠ্যপুস্তক-রচনায় ও অনুবাদ-চর্চায় বিদ্যাসাগরের জীবনের অধিকাংশ কাল ব্যয় হয়েছে, একথা সত্য। নব্য শিক্ষার্থীদের জন্যে যেসব পাঠ্যবই বিদ্যাসাগর প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে আর কিছু না হোক, তাঁর উদ্ভাবনশক্তির পরিচয় আছে। গত শতাধিক বৎসরে বর্ণপরিচয়মূলক যত বই বাংলায় লেখা হয়েছে, তার মধ্যে কোনোটি বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়কে অতিক্রম করতে পারেনি; যোগীন্দ্রনাথের হাসিখুশী ছাড়া এই সঙ্গে নাম করা যায় এমন আর কোনো বইয়ের কথা মনে পড়ে না। ভাষার রহস্য আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশভঙ্গির একটা চিরত্ব অর্জন করতে পেরেছিলেন বলেই বর্ণপরিচয় লেখা সম্ভবপর হয়েছিল। এ বইয়ের প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান নিবেদন করতে গিয়ে জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :
সেদিন পড়িতেছি, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’। আমার জীবনে এইটেই আদি কবির প্রথম কবিতা। সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝিতে পারি, কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না—তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনো তাহার ঝংকারটা ফুরায় না, মিলটাকে লইয়া কানের সঙ্গে মনের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িতে ও পাতা নড়িতে লাগিল।
মৌলিক সাহিত্যরসজ্ঞতার পরিচয় ছিল বলেই এই বাক্য বালক রবীন্দ্রনাথের মনকে এতটা নাড়া দিতে পেরেছিল। তেমনি একথা বলা অসংগত নয় যে, বর্ণপরিচয়ের গোপাল ও রাখাল বাংলা সাহিত্যের শিশু-চরিত্রের মধ্যে মাথা উঁচু করে রাখে।
বিদ্যাসাগরের অনুবাদমূলক রচনার মধ্যে রসসৃষ্টির নৈপুণ্যে বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, সীতার বনবাস ও ভ্রান্তিবিলাস শ্রেষ্ঠ। বেতাল পঞ্চবিংশতি প্রকাশের পরই গদ্য আর গদ্যসাহিত্যের পার্থক্য পাঠকদের কাছে প্রতিভাত হয়েছিল। মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন যে, ‘সংস্কৃত সাহিত্যের অতিশয় পেলব ও মার্জিত, শুদ্ধ ও সংযত রসনৈপুণ্যের সঙ্গে আধুনিক মনোবৃত্তির অনুযায়ী যুক্তিনিষ্ঠা, পরিমাণ-বোধ ও স্বাভাবিকতা, এই দুইয়ের মিলন ঘটিয়াছে—এই রচনার ষ্টাইলে।’ এই সমন্বয়সাধন সৃষ্টিশীল লেখকের পক্ষেই সম্ভব। প্রেতলোকের বিবরণে পরলোকে উদাসীন লেখকের ব্যক্তিত্ব ছায়াপাত করেছে তির্যক হাস্যভঙ্গিমায়, এও এর স্মরণীয় বৈশিষ্ট্য।
শকুন্তলায় বিদ্যাসাগরের আদর্শ ছিল কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটক। মূলের সাতটি অঙ্ক এখানে সাতটি পরিচ্ছেদের রূপ নিয়েছে। মূল নাটকের ঘটনাক্রম ও সংলাপের ঘনিষ্ঠ অনুসরণ করেছেন বিদ্যাসাগর। সামান্য কয়েকটি জায়গায় কিছু বর্জন করেছেন, নিজের থেকে কিছু গ্রহণও করেছেন। অনুবাদ যেমন স্বচ্ছ ও রসবাহী, গ্রহণ-বর্জনে তেমনি অনুবাদকের শিল্পসচেতনতার প্রকাশ। অধ্যাপক পি. লাল-কৃত আধুনিক ইংরেজি অনুবাদ-অবলম্বনে তার কিছু পরিচয় দেওয়া যেতে পারে।
প্রথম অঙ্কে দুষ্মন্তকে দেখে অনুরক্ত শকুন্তলা মূলে স্বগতোক্তি করেছিলেন, ‘Why is there such a feeling in my heart ? He is our guest. And I certainly mustn’t lose my head is an ashrama’. একটু পরে প্রিয়ংবদা রাজার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে শকুন্তলা আবার স্বগতোক্তি করেছেন,‘I must keep calm, She takes the words out of my mouth’. বিদ্যাসাগরের রচনায় ‘শকুন্তলা মনে মনে কহিতে লাগিলেন, কেন, এই অপরিচিত ব্যক্তিকে নয়নগোচর করিয়া, আমার মনে তপোবনবিরুদ্ধ ভাবের উদয় হইতেছে ? এই বলিয়া তিনি, তাঁহার নাম, ধাম, জাতি, ব্যবসায়াদির বিষয় সবিশেষ অবগত হইবার নিমিত্ত, নিতান্ত উৎসুকা হইলেন।’ ‘তপোবনবিরুদ্ধ ভাব’ কথাটির মধ্যে শকুন্তলার লজ্জাজনিত আবেগের সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি আছে। মূলে দুষ্মন্তের পরিচয় সম্পর্কে শকুন্তলার ঔৎসুক্য ব্যক্ত করা হয়নি; প্রিয়ংবদার প্রশ্নের পর শকুন্তলার স্বগতোক্তির সূত্র থেকে বিদ্যাসাগর তা নির্মাণ করেছেন। আখ্যানে এর প্রয়োজন ছিল। প্রিয়ংবদার প্রশ্নের পর বিদ্যাসাগর বলছেন, ‘শকুন্তলা, শুনিয়া, মনকে প্রবোধ দিয়া কহিলেন, হৃদয়! এত উতলা হও কেন ? তুমি যে জন্যে ব্যাকুল হইতেছ, অনসূয়া সেই বিষয়ের জিজ্ঞাসা করিতেছে।’ মূলের এ-রূপান্তর অধিকতর শোভন হয়েছে।
দ্বিতীয়াঙ্কে শকুন্তলার প্রতি রাজার অনুরাগের কথা শুনে :
JESTER. Iaughing. You have the pick of the girls in the palace, sire. You lose your head over trifles.
KING. You haven’t seen her.
JESTER. She must be ravishing indeed if she can attract you ?
KING. Words are poor things.
God made her as beautiful as a painting. She is flawless, created out of whatever is lovely, precious, and simple.
JESTER. The other girls had better brush up their charms!
KING I should think so.
She’s a virgin flower, a serene leaf,
An uncut diamond, untasted honey.
Whoever gets her is a lucky fellow.
JESTER. Get her yourself then, before some oilsmeared hermit takes her.
বিদ্যাসাগরে এই অংশের রূপান্তর এ-রকম :
মাধব্য শকুন্তলার প্রতি রাজার প্রগাঢ় অনুরাগ দেখিয়া, হাস্যমুখে কহিলেন, যেমন, পিণ্ডখর্জ্জুর ভক্ষণ করিয়া, রসনা মিষ্ট রসে অভিভূত হইলে, তিন্তিলীভক্ষণে স্পৃহা হয়; সেইরূপ, স্ত্রীরত্নভোগে পরিতৃপ্ত হইয়া, তুমি এই অভিলাষ কহিতেছ। রাজা কহিলেন, না বয়স্য! তুমি তাকে দেখ নাই, এই নিমিত্ত এরূপ করিতেছ। মাধব্য কহিলেন, তার সন্দেহ কি; যাহা তোমারও বিস্ময় জন্মাইয়াছে, সে বস্তু অবশ্যই রমণীয়। রাজা কহিলেন, বয়স্য! অধিক আর কি বলিব, তার শরীর মনে করিলে, মনে এই উদয় হয়, বুঝি বিধাতা, প্রথমতঃ চিত্রপটে চিত্রিত করিয়া, পরে জীবনদান করিয়াছেন; অথবা, মনে মনোমত উপকরণসামগ্রী সকল সঙ্কলিত করিয়া, মনে মনে অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলির যথাস্থানে বিন্যাস পূর্ব্বক, মনে মনেই তাহার শরীর নির্ম্মাণ করিয়াছেন; হস্ত দ্বারা নির্ম্মিত হইলে, শরীরের সেরূপ মার্দ্দব ও রূপলাবণ্যের সেরূপ মাধুরী সম্ভবিত না। ফলতঃ, ভাই রে, সে এক অভূতপূর্ব্ব স্ত্রীরত্নসৃষ্টি। মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! বুঝিলাম, শকুন্তলা যাবতীয় রূপবতীদিগের পরাভবস্থান। রাজা কহিলেন, তাহার রূপ অনাঘ্রাত প্রফুল্ল কুসুম স্বরূপ, নখাঘাতবর্জিত নব পল্লব স্বরূপ, অপরিহিত নূতন রত্ন স্বরূপ, অনাস্বাদিত অভিনব মধু স্বরূপ, জন্মান্তরীণ পুণ্যরাশির অখণ্ড ফল স্বরূপ; জানি না, কোন্ ভাগ্যবানের ভাগ্যে সেই নির্ম্মল রূপের ভোগ আছে।
রাজার মুখে শকুন্তলার এইরূপ বর্ণনা শুনিয়া, চমৎকৃত হইয়া, মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! তবে শীঘ্র তাহাকে হস্তগত কর; দেখিও, যেন, তোমার ভাবিতে, চিন্তিতে, এরূপ অসুলভরূপনিধান কন্যানিধান কোনও অসভ্য তপস্বীর হস্তে পতিত না হয়।
বাংলা উদ্ধৃতির সূচনায় যে-উপমাটি আছে, তা বিদ্যাসাগরের নিজের সংযোজন; মূলের ভাবকে অব্যাহত রেখে, আরো সংযম ও সরসতার সঙ্গে বলা হয়েছে। শকুন্তলার রূপবর্ণনামূলক অংশের প্রথমটিতে বাংলায় যে-বিস্তার ঘটেছে, তা হয়তো প্রয়োজনাতিরিক্ত; কিন্তু পরেরটিতে বিদ্যাসাগরের অনুবাদ-নৈপুণ্য সগৌরবে প্রকাশমান। এমন কি মাধব্যের শেষ বাক্যটির রূপান্তরও চমৎকার; oil-smeared hermit সেখানে অসভ্য তপস্বীতে পরিণত হয়েছেন।
এ-ধরনের নিদর্শন অনেক উদ্ধৃত করা যায়; বোধহয় তার আবশ্যকতা নেই। শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের মিলনদৃশ্যে বিদ্যাসাগর উভয়ের মুখে সংগতভাবেই কিছু বিস্তৃত সংলাপ দিয়েছেন। মূলে কশ্যপ যেখানে তিনটি বাক্য উচ্চারণ করেছেন, বিদ্যাসাগর সেখানে তাঁর মুখে দুর্বাসাবৃত্তান্ত নতুন করে বলিয়েছেন। এতে ঘটনার স্বাভাবিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলে রাজাই শেষ বাক্যগুলি উচ্চারণ করেছেন—প্রজার জন্যে কল্যাণ, জ্ঞানীর জন্যে সম্মান, এবং নিজের জন্যে পুনর্জন্মের বন্ধনমুক্তি প্রার্থনা করে। বাংলায় শেষ বাক্য গ্রন্থকারের; মর্ত্যজগতে পাত্রপাত্রীর সুখশান্তির ঘোষণায় তার সমাপ্তি। বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গির মানবিকতাও এখানে প্রতিফলিত।
সীতার বনবাসের ভূমিকায় বিদ্যাসাগর নিজেই বলেছেন যে, এর ‘প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের অধিকাংশ ভবভূতিপ্রণীত উত্তরচরিত নাটকের প্রথম অঙ্ক হইতে পরিগৃহীত; অবশিষ্ট পরিচ্ছেদসকল পুস্তকবিশেষ হইতে সঙ্কলিত নহে, রামায়ণের উত্তরকাণ্ড অবলম্বনপূর্বক সঙ্কলিত হইয়াছে।’ সেদিক দিয়ে একে স্বাধীন রচনা বললে ভুল হবে না। যেখানে তিনি ভবভূতির উত্তররামচরিতের অনুসরণ করেছেন, সেখানেও তাঁর অনুবাদ আক্ষরিক নয়। ‘এই সেই সকল গিরিতরঙ্গিণীতীরবর্ত্তী তপোবন’ ইত্যাদি অংশ মূলের ইংরেজি অনুবাদে এ-রকম :
RAMA. We are now among hospitable holy men whose ashramas stand by the side of mountain streams. They are shut off from the world, content with handfuls of wild rice.
LAKSHMANA. Here is the massive hill of Prasravana, ringed with wet clouds, whose torrents give…birth to the river Godavari—who rushes between blue forests, her lover.
বিদ্যাসাগরের অনুবাদ বিস্তৃত ও ওজস্বী, ধ্বনিময় ও আবেগপূর্ণ, ললিত ও প্রগাঢ়।
শকুন্তলায় মধুর রসের প্রাধান্য, সীতার বনবাসে করুণ রসের। শুধু যে এই দুই ভিন্নধর্মী রসকে আশ্রয় করে বিদ্যাসাগর সার্থক সাহিত্যসৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, তা নয়। হাস্যরসের প্রাধান্য স্বীকার করেও তাঁর রচনা অনুরূপ সার্থকতা লাভ করেছে ভ্রান্তিবিলাসে। এর মূল শেক্সপিয়রের The Comedy of Errors-এ। সংস্কৃতের পণ্ডিত যে শেক্সপিয়রের প্রতিভার স্বরূপ সম্পর্কে কত সচেতন ছিলেন, তার প্রমাণ পাই ভ্রান্তিবিলাসের ‘বিজ্ঞাপনে’ তাঁর উক্তিতে : ‘অনেকে বলেন, তিনি যে কেবল ইংল্যাণ্ডের অদ্বিতীয় কবি ছিলেন, এরূপ নহে; এ পর্যন্ত ভূমণ্ডলে যত কবি প্রাদুর্ভূত হইয়াছেন, কেহই তাঁহার সমকক্ষ নহেন। এই সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত বা পক্ষপাতবিবর্জ্জিত কি না, মাদৃশ ব্যক্তির তদ্বিচারে প্রবৃত্ত হওয়া নিরবচ্ছিন্ন প্রগলভতাপ্রদর্শন মাত্র।’
ভ্রান্তিবিলাসে বিদ্যাসাগর স্থান ও পাত্রপাত্রীর নামের পরিবর্তন সাধন করেছেন এবং কেন করেছেন, তার কৈফিয়তও দিয়েছেন। আখ্যান সংকলন করতে গিয়েও তিনি অনেকাংশে আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন; কোথাও কোথাও নিজের অভিরুচি-অনুযায়ী পরিবর্তন করেছেন। যেমন, প্রথম অঙ্ক দ্বিতীয় দৃশ্যে ইফিসাসবাসী ড্রোমিওর উক্তি :
Returned so soon! rather approach’d too late.
The capon burns, the pig falls from the spit;
The clock hath strucken twelve upon the bell—
My mistress made it one upon my cheek;
She is so hot because the meat is cold,
The meat is cold because you come not home,
You come not home because you have no stomach,
You have no stomach, having broke your fast;
But we, that know what it’s to fast and pray,
Are penitent for your default to-day.
ভ্রান্তিবিলাসে জয়স্থলবাসী কিঙ্কর বলছে :
এত সত্ত্বর আসিলে, কেমন; বরং এত বিলম্বে আসিলে কেন, বলুন। বেলা প্রায় দুই প্রহর হইল, আপনি এ পর্য্যন্ত গৃহে না যাওয়াতে কর্ত্রী ঠাকুরাণী অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়াছেন। অনেকক্ষণ আহারসামগ্রী প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে এবং ক্রমে শীতল হইয়া যাইতেছে। আহারসামগ্রী যত শীতল হইতেছে, কর্ত্রী ঠাকুরাণী তত উষ্ণ হইতেছেন। আহারসামগ্রী শীতল হইতেছে, কারণ আপনি গৃহে যান নাই; আপনি গৃহে যান নাই, কারণ আপনকার ক্ষুধা নাই; আপনকার ক্ষুধা নাই, কারণ আপনি বিলক্ষণ জলযোগ করিয়াছেন। কিন্তু আপনকার অনুপস্থিতি জন্য আমরা অনাহারে মারা পড়িতেছি।
দেশীয় পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ধৃতির দ্বিতীয় চরণের বর্জন সংগত হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ চরণের পরিবর্তন স্বেচ্ছাকৃত; কেননা মূলের আক্ষরিক অনুবাদ এখানে সম্ভব হতো না। নবম চরণ, মনে হয়, হাস্যরসের খাতিরে তিনি পরিহার করেছেন : মূলের এই চরণটিতে যে-বেদনাবোধ ধ্বনিত হয়েছে, অনুবাদে তা আমরা হারিয়েছি (এই ধরনের অংশ তিনি অন্যত্রও বর্জন করেছেন)। তবে মূলের রস যে অপরূপ অভিব্যক্তি লাভ করেছে, এতে সন্দেহ নেই।
রুচির অনুরোধেও বিদ্যাসাগর কখনো কখনো মূলের অংশ বর্জন করেছেন। যেমন, তৃতীয়াঙ্ক দ্বিতীয় দৃশ্যে, সিরাকিউসের ড্রোমিও তার প্রভুকে অ্যাড্রিয়ানার দাসীর যে বর্ণনা দিয়েছে, বিদ্যাসাগরে তা একেবারেই সংক্ষিপ্ত ও স্বতন্ত্র।
কখনো কখনো মূলের ভাবকে সম্প্রসারিত করেছেন বিদ্যাসাগর। যেমন, চতুর্থাঙ্ক চতুর্থ দৃশ্যে, সিরাকিউসের ড্রোমিওর উক্তি, ‘She that would be your wife now ran from you’ বাংলায় রূপান্তরিত হয়েছে : ‘মহাশয়! যিনি মধ্যাহ্নকালে আপনকার স্ত্রী হইবার নিমিত্ত ব্যস্ত হইয়াছিলেন, দেখিলাম, তিনিই সর্ব্বাপেক্ষায় অধিক ভয় পাইয়াছেন এবং সর্ব্বাগ্রে পলায়ন করিয়াছেন। তরবারি ডাইন তাড়াইবার এমন মন্ত্র, তাহা আমি জানিতাম না।’
ভ্রান্তিবিলাস মূলের নবরূপায়ণ। বাংলায় শেক্সপিয়রের একটি শ্রেষ্ঠ রূপান্তর এটি— একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বিদ্যাসাগরচরিতেও তাঁর মৌলিক সাহিত্যপ্রতিভার স্বাক্ষর দেদীপ্যমান। বর্ণনার প্রাঞ্জলতায় ও উজ্জ্বল হাস্যপরিহাসে, ভাষার সরলতায় ও বক্তব্যের পরিচ্ছন্নতায় এই অসমাপ্ত রচনা অশেষ মর্যাদাবান।
প্রভাবতীসম্ভাষণ রচিত হয়েছিল তাঁর বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা প্রভাবতীর মৃত্যুতে। এই স্বল্পপরিসর রচনায় মানুষ বিদ্যাসাগরের যে-পরিচয় নিহিত আছে, তার মূল্য অশেষ। বিদ্যাসাগরচরিতে যদি ভ্রান্তিবিলাসের লেখকের পরিচয় ফুটে থাকে, সীতার বনবাসের রচয়িতাকে দেখতে পাই প্রভাবতীসম্ভাষণে।
বেনামি পুস্তিকাগুলিতে বিদ্যাসাগরের পরিহাসপ্রিয়তা যদি কখনো স্থূল মনে হয়, তাহলে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য্যরে উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। সে-যুগের তুলনায় বিদ্যাসাগরের রসিকতা অনেক মার্জিত ও বিশুদ্ধ ছিল। এইসব রচনায় তাঁর শাণিত বিদ্রুপ-প্রয়োগের ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে আশ্চর্য সজাগ মানসিকতার সঙ্গে। তর্ক করবার ভঙ্গির মধ্যেও তাঁর মৌলিকতা সুপরিস্ফুট।
সামাজিক বিষয়ে বিদ্যাসাগর যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার মধ্যেও তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার ছায়াপাত ঘটেছে। বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যায় তাঁর রচনা সীমাবদ্ধ থাকেনি, আবেগ ও অনুভূতিতে ভাস্বর হয়েছে। বিধবাবিবাহে এর পরিচয় আছে, বহুবিবাহে আমরা দেখি তাঁর যুক্তিবাদী মনের স্বতঃপ্রকাশ।
‘তিনি যে কেবল বাংলা গদ্যের আবিষ্কর্তা নহেন, পরন্তু তাঁহার রচনা যে বাংলা গদ্যসাহিত্যের সর্বগুণান্বিত ক্লাসিক,—‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ হইতে আরম্ভ করিয়া তাঁহার আত্ম-জীবনচরিত পর্য্যন্ত পাঠ করিলে প্রতি-পত্রে প্রতি-ছত্রে তাহার প্রমাণ মিলিবে।”—মোহিতলাল মজুমদারের এই উক্তিতে আতিশয্য নেই।
৫. বিদ্যাসাগর-গ্রন্থপঞ্জি
বিদ্যাসাগরের রচিত, সংকলিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের যে-তালিকা ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নির্মাণ করেছেন, তা অবলম্বন করে বিদ্যাসাগর-গ্রন্থপঞ্জি সংকলিত হল।
(ক) রচিত ও সংকলিত
১. বেতাল পঞ্চবিংশতি। ১৮৪৭। হিন্দি বৈতাল পচ্চীসী-অবলম্বনে।
২. বাঙ্গালার ইতিহাস, ২য় ভাগ। ১৮৪৮। মার্শমানের History of Bengal অবলম্বনে।
৩. জীবনচরিত। সেপ্টেম্বর ১৮৪৯। চেম্বার্সের Biography-র অনুবাদ।
৪. বোধোদয়। (শিশুশিক্ষা, ৪র্থ ভাগ)। এপ্রিল ১৮৫১। ‘নানা ইঙ্গরেজী পুস্তক হইতে সংকলিত’।
৫. সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা। নভেম্বর ১৮৫১।
৬. ঋজুপাঠ, ১ম ভাগ। নভেম্বর ১৮৫১। পঞ্চতন্ত্রের কয়েকটি উপাখ্যান।
৭. ঋজুপাঠ, ৩য় ভাগ। ডিসেম্বর ১৮৫১। হিতোপদেশ, বিষ্ণুপুরাণ, মহাভারত, ভট্টিকাব্য, কালিদাসের ঋতুসংহার ও ভট্টনারায়ণের বেণীসংহার থেকে সংকলিত।
৮. ঋজুপাঠ, ২য় ভাগ। মার্চ ১৮৫২। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ড থেকে সংকলন।
৯. সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব। মার্চ ১৮৫৩। কোনো ভারতীয় ভাষায় লিখিত সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস।
১০. ব্যাকরণ কৌমুদী, ১ম ভাগ। ১৮৫৩।
১১. ব্যাকরণ কৌমুদী, ২য় ভাগ। ১৮৫৩।
১২. ব্যাকরণ কৌমুদী, ৩য় ভাগ। ১৮৫৪।
১৩. শকুন্তলা। ডিসেম্বর ১৮৫৪। কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকের আখ্যান।
১৪. বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব। জানুয়ারি ১৮৫৫। বিধবাবিবাহের সপক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ।
১৫. বর্ণপরিচয়, ১ম ভাগ। এপ্রিল ১৮৫৫।
১৬. বর্ণপরিচয়, ২য় ভাগ। জুন ১৮৫৫।
১৭. বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব দ্বিতীয় পুস্তক। অক্টোবর ১৮৫৫। বিধবাবিবাহ-বিরোধীদের প্রত্যুত্তর।
১৮. কথামালা। ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬। ঈশপের Fables থেকে সংকলিত।
১৯. চরিতাবলী। জুলাই ১৮৫৬।
২০. Marriage of Hindu Widows. ১৮৫৬। বিধবাবিবাহ পুস্তকদুটির ইংরেজি অনুবাদ।
২১. পাঠমালা। ১৮৫৯। জীবনচরিত, শকুন্তলা ও মহাভারতের অংশবিশেষ নিয়ে সংকলিত পাঠ্যপুস্তক।
২২. মহাভারত। উপক্রমণিকাভাগ। জানুয়ারি ১৮৬০।
২৩. সীতার বনবাস। এপ্রিল ১৮৬০। ভবভূতির উত্তররামচরিত নাটক এবং অন্যান্য সূত্র থেকে গৃহীত আখ্যান।
২৪. ব্যাকরণ কৌমুদী, ৪র্থ ভাগ।
২৫. আখ্যানমঞ্জরী। নভেম্বর ১৮৬৩। ইংরেজি পুস্তক-অবলম্বনে রচিত কয়েকটি আখ্যান।
২৬. শব্দমঞ্জরী। ১৮৬৪। বাংলা অভিধান।
২৭. আখ্যানমঞ্জরী। ১ম ভাগ। ফেব্রুয়ারি ১৮৬৮।
২৮. আখ্যানমঞ্জরী। ২য় ভাগ। ফেব্রুয়ারি ১৮৬৮।
২৯. ভ্রান্তিবিলাস। ডিসেম্বর ১৮৬৯। শেক্সপিয়রের Comedy of Errors-অবলম্বনে।
৩০. বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার। আগস্ট ১৮৭১। বহুবিবাহ প্রথার বিপক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ।
৩১. বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার। দ্বিতীয় পুস্তক। এপ্রিল ১৮৭৩। বহুবিবাহ-সমর্থনকারীদের মতখণ্ডন।
৩২. বামনাখ্যানম্। ১৮৭৩। মধুসূদন তর্কপঞ্চানন-রচিত সংস্কৃত শ্লোকের বাংলা অনুবাদ।
৩৩. নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস। এপ্রিল ১৮৮৮। মদনমোহন তর্কালঙ্কার-রচিত শিশুশিক্ষার অধিকার-সংক্রান্ত বিতর্ক।
৩৪. পদ্যসংগ্রহ। প্রথম ভাগ। জুলাই ১৮৮৮।
৩৫. পদ্যসংগ্রহ। দ্বিতীয় ভাগ। ১৮৯০।
৩৬. সংস্কৃত রচনা। নভেম্বর ১৮৮৯। বাল্যরচনার সংগ্রহ।
৩৭. শ্লোকমঞ্জরী। মে ১৮৯০। উদ্ভট শ্লোকসংগ্রহ।
৩৮. বিদ্যাসাগরচরিত। (স্বরচিত)। সেপ্টেম্বর ১৮৯১।
৩৯. প্রভাবতীসম্ভাষণ। ১৮৯২।
৪০. ভূগোলখগোলবর্ণনম্। এপ্রিল ১৮৯২। ভূগোল ও খগোল বিষয়ে ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে রচিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত সংস্কৃত শ্লোক-সংগ্রহ।
৪১. রামের অধিবাস। ১৯০৯। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে রচিত ‘রামের রাজ্যাভিষেক’ নামক অসম্পূর্ণ রচনা, পুত্র নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত আখ্যানের অবশিষ্ট অংশসহ।
(খ) বেনামি রচনা
১. অতি অল্প হইল। কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য প্রণীত। মে ১৮৭৩। বহুবিবাহের সপক্ষে তারানাথ বাচস্পতির রচনার প্রত্যুত্তর।
২. আবার অতি অল্প হইল। কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য প্রণীত। সেপ্টেম্বর ১৮৭৩। তারানাথ বাচস্পতির রচনার প্রত্যুত্তর।
৩. ব্রজবিলাস। যৎকিঞ্চিৎ অপূর্ব্ব মহাকাব্য। কবিকুলতিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য প্রণীত। নভেম্বর ১৮৮৪। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ব্রজনাথ বিদ্যারত্বের রচনার প্রত্যুত্তর।
৪. বিধবাবিবাহ ও যশোহর-হিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা। কস্যচিৎ তত্ত্বান্বেষিণঃ। নভেম্বর ১৮৮৪। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে এর নাম হয় বিনয়পত্রিকা।
৫. রত্নপরীক্ষা। অর্থাৎ শ্রীযুক্ত ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন, প্রসন্নচন্দ্র ন্যায়রত্ন, মধুসূদন স্মৃতিরত্ন, এই তিন পণ্ডিতরতের প্রকৃত পরিচয় প্রদান। কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোসহচরস্য প্রণীত। আগস্ট ১৮৮৬। বিধবাবিবাহের অশাস্ত্রীয়তা প্রতিপাদনকারীদের সমালোচনা।
(গ) প্রবন্ধ
১. সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা, দ্বিতীয় সংখ্যায় (ভাদ্র, ১৭৭২ শকাব্দ। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত ‘বাল্যবিবাহের দোষ’।
২. রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতিবোধ পুস্তকের (১৮৫১) অন্তর্ভুক্ত সাতটি প্রস্তাব : ‘পশুগণের প্রতি ব্যবহার’, ‘পরিবারের প্রতি ব্যবহার’, ‘প্রধান ও নিকৃষ্টের প্রতি ব্যবহার’, ‘পরিশ্রম’, ‘স্বচিন্তা ও স্বাবলম্বন’, ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব’ ও ‘বিনয়’।
৩. সখা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘জর্জ ওয়াশিংটনের কথা’ (এপ্রিল ১৮৯৩) ও ‘ছাগলের বুদ্ধি’ (জানুয়ারি ১৮৯৪)।
৪. সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় প্রকাশিত (১৩০৮ সন, দ্বিতীয় সংখ্যা) প্রাদেশিক শব্দসংকলন ‘শব্দ-সংগ্রহ’।
(ঘ) সম্পাদিত গ্রন্থ
১. অন্নদামঙ্গল, ১ম ও ২য় খণ্ড। ১৮৪৭। ‘কৃষ্ণনগরের রাজবাটীর মূল পুস্তক দৃষ্টে পরিশোধিত’।
২. বৈতাল পচ্চীসী। জানুয়ারি ১৮৫২। ইংরেজি ভূমিকা-সংবলিত নতুন হিন্দি পাঠ।
৩. রঘুবংশম্। জুন ১৮৫৩। মূল পাঠ।
৪. কিরাতার্জ্জুনীয়ম্। ১৮৫৩। মূল পাঠ।
৫. শিশুপালবধ। ১৮৫৭। মূল পাঠ।
৬. সর্ব্বদর্শনসংগ্রহঃ। ১৮৫৩-৫৮। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত। ভূমিকা ইংরেজিতে রচিত।
৭. কুমারসম্ভব। ১৮৬১। মল্লিনাথকৃত টীকাসহ মূল পাঠ।
৮. কাদম্বরী। ১৮৬২। মূল পাঠ।
৯. বাল্মীকি রামায়ণ— সটীক। ১৮৬০ ?।
১০. মেঘদূতম্। এপ্রিল ১৮৬৯। মল্লিনাথের টীকাসহ মূল পাঠ।
১১. উত্তরচরিতম্। নভেম্বর ১৮৭০। মূল পাঠ।
১২. অভিজ্ঞানশকুন্তলম্। জুন ১৮৭১। মূল পাঠ।
১৩. হর্ষচরিতম্। মার্চ ১৮৮৩। মূল পাঠ।
গ্রন্থপঞ্জি
প্রমথনাথ বিশী, বিদ্যাসাগর-রচনাসংগ্রহ (কলিকাতা : মিত্র ও ঘোষ, ১৩৬৪), ‘বিদ্যাসাগর’ শীর্ষক ভূমিকা।
বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, তিন খণ্ড (কলিকাতা : বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৬৪-৬৬)।
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (সাহিত্য-সাধক-চরিতমালার ১৮ সংখ্যক পুস্তিকা; পঞ্চম সংস্করণ; কলিকাতা : বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১৩৬২)।
মনোমোহন ঘোষ, বাংলা গদ্যের চারযুগ (দ্বিতীয় সংস্করণ : কলিকাতা : দাসগুপ্ত এণ্ড কোং লিঃ, ১৯৪৯)।
মোহিতলাল মজুমদার, সাহিত্য-বিতান (তৃতীয় সংস্করণ; কলিকাতা; বিদ্যোদয় লাইব্রেরী প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৬৮), ‘সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর’ শীর্ষক প্রবন্ধ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারিত্রপূজা (তৃতীয় সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ; কলিকাতা : বিশ্বভারতী, ১৩৫২), ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ শীর্ষক প্রবন্ধ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনস্মৃতি (পুনর্মুদ্রণ; কলিকাতা : বিশ্বভারতী, ১৩৬৮)।
রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রবন্ধ-সংকলন (কলিকাতা : এভারেষ্ট বুক হাউস, ১৯৫৯), ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ শীর্ষক প্রবন্ধ।
শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস (নতুন সংস্করণ; কলিকাতা : বুকল্যাণ্ড প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৬২)।
সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য (তৃতীয় সংস্করণ; কলিকাতা : মডার্ন বুক এজেন্সী, ১৩৫৬)।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস, বিদ্যাসাগর-গ্রন্থাবলী, ‘সাহিত্য’, ‘সমাজ’ এবং ‘শিক্ষা ও বিবিধ’ খণ্ড (মোদিনীপুর : বিদ্যাসাগর-স্মৃতি-সংরক্ষণ-সমিতি, ১৩৪৪-৪৬), ‘ভূমিকা’।
P. Lal, Great Sanskrit Plays (A New Direction Books; Connecticut, 1964).
M. Obaidullah, The Pattern of Bengali Vocabulary (Dacca : Bengali Academy, 1965).
১৯৬৮
____
* চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিদ্যাসাগর গ্রন্থে একালের একটি ঘটনা বিবৃত করেন, যা পরে লোকপ্রসিদ্ধি লাভ করে। মায়ের আদেশানুযায়ী ঈশ্বরচন্দ্র একবার বাড়ি যেতে চান, কিন্তু মার্শাল তাঁকে ছুটি দিতে চাননি। তখন তিনি পদত্যাগ করতে চাইলে মার্শাল দেশে যাবার অনুমতি দেন। দামোদরের তীরে পৌঁছে বিদ্যাসাগর দেখেন, বর্ষার ঢল নেমেছে : নিকটে কোনো নৌকা নেই, নৌকায় পারাপার করার ভরসাও নেই। তখন সাঁতার দিয়ে দামোদরের উত্তাল তরঙ্গ পেরিয়ে তিনি বাড়ি পৌঁছোন। বিদ্যাসাগরের সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন তাঁর ভ্রমনিরাস বইতে এ-ঘটনাকে অমূলক আখ্যা দিয়ে প্রশ্ন করেছেন, ‘এরূপ মিথ্যা অসঙ্গত কথা লিখিয়া, পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধি করার আবশ্যক কি ?’
* তালিকাপ্রণয়নের এ-রীতি বিদ্যাসাগর অনুসরণ করেছিলেন তাঁর বহুবিবাহ দ্বিতীয় পুস্তকে।
* এতে যাঁরা স্বাক্ষর দান করেন, তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন : কৃষ্ণনগরের মহারাজ শ্রীশচন্দ্র, দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায়, শিবচন্দ্র দেব, দিগম্বর মিত্র, প্যারীচরণ সরকার, রামনারায়ণ তর্করত্ন, মদনমোহন বিদ্যালঙ্কার, রাজনারায়ণ বসু এবং ইয়ং বেঙ্গল দলের রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কিশোরীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার ও প্যারীচাঁদ মিত্র।
** এ-প্রসঙ্গে শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন : ‘যাহারা বিধবার পাণিগ্রহণ করিয়াছিল, তাহাদের বিপক্ষ প্রতিবাসিবর্গ উহাদের প্রতি নানারূপ অত্যাচার করিয়াছিল। অতঃপর অত্যাচার না হইতে পারে, তদ্বিষয়ে রাজপুরুষগণ সতর্ক হইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও উহাদিগকে বিপক্ষের অত্যাচার হইতে রক্ষার জন্য অকাতরে যথেষ্ট অর্থব্যয় করিয়াছিলেন। তৎকালীন জাহানাবাদের ডেপুটি মাজিষ্ট্রেট মৌলবী আবদুল লতিব খাঁন বাহাদুর সম্পূর্ণরূপে আনুকূল্য করেন : তিনি পুলিশ দ্বারা সাহায্য না করিলে প্রতিবাসিরা বিবাহ সময়ে বিস্তর অনিষ্টসাধন করিতে পারিত; এ কারণ, আমরা কস্মিনকালেও উক্ত মহাত্মা মৌলবী আবদুল লতিব খাঁন বাহাদুরের নাম বিস্মৃত হইতে পারিব না।’
* এর মধ্যে একাধিক শব্দ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের প্রবোধচন্দ্রিকায় পাওয়া যাবে।