পরিশিষ্ট

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও স্ত্রীশিক্ষা

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও স্ত্রীশিক্ষা

কানাই লাল রায়

অধ্যাপক আহমদ শরীফ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তিনি [বিদ্যাসাগর] নতুন চেতনার জনক, সংস্কার মুক্তির জনক, জীবন-জিজ্ঞাসার জনক, বিদ্রোহের জনক, শিক্ষা ও সংস্কারের জনক, সংগ্রামীর জনক, ত্যাগ-তিতিক্ষার জনক। জনকত্বই তাঁর কৃতি ও কীর্তি। সমকালীন বাংলার সব নতুনেরই জনক ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন ঈশ্বর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর পরবর্তী কর্মীরা ছিলেন প্রবর্তনাদাতা, সে ঈশ্বরেরই অভিপ্রায়-চালিত নিমিত্ত মাত্র।’

আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে আমাদের দেশে লৌকিক সংস্কৃতবিদ্যার যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসংস্কার এবং বাংলা ভাষার মাধ্যমে গণশিক্ষা প্রচলন— শিক্ষাক্ষেত্রে এগুলি হল শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি। এই কথাটাকে আর একটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মাতৃভাষাকে বিদ্যার মাধ্যম করা, মৌলিক চিন্তার বিকাশে উৎসাহ দেওয়া ও শিক্ষাকে সব রকমের ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ মানবিক আদর্শের বিকাশ ঘটানো— এই ছিল বিদ্যাসাগরের শিক্ষাপরিকল্পনার মূল কথা। তাঁর আর-একটি কীর্তি হল বালকদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। সেসময় স্ত্রীশিক্ষা পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (১৮০১-১৮৫১), যিনি মহাত্মা বেথুন নামে সমধিক খ্যাত, তাঁর সহযোগী রূপে বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে পদার্পণ করেন। সেকালে আমাদের দেশে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে নানা বদ্ধমূল কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। যেমন, নারীরা শিক্ষিত হলে তারা বিধবা হবে, তারা মুখরা, দুশ্চরিত্রা ও গৃহকর্মবিমুখ হবে। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যের নিরবচ্ছিন্ন চর্চার ফলে এদেশের মানুষ, সীমিত সংখ্যায় হলেও, প্রাচীন গোঁড়া সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। এই শিক্ষিত নাগরিক উচ্চ সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক চেতনা জাগছিল। ঠিক সেই সময় বেথুন ও বিদ্যাসাগর স্থির সংকল্পের সঙ্গে এগিয়ে এলেন স্ত্রীশিক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য। রাজপুরুষ ডালহৌসি ও হ্যালিডে-র সঙ্গে যুক্ত হল দুই শিক্ষাবিদ বেথুন ও বিদ্যাসাগরের অধ্যবসায়, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা।

সমাজে প্রচলিত অনেক কুসংস্কার ও সমস্যা নিয়ে যেমন, তেমনই স্ত্রীশিক্ষা নিয়েও রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বল্পায়ু জীবন এবং সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সব চিন্তাভাবনাকে তিনি বাস্তবে রূপায়িত করতে পারেননি। নানা কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও অবসর পেলেই তিনি এদেশের নারীসমাজের নানা সমস্যার কথা নিয়ে আলোচনা করতেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা’-য়। ‘সহমরণ’ বিষয়ে রামমোহন যেসব পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করেছিলেন তার মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে স্ত্রীশিক্ষার বিষয়টিও এসেছিল। এটি ১৮১৮-১৯ সালের কথা। এই সময় থেকে খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে বাংলাদেশে, প্রধানত কলকাতায়, স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের সূচনা হয় বলা চলে। ১৮১৯ সালে ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ (The female Juvenile Society for the Establishment and Support of Female Schools) নামে একটি খ্রিস্টান মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতার নন্দনবাগান, গৌরীবেড়ে, জানবাজার ও চিৎপুরে এই সমিতির বালিকা বিদ্যালয় ছিল। যেসব মহিলার আর্থিক সহায়তায় বিদ্যালয়গুলি স্থাপিত হয়েছিল, তাঁদের মাতৃভূমির নামেই সেগুলির নামকরণ করা হয়েছিল। যেমন লিভারপুর স্কুল, বার্মিংহাম স্কুল ইত্যাদি। এই সমিতির উদ্যোগে ১৮২২ সালে স্ত্রীশিক্ষার উপযোগিতা সম্পর্কে জনসাধারণকে বোঝাবার জন্য স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি লেখেন একজন বিখ্যাত বাঙালি— পণ্ডিত গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার। এই বইটিতে স্ত্রীশিক্ষা যে সামাজিক রীতিনীতি সম্মত, প্রাচীন ও আধুনিক বহু বিদুষী মহিলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সরস আলোচনার মাধ্যমে তা ব্যক্ত করা হয়েছে। রাধাকান্ত দেবও এই বইটি রচনায় সহযোগিতা করেছিলেন।

১৮২৪ সালে ‘চার্চ মিশনারি সোসাইটি’-র উদ্যোগে ‘লেডিজ় সোসাইটি’ (Ladies Society for Native Female Education in Calcutta and its vicinity) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সোসাইটির মূলে ছিল চার্চ মিশনারি সোসাইটি। এর মধ্যে ১৮২১ সালের নভেম্বর মাসে মিস মেরি অ্যান কুক (Mary A. Kooke) এদেশে আসেন মূলত স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন ও সর্বস্তরে প্রসারের উদ্দেশ্যে কাজকর্ম করার জন্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লন্ডনে ‘ব্রিটিশ অ্যান্ড ফরেন স্কুল সোসাইটি’ নামে একটি সোসাইটি ছিল। এই সোসাইটির পক্ষ থেকেই বিদ্যোৎসাহী মিস মেরি কুক কলকাতায় আসেন। তাঁর দৃঢ় প্রচেষ্টায় দুই বছরের মধ্যেই কলকাতা শহরের বিভিন্ন স্থানে আটটি মিশনারি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং এক বছরের মধ্যেই এইসব স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়ায় ২১৭ জনে। ১৮২৩ সালের মধ্যে স্কুলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২২টিতে এবং ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪০০। উল্লেখ্য, ১৮২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গৌরীবেড়েতে ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি-র স্কুলের ছাত্রীদের একটি পরীক্ষা হয়। পরীক্ষা দিতে এসেছিল ১৪০ জনের মতো হিন্দু-মুসলমান ছাত্রী। আগের বছর থেকে ছাত্রীদের সূচীশিল্প শেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে।

মিস কুক (পরবর্তীতে মিসেস উইলসন)-এর উপর লেডিজ় সোসাইটি কর্তৃক এসব স্কুলের সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয় এবং পরবর্তীতে মিসেস উইলসনও লেডিজ় সোসাইটি কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্কোয়্যার-এ একটি কেন্দ্রীয় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন (১৮২৮)। রাজা বৈদ্যনাথ রায় এই বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য ২০,০০০ টাকা দান করেন। রাজা রাধাকান্ত দেবও নানাভাবে সহযোগিতা করেন। ৫৮ জন ছাত্রী নিয়ে এই স্কুলের সূচনা হলেও দু’বছরের মধ্যে এই স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০ থেকে ২০০ জনের মতো। ছাত্রীদের ২০টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্ণপরিচয়, ইতিহাস, ভূগোল, বাইবেল, সেন্ট ম্যাথু-র গসপেল প্রভৃতি। প্রধানত নিম্নবর্ণের ও নিম্নবিত্তের হিন্দু পরিবারের বালিকারাই এসব মিশনারি স্কুলের ছাত্রী ছিল। উচ্চবর্ণের এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্তের হিন্দুরা এসব মিশনারি স্কুলকে স্বাভাবিক কারণে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তাঁরা ভাবতেন এসব স্কুলে তাঁদের কন্যাসন্তানদের পড়তে পাঠালে তারা খ্রিস্টান না হলেও অন্তত খ্রিস্টানভাবাপন্ন হয়ে পড়বে। মিশনারি স্কুলের সিলেবাস বা পাঠ্যসূচি লক্ষ করলেই এ ধারণা সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

তবু খ্রিস্টান পাদরিদের আনুকূল্যে ও ইউরোপীয় মহিলাদের প্রচেষ্টায় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দেশীয় শিক্ষাব্রতী হিন্দুসমাজ নানাভাবে সহযোগিতা করেন। কিন্তু খ্রিস্টান পাদরিদের খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উগ্রতা তাঁদের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়লে তাঁরা এ সহযোগিতা করা থেকে নিবৃত্ত হন। যোগেশচন্দ্র বাগল এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন—

The endeavours on the part of the foreign agencies, however failed to catch the imagination of the people. Along the three R’s, this missionaries and their females as well as other European ladies made it a point to inculcate Christian doctrins into the pliable mind of the young girls. We have already seen that much patrons of female education as Radhakanta Deb and Raja Boidya Nath Roy generally withdraw their co-operation as their extra-academic intention became more and more evident.

উপর্যুক্ত উক্তিটিতে দেখা যায়, সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা তাঁদের মেয়েদের এসব মিশনারি বালিকা বিদ্যালয়ে না পাঠালেও তাঁদের অনেকে এসব স্কুলের ছাত্রীদের নানাভাবে উৎসাহ দিতেন। রাজা রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে স্কুল সোসাইটির ছাত্রদের ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষা হত। ১৮২১ সালে ও ১৮২২ সালে ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটির ছাত্রীরাও এই পরীক্ষা দিতে এসেছে। কিন্তু পরবর্তীতে খ্রিস্টান মিশনারিদের শিক্ষা-বহির্ভূত মানসিকতা লক্ষ করে রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ব্যক্তি এসব মিশনারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেন।

কিন্তু এসব মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠার ফলে অন্তত হিন্দুসমাজের উপরের স্তরে স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হতে থাকে। হিন্দুসমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের অগ্রগণ্য পুরুষ শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব স্ত্রীশিক্ষার বিরোধী না হলেও প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থক ছিলেন না। তিনি চাইতেন বিবাহের আগে ঘরে বসেই মেয়েরা লেখাপড়া করুক। রাধাকান্ত দেবের মতোই রাজা বৈদ্যনাথ রায়, মতিলাল শীল এবং অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি স্ত্রীশিক্ষার নৈতিক সমর্থক ছিলেন। কিন্তু স্ত্রীশিক্ষাকে সামাজিক আন্দোলনের রূপ দেন একদল হিন্দু কলেজের ছাত্র, এঁরা ডিরোজিয়ো-শিষ্য ‘ইয়ং বেঙ্গল দল’। পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ প্রমুখ ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর প্রতিনিধিরা স্ত্রীশিক্ষার প্রকৃত সামাজিক তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৮৪০ সালে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘Native Female Education’ এই বিষয়ের ওপর ইংরেজি প্রবন্ধ রচনা করে পুরস্কার পান। ১৮৪২ সালে রামগোপাল ঘোষ হিন্দু কলেজের ছাত্রদের স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর প্রবন্ধ রচনা করতে বলেন এবং ভাল প্রবন্ধের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন। মধুসূদন দত্ত ও ভূদেব মুখোপাধ্যায় এই পুরস্কার লাভ করেন।

উনিশ শতকের চতুর্থ দশকে স্ত্রীশিক্ষার আন্দোলন মিশনারিদের প্রচেষ্টার বাইরে বৃহত্তর সমাজে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিদ্যাসাগরের বন্ধুস্থানীয় এবং সমবয়সি অক্ষয়কুমার দত্ত স্ত্রীশিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে এবং যাঁরা তার বিরোধিতা করছেন তার সমালোচনা করে তৎসম্পাদিত বিদ্যাদর্শন পত্রিকায় নানা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে থাকেন।

১৮৪৫ সালে কলকাতার উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ ও রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তাঁদের এলাকায় (উত্তরপাড়ায়) একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে সাহায্য প্রার্থনা করে শিক্ষা সংসদে (Director of Education) একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্রের উত্তর অনেকটাই নেতিবাচক ছিল। সেই উত্তরে তাঁরা জানান, সরকারি সম্পদ ছাড়া উদ্যোক্তারা আগে স্বাধীনভাবে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেখান এবং কিছুদিন পরিচালনা করুন, তারপর সংসদ সাহায্যের কথা ভেবে দেখবেন।

এদিকে ১৮৪৭ সালে বারাসাতের কয়েকজন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উদ্যোগে বারাসতে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে সম্ভ্রান্ত বাঙালিদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এটিই প্রথম প্রকাশ্য বালিকা বিদ্যালয়। এর উদ্যোক্তারা ছিলেন শিক্ষাবিদ প্যারীচরণ সরকার এবং বারাসতের স্বনামধন্য ভ্রাতৃদ্বয় কালীকৃষ্ণ মিত্র ও নবীনকৃষ্ণ মিত্র। এর ফলে তাঁদের ওপর নানা সামাজিক নিপীড়ন নেমে আসে।

প্যারীচরণের চরিতকার নবকৃষ্ণ ঘোষ এ সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণ অধ্যাপক বহুল গণ্ডগ্রাম বারাসতে ঐ দেশাচার বিরুদ্ধ নব অনুষ্ঠানের জন্য প্যারীবাবু প্রমুখ ঐ বালিকা বিদ্যালয়ের স্থাপনকর্তাগণকে যে কত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করিতে হইয়াছিল, কত লাঞ্ছনা-নিগ্রহ ভোগ করিতে হইয়াছিল। প্যারীবাবু, নবীনকৃষ্ণবাবু এবং বালিকা বিদ্যালয়ের শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তিগণ বারাসতে সমাজচ্যুত হইয়াছিলেন।’

ইংরেজ সরকারের আইন উপদেষ্টা ও শিক্ষা সংসদের সভাপতি শিক্ষাবিদ জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ছিলেন কেম্ব্রিজ-এর কৃতী ছাত্র, গ্র্যাজুয়েট এবং ব্যারিস্টার। ভারতপ্রেমিক ও মানবতাবাদী এই মানুষটির ভারতবর্ষে তথা কলকাতায় আগমন এদেশের দুর্ভাগা ও অবহেলিত নারীসমাজের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ বলা যায়। অনেকের মতে, যিনি এই বেথুন সাহেবকে বাঙালি নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা এবং অসহায়তা সম্পর্কে অবহিত করে এ কাজে এগিয়ে আসতে সার্বিক প্রেরণা জুগিয়েছিলেন, তিনি স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আবার অনেকের মতে, বিচক্ষণ বেথুন সাহেবই বিদ্যাসাগরকে খুঁজে নিয়ে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে তাঁকে সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তা ছাড়া, আরও যাঁরা স্ত্রীশিক্ষার কাজে বেথুন সাহেবকে সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের কয়েকজন হলেন— রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-১৮৬৮), রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় (১৮১৪-১৮৭৮), পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮), শম্ভুনাথ পণ্ডিত (১৮২০-১৮৬৭) প্রমুখ মনীষী।

১৮৪৯ সালের ৭ মে (সোমবার) মহাত্মা বেথুন কর্তৃক কলকাতায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হল। বেথুনের এই প্রচেষ্টাকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ১৮৪৯ সালের ১০ মে (বৃহস্পতিবার) সম্বাদ ভাস্কর যে নিবন্ধ প্রকাশ করেন তার শিরোনাম ছিল ‘হিন্দু স্ত্রীলোকদিগের স্বাধীনতার শুভানুষ্ঠান’। তাঁরা ‘ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠা’র নানা প্রশংসা করে এক স্থানে বেথুন সাহেব সম্পর্কে লিখেছেন: ‘এইক্ষণে বিদ্যাধ্যাপনীয় সমাজাধিপতি শ্রীযুত বেথুনসাহেবকে সহস্র নমস্কার করি। তাঁর অনুগ্রহে কলিকাতা নগরে স্ত্রীলোকদিগের বিদ্যাভ্যাসের বিদ্যালয় স্থাপিত হইল।’

স্বয়ং বড়লাট ডালহৌসি ১৮৫০ সালের ১ এপ্রিল বেথুন-এর এই বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে উচ্চ প্রশংসা করে লিখেছেন: ‘Mr. Bethune has, in my humble opinion, done a great work in the first successful introduction of Native Female Education in India, on a sound and solid foundation; and has earned a right not only to the gratitude of the Government but to its frank and cordial support.

কিন্তু ভারত তথা বাংলাবাসীর দুর্ভাগ্য যে, এই মহামনীষী মাত্র ৫০ বছর বয়সে প্রয়াত হন। ভারতবর্ষে তাঁর অবস্থানকাল ছিল মাত্র চার বছর। বেথুন প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিকে বলা যায় বাংলায় নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী প্রথম মহিলা স্কুল। পরবর্তীকালে এটি কলেজে পরিণত হয়। কাদম্বিনী বসু, চন্দ্রমুখী বসু প্রমুখ বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মহিলা এই বেথুন কলেজেরই ছাত্রী ছিলেন। মর্যাদায় প্রেসিডেন্সি কলেজের পরেই এই কলেজের স্থান ছিল।

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, কলকাতায় স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন করেছিলেন খ্রিস্টান মিশনারিরা। কিন্তু ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে প্রধানত নিম্নশ্রেণির হিন্দুর মধ্যে তাঁদের প্রয়াস সীমাবদ্ধ ছিল, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজে তাঁরা তেমন প্রবেশাধিকার পাননি।

স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে জনমত পরীক্ষা ও সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর এসময় হুগলি, ঢাকা, কৃষ্ণনগর ও হিন্দু কলেজের সিনিয়র ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদের বাংলা রচনার পরীক্ষক হিসেবে ‘স্ত্রীশিক্ষার আবশ্যকতা’ শীর্ষক বিষয় নির্ধারণ করেন। কৃষ্ণনগর কলেজের নীলকমল ভাদুড়ীর রচনা শীর্ষস্থান লাভ করে এবং স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হয়। প্রবন্ধটি এমনই মানসম্পন্ন হয়েছিল যে সেটি সংবাদপত্র ও শিক্ষাবিভাগের প্রতিবেদনে মুদ্রিত হয়েছিল।

মহাত্মা বেথুনের ইচ্ছাক্রমে ফিমেল স্কুলের তত্ত্বাবধান ও উন্নতিবিধানের সামগ্রিক দায়িত্ব অর্পিত হয় বিদ্যাসাগরের ওপর। তিনি ১৮৫০-এর ডিসেম্বর মাস থেকে স্কুলের অবৈতনিক সম্পাদক রূপে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। দক্ষিণারঞ্জন দান করেছিলেন বিদ্যালয়গৃহের জন্য নিজস্ব বাড়ি, ব্যক্তিগত পাঠাগার থেকে পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের পুস্তক এবং স্কুলের স্থায়ী বাড়ি নির্মাণের জন্য অর্ধবিঘা জমি ও এক হাজার টাকা। মদনমোহন তর্কালঙ্কার সর্বপ্রথম নিজের দুই কন্যাকে ওই স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে অনেক সামাজিক নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল। মহাত্মা বেথুন অর্থব্যয় ছাড়াও নিজের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি স্কুলের উন্নতিকল্পে দান করেছিলেন। কিন্তু স্কুলভবনের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই আকস্মিকভাবে তাঁর মৃত্যু হওয়ায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর নামে স্কুলটির নামকরণ করা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৮৪৯ সালের মে মাসে মাত্র ২১ জন ছাত্রী নিয়ে Calcutta Female School বা কলকাতা বালিকা বিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে এবং বছর শেষে ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪ জনে। ছাত্রীদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া হত না, বইপত্রও দেওয়া হত বিনামূল্যে। বিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচ বহন করতেন বেথুন সাহেব। স্কুলপ্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় বছর পর ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে বেথুন বিদ্যাসাগরকে উক্ত বিদ্যালয়ের অবৈতনিক সম্পাদক নিযুক্ত করেন।

১৮৫৬ সালের মার্চ মাসের পর থেকে সম্পূর্ণ সরকারি ব্যয়ে ও পরিচালনায় স্কুলটি চলতে থাকে। ভারত সরকারের অন্যতম সেক্রেটারি স্যার সিসিল বিডন-কে সভাপতি এবং কালীকৃষ্ণ বাহাদুর, প্রতাপচন্দ্র সিংহ, হরচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল মিত্র প্রমুখ ১১ জন ব্যক্তিকে সদস্য ও বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সম্পাদক করে ১৮৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি পরিচালনা সভা গঠিত হয়। সম্পাদক রূপে বিদ্যাসাগর ১৮৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর ওই বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কিত কার্যক্রম একটি বিজ্ঞাপনে সবিশদ তুলে ধরেন। পরবর্তীকালে ওই কমিটি বিলুপ্ত হয়।

বেথুন প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয় সম্পর্কে স্কুল ইন্সপেক্টর উড্রো সাহেব ১৮৬৪ সালের ৪ জুন অনেক প্রশংসার সঙ্গে বেশ কিছু হতাশার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। স্কুলবাড়িটি বেশ সুন্দর। বেথুন সাহেবের মৃত্যুর পর স্কুলের যাবতীয় দায়িত্ব বড়লাট ডালহৌসি স্বহস্তে গ্রহণ করেন (মাসিক ব্যয় ৬৫২ টাকা এবং বার্ষিক ৭৯২৯ টাকা)। পরবর্তীকালে স্কুলের দায়িত্ব স্বয়ং ভারত সরকার গ্রহণ করেন। স্কুলের যাঁরা প্রধানশিক্ষিকা ছিলেন তাঁরাও স্বনামধন্যা। তথাপি হতাশার কথা হল স্কুলের ক্রমহ্রাসমান ছাত্রীসংখ্যা এবং পড়াশুনার অনগ্রগতি। বেথুন স্কুলে ছাত্রীসংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকায় ১৮৬৭ সালের জুলাই মাসে ‘বেথুন স্কুল কমিটি’ জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য একটি সাব-কমিটি গঠন করে। এই কমিটিতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কুমার হরেকৃষ্ণ দেব এবং প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী। বিষয়টি অনুসন্ধান করে কমিটি ১৮৬৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর একটি রিপোর্ট পেশ করেন। কমিটি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে, ছাত্রীদের শিক্ষাদানের ও পরীক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে— সর্বত্র অনিয়ম লক্ষ করেন। এই অনিয়মের মূলে আছেন প্রধানশিক্ষিকা মিস পিগট (Miss Pigott)। স্কুল কমিটি বিষয়টি বাংলা সরকারকে জানালে সরকার মিস পিগটকে প্রধানশিক্ষিকার পদ থেকে অপসারণ করেন।

অতঃপর সরকার ‘বেথুন স্কুল কমিটি’কে বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টরের সঙ্গে ‘পরামর্শদাতা কমিটি’ হিসেবে সহযোগিতা করার কথা বলেন। কিন্তু ‘বেথুন স্কুল কমিটি’ সেভাবে কাজ করতে সম্মত হন না। এমতাবস্থায় ১৮৬৯ সালের জানুয়ারিতে বেথুন স্কুল সম্পূর্ণভাবে বাংলা সরকারের আয়ত্তাধীনে চলে আসে এবং যথার্থ অর্থে শিক্ষাবিভাগের উপর বেথুন স্কুলের সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয়। এই বিষয়ে ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া সংবাদপত্র যা লিখেছে তার সারাংশ: স্কুল প্রতিষ্ঠার ১৯ বছর পর এবং দুই লক্ষাধিক টাকা (স্থাপক বেথুন সাহেব— প্রদত্ত ৬০,০০০ টাকা এবং সরকার— প্রদত্ত ১,৪২,৭৭৬ টাকা) ব্যয়ের পরও মাত্র ৩০ জন সাত/আট বছরের বালিকার সামান্য শিক্ষালাভের কথা বলা হয়েছে।

শিক্ষাসংসদের সভাপতি রূপে বেথুন আগে থেকেই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁকে শুধু একজন বিচক্ষণ পণ্ডিত বলে নয়, একজন অক্লান্ত কর্মী বলেও শ্রদ্ধা করতেন। বিদ্যাসাগর স্বীয় পাণ্ডিত্য ও কর্মদক্ষতার গুণে ইংরেজ শাসক ও বুদ্ধিজীবী মহলে সবিশেষ পরিচিত ছিলেন। বিদ্যাসাগরের জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘বিদ্যাসাগর মহাশয় মার্শাল, ময়েট প্রভৃতি শিক্ষাবিজ্ঞানী সম্ভ্রান্ত কর্মচারিগণের এতই শ্রদ্ধা ও সমাদরের পাত্র হইয়াছিলেন যে, শিক্ষাবিভাগের কোন কর্মই প্রায় তাঁহার পরামর্শ ব্যতীত সম্পন্ন হইত না।’

স্কুল প্রতিষ্ঠার দিন বেথুন সাহেব তাঁর স্কুলের পাঠ্যসূচির সংক্ষিপ্ত রূপরেখাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই বিদ্যালয়ের মেয়েদের প্রথমে ভাল করে বাংলাশিক্ষা দেওয়া হবে, তারপর কিছু কিছু ইংরেজিও শেখানো হবে। এ ছাড়া, সেলাই, অঙ্কন, হাতের কাজ প্রভৃতি মেয়েদের যে বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয় আছে, সেগুলিও শিক্ষা দেওয়া হবে। এইভাবে শিক্ষা পেলে মেয়েরা তো উপকৃত হবেই, তাদের গৃহের শ্রীও তারা সুন্দররূপে ফুটিয়ে তুলতে পারবে।

এর অনেক পরে, বিদ্যাসাগর তখনও বেথুন স্কুলের সম্পাদক (১৮৬২ সালের ১৫ ডিসেম্বর), বাংলা সরকারকে বেথুন স্কুল সম্পর্কে যে-রিপোর্ট পাঠানো হয় সেখানে পাঠ্যসূচি বিষয়ে বিশদ উল্লেখ ছিল। যেমন— পঠন, লিখন, গণিত, জীবনী, ভূগোল, বাংলার ইতিহাস প্রভৃতি বিষয় বাংলা ভাষার মাধ্যমে পড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। ছিল সূচীকর্মের কথাও। কোন শিক্ষক কোন শ্রেণিতে কী বিষয়ে পড়াবেন, তারও উল্লেখ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর বেথুন স্কুলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও যখনই তাঁর কাছে কোনও পরামর্শ বা সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে, তিনি বিনা দ্বিধায় তা করতে এগিয়ে এসেছেন।

ভারত সরকারের সেক্রেটারি পদে আসীন ছিলেন তখন শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ হ্যালিডে (১৮০৬-১৯০১)। এঁর পুরো নাম স্যার ফ্রেডারিক জেমস হ্যালিডে। ইনি বাংলার প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর বা ছোটলাট (১৮৫৪-১৮৫৯)। গভর্নর হওয়ার পূর্বেও ইনি শিক্ষা তথা নারীশিক্ষা সংক্রান্ত অনেক কাজ করে গেছেন। শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যাপারে ইনি বিদ্যাসাগরকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ১১ এপ্রিল ১৮৫০ সালে হ্যালিডে স্বাক্ষরিত একখানি চিঠিতে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে জানান:

সপরিষদ ভারত সরকার মনে করেন যে ভারতবর্ষে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কাজ করা হয়েছে এবং তাই সরকারের উচিত এই প্রচেষ্টাকে এখন প্রকাশ্যে সাহায্য করা। শিক্ষাসংসদের প্রতি ভারত সরকারের অনুরোধ, যেন তাঁরা এখন থেকে স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তন ও তাঁদের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করেন এবং এদেশীয় লোকের চেষ্টায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে, সেই বিদ্যালয়কে যথাসাধ্য সব দিক দিয়ে সাহায্য করতে কুণ্ঠিত না হন।১০

ভারত সরকার কর্তৃক স্বীকৃতিলাভের পর স্ত্রীশিক্ষার আন্দোলন ক্রমে ব্যাপক ও শক্তিশালী হতে থাকে। ইয়ং বেঙ্গল দলের মুখপাত্ররা সভা-সমিতির বক্তৃতায় ও পত্র-পত্রিকার রচনায় স্ত্রীশিক্ষার যৌক্তিকতা দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেন। অপরপক্ষে গোঁড়া হিন্দু সমাজের প্রবক্তারা তাঁদের পত্র-পত্রিকায় বিদ্রুপাত্মক রচনা প্রকাশ করেন এবং স্ত্রীশিক্ষার উদ্যোগীদের বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির ভয় দেখাতে থাকেন। কিন্তু কেবল ইয়ং বেঙ্গল দল এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তিরাই যে স্ত্রীশিক্ষাকে সমর্থন করেছিলেন তা-ই নয়, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের মধ্যেও অনেকে সেদিন স্ত্রীশিক্ষার আন্দোলনের পক্ষে এগিয়ে এসেছিলেন। যেমন, গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ মহাশয় তাঁর সম্বাদ ভাস্কর পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন।

১৮৫০ সালে সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা  নামে ঠনঠনিয়ার ‘সর্ব্বশুভকরী সভা’-র একটি মুখপত্র প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় বিদ্যাসাগর ‘বাল্যবিবাহ’ প্রসঙ্গে এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কার ‘স্ত্রীশিক্ষা’ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন। স্ত্রীশিক্ষা-বিরোধীদের সমস্ত আপত্তি একে একে খণ্ডন করে মদনমোহন যে-প্রবন্ধটি লেখেন, স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে সমসাময়িক রচনার মধ্যে তা একটি অতি উৎকৃষ্ট রচনা। মদনমোহন দ্বারিকানাথ রায় সম্পাদিত সুলভ পত্রিকা-তেও (১৮৫৪-৫৫) স্ত্রীশিক্ষা-বিরোধীদের অভিমত দৃঢ়ভাবে খণ্ডন করে প্রবন্ধ লেখেন।

স্ত্রীশিক্ষার আন্দোলন যখন বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে, তখন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে সমাসীন এবং প্রধানত শিক্ষাসংস্কারের কাজে ব্যস্ত। ১৮৫৪-৫৫ সালে তিনি বাংলা ভাষায় শিক্ষার প্রসারকল্পে বাংলার ছোটলাট হ্যালিডের সহযোগিতায় গ্রামাঞ্চলে মডেল স্কুল স্থাপনে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ১৮৫৪ সালে ‘উড্‌স ডেসপ্যাচ’-এ স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে কোম্পানির ডিরেক্টররা প্রকাশ্যে তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন যে বালিকা বিদ্যালয়গুলিকেও যেন প্রয়োজনমতো সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়। হ্যালিডে ১৮৫৭ সালে প্রথম বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারকল্পে দৃঢ়ভাবে মনোনিবেশ করেন। স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ছিলেন তাঁর প্রধান সমর্থক ও সহায়ক। কিন্তু ছেলেদের শিক্ষার তুলনায় মেয়েদের শিক্ষার কাজ তত সহজ হয়নি।

স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে বাংলা সরকারের মনোভাব বিদ্যাসাগরের কাছে অনুকূল মনে হয়েছিল। তাঁর বিশ্বাস ছিল বালকদের শিক্ষার ব্যাপারে যেমন বাংলা সরকার তাঁকে সহযোগিতা করে এসেছেন তেমনই বালিকা শিক্ষার ক্ষেত্রেও পূর্ণ সমর্থন করবেন। এই বিশ্বাসে তিনি হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদিয়া এই চারটি জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৮৫৭ সালের শেষ দিক থেকে ১৮৫৮ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়গুলির ছাত্রীসংখ্যা ছিল ১৩০০-র মতো, অর্থাৎ খুবই উৎসাহব্যঞ্জক।১১

সর্বজনীন স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে ১৮৬৬ সালে মিস কার্পেন্টার (বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন) ভারতবর্ষে আসেন। তিনি শুনেছিলেন শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরই ছিলেন সবচেয়ে কর্তব্যনিষ্ঠ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। মিস কার্পেন্টার কলকাতায় পৌঁছেই তাই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তদানীন্তন ডিপিআই (Director of Public Instruction) অ্যাটকিনসন সাহেব একদিন বেথুন স্কুলে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কার্পেন্টার-এর পরিচয় করিয়ে দেন। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কার্পেন্টার কলকাতার কাছাকাছি কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয়ও পরিদর্শন করেন। সঙ্গে ছিলেন ডিপিআই অ্যাটকিনসন ও ইন্সপেক্টর মি. উড্রো।

বালিকা বিদ্যালয়গুলি পরিদর্শনের পর বিদ্যালয়গুলিতে নারী শিক্ষকের অভাবের বিষয়টি কার্পেন্টার বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন। নারীরাই নারীদের সবথেকে ভাল বোঝেন। তাই নারী শিক্ষক গড়ে তোলার মানসে কার্পেন্টার বেথুন স্কুলে একটি নর্মাল (নারী শিক্ষক প্রশিক্ষণ) স্কুল স্থাপনের ব্যাপারে সচেষ্ট হন। ব্রাহ্ম নারীসমাজ শিক্ষাদীক্ষায় যেহেতু অপেক্ষাকৃত অগ্রসর ছিল, তাই ব্রাহ্মসমাজে এই উদ্দেশ্যে একটি সভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় বিদ্যাসাগরও একজন সভ্য নিযুক্ত হন। কিন্তু নানা বাস্তব কারণে সভার উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ হয়নি। স্ত্রী নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের নীতিগত কোনও আপত্তি না থাকলেও সামাজিক কারণে আপত্তি ছিল। কারণ, অভিজ্ঞ বিদ্যাসাগর জানতেন সামাজিক বাধা এক্ষেত্রে দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে দাঁড়াবে। তিনি ১৮৬৭ সালে বাংলার ছোটলাট উইলিয়ম গ্রে সাহেবকে যে পত্র লেখেন তাতে জানান, কুসংস্কারাচ্ছন্ন শাস্ত্রীয় গোঁড়ামিতে ভরা এদেশে একদল দেশীয় শিক্ষয়িত্রী তৈরি করার জন্য মিস কার্পেন্টার যে পথ অবলম্বন করতে চান তা তাঁর কাছে অবান্তর বা অযৌক্তিক বলে মনে হয়। কারণ, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, উচ্চবিত্ত শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে স্ত্রী-অবরোধ প্রথা বলবৎ বা প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মসমাজও দু’-একটি ক্ষেত্র ছাড়া, তার ব্যতিক্রম নয়। বালবিধবাদের এ কাজে নিযুক্ত করার ব্যাপারে পরিবারের বাধা ছিল। তার সঙ্গে, বাল্যবিবাহ প্রথাও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা ছিল। কারণ, বালিকাদের সাধারণত আট/নয় বছরের মধ্যেই বিবাহ হয়ে যেত। তা ছাড়া, পরদাপ্রথা এমনই দৃঢ় ছিল যে, অনেক ক্ষেত্রে যে গাড়িতে মহিলা ছাত্রী বা শিক্ষিকারা স্কুলে যাবেন, সে গাড়ির সহিস বা গাড়োয়ান পুরুষ হলেও সমাজের আপত্তি উঠতে দেখা যেত। বেথুন স্কুলের সঙ্গে একটি নর্মাল স্কুল স্থাপন সংক্রান্ত মিস কার্পেন্টার প্রস্তাবিত বিষয়টি বিদ্যাসাগরের বিরূপ মনোভাব সত্ত্বেও বাংলা সরকার তা অনুমোদন করেন। কিন্তু তিন বছর পরীক্ষামূলকভাবে স্কুলটি চলার পরও প্রত্যাশানুযায়ী কোনও ফল না আসায় অবশেষে নর্মাল স্কুলটি বন্ধ করে দিতে হয়। ওইসময় বাংলার ছোটলাট ছিলেন স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল। তিনি ১৮৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ডিরেক্টরের নিকট এক আদেশপত্রে নারীদের ধর্মসংস্রবহীন শিক্ষা ও সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা দেওয়া বড়ই বিপজ্জনক— এ সম্পর্কে একমত হয়ে ফিমেল নর্মাল স্কুলটি তুলে দিতে বললেন।১২ এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরই যে সঠিক ছিলেন, তা প্রমাণিত হল।

এখানে উল্লেখযোগ্য, স্যার চার্লস উড (বোর্ড অব কন্ট্রোল-এর সভাপতি) ১৯ জুলাই, ১৮৫৪ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘ডেসপ্যাচ’ পাঠান। এদেশে উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক সনদের মতো। উডের শিক্ষাপ্রস্তাব বাস্তবায়ন ছোটলাট হ্যালিডের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। ভারত সরকার কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে তিনি শিক্ষাবিভাগ নামে পৃথক একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন, যার কাজ ছিল প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরে উডের ‘ডেসপ্যাচ’-এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। এই শিক্ষা সনদের বলে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলিকে সফলভাবে সচল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ শিক্ষাসম্পর্কিত আরও অনেক বিষয় ছিল। যেমন, হিন্দু কলেজকে (স্থাপিত ১৮১৭) প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তর (১৫ জুন ১৮৫৫) এবং কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই-এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা (১৮৫৭)। হ্যালিডে বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্্স্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা ছাড়াও বাংলার প্রত্যেকটি মহকুমায় অন্ততপক্ষে একটি সরকারি স্কুল এবং বেশ কিছু সংখ্যক সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। বলা বাহুল্য, এসব কাজে তিনি বিদ্যাসাগরের সহায়তা গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যে কমিটি গঠিত হয় বিদ্যাসাগর তার অন্যতম সদস্য ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে তিনি তার ‘ফেলো’ মনোনীত হন।১৩

আমরা নারীশিক্ষা সংক্রান্ত আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ১৮৫৭ সালের ৩০ মে-র একটি চিঠিতে বিদ্যাসাগর ডিপিআই-কে বর্ধমান জেলার জৌগঞ্জে নবপ্রতিষ্ঠিত একটি বালিকা বিদ্যালয় সম্পর্কে যে-চিঠি লিখেছেন, তার সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ এখানে তুলে ধরা হল। এই চিঠি থেকে সহজেই অনুমিত হয় স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের খুঁটিনাটি মনোযোগ কতটা গভীর ও আন্তরিক ছিল।

আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে এবং অত্যন্ত বিনীতভাবে জানাচ্ছি যে, বর্ধমানের জৌগঞ্জের অধিবাসীরা মডেল স্কুলের প্রধানশিক্ষকের পরামর্শ অনুযায়ী উক্ত গ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। স্কুল প্রতিষ্ঠার তারিখ গত ১৫ এপ্রিল, ১৮৫৮ এবং ওই বালিকা বিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে ৪ থেকে ১১ বছর বয়সি ২৮ জন ছাত্রী ভরতি হয়েছে, যাদের অধিকাংশই স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পরিবারের সন্তান। স্কুলটির অবস্থান স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বাবু নবগোপাল মজুমদারের বসত বাড়িতে। স্কুলটি সকালে বসে, এই স্কুলের শিক্ষকতা ও পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন স্থানীয় মডেল স্কুলের প্রধানশিক্ষক ও একজন সহকারী শিক্ষক। আমি প্রথমে ততটা আগ্রহ বোধ করিনি, কিন্তু এই সপ্তাহে স্কুলটি স্বচক্ষে পরিদর্শনশেষে আমার মনে এই আস্থা দৃঢ় হয়েছে যে, স্কুলটির উন্নতিবিধানের শত ভাগ সুযোগ রয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের আগ্রহ ও উৎসাহ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এবং ছাত্রীরাও অত্যন্ত আনন্দ, উৎসাহ ও মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করছে। স্কুলটি যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয় সেজন্য সরকারি অনুমোদন ও ব্যবস্থাপনার আশু প্রয়োজন। স্কুলের বর্তমান ছাত্রীসংখ্যা ২৮ জন হলেও তারা বিভিন্ন বয়সের। তাই তাদের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষাপরিকল্পনা প্রয়োজন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমার মতে অন্তত দুইজন শিক্ষক ও একজন আয়া প্রয়োজন এবং তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ কিছু টাকা। আপনাকে জ্ঞাপন ও আপনার সহৃদয় অনুমোদনের জন্য একটি টেবুলার স্টেটমেন্ট নিম্নে প্রদত্ত হল—

জৌগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়, জিলা বর্ধমান:

বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগর কর্তৃক ডিপিআই-এর কাছে লেখা পত্র তাঁর মন্তব্যসহ সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হয়। এর ফলে সরকার এই বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য মাসিক বত্রিশ টাকা সাহায্য মঞ্জুর করেন। এতে বোঝা যায়, সহকারী শিক্ষকের পদটি অনুমোদন পায়নি।

তবুও বিদ্যাসাগরের মনে অত্যন্ত আনন্দের সঞ্চার হল। তাঁর মনে হল, বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে সরকারের সমর্থন আছে। যদি আরও বালিকা বিদ্যালয় খোলা যায়, নিশ্চয়ই ন্যায্য প্রয়োজনীয় সরকারি সাহায্য পাওয়া যাবে।১৪

ভারতীয় মহিলাদের শিক্ষার ব্যাপারে বাংলা সরকারের এই মনোভাব বিদ্যাসাগরের কাছে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়। তিনি ইতিমধ্যে বালকদের জন্য অনেকগুলি বাংলা ভাষার স্কুল (Model Vernacular School) স্থাপন করেছেন। এখন তিনি বালিকাদের জন্য বাংলা স্কুল স্থাপনে অধিক মনোযোগ দিতে চান— অন্তত যেসব স্থানে বা জেলায় তিনি সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্বে নিযুক্ত আছেন। কাজেই একইভাবে ডিপিআই-এর কাছে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি এবং মাসিক অনুদানের আবেদন করেন। সেই অফিসারও, পূর্বের আদেশ অনুযায়ী অন্যান্যদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের আবেদনগুলি ছোটলাটের কাছে বিবেচনার জন্য প্রেরণ করেন।

নভেম্বর ১৮৫৭ থেকে মে ১৮৫৮ পর্যন্ত বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যেগুলিতে গড়ে প্রায় তেরোশো বালিকা উপস্থিত থাকত। যেসব গ্রামে স্কুলগুলি স্থাপিত হয়েছিল সেগুলির একটি তালিকা এখানে প্রদান করা হল (স্থান, স্কুল স্থাপনের তারিখ, মাসিক খরচ সহ)—

জেলা: হুগলি

স্থানস্কুল স্থাপনের তারিখটাকা
পটবা২৪ নভেম্বর ১৮৫৭২৯
দাসপুর২৬ নভেম্বর ১৮৫৭২০
বঁইচি১ ডিসেম্বর ১৮৫৭৩২
দিগসুই৭ ডিসেম্বর ১৮৫৭৩২
তালাণ্ডু৭ ডিসেম্বর ১৮৫৭২০
হাতিলা১৫ ডিসেম্বর ১৮৫৭২০
হয়েরা১৫ ডিসেম্বর ১৮৫৭২০
নপাড়া৩০ জানুয়ারি ১৮৫৮১৬
উদয়রাজপুর২ মার্চ ১৮৫৮২৫
রামজীবনপুর১৬ মার্চ ১৮৫৮২৫
আকাবপুর২৮ মার্চ ১৮৫৮২৫
শিয়াখালা১ এপ্রিল ১৮৫৮২০
মাহেশ১ এপ্রিল ১৮৫৮২৫
বীরসিংহ১ এপ্রিল ১৮৫৮২০
গোয়ালসারা৪ এপ্রিল ১৮৫৮২৫
দণ্ডীপুর৫ এপ্রিল ১৮৫৮২৫
দেপুর১ মে ১৮৫৮২৫
রাউজাপুর১ মে ১৮৫৮২৫
মলয়পুর১২ মে ১৮৫৮২৫
বিষ্ণুদাসপুর১৫ মে ১৮৫৮২০

জেলা: বর্ধমান

রানাপাড়া১ ডিসেম্বর ১৮৫৭২০
জাম্বুই২৫ জানুয়ারি ১৮৫৮৩০
শ্রীকৃষ্ণপুর২৬ জানুয়ারি ১৮৫৮২৫
রাজারামপুর২৬ জানুয়ারি ১৮৫৮২৫
জ্যোৎশ্রীরামপুর২৭ জানুয়ারি ১৮৫৮২৫
দাইহাট১ মার্চ ১৮৫৮২০
কাশীপুর১ মার্চ ১৮৫৮২১
সাপুই১৫ এপ্রিল ১৮৫৮২৫
রসুলপুর২৬ এপ্রিল ১৮৫৮৩১
বন্তীর২৭ এপ্রিল ১৮৫৮২০
বেলগাছি১ মে ১৮৫৮২০

জেলা: মেদিনীপুর

ভাঙাবন্ধ১ জানুয়ারি ১৮৫৮৩০
বদলগঞ্জ১০ মে ১৮৫৮৩১
শান্তিপুর১৫ মে ১৮৫৮২০

জেলা: নদিয়া

নদিয়া১ মে ১৮৫৮২৮

[তথ্যসূত্র: Brajendranath Banerji, ‘Ishwar Chandra Vidyasagar as a Promoter of Female Education of Bengal’, The Golden Book of Vidyasagar, p. 366]

অর্থাৎ এই তালিকা মোতাবেক বিদ্যালয়গুলির জন্য মাসিক খরচ হত ৮৪৫ টাকা। কাজেই বালিকা বিদ্যালয়গুলির এই বিপুল মাসিক ব্যয় নির্বাহের জন্য বিদ্যাসাগর ডিপিআই-এর মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে আবেদন করলেন। এখানে বলা ভাল, তিনি বাংলার ছোটলাট হ্যালিডের মৌখিক আদেশ পেয়েই এ কাজে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা গেল, ভারত সরকার বিমুখ। ভারত সরকারের অনুমোদন ব্যতীত আগেই স্থাপিত এই বালিকা বিদ্যালয়গুলির জন্য কোনও সাহায্য মঞ্জুর হল না। অবশ্য বিদ্যাসাগরের এক্ষেত্রে একটি ভুল হয়ে গিয়েছিল, তিনি বালিকা বিদ্যালয়গুলি খোলার আগে সরকারের লিখিত অনুমতি নেননি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এ ব্যাপারে সরকার যেহেতু অনিচ্ছুক নয়, স্কুলগুলি সব আনুষ্ঠানিকতা মেনে স্থাপিত হলে সরকারি সাহায্য অবশ্যই পাওয়া যাবে। আরও একটি সমস্যা হল, বালিকা বিদ্যালয়গুলির শিক্ষকেরা স্কুলের শুরু থেকেই কোনও বেতন পাননি। ১৮৫৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত হিসেব করলে তাঁদের পাওনা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩৫০০ (৩৪৩৯) টাকা। এই টাকা কোথা থেকে আসবে? যদি সরকার একান্তই না দেয়, তবে অবশ্যই তা স্বয়ং বিদ্যাসাগরকেই বহন করতে হবে।

এই বিষয়ে ১৮৫৮ সালের ২৪ জুন বিদ্যাসাগর ডিপিআই-কে যে-চিঠি লিখেছিলেন তার বাংলা অনুবাদ আমরা শ্রীবিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ গ্রন্থ থেকে তুলে ধরছি:

হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া ও মেদিনীপুর জেলায় কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, এই বিশ্বাস নিয়ে যে সরকার সেগুলিকে আর্থিক সাহায্য করবেন। এখন মনে হচ্ছে, ভারত সরকার এই শর্তে সাহায্য করতে ইচ্ছুক নন, কাজেই স্কুলগুলি হয়ত তুলে দিতে হবে। কিন্তু শিক্ষকরা গোড়া থেকেই বেতন পাননি; তাঁদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়া দরকার। আশা করি সরকার তা দেবেন। সরকারী আদেশ পাবার আগেই আমি অবশ্য স্কুলগুলি চালাবার ব্যবস্থা করেছিলাম। প্রথমে আপনি, অথবা বাংলা সরকার এ-বিষয়ে কোনও অমত প্রকাশ করেননি। তা করলে এতগুলি বিদ্যালয় খুলে আমাকে এমনভাবে বিপন্ন হতে হত না। স্কুলের শিক্ষকরা স্বভাবতই বেতনের জন্য আমারই মুখের দিকে চেয়ে থাকবেন। যদি আমাকে নিজেকে এতগুলি টাকা দিতে হয়, তাহলে আমার উপর খুবই অন্যায় করা হবে। এ অবস্থায় আমি আপনার কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি যেন বিষয়টি সরকারের সহৃদয় অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়।

বিদ্যাসাগরের বক্তব্য বাংলা সরকারের গোচরে আনলেন ডিপিআই। তাঁর বিবেচনায় কর্তৃপক্ষের সাহায্য ও সহানুভূতি বিদ্যাসাগরের প্রাপ্য। ডিরেক্টর বাংলা সরকারকে বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে অনুমোদন ও সাহায্য মঞ্জুরের জন্য সুপারিশ করে পাঠালেন।

এরপর এ বিষয়ে ডিপিআই, বাংলা সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে বেশ কিছু পত্র বিনিময় হয়। অবশেষে ভারত সরকার ১৮৫৮ সালের ২২ ডিসেম্বর তাঁদের পত্রে লেখেন, দেখা যাচ্ছে যে, পণ্ডিত মহাশয় আন্তরিক বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে এবং সরকারি কর্মচারীদের উৎসাহ ও সম্মতি পেয়ে এ কাজ করেছেন। এই কথা বিবেচনা করে, এইসব বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য যে ৩৪৩৯ টাকা মোট ব্যয় হয়েছে, সেই টাকার দায় থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হল। সরকার এই টাকা দিয়ে দেবেন। তবে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির অথবা অন্য সরকারি বিদ্যালয়ের খরচের জন্য কোনও স্থায়ী অর্থ সাহায্য করা সম্ভব নয়। এ-সংক্রান্ত সমস্ত চিঠিপত্র Secretary of state-এর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তা ছাড়া, বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য অনধিক ১০০০ টাকা সাহায্যের অনুরোধও ইংল্যান্ড সরকারকে জানানো হবে। টাকা পাওয়া গেলে তার কিছুটা অংশ সরকার সমর্থিত মডেল স্কুলের জন্য ব্যয় করা হবে।১৫

কিন্তু Secretary of State এই মাসিক ১০০০ টাকা মঞ্জুর করেননি। এ সম্পর্কে ১৮৫৯ সালের ১ আগস্ট সোমপ্রকাশ পত্রিকা যে-সম্পাদকীয় লেখেন তাতে শেষে বলা হয়েছে: ‘… ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের কাছে বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ে মাসিক সহস্র মুদ্রা দান অতি সামান্য কথা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনেক কষ্টে সেই সামান্য বিষয়ে অত্রত্য সুপ্রিম গভর্ণমেণ্টের (ভারত সরকারের) যদিও মত করিলেন, কিন্তু ইংলণ্ডীয় কর্তৃপক্ষ তদ্বিষয়ে অনুমোদন করিলেন না।…’

অবশ্য এ কথা সত্য যে, ভারত সরকার তখন সিপাহি বিদ্রোহের (১৮৫৭) দুশ্চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থব্যয় করার মতো আর্থিক অবস্থা বা মনোভাব কোনওটাই তাদের ছিল না। অবস্থার চেয়ে মনোভাবের বিরূপতাই বড় কথা ছিল। বিদ্যাসাগরের বন্ধু দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সোমপ্রকাশ পত্রিকায় লিখেছিলেন— স্বদেশের হিতানুষ্ঠানের ব্যাপার হলে বিদ্যাসাগরের কোনও ‘জ্ঞানগম্য’ থাকত না। কথাটা সত্য। সমাজের কল্যাণকর্মে বিদ্যাসাগরের উৎসাহ বন্যার বেগে প্রকাশ পেত এবং মাঝে মাঝে অতি উৎসাহের বশে তিনি অদূরদর্শীর মতো কাজ করে বসতেন। বালিকা বিদ্যালয়গুলি স্থাপনের সময়েও তা-ই করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন ছোটলাটের সমর্থনই যথেষ্ট, দুর্ভাবনার কোনও কারণ নেই। কিন্তু যথার্থই যখন দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দেখা দিল, তখনও তিনি ব্যথিত ও হতাশ হলেও, একেবারে ধৈর্য হারাননি।

দক্ষিণবাংলার ‘ইন্সপেক্টর অব স্কুলস’ প্লাট সাহেব ছুটি নিয়ে ইংল্যান্ড চলে গেলেন। বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন ওই পদে তিনি নিযুক্তি পাবেন। হ্যালিডের সঙ্গে এ ব্যাপারে তাঁর কিছু আলোচনাও হয়েছিল। তিনি হ্যালিডে সাহেবকে চিঠিও লিখেছিলেন (১৮৫৭ সালের মে মাস) তাতে তাঁর মনোভাবও কিছুটা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের এই চিঠি হ্যালিডের কাছে পৌঁছনোর আগেই হ্যালিডে লজ সাহেবকে ওই পদে নিয়োগ দিয়ে দেন। বিদ্যাসাগরের অসাধারণ নিষ্ঠা ও কর্মনৈপুণ্য এক্ষেত্রে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আসেনি। তা ছাড়া, ডিপিআই গর্ডন ইয়ং সাহেবের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভাল চলছিল না। তাই তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু হ্যালিডের অনুরোধে আরও এক বছর কাজ চালিয়ে যেতে স্বীকৃত হন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁর তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে সহজ ছিল না, কারণ তখন তিনি মাসিক ৫০০ টাকারও অধিক বেতন পেতেন। তা ছাড়া, তাঁর স্থাপিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বিষয়টি তো ছিলই। কিন্তু মনঃপীড়া ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। তাই ১৮৫৮ সালের ৩ নভেম্বর তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করেন। আর্থিক অসচ্ছলতা ও নানারকমের দুশ্চিন্তার মধ্যেও বিদ্যাসাগর তাঁর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। তিনি নানা চিন্তাভাবনার পর বিদ্যালয়গুলি পরিচালনার জন্য একটি নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাণ্ডার খোলেন। এই প্রতিষ্ঠানে পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ প্রমুখ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারবৃন্দ নিয়মিত চাঁদা দিতেন। তৎকালীন ছোটলাট বিডন সাহেবও মাসিক ৫৫ টাকা সাহায্য করতেন। এইভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়েও তিনি বালিকা বিদ্যালয়গুলি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। বিদ্যাসাগরের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এই যে, বেশিরভাগ কাজই তিনি প্রচণ্ড জেদের তথা আত্মবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে আরম্ভ করতেন এবং তার চূড়ান্ত ফলাফল না-দেখা পর্যন্ত ক্ষান্ত হতেন না। এজন্য অনেক ক্ষেত্রে তাঁকে হতাশও হতে হয়েছে।১৬

সতেরো বছরের (১৮৪১-১৮৫৮) চাকুরিজীবনের মধ্যে দীর্ঘ নয় বছর তিনি সংস্কৃত কলেজের পরিচালনা ও শিক্ষার ব্যাপারে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই নয় বছরের মধ্যে শিক্ষাসংস্কারের বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করেন। এই পরিকল্পনাগুলির মূল সুরটি হল মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার এবং উন্নত বাংলা ভাষার ভিত্তির উপর সমৃদ্ধ নতুন বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা। এই আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় বিদ্যার আন্তরিক অনুশীলনকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

১৮৫৮ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পরও তিনি নিজস্ব উদ্যোগে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় যাতে সরকারি অনুদান পায় তারজন্য গভর্নমেন্টের কাছে ক্রমাগত আবেদন করে গেছেন। এর ফলও অবশ্য পেয়েছেন। হুগলি ও বর্ধমানে ৭টি বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য বিদ্যাসাগর ১৮৬২ সালের ১৫ অগস্ট বাংলা সরকারের কাছে যে আবেদন করেন তাতে সাড়া দিয়ে সরকার সেই সাহায্য অনুমোদন করেন।১৭

এইভাবে স্ত্রীশিক্ষার অবস্থার ক্রমশ উন্নতি হয়েছে। রাতারাতি কিছু হয়নি। স্বয়ং বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে স্যার বার্টল ফ্রিয়ার-কে ১৮৬৩ সালের ১১ অক্টোবর একটি চিঠি লেখেন, যার অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হল:

You will no doubt be glad to hear that the Mufussil Female schools, to the support of which you so kindly contributed, are progressing satisfactorily. Female education has begun to be gradually appreciated by the people of districts contiguous to Calcutta, and schools are being opened from time to time.১৮

বিধবাবিবাহ আইন পাশ (১৬ জুলাই ১৮৫৬) এবং কার্যক্ষেত্রেও তার প্রয়োগ বিদ্যাসাগরের নিজের মতে তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। কিন্তু এদেশে শিক্ষা বিস্তার ও শিক্ষাসংস্কারের কাজেও তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবে। তাঁর অন্যতম মহৎ কীর্তি ‘মেট্রোপলিটান কলেজ’ (আজকের ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’) প্রতিষ্ঠা (১৮৭৩)। উত্তর কলকাতার শঙ্কর ঘোষ লেনে ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল’ নামে একটি স্কুল ছিল। স্কুলটির অবস্থা তখন খারাপ যাচ্ছিল। তাই স্কুল পরিচালনা কমিটি উপযুক্ত বিবেচনায় এই স্কুলের সার্বিক দায়িত্ব বিদ্যাসাগরের ওপর অর্পণ করেন। বিদ্যাসাগর দায়িত্ব নিয়েই এই স্কুলের নতুন নামকরণ করেন ‘দ্য হিন্দু মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন’ (১৮৬৪)। বিদ্যাসাগরের পরিচালনা-নৈপুণ্যে এটি দ্রুত উন্নতি করতে থাকে। কিছুকাল পর তিনি ‘দি হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ’ শাখারও প্রতিষ্ঠা করেন। এটিও দ্রুত উন্নতিলাভ করতে থাকে এবং জনসাধারণও এই কলেজটিকে সানন্দে গ্রহণ করেন। দেশীয় প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত এটিই সর্বপ্রথম কলেজ, যেখানে এদেশীয় ছাত্ররা পাশ্চাত্য শিক্ষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চারিত্রপূজা গ্রন্থে ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ প্রবন্ধে লিখেছেন— ‘… বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি-সোদর কেহ ছিল না। এদেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন।… এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ, তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।… দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’১৯

টীকা ও তথ্যনির্দেশ

. গোলাম মুরশিদ, বিদ্যাসাগর (ঢাকা: শোভাপ্রকাশ, ২য় প্রকাশ, মে ২০১৬), পৃ. ৩১।

. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., ৭ম মুদ্রণ, মার্চ ২০১২), পৃ. ১৮৩।

. Jogesh Chandra Bagal, Women’s Education in Eastern India: The First Phase (World Press: Calcutta, 1956), p. 69.

. বিনয় ঘোষ, ‘স্ত্রীশিক্ষা’, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (কলকাতা: ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১১), পৃ. ২১৭।

. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৮৭।

৬. তদেব, পৃ. ১৮৮।

. বিনয় ঘোষ, ‘স্ত্রীশিক্ষা’, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ২২৮।

. শ্রীচণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্ত্রীশিক্ষায় বিদ্যাসাগর, (কলিকাতা: বিদ্যাশাখা, ১৩৭৬ ব.), পৃ. ১৬৫।

. বিনয় ঘোষ, ‘স্ত্রীশিক্ষা’, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ২১৭।

১০. ‌তদেব, পৃ. ২১৯।

১১. তদেব, পৃ. ২২২; ঈষৎ পরিবর্তিত।

১২. ড. প্রথমা রায় মণ্ডল, বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরচর্চা (কলকাতা: বিশ্বকোষ পরিষদ, নভেম্বর ২০০০), পৃ. ২৪১।

১৩. বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি, খণ্ড ১০, পৃ. ৫১৭; ঈষৎ পরিবর্তিত।

১৪. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ২০৪।

১৫. বিনয় ঘোষ, ‘স্ত্রীশিক্ষা’, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ২২৫।

১৬. তদেব, পৃ. ২২৬।

১৭. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ২২২।

১৮. তদেব, পৃ. ২২২।

১৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘চারিত্রপূজা’, রবীন্দ্রসমগ্র, খণ্ড ২, পাঠক সমাবেশ, বাংলাদেশ, ২০১১, পৃ. ৭৮২।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *