ঈশ্বর
রাজধানীর পুরনো বইয়ের মার্কেট। পুরনো বইয়ের মত দোকানগুলোও অনেক পুরনো। প্রতিটা দোকানের দৈর্ঘ্য প্রস্থ কবরের দৈর্ঘ্য প্রস্থের প্রায় সমান। প্রতিটা দোকানেই একটা স্যাঁতস্যাঁতে অথচ মিষ্টি গন্ধ। যত ভেতরে যাওয়া যায়। তত অন্ধকার।
ঈশ্বর বাগচী অন্ধকারেই থাকেন। তার বইয়ের দোকানটা একেবারে ভেতরে। শেষ দোকানটা। ফিরোজের যতদুর মনে পড়ছে, তিনি ঠিক রাস্তাতেই যাচ্ছেন। আশেপাশের দোকান থেকে ডাকছে, “ভাই কী লাগবে আসেন।” ‘ভাইয়া বলেন কী লাগবে।” ফিরোজ সরু গলিগুলোর বাঁক ঘুরে ঈশ্বর বাগচীর পুরনো বইয়ের দোকানটা খুঁজতে লাগলেন।
মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল। আশফাক চৌধুরীর ফোন।
“হ্যালো ফিরোজ?” আশফাক চৌধুরীর বিরক্তি মিশ্রিত গলা।
“হ্যাঁ, বলেন।”
“বহরমপুরে লাশ পাওয়া যাচ্ছে শুনেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“বুঝতে পারছেন কারা এটা করছে? সরকারি দলের প্রতিনিধিদেরকে এভাবে মেরে টাঙ্গিয়ে রাখছে কারা বুঝতে পারছেন? বশিরের বাচ্চা বশির এই কাজটা করাচ্ছে। শয়তানটাকে আপনিই নরক থেকে ডেকে এনেছিলেন। এইবার?”
ফিরোজ নীরব। তিনি বুঝতে পারছেন এটা কারা করছে। প্ল্যাকার্ড দেখলেই বোঝা যায় এরা কারা। সেই পলাতক তিনজন। যাদেরকে পুলিশ খুঁজছে। খুঁজছেন ফিরোজ হক। MRAU এর এজেন্টরা শিকারী কুকুরের মত এই তিনজনকে খুঁজছে। যারা মারা যাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকে এই তিনজনকে একসময় ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক কাজে। নোংরা কাজে। মেজর ফিরোজ ধারণা করছেন, ঠিক এই কারণেই হয়ত ওরা এই লোকগুলোকে খুন করেছে। যারা রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে ওপরে ওঠে, তাদেরকে রক্তপিপাসু কুকুর অনুসরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। প্ল্যাকার্ডের লেখা দুটো লাইন তো তাই বলে।
কিন্তু আশফাক চৌধুরী কিভাবে জানলেন যে বশির বেঁচে আছে?
“কী হল ফিরোজ? চুপ করে আছেন কেন? প্রধানমন্ত্রী কাল মিটিং ডেকেছেন। কর্মীদেরকে এভাবে মেরে ঝুলিয়ে রাখছে কে তিনি জানতে চান। আমি কি বলব কারা এই কাজ করছে? আর কেই বা এই পাগলা কুকুরগুলোকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে?” আশফাক চৌধুরী যেন ফিরোজকেই পাগলা কুকুর বললেন।
ফিরোজ শীতল কণ্ঠে বললেন, “এখনও তিনদিন আছে। আমি আপনার সাথে ঠিক সময়ে যোগাযোগ করব। আর একটা কথা, দয়া করে কাল মিটিং-এ বের হবেন না।”
“কেন? কেন বের হব না? আপনার কথামত এখন আমাকে চলতে হবে?”
“আপনার ভালোর জন্য বলছি। প্লিজ। যতক্ষণ না পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে ততক্ষণ বের হবেন না।”
“জ্ঞান দিতে হবে না। এই পাগলা কুকুরগুলোকে খুঁজে বের করেন তাড়াতাড়ি।”
আশফাক চৌধুরী নিজেই খেঁকিয়ে উঠলেন। লাইনটা কেটে গেল। ফিরোজ সাহেব অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন। হাতে সময় কম। দোকানটা খুঁজে বের করতে হবে। এই একটা মানুষই তাকে এখন বাঁচাতে পারে। ঈশ্বর বাগচী। বারো বছর আগের ঋত শোধ করবেন না ঈশ্বর বাগচী? অবশ্যই করবেন। আজ থেকে বিশ বছর আগে বাগচী একটা উপহার দিয়েছিল ফিরোজকে। রুস্তম। আজ আবার ঈশ্বর বাগচীর কাছে হাত পাততে এসেছেন ফিরোজ, বাধ্য হয়ে
আস্তে আস্তে রোদ কমে এলো। অন্ধকার বাড়তে লাগল। মাথার ওপরে ফুটো টিনের ছাপড়া দিয়ে রোদের ফুটকি ছাড়া আর কোন রোদ নেই। ঘিঞ্জি বইয়ের দোকানগুলো আর অলিগলির ভাঁজে ফিরোজ শুধু সামনেই যেতে থাকলেন। একটা ছোট্ট চায়ের টং দেখতে পেলেন তিনি। অন্ধকার টং-এ এক কালো কুচকুচে বুড়ো বসে বসে চা বিক্রি করছে। ফিরোজ লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাগচীর দোকানটা কোন দিকে?”
লোকটা বলল, “পাঁচ দুকান সামনে।”
পাঁচ দোকান সামনে যেতেই ফিরোজ ঈশ্বর বাগচীর বইয়ের দোকানটা খুঁজে পেলেন। বইয়ের দোকানের ভেতরটা সরু, লম্বা। কফিনের মত। শুধু একজন কোনমতে যেতে পারবে। অন্ধকার দোকানের শেষ মাথায় রোদ পড়ছে। সেই রোদে বসে এক লোক কুঁজো হয়ে বই পড়ছেন। চকচকে টাক মাথা। শুভ্র শত্রুতে পুরো মুখমন্ডল ঢাকা। পরনে সাদা ফতুয়া আর সাদা ধুতি। ইনিই ঈশ্বর বাগচী। যিনি প্রতিটা জীবনের বিনিময়ে একটা মৃত্যু দেন। আর একটা মৃত্যুর বিনিময়ে একটা জীবন। তার অতীত সম্পর্কে কেউ জানে না। যারা জানত ধারণা করা হয় তারা কেউ মারা গিয়েছে, কেউ হারিয়ে গিয়েছে। সমাজের ভেতরের আরেকটা সমাজের অধিপতি তিনি। অন্ধকার সমাজ। সেই সমাজের প্রতিটা মানুষ তার কথায় ওঠে বসে। পুলিশ এবং প্রশাসনের হাতের নাগালেরও অনেক বাইরে এই সমাজ। এখানে আশ্রয় চাইলে আশ্রয় পাওয়া যায়। একটা শর্তে। যেকোন সময়, যেকোন মুহূর্তে সমাজের হয়ে একজনকে খুন করতে হবে। খুন করতে পারলেই সমাজ আমন্ত্রণ জানাবে। কিন্তু সেই সমাজ থেকে ফেরার কোন পথ থাকবে না। এই সমাজের নাম ‘ছায়া সংঘ’। জনগণ তাই দেখে, যা ছায়া সংঘ তাদেরকে দেখায়।
ফিরোজ অন্ধকার পেরিয়ে দোকানের শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়ালেন। এতবড় ক্ষমতাধর একজন মানুষ বাগচী, অথচ কখনও তার আশেপাশে কোন দেহরক্ষী দেখেননি ফিরোজ। আজও কেউ নেই।
মাথা নিচু করে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেন ফিরোজ। এই ফিরোজকে কেউ চেনে না। শুধু বাগচী চেনেন। এই একটা জায়গাতেই ফিরোজ নিজেকে আত্মসমর্পন করেন। আজ থেকে বার বছর আগে বাগচীই তাকে বলেছিলেন, বন্দুক পিস্তল দিয়ে কখনও সমস্যা সমাধান হয় না। কখনও কোন সমস্যার সমাধান না করতে পারলে তখনই কেবল পিস্তল ব্যবহার করা উচিত। আর এটাও মাথায় রাখা উচিত, পিস্তল চালানো মানে আরেকটা সমস্যা ডেকে আনা। এই সমস্যাটা আগের সমস্যার চাইতে সহজও হতে পারে। আবার কঠিনও হতে পারে। ফিরোজ মনে প্রাণে সেই কথা মেনে চলার চেষ্টা করে আসছে।
বাগচী আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরোজের দিকে তাকালেন। কুঁচকে যাওয়া চামড়ার অক্ষিকোটরে একজোড়া কালো চোখ। সেই চোখের দৃষ্টি যেন একটা মানুষের জীবন শুষে নিতে পারে। আবার মৃত মানুষে জীবন দিয়েও দিতে পারে।
বাগচী বলল, “আরে ফিরোজ নাকি! বসো বসো। এতদিন পরে মনে পড়ল বাগচীকে? বাগচীর গলায় বালক সুলভ চপলতা। পাশের অন্ধকার থেকে একটা তেল চিটচিটে কাঠের টুল এগিয়ে দিলেন ফিরোজের দিকে।” ফিরোজ টুলটা টেনে নিয়ে বসলেন। বললেন, “কেমন আছ বাগচীদা?”
“এইতো আছি। বই পড়ে কেটে যাচ্ছে। আগে মৃত কবিদের জন্য কবিতা শিকার করতাম, আর এখন মৃত কবিতার জন্য কবিদের শিকার করি। তুমি কেমন আছ? জানি ভালো নেই। হা হা হা। ভালো থাকলে কেউ ঈশ্বরকে স্মরণ করে না।”
“হ্যাঁ। ভালো নেই বাগচীদা। খুব বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি।”
“জানি। ওই যে বললাম, বিপদে না পড়লে কেউ এই ঈশ্বরকে মনে রাখে না রে।”
“না ছি ছি। এভাবে বলো না। আসলে…… আচ্ছা তোমাকে শুরু থেকে বলি।”
ফিরোজ প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের আদ্যপান্ত বলল ঈশ্বর বাগচীকে। বাগচী খুব মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, “আরে মানুষ কেন অপরাধী হয় এর জন্য আবার গবেষণা করা লাগে নাকি? মানুষ অপরাধী হয় আহত হলে। ক্ষত অপরাধী সৃষ্টি করে। প্রতিটা মানুষ নিজের ভেতরে একটা ক্ষত নিয়ে বেড়ায় ফিরোজ। সেই ক্ষতের যন্ত্রণা যখন কেউ আর সহ্য করতে পারে না, তখনই অপরাধী হয়ে যায়।” কথাগুলো বেশ সময় নিয়ে বললেন ঈশ্বর বাগচী।
দুজনেই নীরব। ফিরোজ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর বললেন, “মেয়েটা ভালো আছে তো বাগচীদা?”
“কোন মেয়েটা? ও হ্যাঁ। ভালোই আছে।”
প্যান্টের পকেট থেকে এবার ফিরোজ একটা ছবি বের করলেন। বাড়িয়ে ধরলেন বাগচীর দিকে। এর মানে বাগচীও যেমন জানে, ঠিক তেমনই ফিরোজও জানে।
“কোথায় থাকে?” বাগচী জিজ্ঞাসা করলেন।
“দ্বীপশহর। উরসুলা এপার্টমেন্ট।”
“নাম?”
“খাইরুল ইসলাম। ওর কাছে একটা চাবি থাকবে। ধাতব পাত লাগানো একটা চাবি। চাবিটাও লাগবে।”
“ফিরোজ?”
“জী বলেন।”
“তুমি নিজে কেন করছ না কাজটা?”
“লোকটা সরকারি কর্মকর্তা। কাজেই তার গায়ে হাত দেওয়া আমার জন্য অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। তাই আপনার কাছে আসা।”
ঈশ্বর বাগচী ছবিটা ফতুয়ার পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বললেন, “হুম।” কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “একটু দেখে শুনে থেকো ফিরোজ। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে আরও অনেকগুলো পাপ করে ফেলা কাজের কথা না। যে কাজটা তুমি করছ তাতে একটু ভুল হয়ে গেলে সবাই শেষ হয়ে যাবে। এই পাপের কালি খুব বিষাক্ত, তোমাকেও ছাড়বে না।”
ফিরোজ একবার ভাবল, ঈশ্বর বাগচীকে ওই তিনজনের কথাও বলা উচিত। যদি তিনি কোন সাহায্য করতে পারেন। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদলালেন। এই সমস্যার সমাধান তিনি নিজে করবেন। ফিরোজ ঈশ্বর বাগচীকে বিদায় জানালেন। ঈশ্বর বাগচী আবার বই পড়ায় মন দিলেন।
ঈশ্বর বাগচীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে আসতেই ফিরোজের মনে হল, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হয়নি। এখন কোনভাবে মেরিলিনাকে দিয়ে বশির জামানের কাছে পৌঁছাতে পারলেই বাকি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ল্যান্ডরোভারটা মোড় ঘুরে MRAU এর সদর দপ্তরের দিকে রওনা হয়ে গেল। আর সেটার পিছু নিল একটা কালো টয়োটা।