ঈশা
এখনও রোদটা তেমন ভয়ংকর হয়ে ওঠেনি। রুদ্ররূপ, চণ্ডভণ্ড প্রকাণ্ড নির্মম। এইভাবে অন্ধ্রের রোদকে ভাবে সে। জানলাগুলো যারা শুধুমাত্র কাচের করেছিল, তারা ভেবেছিল জলজ্যান্ত ভারতবর্ষের এক্কেবারে কোলের ওপর একখণ্ড ফ্রিজ-ঠান্ডা ইয়োরোপ বসিয়ে দেওয়া যায়। ভিন্ন ভূগোল, ভিন্ন ঋতুরঙ্গ, ভিন্ন অভ্যেস ও প্রয়োজনের কথা আদৌ ভাবেনি। দু শতাব্দীর বিলেত-স্বপ্ন দু চোখে মেখে ভেবেছিল এখানে এ.সি থাকবে, কেউ আর দেশটা গরম বলে বুঝতে পারবে না। ভেবেছিল ধুলো ময়লা এখানে হবে না। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে, ম্যাজিক আই দিয়ে দেখে নিয়ে দরজা না খুললেই হল। মে জুন মাসের পাওয়ার কাট-এর সময়ে এলে টেরটা পাবে তারা। এক দিকে বিন্ধ্য অন্য দিকে গোদাবরী, মাঝে তপ্ত কটাহ। তবে হ্যাঁ, শীত, যাকে গ্রীষ্মদেশের লোকেরা সবচেয়ে ভালবাসে, সেই শীত এখানে নেই।
ভারী ভারী পর্দাগুলোকে টেনে টেনে জানলা ছায়, কাচ ছায় ঈশা ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে। হালকা হলুদের ওপর এক বর্ণচ্ছায় গাঢ় হলুদ মোটিফ বসানো চমৎকার পর্দা সব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। কেননা এ তো রৌদ্রশোষক রং নয় একেবারেই। ঘন সবুজ, গাঢ় মেরুন কি খয়েরি ছিল ঠিকঠাক রং। কিন্তু রুচির সঙ্গে প্রয়োজনের প্রায়ই মতে মেলে না। সাত হাজার টাকার পর্দা কিনে শেষ শীতে মুখ আলো করে ফিরেছিল দম্পতি। হালকা চন্দন দেওয়াল। তাতে হলুদ পর্দার আভা সিলিং পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। কী সুন্দর! এখন রোদের তাপের সঙ্গে নিজের তাপ যোগ করে, ফেরত পাঠাচ্ছে সেই শখের পর্দা।
জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখো, সেখানেও কোনও স্নিগ্ধ সবুজ নেই। মেটে মেটে রং। কাজ হচ্ছে। লরি এসে উজাড় করে দিয়ে যাচ্ছে পাথরকুচি। মিক্সার মেশিন ঘড়ঘড় করে ঘুরছে। থামের খাঁচা তৈরি, এবার ভেতর ভরাট করার পালা। আরও হাউজিং উঠছে, আরও। পরে গাছপালা, ঘাস লাগানো হবে মাটির ন্যাড়া গা ঢাকতে, বাগিচা-বাহার। কিন্তু আপাতত ধূলিবসন পশ্চিম রুদ্রামাপল্লির এই তিন নম্বর তিরুপতি কমপ্লেক্স। জুবিলি হিলস পেরিয়ে আধুনিক সাইবারাবাদের বাড়িগুলো তৈরি হচ্ছে। সেখানে হয়তো পাওয়ার কাট হবে না। এমন একান্ত সাধনায় নির্জন নিঃশব্দ ছিল অনেক দিন এই প্রাচীন শহরিকা, তার খানদানি ইতিহাসের ধ্যানে, পৃথিবী পালটে যাচ্ছে খেয়াল করেনি। গণ বিস্ফোরণে আর যন্ত্রসাধনায় ছিটকে উড়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে ধ্যান। চারমিনারে পুরনোকে অন্তরিন রেখে চকচকে ঝকঝকে করে গড়ে উঠেছে যমজ শহর। কে বলবে এখানেই আছে গোলকোন্ডার গোলালো দুর্গ—বহু প্রাচীন, কে বলবে রয়েছে অত সমাধি মন্দির। ঠিক যেমন কে বলবে তার জীবনে একদিন খড়খড়ি দেওয়া সবুজ জানলা ছিল!
আলোছায়ায় ভরা সেই ঘরটা কি মনে পড়ে ঈশা? লম্বাটে, অন্তত ষোলো সতেরো ফুট লম্বা ঘরখানা? সাত-সাতটা জানলা! মেঝেতে ঠাম্মার বিয়ের শীতলপাটি বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে কত গল্প করত তারা তিনজন—সে, মা, আর…আর ভাই। খড়খড়ি দিয়ে পথচলতি মানুষের উলটো ছায়া পড়ত সিলিং-বরাবর। ভাই বলত—সিনেমা।
আস্তে করে গান চালিয়ে দিয়েছে মা ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী।’ গানটা মার খুব প্রিয়, নিজেও গুনগুন করে গায়, চুপ-ঘরের আধো-আঁধারে সে ভাবত সুরের আলো গগন ছেয়ে ফেলছে। সুরের হাওয়া গগন বেয়ে চলছে, সে কেমন সুর? কেমন তার গায়ক? ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম সব ভাবনা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মনে কি পড়ে ঈশা? অন্যরকম দিনকাল সে সব, নয়? খড়খড়িটা একটু তুলে রাস্তার চল-জীবন দেখা সেই! ছাতা মাথায় লোক, ‘চারুলতা’ সিনেমার মতো, বাসন বাজাতে বাজাতে বাসনঅলা, ফুচকাঅলা, পিঠের ওপর অবলীলায় ঝাঁক ঝাঁক বেডকভার নিয়ে একটা লোক যেত! চৌখুপি-চৌখুপি, আবার এই অন্ধ্রর বেডকভারও তাতে থাকত, সে এখন পেছন ফিরে তাকিয়ে চিনতে পারে। অন্যদিকে রাস্তা নয়, হরেন জ্যাঠামশায়দের বাড়ি। খড়খড়ির পটোলচেরা চোখ সেখানে খাঁ-খাঁ দুপুরের উঠোনে তারের ওপর সার সার কাপড় শুকোনো দেখত। কয়েকটা পেঁপে গাছ, তার তলায় পাঁজা করে বাসন ফেলা। শুকনো এঁটো বাসনে কাকের ঝাঁক, দূরে দূরে চড়ুই। একটা বেড়াল ঝাঁপ দিয়ে পড়ল পাঁচিল থেকে বাসনের ওপর, প্রবল বিরক্তি জানিয়ে কাকের দল সরে যাচ্ছে, শুকনো বাসনকে হেলাচ্ছেদ্দায় পেছনে ফেলে হুলো গদাইলশকরি চালে উলটো দিকের নিচু পাঁচিলে অনুপম একটা লাফ দিয়ে উঠল, বিপজ্জনক ভাবে লাফিয়ে পড়ল ওদিকে। কাঁচা নর্দমার নোংরা জলে পড়ল না তো আবার! এক লহমার ভাবনা বিচ্ছিরি ফ্যাঁচফেঁচে, কোঁকানি-কান্না-কাঁদা হুলোর জন্যে, তারপর সারা দুপুর জেগে থাকে রোদ আর ঝিমধরা চরাচর। নিঘুম। শরীরে কেমন জল কাটে, হিউমিডিটি নব্বুই নাকি? জলাক্রান্ত বাতাস কেন অত ঘর্মস্নাবী হবে! তার জলের ভেতরের শীতলতাটি কোথায় গেল? সবই বাষ্প?
খসখসে পিচকিরি দিয়ে জল ছেটাত তারা। চমৎকার একটা গন্ধ উঠত। শোঁ করে শ্বাস টেনে গন্ধটা নিতে নিতে জল ছেটানো। মাঝে মাঝেই পিচকিরির অভিমুখ ঠিক করে দিত মা, কেননা জল চলে যাচ্ছে ঊর্ধ্বগতিতে যেখানে ছাদ উপুড় হয়ে পড়েছে বিজলি পাখার ওপর।
—‘তোরা এবার একটা সর্বনাশ করবি, রবারের চটি পর—’
—‘পড় পড় ঈশা, প্লিজ একটু পড়ে নে, পরীক্ষার সময়ে ওরকম ঘাড়মোড় ভেঙে পড়লে পাশ হয়তো করে যাবি। কিন্তু ভাল হবে না। শিখবিও না কিছু।’ তার যে পড়তে ভাল্লাগে না, যে মুহূর্তে ধাতু আর অধাতুর লিস্ট মুখস্থ করতে হয়, মৌলিক পদার্থ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়, বলের প্রকারভেদ অনুধাবন করতে হয়, অমনি মনটা কেমন উচাটন হয়ে চলে যায় উড়ে। পেছনে ফেলে রেখে যায় একরাশ বিরক্তি মার জন্য, একরাশ মন খিচখিচ তার নিজের জন্য। উড়ে চলে যায় জজপুকুরের নির্জন বাঁধানো ঘাটে, সেখানে হলুদ ফুল লাল ফুলেরা ইচ্ছেমতো ঝরে গেছে। এমন নয় যে সে উন্মত্ত প্রকৃতিপ্রেমিক, তবু তো প্রকৃতি একটা আবহ তৈরি করে দেয় যা দেয়ালের ওদিকের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওই ঘাটের ওপর আড্ডা বসে, সে তিন্নি, দীপু আর আসিফা। গল্প, স্রেফ গপ্পো, তার মধ্যে ভৌতবিজ্ঞান জীববিজ্ঞানের কোনও ছায়া থাকবে না। গণিত, ইতিহাস, ভূগোল সব নিশ্চিহ্ন। কিছু গল্প, কবিতা, গান থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু আফি, তিন্নি, দীপুদের সে সব বেশিক্ষণ পছন্দ হবে না। আফির সৎমা, রমুর বাবার মদাভ্যাস, দীপুর ঠাকুমার ঝগড়াটেপনামি… এই সব। মা একদম পছন্দ করে না, এসব আবার কী, এইটুকু মেয়েদের পরচর্চা। মা বোঝে না, যাকে ভুগতে হচ্ছে, তার ভেতরে বাষ্প জমছে, একটা সেফটি ভাল্ভ চাই, না হলে সে ফেটে বেরিয়ে যাবে। এ সেইরকম। এরই মধ্যে ইউনিভার্সাল হারুদা লাঠি হাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে চলতে —‘কী রে মা, ঘাটে বসে বসে কী করছিস?’ অমনি হাসি, চোখ চাওয়া-চাওয়ি, দীপু চমৎকার চোখ মটকাতে পারে… তারপর হঠাৎ উপলব্ধি— ধুত, বেকার সব, ভাল্লাগছে না, একদম ভাল্লাগছে না। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে—‘শোন দীপু, তিন্নি—আমি কাল থেকে আর আসব না।’ কিন্তু এটা বলা যায় না। তাই মিষ্টি হেসে—‘এবার আসি রে দীপু, আফি—মা আবার বকবে।’ আঙুর-গুচ্ছ চুল দুলতে থাকে। সে জানে না, আবছা আন্দাজ করতে পারে এবার কিছুক্ষণ ওদের আড্ডার কেন্দ্র হয়ে থাকবে সে। খামখেয়ালি? গুমুরে? মাটিতে পা পড়ে না! মা বাবা পণ্ডিত! হুঁঃ, অমন পণ্ডিত অনেক দেখা আছে। ছোট ছোট মেয়ে, কিন্তু এমন চক্র চারদিকে ঘুরে যাচ্ছে যে বিষে-বিষে ভর্তি হয়ে থাকে ভেতরটা। মা বলে না—ওদের সঙ্গে মিশো না। বলে—এত কী আড্ডা ঈশ! সময় কাটাবার কত উপায় আছে! বই পড় না, গল্পের বই। গল্পের বইয়ের মানুষদের সঙ্গে ভাব কর, আড্ডা দে।
মায়ের বকুনি যে শুনছে, সে যে নিতান্ত বাধ্য এটা সে মাকে বুঝতে দিয়েছে। মা আসলে তাকে গভীর, গহন, অনন্ত ভালবাসে, বিশ্বাস করে। সেও কি বাসে না? মা না থাকলে তো বাড়িটা তার কাছে টাওয়ার অব লন্ডন লাগে, যেখানে লেডি জেন গ্রে বন্দিনী ছিলেন! কয়েদখানা একটা! বড় বড় কালো কালো ছায়ারা আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলতে থাকে সব শূন্য স্পেস, শুষে নিতে থাকে আলো। প্রখর রোদের দুপুরই হোক আর শীতের আমেজি দুপুরই হোক, মা না থাকলে বাড়িটাকে বাড়ি বলে মনে হয় না। ভাই কেমন দূরের পুতুল, খুটখাট হাজার রকমের বল নিয়ে খেলছেই খেলছেই, ঠাম্মা এখন ঘুমবুড়ি। আর কে আছে বাড়িতে! জেঠিমা তো বাপের বাড়িতেই থাকে ঘুরে ঘুরে…। জ্যাঠাও অফিস-ফেরত শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অনেক রাতে ফেরে কোনও-কোনও দিন। তারপর বাজনা বাজে ক্যাসেটে। অমল কারুকাজ বাজতে থাকে রাত ভরে। আরও আরও মন কেমন করে তখন, অথচ মা তখন আছে। মা তখন নিজের কাজে মগ্ন, বাবাও। টেবিলের দু দিকে বসে দুজনে। মাঝে মাঝে দুরূহ সব কথাবার্তা বলছে, কথা কাটাকাটিও হল। কিন্তু কাজ। এই কাজকে সে হিংসে করে আবার শ্রদ্ধাও করে। কিন্তু হিংসে আর শ্রদ্ধার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে কাজটা কখনও তার আপন হয় না। ভীষণ একটা নেগেটিভ সংকল্প জাগে মনে, সে করবে না, এ সব করবে না, পারবে না, এই দুরূহ আলোচনা, এই সব পাতার পর পাতা লেখা, মোটা মোটা বই অক্লান্ত উলটে যাওয়া, এদিকে ওদিকে পুরনো পাথরের টুকরো, ভাঙা মূর্তি, হাত দিয়েছ কি বকুনি—‘টেরাকোটা, ওটা টেরাকোটা, পড়লেই ভেঙে যাবে। ঈশা-বুবুন!’ এই জগৎটা তার মায়ের অঙ্গীভূত, তাকে কী করেই বা ভাল না বেসে থাকা যায়। অথচ মাকে সে, তারা পুরো পাচ্ছে না যে! ওই সব সময়ে মায়ের মনে ঈশা নেই, বুবুন নেই, হর্ষবর্ধন, কিংবা রাজা শশাঙ্ক অধিকার করে রেখেছেন সে মন।
ওই কাজগুলো কোল থেকে নামিয়ে মাঝে মাঝেই তার সঙ্গে, ভাইয়ের সঙ্গে বসে কথা আর গল্পের ফুলঝুরি ঝরায় মা, তার থেকেই তো রাজ্যশ্রী, হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ক…সব জানতে পারে তারা। হারমোনিয়াম টেনে গানের পর গান গেয়ে যায় মা, দিদিমা ভাল গাইতে পারেন, মা ততটা নয়। তবে মা স্বভাব গায়ক, যা শোনে, সোজা-সরল করে গেয়ে যায়। সে শ্রোতা, হয়তো নিবিষ্ট তখনকার মতো, কিন্তু মনের খানিকটা, জজপুকুরের পাড়ে বসা মনটা বলে সে এসব পারবে না। পারতে চায় না। এই পড়া এই গান—সবই প্রচুর পরিশ্রমের জিনিস, সে লাল ফুল হলুদ ফুলের মতো বিনা আয়াসে ফুটে থাকার কথা ঝরে যাওয়ার কথা ভাবে। কাদায় পড়ে গেলে অত সুন্দর ফুল পিষ্ট হয়ে যায় ভেবে শিউরে ওঠে একটু। কী তুমি তবে চাও খুকু? কে যেন সারা দিনমান জিজ্ঞেস করতে থাকে। তার কাছে উত্তর থাকত না। আকাশ-বাতাস ভরে চাওয়া বাজে। ঘনিয়ে ওঠে বাদল মেঘে। গাছের ডালে পাতার পাশে পাশে চাওয়ার কুঁড়ি ফোটে। সে শুধু একটা হয়ে ওঠার চাওয়া। কোনও বিশেষ গুণ নয়, সমস্ত অস্তিত্বটা একটা সুগভীর আবেগে টলটল করতে থাকে, হাওয়ায় ভর দিয়ে উধাও… যদি হওয়া যেত! কোথা যে উধাও… উধাও মনটাকে কি অভিনিবেশে টানতেই হবে? এই শুধু ফুটে থাকায়, শুধু হয়ে থাকায় কি কোনও তপ্তি নেই? যা সহজে প্রাপ্য, জল বাতাস আলো হাওয়া… ভালবাসা। এই-ই।
এখন ঈশা জানে তার চাওয়া একরকম সৃষ্টি-ছাড়া। সমাজ-ছাড়া। কে জানে এখনকার জানাটাও হয়তো ঠিক জানা নয়।
এরকম মানুষ কি হয়? হয়তো হয় না। সবাইকার জীবনে একটা লক্ষ্য থাকে সে দেখেছে। তার বন্ধুদের উচ্চাকাঙক্ষা? ছোট হলেও আছে। ভাল করে গ্র্যাজুয়েশনটা, তারপর কেউ মাস্টার্স, কেউ কম্প্যুটার, কেউ বা আর কিছু ধরবে। চাকরি করুক না করুক, একটা বিয়ে তো হবেই। বিয়ে চাই-ই চাই। তারই জন্য সবার গোপন, রোমাঞ্চিত প্রতীক্ষা। কেমন হবে? কে হবে? স্থির করে ফেলছে কেউ। কেউ স্থির করে আবার ভেঙেও ফেলেছে। হাই স্কুল থেকেই গল্প কাহিনি শুনছে ঈশা। তার মনের মানুষ বাইরে কোথাও নেই তো! কিন্তু আছে, ছিল। গোপন মনে স্বপনলোকে। আজকের দিনের মেয়ে হয়েও যে সে বিয়ে ও তারপর রোমাঞ্চময় দাম্পত্য ও চমৎকার স্বাদু গাৰ্হস্থ্যের আবছা-স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকল— এর কী মানে? এটা কি স্বাভাবিক? সে কি তার ঠাকুমা-দিদিমার চেতনা নিয়ে জন্ম নিল! এ কি একটা প্রতিক্রিয়া? মেয়েদের বহির্গমন ও তার দরুন চাপ ও প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে মানবীমনের একটা শান্ত বিদ্রোহ? নাকি প্রতিক্রিয়াটা অন্য কিছুর? তার মায়ের তো গার্হস্থ্যে অভিনিবেশ ছিল না তত! নিজের কাজটা মা বড্ড ভালবাসত। সময় ও মনোযোগ দাবি করত কাজটা। সেটারই ছিল অগ্রাধিকার। মা একটু হারানো-ছড়ানো টাইপও ছিল। মাসির কাছে এ নিয়ে কত বকুনি খেয়েছে মা। ‘যেখানে দেখো পাঁজা পাঁজা বই। কী রে! একটু গুছোতেও পারিস না?’ হতাশ হয়ে অপ্রতিভ হেসে মা বলত ‘তুই-ই দেখিয়ে দে। কোথায় রাখব। সব ভর্তি। যত আলমারি, যত তাক সব ভর্তি, এবার টেবিলে স্তূপ হবে না তো কী! —ওর বিছানা দেখ, চারপাশে বই নিয়ে ঘুমোয়, আমারটা তো তবু ফ্রি। এসেই যাচ্ছে, এসেই যাচ্ছে, জার্নাল, প্যামফ্লেট, বই। রাখতে তো হবে?’
ঠাম্মা? বড্ড গোঁড়া। খুব বাঁধা-ধরা পথে চলতে চায়। তাদের হয়তো ইচ্ছে হল— রাতে নুড্লস্ খাবে। ঠাম্মা বলবেন— ‘রাতে লুচি না রুটি না ভাত না, খাবি ওই চিনে কেন্নো! দুর!’ ব্যস হয়ে গেল। মা একবার দুর্বলভাবে বলল— ওটাতেও তো আটাই আছে মা। স্টেপ্ল ঠিকই যাবে। ক্ষতি কী! চাইছে!
—তা হলে আমি সরে যাচ্ছি। তোমরা যা হয় করো।
এই অভিমানের সামনে মা খুব সহজেই আত্মসমর্পণ করত। কে জানে হয়তো তাই-ই তার সুন্দর বিন্যাস, বিলাস, শৌখিনতার ওপর এত আকর্ষণ! সে তার বাড়ি এই ভাবে সাজাবে, ওই ভাবে। আর এই বিস্তৃত স্বপ্নের মাঝখান দিয়ে চলাচল করত একটা আবছা মূর্তি। তার মুখ পুরো বোঝা যায় না। অথচ নিরবয়বও তো নয় সে। তার আকৃতি কেমন! পেটা স্বাস্থ্য? লম্বা-চওড়া? না দেবকুমারের মতো সুন্দর! জানে না ঈশা। তার রোম্যান্টিক মন সব কিছুকে নির্দিষ্ট করে দিতে চায় না। চায়নি। শুধু ভালবেসো। গভীর ভালবেসো। আমাকে, একমাত্র আমাকে।
‘সাতনরি হার দেবো ফুলের বাহার দেবো
রুপোর হাঁসুলি যদি চাও …’ একটা গান আছে না?
তেমনই— দুধসাদা শয্যা দেব অমৃতস্বাদ খাদ্য দেব
নিতুই নতুন যদি চাও…
ঘর ভরা সাজ দেব বুক ভরা লাজ দেব
রাগ দেব ঝাল দেব মান-অভিমান দেব তা-ও।
পর্দা টানা আধো-অন্ধকার ঘরে লম্বা আয়নায় নিজের আবছা প্রতিবিম্বর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে ঈশা। ও কে? কে ও বিষাদ প্রতিমা? ওকে তো সে চেনে না?