ঈশানে মেঘ
রাত প্রায় শেষ। দিন আসছে ভূপতিচরণের সৌভাগ্য বহন করে।
ঢং ঢং করে পাঁচটার ঘণ্টা বেজে গেল। কিন্তু অন্ধকার কাটেনি। যদিও শীতের শেষ, তবু। কুয়াশার ওড়না দিয়ে যেন পৃথিবী আত্মগোপনের চেষ্টায় আছে এখনও। এখনও কয়েকটা বর্ণহীন তারা বিষাদে ম্লান। জমাট হিমের বুকে চাপ দিচ্ছে উত্তরে হাওয়া।
বাংলার অভ্যন্তরে এখানে মাইলের পর মাইল জুড়ে ছিল সবুজ গাছপালায় ঘেরা শত শত গ্রাম। এখন হয়েছে সামরিক ঘাঁটি। যেন রাতারাতি টেনে হিঁচড়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে গ্রামকে গ্রাম। এখন দিকচিহ্নহীন। গ্যালনের পর গ্যালন পেট্রোল পুড়িয়েও এই বিস্তৃত সামরিক ঘাঁটির থই পাওয়া দায়।
সামরিক ঘাঁটি নয়। লোকে বলে মেলেটারি ডিপো। কুয়াশার আস্তরণ ছিঁড়ে ধীরে ধীরে মেলেটারি ডিপো জাগছে তার সমুদ্রের মতো বিস্তৃতি নিয়ে… জাগছে হাবিলদার মেজর ভূপতিচরণের সৌভাগ্যকে শিয়রে নিয়ে। আজকের রাত্রির প্রভাত ভূপতির জন্যই। আজকের যত আলো, যত বাতাস, যত রং সবই ভূপতির। তাই তার সদ্য-ঘুম-ভাঙা চোখে স্বপ্নাবেশ, থ্যাবড়া নাকের ফুলোনো পাটার পাশ দিয়ে নেমেছে একটা বনমানুষি খুশি হাসির চাপা ঢেউ। নিশ্বাসে চল্লিশ ইঞ্চি বুক ফুলে পঞ্চাশ হয়ে উঠেছে। মনটা একটা নেংটি ইঁদুরের মতো আনন্দে যেন ছুটোছুটি করছে তার জালার মতো শরীরটাতে।
কুয়াশার ঘোর কেটে জাগছে আলো।
জাগছে না শুধু শ্রীপতি। ঘুমটা ভেঙেছে, শরীরটা জাগছে না, জাগছে না মনটা। চটে ঢাকা বারান্দায়, কোন্ মান্ধাতা আমলের কাঁথার তলায় শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে আছে, সাড় নেই শীতের, বোধ নেই প্রভাতী ঘণ্টার। বুকটার মধ্যে কেমন ব্যথা ব্যথা করে। হাড়ে মাংসে নয়, দুনিয়ার রঙ্গে ভঙ্গে যেখানটায় নানা বোধের ঘটা। কেমন যেন একটু ভয় ভয় ভাবও বা আছে। না, ভয় নয়, বিতৃষ্ণা। কী জানি কী। নাকি একটা ছেলেমানুষি কান্না, অপমানহত শিশুর জর্জর অভিমান। তা-ই বা কেন, তা কে জানে।
শ্রীপতি। মিলিটারি নথিতে যার নামের পাশে লেখা আছে ইভ্যালিড়, লোকে যাকে বলে, নুলো ছিপতি বা হাতকাটা ছিপতি। ডিপোর বাইরের লোকে যাকে বলে একহেতে সেপাই। শ্রীপতি সেপাই নয়, মেজর রামচাঁদ কাপুরের আদালি, হাবিলদার মেজর ভূপতির ভাই বান্দা। ভূপতি বলে। ভায়া, লোকে শোনে ভৃত্য।
শ্রীপতির ডান হাতটা নেই কনুয়ের ইঞ্চি দুয়ের উপর থেকে। ডান পায়ে নেই তিনটে আঙুল, পায়ের পাতা দেখায় এবড়ো-খেবড়ো। ডান গালের খানিকটা জুড়ে পোড়া দাগ। সেই অর্ধ নারীশ্বরের মতো সে অর্ধেক বিকলাঙ্গ। বুঝি তাই ভূপতির ভাষায় তার দশ বিয়োনি উনত্রিশ বছরের ক্যারকেরে বউ আদুরি অঙ্গহীন দেওরকে নির্মম ভাষায় বিদ্রূপ করে বলে, সং না সং আমার শাড়ির পেটের ডানাকাটা কার্ত্তিক। ঠুটো জগন্নাথ। শ্রীপতির প্রতি কোনও বিদ্রূপাত্মক বিশেষণ নেই শুধু বিধবা মেজবউ আলোর। নামে আলো, কাজেও আলো। রূপেই যা একটু আঁধার। তা আদুরির যে কটা রঙের এত দেমাক, তার চেয়ে এ আঁধারের ধারে কাটে অনেক গহন তল। আলোকে যদি মেঘনা বলি, আদুরিকে পারি না দিতে খর পদ্মার আসনখানি। বলিহারি বাহাদুরি, তার, যে এ কালো রূপসীর নাম রেখেছিল আলো। এ যেন সেই কালার রূপে জগৎ আলা। ..আদৃরির রূপ আছে, রস নেই। গলায় আছে কুট। যে অর্থে নীলকণ্ঠ, সে অর্থে সে নীলকণ্ঠী নয়, নিশ্বাসে তার বিষ ঝরে। সে বুঝি আদুরির আদর নেই বলে।
আজকের প্রভাতী আলো ভূপতির সৌভাগ্যসন্ধানী। আলো থাকলে তার ছায়া থাকে। যেন সে ছায়ার ঘোর পড়েছে শ্রীপতির মুখে। আর আজকের আখ্যান বলতে গেলে বাদ দেওয়া যায় না আলো আদুরিকে। কী করেই বা বাদ দেওয়া যায়।
ভূপতির সামরিক জীবনের উদ্দাম স্রোতে আদুরি অকুলে ভেসে গিয়েও কোথায় যেন আটকে আছে। সেটা ভূপতির দেখবার নয়। জানে শুধু, সে চলে এসেছে অনেক দূরে যেখান থেকে ঘরের কাউকে দেখা যায় না কেবল আলোর কালো মুখখানি ছাড়া। তার পিঠে কথা, যত্ন ঢালা সবই আলোর পিছে পিছে ভাসুরসুলভ ছদ্মবেশে চাটুকারের মূর্তিতে ধাবিত। সে চাটুকথা বড় চাঁচাছোলা স্কুল ইঙ্গিতময়। ধ্যাবড়া লোমশ গরিলার চেহারাটার মতোই তার চরিত্রটা। সে শুধু বোকা আর নিষ্ঠুর নয়। সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতায় সে এক নতুন বাঙালি। সে বলে, ছিলাম জাতে নাপতে, হয়েছি মিলিটারি।
আলো আলেয়ার মতো। আদুরির কথা বাদ দিই, কেননা এ ঘরে মেয়েমানুষ হিসাবে আলোর অস্তিত্বই তার কাছে জ্বালাময়। সব দোষ গুণের ঊর্ধ্বে। আদুরির কাছে সে সর্বনাশী রাক্ষুসী। ভাসুর ভূপতির নির্লজ্জ ব্যবহারে তার রাগবিরাগ বোঝবার জো নেই। ভাদ্দরবউ পানা ঘোমটাটুকু আছে কিন্তু সেটা মুখখানি না দেখানোর চেয়ে দেখানোই যেন বেশি। নীরব বটে, তবু তার হাসি হাসি ঠোঁট দুটিতে যেন নিরুত্তর কত কথার ঝকমকি! কটুক্তিতে প্রতিবাদ নেই, স্তুতির আড়ে প্রেমোক্তিতেও নেই আপত্তি। এতে যা বোঝার তা বোঝে। তবে এও বলি, ওই পর্যন্তই। এর পরের অদৃশ্য বেড়াটার নাগাল আর কিছুতেই পাওয়া যায় না।
সেই বেড়াটার গায়ে গায়ে মাথা খোঁড়ে হাতকাটা শ্রীপতি। এই দুরন্ত মিলিটারি ডিপোতে সে একটা বেখাপ্পা জীব। কথা বলে সে গোনগাঁথা কয়েকজনের সঙ্গে। সিভিলিয়ান স্টোর ক্লার্ক অমলবাবু, বাগানের মালী গোপাল, ল্যানস্ নায়েক মূলসিং, আরও দু একজন।
সে কখনও মুখ খোলে না ভূপতির বা আদুরির কাছে। এমন কী আলোর কাছেও খুবই কম। তবু এখানেই সে যেন রাধাবেশী কৃষ্ণসাধক। তার বুলি নেই, কিন্তু নিরন্তর সংশয়ের বেদনায় ও যন্ত্রণায় বুকটা তার মুচড়ে থাকে কেবলি। এ বেলার আলোকে সে ও বেলা বুঝতে পারে না, রান্নাঘরের মানুষটাকে চিনতে পারে না উঠোনের আলোর মাঝে। কী জ্বালা! সবহারার এক পাওনার মধ্যে যেন সব পাওনাই লুকিয়ে আছে। আর সে এক পাওনার হদিস মেলে না কিছুতেই। ভাবনা বাড়ে, তাই যখন সে কথা বলতে যায় তখন তার ভাবনার ভারে মনটা করে হাহাকার। …সে তো রিক্ত নয়, অঙ্গহীন। জন্ম অঙ্গহীন নয়, প্রসূতি মায়ের সে ছিল বেদনাহারী নয়নমণি। আদুরে নাম গোরাচাঁদ। সে গোরাচাঁদকে পুড়িয়ে আধখানা করল ভারতের পূর্ব সীমান্তের যুদ্ধক্ষেত্র। মায়ের পেট থেকে জন্মেছিল বিদেশির সাম্রাজ্যে, সে সাম্রাজ্য বাঁচাতে গিয়ে পেয়েছে এই জঞ্জালের লজ্জা ও বেদনা।
ব্যারাক ও মিলিটারি কারখানায় এ জঞ্জালকেই তবু কেউ কেউ মানুষের মর্যাদা দেয়, যাদের সঙ্গে শ্রীপতি দু-দণ্ড কথা বলে। আর একটি নেশা আছে তার, বই পড়া। এ নেশাটা তাকে দিয়েছে স্টোর ক্লার্ক অমল। সেজন্য তাকে বিদ্রূপও বড় কম করে না ভূপতি ও তার বন্ধুরা। : আলো তার কাছে কিছু উদ্দাম, খানিক সরব। হাসির ধারে রহস্যের চেয়ে কর্তৃত্ব বেশি। তাতে পরিস্ফুট নয় শ্রীপতির প্রতি করুণা মমতার চিহ্ন। উপরন্তু সে মনের সুতোকে দিয়েছে জট পাকিয়ে। একমাত্র ভূপতির আন্ডাবাচ্চাগুলির কাছে আলো মূর্তিমতী করুণাময়ী ধাত্রী। মায়ের চেয়ে কাকি তাদের আপন। কারণ বুঝি শিশুরা রূপের চেয়ে আদর বোঝে ভাল। এই কালো হাতের স্নেহটুকু বড় মিঠে। এই আলোকে আদুরি অভিশাপ দেবে না তো, দেবে কাকে। একে ছাড়া আর কাকে বলবে সে ভাসুর দেওর মজানী অসতী। শকুনে খাবলে খাক, এ কথা আর কাকে বলবে সে।
তবু শুধু আদুরি বলে নয়, সকলেই যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত এ সংসারে। আলো ব্যস্ত শুধু এ সংসার নিয়ে। আলো বিনা এ আঁধার। তবে এও সত্যি আলো ছাড়া এ ঘরের মরা মেজ ছেলে নৃপতির আর কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই। জানি না এ ঘরে সে স্মৃতির দাম কতটুকু। সে স্মৃতির আদর ও দুঃখ শ্রীপতিরই আছে একমাত্র বিশেষ করে। তার পোড়া গায়ে বুঝি এখনো নৃপতির রক্ত লেগে রয়েছে, তার মৃত্যু আর্তনাদ এখনও লেগে রয়েছে তার কানে। দাদার চিৎকারে সাড়া দিতে গিয়ে ভাই পুড়েছে। এখনও তার স্পষ্ট মনে আছে, নৃপতির মরতে মরতে সেই চিৎকার ছিপে পালা, পালা। কিন্তু ছিপে অর্থাৎ শ্রীপতি পালাতে পারেনি। রামচাঁদ কাপুর দু-ভাইকে মাড়িয়ে পালিয়ে ছিল গোরাসৈন্যদের সঙ্গে। সেই একই রেজিমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে সে আজও ঘুরছে জঞ্জালের মতো। সেদিনের সেপাই রামচাঁদ আজ ডিপোর ডিফেন্সের মেজর। পুবের শুন্য যুদ্ধক্ষেত্রে বুঝি আজও নৃপতির অতৃপ্ত আত্মা হাহাকার করছে।
যুদ্ধের পরে, তবু এরই মাঝে এ সংসারটি গুছিয়ে-গাছিয়ে উঠতে চেয়েছিল। কিন্তু এই সামরিক বাঙালি পরিবারটির নীলাকাশের ঈশান কোণে বিরাশ কালো মেঘের মতো ভূপতি নতুনভাবে আবির্ভূত। দ্রুত ও সর্বনেশে তার ব্যাপ্তি। সে মেঘ ওখানে কোথাও মাথা হেলিয়ে বা উঁচিয়ে আছে ক্রেইনের মাথা। ডিফেন্সের মাঝ দরিয়ার যাত্রীবাহী নৌকার দিকে দেখে না, উপরন্তু যেন কুটিল ভূকুটি করে মাঠের কুঁড়ের দিকে চেয়ে। ভূপতির মধ্যে যেন কীসের এক নেশা জেগেছে। আরও জাগছে ধীরে ধীরে। সে নেশার মাতলামির সব ভেঙে কেবলি তছনছ করতে চায়।
কুয়াশা সরে যাচ্ছে, বদল হচ্ছে ডিউটি। ডিপো জাগছে। সারি সারি ব্যারাক, গোলপাতার ছাউনির উপর ধূসর পেলের আস্তরণ। অ্যাজবেস্টারের ছাউনি দেওয়া ফ্যামিলি কোয়ার্টার, দেওয়ালের রং সবজে খাকি। পুব-উত্তর জুড়ে কারখানা। ভেহিকল, আর্মস অ্যামুনিশান, বিরাট বিরাট স্টোর শেড়। এখনে ওখানে কোথাও মাথা হেলিয়ে বা উঁচিয়ে আছে ক্রেইনের মাথা। ডিফেন্সের আপিসবাড়ি, প্যারেডের ঘাস-পোড়া মাঠ। সব জাগছে আস্তে আস্তে কুয়াশা ভেদ করে।
ভূপতি গায়ের থেকে ঢাকনাটা খুলে ফেলল। লোমশ শরীরে তার শীতের কোঁকড়ানি নেই, আরামের আমেজ আছে। মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ছে বলিষ্ঠ শরীরের রেখার রেখায়। ছোট ছোট জ্বলজ্বলে চোখ দুটোতে তার সে খুশির চকচকানি।
আধা উলঙ্গ ঘুমন্ত আদুরির দিকে চোখ পড়ল তার। হাড়সার ফরসা আদুরি। ভূপতি দেখলে ন্যাংটা ঘুমন্ত ছেলেমেয়েগুলোকে। তারপর খুশির দমকে লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে মাড়িয়ে ফেলল আদুরির একটা হাত। চকিত আঘাতের ব্যথায় ও বিস্ময়ে আচমকা জেগে আদুরি উঃ করে উঠল। ভূপতির মুখ অপ্রতিভ ও বোকাটে হাসিতে হাঁ হয়ে গেল।-এ হে হে মাইরি দেখতে পাইনি। বলেও সে হে হে করে হাসতে থাকে।
আদুরি বোধ করি স্বভাব দোষে হয়ে গেছে আদরকাড়ানি। তাই না থেমে কেবলি উ উ করতেই থাকে। ছেলেমেয়েগুলো সে শব্দে সদ্য-ঘুম-ভাঙা। ভুতুড়ে চোখে চেয়ে থাকে। সামনে ভূপতিকে দেখে তারা সিটিয়ে যায়। ভাবে মনে হয় যেন সামনে তাদের যম দেখেছে।
ভূপতির হাঁটা ছোট হয়ে জিভটা একটুখানি বেরিয়ে পড়ে, একটা তীক্ষ্ণ রেখা বেঁকে উঠে জুর পাশ দিয়ে। চকিতে হাসি মিলিয়ে একটা ক্রুদ্ধ মোষের মতো সে ফোঁস করে ওঠে, আরে, আদরে আর বাঁচে না যে।
অমনি আদুরির গলার স্বর একটু নেমে যায়, কিন্তু একেবারে থামে না। হাতের ব্যথা সারলেও আসল ব্যথা যে সারে না। আবার হাসে ভূপতি। এই হাসে, এই খেপে। একটা অদ্ভুত জাস্তব বোকাটে ভাব। হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসতে হাসতে সে বেরিয়ে গেল। তার পদভারে কেঁপে কেঁপে উঠল ফ্যামিলি কোয়ার্টারের পাঁচ ইঞ্চি দেওয়াল।..দরজা খুলে বেরুবার মুখে বুঝি খুশির তাল সামলাতে না পেরেই একটা হোঁচট লাগল কাঁথা ঢাকা শ্রীপতির শরীরে। এমন সুদিনে ঘর থেকে বেরুতেই হোঁচট। দাঁতে দাঁত চেপে এক হ্যাঁচকায় শ্রীপতির গায়ের কাঁথাটা খুলে ফেলল সে।
শ্রীপতির ভাবলেশহীন পোড়া মুখটা বেরিয়ে পড়ল। চোখে তার ঠাণ্ডা নিমিমেষ চাউনি, অপলক।
যে চাউনি দেখলে ভূপতি খেপে ওঠে আরও বেশি। কিন্তু ভূপতি হাঁ করে হাসে। বলে, ওঠ না জেনারেল সাহেব।
পরমুহূর্তেই খ্যাঁক করে ওঠে, কাজ করবে নুলো এক হাতে, আবার ঘুম মারে দুকুর অবধি। বলে শ্রীপতির কাটা হাতটা ধরে টান দিল। আশ্চর্য, শ্রীপতির ভাল হাতটা ধরে না সে।
ভূপতি ভাইকে শালা বলে। শুধু শালা নয়, সবই বলে। কিন্তু চিরকালই বলত না। বলে, যাব থেকে সে হয়েছে দুর্ধর্ষ মিলিটারি, মনে প্রাণে পেয়েছে পুরোপুরি সৈনিকের মেজাজ।
তার শক্ত মুঠি থেকে শ্রীপতি ডানাটা ছাড়াবার চেষ্টা করতে থাকে। ভূপতি আরও জোরে সাঁড়াশির চাপ দিতে দিতে বলে, উ, নুলোর তেজ খুব।
এ হাত ছাড়াবার দৃশ্যটি যেমন হাস্যকর তেমনি মর্মস্পর্শী। শ্রীপতির শরীরটাই খালি দুলতে থাকে এ-পাশে ও-পাশে আর অদ্ভুত অভ্যাসবশত নাকের ভেতর থেকে শব্দ বেরোয় ফাঁস ফাঁস করে। খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে ভূপতি। যেন বোবা জানোয়ার…হাসলে মুখটা হাঁ হয়ে চোখ দুটো কুঁচকে যায় তার। রাগলে হয় চোখ গোল আর জিভটা সামনে বেরিয়ে যেন লকলক করে সাপের মতো।
আর একটা টান দিয়ে শ্রীপতিকে সে প্রায় দাঁড় করিপেয় দিল। চট করে হাসিটা থেমে গিয়ে ভ্রূর পাশে রেখাটা বেঁকে উঠল তার। থাম্ থাম্ বলছি। জোর করলে মারব ঘুমো।
শ্রীপতির চোখ দুটো নীরবে ধ্বক ধ্বক করে জ্বলতে থাকে। জলুনিটা অসহায়।
কাঁচা কয়লা পুড়িয়েছিলি?
না।
না তো, তোকে ধুয়ে আমি জল খাব? ফের ওরকম চেয়ে থাকবি তো দেব চোখ গেলে। ও-সব আর চলবে না বুঝেছ চাঁদ? বলতে বলতেই তার বিস্ফারিত হাঁ-মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বলে আজকে তো হেঁ হেঁ, দেখিস্ কী হয়। খুব তো কেতাব পড়িস, মিলিটারিম্যান হতে পারি? যা যা, আজ একটু বাসন টাসন মাজগে, আবার বাজারে যাবি। বলতে বলতেই তার নজর পড়ে আলোর দিকে। অমনি তার মুখটা আরও বোকাটে ও বিগলিত হয়ে ওঠে। তার রাগ আহ্লাদ শোক কোনও কিছুই চাপতে শেখেনি সে। যখন যা তখন তা। শ্রীপতিকে ছেড়ে দিয়ে সে প্রায় ভাদ্ৰবউ আলোর গায়ে গিয়ে পড়ে।
আলো রোজকার মতোই উঠোন ঘর পরিষ্কার করে, বাসন মেজে ধুয়ে স্নান সেরে ফিটফাট। তেমনি ঘোমটা টানা, নির্বাক, নাম-না-জানা হাসি ঠোঁটে। যে হাসিটা দুরন্ত বাতাসের মতো আয়ত্তের বাইরে। আপনি আসে। চলেছে উনুন ধরাতে, ভাসুরের খাবার তৈরি করতে।
হেঁ হেঁ…বউ যে! এর মধ্যেই নেয়ে টেয়ে নিয়েছ? বুঝি আলোর হাত মনে করেই নিজের একটা হাত অন্য হাতে চাপতে থাকে। যেন ছোঁয় ছোঁয় তবু পারে না। হেঁ হেঁ, তা বেশ করেছ। একটু সাবান-টাবান মাখলে পারতে। ও-বেলা একটু সাফ টাফ হয়ো। তুমিই তো দেবে থোবে। কত লোক আসবে। মেজর ক্যাপটেন, সুবেদার মেজর, টেকনিক্যাল জমাদার, কর্নেল সাহেব মিলার।.. লেঃ কর্নেল মিলার মানে ভূপতিদের গাঁয়ের মদন কৈবর্তের ছেলে কালীচরণ। কালীচরণ এক গোরার পোষা ছেলে ছিল। তার পরে কালে কালে কৈবর্ত থেকে কারেস্তান হয়ে মিলিটারিতে ঢোকে। এখন হয়েছে লেফটেনেন্ট কর্নেল। আজকের ভূপতির মতোই সেদিন ধাপে ধাপে কালীচরণ উঠেছিল, কালীচরণ কখনও কালীচরণ, কখনও কে সি মিলার। কলিসন বলেও কেউ কেউ ডাকত মোটা জিভওলা গোরারা। এই কালীচরণই ভূপতিদের তিন ভাইকে মিলিটারিতে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছিল।
কর্নেলের নামটা শুনে আলোর হাসি ঠোঁট একটু বেঁকল, একটু কুঁচকে উঠল বাঁ চোখের কোল। তার পর ভ্রূ তুলে তাকাল শ্রীপতির দিকে। শ্রীপতি অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। মুখের তার যত ভাব সব বোধ হয় এই পোড়া জায়গাটাতেই ফোটে তাই কিছু বোঝা যায় না।
আলো আবার তেমনি হাসে। একটু বা সরস কিম্বা একটু যেন চকিত বিষাদের আভাস তার ভঙ্গিতে। সে আবার বাঁক ফেরে রান্নাঘরের দিকে।
ভূপতি আবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার লোমশ হাত পা নিশপিশ করে যেন কিছু একটা টিপে ধরে দুমড়ে ফেলার জন্য। আজ কিন্তু মাইরি তোমাকে…না, তোমার, লজ্জা আর কাটে না। হ্যাঁ, দোপেঁয়াজি পাকাবার কেরামতি আজ তোমাকে দেখাতে হবে। শালা খেয়ে যেন কেউ ভুলতে না পারে। কথা শেষের আগেই ভূপতির প্রাণ ভুলিয়ে আলো রান্নাঘরে চলে যায়। ভূপতি তবু গোল গোল চোখে হা হা করে হাসে। মাথা দুলিয়ে ফিরতে গিয়ে নজরে পড়ে শ্রীপতি তেমনি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। আদুরির উ উ ঘ্যানঘেনানি তখনও বন্ধ হয়নি। কিন্তু কান পাতলে শোনা যায়, আসলে সে বাছা বাছা গালি ও শাপমন্যিতে শেষ করে ফেলছে আলোকে। শুধু আলো নয়, তার মধ্যে নামহীন ভূপতি শ্রীপতিও আছে। এবং এ চলবে সারাদিনই।
হঠাৎ বাজপড়ার মতো চিৎকার করে উঠে ভূপতি শ্রীপতির প্রতি, যৌ শালা এখান থেকে.যৌ।… যেন কোনও বিদ্রোহী সিপাইকে সে হুকুম করছে।
পোঁ পোঁ করে প্রথম ভেরি বেজে উঠল আপিস ব্যারাক থেকে। সময় ঘনিয়ে এল প্যারেডের। দুপদাপ করে ভূপতি কলঘরের দিকে চলে গেল। শ্রীপতি চলে যায় না, উবু হয়ে বিছানাটা গুটোয় এক হাতে। মনের ধন্দের ভারে সে যেন কুঁজো। ধন্দ তার জীবনের, ধন্দ আলোর। আলোর প্রতিবাদহীন দুর্বোধ্য হাসির।
আলো রুটি বেলে আর ফিরে ফিরে দেখে দরজার দিকে। এখন তার হাসি নেই, চোখে যেন। একটা গাঢ় চিন্তার ছায়া। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের মতো যেন কী ফোটে আর উঁকি মারে দরজার দিকে।
ভূপতি স্নান করতে গেছে। ছেলেমেয়েগুলো সুযোগ বুকে এক ঝাঁক চামচিকের মতো সড়সড় করে ছুটে এসে আলোকে ঘিরে বসল। মুখে তাদের কথা নেই। হাজার ভাষা চোখে।
আলো বলল, তোরা এখন কাকার কাছে পড়তে বোস্ তো আমার ঘরে গিয়ে। নির্বাক পুতুলের মতো তাকিয়ে রইল ছেলেমেয়েগুলো। একজন ভরসা করে ফিসফিসিয়ে বলল, কিন্তু বাবা যে আজকে…
তা বটে। একে তো লেখাপড়া কাউকে করতে দেখলেই ভূপতি রুষ্ট হয়ে ওঠে, ঠাট্টা করে। তার উপরে আজকে ভাসুরের তার বড় সুদিন। তারই উদ্দাম ঝড়ে আজ আর সব যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তবু আলো বলল, তোদের বাবা বেরিয়ে গেলে খাস, এখন চলে যা।
কথা নয়, মিষ্টি গান। ছেলেমেয়েগুলো যেমন এসেছিল, তেমনি চলে গেল।
সেদিকে তাকিয়ে অসীমে মিশে গেল আলোর দৃষ্টি। কী যেন ভাবছে সে।..কী ভাবছে!…তাদের সেই গাঁয়ের ছায়াছন্ন কুঁড়ের কথা নাকি? তার শ্বশুরের ভিটা। দুরন্ত অভাবে পড় পড় ঘড় ঘড় ভাব রাতদিন। শাশুড়ি ছিল না। শ্বশুর অথর্ব। তিন ভাই দুই বউ। আদুরি তখন কত সুন্দর, কী শান্ত! আলো ছিল নৃপতির খেলার পুতুল। সেই অভাবেও। উদার কিশোর শ্রীপতি পিপড়ে মারতে পারত না, কেষ্টযাত্রার গান গেয়ে বেড়াত সারাদিন। …এল গাঁয়ে মদন কৈবর্তের ছেলে কালীচরণ। মস্ত সাহেব একেবারে। এসে একজন দুজন নয়, একেবারে তিন ভাইকে নিয়ে গেল। লক্ষ্মীর ভাঁড়ারের কুলুপকাটি ছিল তার হাতে। কিন্তু সেদিন বালিকা হলেও সুন্দরী আদুরির উপর কালীচরণের সুদৃষ্টির কথা ভোলেনি সে। তার পর..আবার রুটি বেলতে থাকে আলো।
তার পর বঙ্গীয় ঊনপঞ্চাশ রেজিমেন্ট! চাপা উল্লাসে থ্যাবড়া মুখে চাপা হাসি নিয়ে ভাবে ভূপতি। ইউনিফর্ম পরে ধোপদুরস্ত। ভারতীয় খাকি রং যেন পচা পোনামাছের পিত্তির মতো। রেজিমেন্টও নামেই বঙ্গীয়, আসলে খিচুড়ি। পৃথিবীর সব জাতের লোকই বোধ হয় তাতে ছিল। ফরটিনাইন বললেই বোঝা যেত।…কালীচরণ তখন সুবেদার মেজর। ভূপতিরা তিন ভাই সেপাই।..কালীচরণ সম্মানে বড় হলে কী হবে, ভূপতিকে বন্ধুর মতো দেখত। বলত, বউটি তোমার খাসা। ভুপতি তখন শুধু হাসতে জানত, রাগতে জানত না। সেটাও শিখিয়েছে তাকে কালীচরণ। ওদিকে লড়াই-এর ঝোঁকে আদুরির যৌবনের পাল্লাটায় বয়সের মাদকতা পড়ে গিয়েছিল। সে কথাটা কালীচরণ আর মনে আনেনি।
ভূপতি ভাবছে নৃপতির কথা। আশ্চর্য মন তার। নৃপতির কথা মনে হতে বিশাল বুকটা মুচড়ে উঠে কান্না পেল তার। বিকৃত হয়ে উঠল তার মস্ত মুখটা। …কিন্তু বাঁ হাতের মণিবন্ধে তাজটা বাঁধতে গিয়ে সে ভাবটা কেটে উঠল। হাবিলদার মেজরের চিহ্ন ওই তাজ, আর ওই তাজ বাঁধা আজই শেষ।
সে কথা মনে হতেই তার মুখের ভাব গেল পালটে। চোখ দুটো কুঁচকে মোটা মোটা ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে হাঁ করে ফেলল সে। তার নীরব হাসি। কিন্তু খুশির দমক চেপে রাখতে না পেরে একটা অদ্ভুত হেঁ হেঁ শব্দের একটানা গোঙানি বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে।
কান্না বন্ধ করে আদুরি ভয়ে ভয়ে সামনেই বসেছিল শরীরটা সিঁটিয়ে। কেননা ভূপতির আচমকা রাগকে কেউই বিশ্বাস করতে পারে না। হাসি শুনে সে ফিরে তাকাল।
ভূপতি তার দিকে বাঁ হাতটা বাড়িয়ে খুশিতে চাপা হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, আজকেই এটা শেষ। কালকেই একটা তারা খসে পড়বে কাঁধে, আশমানের সোনার তারা দেখি। গরিলার মতো বুক চাপড়ে সে হা হা করে উঠল। আমি আর হাবিলদার মেজর নই, জমাদার…আজ থেকে জমাদার। হঠাৎ গলাটা চেপে ফিসফিসিয়ে উঠল, তার পর সুবেদার, সুবেদার মেজর, ক্যাপটেন, মেজর.. লেঃ কর্নেল। …পরমুহূর্তেই নাটকীয়ভাবে গোড়ালিতে গোড়ালি ঠুকে আদুরিকেই একটা সেলাম জানিয়ে বেরিয়ে গেল বুটের খট খট শব্দ তুলে।
আদুরি আবার উঁ উঁ করে উঠল, বোধ হয় ব্যাথাটা আবার চাগাড় দিল।
রান্নাঘরের দিকে যেতে হঠাৎ ভূপতি আলোর ঘরে ঢুকল।
বাচ্চাগুলো নিশ্চল হয়ে গেল কলবন্ধ পুতুলের মতো। পড়তে বসেছে সকলে, পড়াচ্ছে শ্রীপতি। কিন্তু সবাই নির্বাক। অপলক চোখে তাকিয়ে রইল ভূপতির দিকে। সে বলে, লেখাপড়া শিখে কী হবে, শরীরে শক্তি চাই, সবাইকে মিলিটারিম্যান হতে হবে। কিন্তু ভূপতি এখন রাগেনি, সে বিভোর আপনাতে। মুখ তার হাসিতে বিস্ফারিত। শ্রীপতির কাছে গিয়ে তার কাটা ডানাটাকে একটু সুড়সুড়ি দিয়ে বলল, আচ্ছা বল, তোর ওই অমল কেলার্ক কী পাশ?
শ্রীপতি প্রশ্নটার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে একটু গর্বভরেই বলল, এম, এ পাশ।
কত টাকা মাইনে পায়? এক শশা।
ভূপতি তার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা দেখিয়ে বলল, এর টিপ সই দিয়ে আমি কত পাই?
শ্রীপতি নির্বাক। ভূপতি হা-হা করে হেসে উঠে বলল, তোর এম এ পাশ কেলার্কের ডবল, বুঝলি।… ভূপতির ব্যাটারা হবে এক একটা মেজর, ক্যাপটেন, ওসব কেরানি টেরানি নয়।
বলে সে ছেলেমেয়েগুলোকে বলল, চল সব, আমার সঙ্গে রুটি খাবি।
হয়তো আদরের আহ্বান এবং তাদের জীবনে হয়তো এই প্রথম। কিন্তু এ যেন যমের ডাক। তারা সবাই চলল রান্নাঘরের দিকে। শ্রীপতি স্তব্ধ হয়ে বসে রইল তার পোড়া মুখটা নিয়ে।
ভূপতি হাসতে হাসতে বকবক করতে করতে খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় আলোকে বলল, হেঁ হেঁ দেখো বউ, আজকে আমার মানটা রেখো।
শ্রীপতিকে বলল, চলরে জগন্নাথ, বাজারে যাবি প্যারেডের পরে।
আদুরির গলা বেড়ে উঠল, এবার আর অস্পষ্ট ন্য তার গালাগালি, উহা নয় কারও নাম। বিশেষ করে আলোর প্রতি সে ক্ষমাহীনা।
শ্রীপতি তার কাটা ডানাটা বাঁ হাতে চেপে তখনও তেমনি বসেছিল ঘরের কোণে আঁধারে। তার। অপলক চোখের দৃষ্টি রান্নাঘরের আলোর উপর। চোখে আবার তার সেই সংশয়, সেই ধন্দ।…এ সব কাটিয়ে সে বার বার পালিয়ে যেতে চেয়েছে এই মিলিটারি ডিপো থেকে। চলে যেতে চেয়েছে এই আওতা থেকে অঙ্গহীন শরীরটাকে নিয়ে তার ইনভ্যালিড জঞ্জালের লজ্জা নিয়ে।
কিন্তু পারেনি। তার ইনভ্যালিড জীবনে আর একটি বেদনা লুকিয়ে আছে মনের অন্ধ কোটরে। সে কখনও কাঁটার মতো ফোটে। কখনও দুলিয়ে দেয় অশান্ত দেওয়াল। ইস্! পোড়া মুখে তার একী গোপন স্বপ্নের ছায়া।…ন-টাকা যার সরকারি পেনশন, ঝাড়দারের ডেজিগনেশনে মেজরের আপিস বয়ের কাজ করে যে পায় কুড়ি টাকা মাইনে, সেই বিকলাঙ্গের মনে কেন মানুষের আকাঙক্ষা।
মনটা বুঝি মানে না বাইরের অঙ্গটাকে। সেটা যেন কারও খনি গর্ভের সোনা, কারও কয়লা।
বার বার সে ফিরে ফিরে তাকায় আলোর দিকে। আলো নয়, আলেয়া। আলেয়ার মায়ার কি কোনও শেষ নেই? আলো এসে ঢুকল ঘরে বাটিতে রুটি নিয়ে। ঘোমটা খানিক টেনে খসিয়ে ভ্রূ তুলে বলল, মাছ যে টোপ গিলে ফেলল।
গলার স্বরে চমকে যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল শ্রীপতি। বলল অ্যাঁ?
চাপা হাসি দুর্বার হয়ে উঠল আলোর মুখে। ভ্রূ কুঁচকে বলল, অ্যা নয়, আমি কি তোমার মাছ ধরা ছিপের ফাা যে অমন করে তাকিয়ে আছ?
এমনি থেকে থেকে একটা কথা বলে আলো। গলার ঝাঁজ আছে, কিন্তু সে ঝাঁজ যেন কীসের।
লজ্জায় যেন কুঁকড়ে যায় শ্রীপতি, একটা ঝাপসা রেখা ফোটে তার পোড়া গালে, অহেতুক নড়তে থাকে তার কাটা ডানাটা।
কেবলি কী দেখো অমন করে? আরও চেপে আসে আলোর গলা।
কী দেখে শ্রীপতি।…ছি সে কথা কি বলা যায়। সে যে বড় লজ্জার। ইনভ্যালিড সোলজারের সবদিকেরই লজ্জা। অবস্থায়, ব্যবস্থায়, সম্পর্কে, নিরুত্তর অপলক চোখে সে শুধু চেয়ে থাকে।
কিন্তু আলোর যে হাসি আপনি আসে, সে হাসি আপনি যেন কোথায় উধাও হয়ে যেতে চায়। চেষ্টা করেও ধরে রাখা যায় না। কালো মুখে দেখা দেয় আষাঢ়ের আভাস।…সে তাড়াতাড়ি রুটির বাটিটা রেখে চলে যেতে গিয়ে আবার দাঁড়ায়। কিন্তু শ্রীপতির দিকে ফেরে না। বলে আজ সন্ধেবেলা যেন কোথাও যেয়ো না।
কেন?
লোকজন খাবে যে।
তুমিই তো আছ?
আমি একলাই বুঝি অত লোককে খাওয়াব? অভিমান ফোটে আলোর গলায়।
বেশ, যা খুশি তাই করো। তোমাদের তো কিছু বলার নেই। বলে সে বেরিয়ে গেল।
শ্রীপতির মুখে এসে পড়েছিল, তোমার ভাসুরকে নালিশ করে দিয়ে। কিন্তু এত বড় কথা বলতে পারে না সে। তা ছাড়া আলোর ওই গলার স্বরই তো যত ধন্দ লাগায়। ওই মুখই এক বিচিত্র আসি নিয়ে তার দুর্দান্ত ভাসুরকে কী করে প্রশ্রয় দেয়। নাকি আলো প্রকৃতপক্ষে কোনও সর্বনাশের তল কেটে চলেছে।
.
প্যারেড শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ প্যারেড করাচ্ছে ভূপতি একলা। কোনও নায়েক বা হাবিলদার নেই। দীর্ঘ বাহিনীকে ভূপতি পরিচালনা করছে। অন্যান্য অফিসারেরা দেখছে। লেঃ কঃ কালীচরণ মিলার পাইপ কামড়ে ধরে দেখছে ভূপতিকে। তার কড়া গালের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে একটা প্রচ্ছন্ন হাসি। তার হাতে গড়া ভূপতি, একটুও হিমসিম খাওয়ার নাম নেই। ঘাস পোড়া মাঠে ধুলোর ঝড় ওঠে প্যারেডের ঢেউয়ে। কারখানা এলাকায় ভিড় করছে শ্রমিকরা। এখনও কাজের ঘণ্টা পড়েনি। তাই কেউ কেউ দূর থেকে দেখছে প্যারেড।
টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের মিলিটারি অফিসারেরা এখনও কেউ বেরোয়নি কোয়ার্টার ছেড়ে। তাদের নেই প্যারেডের দায়। ডিফেন্সের অফিসারদেরই শুধু হাজির থাকতে হয়।
আকাশ নীল। কুয়াশা নেই। কাঁচা রোদে তবু ঝলমল করে না ডিপো। সবখানে ছড়িয়ে আছে খাকি রং-এর ধূসরতা। ক্রেইন থেকে শুরু করে সারিবদ্ধ ট্রাক পর্যন্ত।
শ্রীপতি চলেছে ভূপতির পুরনো প্যান্ট আর শার্ট গায়ে দিয়ে ডানদিকে একটু বুকে। সে দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, প্যারেডের ওখানে মেজর রামচাঁদ কাপুর রয়েছে। ও-দিকে সে কখনওই পারতপক্ষে দেখে না। কোনও মিলিটারি অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না বেশিক্ষণ। কীসের নাকি গন্ধ লাগে তার নাকে। এই ব্যারাকের গন্ধও তার সয় না। তাই প্রায়ই তাকে ফাঁস ফ্যাঁস করতে দেখা যায়। ভুপতি তাকে মেরেও পারেনি রিবন্ পরাতে। শ্রীপতি ঢুকে পড়ল আপিস সংলগ্ন বাগানে। বাগানের মালী গোপালের সঙ্গে তার অদ্ভুত বন্ধুত্ব। বলে, গোপালদা সব কাজ সবাই পারে, তোমার মতো ফুল ফোটাতে পারে না কেউ। গোপাল তাকে কিঞ্চিৎ পাগল ভাবলেও সে খুশি।
গোপাল নরম রোদে পিঠ দিয়ে গোলাপ চারার সেবা করছে। শ্রীপতি তার কাছে এসে বসে পড়ল। কীসের যেন একটা উত্তেজনা রয়েছে তার মনে। একটা অদ্ভুত বৈরাগ্য ও আনন্দে ভরপুর। ঠোঁটে মিটমিট করছে হাসি। সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা গোপালদা।
বলো। কাজ করতে করতেই পোপাল জবাব দেয়।
সেই বারান্দার কাটা গোলাপ গাছটা তুমি জীইয়ে তুললে তো?
তা তো তুললামই।
ফুল ফুটেছিল?
গোপাল, একগাল হেসে বলল, বাঃ সেদিন বড় সাহেবের টেবিলে দেখোনি? এত বড় ফুল ফুটেছিল।
বড় সাহেব মানে কালীচরণ। শ্রীপতির আর কোনও জবাব না পেয়ে গোপাল ফিরল। দেখল শ্রীপতি আপন মনে মাটির দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ছে। সে জিজ্ঞেস করল, কী হল?
মুখ তুলতে দেখা গেল শ্রীপতির এক হাসি ও ব্যাথার বিচিত্র ভাব। বলল কিচ্ছু না।
কিছু না আবার কী? বলো না।
শ্রীপতি কাটা হাতটা বাঁ হাত দিয়ে খানিকক্ষণ ডলে ডলে হঠাৎ মুখ নামিয়ে বলল, আচ্ছা কাটা গাছে তো ফুল হয়। আমার…মানে, ধরো যদি কখনও ছেলেপুলে হয় তবে পুরো হাত-পাওলা হবে তো?
প্রশ্ন করেই তার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে জবাবের প্রত্যাশায়।
গোপাল হো-হো করে হেসে ওঠে। কেন হবে না? অন্ধের ছেলে কি অন্ধ হয়, না বোবার ছেলে কথা বলে না। মানুষ তো গাছ; একটা আধটা ডাল কাটলে কি তার ফল ধরে না? নাকি খুঁত ফল ধরে? বলে তার পর রহস্য করে বলে, কেন, বে করছ বুঝি?
বিয়ে? যেন পোড়া গালে থাবড়া খেল শ্রীপতি। তাড়াতাড়ি উঠে সে নুলো হাত নাড়াতে নাড়াতে আপিসের দিকে ছুটে গেল। না না ছি ছি…।
মেজরের চেম্বারের বাইরে টুলটায় সে দম আটকে বসে রইল। …ওইখানে সঙ্গিন নিয়ে সেপাইরা প্যারেড করছে, ওখানে সারি সারি ট্যাঙ্ক, এদিকে কাতার দেওয়া ট্রাক। কাছেই ওই বিরাট শেডটার মধ্যে কামান ঠাসা। ওই তার দাদা, বোকা ও নিষ্ঠুর ভূপতি উন্নতির উন্মাদনায় পাগল, আর সে একটা হাতকাটা ইনভ্যালিড সেপাই। এখানে বসে সে ভাববে বিয়ের কথা! তার আবার বিয়ে!…
তবু হায়রে মন, আলেয়ার কথা ভাবতে বুঝি তোর ভাল লাগে। প্যারেড শেষ। ওদিকে কারখানার হুইসল বেজে ওঠে।
মেজর রামচাঁদ কাপুর আসছে। শ্রীপতি উঠে তাড়াতাড়ি চেম্বারের দরজাটা বাঁ হাতে খুলে ধরে। মেজর ঢুকতেই আবার দরজা বন্ধ করে দেয়। লেঃ কঃ কালীচরণের পাশে পাশে নীরব হাসিতে হাঁ করে আসছে ভূপতি। যেন শিকারির পাশে পোষা গরিলা। কালীচরণকে এগিয়ে দিয়ে ভূপতি এসে ঢোকে মেজরের ঘরে। দেখে মনে হয় শ্রীপতিকে সে চেনেই না। একটু পরে আবার বেরিয়ে আসে। এসে শ্রীপতির সামনে দাঁড়াতেই তার মুখের হাসিটা চকিতে মিলিয়ে চোখ দুটো গোল হয়ে উঠল। জ্বর রেখাটা বেঁকে গিয়ে লকলক করে উঠল জিভটা। বলল, চল বাজারে।
শ্রীপতী ডানদিকে ঝুঁকে ঝুঁকে চলল পিছে পিছে। আপিসবাড়ির পিছনে নির্জনে এসেই ভূপতি আচমকা খপ করে শ্রীপতির শার্টের কলার চেপে ধরল।তুই সব অফিসারকে দাঁড়িয়ে সেলাম করিস, আমাকে করিস না কেন? শ্রীপতি অবাক। সে হাসবে কিনা বুঝতে পারল না। ঘৃণায় কুঁচকে উঠল তার ঠোঁট দুটো। ও-সব ভাই টাইয়ের খাতির নেই, বলে দিলাম। অফিসার তো অফিসার। আবার যদি কোনওদিন দেখি, একটা ঠেলা দিয়ে ছেড়ে দিল ভূপতি শ্রীপতিকে। যেন ফাঁসির আসামীকে মুক্তি দিয়ে আবার চলতে শুরু করল সে।
শ্রীপতির চোখে আগুন জ্বলে উঠল। যেন পারলে এখুনি ভুপতির মাথাটা সে ধুলোয় লুটিয়ে দেয়।
কিন্তু ভূপতির মুখে আবার হাসি, গলায় সেই গোঙানি। বলে, তুই ভাল মাংস চিনি? কচি পাঁঠা কিনতে হবে।…আর দ্যাখ ছিপে, তুই সন্ধেবেলা টুপিটা মাথায় দিয়ে গেটে দাঁড়াস, একটা খুব এস্টাইল হবে, হেঁ হেঁ।.. শ্রীপতি তার পোড়া মুখে এবার সত্যিই হেসে ফেলে।
.
এল সেই বহু প্রতীক্ষিত সন্ধ্যা। কিন্তু ভূপতির মাতন লেগে গেছে বিকাল থেকেই। সে কখনও দোপেঁয়াজি চাখছে, অতিথি সৎকারের পানীয়ের বোতলে চুমুক দিচ্ছে থেকে থেকে। হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসছে, সব বালাই কাটিয়ে ঢলে ঢলে পড়ছে আলোর গায়ে। আজ আর কোনও মানামানির নিষেধ মানতে রাজি নয় সে। বুঝি হাওয়া লেগেছে ঈশান কোণের কালো মেঘটায়। ঝড় আসছে। কখনও ভূপতি আদুরিরও গলা টিপে দিচ্ছে আর আলোর কাছে এসে বলছে, মানটা রেখো বউ, মাইরি। আমি তো আছি তোমার জন্যে হেঁ হেঁ!—এ মান রাখবার কথার মধ্যে এক সাংঘাতিক মতলব যেন পরিস্ফুট। তবু সংশয় কাটে না আলোর। সে সংশয় এতদিন ঘর করার গৃহস্থ মেয়ের সংশয়। সংশয় ভাসুরের বোকামি ও নিষ্ঠুরতার শেষ তলটুকু না জানার। সংশয় ভূপতির চোখে। আলো এখনও নির্বাক, তবু ঠোঁটে হাসি। সর্বনাশী আলেয়া। বুঝি মিথ্যা এ সংশয়ের বোঝা টানা।
ভূপতির মাতনের সুযোগে আদুরি প্রাণ খুলে দেওয়ালের দিকে ফিরে গালাগাল দিচ্ছে আলোকে। হে ভগবান, এত যন্ত্রণায় আদুরি যদিও বেঁচে থাকে, কুলটা আলোর মাথায় এখুনি বজ্রাঘাত করে তুমি ওকে মেরে ফেললো। আলো ফরসা কাপড় পরেছে। ছেলেমেয়েগুলোকে খাইয়ে একটা ঘরে বন্ধ করে দিয়েছে। সব গুছিয়ে গাছিয়ে সে প্রস্তুত। অতিথির প্রতীক্ষার আড়ে রইল সে চেয়ে শ্রীপতির ব্যথিত সন্ত্রস্ত মুখের দিকে।
.
অতিথিরা এল ঘোর সন্ধ্যায়। জমাদার, সুবেদার, ক্যাপটেন, মেজর, লেঃ কর্নেল। জুতোর মস মস খট খট শব্দে ভরে গেল কোয়ার্টারের ছোট আঙ্গিনা! বড় কম কথা নয়, লেঃ কর্নেল এসেছে।
কালীচরণের জন্যই তো এ ভোজসভা, সে-ই প্রধান অতিথি। অতিথি দেবতা। তার ভোগে অদেয় কিছুই নেই। পরিবেশনে লেগে যায় আলো, এগিয়ে দেয় শ্রীপতি। খাওয়ার শব্দ থেকে আস্তে আস্তে কথার খই ফোটে। তার পরে হাসির বন্যা। পেটে সকলের পানীয় পড়তেই কথা হাসির রংও পালটে যায়।…জিন্দাবাদ জমাদার ভূপতি। এখন আর কারও পদমর্যাদার বালাই নেই, তারা সবাই সমান। যাকে বলে, ডেমোক্রসি।
আলো অবাক হয়ে দেখল, কালীচরণও ভূপতির মতোই হা হা করে হাসে। হাসতে হাসতে কালীচরণ বলল, জিন্দাবাদ দোপেঁয়াজি। সে চোখের ইশারা করল আলোকে। অমনি ভূপতি আলোকে ঠেলে দিল কালীচরণের দিকে।
কালীচরণ চোখ টিপল জমাদার ভূপতিকে। বলল, নাই রান্না করেছে মাংসটি। হাত দাও, তোমার সঙ্গে শেক-হ্যান্ড করি। আলো তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এল। অমনি সবাই হা হা করে হেসে উঠল।
ভূপতিও বাইরে বেরিয়ে এল। মদে সে চুরচুর। বলল ফিসফিস করে, এবার সব চলে যাবে, খালি কর্নেল থাকবে মাইরি বউ, দেখো আমি দুদিনে ক্যাপটেন হয়ে যাব! হেঁ হেঁ…
বলে সে খাবার ঘরে গেল।
আলো দেখল কেউ নেই অন্ধকার উঠোনে। ছেলেমেয়েগুলো জানালা দিয়ে উঁকি মারছে ভীত চোখে, কিছুটা বা মজা দেখবার আশায়। আদুরি সেই ঘরের দরজার কাছে রয়েছে দাঁড়িয়ে। শ্রীপতি আশ্চর্যরকম নির্বিকারভাবে হাঁটুতে মাথা দিয়ে বসে আছে।
কিন্তু আলো আর সেই আলো নেই। কোথায় হাসি, রক্তও নেই তার ঠোঁটে। মিথ্যা আশা, রেহাই নেই ভূপতির মতলব থেকে। এখুনি কালীচরণ তাকে দুহাতে সাপটে গ্রাস করবে।
চকিতে সে শ্রীপতির কাছে গিয়ে এক মুহূর্ত কি ভেবে তার বাঁ হাতে ধরে টান দিল। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, শুনছ, চলো পালাই।
যেন ঘুমের ঘোর ভেঙে বলল শ্রীপতি, কেন?
কেন আবার কী! মরতে বলছ? গলায় তার ত্রাস ও কান্না।
এক মুহূর্ত থমকে থেকে কী বুঝল শ্রীপতি কে জানে। হঠাৎ ঝাড়াপাড়া দিয়ে উঠে বলল, চলো।
চকিতে দুটো তারার মতো তারা উঠোন পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। ডিপোর সীমা অনেকখানি। তাড়াতাড়ি পা চালাতে হবে।
সিপাইদের ক্লাবে চলছে হট্টগোল। অফিসারদের ক্লাবটা কিছু নীরব, আলো জ্বলছে নীল। কারখানা এলাকা এখন নিস্তব্ধ। চিমনির মাথায় মাথায় জ্বলছে লাল আলো, প্রহরীর রক্তচক্ষু।
ডানদিকে ঝুঁকে ঝুঁকে চলছে শ্রীপতি, তার গা ঘেঁষে রুদ্ধশ্বাসে আলো। চলছে না, পালাচ্ছে।
ডিপোর গেট পেরিয়ে শ্রীপতি জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?
পেছন দিকে একবার দেখে আলো শ্রীপতির হাতটা ধরে বলল, তোমার যেখানে খুশি। শ্রীপতির জ্বালাধরা চোখ ফেটে হঠাৎ গলগল করে জল বেরিয়ে পড়ল। নৃপতির কথা মনে পড়ছে তার। তার দাদা নৃপতি, যার বিধবা বউ আলো। নাঃ জীবনের কোনও ধন্দই বুঝি কাটবার নয়। মিলিটারি ডিপোটাকে পিছনে রেখে সে আলোকে নিয়ে পশ্চিমদিকে শহরের পথ ধরল।
.
অবাক মানল আদুরি। ভাবল হারামজাদী যায় কোথায়? সে ছুটে এসে দরজায় উঁকি মারল। দেখল শ্রীপতির সঙ্গে আলো হনহন করে চলেছে। জ্বলন্ত চোখে সেদিকে দেখে ক্রুর হাসিতে ভরে উঠল আদুরির মুখ। পালাচ্ছে, আদুরির ঘর ছেড়ে সর্বনাশী পালাচ্ছে।
এদিকে কালীচরণ ব্যতীত অন্যান্য অতিথিরা বেরিয়ে এল টলতে টলতে। আদুরি তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে সরে দাঁড়াল দরজা ছেড়ে। এলোমলো খটখট শব্দের অতিথিরা কেউ ভূপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে, কেউ নাটকীয়ভাবে চুম্বন করে বেরিয়ে গেল। তাদের পেছনে দরজাটায় খিল আটকে দিয়ে মত্ত ভূপতি দুহাতে জড়িয়ে ধরল আদুরিকে। বুকের কাছে চেপে ধরে আচ্ছন্ন করে দিল চুমোয় চুমোয়। জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, তোমাকে আমি আর ছাড়ব না। মাইরি বলছি বউ..
এক মুহূর্ত সিটিয়ে থেকে আদুরি হু হু করে কেঁদে উঠল নিঃশব্দে। বুঝল আলোর আদর অন্ধকারে চুরি করছে সে স্বামীর কাছ থেকে। তা হোক মিথ্যে করেও যে সে স্বামীর এমন আদর আর পায় না। মনে মনে বলল, আমার জীবনে যে কিছুই নেই। তুমি মিথ্যে করেই আমাকে প্রাণভরে ভালবাসো, এই আঁধারে যে ভাবে তোমার ইচ্ছা। ভূপতি বলল, যাও এবার ঘরে, কর্নেল মাইরি বসে আছে।
এবার আদুরি বেঁকে বসল। মাথা নাড়ল, কেঁদে ভাসাল ভূপতির বুক।
ভূপতি তাকে জোর করেই টেনে নিয়ে চলল, জড়ানো গলায় বিড়বিড় করতে করতে, এখন আর তা হয় না। তোমাকে সব দেব বউ, কিন্তু যেতেই হবে তোমাকে।
আলোর আদর চুরি করেছে, কিন্তু সর্বনাশকে সে পারবে না বরণ করতে।
এবার ভূপতির মাতলামির মধ্যে ক্ষিপ্ততা এসে মিশল। চকিতে আদুরিকে পাঁজাকোলা করে সে এনে বসিয়ে দিল কালীচরণের সামনে।
আদুরি ঘোমটা টেনে মাটিতে মুখ চেপে রইল। কালীচরণ হেসে উঠল হ্যাঁ হ্যাঁ করে।
কিন্তু আলোর মাঝে এসে ধ্বক করে উঠল ভূপতির বুকের মধ্যে। মরিয়া হয়ে সে আদুরির ঘোমটাটা টেনে খুলে ফেলেই একটা বিকট চিৎকার করে ঘর কাঁপিয়ে উঠোনে ছুটে এল। হাঁকল— বউ। কোনও উত্তর নেই। বুক চাপড়ে মাটিতে পদাঘাত করে উন্মত্ত গলায় হাঁকল, ছিপে!…
রাত্রি আটটার বিউগল বেজে উঠল পোঁ পোঁ করে।
নিঃশব্দ ছায়ার মতো লেঃ কঃ কালীচরণ সরে পড়ছে। ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে সে।
আদুরি হা হা করে কেঁদে উঠল গলা ছেড়ে।
আর অন্ধকার উঠোনে একটা ক্ষিপ্ত গরিলার মতো হাতের মুঠি পাকিয়ে ফুঁসে ফুঁসে উঠল ভূপতি—খুন করব…ওদের খুন করব। গুলি করব..
তবু বোধ হয় অসহ্য ক্রোধে কিম্বা যন্ত্রণাতেই তার জ্বলন্ত চোখে দেখা দিল নোনা গরম জলের ফোঁটা।