দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

ঈশানের বিষাণ বাজে

ঈশানের বিষাণ বাজে

শেষবেলায় খেলা। সারাদিনের উত্তাপে পৃথিবী যখন ক্লান্ত, প্রায় মুহ্যমান, তখনই শুরু হয়ে যায় ঈশানের আয়োজন। তামাটে নীল ক্রমশ কালো হতে-হতে হয়ে যায় সিঁদুর লাল। বাতাসের প্রশ্বাস কুম্ভকে স্তব্ধ। প্রকৃতিকে যারা চেনে তারা জানে, এইবার শুরু হবে রুদ্রের তাণ্ডব।

ধূসরপাংশুল মাঠ, ধেনুগণ ধায় ঊর্ধ্বমুখে

 ছুটে চলে চাষী।

ত্বরিতে নামায় পাল নদীপথে ত্রস্ত তরী যত

 তীরপ্রান্তে আসি।

পশ্চিমে বিচ্ছিন্ন মেঘ সায়াহ্নের পিঙ্গল আভাস

 রাঙাইছে আঁখি—

বিদ্যুৎ-বিদীর্ণ শূন্যে, ঝাঁকে-ঝাঁকে উড়ে চলে যায়

 উৎকণ্ঠিত পাখি।

এই ঈশানের কৃষ্ণকালো মেঘের গায়ে উড়ন্ত সাদা বকের সারি দেখে আলোর পথে এক বালক আনন্দে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। বালক গদাধর। পরে যিনি রামকৃষ্ণ নামে দক্ষিণেশ্বরে লীলা করেছিলেন। একটি শতাব্দীকে ধরে এমন নাড়া দিয়েছিলেন, ধর্মের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সেও এক কালবৈশাখী। জাতির,

বীণাতন্ত্রে হানো হানো খরতর ঝংকারঝঞ্ঝনা

তোলো উচ্চ সুর।

হৃদয় নির্দয়াঘাতে ঝর্ঝরিয়া ঝরিয়া পড়ুক

প্রবল প্রচুর।

সেই সুর আজও মেলায়নি। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ঝঞ্ঝার কাছে শক্তি ধার না করলে গ্লানির ছিন্নপত্র ঝরিয়ে উড়িয়ে জীবন-বৃক্ষকে নতুন পত্রোদগমের জন্য প্রস্তুত করা যায় না। শেলির মতো এই বিশাল প্রাকৃতিক শক্তিকে আবাহন জানিয়ে বলতে হয় :

Drive my dead thoughts over the universe

Like withered leaves, to quicken a new birth.

বিজ্ঞানীর শুকনো দৃষ্টিতে আকাশ জোড়া কালো মেঘ, বাতাসের খরশ্বাসের সহজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। সে অনেকটা দুই আর দুইয়ে চার হওয়ার মতো সরল ব্যাপার। সে দৃষ্টিতে রুদ্রের পিঙ্গল জটা-জালের উত্তোলিত নৃত্য নেই, শ্যামার শ্যাম অঙ্গের শোভা নেই, বিদ্যুতে নেই অধরোষ্ঠ চাপা শ্বেত দন্তপঙক্তির স্ফুরিত হাসি। এত বড় একটা ব্যাপারকে তাঁরা উত্তাপ, বায়ু-তরঙ্গ, ভ্যাকুয়াম, জলকণা, সব মিলিয়ে মিশিয়ে বলবেন, ও অমন হয়। কখনই বলবেন না :

The locks of the approaching storm. Thou dirge

Of the dying year, to which this closing night

Will be the dome of a vast sepulchre,

Vaulted with all thy congregated might.

দূরে কোথাও এখনও নিশ্চিন্দপুর গ্রাম আছে। নিশ্চিন্দপুর না থাক গ্রাম তো আছে। চৈত্রের চোষকাগজ যেখানে যত খাল বিল ডোবা ছিল সব শুষে নিয়েছে। শুকনো পায়ে-চলা পথে মধ্য দুপুরে বাতাসের লেত্তিতে ধুলোর লাট্টু ঘুরছে। ছায়ায় জিভ বের করে শীর্ণ কুকুর হাঁপাচ্ছে। ছাড়া গরু আর যেন পারে না চলতে। পাখি গান ভুলেছে। হাঁস মন-মরা। বাঁশের রোগা পাতায় ফিকে বাতাস জ্বরো রুগির নি:শ্বাসের মতো লেগে আছে। নিতাই ময়রা গুটি-গুটি বাতাসা পাড়ছে চেটাইয়ে। গুড় আর চিনির মিঠে গন্ধ গুমোট হয়ে আছে বাতাসে। ঘিনঘিনে মাছি ভান ভ্যান করছে ভেলিগুড়ের বস্তায়। হলুদ বোলতার ডানায় চৈত্রের রোদের ঝাঁঝালো রঙ। সুবলের চাকে ঘুরছে মেটে সিঁদুরে রঙের মাটির তাল। ভোলা কামারের হাপরে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস। সাদা-সাদা ছাই উড়ছে উনুনের চারপাশে। খঞ্জ বৈরাগী শুয়ে পড়েছে হাটতলায়। পাশে জেগে আছে তার লাঠি আর ঝুলি। এই গ্রামে ইন্দির ঠাকরুণ এখনও আছেন। ছেঁড়া মাদুর বগলে গ্রামের পথে টুকুর-টুকুর হাঁটছেন দিশাহারা বলদের মতো। সর্বজয়া তাঁকে ঘরছাড়া করেছেন। এই গ্রামে অপু আর দুর্গার বয়স কখনও বাড়ে না। ঘুরে-ঘুরে ফিরে আসে কাল বৈশাখী। সেই বর্ণনা একবারই লেখা হয়েছে চিরকালের জন্যে :

‘বৈকালের দিকটা হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার করিয়া কালবৈশাখীর ঝড় উঠিল। অনেকক্ষণ হইতে মেঘ-মেঘ করিতেছিল, তবুও ঝড়টা যেন খুব শীঘ্র আসিয়া পড়িল। অপুদের বাড়ির সামনে বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলো পাঁচিলের উপর হইতে ঝড়ের বেগে হাটিয়া ওধারে পড়াতে বাড়িটা যেন ফাঁকা-ফাঁকা দেখাইতে লাগিল। ধুলা, বাঁশপাতা, কাঁঠালপাতা, খড় চারিধার হইতে উড়িয়া তাহাদের উঠান ভরাইয়া ফেলিল। দুর্গা বাটির বাহির হইয়া আম কুড়াইবার জন্য দৌড়িল। অপুও দিদির পিছু-পিছু ছুটিল। দুর্গা ছুটিতে-ছুটিতে বলিল—শীগগির ছোট, তুই বরং সিঁদুরকৌটো তলায় থাক। আমি যাই সোনামুখী তলায়—দৌড়ো-দৌড়ো। ধুলায় চারিদিক ভরিয়া গিয়াছে—বড়-বড় গাছের ডাল ঝড়ে বাঁকিয়া গাছ নেড়া নেড়া দেখাইতেছে। গাছে-গাছে সোঁ-সোঁ, বোঁ-বোঁ শব্দে বাতাস বাধিতেছে—বাগানে শুকনা ডাল, কুটা, বাঁশের খোলা উড়িয়া পড়িতেছে। শুকনা বাঁশপাতা ছুঁচালো আগাটা উঁচুদিকে তুলিয়া ঘুরিতে-ঘুরিতে আকাশে উঠিতেছে—কুকশিমা গাছের শুঁয়ার মতো পালকওয়ালা সাদা-সাদা ফুল ঝড়ের মুখে কোথা হইতে অজস্র উড়িয়া আসিতেছে—বাতাসের শব্দে কান পাতা যায় না।’

গ্রামের শিশুর কাছে কালবৈশাখী মহানন্দের। শিশুর ভয় নেই। তার নবীন চোখে এই পৃথিবী বড় সুন্দর।

মধুর রূপে বিরাজ হে বিশ্বরাজ

শোভন সভা নিরখি মন প্রাণ ভুলে।।

বিশালের আয়োজন সে দু-হাতে কুড়িয়ে শেষ করতে পারে না। দু-চোখে দেখে ফুরোতে পারে না। যারা ঘরপোড়া গরু তারা সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয়ে মরে। গ্রামের কালবৈশাখীতে বাঁশপাতা ওড়ে, ডাল নুয়ে পড়ে। শহরের কালবৈশাখীতে ওড়ে দোকানের সাইনবোর্ড, টিনের চালা, ওড়ে টন-টন ধুলো। অপু-দুর্গার পায়ের কাছে সিঁদুর-কৌটো আম পড়ে না। উড়ে আসে প্রতিবেশীর তোয়ালে, প্লাস্টিকের মগ। স্কুল-ফেরত ছেলের হাত ধরে ছুটতে থাকেন শহুরে মা। উচ্চতল অফিসের শত-শত কর্মচারী বিষণ্ণমুখে তাকিয়ে থাকেন মেঘলেপা কালো আকাশের দিকে। থেকে-থেকে বিদ্যুতের ফাটল। ছুটির ঘণ্টা বাজার আগেই আকাশের ষড়যন্ত্র। এখুনি সব ওলটপালট হয়ে যাবে। গাছের ডাল ভেঙে পড়বে বৈদ্যুতিক তারে। বড়-বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নেমে অচল করে দেবে যানবাহন। ফুটপাথের ইন্দির ঠাকরুণ ছেঁড়া কাঁথা বগলে ছুটবেন টাউনহলের দিকে। ভেতরে দেশ স্বাধীন করার স্বদেশি কণ্ঠস্বর ঘুলঘুলি দিয়ে উড়ে চলে গেছে কোন কালে। মৃত ফাইলের স্তূপে নবভারত চাপা পড়ে আছে। বড়বাবুরা প্যান্টের পায়া গুটোচ্ছেন। প্রকৃতি নরম হলেই নামতে হবে নরকের অন্ধকার জলে। ভুসো রঙের আলোয় পড়ে আছে ওলটপালট গোলাপী শহর। লক্ষ পদযাত্রী ধাবমান গৃহতীর্থের দিকে। ট্রামের তার ছিঁড়েছে। দুর্গের মতো খাড়া অচল ডবল ডেকার। আবর্জনায় তটভূমিতে ছলকাচ্ছে বৃষ্টিপাতের কয়েক ইঞ্চি জল। মিছিলের বিপ্লবীরা নেতিয়ে পড়েছেন। নেতা ঠিক সময়ে সরে পড়েছেন ক্যাডিলাক চেপে। ফেস্টুন নিবে গিয়ে বাঁশের আগায় ঝুলছে। ব্যানারের আগুন খসে পড়ে গেছে। ময়দানের মেহগিনি তলায় প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে সহকারশাখার মতো। কিছু একগুঁয়ে প্রেমিক ইডেনের ভিজে কার্পেটে আবার জায়গা খুঁজছে। উচ্চপদস্থ কর্মচারী দশমতলে অফিস থেকে ফোনে গৃহিণীকে নির্দেশ দিচ্ছেন, খিচুড়ি পাকাও, জল একটু নামলেই আমি আসছি পোট্যাটো চিপস নিয়ে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তার মাথায় হাত। হল খালি। কবি আটকে পড়েছেন বারে। আকাশ দেখে তিনি বড় উতলা হয়েছিলেন। কানের কাছে টেনিসন কেবলই বলে চলেছেন,

TONIGHT the winds begin to rise

And roar from yonder dropping day :

The, last red leaf is whirled away.

The rooks are blown about the skies

Blow, Bugle, Blow

বেয়ারা, দিন বড় বেয়াড়া। নিয়ে এস, নিয়ে

এসো, আরও আন। আমার জীবনপাত্র ভরে

দাও কানায়-কানায়।

যদি ঝড়ের মেঘের মতো আমি ধাই চঞ্চল-অন্তর

তবে দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে ঈশ্বর।।

সাহিত্যিক সেজেগুজে বেরুচ্ছিলেন। ঝড় দেখে বসে পড়েছেন বৈঠকখানায়। বাতাসের দমকে জানলা দরজা কাঁপছে। ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাস ঢুকছে বাঁশির সুরে। বাড়ির পেছন দিকটা কমজুরি। ঝড়ের দমকে ঝুলে না যায়। আশি বছরের বৃদ্ধা মা পক্ষাঘাতে পড়ে আছেন ওই দিকের ঘরে। ঝড়ের প্রথম দমকেই বিদ্যুৎ চলে গেছে কাঁপতে-কাঁপতে। এক এক ঝটকা আসছে আর গুঁড়ো-গুঁড়ো খসে পড়ছে চুন-বালি। হাল আমলের উপন্যাসের রাঁধুনীর মতো। যুবক পুত্রের রোমান্টিক হবার বয়েস। ফুরফুরে চুল, কেয়ারি গোঁফ। আকাশে মেঘের পিঙ্গল ঘুরপাক দেখে মনে প্রকৃতি ঢুকে গেছে। সে আর ঘরে নেই। বয়সা লাগা গলায় আবৃত্তি করছে :

ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে

জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে

ঘন গৌরবে নবযৌবনা বরষা

শ্যামগম্ভীর সরসা।

মেক-আপ নিয়ে বসে আছেন সখের থিয়েটারের পাত্র-পাত্রীরা। প্রেক্ষা-গৃহে কাকভেজা হয়ে বসে আছেন মাত্র সাতজন দর্শক। হল শূন্য। কার্টেন কাঁপছে ঝড়ের দাপটে। চরিত্ররা প্রস্তুত। জীবনের সুখদু:খ হাসিকান্না অক্ষরের বুকে ছটফট করছে অবয়ব পাবার জন্যে; কিন্তু দর্শক কোথায়! সব বুঝি মাঠে মারা যায়। সাড়ে নটার মধ্যে হল ছাড়তে হবে সাড়ে সাতটা বেজে গেল।

এইমাত্র মারা গেলেন জীবনযুদ্ধের ক্ষতবিক্ষত সৈনিক, রামলাল ব্যানার্জি লেনের পরোপকারী চরিত্র মাখনলাল গুপ্ত। তাঁর শেষ নি:শ্বাস ঝড়ের বেগে উড়ে গেল পশ্চিম থেকে পূবে, সূর্যোদয়ের আকাশের দিকে। বুকের ওপর ভেঙে পড়েছেন পোড়খাওয়া স্ত্রী। কব্জা-ভাঙা খড়খড়ি জানালা খুলে পড়েছে। ঝড়ের দাপটে বুক চাপড়াচ্ছে। মসীবর্ণ আকাশ দুলছে ভাঙা গরাদের চালচিত্রে। বড় ছেলে চোখের জল চাপতে-চাপতে ভাবছে, মৃত্যুর কি আর সময় ছিল না।

নিমতলায় জ্বলছিল নবীনার চিতা। দমকা বাতাস আর বৃষ্টির দাপটে চিতা নিবে গেছে। গলগল করে ধোঁয়া উঠছে। কিশোর ছেলেটি উবু হয়ে বসে আছে বিস্ফারিত চোখে। সবাই সরে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। সিগারেট ঘুরছে হাতে-হাতে। কেউ-কেউ বলছেন, ঝড়টা বড় বিশ্রী সময়ে এসে গেল। অভিজ্ঞ বলছেন, আমি জানতুম আসবে, যা গুমোট করেছিল। কেউ বলছেন, এক ভাঁড় চা পেলে মন্দ হত না। একজন বললেন, ছেলেটা ভিজছে ওকে উঠে আসতে বলো না।

মায়ের অর্ধদগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে সে বসে আছে। ঝড়ে চুল উড়ছে, বৃষ্টি-ভেজা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। তবু সে বসে আছে। মনের কালবৈশাখীর কাছে হার মেনেছে প্রকৃতির কালবৈশাখী।

হাসপাতালে বৃদ্ধ স্বামীকে দেখতে এসেছিলেন বৃদ্ধা। চওড়া লালপাড় শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছেন পথের পাশে অন্ধকার বটতলায়। হাতে একটি কাপড়ের ঝুলি। দুটি মুসোম্বি কিনেছিলেন বুড়োর জন্যে। হাতের রুলিটি বাঁধা পড়েছে পাড়ার বন্ধকী কারবারের দোকানে। অন্ধকার জল সপসপে রাজপথ সামনে পড়ে আছে। মানুষজন নেই। রাস্তার ধারে-ধারে জমা জল ক্রমশই ওপরে উঠছে। আবর্জনা ভেসে চলেছে ঘুরে-ঘুরে। বৃদ্ধা ভিজছেন। একা-একা যেতে হবে অনেক দূর। বিদ্যুতের নীল চেরা চোখ থেকে-থেকে খুলছে আর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

মর্গে এসেছেন বিভ্রান্ত পিতা। মেয়ে আত্মহত্যা করেছে গোপন ব্যথায়। ভাবছেন এই দুর্যোগের রাতে দাঁতাল শূকরের মতো শহরে এখন কোথায় পাবেন একটি টেম্পো। সঙ্গে এনেছেন একটি ডুরে শাড়ি। গত পুজোয় বিস্তর পছন্দ করে কিনেছিলেন। শেষ যাত্রায় জড়িয়ে দেবেন মেয়ের সেলাই করা শরীরে।

ঝড় এলে কি হবে জীবনের ঘটনা তো থেমে থাকবে না। গৃহ-শিক্ষক প্রথম ছাত্রীর বাড়ি সেরে ছাতাটি খুলে পথে নামার সঙ্গে-সঙ্গেই শিক উলটে গেল। আবার ফিরে এলেন তালগোল পাকিয়ে। বৈঠকখানায় টি ভি চলছে। ঝড়ে অ্যান্টেনা মচকে গেছে। পর্দায় ছবির যেন পালা জ্বর হয়েছে। সর্ব শরীর কাঁপছে। সংবাদ-পাঠক সানন্দে জানাচ্ছেন, ঝড় আর তুমুল বৃষ্টিতে শহর অচল হয়ে পড়েছে। ঘণ্টায় আশি কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে গেছে। টেম্পারেচার নেমে গেছে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ময়দানে দুটো বড় গাছ উলটে পড়েছে। পাঁচিল চাপা পড়ে দুটি শিশুর জীবনাবসান। বিশ বছর আগে হলে বেতারে ঘন-ঘন শোনা যেত নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে। এখন টেপের যুগ। অনুষ্ঠান নির্ধারিত সূচিতেই চলবে।

নতুন বউ আধুনিক সংসারের চারতলার ফ্ল্যাটে গান ধরেছে—

 পাগল হাওয়ার বাদল দিনে

 পাগলা আমার মন জেগে ওঠে।।

কান পড়ে আছে দরজার দিকে। কখন সে আসবে। ভিজে মোজা, পাউরুটি জুতো। এই শহরের বিপ্লবীরা ছাতা বহন করাকে কাপুরুষতা মনে করে। কলেজের মেয়েরা মাথার ওপর পেনসিল উঁচিয়ে বৃষ্টি শাসন করে। এসেই বলবে, গরম জল, জীবাণুনাশক লোশান। পায়ের এক পর্দা খোলস তুলতে হবে। যে জলে পা পড়েছে। চর্মরোগ হল বলে। তারপরেই বলবে, আদা দিয়ে এক কাপ গরম চা। এক ডজন হেঁচেই বলবে, অ্যান্টি অ্যালারজিক ট্যাবলেট।

ট্রেনের হাই টেনশান ছিঁড়ে একের পর এক ট্রেন বাতিল। শেয়ালদায় লক্ষ লোকের গুঁতোগুঁতি। হালিশহরের আটচালায় বৃদ্ধা মা চৌকিতে শুয়ে-শুয়ে বারে-বারে প্রশ্ন করছেন—হ্যাঁ, বউমা খোকা ফিরেছে। পাশে শুয়ে চার বছরের নাতি। মুখে আলো পড়েছে, যেন সদ্য-ফোটা পদ্ম।

খেটে-খাওয়া মানুষ যাদের রোজই পথে নামতে হয় রুজিরোজগারের তাগিদে তাদের কাছে কালবৈশাখী এক প্রাকৃতিক যন্ত্রণা। একদিন শুরু হলেই ধাতে ধরে যায়। রোজই আসতে থাকে পর-পর কয়েকদিন। দুপুর গড়িয়ে গেলেই গলা ধরার মতো আকাশ ধরে আসে। বে-এক্তার হয়ে পড়ে দোর্দণ্ড সূর্য। আকাশে পড়তে থাকে পোঁচের পর পোঁচ মেঘ। কেউ তখন গায় না,

মেঘের পর মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।

আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা ঘরের পাশে।।

ঘড়ি দেখার মতো সবাই তখন আকাশ দেখতে থাকে। কালবৈশাখী ঘরের পাশে বসায় না। বসায় অনেক দূরে পথের পাশে। গাড়ি বারান্দার তলায়, অচেনা বাড়ির প্যাসেজে। দাঁড় করিয়ে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শুরুতেই দিনের তাপমাত্রা নেমে যায়। হঠাৎ ধেয়ে আসে তীব্র বাতাস। ধুলোর রাজপথ সোজা উঠে যায় আকাশের দিকে। নিমেষেই লণ্ডভণ্ড। জানলা পড়ছে, দরজা পড়ছে, দোকানের ঝাঁপ খুলে পড়ছে। ত্রিপল উড়ে চলেছে যাদু কার্পেটের মতো। নটরাজের জটার বাঁধন খুলে যায়। প্রকৃতিকে তখন আর মমতাময়ী ধাত্রী বলে মনে হয় না। তখন তার সংহার মূর্তি।

আনন্দে আতঙ্কে মিশি, ক্রন্দনে উল্লাসে গরজিয়া

মত্ত হাহারবে

ঝঞ্ঝার মঞ্জীর বাঁধি উন্মাদিনী কালবৈশাখীর

নৃত্য হোক তবে!

ঘণ্টা দুয়েকের মতো সব কিছু অচল। মেঘের আড়ালে-আড়ালে সূর্যের অগ্রিম অস্তাচল। সন্ধ্যার আগেই দীপের সন্ধান। সারা চৈত্রের খড়কুটোর সাধনা কাকের নিভৃত বাসা গাছের ডাল থেকে খসে পড়েছে। ভীত টুনটুনি আশ্রয় চাইছে গৃহস্থের বৈঠকখানায়। উদ্দাম, অফুরন্ত বাতাসের আয়োজন। বিমান উড়তে গিয়েও বন্দরের দৌড়পথের একপাশে ভয়ে জড়োসড়ো। জাহাজ ভোঁ দিয়েছিল, নোঙর আর তোলা হয়নি। দেবালয়ে আরতির ঘণ্টাধ্বনি বড় ম্লান। ভৈরব আজ নিজের পূজার আয়োজন নিজেই করে নিয়েছেন। বছরের প্রথম বৃষ্টির উপরি পাওনা শিল। টিনের চালে, ছাদের আলসেতে ছররার মতো শিলাখণ্ড নাচছে। শিশুদের উল্লাস। গৃহবন্দী মহিলারা বয়েস ভুলে, এই একটা, এই আর একটা বলে খোলা বারান্দায় নৃত্য করছেন।

মহা সমারোহে মহারাজ চলে গেলেন তাঁর গজযুথ নিয়ে। বৃষ্টির বিশালধারা ক্রমশ ফিনকি হয়ে মিলিয়ে গেল। গাছের পাতা থেকে ধুয়ে গেল সারা বছরের জমা ক্লেদ। আগামী প্রভাত সূর্যের জন্যে অপেক্ষা করে রইল সবুজ অভ্যর্থনা। ছোট্ট পাখি ঘুম ভেঙে মাকে প্রশ্ন করলে, কি হল মা? মা বললে, এই তোর জীবনের প্রথম ঝড়। ডানা শক্ত কর বাছা। বাতাসের পাল্লা নিতে হবে।

একালের কাব্য, সাহিত্যে কালবৈশাখী অনুপস্থিত। প্রকৃতির ঝড় এখন মানুষের মনের আকাশে স্থান নিয়েছে। যেমন চিতা চলে এসেছে চিন্তায়। ফাঁক-ফোকরে দামাল বাতাস। পাঞ্চজন্য শঙ্খের ধ্বনি—যুদ্ধ কর, যুদ্ধ কর, জীবন যুদ্ধ।

অকৃপণ শক্তিতে সে হঠাৎ আসে, হঠাৎ চলে যায়। মাঝ রাতে আকাশের স্লেট পরিষ্কার। আবার তারার টিপ বিশাল ললাটে। ভ্রূমধ্যে বাঁকা চাঁদ। বাতাসের আবার দখিনা চলন। সবই আবার ফিরে এসেছে। প্রিয়জন পথ থেকে ঘরে। শয্যার আলিঙ্গন। সুপ্ত শিশু। জাগ্রত রুগি।

নবাঙ্কুর ইক্ষুবনে এখনও ঝরিছে বৃষ্টিধারা
 বিশ্রামবিহীন,
মেঘের অন্তর-পথে অন্ধকার হতে অন্ধকারে
 চলে গেল দিন।
শান্ত ঝড়ে, ঝিল্লিরবে, ধরণীর স্নিগ্ধ গন্ধোচ্ছ্বাসে
 মুক্তবাতায়নে
বৎসরের শেষ গান সাঙ্গ করি দিনু অঞ্জলিয়া
 নিশীথগগনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *